নাটক হোক সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার-বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের মঞ্চ নাটকে এই শ্লোগান ধ্বনিত হয়েছিলো। বিশেষ করে আশির দশকে মঞ্চনাটকের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হলো-নাটক হোক সমাজ সচেতনতার হাতিয়ার। সেখানে আরো বলা হলো নাটককে জনগণের মাঝখানে নিয়ে যেতে হবে, নাটকে জনগণের কথা বলতে হবে।
নাটক হবে জনগণের জন্য। নাটক শুধু বিনোদন বিতরণ করবে না, শিক্ষারও বাহন হয়ে উঠবে এবং জনগণের সংগ্রামে পাশে দাঁড়াবে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে তাহলে এর আগে নাটকের উদ্দেশ্য কী ছিলো? নাটক হোক সচেতনতা সৃষ্টির হাতিয়ার-এ কথা কী মানুষ বিশ শতকেই প্রথম ভেবেছিলো, নাকি তার আগেও তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা হয়েছিলো?
বাংলাদেশেই কী এই ভাবনার শুরু না অন্য কোথাও? প্রথম অধ্যায়ে আমাদের আলোচ্য বিষয় হবে ‘শিল্পের জন্য শিল্প নয়, শিল্প হোক সমাজ সচেতনতার হাতিয়ার’-বাংলাদেশের নাটক যে এ ধরনের একটি শ্লোগানকে নাট্যচর্চার জন্য বেছে নিয়েছিলো, কোন্ ধারাবাহিকতার কারণে তা সম্ভব হয়েছিলো তা খুঁজে দেখা। এই শ্লোগানটির উৎপত্তি কোথায়, কোন্ প্রেক্ষাপটে। পাশাপাশি আর একটি জিজ্ঞাসা তৈরি হয়, তাহলো নাটকে যখন সমাজ পরিবর্তনের কথা বলা হয়নি তখন তার চরিত্রটি কেমন ছিলো। নাটক তার জন্মলগ্ন থেকে কীভাবে বেড়ে উঠেছিলো? নাটক কবে থেকে শ্রেণীচেতনার হাতিয়ার হতে শুরু করলো?
তার জন্মলগ্ন থেকে না বহু পরে? এই অধ্যায় আমরা উপরে উল্লিখিত প্রশ্নগুলোরই উত্তর খুঁজবো। আর সেই জবাব খোঁজার জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে নাট্য ইতিহাসের শুরুতে। বারবার ফিরে যেতে হবে পাশ্চাত্যের কাছে যেখানে মূলত এই নাট্যধারার জন্ম ও বিকাশ। ভূমিকাতে আমরা দেখেছি, যাঁরা ‘শিল্পের জন্য শিল্প নয়’ বলতে চান তাঁরা বলতে চান আসলে শিল্পের একটি উপযোগিতা আছে।
আর যাঁরা বলছেন ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ তাঁরা শিল্পের উপযোগিতায় বিশ্বাস করেন না। এই বিরোধের শুরু কোথায় যেমন আমাদের জানা দরকার, তেমনি জানা দরকার শিল্প বা নাটকের জন্মলগ্নে তার কোনো উপযোগিতা ছিলো কি না। শিল্পের ইতিহাসের দিকে তাকালেই এ প্রশ্নের উত্তর আমরা পেয়ে যাবো। শিল্পের ইতিহাসের আলোকেই শুধু এর উত্তর পাওয়া সম্ভব।
নাটক মঞ্চায়নের উদ্দেশ্য ও রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার পশ্চাৎপট [ পর্ব ১ ]
শিল্প-সাহিত্যে প্রতিটি যুগের সামাজিক প্রতিফলন থাকে বলেই প্রত্যেক যুগের শিল্প-সাহিত্য মূল্যায়ন করার সময় সেই যুগের সামাজিক ইতিহাস জানাটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সমাজের কোন্ কোন্ ধারণা শিল্পে প্রতিফলিত হয়েছে আবার সেই শিল্পের প্রভাব সমাজের ওপর কীভাবে কতখানি পড়েছে তা বিশ্লেষণ ও বিচার করে রায় দেবার দায়িত্ব থাকে একজন গবেষকের। নাটকের ব্যাপারটাও তাই।
শিল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে কিছু বলা, নাট্যেরও। কী বলা বিরোধটা প্রধানত সেখানেই। কেউ বলছেন জীবন সত্য, কেউ বলছেন জীবন দর্শন। সেই জন্য নাটক ও নাট্যশালার পথ ধরে এগোতে গিয়ে দুনিয়ার মানুষ বারংবার হোঁচট খাচ্ছে, বিভ্রান্ত হচ্ছে, দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যাচ্ছে।
মুখোমুখি হচ্ছে নানা প্রশ্নের। সেই জন্যই সুদূর অতীত থেকে দীর্ঘদিন ধরে নাটক সম্পর্কে কে কী ভেবেছেন সে ইতিহাসটা জানা জরুরি। বিরাট সে ইতিহাসের নির্যাসটুকু অন্তত যে- কোনো নাট্য গবেষণার ক্ষেত্রে চিন্তায় থাকা দরকার। ভালোভাবে জানা দরকার নাটক ও নাট্য কী এবং কেন। জানা দরকার নাটক ও নাট্য সেই সুদূর অতীত থেকে কখন কোন চেহারা বা রূপ ধরে পথ হাঁটতে হাঁটতে আজকের পর্বে এসে দাঁড়িয়েছে। জীবন- মানুষ-সমাজ-এর পরিপ্রেক্ষিতে নাট্যের ভূমিকা কী এবং কতটুকু।
থিয়েটারের ইতিহাস পড়তে গিয়ে দেখি থিয়েটার কয়েকটি পাণ্ডুলিপির ইতিহাস নয় বরং থিয়েটার হলো “থিয়েটারী সত্য” সম্বন্ধে দীর্ঘ এক ধারাবাহিকতা, যার মূল দিটিতে আছে নাট্য প্রযোজনার ইতিহাস। থিয়েটারের ক্ষেত্রে থিয়েটারী সত্য হলো কোনো বিশেষ যুগের সঠিক এবং যথার্থ ইতিহাস। ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকেই থিয়েটারের অস্তিত্ব ছিলো।
থিয়েটার অমর তার কারণ এ নয় যে তার মৃত্যু নেই, তার কারণ বরং প্রতি মুহূর্তে তার নবজন্ম হচ্ছে জীবনকে ব্যাখ্যা করার জন্য।’ বিভিন্ন শিল্প মাধ্যম থেকে নাটকের পার্থক্য হলো, নাটক প্রতিবার অভিনয়ের মাধ্যমে নতুনভাবে সৃষ্টি হয়। থিয়েটারকে বেঁচে থাকার জন্য প্রতি যুগেই এমন ভঙ্গি আয়ত্ত করতে হয়েছে যা ছিলো সময়োপযোগী।
থিয়েটার বা নাটককে মঞ্চের নানা কৌশল যেমন আয়ত্ত করতে হয়েছে তেমনি জীবন সম্পর্কে বারবার পাল্টাতে হয়েছে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি। নাটক তাই নানা সময়ে নানা বার্তা বয়ে এনেছে। শিল্পের অন্যান্য শাখার মতোই নানান বিবর্তনের মধ্য দিয়েই সৃষ্টি হয়েছে নাট্যকলার। নাট্যকলার প্রয়োজনেই ক্রমশ তৈরি হয়েছে মঞ্চ। মঞ্চ যখন আবার বলিষ্ঠ পদক্ষেপে এগিয়ে এলো সে আবার নিজেই নাটক রচনায়, নাট্য প্রয়োগে প্রভাব ফেলেছে। থিয়েটারের ইতিহাস মানেই তাই নাটক এবং রঙ্গালয় এই উভয়ের ইতিহাস। নাট্য শব্দটির একটি বিস্তৃত পটভূমি আছে। বহু ভঙ্গি নিয়ে নাটক বারবার নতুন করে আবির্ভূত হয়েছে। ফলত মানুষের ধর্মবিশ্বাস, নীতিবোধ, সামাজিক-রীতি ও অনুষ্ঠান, জীবনকে গ্রহণ করার ভঙ্গি-সব মিলিয়ে এর যে পরিমণ্ডল তা পরিবেশ নিরপেক্ষ কোনো শূন্যতায় বেড়ে ওঠে না।
সমাজের একজন ব্যক্তির এবং একটি গোষ্ঠীর ধর্মান্ধতা, তার সমাজচিন্তা, তার বিদ্রোহ সবকিছুই প্রকাশ খোঁজে নাটকে বা নাট্যশিল্পে। সামাজিক ক্ষেত্রে যেমন পুরানো সামাজিক সম্পর্ক ভেঙে পড়লে নতুন সামাজিক সম্পর্ক জায়গা দখল করে নাটকের ক্ষেত্রে ঠিক তেমনি সামাজিক পরিবর্তনগুলোর সাথে সাথে নাটককে পুরানো ভঙ্গি ছেড়ে নতুন ভঙ্গির আশ্রয় নিতে হয়েছে। ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকে তাই কখন কীভাবে নাটক জীবন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রয়োগের ভঙ্গি পাল্টেছে সেটাই আমরা এই রচনায় আলোচনা করবো। যার মধ্য দিয়ে নাটকের সমাজ পরিবর্তনের যে শ্লোগান তার যথার্থ ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে।
প্রচীনকাল, মধ্যযুগ এবং এই আধুনিককালেও নাটক সম্পর্কে সাধারণ ধারণা একই-নাটককে হতে হবে শিক্ষার বাহন। বহু জন আরো স্পষ্ট করে বলেছেন, নাটক হবে মানুষের সচেতনভাবে গড়ে উঠবার অস্ত্র। সমাজের শোষণ-বঞ্চনা, সামন্তযুগ ও ধনতন্ত্রের বর্বরতা, সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন, কৃষক-মজদুরদের ওপর মালিকদের অত্যাচার, গণতন্ত্রকে হত্যা-এসবের বিরুদ্ধে নাটকেই প্রথম প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। যেখানে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার সুযোগ ছিলো না সেখানে নাটক নির্যাতিতের পক্ষ অবলম্বন করেছে। নাটক এমন এক শক্তিশালী মাধ্যম যা নিয়ে প্লেটো, এ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে রুশো, ভলতেয়ার, দিদেরো, ম্যাকিয়াভেলি, মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন, মাও সবাই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় অংশ নিয়েছেন।
নাটক যে কীভাবে জনগণকে মুগ্ধ করে এবং প্রভাবিত করে নাটকের সে শক্তি সম্পর্কে বোঝাতে গিয়ে লগুনের উনব্রিজ স্কুলের শিক্ষক পাদ্রী জন স্টকউড ক্ষেপে গিয়ে নাটক বন্ধ করে দেবার জন্য যে যুক্তি তুলেছিলেন তাহলো, গির্জায় একঘণ্টা ধরে ঘণ্টাধ্বনি করলে যদি একশত লোক প্রার্থনা সভায় আসে, তাহলে এইসব নোংরা নাটকের তুর্যধ্বনি শোনা মাত্র কি হাজার মানুষ জড়ো হয় না?
নাটকের বক্তব্য কীভাবে শাসকশ্রেণীকে ভীত করে তুলতে পারে তার উদাহরণ ফরাসী দেশের অগাস্টিন বমার্শের লেখা ফিগারোর বিবাহ নাটকটি। নাটকটি প্যারিসের বিখ্যাত ঐতিহ্যবাহী নাট্যদল কমেডিয়া ফ্রান্স প্রযোজনার জন্য গ্রহণ করে এবং সরকারি অনুমোদনের জন্য পুলিশ প্রধানের কাছে জমা দেয়।
নাটক পাঠ করার পর পুলিশ প্রধান অনুমতি দেওয়ার ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত হন কারণ নাটকটি যথেষ্ট শিল্পগুণসম্মত হলেও এতে স্থান পেয়েছিলো সমসাময়িক কয়েকটি জ্বলন্ত বিষয়-যেমন পুলিশের ব্যাপক ক্ষমতা, বাক-স্বাধীনতা ও অভিজাত শ্রেণীর সুযোগ-সুবিধা সম্বন্ধে সমালোচনা বা নানা প্রশ্ন। সময়টা ছিলো অস্থির এবং এ ধরনের আবেগ অনুভূতি ফ্রান্সের জাতীয় নাট্যশালায় প্রকাশ্যভাবে আলোচিত হলে তাতে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
পুলিশ প্রধান লেনর এসব ভেবে খোদ সম্রাট ষোড়শ লুইয়ের কাছে পাণ্ডুলিপিটি পাঠিয়ে দেন। যিনি সম্রাটকে ঐ পাণ্ডুলিপিটি পড়ে শোনান তাঁর স্মৃতিকথা থেকে পরবর্তীতে সম্রাটের প্রতিক্রিয়া জানা যায়। সম্রাট ষোড়শ লুই নাটকটির বক্তব্য শুনে ‘ন্যাক্কারজনক! এ নাটক কখনো মঞ্চস্থ হতে দেয়া যায় না’ বলে চিৎকার করে উঠেছিলেন। তিনি আরো বলেন, ‘বর্তমান শাসন ব্যবস্থায় যা কিছু শ্রদ্ধেয় নাট্যকার সেসব বিষয়কে ব্যঙ্গ করেছেন।
এ নাটক মঞ্চস্থ করার আগে বাস্তিল কারাগার ধ্বসিয়ে দিতে হবে-নয়তো এ হবে এক বিপজ্জনক বোকামি। নাট্যকার বমার্শে বুজোয়াশ্রেণীর প্রবক্তা হিসেবে ফরাসী অভিজাতদের কাছে খুবই ঘৃণার পাত্র ছিলেন। শাসকশ্রেণীর বিরোধী চিন্তাকে সঙ্গী করে কীভাবে বেঁচে থাকতে হয় বমার্শে তা ভালোই জানতেন, এমন কি তিনি খোদ সম্রাটকে আক্রমণ করতেও দ্বিধা করেননি। তাই ফিগারোর বিবাহ সম্বন্ধে সম্রাটের উক্তি শুনে তিনি বলেছিলেন, সম্রাট ফিগারোর বিবাহ নাটক বন্ধ করে দিতে চান না, তাই এ নাটকের অভিনয় হবে।
বমার্শে জানতেন যে, সম্রাজ্ঞী মারি আঁতোয়ানেত ও তাঁর বন্ধু-বান্ধবরা এবং সম্রাটের দ্বিতীয় ভ্রাতা কোঁত দ্যর্তোয়া নাট্যপ্রেমী। স্বভবতই তিনি তাই তাঁদের সমর্থন লাভের আশা করেন। উপরন্তু তিনি নাটকে যে গোষ্ঠীকে সরাসরি আক্রমণ করেছেন গোপনে সেই অভিজাত শ্রেণীরই সমর্থন লাভের চেষ্টা চালান। ইতিমধ্যে তাঁর নাটকটি বিপজ্জনক ও বিপ্লবী বিষয়বস্তুর জন্য বেশ দুর্নাম অর্জন করেছে।
ফলে ফিগারোর বিবাহ হয়ে ওঠে এক নিষিদ্ধ ফল যা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ও আগ্রহের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সর্বোপরি ঐ নাটক নিয়ে একটি ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যখন রাশিয়ার গ্র্যান্ড ডিউকের কাছ থেকে নাটকটি সেন্ট পিটার্সবুর্গ শহরে মঞ্চস্থ করার জন্য বমার্শের কাছে আমন্ত্রণ অসে। বমার্শে ফরাসী দেশের সম্মানের কথা ভেবে ডিউকের সে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন; পাশাপাশি সযত্নে চেষ্টা করেন ঘটনাটা সম্রাটের এবং রাজদরবাবের কর্ণগোচর করার।
এই প্রচেষ্টা সার্থক হয়। খোদ সম্রাজ্ঞী নাটকটি মঞ্চায়ন করার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন এবং নাটকের অভিনয়ের ব্যাপারে ব্যাপক তোড়জোর চলে। মহড়া নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়। কিন্তু অভিনয়ের দিন পর্দা ওঠার আধঘন্টা আগে সম্রাটের কাছ থেকে এক বিশেষ দূত মঞ্চের পেছনে সম্রাটের জরুরি বার্তা নিয়ে প্রবেশ করে। কঠিন ও কঠোর সে বার্তাটি হলো এ নাটক মঞ্চস্থ হলে সম্রাটের ঘৃণা ও ক্রোধের উদ্রেক হবে। এর ফলে অভিনয় বন্ধ করে দেয়া হয় এবং দর্শক সারারাত থিয়েটার ঘেরাও করে বসে থাকে। বমার্শের ভক্তের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। সম্রাট শেষ পর্যন্ত জনতার চাপের মুখে নিরুপায় হয়ে পরবর্তীতে এ নাটক মঞ্চায়নের আদেশ দেন।
দীর্ঘ পঁচাত্তর রজনী একটানা পূর্ণ মিলনায়তনে নাটকটির অভিনয়ের মাধ্যমে তা জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌছে যায়। দূর দূর প্রদেশ থেকে জনগণ প্যারিসে ছুটে আসে নাটকটির অভিনয় দেখতে। মানুষকে সচেতন ও শিক্ষিত করে তোলার জন্য যতোগুলো মাধ্যম আছে নাটক তার মধ্যে অন্যতম। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চেতনার নানা স্তর এবং সামাজিক উত্থান পতনের বিচিত্র তরঙ্গ নাটকেই ধরা পড়ে সবচাইতে বেশি। নাটকে নানা চরিত্রের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব এর মধ্যে ফুটে ওঠে সমাজের বৃহত্তর দ্বন্দ্বের প্রতিরূপ। নাটক তাই সমাজকে তুলে ধরে সমাজদ্বন্দ্বের প্রতিরূপ হিসাবে এবং তার প্রধান চরিত্ররা সমাজের একেকটা শক্তির প্রতিনিধি।
এ কথা সত্যি যে, মানুষকে নাটক দ্রুত উদ্দীপ্ত করে। বহুজনই বলেন, বিদ্রোহের উস্কানি নাটক থেকেই আসে সর্বাগ্রে। সমাজে যে বিশ্বাসগুলো শেকড় গেড়ে থাকে, যে বিশ্বাসগুলো আর কোনোভাবেই মানুষের সার্বিক কল্যাণে আসতে পারে না তার বিরুদ্ধে নতুন চিন্তাগুলোকে মুখোমুখি এনে দাঁড় করানো, দর্শকদের সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরাই হচ্ছে নাটকের মূল প্রতিপাদ্য। যার জন্য মঞ্চে যখন কোনো নাটক মঞ্চায়িত হয়, দর্শক তখন যতোই নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে যাক না কেন পুরান আর নতুন চিন্তার দ্বন্দ্বে তার ভিতরের পুরানো বিশ্বাসগুলো মনের অবচেতনে ভেঙ্গে পড়তে থাকে। নাট্যের এই শক্তিকেই প্রাচীন কাল থেকে বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে কাজে লাগাতে চেষ্টা করা হয়েছে, আর সে কারণেই পৃথিবীর কোনো মহৎ নাট্যকারের পক্ষেই শুদ্ধ শিল্পের জয়গান করা সম্ভব হয়নি।
গোড়ায় ধর্মকে উপলক্ষ করে শুরু হলেও অচিরেই নাট্যকলা হয়ে উঠেছিলো সামাজিক অনুষ্ঠান। সামাজিক অনুষ্ঠান থেকে প্রবেশ রাজনীতিতে, নাটকের মধ্যে তখন ঢুকে পড়লো সমাজ ও রাষ্ট্রক্ষমতা বিষয়ক নানা প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ। এ যেমন ঘটেছে প্রাচীন গ্রীসে বা রোমে তেমনি প্রাচীন ভারতবর্ষে, তেমনি আবার রেনেসাঁর ইউরোপে বা তার পরবর্তীকালে।
প্রাচীন ভারতের মুদ্রারাক্ষস ও মৃচ্ছকটিক নাটকে আমরা রাজনীতি দেখতে পাই প্রত্যক্ষভাবে। পাশাপাশি ইস্কাইলাসের আগামেমনন, সেভেন এগেইনস্ট থিবস, সফোক্লিসের আন্তিগোনে, ইডিপাস, ইউরিপিডিসের মিডিয়া; এইসব গ্রীক নাটকগুলোকে অনায়াসেই রাজনৈতিক বলা যায়। মানুষের সমাজ যতোদিনের পুরানো, ততোদিনের পুরানো সমাজের ক্ষমতা দখলের দ্বন্দ্ব। সেই সমাজ বা রাজনীতির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত নাটক তার জন্মলগ্ন থেকেই। গ্রীক নাট্যকারই হোন বা শেক্সপিয়ার-মলিয়ের হোন, সমকালীন সমাজের প্রতি উদাসীন থেকে তাঁরা কখনই নাটক রচনা করেননি। যে-কালে, যে-জনমণ্ডলীর মধ্যে বাস করেছেন তাদের আশা আকাঙ্ক্ষা ও সংগ্রামকে তাঁরা ব্যক্ত করেছিলেন বলেই তাঁরা কালজয়ী।
গ্রীক নাট্যকলা তো বটেই, পরবর্তীতে শেক্সপিয়ারের নাটক থেকে শুরু করে এমন কোনো উল্লেখযোগ্য নাট্যকারের নাম কি উচ্চারণ করা যাবে যিনি তাঁর নাটকে অন্যায়কে সমর্থন করেছেন, অথবা অত্যাচারী শোষক কিংবা অসৎ লোকের পক্ষে সমর্থন দিয়েছেন কিংবা তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ করেননি? রেনেসাঁস যুগে যে নাট্য ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিলো জার্মানীতে, স্পেনে, ফ্রান্সে, ইংল্যান্ডে তারও প্রধান চরিত্র ছিলো সমাজ-রাজনীতি। মলিয়ের বা বেন জনসন, কলদেরন বা মার্লো সকলেই নাট্যশিল্প ও সমাজভাবনাকে একীভূত করে নিয়েছেন তাঁদের সৃষ্টিতে। এরই চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় শেক্সপিয়ারে। এতোই সর্বগ্রাসী ছিলো তাঁর নাট্যজগৎ যে তার মধ্যে প্রতিবিম্বিত হয়েছে তাঁর যুগের সবকিছু।
পরবর্তী নাটকারদের মধ্যে গ্যাটে-শিলারের দেশপ্রেমমূলক নাটক বা গোগলের ক্ষুরধার ব্যঙ্গ থেকে ইবসেন, বার্নার্ড শ, হাউপ্টমান, চেখভ, গোর্কি, গলসওয়ার্দি, সকলের নাট্যরচনায় ছিল মানব সমাজ ও তাদের জীবনযাত্রা, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সংগ্রামের কথা। মানুষকে উদ্দীপ্ত করবার রসদও ছিলো তা।শিল্প সৃষ্টির পিছনে উপযোগিতার কথা বলা হলেও বিভিন্নজন এ ব্যাপারে তাদের জোরালো মতামত প্রদান করলেও শিল্প সৃষ্টির কারণ সবসময় এক ছিলো না। শিল্পকলার উৎপত্তি অন্বেষণে দেখা গেছে, আদিতে এর যে ভূমিকা ছিলো সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে সে ভূমিকারও পরিবর্তন হয়েছে। শিল্পের বা নাটকের শুরুর দিকে ব্যাপারটা ছিলো স্বতঃস্ফূর্ততা; মানুষ যখন নাচলো ছন্দোবদ্ধ তালে তালে সৃষ্টি হলো প্রথম শিল্প।
বিশ্বপ্রকৃতিই তাকে শিখিয়েছিলো এই ছন্দতাল। মানুষ দেখেছে জলের উপর ঢেউয়ের সুশৃঙ্খল নিয়ম। দেখেছে মাঠের উপর হাওয়ার নাচন। দেখেছে চন্দ্র, সূর্যের উদয় ও অস্ত। শুনেছে নিজের হৃদয় স্পন্দনের ছন্দোময় ধ্বনি-তাই সে যখন নাচলো প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চেই নাচলো ছন্দে-সুরে-তালে। সেইটুকুই ছিলো তার স্বতঃস্ফূর্ততার ইতিহাস, সেই সুদূর আদিম যুগে। কিন্তু মানুষের তৈরি মঞ্চে যখন সে নাচলো স্বতঃস্ফূর্ততার পরিবর্তে সেখানে এলো উদ্দেশ্য। শিল্পকলার সাথে সেই যে উদ্দেশ্যের যোগাযোগ, বিভিন্ন সমাজে বিভিন্নভাবে তা আজও চলমান। সুতরাং শিল্প- সাহিত্য সৃষ্টিতে মানুষ প্রবৃত্তির অন্ধ কারাগারে বন্দী হয়ে নেই, নিজের সুপ্ত শক্তিকে জাগ্রত করে নিজের ইচ্ছাপথে তাকে নিয়ন্ত্রিত করছে। তবে তার সে ইচ্ছাপথও নিয়ন্ত্রিত হয় পূর্বনির্দিষ্ট বাস্তবতার দ্বারা।
শিল্প-সাহিত্য কিংবা নাটক সবসময়ই কোনো-না-কোনো উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই পথ চলেছে। শিল্প-সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন শাখা নাটক। সে নাটক তার প্রাচীন যুগ থেকেই উদ্দেশ্যমূলক। সব যুগে সব দেশের থিয়েটারের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের পেছনে সুনির্দিষ্ট বাস্তব কিছু কারণ সর্বদাই ক্রিয়াশীল ছিলো। বিশেষ বিশেষ বাস্তবতায় বিশেষ বিশেষ নাট্যরীতির প্রচলন ঘটেছে।
নাট্যশিল্পীরা সেই বিশেষ বাস্তবতার আলোকে নাট্যচর্চা চালিয়ে গেছেন। নাট্যশিল্প হচ্ছে সমাজ উপরিকাঠামোর একটি চলক। তাই বিশেষ বাস্তবতায় অর্থনৈতিক ভিত্তিটিই নির্ধারণ করে দিয়েছে নাট্যশিল্পের স্বভাব-চরিত্রটিকে। সমাজ বাস্তবতা তথা অর্থনৈতিক বুনিয়াদ যেমন নাট্যচর্চার ধারাকে প্রভাবিত করেছে তেমনি বিভিন্ন সময় যে সমস্ত শিল্প আন্দোলন হয়েছে সেগুলোও নাট্যতত্ত্ব, নাট্যরীতি, নাট্য-ভাবনা ও নাটক লেখার সূত্রসমূহকে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিয়েছে। নাট্যধারাকে সজীব রেখেছে। ইতিহাস সেটা করেছে নিজের পক্ষে নাটকের উপযোগিতা সৃষ্টির জন্যই।
ট্রটস্কি লিখেছেন, ‘ইতিহাসের বস্তুবাদী দৃষ্টিতে দেখলে শিল্পকলা সবসময় ছিল সমাজের ভৃত্য ও ঐতিহাসিকভাবে উপযোগবাদী’। সমাজ ও পরিবেশের উপরও শিল্পকলা প্রভাব ফেলে। সেজন্য ট্রটস্কি লিখছেন, ‘যদি সমাজ-পরিবেশের পরিবর্তনে মানসিকতার কোন পরিবর্তন না-হত, তবে শিল্পকলায় কোনো চাঞ্চল্য আমরা লক্ষ্য করতাম না; পুরুষপরম্পরায় মানুষকে শুধু বাইবেলের কবিতা বা প্রাচীন গ্রীক কবিতা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হত’। ট্রটস্কির মতের পাশাপাশি অঁরি আরভোঁ মনে করেন, মানব জাতির এই ঊর্ধ্বমুখী অগ্রগতিকে স্বীকার করে নিলে শিল্পের উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়
মানুষকে তার পশুসুলভ সুষুপ্তি থেকে জাগ্রত করা। মানবের চিন্তা করবার প্রক্রিয়াকে বিকশিত করা। বিজ্ঞান মানুষের প্রতিদিনের কাজের ধরনকে বদলে দিচ্ছে। সমাজও বদলে যাচ্ছে। শিল্পকলায় তার প্রভাব পড়বেই। শিল্পকলারও প্রভাব পড়বে সমাজের ওপর এবং এর ভিতর দিয়েও সমাজ বিকশিত হবে। কথাটা নাট্যচর্চার ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। নাটকের সৃষ্টি তো হয়েছে জনমানসে কোনো না কোনো বিষয় প্রচার করার জন্যই। বর্তমান ব্যবস্থাই শ্রেষ্ঠ এই ধারণা জনমনে গ্রথিত করা শাসকগোষ্ঠীর নাট্য মঞ্চায়নের উদ্দেশ্য। কিন্তু নাটক যে শাসক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে, তাদের ভীতির কারণ হতে পারে তারও প্রমাণ রয়েছে।
ড্রামা শব্দটা মূলত গ্রীক শব্দ ‘ড্রান’ ক্রিয়াপদ থেকে উদ্ভূত। যার শাব্দিক অর্থ ‘আমি করি’। প্রারম্ভে যার অর্থ ছিলো যে কাজটা করা হয়েছে। ইতিহাসে দেখা যায়, নাটকের সূতিকাগার হচ্ছে ধর্মীয় মন্দির। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সাথেই নাটকের জন্ম সম্পর্কিত। ধর্মযাজকদের তত্ত্বাবধানে সেসব নাটক অনুষ্ঠিত হতো। থিয়েটারের উৎপত্তি সম্পর্কে সাধারণভাবে যে তত্ত্ব প্রচলিত তার ভিত্তি হচ্ছে সহানুভূতিমূলক যাদু, বৃষ্টি নামানোর অনুষ্ঠান, উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা এবং কৃষি ও শস্য উৎপাদন সম্পর্কিত উৎসব। মিশরে পাঁচ হাজার বছর পূর্বেই নাটক সুনির্দিষ্ট রূপ গ্রহণ করেছিলো। পিরামিড টেকস্টস-এ লিখিত বিবরণ থেকেই সে সম্পর্কে জানা যায়।
বিভিন্ন ধরনের নাটকের উল্লেখ রয়েছে পিরামিড টেকস্টস-এ, যার মধ্যে রয়েছে রাজা বা অভিজাত ব্যক্তিবর্গের স্বর্গারোহণ ও পুনর্জীবন লাভের কাহিনী। মিশরীয়দের যা কিছু নাটকীয় কার্যক্রম তার সবটুকুই ছিলো ধর্মীয় কর্মকৃতির সঙ্গে সংযুক্ত। পিরামিড টেকস্টস থেকে জানা যায় মিশরের ‘প্যাশান প্লে’ সম্পর্কে। প্যাশান প্লেতে দেখা যায়, সেখানে থাকতো একজন দেবতা বা দেবোপম চরিত্র এবং তাকে ঘিরে ধাপে ধাপে গড়ে উঠতো নাটকের কাহিনী। প্যাশান প্লে চলতো দিনের পর দিন ধরে। যেমন অ্যাবিডাস প্যাশান প্লে পুরো আঠারো দিন ধরে চলতো। নাটকের শুরুতে অ্যাবিডাসের প্রাসাদ থেকে শোভাযাত্রা বের হতো। শোভাযাত্রায় পুরোহিত, রাজন্যবর্গ, অভিনেতা, জনসাধারণ, কৃষক সকলেই থাকতো।
যেহেতু দেবতা ওসিরিস এর জীবন ও মৃত্যুকে ঘিরে এই নাটকটি মঞ্চস্থ হতো, তাই ওসিরিসের পূণ্য তরণীখানি থাকতো শোভাযাত্রার মাঝখানে। শোভাযাত্রা খানিকটা এগিয়ে আসার পর শত্রুরা আক্রমণ চালাতো। দেবতা ওসিরিসকে হত্যা করা হতো। দ্বিতীয় পর্যায়ে ওসিরিস পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠলেও পুনরায় কবরে চলে যেতো। সঙ্গে সঙ্গে সমবেত জনতার বিলাপ ও ক্রন্দনে চারদিক ভরে যেতো। শোভাযাত্রা আবার আরম্ভ হতো এবং পথে আবার দুপক্ষের যুদ্ধ বাধতো। যুদ্ধে অনেক অভিনেতাই প্রবলভাবে আহত হতো। যুদ্ধবন্দীদের ধরে নিয়ে এসে এই অনুষ্ঠানে সত্যি সত্যি হত্যা করা হতো। শোভাযাত্রার অভিনেতারা ওসিরিসের বিচ্ছিন্ন দেহগুলি তিন দিন ধরে খুঁজতে থাকতো। প্রতিদিন একটি করে কৃত্রিম যুদ্ধানুষ্ঠানও চলতো। যখন এই বিচ্ছিন্ন দেহগুলো পাওয়া যেতো
তখন আবার শোভাযাত্রা চলতে শুরু করতো। পথে সেথ-এর বাহিনীর সাথে আবার তাদের যুদ্ধ লাগতো। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ওসিরিসের দলই হত্যাকারীদের নিধন করে জয়ী হতো। রাজপ্রাসাদে আবার ফিরে আসতো শোভাযাত্রা। সেই সময় ওসিরিস পুনরুজ্জীবিত দেবরূপে আবির্ভূত হতো। ধর্মকে ঘিরে এভাবেই শুরু হয়েছিলো মিশরের নাটক। গ্রীসেরও একই ইতিহাস। গ্রীসে দেবতা দিউনিসাসকে ঘিরে গড়ে ওঠে নাটক। সাহিত্য তত্ত্বের মহাগুরু এ্যারিস্টটলের মতে, গ্রীক দেবতা দিউনিসাসের উদ্দেশ্যে যে নৃত্যগীত সম্বলিত শ্রদ্ধার্ঘ উৎসবের আয়োজন করতো প্রাচীন গ্রীকগণ, তা থেকেই গ্রীক নাটকের উদ্ভব হয়। মন্দির ছিলো নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন ক্ষেত্র।
দিওনিসাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হচ্ছে প্রকৃতি, বসন্ত ঋতু, উর্বর ফলন, নবজন্ম এবং বিশেষভাবে সুরা। মানুষের জীবনে সেই সময় দেবতাদের চিন্তার প্রভাব এতোবেশি ছিলো যে, দেবতারাই হয়ে উঠেছিলো চরিত্র। মানুষ সে সময় দেবতাদের অস্তিত্বের মধ্যে নিজেদেরকে বিলীন করে দয়েছিলো। বিশেষ করে দিউনিসাস ছিলো গ্রীসের সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দিউনিসাস বা বাক্কাস ছিলো মদিরা বা মদের দেবতা, চাষী আর সাধারণ মানুষের দেবতা। দিউনিসাসের জীবনের দুঃখ তাই মানুষের নিজেদের দুঃখ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। দিউনিসাসের আর এক নাম মেলানাইজিস, যার অর্থ ছাগচর্ম পরিহিত দেবতা।
দিউনিসাসের জীবন কাহিনী, তার জীবনের দুঃখের বর্ণনা যিনি দিতেন তিনিও পরিধান করতেন ছাগচর্ম। তিনি কখনও কখনও অভিনয় করেও দেখাতেন। ট্র্যাজেডি শব্দটা এসেছে গ্রীক ত্রাগোদাইয়া শব্দ থেকে। ত্রাগোদাইয়া শব্দের অর্থ ছাগসংগীত। ছাগচর্ম পরিহিত দেবতার সংগীত বলেই তা ছাগসংগীত আবার ছাগলের চর্ম গায়ে দিয়ে অভিনেতা দিউনিসাসের দুঃখের কাহিনী শোনাতেন বলেও তা ছাগসংগীত হিসাবে অভিহিত হতো। সেখান থেকেই ট্র্যাজেডি শব্দের জন্ম। কিন্তু ট্র্যাজেডি শুধু ধর্মকাহিনীর মধ্যে আটকা পড়ে রইলো না। নাট্যকার ইস্কালাইসের হাতে সমাজ, মানুষ ও তার সংগ্রাম হয়ে উঠলো ট্র্যাজেডির বিষয়। সেজন্যই পূর্ণাঙ্গ ট্র্যাজেডির স্রষ্টা বলা হয়ে থাকে ইস্কাইলাসকে।
কী প্রাচ্যে, কী প্রতীচ্যে নাটকের সৃষ্টি ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকে। তবে নাটক সেখানেই থেমে থাকেনি। নাটক ধর্মীয় তন্ত্রমন্ত্র ও বিশ্বাসের ক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে এসে জীবনের বিস্তৃত পটভূমিতে দাড়ালো। প্রথম নাটক ছিলো দেবতাদের কীর্তিকলাপ ও তাদের গুণকীর্তনের বিষয়। সেটা স্বল্প সময়ের জন্য, সেখানে মানুষের জায়গা হতে বেশি সময় লাগেনি। শীঘ্রই দেবতা এবং মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিয়ে রচিত হলো নাটক।
গ্রীক নাটক শৃঙ্খলিত প্রমিথিউস তার প্রথম উদাহরণ। সর্বশক্তিমান ইশ্বরের বিরুদ্ধে সেখানে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ ধ্বনিত হলো প্রমিথিউসের গলায়। মানুষ যখন তাদের দুঃখ কষ্টের কারণ, তাদের নানারকম বিপর্যয়ের কারণগুলো ব্যাখ্যা করতে পারেনি, তখন তারা মানুষের দুঃখ কষ্টকে দেবতাদের অভিশাপ কিংবা নিয়তি হিসাবে দেখেছে।
তখন আবার শোভাযাত্রা চলতে শুরু করতো। পথে সেথ-এর বাহিনীর সাথে আবার তাদের যুদ্ধ লাগতো। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ওসিরিসের দলই হত্যাকারীদের নিধন করে জয়ী হতো। রাজপ্রাসাদে আবার ফিরে আসতো শোভাযাত্রা। সেই সময় ওসিরিস পুনরুজ্জীবিত দেবরূপে আবির্ভূত হতো। ধর্মকে ঘিরে এভাবেই শুরু হয়েছিলো মিশরের নাটক।
গ্রীসেরও একই ইতিহাস। গ্রীসে দেবতা দিউনিসাসকে ঘিরে গড়ে ওঠে নাটক। সাহিত্য তত্ত্বের মহাগুরু এ্যারিস্টটলের মতে, গ্রীক দেবতা দিউনিসাসের উদ্দেশ্যে যে নৃত্যগীত সম্বলিত শ্রদ্ধার্ঘ উৎসবের আয়োজন করতো প্রাচীন গ্রীকগণ, তা থেকেই গ্রীক নাটকের উদ্ভব হয়। মন্দির ছিলো নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন ক্ষেত্র। দিওনিসাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হচ্ছে প্রকৃতি, বসন্ত ঋতু, উর্বর ফলন, নবজন্ম এবং বিশেষভাবে সুরা।
মানুষের জীবনে সেই সময় দেবতাদের চিন্তার প্রভাব এতোবেশি ছিলো যে, দেবতারাই হয়ে উঠেছিলো চরিত্র। মানুষ সে সময় দেবতাদের অস্তিত্বের মধ্যে নিজেদেরকে বিলীন করে দিয়েছিলো। বিশেষ করে দিউনিসাস ছিলো গ্রীসের সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দিউনিসাস বা বাক্কাস ছিলো মদিরা বা মদের দেবতা, চাষী আর সাধারণ মানুষের দেবতা।
দিউনিসাসের জীবনের দুঃখ তাই মানুষের নিজেদের দুঃখ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। দিউনিসাসের আর এক নাম মেলানাইজিস, যার অর্থ ছাগচর্ম পরিহিত দেবতা। দিউনিসাসের জীবন কাহিনী, তার জীবনের দুঃখের বর্ণনা যিনি দিতেন তিনিও পরিধান করতেন ছাগচর্ম। তিনি কখনও কখনও অভিনয় করেও দেখাতেন। ট্র্যাজেডি শব্দটা এসেছে গ্রীক ত্রাগোদাইয়া শব্দ থেকে।
ত্রাগোদাইয়া শব্দের অর্থ ছাগসংগীত। ছাগচর্ম পরিহিত দেবতার সংগীত বলেই তা ছাগসংগীত আবার ছাগলের চর্ম গায়ে দিয়ে অভিনেতা দিউনিসাসের দুঃখের কাহিনী শোনাতেন বলেও তা ছাগসংগীত হিসাবে অভিহিত হতো। সেখান থেকেই ট্র্যাজেডি শব্দের জন্ম। কিন্তু ট্র্যাজেডি শুধু ধর্মকাহিনীর মধ্যে আটকা পড়ে রইলো না। নাট্যকার ইস্কালাইসের হাতে সমাজ, মানুষ ও তার সংগ্রাম হয়ে উঠলো ট্র্যাজেডির বিষয়। সেজন্যই পূর্ণাঙ্গ ট্র্যাজেডির স্রষ্টা বলা হয়ে থাকে ইস্কাইলাসকে।
কী প্রাচ্যে, কী প্রতীচ্যে নাটকের সৃষ্টি ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকে। তবে নাটক সেখানেই থেমে থাকেনি। নাটক ধর্মীয় তন্ত্রমন্ত্র ও বিশ্বাসের ক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে এসে জীবনের বিস্তৃত পটভূমিতে দাড়ালো। প্রথম নাটক ছিলো দেবতাদের কীর্তিকলাপ ও তাদের গুণকীর্তনের বিষয়। সেটা স্বল্প সময়ের জন্য, সেখানে মানুষের জায়গা হতে বেশি সময় লাগেনি। শীঘ্রই দেবতা এবং মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিয়ে রচিত হলো নাটক।
গ্রীক নাটক শৃঙ্খলিত প্রমিথিউস তার প্রথম উদাহরণ। সর্বশক্তিমান ইশ্বরের বিরুদ্ধে সেখানে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ ধ্বনিত হলো প্রমিথিউসের গলায়। মানুষ যখন তাদের দুঃখ কষ্টের কারণ, তাদের নানারকম বিপর্যয়ের কারণগুলো ব্যাখ্যা করতে পারেনি, তখন তারা মানুষের দুঃখ কষ্টকে দেবতাদের অভিশাপ কিংবা নিয়তি হিসাবে দেখেছে।
মানুষের সেই চিন্তাই প্রথম দিকের নাটকে প্রতিফলিত হয়েছে। সেজন্যই প্রাচীন নাটকগুলোতে মানুষের ভাগ্য বিপর্যয়ের সাথে দেবতারা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেই জন্যই জিউসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সর্বশক্তিমান জিউসের বিরোধিতা করে প্রমিথিউস মানুষকে করে তুলেছিলো ভয়ভীতিহীন। মানুষের অগ্রগতির স্বার্থে সে স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে এনে দিয়েছিলো মানুষকে। দেবতা হয়েও সাধারণ মানুষের বন্ধু সেখানে প্রমিথিউস।
প্রমিথিউস তাই প্রথম মানবতাবাদী, থিয়েটারের ইতিহাসে প্রথম বিপ্লবী। প্রমিথিউসকে দিয়েই থিয়েটারে বিদ্রোহের সূচনা ঘটলো। বিদ্রোহ তাই থিয়েটারে জন্মলগ্ন থেকেই রয়েছে। মানুষের ইতিহাস চেতনার ধারাবাহিকতার এ এক নির্দশন মাত্র। সবকিছুর পেছনেই আছে মানুষের চিন্তা। শিল্প কিংবা নাটক কেবল শিল্পের তাগিদেই সৃষ্টি হয়নি, সবকিছুর পেছনে আছে মানব মনের জিজ্ঞাসা এবং মানুষের ওপর বাস্তব ঘটনাবলীর নিয়ন্ত্রণ। মার্কস তাই মানুষকে দেখেছিলেন তার নিজস্ব ইতিহাস সৃষ্টির অজ্ঞান লিপিকার হিসাবে।
নাট্যকলার জন্ম যে মন্দিরে সে নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই, পরবর্তীকালে দেখা যায় রাজনৈতিক সমস্যার অনুপ্রবেশ। ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপের চেয়ে রাজনৈতিক দিকটি অনেক বেশি গুরুত্ব পায়। গ্রীসে দেখা যায়, সে সময়কার গণতন্ত্রীরা ধর্মকে তাদের শাসন ব্যবস্থার ভিত দৃঢ় করার কাজে লাগায়। ধর্ম ও রাষ্ট্রনীতির মাঝে সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে ট্র্যাজেডি এক অপূর্ব মাধ্যম হিসাবে গৃহীত হয়। বিশেষ করে এ্যারিস্টটলের ‘কাব্যতত্ত্ব’ তার নিদর্শন।
এ্যারিস্টটল চেয়েছিলেন নাটককে মানুষের নীতিবোধ নিয়ন্ত্রণের কাজে ব্যবহার করতে আর প্লেটো মারমুখো ছিলেন নাট্যকারদের ওপর। নাট্যকারদের সাথে প্লেটোর ব্যক্তিগত কোনো বিরোধ ছিলো না, বিরোধটা ছিলো দার্শনিক। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে রাজনৈতিক। প্লেটোর চিন্তায় দার্শনিকরা শাসন করবে, সৈনিকরা যুদ্ধ করবে আর শ্রমজীবীরা করবে উৎপাদন। তিনি এই ব্যবস্থার নড়চড় চাইতেন না।
নাটকের নানা বক্তব্যের মধ্যে সেই ব্যবস্থার নড়চড় হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিলো। প্লেটো বিশ্বাস করতেন, শিল্প যা-হোক একটা কিছু শিক্ষা দেয়, আর সেটা কুশিক্ষাও হতে পারে। প্লেটোর লেখায় বারবার এ কথা এসেছে যে, শিল্প যেহেতু আনন্দ দেয়, তার পক্ষে কুশিক্ষা দেয়া আরো সহজ। প্লেটো গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন না। নাটক সেই গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছিলো। সেইজন্যই তিনি নাটক পছন্দ করতেন না। তবে নৃত্য পছন্দ করতেন। নৃত্যের পক্ষে তিনি মত রেখেছেন অথচ নাট্যকারদের নির্বাসন দিতে চেয়েছেন।
নৃত্যে যাঁর আপত্তি নেই তিনি নাটক নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিলেন কেন? নৃত্য হচ্ছে শারীরিক, নাটক মনস্তাত্ত্বিক। মানুষ নৃত্য করুক তাতে রাষ্ট্র আপত্তি করবে না, করবার কোনো কারণ নেই। কিন্তু মানুষ নাটকের মাধ্যমে প্রচলিতকে ভাঙতে চেষ্টা করুক রাষ্ট্র তা চাইতে পারে না। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কোনো-না-কোনোভাবে শ্রেণী থাকে, আর সে শ্রেণী সবসময় নিজের স্বার্থ রক্ষা করতে চায়। বিশেষ করে শাসকশ্রেণী।
সেজন্য রাষ্ট্র থাকলেই আমলাতান্ত্রিকতা থাকবে। কেননা রাষ্ট্র আমলাতান্ত্রিক সংগঠন, আর আমলাতন্ত্র গণতন্ত্রের শত্রু। প্লেটোর ছাত্র এ্যারিস্টটলও গণতান্ত্রিক ছিলেন না। তিনিও জনগণের শাসন চাননি, শাসন চেয়েছেন কতিপয়ের। তিনি জানতেন, নিষিদ্ধ করে দিলেও নাটক থাকবে কেননা মানুষের প্রাথমিক প্রবৃত্তিগুলোর একটি হচ্ছে অনুকরণ প্রবণতা। সেই অনুকরণ থেকেই নাটকের জন্ম। সেজন্য তিনি নাটককে বাদ দিতে চাননি। রাষ্ট্রের পক্ষে নাটককে কাজে লাগাতে চেয়েছেন। তিনি নাটককে রাষ্ট্রের পক্ষে কাজে লাগাবার তত্ত্বই প্রচার করেছেন তার কাব্যতত্ত্বে। ট্র্যাজেডি নিয়ে সেখানে তার আলোচনা।
নাটকের কাব্য বা শিল্পগত দিক ছাড়াও তার যে একটি ব্যবহারিক বা উদ্দেশ্যগত দিক আছে প্লেটো এবং এ্যারিস্টটলের বক্তব্যে তা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত। ফলে ‘শিল্প শুধু শিল্পের জন্য নয়’ কিংবা ‘নাটক শুধু নাটকের জন্য নয়’ প্রাচীনকাল থেকেই নাট্যকার- শিল্পীরা সে নীতি মেনে চলে এসেছে। নাটকের যে একটি ব্যবহারিক দিক আছে তা নিয়ে প্রাচীনকালে অন্তত কোনো বির্তক ছিলো না।
প্রশ্নটি ছিলো সে ব্যবহারিক দিকটা কী হতে পারে কিংবা নাটককে কী ধরনের কাজে লাগানো যায়। গ্রীসের স্বর্ণযুগে নাটকের যে বিকাশ সেটা মূলত ঘটেছিলো নগররাষ্ট্র এথেন্সে। সেখানে নাটকের দর্শক হিসাবে বহু মানুষের উপস্থিতি নাটককে করেছে গৌরবময়, নাটকের অভ্যন্তরে এনে দিয়েছিলো প্রাণবন্ততা। এথেন্সের গণতন্ত্র ছিলো ইহজাগতিক, নাটকও ছিল তাই। চিন্তার মুক্তিসাধন করা, অবিচার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনমত জাগ্রত করা-এ সবই ছিলো তখন গ্রীক নাটকের লক্ষ্য।
বিশেষত গ্রীক ট্র্যাজেডি জীবনের শাশ্বত ও বিশ্বজনীন রূপই তুলে ধরে। নাটকের ক্ষেত্রে একটি প্রধান চরিত্রের ওপর সমস্ত দৃষ্টি একান্তভাবে নিবদ্ধ না রেখে আমরা যদি গোটা নাটকটাকে পূর্ণমাত্রায় অনুভব করি তাহলে এই বোধ জন্মায় যে ট্র্যাজেডি কোনো একক ব্যক্তির জীবনের ঘটনা নয়। ট্র্যাজেডি একটি জনসমষ্টির সামাজিক জীবনের সংকটের অভিজ্ঞতা। যথার্থ ট্র্যাজেডির জন্য একটা সমাজের অবস্থিতি প্রয়োজন।
ট্র্যাজেডি এই অনুভব জাগায় যে মানুষ বা মানুষের সামাজিক গোষ্ঠী এক বিরাট বিশ্বের অংশ। সেই বিশ্বের গতি-প্রকৃতি বা নিয়মের বহুকিছুই মানুষের অজানা। মানুষের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী এক রহস্যময় নিয়তি মানুষকে অনেকটা স্বাধীনতা দিয়েও, মানুষের কৃতকর্মের দায় মানুষের কাঁধে চাপিয়ে পরিণামে মানুষকে ধ্বংস করে। সেজন্য ট্র্যাজেডিতে মানুষের আক্ষেপ ধ্বনিত হয়, প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় চাপিয়ে দেয়া বিশ্ববিধানের বিরুদ্ধে-বিধাতার বিচার করতে উদ্যত হয় মানুষ।
নাটকের আবরণটাই সেখানে ধর্মীয় মাত্র। প্রাচীন গ্রীসের নাটকে দেবদেবীরা মানুষের চতুষ্পার্শ্বেই রয়েছে, তারা নিয়ন্ত্রণ করছে মানুষের ভাগ্য, আর মানুষও লড়ছে সেই ভাগ্যের বিরুদ্ধে। চিরন্তন মানুষের ছবি সেটা-মানুষ পরাজয় মানে না, সে দুঃখ ও বিপর্যয়ের সঙ্গে অনিবার সংগ্রাম করে চলে।
গ্রীক ট্র্যাজেডি তাই বলছে, ভাগ্য অমোঘ হতে পারে, তবে তার বিরুদ্ধে সংগ্রামেই বীরত্ব। লড়াইটা মানবিক, তাই সম্পূর্ণ ইহজাগতিক। লড়াইয়ের ক্ষেত্রটা সেখানে ভিন্ন, লড়াইটা অনিবার্য কিন্তু ঘৃণার প্রকাশ ততোটা নেই। গ্রীক ট্র্যাজেডিতে নেই কোনো খলচরিত্র। গ্রীক ট্র্যাজেডিতে তাই যে দ্বন্দ্ব বা সংঘর্ষ দেখি তা ভালোর সঙ্গে মন্দের দ্বন্দ্ব ততোটা নয়, যতোটা এক ভালোর সঙ্গে আরেক ভালোর সংঘর্ষ। ট্র্যাজেডির পরিণামে তাই নামে বিরাট শোকের ছায়া।
ট্র্যাজেডি মানুষের মনে প্রশ্ন জাগিয়ে তোলে। ট্র্যাজেডি জানতে চায়-মানুষের স্বরূপ কী, মানুষের যথার্থ পরিচয় কী? মানুষ কি অদৃষ্টের ক্রীড়নক মাত্র, নাকি মানুষের নিজেরও কিছু করবার ক্ষমতা আছে? ট্র্যাজেডির চরিত্র এভাবেই নিজের স্বরূপ, নিজের যথার্থ পরিচয় জানতে চায়। প্রশ্ন তোলাটাই সেখানে প্রতিবাদ। মানুষ নিয়তির কাছে প্রশ্নহীনভাবে নিজেকে সমর্পণ করতে চায় না, মানুষের জাগতিক ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ সেটা। মানুষে মানুষে সম্পর্কের ব্যাপারটাও সেখানে স্পষ্ট।
মানুষের দুঃখভোগ বা যন্ত্রণা ট্র্যাজেডির বিষয় নয়, ট্র্যাজেডির বিষয় হলো এক বিশেষ ধরনের কর্ম থেকে সঞ্জাত দুঃখ বা যন্ত্রণা-এর দ্বন্দ্বে মানুষের সত্তা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। হেগেলের মতে মানবসত্তারই এক অংশের সাথে আরেক অংশের বিনাশকারী সংঘর্ষ-এটাই হলো ট্র্যাজেডির আসল তত্ত্ব বা ঘটনা। কিন্তু বহু মানুষকে ঘিরে, সমাজ-রাষ্ট্রকে ঘিরে ব্যক্তির এই অন্তর্দ্বন্দ্ব। শাসক আর সাধারণ মানুষের চিত্রও সেখানে অঙ্কিত।
প্রত্যেক ট্র্যাজেডিতেই কোনো-না-কোনো ধরনের দ্বন্দ্ব বা একটা সংঘর্ষ থাকেই, সে সংঘর্ষ ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির কিংবা রাষ্ট্রের সাথে ব্যক্তির কিংবা নাগরিকের সাথে নাগরিকের। কিন্তু রাষ্ট্র সেখানে সবসময়ই উপস্থিত, সংঘর্ষটা তৈরি হয় রাষ্ট্রকে ঘিরেই। শাসকরা কখনও ট্র্যাজেডির ঘটনার বাইরে থাকতে পারে না। ইডিপাস বা যে-কোনো গ্রীক ট্র্যাজেডিই হতে পারে তার উদাহরণ।
ইডিপাস গল্পে দেখি নিয়তির অমোঘ পরিণাম। ব্যক্তির যন্ত্রণা বা নিয়তি নাটকের মূল কথা কিন্তু জনগণ ও শাসকের প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই এসে যায় সেখানে। শাসক সম্পর্কে ঈডিপাস নাটকে বলা হয়, দম্ভ থেকে জন্ম নেয় দুর্বিনীত শাসক। শক্তিতে দম্ভ হয় আরো স্ফীত, দম্ভ তাকে নিয়ে যায় জীবনের সর্ব্বোচ্চ চূড়ায়-তারপর পতন।
দম্ভ বড় অপরাধ এবং তার পরিণাম নিদারুণ পতন। আবার নগরীর কল্যাণের জন্য সাহস প্রদর্শন অন্যায় নয়। ঈডিপাস নাটকে তাই বলা হচ্ছে, ইশ্বর যেন সেই উদ্যমী সাহসকে তিরস্কৃত না করে পুরস্কৃত করেন। সেখানে আরো বলা হচ্ছে মানুষের কল্যাণে বা স্বদেশের কল্যাণে যে এগিয়ে যায়, মানুষের সাথে দেবতার সংঘাতের দিনেও সে শ্রেষ্ঠ।”
যে মানুষ মানুষের ভাগ্য পাল্টাতে লড়াই করে, তাকে ট্র্যাজেডি নাটকে এভাবেই সম্মানিত করা হয়েছে। নাটকে একথা বলা হচ্ছে যে, নগরকে রক্ষা করার জন্য এক অসামান্য বীরপুরুষের প্রয়োজন, অগ্রণী নেতার প্রয়োজন। পাশাপাশি রাষ্ট্রের নাগরিকদেরও সমালোচনা করা হয় এই বলে যে, জনমণ্ডলী সত্যের অনুসন্ধানের দায় নিতে চায় না, অজ্ঞানের নিরাপদ আশ্রয়ে শান্তশিষ্ট হয়েই থাকতে চায় কিন্তু তারা আবার বীর নেতাকেও চায়।
সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো এই, ট্র্যাজেডির স্রষ্টা ইস্কাইলাস ও কমেডির স্রষ্টা এ্যারিস্টোফানিস উভয়ে যথেষ্ট পরিমাণে উদ্দেশ্যমুখী ছিলেন। স্মরণ রাখতে হবে, তখন কবিরাই ছিলেন নাট্যকার। খ্রীস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের এথেন্সে ইস্কাইলাস ও ইউরিপিডিস একমত হয়েছিলেন, যিনি যথার্থ কবি, তিনি মানুষের মনকে উন্নত করেন, নীতিবোধ জাগ্রত করেন। কবি তাঁর কল্পনা শক্তি ও রচনা কৌশল দ্বারা শ্রোতাদের মনকে জ্ঞান ও ধর্মের পথে পরিচালিত করেন।
ইস্কাইলাস, গ্রীক নাট্যকারদের মধ্যে যিনি ছিলেন সর্বপ্রথম, তিনি ধর্মের চেয়ে রাজনীতিকেই নাটকে প্রধান করে তুলেছিলেন। নির্দিষ্ট কারণেই পৃথিবীর প্রথম ট্র্যাজেডির রচয়িতার জন্মের সাথে রাজনৈতিক ঘটনার ঘূর্ণাবর্তের এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক তৈরি হয়েছিলো। পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্তি অবধি ইস্কাইলাস বড় হয়ে উঠেছেন পারস্য আর গ্রীসের মধ্যকার যুদ্ধের উত্তেজনার মধ্যে।
সেজন্য তাঁর ট্র্যাজেডিতে বিষয়রূপে স্থান পেল যুদ্ধ ও নিয়মনীতি। চারশো নব্বই খ্রীস্টপূর্বে তিনি রচনা করেন প্রথম নাটক দ্য সাপ্পিয়ান্টস। বিশাল পারস্য বাহিনীর বিরুদ্ধে ম্যারাথনের প্রাঙ্গণে সাহসী গ্রীক- এথেনীয়দের মরণপণ সংগ্রাম তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিলো এই নাট্য রচনায়। বিশাল সাম্রাজ্যশক্তির বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র একটি জাতির টিকে থাকবার লড়াই ছিলো তা। ইস্কাইলাসের পার্সিয়ান নাটকটি রচিত হয়েছিলো স্যালামিসের নৌযুদ্ধে গ্রীকদের কাছে পারস্যদের পরাজয়কে কেন্দ্র করে।
নাট্যকার নাটকটিকে গ্রীক বিজয়ের গাথা করে তোলেননি। বরং পারস্য বাহিনীর পরাজয়ের কারণগুলোকেই বিশ্লেষণ করেছেন। নাটকে ইস্কাইলাস দেখিয়েছেন ইতিহাস কোনো কাল্পনিক বিধান মেনে চলে না, চলে বাস্তব পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। নাটকে ঘটনাকে বিশ্লেষণ করার দায় নাট্যকাররা সেই অতীতকাল থেকেই পালন করে আসছিলেন, যা মার্কসীয় নাট্যকারদের প্রধান দাবি। শুধু বিশ্লেষণের মাপকাঠিটি ছিলো ভিন্ন, সেখানে শ্রেণী প্রশ্নের বাইরে ন্যায়-অন্যায় বা নৈতিকতার ব্যাপারটি প্রাধান্য পেয়েছিলো।
ইস্কাইলাস মানবিক আবেগ অপেক্ষা জগতের নৈতিক নিয়ম প্রতিপাদনের দিকেই – অধিক দৃষ্টি দিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, মানুষের পাপে জগতের নীতিনিয়ন্ত্রিত সামঞ্জস্য ক্ষুণ্ণ হয়। পাপ থেকে পাপেরই জন্ম হয় এবং দোষী ও নির্দোষ উভয়েই দুঃখ ভোগ করে। জীবন দর্শনের দিক থেকে ইস্কাইলাসের প্রবণতা ও আগ্রহ ছিলো ধর্ম ও নৈতিকতার প্রতি।
ইস্কাইলাস মহৎ ও নৈতিক আদর্শস্থাপনে প্রয়াসী ছিলেন। যদিও ইস্কাইলাস নাটক দ্বারা মানুষের মনকে ধর্মের পথে পরিচালিত করার কথা বলেছিলেন, বাস্তবে তাঁর নাটক অনেক ক্ষেত্রে উল্টোটাই করেছে। সেই সঙ্গে তিনি অবশ্য মানুষের মৌলিক মর্যাদাবোধের প্রতিও আনুগত্য দেখিয়েছেন।
সফোক্লিসের কাছে ঈশ্বর বা নিয়তির যেমন গুরুত্ব, তেমনি মানুষেরও। দুটোকেই তিনি সমান মর্যাদা দিয়েছেন। মানুষের নিজস্বতা ও নিয়তি-এ দুয়ের টানাপোড়েনেই মানুষের জীবনকে দেখেছেন সফোক্লিস। সফোক্লিসের নাটকে মানুষের পতন ও বিপর্যয় পূর্ব থেকেই নিদিষ্ট হয়ে বীর নেতাকেও চায়। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো এই, ট্র্যাজেডির স্রষ্টা ইস্কাইলাস ও কমেডির স্রষ্টা এ্যারিস্টোফানিস উভয়ে যথেষ্ট পরিমাণে উদ্দেশ্যমুখী ছিলেন।
স্মরণ রাখতে হবে, তখন কবিরাই ছিলেন নাট্যকার। খ্রীস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের এথেন্সে ইস্কাইলাস ও ইউরিপিডিস একমত হয়েছিলেন, যিনি যথার্থ কবি, তিনি মানুষের মনকে উন্নত করেন, নীতিবোধ জাগ্রত করেন।
কবি তাঁর কল্পনা শক্তি ও রচনা কৌশল দ্বারা শ্রোতাদের মনকে জ্ঞান ও ধর্মের পথে পরিচালিত করেন।ইস্কাইলাস, গ্রীক নাট্যকারদের মধ্যে যিনি ছিলেন সর্বপ্রথম, তিনি ধর্মের চেয়ে রাজনীতিকেই নাটকে প্রধান করে তুলেছিলেন। নির্দিষ্ট কারণেই পৃথিবীর প্রথম ট্র্যাজেডির রচয়িতার জন্মের সাথে রাজনৈতিক ঘটনার ঘূর্ণাবর্তের এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক তৈরি হয়েছিলো।
পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্তি অবধি ইস্কাইলাস বড় হয়ে উঠেছেন পারস্য আর গ্রীসের মধ্যকার যুদ্ধের উত্তেজনার মধ্যে। সেজন্য তাঁর ট্র্যাজেডিতে বিষয়রূপে স্থান পেল যুদ্ধ ও নিয়মনীতি। চারশো নব্বই খ্রীস্টপূর্বে তিনি রচনা করেন প্রথম নাটক দ্য সাপ্লিয়ান্টস। বিশাল পারস্য বাহিনীর বিরুদ্ধে ম্যারাথনের প্রাঙ্গণে সাহসী গ্রীক- এথেনীয়দের মরণপণ সংগ্রাম তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিলো এই নাট্য রচনায়।
বিশাল সাম্রাজ্যশক্তির বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র একটি জাতির টিকে থাকবার লড়াই ছিলো তা। ইস্কাইলাসের পার্সিয়ান নাটকটি রচিত হয়েছিলো স্যালামিসের নৌযুদ্ধে গ্রীকদের কাছে পারস্যদের পরাজয়কে কেন্দ্র করে। নাট্যকার নাটকটিকে গ্রীক বিজয়ের গাথা করে তোলেননি। বরং পারস্য বাহিনীর পরাজয়ের কারণগুলোকেই বিশ্লেষণ করেছেন।
নাটকে ইস্কাইলাস দেখিয়েছেন ইতিহাস কোনো কাল্পনিক বিধান মেনে চলে না, চলে বাস্তব পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে।” নাটকে ঘটনাকে বিশ্লেষণ করার দায় নাট্যকাররা সেই অতীতকাল থেকেই পালন করে আসছিলেন, যা মার্কসীয় নাট্যকারদের প্রধান দাবি। শুধু বিশ্লেষণের মাপকাঠিটি ছিলো ভিন্ন, সেখানে শ্রেণী প্রশ্নের বাইরে ন্যায়-অন্যায় বা নৈতিকতার ব্যাপারটি প্রাধান্য পেয়েছিলো।
ইস্কাইলাস মানবিক আবেগ অপেক্ষা জগতের নৈতিক নিয়ম প্রতিপাদনের দিকেই অধিক দৃষ্টি দিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, মানুষের পাপে জগতের নীতিনিয়ন্ত্রিত সামঞ্জস্য ক্ষুণ্ণ হয়। পাপ থেকে পাপেরই জন্ম হয় এবং দোষী ও নির্দোষ উভয়েই দুঃখ ভোগ করে। জীবন দর্শনের দিক থেকে ইস্কাইলাসের প্রবণতা ও আগ্রহ ছিলো ধর্ম ও নৈতিকতার প্রতি। ইস্কাইলাস মহৎ ও নৈতিক আদর্শস্থাপনে প্রয়াসী ছিলেন।
যদিও ইস্কাইলাস নাটক দ্বারা মানুষের মনকে ধর্মের পথে পরিচালিত করার কথা বলেছিলেন, বাস্তবে তাঁর নাটক অনেক ক্ষেত্রে উল্টোটাই করেছে। সেই সঙ্গে তিনি অবশ্য মানুষের মৌলিক মর্যাদাবোধের প্রতিও আনুগত্য দেখিয়েছেন। সফোক্লিসের কাছে ঈশ্বর বা নিয়তির যেমন গুরুত্ব, তেমনি মানুষেরও। দুটোকেই তিনি সমান মর্যাদা দিয়েছেন। মানুষের নিজস্বতা ও নিয়তি-এ দুয়ের টানাপোড়েনেই মানুষের জীবনকে দেখেছেন সফোক্লিস। সফোক্লিসের নাটকে মানুষের পতন ও বিপর্যয় পূর্ব থেকেই নিদিষ্ট হয়ে
রয়েছে। অপর পক্ষে ইউরিপিডিস ঈশ্বর ও নিয়তির চেয়ে মানুষকে ও মানবিক মর্যাদাকে অধিকতর মূল্য দিয়েছেন। ঈশ্বর, নিয়তি বা ধর্ম সম্পর্কে তিনি আগ্রহী ছিলেন না। ইউরিপিডিস ধর্ম, যুদ্ধ ও নারী-সমাজ সম্বন্ধে সমসাময়িক যুগের ধারণাকে কঠোর আঘাত করেছিলেন। ট্র্যাজেডিকে তার আগের লোকদের চেয়ে বাস্তব জগতের অনেক কাছাকাছি এনেছিলেন ইউরিপিডিস। তাঁর নাটকে সামান্য হলেও নিচু-শ্রেণীর জীবন এসেছে।
এথেন্সে সামগ্রিকভাবে যে নতুন বৈজ্ঞানিক চিন্তা-ভাবনা দেখা দিয়েছিলো নাটকে তার রূপায়ণে তিনিই ছিলেন অগ্রদূত। নাট্যকার এ্যারিস্টোফানিস ইউরিপিডিস সম্পর্কে যে-সব অভিযোগ তুলেছিলেন তা হলো-তিনি প্রচলিত দেবদেবী মানেন না।
ইউরিপিডিস সম্পর্কে দীর্ঘ অভিযোগে এ্যারিস্টোফানিস বলেন, তিনি নিজের মতো করে সব দেবতা খাড়া করেছেন। তাঁর নাটক দেখে ছেলে-ছোকরারা বখে যাচ্ছে। ব্যায়াম, খেলাধূলা আর লড়াই ছেড়ে শুধু কে-কি-কেন এই সব প্রশ্ন করতে শিখেছে। তারা শুধুই তর্ক করে, ভালোমন্দ বিচার করে কিন্তু নিয়ম-কানুন মানতে চায় না। সাধারণ মানুষের জীবন থেকে তিনি তাঁর নাটকের মালমশলা এমনকি গানের সুর জোগাড় করেছেন। অভাব অনটন ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে লোককে সজাগ করাই তার লক্ষ্য। নাটক সম্পর্কে প্লেটোর ভয় তাহলে অমূলক ছিলো না।
ইউরিপিডিসের নাটক দেখে লোকের মন অধর্মের পথে গেছে, এ্যারিস্টোফানিস নিজেই এই সাক্ষ্য দিচ্ছেন। নারী স্বাধীনতার পক্ষে মিডিয়া নাটক লেখার জন্য ইউরিপিডিসকে দেশ ছাড়া করা হয়েছিলো। আসলে ইউরিপিডিসের ছিলো যুক্তিবাদী মন।
নাট্যকার এ্যারিস্টোফানিস সম্পর্কে বলা হয় যে, তিনি মানুষের কেমন হওয়া উচিৎ নয় তাই চিত্রিত করেছেন তাঁর নাটকে।
তার নাটকের বিষয়বস্তু তিনি নিয়েছেন সমসাময়িক রাজনৈতিক, সামাজিক ঘটনা ও সমস্যা থেকে, তারপর তাকে গড়ে তুলেছেন কল্পনা দিয়ে। মানুষের ভণ্ডামি, মিথ্যাচার, লোভ ও দুর্বলতা নিয়ে নির্মম ব্যঙ্গ ও পরিহাসই তার নাটকের প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিলো। এ্যারিস্টোফানিস প্রকৃতই অত্যন্ত শক্তিশালী নাট্যকার ছিলেন। কমেডির ভুবনে যতোরকম কলাকৌশল আছে তিনি তাঁর নাটকে প্রায় সবগুলোই দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন। সমকালীন অসাধু ও অযোগ্য বহু রাজনীতিবিদ এবং সরকারি কর্মচারীকে তিনি তাঁর নাটকে কাঠোর সমালোচনা করেছেন।
এরজন্য তিনি বহু শক্তিশালী শত্রু সৃষ্টি করেন। বিশেষ করে ভেক নাটকে রাজনীতিবিদ ক্লিওনকে বিদ্রুপ ও সমালোচনা করার জন্য এথেনীয় পরিষদের বিচারে নাট্যকারকে মোটা অংকের অর্থ জরিমানা দিতে হয়েছিলো।নাট্যকার উক্ত নাটকে সমকালীন এথেন্সের নৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তার গভীর উদ্বেগের কথাটা গোপন রাখেননি। এমনকি সঙ্কট উত্তরণের পথ নির্দেশের ইঙ্গিত দান থেকেও বিরত হননি।
তিনি নাটকের বিভিন্ন সংলাপে ক্লিগোনিসের মতো ডিমাগগদের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। যারা একগুঁয়ে যুদ্ধোন্মাদ, শান্তির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে উদাসীন, অতি-গণতন্ত্রী, এথেন্সের বর্তমান অভ্যন্তরীণ সঙ্কটময় পরিস্থিতি অনুধাবনে যারা অনিচ্ছুক কিংবা অপারগ তাদের সমালোচনা করেছেন।
ভেক নাটকের কিছু সংলাপের দিকে তাকালে নাট্যকারের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিটি স্পষ্ট হবে। যেমন রাজনীতিবিদ ক্লিগোনিস সম্পর্কে বলা হচ্ছে, ‘লোকটা আকারে ক্ষুদ্র কিন্তু নির্বুদ্ধিতায় পাহাড়ের মতো বিশাল ও নিরেট। তার মুখে কখনও শান্তি ও শুভেচ্ছার ললিত বাণী শোনা যায় না। সে বিশ্বনিন্দুক, যুদ্ধবাজ, শান্তি-বিরোধী, যেখানেই কাজিয়াফাসাদ সেখানেই তার মারমূর্তি নিয়ে সে উপস্থিত।
হ্যাঁ, এই হচ্ছে ক্লিগোনিস।’ কোরাস দলপতি এর উত্তরে বলছে, ‘নগরী তার সর্বোত্তম নাগরিকদের কী হাল করেছে সে কথা কি আমি আপনাদের বলবো? ঘটনাচক্রে সেটা খুশির কথা নয় বরং চরম দুঃখের।’ দলপতি আরো বলছে, ‘জাতির যখন সত্যিকার খাঁটি মানুষদের দরকার হলো তখনি দেখা গেল যে তাদের হটিয়ে দেয়া হয়েছে।
সদ্বংশজাত সুশিক্ষিত ভদ্র নানাগুণে গুণান্বিত মানুষদের আজ তাচ্ছিল্য করা হচ্ছে, তাদের নিন্দায় লোকে মুখর, আর যতো চোর-বদমাস-গুণ্ডা, নবাগত বিদেশি, তামার পাত মোড়ানো ক্রীতদাসদের সমাদরেই এখন সবাই ব্যস্ত।’ নাটকে তাই দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে, ‘হে আমার অবিবেচক, নির্বোধ বন্ধুগণ, এখনও সময় আছে আপনাদের নীতি পরিবর্তন করুন।
ভালো লোকদের ডেকে এনে কাজে লাগান। ‘ আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগের নাটকের সংলাপ এগুলো, যার মধ্যে রয়েছে তীব্র রাজনীতি, রয়েছে রাজনৈতিক প্রচার। নাটকটির মূল কাঠামো সাহিত্যনীতি-বিষয়ক এক মহান বিতর্ককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলেও তার পরতে পরতে রয়েছে সেই সময়ের গ্রীক সমাজ-সভ্যতা- রাজনীতির প্রধান দ্বন্দ্বগুলির স্পষ্ট প্রতিভাস।” নাটকের উদ্দেশ্য কী বা অতীতে নাটকের মধ্য দিয়ে কী বক্তব্য প্রচারের চেষ্টা করা হয়েছে সেটা জানা ও বোঝার জন্য ভেক নাটকটি হতে পারে একটি বড় দৃষ্টান্ত।
নাটকটির গল্প হচ্ছে, নাট্যকলার পৃষ্ঠপোষক দেবতা দিউনিসাস এথেন্সের সাম্প্রতিক নাট্যকারদের সৃষ্টিকর্মে আনন্দ ও তৃপ্তি না পেয়ে ভৃত্য জানথিয়াসকে নিয়ে হেরাক্লিসের ছদ্মবেশে পাতালপুরীতে হেডিসের উদ্দেশ্য যাত্রা করেছেন। স্মর্তব্য যে, ইতিমধ্যে ইস্কাইলাস, সফোক্লিস ও ইউরিপিডিস তিন শ্রেষ্ঠ ট্র্যাজিক নাট্যকারই মৃত্যুবরণ করেছেন।
দিউনিসাসের ইচ্ছা ইউরিপিডিসকে নাট্য রচনার জন্য আবার তিনি মর্ত্যে ফিরিয়ে আনবেন। পথে দিউনিসাসের সাথে হেরাক্লিসের যে বাক্য বিনিময় হয় সেগুলো এখানে খুব উল্লেখযোগ্য। হেরাক্লিস জানতে চায়, এতো কবি জীবিত থাকতে কী উদ্দেশ্যে দিউনিসাস সুদূর হেডিস পর্যন্ত কষ্ট করে যাবে। উত্তরে দিউনিসাস বলেন, আমার এমন একজন কবি চাই যিনি লিখতে পারেন।
আজকাল দুরকম কবি আছেন, কেতাদুরস্ত চতুর ও মসৃণ আর মৃত। হেরাক্লিস জানতে চান, সফোক্লিসের পুত্র তরুণ ইয়োফোনের কি হলো? দিউনিসাস উত্তরে বলেন, একমাত্র ওর মধ্যেই কিছু পদার্থ আছে, তাও আবার আমি খুব সুনিশ্চিত নই। হেরাক্লিস তখন বলেন, কিন্তু কয়েকজন তরুণ কবি তো গিজগিজ করছে আর একটার পর একটা ট্র্যাজেডি লিখে যাচ্ছে।
বাগাড়ম্বরের দিক থেকে সেইটিই যদি তুমি চাও ইউরিপিডিস তো তাদের কাছে তুচ্ছ। দিউনিসাস তখন উত্তর দেয়, ওরা সব চুনোপুটি। কোনো কাজের নয়। শুধু চড়ুই পাখির মতো কিচিরমিচির করতে জানে। নিজেদের শিল্পকলার ক্ষেত্রে কলংক স্বরূপ। দ্বিতীয়বার আর তাদের নাম শোনা যায় না। ওদের সারা দঙ্গলে খুঁজে তুমি একজন সত্যিকার শক্তিশালী মৌলিক কবি পাবে না যিনি একটি আকষর্ণীয় উদ্দীপক চরণ রচনা করতে পারেন। তিনি আরো বলেন, যে কবি প্রকৃত দুঃসাহসী কিছু সৃষ্টি করতে পারেন আমি এইরকম কবির কথা বলছি।”
নানারকম ঘটনার পর দিউনিসাস এবং জানথিয়াস শেষ পর্যন্ত প্লুটোর প্রাসাদদ্বারে উপস্থিত হয়। সেখানে দিউনিসাস অবিষ্কার করেন পাতালপুরীর প্লুটোর ভোজসভার ট্র্যাজিক নাট্যকারের জন্য সংরক্ষিত সম্মানিত আসনে কে বসবে তা নিয়ে ইউরিপিডিস ইস্কাইলাসের সঙ্গে সাংঘাতিক বিবাদে মগ্ন। শেষে প্লুটো ঠিক করলেন, এই দুজনের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ নাট্যকার তার সিদ্ধান্ত হবে একটি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে।
প্রতিযোগিতার পর্বে দুই নাট্যকারের মধ্যে তীব্র বাকযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। ইস্কাইলাস ও ইউরিপিডিসের বিবাদের মধ্যে আমরা সাহিত্যের সেই চিরন্তন বিবাদেরই সন্ধান পাই, আদর্শবাদ ও বস্তুবাদের বিবাদ। ইস্কাইলাস দেখিয়েছেন, জীবন যা হওয়া উচিত আর ইউরিপিডিস দেখিয়েছেন, জীবন যা হয়।
দুজনের এই বাকযুদ্ধ ইউরিপিডিস ও ইস্কাইলাসের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে এ্যারিস্টোফানিসের নিজস্ব মূল্যায়ন ছাড়া আর কিছু নয়। সেই বাকযুদ্ধে ইস্কাইলাস ইউরিপিডিসকে প্রশ্ন করছেন, বলতো একজন ভালো কবির কী কী গুণ থাকা দরকার? ইউরিপিডিস উত্তর দিচ্ছেন, আঙ্গিক নৈপূণ্য, নীতি শিক্ষাদানের ক্ষমতা, জনসাধারণকে উন্নততর নাগরিকে রূপান্তরিত করার দক্ষতা।”
গ্রীক রচনার একটি স্পষ্ট চেহারা পাই আমরা ইস্কাইলাস ও ইউরিপিডিসের সংলাপ থেকে। ইস্কাইলাস বলছেন, ‘দেখুন না, একেবারে সেই আদি যুগ থেকে সত্যিকার বড় কবি মাত্রই মানুষকে উপকারী ও উপযোগী কিছু একটা শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। অরফিউস… আমাদের শিখিয়েছেন যে হত্যা করা অন্যায়। মিউসিয়াস শিখিয়েছেন কেমন করে রোগব্যাধি সারিয়ে তোলা যায়।…
হেসিয়ডের কাছ থেকে আমরা শিখেছি কৃষি এবং চাষাবাদের সময় সম্পর্কিত তথ্য।’ ইস্কাইলাস সেখানে হোমার সম্পর্কে বলছেন, হোমারের রচনায় রয়েছে মূল্যবান সামরিক শিক্ষার উপকরণ। সংগঠন, প্রশিক্ষণ, সাজ সরঞ্জাম সব রয়েছে সেখানে। নিজের নাটক থিবীর বিরুদ্ধে সপ্তসুর সম্পর্কে ইস্কাইলাসের বক্তব্য, ‘ওই নাটক দেখার পর সোজা সেখান থেকে উঠে শত্রুকে নিধন করতে যাওয়া ছাড়া কারো কোন গত্যন্তর নেই।’
নিজের পারসিক নাটক সম্পর্কে বলছেন, ‘বিজয়ের অদম্য ইচ্ছাশক্তি সম্পর্কে চমৎকার বক্তব্য আছে সেখানে। আমার সর্বশ্রেষ্ঠ নাটক।’ তিনি আরো বলছেন, ‘আমি পেট্রোক্লাস ও টিউসারের মতো সিংহহৃদয় বীর সৃষ্টি করেছি, যেন সংগ্রামের ডাক এলে দর্শকবৃন্দ তাদের সঙ্গে একাত্ম হবার অনুপ্রেরণা লাভ করতে পারেন।’
তারপরই ইউরিপিডিসের নাটকের সমালোচনা করে বলছেন, ‘ফ্রেইডা কিংবা স্থেনেবিয়ার মতো কুলটা দিয়ে আমি কখনো আমার মঞ্চ আকীর্ণ করে তুলিনি।…এ রকম ঘটনা সত্যিই ঘটে কিন্তু কবির উচিৎ সে সম্পর্কে নীরব থাকা, সবার সামনে অনুকরণের জন্য মঞ্চে উপস্থিত করা নয়। স্কুলের বালকদের শেখাবার জন্য রয়েছে শিক্ষক, প্রাপ্তবয়স্কদের শেখাবেন কবি-সাহিত্যক। আমরা যা শেখাই তা যেন যথার্থ এবং সঠিক হয় তা দেখা আমাদের কর্তব্য।”
ইউরিপিডিস নিজের নাটক সম্পর্কে এই নাটকে মন্তব্য করছেন, ‘আমার নাটকে প্রথম চরিত্রটি মঞ্চে প্রবেশ করে একেবারে শুরুতেই নাটকের পটভূমি ও উৎস পরিস্কার করে ব্যখ্যা করে দেয়।… নাটক শুরু হয়ে গেলে আমি কাউকে খামোখা আলসেমি করতে দেইনি, সবাইকে খাটিয়ে নিয়েছি। মহিলা আর দাসদাসী, প্রভু, অল্পবয়সী অবিবাহিতা মেয়ে আর ধূপসী বুড়ী, সবাই সংলাপ উচ্চারণ করেছে।’
নিজের নাটক সম্পর্কে ইউরিপিডিস আরো বলছেন, ‘আমি তাদের শিখিয়েছি কীভাবে দেখতে হয়, পর্যবেক্ষণ করতে হয়, ব্যাখ্যা দান করতে হয়। আমি তাদের শিখিয়েছি যেন কখনো হুট করে বাইরেরটা দেখে কোনো স্থির ধারণা না করে বসে, যেন প্রথম সবচাইতে খারাপটাই সন্দেহ করে।…
আমি লিখেছি চেনা-জানা সাধারণ বিষয় নিয়ে, যেসব বিষয় সম্পর্কে দর্শককূল সুঅবহিত, যেন প্রয়োজন হলে তারা আমার কাছে কৈফিয়ত চাইতে পারে। লম্বা-চওড়া কথার বহর দিয়ে আমি তাদের অজ্ঞান করে দিতে চাইনি।’ নিজের নাটক সম্পর্কে ইউরিপিডিস আরো বলছেন, ‘দশর্ক শ্রোতাদের মাথা খাটাতে শিখিয়েছি, নাটকের মধ্যে খানিকটা যুক্তি ঢুকিয়েছি।
জনসাধারণ আমার কাছ থেকেই শিখেছে কেমন করে চিন্তা করতে হয়, কেমন করে তাদের ঘর সংসার চালাতে হয়, কেমন করে প্রশ্ন করতে হয়…?” কিন্তু ইস্কাইলাস ইউরিপিডিসের নাটকের বিরুদ্ধে অভিযাগ তুলছেন এই বলে, ‘তোমার রঙ্গমঞ্চ শুধু কানা-খোঁড়া আর ভিক্ষুকের মতো সাধারণচরিত্রে পরিপূর্ণ। দেবতাদের দু চোখে দেখতে পারো না তুমি’। ‘তারপর তুমি মানুষকে শিখিয়েছো সারাদিন শুধু বকুনি আর কথার কচকচিতে ডুবে থাকতে।
কুস্তির আখড়াগুলি এখন খালি পড়ে থাকে। জোয়ান ছেলেপেলেরা এখন যতসব ওচা জায়গায় জড়ো হয়ে বিতর্ক করা শিখছে এবং শুধু যে সেটাই শিখছে তা নয়, শুনছি সাধারণ নাবিকরা পর্যন্ত নাকি এখন অফিসারদের সঙ্গে তর্ক করে। আমার সময় তো মুখ বুজে হুকুম তামিল করা ছাড়া তারা টু শব্দটি করতো না।’কী দেখতে পাচ্ছি তাহলে আমরা? নাট্যকলা তার যাত্রার শুরুতেই ঈশ্বর, নিয়তি বা ধর্ম নিয়ে মাতামাতি করলেও শেষ পর্যন্ত মানুষের মধ্যেই নাটকের উপাদানের সন্ধান করেছে। বাস্তব জীবন ব্যবস্থা থেকেই নিয়েছে তাদের নাটকের ঘটনা ও উপাদানসমূহকে।
সফোক্লিস ঈশ্বর ও মানুষকে সমান গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করলেও তাঁর এ্যান্টিগনি নাটকে মানুষের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা বেশ জোর দিয়েই বলেছেন। শেষ মুহূর্তে এ্যান্টিগনি মৃত্যুবরণ করলেও পরবর্তী মানুষদের কাছে এই সত্য রেখে যায় যে, প্রয়োজনে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়তে হলে মৃত্যুকেও তুচ্ছ জ্ঞান করতে হবে।
ইস্কাইলাসও তার শৃঙ্খলিত প্রমিথিউস নাটকের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন দেবতাদের মানুষের বন্ধু হিসাবে পেতে চেয়েছেন অন্যদিকে তেমনি দেবতাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্যাতিত মানুষকে বিদ্রোহী হতে বলেছেন। ফলে প্রাচীন গ্রীসের নাটক যে উদ্দেশ্যহীন ছিলো না সে কথা আমরা বলতে পারি। বরং তা গণতান্ত্রিক এথেন্সে এতোবেশি উদ্দেশ্যপূর্ণ ছিলো যে, শাসকরাও নাটক সম্পর্কে ভীত হয়ে পড়েছিলো।
ভারতের প্রাচীন নাট্যকলায়ও নাটকের ব্যবহারিক দিক নিয়ে আমরা নির্দিষ্ট কিছু বক্তব্য পাই। বিশেষ করে সংস্কৃত নাটকে। গ্রীসের মতো হিন্দু বা সংস্কৃত নাটকেরও তিনটি পর্ব রয়েছে। নাটকীয় উপাদানগুলি বিবর্তিত হয়ে নাট্যরূপে সর্বপ্রথম আসে দেব-চরিত্র, দ্বিতীয় পর্যায়ে রাজ-চরিত্র এবং তৃতীয় পর্যায়ে সাধারণ মানব চরিত্র। হিন্দু নাটক মাঝপথেই বাধাপ্রাপ্ত হয়ে যাওয়াতে তাতে আর সাধারণ মানব কাহিনীর পূর্ণ বিকাশ সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি।
ভারতের বিভিন্ন স্থানে নাট্যশাস্ত্রের প্রায় চল্লিশখানি পৃথি পাওয়া গেছে, যারমধ্যে সর্বাধিক প্রচারিত ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্র। রচনাকাল নিয়ে বিতর্ক থাকলেও খ্রীস্টীয় দ্বিতীয় শতক কিংবা তৃতীয় শতক কোনো একটি হবে বলে পণ্ডিতদের ধারণা। নাটককে পঞ্চম বেদ বলা হয়েছে।
কিংবদন্তী অনুসারে চতুর্বেদ পাঠ করবার অধিকার ছিলো ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের। অথচ বৈশ্য ও শূদ্ররাই ছিলো সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই কালক্রমে তারাও বেদ পাঠ করার অধিকার দাবি করে বসলো। বৈশ্য ও শূদ্রদের বেদ পাঠে অধিকার দেয়া হলে তারাও ব্রাহ্মণদের সমতুল্য হয়ে ওঠে, সেইজন্য ব্রহ্মা সৃষ্টি করেন পঞ্চম বেদ ‘নাট্যশাস্ত্র’ যাতে সকলের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। কিংবদন্তী অনুসারে ব্রহ্মাই স্বীকার করছেন নাটক থেকে মানুষ বন্ধুর মতো পাবে উৎসাহ, পাবে সুখ, পাবে সৎপরামর্শ-নাটক হবে জনশিক্ষার সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়। নাটক মানুষকে ধর্মে- কর্মে, সামাজিক কর্তব্যে, বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলনে বিশ্বস্তভাবে উদ্দীপিত করবে।**
নাট্যবেদ রচিত হবার পর দেবরাজ ইন্দ্রের পরামর্শে ব্রহ্মা-ভরতমুনিকে নাট্যশিক্ষা দান করেন এবং তাঁকে তাঁর শিষ্যদের নিয়ে তা প্রয়োগ করতে নির্দেশ দেন। কিংবদন্তী অনুসারেই দেখা যায় ইন্দ্রের ধ্বজোৎসবে ভরত অসুর বিজয় নাট্যাভিনয় দেখালেন। যখন এই দৃশ্য এলো যে দৈত্যরা পরাজিত হচ্ছে, দৈত্য-দানবরা তখন বিঘ্ন ও বিরুপাক্ষ নামক অনুচরদের ডেকে বললো-ভেঙে দাও এ নাটক।
এতে আমাদের অপমান করা হচ্ছে। তখন বিঘ্নরা অপ্রাকৃত মায়া বিস্তার করে অভিনেতাদের অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ, কন্ঠস্বর এমনকি স্মরণশক্তি পর্যন্ত বিকল করে দিলো। ইন্দ্র যখন ঘটনাটা বুঝলো তখন ক্রোধে তার রক্তচক্ষু ঘুর্ণিত হতে লাগলো। সে ধ্বজদও তুলে নিয়ে অসুরদের প্রবলভাবে আক্রমণ করে হত্যা করলো এবং মঞ্চকে বিপদমুক্ত করা হলো। অভিনয়স্থান বিপদমুক্ত হলে নাট্যানুষ্ঠান পুনরায় শুরু হলো। তা সত্ত্বেও অসুরগণ নাটকে বিঘ্ন সৃষ্টি করার চেষ্টা করে যেতে থাকে। তখন ব্রহ্মা বিশ্বকর্মাকে নাট্যগৃহ নির্মাণের নির্দেশ দেন যাতে দর্শকদের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত করা যায়। ব্যাপারটা এখানে শেষ হলো না।
দৈত্য ও অসুররা তখন ব্রহ্মার কাছে গিয়ে এই অবিচারের জন্য নালিশ জানালো। ব্রহ্মা তাদের শান্ত করার জন্য নাটকের গুণগান এবং বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করে একটি বক্তব্য দিলেন। তিনি বললেন, ‘নাটকে কারো প্রতিই পক্ষপাতিত্ব থাকবে না, নাটকের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পাবে সারা পৃথিবীর, দেবতার, অসুরের ও মানুষের জীবনকীর্তন। নাটক সর্বশ্রেণীর সর্ব সাধারণের অনুকৃতি।
এতে সকলের ভালমন্দ সব আচরণই স্থান পাবে, নাটক থেকে সকলেই লাভ করবে শিক্ষা ও সুপরামর্শ। নাটক হচ্ছে সকল শাস্ত্রের সমন্বিত আধার।’২৭ তিনি আরো উল্লেখ করেন, ‘নাটকে থাকবে সকল কিছুর অনুকৃতি, যা অভিনয়ের মাধ্যমে রূপায়িত হবে। নাটক যেমন শিক্ষা দান করবে, তেমনি মনে আনন্দের সঞ্চার করবে; শক্তি যোগাবে, দুঃখে হবে সান্ত্বনা।’
প্রাচীন ভারতের নাট্যচিন্তায়ও তাহলে নাটকের একটি ব্যবহারিক দিক ছিলো। বলতে গেলে সেটাই ছিলো প্রধান দিক। বিশেষ করে প্রাচীন ভারতের দুটি সংস্কৃত নাটক মৃচ্ছকটিক ও মুদ্রারাক্ষস ছিলো সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করে। সেখানে মানুষের প্রেম, ভালোবাসা, ঈর্ষা, বিদ্বেষ, বিরহ যেমন ধরা পড়ে; তেমনি ধরা পড়ে তার সমাজ-রাজনীতি।
সর্বসময়ে নাটকের এই ব্যবহারিক বা উপযোগিতার দিকটি সকল নাট্যচিন্তার ইতিহাসে লক্ষণীয়। পৃথিবীর সকল দেশের নাট্যকলাতেই এই ব্যবহারিক দিকটি ছিলো যদিও কীভাবে নাটককে ব্যবহার করা হবে, কার পক্ষে ব্যবহার করা হবে তা নিয়ে বারবার দেখা দিয়েছে মতদ্বৈততা। একমত থেকে ভিন্নমতে উত্তরণও ঘটেছে। সেই ইতিহাসেই আমরা গভীরভাবে দৃষ্টি নিবন্ধ করবো।
নাটকের এই দিকটা বুঝতে গেলে আমাদের প্রধানত ইউরোপ মহাদেশের নাট্য ইতিহাসের ওপরই চোখ রাখতে হবে। কারণ ইউরোপের বিভিন্ন দেশগুলোর নাট্য মঞ্চায়নের ইতিহাসের একটি ধারাবাহিকতা রয়েছে, নাটকের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধারাবাহিক উত্তরণ সেখানে লক্ষণীয়। বিশেষ করে আমাদের নাট্যচিন্তার মূল ধারাটি এসেছে ইউরোপ থেকেই। সেজন্যই ইউরোপের নাট্য ইতিহাসের বাঁকগুলো ভালোভাবে বুঝে নেয়া এই রচনার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। ইউরোপে গ্রীসের পরই নাট্য ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য ধারাটি হচ্ছে রোমের থিয়েটার।
খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে গ্রীস রোমের অধীনে চলে যায়। শুধু গ্রীস নয়, ইউরোপের বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রই তখন রোমের পদানত। মদিরা ও শস্যদেবতা দিউনিসাসকে কেন্দ্র করে গ্রীসে নাট্যকলা জন্ম নিয়েছিলো ও বিকশিত হয়েছিলো। রোমের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি, রোমানরা তাদের শস্যদেবতা তেলুসকে অবলম্বন করে উন্নতমানের কোনো থিয়েটারের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটাতে পারেনি।
রোমে শস্যদেবতাদের সম্মানে যেসব উৎসব ছিলো তাতে হাস্যকৌতুক, ভাঁড়ামি, অশ্লীল নৃত্য প্রদর্শন ইত্যাদিই হতো। গ্রীসের নাট্যপ্রেরণা থেকেই রোমের নাট্য ইতিহাস শুরু। রোমানরা নাটকের চেয়ে দড়ির খেলা, মুষ্টিযুদ্ধ কিংবা তারচেয়ে নৃশংস গ্লাডিয়েটরদের অনুষ্ঠান যা এ্যাম্ফিথিয়েটারে অনুষ্ঠিত হতো, তার প্রতি ছিলো বেশি অনুরক্ত।
রোম গ্রীস জয় করে নিলেও গ্রীস সভ্যতার কাছে তার পরাজয় ঘটলো। রোমেও শীঘ্রই নাটক জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। তবে ট্রাজিডির চেয়ে দশর্কদের আগ্রহ জন্মালো ব্যাঙ্গাত্মক কমেডির প্রতি। গ্রীসে নাটকের আবির্ভাব ঘটেছিলো ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকে, সেখানে নাট্যাভিনয় ছিলো জাতীয় উৎসব।
রাষ্ট্রটি গণতান্ত্রিক হওয়ায় সকলের প্রবেশাধিকার ছিলো প্রেক্ষাগৃহে, যা রোমে ছিলো না। রোমের নাটকের সাথে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কোনো সংযোগ ছিলো না। রোমানদের দেবদেবীর সংখ্যা যথেষ্টই ছিলো, তা সত্ত্বেও তাদের জীবনধারায় ধর্মীয় আগ্রহ-অনুভূতি অনুপস্থিত ছিলো। নিরেট বাস্তব বোধসম্পন্ন রোমানরা অধিকতর আস্থা ও ক্ষমতা স্থাপন করেছিলো যুদ্ধ আর রাজনীতিতে এবং জীবন উপভোগের ক্ষেত্রে বিলাস ও উচ্ছৃঙ্খলতায়। কালক্রমে রোম সমগ্র ইতালীকে আপন কর্তৃত্বাধীনে এনে এবং নানা রাজ্য জয় করে আতাব্যাপ্তি ঘটায়। ফলে খ্রীস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের মাঝামাঝি সময়ে সুসভ্য গ্রীসও রোমের অন্তর্ভুক্ত হয়।
কিন্তু প্রবল পরাক্রমশালী রোম তার পদানত গ্রীসের সাংস্কৃতিক দাসত্ব বরণ করে নিয়েছিলো এবং পরবতীকালে রোম গ্রীক সভ্যতার ধারক ও বাহক হিসাবে কাজ করে ঐ সভ্যতার অবদানকে ভিন্ন ভিন্ন জাতির দুয়ারে পৌঁছে দিয়েছিলো। যদিও নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে গ্রীস রোমের ওপর খুব প্রভাব ফেলতে পারেনি। রোমে নাটক ছিলো সম্পদশালী, বিলাসী অভিজাত রোমানদের ব্যসনের একটি অঙ্গ।
সকলের সেখানে প্রবেশাধিকারও ছিলো না। রোমের নাটকের বিষয়বস্তু ও চরিত্র গ্রীসের মতো পৌরাণিক কাহিনীকে ঘিরে তৈরি হতো না, কাহিনী বিন্যাস ও চরিত্র চিত্রিত হতো পারিবারিক ঘটনা নিয়ে। রোমের নাটকে কোরাসের কোনো স্থান ছিলো না। নাটকের চরিত্রগুলোই ছিলো প্রধান কাহিনীবেত্তা, প্রায় আধুনিক নাটকের মতোই। চরিত্র সংখ্যাও ছিলো অনেক।
রোমান নাটক শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় অভিজাতদের তুষ্টির জন্য রচিত হতো বলেই গ্রীক রঙ্গালয়ের তুলনায় রোমের প্রেক্ষাগৃহ খুবই ছোট আকার ধারণ করলো। থিয়েটারের ইতিহাসে তাদের অবদান প্রধানত থিয়েটার স্থাপত্যেই। নাটক মঞ্চায়নের জন্য তারা বেশ কিছু মিলনায়তন নির্মাণ করেছিলো। রোমের অভিনেতারা তাঁদের পূর্বসূরী গ্রীক-অভিনেতাদের মতো উচ্চ ধর্মীয় বা সামাজিক মর্যাদা পাননি। এখানে অধিকাংশ অভিনেতাই ছিলেন দাসশ্রেণী থেকে উদ্ভূত, যাঁদের কোনো ধর্মীয় বা আইনগত অধিকার ছিলো না।
জাতে এঁরা ছিলেন নিছক পেশাদার আমোদদাতা। জুলিয়াস সীজার ও সম্রাট অগাস্টাসের আইনকানুনের আওতায় এঁদের কোনো সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া নিষিদ্ধ ছিলো। রোমান রিপাবলিকের সিনেট রোমান নাগরিকদের জন্য অভিনয় করা বা অভিনেতা হওয়া নিষিদ্ধ করেছিলো। যদি কেউ এই পেশা গ্রহণ করতেন তাহলে তিনি নাগরিকত্ব ও সর্বপ্রকার নাগরিক অধিকার হারাতেন।
সেনেকাই ছিলেন রোমের সবচেয়ে অগ্রগণ্য নাট্যকার। সেনেকার স্পষ্ট প্রভাব ছিলো বহু শতাব্দী পরের নাট্যকার শেক্সপিয়ারের ওপর। রেনেসাঁস যুগের প্রথম দিকের নাট্যকারগণও সেনেকার ভাবধারা পুষ্ট ছিলেন। সেনেকাই নাটকে আত্মার আবির্ভাব ও ভয়াবহ রক্তাক্ত দৃশ্যের অবতারণা করেন। রক্ত, ভয়াবহতা, বিক্ষুব্ধ ঝঞ্ঝা, মৃত্যুর করাল গহ্বর তাঁকে আনন্দ দিতো।
তিনি নাটকের মধ্যে এগুলো নিরাসক্ত শান্ত চিত্তে ও ঠান্ডা মাথায় ঘটাতেন। সেনেকার নাটকে ধর্মের কোনো স্থান ছিলো না। রোমান নাট্যকার প্লাইতুস লিখতেন জনগণের মনোরঞ্জনের জন্য আর তার উত্তরসূরী তেরেন্স চেয়েছিলেন বিদগ্ধজনের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে। নাটকে রোমানদের রুচি ও প্রকৃতির সমালোচনা করতেন তিনি। প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে সেনেকা, প্লাইতুস, বা তেরেন্সের নাটকও গ্রীসের মতো না হলেও কমবেশি সংলগ্ন থেকেছে সমাজ-রাজনীতির স্রোত ও আবর্তের সঙ্গে। তবে রোমান নাটকের মূল দিকটা ছিলো মনোরঞ্জনই। রোমানররা থিয়েটার স্থাপত্য ও প্রকৌশলে অবদান রাখলেও সামগ্রিক ভাবে নাট্যকলাকে তারা অতীব হীন পর্যায়ে নামিয়ে এনেছিলে।।
বিষয়টি লক্ষণীয় যে, নাটক যখন জনতা থেকে সাধারণ থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ে, রাজন্যদের অনুগ্রহ বা তাদের তুষ্টির ব্যাপার হয়ে পড়ে তখন নাটকের চিন্তার দিকটি হারিয়ে গিয়ে তার মনোরঞ্জনের দিকটিই বড়ো হয়ে দাঁড়ায়। প্রাচীন রোমের নাট্য ইতিহাস তাই প্রমাণ করে। সেখানে নাটক লেখা, অভিনয় করা সবই হয়ে দাঁড়িয়েছিলো প্রধানত চাকরি।
কোনো আদর্শ সেখানে যেমন ছিলো না, নাটক রচনার পেছনে কোনো উদ্দেশ্যও সেখানে ছিলো না। নাট্য মঞ্চায়ন ছিলো উদ্দেশ্যহীন। জনসাধারণের জন্য বা তাদের কথা ভেবে নাটক লেখা হতো না, হতো রাজন্যদের খুশি করার জন্য। রোমান নাটক জনবিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলেই ধর্মের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়েও বিরাট কোনো নাট্যধারা সৃষ্টি করতে পারলো না, যা গ্রীসের নাট্যকাররা পেরেছিলেন।
জনগণের সাথে সম্পৃক্ত থেকে জনগণের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলেন বলেই গ্রীক নাট্যকাররা মহৎ ধ্রুপদী নাটক রচনা করেছিলেন। যা প্রমাণ করে, উপাযোগিতা বাদ দিয়ে উদ্দেশহীনভাবে মহৎ নাটক রচনা করা যায় না। রোমের দুর্ভাগ্য এই যে, রোমের নাট্য ইতিহাস খুব বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারলো না খ্রীস্টধর্ম আবির্ভাবের ফলে। খ্রীস্টধর্ম আবির্ভাবে সেই প্রাচীনকালেই রোমে নাটক মঞ্চায়ন নিষিদ্ধ হয়ে গেল। এরপর প্রায় দেড় হাজার বছরের বিশাল ফাঁক ইউরোপীয় থিয়েটারে।
জীবন ধারণের বস্তুগত উপকরণের উৎপাদন পদ্ধতিই সাধারণভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন-প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। যে-কোনো উৎপাদন পদ্ধতি বিকাশের একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে এলে তার সাথে প্রচলিত উৎপাদন সম্পর্কের সংঘাত লাগে। সেক্ষেত্রে পুরানো উৎপাদন পদ্ধতি নতুন উৎপাদন পদ্ধতি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হলে শিল্প-সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি, আইন, প্রশাসন, ধর্ম প্রভৃতি সমাজের উপরি কাঠামোর প্রতিটি অংশে রূপান্তর ঘটতে থাকে।
আর পরিবর্তিত উৎপাদন পদ্ধতিতে উৎপাদনের উপকরণসমূহের মালিকানা যে শ্রেণীর হাতে থাকে তার ভাবাদর্শই এই রূপান্তর প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। প্রাচীন যুগ পার হয়ে যখন মধ্যযুগ এলো তখনও তাই ঘটলো। মধ্যযুগের শাসকশ্রেণীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেল শিল্প-সাহিত্য, দর্শন ও রাজনীতি। ইউরোপের মধ্যযুগটা ছিলো গির্জা দ্বারা শাসিত। খ্রীস্টধর্ম আবির্ভাবের পর শাসনব্যবস্থার কেন্দ্র বিন্দু হয়ে দাঁড়ালো গির্জা।
মধ্যযুগের শাসকরা বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ইশ্বরের কাছে নিজেদের সম্পূর্ণ সমর্পণ করে। সেজন্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ও নাট্যচর্চা বন্ধ হয়ে গেল কয়েক শতাব্দীর জন্য। পাশাপাশি ছিলো বর্বরদের আক্রমণ। যে-ধর্মকে ঘিরে নাটকের জন্ম সেই ধর্মই আবার আইন করে নাটক মঞ্চায়ন নিষিদ্ধ করে দিলো। নাট্যকর্মের সঙ্গে যুক্ত অনুষঙ্গসমূহ রোমান আমলে এতোটাই অশ্লীল হয়ে পড়েছিলো যে, বর্বরদের দ্বারা রোমের পতনের জন্য অনেকেই নাট্যকর্মকে দায়ী করতো। খ্রীস্টান ধর্মযাজকরা যে নাট্যকলার বিরুদ্ধেই শুধু যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলো তা নয়. চার্চ পৌত্তলিকতা ও যে-কোনো উৎসব অনুষ্ঠানের প্রবল বিরোধী ছিলো।
যদিও অচিরকালের মধ্যে চার্চ এক মহাসত্য উপলব্ধি করতে পারলো আর তা হলো, নাটকের প্রচারকার্য ও জনশিক্ষার ক্ষমতা। ষষ্ঠ শতকের মধ্যে গির্জার ‘মাস’ প্রার্থনা অনুষ্ঠানে, যেখানে যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার স্মৃতি রক্ষার্থে সকলে সমবেত প্রার্থনায় মিলিত হতো-সেখানে বাইবেলের কাহিনী, যিশুর জীবনী ও খ্রীস্টান নীতিগাথা ইত্যাদি বর্ণিত হতে থাকে।
এই মাস অনুষ্ঠান থেকেই থিয়েটার পুনর্জন্ম লাভ করে। সেটা কবে শুরু হয়েছিলো নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। সপ্তম থেকে দশম শতকের মধ্যে ল্যাটিন ভাষায় রচিত কিছু সংলাপ পাওয়া গেছে যাতে দুটি চরিত্র রয়েছে। দশম শতক থেকেই চার্চের অধীনে এক নতুন ধারার আবির্ভাব হয়। বাইবেলের কাহিনী নিয়ে অতি ক্ষুদ্র হয়তো বা চার লাইনের নাটিকা হতো।
দশম শতক থেকে সামন্তশ্রেণী গির্জাকে নিরংকুশ সহযোগিতা দান করতে থাকে, কারণ কৃষকদের শোষণ করতে গেলে তাদের ভিতরে ধর্মবোধকে প্রবলভাবে’ জাগ্রত করা দরকার। গির্জার পরিচালকরাও এটা বুঝতে পেরেছিলো যে কৃষকদেরকে গির্জামুখী না করতে পারলে গির্জার অর্থ সরবরাহ ব্যাহত হবে। সাধারণ মানুষকে ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্যই নাট্য মঞ্চায়নের চিন্তা তাদের মাথায় এসেছিলো।
প্রথমে তারা গির্জার অভ্যন্তরেই এই মঞ্চায়ন শুরু করে। ঈশ্বরই ছিলো তখন নাটকগুলোর দৃশ্যমান বা অদৃশ্য নায়ক। প্রথমদিকে গির্জার পুরোহিত বা পাদ্রীরাই বিভিন্ন চরিত্রে রূপদান করতো। নাটকের চরিত্র সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় পুরোহিত ও পাদ্রীদের পক্ষে সবগুলো চরিত্রে রূপাদান করা সম্ভব ছিলো না বলে গির্জা কর্তৃপক্ষ সাধারণ ব্যক্তিদেরও অভিনয়ে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দিতে বাধ্য হয়, যাদের পক্ষে ল্যাটিন না জানাই স্বাভাবিক।
সে কারণে প্রথম দিকে নাটকে ল্যাটিন ভাষা ব্যবহৃত হলেও একাদশ শতক থেকে নাট্যসংলাপে ল্যাটিন ভাষার প্রাধান্য কমতে থাকে। দেশীয় ভাষায় নাটক রচনা শুরু হয়। থিয়েটার মূলত সমাজ-বাস্তবতার প্রতিভাস। কোনো থিয়েটারই আজ পর্যন্ত তাই বাস্তব পটভূমিকে অস্বীকার করতে পারেনি।
সুতরাং থিয়েটারের বাস্তবতা সেই বিশেষ যুগের ঘটনাবলী ও প্রয়োজনীয়তার দ্বারা এবং সেই সময়ের গতি প্রকৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। নীচের ঘটনাবলীর দ্বারা তা আরো প্রমাণিত হবে। দশম, একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীর ইউরোপে ক্যাথলিক ধর্মভাবাপন্ন নতুন নতুন রাষ্ট্র গড়ে ওঠায় গির্জার ধর্মযাজকরা অনুভব করেন বিশ্বাসপ্রবণ মানুষের ধর্মের সত্যাসত্যগুলি সঠিকভাবে অনুধাবন করানো প্রয়োজন।
মধ্যযুগের চার্চের এই ধর্মপ্রাণ চিন্তা শিল্প-সংস্কৃতি এবং নাটকের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে গির্জার ধর্মযাজকরা দুটি কারণে গির্জার বাইরের মুক্তাঙ্গনে ধর্মীয় নাট্যসম্ভার প্রযোজনা করতে শুরু করে। প্রথমত গির্জা মনে করেছিলো, এভাবে ব্যাপক মানুষের মধ্যে ধর্মের বাণী পৌছে দেয়া যাবে।
দ্বিতীয়ত যিশু খ্রীস্টের গাথা লোকের কাছে বিশেষ দর্শনীয় হয়ে উঠবে। যাজকবর্গ মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য দৃশ্যকাব্য হিসাবে সৃষ্টি করে এই নাটক। বাইবেলের কাহিনীকে ঘিরে খ্রীস্টের পুনরুত্থান ছিলো সেইসব নাটকের একটি দিক। দশম শতকে বাইবেলের সুসমাচার দিয়ে এর শুরু হলেও দ্বাদশ শতকে তা পূর্ণাঙ্গ নাটক হিসাবে বিকশিত হতে থাকে। নাটকের কাজ সেখানেও ধর্মীয় অনুভূতি প্রচার, খ্রীস্টের মাহাত্ম্য প্রচার। মধ্যযুগে ইউরোপের ধর্মীয় নাটকের কয়েকটি ধারা দেখা যায়।
মিস্ট্রি নাটক, মরালিটি নাটক, প্যাশন নাটক। মিস্ট্রি নাটক প্রধানত ছিলো যিশুর জীবনকে ঘিরে কিংবা বাইবেলের কাহিনী নিয়ে। কিন্তু চার্চ তার সংস্কারের আগারে নাটককে দীর্ঘকাল আবদ্ধ রাখতে পারলো না, নাট্যানুষ্ঠান গির্জা প্রাঙ্গণ থেকে লোকালয়ে স্থানান্তরিত হলো। নাট্যানুষ্ঠান গির্জার সীমানা অতিক্রম করে যে হারে বাইরে বেরিয়ে পরলো, ধর্মীয় বন্ধন থেকে সেই হারে মুক্ত হতে থাকলো।
সেই পর্বেই চার্চের নাটক ধর্মের গণ্ডি পার হয়ে মানবিকতার দিকে, পূর্ণ পরিণতির দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। পূতপবিত্র ধর্ম প্রচারের তাগিদেই গির্জার অভ্যন্তরে যে নাট্যধারার সূত্রপাত, গির্জার বাইরে তা সাধারণের হাতে ব্যাপক ধর্মনিরপেক্ষ ও হাস্যরসাত্মক আনন্দদায়ক অনুষ্ঠানে পর্যবসিত হলো। থিয়েটার চার্চের নিয়ন্ত্রণের শৃঙ্খল চূর্ণ করলো।
যা একদা ঈশ্বর ও ঐশ্বরিক জগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো, সেখানে এসে ভর করলো মানব চরিত্র। মিস্ট্রি নাটকে বাইবেলের কাহিনীর জায়গায় এলো অন্য একটি ধারা। এসময় মিরাক্ল ও মরালিটি নামে দুটো নাট্যধারার দেখা পাওয়া যায়। মিরাল নাটক খ্রীস্ট ধর্মের সন্তদের নিয়ে রচিত হতো। নাটকের প্রথম অংশে মূল চরিত্রের প্রথমে পাপ করা দেখানো হতো, দ্বিতীয় অংশে থাকতো বিস্ময় বিমূঢ় পাপীর অনুশোচনা এবং সত্যপথের নির্দেশ।
মিরাল নাটকে ধর্মের ব্যাপার থাকলেও নাটকে আরো বিভিন্ন উপাদান ঢুকে পড়তো। যেমন সন্ত নিকোলাসের জীবন নিয়ে রচিত মিরাক্ল নাটকে ক্রুসেডের যুদ্ধের পাশাপাশি বহু মানবচরিত্র, রাস্তা-ঘাট, সরাইখানা, ঝগড়া-ঝাঁটি সবই রয়েছে। মিরাক্স নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দ্য রুটেবাফ রচিত দ্য মিরাকল অব থিওফিলাস। নাটকটি রচিত হয়েছে এমন একজন মানুষকে ঘিরে যিনি পার্থিব সুখ শান্তির আশায় তার আত্মা শয়তানের কাছে বিক্রি করে দিলেন।
লক্ষণীয় যে পরবর্তীকালে মার্লো ও গ্যাটের ডক্টর ফস্টাস নাটকের মূল চরিত্রের এখানে সূচনা। মিরাল নাটকগুলোতেই ধর্মের পাশাপাশি এসেছে মানুষের জীবন। মরালিটি নাটকগুলোকে এক ধরনের রূপক নাটকও বলা যায়।
নাটকের চরিত্রগুলি হতো মানুষের নানান দোষ-গুণের ব্যক্তিরূপ। নাটকীয় উপাদান বিশেষ কিছু থাকতো না, থাকতো মানুষের মধ্যকার ভালো ও মন্দের দ্বন্দ্ব। মরালিটি নাটকের মূল প্রেরণাই ছিলো ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে জনসাধারণকে জীবন সম্পর্কে সৎ উপদেশ দেওয়া। সেই জন্যই রূপকের সাহায্য নেয়া হতো। মানবীয় গুণাবলীর ধারণাগুলি ব্যক্তির চরিত্রকে পরিগ্রহ করে আসতো।
নাটকের মধ্যে যখন পাপের পরাজয় এবং পূণ্যের জয় দেখানো হতো কিংবা জ্ঞান, বিনয়, নম্রতা, সততার জয় হতো তখন গর্ব, অহংকার, কামুকতা ও অন্যায় আচরণের পরাজয় হতো। কেবলমাত্র দোষগুলোর নিরাকার ধারণাই যে রূপ পেতো তা নয়-তার সঙ্গে খারাপ অভ্যাস, মন্দ অদৃষ্ট, খানাপিনার উৎসব স্থান পেতো। মিস্ট্রি নাটকের ধারা থেকে দুটো চরিত্র সার্বজনীনভাবে এসে গিয়েছিলো, তার একটি হলো শয়তানের চরিত্র ও অন্যটি পাপ বা মানবিক দোষের চরিত্র। মরালিটি নাটক আসলে ধর্মের জগৎ ছেড়ে খারাপ আর ভালোকেই নাটকের বিষয়বস্তু করে ফেললো। মানুষের দৈনন্দিন জীবন কাহিনী বলতে শুরু করলো।
মধ্যযুগীয় নাটক কোনো বিশেষ গোষ্ঠী বা শ্রেণীর উদ্দেশ্যে ছিলো না, ছিলো সমগ্র খ্রীস্ট সমাজের উদ্দেশ্যে। মধ্যযুগীয় নাটকের উৎপত্তি গ্রীক নাটকের মতোই ধর্মকে কেন্দ্র করে, তা সত্ত্বেও মধ্যযুগীয় নাটকে গ্রীক নাটকের সেই ধ্রুপদী চেতনার অভাব পরিলক্ষিত হয় যা কোনো শিল্পকর্মকে কালোত্তীর্ণ করে তোলে। একটি ক্ষেত্রে প্রাচীন মিশর, প্রাচীন গ্রীস ও মধ্যযুগীয় নাটকের মিল লক্ষ্য করি-তা হলো, নাটক কারো না কারো জয় গান করতে চেয়েছে। হয় দেবতা, নয় ইশ্বর কিংবা মানুষ।
কখনও বীর পূজা, কখনও জ্ঞানের পূজা, কখনও সৎ মানুষের পূজা, কখনও সরল জীবন যাপনকারী মানুষের পূজা। নাটকের এই বিষয়টির ভিতর দিয়ে তার প্রচারণার স্বভাবটি বের হয়ে আসে। কারো না কারো পক্ষে সে প্রচার করছেই।
মধ্যযুগীয় নাট্যের কাল ষোড়শ শতক পর্যন্ত বিস্তৃত যদিও ততোদিনে ইউরোপে রেনেসাঁর কাল প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। মধ্যযুগীয় থিয়েটারের অনেক কিছু রেনেসাঁর থিয়েটার গ্রহণ করেছে, সেগুলির উন্নতি ঘটিয়েছে। খ্রীস্টীয় চৌদ্দশো তিপ্পান্ন সালে মুসলিমদের হাতে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টানটিনোপলের পতন ঘটে। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন আধুনিক যুগের সূচনা ঘটে অন্যদিকে মধ্যযুগের হয় অবসান।
মধ্যযুগের অবসানে ইউরোপে এলো নবজাগরণের যুগ। সমস্ত ইউরোপ জুড়ে এই নবজাগরণ ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ে। কনস্টানটিনোপলের পতনের পর খ্রীস্টান পণ্ডিতবর্গ গ্রীকদের জ্ঞান ভাণ্ডার নিয়ে ইউরোপে চলে আসে যার সাথে ইউরোপীয়দের পরিচয় ছিলো না। গ্রীকদের জ্ঞান ভাণ্ডার ইউরোপে নতুন চেতনা জাগ্রত করে তোলে। ইতালীতে প্রথম এর আবির্ভাব।খ্রীস্টান পণ্ডিতরা যে শুধু গ্রীক ও ল্যাটিন গ্রন্থাদিই নিয়ে এসেছিলো তা নয়, মুসলমানদের জ্ঞানচর্চা, দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা, অংকশাস্ত্র প্রভৃতিও নিয়ে আসতে ভোলেনি। ফলে চিন্তার জগতে আসে বিপ্লব, শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে দেখা দেয় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি।
কোনো একটি যুগের সমাপ্তি ও নতুন যুগের সূচনাকে সীমারেখা দ্বারা অংকিত করে দেখানো যায় না; সকলের অলক্ষ্যে যে পরিবর্তন ঘটতে থাকে, সেই ব্যবধান যখন দুস্তর হয় তখন আমরা চমকে উঠি, দেখি নতুন এক যুগ। সেখানে নতুন সব চিন্তার সমারোহ। আধুনিক যুগের শুরু হয় ইউরোপীয় রেনেসাঁর মধ্য দিয়ে, যার অর্থ চিন্তার নবজাগরণ বা নবজন্ম। রেনেসাঁস যুগের মূল বৈশিষ্ট্যই মানবতা প্রতিষ্ঠা।
মধ্যযুগে চার্চের অধীনে মানুষ তার বিচার বিশ্লেষণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলো। ব্যক্তিসত্তা হারিয়ে সে হয়ে উঠেছিলো চার্চের নিয়ম-কানুনের অন্ধ অনুসরণকারী। নবজাগরণের যুগ মানুষকে চার্চের বন্ধন থেকে মুক্ত করলো। মানুষ মুক্তির আলোয় সবকিছু দেখতে পেলো। চার্চের নির্ধারিত পথ অনুসরণ করে শেষ বিচারের দিনের জন্য সে আর অপেক্ষা করলো না। নিজেকে মানুষ বলে সম্মান করতে শিখলো।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য নিয়ে সে উঠে দাঁড়ালো। আবির্ভাব ঘটলো যুক্তিবাদের। মানুষ উপলব্ধি করলো নিজের চেষ্টায়, নিজস্ব বুদ্ধিকে প্রয়োগ করে ভাগ্যকে পাল্টে দেয়া যায়। কোনো স্রষ্টার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে থাকার দরকার হয় না। রেনেসাঁই ইউরোপে মানবতার জন্ম দেয়। মানবতাবাদের মূলমন্ত্রই হলো মানুষই সত্য তার সমস্ত দোষগুণ নিয়েই। জাগতিক জীবনই প্রাধান্য পেল এই চেতনায়। মানুষ নিজের শক্তি সম্পর্কে সচেতন হতে থাকলো। অনুধাবন করতে পারলো যে মানুষ তার জ্ঞান দিয়ে পৃথিবীর সবকিছু নিজের আয়ত্তে আনতে পারে। এমনকি স্রষ্টার ভূমিকায়ও সে অবতীর্ণ হতে পারে। মানবতাবাদকে ঘিরে দেখা দিলো যুক্তিবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবোধের।
পাশাপাশি চললো ধর্ম সম্পর্কে মানুষের দীর্ঘদিনের চিন্তা-চেতনা সংস্কারের চেষ্টা। নাটকের ক্ষেত্রেও এই পরিবর্তন আমাদের চোখে পড়ে। চৌদ্দশো পঁয়ষট্টি সালে মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের ফলে গ্রীক ও রোমান মহৎ নাটকগুলো দেড়শত বছরের মধ্যেই প্রকাশিত হয়ে যায়। নাটকের উদ্দেশ্য কী, নাটক রচনার কোনো রীতি-কানুন আছে কি না, কমেডি ও ট্র্যাজেডির মৌল পার্থক্য কোথায় ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তরের জন্য রেনেসাঁ যুগের পণ্ডিতবর্গ এ্যারিস্টটল ও হোরেসের রচনাবলীর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন।
ষোড়শ শতকে ইউরোপ মধ্যযুগের শৃঙ্খল ভেঙে ফেললে ধর্মীয় নাটক জীবনধর্মী নাটককে পথ ছেড়ে দিলো। যার শুরু হলো প্রাচীন গ্রীক ও রোমান নাটকের পুনরুত্থানের মধ্য দিয়ে। প্রাচীন চিন্তা, নাটক ও শিল্পকলার পুনরুত্থানের কারণেই এই সন্ধিক্ষণটি রেনেসাঁ নামে পরিচিত। রেনেসাঁর যুগের পণ্ডিতেরা রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রীক ও ল্যাটিন নাটক এবং তৎসহ এ্যারিস্টটলের ও অন্যান্যদের দর্শন নিয়ে চর্চা করতে লাগলেন। ল্যাটিন কমেডি ও সেনেকার ট্র্যাজেডির অভিনয় শুরু হলো।
নাটক শুরু হলো রাজন্যদের বলরুম মঞ্চে। নগরগুলিতেও বহু আকাদেমী স্থাপিত হতে লাগলো। রাজা ও রাজকুমাররা তাদের সাহায্যে হাত বাড়ালেন। শাসকরা এই সময় ধর্মীয় চিন্তার বিপক্ষে এ ধরনের নাটকের পৃষ্ঠাপোষকতা করতে এলেন কেন? শাসকদের সাথে রাজন্যদের সাথে তখন চার্চের চলছে কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব। যেমন ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরী রাজনৈতিক ও বৈবাহিক কারণে পোপের সঙ্গে কলহ করে প্রোটেস্টান্ট ধর্ম গ্রহণ করেন এবং ইংল্যান্ডের রাজসভার কার্যক্রম ও ধর্মমতকে পোপের আওতা মুক্ত করেন।
তিনি ইংল্যাণ্ডে পৃথকভাবে আর্চবিশপও নিয়োগ করেন যাকে রাজকার্যে কোনো কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা দেননি। হেনরী ধর্মকে ব্যবহার করেছেন নিজের রাজনীতি ও শাসনকার্যের স্বার্থে। তিনি প্রোটেস্টান্ট ধর্ম যে-কারণেই গ্রহণ করেন না কেন এই ধর্মমত যুগের দাবিকেই পূরণ করেছিলো।
রাজা অষ্টম হেনরীর শাসনকালেই ইংল্যান্ডের রাজসভায় ক্রমশ জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা বেড়ে যেতে থাকে। পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তিনি মুক্তচিন্তার চর্চাকে অব্যাহতভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার অন্যতম কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায় তাঁর রাজদরবার। হেনরীর রাজসভায় রেনেসাঁস যুগের অন্যান্য রাজসভার মতোই ধ্রুপদী ধারার ল্যাটিন নাটকের অভিনয় হতে থাকে। রোমান ন্যাট্যকার প্লাইতুস, তেরেন্স ও সেনেকার প্রভাব বিস্তৃত হতে থাকে।
ল্যাটিন ভাষার প্রাধান্যের কারণেই প্রাচীন রোমান নাট্যকারদের নাটকগুলোই প্রথম জায়গা করে নেয়, গ্রীক নাটকগুলো তখন পর্যন্ত ছিলো অপাংক্তেয়। হেনরীর আমলেই ইংরেজি নাট্যসাহিত্যের সূত্রপাত। ল্যাটিন ভাষায় নাট্যচর্চার পাশাপাশি শুরু হয় মাতৃভাষায় নাটক রচনা। উপরন্তু বিভিন্ন স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অকস্মাৎ যেন নাটক অধ্যয়ন ও মঞ্চস্থ করার সাড়া পড়ে যায়। যদিও হেনরীর আমলে কোনো সাধারণের থিয়েটার নির্মিত হয়নি, তবে তার জন্য পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিলো।
হেনরীর পর ইংল্যান্ডের ক্ষমতায় এলেন রানী এলিজাবেথ। রানী এলিজাবেথের সময় ড্রেক, ডেভিস, ফোরিশার সফল সমুদ্র অভিযাত্রার ফলস্বরূপ বৈদেশিক বাণিজ্যের দ্রুত অগ্রগতিতে বৃটিশ জাতি বিশ্বের অর্থ-সম্পদ লাভে অধিকতর ব্রতী ও দুঃসাহসী হয়ে ওঠে। রাজধানী লণ্ডন হয়ে ওঠে অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল। এলিজাবেথের রাজসভাও ছিলো জ্ঞানী-গুণীদের পীঠস্থান। স্যার ফিলিপ সিডনি, স্যার ওয়ালটার র্যালে, জন লিলি প্রমুখের মতো ব্যক্তি ও পণ্ডিত ছিলেন তাঁর সভাসদ। হেনরীর পর রানী এলিজাবেথও ভীষণভাবে নাটকের পৃষ্ঠপোষক হয়ে ওঠেন। নাটক দেখার ব্যাপারে তাঁর রুচি ছিলো হেনরীর চেয়েও উন্নত। রাজ দরবারের নাটকগুলো শুধু রাজ পরিবারের লোক ও অভিজাতরা দেখার সুযোগ পেতো।
বুর্জোয়া যুগে মধ্যবিত্তরাও সবকিছুতে তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সেও চায় থিয়েটার দেখতে। সেজন্যই এলিজাবেথের যুগে রাজ দরবারের পাশাপাশি সাধারণের রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠা হয়ে গেল। থিয়েটারের ইতিহাসে এটা এক বিরাট ঘটনা, এই ঘটনাই নাটকের গতিপ্রকৃতিকে দ্রুত পাল্টে দিতে থাকলো। জন্ম নিলো নতুন ধারার নাট্যকার। শেক্সপিয়ার-মার্লোরা হচ্ছে সেই সাধারণ থিয়েটারের সৃষ্টি, এবং সাধারণ থিয়েটারের সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
বুর্জোয়া লুটপাটের ভাগীদার মধ্যবিত্তশ্রেণী, যাদের হাতে হঠাৎ জমেছে কাঁচা টাকা। নতুন এক থিয়েটার গড়ে তুলতে তারাই বিরাট ভূমিকা রেখেছিলো। এই ঘটনাটাই নাট্য ইতিহাসের গতি-প্রকৃতিকে দ্রুত পাল্টে দিতে থাকলো। বিশ্ব ইতিহাসে এরপর থেকে নাটকের মূল দশর্ক হয়ে উঠলো মধ্যবিত্তশ্রেণী। যাদের চাহিদার সামনে দাঁড়িয়ে নাটককে বারবার, তার অবস্থান পাল্টাতে হয়েছে। পরবর্তী চারশো বছরের অধিককাল মধ্যবিত্তের দ্বারাই থিয়েটারের গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে।
মধ্যবিত্তদের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বা স্বার্থের সম্পর্ক বজায় রেখেই শাসকশ্রেণীর অনুকূলে থিয়েটার তার চরিত্র পাল্টেছে। শাসকশ্রেণীর পক্ষে থিয়েটার কখনও মধ্যবিত্তকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, কখনও মধ্যবিত্তের আকাঙ্ক্ষা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। এই দ্বান্দ্বিকতার ভিতর দিয়েই নাটকের বিকাশ ঘটেছে। রেনেসাঁ পরবর্তী সময়কার থিয়েটারের ইতিহাস ও থিয়েটারের দর্শকদের দিকে তাকালেই ব্যাপারটা আমাদের কাছে স্পষ্ট হবে। সেজন্য শেক্সপিয়ারের যুগটাকে আমাদের বোঝা দরকার পরবর্তী আলোচনার সুবিধার জন্যই।
লণ্ডন শহরে তখন রাজদরবারের বাইরে সাধারণ দর্শকদের জন্য থিয়েটার হতো সরাইখানাগুলোতে। রক্ষণশীলদের কাছ থেকে বহু কষ্টে সেই থিয়েটার করার জন্য আইনী অনুমতি পাওয়া গিয়েছিলো রাজা-রানীর সমর্থন থাকায়। শেক্সপিয়ারের সমকালে লণ্ডনে প্রায় ছ-সাতশো সরাইখানা ছিলো। সেগুলো ভাড়া নিয়ে নাটক অভিনয় করা হতো। মধ্যযুগের সরাইখানার মাঝের চত্বরগুলি অভিনয়ের পক্ষে যথেষ্ট উপযোগী ছিলো।
অভিজাত সরাইখানাগুলো প্রচণ্ড হট্টগোল, ঝগড়া ইত্যাদির ভয়ে তাদের চত্বরে দলগুলোকে অভিনয়ের অনুমতি দিতো না, তা ছাড়া প্রায় সকল সরাইখানাগুলোতেই নিয়মিত অভিনয় চলতো। এইসব অভিনয় বেলা দুটা কি তিনটার দিকে শুরু হতো। থিয়েটার দলের একজন মূল প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে যারা চত্বরে দাঁড়িয়ে অভিনয় দেখতে আসতো তাদের টিকেট নিতেন।
নাট্যমঞ্চের জন্য কতগুলো মদের পিপের ওপর কাঠের তক্তা পেতে মঞ্চ তৈরি করা হতো। সরাইখানার ইতরজনেরা চত্বরে দাঁড়িয়ে হৈ হুল্লোড় করতো এবং অভিনয় দেখতো, অর্থশালী অতিথিরা গ্যালারীতে বসতো বা দাঁড়াতো। কখনও কখনও বাইরের দর্শকরাও টিকেট কেটে নাটক দেখতে পেতো। সেক্ষেত্রে তাদের বেশি পয়সা দিতো হতো। দর্শকরা সবাই উচ্চস্বরে কথা বলতো, থিয়েটার হচ্ছে না হাট বসেছে বোঝাটা কষ্টকর হতো।
মঞ্চের কোনো কিছু যদি দর্শকদের একঘেয়ে লাগত তবে তারা তাস কিংবা পাশা নিয়ে বসতো। বাদাম আপেল প্রভৃতি বিক্রি হতো তারই মধ্যে। দর্শকদের মধ্যে চলতে থাকতো গান করা এবং নানারকম দ্রব্য ও ফল আহার করা।
নাট্যাভিনয় যদি দর্শকদের ভালো না লাগতো তারা ঝগড়া-ঝাঁটি মারামারি লাগিয়ে দিতো এবং তাদের ঝগড়া-ঝাঁটি মারামারি শেষ পর্যন্ত রক্তপাতে এসে পৌছুতো। মজুর, জাহাজী ও বাউন্ডেলে লোকদের আচরণ প্রায় ভাল্লুক যুদ্ধের মতো হয়ে দাঁড়াতো। নাট্যকারদের তাই দর্শক রুচির কথা ভাবতে হতো। দর্শকদের ভালো লাগা, মন্দ লাগার কথা ভাবতে হতো। খেয়ালখুশি মতো নাটক লেখা যেতো না। টিকেট বিক্রিটাই প্রাধান্য পেতো সেখানে, তারপর ভাবতে হতো দর্শকদের কী বলতে চান তিনি।
গ্রীক নাটকে বক্তব্য দেয়া যতো সহজ ছিলো, শেক্সপিয়ারের যুগে তা ছিলো না। গ্রীক নাটক প্রদর্শিত হতো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় নাগরিকদের জন্য। গ্রীক রাষ্ট্রে শুধুমাত্র সুবিধাভোগীরা ছিলো নাগরিক অধিকার প্রাপ্ত, এরা ছিলো কমবেশি রাজনীতি সচেতন এবং বোদ্ধা দর্শক। সেজন্য প্রাচীন গ্রীসের নাটকে রাষ্ট্র ও সমাজ সম্পর্কিত গুরুগম্ভীর বক্তব্য দেয়াটা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিলো। কিন্তু শেকসপিয়ারের যুগে তা সম্ভব ছিলো না, কারণ নাটক দেখার জন্য কোনো বিশেষ ধরনের বোদ্ধা দর্শক ছিলো না। শিক্ষিত- মূর্খ সকলেরই নাটক দেখার অধিকার ছিলো এবং নিজের পকেটের কড়ি খরচ করে বিভিন্ন ধরনের লোক নাটক দেখতে ভীড় জমাতো। রাষ্ট্রের নয়, নিজের খরচ করা কড়ির বিনিময়ে শেক্সপিয়ারের দর্শকরা নাটকে কিছুটা প্রমোদ আশা করতো।
সেজন্য দর্শকদের খুশি রাখার জন্য নাটকে বহু কিছুর মিশ্রণ ঘটতো একসাথে। দর্শকদের খেলো রুচিকে যেমন তৃপ্ত করতে হতো, তেমনি সত্যিকারের জ্ঞানীগুণী মার্জিত রুচির দর্শকদের মনের খোরাক জোগাতে হতো। শেক্সপিয়ার সেটা খুব ভালোভাবে পেরেছিলেন বলেই তিনি সমকালীন দর্শকদের চিত্তকে জয় করতে পেরেছেন। নাটক সেদিনও উদ্দেশ্যহীন ছিলো না, শুধুমাত্র বিনোদন ছিলো না।
শেক্সপিয়ার বিশাল সব তত্ত্ব আর উদ্দেশ্য তাঁর নাটকে প্রচার করে গেছেন। লোককে বিনোদন দিতে তিনি যেমন কার্পণ্য করেননি, তেমনি চিন্তারও খোরাক যুগিয়েছেন। শুধু শেক্সপিয়ার নন, তাঁর সমসাময়িক সকল নাট্যকাররাই তাই করেছেন। যাঁরা শুধু বিনোদন বিলিয়েছেন তাঁরা টিকে থাকতে পরেননি, ইতিহাসের গর্ভে হারিয়ে গেছেন। ইতিহাসের আলোকে সত্যিকারের নাটক তাই, যার উদ্দেশ্য ছিলো এবং যে নাটক ইতিহাসের পক্ষে কথা বলে গেছে। ইতিহাসের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছে।
গ্রীক নাটকের পর শেক্সপিয়ার বা তার সময়কালটাই নাটকের আর একটি প্রধান ধারা হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। নাটক তারপর আর পিছনে ফিরে তাকায়নি। শুধু এগিয়ে গেছে। দর্শকদের কথা মাথায় রেখে বারবার সে গতি পথ পরিবর্তন করেছে। মানব ইতিহাসে কোনো কালই এতো বিচিত্র ও গতিশীল ছিল না যেমন দেখা যায় এলিজাবেথীয় যুগ থেকে প্রসারিত আজকের যুগটি।
বুর্জোয়া অর্থনীতি অনবরত আনয়ন করে নিজের উৎপাদনের উপকরণে পরিবর্তন। বিচিত্র গতিই বুর্জোয়া শিল্পকলাকে বারবার নতুন চেহারা দিয়েছে, স্থির হয়ে দাঁড়াতে দেয়নি ক্ষণিকের জন্য। এলিজাবেথীয় যুগের পর থেকে নাটকের ক্ষেত্রেও আমরা বারবার তাই দেখতে পাবো। রানী এলিজাবেথের যুগ বা শেক্সপিয়ারের যুগ ছিলো বুর্জোয়া উত্থানের যুগ।
বুর্জোয়া বিপ্লব মানুষকে এই মর্যাদাটাই দিতে চেয়েছিলো মানুষ নিজের পরিচয়ে নিজেকে মেলে ধরবে, সে মাথা উঁচু করে সমাজের সামনে দাঁড়াবে। জমিদারদের ভূমিদাস হিসাবে তারা মানবিক ইন্দ্রিয়ের সুখ বন্ধ করে পশুর স্তরে নেমে যাবে না। চক্ষু-কর্ণ-রসনা প্রভৃতি ইন্দ্রিয়কে সামন্তযুগ ভোঁতা করে তুলেছিলো, বুর্জোয়া বিপ্লব ইউরোপের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে ইন্দ্রিয়গুলি মার্জিত করে তোলার অধিকার এনে দিলো।
অবশ্যই টাকার বিনিময়ে। কার পিতা কে, কার কোন বংশ, কোন কুলে কার জন্ম সেটা সেখানে কখনই প্রাধান্য পায়নি। প্রাধান্য পেয়েছিলো নগদ কড়ি। কিনবার মতো কড়ি আছে কি না সেটাই প্রধান বিবেচ্য। ইউরোপীয় জাতপাতের, বর্ণভেদের অন্তিম ঘোষণা করেছিলো বুর্জোয়া বিপ্লব।
বুর্জোয়া উত্থানপর্বে যেমন বণিকদের প্রয়োজনে গড়ে উঠলো শিল্প কারখানা, তেমনি প্রয়োজন পড়লো কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য নিত্য নতুন অঞ্চল, পণ্যের জন্য নতুন নতুন বাজারের। সেজন্যই দেখা যায় নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কারে ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের দুঃসাহসিক প্রয়াস। ব্রিটিশ, ফরাসী, স্পেনিশ ও পর্তুগীজরা নতুন নতুন ভূখণ্ডে নিজেদের দখল প্রতিষ্ঠার জন্য পরস্পরের সাথে দীর্ঘমেয়াদী সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে।
শক্তিশালী নৌবহরের সাহায্যে স্পেনের মতো শক্তিকে ইল্যাণ্ড সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে দেয়, সেই আধুনিক সজ্জায় সজ্জিত নৌবহরের এবং সমরোপকরণের যোগান দিয়েছিলো এই বণিকশ্রেণী। স্যার ফ্রান্সিস বেকনের মতো দার্শনিকও যুদ্ধকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। নতুন দেশ আবিষ্কারের মধ্যে তিনি দেখেছেন ইংল্যান্ডের বণিকশ্রেণীর অফুরন্ত সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত। সে যুগে বণিকদের পৃষ্ঠপোষকতায় কলম্বাস পৌঁছলেন আমেরিকায়, ভাস্কো-ডা-গামা ভারতে। ফ্রান্সিস ড্রেক সমুদ্রপথে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করলেন। ফার্ডিনাও ম্যাগেলান প্রশান্ত মহাসাগর আবিষ্কার করে সমুদ্র ঘুরে ঘুরে পৌছুলেন ফিলিপাইনে।
সকল সমুদ্র যাত্রার মূল লক্ষ্যটাই ছিলো ভিন্ন দেশ জয় করা এবং অন্যের সম্পদ লুটপাট। সেইজন্য তৎকালীন রচনায় আমরা দেখতে পাই বণিক, বণিকবৃত্তি, সমূদ্র পাড়ি, ভৌগোলিক অভিযানের অবিচ্ছিন্ন জয়গান। টিউডর যুগের সাহিত্যে ছড়িয়ে আছে এর অসংখ্য উদাহরণ। টমাস করিয়ট তার লেখনী চালনা করেছেন নৌযাত্রাকে প্রলুব্ধ করতে। হ্যালিউট তাঁর পুরো গ্রন্থ কাজে লাগিয়েছেন দূঃসাহসিক নৌযাত্রার বর্ণনায়।
হ্যাসলটন ও মাণ্ডে তাঁদের বিদেশযাত্রার কাহিনী লিখে নাবিক জীবনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। সে সময়ের রচনায় আর এসেছে মুনাফার জয়গান, প্রোটেস্টান্ট ধর্মের জয়গান। নিজ যুগের চেতনা সেখানে প্রতিফলিত। কারণ শাসকশ্রেণী শিল্প-সাহিত্যকে নিয়ন্ত্রণ করে।
শেক্সপিয়ার সেখানে ব্যতিক্রম। একই সাথে তিনি নিজ যুগের প্রচারক, আবার সমালোচক। নাট্য ইতিহাসের গতি প্রকৃতিতে সবসময়ই আমরা এই সত্য পর্যবেক্ষণ করবো। নাটক কখনই শুধু বিনোদন ছিলো না, নিজ যুগের দাবি তাকে মেটাতেই হয়েছে, পুরানো চিন্তার বিরুদ্ধেও তাকে দাঁড়াতে হয়েছে। আবার সমকালের অন্যায়ের বিরুদ্ধেও তার প্রতিবাদ ঘোষিত হয়েছে।
সেজন্য গ্রীস যুগের মতো শেক্সপিয়ারের যুগেও নাটক শিল্পের জন্য শিল্প ছিলো না। শেক্সপিয়ারের পূর্বসূরীদের মধ্যে সর্বপ্রধান ছিলেন ক্রিস্টোফার মার্লো। বলা যায় তাঁর পূর্বসূরীদের মধ্যে একমাত্র তিনিই ছিলেন যুগোত্তীর্ণ প্রতিভার অধিকারী। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে তিনি নিহত হন-তখন কেবলমাত্র তিনি চারখানা নাটক লিখেছেন।
মার্লোর সঙ্গে একই বছরে জন্মেছিলেন শেক্সপিয়ার; তবে শেক্সপিয়ার তার নাট্যজীবন বেশ দেরিতেই শুরু করেছিলেন। মার্লোর প্রথম নাটক টাম্বারলেইন দ্য গ্রেট-এ তৈমুর লংয়ের বিশাল বিশ্বজয়ের পরিকল্পনা সে যুগের ইংরেজ জাতির মানসলোকেরই পরিচয় বহন করে। শেকসপিয়রের পূর্বে তিনিই নতুন যুগের আশা আকাঙ্ক্ষাকে দর্শকের সম্মুখে তুলে ধরেন।
টাম্বারলেইন নাটক হিসাবে দর্শকদের মানোযোগ কেড়ে নিয়েছিলো বর্ণোজ্জ্বল কথায়, বীরত্বময় কাহিনীতে এবং এর গুরুগাম্ভীর্যে। টাম্বারলেইনে রয়েছে এক বীরচরিত্রের পরপর জয় লাভের গাথা। মার্লো প্রমাণ করলেন ধর্মের বাণী নয়, মানুষের বীরত্ব ও চরিত্রের মাহাত্ম্য দর্শকদের অনেক বেশি ধরে রাখতে পারে।
দর্শক বিশ্বয়ে চকিত হয়ে এখানে দেখে একটি মানুষের কী ক্ষমতা, কতো সাধারণ জন্ম থেকে সে কতো উচ্চে উঠে আসতে পারে। ভাগ্য এখানে দৈবায়ত্ত নয়। মার্লোর দ্বিতীয় নাটক দ্য ট্র্যাজিক্যাল হিস্ট্রি অব ডক্টর ফস্টাস। ডক্টর ফস্টাসে আমরা দেখি, তার অতি উচ্চাশাই হয়েছে তার পতনের কারণ। নায়ক চরিত্র ফস্টাস চারদিক থেকেই অন্যায়-বুদ্ধির জালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ডক্টর ফস্টাস একটি ট্র্যাজেডি কিন্তু ট্র্যাজেডির নায়ককে যে প্রখ্যাত বংশের রাজা বা রাজপুরুষ হতে হবে এই প্রাচীন ধারণা ও প্রথাগত পন্থাকে মার্লো এ নাটকে ভেঙে দিয়েছেন। নাটকের প্রধান চরিত্র ফস্টাস এখানে কোনো রাজপুরুষ নয়, সে ছিলো তার যুগের সমস্ত মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী।
অসাধারণ পণ্ডিত হলেও সে সাধারণ রঙ্গমঞ্চের সাধারণ মানুষ। ডক্টর ফস্টাস রচনার পর থেকে নায়ক চরিত্রে বিপ্লব ঘটে গেল। রাজচরিত্রেই কেবল ট্র্যাজেডি সম্ভব নাট্যকাররা আর তা মনে করলেন না। মার্লো দেখালেন দীনতম চরিত্রের দ্বারাও ট্র্যাজেডির গভীরতম আবেগ সৃষ্টি করা সম্ভব। নাটকটির দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক হলো, ট্র্যাজেডির উপাদানকে ভাগ্য এবং দৈববাদের হাতে ছেড়ে না দিয়ে নীতিবাদের সাথে সংমিশ্রণ ঘটানো।
নাটক এভাবেই দেবতা ও ধর্মীয় বিশ্বাসের হাত থেকে মানুষকে মুক্ত করতে আরম্ভ করে। নাটক যে শুধু উদ্দেশ্যমূলক তাই নয়, যুগের বা সময়ের বৈশিষ্ট্যও নাটক ধারণ করে। খণ্ডিতভাবে কোনো নাট্য ইতিহাস তাই গড়ে ওঠে না। কোনো ব্যক্তিগত প্রচেষ্টাতেও নয়। একটি যুগ, তার দাবি, তার প্রয়োজন আর পারিপার্শ্বিকতার মধ্য দিয়েই নাটকের ইতিহাস গড়ে ওঠে। বিভিন্ন নাট্যধারা সৃষ্টির পেছনেও কাজ করে সেই যুগেরই বৈশিষ্ট্য ও প্রয়োজন। শেক্সপিয়ারের যুগেরও প্রয়োজন সেই একই কারণে।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের যতোরকম ক্রমোন্নতি হচ্ছিলো শেক্সপিয়ারের যুগে বা এলিজাবেথের যুগে, নাটক তার সাক্ষ্য বহনকারী। ইতিহাস বিজ্ঞান, নতুন নতুন নৌপথ আবিষ্কার, আইন-কানুন, জ্যোতির্বিদ্যা, প্রাকৃতিক-বিজ্ঞান, পৌরবিজ্ঞান, জনতার গালগল্প, সকলি ঠাঁই পেয়েছিলো তৎকালীন নাট্যাভিনয়ে। নাটকে স্থান পেয়েছিলো গ্রীস-রোমের নাটকীয় কাহিনী, ইতালীর উপন্যাস, ইংরেজ জাতির ইতিহাস। এমনকি সেকালের লণ্ডন শহরের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাও। শুধু যুগের বৈশিষ্ট্য ধারণ করেই নাটক কালোত্তীর্ণ হতে পারে না।
সেই যুগের প্রধান প্রধান দ্বন্দ্বগুলোও নাটকে ধরতে পারা চাই। যুগ-যন্ত্রণাকে তুলে ধরার পাশাপাশি নাটকে নাটকীয়তা তৈরি করতে পারা চাই। শেক্সপিয়ার তা পেরেছিলেন বলেই তিনি কালজয়ী। যুগের দ্বন্দ্ব কীভাবে নাটকে ফুটে ওঠে তা বুঝতে হলে শেক্সপিয়ারের যুগ এবং তার নাটকগুলোকে আমাদের একটু ভালোভাবে বুঝতে হবে। শেকস্পিয়ারের যুগ ছিলো বণিকতন্ত্রের যুগ।
বণিকদের কাছে পৃথিবীটা একটা বাজার ছাড়া কিছুই নয়। ইতিহাসের বিচারে বুর্জোয়া যতো প্রগতিশীল হিসাবেই আবির্ভূত হোক, তার উদ্দেশ্য সব সময়ে হীন জঘন্য মুনাফা। মুনাফার স্বার্থেই সে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি ঘটিয়েছে, যন্ত্রের উন্নতি ঘটিয়েছে, নতুন নতুন দেশ জয়ের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। দূরকে নিকট করে তুলেছে। ব্যক্তি নিরপেক্ষ, উদ্দেশ্য নিরপেক্ষ বিচারে বুর্জোয়ার উত্থান এক মহান প্রগতিশীল অধ্যায়।
তবে এই বুর্জোয়ারা সচেতনভাবে নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের মুক্তির কথা ভাবেনি। জনতার দুঃখ-দুর্দশা মোচনের অভিপ্রায় নিয়ে, সদিচ্ছা নিয়ে ক্ষমতার লড়াই আরম্ভ করেনি। সামন্তবাদের বিরুদ্ধে তার বিজয় লাভটাই ছিলো মূল কথা। ইতিহাসের অনিবার্যতার কারণেই জনতাকে সে সাথে পেয়েছিলো, যে জনতাই পরে তার নির্মম শোষণের শিকার হয়েছে।
বুর্জোয়া শাসনের যন্ত্রণা ভোগ করেছে। বণিকরা যেমন নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী কখনও রাজার পক্ষে, কখনও রাজদ্রোহী-ঠিক তেমনি শ্রেণীসংগ্রামের নানা স্তরে জনতা কখনও বণিকের সঙ্গে, কখনও বা বিরুদ্ধে। সামন্তবাদের এবং তাদের কূপমণ্ডুক চিন্তার বিরুদ্ধে বুর্জোয়া শাসকশ্রেণীর মতবাদ জনতার ওপর প্রবল প্রভাব বিস্তার করে।
ফলে বণিকদের সাথে জনতার চিন্তাভাবনার যেমন মিল ছিলো, তেমনি বণিকদের বহু চিন্তার বিরুদ্ধে জনতার নিজস্ব মতামতও বেরিয়ে এসেছিলো। বণিকদের অর্থ লালসাকে পূর্ণ সমর্থন তারা কোনোদিনই দিতে পারেনি। সেইজন্যই বণিকদের অর্থ লালসার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে জনমত। জনতার পাশাপাশি বুর্জোয়া চিন্তাবিদদের অনেকের ক্ষেত্রেও কথাটি সত্যি। নবোথিত বুর্জোয়া চিন্তাবিদরা যেমন জমিদারতন্ত্রের ছিলো ঘোর শত্রু, তেমনি বুর্জোয়ার অর্থগৃধনুতা, তার কূপমণ্ডুকতা, নানা প্রশ্নে বিস্ময়কর পশ্চাদপদতা, সবই তীব্র কশাঘাতে জর্জরিত হচ্ছিলো লেখক-কবি-নাট্যকারদের হাতে।।
বণিকশ্রেণীর মুখপাত্ররা যখন বাণিজ্যের জয়গান করেছেন, জনতার প্রতিনিধিরা সে গানে কণ্ঠ মেলাননি। সেই কারণেই বুর্জোয়া যুগের শাসকদের, সুবিধাভোগীশ্রেণীর স্বার্থ-চিন্তা, বুর্জোয় যুগের অগ্রগতি যেমন শিল্প-সাহিত্য-নাটকে ধরা পড়তে বাধ্য, তেমনি তার বিপরীত সত্যটাও। যারা বুর্জোয়া চিন্তার বলি সেই জনগণের ক্ষোভটাও সত্যিকারের শিল্প-সাহিত্যে ধরা পড়বে সেটাই ছিলো স্বাভাবিক। সেজন্য মহৎ শিল্প-সাহিত্যে আস্ত যুগের ছবিটাই ফুটে ওঠে।
শেক্সপিয়ারের ক্ষেত্রে তাই ঘটেছিলো। নিজ যুগচেতনার সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও প্রত্যেক ক্ষেত্রে তিনি এর পাল্টা মতও দাঁড় করাবার প্রয়াস পেয়েছেন। বুর্জোয়ার মতবাদকে তিনি কতোটা গ্রহণ করেছিলেন আর কতোটা বর্জন করেছিলেন সেটা সে বিচারে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর সময়কালে রাজা- অভিজাত-বুর্জোয়ারা নিজেদের মধ্যে শত বিরোধ সত্ত্বেও নিজ স্বার্থচিন্তায় এক ঐক্যবদ্ধ শক্তি।
ভিন্ন দিকে লক্ষ লক্ষ নিঃস্ব মানুষ, যাদেরকে নতুন উৎপাদন ব্যবস্থায় মজুর হিসাবে কাজে লাগাবার চেষ্টা চলছে, যাদের শ্রম শোষণের মধ্য দিয়েই গড়ে উঠবে নতুন পৃথিবী-ইতিহাসের সেই দ্বান্দ্বিক নিয়মটা শেম্পিয়ার কাছে পরিষ্কার না থাকলেও ধনীদের কর্তৃক দরিদ্রদের শোষণ, বণিকদের অর্থলালসা তাঁর নজর এড়ায়নি।
ফল কী দাঁড়াল? শেক্সপিয়ার উঠতি বুর্জোয়াকে বরণ করতে পারেননি আবার পশ্চাদপদ সামন্ততান্ত্রিক সমাজকেও গ্রহণ করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়েছিলো। সেজন্য সামন্ততান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে যেমন তাঁর নাটকে তীব্র আক্রমণ রয়েছে, তেমনি বুর্জোয়া বণিকদের বিরুদ্ধেও তিনি কলম ধরেছেন।
ধর্মীয় আবেষ্টনীর মধ্যে জন্মগ্রহণ করায় যেমন শেক্সপিয়ার ধর্মকে বর্জন করতে পারেননি, তেমনি আবার ধর্মের কুসংস্কার, পুরোহিতদের সম্পদ-লালসা, ধর্মীয় গির্জার কর্তৃত্বকে সমর্থন দিতে পারেননি। পাশাপাশি সে সময়কার প্রোটেস্টান্টদের দ্বারা ক্যাথলিকদের প্রতি অত্যাচার হতে দেখেই তিনি ক্যাথলিকদের পক্ষ নিয়েছিলেন। যে- সমাজে শেক্সপিয়ার বাস করতেন এবং যে-শ্রেণীর তিনি মুখপাত্র এবং ইতিহাসের যে সময়কালে তিনি কলম ধরেছিলেন-সবই তাঁর চিন্তাকে প্রভাবিত করেছিলো। শেক্সপিয়ারের রচনাগুলোই তার প্রমাণ। শেক্সপিয়ারের নাটকে তার সমাজের মূল বিরোধগুলো এবং সেই সাথে অসংখ্য ক্ষুদ্র ও বৃহৎ সংর্ঘষগুলোও ধরা পড়েছে।
তিনি মহৎ ও জনপ্রিয় এ কারণেই যে, নিজ সময়কে এতো ব্যাপকভাবে খুব কম নাট্যকারই ধরতে পেরেছেন। একান্তভাবেই তিনি তাঁর যুগ দ্বারা সীমিত কিন্তু তিনিই আবার সেই যুগের বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। বুর্জোয়া অর্থগৃধনুতার বিরুদ্ধে তার নাটক ভেনিসের সওদাগর। মহৎ ক্রোধে উদ্দীপ্ত হয়েই তিনি আক্রমণ চালিয়েছিলেন বণিকদের ওপর। সুদখোর বণিকদের বিরুদ্ধে যে প্রবল জনমত ছিলো শেক্সপিয়ার তারই প্রতিনিধি। সে জন্যই তার নাটকের ভিলেনরা শুধু টাকাই চিনেছে। ইয়াগো, এডমণ্ড, এজ ইউ লাইক ইট-এর ফ্রেডারিক, টেমপেস্ট-এর আন্তিনিও ক্লোটেন সকলেই অর্থের পূজারী।
শেক্সপিয়ার ছিলেন নির্যাতিতের মুখপাত্র সেজন্যই বুর্জোয়াদের লালসাবৃত্তিকে তিনি শুধু ঘৃণাই করেননি, শুধু সমালোচনা করেই ক্ষান্ত হননি, ধর্মচেতনায় রঞ্জিত বিশেষ এক পাল্টা জীবনবিধি সৃষ্টির সক্রিয় প্রচেষ্টা তাঁর লেখায় সুস্পষ্ট। লক্ষণীয় শেক্সপিয়ারের সমসাময়িক নাট্যকার ন্যাশ আক্রমণ করেছিলেন সুদখোর মহাজনদের, চেটল্ও ব্যঙ্গ করেছেন সেই সব রসবোধহীন ধনীদের যারা শুধু টাকা সঞ্চয়কেই জীবনের লক্ষ্য মনে করে।
শেক্সপিয়ার-পরবর্তী জনপ্রিয় ফরাসী নাট্যকার মলিয়েরও লোভী ও ভণ্ড বুর্জোয়াদের আক্রমণ করেছেন। টাকাকে আক্রমণ করা ছিলো সে যুগের লেখনীর এক বৈশিষ্ট্য। পরবর্তী কালে বালজাকের উপন্যাসে বারংবার দেখি টাকার হিসেব কষা কৃপণ বুর্জোয়ার চিত্র যাদের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি হয়ে রয়েছে বৃদ্ধ গোরিও এবং গ্রাঁদে। গ্রাঁদে মুনাফা বৃদ্ধির লোভে নিজ কন্যা ইউজিনের ভবিষ্যৎ নিয়ে ফটকা খেলতেও দ্বিধা করে না। টাকার মালিক বুর্জোয়াদের প্রতি এভাবেই নাটকের পর নাটকে ঘৃণার প্রকাশ ঘটেছে বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী, লেখক-শিল্পীদের দ্বারাই।
বর্তমানকে লঙ্ঘন করে চিরন্তনকে ধরা যায় না, শেক্সপিয়ারের নাটকে সেটাই প্রমাণিত। বর্তমান সময়কে দ্বন্দ্বসমেত ধরতে গিয়ে তিনি চিরন্তনকে তুলে ধরেছেন। জনগণের মধ্যকার বিদ্রোহ, প্রতিক্রিয়াশীলতা সবই শেক্সপিয়ারে প্রতিফলিত। শেক্সপিয়ারের নাটকে গুপ্তহত্যা, বিষপ্রয়োগ ও রক্তাক্ত সংঘর্ষের ছড়াছড়ি-সেগুলো সে. যুগেরই বাস্তবতা। শেক্সপিয়ার তার নাটকে সময়কে এড়িয়ে যেতে পারেননি, কোনো বড়ো নাট্যকারের পক্ষেই তা সম্ভব নয়।
নির্যাতিতের মুখপাত্র বলেই তিনি যুগের মুখপাত্র। শেক্সপিয়ারের চোখে বুর্জোয়ারা, নতুন শাসকরা ছিলো অর্থগৃধনু ষড়যন্ত্রকারী নীতিবোধ বিবর্জিত দস্যুর দল। সে কারণে শাসকশ্রেণী যেমন ছিলো তার আক্রমণের লক্ষ্য, তেমনি পুরোহিত সম্প্রদায়কে শেক্সপিয়ার সদাসর্বদা নীচ-প্রকৃতির করে দেখিয়েছেন। শোষক পুরোহিতদের জ্বলন্ত ভাষায় আক্রমণ করে তার একটি প্রধান দায়িত্ব পালন করেছেন। রাজনীতি যেহেতু সমাজবদ্ধ মানুষের বেঁচে থাকার অঙ্গ, তাই প্রশ্নাতীতভাবে তা এসে গেছে তাঁর নাট্যচিন্তায়।
পূর্বেই আমরা দেখেছি, প্রতি যুগে শাসকশ্রেণীর চিন্তা-ভাবনাই হয়ে ওঠে পুরো সমাজের চিন্তা। সুতরাং বুর্জোয়া যুগে শেক্সপিয়ার কিংবা অন্যান্য মহৎ নাট্যকারদের চিন্তায় কীভাবে সেই শ্রেণীর চিন্তা প্রতিফলিত হয়েছে, কীভাবে কতোটুকু নাট্য রচনাকে প্রভাবিত করেছে সেটা এখানে বিবেচ্য বিষয়। রেনেসাঁস মানুষকে নিয়ে এলো সব শিল্পের কেন্দ্রস্থলে। সামন্তযুগে গির্জা মানুষকে ফেলে রেখেছিলো ইশ্বর ও শয়তানের পদতলে।
সেখানে রেনেসাঁর যুগে ইশ্বরের স্থানে মানুষের উপাসনা ছিলো এক বৈপ্লবিক অগ্রগতি। শীঘ্রই এই ঘটনা ব্যক্তিত্ববাদের ধারণা জন্ম দিলো। ব্যক্তিই হয়ে উঠলো সর্বেসর্বা। ব্যক্তিই যেন নিয়ন্ত্রণ করছে ঘটনাকে। যা ইতিহাসের দ্বান্দ্বিকতাকেই অস্বীকার করে এবং শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য জন্ম দেয় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বিরোধী পরিস্থিতির।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের কথা বলা হলেও বৃহৎ ব্যক্তির দ্বারা নিগৃহীত হতে থাকে ক্ষুদ্র ব্যক্তি। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, ব্যক্তিস্বাধীনতা ব্যক্তিগত সম্পত্তির হাতিয়ারে পরিণত হয়ে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধের নয়া শিকলে বাঁধলো মানুষকে। বুর্জোয়া সমাজে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের জন্ম সম্পর্কে ক্রিস্টোফার কডওয়েল বলেছেন, বুর্জোয়া নিজেকে দেখে স্বাধীনতার জন্যে একাকী যুদ্ধরত বীরনায়করূপে।
যেসব প্রাকৃতিক ও সামাজিক- সম্পর্ক মানুষকে আটকে রেখেছে তার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত একজন ব্যক্তি হিসাবে। বুর্জোয়া শিল্পী-সাহিত্যিকরাও নিজেদের দেখেন ঠিক তেমন একজন ব্যক্তিরূপেই। মধ্যেই মানুষ সম্পদ ও সৌভাগ্য গড়ে তোলে। বুর্জোয়া ব্যবস্থা মানুষকে শেখায় নিজের জন্যই নিজের ভাগ্য গড়ে তুলতে, লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে সাচ্ছল্য লাভ করতে।
পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামা, আলাদা ভাবে ধনী হওয়ার প্রয়াস পাওয়া বুর্জোয়া ধারণাগুলোরই অন্তর্ভুক্ত।” বুর্জোয়া বিকাশ কালে রোমান্টিক যুগ মানেই ব্যক্তিত্ববাদের যুগ। বুর্জোয়া বিপ্লব তার উষালগ্নে মানুষকে মুক্ত করেছিলো সামন্ততন্ত্রের কঠিন নিগড় থেকে। ব্যক্তি স্বাধীনতার জয়গানে মুখরিত ছিলো সেই সময়বৃত্ত। সমষ্টির স্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত স্বার্থকে দাঁড় করানোটা ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিকাশের সঙ্গে জড়িত। কেননা অগ্রগতির পথে তখন প্রয়োজন ছিল মুক্তশ্রমের। মার্কস লিখছেন যে, সামন্তবন্ধন থেকে মুক্ত হলেই কেবল মানুষ নিজেরাই নিজেদের বিক্রেতা হতে পারে শ্রমদানের জন্য।
চরম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের তত্ত্বটা তাই পুঁজিবাদী অভ্যুত্থানের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। পূর্বেই আমরা দেখেছি পুঁজিবাদের ঝোঁক হচ্ছে মানুষে মানুষে সম্পর্কের স্থানে একটা নগদ-কড়ির সম্পর্ক স্থাপন করা। তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বুর্জোয়া সমাজে তাই স্বার্থ কথাটির অর্থ দাঁড়ায় অন্যের বিরুদ্ধে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। সামন্ত সমাজের সীমাবদ্ধতাকে চূর্ণ করার আকাঙ্ক্ষা থেকে উদ্ভূত বুর্জোয়ার ব্যক্তি সর্বস্বতা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রচণ্ড ও নিরন্তর প্রযুক্তিগত অগ্রগতি আনয়ন করে। বুর্জোয়া চিন্তায় ব্যক্তি নিজেকে দেখেন এমন একজন ব্যক্তিরূপে যিনি তার হৃদয়স্থিত শক্তির বহিঃপ্রকাশ।
এই বুর্জোয়া-স্বপ্ন, জগতপ্রপঞ্চকে এককভাবে রচনা করার একক মানুষের স্বপ্ন। যেমন ফাউস্ট, হ্যামলেট, রবিনসন ক্রুশো, শয়তান এবং প্রফুক। মার্লো, শেক্সপিয়ার বা পরবর্তীরা সেই ব্যক্তিত্ববাদের চিন্তাকে এড়াতে পারেননি তাঁদের নাটকের চরিত্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের কারণেই শেক্সপিয়ারের বিরাট বিরাট চরিত্ররা নিজেদের বিরাটত্ব প্রমাণ করতে এতো ব্যস্ত যে তার জন্য ঘটনার বাস্তবতা পর্যন্ত চুরমার হয়ে যায়, বিরাটত্ব প্রমাণ করার জন্য রাজা লিয়রকে যেতে হয় বনবাসে এবং শেষে কন্যার মৃতদেহ বুকে নিয়ে মহত্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। রেনেসাঁস যুগের মানববন্দনার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ হ্যামলেট। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বলিষ্ঠতম ঘোষণা হ্যামলেট। শেক্সপিয়ারের নাটকে সব ধরনের চরিত্ররাই এসেছে। কিন্তু রাজারাই, অভিজাতরাই এসেছে নায়ক হিসাবে।
শেক্সপিয়ারের আমলে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, চিন্তার বলিষ্ঠতায়, কুসংস্কারের বিরোধিতায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো শিক্ষিত অভিজাতদেরই, রাজা রাজকুমারদেরই। বিশেষত ইংল্যান্ডে। সেইজন্য শেক্সপিয়ার তাদেরকেই নাটকের নায়ক করেছেন। সেটাই সেই সময়ের বাস্তবতা। তাঁর নাটকে বিপ্লবী কোনো শ্রমিক নেতার দেখা মেলেনি, ফরাসী বিপ্লবের আগে সেটা সম্ভবও ছিলো না। সেজন্য কোনো শ্রমিক নেতাকে নায়ক করা শেক্সপিয়ারের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
আবার গণবিদ্রোহের ঘটনা এড়ায়নি তাঁর চোখ যার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ কোরিওলেনাস, জুলিয়াস সীজার। সেই সব গণবিদ্রোহকেও শেক্সপিয়ার চিত্রিত করেছেন চমৎকারভাবে জনতার দোদুল্যমান চরিত্রসহ। সেজন্য উৎপল দত্ত লিখছেন, ‘রাজনৈতিক নাটকও শেক্সপিয়ারের কাছ থেকেই শিখতে হবে এখনো’।”
গ্রীক নাটক ও শেক্সপিয়ারের নাট্য সময়কে কিছুটা গুরুত্বের সাথেই দেখতে হবে। দুটো নাট্যধারাই যেমন সেই সময়কার শাসকশ্রেণীর মতামতকে প্রতিফলিত করেছে তেমনি নির্যাতিত মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার কথাও বলেছে। শেক্সপিয়ার ও তাঁর সমসাময়িক নাট্যধারার যেটা বড়ো লক্ষণ তাহলো, নাটকের ভিতর দিয়ে তাঁরা সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। কোথাও তা সামন্ত সমাজের বিরুদ্ধে, কোথাও তা বুর্জোয়া সমাজের বিপরীতে।
নাটক সেখানে উদ্দেশ্যহীন ছিলো না। শুধুমাত্র বিনোদন বিতরণ তাদের লক্ষ্য ছিলো না। বুর্জোয়া যুগে থিয়েটারের উপযোগিতা বা উদ্দেশ্যগত দিকটি খুবই গুরুত্ব পেয়েছিলো। বহুজন বহুভাবে নাটককে কাজে লাগাবার পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন। বিশেষ করে ফরাসী বিপ্লবের যুগে সবচেয়ে শক্তিশালী শিল্পমাধ্যম থিয়েটার বিপ্লবের উত্তাল পরিস্থিতিতে প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত হয়।
এ ছিলো নাট্যশালার কর্মকাণ্ডে উন্মাদনার যুগ। হাজার হাজার নতুন নাটক রচিত হয়, শয়ে শয়ে নতুন নাট্যদল জন্ম নেয়। ঐ সময়ের অস্থির বৈপ্লবিক পরিস্থিতি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয় প্যারিসের নাট্যশিল্পীদের পেশায় এবং তাঁদের নাট্য প্রযোজনায়। দেশের রাজনৈতিক মত ও ক্ষমতা যেমন অনবরত পরিবর্তিত ও উগ্র হতে থাকে সেইরকম যে নাটক প্রযোজিত হতে থাকে তার বিষয়বস্তু ও আঙ্গিক পরিবর্তিত হতে থাকে সপ্তাহ থেকে সপ্তাহে, দিন থেকে দিনে।
যাঁদের জীবন ধারণের একমাত্র উপায় দর্শকের সামনে রাতের পর রাত অভিনয়, তাঁদের পক্ষে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলাই ছিলো একমাত্র পথ। প্রতিটি চরিত্র, এমনকি প্রতিটি নাটকের সংলাপ ছিলো নিয়ত পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক চিন্তার এবং শতাব্দীর শোষণে জর্জরিত, নিপীড়িত হিংস্র জনতার নিয়ন্ত্রণাধীন।” নাটক এভাবেই তার সমকালে ঘটে যাওয়া বড় বড় ঘটনা থেকে দৃষ্টিকে ফিরিয়ে রাখতে পারে না। ঘটনার পক্ষে বা বিপরীতে তাকে দাঁড়াতেই হয়। ফরাসী বিপ্লবের পরে কিংবা পূর্বে খুব ব্যাপকভাবে সেটা লক্ষ্য করা যায়।
ফরাসী বিপ্লবের পূর্বে বমার্শের নাটক যেমন সামন্তদের সমালোচনা আরম্ভ করে, ঠিক তেমনি মলিয়েরের নাটক শাসকদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। ফরাসী বিপ্লবের কিছুকাল পূর্বে নাটক সম্পর্কে বলা হয়েছিলো, নাটকের কাজ মানুষের চেতনা বিকাশে সহায়তা করা। ফরাসী থিয়েটার ফরাসী বিপ্লবের ঠিক পূর্বমুহূর্তে সামন্ততান্ত্রিক চিন্তাধারার বিরুদ্ধে জনগণকে সংগ্রাম করার প্রেরণা দেয়, আবার বিপ্লবের পরই তা গির্জা ও ধর্মযাজকদের সোচ্চারে ব্যঙ্গ শুরু করে। সপ্তদশ শতাব্দীর ফরাসী সমাজের ভণ্ডামি, কৃত্রিমতা, উন্নাসিকতা প্রভৃতির উপর নির্মম আঘাত করেন মলিয়ের। মলিয়েরের প্রতি তখন অনেকেই বিরূপ হয়ে উঠেছিলেন। তবুও কেউ তাঁর অকাট্য সত্য ও অপরিসীম প্রভাব অস্বীকার করতে পারেননি। বিপ্লবের পূর্বে মলিয়েরের তিন অংকের প্রখ্যাত প্রহসন হলো তারতুফ।
এই নাটকে তিনি ধর্মান্ধতাকে আঘাত করেন। চার্চের ক্রমাগত আপত্তির কারণে শেষ পর্যন্ত এই নাটকের মঞ্চায়নের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিলো। নাট্যকার মলিয়ের তখন খুবই জনপ্রিয় ফরাসী দেশে, যাঁর আসল নাম জাঁ বাস্তি পোল্যা। রাজা নিজেও মলিয়েরের নাটক খুব পছন্দ করতেন। রাজার পৃষ্ঠপোষকতার কারণেই সভাসদদের বিরোধিতা সত্ত্বেও মলিয়ের তাঁর ব্যঙ্গ বা প্রহসনগুলো মঞ্চস্থ করার সুযোগ পান। মলিয়ের নাটকে মূলত আক্রমণ করেছিলেন অভিজাত ও পুরোহিত সম্প্রদায়কে। সেই সম্প্রদায়ের নানা অসঙ্গতিকে হাস্য-রসের মাধ্যমে নাটকে চিত্রিত করে তুলেছিলেন। গির্জার পুরোহিতদের আক্রমণ ও তুচ্ছ- তাচ্ছিল্য করে তিনি তারতুফ নাটক রচনা করেছিলেন।

রাজা পুরোহিতদের চাপের মুখেই এ নাটক বন্ধ করতে বাধ্য হন এবং ধর্ম সম্প্রদায়গুলেকে ভবিষ্যতে না ঘাঁটাবার জন্য মলিয়েরকে সাবধান করে দেন। রাজার সভাসদরা সকলেই ছিলেন মলিয়েরের বিরুদ্ধে। মলিয়েরের নাটকে তেমন কোনো রাজনীতি ছিলো না, ছিলো শাসকশ্রেণী ও পুরোহিতদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বক্রোক্তি। সেটাই তৎকালীন শাসকশ্রেণী সহ্য করতে পারলো না। মলিয়ের তবুও সমাজের নানা অসঙ্গতিকে আক্রমণ করতে ছাড়লেন না।২ সতেরশো যাট সালে সোরিন লিখেছিলেন, তাঁর স্পার্টাকাস নাটকটি গির্জা ও ধর্মযাজকদের সোচ্চারে ব্যঙ্গ করেছিলো।
ফরাসী বিপ্লবের পর মধ্যবিত্তশ্রেণীর চিন্তার ধারক বাহক হয়ে ওঠে থিয়েটার। ফরাসী বিপ্লব থিয়েটারের সর্বত্র তার ছাপ রেখে যায় এবং থিয়েটারও বিপ্লবের গায়ে তার ছাপ এঁকে দেয়। বিপ্লবের নেতৃবৃন্দ বিশাল নাট্য উৎসবের আয়োজন নিয়ে জনগণের জন্য শশব্যস্ত, যে আমোদ প্রমোদে এযাবৎ রাজা রাজড়াদেরই একচ্ছত্র • অধিকার ছিলো।
বিপ্লবের কিছুকাল পূর্বেই মার্সিয়া দাবি জানিয়েছিলেন যে, এমন এক পিপলস থিয়েটার বা গণনাট্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে যার প্রেরণা হবে জনগণ এবং যার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হবে জনগণ। রুশোরও দাবি ছিলো, থিয়েটারের মাধ্যমে গণউৎসবের আয়োজন করা ও শিক্ষাকে ছড়িয়ে দেয়া। জাতিকে কীভাবে শিক্ষায় সমৃদ্ধ করে তুলবেন রুশোর ভাবনা ছিলো সেই লক্ষ্যে পরিচালিত। ফরাসী বিপ্লবের পর নানাভাবে থিয়েটার নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হলো।
কমিটি অব জেনারেল সিওরিটি পারীর বিভিন্ন থিয়েটার পরিচালকদের কাছে সুপারিশ পাঠালেন যে, তাঁরা যেন তাদের থিয়েটারগুলিকে রীতিনীতি ও শোভনতার শিক্ষায়তন হিসাবে গড়ে তোলেন। দেশাত্ববোধক নাটকের পাশাপাশি অন্যান্য নাটকও যেন প্রযোজনা করে যেখানে ব্যক্তি পরিমাকে উজ্জ্বল করে তুলে ধরা হবে। ব্যক্তিত্ববাদের জয় ফরাসী বিপ্লবেও ধ্বনিত হলো।
সেই একই সময় আবার ফরাসী বিপ্লবের অভ্যন্তরেই একদল মানুষ সাম্যবাদের স্বপ্ন দেখতে লাগলেন। পাশাপাশি সারা বিশ্বের বহু চিন্তাশীল মানুষ যে বুর্জোয়া বিপ্লবের কট্টর বিরোধী হয়ে উঠেছিলেন তারও বহু নজির আছে। গ্যাটে, শিলার এই ধারার অন্তর্ভুক্ত। এই ধারার অন্তর্ভুক্ত উপন্যাসিক বালজাক। অথচ ইতিহাসের দ্বান্দ্বিকতা এই যে, যেসব নাটকে সচেতনভাবে বুর্জোয়া মতাদর্শের বিরোধিতা করা হয়েছিলো সেগুলোও ছিলো বুর্জোয়া নাট্যেরই অঙ্গীভূত।
সমর্থন হোক, বিরোধিতা হোক, বুর্জোয়া যুগের প্রায় সব নাটকই বুর্জোয়া মূল্যবোধকে নাটকের কেন্দ্রে এনে ফেলেছিলো। নইলে গ্যাটে থেকে ইবসেন পর্যন্ত অনেকেই বুর্জোয়া ক্ষুদ্রমন্যতায় ছিলেন বীতশ্রদ্ধ ও বিদ্রোহী, তবুও বুর্জোয়া মূল্যবোধ সম্পর্কে উদাসীন তাঁরা থাকতে পারেননি।
কারণ তাঁদের চারপাশে বুর্জোয়ার প্রভাব ছিলো অপ্রতিরোধ্য। গ্যাটে এবং শিলারেব নাটকে আমরা বারবার যে ধারার মুখোমুখি হই সেটা হচ্ছে দেশপ্রেম, দেশের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম এবং স্বেচ্ছায় শাহাদত বরণ। পৃথিবীকে আধুনিক দেশপ্রেম দিয়ে গেছে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব।
বুর্জোয়া বিপ্লবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এক একটি জাতি সত্ত্বার বিকাশ, দেশের সীমানা নির্ধারণ এবং ঐক্যবদ্ধ দেশের জন্য গর্ব ও ভালবাসা। মূলত আঠার শতকের শুরু থেকেই ফরাসী দেশের মতো জার্মানী ও রাশিয়াতেও দ্রুত থিয়েটারের বিকাশ ঘটে। উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশসমূহ এবং মধ্যে ও দক্ষিণ ইউরোপে থিয়েটারের যাত্রা শুরু হয়। বুর্জোয়া উত্থানের মধ্য দিয়ে থিয়েটার জনমনে নতুন আকাক্কার সৃষ্টি করে।
নাটক মঞ্চায়নের উদ্দেশ্য ও রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার পশ্চাৎপট [ পর্ব ২ ]:
নাটক মঞ্চায়নের উদ্দেশ্য ও রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার পশ্চাৎপট [ পর্ব ২ ] – পৃথিবীর সব দেশের বুর্জোয়ার বৈশিষ্ট্য এই যে মুনাফার লোভে তারা একেকটা দেশকে এক এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বাঁধতে বাধ্য হয়। বুর্জোয়ারই প্রয়োজন হয় স্বাধীন ঐক্যবদ্ধ দেশ যেখানে বুর্জোয়া পুরো বিকশিত হতে পারবে। যুদ্ধে জড়িয়ে গেলে তখন মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম, দেশের জন্য মৃত্যুবরণের আগ্রহ জাগাতেই হয়।”” বুর্জোয়া সমাজের এই দাবির কাছে হার মেনেই শিলার পরপর মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী শোনাতে লাগলেন থিয়েটারে। ডি রবার নাটকে কার্ল ফন এক দস্যু দল সংগঠিত করে জমিদার এবং রাজার পশুশক্তির বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধে লিপ্ত হন।
ইউরোপের বুর্জোয়ারা জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রবল বিজাতীয় ঘৃণা পোষণ করতেন, শিলারও সেই বক্তব্যের প্রবক্তা হয়ে দাঁড়ান। মার্সিয়ার চিন্তা ভাবনা শিলারের ওপর ভীষণ প্রভাব ফেলেছিলো। শিলার তাঁর ভিনহেলম টেল-এর বিষয় বা ভাবনাকে পেয়েছিলেন মার্সিয়ার নুভেল এসাই-এর মধ্যে। শিলার তাঁর বেশির ভাগ নাটকে যা ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন, তাহলো-স্বাধীনতার স্পৃহা স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে মুখর হচ্ছে তরবারির ফলায়, মৃঢ়তার শৃঙ্খল ভেঙে যাচ্ছে, মুছে যাচ্ছে হাজার হাজার বছরের কুসংস্কার, একটি জাতি দাবি জানাচ্ছে মানুষের অধিকারের।
প্রজাতান্ত্রিক ঐতিহ্য কায়েম হচ্ছে। গ্যাটেও তার এডমণ্ড নাটকের নায়কের মুখ দিয়ে বলাচ্ছেন, নিজেদের অধিকার রক্ষা করো, তোমার যা আছে তাকে রক্ষা করতেই হে প্রিয়, আনন্দের সাথে মুত্যুবরণ করো।”” স্মরণ রাখতে হবে, শাসকশ্রেণীর চিন্তার প্রভাব যেমন যুগের ওপর প্রতিফলিত হয় তেমনি প্রভাব কখনো একপেশে হয় না। প্রভাবের মধ্যে স্বীকৃতির সঙ্গে থাকে অস্বীকৃতির প্রয়াস। সেজন্য গ্যাটের গ্যোটস ফন বেলিখিঙ্গেন নাটকে দেখা যায়, এক অসমসাহসিক বীর অপ্রতিরোধ্য নতুন উঠতি সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে পুরাতনকে রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছে কিন্তু মাথা নোয়াচ্ছে না।
রাজনৈতিক ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে বুর্জোয়ারা, সেখানে এক পুরাতনপন্থী অভিজাত যোদ্ধা কিছুতেই হার মানতে রাজি নয়, যদিও ইতিহাস তার বিরুদ্ধে। এইভাবে গ্যাটে প্রকারান্তে বুর্জোয়ার নিরেট মুনাফাবৃত্তির বিপরীতে অভিজাত বীরকে দাঁড় করালেন। শুধু গ্যাটে নয়, অনেকেই বুর্জোয়ার ধনলিন্সা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পতিত হলেন অতীতমুখী প্রতিক্রিয়াশীল সনাতনী রক্ষণশীলতায়, কেউ হয়ে দাঁড়ালেন রাজতন্ত্রের সমর্থক। রাজা লুই ও মারি আঁতোয়ানেতের হারিয়ে যাওয়া কালটাই ছিলো ফ্রান্সের স্বর্ণযুগ, এই মিথ্যা প্রচারে তাঁরা জীবন অতিবাহিত করতে লাগলেন। আসলে এ সবই ছিলো বর্তমান কালের শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রকাশিত মতবাদ।
ফরাসী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সামন্ত শোষণের অবসান ঘটলেও ইতিহাসে আবির্ভূত হলো নতুন শোষকশ্রেণী বুর্জোয়ারা। ফরাসী বিপ্লবের পরবর্তী বুর্জোয়া শোষণের ভয়ংকর চেহারাটা অনেকে দেখেছিলেন। বুর্জোয়াদের উত্থান-পূর্বে বুর্জোয়াদের যে দস্যুবৃত্তি সেটাও তাঁরা প্রত্যক্ষ করলেন। উঠতি বুর্জোয়ারা ছিলো চোর, লুটেরা, অত্যাচারী। লক্ষলক্ষ কৃষককে ভিখারিতে পরিণত করেছিলো সে পুঁজি সঞ্চয়ের জন্য।
জনগণের অশ্রু, রক্ত ও হাহাকারের আঁচে আরম্ভ হয়েছিল বুর্জোয়া ভোগের রন্ধন, যার প্রতিটি তণ্ডুল-কণা চুরির মাল, ডাকাতির মুনাফা। মার্কস লিখেছিলেন, পুঁজি আসে মাথা থেকে পা পর্যন্ত প্রত্যেক রোমকূপ থেকে রক্ত ও নোংরামি হুড়াতে ছড়াতে।”” বুর্জোয়া পুঁজি সঞ্চয়ের সেই খুন- ডাকাতি ও নির্মম শোষণের মাঝখানে শেক্সপিয়ার-গ্যাটে-শিলারদের জন্ম।
সেইজন্য বুর্জোয়া লুণ্ঠনটাকে বুর্জোয়াদের ভাড়াটে লেখকদের মতো তাঁরা এড়িয়ে যেতে পারেননি। ভিতরের ক্রোধটা তাঁদের নাট্য রচনার ভিতর দিয়ে বের হয়ে এসেছিলো। অঁরি আঁরভোর মতে, মহৎ রচনা কখনো একটি একক শ্রেণীর পক্ষপাতমূলক ছাঁচে গড়ে ওঠে না, সামগ্রিকভাবে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর সম্পর্ককে সেটা প্রকাশ করে এবং বলার কায়দায় লেখককে তাঁর শ্রেণী পক্ষপাতের ওপরে উঠতে সাহায্য করে। এজন্য দেখা যায় যে, ব্যক্তিগত চিন্তায় একজন লেখক রাজনৈতিকভাবে অতিমাত্রায় রক্ষণশীল হতে পারেন আবার শিল্পী হিসাবে প্রগতিশীল রচনার লেখকরূপে আবির্ভূত হতে পারেন।
শেক্সপিয়ার বা তাঁর সমকালীন বা পরবর্তী নাট্যকারদের চিন্তা কি শাসকশ্রেণী মেনে নিয়েছিলো? বুর্জোয়া উত্থানের পেছনে যে প্রগতিশীল ভূমিকা তার প্রতি এইসব নাট্যকারদের সমর্থন সত্ত্বেও ধনীদের অর্থগৃধনুতার যে সমালোচনা তাঁরা করেছিলেন শাসকশ্রেণী কি ভালোভাবে সেটা গ্রহণ করতে পেরেছিলেন? মোটেও না। শেক্সপিয়ারের যুগের নাট্যশালা ও নাটকের সঙ্গে বুর্জোয়াদের ক্রমান্বয়ে সংঘর্ষ ‘সর্বজনবিদিত। শেক্সপিয়ারের দ্বিতীয় রিচার্ড নাটকের রিচার্ডকে সিংহাসন থেকে অপসারণ করার দৃশ্যটি সরকারি প্রশাসনের পক্ষ থেকে কেটে বাদ দেয়া হয় এবং শেক্সপিয়ারকে ওন্ডকাস্ল নাটকটির নাম পরিবর্তন করে ফলস্টাস রাখতে বাধ্য করা হয়। ষোল শতকের মাঝামাঝি থেকেই শাসকশ্রেণী নাটক নিষিদ্ধ করার বহুরকম চেষ্টা চালিয়েছিলেন।
বুর্জোয়ারা ষোল শতকেই নাটকের বিরোধিতা করেছিলেন এই বলে যে, থিয়েটার যুব শক্তিকে পাপের পথে টেনে নেয়। শহরে থিয়েটার থাকলে খুন জখম বৃদ্ধি পায়। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে, থিয়েটারে রাজদ্রোহী কথাবার্তা উচ্চারিত হয় জনগণের বোধগম্য ভাষায়। জন স্টকউডের মতে নাট্যশালা হচ্ছে শয়তানের আখড়া। পাদ্রী নর্থব্রুক বলেন, শয়তান যে স্কুল খুলেছে তার নামই থিয়েটার। গসন বলতে চেয়েছেন নাটক মানুষকে শেখায় খুন, পাশবিকতা, অবৈধ প্রেম ও নিষিদ্ধ আত্মীয়-সঙ্গম।
ষোল শতকের শেষদিক থেকেই নাটকের ওপর সেন্সর প্রথা চালু করা হলো। সরাইখানাগুলোতে থিয়েটার দেখানোর জন্য লর্ড মেয়রের অনুমতি নিতে হতো। মেয়রের নিষেধ থাকলে যে-কোনো নাটক বন্ধ হয়ে যেতো। ষোল শতকের শেষে টমাস ন্যাশ ও বেনসনের মতো নাট্যকারদের জেলে পোড়া হলো। শেক্সপিয়ারের নাটকের ওপর কড়া নজর দেয়া হতে থাকলো। সেজন্য তাঁর বেশকিছু নাটক থেকে বহু সংলাপ বাদ পড়েছে, বহু সংলাপ উধাও হয়ে গেছে। ষোলশো বিয়াল্লিশ সালে নাটকের ওপর এলো চরম আঘাত। বুর্জোয়াদের অগ্রণী সৈনিক পিউরিটানরা ক্ষমতা দখল করে নাট্যশালা বন্ধ করে দেয় দীর্ঘদিনের জন্য। সতের শতকের মধ্যভাগেই এভাবে ইংল্যান্ডে নাটকের ওপর শাসকশ্রেণীর খড়গ নেমে এলো।
ফরাসী দেশের নাটকে এ সময় চলছিলো রাজা ষোড়শ লুই ও গির্জার নিয়ন্ত্রণ। মলিয়েরের এবং বমার্শের নাটক মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে শাসকদের সে নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে পূর্বে আলোচিত হয়েছে। ফরাসী বিপ্লবের পরেও দেখা যাবে, যখন বুর্জোয়ারা ক্ষমতায় পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত তখন পুনরায় নাটকের ওপর সরকারের, শাসকমহলের নিয়ন্ত্রণ ভয়াবহ রূপ নেয়। কিন্তু শত নিয়ন্ত্রণেও নাটকের প্রচারের ক্ষমতাকে, তার কথা বলার আকাঙ্ক্ষাকে রোধ করা যায়নি।
উপরের দীর্ঘ আলোচনায় যে ব্যাপারটি আমাদের কাছে স্পষ্ট হলো তা হচ্ছে, নাটক কোনোকালেই উদ্দেশ্যহীন ছিলো না। নানাভাবে সে তার উদ্দেশ্য প্রচার করেছে। সে উদ্দেশ্য কখনও ধর্মের পক্ষে, কখনও ধর্মের বিরুদ্ধে। কখনও রাষ্ট্রের পক্ষে, কখনও বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। কখনও ব্যক্তি বা জনগণের পক্ষে কিংবা তার বিপক্ষে। নাটকে শাসক ও শোষক উভয়ের পক্ষেই প্রচার চলেছে। সব সময়ই তার একটা ব্যবহারিক দিক ছিলো, একটি উপযোগিতার দিক ছিলো।
স্বাভাবিকভাবেই তাহলে প্রশ্ন জাগে, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের নাটককে হঠাৎ কেন তবে এ শ্লোগান তুলতে হলো-শিল্পের জন্য শিল্প নয়, নাটক হোক সমাজ সচেতনতার হাতিয়ার কিংবা সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার। সেই সাথে আর একটি প্রশ্নও আমাদের মনে আসে, বাংলাদেশেই কি প্রথম এই শ্লোগান তোলা হয়েছিলো-নাকি এর আগে অন্য কোথাও কেউ এ শ্লোগান তুলেছিলো? না, বাংলাদেশে এই শ্লোগান প্রথম তোলা হয়নি। বাংলাদেশে তোলা শ্লোগানটি ছিলো দীর্ঘ এক ইতিহাসের ধারাবাহিকতা। মূলত ফরাসী বিপ্লবের পর নানা ঘটনার প্রেক্ষিতে ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ কিংবা ‘মানুষের জন্য শিল্প’ দুটি শ্লোগানই প্রথমারের মতো উত্থাপিত হয়।
শাসকদের সাথে শিল্প-সাহিত্যের সম্পর্ক কী হবে সেই প্রেক্ষিত থেকেই এই শ্লোগান দুটির জন্ম। কেন এবং কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে এই শ্লোগানগুলোর আবির্ভাব ঘটে নীচের আলোচনায় আমরা সেই ইতিহাসটি তুলে ধরার চেষ্টা করবো। ফরাসী বিপ্লব ছিলো এক নতুন ধরনের বিপ্লব। রাজনৈতিকভাবে সচেতন মানুষদের দ্বারাই ঘটেছিলো এ বিপ্লব।
সেই বিপ্লবে সাম্যের বাণীও ঘোষিত হয়েছিলো। সাম্যই ছিলো তার প্রধান কথা। ইংল্যান্ডের বিপ্লবে পার্লামেন্টের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেও সেখানে শাসন-ক্ষমতায় ধনী বুর্জোয়াদের সাথে উচ্চ অভিজাতদের সমন্বয় ঘটেছিলো। ফরাসী বিপ্লবে পূর্বের গোটা ব্যবস্থাই উল্টে গেল। সে বিপ্লবে শ্রমিক-কৃষকরাও ছিলো অন্তর্ভুক্ত। মাথার উপর বসে ছিলো যে ক্ষমতাশীল অভিজাতরা তাদের, সেখান থেকে বিচ্যুত করা হলো। চার্চের সমস্ত কর্তৃত্বের অধিকার কেড়ে নেয়া হলো। শেষ পর্যন্ত রাজা ও রানীর শিরচ্ছেদ করা হলো। ঘোষণা দেয়া হলো, আইনের চোখে সবাই সমান সুতরাং বিশেষ সুবিধার ইতি ঘটবে। সব জায়গাতেই মনোনয়নের স্থানে নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করলো বিপ্লবী পরিষদ।
বিচারকরা পর্যন্ত নির্বাচিত হতে থাকলো। রাজপদ ক্রয়ের ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেল। ফরাসী সমাজ পুরানো ব্যবস্থার জড়ত্বের হাত থেকে মুক্তি পেল। যখন রাজতান্ত্রিক ইউরোপ পুরানো ব্যবস্থার নিগড়ে আবদ্ধ হয়ে গতিহীন, ফ্রান্সে তখন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন-শৃঙ্খলমুক্ত মানুষের ব্যক্তিগত উদ্যম সেখানে অবাধ গতির সঞ্চার করেছিলো। ফরাসী বিপ্লবের পরপর প্রজাসাধারণ কিছুদিনের জন্য হলেও ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছিলো। ফলে সে সময়কার নাটক নিয়ে নতুন সব চিন্তাভাবনা দেখা গিয়েছিলো জনগণের স্বার্থকে ঘিরে।ফরাসী বিপ্লবের পর নাটক বিপ্লবী চিন্তাবিদদের কাছে খুবই গুরুত্ব পেয়েছিলো।
নব্বই সালে বিপ্লবীদের জয় ও স্বৈরাচারের পতনে দর্শকরা কোরাস গাইতে থাকে ‘সামন্ততন্ত্র তুমি পরাজিত’। বিখ্যাত, সাহিত্যিক গকুর-এর লেখা থেকে জানা যায়, জনগণ তখন থিয়েটার দখল করে। বিপ্লবের স্বার্থে নাটককে ব্যবহারের চিন্তা শুরু হয়। রুশো এই সময় থিয়েটার দ্বারা যেমন জনগণকে শিক্ষিত করে তুলতে চেয়েছিলেন, তেমনি চেয়েছিলেন মানুষের গৌরবের দিকগুলোকে তুলে ধরতে।
রুশোর ধারণায় স্বাধীনতা ও সাম্যের প্রয়োজন পরিষ্কার। তাঁর রাজনৈতিক ধারণার মূল কথা ছিলো, সামাজিক রাষ্ট্র তখনই সুবিধাজনক যখন প্রত্যেকেরই কিছু থাকে এবং কারোরই বেশি থাকে না। সুতরাং সমাজের ভিত্তি হবে স্বাধীনতা ও একধরনের সাম্য। থিয়েটারের মধ্য দিয়েও ফরাসী বিপ্লব সাম্যের বাণী প্রচার করতে চেয়েছিলো। সতেরশো চুরানব্বই সালে জনশিক্ষা কমিশনের জোশেফ পায়া শুধুমাত্র লেখক এবং পরিচালকদের ফটকাবাজি এবং থিয়েটারী মনোরঞ্জনের নীতিহীনতা ও মুনাফাবাজির বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করলেন তা নয়, তাঁর আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো সেই সময়ের মন্থর মেজাজ এবং শিল্পের ক্রীতদাসসূলভ মনোবৃত্তি। তিনি বললেন, উচ্ছৃঙ্খলতা আমাদের থিয়েটার থেকে অবশ্যই দূর করতে হবে। মঞ্চকে করে ফেলতে হবে পরিষ্কার।
স্বাধীনতার ভাষাকে উচ্চারণ করতে হবে আমাদের, শহীদদের সমাধির ওপর ছড়িয়ে দিতে হবে ফুল, গাইতে হবে বীরত্ব ও গৌরবের গান, জনগণকে উদ্দীপ্ত করতে হবে ভালোবাসা ও দেশপ্রেমে। ফরাসী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে এক নবযুগের সূত্রপাত হয়। বিপ্লবোত্তর রাষ্ট্রচিন্তায় জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের আদর্শ বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। নাট্যচিন্তায়ও তার প্রভাব পড়ে। বহু নাট্যকারের রচনায় দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের ধারণা স্পষ্ট হতে থাকে। ব্যাপারটা সেখানেই শেষ হয় না। জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের অভ্যন্তরেই শ্রমিক ও সাধারণ মানুষও নাটকের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে থাকে।
শুধু বুর্জোয়াদের নয়, সকল মানুষের ভাগ্য পাল্টাবার দাবি তোলে নাটক। বিপ্লবকে মাঝপথে থামিয়ে না দিয়ে বিপ্লবের চূড়ান্ত রূপটি তারা দেখতে চায়। ফরাসী বিপ্লবকে কেন্দ্র করে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে ইউরোপের রাষ্ট্রীয় কঠোমোয় পরিবর্তনের যে ঢল নামে তার জোয়ারে সমগ্র ঊনবিংশ শতাব্দীটি কাটছিলো এক অদ্ভূত অস্থিরতার মধ্যে।” অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসী বিপ্লব ছাড়াও আরো দুটি বিপ্লব ঘটে।
রাজনৈতিক বিপ্লব ঘটে আমেরিকায়, সেখানকার ব্রিটিশ উপনিবেশগুলো বিদ্রোহ করে। ফলে স্বাধীন সাধারণতন্ত্র হিসাবে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পত্তন হয়। শিল্প বিপ্লব শুরু হয় ইংল্যাণ্ডে এবং পরে পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। উল্লিখিত তিন তিনটি বিপ্লবের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে মধ্যবিত্ত বুর্জোয়ারা। পাশাপাশি শ্রমিকশ্রেণীও জেগে ওঠে নিজেদের ভাগ্য পাল্টাবার প্রশ্নে।
বুর্জোয়াদের সাথে শ্রমিকদের সংঘর্ষ কখনও কখনও মারাত্মক আকার নেয়। সময়টা নতুন যুগসন্ধিক্ষণ ও অস্থিরতার। এই সময় থেকেই আধুনিক রাষ্ট্রের উৎপত্তি লক্ষ্য করা যায় এবং রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব শুরু হয় নতুনভাবে। ধর্মের অনুশাসনের জায়গায় শুরু হয় আইনের নিয়ন্ত্রণ। শিক্ষা ও সংস্কৃতির ব্যাপারটাকে দেখা হতে থাকে রাষ্ট্রের শাসকদের স্বার্থে। রাষ্ট্রের স্বার্থে নৈতিক শিক্ষা দেয়ার ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়ায় শিল্প-সাহিত্যের বিষয়বস্তু। ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ তত্ত্বের উৎপত্তিও ঘটে বুর্জোয়া উত্থানের এই পর্বে।
ফরাসী বিপ্লবের পর সা-সিম প্রমুখ দাবি করেছিলেন, শিক্ষক সাহিত্যিকদের এক বিশেষ সামাজিক ভূমিকা আছে। বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে তাঁরা হবেন অগ্রবাহিনী। ফরাসী বিপ্লব শুধু বুর্জোয়া বিপ্লবের মধ্যেই আটকে থাকতে চায়নি। নতুন নতুন আরো বিপ্লবের স্বপ্নও ছিলো তা। ফরাসী বিপ্লবের অভ্যন্তরেই একদল মানুষ সাম্যবাদী সমাজের যে স্বপ্ন দেখতেন তাকে সমাজে প্রয়োগ করার কথা ভাবলেন কেউ কেউ। রুশো, সা-সিম, জ্যাকোবিনদের নেতা রোবপিয়েরও ছিলেন এইরকম চিন্তার ধারক।
সেটা বাস্তবে ঘটলো না বাস্তব অবস্থার কারণেই। ফরাসী বিপ্লবের পর থেকে ফ্রান্সের অর্থনীতি ও রাজনীতির বিকাশ এমন ধারায় ঘটেছে যাতে কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তনই সর্বহারাশ্রেণীর প্রাধান্য স্বীকার না করে সম্ভব ছিলো না। কিন্তু ফরাসী সর্বহারাশ্রেণীর রাজনৈতিক চেতনা সেই অনুপাতে উপযুক্ত ছিলো না। নিজেদের রক্তে বারবার ফ্রান্সে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পথ করে দিলেও, নিজেদের কিছু কিছু দাবি প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করলেও, ফরাসী সর্বহারারা সাধারণভাবে নিজেদের দাবি-দাওয়া সম্পর্কে ছিলো অস্পষ্ট ও বিভ্রান্ত।
ফ্রান্সে প্রতিটি বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের পরেই একটি নতুন সংগ্রাম শ্রমিকদের গড়ে তুলতে হচ্ছিলো, অথচ যথাযথ প্রস্তুতির অভাবে বারবার তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছিলো। পাশাপাশি ফ্রান্সের পরাজিত অভিজাতশ্রেণী বারবার চেষ্টা করে যাচ্ছিলো অনেকাংশে বুর্জোয়া পরিবর্তন স্বীকার করে নিয়ে নিজেদের সামন্ততন্ত্রের ক্ষমতা কায়েম করতে এবং জমির মালিকানার সুবাদে ও পরম্পরাগত আধিপত্যের দরুন অজ্ঞ ও পশ্চাদপদ ফরাসী কৃষক সমাজকে নিজেদের কুক্ষিগত করে রাখতে। বুর্জোয়াদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ প্রজাতন্ত্রবাদী হওয়া সত্ত্বেও শ্রমিকদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অভিজাতশ্রেণীকে মিত্র রূপে বেছে নেয়। জেগে ওঠা শ্রমিকশ্রেণীর ভয়ে যেমন ভীত ছিলো গির্জার পুরোহিত ও অভিজাতশ্রেণী, তেমনি নতুন এই শক্তির জাগরণে বুর্জোয়ারাও ছিলো শঙ্কিত।
বিপ্লবের মূল শক্তি ছিলো তখন জনগণের প্যারিস কমিউন। প্যারিস কমিউনের সমর্থন ছিলো জ্যাকোনিদের নেতা রোবপিয়েরের দিকে। বুর্জোয়ারা চেয়েছিলো ক্ষমতা থেকে শ্রমিকদের উৎখাত করতে আর তাই তারা অভিজাতদের সাথে হাত মিলিয়েছিলো। সন্ত্রাসের রাজত্বকে কেন্দ্র করে
রোবসপিয়েরকে গিলোটিন-এ পাঠানোর মধ্য দিয়ে জনগণের বিপ্লব মুখ থুবড়ে পরে এবং শীঘ্রই ক্ষমতা দখল করেন নেপোলিয়ান বোনাপার্ট। ফরাসী বিপ্লবে সাম্যের নির্ঘোষ শোনা গেলেও অতি দ্রুত তা কনসুলেট আর সম্রাটের সিংহাসনের চোরাগলিতে
হারিয়ে গেল।
ফরাসী বিপ্লব তখনো অর্ধসমাপ্ত, জনগণের হাত থেকে ক্ষমতা চলে গেল সামরিক। বাহিনী আর অভিজাতদের হাতে। শিল্প-সাহিত্য এবং নাটক নিয়ে নতুন শাসকরা নতুনভাবে চিন্তা শুরু করলেন। শিল্পীদের সমকালীন যুগের সচেতনতাকে নেপোলিয়ন সমর্থন করতেন এবং তিনি চেয়েছিলেন যে সাম্রাজ্যের মহিমাময় কীর্তিও শিল্পীদের চিত্রপটে বিধৃত হোক। নেপোলিয়ন ছড়িয়ে পড়া থিয়েটার কোম্পানিগুলোকে উৎসাহ দানের জন্য নানা উদ্যোগ নিলেন বটে, তবে ষোড়শ লুই মলিয়েরকে যেটুকু স্বাধীনতা দিয়েছিলেন সেটুকু স্বাধীনতাও তিনি নাট্যকারদের দিলেন না।
সেই সময় শ্রমিকশ্রেণী ও সাধারণ জনগণ ছিলো রাষ্ট্রের বিরাট শক্তি। যে-কোনো সময় শ্রমিকশ্রেণী বিদ্রোহ করে বসতে পারে শাসকদের বিরুদ্ধে। শাসক মহল তাই কঠোর হলো যাতে ফরাসী বিপ্লবের সাম্যের বাণী শিল্প-সাহিত্যে প্রচারিত না হয়। বুর্জোয়াদের ঘোষিত বিপ্লবের বাণী বুর্জোয়াদের শ্রেণীস্বার্থেই প্রচার করা নিষিদ্ধ হয়ে গেল।
ইউরোপের সর্বত্রই অষ্টাদশ শতকের শেষ পাদ থেকে নাটক মঞ্চায়নের ওপর নিয়ন্ত্রণ শুরু হলো। শাসকবর্গ থিয়েটারের ওপর তাদের কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে থাকলো। অস্ট্রিয়ার সরকার নিয়ন্ত্রিত বার্গ থিয়েটারে তো বটেই, বেসরকারি মালিকাধীন থিয়েটারেও সেন্সরের কড়াকড়ি ছিলো। জার্মানীর সব কটি শহরেই ও কোর্ট থিয়েটারেও এবং ইটালীর নগররাষ্ট্রগুলিতেও সেন্সরের প্রতাপ ছিলো প্রবল।
বস্তুত শাসকশ্রেণী থিয়েটারের গণসংযোগ ক্ষমতা সম্পর্কে ভীত ছিলো বলেই তারা সেন্সর প্রথার নিগড়ে থিয়েটারকে বেঁধেছিলো। রাশিয়াতে ঘটেছিলো একই ঘটনা। ফরাসী বিপ্লবের পরে কমেডি ফ্রঁসেজ যেভাবে বিপ্লবের পক্ষে রচিত নাটকের মঞ্চায়ন করে চলেছিলো তাতে ইউরোপের রাজন্যবর্গ শঙ্কিত না হয়ে পারেনি। থিয়েটারের চিরকালই একটা রাজনৈতিক প্রবণতা আছে, বহু লোককে একত্রিত করা এবং জীবনের নানা দিকগুলি নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করা। এটা থিয়েটারের ধর্ম এবং এটা অবশ্যই একটা রাজনৈতিক কাজ। সুতরাং রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে থিয়েটারের বিরোধ বাধাটাই ছিলো সঙ্গত।
শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বের ধারণা প্রথম পাওয়া যায় নিকোলাস-এক-এর সময়কার আলেকজান্ডার পুশকিনের রচনাবলীতে। রাশিয়ায় তখন জার নিকোলাস-এক-এর শাসন কাল। নিকোলাসের শাসনকালে শিল্প-সাহিত্যের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ ছিলো অধিকতর কঠোর। বিশেষ করে থিয়েটারের সর্বপ্রকার কার্যক্রমকে গোপন পুলিশ কর্তৃপক্ষের আওতায় নিয়ে আসা হয় যার প্রধান ছিলেন নিকোলাস নিজেই।
গোপন- পুলিশের এই বিভাগ নাটক মনোয়ন থেকে শুরু করে চরিত্র অনুযায়ী অভিনেতা- অভিনেত্রী নির্বাচনও করতেন। সমগ্র উনিশ শতকে রাশিয়ার বিভিন্ন প্রদেশে বহু থিয়েটার গড়ে উঠেছিলো, এসবের অনেকগুলোরই মালিকানা ছিলো ব্যবসায়ীদের। সেগুলিকেও গোপন পুলিশের নিয়ন্ত্রণ ও নির্দেশ মেনে চলতে হতো। নিকোলাস- এক-এর শাসনামলেই জন্ম নেয় শিল্পের জন্য শিল্পের তত্ত্ব, যার শুরুর ইতিহাসটা বড়ই বিচিত্র। প্লেখানভ তার ‘শিল্প ও সমাজ’ গ্রন্থে ব্যাপারটি চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
শিল্পের জন্য শিল্প এ তত্ত্বটি ভুল কি ঠিক সে বিচারে না গিয়ে আমরা প্রথমত বুঝতে চেষ্টা করবো এই ধারণার উৎপত্তির কারণটি-কী। প্লেখানভের শিল্প ও সমাজ গ্রন্থে দেখা যাচ্ছে যে, পুশকিন একদা শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন না। বরং উল্টোটাই তাঁর লেখনীতে ধরা পড়েছিলো। তিনি তাঁর লেখনীর মধ্য দিয়ে সমাজের দুর্ভোগ দৈন্যতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন।
সরকারি মহলে থেকে তিনি যুব সমাজকে বিপথে পরিচালিত করছেন এমন অভিযোগও উঠেছিলো। তিনি তাঁর মুক্তি কবিতায় ঘৃণা-ক্রোধ ও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন নিজ জাতিকে শৃঙ্খলে বন্দী হতে দেখে, মানুষকে শাসকদের হাতে অত্যাচারিত হতে দেখে। উদ্ধত অভিজাতদের ক্ষমতার অপব্যবহারেও তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সেজন্য প্লেখানভ লিখছেন, ‘একদা পুশকিন শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন না। সে সময় তিনি বিবাদকে এড়িয়ে যেতেন না বরং বিবাদ করার জন্য উদগ্রীব থাকতেন।
সে আলেক্সান্দর-এক-এর – সময়ের কথা। পরে তাঁর মানসিকতা সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়। নিকোলাস-এক-এর সময় তিনি শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বের পক্ষাবলম্বন করেন। নিকোলাস-এক-এর সময় কেন তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তন ঘটে? কোন প্রেক্ষাপটে তিনি নিজের চিন্তাকে পাল্টে নিয়েছিলেন?
রাশিয়াতে আঠারশো পঁচিশ সালের চৌদ্দই ডিসেম্বর বিপ্লবী অফিসারদের দ্বারা ভূমিদাসত্ব ও জারদেদ্র স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক অভ্যুত্থান ঘটে। সেই অভ্যুত্থানকে দমন করা হয়, অভ্যুত্থানের পাঁচ জন নেতা প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন, বাকিদের অনেকেই সাইবেরিয়াতে নির্বাসিত হয়েছিলেন। আলোক্সান্দর-এক এর মৃত্যুর পর নিকোলাস-এক তখন মাত্র শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। নিকোলাস-এক-এর সময়কার এই অভ্যুত্থান তাঁকে ভীষণভাবে বিপ্লব সম্পর্কে ভীত করে তোলে। তিনি যে-কোনো রকম বিপ্লব থেকে রাশিয়াকে রক্ষা করবার জন্য দৃঢ় মনোভাব গ্রহণ করেন। দুটি বিশেষ লক্ষণের দ্বারা নিকোলাস-এক-এর রাজত্বকাল চিহ্নিত হয়-জঙ্গী সামরিকতা ও আমলাতান্ত্রিকতা। সামরিক বাহিনীর পদস্থ অফিসার দিয়ে নিকোলাস নিজেকে ঘিরে রাখতেন। নিকোলাসের মূল প্রশাসনযন্ত্র ছিলো পুলিশ দপ্তর। সাধারণ মানুষের কাছে শেষ পর্যন্ত এই দপ্তরই নিকোলাসের শাসনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।
গোপন সন্ত্রাস ও বিপ্লবের বিরুদ্ধে নিকোলাসের প্রধান হাতিয়ার ছিলো তা। পশ্চিম ইউরোপের বিপ্লবী রাজনৈতিক সামাজিক আদর্শ যে রাশিয়ার পক্ষে বিপজ্জনক সে সম্বন্ধে তাঁর কোনো সংশয় ছিলো না। সুতরাং নাগরিকদের বিদেশ ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কঠোর নিয়ন্ত্রণ বলবৎ করা হয়। সেন্সর ব্যবস্থার মাধ্যমে রাশিয়াতে সমস্ত প্রকাশনার ওপরেও কঠোর নজরদারি চলে। মুক্তচিন্তার সমস্ত পথ রোধ করা হয়। বিধিনিষেধের এই বাড়াবাড়ি প্রায় হাস্যকর হয়ে উঠলো।
গোপন পুলিশ সমস্ত রকম রাজনৈতিক কার্যকলাপের ওপরেও কঠোর দৃষ্টি রেখেছিলো, বিশেষ করে সন্ত্রাসবাদী কাজকর্ম দমনের জন্যই গোপন পুলিশকে ব্যবহার করা হতো।পুশকিন নিকোলাসকে একেবারেই পছন্দ করতেন না, সম্রাট সম্পর্কে যাচ্ছেতাই বলতেন। এসবের জন্য পুশকিন স্বভাবতই নিকোলাস-এর পুলিশ প্রধানদের সর্তক নজরে পড়েন। নিকোলাস ক্ষমতায় আসার পর পুশকিনের কাছ থেকে আশা করছিলেন, পুশকিন রাষ্ট্র বা শাসকদের স্বার্থে লিখুক। পুশকিনের প্রথম দিকের লেখাগুলো নিকোলাসের মোটেই পছন্দ ছিলো না।
পুশকিন যেভাবে তাঁর রচনাতে স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করতেন শাসকরা তার মধ্যে বিদ্রোহের এবং উচ্ছৃঙ্খলতার গন্ধ পাচ্ছিলেন। নিকোলাস চাইছিলেন, পুশকিনের কাছ থেকে নৈতিকতা সম্পন্ন লেখা; যে-লেখা যুব সমাজকে রাষ্ট্রের প্রতি, শাসকদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তুলবে। নিকোলাস-এক নিজে প্রধানত এই নৈতিকতার ভিত্তিতেই শিল্পকে দেখেছেন। ফ্রান্সের ষষ্ঠদশ লুইয়ের মতও ছিলো একই রকম যে, শিল্প স্বলক্ষ্য সম্পন্ন নয় বরং অবশ্যই নৈতিক শিক্ষার হাতিয়ার।
বিপ্লবের পর ফরাসী দেশের শাসকদের চিন্তাভাবনা এর থেকে আলাদা কিছু ছিলো না। ফরাসী বিপ্লবের নেতারাও নাটককে নৈতিক শিক্ষার হাতিয়ার মনে করতেন, নেপোলিয়ন-একও চাইতেন সাহিত্য এবং শিল্প যেন নৈতিক উদ্দেশ্যকে সেবা করে। ফরাসী বিপ্লব নৈতিক শিক্ষা দিতে চেয়েছিলো সাম্য স্বাধীনতা ও মৈত্রীর পক্ষে, কিন্তু নেপোলিয়ন নৈতিক শিক্ষা দেবার কথা ভাবলেন বুর্জোয়া শাসকদের লুন্ঠনের স্বার্থে এবং বুর্জোয়া শোষণকে টিকিয়ে রাখতে।
থিয়েটারকে নীতিকথার বিদ্যালয়ে পরিণত করার দাবি উঠেছিলো বুর্জোয়া মতাদর্শের অভ্যুত্থানের সময়ই। সে নীতিকথা কী বা কেন সে নিয়ে ভিন্নমত থাকলেও নীতিকথা প্রচার থিয়েটারের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো। সেজন্য সিডনি ও টমাস ন্যাশের মতন মুক্তচিন্তার প্রবক্তরা পর্যন্ত সে দাবি মেনে নিয়ে লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন।
নতুন উঠতি বুর্জোয়ার চিন্তাধারা আচ্ছন্ন করে ফেলেছিলো শিল্পী সাহিত্যিকদের বড় একটা অংশকে। বেন জনসনের মতন সমাজ সচেতন নাট্যকারও থিয়েটারকে নৈতিকতার পাঠশালা বলে স্বীকার করে নিলেন। গসনও বারম্বার নাটকে শিক্ষার কথা উত্থাপন করেছেন। গসন যে নাটককে নীতিকথা রূপে দেখেছিলেন সে ধারা বুর্জোয়া সমালোচকদের বহুদিন পর্যন্ত আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। ফরাসী চিন্তাবিদ মার্সিয়া মনে করতেন, নাট্যকারদের প্রথম কর্তব্য হলো নাগরিকদের নৈতিক এবং ব্যবহারিক মান উন্নত করা। ফরাসী বিপ্লবের পর যোশেফ পায়ার মতো বিপ্লবীও দেশপ্রেমিক লেখকদের কাছে আবেদন জানালেন এই বলে, ‘একবার ভেবে দেখুন, নাটকের মধ্য দিয়ে আমরা কি গভীরভাবে মানুষকে নৈতিক দিক থেকে প্রভাবিত করতে পারি।
নাট্যকার জন গলসওয়ার্দি নাটকে এই নীতিবোধ প্রচারকে সমালোচনা করে লিখেছিলেন, গড় নাটকের নীতিবোধ এখন তো বটেই, সম্ভবত চিরকালই তথাকথিত মন্দনীতির ওপর যে কোনওভাবে অপেক্ষাকৃত ভালোর জয় ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ। তিনি আরো লিখছেন, বিকৃত নৈতিকতা নাটকের হাড়েমজ্জায় প্রবেশ করে নাটকের শৈল্পিকতা, মানবিকতা ও তাৎপর্য নষ্ট করেছে। স্রষ্টা, অভিনেতা, দর্শক, সমালোচক সকলকেই তা সংক্রামিত করেছে।
গ্রীক নাটক বা শেক্সপিয়ারের নাটকে আমরা যা দেখি, নাটক হচ্ছে নানা চরিত্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং সেই দ্বন্দ্বের মধ্যে ফুটে ওঠে বৃহত্তর দ্বন্দ্বের প্রতিরূপ। শেক্সপিয়ার সম্পর্কে বলা হয় তিনি নাকি কোনোদিন কারো ভালো করেননি, করবেনও না কোনোদিন। বস্তুত শেক্সপিয়ার মানবতার যেটুকু ভালো করেছেন তার ধরনটা পরোক্ষ, দূরস্থিত।
তিনি তাঁর মহত্তম নাটকগুলোর ঘটনা পরম্পরার ক্ষেত্রে বিকৃত নৈতিকতা চিত্রায়ণের অভ্যাস থেকে মুক্ত ছিলেন। নাটকে তিনি সমাজ সত্যকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন, নীতিকথা বলার চেষ্টা করেননি। যে নাট্যকার গড়জনতাকে তার প্রত্যাশা-মাফিক নৈতিকতায় বিকৃত করে জীবন তথ্য সরবরাহ করেন, তিনি জনগণের যাবতীয় সংস্কার অক্ষুন্ন রেখে তাদের তাৎক্ষণিক ভালো করছি ভেবেই তা করেন। কিন্তু
বিষয় পাল্টে যায়, নীতিবোধও পাল্টায়, মানুষ থাকে। সেজন্য মানুষ ও তার জীবনতথ্যের বিশ্বস্ত উপস্থাপন সম্ভবত সবচেয়ে বেশি তার কাজে লাগে। সামন্ত- শাসকশ্রেণী ও বুর্জোয়ারা সেটা বুঝতে চাইলেন না। নাটক যে ইশপের উপকথা নয়, নাটকের উদ্দেশ্য যে নীতি প্রচার নয়-সে সত্যটা তাদের বোধগম্য হলো না। সমাজকে বিশ্লেষণের চেয়ে নীতিকথা বলার মাধ্যম হিসাবে বিবেচনা করলেন নাটক ও শিল্প- সাহিত্যকে।
ভি এ বুকোভস্কি একজন বড়ো কল্পনাপ্রবণ কবি আর সভাসদও বটে, তিনি আঠারশো ছাব্বিশ সালের বারোই এপ্রিল পুশকিনকে একটি চিঠি লেখেন। সেই চিঠির বক্তব্য ছিলো, পুশকিনের লেখা পড়ে যুব সমাজ বিদ্রোহী চেতনার সাথে পরিচিত হয়। পুশকিন ইতিমধ্যেই সেভাবে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি করে ফেলেছেন। তিনি পুশকিনকে গতানুগতিক নৈতিকতার প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করে লেখার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন প্রতিভা কিছু নয়, নৈতিকতাই বড় কথা।
পুশকিনকে এ রকম বহু ঘটনার মুখোমুখি হতে হয় তাঁর প্রথম দিকের বিদ্রোহী ধরনের লেখার জন্য। পাশাপাশি নিকোলাস-এক-এর সময় রাষ্ট্রের পক্ষে লেখার জন্য চাপ আসতে থাকে। শাসকদের এই চিন্তার সাথে পুশকিন নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে
পারছিলেন না।
শাসকদের পক্ষে লেখা মানেই জনতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এটা পুশকিন বুঝতেন, কিন্তু তা থেকে বেরিয়ে আসার বৈপ্লবিক পথটাও তাঁর জানা ছিলো না। তাই তিনি লক্ষ্যহীন অন্তর্দ্বন্দ্বে হয়ে পড়েছিলেন ক্ষত-বিক্ষত। তিনি সৎ ছিলেন, তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিলো কী করা উচিৎ, তিনি জানতেন না কীভাবে তা করতে হবে। সরকারি বিধি- নিষেধ ও ত্রাস সৃষ্টিকারী ঘটনায় দেশের মানুষের জীবন তখন চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ। রাষ্ট্রটা যেন একটা জেলখানা, যেন একটা লোহার গরাদ, পিঞ্জরাবদ্ধ পাখির মতো নগরিকজীবন তার মধ্যে ছটফট করছে। চারদিকে শুধু ক্লান্তি, অবসাদ আর
একঘেয়েমির চিত্র!
পুশকিন বুঝতে পারছিলেন না দেশের মানুষের স্বার্থে কীভাবে তিনি কী করবেন। রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিলো শাসকদের স্বার্থে পুশকিনের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং তাঁর লেখনী শাসকদের স্বার্থে পরিচালিত করা। কিন্তু যে-লেখক রাষ্ট্রের এই নিয়ন্ত্রণ মেনে নিতে চান না তিনি কি করবেন? স্বভাবতই তিনি রাষ্ট্রের এই উদ্দেশ্যের বিরোধিতা করবেন। সরকারের পক্ষে উদ্দেশ্য প্রণোদিত শিল্প রচনা করা উচিৎ নয়।
বলেই মনে করবেন। সেই বিরোধিতা হতে পারে দুভাবে। হয় তিনি এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করবেন, নতুবা তিনি শাসকদের সাথে কোনরকম ঝামেলা এড়িয়ে পলায়নপর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। পলায়নপর ভূমিকার অর্থ আপাতভাবে তিনি নিরপেক্ষ ভূমিকাই পালন করবেন। শোষক বা শোষিত কারো পক্ষেই তিনি উচ্চকণ্ঠ হবেন না। পুশকিনের ক্ষেত্রে তাই ঘটেছিলো। শাসকদের নিয়ন্ত্রণ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার জন্য তিনি দ্বিতীয় পন্থাই অবলম্বন করেছিলেন।
যখন পুশকিনকে সরকারের পক্ষে লিখতে বলা হলো অর্থৎ পুশকিনের রচনাকে সরকারের প্রচার মাধ্যম বানাবার চেষ্টা করা হলো, তখনি পুশকিন সরকারের এই দাবির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসলেন। সে বিদ্রোহ কোনো সরব বিদ্রোহ নয়। সে বিদ্রোহ ছিলো কৌশলেরই নামান্তর। শিল্প যে সরকারের প্রচার যন্ত্র নয় সেটা প্রমাণ করার জন্যই তিনি শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে উঠলেন।
পুশকিন নিজের লেখাকে শাসকশ্রেণীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখা এবং শাসকশ্রেণীর চিন্তা প্রচার না করার জন্যই শিল্পের জন্য শিল্প রচনায় মনোযোগী হন। শাসক মহলের চাপে পুশকিন যৌক্তিক কারণেই শিল্পের উপযোগিতাবাদের বিরুদ্ধে চলে যান। জিপসী কবিতায় এ সম্পর্কে পুশকিন লিখেছিলেন ‘টাকায় তাহারা বাণিজ্য করে মুক্তি’। সেই টাকার মাহাত্ম্য পুশকিন প্রচার করতে চাননি। ব্যাপারটা যে শুধু পুশকিনের ক্ষেত্রেই ঘটেছিলো তা নয়, এটা ছিলো একটা যুগের ব্যাপার। শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে যেহেতু পুশকিন তার শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বকে ব্যবহার করেছিলেন, সেজন্য তাঁর এই চিন্তা সেদিন জনগণের পক্ষেই ছিলো।
কিছু ব্যতিক্রমবাদে পুশকিনের সমসাময়িক রোমান্টিকরাও ছিলেন শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বের সমর্থক। শাসকদের অনুশাসন অগ্রাহ্য করবার জন্যই, তার থেকে আত্মরক্ষা করবার জন্যই তাঁরা প্রধানত এই ধ্বনি তুলেছিলেন। ফ্রান্সের তয়েফিল গতিয়ে তাঁদের মধ্যে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য। ক্লবেয়ারও একই ধরনের তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন। ফ্লবেয়ারের মতে শিল্প হলো অপ্রয়োজনের অন্বেষা।” তুর্গেনেভও শিল্পের উপাযোগিতাবাদী প্রবক্তাদের দারুন অপছন্দ করতেন। বুর্জোয়াদের প্রতি ঘৃণা থেকেই এই ব্যাপারটা ঘটে। বুর্জোয়াদের প্রতি শেক্সপিয়ার, ন্যাশ, গ্যাটে, মলিয়েরের যে কারণে ঘৃণা ছিলো, এদের ঘৃণারও প্রধান কারণটা তাই। এই বুর্জোয়ারা কারা?
গতিয়ে লিখছেন, তারা হলেন ব্যাংকার, দালাল, উকিল, বণিক, দোকানদার প্রভৃতি সকলেই। রোমান্টিকদের ভাষায় বুর্জোয়ারা হলো এমন মানুষ যার কেবল ইশ্বর একমাত্র সম্বল, নিজের স্বার্থ ছাড়া যার রক্ষা করার আর কিছু নেই। বুর্জোয়ারা সৌন্দর্য্যের চেয়ে টাকাকেই বড় করে দেখতো। সেই টাকার মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য তারা শিল্প সাহিত্যকে কাজে লাগাতে আরম্ভ করে। বুর্জোয়াদের এই নোংরা প্রচারের হাত থেকে নিজেদের শুদ্ধতা রক্ষা করার জন্যই রোমান্টিকরা শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বকে আরো বেশি আঁকড়ে ধরেন। ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ মতবাদের প্রবক্তা তাহলে বুর্জোয়ারা নয়। বুর্জোয়ারাই বরং শিল্পকে, শিল্প-সাহিত্যকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলো বুর্জোয়া বিপ্লব ও মতাদর্শের পক্ষে। যতো গণ্ডগোলের শুরুও সেখান থেকেই। শিল্পের জন্য শিল্প মতবাদের বুর্জোয়া ইতিহাসটাও এখানে আরম্ভ।
বুর্জোয়া ব্যবস্থায় সৎগুণ, ভালোবাসা, বিশ্বাস, জ্ঞান, চেতনা ইত্যাদি সবকিছু এক কথায় বাণিজ্যের অন্তর্গত হয়ে গেল। নৈতিক কিংবা শারীরিক সবকিছুর একটি ব্যবসায়িক মূল্য দাঁড়ালো। মানুষের পুরানো আবেগ চট করে এই অবস্থাটা মানতে পারছিলো না যে টাকাই হবে সবকিছুর মানদণ্ড। রোমান্টিকরা তাদের সময় বুর্জোয়াদের কেন ঘৃণা করছিলো এ ব্যাপারে বাঁভিলের বক্তব্য ছিলো, বুর্জোয়ারা সবকিছুর ওপর কড়িকে মূল্য দিয়েছে। বুর্জোয়ারা টাকার চেয়ে বড়ো করে আর কিছুই দেখতো না।
পূর্বেই আমরা দেখেছি যখন আধুনিক রাষ্ট্র জন্ম নিচ্ছিলো, তখন শাসকরা আশা করছিলো শিল্প-সাহিত্য রাষ্ট্র বা শাসকদের স্বার্থকে সেবা করবে। রাষ্ট্রের তৎকালীন সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের পক্ষে প্রচার চালাবে। বুর্জোয়াদের এই মনোভাব শিল্পী সাহিত্যিকদের একটা অংশ মেনে নিতে পারেননি।
বুর্জোয়াদের বহু আচার আচরণকেও এঁরা ঘৃণা করতেন। সেজন্য বুর্জোয়াদের কোনোরকম উপকার সাধন করতে তাঁরা চাইতেন না। প্লেখানভ তাই লিখছেন, ‘বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতি যুব রোমান্টিকদের এরূপ ধারণা থাকার ফলে স্বভাবতই তাঁরা উপকারী শিল্পের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। তাঁদের কাছে শিল্পকে ‘উপকারী’ করে তোলার অর্থ ছিল, যে-বুর্জোয়া শ্রেণীকে তাঁরা এতো গভীরভাবে ঘৃণা করে শিল্পকে তাঁদের জন্য উপকারী করে তোলার সমান।'” সেদিক থেকে রোমান্টিকদের এই চিন্তা প্রগতিশীলও বটে।
বুর্জোয়াদের প্রতি রোমান্টিকদের এই ঘৃণার প্রকাশ ঘটেছিলো শুধু তাদের শিল্পকর্ম, বা লেখালেখিতেই নয়। দৈনন্দিন আচার আচরণেও।
বুর্জোয়ারা সাধারণত যে ধরনের পোষাক, বেশবাশ ধারণ করতো রোমান্টিকরা তা সজ্ঞানে বর্জন করে। বুর্জোয়াদের সাথে সবসময় তারা নিজেদের একটি পার্থক্য তৈরির জন্য নানা পথ, পদ্ধতি অনসুরণ করতো। যুব রোমান্টিকদের কাছে লম্বা চুল পরার মতো অদ্ভুত সব পোষাক পরা ছিলো ঘৃণিত বুর্জোয়া এবং তাদের মধ্যকার পার্থক্য প্রকাশের একটি উপায়। বুর্জোয়াদের অতিরিক্ত পরিপূর্ণতার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ।
ইউরোপে কলাকৈবল্যবাদ বা শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্ব দেখা দিলো যখন সমাজের সর্বস্তরে যন্ত্রশিল্প-বিপ্লবের সর্বগ্রাসী প্রভাব পড়লো। বুর্জোয়াদের স্থূল রুচি ও সংকীর্ণতাবোধের সাথে যেসব সংবেদনশীল শিল্পীরা সামঞ্জস্য বিধান করতে পারেননি, বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে তাঁদের বিদ্রোহ একান্ত শিল্প সাধনার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়লো। বুর্জোয়া শাসকদের স্থল মনোভাবের বিপক্ষে তাঁরা কোনো সচেতন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বা জোরালো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি।
ফরাসী বিপ্লবের পরবর্তী ঘটনাসমূহের কারণেই এমনটি ঘটেছিলো। ফরাসী বিপ্লবের পর রোবপিয়েরের পতনের মধ্য দিয়ে নেপোলিয়ন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। নেপোলিয়ান বিপ্লবের মূল বাণী সাম্যকে বাদ দিয়ে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও ফরাসী বিপ্লবের ইতিহাসকে তিনি পিছনে টেনে নিতে পারেননি। সামন্তযুগ আর ফিরে আসেনি।
তিনি নিজে স্বৈরাচারী শাসক হলেও ইউরোপের রাজশক্তিকে ধ্বংস করেছিলেন এবং ভেঙে পড়া পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন। তিনি যেসব দেশ জয় করেছেন সেখানেই ফরাসী বিপ্লবের মূলমন্ত্র বহন করে নিয়ে গেছেন। তিনি কৃষকদের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করেছিলেন এবং বুর্জোয়াদের আকাঙ্ক্ষিত, সামাজিক সমতা দিয়েছিলেন।
নেপোলিয়নের পরাজয়ের পর ফ্রান্সে আবার বুরব রাজবংশ ক্ষমতায় ফিরে এলো। ফ্রান্স তখন মূলত একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে পরিণত হলো। ব্যক্তি স্বাধীনতা অনেকটা হরণ করা হলো, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করা হলো, শিক্ষা-ব্যবস্থা আবার বিশপদের অধীনে চলে গেলো। আঠারশো চব্বিশ সালে অষ্টাদশ লুইয়ের মৃত্যুর পর দশম চার্লস ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেন। রাজশক্তিতে ছিলো তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস। তিনি বিপ্লবের এবং বিপ্লবী আদর্শের ঘোর শত্রু ছিলেন।
চালর্সের রাজত্বের প্রথম থেকেই যাজকদের ও দেশত্যাগী অভিজাতদের ফিরিয়ে এনে অধিক ক্ষমতা প্রদান করা হলো। শিক্ষা ব্যবস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর যাজকদের নিয়ন্ত্রণ পূর্বের চেয়েও বৃদ্ধি পেল। তেমনি এক অবস্থার মধ্যেই, যেখানে সকলের কন্ঠরুদ্ধ; প্রতিকুল সেই আবহাওয়ার মধ্যে দাঁড়িয়েই রোমান্টিক ও পারনেশিয়ানরা শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। নেপোলিয়নের পতনের পর বহু তরুণ শিল্পীর কাছে মনে হয়েছিলো যে, আঠারশো পনেরোর পরের ফ্রান্স বুর্জোয়া ভব্যতায় ফিরে গেছে। এতে তাঁদের মন তিক্ততায় ভরে গিয়েছিলো। সেজন্য এ যুগের শিল্পের মেজাজ ছিলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিষন্ন ও অন্তর্মুখী।
কারণ শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়বার ক্ষমতা বা ইচ্ছা কোনটাই তাঁদের ছিলো না, আবার তা মেনে নিতেও তাঁরা পারছিলেন না। তাই অন্তর্মুখী শিল্প চর্চায় তাঁরা মনোনিবেশ করেন। ফরাসী বিপ্লব তাঁদের মধ্যে যে আকাঙ্ক্ষা জন্ম দিয়েছিলো আর জন্মলগ্ন থেকেই তার যে বীভৎস চেহারা তাঁরা দেখতে পেলেন দুয়ের মধ্যে মিল ছিলো না। বিপ্লব হয়ে দাঁড়ালো বাক্যবাগীশ, লুন্ঠন, ধ্বংস ও হত্যার সংমিশ্রণ। স্বভাবতই তা শিল্পীদের হতাশ করেছিলো।
ফরাসী দেশে আঠারশো তিরিশের বিপ্লবের পর ক্ষমতায় এলো লুই ফিলিপ। লুই ফিলিপ ছিলো বুর্জোয়াদের প্রতিনিধি। তিরিশের এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ফ্রান্সের অভিজাতশ্রেণীকে সম্পূর্ণ পরাজিত করা হলো এবং বুর্জোয়াশ্রেণীর চূড়ান্ত বিজয় ঘটলো। সাংবিধানিক শাসনতন্ত্রের ও প্যারিসের জনতার স্বীকৃতি দিয়েছিলো এই বিপ্লব। এই বিপ্লবেব ফলে সামাজিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য চলে গেল উচ্চমধ্যবিত্তদের হাতে। বিপ্লবের তেরঙা ঝান্ডা আবার ‘ফ্রান্সের পতাকা হলো।
বুর্জোয়াদের এই ক্ষমতা লাভের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন তারা হয়ে উঠলো সর্বেসর্বা তেমনি শ্রমিকশ্রেণীর সাথে তাদের বিরোধও তীব্র হয়ে উঠলো। উচ্চ-বুর্জোয়াশ্রেণী নিজেদের সম্পত্তির অধিকার প্রতিষ্ঠাতেই বেশি আগ্রহী ছিলো। ব্যাংক-মালিক, কল- কারখানার মালিক বা পুঁজির মালিকদের এই শ্রেণীকে মার্কস ফ্রান্সের জাতীয় সম্পদ নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের জন্য গঠিত ‘জয়েন্ট স্টক কোম্পানি’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
মালিকদের শ্রম শোষণে দেশে যেমন অর্থিক সংকট দেখা গেল, তেমনি শ্রম শোষণের কারণে শ্রমিক পরিবারগুলোর দুর্ভোগ মারাত্মক আকার ধারণ করলো। ফ্রান্সের বেশ কিছু লেখক, রাজনীতিবিদ ও চিন্তাবিদ তাঁদের রচনায় এই ব্যবস্থার ত্রুটি ও বৈষম্য সম্পর্কে তীক্ষ্ম মন্তব্য করেন। শিল্পী-সাহিত্যকদের মধ্যে একটি অংশ এই সময় বুর্জোয়াদের পক্ষ অবলম্বন করেন এবং শ্রমিকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয় তাঁদের কলম। রোমান্টিকরা নিরপেক্ষ ভূমিকা গ্রহণের চেষ্টা করে।
শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বের প্রচারকরা যাঁরা বুর্জোয়াদের ঘৃণা করতেন তাঁরা কিন্তু বুর্জোয়া ব্যবস্থার উচ্ছেদ চাননি। বুর্জোয়া কিছু কিছু অভ্যাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেও এই সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের কথা তাঁরা বলেননি। বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেই তাঁরা বুর্জোয়াদের কিছু কিছু দোষ থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিলেন। শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বের ধারক-বাহকরা বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেও সে বিদ্রোহ সমাজের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কাঠামো পরিবর্তনের দিকে সম্প্রসারিত হলো না। থিয়োডর দ্য বাঁভিল সেজন্য বলেছেন, রোমান্টিকরা বুর্জোয়াদের উপর আক্রমণ করেছে তবে সামাজিক শ্রেণী হিসাবে তা বুর্জোয়াশ্রেণীর বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়নি।” মূলত রোমান্টিকদের বিদ্রোহ ছিলো এক ধরনের রক্ষণশীল বিদ্রোহ।
শাসকদের দাবির বিরুদ্ধে তাঁরা এক ধরনের পলায়নপর পথ বেছে নিলেও শাসকদের দাবির বিরুদ্ধে তীব্র কোনো স্রোতধারা তৈরি করতে পারেননি। কোনো ধরনের লড়াইয়ে তাঁরা নামেননি। সে দৃষ্টিকোণ থেকে শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বের এইসব ধারক-বাহকরা একাধারে যেমন ছিলেন বিপ্লবী, তেমনি রক্ষণশীলও বটে। পরবর্তী সময় আমরা শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বের সমর্থকদের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রটিও দেখতে পাবো। বিশ শতকে শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বের ধারকদের চরম প্রতিক্রিয়াশীল রূপটি প্রকাশিত হয়ে পড়ে, যা এই অধ্যায়ের শেষ দিকে আলোচিত হবে।
আঠারশো আটচল্লিশ সাল ছিলো ইউরোপের জন্য বিপ্লবের বছর। আঠারশো আটচল্লিশ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের শক্তিশালী ঝড়ঝঞ্ঝার সময় শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বে বিশ্বাসী অনেক ফরাসী শিল্পী তা দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করলেন। শিল্পের সম্পূর্ণ স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন যে বোদলেয়ার, তিনি এসময় নিজের পুরানো বিশ্বাস থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে তিনি ‘লা স্যালুট পাবলিক’ নামে একটি বিপ্লবী সাময়িকী প্রকাশ করতে শুরু করলেন। তিনি এ সময় শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বকে বালসুলভ বলে মনে করেন এবং ঘোষণা দেন শিল্পের সামাজিক উদ্দেশ্য থাকতে হবে। পুশকিন বা অন্যান্য রোমান্টিকদের শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বের বিরুদ্ধে অনেকেই তাদের লেখনীকে ব্যবহার করেন। শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বের বিরুদ্ধে তখন থেকেই সচেতনভাবে বহু লেখালেখি শুরু হয়।
শিল্পের জন্যই শিল্প এই মতবাদ যেভাবেই আসুক না কেন, তার মূলে এই একটি চিন্তাই থাকে শিল্প সমাজ নিরপেক্ষ। সমাজের কল্যাণ-অকল্যাণ করার কোনো ভূমিকা শিল্পের নেই। তা যখন নেই তখন শিল্পী সামাজিক ন্যায় অন্যায় নিয়েই বা মাথা ঘামাতে যাবেন কেন এবং শিল্প কোনো প্রয়োজন সিদ্ধ করলো কি না এখানে তাও বিচার্য বিষয় নয়। এই চিন্তার বিরুদ্ধেই রাশিয়ায় চেরনিশেভস্কি লিখছেন, ‘
শিল্পের জন্য শিল্পে’র ধারণা হলো ‘সম্পদের জন্য সম্পদ’ ‘বিজ্ঞানের জন্য বিজ্ঞান’ প্রভৃতি ধারণার মতোই আজগুবি। ধন সম্পদ হলো মানুষের উপকারের জন্য। বিজ্ঞানও মানুষকে নির্দেশনা দানের জন্য। শিল্পও তেমনি কোনো নিষ্ফলা আনন্দের পরিবর্তে কিছু প্রয়োজনীয় লক্ষ্যকেই সেবা করবে। তিনি লিখছেন, শিল্পের মূল্য নির্ধারিত হবে তার দ্বারা সমাজে সঞ্চারিত জ্ঞানের মাত্রার উপর। তিনি বলতে চান শিল্প জীবনকে শুধু নতুন করে সৃষ্টি করে না, একে ব্যাখ্যাও করে।
চেরনিশেভস্কির আগে বেলিনস্কি আঠারশো সাতচল্লিশ সালে লিখেছিলেন, জনকল্যাণের উপায় হলো জন-চেতনা আর চেতনা উন্নয়নে বিজ্ঞানের চেয়ে শিল্প কম যায় না। বিজ্ঞান ও কলা সমভাবে অপরিহার্য, কেউ কারো বিকল্প হতে পারে না। চেরনিশেভস্কি বেলিনস্কির ধারণায় বিশ্বাস করতেন। চেরনিশেভস্কি এবং তাঁর অনুগামী দব্রলিউবভের মতে শিল্পের অবশ্য কর্তব্য হলো জীবনকে নতুন করে সৃষ্টি করা এবং জীবন সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করা।”
শিল্প- সাহিত্য প্রসঙ্গে এ ধরনের বক্তব্য বহুজন দিয়েছেন। ফরাসী বিপ্লবের সময় যেমন মার্শিয়া বলেছিলেন, থিয়েটার হলো মানবিক যুক্তিবোধকে শক্তিশালী করার এবং গোটা জাতিকে আলোকিত করার সব থেকে ক্ষমতা সম্পন্ন এবং প্রত্যক্ষ মাধ্যম বা পদ্ধতি।” ফিকটে মনে করতেন, শিল্পের লক্ষ্য শিক্ষা-তবে শুধুমাত্র মনের শিক্ষা নয় বরং শিল্পের লক্ষ্য সমগ্র মানুষটিকে শিক্ষা।” লিও টলস্টয় তার শিল্পের স্বরূপ গ্রন্থে খুবই জোরের সাথে শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বের বিরোধিতা করেন।
ফরাসী দেশে মিশেল ভেবেছিলেন জনগণের থিয়েটারের কথা।
থিয়েটার দর্শকদের কী দিতে পারে সে সম্পর্কে তিনি তার ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘নাট্যশালার মঞ্চে দর্শকদের উপহার দিন তাদেরই নিজস্ব গৌরবময় উপাখ্যান, দেখান তাদেরই নিজস্ব কাজ এবং ক্ষমতাকে। জনগণের মধ্যে আনুন তাদের নিজস্ব বোধ, তাদের জনগণত্ব, থিয়েটার হলো শিক্ষা প্রসারের এক মস্তো অস্ত্র, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পকর্কে যা ঘনিষ্ঠতর করে।””‘
তিনি আরো বলেন, ‘জাতীয় পুনরুজ্জীবন ঘটানোর ক্ষেত্রে থিয়েটার হলো মস্তো বড় আশা। থিয়েটার হবে বিশ্বজনীনভাবেই জনগণের, থিয়েটার জনগণের প্রতিটি চিন্তাভাবনার প্রতিধ্বনি তুলবে’। জাঁ জাক রুশোর ভাবনাও ছিলো একই রকম। মিশেলের ভাবনা মূলত রুশোর ভাবনারই প্রতিফলন। সতেরশো আটান্ন সালে রুশো এরকম একটি প্রস্তাব রেখেছিলেন থিয়েটারকে কেন্দ্র করে। থিয়েটারকে কেন্দ্র করে ধর্মের বিকল্প একটা জায়গা তৈরি করা এবং মানুষের ভিতর জাতীয়তাবোধ গড়ে তোলার কথা তিনিই প্রথম বলেন, যার স্ফুরণ ঘটে ফরাসী বিপ্লবে। পাশাপাশি একথাও সত্য, শিক্ষা প্রচারের উদ্দেশ্যে থিয়েটারকে ‘জনগণের থিয়েটার’ করার উদ্যোগ যথেষ্ট ব্যাপক হলেও তখনো সুসংগঠিত ছিলো না। গণনাট্যের রূপটি কী হবে অনেকেই তা সঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারছিলেন না।
আঠারশো আটচল্লিশের পর নাট্যজগতে আরো নানা ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে নাট্য ইতিহাসের আর একটি যুগ সন্ধিক্ষণের জন্ম হয় এসময় থেকেই। ইতিমধ্যে শিল্প বিপ্লব ঘটে গেছে। বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারে তাই উচ্ছ্বাসপূর্ণ রোমান্টিসিজম থিতিয়ে এলো। সর্বত্রই যুক্তিবাদ পেতে লাগলো পূর্ণাধিকার। থিয়েটারের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও থিয়েটারের লোক হয়ে উঠলো মধ্যবিত্তশ্রেণী, যারা সম্পূর্ণ বাস্তবের মাটিকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। তাই তারা মঞ্চে চাইলো বাস্তব জীবনের যুক্তিপূর্ণ কোনো শিল্পকলা।”
শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে এসময় বাস্তববাদ জায়গা করে নেয়। বাস্তববাদের যুগে শিল্পকে আবার উদ্দেশ্যমূলক ভাবা হতে লাগলো। বলা হলো নাট্যকারদের উচিৎ তার চারপাশের জগৎ ও জীবনের সত্যকার চিত্র নাটকে তুলে ধরা, যে জগৎ-জীবনকে তিনি পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের দ্বারা পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণের মাধ্যমে দেখেন ও জানেন। তাদের উচিৎ সর্বতোভাবে বাস্তববাদী হওয়া।
ইউরোপের বুর্জোয়াশ্রেণীর ক্ষেত্রে, তাদের উত্থানের পর্বে বাস্তবচেতনা ছিল তাদের সামন্তান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে মুক্তির প্রধান তাত্ত্বিক শর্ত। বাস্তববাদী এই নাট্যধারার তাগিদেই থিয়েটার প্রযোজনায় তৈরি হলো চতুর্থ দেয়ালের প্রশ্ন। এতোদিন থিয়েটারের দর্শক যা কিছু দেখেছে শুনেছে, সেটা দর্শকদের দেখানোর ভঙ্গিতেই নির্মিত হতো। বাস্তববাদী থিয়েটারের ভঙ্গি নির্মিত হলো এমনভাবে দর্শকরা যেন ঘরের একখানি দেয়াল সরিয়ে চরিত্রগুলোর অজান্তে তাদের বাস্তব জীবনযাত্রার একাংশ উকি মেরে দেখে নিচ্ছে। এই সময়কার থিয়েটার দর্শকদের উপস্থিতির কথা ভুলে যেতে চেয়েছিলো। মঞ্চের সামনে দর্শক রয়েছে সেটা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মাথায় রাখা চলবে না, দর্শকের সাথে সরাসরি কথা বলা কিংবা চিন্তা আদান-প্রদান করা যাবে না।
কখনও দর্শকের উদ্দেশ্যে কোনো কথা বললে বা কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করলে তৎক্ষণাৎ নাটকের বাস্তবতা লঙ্ঘিত হবে। গ্রীক নাটকের কোরাস যারা সরাসরি দর্শকদের সাথে কথা বলতো কিংবা শেক্সপিয়ারের নাটকের চরিত্রদের স্বগতোক্তি সর্বত্রই বাস্তবতা লঙ্ঘন করছে বলে বাতিল করে দেয়া হলো। থিয়েটারের সাথে তারা দর্শকের অনুভূতিকে একাত্ম করে ফেলতে চেয়েছিলো। নতুন চিন্তা বা আঙ্গিক ভাঙার তাগিদটা এলো সাধারণ মানুষের মুক্তির কথা বলার জন্য। বিজ্ঞানের সাথে মানুষকে পরিচিত করে তুলবার জন্য। ক্লাসিকাল রিয়ালিজম বা রোমান্টিক যুগ পর্যন্ত আমরা দেখে এসেছি শ্রেষ্ঠ কবিরাই ছিলেন শ্রেষ্ঠ নাট্যকার, স্বভাববাদের যুগে এসে দেখা গেলো নাট্যকারদের কবি হবার দরকার নেই। যেমন হেনরিক ইবসেন, জর্জ বার্নার্ড শ ও আন্তন চেখভ।
ধ্রুপদী বাস্তববাদের যুগে শেক্সপিয়ার একরকমের নাটক লিখেছেন কিন্তু তারপর একটা বিরাট পরিবর্তন ধরা পড়ে যখন ইবসেন, বার্নার্ড শ প্রমুখের যুগে এসে পড়ি, দেখি নাটক মঞ্চায়নের উদ্দেশ্য পাল্টে গেছে। কিন্তু উদ্দেশ্য একটা আছেই। শেক্সপিয়ার যে উদ্দেশ্য নিয়ে নাটক লিখতেন; ইবসেন, বার্নার্ড শ-র সময় সম্পূর্ণ অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে নাটক লেখা হতে থাকলো। নাট্য রচনার মূল যে উদ্দেশ্য সেটা তখন পাল্টে গেছে, পাল্টে গেছে নাট্য রচনার ভঙ্গি। শেক্সপিয়ার বাস্তববাদী ছিলেন এবং তাঁর সময়কার মানুষ এবং সমাজ নিয়েই লিখেছেন। ঠিক একইভাবে ইবসেন, বার্নার্ড শ লিখেছেন তাদের সময়কার সমাজ নিয়ে। কিন্তু সমাজটা এতো পাল্টে গেছে যে টকের বিষয়বস্তু এবং আঙ্গিক দুটোই পাল্টাতে হয়েছে নতুন সময়কে ধরার জন্য।
দর্শকের কাছে নাটকের বিষয়বস্তু পৌঁছে দেয়ার জন্য। যখন সারা পৃথিবীতে পুঁজিপতিরা বা বুর্জোয়ারা পুরোপুরি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তখন তাদের প্রয়োজনে নতুন নাটক লেখা হলো এবং সন্দেহ নেই বুর্জোয়াদের সমালোচনা করেও নাটক রচিত হলো। বুর্জোয়া বাস্তববাদ আর শেক্সপিয়ারের যুগ সম্পূর্ণ ভিন্ন। শেক্সপিয়ারের যুগে নাটক মঞ্চায়ন হতো খোলা ময়দানে, বহু দর্শক একসঙ্গে নাটক দেখতো। সেজন্য বাস্তবতাকে চড়া রঙ দিতে হয়েছে, শেক্সপিয়ারের নাটকে তাই প্রচুর খুন-যখম, যুদ্ধ, বারবার তলোয়ার খেলা। সময়ের প্রয়োজনেই, দর্শকের চাহিদার কথা ভেবেই ঘন ঘন নাটকীয়তা তৈরি করতে হয়েছে শেক্সপিয়ারকে-এটাই হলো ধ্রুপদী বাস্তবতা।
বুর্জোয়া বাস্তবতা এর উল্টো, একেবারে অন্য থিয়েটার। নাটক মঞ্চস্থ হলো চার দেয়ালের ভিতর মিলনায়তনে। গরীব মানুষদের সে থিয়েটারে যাবার সুযোগ নেই। কেননা টিকেটের দাম এতোবেশি যে প্রথমেই ইউরোপের শ্রমিকশ্রেণী থিয়েটারে যাওয়া বন্ধ করতে বাধ্য হলো। সুতরাং বুর্জোয়া নাটকে দর্শক বুর্জোয়াশ্রেণী, মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকরা।
ধূমপান বারণ করা হলো মিলনায়তনে, শেক্সপিয়ারের যুগে যা চিন্তাই করা যেতো না। ধূমপান কেন সেখানে মদ্যপানও করতো দর্শকরা। শেক্সপিয়ারের থিয়েটারে কেউ কোনোদিন মঞ্চসজ্জার কথা ভাবেনি। দর্শকদের কল্পনায় বুঝে নিতে হয়েছে ঘটনার স্থান, কাল সবকিছু। কিন্তু বুর্জোয়া থিয়েটারে মঞ্চসজ্জা একটা বিরাট ব্যাপার। শেক্সপিয়ারের সময় একটা খালি, ফাঁকা মঞ্চ, সেখানে একা অভিনেতা চিৎকার করছেন। চরিত্ররা যখন ক্রোধের নানা দিক দেখাতে থাকেন-সবটাই অভিনয়ের মাধ্যমে, সবটাই সংলাপের মাধ্যমে। নানা ধরনের অভিব্যক্তির ভিতর দিয়ে অভিনেতা নাটকের বক্তব্যকে বের করে আনতেন। নানা ধরনের অভিব্যক্তি প্রকাশই ছিলো অভিনয়ের মূল দিক।
শেক্সপিয়ারের থিয়েটারে দর্শক আসতো বাস্তবে যা ঘটে তার চেয়েও বেশি কিছু পাবার কথা ভেবে, কিন্তু ইবসেনের থিয়েটারে দর্শক আশা করতো বাস্তবের হুবহু কিছু। সমকালীন সঙ্কট নিয়ে তাই নাটক লিখলেন ইবসেন। কিন্তু যুক্তি- তর্কের বেড়াজালে সে নাটকের গতি এমনভাবে তৈরি হলো যে, দর্শক মুগ্ধ হয়ে বসে থাকতো। নাটক দেখার সে এক নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা।
বাস্তববাদী নাট্যধারার প্রথম পর্ব হলো ন্যাচারালিজম বা প্রকৃতিবাদ বা স্বাভাবিকতাবাদ কিংবা স্বভাববাদ। প্রকৃতিবাদীরা মানুষের জৈব দিকের উপরই বেশি জোর দিলেন। ন্যাচারালিজম বা প্রকৃতিবাদের প্রথম প্রবক্তা এমিল জোলা। তিনি মনে করতেন প্রকৃতিবাদী নাটক মানেই একখানি বৈজ্ঞানিক নথি বা প্রমাণপত্র। সোজা কথায় জীবনের একটি নির্ভেজাল অংশ।
ন্যাচারালিজমের উদ্দেশ্য ছিলো, বৈজ্ঞানিক যেমন ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন কিংবা একজন শল্য চিকিৎসক যেমনভাবে শব ব্যবচ্ছেদ করে থাকেন তেমনিভাবে জীবন ও বাস্তবতাকে দেখা। উনিশ শতক ধরে যে যন্ত্রনির্ভর পুঁজিতন্ত্র গড়ে উঠেছিলো, তা পুরানো সমাজ ভেঙে ফেলে নতুন শ্রেণীসমূহের জন্ম দিচ্ছিলো। এই নতুন আবির্ভূত শ্রেণীসমূহের মধ্যে সংঘাত ও সংঘর্ষ প্রায় নিত্য নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। এই সংঘাতের পরিমণ্ডলে আঠারো শতকীয় যুক্তিবাদে বা রোমান্টিক ভাবালুতায় নাট্যকারদের পক্ষে আস্থা রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিলো। আঠারশো একাত্তর সালে প্যারী কমিউনের সদস্যরা বুঝলেন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অনুপস্থিতির অর্থই হচ্ছে জীবনের অনুপস্থিতি। শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও এই চিন্তা দেখা গেল। রোমান্টিসিজমের জায়গায় এ সময় আমরা দেখতে পাই খুব দ্রুত বেশকিছু নতুন নাট্যচিন্তা ও নাট্যভঙ্গির উপস্থিতি।
উনিশ শতকের শেষপাদে জীবনকে যথাযথভাবে তুলে ধরা বা জীবন যেমন ঠিক তেমনি দেখানো নাটকের একটি প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। ফরাসী দেশের এমিল জোলা ছিলেন যেমন এর প্রধান প্রবক্তা, তেমনি তিনি থিয়েটারের স্বভাববাদ শিরোনামে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লেখেন। জোলা লিখলেন যে, মানুষকেও মৌলিক পদার্থসমূহের মতো বীক্ষণের আওতায় আনতে হবে এবং তাদের প্রতিক্রিয়াসমূহ লক্ষ্য করতে হবে। জোলার মতে থিয়েটারকে বিকশিত হতে হবে তার স্বাভাবিক শক্তিতে। থিয়েটার সরাসরি বাস্তব থেকে এতোটুকু মিথ্যা বর্ণনা না করে রক্তমাংশের একটা লোককে সোজা মঞ্চে তুলে দেবে। সমস্ত কাল্পনিক চরিত্রদের সেখান থেকে বিদায় নিতে হবে।
থিয়েটার স্বাভাবিক হবে, কোনো মিথ্যা চাতুরি বা ভান না করে সে হবে বাস্তবসম্মত। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মানসিকতা আনতে হবে নাটকে। নতুনতর পদ্ধতি প্রয়োগের সুস্পষ্ট ইচ্ছা নিয়ে জোলা যখন থিয়েটারে এলেন স্বভাবতই বহুজন তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হলেন। জোলার এই পথ ধরে যাঁরা এগিয়েছিলেন তাঁরাই স্বভাববাদী ধারার সাথে সম্পৃক্ত বলে ধরা হয়। প্রথম দিকে স্বাভাবিকবাদী নাটক সমস্ত ধারণাকে স্রেফ উড়িয়ে দিয়ে শুধুমাত্র ঘটনার বিবরণে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতো। সেজন্যই নাটক থেকে নাটকীয়তা বাদ দিতে চাইলেন স্বভাববাদীরা। স্বভাববাদী নাটকের আরম্ভ হয়েছিল উনিশ শতকে। এটা ছিলো এক নতুন পথে যাত্রার সূচনাবিন্দু।
স্বভাববাদের প্রবক্তা এমিল জোলা মনে করতেন, সমসাময়িককালের বৈজ্ঞানিক ও পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক মনোভাব অচিরেই থিয়েটারে প্রভাব বিস্তার করবে এবং থিয়েটারের আমূল সংস্কার সাধনে এটি একমাত্র সম্ভাব্য পথ। তিনি মনে করতেন, থিয়েটারের তাবৎ কর্মকাণ্ডের-পরিচালনা, মঞ্চস্থাপত্য, প্রযোজনা সবকিছুর পরিবর্তন। আবশ্যক। থিয়েটারী পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পর্কে জোলা দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘আমি প্রতিনিয়ত আমার নাটকে এমনভাবে চরিত্রদের পেশাগত জীবনকে মঞ্চে উপস্থাপিত করতে চেষ্টা করেছি যে তারা দর্শকের চোখে যেন অভিনয় না করে জীবন্ত হয়ে ওঠে।** স্বভাববাদী নাট্যধারা আসার আগে পর্যন্ত নাটক ছিলো নাট্যধর্মী।
জীবনকে যথাযথভাবে শিল্পীরা ফুটিয়ে তুলতে চাননি, চেয়েছিলেন তার ভাবসত্যকে ফুটিয়ে তুলতে। স্বভাববাদী নাট্যধারায় নাটক হয়ে উঠলো জীবনের যথাযথ অনুকরণ। স্বভাববাদী নাটকের চরিত্রগুলো অত্যন্ত স্বাভাবিক হওয়া চাই, তাদের কথা বা সংলাপও হবে স্বাভাবিক। এ ছাড়াও তাদের মানসগঠন বা মনোবিজ্ঞানও হবে আজকের দিনের মানুষের মতন, তাদের মানস গঠনের অনুরূপ; যাদের আমরা চিনি-জানি-বুঝি। দৈনন্দিন যাদেরকে চারদিকে দেখতে পাই। বাস্তব জীবনে যেভাবে ঘটনাগুলো ঘটে মঞ্চের ঘটনাগুলো অনুরূপ ঘটবে। স্বাভাবিকতা ক্ষুন্ন করা যাবে না নাট্য রচনা ও পরিচালনায়। এসবই ছিলো স্বভাববাদী নাটকের মূল কথা।
নাটক এ সময় কাহিনী প্রধান হয়ে ওঠে তা গদ্য ভাষায় লিখিত হতে লাগলো। স্বভাববাদী এই নাট্যধারার পরীক্ষা-নিরীক্ষা জোলা এবং গকুর থেকে আরম্ভ করে ইবসেন, স্ট্রিগুবার্গ হয়ে এখনো প্রবাহিত হয়ে চলেছে। এ সময়কার নাট্যকার বা নাট্যচিন্তকরা সচেতনভাবেই পুরানো চিন্তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। পুরোনো বহু কিছু ভেঙে-চুরে অনেক কিছু নতুন করে গড়াই ছিলো এঁদের লক্ষ্য। জোলা বলেন, বিশেষ থিয়েটারের অস্তিত্ব নেই, থিয়েটার আছে একাধিক। নাটকীয় বিষয়বস্তুকে ব্যবহার করার যুগোপযোগী ভঙ্গি যা নিয়ত পরিবতনশীল এবং যা কোনো বাঁধা-ধরা নিয়মের আগড়ে আবদ্ধ নয়।
তিনি বলেন ‘যেহেতু ভঙ্গি পরিবর্তনশীল সেহেতু গতকালের অচল ভঙ্গির বৈপরীত্যে আগামী কালের নতুন ভঙ্গির অন্বেষণের স্বাধীনতা প্রত্যেকের আছে।”** তিনি বলেন, এক কথায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করেই বর্তমান সমাজকে উপলব্ধি করতে হবে। হাউস্টমান যিনি ছিলেন এমিল জোলার যোগ্য শিষ্য তিনি মন্তব্য করছেন, যেসব ক্ষেত্রে আমরা নাট্য ভঙ্গিতে জীবন গড়ে তুলতে পারি না, সেসব ক্ষেত্রে কি আমাদের শিল্প ভঙ্গিকেই জীবনের মতো আত্মস্থ করতে পারা উচিৎ নয়? স্বভাববাদের আগে নাটকে যেসব পরিবর্তন এসেছে, যেভাবে নাটক একধারা থেকে অন্য ধারায় চলে গেছে তা ছিলো অনেকটা স্বতঃস্ফূর্ত বিবর্তনের এক ধারা।
নাট্য ইতিহাসে এই প্রথম আমরা সচেতন বিদ্রোহ দেখি নাটককে এক ধারা থেকে অন্য ধারায় নিয়ে যাবার জন্য। স্বভাববাদী এই নাট্যচিন্তা থেকেই নাট্যনির্মাণের সচেতন প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। শুধু নাটক লেখা নয়, নাটকের প্রকৃতি নিয়েও চিন্তা-ভাবনা শুরু হলো। নাটকের উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হলো নানা মত ও পথের।
স্বভাবধর্মী নাটকের উদ্দেশ্য হলো বাস্তব জীবনের যথাযথ অনুকরণ। বলা যেতে পারে যা পরিচিত, যা প্রাত্যহিক, যা স্বাভাবিক তাকে উদ্ঘাটন করাই হলো এই নাটকের দর্শন। যে বাস্তব স্থুল, রুক্ষ, কুৎসিত ও কলুষিত তাই বাস্তববাদীদের অতি প্রিয়। মুটে, মজুর, মিস্ত্রি, কসাই, দালাল, বেশ্যা ইত্যাদি-এরাই হলো বাস্তব নাটকের চরিত্র।
এদের জীবনের সমস্যা ও সংগ্রাম, বিকৃতি ও দুর্নীতি, বেদনা ও ব্যর্থতা নাটকের মধ্যে অত্যন্ত সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে অঙ্কিত হতে থাকে। যে জীবন আমরা দেখতে চাই না অথবা যে জীবন নিষ্ঠুরভাবে সত্য, তাই বাস্তববাদী নাটকের মধ্যে চিত্রিত হয়। স্বাভাবিকতাবাদী নাট্যচিন্তা আগমনের সাথে সাথে সকল কিছুই নাটকের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ালো। হাসপাতাল, ব্যাংক, কয়লাখনি, বস্তি, কোটিপতির বাড়ি, শেয়ার মার্কেট, কারখানা, গুঁড়িখানা, বেশ্যালয়-বাস্তব বলতে যতদূর চোখ চলে সবকিছুই থিয়েটারে তুলে আনা হলো।
সামাজিক জীবনের প্রতিটি কানাগলি, চোরাগলি নাটকের বিষয়ের মধ্যে চলে এলো। থিয়েটারের তখন প্রধানতম আগ্রহ হলো বাস্তব জীবনের সব ঘটনাকে নাটকে জড়ো করা, তার যথাযথ চিত্র নাটকে তুলে ধরা। নাটকীয়তা বর্জন করা। স্বভাববাদী নাট্যপ্রক্রিয়া সব কিছুতেই এমন স্বাভাবিকত্ব বজায় রাখে যে দর্শক তাঁর বিচার বিবেচনা, কল্পনাশক্তি এবং আবেগ দ্বারা সেখানে কোনো হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পান না। পরিবর্তে দর্শক নিজেই এমন নিমগ্ন ও একাত্ম হয়ে যান যে তিনি নিজেই হয়ে ওঠেন বস্তু।
স্বভাববাদের এই ধারা খুব দ্রুত ইউরোপকে গ্রাস করলো। ব্রাহাম এই নতুন শিল্পের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে বলেন, নতুন শিল্পরীতি হলো একটি কথায় সত্য। অভিনেতার কাজ হলো দর্শকের কাছে অতি সরলভাবে বাস্তব মানুষের পরিপূর্ণ চেহারা তুলে ধরা। বিশেষ থিয়েটারী ভঙ্গিতে সাজানো মানুষ নয়, কেবলমাত্র বিশ্বাসযোগ্য মানুষ। দৈনন্দিন জীবনের বিশ্বাসযোগ্য বাস্তব।” জোলা বললেন, পবিত্র বিশুদ্ধ নীতিবান নায়কেরা কেবলই জিতে যায় এবং নীতিবিবর্জিত খলনায়কেরা প্রভৃত চক্রান্ত করেও কেবলই হেরে যায় অথবা আকস্মিকভাবে তাদের হৃদয়ের পরিবর্তন ঘটে-এসব আর চলবে না। তা দর্শকদের ক্লান্তিই উৎপাদন করছে।
নতুন ধরনের নাটক দরকার যা হবে বাস্তবধর্মী ও বৈজ্ঞানিক চিন্তায় ভরপুর। নায়ক-নায়িকার চেয়ে নর-নারীই চরিত্র হিসাবে তাঁদের কাছে গুরুত্ব পেল। কোনো অসাধারণত্ব নেই এমন মানুষদেরই সেখানে জায়গা হলো। পূর্বে রাজা বাদশার চরিত্রের পাশাপাশি যে সাধারণ মানুষের চরিত্র ছিলো না তা নয়, তবে তারা নাটকে কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে আসতে পারেনি, ঘটনার কেন্দ্রে তারা ছিলো না। প্রকৃতিবাদ সাধারণ মানুষকেই ঘটনার কেন্দ্রে নিয়ে এলো।
নতুন এই নাট্যরীতি স্বাভাবিকতাবাদ সম্পর্কে বহু সমালোচকই বলেছিলেন মঞ্চে একে প্রতিষ্ঠা দেয়া অসম্ভব। সেইসব সমালোচনাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে স্বাভাবিকতাবাদ শীঘ্রই স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত হলো। যদিও স্বাভাবিকতাবাদ বা প্রকৃতিবাদ খুব অল্প সময়ই নাটকের ইতিহাসে তার আধিপত্য বজায় রাখতে পেরেছিলো, তবে এই ধারাই নতুন নতুন সব নাট্যধারার পথ বাতলে দেয়, নাট্য ইতিহাসে এক নতুন পথ, পদ্ধতির সৃষ্টি করে। স্বাভাবিকতাবাদ থেকেই খুব দ্রুত জন্ম নেয় বাস্তববাদ বা •রিয়ালিজম। বাস্তববাদ হলো স্বাভাবিকতাবাদেরই এক বিবর্তিত বা উন্নত রূপ। ব্রেন্ট এ সম্পর্কে লিখছেন, স্বাভাবিকতাবাদ বেশিদিন ধোপে টিকলো না। রাজনীতিজ্ঞদের কাছে এটা মনে হলো নিস্তরঙ্গ এবং শিল্পীদের কাছে বিরক্তিকর, তাই তা এসে দাঁড়ালো বাস্তববাদে।
সমাজচিন্তা থেকে উদ্ভব স্বভাববাদী জোলার থিয়েটারের মধ্যেই ছিলো বাস্তব থিয়েটারের আসন্ন সম্ভাবনা। ইবসেনের থিয়েটারের সমাজচিন্তা সেই আসন্ন সম্ভবকে বাস্তবসত্যে পরিণত করলো। পরবর্তীকালে এই সমাজচিন্তা অধিকতর ঘনত্ব অর্জন করে আরও সুসংহত হয়ে উঠেছিলো। জার্মানীর এপিক থিয়েটারের ভিত্তিমূলেও আছে এই স্বভাববাদের অবদান। ব্রেন্ট নিজেই স্বীকার করে বলেন, মহাকাব্যিক নাট্যধারার সূত্রপাত স্বভাববাদ থেকেই।
ইতিহাস অনুসরণ করলে দেখা যায়, বাস্তববাদী থিয়েটার সমাজনীতিগত ও সমাজবুদ্ধিগত দ্বন্দ্বের সঙ্গে ক্রমশই ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে পড়েছে। থিয়েটার দেখার যে অবসরের আনন্দ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দর্শক সে আনন্দ পেতে চেয়েছেন তাঁদের নিজেদের দ্বন্দ্ব সমস্যার মঞ্চ প্রতিফলনের মাধ্যমে।
সে সময় ইউরোপের থিয়েটারের বাস্তববাদীরা তাঁদের থিয়েটারে এমন একটি রূপ তুলে ধরলেন, যে রূপের মাধ্যমে শুধু যে মঞ্চ ও সমাজের যোগাযোগটি স্পষ্ট হয়ে উঠলো তা নয়, সমস্যার বিভিন্ন দিক জীবন্ত আলোচনাকক্ষ রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে অভিনয়ান্তে দর্শকদের সেই সমস্যাকে বিচার করার যোগ্যতা এনে দিলো। সেদিনের ইউরোপে বিশৃঙ্খল ও বিচ্ছিন্ন দর্শকচেতনার পক্ষে সমাজসত্যকে উপলব্ধি করা যে খুবই প্রয়োজন, যুক্তির অনুসরণ করাই যে প্রধান পথ-এই সত্য সেদিনের বাস্তব-থিয়েটারবাদীরা ভালো করেই হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন।
বাস্তববাদী নাটক হলো শিল্পের সঙ্গে বাস্তব জগতের যোগ আর বাস্তববাদী মাধ্যম হলো বাস্তব ঘটনার কার্যকারণ সম্বন্ধে শিল্পীর সচেতন ব্যাখ্যা। ঐতিহাসিক গতিকে ব্যাখ্যা করেই শিল্পী মানুষের কাছে বাস্তব ঘটনার উপস্থাপনা করেন। বিশ্লেষণ তাই বাস্তববাদী নাট্যের প্রধান লক্ষণ। বহু যুগ আগে এরিস্টটল একই কথা বলেছেন, তিনি বলেন, শিল্প অবশ্যই বস্তুকে ব্যাখ্যা করবে, হয় তারা যেমন আছে অথবা তাদের যেমনটি হওয়া উচিৎ, যেমনভাবে চিন্তন করা উচিৎ তেমনভাবে। শিল্পের ভূমিকা এখানে দুটি; হয় জীবন যেমন তেমনি শিল্পে প্রকাশিত হওয়া অথবা জীবন যেমন হওয়া উচিৎ, তেমনিভাবে স্রষ্টার সৃষ্টিতে বিকশিত হওয়া।
বাস্তববাদী শিল্পকে অবশ্যই বস্তুবাদী মাধ্যমকে বাহন করতে হবে। বাস্তববাদের বিস্তারিত আলোচনায় যাবার আগে আমরা প্রকৃতিবাদ সম্পর্কে আরো দু একটা বিষয় জানতে চেষ্টা করবো। যেমন প্রকৃতিবাদ-এই ভঙ্গি আবিষ্কারের পেছনে মূলত কী চিন্তা কাজ করেছিলো, কেন তার আর্বিভাব অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিলো উনিশ শতকের শেষ পাদে? কারা এই ভঙ্গিকে সাধুবাদ বা স্বাগত জানিয়েছিলো? কেনই বা খুব বেশিদিন এ ধারা টিকে থাকতে পারলো না?
স্বভাববাদী নাট্যধারার শুরু হয়েছিলো আসলে কোথা থেকে? আঠারশো চল্লিশ সালে ডেভিল হিল নামক এক ভদ্রলোক ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে বসলেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিকে যে ধরে রাখা যায় এটা জানতে পেরে মানুষ উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলো। বাস্তবকে অনুকরণ করাও শুরু হলো। পাশাপাশি যে ঘটনাটি ঘটে, আঠারশো একাত্তর সালে প্যারিস কমিউন গঠনের মাধ্যমে শ্রমিকশ্রেণী কয়েক মাসের জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে।
এই রাজনৈতিক ঘটনায় শ্রমিকরা বা নীচুতলার মানুষরা শিল্পী-সাহিত্যিক- বুদ্ধিজীবীদের নজর কেড়ে নেয়। নীচুতলার মানুষরাও যে বিরাট বিরাট ঘটনার নায়ক ‘হয়ে উঠতে পারে এই ঘটনার মধ্য দিয়ে তারই প্রমাণ ঘটে এবং তা শিল্পী- সাহিত্যিকদের চিন্তাকে ভীষণরকম প্রভাবিত করে। নীচুতলার এই মানুষদের শিল্প- সাহিত্যের কেন্দ্রে আনতে হলে রাজা বাদশার আঙ্গিনা ছেড়ে স্বভাবতই থিয়েটারকে
ঢুকে পড়তে হয় সাধারণ মানুষের জীবনে। শ্রমিকদের কুঁড়ে ঘরে উকি দেয় সে, হাজির হয় পুলিশ কার্যালয়, বিচারালয় কিংবা বেশ্যালয়ে। নাটকের বিষয়বস্তু পাল্টাতে গিয়েই নতুন চিন্তা, সেই সাথে নাটকের নতুন আঙ্গিক জন্ম নেয়। শাসকশ্রেণীর আধিপত্য শিল্প-সাহিত্যে প্রভাব ফেলতে বাধ্য এ কথা আমরা আগেই বলেছিলাম। ফলে যে শ্রমিকশ্রেণী সামান্য সময়ের জন্য হলেও শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলো তারা যে শিল্প-সাহিত্যে তাদের প্রভাব বিস্তার করবে এটাই তো ইতিহাসের স্বাভাবিক ঘটনা। তাই প্যারিস কমিউনের মধ্য দিয়ে শ্রমিকশ্রেণী তার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রেখে গেল শিল্প- সাহিত্যে।
সাধারণ মানুষের কাছে সাধারণ মানুষের থিয়েটারকে পৌঁছে দেয়ার জন্য এই সময় থেকেই গণনাট্যের ধারণাও শক্তিশালী হতে শুরু করে। ফ্রান্সে যে-ব্যক্তি প্রথম পিপলস থিয়েটার বা গণনাট্যের আদর্শ অনুভব করতে পেরেছিলেন তাঁর নাম মরিস পত্তিসের। প্যারিস কমিউন বা আঠারশো একাত্তর সালের শ্রমিক বিপ্লবকে ঘিরেই যেমন ন্যাচারালিজমের জন্ম তেমনি এইসব ঘটনাকে কেন্দ্র করেই থিয়েটারে জনগণ ও রাজনীতির বিষয়টি গুরুত্ব পেলো। নাট্যজগতে এক বিরাট আলোড়ন তুলেছিলো ঘটনাটি। নাটক নিয়ে নতুন করে চিন্তা ভাবনা শুরু হলো। সাধারণ মানুষের স্বার্থকে মাথায় রেখে নাটক লেখা ও মঞ্চায়িত হওয়ার ব্যাপারটি এ সময় থেকেই গুরুত্ব পেতে থাকলো।
পাশাপাশি এ কথাও সত্যি, শ্রমিকশ্রেণীর রাষ্ট্র যেমন খুব শীঘ্র মুখ থুবড়ে পড়েছিলো, তেমনি ন্যাচারালিজমের ধারণাও খুব শীঘ্রই বাতিল হয়ে যায়। কারণ ন্যাচারালিজম জীবনকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্লেষণ না করে জীবনের যথাযথ ছবি তুলে ধরতে লাগলো। চোখ ঝলসানো মঞ্চসজ্জার কোনো ব্যাপার এখানে নেই। সাধারণ বিষয়, সাধারণ ঘটনা, সাধারণ রীতিনীতি, সমাজের গড় একটা ঘটনা, যা এতোই শূন্যগর্ভ, এতোই তাৎপর্যহীন যে চার ঘণ্টা ধরে তা দেখার পর দর্শক স্বভাবতই প্রশ্ন করতে পারেন এর সঙ্গে তাঁর জীবনের সম্পর্ক কী? স্ট্রিওবার্গের মতে চারঘন্টা ধরে সে নাটক দেখাটাও ছিলো যন্ত্রণাদায়ক।
ফটোগ্রাফের কাজ কোনো কিছুই’ বাদ দিতে চায় না, এমনকি ক্যামেরার লেন্সে পড়ে থাকা এক কণা ধুলোরও এখানে রেহাই নেই, স্বাভাবিকতাবাদী নাটকও হলো তাই। স্বাভাবিকবাদীরা মনে করেন প্রকৃতির কোনো এক খণ্ডাংশের বর্ণনাই হলো শিল্প। প্রশ্ন হলো, সে বর্ণনা যদি মানব সভ্যতার বিকাশকে ব্যাখ্যা করতে না পারে কিংবা মানব সমাজের বিকাশের স্বার্থে কাজে না লাগে তাহলে তার মূল্য কী?
পথে-ঘাটে প্রতিদিন যা কিছু দেখতে পাওয়া যায় তার সবকিছুই মানুষ দেখতে ভালোবাসে না। মানুষ দৈনন্দিন জীবনে যা দেখছে তাকে আবার হুবহু মঞ্চে তুলে আনার কোনো অর্থ নেই। মানুষ নাটকে দেখতে চায় ঘটনার নির্যাসটুকু। নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ দেখিয়েছেন যে, রাস্তা ঘাটে প্রতিদিন যা ঘটছে তা দেখে জীবনকে বুঝতে যাওয়া কয়েকটা প্রতিবাদ সভার ছবি দেখে জনগণের সমস্যা বুঝতে যাওয়ার মতোই
অর্থহীন। ফ্রান্সে সেই সন্ত্রাসের দিনে সংঘটিত সবগুলো হত্যাকাণ্ডের ছবি জোগাড় করে তা হাজারবার দেখলেও বিপ্লবের প্রকৃত অর্থ অবোধ্যই থেকে যাবে। জীবনে ঠিক যেমন যেমন ঘটে, তার প্রকৃতপক্ষে কোনো মানে নেই। একটা পুলিশকর্মী তিরিশ বছর রাস্তায় দাঁড়িয়ে বা পারির আদালতে বসে খুব খেয়াল করে দেখেও এ বিষয়ে যতোটা বুঝবে, একটা বাচ্চা ছেলে বা কোনো সন্ন্যাসিনী ব্রিয়র একটা মাত্র নাটক দেখেই তা বুঝে যাবে। কারণ ব্রিয়র কাজই হলো প্রতিদিনের ধুন্দুমার কাণ্ড থেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটিকে ছেঁকে বার করে এমনভাবে তা সাজানো, যাতে এই সমস্ত ঘটনার পারস্পরিক সম্পর্ক একটা তাৎপর্য পায়।
মানুষ উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনা পছন্দ করে যা ইতিহাসে প্রতিদিন ঘটে না। মহৎ নাট্যকাররা রচনাশৈলীর মধ্য দিয়ে সেইসব উত্তেজনাকে মঞ্চে হাজির করতে চায়, স্বাভাবিকবাদীরা যার বিরুদ্ধে। সেজন্যই স্বাভাবিকতাবাদী নাট্যধারার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হলো। সমালোচকরা বলতে শুরু করলেন, এগুলো অসার এবং সামাজিক চেতনাশূন্য। ব্রেশটের ভাষায়, স্বভাববাদী থিয়েটারে এমন বিশেষ কিছু পাওয়া যায়নি যা থিয়েটারের বাইরে পাওয়া যেতো না। পিসকাটর লিখেছিলেন, স্বাভাবিকতাবাদ জনগণের দাবিগুলোকে তুলে ধরার থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। এবং অবশ্যই মানতে হবে, স্বাভাবিকতাবাদ বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন নয়, অধুনিক অর্থে মার্কসীয় নয়।
জীবন সম্পর্কে যেখানে আমাদের উত্তর পাবার কথা, সেখানে শুনেছি জীবন সম্পর্কে শুধু আর্তনাদ। তিনি লিখছেন, স্বাভাবিকতাবাদ যুগের একটা ভগ্নাংশ, বিশ্বচিত্রের একটা খণ্ড; কিন্তু কখনই পুরোটা নয়। সমস্ত যুগের শিল্পের মধ্যে আছে সরল আর প্রত্যক্ষ • ব্যক্তিগত ভাবাবেগ। শিল্প ব্যক্তির ভাবপ্রবণ অংশকে প্রকাশ করে এক বিশেষ ধরনে। শিল্প চিরকালই মানুষের ব্যক্তিত্ব, সহজাত প্রবৃত্তি, ভাবপ্রবণতা, অর্থনৈতিক ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন। কিন্তু স্বভাববাদী ধারায় এই ধরনের কোনো প্রতিফলন প্রকাশ করা অসম্ভব। কারণ-সত্য, আর কিছু নয় শুধু সত্য; এই হলো স্বভাববাদের মূল কথা। কিন্তু সকল সত্যই পাল্টে যায় স্থান কালের প্রেক্ষিতে।
রজার গ্যারডি ফরাসী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এক বিরল ব্যক্তিত্ব। প্রকৃতিবাদকে তিনি মানবতাবিরোধী বলেছেন, কেননা, প্রকৃতিবাদ মানব প্রকৃতির বিভিন্ন সম্পর্ককে যথাযথ বিশ্লেষণ না করে শুধুমাত্র ঘটনার বিবরণ দিচ্ছে। রাষ্ট্রের সাথে, সমাজের সাথে মানুষের সম্পর্কের, তা যে-শ্রেণীরই হোক বা ব্যক্তিগতই হোক, কারণ অনুসন্ধানের পথে এ নাট্যধারা পা বাড়ায়নি।
এ ভাবেই স্বভাববাদী ভঙ্গির দোষ ত্রুটি ধরা পড়তে লাগলো। প্রশ্ন উঠলো জীবনকে কি যথাযথ তুলে ধরা সম্ভব? জীবনতো শুধু ঘটনা স্রোত নয়, জীবন বলতে একটা যুগের চিন্তাভাবনা, ধ্যনধারণা স্বপ্ন-সাধনা সব। জ্ঞান বাদ দিয়ে, অভিজ্ঞতা বাদ দিয়ে, পূর্বে আহরিত তথ্য বাদ দিয়ে, কল্পনা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র চোখের ওপর নির্ভর করে কি সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা যায়? স্বাভাবিকবাদী থিয়েটারে সবকিছু এতোই স্বাভাবিক যে কারো পক্ষে দাঁড়িয়ে কিছু বিশ্লেষণের অবকাশ ছিলো না।
এই থিয়েটার জনগণের কল্যাণের স্বার্থেই কাজ করছিলো, যদিও জনগণের স্বার্থ প্রতিফলিত করার সঠিক পদ্ধতি এই থিয়েটারে ছিলো না। সমালোচকরা ব্যাপারটাকে এভাবেই দেখেছিলেন। ব্রেশট তার এক রচনায় স্বভাববাদ সম্পর্কে লিখলেন, ‘যতই শিল্প উন্নত হবে ততই জীবনকে দেখতে গেলে বাস্তবজীবন থেকে কম সাহায্য নিতে হবে। একথা সত্য যে আমরা বাস্তবজীবন থেকে ঘটনার অনুকরণ করি কিন্তু সেটা ছাড়াও আরও আছে। শুধু ঘটনা নিয়ে কি হবে? আসল কথা হচ্ছে ঐ অনুকরণ করার পিছনে আমাদের কারণটা কি? তিনি আরো লিখছেন, অনুকরণকে উদ্দেশ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করলে আর থিয়েটার বস্তুটার অস্তিত্ব থাকবে না।
নাটক করার পেছনে উদ্দেশ্যটাই আসল। নাটক সম্পর্কে এ্যারিস্টটলের চিন্তা ছিলো, যা হয় তাকে হাজির করা নয়, যা হওয়া উচিৎ তাকে দেখানো। ইতিহাসের সঙ্গে নাটকের ধারণাকে তিনি এই সুবাদেই আলাদা করেছেন। প্রকৃতিবাদীরা সেক্ষেত্রে জোর দেন যা হয় তার ওপরে, তার যে কোনো রদবদল হতে পারে সেটা দেখানোর দায় তারা বোধ করেননি। প্রকৃতিবাদী নাটক সম্পর্কে স্ট্রিগুবার্গ লিখেছিলেন, মানুষ নাটক দেখতেই আসে, হুবহু জীবনচিত্র দেখতে আসে না। সুতরাং বাস্তবতার নামে এমন কোনো সীমারেখা টানা উচিৎ নয় যাতে করে দর্শকদের পূর্ণ পরিতৃপ্তি লাভে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। সামগ্রিকভাবে ন্যাচারালিজম কিন্তু তার দায়িত্ব থেকে বিচ্যুত হয় না।
বরং এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনের মুহূর্তে ন্যাচারালিজম থিয়েটারকে নিয়ে যায় একটি রাজনৈতিক চিন্তার মঞ্চে। ১০ যখন থিয়েটারকে আমরা স্বভাববাদ না বলে বাস্তববাদ বলতে আরম্ভ করি। স্বভাববাদ এভাবেই নিজেকে বাস্তববাদে উত্তীর্ণ করে এবং স্বভাববাদের পরিবর্তে বাস্তববাদ নাট্য ইতিহাসে জায়গা করে নেয়।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কয়েকজন উল্লেখযোগ্য নাট্যকার বাস্তববাদী ধারায় নাটক লিখে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। বাস্তববাদীরা শুধু কী হয় তাই দেখাননি, কী হওয়া উচিৎ তাও দেখাতে চেষ্টা করেছেন। যা আছে তার বর্ণনা দেওয়া এবং একই সাথে অন্তলীন কারণসমূহের অনুসন্ধান করা। যদিও উচিৎ-অনুচিৎকে তাঁরা দেখেছেন নিজ নিজ চিন্তার আলোকে, প্রচলিত নানা বিশ্বাস ও তার বিরুদ্ধমতের আলোকে। প্রচলিত নীতিবোধ দ্বারা তাঁরা যেমন প্রভাবিত হয়েছিলেন, তেমনি আবার নতুন মূল্যবোধ নীতিবোধের জন্ম দিয়েছিলেন। সামাজিক দ্বন্দ্বকেই তাঁরা মূল বিষয়বস্তু হিসাবে গ্রহণ করেন। তাঁদের নাটকগুলো নাট্য ইতিহাসের প্রথম রাজনৈতিক চিন্তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসাবে বিরাজ করছে।
গোড়া থেকেই এ নাট্যধারা যেসব সমস্যার বোঝা মাথায় নিয়ে এগুতে থাকে তা অতীতের কোনো নাট্য সাহিত্যে ছিলো না। অতীতের নাটকে যে রাজনৈতিক ও সামাজিক উদ্দেশ্য প্রচ্ছন্ন ছিলো তা এসব নাটকে প্রত্যক্ষভাবে বলা হতে থাকে। তাই এ ধরনের নাটকে দ্বন্দ্ব শুধু ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে নয়; ব্যক্তির সঙ্গে, বিশেষ করে নাটকের নায়কের সঙ্গে এখানে দ্বন্দ্ব সামাজিক প্রতিষ্ঠানের। বাস্তবধর্মী নাটকে সমাজসত্তার সঙ্গে ব্যক্তির একটি সজাগ ও সক্রিয় সম্পর্ক স্থাপন করা হয়।
সমাজনিরপেক্ষ ব্যক্তিত্বের কোনো মহিমা বাস্তববাদী নাটকে নেই। সমাজের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তির ক্রিয়াবিক্রিয়ায় মানবচরিত্রের যে বিশেষ বিশেষ ভাব ও কর্মরূপ পরিস্ফুট, তার পরিচয়ই আধুনিক বাস্তববাদী নাটকে প্রকাশিত হয়। ব্যক্তিসত্তা সমাজ-পরিবেশের অধীন বলে এখনকার অনেক নাটকে কোনো বিশেষ ব্যক্তি আর অনন্য প্রাধান্য লাভ করে না, সেজন্য সেসব নাটকে এক নায়কের স্থলে বহু নায়ক দেখা যায়। ব্যক্তির পরিবর্তে ঘটনা নায়ক হয়ে দাঁড়ায়।
বাস্তববাদী নাটক ভাবতে আরম্ভ করে যে থিয়েটার নিছক আমোদ প্রমোদের স্থান নয়। বৃহৎ একটি দায়িত্ব তার রয়েছে। বাস্তবধর্মী নাটক হৃদয়বৃত্তি অপেক্ষা মনন ও বুদ্ধিবৃত্তির স্তর অবলম্বন করে বলে নানা বির্তক ও বিচার এই নাটকে অবতারণা করা হয়। সমাজ সম্বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সমাজের নানা রীতিনীতি, প্রথা ও সংস্কার সম্পর্কে কোনো বিশেষ প্রতিক্রিয়া ও মতবাদ নাটকের চরিত্রের মুখে ব্যক্ত হওয়া সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ব্যাপার। এই ধারার নাট্যকারদের মধ্যে যাঁদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাঁরা হলেন ইবসেন, হাউস্টমান, ভিক্টর উগো, চেখভ, বার্নার্ড শ, গোর্কি, গলসওয়ার্দি প্রমুখ। যুক্তিবাদী নাট্যকার হিসাবেই এরা স্বীকৃত।
নবধারা সৃষ্টিতে এঁদের রয়েছে ভীষণ অবদান। রোমান্টিক নাটকে যেমন শেক্সপিয়ার, তেমনি আধুনিক বাস্তববাদী নাটকে ইবসেন একটি যুগের স্রষ্টা। ইবসেন তাঁর নাটকের উপাদান গ্রহণ করেছিলেন সাধারণ লোকের দৈনন্দিন জীবন থেকে। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা, সামাজিক প্রথা ও জীবন-ধারার সঙ্গে ব্যক্তি সত্তার সংঘাত ও সংগ্রাম তাঁর নাটকের প্রধান দিক। সমসাময়িক সামাজিক সমস্যাগুলির দিকে তাঁর প্রখর দৃষ্টি ছিলো।
ইবসেনের নাটকে এমন সমস্ত সমস্যা আনা হয় যেগুলি তার আগে মঞ্চে দেখানো প্রায় নিষিদ্ধ ছিলো। ইবসেন নির্ভীকভাবে সেইসব সমস্যার ওপর গুরুত্ব দিয়ে নাটক লিখলেন। ইবসেনের সমাজসংস্কারের ধারণা ছিলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক। তিনি যে বিপ্লবের কথা বলেন তা মানবতার বিপ্লব। সমাজের উন্নতি করতে গেলে, তিনি বিশ্বাস করতেন প্রথমে মানুষের নিজেকে উন্নত করতে হবে। ইবসেন তাঁর নাটকে এমন সমস্ত সামাজিক সমস্যা নিয়ে এলেন যেগুলি নাটকের উপজীব্য হতে পারে বলে আগে কেউ চিন্তাই করেননি। চপলতার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ আভিযান চালানোর জন্য তিনিও সমস্তরকম কৃত্রিমতার পথ পরিহার করলেন।
ইবসেনের আর্বিভাবের ফলে ফরাসী চটুল নাটকের প্রভাব ইউরোপ থেকে তিরোহিত হলো। তিনি তাঁর যুগের জন্য বৈপ্লবিক চিন্তা নিয়ে এসেছিলেন। সমাজের নানা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। তিনি মানব সমাজের দোষ ও দুর্নীতিগুলি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে বিশ্লেষণ করলেন, ভ্রান্ত ধারণা ও আদর্শসমূহকে কঠোর আঘাতে বিচলিত করলেন, ভণ্ডামি ও সর্বপ্রকার সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষণা করলেন। বলা হয়ে থাকে, জীববিজ্ঞানে ডারউইনের মতবাদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে নিউটনের তত্ত্ব যে বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলো তেমনি এক বিপ্লব এনে দেয় ইবসেনের নাটক ইউরোপের নাট্য-জগতে।
নাট্যকার ইবসেন ও নাট্যকার বিয়নসন দুজনেই ছিলেন নরওয়েবাসী এবং দুজনেই বাস্তববাদী নাট্য রচনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। রাজনৈতিক চিন্তাধারায় দুজনেই ছিলেন বিদ্রোহী। বিয়নসন রাজনৈতিক দলের নেতা ছিলেন এবং ইবসেন কিছুকালের জন্য সমাজতন্ত্রী ছিলেন। দুজনেই তৎকালীন সামাজিক ও নৈতিক পাপের উপর আক্রমণ চালিয়ে গেছেন। দুজনের মধ্যে পার্থক্যও লক্ষণীয়। সকল ক্ষেত্রে নানা সুচিন্তিত বাস্তব সমস্যা তুলে ধরলেও বিয়নসন নাটকের সমাপ্তি সুখময় করতেন যা ইবসেনের মধ্যে ছিলো না। তিনি নির্মম সত্য উদ্ঘাটিত করেছেন এবং চরম পরিণতি দেখিয়েছেন। ইবসেনের নাটক আধুনিক এবং বাস্তববাদী, তবে তা বাস্তবের হুবহু চিত্রাঙ্কনের জন্য নয়।

পরিবেশের বাইরেও আছে সমাজ সত্য, আছে জীবন সত্য, আছে মানস গঠন এবং ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের অমোঘ স্বীকৃতি-যা ইবসেনের নাটকে খুঁজে পাওয়া যায়। আধুনিক নাটকের এক যুগান্তর হলো ইবসেন থেকেই যার মূল তাৎপর্য সমাজকে এবং ব্যক্তিসত্তাকে সম্পূর্ণ মোহমুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ও যুক্তিবাদ দিয়ে বিশ্লেষণ করা। সমাজের সাথে ব্যক্তির বিরোধ তৈরি করে এভাবেই তিনি নাটককে রাজনৈতিক করে তুললেন। ইবসেনের চিন্তাধারা ও সিদ্ধান্তের সাথে আজকের দিনে সবাই একমত নাও হতে পারেন, তবে তাঁর যুগে তিনি বৈপ্লবিক চিন্তাধারা নিয়ে এসেছিলেন একথা সর্বজনসম্মত।
সব চেয়ে বড়ো কথা, তিনি সেদিন যা সত্য বলে উপলব্ধি করেছিলেন-নির্যাতন, তিরস্কার বা উপেক্ষার ভয়ে তা প্রকাশ করতে তিনি কখনো কুণ্ঠিত হননি। তিনি কেবল নতুন রূপরীতি ও আঙ্গিকই আনলেন না, তাঁর নাটকে দিলেন মানুষকে চিন্তারও খোরাক। নাটক লেখার জন্য ইউরোপের অভিজাত সম্প্রদায় ও তথাকথিত ভদ্রলোকেরা ইবসেনের মুণ্ডুপাত করে ছেড়েছিলেন, কারণ শূন্যগর্ভ আভিজাত্যের আঁতে ঘা দিয়েছিলেন ইবসেন।
রাষ্ট্র সম্পর্কে ইবসেন কি মত প্রকাশ করতেন তা জানা যায় তাঁর এক চিঠি থেকে। ইবসেন জর্জ ব্রাত্তিকে লিখছেন, ‘রাষ্ট্র বস্তুটির বিলোপ দরকার… এক ধরনের সরকারের জায়গায় আরেক ধরনের সরকার হলো একই জিনিসের এপিঠ ওপিঠ; অপেক্ষাকৃত কম বা বেশি। এর সবটাই মূর্খতা।” সমাজতন্ত্র সম্বন্ধে ইবসেনের প্রতিক্রিয়া কী ছিলো জানা যায় তাঁর একটি বক্তব্যে। তিনি লিখছেন, ‘আমি একথা বলি না যে সমাজতন্ত্রের বিষয়টি আমি কখনো চিন্তা করিনি।
ঘটনা হলো এই বিষয়টিতে আমি খুবই উৎসাহী এবং আমার সাধ্যমত তার ভিন্ন ভিন্ন দিক সম্বন্ধে জানতে চেষ্টা করেছি… আমি বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করেছি সোস্যাল ডেমোক্রেটিক নীতিবাদী দার্শনিকরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্যে যে সিদ্ধান্তে এসেছেন আমি সচেতনভাবে না হলেও ঐ বিষয়ে কিছু কিছু ব্যাপারে একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি।… তবুও একান্তে স্বাধীনভাবে নিজের পথ ধরে চলাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।’ ইবসেনের রাজনৈতিক বিশ্বাস যাই হোক তিনি ছিলেন তাঁর যুগের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার। বহুকাল পর্যন্ত ইউরোপের মঞ্চে এবং নতুনদের নাট্য রচনার ধারায় তাঁর প্রভাব বিস্তৃত ছিলো।
ইবসেনের চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে উনবিংশ শতকের শেষ দশক থেকে বিংশ শতকের অক্টোবর বিপ্লব পর্যন্ত দুজন নাট্যকার রুশ থিয়েটারের রূপান্তর ঘটায় তার একজন আন্তন চেখভ, অন্যজন ম্যাক্সিম গোর্কি। দুজনেই তাঁদের সমকালীন রুশ জীবনের দিকে লক্ষ্য রেখে নাটক রচনা করেছেন।
দুজনেই ছিলেন ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী। রুশ নাট্যকার আন্তন চেখভের নাটকে তীব্র সংঘাত, উচ্চকণ্ঠ উত্তেজনা বা ভয়ংকর মৃত্যু নেই। চেখভ নাটকে চরিত্রের আত্মিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। চেখভের নাটকে রুশীয় সমাজের এক ক্রান্তিলগ্ন ধরা পড়েছে, সামন্ততন্ত্রের বিলয় এবং বুর্জোয়াতন্ত্রের উত্থান। চেখভ যেমন তার সময়ের হতাশা, বিষন্নতা তুলে ধরেছেন তেমনি তিনি ভবিষ্যৎ স্বপ্নের কথাও বলে গেছেন। শ্রমিক, শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষ সম্পর্কে চেখভের অপরিসীম দরদ ছিলো। নির্যাতিত নিপীড়িত, শোষিত বঞ্চিত মানুষের পক্ষে তিনি তাঁর নাটকে কথা বলে গেছেন। বুর্জোয়া মতাদর্শ ও প্রথার প্রতি ছিলো তাঁর তীব্র ঘৃণা, দি চেরী অর্চার্ড নাটকে তা ধরা পড়ে। নতুন বণিকশ্রেণীর প্রতিনিধি সেখানে লোপাখিন, যাদের স্বভাব পেশল, আগ্রাসী ও স্থল। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে এভাবেই তার ঘৃণা প্রকাশিত।
কিন্তু তার পরিবর্তে কী হওয়া উচিত বা ভবিষ্যতে কী ঘটবে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণার অভাব ছিলো বলেই সে সম্পর্কে কোনো ভবিষ্যৎ বাণী নেই তাঁর নাটকে। তিনি মনে করতেন সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় মানুষকে সংগ্রাম করে যেতে হবে। সেজন্যই বুর্জোয়া সমাজের যে অসঙ্গতি ও অসারতা এবং সামন্ততান্ত্রিক আভিজাত্যের শূন্যগর্ভ অহংকার তা তিনি নিপুণভাবে চিত্রিত করেছেন। থ্রি সিস্টার্স নাটকে সামাজিক পরিবর্তনের বিষয়টি আছে পরোক্ষে। তিন বোন এখানে সামন্ত সমাজের সুবিধাভোগীশ্রেণীর প্রতিভূ এবং তারা তাদের সামাজিক অবস্থান থেকে বিচ্যুত হচ্ছে নবীন ব্যবসায়ীশ্রেণীর দ্বারা।
সামন্তবাদের বিরুদ্ধে বুর্জোয়াদের উত্থান দেখেছিলেন চেখভ। সামন্তরা যেমন তাঁর পছন্দনীয় ছিলো না, তেমনি বুর্জোয়ারাও তাঁর কাছে কাম্য ছিলো না। তবে বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণী যে লড়াই করতে আসছে সেটা তিনি ধরতে পারেননি, যা পেরেছিলেন গোর্কি। যদিও শ্রমিকশ্রেণীর ঐতিহাসিক ভূমিকা চেখভের উপলব্ধিতে ছিল না বা তাঁর যুগের ক্রমবর্ধমান বৈপ্লবিক আন্দোলনের সঙ্গেও তিনি কোনোভাবেই সংযোগ রাখেননি, তথাপি বিজ্ঞানের সাফল্যসমূহ ও সভ্যতার অগ্রগতির প্রতি তাঁর প্রখর দৃষ্টি ছিলো বলেই শ্রমিকশ্রেণীর প্রতি তিনি ছিলেন সহানুভূতিশীল ও সপ্রশংস। বিজ্ঞান ও প্রগতির বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে চেখভ অত্যন্ত বিরক্ত হতেন।
সামাজিক চেতনা ও অনুভূতি ছিলো তাঁর অত্যন্ত তীব্র। তাঁর কালের সভ্যতার অবদানগুলোর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেও বুর্জোয়া ব্যবস্থার সঙ্গে কোনো আপস করার তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী। শিল্পীর স্বাধীনতা সম্পর্কে চেখভের ধারণায় কোনো অস্পষ্টতা ছিলো না। তিনি বিশ্বাস করতেন না যে, জীবনদৃষ্টি থেকে বিচ্যুত শেয়া শিল্পী প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন হতে পারে। সে ধরনের সব স্বাধীনতাকে তিনি মনে করতেন নিকৃষ্ট পরাধীনতা। চেখভ স্পষ্ট করে বলেছিলেন, যদি আমি চিকিৎসক হতাম আমার দরকার হতো একটি চিকিৎসা কেন্দ্র ও রোগী, যখন আমি লেখক তখন আমার দরকার জনগণের মাঝেই থাকা।
নাটক মঞ্চায়নের উদ্দেশ্য ও রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার পশ্চাৎপট [ পর্ব ৩ ]:
ইবসেন নাটকে এমন ধারা নিয়ে এলেন যার প্রভাব পড়লো সারা ইউরোপে। নানা দেশে তার অনুসারীরা তাকে অনুসরণ করতে লাগলো। চেখভ, বার্নার্ড শ, গলসওয়ার্দি এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। বার্নার্ড শ ইবসেনের স্বঘোষিত অনুসারী, শিষ্য। ইবসেন কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে অস্বীকার করেন, বার্নার্ড শ সেখানে ছিলেন ফেবিয়ান সমাজবাদী ও সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। মার্কসবাদী সমালোচকদের মতে অবশ্য ফেবিয়ান সমাজতন্ত্র আদৌ মার্কসবাদী নয় কারণ মার্কসবাদের অনেক নীতিই ফেবিয়ানিজমে অনুপস্থিত।
বার্নার্ড শ সম্পর্কে লেনিন লিখেছিলেন, ‘শ একজন ভালো মানুষ যিনি ফেবিয়ানদের দলে পড়ে অধঃপতিত। অবশ্য তিনি তাঁর দলের তুলনায় অনেক বেশি বামপন্থী’। ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী এ নাট্যকার তীব্র ব্যঙ্গ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে পুঁজিবাদী সভ্যতার তথাকথিত ভদ্র ও সংস্কৃতিবান উঁচুতলার ব্যক্তিবৃন্দ কীভাবে শোষণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত তার অনতিগোচর প্রক্রিয়াসমূহ উন্মোচন করে দেখান।
বার্নার্ড শর নাটকের বৈশিষ্ট্য এই যে, তা মানুষের মস্তিষ্ককে নাড়া দেয়, মনকে ভাবিয়ে তোলে। তার যুক্তি অনেক সময় মানুষের পূর্ব প্রত্যয়কে ভেঙে দেয়। দেখা জিনিসকে নতুন করে দেখতে হয়। জানা জিনিসকে নতুন করে জানতে হয়। যুক্তির সোপান রচনা করে শ সব জিনিসকে এমনভাবে দেখিয়ে দেন যে, আগের দেখাটা দৃষ্টিভ্রম বলে মনে হয়। মঞ্চে যুক্তির লড়াই দ্বন্দ্বযুদ্ধের মতোই উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে তার নাটক সেটাই প্রমাণ করে।
মানুষের সযত্নে লালিত বিশ্বাসকে আক্রমণ করেই তিনি ক্ষান্ত হননি, নিজের চিন্তাকেও প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সমরনায়কদের বীরত্বে তিনি অনাস্থা প্রকাশ করেছেন, ইংরেজ জাতির ঠুনকো সম্ভ্রমবোধকে তিনি বিদ্রুপ করেছেন, প্রণয়ের শ্রেষ্ঠ পরিণতি বিবাহ একথা তিনি অস্বীকার করেছেন। কোনো ভাবালুতাকেই তিনি আমল দেননি।
বার্নার্ড শ নাটককে দার্শনিক বিতর্কের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করেছেন এবং এ সমস্ত বির্তক নাটকে ঘটনার স্থান দখল করেছে। চরিত্ররা সত্যাসত্য, ভালোমন্দ, নারী- পুরুষের ভালবাসা, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ব্যক্তি ও সমাজ, মানুষ ও ভগবান, অর্থনৈতিক শোষণ ও স্বাধীনতা, উদারনীতি ও সমাজতন্ত্র প্রভৃতি বিষয় নিয়ে দীর্ঘ তর্কে লিপ্ত হয়, যার এক একটা বক্তৃতা কখনও কখনও ছাপানো এক পৃষ্ঠার চেয়ে লম্বা।
এ সমস্ত থেকে তার চরিত্ররা সমাজে প্রচলিত ধারণা, রাজনৈতিক বিশ্বাস, ধর্মীয় বা সামাজিক মূল্যবোধ বা সংস্কার নিয়ে হাসিঠাট্টা করে এবং বাস্তবজীবনের সঙ্গে ঐ সব ধ্যানধারণার বিরোধ বা ব্যবধানের দিকেও আমাদের দৃষ্টিকে সঞ্চালিত করে। সমাজ ব্যবস্থাই বার্নার্ড শর আক্রমণের লক্ষ্য। প্রচারের প্রবণতা থাকলে সু-নাট্যকার হওয়া যায় না-ইবসেন চেখভের মতো বার্নার্ড শ তা মিথ্যা প্রমাণ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন সমাজের আসল ভিত্তি অর্থনীতি। তিনিই একমাত্র ইংরেজ নাট্যকার যিনি প্রথম থেকেই বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে তার বলিষ্ঠ মতামত ব্যক্ত করেন। শ-র স্পষ্ট বক্তব্য ছিলো মুষ্টিমেয় ব্যক্তি যারা জাতির পরগাছা এবং অতিশয় মূর্খ তারাই হচ্ছে ধনী এবং শাসক।
সাধারণ মানুষের মধ্যে তাই জোর করেই বুদ্ধি ও মানবতার প্রতিষ্ঠা ঘটাতে হবে।” বার্নার্ড শ বাস্তবধর্মী নাটককে সম্পূর্ণ বুদ্ধিধর্মী করে তুললেন। শ-র নাটকের দিকে তাকালে দেখা যাবে, শ্রেণীসংগ্রামের কোনো চেহারা তাঁর রচনায় নেই কিন্তু পুঁজিপতিরা কলঙ্কিত চরিত্র হিসাবেই আবির্ভূত। শ-র নাটকে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ চালানো হলেও শ্রমিকদের নৈতিক চরিত্রের ওপরও গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।
বাস্তববাদী নাটকের দিকে ভালোভাবে তাকালেই দেখা যাবে পুঁজিবাদী সমাজের বিরুেদ্ধে ক্ষোভই সেখানে প্রকাশিত। যেমন অঁরি বেক-এর ভালচারস নাটকটি, এ নাটকে বেক পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের ক্ষমাহীন ও করুণাহীন বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতার, চক্রান্তের ও প্রতারণার কাহিনী রচনা করেছেন। জার্মানীর গেরহার্ট হাউস্টমান সমাজতাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে সবচেয়ে দক্ষ নাট্যকার। তাঁর উইভারস নাটকে তিনি বজ্রকলের মালিকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ক্রমশ পরাভূত তন্ত্রবায়শ্রেণীর মজুরির দাবিতে ধর্মঘটের কাহিনী বলেছেন। হাউস্টমানের অন্য নাটক বিফোর সানরাইজ শ্রমিকশ্রেণীর ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নিয়ে।
নাটকে একটি সাইলেশীয় খনিশ্রমিক পরিবারের আকস্মিক বড়লোক হয়ে ওঠার পেছনের গোপন রহস্য এবং বড়লোক হওয়ার পর তাদের নৈতিক অধঃপতন ও অবক্ষয়ের কাহিনীর মাধ্যমে পুঁজিবাদী মূল্যবোধ ও জীবন পদ্ধতির তীব্র সমালোচনা উপস্থিত করেছেন। কৃষকদের জীবন কথা নিয়ে লেখা তাঁর শ্রেষ্ঠ নাটক হলো রোজ বার্নড। হাউপ্টমান ছিলেন ইবসেন, বার্নার্ড শ’র মতোই যুক্তিবাদী ধারার লোক।
বাস্তববাদী ধারার বৃটেনের একজন সফল নাট্যকার গল্সওয়ার্দি। বার্নার্ড শয়ের পর গল্সওয়ার্দিও সামাজিক অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে তাঁর নাটকগুলি রচনা করলেন। বৃটিশ থিয়েটারে কী বিষয়বস্তু, কী জীবনদৃষ্টিতে তিনি একটা নতুন ধারা এনে দেন। গল্সওয়ার্দির নাটকে নাটকীয় আবেগের প্রতিও দৃষ্টি দেয়া হলো। বাস্তব জগতে যে কতো নিষ্ঠুরতা, কদর্যতা, অবিচার ও নৈরাশ্য রয়েছে তিনি তা দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো সমাজবিজ্ঞানসম্মত। মানুষের নির্বুদ্ধিতা বা ছলনা দেখে প্রচণ্ড ক্ষোভ জমতো তাঁর মনে তবে তিনি বিচার বুদ্ধি হারিয়ে ফেলতেন না, আবেগকে তিনি তাঁর যুক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে জানতেন।
সমাজ সংস্কারের চিন্তা থাকলেও নাট্যকারের স্বধর্ম থেকে তিনি বিচ্যুত হতেন না। তিনি ছিলেন একই সাথে নাট্যকার ও সমাজ সংস্কারক। সমাজের গলদগুলি তিনি দেখিয়েছেন, কোনো সিদ্ধান্ত টানতে তিনি চেষ্টা করেননি। তিনি কোনো পক্ষপাতিত্ব না করে নাটকে সমাজ সত্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। বার্নার্ড শ-র সমসাময়িক নাট্যকার হয়েও তিনি ছিলেন শ-র চেয়েও অনেক বেশি মঞ্চসফল নাট্যকার।
জন গলসওয়ার্দি তাঁর সিলভার বক্স নাটকে দেখিয়েছেন আইন সর্বদাই গরীবদের প্রতি বেশি নিষ্ঠুর। একটি গরীব ঝি-রমণী অন্যায়ভাবে চুরির দায়ে অভিযুক্ত হয় এবং তাকে পেতে হয় কঠোর সাজা অথচ তার চেয়ে কতো বড়ো বড়ো অপরাধ করেও একজন বিক্তশালী পেয়ে যান অব্যাহতি। বিত্তশালীদের বেলায় আইন অনেক বেশি উদার। গল্সওয়ার্দির নাটকের চরিত্ররা সংগ্রাম করে সমকালীন সামাজিক ও আইনগত বৈষম্যগুলির বিরুদ্ধে। সমাজকাঠামোর অসঙ্গতি তুলে ধরাই ছিলো তাঁর নাটকের উদ্দেশ্য। তাঁর সমসাময়িক কালের টিন-প্লেট কারখানার একটি ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে তিনি রচনা করেন স্ট্রাইক নাটকটি। গল্সওয়ার্দির এই নাটকেই প্রথম ইংরেজ শ্রমিকদের জীবন স্থান পায় এবং নাটকীয় সংঘাত বাধে শ্রমিক-মালিক বিরোধকে কেন্দ্র করে।
দুই বিরুদ্ধ শক্তির মধ্যকার সংঘাতে নাটকটি জমে ওঠে। পারিপার্শ্বিক বিচারে গল্সওয়ার্দিকে শ্রমিকশ্রেণীর বিপরীত শ্রেণীভুক্তই করা চলে; কিন্তু মানসিকতার দিক থেকে সেই স্বকীয় শ্রেণীচরিত্রের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি দরদী মন নিয়ে শ্রমিকচরিত্র অঙ্কনে সফল হয়েছেন। মালিক পক্ষের একগুঁয়েমিও তিনি সমানভাবেই দেখিয়েছেন। ভ্রান্ত জেদের বশবর্তী হয়ে মানুষ কীভাবে নিজের অশান্তি ও অমঙ্গলকে ডেকে আনতে পারে তাই দেখানো হয়েছে নাটকে। আরো বলা হয়েছে শক্তিমান ব্যক্তি দন্তবশতঃ কেবল অন্যের দুঃখের কারণ হয় না, নিজের ট্র্যাজেডিও ডেকে আনে।
স্ট্রাইক নাটকটি শ্রমিক-মালিক বিরোধকে ঘিরে রচিত হলেও এটিকে ঠিক বিপ্লবী বা শ্রেণীসংগ্রামের নাটক বলা যায় না। মতাদর্শের দিক থেকে গল্সওয়ার্দি পুঁজিবাদের উচ্ছেদকামী কোনো বিপ্লবী ছিলেন না, তিনি চেয়েছিলেন তার খানিকটা সংশোধন। পুঁজিবাদী সমাজের ধনিকদের প্রতি তাঁর তীব্র সমালোচনা প্রকাশ পেয়েছিলো বিভিন্ন নাটকগুলিতে। তাঁর জাস্টিস নাটকে দেখা যায় প্রেমিকের জন্য একটি চেক কারচুপি করতে গিয়ে এক সামান্য কেরানির জীবনে নেমে আসে করুণ পরিণতি। দরিদ্র কেরানির পক্ষে চেকটি কারচুপি করা ছাড়া সেই অর্থ জোটাবার আর কোনো উপায় ছিলো না। শেষ পর্যন্ত কারচুপি ধরা পড়ে এবং কেরানির সাত বছর জেল হয়।
নাটকের একাধিক দৃশ্যে দেখানো হয়েছে কারাজীবনের মর্মন্ত্রদ চিত্র। উইনস্টন চার্চিল ছিলেন তখন বৃটেনের স্বরাষ্ট্র সচিব। নাটকটি দেখে তিনি এতোই অভিভূত হন যে, কারাজীবনের কঠোরতা খানিকটা শিথিল করতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তিনি উদ্যোগী হয়েছিলেন।নাটক মঞ্চায়নের যে একটি উদ্দেশ্য থাকে এবং নাটকের প্রভাব সৃষ্টি করবার ব্যাপারটা যে সত্যি এ ঘটনায় তা আবার প্রমাণিত হয়।
জর্জ বার্নার্ড শ ও জন গলসওয়ার্দির পর গ্র্যানভিল বার্কার, ব্যারী প্রমুখের নাটকে বাস্তবতার বিচিত্র প্রসার দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে ইউজিন ও’নীল, সিডনি হাওয়ার্ড, আর্থার মিলার প্রমুখ বাস্তববাদী ধারার নাটক রচনায় বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বিভিন্ন অন্যায়ের বিরুদ্ধেই তাদের নাটকেও প্রতিবাদ ঘোষিত হয়েছিলো। ত্রিশ চল্লিশ বছর ইউরোপীয় নাটকের প্রধান স্রোত ছিলো এই বাস্তববাদী ধারা। বাস্তববাদী ধারার পূর্ব উল্লিখিত নাট্যকাররাই হচ্ছেন রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার পথপ্রদর্শক। যাঁরা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নানা অসঙ্গতিকে প্রতিপাদ্য করে নাটক লিখছিলেন, যুক্তি দ্বারা তাঁদের নাট্য ঘটনাকে পরিচালিত করতে চেয়েছিলেন।
যুক্তি দ্বারা সেসব নাটকে শুধুমাত্র সমসাময়িক জীবনই চিত্রায়িত হয়েছে, বুর্জোয়া সমাজের নানা দ্বন্দ্ব ফুটে উঠেছে, শোষিতদের প্রতি নাট্যকারদের সহানুভূতিও প্রকাশ পেয়েছে, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। বুর্জোয়া সমাজ থেকে বের হয়ে আসার বা বুর্জোয়া সমাজের অসঙ্গতি থেকে মুক্তি লাভের উপায় তাঁরা বলেননি কিংবা এ ব্যাপারে কোনো দিক নির্দেশনাও দেননি। সমসাময়িক সময়ের অসঙ্গতির বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করেছেন যদিও সেই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়বার কথা বলেননি-যা আমরা লক্ষ্য করি পরবর্তী রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার মধ্যে। রাজনৈতিক নাট্যচিন্তায় সরাসরি বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে উচ্ছেদের কথা বলা হয়, বাস্তববাদী নাট্যকারদের চিন্তায় যা আমরা দেখতে পাই না। রাজনৈতিক নাটক বলে শ্রেণীসংগ্রামের কথা এবং সে বিশ্বাস করে বুর্জোয়া সমাজের ধ্বংস অনিবার্য।
আঠারশো নব্বইয়ের পর বাস্তববাদী নাট্যধারায় দেখা গেল, লক্ষ্যে পৌছানোর জন্য নতুন নতুন পথের সন্ধান চলছে। যার মধ্যে অন্যতম ছিলো থিয়েটারকে ব্যাপক জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা। জার্মানীতে এই উদ্দেশ্যে গড়ে উঠলো ‘ফোকস্- ব্যুহনেন’ নামের একটি সংগঠন। যারা নবীন নাট্যকারদের লেখা নাটকগুলো নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ, বিশেষ করে শ্রমিকদের মধ্যে মঞ্চস্থ করতে চেয়েছিলো। এর পরই দেখা গেল এরকম অসংখ্য উদ্যোগ, যেখানে মূল প্রশ্ন ছিলো দর্শকদের সঙ্গে যোগাযোগ, দর্শকদের সঙ্গে আত্মীয়তা, সাধারণ মানুষের জন্য থিয়েটারের দরজা খুলে দেয়া। দেখা গেল, এতোদিন থিয়েটারের বাইরে যারা ছিলো, সেই শ্রমিকশ্রেণী অনেক বেশি করে থিয়েটারে অংশ নিচ্ছে। সন্দেহ নেই, থিয়েটারকে জনগণের করে তোলার এবং জনগণের কাছে পৌঁছানোর এই আর্তি থেকে অবশ্যই থিয়েটারকে তার আঙ্গিক, তার প্রকরণ, তার চরিত্র, তার মেজাজ-সব কিছুতেই প্রতিনিয়ত এক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়েই নাটক ব্যাপক রাজনৈতিক চরিত্রটি লাভ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে রাশিয়া ও জার্মানীতে ছড়াতে থাকে এ্যাজিটপ্রপ থিয়েটারের ধারণা। এই থিয়েটারের মূল উদ্দেশ্য ছিলো শ্রেণীবিন্যাস, শ্রেণীসংঘর্ষ, শ্রেণীসংগ্রামের কথা তুলে ধরা এবং শ্রমিকদের সংগঠিত করা। বিশের দশকে জার্মানীতে ব্লু ব্লাউজ আন্দোলন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে এবং ক্রমশই তা রাজনৈতিক হয়ে উঠতে থাকে। রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার পদযাত্রা এভাবেই শুরু হয়, নাটক সেখানে শুধু আর চিন্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে ক্ষমতা দখলের প্রশ্নেও জড়িয়ে পড়ে।
বাস্তববাদী নাট্যধারার প্রধান যে কয়জন, নাট্যকার তাঁদের প্রায় সকলেই নাটকের মধ্য দিয়ে বুর্জোয়া সময়কালের সমালোচনায় নিজেদের ব্যস্ত রেখেছিলেন। সময় ও নিজস্ব শৈল্পিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রত্যেক বড় বাস্তববাদী শিল্পীই মূল সমস্যার আলাদা সমাধানে উপনীত হয়েছিলেন। এ-বিষয়ে সবার চিন্তার ঐক্য ছিল যে, তাঁরা তাঁদের বিরাট সময়কালের বেশ গভীরে প্রবেশ করেছিলেন এবং সময়কালকে যেভাবে দেখেছিলেন তদানুযায়ী বাস্তবতার যথার্থ নির্যাসকে অমোঘভাবে চিত্রিত করেছিলেন।বুর্জোয়া সমাজ স্বভাবতই এসময় কঠিন সমালোচনার মুখোমুখি পড়ে। উনিশ শতকের মধ্য ভাগে রোমান্টিকরা বুর্জোয়াদের ঘৃণা করলেও তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো সমলোচনা এড়িয়ে গিয়েছিলেন শাসকদের ক্রোধ থেকে নিজেদের বাঁচাবার জন্য। বাস্তববাদী প্রধান ধারার নাট্যকাররা তা করলেন না। সরাসরি ‘পুঁজিবাদের সমালোচনায় অংশ নিলেন। এই সময়ই পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে জনগণের থিয়েটার-এর ধারণাও ব্যাপকতা পেতে থাকে।
ফরাসী দেশের রম্যা রলাঁ ছিলেন জনগণের থিয়েটারের একজন বড় প্রবক্তা। যিনি বুওেয়াদের বিরুদ্ধে নাটককে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন এবং নাটককে সর্বসাধারণের মধ্যে পৌঁছে দেবার দাবি তুলেছিলেন। তাঁর গণনাট্য চিন্তার মূল লক্ষ্য ছিলো নাটকের মধ্যে জনগণকে সমাজ সম্পর্কে সচেতন করে তোলা। রম্যা রলাঁ তার এই বিশ্বাসের পক্ষে উনিশশো সাল থেকে উনিশশো তিন সাল পর্যন্ত ফরাসী পত্রিকায় বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লেখেন। উনিশশো তিন সালেই প্রবন্ধগুলো একত্রিত হয়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় যার নাম দেয়া হয় ‘তেয়াতর দু পুল’ বা জনগণের থিয়েটার। তিনি তার গ্রন্থে লিখছেন, ‘যুগের চাহিদা বা ইচ্ছার সঙ্গে শিল্প বিযুক্ত থাকতে পারে না।
পিপলস থিয়েটার বা গণনাট্যকে অবশ্যই জনগণের সংগ্রামের শরিক হতে হবে। তাদের দুঃখ- কষ্ট, তাদের আশা-আকাঙ্খা, তাদের লড়াইয়ে অংশ নিতে হবে। খোলাখুলিভাবে বলা যায়, গণনাট্য হবে অবশ্যই জনগণের। তিনি বলছেন, তা যদি না হয় তাহলে গণনাট্য কখনই সফল হবে না। নাটককে সেসময় থেকেই বুর্জোয়াদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার চেষ্টা চলতে থাকে। সেজন্য স্বাভাবিকতাবাদী বা বাস্তববাদীদের নাটকে বুর্জোয়া সমাজের প্রতি তীব্র বিরোধিতাপূর্ণ মনোভাব সুস্পষ্টভাবেই পরিলক্ষিত হয়। বুর্জোয়া ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধে সেই চিন্তা ক্রমশই দানা বাঁধতে থাকে।
বুর্জোয়াদের বিপক্ষেই যে শুধু শিল্প-সাহিত্য রচিত হচ্ছিলো ব্যাপারটা তা নয়, বরং বুর্জোয়াদের চিন্তার পক্ষেও অনেক শিল্প-সাহিত্য রচিত হচ্ছিলো।
যেমন ন্যূট হামসান, ফ্রাঁসোয়া দ্য কারেল, পল বুর্জে ছিলেন এই ধারার নাট্যকার যাঁরা বুর্জোয়াদের জয়গান গেয়েছেন। প্রথম জন নরওয়েজিয়ান, পরের দুজন ফরাসী দেশের। তাঁদের পূর্বসূরী নেস্তর ভাসিলিয়েভিস কুকুলনিক ছিলেন রুশ প্রতিক্রিয়াশীল নাট্যকার। ফ্লবেয়ারও ছিলেন ন্যূট হামসানদের আদর্শগত পূর্বসূরী। ন্যুট হামসানের দ্য গ্রেট অব দ্য কিংডম নাটকের নায়ক আইভার কারেনা একজন প্রতিভাবান তরুণ লেখক, যে নিজেকে খুবই মুক্তমনের অধিকারী মনে করে। মুক্তমনের এই চিন্তাবিদের বক্তব্য মতো প্রলেতারিয়ানরাই প্রতিরোধযোগ্য আর প্রলেতারিয়ানরা অবশ্যই ঘৃণ্য। প্রলেতারিয়ানদের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ করার কথা চিন্তা করে সে নিশ্চয় বুর্জোয়া আদর্শবাদী।
এই কারেনাকে নাট্যকার মনে করছেন একজন প্রথম সারির বিপ্লবী বলে। ফ্রান্সের ফ্রাঁসোয়া দ্য কারেল, তার নাটক লা রেপা দ্য লিয়। নাটকটির প্রধান চরিত্র জাঁ দ্য সাঁসি পুঁজিপতি ও শ্রমিকদের কার কী ভূমিকা সে সম্পর্কে বক্তব্য রাখছে। সাঁসির বক্তব্য, একপাল শেয়াল মরুভূমিতে সিংহকে অনুসরণ করে শিকারের উচ্ছিষ্ট ভোগের জন্য। যাঁড়কে আক্রমণ করার শক্তিতে অপারগ, তুরগ হরিণের পেছনে ছুটবার গতিতে অসমর্থ শেয়ালদের সমস্ত প্রত্যাশা বাঁধা আছে মরুভূমির রাজা সিংহের ঐ থাবার ভিতর। যখন রাত্রি ঘনায়, ক্ষুধায় কাতর হয়ে সিংহ তার আবাস ত্যাগ করে ছোটে শিকার খোঁজে। এইখানেই তো কথা। সে শক্তিশালী ব্যূহ তৈরি করে এমন এক যুদ্ধ ঘটায় যে যুদ্ধটা – নৈতিক। আর জগৎ যে রক্তে ভেসে যায় তা সবসময়ই শিকারের রক্ত নয়।
তারপর রাজকীয় ভোজন, শেয়াল দেখে আগ্রহে ও শ্রদ্ধায়। সিংহ পুরোপুরি তৃপ্ত হলে শেয়ালদের খাবার পালা আসে। শিকারটা যদি সিংহ শেয়ালদের প্রত্যেককে সমান ভাগে ভাগ করে দেয় আর এক ভাগ নিজের জন্যে রাখে তবে সিংহের জন্যে ঐ খাবার কী যথেষ্ট হয়? না, মোটেই না। এ রকম সহৃদয় সিংহ সিংহের আযোগ্য। এই বক্তৃতার মধ্য দিয়ে নাট্যকার বুর্জোয়াদের সিংহ আর শ্রমিকদের শিয়ালের সাথে তুলনা করেছেন। নাট্যকার বা নাটকের নায়ক জাঁ দ্য সাঁসির মতে পুজিঁপতিদের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের সংগ্রাম হলো সিংহের বিরুদ্ধে ঈর্ষান্বিত শেয়ালের সংগ্রাম। নাট্যকার এখানে পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের আন্দোলনে পুঁজিপতিদেরই পক্ষ নেন। মালিক যে শ্রমিকদের লালন-পালন করেন সে কথাও বলতে চান।
বুর্জেও তাঁর নাটকে প্রায় ন্যূট হামসান ও ফ্রাঁসোয়া দ্য কারেলের কথার প্রতিধ্বনি তোলেন। বুর্জের নাটক ‘লা ব্যারিকেড’-এর মূল ধারণা হচ্ছে আধুনিক শ্রেণীসংগ্রামে প্রত্যেকের অবশ্যই তার নিজ শ্রেণীর পক্ষে অংশ নেয়া উচিৎ। নাটকের সবচেয়ে পছন্দনীয় চরিত্র হিসাবে বুর্জে মনোনীত করেছেন গশাঁর নামক একজন বৃদ্ধ শ্রমিককে, যে গশাঁর নিজশ্রেণীর পক্ষ না নিয়ে তার নিয়োগকর্তার পক্ষ নিয়েছে।
নাট্যকার এটাকে গশাঁর নৈতিক আদর্শ ও মালিকের প্রতি কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হিসেবে দেখেছেন এবং শ্রমিকদের সকলের কাছ থেকে তিনি মালিকদের জন্য এই ধরনের নৈতিক ব্যবহার আশা করছেন। শ্রমিকটির এই ধারণার মধ্যে আমরা আসলে কী দেখতে পাচ্ছি? যে ধারণা এই শ্রমিককে চালনা করে তা এমন একজন দাসের ধারণার মতো, যে দাস তার শেকলকে ভালবাসে।”” বুর্জে শাসকশ্রেণীর স্বার্থে মানুষকে দাস হিসাবে দেখতে চান। শ্রমিকরা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করবে, তিনি সেটা চাইছেন না।
ন্যুট হামসান বা ফ্রাঁসোয়া দ্য কারেল ও বুর্জে তাঁদের নাটকে স্পষ্টতই একটি রাজনীতি প্রচার করছেন। সে রাজনীতি বুর্জোয়াদের পক্ষের রাজনীতি। ফরাসী বিপ্লবের পর রাজনীতি প্রধানত দুটো ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। সম্পদের ওপর দখলদারির প্রশ্নে মানুষ হয়ে গেল দুটো পক্ষ। একদিকে সম্পদের অধিকারী সুবিধাভোগী মানুষ, অন্যদিকে সম্পদহীন শোষিত মানুষ। বুর্জে সম্পদশালী মানুষের পক্ষে তাঁর রাজনীতি প্রচার করেছেন। ফরাসী বিপ্লব ও প্যারিস কমিউন গঠনের মধ্য দিয়ে মানুষ যেমন সচেতনভাবে রাজনীতিতে অংশ নিতে শুরু করে, তেমনি নাটক হয়ে পড়ে অত্যন্ত যুক্তিনিষ্ঠভাবে দুপক্ষের হাতিয়ার। কোনো নাটকই তাই অরাজনৈতিক নয়। যে-কোনো নাটকই তাই স্ব-স্ব শ্রেণীর পক্ষে শ্রেষ্ঠ প্রচারই হয় শেষ পর্যন্ত।
আর এ যে কতো বড়ো সত্য তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর সব মহান সৃষ্টিগুলোতে। বুর্জোয়াদের পক্ষের নাটকগুলোও এই প্রচারের বাইরে নয়। বুর্জে, কারেল ও হামসানের মতো শিল্পীরা তাঁদের রচনার মাধ্যমে কী রক্ষা করছেন? সেইসব সামাজিক সম্পর্ক যা বুর্জোয়া ব্যবস্থার জন্য প্রাচুর্যময় উৎস। শাসকশ্রেণীর স্বার্থে মানুষকে তাঁরা দাস ও প্রভু হিসাবে বিভক্ত করে রাখতে চাচ্ছেন। কিন্তু ব্যাপক জনগণ তাহলে তাঁদের এই নাটক গ্রহণ করবে কেন, সে কারণেই নাট্যকার হিসাবে এঁরা দাঁড়াতে পারলেন না। জনপ্রিয়তা যেমন পেলেন না, নাটকের ইতিহাসেও তাঁদের জায়গা হলো না। ইবসেন, চেখভ, বার্নার্ড শ, গলস্ওয়ার্দীর নামের পাশে এঁরা হারিয়ে গেলেন।
শাসকশ্রেণীর মুখপাত্ররা ইতিহাসের বিচারে প্রগতিশীল বলে বিবেচিত হতে পারেন, হনও কখনও কখনও তবে শোষিত জনতার মুখপাত্র না হলে যুগের মুখপাত্র হওয়া অসম্ভব। বর্তমানকে লঙ্ঘন করে চিরন্তনকে ধরা যায় না। যাঁরা বর্তমানের দ্বন্দ্বপূর্ণ সত্যকে লুকিয়ে শুধু এক পক্ষের প্রচার চালিয়েছিলেন, ইতিহাসের স্বাভাবিক নিয়মেই তাঁরা টিকে থাকতে পারলেন না। প্রলেতারিয়েত মুক্তি সংগ্রামের বিরুদ্ধে তাঁদের ক্ষমাহীন যুদ্ধ ঘোষণা দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হলো না।
বুর্জোয়ারা দেখতে পাচ্ছিলো তাদের মুখপাত্ররা জনতার হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারছে না। বুর্জোয়াদের প্রতিনিধি নাট্যকাররা জনগণকে যে-কথা বলতে চাইছে তার কোনো মূল্য নেই সাধারণ দর্শকের কাছে। কারণ, বুর্জোয়ার সম্পদ বানানোর গল্প কিংবা বুর্জোয়ার সম্পদ হারানোর বেদনা নাটকের বিষয়বস্তু হতে পারে না। রাশকিন যেমন বলেছিলেন, কুমারী তার হারানো ভালবাসার জন্য গান গাইতে পারে কিন্তু কৃপণ তার হারিয়ে যাওয়া পয়সার জন্য গান গাইতে পারে না।
কৃপণ কেন তাঁর হারিয়ে যাওয়া পয়সার জন্য গান গাইতে পারে না? কারণ দর্শকদের হৃদয়ে তা কোনো আবেগ সৃষ্টি করবে না। কৃপণ যদি তার লোকসানের জন্য গান গায় তা কারো ভেতরে সাড়া জাগাবে না। দর্শকের সাথে যোগাযোগ তৈরির মাধ্যম হিসাবে তা ব্যর্থ হবে। কিন্তু কুমারীর হারানো ভালোবাসার বেদনা দর্শকের সাথে যোগাযোগ তৈরি করবে, দর্শকের হৃদয়ে দোলা দেবে। কারণ ভালোবাসার জন্য হাহাকার মানব মনের চিরন্তন ধর্ম। রাশকিন তাই বলেছিলেন, শিল্পকর্মের গুণ নির্ধারিত হয় ঐ শিল্পকর্মে প্রকাশিত আবেগের মাহাত্ম্যে।

সমস্ত শিল্পই কাল নিয়ন্ত্রিত। একই সঙ্গে শিল্প এই সীমাবদ্ধতাকেও অতিক্রম করে যায় এবং ইতিহাসের কালসীমার মধ্যেই নিরন্তর বিকাশের সম্ভাবনা নিয়ে মানবতার ক্ষণকে রচনা করে।” শ্রেণা ঈদিতাসের সর্বমুহূর্তে বিরাজিত প্রবাহমানতাকে ধরতে পারলেই নাটক হয়ে উঠতে পারে চিরকালীন। দুই শ্রেণীর বা দুই পক্ষের ঘৃণা যদি নাটকে ধরতে পারেন নাট্যকার তাহলেই তা হতে পারে কালজয়ী। রণকবিতা যেমন শত্রুর প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে তেমনি এইসব কবিতা সৈনিকের নিবেদিত দুঃসাহসকে, দেশ জাতি ইত্যাদির জন্যে তাদের মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানোর তৎপরতাকে উচ্চ প্রশংসা করে। ব্রেস্ট সেজন্য বলেছিলেন, থিয়েটারকে অবশ্যই উপলব্ধির উত্তেজনাকে উৎসাহিত করতে হবে এবং বাস্তবতাকে বদলানোর আনন্দে দর্শককে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কীভাবে প্রমিথিউস মুক্ত হয়েছিলেন আমাদের দর্শককে শুধু সেটা জানালেই চলবে না, নিজেদের মুক্ত করার আনন্দদায়ক কর্মে তাঁদেরকে প্রশিক্ষিত করতে হবে।”
প্রাচীন গ্রীক নাটক, দান্তে, শেক্সপিয়ার, গ্যাটে, বালজাকন্ত তলস্তয় এরা সবাই মানবীয় বিকাশের বিরাট যুগের পর্যাপ্ত চিত্র প্রদান করেন-সেজন্যই তাঁরা চিরকালীন। ইবসেন, চেখভ, বার্নার্ড শ, হাউস্টমানদের ক্ষেত্রেও সে কথা সমানভাবে সত্য। বুর্জোয়ার মুখপাত্ররা তা পারেননি। বুর্জোয়া প্রচারকদের পক্ষে বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রচার চালানো এবং বুর্জোয়া শিল্প-সাহিত্যকে জনমনে গেঁথে দেয়া সম্ভব হয়নি বলেই বুর্জোয়ারা একটা সময়ের পরে ভিন্ন পথ ধরে আগাতে চেষ্টা করলেন। শিল্প-সাহিত্যে কলা কৈবল্যবাদের পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠলেন তাঁরা। কেন তাঁরা সে পথে গেলেন?
বাস্তববাদিতার নাট্যধারায় শিল্প-সাহিত্য যখন পুনরায় উদ্দেশ্যমূলক হয়ে ওঠে বুর্জোয়া ব্যবস্থার জন্য এর পরিণতি হয়ে দাঁড়ায় মারাত্মক। ইবসেনের নতুন কোনো নাটক বা বাস্তববাদী থিয়েটারে নতুন কোনো নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে শুনলে শাসক সম্প্রদায় শঙ্কিত হয়ে উঠতো। সেজন্য ইবসেনের নাটক সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের উইলিয়াম উইন্টার সমালোচনা করে লিখেছিলেন, ইবসেনদের জন্য মঞ্চকে নির্বাচন করা ভুল হয়েছে। বক্তৃতা মঞ্চই তাঁদের উপযুক্ত ক্ষেত্র। তিনি আরো লিখলেন, ইবসেনদের মতো নাট্যকারদের দুষিত সমাজচিন্তা দর্শক চিত্তকে অভিভূত করে কলুষিত করে তুলবে। বুর্জোয়া মুখপাত্রদের সমালোচনা ছিলো সেটা।
এই সময় থেকে শিল্পী-সাহিত্যকদের রচনায় বুর্জোয়া ব্যবস্থার দোষত্রুটিগুলো নানাভাবে সমালোচিত হতে থাকে। বিশেষ করে প্রথম মহাযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে এবং পরে বার্নার্ড শ, গলসওয়ার্দি, গোর্কির নাটকে যেভাবে বুর্জোয়াদের আক্রমণ করা হয়, তাতে বুর্জোয়ারা খুব ভালোভাবে বুঝতে। পারেন বাস্তববাদী নাট্যধারা আরো বেশি রাজনৈতিক হয়ে উঠছে এবং তা ধনবাদী শোষণের বিরুদ্ধেই চলে যাচ্ছে।
সমালোচকরা যে যেভাবে দেখে থাকুন না কেন, ইবসেনের থিয়েটারে সমাজ সত্যের প্রতিফলন ছিলো বলেই দর্শক চিত্ত অভিভূত হয়েছে, কিন্তু বুর্জোয়ারা তা চাইছিলো না। সেজন্য শিল্পী-সাহিত্যিকদের আক্রমণের হাত থেকে বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে রক্ষা করবার জন্য বুর্জোয়া মুখপাত্ররা নতুন খেলায় নামতে বাধ্য হলেন। পুশকিনের মতো তাঁরাও হঠাৎ শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে উঠলেন। বক্তব্য রাখলেন, শিল্প-সাহিত্য দ্বারা কোনো রকম প্রচার চালানো বা শিল্প সাহিত্যকে উদ্দেশ্যমূলক করে তোলা মানেই শিল্পের মান ক্ষুন্ন করা। শিল্প-সাহিত্যের আক্রমণের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করবার জন্য বুর্জোয়ারাই এই বক্তব্য দিলেন।
কিন্তু এই বুর্জোয়ারাই একদিন টাকার মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য শিল্প-সাহিত্যের আশ্রয় নিয়েছিলেন। কেবল শোষিতের স্বার্থরক্ষার ব্যাপার দেখা দিলেই তাঁদের কাছে শিল্পের এই উপযোগিতার ধারণা অসহ্য হয়ে ওঠে। সেজন্য রম্যা রলাঁ তাঁদের আক্রমণ করে লিখেছিলেন, রাজনীতি নিয়ে নাটকের করণীয় কিছু নেই-এই প্রতিবাদ আপনারাই তুলেছিলেন। তা সত্ত্বেও আপনারাই জনগণকে আকৃষ্ট করার জন্য আপনাদের নানা প্রযোজনায় একটি রাজনৈতিক তাৎপর্যকে সবসময়েই তুলে ধরতে চেয়েছেন। এ কথা কি আপনারা অস্বীকার করতে পারেন যে, যে-রাজনীতির বিরুদ্ধে আপনারা লড়াই করছেন বা বিরোধিতা করছেন তা আপনাদের নিজেদেরই বিরুদ্ধে প্রযুক্ত রাজনীতি নয়?’
তিনি বুর্জোয়াদের উদ্দেশ্যে আরো লিখছেন, আপনারা বোধ হয় ভেবেছেন গণনাট্যের কাল এখনও আসেনি আর সেই সময়টাকে কাজে লাগাতে আপনারা জনগণের গলায় আপনাদের বুর্জোয়া থিয়েটারকে জোর করে বিধিয়ে দেবার জন্য এক অন্য থিয়েটার চালু করার উদ্যোগ নিয়েছেন। এই থিয়েটারকে সরিয়ে রাখুন, কারণ এই থিয়েটার আমরা চাই না। বাস্তববাদী থিয়েটারের রাজনৈতিক চিন্তার পক্ষেই তিনি এ কথা লিখেছিলেন। রাজনৈতিক নাট্যচিন্তা নিয়ে আমাদের দীর্ঘ আলোচনার সুযোগ থাকবে পরবর্তী অধ্যায়ে।
এই অধ্যায়ে আমরা মূলত নাট্য ইতিহাসের, বিশেষত ইউরোপের নাট্য ইতিহাসের শুরু থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত তার কর্মকাণ্ডকে আলোচনায় রেখেছি। উনিশ শতকের শেষপাদটি বাস্তববাদী থিয়েটারের সময়কাল যার কর্মকাণ্ড প্রথম মহাযুদ্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত। বিশ শতককে আমরা চিহ্নিত করবো রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার শতক হিসাবে।
বিশ শতকের শুরু থেকে প্রথম মহাযুদ্ধের সময়কাল পর্যন্ত বিভিন্ন নাট্যধারার সাথে আমরা পরিচিত হই, রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার উন্মেষকালও সেটা। এই সময়কালে যেমন পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষে নতুন নাট্যচিন্তার সূত্রপাত হতে দেখি তেমনি শাসকশ্রেণীর পক্ষে নাটক রচিত হতে থাকে। সেটা ছিলো বাস্তববাদী থিয়েটারের পরবর্তী অধ্যায়।
বুর্জোয়া বিপ্লবের মধ্য দিয়েই বাস্তববাদী থিয়েটার ধারা জন্ম নিয়েছিলো, বুর্জোয়ারাই ছিলো প্রথম এ ধারার পৃষ্ঠপোষক। কিন্তু বুর্জোয়ারা খুব শীঘ্রই আবার নিজশ্রেণীর স্বার্থে বাস্তববাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেল। ফরাসী বিপ্লবের সময়ে বুর্জোয়া শিল্পচেতনাই আদর্শ শিল্পচেতনা বলে চিহ্নিত হতো। সেখানে মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্নকে আদর্শ করা হয়েছিলো। বুর্জোয়া অগ্রগমনের সঙ্গে সঙ্গে এই স্বাধীনতার চেতনা আবার ব্যক্তি-সর্বস্বতায় পর্যবসিত হলো। রেনেসাঁ যুগের বুর্জোয়া মানবতাবাদ যে স্বাধীন শোষণহীন মানুষের কথা ভেবেছিলো, সেই চিন্তা থেকে বুর্জোয়ারা তখন বহু দূরে। নিজেদের স্বার্থ চিন্তা ও নিজেদের ক্ষমতা রক্ষাই সেখানে প্রধান।
বাস্তববাদী থিয়েটারের আক্রমণের মুখে তাই নিজেদের স্বার্থেই তারা আবার বাস্তববাদী থিয়েটার থেকে সরে দাঁড়ালো। উদ্দেশ্যহীন, অবাস্তব থিয়েটারের পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠলো। বিশ্লেষণ ছিলো বাস্তববাদী নাটকের প্রধান লক্ষণ, আর বুর্জোয়াদের পরবর্তী নাট্যধারা বিমূর্ততার পথ ধরে আগাতে লাগলো। বিমূর্ত দার্শনিক ধারণাকে প্রকাশ করার জন্য বাস্তবকে বিকৃত করা হলো। রজার গ্যারডি দেখান যে, বস্তুবাদ চিরকালই মানুষের পক্ষে, সমাজ প্রগতির পক্ষে। আর বিমূর্ততা মানবিক মূল্যবোধের বিরোধী, মানুষের প্রগতির বিশ্লেষণ না করে তার ভাঙাচোরা বিকৃতরূপ হাজির করে। মানুষকে সুস্থ চিন্তা দেয়ার পরিবর্তে যা মানুষকে বিভ্রান্ত করে। বুর্জোয়ারা বা তার মুখপাত্ররা ইচ্ছাকৃতভাবেই এ বিভ্রান্তি ঘটান।
বিশ শতকের রাজনৈতিক থিয়েটারের, আধুনিক থিয়েটারের প্রথম ধারা বাস্তববাদী থিয়েটার। বাস্তববাদী ধারারই রয়েছে আবার বিভিন্ন পর্ব বা ভাগ। বাস্তববাদী ধারার বিকল্প ধারাও বলা যায় সেগুলোকে কিংবা পরবর্তী ধারা। যেমন সিম্বলিজম বা রূপকভঙ্গি, থিয়েট্রিক্যালিজম বা নাটকীয় ভঙ্গী, এক্সপ্রেসনিজম বা অভিব্যক্তিবাদ ও সুররিয়ালিজম বা পরাবাস্তববাদ। বিভিন্ন রূপবন্ধে বিভক্ত হয়ে এই বাস্তববাদের পরিধি এতোই বিস্তৃত হয়ে ওঠে যে শেষ পর্যন্ত অবাস্তববাদী থিয়েটারের যাত্রাও শুরু হয় সেখান থেকে। দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানের সময়ে, বিশের দশক থেকে চল্লিশের দশক পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদের আপাতসুস্থ দেহে অবক্ষয়ের চিহ্ন দেখা গিয়েছিলো।
টাকা ও ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় রাজনৈতিক আর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির অসুস্থতা, উদার মানবতাবাদের অপমৃত্যু, বিজ্ঞানের আবিষ্কারের ক্ষতিকর প্রভাব এবং পুরানো ধ্যান- ধারণা বা বিশ্বাসের ভাঙন, ভাঙন থেকে বিভ্রান্তি-সেই বিভ্রান্তি থেকেই জন্ম নিলো স্বপ্নের জগতে পলায়নবাদিতা, বিমূর্ত অবাস্তবতার দরজায় প্রবেশ। শিল্প-সাহিত্য বা নাটক হয়ে উঠলো শিল্পীর বিচ্ছিন্নতাজনিত নিঃসঙ্গতার একান্ত প্রকাশ। সমাজের বৃহত্তর মানুষের সাথে যোগাযোগের যে দায়বদ্ধতা এতোদিন শিল্পের ছিলো, সেটা হয়ে গেল তখন অপ্রাসঙ্গিক। বিমূর্তবাদীরা সমাজ-রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্রমশই অবাস্ত ব বা বাস্তব-বিপরীত সমাজ সম্পর্কহীন মানসের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
রাষ্ট্র- সমাজের সংকটকে ঘিরে মানব-চেতনার যে অংশে বিশৃঙ্খলা ও বিচ্ছিন্নতায়পূর্ণ, সেই অংশের প্রতিফলন হয়ে ওঠে তা। সমাজ বিজ্ঞানের চেতনা সেখানে ধরা পড়ে না। বিশ শতকের শুরুতে আমরা সিম্বলিজম, থিয়েট্রিক্যালিজম, এক্সপ্রেশনিজম সুররিয়ালিজম, ফিউচারিজম, ডাডাইজম-এই যে বিভিন্ন ধারা দেখতে পাই এরা সকলেই শেষ পর্যন্ত শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে ওঠে এবং তার পক্ষে প্রচার চালাতে থাকে নানারকম নিরীক্ষার নামে। রূপকধর্মীরা রূপকের মাধ্যমে জীবনকে ব্যাখ্যা করতে চাইলেন। শেষ পর্যন্ত এই ধারার পরিচালকরা দৃশ্যসজ্জার ব্যাপারে অধিক গুরুত্ব দিতে থাকেন। নাটকের চেয়েও অধিক গুরুত্ব দেন অভিনেতাদের। সর্বোপরি সৌন্দর্যের প্রেমিক হতে গিয়ে তাঁরা জীবনপ্রেমিক হতে ভুলে গিয়েছিলেন।
থিয়েট্রিক্যালিজম বলতে চাইলো নাটক নাটকই, নাটক জীবন নয়।বাস্তববাদের বিরুদ্ধেই মূলত ছিলো তাদের এই শ্লোগান। অভিব্যক্তিবাদীরা মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টাকে প্রাধান্য দেয় ঘটনাকে বাদ দিয়ে। ফ্রয়েডের চিন্তার অনুসারী এরা। মানুষের অন্তরের জটিলতাকে এরা নাটকের বিষয়বস্তুর মধ্যে প্রধান করে তোলে। ব্যক্তি মানুষই এদের চিন্তায় গুরুত্ব পায়। স্বভাবতই সামাজিক দ্বন্দ্ব থেকে এরা নিজেদের দৃষ্টিকে সরিয়ে নেয়। শিল্প সম্পর্কে ভবিষ্যতবাদীদের বক্তব্য ছিলো সন্ত্রাস, হিংস্রতা ও অবিচার ছাড়া শিল্প হতে পারে না।
থিয়েটারকে তারা যুক্তিহীন, অদ্ভুত ও উদ্ভটভাবে দেখাতেই সর্বশক্তি ব্যয় করেছিলো। ভবিষ্যতবাদীদের ইস্তেহারের দাবি অনুযায়ী শিল্পকলা তথা থিয়েটারের সংজ্ঞা হচ্ছে-শিল্পকলায় কোনো যুক্তি, কোনো ঐতিহ্য, কোনো নান্দনিকতা, কোনো প্রযুক্তি থাকবে না এবং শিল্পীর প্রকৃতিদত্ত প্রতিভার ওপর কোনো বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যাবে না। ভবিষ্যতবাদের অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে যান্ত্রিকতা। ভবিষ্যতবাদীরা অতীতের সবকিছুই অস্বীকার করতে চায়।
ভবিষ্যতবাদীরা যাবতীয় পুরানো নাট্যরীতি ধ্বংস করে যুক্তিবিহীন, ঐতিহ্যহীন, নান্দনিকতাবিহীন যে থিয়েটার নির্মাণের কথা বলেছে তার লক্ষ্য হবে দর্শকদের উত্তেজিত করা, দর্শকদের স্নায়ুকে নির্মমভাবে আঘাত করা। থিয়েটারকে এমন একটি জিমন্যাসিয়ামে পরিণত করা যেখানে মানুষ দ্রুতগতি সম্পন্ন ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিপদ সংকুলতায় উৎসাহী হয়ে উঠবে। গতি ও যান্ত্রিক কলাকৌশলে যে থিয়েটার গড়ে উঠবে তার কোনো নির্দিষ্ট ফর্ম থাকবে না, অথবা হবে বহু রকমের সমন্বিত রূপ। ভবিষ্যতবাদীরা শিল্পকলার সবক্ষেত্রেই আক্রমণ চালিয়েছে তাদের উদ্ভট উদ্ভাবনার দ্বারা।
যুদ্ধ যেহেতু সর্বাধিক উত্তেজক বিষয়, সেহেতু দেখা যায় তাদের চিন্তাভাবনায় যুদ্ধ শব্দটি বারবার এসেছে, এবং তাকে তারা প্রকাশও করেছেন কোনো দ্বিধা বা সংশয় না রেখে। যুদ্ধকে তারা গৌরবান্বিত করেছে। ভবিষ্যতবাদ ছিলো মূলত একটি রাজনৈতিক ব্যাপার। ভবিষ্যতবাদের প্রবক্তা মারিনাত্তি ছিলেন প্রচণ্ড রকমের উগ্র রাজনৈতিক মতের অনুসারী। তাঁর তত্ত্ব ছিলো উদ্দেশ্যমূলক। তিনি ইতালীয় জনগণকে থিয়েটারের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সন্ত্রাসী করে তুলতে চেয়েছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পক্ষেই তিনি তা করতে চেয়েছেন। প্রথম মহাযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতেও তাঁর ভূমিকা ছিলো যথেষ্ট।
ভবিষ্যতবাদীদের পাশাপাশি আমরা দেখতে পাই ডাডাইস্টদের। ভাল্টার মেহরিং, রিচার্ড হুয়েলজেনবেক, ফ্রানৎ ইয়ুং, রাওউল হাউসমান প্রমুখ ছিলের ডাডার লোক। পিসকাটর নিজেও প্রথম এই ডাডাইস্টদের সাথে ছিলেন। পরে পিসকাটর লিখছেন, ডাডাপন্থীরা ‘শিল্প একটা ফাঁকি’ এই শ্লোগান তুলে শিল্পের ধ্বংস সাধনে মেতে উঠেছিলো। সবকিছুতেই অবিশ্বাস ছিলো ডাডাইজমের দর্শন। ডাডাইস্টরা নিজেদের আদর্শ সম্পর্কে বলেছে যে, ডাঙা হচ্ছে যুক্তিকে বিলুপ্ত করা, স্মৃতিকে বিলুপ্ত করা, ভবিষ্যৎকে বিলুপ্ত করার জন্য।
ডাডাইস্ট নাটকে ছিলো না কোনো যুক্তিবহ প্লট, ছিলে। উদ্ভট ও পাপেট ধর্মী পরিচ্ছদ, ছিলো অর্থহীন ও অবোধ্য সংলাপ। সমাজ বাস্তববাদের বিরুদ্ধে এর বিদ্রোহ। সাধারণ মানুষের আবেগ-অনুভূতি, তাদের চিন্তা-ভাবনা থেকে বিচ্ছিন্ন সেইসব নাটক সম্পর্কে ফেন্দরিকো গার্সিয়া লোরকা লিখেছিলেন, ‘যখন লেখক ও অভিনেতারা এমন ব্যাবস্থাপকদের হাতের পুতুল, যারা সর্বতোভাবে বাণিজ্যিক, কোনওরকম সাহিত্যগত বা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের অধীন নয়, সম্পূর্ণ বিবেচনাহীন, ন্যূনতম নিরাপত্তা দিতে অপারগ, তখন এটা খুবই স্বাভাবিক যে অভিনেতা, নাট্যকার, মায় সমগ্র নাট্যজগতই প্রতিদিন আরো তলিয়ে যাবে, বাঁচার কোনও আশা থাকবে না।
গার্সিয়া লোরকা ঠিকই বলেছিলেন। শিল্পের জন্য শিল্পের থিয়েটার শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিলো থিয়েটার ব্যক্তিত্বদের নিজেকে হাজির করবার ও দন্ত প্রকাশ করবার জায়গা। দর্শকদের আনন্দ দানের জন্য সেখানে কিছুই ছিলো না। নিরীক্ষার নামে থিয়েটার শেষে এমন জায়গায় পৌঁছেছিলো যে বিষয়বস্তুর মধ্যে ছিলো শুধু মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ এবং দর্শকদের ভুলে গিয়ে শিল্পীরা শুধু নিজেদের মধ্যে মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে কথা বলতেন। থিয়েটার ব্যক্তিত্বরা ধরে নেন তাঁরা যা বলবেন যা কিছু করবেন বা দেখাবেন দর্শক যেন তাই দেখতে বাধ্য থাকবে। সিম্বলিজম, এক্সপ্রেশনিজম, সুররিয়ালিজম, থিয়েট্রিক্যালিজম প্রভৃতি ভঙ্গি থিয়েটার কর্মীদের ক্রমশ অন্তর্মুখী করে তোলে। স্বভাবতই দর্শক এ ধরনের থিয়েটার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো।
বুর্জোয়া থিয়েটারের সেই দৈন্যদশার দিনে রাজনৈতিক নাট্যচিন্তা থিয়েটারকে নতুন পথ দেখালো। বিভিন্ন ভাবাবেগ কেটে গিয়ে রাজনৈতিক শিল্পের দাবি যখন স্পষ্ট আকার পেল, ডাডাপন্থীদের শিল্পভাবনা যখন স্তিমিত হয়ে এলো-নতুন ধরনের চাল চাললো বুর্জোয়া মুখপাত্ররা। তখন তারা নতুন এক আবেগ, নতুন এক ভাবনা সঞ্চারিত করতে চাইলো মানুষের মনে। বলতে চাইলো নাটকও এক ধরনের বিপ্লব, বিপ্লব বিচ্ছিন্ন এক ব্যক্তির। মানুষ, এক একজন মানুষ, বিদ্রোহ করছে ভাগ্যের বিরুদ্ধে।
মানুষের আত্মানুসন্ধানে নেতিবাচক পথ ধরে অগ্রসর হয়েছিলো ভবিষ্যতবাদী ও ডাডাইস্টদের নাটকগুলো। পিসকাটর লিখছেন, এদের নাটকগুলো ছিলো ভীষণভাবে প্রতিক্রিয়াশীল। বুর্জোয়াদের এমনি নানা পাঁয়তারার বিরুদ্ধেই রাজনৈতিক নাটক- এর সৃষ্টি, যারা বলতে চায় নাটক সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার। একক মানুষের নয়, মিলিত মানুষের, শোষিতশ্রেণীর।
রাজনৈতিক থিয়েটার বা রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলন বুর্জোয়াদের শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বের বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছিলো থিয়েটারে নতুন প্রাণ সৃষ্টি করতে। রাজনৈতিক থিয়েটারের সে পথ চলাও বাধা বন্ধনহীন সোজা সরল রেখায় ছিলো না। রাজনৈতিক থিয়েটারের বিরুদ্ধে আবার দাঁড়িয়ে গেলো কিমিতিবাদী থিয়েটার। রাজনৈতিক থিয়েটারের যাত্রা প্রথম মহাযুদ্ধের পর, কিমিতিবাদী থিয়েটারের আরম্ভ সেই একই সময়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরই এই ধারার থিয়েটার বুর্জোয়াদের বেশি বেশি পৃষ্ঠপোষকতা পেতে থাকে।
বিমূর্ত যে নাটাধারা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যে ঝোঁকের সূত্রপাত, সে-ধারার নাটক নির্মাণের বিপুল জোয়ার দেখা যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরই শোনা যায় অস্তিত্ববাদী নাটক, ক্রুদ্ধ নাটক, যন্ত্রণার নাটক এবং অ্যাবসার্ড বা উদ্ভট বা কিমিতিবাদী নাটকের নতুন নতুন নাম। বর্তমান কাল পর্যন্ত তার বিস্তার। অ্যাবসার্ড নাটকের জন্মের একটা ইতিহাস আছে।
দার্শনিক তত্ত্ব প্রয়োগ করে হেগেল দেখান যে, বস্তুকে দেখতে হবে একটা অনর্গল প্রক্রিয়া হিসেবে। এটাই ছিলো তাঁর দ্বান্দ্বিক তত্ত্ব। দার্শনিক হেগেল, দ্বন্দ্ববাদকে যুক্তির সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয় বলে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। দার্শনিক সোরেন কিয়ের্কগার্ড হেগেলীয় যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে তার ‘আইদার অর’ গ্রন্থে দেখিয়েছিলেন, আমাদের জীবন আসলে বিসঙ্গত, অযৌক্তিক বা অ্যাবসার্ড ঘটনার যোগফল। কেন না সংসারের বেশিরভাগ ক্রিয়াকাণ্ডই সঠিক যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। শিক্ষা সংস্কৃতিতে প্রভূত উৎকর্ষের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধে ফ্রান্সের পতন অনিবার্য হয় উঠলো-এই একান্ত আবেগিক তথা অভিমান-সঞ্জাত কারণ বা উপাদান থেকে ফরাসী সাহিত্যে অস্তিত্ববাদের উত্থান।
জাঁ পল সাত্রে, সিমন দ্য বোভেয়ার, জাঁ আনুই, গাব্রিয়েল মার্সেল প্রভৃতি ফরাসী লেখকরা দুঃখময় সংগ্রাম ছাড়া আশাবাদী অথবা আনন্দোচ্ছল কোনো ছবি নিজেদের লেখনীতে কখনও তুলে ধরেননি। সেখান থেকেই নাটকে বিমূর্ত বা কিমিতিবাদের শুরু। ফ্রান্স ছাড়াও ব্রিটেন, স্পেন, ইতালী, জার্মানী, সুইজারল্যাণ্ড, পূর্ব ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রের তথা সামগ্রিক পাশ্চাত্য ঐতিহ্যে বহু প্রাচীন ধারার নব-রূপায়ণের মধ্য দিয়ে এই নাটক তার নিজস্ব স্বকীয়তা অর্জন করেছে। বিশ শতকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পাশ্চাত্যে যে রাজনৈতিক সমাজ সচেতন ও প্রতিবাদী নাট্য প্রচেষ্টা লক্ষ্য করি, বিমূর্তরীতি বা অ্যাবসার্ড তার বিপরীত ধারা। সমাজবিজ্ঞান সচেতন নাট্যধারা চেষ্টা করছিলো বিশ্বযুদ্ধের কারণগুলো ব্যাখ্যা করতে।
সেখানে অ্যাবসার্ড নাট্যধারা শুধু বিভ্রান্তিরই জন্ম দেয়। বিমূর্ত দার্শনিক ধারণাকে প্রমাণ করার জন্য ক্যামু বাস্তবকে বিকৃত করেছেন। কিমিতিবাদ মূলত শিল্পীর বিচ্ছিন্নতাজনিত নিঃসঙ্গতার একান্ত ব্যক্তিগত প্রকাশ। সমাজের বৃহত্তর মানুষের সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগের যে দায়বদ্ধতা এতোদিন শিল্পের ছিলো, এখন সেটি অপ্রাসঙ্গিক। শিল্পী আর সমাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে চান না। কেননা এই অবিশ্বাসী, আশাহীন সমাজে তিনি নিঃসঙ্গ। তাঁর শিল্পপ্রকাশও সমাজ পরিত্যক্তর্ণনঃসঙ্গতার ভাঙাচোরা বিমূর্ত প্রতীক।
বিমূত, বেখাপ্পা বা এই অ্যাবসার্ড নাটকটি আসলে কী? ইয়োনেস্কো যিনি এই নাট্যধারার পথিকৃতদের একজন, তিনি নিজে এই বেখাপ্পা বা অসম্ভব নাটকের একটি সংজ্ঞা দিতে চেষ্টা করেছেন। সে সংজ্ঞা অনুযায়ী, এরা প্রত্যেকেই নাটকের জগতে বিষয়বস্তু এবং প্রকরণ দুটি ক্ষেত্রেই তাদের চিন্তাধারাকে স্বাধীনতা দানে সম্পূর্ণ বিশ্বাসী। যারা কোনো যৌক্তিকতার ধার ধারেন না। সেই বিশ্বাস থেকে বেখাপ্পা নাটকের দর্শন শূন্যতার দর্শন, অবক্ষয়ের দর্শন। উদ্দেশ্যহীনতাই এর প্রধান উদ্দেশ্য। নাট্যকার হ্যারল্ড পিন্টার লিখছেন, ‘আমি কোনো দর্শকের কথা মনে রেখে নাটক লিখি না। আমি শুধু লিখি নিজের তাগিদে।… যদি কেউ আকস্মিকভাবে সেই নাটকে অংশগ্রহণ করে সেটা নেহাতই দুর্ঘটনা।
ফরাসী বিপ্লবের সময়ে বুর্জোয়া শিল্পচেতনাই আদর্শ শিল্পচেতনা বলে চিহ্নিত হতো। সেখানে মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্নকে আদর্শ করা হয়েছিলো। কিন্তু বুর্জোয়াতন্ত্রের অগ্রগমণের সঙ্গে সঙ্গে এই স্বাধীনতার চেতনা ব্যক্তি সর্বস্বতায় পরিণত হলো। উদ্দেশ্যহীন অবাস্তবতায় পরিণত হলো। অ্যাবসার্ড নাটক বা এই নৈরাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্ব সম্পর্কে মার্কসবাদী- লেনিনবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সম্পূর্ণ বিপরীত। দুটো বিশ্বযুদ্ধকে এরা দেখেছে মৃত্যুর ইতিহাস হিসাবে। বিশ্বযুদ্ধগুলো শুধু মৃত্যুর ইতিহাসই ছিলো না, সেটা ছিলো মানুষের বেঁচে থাকারও ইতিহাস। কোটিকোটি মানুষের বাঁচার উদ্যমকে না দেখে তারা শুধু তার মধ্যে মৃত্যু আর হতাশা খুঁজেছে। কোটিকোটি মানুষের মুক্তি সংগ্রামকে পাশ কাটিয়ে গেছে। সমাজ বিজ্ঞানকে তারা সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেছে।
বিমূর্ত রীতির নাট্যকাররা তাই মানুষের যে চিত্র এঁকেছেন সেখানে মানুষ খুব ক্ষুদ্র এবং সম্পূর্ণ অসহায় জীব, সেখানে শুধু ধরা পড়ে এই পৃথিবীতে স্বয়ং মানুষেরই নিজের করুণ হাস্যকার অবস্থান, যেখানে সে সর্বদা অনিশ্চিতের মধ্যে বিরাজমান। এডওয়ার্ড এলবীর চিড়িয়াখানার গল্প নাটকে দেখি নায়ক মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে অবশেষে আত্মহননের বাসনায় উদ্বেল হয়। স্যামুয়েল বেকেট তাঁর গডোর প্রতীক্ষায় নাটকে দেখান, মানুষের জীবনে সত্যিকার কখনও কিছু ঘটে না, মানুষ যার জন্য অপেক্ষা করে সে আসে না। তাঁরা দেখতে পান না সে মানুষকে, যে মানুষ আপন ভাগ্যকে শ্রমের হাতে নির্মাণ করে চলেছে। মানুষের সুখ, স্বাধীনতা, সৃজনী প্রতিভা দিনে দিনে বিকশিত হচ্ছে। জীবন সেখানে অর্থহীন নয়।
মানুষ তার মেধা কর্ম শ্রম ও চিন্তার দ্বারাই গুহামানব থেকে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে, তথাপি বিমূর্ত ধারার নাট্যকারদের কাছে বিশ্ব এক সীমাহীন শূন্যতার মুখোমুখি দণ্ডায়মান। মানুষের সংগ্রামে এঁদের দীক্ষা নেই বলে সমাজের বিকাশকে এঁরা দেখতে পান না। সেজন্যই সমাজ-দেশ-কাল, ইতিহাস পৃথিবী সবকিছুকে এঁরা অর্থহীন মনে করেন। সেজন্য কোনো দ্বন্দ্ব বা সংঘাতের বিজ্ঞানজনক পন্থায় সমাধান হতে পারে সেটা তাঁরা ভাবতেই পারেন না। বস্তুবাদী চিন্তার বিপরীতে এঁরা ক্রমাগত মগজের ওপর নির্ভর করতে করতে উদ্ভট, অর্থহীন সব চিন্তার জন্ম দেন। নাটকে শুধু নৈরাজ্যই ফুটিয়ে তোলেন। নৈরাজ্য হচ্ছে হতাশার পরিণাম ফল। জর্জ টমসন মনে করেন, নৈরাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম সমাজের বিকাশকে না বোঝার ব্যর্থতা থেকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুঁজিবাদীরা এই নাট্যধারাকে সমর্থন করতে এগিয়ে এসেছিলো এই লক্ষ্য থেকে যে, যদি নাট্যকাররা সমাজের সব ঘটনার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে শুরু করেন তাহলে সেটা পুঁজিবাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক পরিণাম বয়ে আনবে। পিসকাটর-ব্রেন্টরা যুদ্ধকে দেখেছিলেন পুঁজিবাদের স্বাভাবিক পরিণতি হিসাবে। চলমান বিশ্বের সংকটগুলোর মূল কারণ হিসাবে দায়ী করেছিলেন পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে, যা ছিলো পুঁজিবাদের জন্য খুবই ভয়ের ব্যাপার। সে কারণে এই নতুন বিমূর্ত নাট্যধারাকে খুব কৌশলে পুঁজিবাদীরা ব্যবহার করতে চাইলো রাজনৈতিক থিয়েটারের বিরুদ্ধে। কিমিতিবাদীরা থিয়েটার থেকে দর্শক ব্যাপারটিকেই বাতিল করতে উদ্যত হলো।
কিন্তু রাজনৈতিক নাটক দর্শককে বাদ দিয়ে চলতে পারে না। কারণ মানুষের জন্যই সে নাটক করে। বিশেষ করে শ্রমিকশ্রেণী কিংবা বিশ্বের শোষিত মানুষের জন্য তার নাটক। বিমূর্ত নাট্যধারা তাই রাজনৈতিক নাট্যধারার সম্পূর্ণ বিপরীত ধারা। কিমিতিবাদীরা নাটকের নামে উদ্ভট সব বিষয়ের আমদানি করলেন, যৌন সম্পর্ক নিয়ে বাড়াবাড়ি, নিয়তি ও দৈবের জয়গান ইত্যাদি জনবিরোধী চিন্তা পুনসংযুক্ত করলেন। কিমিতিবাদী নাটকের নামে এলো ভঙ্গি নিয়ে নানারকম চমক, বিশৃঙ্খলা, মঞ্চে দাপাদাপি।
যখন বিমূর্ত নাট্যধারার উদ্ভব ঘটে তখন সেটা ছিলো স্বতঃস্ফূর্ত একটি প্রবণতা। দুটি ক্রমসংঘটিত মহাযুদ্ধ পাশ্চাত্যের প্রতিষ্ঠিত সমাজজীবন, নৈতিক মূল্যবোধ ও যাবতীয় প্রচলিত বিশ্বাসকে প্রবলভাবে বিচূর্ণ করে সেখানে টাকা আর বাণিজ্যকে দাঁড় করিয়েছিলো। যাঁরা সমাজ বিজ্ঞানের দৃষ্টি দিয়ে ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করতে পারেননি, তাঁরাই হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছিলেন। বিমূর্ত ধারার উদ্ভব সেখান থেকেই।
পুঁজিবাদীরা এই নাট্যধারাকে তাঁদের শ্রেণীস্বার্থে ব্যবহার করা কথা ভাবলেন। বিমূর্তধারা টাকা ও প্রচার দুটোই পেলো পুঁজিবাদী পৃষ্ঠপোষকতার বদৌলতে। সেজন্য তারা শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারলো নাট্যাঙ্গনে, যদিও তাদের পেছনে বৃহৎ দর্শক গোষ্ঠীর কোনো সমর্থন ছিলো না। সেজন্য দর্শকদের ধরে রাখতে তাকে নিত্য নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হলো। সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরিণামে বিমূর্ত নাট্যশালা যৌনতা-নগ্নতা আর মাদকদ্রব্যের আখড়ায় পরিণত হলো।
উৎপল দত্তের ‘জপেন দা জপেন যা’ গ্রন্থ থেকে আমরা বিমূর্ত নাট্যরীতির একটি অংশ এখানে তুলে ধরবো। নাটকটি ফরাসী দেশের জাঁ-জাক লেবেল পরিচালিত। নাটকের ঘটনা হচ্ছে, দুটি নগ্ন নারী দেয়ালে ছবি আঁকছে আর লেবেল নিজে মেয়ে দুটির নিতম্বে ছবি আঁকছেন। টি-ডি-আর পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে লেবেল এটাকে বললেন, নতুন নাট্যশালার আবির্ভাব। ভিন্ন একটি নাটকের বর্ণনা পাওয়া যায় এই গ্রন্থেই। দর্শকদের বলা হলো, ঘন্টা বাজলেই সবাই উঠে দাঁড়াবেন, এসব কাপড়-জামা খুলে ফেলবেন, উলঙ্গ হয়ে নাচবেন, তারপর পাশের ঘরে যাবেন। নানা ড্রাগের অলৌকিক নেশায় আচ্ছন্ন দর্শকরা তাই করলেন।
পাশের ঘরে গিয়ে দেখলেন পর্দায় একটি নগ্ন নারীর চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে আর কক্ষের মধ্যস্থলে সেই নারীই সম্পূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায় নৃত্য করছে। ইয়োনেস্কো তাঁর শিক্ষাদান নাটকে দেখাচ্ছেন যে নায়ক তার ছাত্রীকে অসংলগ্নভাবে বিবিধ বিষয় পড়াতে পড়াতে তাকে উদভ্রান্ত করে তুলে অশ্লীলতা করায় এবং অতঃপর তাকে হত্যা করে পরবর্তী ছাত্রীর জন্য মঞ্চে অপেক্ষা করে। পিকাসোর আঙুলবন্ধ বাসনা নাটকে দেখানো হয় নারীর স্বমৈথুন-ক্রিয়া।
নাটকের দুটো চরিত্রের নাম, বুড়ো আঙুলের মাথা এবং হোঁৎকা উদ্বেগ। যবনিকা উত্তোলনের সঙ্গে সঙ্গে তরুণী অভিনেত্রী এসে দর্শকদের দিকে তাকিয়ে বসে এবং পুরো পাঁচ মিনিট ধরে কোনো একান্ত গোপনীয় শরীরধর্ম পালন করে। উৎপল দত্তের মতে, এই হচ্ছে তাদের নাটক, যাদের কাছে বেশ্যালয় আর নাট্যশালায় কোনো পার্থক্য নেই। নাটকের নামে এভাবেই পুঁজিবাদী দুনিয়ায় চলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে এ নাটক। মানুষকে সুস্থভাবে চিন্তা করতে দিতে চায় না এরা।
ইয়োনেস্কোদের উদ্দেশ্যে ছিলো সমাজতান্ত্রিক দেশের বলিষ্ঠ নাট্য আন্দোলনের পথ রোধ করা, যাতে পশ্চিম ইউরোপে ব্রেস্টদের রাজনৈতিক নাটকের প্রভাব ছড়িয়ে না পড়ে। কিমিতি-জ্যামিতি-দুর্মতি প্রভৃতি নানা দুর্বোধ্য নামের আড়ালে তাঁরা বলতে চাইলেন-নাটকের কোনো অর্থ বা উদ্দেশ্য থাকা উচিৎ নয়। ইয়োনেস্কোরা বলেছিলেন, নাটক অর্থহীন হবে, বেকরা বলেছেন নাটকে ভাষাই থাকবে না। তাঁরা বললেন যে, যুক্তিবাদ বা বিজ্ঞাননিষ্ঠার কারণে শিল্প স্বনিয়মে স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হতে পারে না, তার ওপর আরোপিত হয় আনুশাসন বা নিয়ন্ত্রণ, হৃদয়ের আবেগ-উচ্ছ্বাস ও কল্পনা থেকে শিল্প দূরে সরে যায়।
বিমূর্তরীতির সমর্থক বেক ও মালিনা বলতে শুরু করলেন, নাটকের কথাই হচ্ছে শিল্পের বাধা, সুতরাং কথা বাদ। তার পরিবর্তে চিৎকার, গোঙানি, বিদঘুটে ঘোৎকার, এইসব হবে নাটকের ভাষা। আর অভিনেতারা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে নানা আকৃতি সৃষ্টি করবেন মঞ্চে, সেটাই হবে অভিনয়। সেইজন্যই জুলিয়ান বেকের নাটকে আমরা দেখতে পাই মঞ্চে এক অভিনেতা দাঁড়িয়ে আছেন, এবং আধ ঘন্টা তিনি নির্বাক নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইলেন। মঞ্চ ভর্তি সব লাশ। জুলিয়ান বেকের দার্শনিক চিন্তা এক স্টেজ মৃতদেহে পরিণত হোলো। নাটক শেষ।
তিনি বোঝাতে চাইলেন পৃথিবীতে মৃত্যুই সব, মানুষ মৃত্যুতে রূপান্তরিত হবে। মৃত্যুই বাঁচবার পথ, মৃত্যুই আনবে অনন্তর বার্তা। মানুষ চতুর্দিকে অসম্ভবের প্রাচীরে বন্দী, অসম্ভবের পায়ে সে মাথা খুঁড়ে মরছে। মৃত্যুই জীবনের একমাত্র সত্য স্বরূপ, মৃত্যুই হলো জীবনের শেষ পরিপূর্ণতা। যার অর্থ দাঁড়ায় মানুষ যা কিছু করছে সব কিছু অর্থহীন। সব কর্মের ফল শূন্য।
দুঃস্বপ্ন, ভয়, আতংক এবং মৃত্যু ছাড়া পৃথিবীতে এরা আর কিছুই দেখতে পায় না। মানুষের বিশাল কর্মের জগতের প্রতি এদের কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই। উদ্ভট নাটকের জগৎ জড়, নিষ্ক্রিয়, হতোদ্যম মানুষের জগৎ-বিরাট বিশ্বপ্রকৃতির মাঝখানে যারা জন্মসূত্রেই অভিশপ্ত, কোণঠাসা আর হতাশ। অস্তিত্বের জটিল ঘূর্ণাবর্তে যারা কক্ষচ্যুত জ্যোতিষ্কের মতো উদভ্রান্ত এবং অসহায়। মানুষকে এভাবেই বিচার করে এরা। মানুষের বিপুল কর্মযজ্ঞ এদের চিন্তার বাইরে থাকে বলেই পৃথিবীতে শূন্যতা ছাড়া এরা আর কিছুই দেখতে পায় না। সেজন্য মানুষকে তারা মৃত লাশ বলেই মনে করে এবং ভালভাবে বাঁচার জন্য সংগ্রাম থেকে তাদের দৃষ্টিকে ফিরিয়ে রাখতে চায়, যে কাজটি পূর্বে গির্জার মাধ্যমে ঘটতো।
গির্জা মানুষকে মনে করতো স্রষ্টার ক্রীড়নক এবং ধর্মীয় নাটকগুলোতে তখন তাই প্রচার করা হতো। স্রষ্টার ক্রীড়নক মানে মানুষের নিজের কোনো শক্তি নেই সকলকে সেটা বিশ্বাস করতে অনুপ্রাণিত করা। বিমূর্তরীতির নাট্যধারাও সেই একই কাজ করে চলছে। মানুষের শক্তি ও সম্ভাবনাকে সে অস্বীকার করে বসে আছে। ধর্মীয় নাটকে তবু আশার বাণী ছিলো, এদের নাটকে সেটুকুও নেই। মৃত্যু ছাড়া মানব জন্মের পেছনে এরা আর কিছুই দেখতে পায় না। কিন্তু মানুষের ইতিহাস কখনই আত্মহননের ইতিহাস নয়। সত্যি বলতে যে-অবক্ষয়ের মানস প্রতিমা কিছুত বা বেখাপ্পা নাটক, সে নেহাৎই ধনবাদী অর্থনীতির শৃঙ্খলিত পরিণাম। বিমূর্ত নাট্য সৃষ্টির একটি মাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে ধনবাদী সমাজের শোষণকে স্থায়ী করা। ধনতান্ত্রিক শিবিরকেই শক্তি যোগানো।
সাধারণ শ্রমবাদী মানুষের বাঁচার সংগ্রামের বিরুদ্ধে বুর্জোয়াশ্রেণীর শিল্প-অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা। বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবোধ ও সমাজচেতনার দ্বারাই শিল্প-সাহিত্যের সৃষ্টি। বিমূর্তরীতির শিল্পীগণ এর বিরুদ্ধে গেলেন। পুঁজিবাদের কারখানা থেকে এ থিয়েটারের জন্ম, রাজনৈতিক নাটকের বিরুদ্ধেই যা সোচ্চার। কিমিতিবাদী নাটক-এর প্রবক্তারা যতোই অগ্রগামিত্বের দাবি করুন না কেন, এর মূল তত্ত্ব বিশ্লেষণ করলে এর মধ্যে ভাব এবং রূপ উভয় ক্ষেত্রেই যা প্রকট হয় তাকে অনিবার্যভাবেই প্রতিক্রিয়াশীলমনস্ক বলতে হয়।
পশ্চিমী দুনিয়ার এই কিমিতিবাদী শিল্পীরা বলেন, বিচ্ছিন্নতাবোধ কি বাস্তব নয়, সত্য নয়? মানুষ কি আজ একা হয়ে পড়ছে না এই যন্ত্রসভ্যতায়? স্বয়ং মার্কস কি বিচ্ছিন্নতার কথা বলেননি? হ্যা, মার্কস বিচ্ছিন্নতার কথা বলেছেন। মার্কসের বিচ্ছিন্নতা আর কিমিতিবাদীদের বিচ্ছিন্নতার চেহারাটা এক নয়। মার্কসের বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বের মূল কথা হলো বিচ্ছিন্নতার যে-কোনো রূপই শ্রম বিচ্ছিন্নতার ফল। ব্যক্তিগত মালিকানাই হলো শ্রমের স্ববিচ্ছিন্নতার কারণ। সামাজিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির একটি বিশেষ কারণই মানুষের বিচ্ছিন্নতা ঘটায়। সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা সমাজকে দুই অংশে বিভক্ত করে; যারা উৎপাদনের মালিক আর যারা মালিক নয়। মার্কসের বিচ্ছিন্নতার মূল কথা হলো, পুঁজিবাদী সমাজ মানুষকে তার সব সুকুমার বৃত্তি থেকে, প্রতিবেশী থেকে, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে; মানুষ পরিণত হয় যন্ত্রে।
মার্কসের এই বক্তব্যের প্রতিধ্বনি চ্যাপলিনের মডার্ণ টাইম চলচ্চিত্রটি। কাজের চাপে মানুষ সেখানে যন্ত্রে পরিণত। মার্কস লিখছেন, শ্রম সৌন্দর্য সৃষ্টি করে কিন্তু শ্রমিককে করে পঙ্গু-তাকে করে তোলে নির্বোধ ও বিকৃত। পুঁজি গ্রন্থের বিভিন্ন খণ্ডে মার্কস দেখিয়েছেন, ব্যক্তিগত মালিকানাভিত্তিক যে-কোনো উৎপাদন ব্যবস্থাতেই মানুষের বিচ্ছিন্নতা ঘটা অনিবার্য। কিন্তু বস্তুবাদী দর্শনে বিচ্ছিন্নতার ইতিবাচক দিকও উত্থাপিত। মার্কসবাদী দর্শনে বিচ্ছিন্নতা এক বৈপ্লবিক শক্তিও বটে।
বিচ্ছিন্নতা থেকেই উদিত হয় বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণী। মার্কস বলছেন, ব্যক্তিগত মালিকানার অবলুপ্তি ছাড়া মানুষের বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্তি নেই। মার্কস দেখান যে, বিচ্ছিন্নতাঁর কারণ যন্ত্র নয়, শিল্প নয়, নাগরিক সভ্যতা নয়, কারণ সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা। সুতরাং এই সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান। মার্কসবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে ‘বিচ্ছিন্নতা’ হতাশা আর অবিশ্বাস ছড়ায় না, দুর্বোধ্য ব্যক্তিসর্বস্বতায় নিয়ে যায় না, বিপ্লবের সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ইঙ্গিত প্রদান করে।
লিও তলস্তয় বলেছেন, ‘কেবলমাত্র সেই শিল্পেরই মূল্য আছে যা মানুষকে একতাসূত্রে বাঁধে। শুধু সেই শিল্পীকেই গ্রহণ করা যায় যিনি তাঁর বিশ্বাসের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেন। শিল্পীর মহান চরিত্র হচ্ছে-শিল্পকে ভালোবাসা নয়-মানবজাতিকে ভালোবাসা। ১৩ কিমিতিবাদীরা তলস্তয়ের এই বক্তব্যের সাথে একমত নন।
রাজনৈতিক নাট্য তলস্তয়ের এই বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করে বলতে চাইলো জীবন যেমন রাজনীতি বিবর্জিত হতে পারে না, তেমনি নাটক যদি জীবনের প্রতিচ্ছবি হয়ে থাকে নাটকও রাজনীতি বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। ঠিক এর বিরুদ্ধে কিমিতিবাদী পক্ষ বললো, নাটকে রাজনীতির কী দরকার, নাটক নাটকই। নাটকের আভ্যন্তরীণ শক্তি দ্বারাই নাটকের মূল্যায়ন হবে। দুপক্ষের এই বিরোধ বিশ শতকের নাট্যচর্চার একটি উল্লেখযোগ্য দিক। রাজনৈতিক থিয়েটারের বিরোধী পক্ষে বিষয়বস্তু বাদ দিয়ে মঞ্চকে ঘিরেই ছিলো যতোসব চিন্তা। রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার নানা উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে কলাকৈবল্যবাদ নানা নাম ধরে এসেছে।
অস্তিবাদ, উদার ক্যাথলিকবাদ, প্রকাশবাদ, অসম্ভাব্যতাবাদ, নিঃসঙ্গতাবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ, ভবিষ্যতবাদ প্রভৃতি যা কিছু নাম শুনতে পাওয়া যায় তারই মূলে রয়েছে জীবনবিমুখ প্রগতিবিরুদ্ধ চিন্তাধারা। জাঁ পল সার্জ থেকে আরম্ভ করে পরবর্তী যে সব তরুণ বুদ্ধিজীবী অন্তিবাদের নামে মোংহধর্মী ব্যক্তি স্বাধীনতার মহিমাকীর্তনে পঞ্চমুখ তাঁরা আসলে ইতিহাস ও বিজ্ঞানকে অন্ধকারে রেখে তথাকথিত জীবন রহস্যবাদের ধোঁয়া বিস্তার করেন।
মার্কিন নাট্যকার ইউজিন ও’নীল তাঁর দি আইসম্যান কামেথ নাটকে বলছেন মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো জেনেশুনে আত্মপ্রবঞ্চনা করা। সে দেশেরই নাট্যকার টেনেসি উইলিয়ামস তাঁর বেশ কিছু নাটকে অর্ধোনন্মাদ ও অসুস্থ চরিত্রগুলো আমদানি করে বলছেন এই পৃথিবীতে আশার আর কিছুই নেই, একমাত্র মানসিক চিকিৎসাই হচ্ছে বিধান। বাস্তবতার বিপরীত প্রতিক্রিয়া থেকেই এসব সাহিত্য-চিন্তার উদ্ভব।
রাজনৈতিক নাট্যচিন্তকরা মনে করেন, নাটকের লক্ষ্য হবে দর্শকের মধ্যে বৈপ্লবিক চেতনা সৃষ্টি। বিপরীতে কলা কৈবল্যবাদ বা শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বের প্রচারকরা কী করলেন? মেটারলিঙ্ক, ইয়েটস, হুইটম্যান প্রভৃতি সংকেতবাদী নাট্যকার বাস্তবের ইলিউশন ও মায়াকে অগ্রাহ্য করে, অবাস্তবের ইলিউশন সৃষ্টি করে বাস্তব জগতের আড়ালে যে অতলস্পর্শ নৈঃশব্দের জগৎ রয়েছে, অব্যক্ত অনড় রহস্যময়তাকে প্রতীকী ব্যঞ্জনার মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে চাইলেন। অ্যাবসার্ড নাটকের প্রধান চরিত্ররা মানুষ বটে, সেই মানুষ নির্জন নিঃসঙ্গ নির্বাসিত আউটসাইডার। কোনো ধরনের সংগ্রামেই তাই তার আস্থা নেই। মৃত্যুই সেখানে বাঁচবার পথ। কিমিতিবাদের এই হচ্ছে মূল দৃষ্টিভঙ্গি ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করার।
নাটক মঞ্চায়নের ক্ষেত্রেও তাদের বক্তব্য একই রকম, বিশেষ করে স্যামুয়েল বেকেট, ইউঞ্জীন ইয়োনেস্কো, আর্থার আদামত, জাঁ জেন্যে এবং হ্যারল্ড পিন্টার-এরা প্রত্যেকেই নাটকের জগতে বিষয়বস্তু এবং প্রকরণ দুটি ক্ষেত্রেই তাদের চিন্তাধারাকে স্বাধীনতা দানে সম্পূর্ণ বিশ্বাসী। সে স্বাধীনতার অর্থ তাঁরা কোনো যৌক্তিকতার ধার ধারেন না, পূর্ব-অভিজ্ঞতারও কোনো মূল্য নেই তাঁদের কাছে।
শুধু তাই নয়, নিজেরা তাঁরা নাটকে কোনোরকম কোনো উদ্দেশ্য প্রচারের যেমন বিরোধী, তেমনি অন্যরা কিছু প্রচার করুক তারও তাঁরা বিরোধী। নিজেদেরকে তাঁরা প্রমাণ করতে চান নিরপেক্ষ। গ্রামসি এদের সম্পর্কে লিখছেন, সমাজে শাসকশ্রেণী তার আধিপত্য বজায় রাখে কীভাবে? নিজের শ্রেণীর প্রয়োজনে রাষ্ট্র ক্ষমতাকে ব্যবহার করে আর উৎপাদন ব্যবস্থার উপর দখলদারির মাধ্যমে। কিন্তু এ ছাড়াও আরো একটা গভীর উৎস আছে। গ্রামসি দেখাচ্ছেন, এই মাতব্বরশ্রেণী নিজেদের স্বার্থবাহী দর্শন আর মূল্যবোধগুলোকে সার্বজনীন আপাত নিরপেক্ষ আদর্শ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন।
মূল সত্য হচ্ছে প্লেখানভ যা বলেন, বক্তব্যবিহীন শিল্পকর্ম বলে কিছু নেই। এমনকি যে সমস্ত শিল্পকর্মের রচয়িতারা শুধুই আঙ্গিকের উপর জোর দেন বক্তব্যের ব্যাপারে মনোযোগী হন না, তাঁরাও কোনো না কোনোভাবে তাঁদের শিল্পকর্মে কিছু বক্তব্য প্রকাশ করেন। কিংবা যে কথা লুনাচারস্কি বলেন, শিল্পকর্ম জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে সর্বদা লেখকের শ্রেণী-মনস্তত্ত্বকে প্রতিফলিত করে। মনে রাখতে হবে, এটা শিল্প-সাহিত্য বা নাটক সম্পর্কে মন্তব্য। নিছক হাস্য-কৌতুককে যখন নাটক হিসাবে চালানো হয়, তখন তা যেমন কোনো শিল্প হিসাবে বিবেচিত হয় না, তেমনি তার রাজনৈতিক দিকটিও গুরুত্ব বহন করে না। বর্তমান আলোচনার সুবিধার্থে সেই ধরনের হাস্য-কৌতুক বা কোনো সৃষ্টি যা শিল্পোত্তীর্ণ নয়, অথচ মানুষকে বিনোদন দেয়, তা এই মন্তব্যের অন্তর্ভুক্ত নয়।
কিমিতিবাদীদের ক্ষেত্রেও একথা সত্য। কিন্তু কিমিতিবাদী নাটককে আমরা রাজনৈতিক নাটক না বললেও, শিল্প হিসাবে বিবেচনা না করলেও, তার রাজনীতির একটি দিক আছে। মার্কসাদীরা মনে করেন, সেই রাজনীতি হচ্ছে মানুষকে রাজনীতিবিমুখ করে তোলা। শোষকশ্রেণীর পক্ষে সেটাও একধরনের রাজনীতি। মানুষের মধ্যে তারা হতাশাকে প্রচার করে যখন তারা বলে মৃত্যুর মধ্যেই সব মুক্তি। সেটাই বারবার তারা প্রচার করছে যদিও শ্রেণীসংগ্রাম প্রচারে তাদের আপত্তি। সেইজন্য তাদের এই চিন্তার বিরুদ্ধেই রাজনৈতিক থিয়েটারের, শ্রমিকশ্রেণীর থিয়েটারের, এমনকি মানবতাবাদী থিয়েটারের শ্লোগান ছিলো-শিল্প শুধু শিল্পের জন্য নয়, শিল্প হোক মানুষের জন্য।
বিয়ষটি নিয়ে দ্বিতীয় অধ্যায়ে পুনরায় আলোচিত হবে। এখানে শুধু একটি কৈফিয়ত দিয়ে রাখা দরকার, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে যে শিল্প শিল্পের জন্য নয়, নাটক হোক সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার বা শ্রেণী সংগ্রামের হাতিয়ার ইত্যাদি শ্লোগান উঠেছিলো তা মূলত কিমিতিবাদী চিন্তার বিরুদ্ধেই তারা ব্যবহার করেছিলো। কতোটা সচেতনভাবে তা করেছিলো সেটা অবশ্য দীর্ঘ আলোচনার বিষয়। চতুর্থ ও পঞ্চম অধ্যায়ে আমরা তা নিয়ে আলোচনা করবো। এখন আমরা রাজনৈতিক নাট্যচিন্তা এবং রাজনৈতিক নাট্যচিন্তায় মার্কসীয় প্রভাব নিয়ে বিশদ আলোচনার জন্য দ্বিতীয় অধ্যায়ে চলে যাবো।
আরও দেখুন: