সত্যজিৎ রায় ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙ্গালি চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, সংগীত পরিচালক এবং লেখক। তাঁকে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একজন হিসেবে গণ্য করা হয়। সত্যজিতের জন্ম কলকাতা শহরে সাহিত্য ও শিল্প সমাজে খ্যাতনামা রায় পরিবারে ২ মে ১৯২১ সালে। তাঁর পূর্বপুরুষের ভিটা ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের কিশোরগঞ্জে (বর্তমানে বাংলাদেশ) কটিয়াদী উপজেলার মসূয়া গ্রামে। তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ ও শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। সত্যজিতের কর্মজীবন একজন বাণিজ্যিক চিত্রকর হিসেবে শুরু হলেও প্রথমে কলকাতায় ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাতা জঁ রনোয়ারের সাথে সাক্ষাৎ ও পরে লন্ডন শহরে সফররত অবস্থায় ইতালীয় নব্য বাস্তবতাবাদী চলচ্চিত্র লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে (ইতালীয়: Ladri di biciclette, বাইসাইকেল চোর) দেখার পর তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্বুদ্ধ হন।
সত্যজিৎ রায়
সত্যজিৎ সম্পর্কে গুলজার লিখেছেন :
বরটা হৃষীকেশদা’র কাছ থেকে পেয়েছিলাম। উনি’ আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন। সোজা চলে গেলাম ‘সান অ্যান্ড স্যান্ড’ হোটেলে। রিসেপশনে জিজ্ঞেস করতেই বলল, উনি লনে বসে আছেন। গিয়ে দাঁড়াতেই একটি ডিপ ব্যারিটোন বেজে উঠল, ‘গুলজার। আমার নামে Z উচ্চারণ একদম পারফেক্ট। বিমলদার মতো একটুও নয়। ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, মানে… আমার কথা শেষ হল না, তিনি বললেন,
‘Yes, I was to complement you.
Every one had told me about you’.
সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সেই আমার প্রথম দেখা। এত ভাল ইংরেজি কেউ যে বলতে পারে, না শুনলে বিশ্বাস করা যায় না। আর ওই গলার আওয়াজ, ওই উচ্চারণ, এমনকী ইংরেজি বলার সময় শরীরী ভঙ্গিমাও যেন এক জন পাক্কা ইংরেজের মতো। অথচ যেই বাংলায় কথা বলতেন, তখন একেবারে চেনা বাঙালি। আর বাকি সময় অপরিচিত, ডিসট্যান্ট।
মানিকদা—সবার কাছে শুনে শুনে আমিও তাকে এই নামটাতেই ডাকতে শুরু করেছিলাম – সেই সময় ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ হিন্দিতে করতে চাইছেন। সেই সিনেমার স্ক্রিপ্ট আর গান নিয়েই আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। প্রথমেই দেখলাম, ওঁর সবচেয়ে বড় চিন্তা গুগাবাবা’র বাঙালি ফ্লেভারটা হিন্দিতে করতে গিয়ে যেন নষ্ট না হয়। আমার এত ভাল লেগেছিল এই ব্যাপারটা, যে একজন বিশ্ব পরিচিত পরিচালক তাঁর মাতৃভাষার বিশেষত্ব ও মাধুর্যের ব্যাপারে কোনও ‘অ্যাডজাস্টমেন্ট’ করতে রাজি নন। আমায় বললেন,
‘তুমি গুপী গাইন দেখেছ?’
বললাম,
‘হ্যাঁ, দেখেছি।’
‘আচ্ছা বলো তো, ‘সাদাসিধা মাটির মানুষ’ এই কথাটা কী ভাবে অনুবাদ করবে?’
আমার মাথায় তখুনি যা এল বললাম, সাদাসিধাকে খুব পালটানোর তো দরকার নেই, ও রকমই রাখা যেতে পারে।’ তাতে উনি খুব আশ্বস্ত হলেন, ফের দুটো জলদগম্ভীর, ‘Good, good’.
মিটিং শেষ হল। এর পর আমি যখন কলকাতা এলাম, ওঁর সঙ্গে স্ক্রিপ্ট নিয়ে ডিটেলে কথা হল। ওঁর অ্যাসিস্ট্যান্টকে বললেন স্ক্রিপ্টটা নিয়ে আসতে। তার পর সেটা দেখে গানগুলো উনি নিজে হাতে আমায় লিখে দিলেন। উনি তখন বিশ্ববিখ্যাত। বললেই হয়তো তখুনি কেউ লিখে দিত। কিন্তু বোধহয় নির্ভুল রাখতেই লিখে দিলেন। এক জন মানুষ তাঁর কাজ সম্পর্কে কতটা সিরিয়াস হতে পারেন, ওঁকে দেখে আবারও সেই শিক্ষাটা নিলাম। তাঁর হাতে লেখা সেই কাগজগুলো এখনও আমার কাছে অমুল্য স্মারক হিসেবে রয়ে গিয়েছে।
গুপী গাইন হিন্দিতে হল না। আমার ওঁর সঙ্গে প্রথম কাজ করার সুযোগ মার গেল। কিন্তু সম্পর্কটা রয়ে গেল। আমি নিউ থিয়েটার্স-এ প্রায়ই কাজে যেতাম। তনুদা, মানে তরুণ মজুমদারদের সঙ্গে কাজ করতাম। তখন দোতলায় মানিকদার এডিটিং রুমে গিয়ে দেখা করে আসতাম। এক বার নিউ থিয়েটার্সে গেছি, দেখি, শশী কপূর, মানিকদা, আরও কয়েক জন কথা বলছেন। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এক টুকরো সেই কথাবার্তা এখনও আমার মনে গেঁথে আছে। উনি এ-রকমই একটা কিছু বলেছিলেন,
if we dont have money to spend on it, we have to spend our brain,
কথাটা আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। অজুহাত না খাড়া করে, নিজেকে আরও বেশি প্রয়োগ করতে হবে, এই শিক্ষাটা ওই বাক্যটা থেকে নিলাম।
দ্বিতীয় বার কাজ করার সুযোগ এল। করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়, মানে ‘পথের পাঁচালী’ সিনেমায় অপুর মা, সর্বজয়া— তাঁর মেয়ে এক বার মানিকদার প্রফেসর শঙ্কুর গল্প নিয়ে দিল্লি দূরদর্শনে হিন্দিতে সিরিয়াল করতে চাইল। আমায় স্ক্রিপ্ট করার দায়িত্ব দেওয়া হল। শুনলাম ফাইনাল স্ক্রিপ্ট পাস করবেন মানিকদা। শুনে আমিও আদা-জল খেয়ে লেগে পড়লাম। কিন্তু কিছু দিন পর খবর পেলাম, ওই সিরিয়াল হবে না। মানিকদা বলেছেন, উনি নিজেই করবেন। আর, এভাবে নয়, অন্য ভাবে করবেন।
আমি ঠাট্টা করে বললাম, নিশ্চয়ই আমার স্ক্রিপ্ট পছন্দ হয়নি, তাই আইডিয়া খারিজ করেছেন। তখন অন্য সবাই বলল, ‘দ্যাখো হয়তো তোমার স্ক্রিপ্ট দেখে মনে হয়েছে, একটা দারুণ কিছু হতে পারে, তাই হয়তো উনি রিজার্ভ-এ রাখছেন। আমিও হেসে উঠে বললাম, ‘এটা ঠিক বলেছ। এটা খুব ইন্সপায়ারিং।’ ব্যাপারটা হাসি-ঠাট্টায় শেষ বটে। কিন্তু আমার ভেতরটা দমে গেল। বারেও মানিকদার সঙ্গে কাজ করা হল আমার।
তৃতীয় কাজ করার জন্য আমিই ছুটে গেলাম। “শতরঞ্জ খিলাড়ি’ করবেন, খবর পেলাম। হোটেলে দেখা করতে গিয়ে শুনি, কলকাতা ফিরবেন বলে এয়ারপোর্ট বেরিয়ে গেছেন। ট্যাক্সি নিয়ে ছুটলাম এয়ারপোর্ট। তখন অবশ্য এত ঝুটঝামেলা ছিল না। একটা টিকিট কেটে ঢুকে গিয়ে দেখা করলাম। বললাম, ‘মানিকদা, আমি শতরঞ্জ খিলাড়িতে কাজ করতে চাই। স্ক্রিপ্ট লিখব।’ উনি বললেন, ‘আসলে আমি কাজটা দিয়েছি অন্য একজনকে। তিনি ড্রেস, ডিজাইনিং, সিনেমার আরও অন্য অ্যাসপেক্টও দেখছেন। You know, one those things… Gulzar.’ কী করব। একটা মনকে আচ্ছন্ন করে রাখল দিন।
এমনকী এখনও। আমার মানিকদার সঙ্গে কাজ করা হয়নি। কিন্তু যোগাযোগ থেকেছে। সন্দীপের সঙ্গেও যোগাযোগ ভালই। একবার একটা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখা। বিচারক ওখানে ওদের একটা স্পেশাল স্ক্রিনিং ছিল। আমি বললাম, ‘সন্দীপ, আমি সিনেমাটা দেখতে পেছন থেকে প্রোজেকশন রুম দিয়ে যাব, কাউকে বিরক্ত করব না। বলল, ‘আপনি সামনে দিয়ে যান সামনে গিয়ে বসুন। আমরা সিনেমা ভাবেই দেখেছি। এমনকী বাবাও এ রকম অনেক সিনেমাই দেখতেন।
সত্যজিৎ রায়ের একটা অমোঘ আকর্ষণ ছিল। সেটা সারা অস্তিত্বে ছড়ানো ছিল। সিনেমার অলৌকিক সেন্স, এক কমপ্লিট ফিল্মমেকারের প্রতিভা, ব্যক্তিত্ব, খ্যাতি, বোধ, ছেলেমানুষি, মনোযোগ, সবটার একটা অপূর্ব মিশেল। সত্যিই সাধারণের কাছে অধরা। এ একজন মানুষের সঙ্গে কাজ করতে পারার আক্ষেপ একজীবনে যায়?
সত্যজিৎ রায় [ Satyajit Ray ] সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্য:
নাম : সত্যজিৎ রায়
জন্ম তারিখ : ০২ মে ১৯২১
জন্মস্থান : কলকাতা, ভারত
মৃত্যুর তারিখ : ২৩ এপ্রিল ১৯৯২
মা এবং বাবার নাম : সুপ্রভা রায় / সত্যজিৎ রায় সুকুমার
পুরস্কার : সত্যজিৎ রায় ভারত সরকারের ৩২ টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার সহ বেশ কয়েকটি পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৯২ – প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা যিনি ভারতরত্ন পুরস্কারে ভূষিত হন
পেশা / দেশ : চলচ্চিত্র পরিচালক / ভারত
আও পড়ুন: