আজকের আলোচনার বিষয় আবদুল্লাহ আল-মামুনের কোকিলারা: যৌন-রাজনীতি ও নিম্নবর্গীয় নারীর এক চিরায়ত আখ্যান সম্পর্কে |
আবদুল্লাহ আল-মামুনের কোকিলারা: যৌন-রাজনীতি ও নিম্নবর্গীয় নারীর এক চিরায়ত আখ্যান
ভূমিকা
আবদুল্লাহ আল-মামুন রচিত কোকিলারা নাটকে মূলত কোকিলা নামক তিন জন নারীর গল্প বলা হয়েছে যারা একত্রে হয়ে উঠেছেন কোকিলারা। তিন জন নারীর জীবনের গল্প নিয়ে রচিত এই নাটকটি তিনটি আলাদা গল্পের মিশ্রণ হলেও এই তিন জন কোকিলা মিলেই যেমন হয়ে উঠেছেন ‘কোকিলারাত তেমনিভাবে পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে এই তিন জন নারীর নির্যাতনের গল্পটাও প্রায় একই। এই কোকিলারা সকলেই নারী হয়ে জন্মেছেন, এই কোকিলারা সকলেই এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী হয়েই বেড়ে উঠেছেন এবং শেষ পর্যন্ত নারী হয়ে বেড়ে ওঠা এই কোকিলারা তাদের না-বলা কথাগুলো নিয়েই হারিয়ে গেছেন।
নাট্যকার বলেছেন তিনি কোকিলারা নাটকে একজন সাধারণ, একজন খুব সাধারণ আর একজন অসাধারণ কোকিলার গল্প বলেছেন যাদের নাম যথাক্রমে প্রথম কোকিলা, দ্বিতীয় কোকিলা ও তৃতীয় কোকিলা কিন্তু আসলে কি শেষ পর্যন্ত কোকিলারা নাটকের কোকিলারা কিছু বলতে পেরেছে? কোকিলাদের বলা কথা আসলে কি আমরা কখনও শুনতে পাই কিংবা পেয়েছি? আলোচ্য গবেষণা প্রবন্ধটির মাধ্যমে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে।
গবেষণার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
আবদুল্লাহ আল-মামুন বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য নাট্যকার। কোকিলারা নাটকটি তাঁর রচিত নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং বাংলাদেশের একক নারী চরিত্রের নাটকের ইতিহাসে একটি দর্শক নন্দিত নাটক। সেক্ষেত্রে এই নাটকে কিভাবে নারীকে উপস্থাপন করা হয়েছে এর উপর গবেষণা করাটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ফলে এই গবেষণা প্রবন্ধটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো কোকিলারা নাটকে কিভাবে নারীকে উপস্থাপন করা হয়েছে তার অনুসন্ধান করা।
গবেষণার গুরুত্ব
কোকিলারা নাটকের মাধ্যমে যে তথ্য দর্শকের কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে তা কিভাবে দর্শকের ধারণাকে প্রভাবিত করে তা জানার প্রয়োজন আছে। এই গবেষণায় সাহিত্য পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা যায় যে, কোকিলারা নাটক নিয়ে নারী বিষয়ক যে সকল গবেষণা পূর্বে পরিচালিত হয়েছে সেখানে নারীর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হয়ে থাকলেও কেট মিলেট-এর “Sexual Politics (যৌন-রাজনীতি)” ও গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক-এর “Can the Subaltern Speak? (নিম্নবর্গ কি কথা বলতে পারে?)” এই ধারণার আলোকে নারী যে নিম্নবর্গ হবার ফলে তাঁর কণ্ঠস্বর আমাদের কাছে পৌঁছায় না এই বিষয়টি নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি।
ফলে বাংলা নাটকে নারীকে কিভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে তা জানার জন্য পূর্ণাঙ্গ গবেষণার প্রয়োজন আছে। তাই আবদুল্লাহ আল-মামুন রচিত একক অভিনয়ের নাটক কোকিলারা নাটকে কিভাবে নারীকে উপস্থাপন করা হচ্ছে তার অনুসন্ধানের জন্য পরিচালিত এই গবেষণা-কৰ্মটি বর্তমান সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ।
গবেষণা পদ্ধতি
এই গবেষণাটি মূলত গুণগত পদ্ধতির গবেষণা। এখানে বিশ্লেষণ ও বর্ণনামূলক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। গবেষণার মৌলিক উৎস আবদুল্লাহ আল-মামুন রচিত কোকিলারা নাটকের পাণ্ডুলিপি।
তাত্ত্বিক কাঠামো
এই গবেষণা প্রবন্ধের ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক কাঠামো হিসেবে কেট মিলেট প্রদত্ত “Sexual Politics (যৌন- রাজনীতি)” ও গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক-এর “Can the Subaltern Speak? (নিম্নবর্গ কি কথা বলতে পারে?)” ধারণা প্রয়োগ করে কোকিলারা নাটকটিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
গবেষণা সীমাবদ্ধতা
এই গবেষণা প্রবন্ধের সীমাবদ্ধতা হলো আবদুল্লাহ আল-মামুনের একাধিক নাটকের কেন্দ্রিয় চরিত্র নারী হলেও শুধু একটি নাটকের আলোকে এখানে ব্যাখা করা হয়েছে এবং নারীবাদী বিভিন্ন তত্ত্বের মধ্যে থেকে কেবল কেট মিলেট ও গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক-এর তত্ত্বের উপরেই নির্ভর করা হয়েছে অন্য কোনো নারীবাদী লেখকের তত্ত্বের উপর নয়।
কোকিলারা নাটকে যে আধিপত্য প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে সেই আধিপত্য হলো নারীর উপর প্রয়োগ করা চির চেনা পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য। নারীর উপর পুরুষের এই আধিপত্য প্রকাশের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো নারীর শরীর।
কেট মিলেট-এর যৌন-রাজনীতিতত্ত্বে পুরুষ আধিপত্যের আটটি ক্ষেত্র উল্লেখ করে তিনি দেখান যে, কিভাবে যৌনতাও একটা রাজনীতি এবং ক্ষমতা প্রকাশের মাধ্যম হয়ে উঠেছে। পুরুষ তার ক্ষমতা ও আধিপত্য প্রয়োগ করে নারীর উপর এবং যৌনতা সম্পূর্ণভাবে রাজনীতির সাথে জড়িত। “The term politics shall refer to power structured relationship, arrangements whereby one group of person is controlled by another.” politics = struggle for power. রাজনীতির মূল হলো ক্ষমতা। তাই নারী-পুরুষের মধ্যকার সম্পর্ক হলো সর্বদাই ক্ষমতার সম্পর্ক।
এই নাটকে প্রথম কোকিলাকে বিয়ে করার কথা বলে আনোয়ার নামের চরিত্রটি যে যৌননিপীড়ন করেছে সেটাও পুরুষ কর্তৃক প্রয়োগ করা ক্ষমতারই বহিঃপ্রকাশ। কেট মিলেট এর তত্ত্ব অনুযায়ী নারীর উপর প্রয়োগকৃত পুরুষের আধিপত্যের আটটি ধাপ হলো-
১. Ideological (ভাবাদর্শিক),
২. Biological(জৈবিক),
৩. Sociological (সমাজতাত্ত্বিক ),
8 Class (শ্রেণি),
৫. Economic and Educational (অর্থ ও শিক্ষা),
৬. Force (বল প্রয়োগ),
৭. Anthropological: Myth and Religion (নৃতাত্ত্বিক: পুরাণ ও ধর্ম)
৮. Psychological (মনস্তাত্ত্বিক)।
১. Ideological (ভাবাদর্শিক )
কেট মিলেট বলতে চান, কোনো দেশে সরকার যেমন ক্ষমতা দখল করে হয় সম্মতি আদায়ের মধ্যে দিয়ে অথবা জোর করে এবং তা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তেমনি নারীর উপর পুরুষের ক্ষমতার প্রয়োগের ক্ষেত্রেও একটা সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে তা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় এবং নারী, পুরুষ উভয়ই তাতে সম্মতি প্রদান করে। সিমোন দ্যা বুভ্যেয়ার যেমন বলেছিলেন, কেউ নারী হয়ে জন্মায় না নারী হয়ে ওঠে অর্থাৎ সমাজব্যবস্থার মধ্য দিয়ে, নারী-পুরুষের সম্মতির মধ্য দিয়ে একজন নারীকে নারী করে তোলা হয়, আর পুরুষকে দেয়া হয় শ্রেষ্ঠত্বের স্থান।
একটা বাচ্চা জন্ম নেবার পর থেকেই পিতৃতন্ত্র ঠিক করে সে কেমন ধরনের জীবন-যাপন করবে। পুরুষ হয়ে জন্মালে জীবনধারণ, পোশাক, আচার-আচরণ কেমন হবে আর নারী হলে কেমন হবে। পুরুষ হলে সে হবে প্রভু আর নারী হলে দাসী। যেহেতু সমাজই নির্ধারণ করে দেয় পুরুষের ভূমিকা হলো প্রভুর তাই পুরুষ তাঁর আধিপত্য প্রয়োগ করে নারীর ওপর। আর নারী তা মেনে নেয় নির্বিকারভাবেই। ঠিক এই নাটকের ক্ষেত্রে যেমন কোকিলা মেয়ে বলে তাঁর বিপরীতে থাকা চরিত্রগুলো যেমন- অনোয়ার, খন্দকার সাহেব কিংবা আদালতের বিচারক সকলে সব ক্ষেত্রেই পুরুষ হিসেবে কোকিলার থেকে এগিয়ে ছিল।
২. Biological (জৈবিক)
মনে করা হয় যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক যে পার্থক্য তার প্রধান কারণ হলো শারীরিক পার্থক্য। শারীরিকভাবেই পুরুষ হয় শক্তিশালী ও আক্রমণাত্মক আর তাই পুরুষ চাইলেই মাত্র কিছুক্ষণের ভেতরেই নারীর শরীরের ওপর তার ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটাতে পারেন শুধুমাত্র নারীর শরীরকে ব্যবহার করার মাধ্যমেই।
Quite the same manner, a disinterested examination of our system of sexual relationship must point out that the situation between the sexes now, and throughout history, is a case of that phenomenon Max Weber defined as herrschaft, a relationship of dominance and subordinance.
অর্থাৎ নারীর শরীরের সাথে যৌনতার নামে পুরুষ যে সম্পর্ক গড়ে তোলে সেটা আসলে সম্পূর্ণভাবেই একটা আধিপত্যের সম্পর্ক। এই আধিপত্যের সম্পর্ক গড়ে ওঠে অধিপতি শ্রেণির প্রতিনিধি সেই পুরুষ আর নিম্নবর্গের প্রতীক সেই নারীর মধ্যে “Through this system a most ingenious form of “interior colonization has been achieved.” অর্থাৎ নারীর শরীরের সাথে যৌনতার নামে সম্পর্ক স্থাপন করা হয় সেটা নারীর শরীরের উপর প্রয়োগ করা একধরনের অভ্যন্তরীন উপনিবেশও বটে।
আনোয়ার কিন্তু বিয়ে করার অজুহাতে প্রথম কোকিলার শরীরের উপর এক ধরনের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ স্থাপন করে এবং গর্ভবতী অবস্থায় কোকিলাকে ফেলে রেখে চলে যায় কিন্তু এর ফলে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করতে যায় নারী চরিত্রের প্রতিনিধি কোকিলা। তাহলে এর অর্থ কি দাঁড়ায় পুরুষের ক্ষমতা প্রয়োগ শুধু শারীরিক নিপীড়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং শেষ পর্যন্ত নারীকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছে?
প্রথম কোকিলার ক্ষেত্রে তাঁর সৎ বাবাও তাঁকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করতে চায়।
আনোয়ার তো কোকিলাকে বিয়ের আশা দিয়ে তাঁর শরীরের উপর ক্ষমতার প্রয়োগ করেছে কিন্তু কোকিলার সৎ বাবার তো শুধু একজন নারীর শরীর দরকার ছিল। সেটা তাঁর মেয়ে হোক বা অন্য কেউ। এর অর্থ কি এটা দাঁড়ায় যে, পুরুষের জন্য একজন নারীর শরীর হলেই যথেষ্ট? একইভাবে দ্বিতীয় কোকিলার স্বামী খন্দকার সাহেবও তো অন্য এক নারীর শরীরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ছেড়ে যেতে চান নিজ স্ত্রী দ্বিতীয় কোকিলাকে। এখানেও নারীর শরীরের উপর আধিপত্য প্রয়োগ করার মধ্যে দিয়েই নারীকে দখলের চেষ্টা করা হয়েছে।
এজন্যই কোকিলা এখন মনে করে, সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীটা পুরুষের জন্যই সৃষ্টি করেছে এবং তাঁদের ফুর্তির জন্যই দুনিয়া। এখানে মেয়ে মানুষের কোন দাম নেই কিংবা বাঁচার অধিকার, উপায় নেই। অতএব অন্য আরো অনেক পুরুষ তাঁর শরীর ছিঁড়ে খাওয়ার আগেই সে আত্মহত্যার মাধ্যমে মুক্তি খুঁজে নিয়েছে।”
৩. Sociological (সমাজতাত্ত্বিক
পরিবার
কেট মিলেট দেখাচ্ছেন যে, পিতৃতন্ত্র নিজের ভূমিকাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নানা রকম সংস্থা সৃষ্টি করে রাখে যার মধ্যে একটা বিশাল ভূমিকা থাকে পরিবারের। পরিবারই পিতৃতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করে। পিতা পরিবারের প্রধান এই ধারণা ব্যক্তির মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয় আর পরিবারের বৃহৎ সংস্করণ হলো সমাজ ও রাষ্ট্র। যেকোনো পরিবারে যেমন সবাই পুরুষ ব্যক্তি হিসেবে থাকা বাবার উপর নির্ভরশীল ঠিক তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যেও পুরুষই প্রধান আর এটাই প্রতিষ্ঠিত করে দেয় পরিবার। “কোকিলারা নাটকের তিন কোকিলার মধ্য প্রথম দু’জন পরিবার ও পুরুষতন্ত্রের ক্ষমতা দ্বারা দমিত।”
প্রথম কোকিলার মা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন শুধুমাত্র পরিবারে একজন পুরুষ মানুষ প্রয়োজন তাই। কোকিলা ও তাঁর বোনদের অনুরোধ উপেক্ষা করে তিনি বিয়ে করেন এক বুড়ো মাতবরকে। কোকিলার মা বলেন যে, ‘একজন পুরুষ না থাকলে এই রাক্ষুসে দুনিয়ায় না আমি বাঁচতে পারমু না তরা বাঁচতে পারবি। খাবলা দিয়া তগো গতর থেকে মাংস উঠায় লইবো’, অর্থাৎ জীবনে একজন পুরুষ অত্যাবশ্যক আর এই ধারণা আসে পরিবার থেকেই।
8. Class (শ্রেণি)
“কী শিক্ষিত, কী অশিক্ষিত, কী উচ্চবিত্ত, কী নিম্নবিত্ত সকল ক্ষেত্রেই নারী স্বশ্রেণির এবং উপর শ্রেণির পুরুষ কর্তৃক লৈঙ্গিক বৈষম্যের লৈঙ্গিক পীড়নের এবং যৌন ব্যাভিচারের শিকার হওয়া যেন অস্বাভাবিক নয়।” পুরুষের এক ধরনের চাতুর্য হলো তারা সবসময় এক শ্রেণির নারীকে লাগিয়ে রাখে অন্য শ্রেণির নারীর বিরুদ্ধে। যেখানে হয়তো নিম্নজীবীকে উচ্চজীবীর বিরুদ্ধে কিংবা গৃহিণীকে লাগিয়ে রাখা হয় কর্মজীবী নারীর বিরুদ্ধে। পুরুষ নিজেকে আরো ক্ষমতাবান রূপে অধিষ্টিথ করার জন্য এক শ্রেণির নারীকে সর্বদা লাগিয়ে রাখে অন্য শ্রেণির নারীর পেছনে।
এই নাটকের ক্ষেত্রেও একদিকে দেখি প্রথম কোকিলার মালিককে, যে নিজে নারী হয়েও কোকিলাকে কোনরকম সাহায্য করে না। “কোকিলা: আপনেও তো মাইয়া মানুষ। আমার দুঃখড়া আপনের তো বুজা উচিত।” এ প্রসঙ্গে সাজেদুল আউয়াল বলেন যে, কোকিলা নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজের নারী আর অন্যান্য চরিত্রগুলো যেমন আনু, খালুজান, খালাম্মা সবাই উচ্চমধ্যবিত্ত মানুষ। দুই শ্রেণির দুই পক্ষ।
কোকিলা শুধু পুরুষ দ্বারাই শোষিত হচ্ছে না, সে নারী দ্বারাও শোষিত হচ্ছে কারণ খালাম্মা নিজেও একজন নারী। আসলে সমাজ ব্যবস্থাই এমন যে নারী তাঁর নিজের শ্রেণির পুরুষ দ্বারা যেমন শোষিত হয়, তেমনি তাঁর নিজের শ্রেণির নারী দ্বারাও শোষিত হয়।
আবার দ্বিতীয় কোকিলার ক্ষেত্রেও দেখতে পাই মিস রিতাকে। যে নিজে নারী হয়েও অন্য এক নারীর ঘর ভাঙ্গার পেছনে ভূমিকা রাখছে— “কোকিলা: এখনো আমি বিশ্বাস করি আমার স্বামী অত খারাপ নয় । তাকে অবশ্যই উত্যক্ত করেছে নারীর আরেক শত্রু আরেক নারী, ঐ পার্সোনাল এসিসটেন্ট।” আবার পরবর্তীতে এটাও বলতে শুনি, “কোকিলা: তোমরা পুরুষেরা, বিশেষ করে বিবাহিত পুরুষেরা এক নারীতে সন্তুষ্ট থাকতে পার না। স্বভাব পাল্টানো তোমাদের মজ্জাগত অভিলাষ।”
অর্থাৎ দুইজন কোকিলার ক্ষেত্রেই নারীর সাথে নারীর এক ধরনের বিরোধ তৈরি করেছে মধ্যবর্তী পুরুষেরা। প্রথম কোকিলা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে তা শুধুমাত্র পুরুষে অত্যাচারের বিরুদ্ধেই নয়, একই সাথে সমাজে বিদ্যমান উচ্চবর্গ কর্তৃক নিম্নবর্গের প্রতি যে বৈষম্য তার বিরুদ্ধেও এক তীব্র প্রতিবাদ।
ফলে প্রথম কোকিলার জীবন শুধুমাত্র পুরুষ কর্তৃক ঘটে যাওয়া লৈঙ্গিক বৈষম্য নয়, বরং একই সাথে বৈষম্যমূলক এই সমাজব্যবস্থায় উচ্চশ্রেণির নারী কর্তৃক নিম্নশ্রেণির নারীর উপর নির্যাতনের চিত্রও উঠে এসেছে। আর দুই দলের নারীর বিরোধের মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে কিন্তু পুরুষের আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে কোন বাধা তৈরী হচ্ছে না। যেমন বোরহান বুলবুল বলছেন, “পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা পুরুষের তুলনায় নীচু শ্রেণির হিসাবেই গণ্য। আবার তার মধ্যে সেই নারী যদি অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া নিম্নবিত্তের হয় তাহলে তো তার উপর অত্যাচার-নির্যাতনের মাত্রা আরও এক ধাপ বেশিই হয়।
৫. Economic and Educational (অর্থ ও শিক্ষা)
অর্থ
পিতৃতন্ত্রের একটা বড় হাতিয়ার হলো পুরুষ সবসময়ই অর্থের কর্তৃত্বটা পুরুষের হাতেই রেখে দেয়। নারী কখনই অর্থের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে। নারী সাধারণত পুরুষের থেকে বেশি শ্রম দিয়ে এসেছে কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে নারী কখনই সেই মূল্য পায়নি।
“আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া নারীরা নিম্নবর্গের মধ্যেও আরো বেশি নিম্নবর্গ।”২ আর্থিকভাবে যেহেতু নারী পুরুষের উপর নির্ভরশীল থাকে তাই নারীর পরাধীনতার অন্যতম কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক কারণকেই ধরা হয়। আবার নারী যদি কোনো পেশায় নিয়োজিত থেকে অর্থ উপার্জন করে সেক্ষেত্রেও সে পুরুষের তুলনায় পারিশ্রমিক পায় কম। ফলে সে আজীবন পুরুষের অধীনেই থেকে যায়।
শিক্ষা
নারীর শিক্ষার প্রয়োজন নেই বলে একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত নারী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিল। কিন্তু আধুনিককালে যখন নারী শিক্ষিত হতে শুরু করল সেখানেও পুরুষতন্ত্র আসলে নারীকে সেই শিক্ষাতেই শিক্ষিত করতে চায় যা নারীকে আরও নারী করে রাখে। নারী শিক্ষায় অবশ্যই থাকবে মানবিক আর গৃহস্থালির শিক্ষা আর পুরুষের জন্য বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ব্যবসা, বাণিজ্য সব।
এই নাটকে প্রথম কোকিলা কাজ করে বলে সীমিত অর্থ উপার্জন করতে পারে তাই তাঁর কাছে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আছে কিন্তু শিক্ষা নেই। ঠিক একইভাবে দ্বিতীয় কোকিলা যিনি শিক্ষিত কিন্তু গৃহিণী বিধায় তাঁর কোন উপার্জন নেই। ফলে কোনো অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও নেই। অর্থাৎ দুইজন কোকিলার ক্ষেত্রেই অর্থ ও শিক্ষা তাঁদের পরাধীন করে রেখেছে। আর এই সুযোগে পুরুষতন্ত্র তাঁদের আধিপত্য প্রয়োগ করছে নিশ্চিন্তভাবে।
৬. Force (বল প্রয়োগ)
পুরুষ তাঁর আধিপত্য বিস্তার করে বল প্রয়োগের মাধ্যমে। সমাজ শুধুমাত্র এই ক্ষমতা পুরুষের হাতেই দিয়েছে। নিম্নশ্রেণির পুরুষ সরাসরি বল প্রয়োগ করে নারীর শরীরের উপর আর উচ্চশ্রেণির পুরুষ এই বলপ্রয়োগ করে শারীরিকভাবে আবার অনেক ক্ষেত্রে শুধুমাত্র মানসিকভাবেও। যেমন দ্বিতীয় কোকিলার স্বামী খুব সহজেই শরীরিক এবং একই সাথে মানসিক ক্ষমতার প্রয়োগ করতে পারেন স্ত্রীর উপর। ফলে শেষ পর্যন্ত মৃত্যু হয় দ্বিতীয় কোকিলার।
অন্যদিকে প্রথম কোকিলার ক্ষেত্রে আনোয়ার কোকিলার শরীরের উপর বল প্রয়োগ করে আবার যখন চোর অপবাদ দিয়ে ধরিয়ে দেয় পুলিশের হাতে তখন সেখানে পুলিশের দ্বারাও মানসিকভাবে বল প্রয়োগের স্বীকার হয়। সেই সব পুলিশ অফিসারেরা যারা কিনা পুরুষ ঠিক তারাও একইভাবে কোকিলাকে তাঁর শরীর নিয়ে অশালীন মন্তব্য করে। কোকিলার সংলাপে, “হারাডা রাইত পুলিশ ব্যাডারা আমারে টিটকারি করছে।
কার মাও বইন নাই। পুরুষের বাচ্চারা কেবল মাইয়া মানুষগো লইয়া ফূর্তি করতেই জানে। মাইয়া মানুষের কোন ইজ্জত নাই ।” অর্থাৎ রাষ্ট্রের প্রতিনিধি পুলিশের কাছেও নারী নিরাপদ নয় কারণ সেখানেও পুরুষের দ্বারা বল প্রয়োগ হচ্ছে।
৭. Anthropological: Myth and Religion (নৃতাত্ত্বিক: পুরাণ ও ধর্ম)
পুরাণ বা ধর্মে নারীর শরীরকে ধরা হয়েছে অপবিত্র হিসেবে। পুরাণ একদিকে যেমন নারীর শরীরকে তুলনা করে ‘প্যান্ডোরার বাক্স’ নামক এক বাক্সের সাথে যার ভেতর থেকে ছড়িয়ে পরে সকল রোগ জীবাণু অন্য দিকে বেহেশত হতে মানবের বিচ্যুতির কারণ হিসেবেও ধরা হয় নারীকেই। এই যে বেহেশত ছেড়ে মানব জাতি পৃথিবীতে এত কষ্টের সম্মুখীন হচ্ছে তার দায়ভারও কিন্তু নারীর উপরেই। আবার অন্যদিকে বলা হয় যে, পুরুষের শরীরের একটা অংশ হতে নারীর সৃষ্টি। অর্থাৎ নারী তাঁর জন্মের জন্যও পুরুষের উপর নির্ভরশীল। এই একই কথাই আমরা তৃতীয় কোকিলার মুখে শুনতে পাই,
কোকিলা: সৃষ্টিকর্তা বাবা আদমকে তো সৃষ্টি করলেন। তাঁর সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের কোন ব্যবস্থার ত্রুটি থাকলো না। কিন্তু তারপরও সৃষ্টিকর্তা লক্ষ্য করলেন, বাবা আদম যেন কেমন মনমরা হয়ে থাকেন । তখনই তিনি- কি? ওপাশ থেকে একজন কি বললেন? তখন তিনি বাবা আদমের পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করলেন মাতা হাওয়াকে।
আবার এ জগতে নিজের ভাগ্যের এই করুণ পরিণতি দেখা কোকিলা তাঁর সৃষ্টিকর্তার কাছে বিচার চায় মনে-প্রাণে— “আপনে আমারে কেন ঠকাইলেন সেই প্রশ্ন আমি আপনারে করুম না। কেয়ামতের দিন আল্লারে জিগামু।
যদি ধর্মই বলে দেয় নারীর সৃষ্টি পুরুষের একটা অংশ হতে তাহলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতি বিতৃষ্ণ কোকিলা যে প্রশ্ন করতে চায় সৃষ্টিকর্তার কাছে তাঁর কি কোন প্রয়োজন আদৌ আছে? একদিকে যেমন ধর্ম তেমনি পুরাণও তো বলে নারীই সকল নষ্টের মূলে। নারীশরীর হতেই সকল জরা, সকল কামের উদ্ভব। যা ধ্বংস করেছে পুরুষকে আর তাইতো শেষ অবধি লোক-পুরাণেও মহুয়াকে প্রাণ দিতে হয়, বেহুলাও ভাসতে হয় ঘাটে ঘাটে। অর্থাৎ যতই নারী বজ্রকণ্ঠে প্রতিবাদী হয়ে উঠুক না কেন শেষ পর্যন্ত অগ্নিপরীক্ষায় নামতে হয় নারী হিসেবে সীতাকেই। ঠিক একইভাবে কোকিলাদেরকেও মরতে হয়।
৮. Psychological (মনস্তাত্ত্বিক)
পিতৃতন্ত্র শুধুমাত্র নারীর শরীরকেই নিয়ন্ত্রণ করে না বরং একইসাথে নিয়ন্ত্রণ করে তাঁর মনস্তত্ত্বকেও। ফলে নারী নিজেও নিজেকে দুর্বল ভাবতে শুরু করে। কোকিলার মায়ের বক্তব্যে একদিকে পুরুষশাসিত সমাজের নগ্নতা আর অন্যদিকে নারীর ওপর পুরুষের কর্তৃত্বের চিত্র ফুটে উঠেছে-
“মাইয়া মানুষের একমাত্র ভরসা হইতাছে পুরুষ’ অর্থাৎ পুরুষের তুলনায় এ সমাজ ব্যবস্থায় নীচু শ্রেণির তথা নিম্নবর্গীয় হিসেবে গন্য। অবশ্য এই বিভাজন অর্থনৈতিকভাবে উচ্চবর্গীয় এবং নিম্নবর্গীয় উভয় শ্রেণির মাধ্যমেই পরিলক্ষিত হয়।
যদি এর একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে বলি, পুরুষই শুধুমাত্র নারীকে হেয় করে দেখে না বরং নারী নিজেও নারীকে দুর্বল মনে করে সে নিজেও ভাবে সে কোনো পুরুষ দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়েছে বলে সমাজে টিকে থাকতে পারবে না। ফলে সে নিজেই নিজেকে ধ্বংস করে দিতে চায়, নিজেই নিজেকে নারী ভাবতে শুরু করে।
অর্থাৎ এমনিতেই নিম্নবর্গ তো কথা বলতেই পারে না তাঁর উপর এই নিম্নবর্গ যদি হয় নারী তবে সে আরো কথা বলতে পারে না। কোকিলার মা কোকিলাকে বলে, পুরুষ পোলা হইয়া জন্মাইতে পারলি না? ক্যান, ক্যান মাইয়া হইয়া জন্মাইলি? অর্থাৎ একজন নারী হয়েও কোকিলার মা নিজেই তো চান পুরুষ সন্তানের জননী হতে। এর মানে কি এটা নয় যে, নারী নিজেও নারীকে দুর্বল মনে করে? আবার দ্বিতীয় কোকিলাকে যখন তাঁর স্বামী ডিভোর্স দিচ্ছিল তখন তিনি বারবার বলেছেন,
কোকিলা: আমি তোমার বাড়ির বারান্দায় কিংবা রান্নাঘরে পরে থাকবো। একটুও বিরক্ত করবো না, তোমাকেও না, তোমার নতুন বউকেও না। দয়া কর। আমাকে তোমার স্ত্রীর পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকতে দাও।”
এখানে কোকিলা নিজেই তাঁর স্বামীর আশ্রয়ে বেঁচে থাকতে চাইছেন। শত অপমান এর পরেও নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে তিনি স্বামীর কাছেও মাথা নত করছেন।
এ প্রসঙ্গে শাহীন মাহমুদ বলেন যে,
The issues are presented as showing women oppressed and exploited by men, be it a husband, a lover, a master, a father, a priest or the law-makers. These may not help our women so much as to take action into their hands and change the situation- but they do help them see the situation they are in and thus rouse their consciousness about the injustice of such situations.
এবং এটাই সত্য যে নারীরা তাঁদের নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করতে পারে না। মনস্তাত্ত্বিক জায়গা হতেও নারী এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে, নারী নিজেও নিজকে অসহায় বলে মনে করে। নারী নিজেও মনে করে তাঁকে বাঁচতে হলে একজন পুরুষের সাহায্যের প্রয়োজন। কোকিলারা নিম্নবর্গ থেকেও নিম্নবর্গ এবং নিম্নবর্গ কথা বলতে পারে না নাট্যকার নিজে দাবী করছেন তৃতীয় কোকিলাকে এক অসাধারন নারী হিসেবে যে নিজেই প্রশ্ন করে বসে এই পুরুষসমাজকে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষ নির্মিত প্রচলিত আইনের দ্বারস্থ হন তিনি।
আদালতকে কোকিলা এই বলে হুমকি দেন যে, পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষেরই মুখোশ উন্মোচন হবে আজ— “আদালতে উপস্থিত পুরুষেরা, মাপ করবেন, মহামান্য আদালত আপনি সমেত, কেননা দেখতে পাচ্ছি আপনিও একজন পুরুষ।” আবার কোকিলাকে বলতে শুনি “ভাবছেন এক কোকিলা এসেছে দুই কোকিলার কথা বলতে। কোকিলারা ত সবাই মেয়েছেলে। তাঁরা আবার কথা বলতে শিখলো কবে?”
এ প্রসঙ্গে সোনিয়া নিশাত বলেন যে,
The feminist critique would be aimed at the fact that the voice of the Kokila is that of women who wants the reward of the patriarchal system rather than rejecting them.”
তৃতীয় কোকিলা পুরুষতন্ত্রকে নাকচ করে না দিয়ে সেই পুরুষের কাছেই বিচার চাইছে। ঠিক একইভাবে তো প্রশ্ন দ্বিতীয় কোকিলাও করেছিল কিন্তু তাঁর উত্তর মিলেছে কি?
কোকিলা: এই পুরুষটি হয়তো আজীবন এমনি আরো মেয়েকে হতভাগিনী বানিয়ে রেলের চাকার তলায় ঠেলে দেবে। কোনদিন তাঁর বিচার হবে না। এই অপরাধের কোনো প্রতিবিধান নেই। সমাজ নামক খাঁচার মধ্যে আমরা সবাই বন্দী। এই বন্দিদশা থেকে হয়ত পুরুষ একদিন তাঁর সুবিধামতন মুক্তি খুঁজে নেবে। কিন্তু নারীরা মুক্তি পাবে না। বিধাতার নির্মাণ কৌশলের কাছে নারীরা আর কতকাল মার খাবে?
প্রশ্ন আসতে পারে, তৃতীয় কোকিলা তো প্রথম ও দ্বিতীয় কোকিলার পক্ষ হয়ে কথা বলতে পেরেছে। গণ-আদালতে বিচার চাইতে পেরেছে, তাঁদের সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষের সামনে এসে কথা বলতে পেরেছে। কিন্তু আদতে যে কথা তাঁরা বলেছে সেই কথা কি সত্যিই বলা হয়েছে?
“নেপথ্য বিচারক : সাক্ষীগণের বক্তব্য শ্রবণ করে আদালত এই মর্মে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। সেমতে আদালত জনাব আনোয়ার হোসেন ও জনাব হাবিব খন্দকারকে বেকসুর খালাস প্রদান করছে।
উপরের সংলাপে কি এটা স্পষ্ট নয় যে, শেষ পর্যন্ত কোকিলাদের বলার কিছু থাকে না। শেষ পর্যন্ত কোকিলাদের কথাগুলো নাবলাই থেকে যায়, তাই নয় কি?
She, an efficient and capable lawyer stands up, fight, tries to vinidicate- but can’s wrest justice for her clients-first, because she herself is a women, and secondly, because those who dispense justice are males
আবার আপাতভাবে দেখলে কোকিলা; প্রতিবাদী চরিত্র; দর্শকের সামনে এসে কথা বলতে পারে, প্রশ্ন তুলতে পারে এমন চরিত্র বলে মনে হতে পারে কিন্তু প্রশ্ন হলো যদি কোকিলা প্রতিবাদ করতে জেনেই থাকে তাহলে প্রথম কোকিলা আত্মহত্যা করতে গেল কেন? আর দ্বিতীয় কোকিলাই বা কেন স্বামীর আশ্রয়ে বেঁচে থাকার জন্য মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত স্বামীর কাছে মাফ চেয়ে তীব্র আকুতি জানালো? দুই কোকিলার ক্ষেত্রেই যে প্রতিবাদের ফলাফল সে নিজেই উপভোগ করতে পারবে না সেটা তাহলে কেমনতর প্রতিবাদ?
তাহলে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক যে নারীকে নিম্নবর্গের থেকেও নিম্নবর্গ বলছেন সেটার জলন্ত উদাহরণ কি এই নাটকের কোকিলারা নয়? এই ইচ্ছাকৃত আত্মহত্যা, মৃত্যু এমনকি শেষ পর্যন্ত আসামীদের বেকুসুর খালাস কি নাট্যকারের নিজস্ব পুরুষতন্ত্রকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে না? এ প্রসঙ্গে জাকিরুল হক যেমন বলেন,
আসলে তৃতীয় কোকিলার কণ্ঠে নাট্যকারের নিজের বক্তব্যই উপস্থাপিত। তাই নাট্যকার অন্যায়- বৈষম্য, নিপীড়ন-নির্যাতনে জর্জরিত এই ক্ষয়িষ্ণু বর্বর পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনের পক্ষে জোরাল বক্তব্য তুলে ধরেন জাঁদরেল ব্যারিস্টার তৃতীয় কোকিলার সংলাপে। কিন্তু পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থায় আইনী আদালত আর গণ- আদালতে বিচার পেতে ব্যর্থ হয়ে কান্নাকাটি করে কি পুরুষতান্ত্রিক এ ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে?
আবার কোকিলাকে বলতে শুনি যে,
কোকিলা: আমি জানি, আপনারাও জানেন, সেই বিশ্বাসঘাতকটা অবশ্যই একটা পুরুষ। এবং পুরুষ বলেই সে যখন এই পুরুষশাসিত সমাজে মাথা উঁচু করে হেঁটে বেড়াচ্ছে তখন এই হতভাগিনী পেটে অবৈধ সন্তান নিয়ে রেলের তলায় মাথা পেতে দিচ্ছে। আমরা প্রথম কোকিলার ক্ষেত্রে পাই কোকিলা ট্রেনের নীচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। আর দ্বিতীয় কোকিলাকে তাঁর স্বামী খন্দকার সাহেব হত্যা করেছেন। এখন এই আত্মহত্যা আর জোরপূর্বক হত্যা দুটোই কি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ দিয়ে নির্মিত হত্যা নয়?
নারীর নিজের কথা বলার কোন সুযোগ নেই সমাজে কারণ নারীর কথা বলাটা নিয়ন্ত্রণ করছে পুরুষ আর পুরুষতন্ত্র। আর এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে “নারী” তাই কথা বলতে পারে না। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক যাকে বলেছেন Can the subaltern speak? তিনি আরো বলেন যে,
The question is not of female participation in insurgency, or the ground rules of the sexual division of labour, for both of which there is evidence; rather. Both were used as object of colonialist historiography and as a subject of insurgency, though the ideological construction of gender keeps the male dominant. If in the context of colonial production, the subaltern has no history and cannot speak, the subaltern as female is even more deeply in shadow.
এখানে গায়ত্রী যে Subaltern শব্দটি ব্যবহার করেছেন সেই Subaltern শব্দটি সর্ব প্রথম ব্যবহার করেন আন্তোনিও গ্রামসি তাঁর Selections from the Prison Notebooks গ্রন্থে। যার বাংলা পরিভাষা দাঁড়ায় নিম্নবর্গ। পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন যে, “রণজিৎ গুহ এর বাংলা প্রতিশব্দ করেছেন নিম্নবর্গ।” গ্রামসি তাঁর লেখায় ইতালীয় ভাষায় ‘সুবলতের্নো’ শব্দটি ব্যবহার করেন। যার ইংরেজি করা হয় ‘সাব-অল্টার্ন’ । পার্থ চট্টোপাধ্যায় আরো বলেন যে, “ইংরেজী ভাষায় শব্দটি বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয় সামরিক সংগঠনের ক্ষেত্রে।
ক্যাপ্টেনের অধস্তন অফিসারদের ‘সাবলটার্ন’ বলা হয়। তবে শব্দটির সাধারণ অর্থ হল অধস্তন বা নিম্নস্থিত। ২ গ্রামসি অবশ্য যে অর্থে ‘Subaltern’ শব্দটির কথা বলেছেন তাঁর সাথে গায়ত্রী চক্রবর্তী বা পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘Subaltren (নিম্নবর্গ)’ এর ধারণাটা সম্পূর্ণ এক নয়। যে অর্থে তারা নিম্নবর্গ বলছেন তা হলো যে কোনো এলিট বা উচ্চবর্গের বিপরীতে যে থাকে সেই নিম্নবর্গ এবং নিম্নবর্গ ততক্ষণ নিম্নবর্গ থাকে যতক্ষণ সে কথা বলতে না পারে। এবং এই নিম্নবর্গ হলো সে, যে জানে সে উচ্চবর্গ দ্বারা শোষিত হচ্ছে কিন্তু তার কিছু করার থাকে না।
ঠিক যেমন এ নাটকের ক্ষেত্রে দুইজন কোকিলাই বুঝতে পারে যে তাঁরা নির্যাতিত হয়েছে, প্রতারিত হয়েছে, কিন্তু তবুও তারা কিছুই বলতে পারেনি। তবুও তারা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বারবার সেই সব প্রতারক, নির্যাতনকারী পুরুষের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চেয়েই গেছে। কারণ নিম্নবর্গের কাছে কখনও উচ্চবর্গের রাজনীতির কৌশলটা বোঝা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
নাটকের এক পর্যায়ে দ্বিতীয় কোকিলাকে বলতে শোনা যায়, “কোকিলা: আমি রাজনীতি বুঝি না। আমার ব্যবসায়ী স্বামী বোঝেন। কে কখন ক্ষমতায় যাচ্ছে আমার স্বামী অংক কষে সেটা বার করার চেষ্টা করে।” সত্যিই তো কোকিলার স্বামী খুব ভালো করেই রাজনীতি বোঝেন কারণ তিনি তো উচ্চবর্গের প্রতীক আর তাইতো নিজের পঁচিশ বছরের সংসার ফেলে অন্য নারীর শরীরের প্রতি খুব সহজেই আকৃষ্ট হয়ে যেতে পারেন।
নিম্নবর্গ কি সেটা আলাদা করে বলার চেয়ে উচ্চবর্গের সঙ্গে এর সম্পর্কের ভেতর থেকেই এর অর্থ উদ্ধার সম্ভব। আর এই সম্পর্ক হল ক্ষমতার সম্পর্ক। পদমর্যাদার ক্রমোচ্চবিন্যাসে পার্থক্যের কারণে স্তর পরম্পরায় সমাজের একেবারে নিম্ন শ্রেণিতে বসবাসকারী ব্যক্তিও তার চেয়ে নিচুস্তরের যে কারো তুলনায় উচ্চবর্গ ।
এ যে কোকিলাকে নাটকের প্রথম অংশে নিপীড়িত শ্রেণির প্রতিনিধি বা নিম্নবর্গ বলে দেখা যাচ্ছে সেই একই রকম নিম্নবর্গের প্রতীক তো দ্বিতীয় কোকিলা নিজেও। তাই তিনজন কোকিলাই সম্পূর্ণভাবে নিম্নবর্গের প্রতীক কারণ তাঁদের উপরে উচ্চবর্গের প্রতীক হিসেবে আছে আনোয়ার, বিবিসাব বা খন্দকার সাহেবের মত আরও অনেকেই।
“তবে এই কোকিলা কাজের মেয়ে কিংবা নিম্নবর্গীয় মানুষ না হলে- তাঁর পরিণতি আত্মহত্যায় হতো কিনা তা ভাবার অবকাশ থেকে যায়। কোকিলারা নাটকের কাজের মেয়ে বলেই কোকিলাকে আত্মহত্যা করে মুক্তির স্বাদ পেতে হয়েছে।” কিন্তু প্রশ্ন হলো কোকিলা কি কাজের মেয়ে বলেই শুধুমাত্র নিম্নবর্গের প্রতীক? কাজের মেয়ে হিসেবে কোকিলা যে নির্যাতনের শিকার হয়েছে সেই একই নির্যাতনের শিকার কি খন্দকার সাহেবের বউ হিসেবে দ্বিতীয় কোকিলাকে সহ্য করতে হয়নি? তিনি আরও বলছেন, “কাজের মেয়ে কোকিলা সামাজিক ও আর্থিক উভয় বিবেচনায় নিম্নশ্রেণির, নিম্ন আয়ের তথা নিম্নবর্গের নারী।
” কিন্তু শুধু প্রথম কোকিলাকে নিম্নবর্গের প্রতিনিধি বলেই একবাক্যে শেষ করা যাবে না। প্রথম কোকিলা হয়তো আপাতভাবে নিম্নশ্রেণির বলে মনে হতে পারে কারণ সে কাজ করে অন্যের বাড়িতে ফলে তাঁকে দ্বিতীয় কোকিলা হতে নিম্নবর্গের নারী বলা হচ্ছে কিন্তু ঠিক একই ভাবে দ্বিতীয় কোকিলাও কিন্তু তৃতীয় কোকিলা থেকে নিম্নবর্গ। কারণ দ্বিতীয় কোকিলা একজন গৃহিণী আর তৃতীয় কোকিলা সমাজে প্রতিষ্ঠিত একজন উকিল।
ফলাফল
সমগ্র বিশ্বের প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যায় যে, পুরুষের তুলনায় নারী সবসময়ই নিম্নবর্গের প্রতীক এবং নির্যাতিত হয়ে এসেছে। ফলে নারীদের কথাগুলো সবসময়ই না-বলাই থেকে গেছে। কিংবা নারীরা কথা বললেও সে কথাগুলো হয়তো আমরা কখনও শুনতেই পাই না।
ঠিক যেমন এই নাটকে মিসেস খন্দকাররূপী কোকিলা নির্যাতিত ও শোষিত আবার নাটকের শুরুতে যে প্রথম কোকিলা সেই কোকিলাও পুরুষশাসিত সমাজে নির্যাতিত ও শোষিত। তিনজন কোকিলাই পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে যৌন-রাজনীতির শিকার হয়েছেন পুরুষ দ্বারা এবং তাঁরা যে কথা বলতে চেয়েছেন তা হয়তো আমরা শুনতেই পাইনি। যদিও কেট মিলেট প্রদত্ত “যৌন-রাজনীতি (Sexual politics ) ” তত্ত্ব ও গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক এর “নিম্নবর্গ কি কথা বলতে পারে? ( Can the subaltern speak)” তত্ত্বের সবগুলো বৈশিষ্ট্যের সাথেই এই তিনজন কোকিলার মিল পাওয়া যায়।
কিন্তু একজন নাট্যকার কখনই তাঁর নাটক রচনার ক্ষেত্রে কোন তাত্ত্বিকের তত্ত্ব দ্বারা চালিত হয়ে নাটক লেখেন না। তিনি তাঁর জীবনবোধ, সৃজনশীলতা, শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামাজিক বাস্তবতায় নির্ভর করেই নাটক রচনা করেন। ফলে সমগ্র নাটক বিশ্লেষণ করে এটা বলা যাবে না যে, নাট্যকার এখানে কেট মিলেট বা গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক-এর তত্ত্ব দ্বারাই শুধু প্রভাবিত হয়েছেন এবং শুধু নারীকে নিম্নবর্গ করে উপস্থাপন করেছেন। এটা বলা যেতে পারে যে, তিন জন কোকিলাই আসলে শেষ পর্যন্ত কিছুক্ষেত্রে নিম্নবর্গ হিসেবে উঠে এসেছে।
যার কারণ হিসেবে বলতে পারি বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় নারীর উপর চাপিয়ে দেয়া নানা ধরনের বিধি-নিষেধ, ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক ও মানসিক অবস্থানের কথা যা একজন নারীকে আরো বেশি নারী করে গড়ে তোলে। এই নাটকে এক দিক থেকে যেমন প্রথম কোকিলার উপর উচ্চবর্গের প্রতীক হিসেবে আনোয়ার, তেমনি দ্বিতীয় কোকিলার উপর আছে তাঁর স্বামী খন্দকার সাহেব, যারা প্রথম থেকেই নিম্নবর্গের প্রতিনিধি এই দুই কোকিলার উপর তাঁদের ক্ষমতার প্রয়োগ করে আসছিল। কিন্তু আবার এটাও সত্য যে, নাটকের শুরুতেই নাট্যকার যেমন বলছেন কোকিলা হলো এক নারী।
সাধারণ, খুব সাধারণ এবং অসাধারণ। অর্থাৎ এই তিনজন নারীর ঘটনার মধ্যে দিয়ে শুধু নিম্নবর্গ বা যৌন- রাজনীতিতত্ত্ব ব্যাখ্যা না করে বরং একই সাথে নাট্যকার তাঁদের ভেতরকার দ্রোহের বিষয়টিও চিত্রিত করেছেন। তাই সামগ্রিক ভাবে কোকিলারা নাটকের কোকিলারা কিছু ক্ষেত্রে নিম্নবর্গের প্রতীক হলেও শৈল্পিক বিশ্লেষণে আবদুল্লাহ আল-মামুনের এই নাটকে আবহমান বাংলার চিরায়িত নারীদের সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোরই প্রতিরূপায়ণ ঘটেছে, যেখানে নারী প্রকৃত অর্থে নারী হয়েই লড়াই করে টিকে থেকেছে ব্যস্ত এই নাগরিক সভ্যতায়।
আরও দেখুনঃ