আজ, ১৯ আগস্ট, আমরা স্মরণ করছি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও সাহিত্য জগতের এক অমর দিগগজ জহির রায়হানকে। অভিনয় গুরুকুলের পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
জীবনের শুরু
জহির রায়হান ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট ফেনী জেলার মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন সৃজনশীল ও কৌতূহলী। কলকাতায় প্রাথমিক শিক্ষা শেষে দেশভাগের পর তাঁর পরিবার পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য অধ্যয়নকালেই তিনি লেখালেখি শুরু করেন এবং সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত হন। সাহিত্য ও চলচ্চিত্র—দুই ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সমান স্বচ্ছন্দ, যা তাঁকে করে তুলেছিল এক বিরল প্রতিভা।
সাহিত্যজীবন: শব্দের জাদুকর
জহির রায়হানের সাহিত্যকর্ম ষাটের দশকের বাংলা সাহিত্যকে নতুন মাত্রা দেয়। তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘সূর্যগ্রহণ’, ‘শীতের পরশুরাম’, ‘আরেক ফাল্গুন’ এবং উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে’, ‘আরেকটি ফাল্গুন’, ‘বরফ গলা নদী’ পাঠককে গভীরভাবে আলোড়িত করেছে।
- ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসটি গ্রামীণ জীবনের অসাধারণ দলিল, যেখানে প্রেম, বেদনা, সংস্কৃতি ও সংগ্রামের কাহিনি উঠে এসেছে। এটি ১৯৬৪ সালে ‘আদমজী সাহিত্য পুরস্কার’ অর্জন করে।
- ‘আরেকটি ফাল্গুন’ রাজনৈতিক সংগ্রামের অগ্নিশিখা, যা তরুণ সমাজকে আন্দোলনের প্রেরণা জুগিয়েছিল।
তাঁর লেখনীতে ছিল স্পষ্ট মানবতাবাদী দৃষ্টি ও সময়ের সামাজিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।
চলচ্চিত্র জীবন: পর্দার কবি
চলচ্চিত্রে জহির রায়হান প্রথমে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে তিনি নিজেই নির্মাণ করেন একের পর এক কালজয়ী ছবি।
- ‘কোথায় বাংলার মানিক’ (১৯৬৯): বাংলাদেশের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র। এই ছবির মাধ্যমে তিনি প্রযুক্তিগত ও শিল্পিত দুই দিকেই বিপ্লব ঘটান।
- ‘জীবন থেকে নেওয়া’ (১৯৭০): সর্বকালের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক চলচ্চিত্রগুলির একটি। পরিবারের গল্পের মধ্য দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরশাসনের প্রতিচ্ছবি। ছবিটি হয়ে ওঠে মুক্তির আন্দোলনের প্রতীক।
- ‘সংসার’, ‘বাহানা’, ‘বধূ বিদায়’—প্রতিটি ছবিই ছিল সমাজ বাস্তবতার দলিল।
- ডকুমেন্টারি ‘স্টপ জেনোসাইড’ (১৯৭১): মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে নির্মিত এ চলচ্চিত্র আন্তর্জাতিক মহলে পাকিস্তানি সেনাদের হত্যাযজ্ঞ তুলে ধরে। এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আন্তর্জাতিক সমর্থন জোগাড় করতে বিশাল ভূমিকা রাখে।
তাঁর চলচ্চিত্র প্রমাণ করেছে—সিনেমা শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং সামাজিক পরিবর্তনের হাতিয়ার।
সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনা
জহির রায়হান কেবল সাহিত্যিক বা চলচ্চিত্রকার ছিলেন না; তিনি ছিলেন সমাজসচেতন এক সাংস্কৃতিক সৈনিক। ষাটের দশকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি শিল্পীদের সংগঠিত করেন, শরণার্থী শিবিরে কাজ করেন, এবং চলচ্চিত্রকে ব্যবহার করেন মুক্তির বার্তা ছড়াতে।
১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে তাঁর ভাই শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সারের সন্ধানে বেরিয়ে তিনি আর ফিরে আসেননি। আজও তাঁর নিখোঁজ হওয়া আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক রহস্য ও বেদনা।
শিল্পদর্শন ও দর্শন
জহির রায়হানের কাজের ভেতরে যে কয়েকটি দর্শন স্পষ্টভাবে দেখা যায়—
- মানবিকতা: প্রতিটি চরিত্রে মানুষের মৌলিক আবেগের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা।
- বাস্তবতা: সমাজ ও রাষ্ট্রের সমস্যাগুলোকে নির্দ্বিধায় চলচ্চিত্রে তুলে ধরা।
- সাহসিকতা: সেন্সরশিপ ও রাজনৈতিক চাপের ভয় না করে সত্যকে প্রকাশ করা।
- অভিনবতা: প্রযুক্তি, কাহিনি ও নির্মাণশৈলীতে নতুনত্ব আনা।
উত্তরাধিকার
বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা জহির রায়হান থেকে শিখতে পারে—
- চলচ্চিত্র ও সাহিত্য হতে পারে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার।
- শিল্প মানে দায়িত্ব ও সততা।
- ছোট পরিসর থেকেও বড় আন্দোলন শুরু করা যায়।
আজও তাঁর রচনা ও চলচ্চিত্র গবেষক, ছাত্র ও নির্মাতাদের অনুপ্রেরণার উৎস।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
জহির রায়হানের কাজ সীমান্ত ছাড়িয়ে প্রশংসিত হয়েছে। ‘স্টপ জেনোসাইড’ মুক্তির পর বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকার সোভিয়েত পরিচালক ইয়ারি ইভানভ প্রমুখ তাঁর কাজকে বিপ্লবী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে তাঁর নাম উচ্চারিত হয়েছে সম্মানের সঙ্গে।
কেন তিনি চিরস্মরণীয়?
- তিনি ছিলেন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির গৌরবময় রক্ষক।
- তাঁর লেখনীতে গ্রামীণ জীবন, প্রেম ও সংগ্রাম জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
- তাঁর চলচ্চিত্র জনগণের কণ্ঠস্বর হিসেবে ইতিহাসের দলিলে পরিণত হয়েছে।
- তাঁর মৃত্যু জাতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি, তবে তাঁর সৃষ্টি চিরজীবী।
অভিনয় গুরুকুলের শ্রদ্ধা
অভিনয় ও চলচ্চিত্র শিক্ষার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে আমরা অভিনয় গুরুকুল বিশ্বাস করি—
জহির রায়হানের সৃষ্টিকর্ম নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে। তাঁর সাহিত্যের গভীরতা, চলচ্চিত্রের শিল্পিতা এবং মানবিক মূল্যবোধ আমাদের মনে চিরকাল অমলিন হয়ে থাকবে।
সমাপনী শ্রদ্ধাঞ্জলি
আজ, ১৯ আগস্ট, আমরা শুধু একজন শিল্পীকে নয়, এক মহান চিন্তাবিদ, এক সামাজিক বিপ্লবীকে স্মরণ করছি।
চিরস্মরণীয় জহির রায়হানকে অভিনয় গুরুকুলের পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধা ও প্রণাম।
#ZahirRaihan #BangladeshiCinema #FilmLegend #Filmmaker #Storyteller #CinemaIcon #BangladeshCinema #FilmGuruKul #RIPZahirRaihan #CinemaTribute #BanglaFilmHistory #BanglaCinema #BanglaCulture

#ZahirRaihan #BangladeshiCinema #FilmLegend #Filmmaker #Storyteller #CinemaIcon #BangladeshCinema #FilmGuruKul #RIPZahirRaihan #CinemaTribute #BanglaFilmHistory #BanglaCinema #BanglaCulture