বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে পরিচালক, চিত্রনাট্যকার কিংবা অভিনেতাদের নাম যতটা আলোচিত হয়েছে, সম্পাদকের নাম ততটা প্রচারে আসেনি। অথচ চলচ্চিত্রের নান্দনিক গঠন, গতি, এবং দর্শকের মনে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে সম্পাদকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এই নেপথ্যের শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন গঙ্গাধর নস্কর, যিনি ষাটের দশক থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বাংলা চলচ্চিত্রকে তাঁর কাঁচি ও ক্যানভাসে নতুন মাত্রা দিয়েছেন।
গঙ্গাধর নস্কর । বাংলা চলচ্চিত্রের অভিধান
প্রারম্ভিক জীবন ও ক্যারিয়ারের সূচনা
গঙ্গাধর নস্করের প্রাথমিক জীবনের সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া না গেলেও জানা যায়, তিনি চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেন একজন সহকারী সম্পাদক হিসেবে। প্রথমে প্রখ্যাত সম্পাদক রমেশ যোশীর সহকারী হিসাবে কাজ শুরু করেন। এই সময়ে তিনি চলচ্চিত্র সম্পাদনার খুঁটিনাটি শিখে নেন—দৃশ্য বিন্যাস, শট মিলানো, গতি নিয়ন্ত্রণ, এবং আবেগ জাগ্রত করার সূক্ষ্ম কৌশল।
পরবর্তীতে তিনি সুবোধ রায়ের সহকারী হিসেবে কাজের সুযোগ পান। সুবোধ রায়ের নির্দেশনায় তিনি অংশ নেন মৃণাল সেনের বিখ্যাত ছবি বাইশে শ্রাবণ (১৯৬০)-এর সম্পাদনার কাজে। এই ছবির কাজ গঙ্গাধর নস্করের কাছে ছিল একটি শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা। তিনি উপলব্ধি করেন, কেবল দৃশ্য কেটে জোড়া লাগানোই সম্পাদনার কাজ নয়—বরং একটি গল্পকে দর্শকের মনে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সঠিক ছন্দ ও শৈলী খুঁজে পাওয়া-ই একজন সম্পাদকের প্রকৃত দক্ষতা।
স্বাধীন সম্পাদক হিসেবে আবির্ভাব
গঙ্গাধর নস্করের স্বাধীন সম্পাদক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে মৃণাল সেন পরিচালিত “পুনশ্চ” (১৯৬১) ছবিতে। এই ছবির সাফল্য তাঁকে চলচ্চিত্র দুনিয়ায় পরিচিত করে তোলে। এর পর থেকে তিনি দীর্ঘ তিন দশক ধরে বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রধান সম্পাদক হিসেবে কাজ করে গিয়েছেন।
তিনি কেবল বাংলা চলচ্চিত্রেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। হিন্দি, ওড়িয়া এবং আন্তর্জাতিক প্রযোজনাতেও কাজ করেছেন। তবে তাঁর নাম সবচেয়ে বেশি যুক্ত হয়েছে মৃণাল সেন-এর সঙ্গে। বলা যায়, মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র ভাবনার একটি বড় অংশ具 বাস্তব রূপ পেয়েছে গঙ্গাধর নস্করের দক্ষ সম্পাদনার মাধ্যমে।
মৃণাল সেনের সঙ্গে দীর্ঘ পথচলা
গঙ্গাধর নস্কর প্রায় কুড়িটি চলচ্চিত্রে মৃণাল সেনের সঙ্গে কাজ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- অবশেষে (১৯৬৩)
- প্রতিনিধি (১৯৬৪)
- আকাশ কুসুম (১৯৬৫)
- ইন্টারভিউ (১৯৭০)
- কলকাতা ৭১ (১৯৭২)
- পদাতিক (১৯৭৩)
- কোরাস (১৯৭৪)
- পরশুরাম (১৯৭৮)
- একদিন প্রতিদিন (১৯৭৯)
- আকালের সন্ধানে (১৯৮২)
- খারিজ (১৯৮২)
এই চলচ্চিত্রগুলির সম্পাদনা কেবল কাহিনির গতি নয়, দর্শকের ভাবনার জগৎকে নাড়া দিয়েছে। সেনের রাজনৈতিক ও বাস্তবধর্মী সিনেমা গঙ্গাধর নস্করের দক্ষ হাতে এক অনন্য মাত্রা লাভ করে।
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্তি ও সম্মান
গঙ্গাধর নস্করের ক্যারিয়ারের অন্যতম বড় স্বীকৃতি আসে জাতীয় পর্যায়ে। তিনি তিনবার শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র সম্পাদক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পান—
- পরশুরাম (১৯৭৮)
- একদিন প্রতিদিন (১৯৭৯)
- আকালের সন্ধানে (১৯৮২)
এই সাফল্য প্রমাণ করে, তিনি কেবল একজন প্রযুক্তিগত সম্পাদকই নন, বরং চলচ্চিত্র নির্মাণের দার্শনিক দিকগুলোও তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করতেন।
অন্যান্য পরিচালকের সঙ্গে কাজ
যদিও মৃণাল সেনের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ সহযোগিতা সবচেয়ে আলোচিত, তিনি আরও বহু খ্যাতনামা পরিচালকের সাথেও কাজ করেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত – যার কবিতার মতো সিনেমাগুলি নস্করের সংবেদনশীল সম্পাদনা ছাড়া পূর্ণতা পেত না।
- বিমল ভৌমিক, সৈকত ভট্টাচার্য, শঙ্কর ভট্টাচার্য – যাদের ভিন্নধর্মী সিনেমায়ও তিনি দক্ষতার ছাপ রেখেছেন।
চলচ্চিত্রপঞ্জির বিস্তার
গঙ্গাধর নস্করের হাতে সম্পাদিত চলচ্চিত্রের তালিকা দীর্ঘ। তাঁর চলচ্চিত্রপঞ্জি থেকে কিছু উল্লেখযোগ্য ছবি:
- ১৯৬১: পুনশ্চ
- ১৯৬৩: অবশেষে
- ১৯৬৪: প্রতিনিধি, কাঁটাতার
- ১৯৬৫: আকাশ কুসুম
- ১৯৭০: ইন্টারভিউ
- ১৯৭২: কলকাতা ৭১
- ১৯৭৩: পদাতিক
- ১৯৭৪: কোরাস
- ১৯৭৭: তিন পরী ছয় প্রেমিক, শেষ রক্ষা
- ১৯৭৮: অবতার, পরশুরাম
- ১৯৭৯: একদিন প্রতিদিন, দৌড়
- ১৯৮০: জি. টি. রোড
- ১৯৮২: আকালের সন্ধানে, খারিজ, বন্দিনী কমলা
- ১৯৮৩: নিম অন্নপূর্ণা
- ১৯৮৬: ছেলেটা
- ১৯৮৯: বান্ধবী
- ১৯৯০: শেলী
- ১৯৯১: কাগজের নৌকো, নজরবন্দী
- ১৯৯৪: মহাভারতী
- ১৯৯৬: হিমঘর
এই তালিকা থেকেই বোঝা যায়, গঙ্গাধর নস্কর বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালি যুগ থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে সক্রিয় ছিলেন।
কাজের বৈশিষ্ট্য ও স্টাইল
গঙ্গাধর নস্করের সম্পাদনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল—
- ছবির গতি ও ছন্দের নিখুঁত সামঞ্জস্য রাখা।
- বাস্তবতাকে দর্শকের সামনে জীবন্ত করে তোলা।
- দীর্ঘ শট এবং দ্রুত কাটের মধ্যে সুষম সামঞ্জস্য রক্ষা।
- চরিত্রের আবেগকে ফুটিয়ে তুলতে দৃশ্যান্তর ব্যবহারের দক্ষতা।
বিশেষ করে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের চলচ্চিত্রে তাঁর কাজ ছিল অনন্য।
বাংলা চলচ্চিত্রে অবদান
গঙ্গাধর নস্করের অবদান কেবল কয়েকটি পুরস্কারে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি বাংলা চলচ্চিত্রে সম্পাদনার গুরুত্বকে সামনে নিয়ে এসেছেন। তাঁর হাত ধরে সম্পাদনা ধীরে ধীরে এক স্বতন্ত্র শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি পেতে শুরু করে। নবীন প্রজন্মের বহু সম্পাদক তাঁকে অনুসরণ করেছেন।
গঙ্গাধর নস্কর ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের এক নীরব কারিগর। তাঁর কাঁচির জাদুতে অনেক সাধারণ দৃশ্য পরিণত হয়েছে কালজয়ী চলচ্চিত্রে। তিনি প্রমাণ করেছেন, একজন সম্পাদক শুধু সিনেমার কারিগরই নন—তিনি একজন গল্পকার, দার্শনিক এবং শিল্পীও বটে।
আজ যখন আমরা “কলকাতা ৭১”, “আকালের সন্ধানে” কিংবা “খারিজ”-এর মতো ছবিগুলি স্মরণ করি, তখন কেবল মৃণাল সেনের নাম নয়, গঙ্গাধর নস্করের নামও উচ্চারিত হয় সমান মর্যাদায়। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।