হিন্দি সিনেমার বিখ্যাত অভিনেতা ও নির্মাতা মনোজ কুমার তাঁর উপকার, পূরব অউর পশ্চিম এবং রোটি কাপড়া অউর মকান-এর মতো কালজয়ী ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে গভীর প্রভাব রেখে গেছেন। অভিনয় ও পরিচালনা—উভয় ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন এক অনন্য প্রতিভা, যাঁর ছবি সমাজের দর্পণ হয়ে উঠেছিল। মূলধারার হিন্দি সিনেমায় দেশপ্রেম ও সামাজিক সচেতনতার যে সুনিপুণ মিশ্রণ তিনি উপস্থাপন করেছিলেন, তা আজও স্মরণীয়।

পরিচালনার অজানা যাত্রা
নিজের ক্যারিয়ার সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে মনোজ কুমার বলেন, “আমি কখনোই পরিচালনার পরিকল্পনা করিনি। ‘শহীদ’ ছবির সময় অনানুষ্ঠানিকভাবে পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। পরে, লাল বাহাদুর শাস্ত্রী যখন ‘জয় জওয়ান, জয় কিসান’ স্লোগান দেন, তখন থেকেই ‘উপকার’ বানানোর ধারণা আসে।”
বাবার চিঠি: ভুল হতেই পারে, কিন্তু তা যেন ভুল সিদ্ধান্ত না হয়
১৯৫৬ সালে দিল্লি থেকে মুম্বাইয়ে এসে অভিনয়ের ক্যারিয়ার শুরু করার সময় মনোজ কুমার তাঁর বাবার কাছ থেকে একটি চিঠি পান। তাঁর বাবা, একজন কবি ও দার্শনিক, সেই চিঠিতে লিখেছিলেন—
“আমার রক্ত ভুল করতে পারে, কিন্তু ভুল সিদ্ধান্ত নয়।”
এই বাক্যটি মনোজ কুমারের জীবনে এক আদর্শ বাক্য হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, “আমার ক্যারিয়ারে আমি অনেক ভুল করেছি। কিন্তু কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেই।”
তিনি আরও বলেন, “আমি মুম্বাই এসেছিলাম দুটি লক্ষ্য নিয়ে—একটা ছিল নায়ক হওয়া, আরেকটা ছিল ৩ লাখ টাকা উপার্জন করা: বাবা-মায়ের জন্য ১ লাখ করে এবং ভাইবোনদের জন্য ১ লাখ।”

‘রোটি, কাপড়া অউর মকান’-এর উৎপত্তি
মনোজ কুমার জানান, এই ছবির ধারণা তাঁর মাথায় আসে স্কুলজীবনে, অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়। এক অনুষ্ঠান চলাকালে এক সিনিয়র ছাত্র বলেছিলেন,
“মাংগ রহা হ্যায় হিন্দুস্তান — রোটি, কাপড়া অউর মকান।”
এই বাক্য তাঁর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। ছবিটি পরবর্তীতে আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে একটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে, যেখানে দেখা যায়, একজন স্নাতক ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সামনে তাঁর সনদপত্র ছিঁড়ে ফেলেন। কারণ, ডিগ্রি থাকলেও চাকরি ছিল না। এই ঘটনাই ছবির মূল ভাবনার ভিত্তি হয়ে ওঠে।

ভালোবাসা, সংস্কৃতি, এবং কৌশলী রোমান্স
নিজের সংস্কার ও আদর্শ মেনে চলতেন মনোজ কুমার। তিনি বলেন, “আমি এমন এক সংস্কৃতি থেকে এসেছি, যেখানে বিয়ের আগে পুরুষরা নারীদের স্পর্শ করতেন না। এটা আমার জন্য খুব কঠিন ছিল। নায়িকাকে না ছুঁয়েও রোমান্স সৃষ্টি করতে হত। সেটা ছিল একপ্রকার দুঃস্বপ্ন।”
তিনি আরও বলেন, “পূরব অউর পশ্চিম ছবিতে সায়রা বানু আধা-ব্রিটিশ মেয়ে চরিত্রে ছিলেন। তিনি সোজা এসে ধরে চুমু খেতেন! তখন আমার চরিত্র ‘ভারত’—তার পবিত্রতা রক্ষা করতে আমায় অনেক আত্মসংযম রাখতে হত।”
একটি স্মৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন, “একবার আমি হারিদ্বারে আমার সন্তানদের নিয়ে গিয়েছিলাম। তখন ভোর ৪টায় মাইক থেকে ‘হায়ে হায়ে ইয়ে মজবুরি’ গানটি বাজছিল। আমি হেসে ফেলেছিলাম। গানটিতে জিনত আমান নেচেছেন, আমি শুধু দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। কারণ, আমার চরিত্র তখন একটি চাকরির ইন্টারভিউতে যাচ্ছিল। ‘উপকার’ আর ‘পূরব অউর পশ্চিম’-এর মতো দেশপ্রেমিক চরিত্রের পর আমি কীভাবে নায়িকার সঙ্গে ভিজে-ভিজে ঘনিষ্ঠতা দেখাতে পারতাম?”

মনোজ কুমারের উত্তরাধিকার
আজ তিনি আমাদের মাঝে না থাকলেও, তাঁর সৃষ্টি ও আদর্শ কোটি ভক্তের হৃদয়ে আজও বেঁচে আছে। দেশপ্রেম, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সাধারণ মানুষের সংগ্রাম—এই তিনটি স্তম্ভে দাঁড়িয়ে তাঁর ছবিগুলো আজও সমান প্রাসঙ্গিক।
মনোজ কুমার পরিচালিত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র
সাল | ছবি | বিষয় |
---|---|---|
১৯৬৭ | উপকার | দেশপ্রেমিক নাটক |
১৯৭০ | পূরব অউর পশ্চিম | সংস্কার বনাম পাশ্চাত্যতা |
১৯৭৪ | রোটি কাপড়া অউর মকান | সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট |
১৯৭৬ | শোর | পারিবারিক ও সামাজিক ড্রামা |
১৯৯৩ | ক্ষত্রিয় | অ্যাকশন ও ঐতিহাসিক গল্প |
মনোজ কুমারের এই অসাধারণ যাত্রা প্রমাণ করে, আদর্শ ও মূল্যবোধ মেনে চলেও একজন শিল্পী সাফল্যের শিখরে পৌঁছাতে পারেন। তাঁর সৃষ্টি ও জীবনচর্চা আজও নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে।