উৎপল দত্তের প্রয়াণ দিবসে অভিনয় গুরুকুলের শ্রদ্ধাঞ্জলি

বাংলা নাটক ও চলচ্চিত্রের ইতিহাসে উৎপল দত্ত এমন এক মহীরুহ ব্যক্তিত্ব, যিনি শুধু অভিনেতা নন—ছিলেন নাট্যকার, নির্দেশক, অনুবাদক, সংগঠক এবং সমাজচিন্তার এক সংগ্রামী সৈনিক। তিনি ছিলেন একাধারে শিল্পী ও কর্মী, যিনি বিশ্বাস করতেন—“নাটক শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, নাটক হলো সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার।”

 

শৈশব ও শিক্ষা জীবন

উৎপল দত্ত ১৯২৯ সালের ২৯ মার্চ তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই নাটকের প্রতি ছিল তাঁর প্রবল আকর্ষণ। শিলং ও কলকাতায় শিক্ষালাভ শেষে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে ইংরেজিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। কলেজ জীবনে তিনি ইংরেজি সাহিত্যের নাটক নিয়ে গভীরভাবে পড়াশোনা শুরু করেন, যা পরবর্তীতে তাঁর মঞ্চজীবনের ভিত্তি গড়ে দেয়।

 

ইংরেজি নাট্যজীবন ও The Shakespeareans

প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন মূলত ইংরেজি নাটকের দাপুটে অভিনেতা। ১৯৪৯ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন নাট্যদল দ্য শেক্সপিয়ারিয়ান্স। এই দলের প্রযোজনায় Richard III-তে রিচার্ডের ভূমিকায় তাঁর অভিনয় সারা দেশকে তাক লাগিয়ে দেয়। কেবল দেশেই নয়, বিদেশেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। পরে এই দলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় লিটল থিয়েটার গ্রুপ

 

বাংলা নাটকে আগমন ও গণনাট্য আন্দোলন

ইংরেজি নাটক থেকে বাংলা নাটকে আসার মধ্য দিয়ে উৎপল দত্ত যুক্ত হন সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে। তিনি যুক্ত হন গণনাট্য সংঘ-এর সঙ্গে এবং হয়ে ওঠেন গণনাট্য আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। তাঁর লেখা ও মঞ্চস্থ নাটকগুলো যেমন টিনের তলোয়ার, কল্লোল, অঙ্গার, মানুষের অধিকার, আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক ও কালজয়ী।

  • কল্লোল নাটকে তিনি ১৯৪৬ সালের নৌবাহিনী বিদ্রোহের কথা ফুটিয়ে তুলেছিলেন, যা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
  • টিনের তলোয়ার এবং অঙ্গার-এ তিনি সমাজের শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠস্বর হয়েছিলেন।

তিনি বিশ্বাস করতেন—নাটক মানেই সংগ্রাম, মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।

 

অনুবাদ ও বিশ্বনাট্য মঞ্চস্থ

শেক্সপিয়ার, ব্রেখট, গোর্কি থেকে শুরু করে বিশ্বসাহিত্যের বহু নাটক তিনি অনুবাদ ও মঞ্চস্থ করেছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি বাঙালি দর্শকদের সামনে বিশ্বনাট্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন।

 

চলচ্চিত্রে অবদান

চলচ্চিত্রে তাঁর প্রতিভা সমান উজ্জ্বল। বাংলা ও হিন্দি সিনেমা উভয় ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন অপরিহার্য নাম।

  • হিন্দি সিনেমায় কৌতুকাভিনেতা:
    গুড্ডি (১৯৭১), গোলমাল (১৯৭৯), নরমগরম, রঙবিরঙ্গি, শৌকিন—এই ছবিগুলোতে তাঁর কৌতুকাভিনয় তাঁকে সর্বভারতীয় দর্শকের প্রিয় করে তোলে। গোলমাল-এ তাঁর কঠোর অথচ হাস্যরসাত্মক চরিত্র আজও অমলিন।
    → এ অভিনয়ের জন্য তিনি পান ফিল্মফেয়ার পুরস্কার
  • বাংলা সিনেমায় গম্ভীর চরিত্র:
    সত্যজিৎ রায়ের আগন্তুক, জনঅরণ্য, হীরক রাজার দেশে,
    মৃণাল সেনের ভুবন সোম,
    গৌতম ঘোষের পদ্মা নদীর মাঝি—সবগুলোতেই তাঁর অভিনয় বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সোনালি অধ্যায়।
  • খলনায়ক চরিত্র:
    অমানুষ, বরসাত কি এক রাত প্রমাণ করেছে, তিনি কেবল কৌতুক বা গম্ভীর চরিত্রেই নয়, খলচরিত্রেও ছিলেন দুর্দান্ত।

 

️ রাজনৈতিক জীবন ও সংগ্রাম

উৎপল দত্ত ছিলেন দৃঢ় বামপন্থী। সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় বিশ্বাসী তিনি নাটককে ব্যবহার করেছেন রাজনৈতিক ও সামাজিক বার্তা পৌঁছে দিতে। এই কারণে তাঁকে ১৯৬৫ সালে কারাবাসও ভোগ করতে হয়। কিন্তু জেলেও থামেননি—বরং আরও শক্তিশালীভাবে লিখেছেন ও ভেবেছেন নাটকের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের পরিকল্পনা।

 

নাট্যচিন্তা ও দর্শন

উৎপল দত্ত মনে করতেন—
“শিল্পী কেবল বিনোদন দেবে না, শিল্পী সমাজের দায়িত্ব নেবে।”
তাঁর নাটকগুলো সাধারণ মানুষকে আন্দোলিত করেছিল। মঞ্চকে তিনি দেখতেন আন্দোলনের মঞ্চ হিসেবে, যেখানে শোষণ, দারিদ্র্য, বৈষম্য ও রাজনৈতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা যায়।

 

পুরস্কার ও স্বীকৃতি

  • ফিল্মফেয়ার পুরস্কার (সেরা কৌতুকাভিনেতা)
  • পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নাট্য পুরস্কার
  • থিয়েটারে অনন্য অবদানের জন্য নানা সংস্থার সম্মাননা
  • মৃত্যুর পর তাঁকে আরও বহু আন্তর্জাতিক ও জাতীয় স্বীকৃতিতে ভূষিত করা হয়েছে।

 

️ শেষ জীবন ও প্রয়াণ

১৯৯৩ সালের ১৯ আগস্ট, মাত্র ৬৪ বছর বয়সে উৎপল দত্তের জীবনাবসান ঘটে। তাঁর প্রয়াণ বাংলা সংস্কৃতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। তবে তাঁর রেখে যাওয়া নাটক, চলচ্চিত্র, দর্শন আজও জীবন্ত এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করছে।

 

উৎপল দত্ত

 

উৎপল দত্ত ছিলেন কেবল শিল্পী নন—তিনি ছিলেন চিন্তাবিদ, সংগ্রামী কণ্ঠস্বর এবং সংস্কৃতির বিপ্লবী সৈনিক। নাটক ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছেন, শিল্পই পারে সমাজকে বদলাতে।

আজ তাঁর ৩২তম প্রয়াণবার্ষিকীতে আমরা গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি— উৎপল দত্ত, যিনি আজও আমাদের মঞ্চ পর্দায় বেঁচে আছেন।