অভিনয়শিল্পীদের কাছে প্রতিদিনের অনুশীলন মানে শরীর, কণ্ঠস্বর ও মানসিক শক্তিকে প্রস্তুত রাখা। একজন গায়ক যেমন রেওয়াজ ছাড়া কণ্ঠ শাণিত রাখতে পারেন না, তেমনি অভিনেতাও প্রতিদিনের নির্দিষ্ট সময় ধরে অনুশীলন না করলে অভিনয়ের স্বাভাবিকতা ও তীক্ষ্ণতা ধরে রাখতে পারেন না। সময়ের অভাবে বড় আকারের অনুশীলন সবসময় সম্ভব না হলেও, প্রতিদিন মাত্র ২০ মিনিটের একটি রুটিন অভিনেতাকে সজীব, আত্মবিশ্বাসী ও দক্ষ রাখবে।
১. শারীরিক উষ্ণতা (৩ মিনিট)
অভিনয়ের জন্য শরীর হলো অভিনেতার প্রথম ও প্রধান হাতিয়ার। তাই প্রতিটি অনুশীলনের শুরুতেই শরীরকে প্রস্তুত করা অপরিহার্য। শরীরকে নমনীয়, শিথিল ও সজাগ না করলে অভিনয়ের সময় অঙ্গভঙ্গি জড়তা পেতে পারে এবং আবেগের প্রকাশে ঘাটতি দেখা দেয়। এই উষ্ণায়ন অনুশীলন শরীরকে কেবল সক্রিয়ই করে না, বরং মঞ্চ বা ক্যামেরার সামনে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।
হালকা স্ট্রেচিং (১ মিনিট)
ঘাড় একদিকে থেকে অন্যদিকে ধীরে ঘোরানো।
কাঁধ উপরে তুলে আবার নামানো।
হাত ও পা প্রসারিত করে টান ধরা এবং আলগা করা।
এর ফলে শরীরের পেশি খুলে যায় এবং জড়তা কেটে যায়।
শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম (১ মিনিট)
গভীর শ্বাস নিয়ে চার গুন গোনা পর্যন্ত ধরে রাখা, তারপর ধীরে ধীরে ছেড়ে দেওয়া।
বুকে নয়, বরং পেট থেকে শ্বাস নেওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা (diaphragmatic breathing)।
এটি ফুসফুসের নিয়ন্ত্রণ বাড়ায়, সংলাপকে শক্তিশালী করে এবং আবেগ প্রকাশে স্বরকে সমৃদ্ধ করে।
ভঙ্গি সচেতনতা (১ মিনিট)
সোজা হয়ে দাঁড়ানো, মাথা ও ঘাড় স্বাভাবিকভাবে রাখা।
শরীরের ভারসাম্য এক পায়ে না দিয়ে সমানভাবে দুই পায়ে রাখা।
চোখ সামনে রেখে হালকা মৃদু হাসি দিয়ে দাঁড়ানো।
এর মাধ্যমে শরীর আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গি অর্জন করে, যা চরিত্রে প্রবেশের জন্য মানসিক প্রস্তুতি তৈরি করে।
২. কণ্ঠস্বর ও উচ্চারণ অনুশীলন (৫ মিনিট)
অভিনয়ের প্রাণ হলো কণ্ঠস্বর। সংলাপ কেবল শব্দ উচ্চারণ নয়, বরং এর ভেতরে থাকে আবেগ, সুর, ছন্দ ও শক্তি। কণ্ঠস্বর যদি শক্তিশালী, পরিষ্কার ও নিয়ন্ত্রিত না হয়, তবে অভিনয়ের আবেগ দর্শকের কাছে পৌঁছায় না। তাই প্রতিদিন কণ্ঠচর্চা অপরিহার্য। এই অনুশীলনের মাধ্যমে শ্বাসপ্রশ্বাসের নিয়ন্ত্রণ বাড়ে, উচ্চারণ হয় স্পষ্ট, এবং কণ্ঠে আসে ভর ও আবেগপ্রবাহ।
হামিং (১ মিনিট)
ঠোঁট আলতো বন্ধ করে “ম্-ম্” শব্দ করা।
ধীরে ধীরে গলার গভীর থেকে মাথার শীর্ষ পর্যন্ত কম্পন অনুভব করা।
এই অনুশীলন কণ্ঠযন্ত্র গরম করে, গলা খোলে এবং স্বরের স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনে।
স্বর অনুশীলন (১ মিনিট)
আ, ই, উ, এ, ও ধ্বনিগুলি লম্বা টেনে উচ্চারণ করা।
প্রতিটি স্বরধ্বনি স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করতে হবে যাতে ঠোঁট, জিভ ও দাঁতের মধ্যে সঠিক নিয়ন্ত্রণ আসে।
এর ফলে উচ্চারণ পরিষ্কার হয় এবং সংলাপে ধ্বনিগত স্বচ্ছতা বজায় থাকে।
টাং টুইস্টার (২ মিনিট)
কঠিন শব্দ বা বাক্য দ্রুত ও স্পষ্ট উচ্চারণের অনুশীলন।
যেমন: “টকটকে টক টকায় টক।” অথবা “রাজা রাজেশ্বর রাজার রাজত্বে।”
একই বাক্য ধীরে, মাঝারি ও দ্রুত গতিতে বলা।
এতে জিভ, ঠোঁট ও চোয়ালের পেশি সচল হয়, সংলাপ সাবলীল হয় এবং মঞ্চে বা ক্যামেরার সামনে আটকে যাওয়ার ভয় কমে যায়।
ভলিউম নিয়ন্ত্রণ (১ মিনিট)
একই বাক্য প্রথমে আস্তে, তারপর মাঝারি স্বরে, শেষে উচ্চস্বরে বলা।
শ্বাস-প্রশ্বাসের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে ভলিউম বাড়ানো বা কমানো।
এটি কণ্ঠের গতি ও শক্তি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, ফলে ছোট ঘরে বা বড় অডিটোরিয়ামে অভিনয় সমান কার্যকর হয়।
৩. মুখভঙ্গি ও শরীরী ভাষা (৪ মিনিট)
অভিনয়ের শক্তি কেবল সংলাপে সীমাবদ্ধ নয়, বরং মুখভঙ্গি ও শরীরী ভাষাই চরিত্রের প্রাণ। একজন অভিনেতার মুখ যেন আবেগের ক্যানভাস এবং শরীর যেন সেই আবেগকে বহন করার ভাষা। দর্শক প্রায়ই প্রথমে চরিত্রের অভিব্যক্তি ও দেহভঙ্গি থেকেই আবেগ উপলব্ধি করেন। তাই প্রতিদিন কয়েক মিনিট মুখভঙ্গি ও শরীরী ভাষার অনুশীলন অত্যন্ত জরুরি।
আয়নার সামনে অনুশীলন (২ মিনিট)
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পর্যায়ক্রমে মৌলিক আবেগ ফুটিয়ে তোলা:
আনন্দ – স্বতঃস্ফূর্ত হাসি, চোখে উজ্জ্বলতা।
দুঃখ – চোখ নীচু, ঠোঁট কাঁপা, কণ্ঠ ভারী ভাব।
রাগ – ভ্রূ কুঁচকানো, চোয়াল শক্ত করা, কণ্ঠ তীব্র।
বিস্ময় – চোখ বড় বড়, মুখ খানিকটা খোলা।
একই আবেগ ধীরে-ধীরে বাড়ানো ও কমানো, যাতে অভিনয়ে আবেগের সূক্ষ্মতা নিয়ন্ত্রণে থাকে।
এর ফলে মুখের পেশিগুলো সচল হয় এবং অভিব্যক্তি স্বাভাবিক ও প্রাণবন্ত হয়।
ভঙ্গি পরিবর্তন (২ মিনিট)
ভিন্ন ভিন্ন আবেগ শরীর দিয়ে প্রকাশ করা:
আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গি – বুক সোজা, মাথা উঁচু, পায়ের ভর সমানভাবে রাখা।
ভীত ভঙ্গি – কাঁধ নীচু, শরীর সঙ্কুচিত, চোখে আতঙ্ক।
ক্লান্ত ভঙ্গি – পিঠ বাঁকা, পা টেনে হাঁটা, কাঁধ ঝুঁকে থাকা।
একটি চরিত্র থেকে আরেকটি চরিত্রে ভঙ্গির দ্রুত পরিবর্তন করার অনুশীলন।
এর ফলে শরীর স্বয়ংক্রিয়ভাবে আবেগ প্রকাশে সক্ষম হয় এবং মঞ্চে চরিত্রান্তরের সময় স্বাভাবিক গতি বজায় থাকে।
৪. সংলাপ চর্চা (৫ মিনিট)
অভিনয়ের মূল প্রাণ হলো সংলাপ। শুধু শব্দ উচ্চারণ নয়, বরং এর ভেতরে থাকে আবেগ, ছন্দ, ওঠানামা ও প্রকাশভঙ্গি। প্রতিদিন সংলাপ চর্চা করলে অভিনেতার কণ্ঠে দৃঢ়তা আসে, আবেগের প্রকাশ স্বাভাবিক হয় এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ে।
প্রিয় নাটক বা কবিতা থেকে অংশ নির্বাচন (৩ মিনিট)
- প্রতিদিন নিজের পছন্দের কোনো নাটক, গল্প বা কবিতা থেকে একটি সংলাপ বা অংশ বেছে নিন।
- সংলাপটি প্রথমে ধীরে, স্পষ্ট উচ্চারণে পড়ুন।
- এরপর ধীরে ধীরে আবেগ যুক্ত করুন—যেমন আবেগঘন দৃশ্যে চোখ ও দেহভঙ্গির ব্যবহার।
এতে সংলাপের ভেতরের আবেগ খুঁজে পাওয়া যায় এবং চরিত্রের সঙ্গে ব্যক্তিগত সংযোগ তৈরি হয়।
একই সংলাপ ভিন্ন ভিন্ন আবেগে (২ মিনিট)
- নির্বাচিত সংলাপটি একাধিকভাবে প্রকাশ করুন:
- রাগের সুরে – কণ্ঠ জোরালো, শরীর টানটান।
- হাস্যরসে – কণ্ঠে হালকা সুর, চোখে খেলা, ঠোঁটে হাসি।
- শান্তভাবে – কণ্ঠ নরম, ছন্দ ধীর, শরীর স্থির।
- একই লাইন ভিন্ন আবেগে বলার মাধ্যমে সংলাপের বহুমাত্রিকতা ধরা যায়।
এর ফলে অভিনেতা চরিত্রের বিভিন্ন দিক অন্বেষণ করতে শেখেন এবং বাস্তব অভিনয়ে প্রয়োগে পারদর্শী হন।
৫. কল্পনা ও মনোসংযোগ (৩ মিনিট)
অভিনয়ের অন্যতম মূল চাবিকাঠি হলো কল্পনাশক্তি ও একাগ্রতা। একজন অভিনেতাকে প্রায়শই এমন পরিবেশ বা চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে হয় যা বাস্তবে উপস্থিত নয়—সেক্ষেত্রে কল্পনাশক্তিই তাকে সাহায্য করে। অন্যদিকে, অভিনয়ের সময় মঞ্চ বা ক্যামেরার সামনে বিভিন্ন বিভ্রান্তি থাকা সত্ত্বেও চরিত্রে নিবিষ্ট থাকার জন্য প্রয়োজন দৃঢ় মনোসংযোগ। এই দুই অনুশীলন মিলেই চরিত্রকে করে তোলে বাস্তব ও প্রাণবন্ত।
দৃশ্য কল্পনা (২ মিনিট)
চোখ বন্ধ করে নিজেকে ভিন্ন পরিবেশে কল্পনা করুন—যেমন যুদ্ধক্ষেত্রের ভয়াবহতা, সমুদ্রতীরের প্রশান্তি, কিংবা ভিড়ের মাঝে একাকীত্ব।
শুধু দৃশ্য নয়, পরিবেশের শব্দ, গন্ধ, আবহাওয়া ও অনুভূতিও কল্পনা করার চেষ্টা করুন।
তারপর সেই কল্পিত পরিবেশে নিজের চরিত্রকে স্থাপন করুন এবং কেমনভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবেন তা উপলব্ধি করুন।
এর ফলে চরিত্রের ভেতরে প্রবেশ করা সহজ হয় এবং অভিনয় অনেক বেশি বাস্তব ও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
ফোকাস অনুশীলন (১ মিনিট)
কাছের একটি বস্তু বেছে নিন (যেমন একটি কলম, ফুল বা কাপ)।
সেটির দিকে মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করুন—রঙ, আকার, গঠন, গন্ধ বা স্পর্শ কেমন।
এরপর মনে মনে সেই বস্তুর বিস্তারিত বর্ণনা দিন।
এই অনুশীলন মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করে এবং অভিনয়ের সময় সংলাপ, দেহভঙ্গি ও আবেগ প্রকাশে একাগ্রতা বাড়ায়।

অভিনয় হলো শরীর, কণ্ঠস্বর ও কল্পনার সমবায় শিল্প। প্রতিদিন মাত্র ২০ মিনিটের অনুশীলন অভিনেতাকে প্রস্তুত রাখে—
- শরীরকে নমনীয় ও সজীব করে,
- কণ্ঠকে জোরালো ও স্পষ্ট করে,
- মুখভঙ্গি ও ভঙ্গিমাকে প্রাণবন্ত করে,
- এবং মনকে একাগ্র ও কল্পনাপ্রবণ করে।
এই অনুশীলনই ধীরে ধীরে একজন শিল্পীকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে এবং মঞ্চ কিংবা ক্যামেরার সামনে তাঁকে করে তোলে আরও দক্ষ ও প্রাণবন্ত।