১৯৮০ সালের এক সোনালী সময়, ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রে মুক্তি পেয়েছিল একটি অমর চলচ্চিত্র – দাদার কীর্তি। পরিচালনা করেছিলেন এক ব্যতিক্রমী নির্মাতা তরুণ মজুমদার। ছবিটি আজও বাংলার চলচ্চিত্রপ্রেমীদের হৃদয়ে এক অমূল্য রত্ন হিসেবে স্থান করে রেখেছে। এটি ছিল তাপস পাল এবং দেবশ্রী রায়ের প্রথম চলচ্চিত্র এবং তাদের অভিনয় জীবনের এক বিশেষ মুহূর্ত। ছবির গানের সুর, কাহিনি, চরিত্রের গভীরতা – সবই এক ঐতিহ্যপূর্ণ যুগের সাক্ষী হয়ে আজও সমাদৃত।

দাদার কীর্তি চলচ্চিত্র
চলচ্চিত্রের কাহিনি
দাদার কীর্তি চলচ্চিত্রের কাহিনি এক তরুণ যুবক কেদার (তাপস পাল) কে নিয়ে, যিনি বার বার বিএ পরীক্ষায় ফেল করে বাবা-মায়ের প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হন। তাদের অনুরোধে, কেদারকে তার কাকার কাছে পাঠানো হয় বিহারের একটি শহরে। সেখানে তার জীবন নতুনভাবে মোড় নেয়। কেদার সরস্বতী (মহুয়া রায়চৌধুরী) নামের এক কড়া মেজাজের মেয়ের প্রেমে পড়ে। সরস্বতী ছিল একটি পরিশ্রমী, সিরিয়াস মেয়ে, যিনি জীবনের সাথে খুবই যুক্ত। কেদার এবং সরস্বতীর মধ্যে সম্পর্কের প্রথম সূচনা হয় ভোম্বলদার (অনুপকুমার) কেরামতিতে।
তবে, ভুল বোঝাবুঝির কারণে দুজনের মধ্যে সম্পর্কের প্রথম দিকে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। সরস্বতী কেদারের প্রতি বিরক্ত হয়ে ওঠে, কিন্তু শেষে সমস্ত ভুল বোঝাবুঝি দূর হয়ে তাদের সম্পর্ক মিষ্টি হতে শুরু করে।

চরিত্র বিশ্লেষণ
কেদার (তাপস পাল): কেদার ছিল একজন সাদাসিধা, সরল মনের ছেলে। যে পাস করতে পারেনি, কিন্তু তার চরিত্রে ছিল অগাধ ভালোবাসা, সততা, এবং অন্যকে সাহায্য করার ইচ্ছা।
সরস্বতী (মহুয়া রায়চৌধুরী): সরস্বতী ছিল এক চ্যালেঞ্জিং, কঠোর মনের মেয়ে। যিনি কোনও কিছু না শিখলে মেনে নিতেন না। তার মধ্যেও ছিল এক গভীর কোমলতা, যা কেদারের সাথে সম্পর্কের মধ্যে ফুটে উঠেছিল।
ভোম্বল (অনুপকুমার): তিনি ছিলেন গল্পের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, যিনি অনেক সময় পরিস্থিতি বদলে দিতেন।
শিল্পী ও কলাকুশলীরা
দাদার কীর্তি চলচ্চিত্রে বিশিষ্ট অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয় একটি অমূল্য রত্ন হয়ে রয়েছে। অভিনেতা তাপস পাল এবং মহুয়া রায়চৌধুরী ছাড়াও, যাদের অভিনয়ের প্রশংসা পেয়েছিল তারা হলেন:
অভিনেতা/অভিনেত্রী | চরিত্র |
---|---|
তাপস পাল | কেদার |
মহুয়া রায়চৌধুরী | সরস্বতী |
অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় | সন্তু |
দেবশ্রী রায় | বীণা |
অনুপকুমার | ভোম্বল |
কালী বন্দ্যোপাধ্যায় | ক্ষিতীন্দ্র বাবু |
রুমা গুহঠাকুরতা | মনোরমা |
সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় | পরিতোষ |
সন্ধ্যা রায় | চঞ্চলা |
শমিত ভঞ্জ | অনিল |
এছাড়া, চলচ্চিত্রের নেপথ্য কণ্ঠের জন্য সংগীত পরিচালনা করেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, এবং অরুন্ধতী হোমচৌধুরী। এরা সকলেই চলচ্চিত্রের মধুর সংগীতের মাধ্যমে দর্শকদের মুগ্ধ করেছেন।
সংগীত এবং গান
এই চলচ্চিত্রের সংগীত ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের মধ্যে দিয়ে। ছবির গানগুলো এমনভাবে দর্শকদের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল, যে তা প্রায় প্রতিটি পরিবারের অঙ্গ হয়ে ওঠে। গানগুলো ছিল শুধুমাত্র চলচ্চিত্রের অংশ নয়, বরং এক একক সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং হৃদয়েশ পাণ্ডে গীতিকার হিসেবে কাজ করেছেন।
চলচ্চিত্রের প্রতিক্রিয়া
দাদার কীর্তি চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাওয়ার পর ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এটি তৎকালীন সময়ের দর্শকদের মনে একটি গভীর ছাপ রেখে যায়। ছবিটি ১৯৮০-৮১ সালে ইন্ডিয়ান প্যানোরামা-তে অন্তর্ভুক্ত হয়, যা এই ছবির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রমাণ।
টেকনিক্যাল তথ্য
প্রযোজনা: রাম সিনে আর্টস
প্রযোজক: রাম গুপ্ত
চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: তরুণ মজুমদার
মূল কাহিনি: শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
সংগীত পরিচালনা: হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
চিত্রগ্রহণ: শক্তি বন্দ্যোপাধ্যায়
শিল্প নির্দেশনা: সুরেশচন্দ্র চন্দ
সম্পাদনা: রমেশ যোশী, শক্তিপদ রায়
নৃত্য নির্দেশনা: অসিত চট্টোপাধ্যায়
শব্দগ্রহণ: অনিল দাশগুপ্ত, সোমেন চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতি চট্টোপাধ্যায়, অমূল্য দাস

দাদার কীর্তি শুধুমাত্র একটি চলচ্চিত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি একটি যুগের প্রতিচ্ছবি, যা বাংলা চলচ্চিত্রের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে ধারণ করে। তরুণ মজুমদারের দক্ষ পরিচালনা, শক্তিশালী কাহিনি, মনোমুগ্ধকর সংগীত এবং প্রতিভাবান অভিনেতা-অভিনেত্রীর অসাধারণ অভিনয় একত্রে এই চলচ্চিত্রকে সৃষ্টির এক মাইলফলক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আজও যখন আমরা এই চলচ্চিত্রের কথা স্মরণ করি, আমরা একটি নিখুঁত সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা লাভ করি।
আরও দেখুনঃ