বাংলা সংগীত ও চলচ্চিত্র জগতের এক উজ্জ্বল নাম কালীপদ সেন। যাঁর জন্ম ভারতের ত্রিপুরা জেলার চানপুরে। ছোটবেলা থেকেই সংগীতের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ ও প্রাকৃতিক প্রতিভা প্রকাশ পায়। এই আগ্রহই পরবর্তীতে তাঁকে বাংলা সংগীত ও চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
কালীপদ সেন

সংগীত শিক্ষা ও শুরুর দিন
কালীপদ সেন সংগীতের গুরু হিসেবে পেয়েছিলেন দুই মহান ব্যক্তিত্ব—কাজী নজরুল ইসলাম এবং হিমাংশু দত্ত। তাঁদের কাছ থেকে তিনি শুদ্ধ ও সৃজনশীল সংগীত শিক্ষায় দীক্ষিত হন।
চলচ্চিত্রে তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিল হিমাংশু দত্তের সহকারী হিসেবে, যা পরবর্তী জীবনে সংগীত পরিচালক হিসেবে তাঁর ভিত মজবুত করে।
চলচ্চিত্র সংগীত পরিচালক হিসেবে কর্মজীবন
স্বাধীন সংগীত পরিচালক হিসেবে কালীপদ সেনের প্রথম কাজ ছিল মানু সেন পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘বিরিঞ্চিবাবা’ (১৯৪৪)। এরপর ১৯৪৭ সালে প্রেমেন্দ্র মিত্র পরিচালিত ‘নতুন খবর’ ছবিতে তিনি গীতিকার হিসেবেও কাজ করেন।
১৯৪৪ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত প্রায় চার দশক তিনি চলচ্চিত্র সংগীতে সক্রিয় ছিলেন এবং মোট ৯৪টি চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেছেন। তাঁর সংগীতায়োজন বাংলা চলচ্চিত্রে মান ও সৃজনশীলতার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
যাঁদের সঙ্গে কাজ করেছেন
বাংলা চলচ্চিত্রের বহু খ্যাতনামা পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন কালীপদ সেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- মধু বসু
- বিমল রায়
- নীরেন লাহিড়ী
- মানু সেন
- প্রফুল্ল রায়
- নরেশ মিত্র
- চিত্ত বসু
- হীরেন নাগ
- তপন সিংহ
- অজয় কর
- বিকাশ রায়
- সুশীল মজুমদার
- গুরু বাগচী
- অজিত লাহিড়ী
- অজিত গাঙ্গুলী
- নির্মল দে
চলচ্চিত্রপঞ্জি (সংগীত পরিচালিত নির্বাচিত চলচ্চিত্র)
কালীপদ সেনের সুরারোপিত চলচ্চিত্রের তালিকা সুবিস্তৃত। কিছু উল্লেখযোগ্য ছবি নিম্নরূপ:
- ১৯৪৪–১৯৫০: বিরিঞ্চিবাবা, দোটানা, রাত্রি, তরুণের স্বপ্ন, দেবী চৌধুরাণী, কুয়াশা, বৈকুণ্ঠের উইল
- ১৯৫১–১৯৫৫: কুলহারা, পণ্ডিতমশাই, নীল দর্পণ, শেষের কবিতা, সতীর দেহত্যাগ, বারবেলা, ছোট বৌ
- ১৯৫৬–১৯৬০: লক্ষহীরা, ছায়াসঙ্গিনী, পুনর্মিলন, পুরীর মন্দির
- ১৯৬১–১৯৬৬: মধুরেণ, সঞ্চারিণী, মহালগ্ন, জোড়াদীঘির চৌধুরী পরিবার
- ১৯৬7–১৯৭৩: দেবীতীর্থ কামরূপ কামাখ্যা, নল দময়ন্তী, জনতার আদালত, আরণ্যক
- ১৯৭৪–১৯৮০: বিসর্জন, যুগমানব কবীর, নবদিগন্ত, দর্পচূর্ণ
- ১৯৮১–১৯৮৮: সুবর্ণলতা, মা ভবানী মা আমার, অগ্রদানী, রাতের কুহেলি
(সম্পূর্ণ তালিকা সংরক্ষিত; সংক্ষেপে গুরুত্বপূর্ণ সিনেমাগুলো উল্লেখ করা হয়েছে।)
কালীপদ সেনের প্রভাব ও অবদান
বাংলা চলচ্চিত্র সংগীতে কালীপদ সেন ছিলেন এক অগ্রদূত। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি সংগীত পরিচালনার মাধ্যমে এক অনন্য ধারা সৃষ্টি করেন। তাঁর সুরে ছিল ক্লাসিক্যাল ঘরানার মাধুর্য, লোকসংগীতের ছোঁয়া, এবং চলচ্চিত্রের আবহে সঙ্গতিপূর্ণ আবেগ।
তাঁর সৃষ্ট গানগুলি শুধুমাত্র সিনেমার পরিপূরকই ছিল না, বরং তারা হয়ে উঠেছিল বাংলা সংগীতজগতের স্থায়ী সম্পদ।

কালীপদ সেন বাংলা চলচ্চিত্র সংগীতের ইতিহাসে এক নিভৃতচারী কিন্তু অপরিহার্য নক্ষত্র। তাঁর সুরের জাদু আজও প্রজন্মের পর প্রজন্মকে আকর্ষণ করে। তিনি যেমন ছিলেন নিষ্ঠাবান শিল্পী, তেমনি ছিলেন সাধকপ্রাণ সুরকার—যিনি চুপচাপ সংগীতের মাধ্যমে মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছেন।