বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে গৌতম ঘোষের নাম এক বিশেষ মর্যাদায় উচ্চারিত হয়। তিনি শুধুমাত্র একজন পরিচালকেরই ভূমিকা পালন করেননি, বরং সৃষ্টিশীলতা, সমাজতত্ত্ব, এবং ইতিহাসের প্রতি তাঁর আগ্রহের মাধ্যমে বাংলা সিনেমার জগতে একটি নতুন দিশা দেখিয়েছেন। ‘দখল’ (১৯৮১) তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যা আজও বাংলা চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মনে এক স্থায়ী স্থান দখল করে রয়েছে।
দখল চলচ্চিত্র
গৌতম ঘোষের সৃজনশীল পথচলা
গৌতম ঘোষের নাম সাধারণত তথ্যচিত্র নির্মাতা হিসেবে পরিচিত, এবং তাঁর প্রথম দিকের কাজ যেমন ‘হাংরি অটাম’ (১৯৭৬) আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছে। তাঁর পরিচালনার ধরন এবং চলচ্চিত্রের গভীরতা আজও তাঁকে একটি আলাদা পরিচিতি দিয়েছে। তবে, চলচ্চিত্রের বাইরে গৌতম ঘোষের অবদানও অসাধারণ। তাঁর ছবিতে সঙ্গীতের অসামান্য প্রয়োগ, এবং ছবির প্রতিটি দৃশ্যে সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সমাজতত্ত্বের পরিচয় পাওয়া যায়।
‘দখল’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে গৌতম ঘোষ যে অসাধারণ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন, তার মাধ্যমে সমাজের শোষণ, মানবাধিকার, এবং একটি নিপীড়িত মানুষের আত্মমর্যাদার লড়াইকে অত্যন্ত মানবিকভাবে তুলে ধরেছেন। এই ছবিটি ইতিহাসের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসার এক নিদর্শন।
চলচ্চিত্রের প্রযোজনা এবং কলাকুশলী
‘দখল’-এর প্রযোজনার দায়িত্ব ছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ওপর। চলচ্চিত্রটির কাহিনি রচনা করেছেন সুশীল জানা, চিত্রগ্রহণ, সংগীত এবং পরিচালনা করেছেন গৌতম ঘোষ নিজেই। চিত্রনাট্যটি লিখেছেন গৌতম ঘোষ এবং পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়। শিল্প নির্দেশনায় ছিলেন অশোক বসু এবং সম্পাদনা করেছেন প্রশান্ত দে।
অভিনয়শিল্পীরা
‘দখল’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন উল্লেখযোগ্য শিল্পীরা, যাদের মধ্যে প্রধান চরিত্রে ছিলেন মমতাশঙ্কর (আন্দি), সুনীল মুখোপাধ্যায় (মগন), বিমল দেব (গোবিন্দ), রবীন সেনগুপ্ত (বাগম্বর), সজল রায়চৌধুরী, সুশীল জানা, বনবিহারী জানা এবং অমর ভট্টাচার্য।
চলচ্চিত্রের অভিনয়শিল্পীদের তালিকা:
চরিত্র | অভিনেতা/অভিনেত্রী |
---|---|
আন্দি (কেন্দ্রীয় চরিত্র) | মমতাশঙ্কর |
মগন | সুনীল মুখোপাধ্যায় |
গোবিন্দ | বিমল দেব |
বাগম্বর | রবীন সেনগুপ্ত |
অন্যান্য | সজল রায়চৌধুরী, সুশীল জানা, বনবিহারী জানা, অমর ভট্টাচার্য |
কাহিনী: শোষণ ও প্রতিরোধের গল্প
‘দখল’ চলচ্চিত্রের কাহিনির মূল চরিত্র আন্দি (মমতাশঙ্কর), যিনি যাযাবর কাকমারা সম্প্রদায়ের মেয়ে এবং একটি অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ যোগা পাইকের (তার স্বামী) সঙ্গে প্রেমে পড়ে বিয়ে করেন। তাদের জীবন দক্ষিণবঙ্গের ভাটি অঞ্চলে কষ্টে কাটলেও, তাদের জীবনকে টিকিয়ে রাখার জন্য জমিজমা চাষে তারা মনোযোগী ছিল।
তাদের একমাত্র সন্তান শ্যামলী ছিল। কিন্তু আন্দি যখন দ্বিতীয়বার সন্তানসম্ভবা হন, তখন সাপের কামড়ে যোগার মৃত্যু হয়। এরপর মগন (সুনীল) হন আন্দির একমাত্র সহায়। এই সময়েই গ্রামের জমিদার গোবিন্দ (বিমল) তার জমি গ্রাস করার চেষ্টা শুরু করে। তার যুক্তি ছিল, যেহেতু আন্দি কাকমারা সম্প্রদায়ের মেয়ে, তার বিয়ে আইনসিদ্ধ নয় এবং সে অতএব জমির উত্তরাধিকারী হতে পারে না।
এই ঘটনার পর গোবিন্দের লোকেরা আন্দির বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। তবে, কাকমারা সম্প্রদায় এবং তাদের নেতা বাগম্বর (রবীন সেনগুপ্ত) আন্দির পাশে এসে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু আন্দি তাদের সাহায্য প্রত্যাখ্যান করে, কেননা সে তার নিজের সংগ্রাম নিজেই লড়তে চায়।
সমাজতত্ত্ব এবং মানবাধিকার
‘দখল’ চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে গৌতম ঘোষ সমাজের শোষণ, মানবাধিকার এবং সমাজের নিচু শ্রেণির মানুষের প্রতি ব্যবহারের অমানবিকতার প্রতিবাদ করেছেন। ছবিটি দেখায় যে, একজন নারী যখন তার মানবাধিকার রক্ষা করতে চায়, তখন তাকে শুধু তার ন্যায়বিচারের জন্য যুদ্ধ করতে হয় না, বরং সমাজের আরও অনেক নিয়ম ও বিধির সাথে এক সঙ্গে লড়াই করতে হয়।
পুরস্কার ও সম্মান
‘দখল’ চলচ্চিত্রটি দেশের এবং বিদেশে বহু পুরস্কৃত হয়েছে। ১৯৮১ সালে ভারত সরকারের রাষ্ট্রপতির স্বর্ণকমল পুরস্কার লাভ করে এটি শ্রেষ্ঠ ছবির জন্য। এছাড়াও, ফ্রান্সের একাদশ মানবাধিকার চলচ্চিত্র উৎসবে জুরি পুরস্কার এবং পর্তুগালের ফিরা ডি ফোজ উৎসবে রৌপ্য পদক অর্জন করে। এছাড়া এটি লন্ডন, সিডনি, লোকার্নো চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে।
পুরস্কারের তালিকা:
পুরস্কার | অর্জিত উৎসব/সংস্থা |
---|---|
শ্রেষ্ঠ ছবি (রাষ্ট্রপতির স্বর্ণকমল পুরস্কার) | ভারত সরকার |
জুরি পুরস্কার | একাদশ মানবাধিকার চলচ্চিত্র উৎসব (ফ্রান্স) |
রৌপ্য পদক | ফিরা ডি ফোজ উৎসব (পর্তুগাল) |
প্রদর্শন | লন্ডন, সিডনি, লোকার্নো চলচ্চিত্র উৎসব |

‘দখল’ চলচ্চিত্রটি শুধুমাত্র একটি চলচ্চিত্র নয়, এটি একটি সামাজিক বার্তা। গৌতম ঘোষ তার পরিচালনায় একদিকে যেমন অমানবিকতা ও শোষণের বিরোধিতা করেছেন, অন্যদিকে এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সমাজের নিপীড়িত শ্রেণির শক্তি ও সাহসিকতাকেও তুলে ধরেছেন। এই ছবিটি আজও আমাদের শেখায় যে, নিজের অধিকার রক্ষা করতে গেলে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা এবং শোষণকেও পরাজিত করতে হবে।
আরও দেখুনঃ