বাংলা নাট্য ও চলচ্চিত্র জগতে উৎপল দত্ত এমন এক নাম, যিনি শুধু একজন শক্তিমান অভিনেতা নন, বরং নাট্যকার, নির্দেশক, পরিচালক, প্রাবন্ধিক ও সমাজচেতনার ধারক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় একেকটি নাট্যমঞ্চ, প্রতিটি রচনার পেছনে রাজনৈতিক বক্তব্য, আর প্রতিটি অভিনয়ের মধ্যে অদম্য সমাজসচেতনতা।

উৎপল দত্ত । বাংলা চলচ্চিত্রের অভিধান
জন্ম ও শিক্ষা
উৎপল দত্ত জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৯ সালে শিলংয়ে। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় শিলংয়ের একটি মিশনারি স্কুলে। পরে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৪৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং ১৯৪৯ সালে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, কলকাতা থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেন কলকাতার বিখ্যাত সাউথ পয়েন্ট স্কুলে।
নাট্যজগতে অভিষেক ও যাত্রা
কলেজে পড়ার সময় থেকেই উৎপল দত্ত নাটকে অভিনয় শুরু করেন। তাঁর প্রথম মঞ্চ-অভিনয় ছিল উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের “হ্যামলেট” নাটকে। এরপর তিনি গড়ে তোলেন ‘দি অ্যামেচার শেক্সপিয়ারিয়ান’ নামের নাট্যদল, যেটির মাধ্যমে বহু শেক্সপিয়ার নাটকে অভিনয় করেন। পরবর্তীতে জিয়ফ্রে কেন্ডালের নাট্যদলে যোগ দেন এবং পরে নিজেই প্রতিষ্ঠা করেন লিটল থিয়েটার গ্রুপ (LTG)।
চলচ্চিত্র জীবন
উৎপল দত্ত প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন ১৯৫০ সালে, মধু বসু পরিচালিত “মাইকেল মধুসূদন” ছবিতে শিরোনাম চরিত্রে। এরপর প্রায় চার দশকের অভিনয়জীবনে তিনি ১৬০টিরও বেশি বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। তিনি ছিলেন পরিচালকদের পছন্দের অভিনেতা—খলচরিত্র, পিতা, প্রহসনের চরিত্র কিংবা নাটকের কেন্দ্রীয় মুখ—সব ভূমিকায় সমান স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল।
গুরুত্বপূর্ণ বাংলা চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয়—
- শ্রীমান পৃথ্বীরাজ (১৯৭৩) – নায়িকার বাবা পান্নালাল
- অমানুষ (১৯৭৪) – খলনায়ক মহিম ঘোষাল
- ছুটির ফাঁদে (১৯৭৪) – উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা
- পালঙ্ক (১৯৭৫) – ধলার চরিত্রে
- দা (১৯৭৬) – রাসবিহারী
- ঝড় (১৯৭৯) – রাধাকান্ত দেব
- জয় বাবা ফেলুনাথ (১৯৭৮) – মগনলাল মেঘরাজ
- হীরক রাজার দেশে (১৯৮০) – হীরকরাজ
- আগন্তুক (১৯৯১) – মনোমোহন
- পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৯২) – হোসেন মিঞা
হিন্দি চলচ্চিত্রে তাঁর উল্লেখযোগ্য সাফল্যের একটি উদাহরণ হলো “ভুবন সোম” (১৯৬৯), যেখানে তিনি প্রধান চরিত্র সোন সাহেবের ভূমিকায় অভিনয় করে সর্বভারতীয় পরিচিতি ও প্রশংসা অর্জন করেন।
নাটক নির্দেশনা, রচনা ও প্রযোজনা
উৎপল দত্ত মূলত নাট্যব্যক্তিত্ব। তিনি নির্দেশনা, অভিনয়, রচনা ও প্রযোজনা—সবটিতেই ছিলেন সমান দক্ষ। ১৯৫৯ সালে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা মিনার্ভা থিয়েটারে নাট্যাভিনয় শুরু করেন। তাঁর প্রথম উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা “অঙ্গার”, যা বাংলা নাট্য ইতিহাসে এক যুগান্তকারী সংযোজন। এরপর একে একে মঞ্চে আসে—
- ফেরারী ফৌজ
- তিতাস একটি নদীর নাম
- রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট
- চৈতালী রাতের স্বপ্ন (মিডসামার নাইটস ড্রিম অবলম্বনে)
- কল্লোল (১৯৬৪) – ঐতিহাসিক নৌ বিদ্রোহ অবলম্বনে
“কল্লোল” নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার সময় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ চলছিল। এই নাটকের কারণে তাঁকে বিনা বিচারে গ্রেফতার করা হয়। শুধুমাত্র তাঁর নাটকে রাজনৈতিক বক্তব্য প্রচারের জন্য তাঁকে একাধিকবার কারাবরণ কিংবা আত্মগোপন করতে হয়েছে।
রাজনৈতিক নাট্যচর্চা
উৎপল দত্ত আজীবন বামপন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং সেই বিশ্বাস নাটকের মাধ্যমেও প্রচার করতেন। কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (CPI-M) এর প্রচারণায় নাটক ব্যবহার করতেন। তাঁর লেখা রাজনৈতিক নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
- দিন বদলের পালা (১৯৬৭)
- টিনের তলোয়ার (১৯৭০)
- ব্যারিকেড (১৯৭২)
- দুঃস্বপ্নের নগরী (১৯৭৫)
যাত্রাপালা: লোকনাট্যের শক্ত ভিত
নাটক ও চলচ্চিত্রের পাশাপাশি তিনি ১৯৬৮ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত সময়কালে ১৯টি যাত্রাপালা রচনা ও নির্দেশনা করেন। নিজের তৈরি যাত্রাদল—বিবেক নাট্যসমাজ, লোকনাট্য, গণবাণী, তরুণ অপেরা ইত্যাদি দলের মাধ্যমে তিনি অভিনয় ও নির্দেশনা করেন।
উল্লেখযোগ্য যাত্রাপালা—
- রাইফেল
- জালিয়ানওয়ালাবাগ
- দিল্লি চলো
- সন্ন্যাসীর তরবারী
- মাও সে তুং
- স্বাধীনতার ফাঁকি
- দামামা ঐ বাজে
নাট্যসাহিত্য ও প্রবন্ধ রচনা
উৎপল দত্ত ছিলেন একাধারে পত্রিকা সম্পাদক, প্রবন্ধকার ও গবেষক। তিনি সম্পাদনা করেন নাট্য পত্রিকা প্রসেনিয়াম (১৯৬২) এবং এপিক থিয়েটার (১৯৬৫)।
তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ—
- Towards a Revolutionary Theatre (প্রবন্ধ সংকলন)
- শেক্সপিয়ারের সমাজচেতনা
- গিরিশ মানস
- জপেনদা অপেন যা
- চায়ের ধোঁয়া
- প্রতিবিপ্লব
তিনি ছিলেন শেক্সপিয়ারের উপর ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান বিশ্লেষক এবং ইংরেজি নাটকেও ছিলেন সমান দক্ষ।
পরিচালনা ও সংগীত রচনা
উৎপল দত্ত ৫টি বাংলা চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
- ঘুম ভাঙার গান (১৯৬৫)
- ঝড় (১৯৭৯)
- বৈশাখী মেঘ (১৯৮১)
এই চলচ্চিত্রগুলোর চিত্রনাট্য নিজেই রচনা করেছেন এবং ঝড় ছবির গানে তিনি সুর ও কথা রচনা করেন।
পুরস্কার ও সম্মাননা
- ভরত পুরস্কার – ভুবন সোম চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য
- সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার – দু’বার ঘোষিত হলেও দ্বিতীয়বার তিনি প্রত্যাখ্যান করেন
ব্যক্তিগত জীবন
তাঁর স্ত্রী শোভা সেন নিজেও একজন খ্যাতিমান নাট্য ও চলচ্চিত্র অভিনেত্রী ছিলেন। দাম্পত্য জীবনে তাঁরা নাট্যচর্চায় ছিলেন একে অপরের পরিপূরক।

️ পরিচালিত চলচ্চিত্রসমূহ
উৎপল দত্ত শুধুমাত্র শক্তিশালী অভিনেতাই নন, ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ পরিচালকও। তাঁর পরিচালিত ছবিগুলোর বেশিরভাগই সামাজিক, রাজনৈতিক এবং নাট্যভাবনায় পরিপূর্ণ।
- মেঘ (১৯৬১)
- ঘুম ভাঙার গান (১৯৬৫)
- ঝড় (১৯৭৯)
- বৈশাখী মেঘ (১৯৮১)
- মা (১৯৮৪)
চলচ্চিত্রে অভিনয়: বছরভিত্তিক তালিকা
উৎপল দত্ত প্রায় পাঁচ দশক ধরে বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। নিচে তাঁর অভিনীত ছবিগুলোর ধারাবাহিক ও বছরভিত্তিক তালিকা তুলে ধরা হলো:
️ ১৯৫০–এর দশক
- ১৯৫০: মাইকেল মধুসূদন, সুধার প্রেম, বিদ্যাসাগর
- ১৯৫২: সিরাজদ্দৌলা, মহারাজা নন্দকুমার
- ১৯৫৩: রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, শেষের কবিতা
- ১৯৫৪: বিক্রম উজানী, মরণের পরে
- ১৯৫৫: রাণী রাসমণি, বীর হাম্বীর
- ১৯৫৬: মহাকবি গিরিশচন্দ্র, শুভলগ্ন, কীর্তিগড়, টাকা আনা পাই
- ১৯৫৭: হারানো সুর
- ১৯৫৮: যোগাযোগ, রাজধানী থেকে
- ১৯৬০: উত্তর মেঘ
- ১৯৬১: মেঘ, পঙ্কতিলক, দিল্লি থেকে কলকাতা, সপ্তপদী
️ ১৯৬০–এর দশক
- ১৯৬২: কাঁচের স্বর্গ, তরণীসেন বধ, রক্তপলাশ
- ১৯৬৩: অবশেষে, সূর্য্যশিখা, শেষ অঙ্ক
- ১৯৬৪: মোমের আলো
- ১৯৬৫: ঘুম ভাঙার গান
- ১৯৬৭: মহাশ্বেতা
- ১৯৬৮: চৌরঙ্গী
- ১৯৬৯: বিবাহ বিভ্রাট, অপরিচিত
️ ১৯৭০–এর দশক
- ১৯৭০: কলঙ্কিত নায়ক
- ১৯৭১: কুহেলি, খুঁজে বেড়াই, ফরিয়াদ
- ১৯৭২: কলকাতা ৭১, শেষ পর্ব
- ১৯৭৩: শ্রীমান পৃথ্বীরাজ, অগ্নিভ্রমর
- ১৯৭৪: বিসর্জন, শ্রাবণ সন্ধ্যা, আলোর ঠিকানা, রোদনভরা বসন্ত, অসতী, ফুলেশ্বরী, সাধু যুধিষ্ঠিরের কড়চা, বিকেলে ভোরের ফুল, অমানুষ, ঠগিনী, কোরাস
- ১৯৭৫: মর্জিনা আবদাল্লা, সেদিন দুজনে, ছুটির ফাঁদে, সেলাম মেমসাহেব, সংসার সীমান্তে, পালঙ্ক, স্বয়ংসিদ্ধা, নিশিমৃগয়া
- ১৯৭৬: জনঅরণ্য, স্বীকারোক্তি, মোহনবাগানের মেয়ে, আনন্দমেলা, অপরাজিতা, দত্তা, সেই চোখ, নিধিরাম সর্দার, দম্পতি, যুগমানব কবীর
- ১৯৭৭: অসাধারণ, বাবুমশাই, সিস্টার, প্রতিশ্রুতি, যুক্তি তক্কো আর গপ্পো, স্বাতী, মন্ত্রমুগ্ধ, আনন্দ আশ্রম, সানাই
- ১৯৭৮: ময়না, বন্দী, স্ট্রাইকার, ধনরাজ তামাং, লালকুঠী, জটায়ু, তিলোত্তমা
- ১৯৭৯: জয় বাবা ফেলুনাথ, নৌকাডুবি, বন্ধন
️ ১৯৮০–এর দশক
- ১৯৮০: পঙ্খীরাজ, ঘরের বাইরে ঘর, পাকা দেখা, শেষ বিচার, হীরক রাজার দেশে
- ১৯৮১: অনুসন্ধান, সুবর্ণ গোলক, বৈশাখী মেঘ, সাহেব, কলঙ্কিনী
- ১৯৮২: ঝড়, মেঘমুক্তি, প্রতীক্ষা, রাজবধূ, মাটির স্বর্গ
- ১৯৮৩: দুটি পাতা, শৃঙ্খল, ইন্দিরা, আগামী কাল
- ১৯৮৪: জয় পরাজয়, পূজারিণী, মা, রাশিফল
- ১৯৮৫: হরিশ্চন্দ্র শৈব্যা, টগরী, আহুতি, প্রতিজ্ঞা, ভালবাসা ভালবাসা, অন্যায় অবিচার
- ১৯৮৬: লালমহল, জীবন, উত্তরলিপি, পথভোলা
- ১৯৮৭: সম্রাট ও সুন্দরী, প্রতিকার, যার যে প্রিয়
- ১৯৮৮: প্রতিপক্ষ, আগুন, মধুবন, জ্যোতি, প্রতীক
- ১৯৮৯: আশা ও ভালোবাসা, বিদায়, গিলি গিলি গে, জজসাহেব, আক্রোশ, কড়ি দিয়ে কিনলাম, অঙ্গার
️ ১৯৯০–এর দশক
- ১৯৯০: অগ্নিকন্যা, কয়েদী, রক্তঋণ, গরমিল, ন্যায়দণ্ড, মহাজন, লড়াই
- ১৯৯১: অহংকার, পথ ও প্রাসাদ, মানমর্যাদা, শুভকামনা, পতি পরম গুরু, সজনী গো সজনী, নবাব
- ১৯৯২: মণিকাঞ্চন, পেন্নাম কলকাতা, আগন্তুক, মায়াবিনী
- ১৯৯৩: পদ্মা নদীর মাঝি, প্রান্ত পথিক, মিষ্টি মধুর
- ১৯৯৪: অজানা পথ
- ১৯৯৫: প্রতিধ্বনি, কেঁচো খুঁড়তে কেউটে, আবির্ভাব
- ১৯৯৭: প্রেম জোয়ারে
উৎপল দত্ত কেবল একজন অভিনেতা ছিলেন না—তিনি ছিলেন একটি আন্দোলনের নাম, একটি চেতনার ভাষ্যকার। তাঁর নাটক, অভিনয়, প্রবন্ধ এবং রাজনৈতিক অবস্থান যুগ যুগ ধরে অনুপ্রেরণা জোগাবে প্রগতিশীল নাট্যকর্মীদের। বাংলা ও ভারতীয় নাট্যজগতে উৎপল দত্ত আজও এক অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত।