কালী রাহা ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের এক বিশিষ্ট সম্পাদক, যিনি চার দশকেরও বেশি সময় ধরে চলচ্চিত্র সম্পাদনায় অবদান রেখেছেন। তাঁর জীবন শুরু হয়েছিল নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে, যেখানে তিনি প্রথমে প্রখ্যাত সম্পাদক শচীন বসুর সহকারী হিসাবে কাজ করতেন। প্রাথমিকভাবে সম্পাদনা বিভাগের নানা টেকনিক্যাল কাজে যুক্ত থাকলেও ধীরে ধীরে তিনি স্বতন্ত্রভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং শিগগিরই হয়ে ওঠেন অন্যতম নির্ভরযোগ্য সম্পাদক।
কর্মজীবনের সূচনা
স্বাধীন সম্পাদক হিসাবে কালী রাহার প্রথম কাজ ছিল নিউ থিয়েটার্স প্রযোজিত এবং প্রমথেশচন্দ্র বড়ুয়া পরিচালিত মায়া (১৯৩৬) চলচ্চিত্র। এই ছবির মাধ্যমে তিনি চলচ্চিত্র জগতে নিজের পরিচয় গড়ে তোলেন। এরপর ধারাবাহিকভাবে নিউ থিয়েটার্সসহ বিভিন্ন প্রযোজনা সংস্থার ছবিতে কাজ করেন। তাঁর দক্ষতা ও নান্দনিক সম্পাদনা শৈলী দ্রুতই পরিচালকদের কাছে সমাদৃত হয়।
কর্মজীবনের বিস্তার
চার দশকের দীর্ঘ চলচ্চিত্র জীবনে কালী রাহা কাজ করেছেন বাংলা চলচ্চিত্রের একাধিক কিংবদন্তি পরিচালকের সঙ্গে। প্রমথেশচন্দ্র বড়ুয়ার পাশাপাশি তিনি কাজ করেছেন ফণী মজুমদার, দেবকী বসু, নীতিন বসু, সুকুমার দাশগুপ্ত, নীরেন লাহিড়ী, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নির্মল দে, অগ্রদূত, অগ্রগামী এবং সুশীল মজুমদারসহ বহু প্রখ্যাত পরিচালকের সাথে।
তাঁর সম্পাদিত ছবিগুলির বৈশিষ্ট্য ছিল গল্প বলার ছন্দকে বজায় রাখা, দৃশ্যান্তরের স্বাভাবিকতা ও দর্শককে আবেগের ভেতরে ডুবিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা। সেসময়কার প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কালী রাহা নতুনত্ব আনতে সচেষ্ট ছিলেন।
উল্লেখযোগ্য অবদান ও শৈলী
কালী রাহা কেবল প্রযুক্তিগত দিকেই পারদর্শী ছিলেন না, বরং গল্পের নাটকীয়তা ও আবেগের ভারসাম্য রক্ষায়ও তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি দৃশ্যান্তরের গতি ও আবহ তৈরি করতেন এমনভাবে, যাতে ছবির আবেগগত কাঠামো দর্শকদের কাছে গভীরভাবে পৌঁছে যায়।
- মায়ের প্রাণ (১৯৪১) কিংবা নৌকাডুবি (১৯৪৭)-এর মতো সাহিত্যনির্ভর ছবিতে তিনি কাহিনির সংবেদনশীল দিক ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
- আবার সাড়ে চুয়াত্তর (১৯৫৩) বা চৌরঙ্গী (১৯৬৮)-এর মতো সামাজিক ও বাণিজ্যিক ছবিতেও তিনি দক্ষ সম্পাদনার মাধ্যমে ছবিকে জনপ্রিয় করেছিলেন।
চলচ্চিত্রপঞ্জি (নির্বাচিত)
- ১৯৩৬: মায়া
- ১৯৩৭: মুক্তি
- ১৯৩৮: সাথী
- ১৯৩৯: অধিকার, সাপুড়ে
- ১৯৪০: আলোছায়া
- ১৯৪১: মায়ের প্রাণ, উত্তরায়ণ
- ১৯৪২: পাষাণ দেবতা, শেষ উত্তর
- ১৯৪৩: বিচার
- ১৯৪৭: নৌকাডুবি
- ১৯৪৮: দৃষ্টিদান, মহাকাল, সাধারণ মেয়ে
- ১৯৪৯: হেরফের, সিংহদ্বার
- ১৯৫০: বৈকুণ্ঠের উইল, গরবিনী, সন্ধ্যা বেলার রূপকথা
- ১৯৫১: কুলহারা, দুর্গেশনন্দিনী, সেতু
- ১৯৫২: বসু পরিবার, কার পাপে, ভুলের শেষে, আঁধি
- ১৯৫৩: সাড়ে চুয়াত্তর, চিকিৎসা সংকট
- ১৯৫৬: শিল্পী
- ১৯৫৭: পুনর্মিলন, মাধবীর জন্য
- ১৯৫৮: ডাক হরকরা, মানময়ী গার্লস স্কুল, মর্মবাণী
- ১৯৫৯: অগ্নিসম্ভবা
- ১৯৬২: কান্না, কাজল
- ১৯৬৩: নিশীথে
- ১৯৬৬: শঙ্খবেলা
- ১৯৬৭: গৃহদাহ
- ১৯৬৮: চৌরঙ্গী
- ১৯৭০: বিলম্বিত লয়
- ১৯৭৫: সেলাম মেমসাহেব
উত্তরাধিকার ও প্রভাব
কালী রাহার কাজ বাংলা চলচ্চিত্রের সম্পাদনা শৈলীর এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপকে চিহ্নিত করে। তিনি একাধারে সাহিত্যনির্ভর কাহিনি, সামাজিক নাটক এবং বাণিজ্যিক ছবির সার্থক সম্পাদনা করেছেন। অনেক তরুণ সম্পাদক তাঁর কাজ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছেন।
যদিও তাঁর নাম পরিচালক বা নায়কদের মতো প্রচারের আলোয় আসেনি, তবুও কালী রাহার অবদান বাংলা চলচ্চিত্রকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অপরিসীম। তাঁর সম্পাদিত চলচ্চিত্রগুলো আজও বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ।