গোপেন মল্লিক জন্মেছিলেন কলকাতায়। শৈশব থেকেই তাঁর জীবনে সংগীতের আবেশ ছিল প্রবল। ছোটবেলা থেকেই সংগীত চর্চার শুরু, আর সেই চর্চা তাঁকে পৌঁছে দেয় বাংলা চলচ্চিত্র সংগীতের এক স্বর্ণযুগে। তিনি শৈলেশ দাশগুপ্ত, রামচন্দ্র পাল ও দুর্গা সেনের মতো প্রথিতযশা গুরুদের কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম নেন। এই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর সুরচিন্তায় ধ্রুপদী বৈচিত্র্য এনে দেয়। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই তাঁর প্রতিভা শিল্পমহলে স্বীকৃতি পায়—১৯৩৬ সালে সোনেলা কোম্পানি থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম রেকর্ড। পরবর্তী সময়ে তাঁর সুরে হিন্দুস্থান রেকর্ডস ও এইচ.এম.ভি.-র বহু জনপ্রিয় গান প্রকাশিত হয়, যা তাঁকে বাংলার সংগীত জগতে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে।
চলচ্চিত্র সংগীতে প্রবেশ
১৯৪৬ সাল থেকে শুরু হয় গোপেন মল্লিকের চলচ্চিত্র সংগীত পরিচালনার যাত্রা। মনুজেন্দ্র ভঞ্জ পরিচালিত মৌচাকে ঢিল ছিল তাঁর প্রথম সিনেমা, যেখানে তিনি সংগীত পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর পরের প্রায় চার দশক ধরে তিনি ৩৭টি ছবিতে সংগীত পরিচালনা করেছেন। ১৯৪৬ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত সময়কাল ছিল তাঁর কর্মজীবনের সোনালি অধ্যায়। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি ধীরেশ ঘোষ, মানু সেন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুশীল মজুমদার, চিত্ত বসু, মধু বসু, মঙ্গল চক্রবর্তী, হীরেন নাগ ও অগ্রদূতের মতো বিশিষ্ট পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করেছেন। তাঁদের চলচ্চিত্র তাঁর সুরে পেয়েছে এক বিশেষ মাত্রা।
সঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য ও অবদান
গোপেন মল্লিকের সঙ্গীত পরিচালনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল গল্পের আবহ অনুযায়ী সুরের প্রয়োগ। তিনি জানতেন কাহিনির আবেগ কোন সুরে সবচেয়ে ভালোভাবে প্রকাশ পাবে। তাঁর সুরে ধ্রুপদী রাগের ব্যবহার যেমন ছিল, তেমনি লোকগীতি ও আধুনিকতার ছোঁয়াও পাওয়া যেত। ফলে তাঁর তৈরি গান ও ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর সাধারণ দর্শকের কাছে সহজবোধ্য হলেও ছিল শিল্পসম্মত। তাঁর সুরে একদিকে শোনা যেত ক্লাসিক্যাল ঘরানার শৃঙ্খলা, অন্যদিকে সমকালীন বাংলা গানের প্রাণবন্ত সুরভি।
ব্যক্তিগত জীবন
সংগীতের জগতেই গোপেন মল্লিক জীবনের সঙ্গিনী খুঁজে পান। তাঁর বিবাহ হয় প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী রেখা মল্লিকের সঙ্গে। সংগীতজীবনে রেখা মল্লিক যেমন নিজস্ব অবস্থান গড়ে তুলেছিলেন, তেমনি স্বামী-স্ত্রী মিলে তাঁরা বাংলা সংগীত জগতে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।
চলচ্চিত্র তালিকা
তাঁর কাজ করা চলচ্চিত্রের তালিকা বাংলা সিনেমার ইতিহাসে এক অমূল্য ভান্ডার:
- ১৯৪৬: মৌচাকে ঢিল, এই তো জীবন
- ১৯৪৭: দুই বন্ধু
- ১৯৪৮: শাঁখা সিঁদুর, নন্দরাণীর সংসার, মহাকাল
- ১৯৪৯: চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন
- ১৯৫০: জীবন সৈকতে, মহা সম্পদ, ইন্দ্রজাল
- ১৯৫১: অপরাজিতা, সেতু, চীনের পুতুল
- ১৯৫২: জবানবন্দী
- ১৯৫৩: গোপাল ভাঁড়, রোশেনারা
- ১৯৫৪: ভাঙাগড়া
- ১৯৫৫: অপরাধী, জ্যোতিষী
- ১৯৫৬: শুভরাত্রি, পরাধীন, পাপ ও পাপী, দানের মর্যাদা
- ১৯৬১: বিষকন্যা
- ১৯৬৪: অগ্নিবন্যা
- ১৯৬৫: দিনান্তের আলো, তাপসী
- ১৯৬৭: ৮০’তে আসিও না, জীবন
- ১৯৬৮: তিন অধ্যায়
- ১৯৬৯: সাবরমতী, অগ্নিযুগের কাহিনী
- ১৯৭০: আলেয়ার আলো
- ১৯৭৬: বন্দী বিধাতা
- ১৯৭৮: তুষারতীর্থ অমরনাথ
- ১৯৭৯: ঘটকালি
- ১৯৮৫: বৈকুণ্ঠের উইল
উত্তরাধিকার
গোপেন মল্লিকের সঙ্গীত বাংলা চলচ্চিত্রে এক অনন্য ধারা তৈরি করেছে। তিনি কেবল জনপ্রিয় গান সৃষ্টি করেননি, বরং সঙ্গীতের মাধ্যমে চলচ্চিত্রের গল্পকে আরও জীবন্ত করে তুলেছিলেন। আজও তাঁর সুরে বাঁধা গানগুলো প্রাচীন হলেও কালজয়ী হয়ে আছে। তাঁর অবদান বাংলা চলচ্চিত্র সংগীতের ইতিহাসে এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয় থাকবে।