ঋত্বিককুমার ঘটক জন্ম বাংলাদেশের ঢাকায়, আদি বাড়ি পূর্ববঙ্গের পাবনা জেলায়। পিতা ছিলেন সরকারি কর্মচারী। বড় ভাই মণীশ ঘটক (যুবনাশ্ব) কল্লোল যুগের খ্যাতনামা সাহিত্যিক। প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় পূর্ববঙ্গে। রাজশাহী কলেজ থেকে আই. এ. পাস করেন। দেশ বিভাগের ফলে পরিবার পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুরে চলে আসে। বহরমপুর কলেজ থেকে ইংরাজিতে অনার্স নিয়ে বি.এ. পাস করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ. পড়তে ভর্তি হন। পাঠ্যক্রম শেষ করেও পরীক্ষা দেন নি। এই সময় থেকেই ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সাথে যুক্ত হন।
ঋত্বিককুমার ঘটক
ছোটবেলায় বাড়িতে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বড় হয়েছেন। বাড়িতে এবং পাড়ায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাচ-গান-অভিনয়ে অংশ নিয়েছেন। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সেন্ট্রাল স্কোয়াডের দায়িত্বেও ছিলেন, বিসর্জন নাটকে রঘুপতির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। এই সময়ে তাঁর লেখা মৌলিক নাটক জ্বালা (১৩৭৫), দলিল (১৩৭৫) ইত্যাদি। এ ছাড়াও ব্রেখট-এর লেখা ‘লাইফ অফ গ্যালিলিও’ অবলম্বনে ‘গ্যালিলিও চরিত’ অনুবাদ করেন।
গণনাট্য সংঘ প্রযোজিত কয়েকটি নাটকে নির্দেশনার সাথে সাথে অভিনয়ও করেছিলেন। ১৯৪৮-৫৪ গণনাট্য সংঘের সক্রিয় সদস্যদের মধ্যে অন্যতম ঋত্বিক ১৯৫৩ সালে বম্বেতে অনুষ্ঠিত IPTAর সারা ভারত সম্মেলনে প্রতিনিধি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। ঐ বছর তাঁর লেখা দলিল নাটকটি সর্বভারতীয় IPTA সম্মেলনে বাংলার পক্ষ থেকে পাঠানো হয়েছিল।
মতান্তরের কারণে ১৯৫৪ সালে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করেন। ১৯৫৪ সালে একই কারণে CPIর সাথেও সম্পর্ক ছেদ হয়।
চলচ্চিত্র শিল্পের সাথে যুক্ত হন ১৯৫০ সালে বিমল রায় প্রযোজিত এবং মনোজ ভট্টাচার্য পরিচালিত তথাপি (১৯৫০) ছবিতে সহ পরিচালক হিসাবে কাজ করেন, পরে নিমাই ঘোষ পরিচালিত ছিন্নমূল (১৯৫১) ছবিতে অভিনয়ও করেছিলেন। তাঁর পরিচালনায় প্রথম ছবি নাগরিক তৈরি হয় ১৯৫৩ সালে। কিন্তু ঐ সময় ছবিটি মুক্তি পায় নি। তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৭৭ সালে ছবিটি মুক্তি পায়।
১৯৫৫ সালে সুরমা ভট্টাচার্যের সাথে তাঁর বিয়ে হয় বোম্বের ফিল্মিস্থান স্টুডিওতে কাহিনি ও চিত্রনাট্যকার হিসাবে যোগ দেন। বিমল রায়ের মধুমতী (১৯৫৮) ছবির চিত্রনাট্য রচনা করেন। হৃষিকেশ মুখার্জীর মুসাফির (১৯৫৭) ছবির চিত্রনাট্য রচনায় পরিচালকের সাথে যুগ্ম দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫৮ সালে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন এবং অযান্ত্রিক (১৯৫৮) ছবিটি পরিচালনা করেন। এই ছবি মুক্তি পাওয়ার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সভায় নীহাররঞ্জন রায়, নির্মল সিদ্ধান্ত ইত্যাদি ব্যক্তিগণ ঋত্বিক ঘটককে সম্মানিত করেন। মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০) ছবিতে দেশ ভাগ এবং উপাত্ত জীবনের পটভূমিকায় একটি মেয়ের আত্মত্যাগের কাহিনি ভিন্নধর্মী পরিচালক হিসাবে তাকে পরিচিতি এনে দেয়।
কোমল গান্ধার (১৯৬১) ছবিটি মুক্তির পর গণনাট্য আন্দোলনকে বিকৃত ভাবে উপস্থাপিত করার দায়ে বামপন্থী বন্ধুদের দ্বারা ধিকৃত হন। স্বাধীনতা পত্রিকাতে ছবিটির বিরূপ সমালোচনা প্রকাশিত হয়। তৎকালীন পত্রপত্রিকায় ছবির বিরূপ সমালোচনার বিরুদ্ধে ধ্রুব গুপ্ত, মৃগাঙ্কশেখর রায়ের লেখা প্রবন্ধগুলি ছবিটির যথার্থ মূল্যায়নে সাহায্য করে। ১৯৬০-৬৫ এই পাঁচ বছরে তাঁর লেখা চিত্রনাট্য অবলম্বনে অসিত সেন পরিচালিত স্বরলিপি (১৯৬০), চিত্ররথ পরিচালিত কুমারী মন (১৯৬২), গুরু বাগচী পরিচালিত দ্বীপের নাম টিয়ারং (১৯৬৩) এবং সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত রাজকন্যা (১৯৬৫) নির্মিত হয়।
সুবর্ণরেখা (১৯৬২) ছবিটি পরিচালনার পর তিনি ভিজিটিং প্রফেসর হিসাবে পুনায় অবস্থিত FTIIতে যোগ দেন (১৯৬৪-৬৫)। ঐ সময় তাঁর ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কুমার সাহানি, মণি কাউল প্রভৃতি। পরে তিনি FTILএর ভাইস-প্রিন্সিপলও হয়েছিলেন। ভারত সরকার ১৯৬৯ সালে তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করে। এই বছরই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর প্রদত্ত ভাষণে কিছু রাজনৈতিক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।
১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসাবে বাংলাদেশে যান। অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩) ছবির শুটিং-এর কাজ শেষ করেন। ছবিটি ভারতে মুক্তি পায় ১৯৯১ সালে। তাঁর শেষ ছবি যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৪)। ছবিটি শ্রেষ্ঠ কাহিনির (১৯৭৫) জন্য রাষ্ট্রীয় পুরস্কার লাভ করে। অসম্পূর্ণ এবং মাঝপথে পরিত্যক্ত ছবি বাদ দিয়ে তিনি আটটি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র, ৪টি তথ্যচিত্র, ৫টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চিত্র এবং একটি বিজ্ঞাপনী চিত্র নির্মাণ করেন। ১৯৭৬ সালে তার জীবনাবসান হয়।

চলচ্চিত্রপঞ্জি —
- নাগরিক (১৯৫৩),
- ওঁরাও (তথ্যচিত্র, ১৯৫৫),
- অযান্ত্রিক (১৯৫৮),
- বাড়ী থেকে পালিয়ে (১৯৫৯),
- মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০),
- কোমল গান্ধার (১৯৬১),
- সুবর্ণরেখা (১৯৬২),
- সিজারস (বিজ্ঞাপন চিত্র),
- ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান (তথ্যচিত্র, ১৯৬৩),
- ফিয়ার (স্বল্পদৈর্ঘ্য, ১৯৬৪),
- রঁদেভু (স্বল্পদৈর্ঘ্য, ১৯৬৫),
- সায়েন্টিস্টস অফ টুমরো (তথ্যচিত্র, ১৯৬৭),
- পুরুলিয়ার ছৌ (তথ্যচিত্র, ১৯৭০),
- আমার লেনিন (স্বল্পদৈর্ঘ্য), ১৯৭০),
- ইয়ে কিউ (স্বল্পদৈর্ঘ্য), ১৯৭০),
- দুর্বার গতি পদ্মা (স্বল্পদৈর্ঘ্য, ১৯৭১),
- তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩),
- যুক্তি তক্কো আর গল্পো (১৯৭৪)।
রচিত গ্রন্থ—
- ঋত্বিক ঘটকের গল্প (১৯৮৭)।
- গ্যালিলিও চরিত (১৩৭২)।
- চলচ্চিত্র মানুষ এবং আরও কিছু ১ম খণ্ড (১৩৮২)।
- জ্বালা (নাটক, ১৩৭৫)।
- দলিল (নাটক, ১৯৫২)।
- মেঘে ঢাকা তারা (চিত্রনাট্য, ১৯৯৯)।
- Cinema and 1 (1987)।
- On Cultural Front (1997) Rows and Rows of Fences Ritwik Ghatak on Cinema (2000)।
- Ritwik Ghatak Stories Translated from Bengali by Rumi Ray (2000).
সহায়ক গ্রন্থ ও পত্রিকা —
- ঋত্বিক।
- সুরমা ঘটক।
- কলকাতা, আশা প্রকাশনী ১৩৮৪।
- ঋত্বিক ও তাঁর ছবি, ১ম খণ্ড।
- সম্পাদনা রজত রায়।
- কলকাতা, সাম্প্রতিক, ১৯৭১।
- ঋত্বিক ও তাঁর ছবি ২য় খণ্ড।
- সম্পাদনা রজত রায়।
- কলকাতা, অন্নপূর্ণা, ১৯৮৩।
- ঋত্বিককুমার ঘটক।
- সম্পাদনা রজত রায়।
- কলকাতা, সৃষ্টি, ২০০১।
সাক্ষাৎ ঋত্বিক, সম্পাদনা শিবাদিত্য দাশগুপ্ত ও সন্দীপন ভট্টাচার্য। কলকাতা, দীপায়ন,২০০০।
Ritwik Ghatak A Monograph. Edited by Shampa Bandyopadhyay MD. DFF 1982 Ritwik Kumar Ghatak A Monograph by Haimanti Banerjee Pune. MFAI, 1985. Ritwik Ghatak A Return to Epic by Asish Rajadhyaksha Bombay, Screen Unit, 1982 Ritwik Ghatak Arguments/Stories Edited by Asish Rajadhyaksha and Amrit Gangar Bombay, Screen Unit, 1987
The Cinematic will of Ritwik Kumar Ghatak Calcutta, Papyrus, 2001 বিভিন্ন সময়ে চিত্রপট, চিত্রবীক্ষণ, চিত্রভাবনা, দৃশ্য, পটভূমি, বিজ্ঞাপনপর্ব, মুভি মনতাজ, অযান্ত্রিক ইত্যাদি পত্রিকা ঋত্বিক ঘটকের উপর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে।
আরও দেখুনঃ