তৃপ্তি মিত্র প্রধানত নাট্য ব্যক্তিত্ব, জন্ম দিনাজপুর জেলায় ঠাকুরগী গ্রামে (বর্তমান বাংলাদেশ)। স্কুল শিক্ষা প্রথমে দিনাজপুরে মাইনর স্কুলে, পরে প্যারীচরণ স্কুল থেকে ১৯৪৩ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। কলেজে ভর্তি হলেও প্রথাগত শিক্ষা অসম্পূর্ণ রেখে এ. আর. পি. -তে চাকরি নেন। কলেজে পড়ার সময় ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য ছিলেন। এই সময় থেকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি নাট্যাভিনয়ও শুরু করেন। প্রগতিশীল নাট্য আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। বিজন ভট্টাচার্য ছিলেন মাসতুত দাদা।
তৃপ্তি মিত্র
ভারতীয় গণনাট্যসংঘ প্রযোজিত আগুন নাটকে অভিনয় করেন। গণনাট্যের পরবর্তী প্রযোজনা ল্যাবরেটরি, নবান্ন, জবানবন্দী, মুক্তধারা প্রভৃতি নাটকেও অভিনয় করেন। গণনাট্য সংঘে অভিনয়ের সুত্রে শম্ভু মিত্রের সাথে ঘনিষ্ঠতা এবং বিবাহ। গণনাট্য প্রযোজিত খাজা আহম্মদ আব্বাস পরিচালিত ছবি ধরতি কে লাল (১৯৪৬) ছবিতে অভিনয় করেন।
১৯৪৮ সালে তৈরি হয় বহুরূপী। প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে ছিলেন শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, বঙ্গাপন বসু, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, মহম্মদ ইসরাইল,কলিম শরাফী, তুলসী লাহিড়ী ইত্যাদি। প্রথম অভিনীত নাটক নবান্ন রঙমহল নাট্যমঞ্চে ১৯৪৮ সালে অভিনীত হয়।
তুলসী লাহিড়ীর লেখা বহুরূপীর মঞ্চসফল নাটক অবলম্বনে দেবকী বসুর পরিচালনায় পথিক (১৯৫৩) ছবিতে সুমিত্রার ভূমিকায় অভিনয় করেন। পরবর্তী ছবি প্রেমেন্দ্র মিত্র পরিচালিত মালা কাগজ (১৯৫৪), এই ছবিতে তিনি সুদাসের (ধীরাজ ভট্টাচার্য) স্ত্রীর ভূমিকায় ছিলেন। দো বিঘা জমিন-এর বাংলা রূপান্তর সত্যেন বসু পরিচালিত রিক্সাওয়ালা (১৯৫৫) ছবিতে আণুবীর চরিত্রে তাঁর অভিনয় দর্শকদের প্রশংসা পেয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই ছবিতে শশীর ভূমিকায় অভিনয় করেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৯৫৩-৭৭ পর্যন্ত তিনি বারোটি বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছিলেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলি হল শুভবিবাহ (৫৯) ছবিতে সন্ধ্যা, মানিক ছবিতে ফকিরের প্রেমিকা নিলি, কাঞ্চনরঙ্গ (৬৪) ছবিতে তরলা এবং যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৭) ছবিতে নীলকন্ঠর স্ত্রীর চরিত্র।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তান ও ব্রিটিশ চলচ্চিত্রের দুটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ প্রযোজনায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি জাগো হুয়া সাভোরা’ নামক উর্দু ছবিতে কপিলার ভূমিকায় অভিনয় করেন। এ ছাড়া অনেকগুলি হিন্দী ছবিতেও অভিনয় করেন।
তৃপ্তি মিত্র চলচ্চিত্রে কমই কাজ করেছেন, এমন কিছু চরিত্রে কাজ করেছেন যারা আমাদের নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবনের চরিত্র নয়। অনেক সময় সমাজের প্রান্তিক মানুষের চরিত্র, আবার অনেক সময় গ্রাম বাংলার কথ্য ভাষায় এই চরিত্রগুলি কথা বলে, সব ক্ষেত্রেই তাঁর স্বচ্ছন্দ অভিনয় সমালোচকদের প্রশংসা পেয়েছে।

যদিও চলচ্চিত্র অপেক্ষা নাটকে তিনি অধিক স্বচ্ছন্দ। বহুরূপীর প্রযোজনায় অনেক নাটক তাঁর নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয়েছে – তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ডাকঘর, অপরাজিতা, ঘরে বাইরে, কিংবদন্তি। অপরাজিতায় তাঁর একক অভিনয় নাট্যক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রমী প্রযোজনা, পুতুল খেলায় বুলু, রক্তকরবীতে নন্দিনী ইত্যাদি চরিত্রগুলিতে তাঁর অভিনয় রেকর্ড করে রাখতে পারলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম উপকৃত হত। পেশাদারি মঞ্চেও অভিনয় করেছেন সেতু, বিরাজ বৌ, গৃহলক্ষ্মী, থানা থেকে আসছি, বিনাস ইত্যাদি নাটকে।
১৯৮০ সালে সাংগঠনিক বিরোধে বহুরূপী ত্যাগ করেন। যে সংগঠনের তিনি ছিলেন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও উদ্যোক্তা, সেই সংগঠন ছাড়তে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন।
তাঁর লেখা নাটকগুলি ‘তৃপ্তি মিত্র নাটক সমগ্র’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাকে সম্মান জানিয়েছে। ১৯৬২ সালে পান সংগীত নাটক অকাদেমি পুরস্কার, ১৯৭১-এ পদ্মশ্রী, ১৯৮৭ সালে পান পশ্চিমবঙ্গ নাট্য অকাদেমির দীনবন্ধু পুরস্কার, মধ্যপ্রদেশ সরকার ১৯৮৯ সালে তাঁকে কালিদাস পুরস্কার দিয়ে সম্মান জানায়। ১৯৮০-৮১ সালে তিনি ছিলেন বিশ্বভারতীর ভিজিটিং ফেলো। নান্দীকারের ২৫ বছর পালনের সময়ে তাকে সম্বর্থনা জানানো হয়। ১৯৮৯এ তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
চলচ্চিত্র পঞ্জি —
- ১৯৫১ বোধোদয়,
- ১৯৫৩ পথিক,
- ১৯৫৪ ময়লা কাগজ
- ১৯৫৫ রিক্সাওয়ালা, আর মা কালী বোর্ডিং,
- ১৯৫৬ আশা
- ১৯৫৯ শুভবিবাহ,
- ১৯৬১ মানিক
- ১৯৬২ সুর্যস্নান
- ১৯৬৪ কাঞ্চনরঙ্গ,
- ১৯৬৭ সেবা,
- ১৯৬৮ চারণকবি মুকুন্দদাস
- ১৯৭৭ যুক্তি তক্কো আর গপ্পো।
আরও দেখুনঃ