আর. ডি. বনশল – জীবন ও কর্ম

আর. ডি. বনশল (পূর্ণ নাম – রামদাস বনশল) ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্র জগতের একজন খ্যাতনামা প্রযোজক, যিনি শিল্পমান ও বাণিজ্যিক সাফল্যের দিক থেকে একাধিক স্মরণীয় চলচ্চিত্র নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। সত্যজিৎ রায়, অজয় কর, সুধীর মুখোপাধ্যায়, মৃণাল সেন, তপন সিংহ প্রমুখ বিখ্যাত পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করে তিনি বাংলা সিনেমাকে আন্তর্জাতিক মানচিত্রে প্রতিষ্ঠা করতে বিশেষ অবদান রাখেন।

 

আর. ডি. বনশল – জীবন ও কর্ম

 

জন্ম প্রারম্ভিক জীবন

১৯২৩ সালে (তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত) উত্তর প্রদেশের আগ্রায় জন্মগ্রহণ করেন রামদাস বনশল। তাঁর ছাত্রজীবনও অতিবাহিত হয় সেখানেই। বনশল পরিবারের মূল ব্যবসা ছিল মার্বেল পাথরের, যার বিস্তারের উদ্দেশ্যে তিনি পরবর্তীতে কলকাতায় আসেন। এখানেই ধীরে ধীরে তিনি চলচ্চিত্র ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন এবং একসময় বাংলা সিনেমার অন্যতম প্রভাবশালী প্রযোজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

 

চলচ্চিত্র ব্যবসায় প্রবেশ

১৯৫৩ সালে তিনি প্রথমবার চলচ্চিত্র ব্যবসায় যুক্ত হন এবং একই বছর গ্রেস সিনেমা-র ভার গ্রহণ করেন। শুরুতে তিনি মূলত চলচ্চিত্র পরিবেশনের কাজ করতেন। ১৯৫৭ সালে তিনি গ্রেস পিকচার্স গঠন করেন এবং ১৯৫৮ সালে লোটাস সিনেমা-র দায়িত্বও নিজের হাতে নেন।

১৯৫৯ সালে প্রযোজনা করেন তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র – সুধীর মুখোপাধ্যায় পরিচালিত শশীবাবুর সংসার। এই ছবিটি তাঁর প্রযোজনা জীবনের ভিত্তি রচনা করে। ১৯৬০ সালে তিনি গঠন করেন স্বনামধন্য প্রযোজনা সংস্থা আর. ডি. বি. অ্যান্ড কোং, যা দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে বাংলা চলচ্চিত্র জগতে সক্রিয় ছিল।

 

উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা অবদান

আর. ডি. বনশলের প্রযোজনা সংস্থার ব্যানারে বাংলা সিনেমার ইতিহাসে কালজয়ী একাধিক ছবি তৈরি হয়েছে। বিশেষত সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ সহযোগিতা বাংলা সিনেমাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মঞ্চে পৌঁছে দেয়। তাঁর প্রযোজিত কিছু বিখ্যাত চলচ্চিত্র—

  • মহানগর (১৯৬৩) – নগর জীবনে নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠার কাহিনি।
  • চারুলতা (১৯৬৪) – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “নষ্টনীড়” অবলম্বনে নির্মিত; চলচ্চিত্রটি আন্তর্জাতিকভাবে বহুল প্রশংসিত এবং ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা পরিচালক সম্মান এনে দেয় সত্যজিৎ রায়কে।
  • কাপুরুষ মহাপুরুষ (১৯৬৫) – দুটি কাহিনি নিয়ে নির্মিত ডাবল ফিচার, যা সমালোচকদের মধ্যে বিশেষ সমাদৃত।
  • নায়ক (১৯৬৬) – বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছবি, যেখানে উত্তমকুমার অভিনীত চরিত্রের মাধ্যমে খ্যাতি, সাফল্য ও একাকীত্বের দ্বন্দ্ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

তাছাড়াও তিনি প্রযোজনা করেছিলেন অজয় করের সাত পাকে বাঁধা (১৯৬৩), যা বাংলা সিনেমার অন্যতম জনপ্রিয় রোমান্টিক ছবি এবং সুচিত্রা সেন ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়ে আজও সমান জনপ্রিয়।

সত্যজিৎ রায় ছাড়াও তিনি অজয় কর, পার্থপ্রতিম চৌধুরী, সুধীর মুখোপাধ্যায়, মৃণাল সেন, তপন সিংহ প্রমুখ পরিচালকের চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছিলেন।

 

চলচ্চিত্রপঞ্জি (নির্বাচিত)

  • ১৯৫৯ – শশীবাবুর সংসার
  • ১৯৬০ – শেষ পর্যন্ত
  • ১৯৬২ – অতল জলের আহ্বান
  • ১৯৬৩ – এক টুকরো আগুন, সাত পাকে বাঁধা, ছায়াসুর্য, মহানগর
  • ১৯৬৪ – চারুলতা
  • ১৯৬৫ – কাপুরুষ ও মহাপুরুষ
  • ১৯৬৬ – কাঁচ কাটা হীরে, নায়ক
  • ১৯৭১ – চৈতালী
  • ২০০৫ – নিশিযাপন

 

স্বীকৃতি উত্তরাধিকার

আর. ডি. বনশলের প্রযোজনা করা চলচ্চিত্রগুলি একদিকে যেমন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক উৎসবেও বাংলা সিনেমাকে সম্মানিত করেছে। চারুলতানায়ক আজও বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসে অনবদ্য সৃষ্টির মর্যাদা পায়।

তাঁর প্রতিষ্ঠিত আর. ডি. বি. অ্যান্ড কোং আজও চলচ্চিত্র ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত, যা প্রমাণ করে তিনি কেবল চলচ্চিত্র প্রযোজনা নয়, চলচ্চিত্রকে একটি দীর্ঘমেয়াদি শিল্প ব্যবসা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন

 

মূল্যায়ন

আর. ডি. বনশল বাংলা চলচ্চিত্র জগতের এক কিংবদন্তি প্রযোজক। তাঁর হাত ধরে বাংলা চলচ্চিত্র লাভ করেছে বিশ্বমানের স্বীকৃতি। সাহিত্যনির্ভর কাহিনি, সমাজকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র এবং রোমান্টিক ছবির মিশ্রণে তাঁর প্রযোজনাগুলি একদিকে যেমন সমালোচকদের সমাদর কুড়িয়েছে, অন্যদিকে দর্শককেও আকৃষ্ট করেছে। তিনি ছিলেন সেই সেতুবন্ধন, যিনি বাংলা সিনেমাকে আঞ্চলিক সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে পৌঁছে দেন।

Leave a Comment