মাজরুহ সুলতানপুরী | উর্দু কবি, গীতিকার

মাজরুহ সুলতানপুরী নামে বেশি পরিচিত হলেও তার আসল নাম আসরার উল হাসান খান। তিনি হিন্দি (হিন্দুস্থানি) চলচ্চিত্র শিল্পে গীতিকার হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তবে আসলে তিনি উর্দু কবি ছিলেন। মাজরুহ ভারতের তারকা গীতিকারদের একজন। তিনি গীতিকার হিসেবে হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে অংখ্য কালজয়ী গান উপহার দিয়েছেন।

 

মাজরুহ সুলতানপুরী

 

মাজরুহ সুলতানপুরীর ভারতের চলচ্চিত্রের জগতে আসেন পঞ্চাশের দশকের শুরুতে। ১৯৫০ এবং ১৯৬০ দশকে ভারতীয় চলচ্চিত্রে তিনি খুবই প্রভাবশালী সঙ্গীতকার ছিলেন। গীতিকার পেশার পাশাপাশি, তিনি প্রগতিশীল লেখক আন্দোলনের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। মজরুহ কে বিংশ শতাব্দীর উর্দু সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

[ মাজরুহ সুলতানপুরী [ কবি, গীতিকার ] ]

ছয় দশকের কর্মজীবনে মজরুহ অনেক বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালকের সাথে কাজ করেছেন। ১৯৬৪ সালে মুক্তি পাওয়া “দোস্তি” নামের ছায়াছবিতে, “চাহুঙ্গা ম্যায় তুঝে” গানটি লেখার কারণে তাকে “ফিল্মফেয়ার সেরা গীতিকার পুরস্কার” দেয়া হয়। তার অবদানের জন্য তাকে ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার “দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার” দেয়া হয় ১৯৯৩ সালে। আশি ও নব্বই এর দশকে, তার বেশিরভাগ কাজ করেন সঙ্গীত পরিচালক আনন্দ-মিলিন্দের সাথে। আনন্দ-মিলিন্দের তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ হল “কেয়ামত সে কেয়ামত তক”, “লাল দুপাট্টা মালমাল কা”, “লাভ”, “কুরবান” এবং “দাহেক”।

 

মাজরুহ সুলতানপুরী

 

মজরুহ শুধুমাত্র নতুন আঙ্গীকের সাহিত্যই উপহার দেননি, তিনি হিন্দি ছবিকে অনেক গুলো নতুন শব্দ উপহার দিয়েছেন, যা পরবর্তিতে ট্রেন্ড হয়েছে। যেমন সনম, জনম ধরণের শব্দগুলো।

মজরুহ সঙ্গীত পরিচালক জুটি যতীন-ললিত লিখেছেন জো জিতা ওহি সিকান্দার (“পেহলা নাশা” গান সহ), যা পরবর্তিতে  ক্লাসিক হয়েছে বলা যায় । যতীন-ললিত এর প্রথম চলচ্চিত্র ইয়ারা দিলদারা (“বিন তেরে সানাম” গানটি সহ) সিনেমার জন্যও লিখেছিলেন মজরুল, যেটি ভারতীয় সঙ্গীতের এয়ারওয়েভে আজ অবধি শোনা যায়।

মাজরুহ সুলতানপুরী উত্তরপ্রদেশের সুলতানপুরে একটি রাজপুত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পরে নাম দেয়া হয় আসরার উল হাসান খান। তার বাবা পুলিশ বিভাগে কর্মরত ছিলেন। একজন পুলিশ অফিসার হয়েও তিনি ছিলেন ভীষণ রক্ষণশীল। তাই ছেলেকে ইংরেজি পড়াতে তার খুব একটা আগ্রহ ছিলা না। এজন্যই মাজরুহকে তিনি ঐতিহ্যবাহী ‘মাদ্রাসা শিক্ষা’র জন্য পাঠন। মজরুল সেখানে সাত বছর লেখাপড়া করেন এবং প্রথম “দরস-ই-নিজামী” অর্জন করেন। সেখান থেকেই তার আরবি ও ফারসি ভাষায় দক্ষতা তৈরি হয়। তিনি আলিম শেষ করে লখনউয়ের তাকমীল-উত-তিব কলেজ অফ ইউনানি মেডিসিনে (গ্রীক পদ্ধতি অব মেডিসিন) ভর্তি হন।

 

মাজরুহ সুলতানপুরী

 

মাদ্রাসায় লেখাপড়ার সময়ে তাকে কবিতার নেশা পেয়ে বসে। তাই লেখাপড়ার পাশাপাশি শের-শায়েরীর চর্চা চলছিল। হাকিমির পাশাপাশি সুলতানপুরে তিনি মুশায়রায় যাতায়াত শুরু করেন। একদিন তার একটি গজল খুবই প্রশংসিত হয়। শ্রোতাদের প্রসংসা মজরুহ কে মুশায়রাতে আরও নিয়মিত করে। আর মুশায়রাতে পড়ার প্রয়োজনে লেখার গুরুত্বও বাড়তে থাকে। লেখালেখি আর হাকিমির মধ্যে কাশমাকাশ চলছিলই। এক পর্যায়ে কবি হেকিমি ছেড়ে দিয়ে তার প্রেম “শায়েরি”র হাত ধরার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর তার গুরুত্ব সহকারে কবিতা লিখার যুগ শুরু হয়। কিন্তু উর্দু শায়েরিতে অগ্রসর হবার জন্য ওস্তাদের সহবত জরুরী। তিনি ওস্তাদের সন্ধানে একসময় উর্দু মুশাইরাসে তৎকালীন শীর্ষ নাম জিগার মোরাদাবাদীর দারস্থ হন। জিগার মোরাদাবাদী তাকে শিষ্য করে নিন। মজরুল চলচ্চিত্র গীতিকার হিসাবে জনপ্রিয় হলেও উর্দু কবিতার অন্যতম সেরা শ্লোকও তৈরি করেছিলেন:

“ম্যায় আকেলা হি চালা থা জানিবে মঞ্জিল মাগর,
লগ সাথ আতে গয়ে অর কারভান বান্তা গেল!”
(আমি একাই গন্তব্যের দিকে রওনা হলাম,
কিন্তু লোকেরা যোগ দিল এবং শীঘ্রই এটি একটি কাফেলা হয়ে গেল!)

১৯৪৫ সালে মাজরুহ “সাবু সিদ্দিক ইন্সটিটিউটে” একটি মুশায়রায় যোগ দিতে বোম্বে যান। এখানে তার গজল ও কবিতা শ্রোতাদের কাছে প্রশংসিত হয়। মুগ্ধ শ্রোতাদের একজন ছিলেন চলচ্চিত্র প্রযোজক এ.আর. কারদার। তিনি মুশায়রা শেষে জিগার মোরাদাবাদীর সাথে যোগাযোগ করেন মাজরুহের সাথে আলাপ করিয়ে দিতে। উদ্দেশ্য ছিল মজরুহ কে দিয়ে চলচ্চিত্রের গান লিখানো।

 

মাজরুহ সুলতানপুরী

 

এ.আর. কারদার যখন মাজরুহ কে চলচ্চিত্রের জন্য গান লিখতে অনুরোধ করেন, তখন কিছু না ভেবেই মজরুহ অস্বীকার করে। এরপর এ. আর. কারদার আবার জিগার মোরাদাবাদির দ্বারস্থ হন। তখন ওস্তাদ শিষ্যকে রাজি করিয়েছিলেন এই বলে যে – শায়েরি তো পয়সা দেবে না, আর ঘর সংসারের জন্য পয়সা দরকার। আর চলচ্চিত্রের জন্য লেখা তাকে ভাল অর্থ দেবে। তাই চলচ্চিত্র থেকে আয় করো, আর কবিতার জন্য কবিতা করো।

মাজরুহ রাজি হবার পরে কারদার তাকে সঙ্গীত পরিচালক নওশাদের কাছে নিয়ে যান। কারদার নওশাদকে বলে তরুণ লেখককে বাজিয়ে দেখতে। নওশাদ মাজরুহকে একটি সুর দিয়ে সেই মিটারে কিছু লিখে দিতে বলেন। তখনই মাজরুহ লেখেন “উসনে গেসু বিখরায়ে, বাদল আয়ে ঘুম কে”। নওশাদের খুবই পছন্দ হয় এবং এক ইতিহাসের সূচনা হয়। এরপর মাজরুহ শাহ জাহান চলচ্চিত্রের গীতিকার হিসাবে চুক্তিবদ্ধ করা হন। ১৯৪৬ সালে রিলিজ পাওয়া সেই ছবির গানগুলি হৈচৈ ফেলে দেয়। দারুণ ব্যবসা করে সেই ছবি। গান এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে গায়ক কে.এল. সায়গাল চেয়েছিলেন তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় “জব দিল হি টুট গায়া” গানটি বাজানো হোক।

 

গ্যালারী:

 

আরও পড়ুন:

https://youtu.be/oCnjWyi9An0

 

Comments are closed.