এক অসমাপ্ত গানের বেদনা – মামুনুর রশীদ

এক অসমাপ্ত গানের বেদনা : সোলায়মানের এক জোড়া চোখ ছিল। সাধারণভাবে বলা হয় চোখ দুটি স্বপ্নিল কিন্তু ওর ক্ষেত্রে তা নয়। চোখ দুটি গীতল এবং সঙ্গীতময়। মনে হয় চোখের পলকেই যেন এককলি গান বেরিয়ে আসবে কণ্ঠে, তার চোখে চোখ দিয়ে সে সঙ্গীত নির্মাণ করতে পারতো।

সোলায়মানের কণ্ঠ ছিল ভেজা। ভেজা কণ্ঠের মধ্যেই অবলীলায় ধরা দিতো স্বরলিপি। এই স্বরলিপিগুলোই কালক্রমে ধরা দিয়েছে তার সংলাপে।

ওর জন্ম আসামে। আসামের মাটি আর্দ্র। শীতাক্রান্ত। সেখান থেকেই তার বুকের মধ্যে সঙ্গীত বাসা বেঁধেছিল কিনা তা আমাদের জানা নেই। বুক ভরা গান নিয়ে এক দুরন্ত বালক-কিশোর পরবর্তীকালে এসেছিল নাটকে। মাঝখানে রাজনীতির একটা ঝোড়ো হাওয়া তাকে তছনছ করে দিতে চেয়েছিল। তার বন্ধুদের কাছে যতোটা জানা যায় সঙ্গীতপাগল ছেলেটি একসময় রাজনীতিরও দামাল ছেলে হয়েছিল।

আর সে রাজনীতিটাও সুবিধাবাদের রাজনীতি নয়। একেবারেই গণমানুষের মুক্তির রাজনীতি। সে রাজনীতিটাও যখন ভ্রান্ত পথের হাওয়ায় পাল তুললো তখন সোলায়মানের বুকে টান পড়লো। সে সম্পূর্ণভাবেই ফিরে এলো শিল্পের সংসারে। সঙ্গীতের সংসার থেকেও সে আবদ্ধ করলো নিজেকে নাটকে।

মামুনুর রশীদ
মামুনুর রশীদ

নাটক এক সর্বগ্রাসী শিল্প। এ শিল্প সবকিছুকে তছনছ করে দেয়। একদিকে শিল্পের প্রতিনিয়ত অন্বেষণ, সমসাময়িকতা, তার সাথে আবার সংগঠন। এ দু’য়ের মিলন ঘটানো সত্যিই কঠিন। শিল্পী একা ছবি আঁকে, গায়ক একাকী গান গাইতে পারে, কবি তার কাব্যচর্চাটিও নীরবে নিভৃতে করতে পারে। কিন্তু নাটক একাকীর কাজ নয়। বরং সমন্বয় ঘটাতে হয়। এক ধরনের সমাজই তৈরি হয়ে যায়। সেই সমাজের সাংগঠনিক শক্তিই একটা সমন্বিত শিল্পের জন্ম দেয়। আবার এই শিল্পের চর্চায় এসে এক ধরনের অহঙ্কারও জন্ম নেয়।

যে সোলায়মান চোখ দিয়ে গান বানাতে পারে, সংলাপ নির্মাণ করতে পারে তার পক্ষে এই সংগঠনের কাজ করা কতোটা নিরাপদ?

তারপরও সে তা করতে পেরেছিল। বলতে গেলে তাকে ঘিরেই একটা দল দাঁড়িয়ে যেত। একটা অসমাপ্ত জীবনে সে অনেকগুলো সংগঠনের সৃষ্টিশীল নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হয়েছিল। শুরু তার কালান্তর দিয়ে। তারপর, পদাতিক নাট্য সংসদ, ঢাকা পদাতিক, অন্যদল নাট্য সম্প্রদায়, থিয়েটার আর্ট, থিয়েটার আর্ট ইউনিট। এও অবশ্য বাংলা নাটকের নিয়তির মতো। সেই গিরীশের কাল থেকে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত কোনো প্রতিষ্ঠাতা নির্দেশকই নিজের দলে থাকতে পারেননি। দল পাল্টাতে বা নতুন দল করতে হয়েছে। সংঘবদ্ধ কোনো কাজে বাঙালির সুদীর্ঘ সুস্থিতি অস্বাভাবিক।

সোলায়মানের শিকড় যেহেতু স্বরলিপিতে প্রোথিত, তাই দেখা গেছে একটা প্রবল ঝোঁক তার থেকে গেছে গীতল প্রযোজনায়। গীতি সমৃদ্ধ নাট্যের প্রতি তার আগ্রহ ছিল। প্রবল। সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছে সেখানেই। এখান থেকেই বাংলা নাটকের আদি জায়গাটা যেখানে সঙ্গীত দখল করে রেখেছিল প্রায় সবটাই, সেখানে প্রবেশ করেছিল সে। বাংলার জনপ্রিয় গানগুলোও দেখা গেছে নাটক থেকেই এসেছে। তাই পাশ্চাত্যের ধাঁচে (তখনো সোলায়মান পাশ্চাত্যে যায়নি) সে নির্মাণ করছে এদেশের উপযোগী মিউজিক্যাল।

এ আবার গীতিনাট্য নয়, নৃত্যনাট্য নয়। একেবারেই দেহের ভাষা, কোরিওগ্রাফি ব্যবহার করে অভিনয়। Musical demonstration নয়, একেবারেই নাট্যের ব্যবহার। এ কাজ করতে গিয়ে সে খুঁজে বেড়িয়েছে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের নাট্যসম্ভার। তার নাটক ইঙ্গিত যখন অভিনীত হচ্ছিল তখন চারদিকে একটা হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল। একদিকে সঙ্গীতের ব্যবহার, ক্ষুরধার সংলাপ, দলগত এবং ব্যক্তিগত অভিনয়, অন্যদিকে অত্যন্ত সময়োপযোগী বিষয়বস্তু আহরণ।

অত্যন্ত ছোট্ট একটি পথনাটক খ্যাপা পাগলার প্যাচালও এক সময় ঝড় তুলেছিল আমাদের নাট্যক্রিয়ায়। সোলায়মানের অভিনয়টাও বেশ খুলেছিল সেখানে। সোলায়মান নাটকের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করেছে। রচনা, নির্দেশনা, অভিনয়, সঙ্গীত পরিচালনা, সুরস্রষ্টা এবং সংগঠক।

নাট্য রচনার ক্ষেত্রে তার একটা প্রহসনপ্রিয়তা সমসময়ই লক্ষ্য করা যায়। সেই প্রহসনের মধ্য থেকে একটা বিনোদন এবং বক্তব্য প্রাধান্যও খুব সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়।

google news , গুগল নিউজ
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

সোলায়মান তীব্রভাবে ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা আর কূপমণ্ডূকতা-বিরোধী। ব্যঙ্গ কৌতুক, বিদ্রূপে, ক্ষুরধার সংলাপে সে তছতছ করে দিতে চাইতো এসবকে। এই জায়গায় সে ছিল মারাত্মকভাবে আপোসহীন। এই দেশে এই বেশে নাটকে সে অসম সাহসের সাথে এসব প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াই ঘোষণা করেছে। গান যে কতোটা বিদ্রূপে সহায়তা করতে পারে তার উদাহরণ মেলে তার প্রায় প্রতিটি নাটকে।

যেমন সে সোচ্চার স্বৈরাচারী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে, তেমনি নির্বাচনী প্রহসনকেও ছেড়ে কথা বলেনি। এলেকশান ক্যারিকেচার নাটকে রফিক উদ্দিন বি.এ.কে উপস্থাপন করে আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নির্বাচনী দুর্বলতাকে তুলে ধরেছে। এলেকশান ক্যারিকেচার পড়লে মনে হয় আজকের দিনে তার আবেদন বোধহয় বহুগুণে বেড়েছে। আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটি যে ক্রমেই মুখ থুবড়ে পড়ছে তার পেছনে হয়তো নির্বাচন প্রক্রিয়াটা একটা বড় ব্যাপার। সোলায়মান বিষয়টি বহু আগেই বুঝতে পেরেছিল।

সোলায়মানের কোনো একটি নাটক নিয়ে আলোচনা করতে বিশাল পরিসর প্রয়োজন। হয়তো ভবিষ্যতে কোনো সোলায়মান গবেষক এই কাজটি করবেন। তবে তার অনুরাগী দর্শক হিসেবে কিছু নাটকের আলোচনা প্রাসঙ্গিক। গনি মিয়া একদিন সোলায়মানের এক অসাধারণ রচনা এবং প্রযোজনাও। গ্রাম থেকে শহর, শহর থেকে রাষ্ট্রে, সামন্তবাদ থেকে বেনিয়া পুঁজি এবং আকণ্ঠ নিমজ্জিত ধর্মবিশ্বাসকে এক সুনিপুণ ব্যঞ্জনায় তুলে ধরেছে।

বেহেশত-দোজখের প্রচলিত বিশ্বাসকে এক আশ্চর্য সাঙ্গীতিক দ্যোতনা দেয়া হয়েছে। কোরাসের ব্যবহারে সোলায়মানের কোনো তুলনা নেই। কোরাসকে প্রাণবন্ত করে তোলার ব্যাপারে তার মুন্সিয়ানা অবাক করার মতো। গনি মিয়ার মধ্যে আমরা একটা অদ্ভুত ডায়লেকটিস পাই।

একদিকে তার আদর্শবোধ, শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি সততা, অন্যদিকে তার হারিয়ে যাওয়া পিতৃপুরুষের সম্পদ ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, সর্বোপরি তার ধমনিতে প্রবহমান সামন্তবাদ মিলে যে গনি মিয়া সৃষ্টি হয়, তা একজন অত্যন্ত রাজনীতিচেতন শিল্পীর পক্ষেই করা সম্ভব। মানুষের সকল আদর্শবাদ যে কীভাবে ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষার কারণে ধ্বংস হয়ে যায় গনি মিয়া তার এক জলজ্যান্ত প্রমাণ।

 

আমাদের প্রচলিত লোকসঙ্গীতও এক যথার্থ আধুনিকতায় এখানে ব্যবহৃত হয়েছে। এক জায়গায় গনি মিয়া বলছে, ‘দুনিয়া লোভী অন্যের মাথায় কাঁঠাল ভাইঙ্গা নিজের ফায়দা লুটে। আর আখিরাতের লোভী দুনিয়ার রস থেইক্যা নিজেরে বঞ্চিত কইরা সারাটা জীবন মইরা থাকে। এমনি অসংখ্য ক্ষুরধার সংলাপে সমৃদ্ধ গনি মিয়া একদিন। তেমনি তার ইঙ্গিত নাটকও।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পালাবদল, সংস্কৃতিতে তার প্রতিফলন এবং তার মধ্য দিয়ে যে একটা কুৎসিত ব্যবস্থার দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি তার ইঙ্গিত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবে এখানে দেখা যায়। একজন নাট্যকার যথার্থই তার সময়ের এবং আগামীর কথা এভাবেই বলে থাকে। রূপান্তরেও সোলায়মানের ছিল একান্ত নিজস্ব স্টাইল। গোগোলের ইন্সপেক্টর জেনারেলের যে রূপান্তর সে করেছিল, তা সত্যিই অভিভূত হওয়ার মতো।

আমলাতন্ত্রের প্রকৃতি একেক দেশে একেকরকম। আমাদের দেশে আমলাতন্ত্রের ভেতরের এবং বাইরের চেহারাটা ধরতে পারা এবং তাকে যথার্থভাবে প্রয়োগই ছিল তার সার্থকতা। আবার যখন সে দারিও ফো’র নাটকের রূপান্তর করে তখন তা হয়ে দাঁড়ায় একান্ত মৌলিক।

আহ্ কমরেড নাটকে যে অসাধারণ রাজনৈতিক ব্যঙ্গ অত্যন্ত সাহসের সাথে তুলে ধরে তা দেখে চমকে যেতে হয়। এসব নাটকে তার সহকর্মী ছিল জামিল আহমেদ। ভারতের ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা থেকে পাস করে আসা তরতাজা তরুণ জামিলের সাথে একটা চমৎকার বোঝাপড়া হলো তার। সেই বোঝাপড়ার ফসলটা বেশ ভালোই ফলেছিল।

 

মামুনুর রশীদ
মামুনুর রশীদ

 

সোলায়মান যেভাবে স্বদেশ দীপকের কোর্ট মার্শাল একেবারেই আমাদের দেশের সেনাবাহিনীর কোর্ট মার্শাল করে তুলেছিল তা সত্যিই ভাববার মতো। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকেও সে চমৎকারভাবে তুলে নিয়ে এলো এ নাটকে। তাই উষা গাঙ্গুলীর নির্দেশনার সাথে সোলায়মানের নির্দেশনার মৌলিক পার্থক্যগুলো বড়ভাবে চোখে ধরা পড়ে। অনেক বাঙালি দর্শককে বলতেও শুনেছি, এ তো আমাদের গল্প।

লোকসঙ্গীতের ওপর সোলায়মানের যে দখলটা ছিল তার কারণ লোককাহিনীর প্রতি তার কৌতূহল, বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলের। তার একাধিক নাটকে লোককাহিনীর এই পরম্পরাগুলো লক্ষণীয়। এইখানেই তার ঈর্ষণীয় কাজ নছর মালুম ও ভেলুয়া সুন্দরী অবলম্বনে আমিনা সুন্দরী। আমিনা সুন্দরী যখন সোলায়মানের হাতে মঞ্চে আসে তখন সকল আধুনিকতা নিয়েই তা উপস্থিত হয়। তাতে লোককাহিনীর সম্পদ যেমন রক্ষিত হয় সযত্নে, আবার নাট্য উপাদানগুলোও নতুন করে যুক্ত হয়।

গোলাপজান গল্প অবলম্বনে নাট্যরূপায়ণ ও রূপান্তর। একেবারেই আধুনিক গল্প। পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ঘুড়ি ওড়ানোর দৃশ্যটি সাঙ্গীতিক ব্যঞ্জনায় অপরূপ হয়ে ফুটে উঠেছিল। পুরনো গানকে ব্যবহার করে একক অভিনয়ের এক নিরীক্ষা বেশ ভালোভাবেই উত্তরে গেল।

সোলায়মানের নাট্যরচনায় বহুমুখিনতা এক আশ্চর্য দক্ষতার পরিচায়ক। মৌলিক নাট্যরচনায়, রূপান্তরের অনায়াস দক্ষতা ছিল তার। অনুবাদ সে করেনি। হয়তো মৌলিক সৃষ্টিকে অধিকার করে আবার অন্য মৌলিকতা খুঁজেছে। আবারও বলতে হয়, এক অসমাপ্ত জীবনে তার সৃষ্টিশীল জীবনের বয়স ২৫ বছর, তার মধ্যেই সে শুধু মঞ্চের জন্য মৌলিক নাটক রচনা করেছে তেরটি, রূপান্তর করেছে আঠারটি।

 

এই স্বল্পসময়ে ভীষণ নাট্যাক্রান্ত মানুষ না হলে কী করে সম্ভব এতো নাটক লেখা? অবাক লাগে একটা সৃষ্টিশীল ঘোরের মধ্যে থাকতো বলেই হয়তো তা সম্ভব হয়েছে।

নির্দেশক হিসেবে বলতে গেলে আবার একটি কথার পুনরাবৃত্তি করতেই হয়। সোলায়মান সেখানেও প্রেরণা গ্রহণ করতো সম্ভবত সঙ্গীত থেকেই। কোর্ট মার্শাল-এর নির্দেশনায় কাজ করার সময় তাকে ভীষণ উদ্বিগ্ন দেখেছি শেষ দৃশ্যের সঙ্গীতের ভাবনাটা নিয়ে। সুধীরলালের সেই অমর গানকে ব্যবহার করেছিল, মধুর আমার মায়ের হাসি..।

কী যন্ত্র ব্যবহার করা যায়, গায়কিটা কেমন হবে এই নিয়ে ভাবনার অন্ত ছিল না। কোর্ট মার্শাল সবটাই সংলাপ। তার মধ্যে সঙ্গীতের ব্যবহারের জায়গা খুবই কম। ঐটুকু ছোট্ট জায়গাতেই তাঁর কাজটুকু করে ফেলেছিল। নির্দেশনায় দেহের ভাষা ব্যবহারে সে ছিল ভীষণ আগ্রহী। এই দেহের ভাষাই একটা কোরিওগ্রাফি নির্মাণ করতো। অঙ্গ সঞ্চালন এবং তার সাথে সাথে মুভমেন্ট দিয়ে এমন একটা energy সৃষ্টি করতো যে তা কেবল সোলায়মানের পক্ষেই সম্ভব ছিল।

 

অভিনয়েও তাঁর ছিল এক বিশেষ স্বাতন্ত্র্য। মনে হতো সে যেন ব্যাখ্যা করছে চরিত্রগুলোকে। স্তালিনাভস্কির চাইতে ব্রেখটকে এক্ষেত্রে বেশি অনুসরণ করতো। এক কৌতুকময়তা তাকে ঘিরে রাখতো প্রায় সময়ই। ঠোঁটের স্বভাবসুলভ মিষ্টি হাসিটি কখনো ম্লান হয়নি। যেহেতু কণ্ঠটি সুরেলা, তাই সংলাপটিও তার কণ্ঠে বড় মিষ্টি লাগতো। তার জীবনের এতো কাজ, এতো বিচিত্রমুখী সেগুলো যে তাকে ব্যাখ্যা করা কারো একার পক্ষে সম্ভব নয়।

সোলায়মানের দ্বিতীয় কর্মক্ষেত্র হিসেবে একসময় পরিচিত ছিল নিউইয়র্ক। থিয়েটার অব আমেরিকার আতিথেয়তায় ও আমন্ত্রণে সেখানে বছরের পর বছর গেছে। সেখানকার সদস্যরা সবাই প্রবাসে নানা ধরনের কাজের সঙ্গে । সোলায়মান প্রবাসীদের থিয়েটারকে একটা পেশাদারি পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। নিউইয়র্কের অফ অফ ব্রডওয়েতে প্রথম তার নির্দেশিত নাটক অভিনীত হয় বাংলা ভাষায়। এ বিরল কৃতিত্বের দাবিদার থিয়েটার অফ আমেরিকা এবং এস এম সোলায়মান।

 

সেখানে ব্যস্ত এসব কর্মজীবী শিল্পীদের জীবনে সে থিয়েটারের জন্য এক নবতর প্রেরণা সৃষ্টি করতে পেরেছিল। সেখানকার সদস্যরা বলেছেন, সোলায়মান প্রচণ্ড ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করতো কখন শিল্পীরা আসবে। তাদের সমস্যা বুঝে তার মধ্যেই সময় বের করে নাটক নামাবার ব্যবস্থা করতো। শিল্পীরা অবশ্য এক পর্যায়ে নিয়মিতভাবে দিনের পর দিন মহড়া করে নাটক মঞ্চে নিয়ে আসতো। এক চমৎকার থিয়েটারের সংস্কৃতিও সে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল।

মানুষ হিসেবে সে ছিল সম্পূর্ণ শিল্পী। শিল্পী স্বাভাবিক বিষয়-আশয়ী মানুষ নয়। তাকে দায়িত্বহীন হতেই হয় কোনো সময়। এ যেন এক অনিবার্যতা। সমাজের মানুষের সার্থকতা অর্থ উপার্জনে। জীবিকা একটা বড় প্রয়োজন সেখানে। কিন্তু শিল্পী হয়তো সেখানে সবচেয়ে ব্যর্থ। শিল্পী চাকুরেও হতে পারে না। সে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে সোলায়মান। এ ব্যর্থতার দায়ভার সোলায়মানকে দিয়েই বা কী হবে? এক্ষেত্রে তো প্রকৃত শিল্পীরা সবাই এক। তবে বিভিন্ন যুগে শিল্পের ব্যবসায়ীরও অভাব নেই, শিল্পের ব্যবসাটা যারা ভালোভাবেই করতে পারেন।

 

সোলায়মানের আরো একটি বড় ব্যর্থতা হচ্ছে প্রিন্ট মিডিয়াকে ব্যবহার করতে না পারা। আপাতদৃষ্টিতে এ এক হাস্যকর ব্যর্থতা যদিও। এই একটি জায়গায় ঢুকতেই পারেনি সে। দর্শক সাথে ছিল, কিছু সমঝদারও, কিন্তু পায়নি সে ছাপার অক্ষরের সহযোগিতা। পিঠ চাপড়েছে অনেকে, কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতা দেয়নি। নাটকে করতালির প্রশংসার অভাব হয়নি, কিন্তু কাগজে-কলমে বড় একটা তা প্রকাশ পায়নি।

সোলায়মান সংসার পেতেছিল, একটি কন্যা সন্তানের জনকও ছিল সে। কন্যার প্রতি স্নেহের অভাবও ছিল না তার। কিন্তু আপাদমস্তক বোহেমিয়ান সোলায়মান সে বন্ধনে আবদ্ধ থাকতো না। জনারণ্যে একাকিত্বের এক নির্জন প্রান্তরে সে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসতো। তাহলে কি সে উৎপল দত্তের সংলাপের মতো আমি দেবতার মতো, ঘৃণার মতো, অবজ্ঞার মতো একাকিত্বকে ভালোবেসে ফেলেছিল? হয়তো তাই। অথবা এ আমাদের অনুমান।

 

মামুনুর রশীদ
মামুনুর রশীদ

 

আজকের দিনে আরেক সর্বগ্রাসী মাধ্যম এসেছে টেলিভিশন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সোলায়মান জড়িয়ে পড়েছিল এই মাধ্যমের সাথে। শুধু সৃজন নয়, ব্যবসার সাথেও। এই মাধ্যমের ব্যবসার কাজটি কারো কাছে বড় সহজ যদি বিকিকিনির মাথাটা খেলে ঠিকমতো। সোলায়মানের তা খেলবার কথা নয়। তাই যা হবার তাই হলো। অনুষ্ঠানগুলো অবিক্রীত থাকলো। স্টুডিও, ক্যামেরা লগ্নি ঠিকমতো ফেরত এলো না। সবকিছুই ভেঙে পড়লো। সেই সাথে সোলায়মানেরও ভেঙে পড়লো মন শরীর উদ্যম।

সোলায়মান দেহের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছিল। তীব্র জীবনযন্ত্রণা তাকে যে পথ দেখিয়েছে সেখানে শরীর ছিল অবহেলিত। যেমন দেখা গেছে বাংলার আরেক শিল্পী ঋত্বিক ঘটকের ক্ষেত্রে। প্রায় একই বয়সে তাদের প্রয়াণ হলো। এই সময়ে সোলায়মান সুস্থিতও ছিল না। ফলে সৃষ্টির ওপরেও সে প্রভাব পড়েছে।

 

আশির দশকের নাট্যকর্মে যে ঔজ্জ্বল্য ছিল, নব্বইয়ের শেষে এসে তা ম্লান হতে শুরু করে। এ সময়ে ভিডিও হাউস, ভিডিও নাটক প্রযোজনা তার জন্য একটা মানসিক ও শারীরিক ধকলেও পরিণত হয়েছিল। শিল্পের সাথে ব্যবসার প্রত্যক্ষ যোগাযোগটা কখনো কখনো শিল্পীর ওপর বিশাল বোঝাও হয়ে দাঁড়ায়। সেটাও তার জীবনে হয়েছিল। একেবারে বিদায় নেয়ার আগে সে ব্যবসা থেকে নিজেকে মুক্তও করে ফেলেছিল।

মৃত্যুর সাথে লড়াই করার সময়টুকুও সে পেলো না। এক নিঃসঙ্গ মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করলো। অথচ এই সোলায়মান স্বৈরাচার, সামরিক শাসন, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা কারো কাছে কখনো আত্মসমর্পণ করেনি।

এ লেখা যখন লিখছি তখনো সন্দেহ হচ্ছে একি সত্যি যে সোলায়মান নেই, মৃত্যু হয়েছে তার! হ্যাঁ, এটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্য সোলায়মানের। সে থেকে যাবে আমাদের কাছে, বাংলা নাটকের কুশীলব দর্শকদের কাছে একটা সন্দেহের মধ্যে, কেউ বিশ্বাস করবে না সে বেঁচে নেই।

মামুনুর রশীদ
মেঘনার নদীবক্ষ
৮.২.২০০২

Leave a Comment