তন্দ্রা বর্মণ নামটা শোনা-শোনা লাগলেও, তাঁকে আর অনেকেই মনে করতে পারেন না ইদানীং। কী করেই বা পারবেন, তিনি তো চল্লিশ বছরের বেশি সময় অন্তরালে ছিলেন। আসেননি কখনও মিডিয়ার সামনে। কিন্তু ‘ভুল সবই ভুল’– এই বিখ্যাত গানটির কথা বললে মনে পড়ছে কারও মুখ? একজোড়া মায়াবি চোখ? ‘অতল জলের আহ্বান’ ছবির সেই গানের নায়িকা ছিলেন তন্দ্রা বর্মন। সেই ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বিপরীতে নায়িকা হন তন্দ্রা। কিন্তু একসময়ে হারিয়ে যান তিনি। অথচ রেডিওর গানে বা ছায়াছবির পর্দায় তাঁর চকিত দর্শন আজও অনেকেরই মন উদ্বেল করে তোলে।

বাবা যেহেতু শিল্পী মানুষ ছিলেন, তাই তাঁর খুব শখ ছিল মেয়ে সিনেমায় আসুক। সেই কারণেই বাবা নরেন্দ্রনাথ তন্দ্রাকে ছোট থেকেই পিল্লাই গুরুজির কাছে নাচের তালিম নিতে পাঠান। কিন্তু সিঙ্গুরের মতো গ্রাম্য পরিবেশে, বাড়ির মেয়ে নাচবে– এমনটা কেউই ভাল চোখে দেখতনা। নানা কূটকচালি হত তন্দ্রার নাচ শেখা নিয়ে। খারাপ মেয়ে তকমা জুটল তন্দ্রার। তন্দ্রাদের ছিল রক্ষণশীল যৌথ পরিবার, সেখানেও পরিবারের অনেক সদস্য তন্দ্রাকে নিচু চোখে দেখতেন। কিছুদিন সেতার শেখাও রপ্ত করেছিলেন তন্দ্রা। কিন্তু তাঁর শিল্পের কদর কেউই করত না।
তন্দ্রা বর্মনের জন্ম ১৯৪০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর হুগলির সিঙ্গুরে। পিতার নাম নরেন্দ্রনাথ বর্মন। মায়ের নাম যমুনাদেবী। চেতলা গার্লস স্কুলে কিছুদিন পড়াশোনা করেছিলেন। পারিবারিক কারণে আর পড়াশোনা হয়নি। চলচ্চিত্রে প্রথম সুযোগ পান বাবার বন্ধু হেমেন্দ্র মিত্রর ছবি ‘দুই তীরে’ কিন্তু মহরতের পরেই ছবির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর প্রযোজক গোবিন্দ বর্মন সুযোগ দেন ‘ভিজে বিড়াল’ ছবিতে। তিনি আশিস কুমারের বিপরীতে। এ-ছাড়া অনুপ কুমার সহ অনেক শিল্পী ছিলেন। সেই ছবিটিও নানান কারণে মুক্তি লাভ করেনি। তবে ইতিমধ্যে তিনি কাজ করেছেন ‘স্বপ্নপুরী’ ছবিতে এবং পরিচালক নীরেন লাহিড়ীর ‘তানসেন’ ছবিতে। তিনি নাচ শিখেছিলেন।
বাংলা ছবির প্রখ্যাত প্রচারবিদ ফণীন্দ্র পাল তন্দ্রা বর্মনকে নিয়ে গেলেন বিকাশ রায়ের কাছে। বিকাশ হয় তখন প্রমথনাথ বিশীর কাহিনি অবলম্বনে ‘কেরী সাহেবের মুন্সী’ ছবিটি নির্মাণ করতে চলেছেন। বিকাশ রায় নিজে মুন্সি রামরাম বসুর চরিত্রে, কেরী সাহেবের চরিত্রে ছবি বিশ্বাস। এ-ছাড়া পাহাড়ী সান্যাল, নীতীশ মুখোপাধ্যায়, মঞ্জু দে-সহ অসংখ্য শিল্পী। উপন্যাসটির একটি স্মরণীয় চরিত্রের নাম রেশমি। বিধবা হলে তাকে যেতে হবে সহমরণে। সব আয়োজন সম্পন্ন।
দৈবক্রমে তাঁকে উদ্ধার করেন ইংরেজ যুবক জন। পাশ্চাত্য রীতিতে দীক্ষিত হয়ে ওঠেন রেশমি। রেশমি ও জন দুজনে দুজনের কাছাকাছি এলেন কিন্তু রেশমির জীবনে সুখ নেই। তিনি অপহৃতা হন। মতি রায়ের বাগানবাড়িতে বন্দিনী রেশমি। মুক্তির পথ তাঁর জানা ছিল। নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে পুড়ে মরলেন রেশমি। এমন জটিল চরিত্রের জন্য বিকাশ রায় খুঁজছিলেন একজন নতুন শিল্পী। সেই সময় যোগাযোগ হল তন্দ্রা বর্মনের সঙ্গে। স্ক্রিন টেস্ট নেওয়া হল। উত্তীর্ণ হলেন। রেশমির চরিত্রে তাঁর অভিনয় দর্শকের মনে দাগ কাটল।
তন্দ্রা বর্মণ অভিনীত উল্লেখযোগ্য চরিত্র:
- রেশমী (কেরী সাহেবের মুন্সী, ১৯৬১)
- সাবিত্রী (অতল জলের আহ্বান, ১৯৬২)
- নায়কের ভাগ্নি (এক টুকরো আগুন, ১৯৬৩)
- দীপু (দুই বাড়ী, ১৯৬৩)
- মায়া (ন্যায়, ১৯৬৩)
- দীপিকা (সেবা, ১৯৬৭) প্রভৃতি।

তন্দ্রা বর্মণ নীরেন লাহিড়ী ছাড়াও কাজ করেছেন বিকাশ রায়, অজয় কর, বিনু বর্ধন, মঙ্গল চক্রবর্তী, ভোলানাথ আঢ্য, অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়, অগ্রদূত প্রভৃতি পরিচালকের সাথে। অতল জলের আহ্বান ছবিতে তাঁর প্রায় নির্বাক অভিনয় দর্শকদের পাশাপাশি চলচ্চিত্র সমালোচকদেরও প্রশংসা পেয়েছিল।

তন্দ্রা বর্মণের চলচ্চিত্রপঞ্জি—
- ১৯৫৮ তানসেন
- ১৯৫৯ স্বপনপুরী,
- ১৯৬১ কেরী সাহেবের মুন্সী,
- ১৯৬২ অতল জলের আহ্বান;
- ১৯৬৩ এক টুকরো আগুন, দুই বাড়ী, ন্যায়দণ্ড,
- ১৯৬৭ সেবা:
- ১৯৭০ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, মঞ্জরী অপেরা,
- ১৯৭৯ আমি রতন।
আরও দেখুনঃ