অপর্ণা সেন একজন বিখ্যাত বাঙালী অভিনেত্রী, পরিচালক ও সম্পাদক। তার জন্ম ১৯৪৫ সালে কলকাতায়, পিতা স্বনামধন্য চলচ্চিত্র সমালোচক এবং পরিচালক চিদানন্দ দাশগুপ্ত। স্কুলশিক্ষা প্রথমে সাউথ পয়েন্ট ও পরে মডার্ন হাই স্কুল ফর গার্লস-এ। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরাজিতে সাম্মানিক সহ স্নাতক।
অপর্ণা সেন
অপর্ণা সেন ১৬ বছর বয়সে প্রথম চলচ্চিত্রাভিনয় সত্যজিৎ রায় পরিচালিত তিন কন্যার অন্তর্গত‘সমাপ্তি” (১৯৬১) ছবিতে মৃন্ময়ীর ভূমিকায়। মৃণাল সেন পরিচালিত আকাশ কুসুম (১৯৬৫) ছবিতে মনিকার ভূমিকায়, নিত্যানন্দ দত্ত পরিচালিত বাক্সবদল (১৯৬৫) ছবিতে অমিতার ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেন। অভিনয় জীবনে অপর্ণা ৬০টিরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন।
যার মধ্যে বেশির ভাগই নায়িকার ভূমিকায়। উত্তমকুমারের বিপরীতে ১২টি ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল অপরিচিত (১৯৬৯), কলঙ্কিত নায়ক (১৯৭০), এখানে পিঞ্জর (১৯৭১), জয় জয়ন্তী (১৯৭১), মেমসাহেব (১৯৭২), আলোর ঠিকানা (১৯৭৪), যদুবংশ (১৯৭৪), কাজললতা (১৯৭৫) ইত্যাদি।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথে প্রায় ২২টি ছবিতে অভিনয় করেন, তার মধ্যে সমাপ্তি (১৯৬১), বাক্সবদল (১৯৬৫), আকাশ কুসুম (১৯৬৫), জীবন সৈকতে (১৯৭২), বসন্ত বিলাপ (১৯৭৩), ছুটির ফাঁদে (১৯৭৫) ইত্যাদি উল্লেখের দাবি রাখে। ৬০টিরও বেশি বাংলা ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি অপর্ণা একাধিক হিন্দী ও ইংরাজি ছবিতে অভিনয় করেছেন।
নিজের পরিচালনায় তৈরি পারমিতার একদিন ছবিতে সনকার ভূমিকায় তাঁর অভিনয় প্রশংসিত হয়েছিল। ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত ১৯শে এপ্রিল (১৯৯৬) এবং তিতলি (২০০১) ছবিতে তাঁর সংযত অভিনয়ও মনে রাখার মতো।
চলচ্চিত্র অভিনয়ের পাশাপাশি পেশাদার রঙ্গমঞ্চেও তিনি অবতীর্ণ হয়েছেন। তাঁর পরিচালনায় প্রথম ছবি ইংরাজি ভাষায় নির্মিত ৩৬ চৌরঙ্গী লেন (১৯৮১) তাঁকে শ্রেষ্ঠ পরিচালকের জাতীয় সম্মান এনে দেয়। ছবিটি ম্যানিলা চলচ্চিত্র উৎসবেও গ্রাঁ প্রী সম্মানে ভূষিত হয়। ছবিটি সিনেম্যানিলা চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ ছবির মর্যাদা পায়। প্রথম ছবিতেই নতুন প্রজন্মের চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি।
পরবর্তী চারটি ছবি পরমা (১৯৮৪), সতী (১৯৮৯), যুগান্ত (১৯৯৫) এবং পারমিতার একদিন (২০০০) নিজের গল্প ও চিত্রনাট্য অবলম্বনে তৈরি। পরমা এবং সতী কোনো পুরস্কারে ভূষিত না হলেও পরমা ছবিটি দর্শকদের আনুকূল্য পেয়েছিল। যুগান্ত ছবি বাংলা ভাষায় শ্রেষ্ঠ ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কার লাভ করে এবং পারমিতার একদিন বাংলা ভাষায় শ্রেষ্ঠ ছবির জাতীয় সম্মানের সাথে অপর্ণাকে শ্রেষ্ঠ পরিচালকের সম্মানও এনে দেয়। মুম্বাই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে FIPRESCI পুরস্কার, এবং কার্লো ভি ভ্যারি চলচ্চিত্র উৎসবে জুরী পুরস্কার লাভ করে।
নিজেকে নারীবাদী চলচ্চিত্রকার হিসাবে তুলে ধরতে না চাইলেও তিনি সমাজে নারীর স্থান বা মর্যাদা নিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলে ধরেন।

পরবর্তী ছবি মিস্টার এ্যন্ড মিসেস আয়ার (২০০১) জাতীয় সংহতির বিষয় নিয়ে ছবির জন্য সম্মানের পাশাপাশি অপর্ণাকে শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকারের সম্মান এনে দেয়। সিনেম্যানিলা চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য, হাওয়াই চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ ছবি, লোকার্নো চলচ্চিত্র উৎসবে নেটপেক পুরস্কার, ইউথ জুরী এ্যাওয়ার্ড এবং ফিলাডেলফিয়া চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ ছবির মর্যাদা পায়।
২০০৫ সালে নির্মিত ১৫ পার্ক এভিনিউ ছবির জন্যও তিনি পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০১০ সালে মুক্তি পায় দ জাপানিজ ওয়াইফ এবং ২০১১ সালে ইতি মৃণালিনী।
১৯৮৬-২০০৫ পর্যন্ত মহিলাদের জন্য প্রকাশিত বাংলা ভাষায় পাক্ষিক পত্রিকা ‘সানন্দা’ সম্পাদনা করেন। ঐ সালেই শ্রীমতী সেন পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন এবং ২০০৮ সালে এশিয়া পেসিফিক স্ক্রীন এ্যাওয়ার্ড-এর জন্য জুরী হিসাবে নির্বাচিত হন।
চলচ্চিত্রপঞ্জি (পরিচালনা)৩৬ চৌরঙ্গী লেন (ইংরাজি, ১৯৮১), পরমা (১৯৮৫), সতী (১৯৮৯), যুগান্ত (১৯৯৫), পারমিতার একদিন (২০০০), মিস্টার এ্যন্ড মিসেস আয়ার (২০০১), ১৫ পার্ক এভিনিউ (ইংরাজি, ২০০৫), দ জাপানিজ ওয়াইফ (২০১০), ইতি মৃণালিনী (২০১১)।
চলচ্চিত্রপঞ্জি (অভিনয়) –
- ১৯৬১ : তিন কন্যা;
- ১৯৬৫ : বাক্সবদল, আকাশ কুসুম;
- ১৯৬৮: হংসমিথুন;
- ১৯৬৯ : অপরিচিত;
- ১৯৭০ : অরণ্যের দিনরাত্রি, পদ্মগোলাপ, কলঙ্কিত নায়ক;
- ১৯৭১ : এখানে পিঞ্জর, জয়জয়ন্তী, এখনই, খুঁজে বেড়াই;
- ১৯৭২ : নায়িকার ভূমিকায়, জীবন সৈকতে, মেমসাহেব;
- ১৯৭৩ : বসন্ত বিলাপ, কায়াহীনের কাহিনী, সোনার খাঁচা, রাতের রজনীগন্ধা, বিলেত ফেরত, শেষ পৃষ্ঠায় দেখুন, এপার ওপার; ১৯৭৪ : আলোর ঠিকানা যদুবংশ, অসতী, সুজাতা;
- ১৯৭৫ : ছুটির ফাঁদে, কাজললতা, রাগ অনুরাগ, নিশিমৃগয়া;
- ১৯৭৬: জনঅরণ্য, অসময়, নিধিরাম সর্দার;
- ১৯৭৭ : অজস্র ধন্যবাদ, প্রক্সি;
- ১৯৭৯ : নৌকাডুবি;
- ১৯৮১ : অবিচার, বন্দী বলাকা;
- ১৯৮২ : বিজয়িনী, অমৃতকুম্ভের সন্ধানে;
- ১৯৮৩ : পিকু, অভিনয় নয়, অর্পিতা, ইন্দিরা;
- ১৯৮৪ : বিষবৃক্ষ, মোহনার দিকে;
- ১৯৮৫ : পরমা, নীলকণ্ঠ;
- ১৯৮৬ : শ্যাম সাহেব ;
- ১৯৮৭ : দেবিকা, একান্ত আপন, যার যে প্রিয়;
- ১৯৮৯ : কড়ি দিয়ে কিনলাম;
- ১৯৯০ : সংক্রান্তি;
- ১৯৯১ : মহাপৃথিবী;
- ১৯৯২ : অনন্যা, শ্বেত পাথরের থালা;
- ১৯৯৫ : আমোদিনী;
- ১৯৯৬ : ১৯শে এপ্রিল;
- ২০০০ : পারমিতার একদিন;
- ২০০১: তিতলি;
- ২০০৯ : অন্তহীন;
- ২০১১ : ইতি মৃণালিনী ।
আরও দেখুনঃ