সানস্ এন্ড লাভারস্ উপন্যাসে মাতৃপ্রেম : একটি মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ – সৈয়দ আনোয়ারুল হক : আধুনিক ইংরেজী উপন্যাসের অন্যতম প্রধান লেখক ডি. এইচ. লরেন্স তাঁর উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে নর-নারীর সম্পর্ক উপস্থাপন করেছেন বেশ খোলামেলা ভাবে, যা সমকালীন সমাজে বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল তাঁর বেশ কয়েকটি উপন্যাস, যার মধ্যে সানস্ এন্ড লাভারস্ অন্যতম। যৌনতার ব্যাপারে খৃষ্টান ধর্মের অতি রক্ষণশীল মনোভাব দারুণ ক্ষুব্ধ করেছিল লরেন্সকে এবং ধর্মীয় মনোভাবের বিরুদ্ধে অনেকটা বিদ্রোহ করেই তিনি তাঁর উপন্যাসগুলোর কাহিনী যৌনতায় কেন্দ্রীভূত করেন।
লরেন্সের আত্মজৈবনিক উপন্যাস সানস্ এন্ড লাভারস্-এ মাতৃপ্রেম উপস্থাপিত হয়েছে এমন জটিল মনস্তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটে যা কোন কোন সমালোচকের দৃষ্টিতে অজাচারের অবয়বে ধরা পড়েছে। এই উপন্যাসে মা মিসেস মরেল ও মেঝ ছেলে পলের মধ্যে পরস্পর নির্ভরশীল এক মানসিক অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে যার প্রকাশ মাতৃপ্রেমের সীমানা ছাড়িয়ে যায়। প্রেমহীন বিবাহিত জীবনে পীড়িত মিসেস মরেল স্বামীর প্রতি প্রচণ্ড অবজ্ঞায় প্রথমে বড় ছেলে উইলিয়াম এবং তার অকাল মৃত্যুর পর মেঝ ছেলে পলকে তাঁর জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে প্রতিস্থাপন করেন।
ঘটনা পরম্পরায় মাতৃস্নেহ স্বাভাবিক মায়া-মমতার সীমা ছড়িয়ে এমন এক জটিল মনস্তাত্ত্বিক পর্যায়ে চলে যায় যে ছেলেই হয়ে ওঠে তাঁর ঘূর্ণিত স্বামীর বিকল্প। উপন্যাসের শুরুতেই মিসেস মরেল নিজেকে বিশ্বাসঘাতকতার এক করুণ শিকার মনে করেন। জীবনের বাসন্তীলগ্নে প্রথম প্রেমিক জন ফিল্ড আবেগের স্মৃতি হিসেবে তাঁকে পবিত্র বাইবেল উপহার দিয়েছিল। তাদের সম্পর্ক ছিল সম্পূর্ণ পবিত্র। গীর্জায় প্রার্থনা শেষে এক সাথে বাড়ী ফিরতেন গারট্রুড। কিন্তু জন তার কথা রাখেনি। অর্থনৈতিক মন্দায় শিক্ষকতার কাজ নিয়ে চলে যায় সুদূরে। দু’বছর সে গারট্রুডের সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখেনি। পরে খোঁজ নিয়ে গারট্রুড জেনেছেন মধ্যবয়সী ধনী বিধবা তার গৃহকর্ত্রীকে সে বিয়ে করেছে। নিজেকে প্রতারিত ভেবেছেন গারট্রুড, কিন্তু উপহার দেয়া বাইবেলটি স্মৃতির যাদুঘরে তুলে রেখেছেন।
[ সানস্ এন্ড লাভারস্ উপন্যাসে মাতৃপ্রেম : একটি মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ – সৈয়দ আনোয়ারুল হক ]
মরেলের সঙ্গে গারট্রুডের যোগাযোগ নাটকীয়ভাবে, নাচের আসরে মরেলের পৌরুষদীপ্ত চেহারা ও অট্টহাসির ভঙ্গি গারট্রুডকে মুগ্ধ করে। অনেকটা মোহের বশেই পরবর্তী বড়দিনে মরেলকে বিয়ে করেন গারট্রুড এবং প্রথম কয়েকমাস অনাবিল আনন্দে সময় কাটে তাঁদের। কিন্তু ক্রমে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণের ভিন্নতা সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি করে। অশিক্ষিত খনি শ্রমিক মরেলের অশুদ্ধ আঞ্চলিক উচ্চারণ ও মদ্যপ আচরণে ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠেন তাঁর স্ত্রী। ব্যক্তিগতভাবে সুশিক্ষিত ও মার্জিত রুচির গারট্রুড স্বামীর অমার্জিত আচরণে তাঁকে ঘৃণা করতে শুরু করেন এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবে তাঁকে স্বামী হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেন। ক্রমে ছেলেরাই হয়ে ওঠে তাঁর স্বামীর বিকল্প। ১৯১২ সালে Edward Garnett-কে লেখা এক চিঠিতে মিসেস মরেলের এই সমস্যাকে লরেন্স এভাবে ব্যাখ্যা করেন :
স্বামীর প্রতি প্রচণ্ড আবেগ ছিল তাঁর এবং সন্তানরা সেই আবেগের ফসল। কিন্তু ছেলেরা বড় হয়ে উঠলে প্রথমে বড় ছেলে ও পরে মেঝ ছেলেকে প্রেমিক হিসেবে বেছে নেন তিনি। মায়ের প্রতি পারস্পরিক ভালবাসায় ছেলেরা দ্রুত বেড়ে ওঠে। কিন্তু পরিপূর্ণ যুবক হয়ে তারা কোন মেয়েকে ভালবাসতে পারে না, কারণ তাদের জীবনে মায়ের প্রভাবই সবচেয়ে বেশী। ছেলেরা মা’কে প্রচণ্ড ভালবাসে আর ঘৃণায় বাবার প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে ওঠে।”
মরেলের সঙ্গে তার স্ত্রীর সম্পর্কের অবনতি শুরু হয় ছোট্ট একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে। মরেল বিয়ের আগে বলেছিলেন, ঘরের আসবাবপত্রের মালিক তিনি নিজে, কিন্তু অচিরেই জানা যায় তাঁর অসত্য কথন। সংসারের দারিদ্র্যের টানাপোড়েন ও স্বামীর অভদ্র আচরণ অসহ্য হয়ে ওঠে স্ত্রীর কাছে। তিনি ভাবেন, প্রথম প্রেমিকের মতই স্বামীর কাছেও তিনি প্রতারিত। পরিস্থিতি এতই জটিল হয়ে ওঠে যে পলের জন্মের পর সব ছেলেমেয়েই বাবাকে ঘৃণা করা শুরু করে। এমনকি একমাত্র মেয়ে এ্যানিরও কোন সহানুভূতি নেই বাবার জন্য। ঘরে ফিরেই মরেল কারো সাথে ভাল ব্যবহার করেন না। সামান্য ব্যাপারে চিৎকার করে কথা বলেন, খাবার নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন আর অকারণে বাচ্চাদের তিরস্কার করেন।
এসব দেখে ক্ষেপে যান তার স্ত্রী, আর বাচ্চারা ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকায় বাবার দিকে। ছোট্ট পল বাবাকে এতই অপছন্দ করে যে সে তাঁর মৃত্যু কামনা করে বসে। তার নিয়মিত প্রার্থনা “হে প্রভু, বাবা যেন মরে যায়।” একবারতো বাবার সঙ্গে মারপিট শুরু করে পল। বাবার প্রতি পলের প্রচণ্ড নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ পায় যখন মাকে তাঁর স্বামীর সঙ্গে এক বিছানায় যেতে নিষেধ করে: “এ্যানির সঙ্গে ঘুমাও মা, তাঁর সঙ্গে নয়,” এ বক্তব্যে বাবার প্রতি পলের যৌন-প্রতিহিংসার সুর স্পষ্ট। পরস্পরের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিভেদের দেয়াল তুলে দেয়।
ধর্মীয় মনোভাবের মিসেস মরেল স্থানীয় পাদ্রীর সঙ্গে ধর্ম নিয়ে কথা বলতে ভালবাসেন কিন্তু এটা তাঁর স্বামীর পছন্দ নয়। তাঁর স্বামী পুরোপুরি ইন্দ্রিয়পরায়ণ, ইহলৌকিক সুখই তার একমাত্র অন্বেষণ, পারলৌকিকতার কোন স্থান তাঁর জীবনে নেই। বিতৃষ্ণায় মন ভরে ওঠে মিসেস মরেলের। ছেলেদের ঘনিষ্ট সান্নিধ্যে স্বামীর দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে চান তিনি।
মায়ের প্রতি পলের প্রচণ্ড অনুভূতি ক্রমে অজাচারের প্রান্তসীমায় পৌঁছে যায় এবং বাবাকে পরিত্যাগ করে সে মায়ের সঙ্গে একই বিছানায় শয্যা গ্রহণ। করে। মায়ের সঙ্গে ঘুমাতে পলের ভালো লাগে, এর উষ্ণতা নিরাপত্তাবোধ আত্মার শান্তি, পরস্পরের স্পর্শে পাওয়া স্বস্তি সবকিছু তার দেহ ও আত্মাকে দ্রুত আরোগ্য লাভে সহায়ক হয়। মায়ের সঙ্গে ঘুমিয়ে পল দ্রুত ভালো হয়ে ওঠে।
লরেন্সের এই বর্ণনায় দৈহিক ও আত্মিক প্রেমের এক সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। মায়ের প্রতি পলের প্রচণ্ড অনুরাগের প্রতিফলন দেখা যায় ছোট্ট একটি ঘটনায়। মায়ের খুব পছন্দের ব্লাকবেরী ফল জোগাড় করতে না পেরে হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে সে। দু’ভায়ের মধ্যে হিংসা দ্বেষ লেগে থাকে মায়ের প্রতি ভালবাসা নিয়ে। উইলিয়াম নটিংহাম গেলে পলকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন মিসেস মরেল। ব্যাপারটি জেনে পরে ব্যাপারে ঈর্ষান্বিত হয় উইলিয়াম। পলের অত্যধিক সংবেদনশীলতার কারণেও মায়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
পলের অনুভবে আসে, প্রিয়তমার মতই তার মা উচ্ছল। মায়ের আচরণে মনে হয়, ঘুমিয়ে প্রেমিকের স্বপ্নে বিভোর কোন রমণী। পলের জীবনের সঙ্গে মায়ের জীবন এতটাই জড়িয়ে যায় যে পলের জীবন কাহিনীতে মিসেস মরেল তাঁর নিজের জীবন কাহিনীর প্রতিফলন দেখতে পান। প্রেমিক যুগলের মত পারস্পরিক সান্নিধ্যে আনন্দমুখর হতে দেখা যায় দু’জনকে। লন্ডনে উইলিয়ামের আকস্মিক মৃত্যুতে মিসেস মরেল এতটাই ভেঙ্গে পড়েন যে নিজের অস্তিত্বই ভুলে যান। তাঁর দৃষ্টির সীমানা থেকে হারিয়ে যায় পল।
পলের হঠাৎ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় তিনি আরো মুষড়ে পড়েন এবং পলের সঠিক নার্সিং করার লক্ষে যেন জীবন ফিরে পান। এ সময়ে মায়ের অন্তরঙ্গ স্পর্শ পলের অজাচারমূলক আবেগকে জাগিয়ে দেয়, “পল মায়ের বুকে মাথা রেখে ভালবাসার স্বস্তি অনুভব করে। মিসেস মরেলও পলের কারণে জীবনের শিকড় খুঁজে পান। মায়ের সঙ্গে পলের এতটা অন্তরঙ্গতার কারণে পলের মধ্যে মাতৃ-সাদৃশ্য নারীর প্রতি বিশেষ অনুরাগ লক্ষ্য করা যায়। মিরিয়ামের মা মিসেস লিভারস্-এর প্রতি পলের এই অনুভূতির প্রকাশ স্পষ্ট “পল মিসেস লিভারস্-এর সম্মোহনীতে আটকে যায়। আত্মিকভাবে সে পুষ্ট হয় তার সান্নিধ্যে, অভিজ্ঞতা থেকে যেন অত্যাবশ্যকীয় জ্ঞান লাভ করে।”
মায়ের মন-মানসিকতা পলকে এতটাই প্রভাবিত করে যে সে আবেগহীন সম্পর্কের ব্যাপারে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। মিরিয়ামের সঙ্গে সম্পর্ক চলাকালীন তার আবেগময় অনুভূতি তাকে আহত করে: “তার (মিরিয়ামের) অস্বাভাবিক আবেগের প্রচণ্ডতা পলকে ক্ষিপ্ত করে। মায়ের সংযমী আচরণ দেখতেই সে অভ্যস্ত”; গারট্রুড মিরিয়ামের সম্পর্ক উপস্থাপনে লরেন্স মনস্তাত্ত্বিক অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন।
যেহেতু তারা দুজনেই পলকে ভালবাসে, গারট্রুড সবসময় মিরিয়ামকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে তার সঙ্গে পলের মেলামেশা প্রচণ্ড অপছন্দ করেন “যখনই পল মিরিয়ামের সঙ্গে বেড়াতে যায় এবং বেশ রাত হয়ে যায়, জানে তার মা ক্ষেপে আছেন তার ওপর। কিন্তু কেন – সঠিক সে বুঝে উঠতে পারে না।” বাড়ী ফেরার পর মায়ের জিজ্ঞাসার মধ্যেই তাঁর অসন্তোষ প্রকাশ পায় : “কথা বলার আর কেউ কি নেই? ছোট ছোট ছেলে-মেয়ের প্রেম বিরক্তিকর।”
পলের বাড়ীতে মিরিয়াম বেড়াতে এলে তার প্রতি মায়ের অনীহা স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। “পলের ভাবনায় মগ্ন মিরিয়াম সোফায় বসে থাকে। নিজের চেয়ারে ঈর্ষান্বিতভাবে বসে থাকেন মিসেস মরেল: “মায়ের রূঢ় আচরণে পল মনে কষ্ট পায়। কিন্তু ছেলের মনোবেদনার জন্য মা অপবাদ দেন মিরিয়ামের।” মিসেস মরেল মিরিয়ামকে ঘৃণা করেন তার ছেলের এই অবস্থা সৃষ্টির জন্য। তিনি চেয়ে চেয়ে দেখেন পলের পাল্টে যাওয়া তার ক্রোধ, অতি মাত্রায় বিষণ্নতা, এর সব কিছুর জন্য তিনি দোষ দেন মিরিয়ামকে।
“আর একদিন ক্লারার উপস্থিতিতে ভাই এডগারকে নিয়ে মিরিয়াম বেড়াতে যায় পলদের বাড়ী। মিসেস মরেল দাঁড়িয়ে অতিথিদের সঙ্গে মিলিত হন। এডগারের সঙ্গে তিনি আন্তরিক ব্যবহার করেন, কিন্তু মিরিয়ামের প্রতি তাঁর মনোভাব শীতল ও ঈর্ষাপরায়ণ।” মিরিয়ামের প্রতি তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ্যেই উচ্চারণ করেন মিসেস মরেল : “সে সাধারণ কোন মেয়ে নয় যে পলের প্রতি আমার ভাগটা রেখে দেবে। এমনকি নিজের জন্যও ওর কিছু না থাকা পর্যন্ত সে পলকে গিলে খাবে। নিজের পায়ে কখনও পল দাঁড়াতে পারবে না। ও মেয়ে ওকে শেষ করে দেবে।”
মিরিয়ামের প্রতি মায়ের প্রচণ্ড নেতিবাচক মনোভাবের কারণে মিরিয়ামকে ভাল লাগা সত্ত্বেও পল তার মন পাল্টে ফেলার কথা ভাবে। মনের সব আবেগ অনুভূতি সে শুধুমাত্র মায়ের জন্য সংরক্ষিত রাখতে চায়। নিজেকে সে একান্তভাবেই তার মায়ের জন্য ভাবতে চায়। এই ধরনের অদ্ভুত সম্পর্ক দু’জনকেই বিচলিত করে : “তিনি (মিসেস মরেল) বসে চেয়ে থাকেন তার দিকে। তারপর তাঁর দৃষ্টি চলে যায় সুদূরে। তাদের মধ্যে এমন কিছু আছে যা প্রকাশ করা যায় না।
সে (পল) ও তার মা পরস্পরকে যেন এড়িয়ে চলে। তাদের মধ্যে গোপন কিছু আছে যা তারা সহ্য করতে পারে না; পুরো ব্যাপারটাই পলের কাছে অবান্তর মনে হয়, সে কিছু বুঝতে পারে না, … পরিস্থিতির কারণে মাকে দুঃখ ভারাক্রান্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী মনে হয়। .. তাঁর (মায়ের) মুখ দেখে মনে হয়, তিনি যেন মৃত, নীলাভ ঠোঁট শক্তভাবে বন্ধ। তাঁর নীল খোলা চোখে তিনি মিনতির ভঙ্গিতে তার দিকে তাকান – যেন তাঁকে ক্ষমা করতে বলতে চান।”
যদিও ভ্রষ্টাচারের অনুভূতি পারস্পরিক, তবে ভ্রষ্টাচারের বীজ বপন করেছেন মিসেস মরেল, যখন তিনি পলকে বলেন, সত্যিকার ভাবে তার কোন স্বামী নেই : “তুমিতো জান, পল, যে আমার কোন স্বামী ছিল না – সত্যিকার ভাবে না,” স্বামী না থাকায় মায়ের যন্ত্রণা পলকে দগ্ধ করে এবং রোমান্টিক কল্পনায় মায়ের কষ্ট লাঘবের জন্য নিজেকে তাঁর স্বামীর অবয়বে উপস্থাপিত করে।
মায়ের বেশী বয়সের কারণে এবং তরুণী মা পাবার আকাঙ্ক্ষায় স্বামীর অবয়বে পলের মনস্তাত্ত্বিক চাপ লক্ষণীয় : “মানুষের তরুণী মা থাকবে না কেন? কেন মা বৃদ্ধা হবে?” পলের কল্পনায় মা ধরা পড়েন আকর্ষণীয় এক প্রেমিকার অবয়বে : “তিনি যখন ঘুমিয়ে থাকেন, দেখতে ঠিক তরুণীর মত, প্রেমিকার মত। সারাক্ষণ তাঁর নীল চোখ ফিরে ফিরে তাকে দেখে।” লরেন্সের বর্ণনায় তাদের দুজনকে দেখা যায় প্রেমিক-প্রেমিকার অবয়বে: “পলের মায়ের চোখের কাছাকাছি। নীল চোখে তিনি পলের দিকে চেয়ে হাসছেন হাসিটা তরুণীসুলভ উষ্ণ, আবেগময়, অভিমানী।”
পলের কল্পনায় মাকে স্ত্রীর বিকল্প হিসেবে ভাবনা প্রতিফলিত হয় যখন সে বিয়ে না করার প্রতিজ্ঞা করে। বোন এ্যানির বিয়ের পর যখন মিসেস মরেল তাঁর মানসিক বেদনার কথা বলেন, পল দৃঢ়ভাবে জবাব দেয়: “যে কোন অবস্থাতেই আমি কখনোই বিয়ে করব না আমি বিয়ে করবনা মা। আমি তোমার সঙ্গে থাকব। তোমাকে যখন পেয়েছি, তখন বিয়ে করবই না। কখনোই না।”
পরবর্তীতে পল যখন মিরিয়ামের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়, মাকে দেখা যায় খুশী মনে তাকে বোঝাতে: “এসব নিয়ে ভেবো না। সবকিছু শেষ হয়ে গেলে তোমারই ভালো হবে।” মিরিয়ামের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যখন পল মাকে তা জানায়, তিনি প্রচণ্ড আনন্দ ও স্বস্তিতে বলেন, “আমি খুশী হয়েছি”; তাঁর আচরণে স্পষ্ট উত্তেজনা দেখা যায়। “তার (পলের) প্রতি ভালবাসায় তিনি আবার উষ্ণ ও আশান্বিত, যেন সূর্যালোকে তিনি সিক্ত।”
উপন্যাসে পলের বিকল্প মা হিসেবে ক্লারার ভূমিকা ভ্রষ্টাচারের ধারণাকে সুদৃঢ় করে। জীবনের দুঃসহ পরিস্থিতিতে, মিসেস মরেলের দ্বিতীয় সত্তা হচ্ছে ক্লারা। দুজনের জীবনেই ঘটেছে প্রেমহীন বিয়ে ও তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি আবেগের অবিন্যস্ততা। এই ধারণাটা স্পষ্ট হয় যখন দেখি মিরিয়ামের প্রতি বিদ্বেষী মনোভাব সত্ত্বেও ক্লারার প্রতি মিসেস মরেলের ইতিবাচক মনোভাব: “যে ভাবেই হোক ক্লারার প্রতি তিনি (মিসেস মরেল) বিদ্বেষী নন।”
ক্লারার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে সমালোচক Mark Spilka লিখেছেন : “ক্লারা পলের যৌন চাহিদা মেটায় এবং মায়ের জন্য অনেক কিছু রেখে দেয়। আসলে মিরিয়ামের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্কের পর এ ধরনের সম্পর্ককে তিনি (মিসেস মরেল) স্বাস্থ্যকর মনে করেন, ” ক্লারা যে মিসেস মরেলের বিকল্প তা পল কর্তৃক তার মায়ের সাথে ক্লারার তুলনা করার মধ্যে প্রকাশ পায় : “ক্লারাকে দেখে পলের মনে বেদনার সৃষ্টি হয়। তার মাকে এত ক্ষুদ্র অস্পষ্ট ও বিধ্বস্ত দেখায় উজ্জ্বল প্রাণবন্ত ক্লারার পাশে।” মিসেস মরেল ও ক্লারার প্রথম সাক্ষাতের সময় ঘটনাক্রমে দু’জনের পোষাকে কালো রংয়ের উপস্থিতি যেন পরস্পরকে পরিবর্তনীয় করে তোলে: “ক্লারার বড় কালো হ্যাট আর মিসেস মরেলের কালো সিল্ক ব্লাউস”।
ক্লারার সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে প্রতীকী অর্থে পল মায়ের সঙ্গে ভ্রষ্টাচারে লিপ্ত হয়, কারণ সত্যিকারভাবে তেমন কোন সম্পর্ক নৈতিক, ধর্মীয় ও আইনী দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অবৈধ। ব্যাপারটি এভাবে ঘটে যায় কারণ ক্লারা ও গারট্রুড মরেল মনস্তাত্ত্বিক ভাবে পলের দৃষ্টিতে অভিন্ন সত্ত্বায় ধরা পড়ে।” উপন্যাসে এটাও লক্ষণীয় যে বয়ঃসন্ধিকালে পলের মধ্যে যৌন চেতনা জাগরণের ক্ষেত্রে মায়ের একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল।
John Middleton Murry যথার্থই মন্তব্য করেছেন : “সম্পূর্ণ অসচেতনভাবে তার মা যৌন আকাঙ্ক্ষা জাগিয়েছেন পলের মধ্যে। স্বামীর প্রাপ্য আবেগ ছেলের প্রতি চালিত করে তিনি সময়ের আগেই তাকে পরিপূর্ণ পুরুষে রূপান্তরিত করেছেন। মায়ের প্রতি পল সেই অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছে যা তার পছন্দের নারীর প্রতি থাকা স্বাভাবিক হত।” আসলে যা ঘটেছে তা হল মায়ের জাগিয়ে দেয়া যৌন আকাঙ্ক্ষা সে ক্লারার মধ্যে চরিতার্থ করেছে, মানসিকভাবে তাকে ধরে নিয়েছে মায়ের বিকল্প।
এই সমালোচক আরো মনে করেন: “সচেতনভাবে পল মায়ের জন্য এতটাই অনুভব করেছে, পূর্ণ বয়স্ক একজন মানুষ তার প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য যতটা করে। ক্লারা পলের মায়ের বিকল্প হবার বিষয়টি আরো ব্যাখ্যা করা যায় অতিরিক্ত মাত্রার ঔষধ দিয়ে মায়ের ত্বরিত মৃত্যু ঘটানোর পর পলের আচরণ বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে।
ঐদিন সন্ধ্যায় যখন ক্লারার সঙ্গে পলের দেখা হয়, প্রেমিকের সকল আবেগ ও উচ্ছ্বাস নিয়ে পল এগিয়ে আসে। তার মধ্যে মায়ের মৃত্যুতে কোন দুঃখবোধ বা বিলাপ নেই।” প্রচণ্ড আবেগে পলকে বুকে জড়িয়ে ক্লারা বলে “প্রিয়তম, এটা (মায়ের মৃত্যু) ভুলে যাও।” পলের জবাব, “আমি ভুলে যাব।” পলের আচরণে মনে হয় মায়ের প্রতি সকল অনুভূতি এখন ক্লারার জন্য। সে মায়ের সান্নিধ্যে যেমন উচ্ছ্বসিত হত, তেমনই হয় ক্লারার সান্নিধ্যে।
যদিও সানস্ এন্ড লাভারস্ লরেন্সের শ্রেষ্ঠতম মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস নয়, তবুও অজাচারের বিষয়টি মনস্তাত্ত্বিকভাবে এ উপন্যাসে উপস্থাপিত হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের লেখকদের মত লরেন্সও নিঃসন্দেহে ফ্রয়েডের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, যা এই উপন্যাসে প্রতিফলিত। তবে ফ্রয়েডের মতবাদের তাত্ত্বিক উপস্থাপনা সানস্ এন্ড লাভারস্ নয়, বরং এটি একটি মনোযৌবনিক বাস্তববাদী উপন্যাস। আত্মজৈবনিক উপাদানও উপন্যাসে রয়েছে। নায়ক পল লেখক লরেন্সের দ্বিতীয় সত্তা, কারণ মায়ের সঙ্গে লরেন্সেরও আবেগময় সম্পর্ক ছিল। তবে লরেন্সের কাল্পনিক সৃষ্টিতে আত্মজৈবনিক ব্যাপারটি গৌণ হয়ে পড়েছে এবং উপন্যাসটি মহত্তর সৃষ্টি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
আরও পড়ুন:
সহায়ক গ্রন্থ :
- ডি. এইচ. লরেন্স : Pornography and Obscenity, পুনর্মুদ্রিত Sex, Literature and Censorship, নিউ ইয়র্ক : Twayne, ১৯৫৩।
- বারবারা এ মিলারস্ : Pillar of Flame (The Mytho Foundation of D. H. Lawrence’s Sexual Philosophy), নিউ ইয়র্ক : Peter Lang, ১৯৮৭।
- জন এম. মুরী Sons and Lovers, পুনর্মুদ্রিত D. H. Lawrence and Sons and Lovers Sources and Criticism, সম্পাদনা E. W. Tedlock Jr., নিউ ইয়র্ক: New York University Press, ১৯৬৫।
- মার্ক স্পিক্ষা : Counterfeit Lovers, পুনর্মুদ্রিত জন এম. মুরী Sons and Lovers, সম্পাদনা E. W. Tedlock Jr., নিউ ইয়র্ক : New York University Press, ১৯৬৫।
“সানস্ এন্ড লাভারস্ উপন্যাসে মাতৃপ্রেম : একটি মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ – সৈয়দ আনোয়ারুল হক”-এ 1-টি মন্তব্য