অনুপ কুমার এর জন্ম কলকাতায়, আসল নাম সত্যেন দাস। পিতা ধীরেন দাস ছিলেন মঞ্চাভিনেতা, তাঁর কাছেই অভিনয় ও গানে হাতেখড়ি। প্রথাগত শিক্ষা ম্যাট্রিক পর্যন্ত। মাত্র ১২ বছর বয়স থেকেই মঞ্চাভিনয় শুরু করলেও তার আগেই তিনি শিশুশিল্পী হিসাবে চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত হাল বাংলা (১৯৩৮) ছবিতে প্রথম চলচ্চিত্রাভিনয় । ষোলো বছর বয়সে অভিনয় করেন অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত সংগ্রাম (১৯৪৬) ছবিতে।
অনুপ কুমার
সাধারণত কৌতুক অভিনেতা হিসাবে পরিচিত হলেও, অনেক ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে, আবার কখনও খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয়ও করেছেন। সমগ্র চলচ্চিত্র জীবনে তিনশোটির বেশি ছবিতে চিত্ত বসু, কালীপ্রসাদ ঘোষ, অর্দ্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়, অগ্রদূত, সুধীর মুখোপাধ্যায়, নরেশ মিত্র, নীরেন লাহিড়ী, তপন সিংহ, মধু বসু, দেবকী বসু, তরুণ মজুমদার, মৃণাল সেন ছাড়াও আরও বহু পরিচালকের সাথে কাজ করেছেন।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে উত্তম-সুচিত্রা জুটির ছবিগুলিতে অনেক ক্ষেত্রেই নায়িকার দাদা বা ভাইয়ের ভূমিকায় তাঁকে দেখা গিয়েছে। অনুপ কুমার অভিনীত কিছু উল্লেখযোগ্য চরিত্র হল কেশব (বাঁশের কেল্লা, ১৯৫৩); গবা (নীল শাড়ি, ১৯৫৪); রাজেন (টনসিল, ১৯৫৬); শেখর (কাঁচামিঠে, ১৯৫৭); কেষ্ট (অর্ঘ্য, ১৯৬১); বসন্ত (পলাতক, ১৯৬৩); অমর (জীবনকাহিনী, ১৯৬৪); সোহনলাল (আলোর পিপাসা, ১৯৬৫); বাবু (একটুকু বাসা, ১৯৬৫); অভিরাম (ফুলেশ্বরী, ১৯৭৪); শঙ্করের বন্ধু (রাগ অনুরাগ, ১৯৭৫); ভোম্বল (দাদার কীর্তি, ১৯৮০) ইত্যাদি।

বেশির ভাগ ছবিতেই কমেডিয়ান হিসাবে অভিনয় করলেও যাত্রিক পরিচালিত পলাতক (১৯৬৩), তরুণ মজুমদার পরিচালিত ঠগিনী (১৯৭৪) ছবিতে অভিনয় এবং নিমন্ত্রণ (১৯৭১) ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্র হীরুর ভূমিকায় তাঁর অভিনয় দর্শকদের সাথে সমালোচকদেরও প্রশংসা অর্জন করেছে। তরুণ মজুমদার তাঁর ছবিগুলিতে অনুপ কুমারকে বিভিন্ন ভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করেছেন। তাঁর পরিচালিত আলোর পিপাসা ছবিতে একেবারেই ব্যতিক্রমী খলনায়ক সোহনলালের চরিত্রে সামান্য সময়ের অভিনয়েও অনুপ কুমার দর্শকদের মুগ্ধ করেন।
চলচ্চিত্রের পাশাপাশি ১৯৪২ সাল থেকেই অনুপ কুমার পেশাদার রঙ্গমঞ্চের সাথে যুক্ত ছিলেন। মহেন্দ্র গুপ্ত, শিশিরকুমার ভাদুড়ী, অহীন্দ্র চৌধুরী, রবি ঘোষ, বাদল সরকার, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতির সাথে ৫০টিরও বেশি নাটকে অভিনয় করেছেন। নাট্য নির্দেশনা, চলচ্চিত্র এবং রঙ্গমঞ্চে অভিনয়ের সঙ্গে যাত্রাভিনয় করেছেন এবং যাত্ৰা নির্দেশনাও দিয়েছেন ।
পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি ১৯৮৮ সালে তাঁকে বাংলা নাটকে বিশেষ অবদানের জন্য সম্মান জানায়। বিবিধ বেসরকারি পুরস্কার ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কথা শিরোমণি পুরস্কার ও দীনবন্ধু পুরস্কার লাভ করেন। অভিনেত্রী অলকা গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে তাঁর বিয়ে হয়।
৫০ বছরেরও বেশি অভিনয় জীবনে অনুপ কুমার খুব অল্প ছবিতেই তাঁর প্রকৃত অভিনয় প্রতিভা প্রদর্শনের সুযোগ পেয়েছেন।
চলচ্চিত্রপঞ্জি—
- ১৯৩৮ : হাল বাংলা;
- ১৯৪৬ : বন্দেমাতরম, সংগ্রাম;
- ১৯৪৭ : চন্দ্রশেখর, মুক্তির বন্ধন;
- ১৯৪৮ : বাঁকালেখা, ধাত্রী দেবতা, পদ্মা প্রমত্তা নদী;
- ১৯৪৯ : দ’খনে বাঘ, কৃষ্ণা কাবেরী, সন্দীপন পাঠশালা, সংকল্প;
- ১৯৫০ : বিদ্যাসাগর;
- ১৯৫১ : ভক্ত রঘুনাথ, বরযাত্রী, ছুটির দিনে;
- ১৯৫২ : পাশের বাড়ী; ১৯৫৩ : বাঁশের কেল্লা, শ্বশুরবাড়ী, রামী চণ্ডীদাস, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, অদৃশ্য মানুষ;
- ১৯৫৪ : আজ সন্ধ্যায়, মহিলা মহল, এই সত্যি, অন্নপূর্ণার মন্দির, অগ্নিপরীক্ষা, নীল শাড়ি;
- ১৯৫৫ : রাণী রাসমণি, অনুপমা, দেবত্র, বিধিলিপি, উপহার, জয় মা কালী বোর্ডিং, কঙ্কাবতীর ঘাট, দেবী মালিনী, মেজ বৌ, কালিন্দী;
- ১৯৫৬ : সাগরিকা, টনসিল, শুভরাত্রি, সাবধান, একটি রাত, মহাকবি গিরিশচন্দ্র, শঙ্করনারায়ণ ব্যাঙ্ক, অসমাপ্ত, শ্যামলী, মদনমোহন, নাগরদোলা, সিঁথির সিঁদুর;
- ১৯৫৭ : হারজিৎ, উল্কা, রাত্রিশেষে, তাপসী, আদর্শ হিন্দু হোটেল, পৃথিবী আমারে চায়, সুরের পরশে, রাস্তার ছেলে, কাঁচামিঠে, পুনর্মিলন, ওগো শুনছো, গড়ের মাঠ, পথে হল দেরী, জন্মতিথি;
- ১৯৫৮ : প্রিয়া, কালামাটি, ডাক্তার বাবু, নাগিনী কন্যার কাহিনী, শিকার, লীলাকঙ্ক, মর্মবাণী;
- ১৯৫৯ : নৌকাবিলাস, দেড়শো খোকার কাণ্ড, শশীবাবুর সংসার, গলি থেকে রাজপথ;
- ১৯৬০ : দুই বেচারা, প্রবেশ নিষেধ, বিয়ের খাতা, বাইশে শ্রাবণ, নতুন ফসল, গরীবের মেয়ে;
- ১৯৬১ : মিষ্টার এন্ড মিসেস্ চৌধুরী, বিষকন্যা, অর্ঘ্য, কাঞ্চনমূল্য, কঠিন মায়া, আজ কাল পরশু, আহ্বান, মা, কানামাছি;
- ১৯৬২ : অগ্নিশিখা, শেষ চিহ্ন, অভিসারিকা, বেনারসী, শুভদৃষ্টি;
- ১৯৬৩ : অবশেষে, সৎ ভাই, হাই হিল, পলাতক, দুই নারী, কাঞ্চনকন্যা, শ্রেয়সী, বর্ণচোরা;
- ১৯৬৪ : প্রতিনিধি, তাহলে, জীবনকাহিনী, অগ্নিবন্যা, কষ্টিপাথর, বিংশতি জননী;
- ১৯৬৫ : আলোর পিপাসা, মহালগ্ন, অন্তরালে, জয়া, একটুকু বাসা, দিনান্তের আলো, দোলনা, সূর্যতপা, তাপসী, মুখুজ্যে পরিবার; ১৯৬৬ : কলঙ্কী রাত, মায়াবিনী লেন, নতুন জীবন, রাজদ্রোহী, শেষ তিন দিন, উত্তর পুরুষ;
- ১৯৬৭ : বালিকা বধূ, হঠাৎ দেখা, খেয়া, প্রস্তর স্বাক্ষর;
- ১৯৬৮ : বালুচরী, বৌদি, ছোট্ট জিজ্ঞাসা, গড় নাসিমপুর, জীবন সঙ্গীত, তিন অধ্যায়;
- ১৯৬৯ : বিবাহ বিভ্রাট, দাদু, দুরন্ত চড়াই, পান্না হীরে চুণী, পিতাপুত্র;
- ১৯৭০ : সমান্তরাল্ব, আলেয়ার আলো, কলঙ্কিত নায়ক, পদ্ম গোলাপ, এই করেছো ভালো, নিশিপদ্ম, মঞ্জরী অপেরা;
- ১৯৭১ : আটাত্তর দিন পরে, অন্য মাটি অন্য রঙ, নিমন্ত্রণ, প্রথম বসন্ত;
- ১৯৭২ : বিরাজ বৌ, নয়া মিছিল, শেষ পর্ব, আজকের নায়ক;
- ১৯৭৩ : বসন্ত বিলাপ, এক যে ছিল বাঘ, নতুন দিনের আলো, শবরী;
- ১৯৭৪ : দাবী, প্রান্তরেখা, ফুলেশ্বরী, ঠগিনী, সঙ্গিনী;
- ১৯৭৫ : মৌচাক, নিশিমৃগয়া, ফুলু ঠাকুরমা, রাগ অনুরাগ;
- ১৯৭৬ : চাঁদের কাছাকাছি, সেই চোখ, স্বীকারোক্তি;
- ১৯৭৭ : অজস্র ধন্যবাদ, বাবা তারকনাথ, বাবু মশাই, ভোলা ময়রা, এই পৃথিবীর পান্থনিবাস, এক যে ছিল দেশ, ফুলশয্যা, প্রতিমা, প্রতিশ্রুতি, সানাই, তিন পরী ছয় প্রেমিক, হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ, প্রক্সি;
- ১৯৭৮ : ডাক দিয়ে যাই, গোলাপ বৌ, নদী থেকে সাগরে, টুসি;
- ১৯৭৯ : চিরন্তন, দেবদাস, গণদেবতা, ঘটকালি;
- ১৯৮০ : দাদার কীর্তি, পাকা দেখা;
- ১৯৮১ : সুবর্ণলতা, সেই সুর, প্রতিশোধ, শহর থেকে দূরে, স্বামী স্ত্রী, উপলব্ধি;
- ১৯৮২ : মেঘমুক্তি, শঠে শাঠ্যং, পিপাসা, মা ভবানী মা আমার, বোধন, ইমন কল্যাণ, খেলার পুতুল, শ্রেয়সী, মায়ের আশীর্বাদ, সোনার বাংলা, অমৃতকুম্ভের সন্ধানে, প্রফুল্ল, শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত;
- ১৯৮৩ : এই ছিল মনে, শৃঙ্খল, সমাপ্তি, সংসারের ইতিকথা, নিশিভোর, অভিনয় নয়, অপির্তা, ইন্দিরা, জীবনমরণ, জ্যোৎস্না রাত্রি; ১৯৮৪ : সূর্যতৃষ্ণা, প্রায়শ্চিত্ত, অমরগীতি, লাল গোলাপ, অগ্নিশুদ্ধি, মোহনার দিকে, সোরগোল, শত্রু;
- ১৯৮৫ : বৈকুণ্ঠের উইল, আমার পৃথিবী, নীলকণ্ঠ, হরিশ্চন্দ্র শৈব্যা, ভালবাসা ভালবাসা, সন্ধ্যাপ্রদীপ, তিল থেকে তাল;
- ১৯৮৬ : স্বর্গসুখ, অনুরাগের ছোঁয়া, দুই অধ্যায়, উর্বশী, আশীর্বাদ, ডাক্তার বৌ, অভিশাপ;
- ১৯৮৭ : বিদ্রোহী, অর্পণ, লালন ফকির, রাজপুরুষ, মহামিলন, স্বর্ণময়ীর ঠিকানা, মৌনমুখর, রাধারাণী, একান্ত আপন, আবীর, দোলনচাপা;
- ১৯৮৮ : কলঙ্কিনী নায়িকা, বোবা সানাই, কিডন্যাপ, অন্তরঙ্গ, ওরা চারজন, তুমি কত সুন্দর, দেবীবরণ, সুরের আকাশে, দেনাপাওনা, আগমন, ছন্নছাড়া;
- ১৯৮৯: আশা ও ভালোবাসা, বিদায়, মঙ্গলদীপ, অপরাহ্নের আলো, আশা, অভিসার, ঝংকার, আমার শপথ, অঘটন আজও ঘটে; ১৯৯০ : রক্তঋণ, আপন আমার আপন, অনুরাগ, গরমিল, দেবতা, রাজা বাদশা;
- ১৯৯১ : অহংকার, রাজনর্তকী, পথ ও প্রাসাদ, বৌরাণী, অভাগিনী, দেবর, সজনী গো সজনী, এক পশলা বৃষ্টি, নবাব, পতি পরম গুরু, নীলিমায় নীল;
- ১৯৯২ : অনুতাপ, রূপবান কন্যা, পেন্নাম কোলকাতা, ইন্দ্রজিৎ, মহাশয়, সত্যি মিথ্যা, নবরূপা, প্রিয়া;
- ১৯৯৩ : মন মানে না, মায়া মমতা, ক্রান্তিকাল, ভ্রান্ত পথিক, মিষ্টিমধুর, শ্রদ্ধাঞ্জলি, কন্যাদান, পৃথিবীর শেষ স্টেশন, তপস্যা, মায়ের আশীর্বাদ;
- ১৯৯৪ : তবু মনে রেখো, অতিক্রম, গীত সংগীত, নটী বিনোদিনী, আমিও মা, সালমা সুন্দরী, কথা ছিল, লাল পান বিবি;
- ১৯৯৫ : সংঘর্ষ, মশাল, মেজবৌ, সংসার সংগ্রাম;
- ১৯৯৬ : ত্রিধারা, হিমঘর, রবিবার;
- ১৯৯৭ : আজকের সন্তান, জীবন সন্ধান, প্রতিরোধ সপ্তমী, মাতৃভূমি;
- ১৯৯৯ : দাবীদার, নিয়তি, রাজডাঙা;
- ২০০১ : নরক গুলজার, ভালোবাসা কি আগে বুঝিনি।
প্রকাশনা :
‘আনন্দ বৈরাগী’। সপ্তর্ষি থেকে ২০১৪ সালে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে।
আরও দেখুনঃ