বাংলাদেশের বর্তমান চলচ্চিত্র অঙ্গনের অন্যতম জনপ্রিয় মুখ পূজা চেরি রায়। শিশুশিল্পী হিসেবে তার ক্যারিয়ার শুরু হলেও দ্রুতই তিনি প্রধান নায়িকা হিসেবে জায়গা করে নেন। অভিনয় দক্ষতা, সৌন্দর্য ও পরিশ্রমের কারণে অল্প বয়সেই তিনি দর্শক ও সমালোচকের প্রশংসা অর্জন করেছেন।

জন্ম ও শৈশব
পূজা চেরি রায় ২০০০ সালের ২০ আগস্ট খুলনার গাজিরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম দেব প্রসাদ রায় এবং মাতার নাম ঝর্ণা রায়। পরিবারের পরিবেশ থেকেই তিনি শিল্প ও সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগী হয়ে ওঠেন। ছোটবেলা থেকেই নাচ, গান ও অভিনয়ে তার আগ্রহ ছিল। বাবা-মায়ের উৎসাহেই মিডিয়া জগতে প্রবেশ করেন তিনি।
শিক্ষাজীবনে তিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট গার্লস পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়াশোনা করেছেন। পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, যা তার আত্মবিশ্বাস ও মঞ্চে উপস্থাপনার দক্ষতা গড়ে তোলে।
তার উচ্চতা ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি এবং ওজন ৫১ কেজি।
অভিনয় জীবন: সূচনা
পূজা চেরির চলচ্চিত্র জীবনের শুরু শিশুশিল্পী হিসেবে। ২০১২ সালে ভালোবাসার রং চলচ্চিত্রে তিনি প্রথমবারের মতো শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন। এরপর তিনি ধারাবাহিকভাবে বেশ কিছু জনপ্রিয় ছবিতে অভিনয় করেন।
শিশুশিল্পী হিসেবে তার উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- নাইওরি (২০১২)
- মোস্ট ওয়েলকাম (২০১২)
- মাই নেম ইজ খান (২০১৩)
- তবুও ভালোবাসি (২০১৩)
- অগ্নি (২০১৪)
- মোস্ট ওয়েলকাম ২ (২০১৪)
- ব্ল্যাকমেইল (২০১৫)
- কৃষ্ণপক্ষ (২০১৬)
- বাদশা দি ডন (২০১৬)
শিশুশিল্পী হিসেবে তিনি সবসময় প্রাণবন্ত ও স্বাভাবিক অভিনয়ের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন।
প্রধান অভিনেত্রী হিসেবে আত্মপ্রকাশ
২০১৮ সাল পূজা চেরির ক্যারিয়ারে মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এই বছরেই তিনি তিনটি বড় চলচ্চিত্রে প্রধান নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
- নূর জাহান (২০১৮)
কলকাতার পরিচালক রাজ চক্রবর্তীর প্রযোজনায় নির্মিত এই চলচ্চিত্রে পূজার বিপরীতে ছিলেন আদৃত রায়। এটি বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ প্রযোজনার ছবি। চলচ্চিত্রটি মুক্তির পর ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয় এবং পূজাকে এক ঝটকায় আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। - পোড়ামন ২ (২০১৮)
রায়হান রাফীর পরিচালনায় নির্মিত এই ছবি ছিল বিশাল ব্যবসাসফল। এতে তার বিপরীতে অভিনয় করেন সিয়াম আহমেদ। ছবির গানগুলোও ব্যাপক জনপ্রিয় হয় এবং পূজাকে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের নায়িকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। - দহন (২০১৮)
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে পূজার অভিনয় ছিল প্রশংসনীয়। এখানে তিনি আরও একবার সিয়াম আহমেদের বিপরীতে অভিনয় করেন।
পরবর্তী কাজ ও বহুমুখী সাফল্য
২০১৯ সালে পূজা অভিনয় করেন প্রেম আমার ২ চলচ্চিত্রে। এরপর ২০২০ সালে তার হাতে আসে বেশ কিছু ভিন্নধর্মী প্রজেক্ট—
- জিন (হরর ঘরানার)
- সান
- সাইকো
তিনি প্রতিটি ছবিতেই ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে নিজেকে প্রমাণ করেছেন।
চলচ্চিত্র তালিকা (সংক্ষেপে)
বছর | চলচ্চিত্রের নাম | ভূমিকা |
২০১১ | মনের ঘরে বসত করে | শিশুশিল্পী |
২০১২ | সন্তানের মত সন্তান, ভালোবাসার রং, নাইওরি, মোস্ট ওয়েলকাম | শিশুশিল্পী |
২০১৩ | মাই নেম ইজ খান, তবুও ভালোবাসি | শিশুশিল্পী |
২০১৪ | অগ্নি, মোস্ট ওয়েলকাম ২ | শিশুশিল্পী |
২০১৫ | ব্ল্যাকমেইল | শিশুশিল্পী |
২০১৬ | কৃষ্ণপক্ষ, বাদশা দি ডন | শিশুশিল্পী |
২০১৮ | নূর জাহান, পোড়ামন ২, দহন | প্রধান অভিনেত্রী |
২০১৯ | প্রেম আমার ২ | প্রধান অভিনেত্রী |
২০২০ | জিন, সান, সাইকো | প্রধান অভিনেত্রী |
টেলিভিশন ও বিজ্ঞাপন
চলচ্চিত্র ছাড়াও পূজা চেরি বিভিন্ন টেলিভিশন বিজ্ঞাপন ও নাটকে কাজ করেছেন। তিনি বেশ কিছু জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের মুখপাত্র হয়েছেন, যা তার জনপ্রিয়তাকে আরও বৃদ্ধি করেছে।
পুরস্কার ও সম্মাননা
পূজা চেরি ইতিমধ্যেই বেশ কিছু পুরস্কার অর্জন করেছেন।
- পোড়ামন ২ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য ২০১৯ সালে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারে সেরা চলচ্চিত্র অভিনেত্রী (পাবলিক চয়েস) বিভাগে পুরস্কৃত হন।
- এছাড়া বিভিন্ন সংগঠন থেকে অভিনয়ে অবদানের জন্য সম্মাননা পেয়েছেন।
ব্যক্তিগত জীবন
তার ব্যক্তিগত জীবনও দর্শকের কাছে আগ্রহের বিষয়। ২০২৪ সালে তার মা ঝর্ণা রায় মৃত্যুবরণ করেন, যা পূজার জীবনে বড় ধাক্কা হয়ে আসে। তবে তিনি দৃঢ় মনোবল নিয়ে আবারও অভিনয় জগতে সক্রিয় আছেন।
অভিনয়ের পাশাপাশি পূজা চেরি ফ্যাশন, ভ্রমণ ও সামাজিক কাজেও আগ্রহী। তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভক্তদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন এবং নিজের জীবনের ঝলক শেয়ার করেন।
জনপ্রিয়তা ও অবদান
পূজা চেরি কেবল একজন অভিনেত্রী নন, তিনি বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের চলচ্চিত্রের একটি প্রতীক। তার কাজ প্রমাণ করেছে যে সঠিক প্রতিভা ও পরিশ্রম থাকলে খুব অল্প বয়সেও বড় অর্জন সম্ভব। তার অভিনয় শুধু বিনোদনই নয়, বরং নারীর আত্মবিশ্বাস ও সংগ্রামী মানসিকতার প্রতিফলনও বটে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
পূজা চেরি ভবিষ্যতে আরও চ্যালেঞ্জিং চরিত্রে কাজ করতে চান। বাংলাদেশের পাশাপাশি তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্রেও কাজের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তার ভক্তরা আশা করছেন, পূজা আরও বহুমাত্রিক চরিত্রে অভিনয় করে দক্ষিণ এশিয়ার চলচ্চিত্র জগতে নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবেন।
শিশুশিল্পী থেকে প্রধান নায়িকা হয়ে ওঠা পূজা চেরি রায়ের জীবন এক অনুপ্রেরণাদায়ী যাত্রা। প্রতিটি চলচ্চিত্রে তার অভিনয় দর্শকদের হৃদয় জয় করেছে। তিনি প্রমাণ করেছেন, ধারাবাহিক পরিশ্রম, নিষ্ঠা এবং আত্মবিশ্বাস একজন শিল্পীকে কতটা উচ্চতায় পৌঁছে দিতে পারে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে পূজা চেরির অবদান দীর্ঘদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে, এবং তার হাতে গড়া চরিত্রগুলো আগামী প্রজন্মকেও অনুপ্রাণিত করবে।