অযান্ত্রিক চলচ্চিত্রটি নিয়ে আমাদের আজকের আলোচনা- ১৯৫৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র। এই ছবিটির পরিচালনা করেছিলেন ভিন্নধারার চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক। সুবোধ ঘোষ রচিত একই নামের একটি বাংলা ছোটোগল্প অবলম্বনে এই ছবিটি নির্মিত হয়েছে।
গল্পটি বিমল নামে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে নিয়ে । তিনি একটি ছোটো মফস্বলে বাস করেন। তিনি একাই থাকেন। তার ট্যাক্সিটি একটি ১৯২০ সার্ভোলেট জালোপি ট্যাক্সি। বিমল এই ট্যাক্সিটির নাম রেখেছিলেন ‘জগদ্দল’। এই ট্যাক্সিটিই তার একমাত্র সঙ্গী। ওই ট্যাক্সিটি ভাঙাচোরা হলেও সেটিই ছিল তার নয়নের মণি। একটি যন্ত্রশিল্প-বিবর্জিত এলাকায় সেই ট্যাক্সিটিতে চড়িয়ে মানুষকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছে দিয়ে কীভাবে বিমলের জীবন কাটছিল, সেটিই এই ছবিটিতে বিভিন্ন পর্যায়ে চিত্রিত করা হয়েছে।
অযান্ত্রিক চলচ্চিত্র
- প্রযোজনা –এল বি ফিল্মস ইন্টারন্যাশনাল।
- কাহিনি— সুবোধ ঘোষ।
- কাহিনি সম্প্রসারণ, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা —ঋত্বিককুমার ঘটক।
- সংগীত পরিচালনা — ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ।
- চিত্রগ্রহণ — দীনেন গুপ্ত।
- শিল্প নির্দেশনা—রবি চট্টোপাধ্যায়।
- শব্দগ্রহণ – মৃণাল গুহঠাকুরতা, সত্যেন চট্টোপাধ্যায়।
- সম্পদনা— রমেশ যোশী।
অযান্ত্রিক চলচ্চিত্রে যারা অভিনয় করেছেন —
কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজল গুপ্ত, গঙ্গাপদ বসু, তুলসী চক্রবর্তী, ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, সতীন্দ্র ভট্টাচার্য, কেষ্ট মুখোপাধ্যায়, অনিল চট্টোপাধ্যায়, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়, শ্রীমান দীপক, দেবী নিয়োগী, সুনীল রায়, গোপাল সান্যাল, বেচু সিংহ, লুধার টিগা, ভানু ঘোষ, গুপী বন্দ্যোপাধ্যায়, জন সিং, নিখিলেশ লাহিড়ী, উমাপ্রসাদ মৈত্র, অমলেশ চট্টোপাধ্যায়, শ্রীমান নলকুমার, সীতা মুখোপাধ্যায়, আরতি দাস, প্রসাদী।

অযান্ত্রিক চলচ্চিত্রের কাহিনি—
ছোটনাগপুরের অরণ্যের কোলে আদিবাসী অধ্যুষিত পাহাড় এবং উপত্যকার মাঝে একটি মফস্সল শহরে ছবির নায়ক বিমলের (কালী) বাস। সে একজন ড্রাইভার এবং তার আছে ১৯২০ সালের মডেলের একটা শেভ্রোলে গাড়ি — নাম জগদ্দল, যেটি সে নিজেই চালায়। গাড়িটা তার কাছে একটি জীবন্ত প্রাণী, তার সাধ আছে, আবদার আছে, আবার অভিমানও আছে। এই গাড়ির ওপর বিমলের একটা অদ্ভুত টান আছে, সে গাড়িটার সাথে কথা বলে।
লোকে বিমলকে পাগল ভাবলেও বিমল নিজে মনে করে সে যেমন জগদ্দলকে বুঝতে পারে তেমন জগন্দলও তার কথা বুঝতে পারে। বিমল তার জগদ্দলে যাত্রী নিয়ে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করে। একবার এক জন মহিলা যাত্রীকে নাম হাসি (কাজল) তার গাড়িতে করে এক রেল স্টেশনে নিয়ে যায়, হাসিরও জীবনে যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, বিমল তার প্রতি দুর্বলতা অনুভব করে।
বিমলের ট্যাক্সিতে হাসি কিছু জিনিস ফেলে যায়, বিমল পরবর্তী স্টেশনে গিয়ে হাসির হাতে সেগুলি দিতে চায় কিন্তু সেই সময়ই জগদ্দল বিগড়ে যায়। বিমলের বিশ্বাস জগদ্দল অভিমান করেছে। বিমল তার শেষ সঞ্চয় খরচ করে জগদ্দলের মেরামত করায়, কিন্তু কিছুদিন পরে জগদ্দল আবার বিগড়ে যায়, বিমল বুঝতে পারে জগদ্দলের শেষ সময় উপস্থিত। শেষ দৃশ্যে আমরা দেখি একটা ঠেলাগাড়িতে গাড়ির সব কলকব্জা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কালোয়ারের কাছে কিন্তু গাড়ির হনটি নিয়ে একটি আদিবাসী বাচ্চা ছেলে মনের আনন্দে বাজাচ্ছে।
ছবির বিষয়বস্তু নির্বাচনে ঋত্বিক ঘটক সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন। একটা পুরোনো গাড়ি এবং তার মালিক কাম ড্রাইভারের সাথে গাড়িটার জটিল সম্পর্কই এই ছবির মূল বিষয়। বিমল একজন নিঃসঙ্গ মানুষ, কিছুটা লুনাটিকও বটে। আক্ষরিক অর্থেই তার পরিবারে কেউ নেই, এক
সময় মা ছিলেন, কিন্তু তিনিও মারা গিয়েছেন। এই গাড়ি গত পনেরো বছর ধরে তার খাওয়া পরার ব্যবস্থা করেছে। জগদ্দল ও বিমল একে অন্যের পরিপুরক। এর মধ্যে আদিবাসী অধ্যুষিত মানুষের মাঝখানে বিমল ও জগদ্দল একটি নতুন ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করে। শেষ দৃশ্যে ওঁরাও বাচ্চা ছেলেটির হাতে জগদ্দলের হন এক নতুন ভবিষ্যতের ইঙ্গিত বহন করে।
প্রকাশনা :
রজত রায় সম্পাদিত ঋত্বিক ও তাঁর ছবি গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে বিমল ভৌমিক, জর্জ সাদুল, রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দীপেন্দু চক্রবর্তীর লেখা (পূর্বে প্রকাশিত) চারটি প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
আরও দেখুনঃ