কালীপ্রসাদ ঘোষ – জীবন ও কর্ম

কালীপ্রসাদ ঘোষ ছিলেন বিশিষ্ট ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক ও অভিনেতা। বাংলা চলচ্চিত্রের নির্বাক যুগ থেকে শুরু করে টকিজ যুগ পর্যন্ত তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এবং সমাজসচেতন ও সাহিত্যনির্ভর ছবির জন্য বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

 

কালীপ্রসাদ ঘোষ – জীবন ও কর্ম

 

জন্ম শিক্ষা

কালীপ্রসাদ ঘোষের জন্ম কলকাতায়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্মান লাভ করেন। শৈশব থেকেই অভিনয় ও নাট্যকলা তার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে তিনি মিনার্ভা থিয়েটারের নাট্যাভিনয়ে যোগ দেন এবং দ্রুতই নাট্যমঞ্চে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেন।

 

চলচ্চিত্রে প্রাথমিক জীবন

থিয়েটারের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন। মিনার্ভার তৎকালীন স্বত্বাধিকারী ঘনশ্যামদাস চৌষানীর সাথে যৌথভাবে ইন্ডিয়ান কিনেমা আর্টস নামে একটি প্রযোজনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংস্থা থেকে প্রযোজিত সাতটি নির্বাক ছবির মধ্যে পাঁচটি তিনি নিজেই পরিচালনা করেছিলেন।
তার পরিচালিত ছবিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য—

  • শঙ্করাচার্য (১৯২৭)
  • নিষিদ্ধ ফল (১৯২৮)
  • অপহৃতা (১৯২৯)
  • কণ্ঠহার (১৯২৯)
  • ভাগ্যলক্ষ্মী (১৯৩২)

‘নিষিদ্ধ ফল’ এবং আরও কয়েকটি ছবিতে তিনি অভিনয়ও করেছিলেন।

 

বোম্বে অধ্যায়

কিছুদিন তিনি বি. এল. খেমকার প্রতিষ্ঠিত ইস্ট ইন্ডিয়া ফিল্মস-এর সাথেও যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৩৪ সালে তিনি বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) চলে যান এবং সাগর মুভিটোন ব্যানারে দুটি হিন্দি ছবি পরিচালনা করেন। এই সময়কাল তাকে অল-ইন্ডিয়া চলচ্চিত্র অঙ্গনে একটি পরিচিত নাম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

 

কলকাতায় প্রত্যাবর্তন টকিজ যুগ

১৯৪০-এর দশকে কলকাতায় ফিরে তিনি সাহিত্যনির্ভর ও সমাজসচেতন চলচ্চিত্র নির্মাণে মনোনিবেশ করেন। তার নিজের কাহিনি ও চিত্রনাট্যের ভিত্তিতে নির্মিত জজ সাহেবের নাতনী (১৯৪৩) সমকালীন দর্শকপ্রিয়তা লাভ করে।

পরবর্তীতে তিনি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনির অবলম্বনে ধাত্রী দেবতা (১৯৪৮) চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন। এখানে তিনি চিত্রনাট্য রচনার পাশাপাশি গানের কথাও লিখেছিলেন।

তাঁর নিজের কাহিনির উপর ভিত্তি করে নির্মিত কার পাপে (১৯৫২) চলচ্চিত্রটি সমাজসচেতন একটি বার্তা বহন করেছিল এবং সমালোচকদের প্রশংসা পেয়েছিল।

১৯৫৫ সালে তিনি রাণী রাসমণি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন এবং শেষ পরিচালিত ছবি ছিল শ্রীশ্রীমা (১৯৫৮)

 

অভিনেতা হিসেবে অবদান

নিজের ছবির বাইরে তিনি অন্য পরিচালকদের ছবিতেও অভিনয় করেছিলেন।

  • মধু বসু পরিচালিত আলিবাবা (১৯৩৭)
  • জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত একলব্য (১৯৩৮)
  • ফণী বর্মা ও নির্মল গোস্বামী পরিচালিত কমলে কামিনী (১৯৪০)

এইসব ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি অভিনেতা হিসেবেও নিজের স্বতন্ত্র পরিচয় রেখে যান।

 

চলচ্চিত্রপঞ্জি

  • ১৯২৭ – শঙ্করাচার্য
  • ১৯২৮ – নিষিদ্ধ ফল
  • ১৯২৯ – অপহৃতা, কণ্ঠহার
  • ১৯৩২ – ভাগ্যলক্ষ্মী
  • ১৯৪৩ – জজ সাহেবের নাতনী
  • ১৯৪৮ – ধাত্রী দেবতা
  • ১৯৫০ – বিদ্যাসাগর
  • ১৯৫২ – কার পাপে
  • ১৯৫৫ – রাণী রাসমণি
  • ১৯৫৮ – শ্রীশ্রীমা

 

মূল্যায়ন

কালীপ্রসাদ ঘোষ ছিলেন সেই সময়কার চলচ্চিত্র আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি বাংলা সাহিত্যের কাহিনি, সমাজ-সংস্কৃতির বাস্তবতা ও মানুষের জীবনের দ্বন্দ্ব চলচ্চিত্রে প্রতিফলিত করেছিলেন। নির্বাক যুগ থেকে টকিজ যুগে সফলভাবে উত্তরণ ঘটিয়ে তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, সাহিত্যনির্ভর ও সমাজকেন্দ্রিক সিনেমা সমানভাবে দর্শক ও সমালোচকপ্রিয় হতে পারে।

Leave a Comment