বাংলাদেশের মঞ্চনাটক : উৎস ও কর্মধারার ব্যাপকতা নিয়ে আজকের আলোচনা। বর্তমান অধ্যায়ে আমরা বুঝতে চেষ্টা করবো বাংলাদেশের যে নাট্য আন্দোলন সে আন্দোলনের উৎস কী। স্বাধীনতার পরেই বা হঠাৎ করে এ আন্দোলন দেখা দিলো কেন? কোন্ প্রেক্ষাপটে বা কোন্ ধারাবাহিকতায় এ নাট্য আন্দোলনের জন্ম। বাংলাদেশে যে নাট্য আন্দোলন জন্ম নেয় তা গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন নামেই বা কেন পরিচিত হয়? এই গ্রুপ থিয়েটার ব্যাপারটিই বা আসলে কী? কোথায় তার উৎস? গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন সৃষ্টির পেছনে কারা প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলো? গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন আমরা প্রথম জন্ম নিতে দেখি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে।
বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গের সেই গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের একটি ভিন্ন রূপ। সেজন্য পশ্চিমবঙ্গের গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন সৃষ্টির পেছনের ঘটনাগুলো এ অধ্যায়ে যথেষ্ট গুরুত্ব পাবে, যার ভিতর দিয়ে আমরা বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের স্বরূপটিও বুঝতে পারবো। বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের উৎস ও স্বরূপ সন্ধানেই স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গের নাট্য আন্দোলনের ওপর এখানে বিস্তৃত পটভূমিতে আলোচনা করা হবে।
ভারতীয় গণনাট্য সংঘের অধীনে উনিশশো তেতাল্লিশ সালে পশ্চিমবঙ্গে যে নাট্যধারা আরম্ভ হয়েছিলো তা পরবর্তীকালে সারা পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক আকার নিয়েছিলো। চল্লিশের দশকে এবং তারপরেও যেখানেই সাধারণ মানুষ অন্যায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে, সেখানেই গণনাট্য জনগণের সংগ্রামের পাশে ছিলো। বাংলার কৃষক যখন তেভাগার দাবিতে ধানের মঞ্জুরী হাতে বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছে, গণনাট্য তখন গেয়েছে তেভাগার গান।’ ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার অন্ধকারাচ্ছন্ন দিনগুলিতে গণনাট্য হাহাকার করে কেঁদেছে, সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা জাগাবার উদ্দেশ্যে মঞ্চের প্রতিটি আঙ্গিককে যুদ্ধযাত্রায় প্রস্তুত করেছে।
আবার সাতচল্লিশ সালের পর স্বাধীন ভারতের বুকে শোষণ যখন নূতন রূপ পরিগ্রহ করেছে, তখন বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক অনাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাংলার গণনাট্য নির্ভীকভাবে তার প্রতিবাদ জানিয়েছে। বৃহত্তর ক্ষেত্রে জনগণের জন্য সংস্কৃতির এই বিরাট দায়িত্ব গণনাট্য গ্রহণ করেছিলো বলেই অতি অল্প সময়ের মধ্যেই গ্রাম-মফঃস্বল শহর, রাজধানী সর্বত্রই এই মঞ্চকে মানুষ গ্রহণ করলো সাদরে। জনগণ সম্পৃক্ত হলো গণনাট্যের উদ্যোগের সাথে।
বাংলাদেশের মঞ্চনাটক : উৎস ও কর্মধারার ব্যাপকতা [ পর্ব ১ ]
মঞ্চান্দোলনে সাধারণ মানুষের যোগদান-এ ছিলো সে যুগের এক অভূতপূর্ব দিক। শহর বা শহরতলীর শুধুমাত্র কিছু বোদ্ধা দর্শক নয়, গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-মাঠে সাধারণ জনগণের উৎসাহ ও উদ্দীপনা এর সঙ্গে মিলে গিয়েছিলো’। যদিও প্রথম পর্বে মধ্যবিত্ত ও কৃষক আন্দোলন নিয়ে যতো নাটক রচিত ও মঞ্চস্থ হয়েছে সে তুলনায় শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলন নিয়ে রচিত ও মঞ্চায়িত নাটকের সংখ্যা ছিলো কম।
গণনাট্য কর্মীদের জন্য সেটা খুবই স্বাভাবিক ছিলো রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণেই। ভারত কৃষিপ্রধান দেশ, সুতরাং কৃষক আন্দোলনের ওপর রচিত নাটক ও তার প্রযোজনার সংখ্যা প্রথম পর্বে বেশিই হবে। সে কারণে গণনাট্য সংঘে প্রথম দিকে কৃষক আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা নাটকগুলোই খুব সহজে সকলের নজর কেড়ে নেয়। বিজন ভট্টাচার্যের নবান্ন নাটকটি দুর্ভিক্ষের উপর রচিত হলেও সেখানে গ্রাম্য কৃষক জীবনই প্রাধান্য পেয়েছে। যদিও জোতদারদের সাথে কৃষকদের বিরোধ নাটকের মূল দ্বন্দ্ব নয়।
ভারতবর্ষের কৃষক আন্দোলনের কয়েকটি স্মরণযোগ্য নাম তেলেঙ্গানা, কাকদ্বীপ, সোনারপুর ও নকশালবাড়ি। বাংলাদেশের অন্তর্গত ময়মনসিংহের হাজং অঞ্চলে, রাজশাহীর নাচোলে ব্যাপক কৃষক আন্দোলন গড়ে উঠেছিলো। সেইসব দীর্ঘকালীন কৃষক বিদ্রোহে শুধু জমিদার-জোতদার নয়, শাসকগোষ্ঠীরও ঘুম ছুটে গিয়েছিলো। কৃষকদের তেভাগার সংগ্রামে প্রথম সারিতে এসে দাঁড়িয়েছিলো ময়মনসিংহের হাজং চাষীরা এবং মালদহ, দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি জেলা আর দক্ষিণ বাংলার কাকদ্বীপ সোনারপুর ও ভাঙড়ের লক্ষলক্ষ বর্গাচাষী-ক্ষেতমজুররা। দক্ষিণ বাংলায় ভাগচাষী- ক্ষেতমজুরদের অভূতপূর্ব সংগ্রাম চলেছিলো। গোটা চাষী সমাজই এই সংগ্রামে সামিল হয়েছিলো।
অধিকার রক্ষা, অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তারা অবলীলাক্রমে রাইফেলের সামনে দাঁড়িয়েছিলো যদিও সরকারি শক্তির সঙ্গে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত তারা জয় লাভ করতে পারেনি। সেইসব আন্দোলনের কোনোটাই গণনাট্য সংঘের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারেনি। সেইসব বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছে উদয়াস্ত, ডাক, তরঙ্গ, ঢেউ, এই মাটিতে, গায়েন, বাঘের খেলা নাটকগুলো। কৃষক বিদ্রোহের ওপর আর একটি স্মরণীয় নাটক বিদ্রোহী বীর তিতুমীর। কাকদ্বীপ, বুড়ুল, ভাঙড়, সোনারপুর, বড়-কমলাপুর, কোচবিহার তথা পশ্চিম বাংলার কৃষক আন্দোলনের পটভূমিকায় রচিত হলো আরো বেশ কিছু নাটক। যেমন সাঁওতাল বিদ্রোহ, নয়নপুর, আমার মাটি, আবাদ, দেবী গর্জন ইত্যাদি। উনিশশো বত্রিশ সালে মালদহ দিনাজপুরের সাঁওতাল কৃষকরা জমিদার- জোতদারদের বিরুদ্ধে তাদের অধিকার রক্ষার সংগ্রাম করে। সেই প্রেক্ষাপটে রচিত হয় সাঁওতাল বিদ্রোহ।’
স্বাধীনতা লাভের পর শাসক বদল হলেও কৃষক-সামন্ত প্রভু, কৃষক-পুলিশ, পুলিশ- সামন্তপ্রভু-এই সব সম্পর্ক আগের মতোই রয়ে গেলো। জোড়া ডাঙ্গার কৃষকরা যখন তাদের ন্যায্য দাবি নিয়ে লড়াই আরম্ভ করলো পুলিশ তখন সামন্ত প্রভুদের রক্ষা করার জন্য এগিয়ে এলো। কৃষকরা বাধা দিলো এবং নিহত হলো বহু সংখ্যায়। সেই ঘটনা নিয়ে অনিল ঘোষের নয়নপুর নাটক। জমির জন্য কৃষকদের লড়াইকে ভিত্তি করে লেখা হয় এই নাটক। পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত বীরভূম জেলার পটভূমিতে আদিবাসী ও সাঁওতাল চাষীদের আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে দেবী গর্জন। উনিশশো পঞ্চাশ সালে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ করা হয়।
অথচ দেখা গেল আইনের ফাঁক গলিয়ে জোতদার-জমিদাররাই কৃষকদের জমি থেকে উচ্ছেদ করছে। জমির জন্য কৃষকদের সেই সংগ্রামের উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে মনোরঞ্জন বিশ্বাসের আমার মাটি। গোবিন্দ চক্রবর্তীর আবাদ নাটকেও জোতদারদের বিরুদ্ধে চাষী সম্প্রদায়ের সংগ্রাম বিবৃত হয়েছে। বাংলার এ সময়কার কৃষক বিদ্রোহের ওপর আরো প্রচুর নাটক লেখা হয় যার মধ্যে রয়েছে মেঘ কাটার পালা, খাদ্যচোর, ফেরার, পাকা ধানের বাস, শঙ্খচূড় ইত্যাদি। স্বাধীনতা পরবর্তী দেশত্যাগী উদ্বাস্তু জীবনের ওপর রচিত হয়, বাস্তুভিটা, নতুন ইহুদি, দলিল, গোত্রান্তর, আজকাল, ভাঙ্গাবন্দর নাটকগুলি।
পরবর্তীকালে মূলত জোরটা বেশি দেখা যায় শ্রমিক আন্দোলনের দিকেই। শ্রমিক চরিত্র এবং শ্রমিকদের জীবন নিয়ে নাটক লেখা বৃদ্ধি পায় স্বাধীনতার পর। স্বাধীনতার পূর্বে ভারতের জনগণের সাথে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্বটাই ছিলো প্রধান। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে শ্রমিকশ্রেণী ও বুর্জোয়াদের দ্বন্দ্ব মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়।
এই সময় থেকেই। শ্রমিকশ্রেণী এবং শ্রমজীবী জনগণের উপর বুর্জোয়াদের চাপিয়ে দেওয়া নির্মম শোষণের দিকে বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টি পড়ে। নাট্যকাররা শ্রমিকদের নিয়ে বেশি বেশি নাটক লিখতে আরম্ভ করেন। ছাঁটাই বিরোধী ধর্মঘট, মালিকের সঙ্গে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার নিয়ে ধর্মঘট যেমন নাট্যরচনা ও প্রযোজনায় প্রাধান্য পেল, তেমনি মালিকদের শ্রেণীচরিত্রকে নগ্ন করে তোলা হলো যাতে তাদের বিরুদ্ধে দর্শকের শ্রেণীঘৃণা জাগ্রত করা যায়। শ্রমিকশ্রেণীকে নিয়ে অমর গঙ্গোপাধ্যায় লেখেন দ্বান্দ্বিক এবং মমতাজ আহমেদ খাঁ ও রণেন ঘোষ দস্তিদার রচনা করেন ইস্পাত। ধর্মঘট চলার সময় শ্রমিকদের দুরবস্থা এবং তার জন্য তাদের হতাশা, অন্নের জন্য হাহাকার ইস্পাত নাটকে এবং কিছুটা দ্বান্দ্বিক নাটকেও প্রধান হয়ে উঠেছে। ধর্মঘট হলে শ্রমিকরা দাঁতে দাঁত দিয়ে কী কষ্টের ভিতর লড়াই করে তাই এ নাটক দুটিতে ফুটে উঠেছে।
মার্কসীয় বিশ্বাসে শ্রমিকশ্রেণীর সমস্ত সংগ্রাম ক্রমশই রাজনৈতিক সংগ্রামের চেহারা নেয়, শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে পরিণত হয়। শ্রমিকশ্রেণীর এই বৈশিষ্ট্যসূচক দিক নিয়ে বাংলার গণনাট্য যে কয়টি নাটক মঞ্চস্থ করেছে তার মধ্যে বাসুদেব বসুর মুক্তির অন্তরালে একটি। মুক্তির অন্তরালে নাটকে শ্রমিকশ্রেণীর সচেতন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অতি উচ্চ গুণমানে প্রকাশিত হয়েছে। নাটকটির বিষয়বস্তু কেরালার প্রথম কমিউনিস্ট সরকারকে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে ব্যাপক শ্রমিক-গণ আন্দোলন। উনিশশো পঁয়ষট্টি-ছিষট্টি সালে দুর্গাপুরে শ্রমিকশ্রেণী খাদ্য, বন্দীমুক্তি ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে যে বিরাট আন্দোলন করে দিলীপ ঘোষালের আগুন রাঙ্গা ইস্পাত নাটকে তারই এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়।
সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিচালনায় ইস্পাত কারখানার কর্তৃপক্ষ, পুলিশ ও প্রশাসন একযোগে শ্রমিকদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। চলে গ্রেপ্তার, গুলি, ঘোষিত হয় কারফিউ, চারদিকে নেমে আসে সন্ত্রাসের রাজত্ব। এই লৌহ কঠিন বেড়াজালের মধ্যে শ্রমিকশ্রেণী গোপনে ও প্রকাশ্যে আন্দোলন গড়ে তোলে। শাসকশ্রেণী সমস্ত আক্রমণ প্রতিহত করে জয়ী হয়। শ্রমিকদের পরাজয় সত্ত্বেও তাদের উদ্দীপক কার্যকলাপ ও দৃঢ়তার প্রতিচ্ছবি এ নাটকে মূর্ত হয়েছে।”
বীরু মুখোপাধ্যায়ের আঁতাত নাটকে দেখানো হয়েছে শ্রমিক আন্দোলনের চেহারা। নাটকে ফুটে উঠেছে ধনিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে সর্বহারাশ্রেণীর সংগ্রাম। শ্রমিকশ্রেণীকে নিয়ে। লেখা অন্যান্য নাটকের মধ্যে রয়েছে কিমলিস, আলোয় ফেরা, লেবার অফিসার, ফুলের রঙ লাল, ছাঁটাই ইত্যাদি নাটক। বস্তি জীবনের লাঞ্ছনা ও তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং সেই সাথে বস্তি উচ্ছেদের চক্রান্তের প্রতিরোধের ওপর রচিত নাটক পূর্ণগ্রাস, ভাঙাগড়ার খেলা। বিচারের নামে প্রহসনের নাটক বিচার। তন্তুবায় বিদ্রোহের নাটক চন্দনডাঙার হাট। ব্যবসায়িক প্রলোভনের উর্দ্ধে ওঠার ডাক রয়েছে নাট্যকার-এ।
জীবন যন্ত্রণা, পিছুটান, অন্ধ সংস্কার, সংকীর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবিদ্বেষ, জাতিবিদ্বেষ মাড়িয়ে সুস্থ সুন্দর জীবন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামী নাটক গাঙ্গুলী মশাই, নবজন্ম, ইংগিত, কিম্বদন্তী, নাটক নয়, পান্থশালা, নীলদরিয়া প্রভৃতি। ফ্যাসীবাদী সন্ত্রাস ও স্বৈরতন্ত্রের স্বরূপ উদঘাটনের নাটক পাগলাঘণ্টা, রক্তে ধোয়া দিন, পথ, সমুদ্র মন্থন। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মড়া, নয়াবসতে ইত্যাদি। ফ্যাসিস্তদের হাতে নিহত চেক নেতার অমর কাহিনী জুলিয়াস ফুচিক, আইসেন হওয়ারের নির্দেশে ইলেকট্রিক চেয়ারে নিহত আমেরিকার বৈজ্ঞানিক দম্পতি জুলিয়াস ও এথেল রোজেনবার্গের শেষ জীবন নিয়ে লেখা বিশে জুন।
লেনিন ও স্তালিনকে নিয়ে লেখা হয়েছে মহানায়ক কমরেড লেনিন, জোসেফ স্তালিন, ইস্পাতের ফলা। রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ওপর অক্টোবর বিপ্লব, আহ্বান, বিপ্লব। কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস সম্পর্কিত একটি উৎকৃষ্ট নাটক পাণ্ডুলিপি।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কালো মানুষদের স্বাধীনতার সংগ্রাম ও তথাকথিত মুক্ত গণতন্ত্রের প্রহসনকে আখ্যান করে মঞ্চায়িত হয় পশ্চিম স্বর্গ ও মৃত্যুহীন। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে ভিয়েতনাম, ভিয়েতনাম ক্যাম্পেসিনো। এভাবেই গণনাট্য গ্রাম- গঞ্জ পর্যন্ত তার কর্মধারা ছড়িয়ে দিয়েছিলো এবং রাজনৈতিক বিষয়বস্তু ছিলো নাটকের একমাত্র লক্ষ্য। উদ্দেশ্যহীন নাটক তারা করেনি। সরাসরি কৃষক শ্রমিকের পক্ষে এবং সমাজতন্ত্র প্রচারের জন্য নাটক করেছে অর্থাৎ মার্কসবাদী তত্ত্ব প্রচার করেছে নাটকের
মধ্য দিয়ে।
গণনাট্য ছিলো রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ নাট্যধারার পথিকৃত। নাট্যমঞ্চের চরম সংকট মুহূর্তে সংঘ নাটককে বাঁচার পথ দেখিয়েছিলো। উপস্থিত হয়েছিলো নতুন এক মর্মবাণী নিয়ে। সে বাণী বিপ্লবী মানবতাবাদের, সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদী শিল্প চেতনার। মানুষকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন করার দায়িত্বটি চল্লিশের দশক থেকে গণনাট্যই পালন করে আসছিলো। তারপর আমরা দেখতে পাই আরো অন্যান্য অনেক নাট্যধারা। প্রথমে বহুরূপীর ‘নবনাট্য’ ধারা যা পরে ‘সৎনাট্য’ বলেও পরিচিতি লাভ করে। যার সাথে নাট্যচক্র, থিয়েটার সেন্টার, রূপকার, শৌভনিক, গন্ধর্ব, চতুরঙ্গ, থিয়েটার ইউনিট, ক্যালকাটা থিয়েটার, অন্বেষা, নান্দিকার ইত্যাদি দলের নাম যুক্ত হতে থাকে।’
পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকে এই নবনাট্য ধারার শুরু। শম্ভু মিত্র ছিলেন এই নাট্যধারার পথিকৃত। যিনি নাটক করার উদ্দেশ্য মনে করতেন, সামাজিক দায়িত্বজ্ঞানের প্রকাশ ঘটানো। যিনি মনে করতেন, সামাজিক বাস্তবতা কারো পক্ষে এড়ানো সম্ভব নয়। সেজন্য পেশাদারি হওয়ার পথ ছেড়ে তিনি বেছে নিলেন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পথ।
ষাট দশকের শেষে আমরা দেখতে পাই নতুন নাট্য প্রচেষ্টা, গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন। যার সাথে থিয়েটার কমিউন, শূদ্রক, চেতনা, থিয়েটার ওয়ার্কশপ ইত্যাদি দলের নাম যুক্ত হলো; যা দিনকে দিন বিস্তৃত হলো আশির দশকের শুরু পর্যন্ত। দর্শককে সমাজ সচেতন করা ছিলো যাদের লক্ষ্য। গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের নাট্য আন্দোলনের মূলধারা হয়ে দাঁড়ালো। কিন্তু গণনাট্য বাদ দিয়ে বা গণনাট্য আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জনগণকে সমাজ সচেতন করার লক্ষ্যে নবনাট্য, সৎনাট্য বা গ্রুপ থিয়েটার ছদ্মনামে ভিন্ন ভিন্ন পথে আসতে হলো কেন? সেখানে গণনাট্য নামটি ব্যবহারের বাধা কোথায় ছিলো?
প্রশ্নটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের নাট্যান্দোলনের চরিত্রটি বুঝতে হলে এ প্রশ্নের যথাযথ উত্তর আমাদের পেতে হবে। ঘোষণা না দিলেও গণনাট্য ছিলো কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সম্পৃক্ত ও মার্কসবাদী চিন্তা বা সমাজতান্ত্রিক ধারার অনুসারী, পূর্বেই সেটা আমরা দেখেছি। মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসী নাট্যকাররা মনে করতেন, সামাজিক সংঘাতগুলো আসলে শ্রেণীসংগ্রাম ছাড়া কিছু নয় এবং এ সংগ্রামে জয়লাভের জন্য রাজনীতি হলো প্রধান হাতিয়ার। স্বভাবতই সে সময়কার বৃহৎ রাজনৈতিক দল কংগ্রেস-এর চিন্তার সাথে গণনাট্যের মিল ছিলো না। গণনাট্যের নাটকে মূলত মার্কসবাদী আদর্শই প্রচারিত হতো, যা ছিলো ব্রিটিশ সরকার ও কংগ্রেস দলের বিরোধিতারই নামান্তর। ব্রিটিশ শাসক বা কংগ্রেস দুপক্ষের কেউ এই নাট্যধারাকে ভালো চোখে দেখেনি।
তাহলেও গণনাট্যের ওপর প্রথম দিকে সরাসরি কোনো আক্রমণ আসেনি। গণনাট্যের শরিক দল কমিউনিস্ট পার্টির সাথে ব্রিটিশ সরকার ও কংগ্রেসের বিরোধিতা ছিলো দীর্ঘদিনের। মার্কসবাদী ভারতীয় কমিউনিস্ট দলকে কংগ্রেস তার প্রধান প্রতিপক্ষ মনে করতো। মুসলিম লীগ, কংগ্রেস ও ব্রিটিশ রাজের সাথে আলোচনায় কমিউনিস্ট পার্টি কখনও একসাথে বসার সুযোগ পায়নি। স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্বে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে ব্রিটিশ শাসক ও কংগ্রেস দলের বিরোধ চরম আকার নেয় ভারতের স্বাধীনতা লাভের পরিপ্রেক্ষিতে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি চেয়েছিলো কৃষক-শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ শক্তিকে ভারত থেকে তাড়াতে আর কংগ্রেসের লক্ষ্য ছিলো ব্রিটিশদের সাথে আপোষরফার মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ।
জমিদার ও ধনিকদের দ্বারা প্রভাব বিস্তারকারী কংগ্রেস জানতো দীর্ঘ গণযুদ্ধের ভিতর দিয়ে ভারত স্বাধীনতা অর্জন করলে দেশের কর্তৃত্ব তাদের হাত থেকে চলে যাবে প্রলেতারিয়েতদের হাতে। বিশেষ করে স্বাধীনতার প্রশ্নে দেশভাগের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে ছিলো কমিউনিস্ট দল। সেইসব কারণে জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে কমিউনিস্টদের মতপার্থক্য এমনি প্রবল হয় যে, উনিশশো ছেচল্লিশ সালে কংগ্রেস নেতারা জেল থেকে বের হওয়ার পর তাদের প্ররোচনায় কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় অফিস ভাংচুর করা হয় এবং বহু কমিউনিস্ট নেতা ও বুদ্ধিজীবী দৈহিক আক্রমণের শিকার হন। গণনাট্য সংঘও তা থেকে রেহাই পায়নি। ব্রিটিশ আমলের শেষ নির্বাচনে এই বিরোধ চরম আকার নেয়। ব্রিটিশ রাজের সহযোগিতায় জাতীয় কংগ্রেস তখন সর্বশক্তি নিয়োগ করে কমিউনিস্টদের নিধনের জন্য। কমিউনিস্ট নিধনের পাশাপাশি গণনাট্যের উপরেও আক্রমণ নেমে আসে। গণনাট্য সংঘের অফিস ও আবাসস্থল আক্রান্ত হয়।
সেই সময় একদিকে যেমন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, তেমনি অন্য দিকে গণনাট্য সংঘ মারাত্মক বিপাকে পড়ে। রাজনৈতিক দিক দিয়ে বৃটিশের অত্যাচার, কংগ্রেসের বিরোধিতা পার্টিকে আঘাত হানছিলো। তা ছাড়া ছেচল্লিশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটিয়েছিলো। পাশাপাশি ছিলো গণনাট্য সংঘের ভিতরকার সমস্যা। স্বাধীনতার মর্মবস্তু সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ যেমন রাজনীতির ক্ষেত্রে, তেমনি শিল্প- সাহিত্য ও সমাজ প্রগতির প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ কমিউনিস্ট ও অকমিউনিস্ট সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে মত পার্থক্য থেকে গণনাট্য সংঘ ভিতর থেকেই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়।
গণনাট্যের মঞ্চে শ্রেণীসংগ্রামই ছিলো প্রধানতম বিষয়। ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো দ্বিমত দেখা না দিলেও যুদ্ধ শেষে শ্রেণীসংগ্রামের আদর্শে অনেক সদস্যই অবিচল থাকতে পারলেন না। ‘সমস্ত শিথিলতা ও পিছুটান সরিয়ে ফেলে সংগ্রামী শ্রমিক, কৃষক ও মধ্যবিত্তের লড়াইয়ের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে’ কিংবা ‘প্রতিটি রাজনৈতিক সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে হবে’-গণনাট্যের এই ঘোষণার মধ্যে শ্রেণীসংগ্রামের যে বিশ্লেষণ ও নাট্য কর্মীদের বিশেষ শিবির বেছে নেয়ার আহ্বান, তা অনেকেরই ভালো লাগেনি। গণনাট্য পার্টি সংগঠকদের দ্বারা তৈরি হলেও ওটা পুরোপুরি পার্টি সভ্যদের দ্বারা গড়া ছিলো না।
দ্বিতীয়ত পার্টির বাইরেকার কিছু লোক এই সংগঠনে ছিলেন যাঁরা সমাজতন্ত্রে ঘোরতর বিশ্বাসী হলেও কমিউনিস্ট পার্টির দৈনন্দিন নীতি মেনে চলার দায় বোধ করতেন না। বহু কর্মীর মধ্যেই সংস্কৃতি আন্দোলনের তাৎপর্য পরিষ্কার ছিলো না। তাদের ধারণা ছিলো শিল্প তারা শিল্পের জন্যই করবেন, রাজনীতির বায়নাক্কা কেন?
‘শিল্পের মধ্যে রাজনীতি’-সরকার যে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি বরদাস্ত করবে না তা ছিলো খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এই চিন্তার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো গণনাট্যেরই বেশ কিছু নেতৃস্থানীয় সদস্য। সেজন্য গণনাট্য সংঘের দ্বারা রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলনকে বিস্তৃত করার যে বিপুল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিলো, মধ্যবিত্ত মানসিকতার যেসব অরাজনৈতিক শিল্পী এখানে সমবেত হয়েছিলেন, তাঁদের শ্রেণী অবস্থানের সহজাত ভাবনাতেই বিপ্লবী চেতনার আন্দোলনকে সাংগঠনিক দৃঢ়তায় কার্যকরী করা গেল না। সর্বভারতীয় সংগঠন হিসাবে গণনাট্য সংঘ এই সময় তার দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। পার্টিকে তখন একদিকে জাতীয় কংগ্রেসের আক্রমণের এবং অন্যদিকে ব্রিটিশ সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সংগঠন তৈরি করতে হচ্ছিলো।
সারা পৃথিবীর রাজনীতি ও ঘটনা এতো দ্রুত এই সময়ে পরিবর্তিত হচ্ছিলো যে, পার্টি সব সময় তার সঙ্গে তাল রাখতে পারেনি। একইভাবে গণনাট্যের সমস্যার ব্যাপারেও তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলো না। সে সময়ে পুরন্দর চাঁদ যোশী কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। গণনাট্য শিল্পীদের নিয়ে সারাদেশের জনগণের কাছে যাওয়ার চাইতে, তিনি সব শিল্পীকে বোম্বেতে এনে তাঁদের নগরকেন্দ্রিক শিল্প প্রযোজনার দিকে উৎসাহ দিতে থাকেন। পরবর্তী সময় অনেকেই যোশীর এই সিদ্ধান্তকে সমালোচনা করেন।
সাধারণ সম্পাদক যোশীর এই সিদ্ধান্তে গণনাট্যের কার্যক্রম গ্রাম-গঞ্জ থেকে নগরকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে, যার ফলাফল হয়ে দাঁড়ায় মারাত্মক। গণনাট্যের শিল্পীদের মধ্যে শহরমুখী সংস্কৃতি চর্চার স্বপ্ন বাসা বাঁধে। মূল ভাবনা থেকে সরে গিয়ে তথাকথিত প্রতিষ্ঠানগত খ্যাতি ও উচ্চাশা তাই অনেককেই সেই সময় হাতছানি দিয়েছিলো। কিছু নাট্যকর্মী শ্রেণীসংগ্রামের সমাজবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যাগ করে সমঝোতার পথে পা বাড়াবার কথাও ভাবছিলেন। অনেকের মধ্যেই যে গণনাট্যের মূল ভাবাদর্শ গভীরভাবে কাজ করেনি এটাই তার প্রমাণ। ফল কি দাঁড়ালো? গণনাট্য কর্মীরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আত্মত্যাগ ও কষ্ট স্বীকারের যে ব্রত নিয়েছিলেন তা কয়েক বছরের মধ্যেই ভেঙে পড়ে।
যার জন্য গণনাট্যের সেই চোখ ধাঁধানো অরুণোদয় অচিরেই মেঘম্লান হয়ে যায়। যতোই সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিক দর্শনে উদ্বুদ্ধ হোক না কেন মূলে অর্থাৎ নেতৃত্বে সত্যিকারের শ্রমিকশ্রেণী না থাকলে মধ্যবিত্তরা কিংবা মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীর দল অন্তরের গভীর গভীরতর স্তরে ওৎ পেতে থাকা মধ্যবিত্ত সুলভ সুবিধাবাদ ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব তথা অহংবোধ নিয়ে বেশি দূর যেতে পারে না।” চল্লিশের দশকের শুরুতে যে রাজনৈতিক সামাজিক চেতনা গণনাট্যের ভিত্তিভূমি রচনা করেছিলো, রাজনৈতিক বিরোধ ও সাম্প্রদায়িক টানাপোড়েনে এবং কিছু কিছু ব্যক্তির মধ্যবিত্তসুলভ বিভ্রান্তিতে তা ক্ষয় হতে শুরু করেছিলো। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তখনো স্বাধীনতার জন্য লড়তে হচ্ছিলো বলে সে বিরোধ সাময়িকভাবে চাপা পড়েছিলো। স্বাধীনতার পর তা আর চাপা থাকে না, প্রকাশিত হয়ে পড়ে।
বাংলা ও পাঞ্জাবকে দ্বিখণ্ডিত করে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে সাতচল্লিশ সালে। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ রাজ চলে গেল, ভারতবর্ষ শাসনের ভার পড়লো জাতীয় কংগ্রেস দলের নেতাদের হাতে। দেশীয় বুর্জোয়া শিল্পপতি, জমিদারদের স্বার্থ ও প্রয়োজনের স্বীকৃতি ঘটলো সেখানে। সাম্রাজ্যবাদ তখন আর প্রত্যক্ষ শত্রুর ভূমিকায় নেই, আছে দেশীয় শাসকরা, আছে একটি শোষণভিত্তিক রাষ্ট্রযন্ত্র। স্বভাবতই দেশের ভিতর সংগ্রামের চেহারায় মৌল পার্থক্য এলো। বিদেশি শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ব্যাপারটি এবার স্বদেশি শোষকদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্ন হয়ে দেখা দিলো। যা ছিলো পূর্বে ফ্যাসিবাদ বিরোধী ও স্বাধীনতা লাভের সংগ্রাম, স্বাধীনতা-উত্তর যুগে সেটি সরাসরি মার্কসীয় অনুকরণে সমাজতন্ত্র তথা সাম্যবাদী আন্দোলনে রূপ নিলো।
গণনাট্য সংঘ মেতে উঠলো ক্ষমতাসীন দেশীয় শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে সরাসরি দ্বন্দ্বে। গণনাট্য সংঘের সাচ্চা কর্মীরা যখন সেই বৃহত্তর লড়াইয়ে সামিল হলো, মধ্যবিত্তদের তাতে তেমন উৎসাহ ছিলো না। ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে যে মধ্যবিত্তরা জাতীয়তাবাদী প্রতিরোধ আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিলো, স্বাধীন দেশে তারা লড়াই করার পরিবর্তে নিজেরাই কিছু পেতে চাচ্ছিলো। গণনাট্যের জন্য সেটা ছিলো সবচেয়ে দুর্যোগপূর্ণ সময়। ঘরে-বাইরে দুদিকের শত্রু দ্বারা তারা আক্রান্ত হচ্ছিলো।
স্বাধীনতার পর যখন কংগ্রেস সরকার শাসনযন্ত্র হাতে নিলো তাদের সঙ্গে সাম্যবাদী ভাবনার সংঘর্ষ অনিবার্যভাবেই দেখা দিলো। গণনাট্য সংঘ শোষিত মানুষের সহযাত্রী, মেহনতী মানুষের সাংস্কৃতিক সংস্থা। পূর্ব ঘটনার জের হিসাবে কংগ্রেস সরকার যে গণনাট্যের ওপর সদয় বা প্রীত থাকবে না সেটাই ছিলো স্বাভাবিক। সুতরাং বুর্জোয়া- জমিদাররা এ সংস্থাকে তাদের শত্রু মনে করলো। সদ্য স্বাধীন দেশে কংগ্রেসী সরকার গণনাট্য সংঘের সাথে এমন ব্যবহার আরম্ভ করলো যেন সেটা একটা বে-আইনি সংস্থা। সাম্রাজ্যবাদী আমলে যেমন এই নাটকের দলটিকে সহ্য করা হয়নি, স্বাধীন ভারতের শাসকদলও এদের সহ্য করলো না।
ব্যবসায়ী, ধনী ও জমিদারদের প্রতিনিধি কংগ্রেস তার শ্রেণীস্বার্থেই গণনাট্যকে স্তব্ধ করতে চাইলো। গণনাট্য স্তব্ধ করার জন্য তারা দ্বিমুখী আক্রমণ চালালো। একদিকে গণনাট্য কর্মীদের ওপর আক্রমণ, জেলে পাঠানো, নাট্যাভিনয়ের অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া, নাটক নিষিদ্ধ করা প্রভৃতি চলতে লাগলো, তেমনি অন্যদিকে গণনাট্য কর্মীদের প্রলোভন দিয়ে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে তাদের অনুগত কর্মীতে রূপান্তরের প্রচেষ্টাও অব্যাহত রইলো।
স্বাধীনতার পরপরই পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়, পার্টির সকল দপ্তর সরকারের দখলে চলে যায় এবং পার্টির প্রেস ও সমস্ত অর্থ বাজেয়াপ্ত করা হয়। পাশাপাশি গণনাট্যের ওপরেও চলে আক্রমণ। পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার মাসখানেক পূর্বে উনিশশো আটচল্লিশ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি গণনাট্য সংঘের তৎকালীন সম্পাদক চারুপ্রকাশ ঘোষের বাড়িতে গণনাট্য কর্মী সুশীল মুখোপাধ্যায় এবং সমর্থক ভবমাধব ঘোষ শত্রুর অতর্কিত আক্রমণে নিহত হন। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার যুব প্রতিনিধিদের সম্মানে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে রাত্রির অন্ধকারে এই আক্রমণ ঘটেছিলো। আক্রমণকারীরা বিদ্যুৎ-যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে স্টেনগান নিয়ে আক্রমণ করে। হত্যাকারীদের পরিচয় গোপন থাকেনি, কংগ্রেস শিবিরে সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীর ভূমিকায় তাদের বারবার দেখা গেছে।
নাটকে তারা রাজনীতির গন্ধ পেয়েই শঙ্কিত ছিলো। গণনাট্যের নাটক যে মানুষকে শ্রেণীসংগ্রামের পথে উদ্দীপ্ত করে তুলতে পারে সেটা বুঝতে পেরেই তারা গণনাট্যের মতো বলিষ্ঠ সংগঠনকে ভাঙবার কাজে সচেষ্ট হয়েছিলো। সেজন্যই চলে সরকারি আক্রমণ।
উনিশশো আটচল্লিশ থেকে পঞ্চাশ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি জাতীয় কংগ্রেসের অত্যাচারে উত্তেজিত হয়ে অতিবাম রাজনীতি গ্রহণ করে। তাতে সমস্ত গণ আন্দোলন থেকে দোদুল্যমান মধ্যবিত্তরা সরে যায়। পার্টি এ সময় দুর্বল হয়ে পড়ে। মতাদর্শগত সংগ্রাম চালাবার শক্তি হ্রাস পায়। পার্টিকে এ সময় ভিন্ন পথ ধরতে হয়, সে পথ সশস্ত্র সংগ্রামের পথ।
কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির সংঘর্ষ যখন কাকদ্বীপ ও তেলেঙ্গনাতে সশস্ত্র রূপ ধারণ করে তখন গণনাট্য সংঘের নামও কংগ্রেস সরকারের দ্বারা অবৈধ ঘোষিত হয়েছিলো। গণনাট্য সংঘের সাথে জড়িত যেসব নাট্যকর্মীরা রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছিলেন না তাঁরা এ সময় দ্বিধান্বিত ছিলেন; নিজেদের ওপর আক্রমণের ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছিলেন। ‘নাটক করবো, হাততালি কুড়োবো, অভিনয় চাতুর্য দেখাবো, পারলে মানবিকতার খাতিরে জনগণের সুখ-দুঃখের কথাও বলবো কিন্তু রাজনৈতিকভাবে বে-আইনি একটি সংগঠনের হয়ে এসব করতে গেলে জীবনের ঝুঁকি থেকে যায়! তাই অনেকে গণনাট্য থেকে সরে পড়লেন। গণনাট্যের নাটকের লক্ষ্য ছিলো শ্রেণীসংগ্রাম প্রচার করা।
অথচ নাট্যশিল্পীদের অনেকেই এ সময় নাটককে সুন্দরভাবে করার দিকে জোর দিলেন। বক্তব্যের চেয়ে নাট্যশিল্পের দিকে জোর দিতে চাইলেন গণনাট্যের মূল দাবিকে অস্বীকার করে। নাটকটাই প্রধান হয়ে উঠলো, জনগণ নয়। শিল্প যে গণসংগ্রামের হাতিয়ার এমন ভাবনা তারা আর ভাবতেই চাইছিলেন না। জনগণের কাছে যাওয়া তো দূরের কথা, সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইলেন সরকারি আক্রমণের ভয়ে। গণ সংস্কৃতির ময়দানে যাঁরা সৌখিন মজদুরী করতে এসেছিলেন তাঁরা এই সকল ঘটনার পর গণনাট্যে থাকা নিরাপদ মনে করলেন না।” স্বাধীনতার পূর্বে মধ্যবিত্তের যে শক্তি শ্রমিক-কৃষকদের সংগ্রামে শরিক হয়েছিলো স্বাধীনতার পর সেই মধ্যবিত্ত অংশ কী রাজনীতিতে, কী শিল্প সংস্কৃতির ক্ষেত্রে হলো বিপর্যস্ত, বিভক্ত ও বিভ্রান্ত। স্বাধীনতার প্রয়োজনে পরাধীন যুগে যে দৃষ্টি ছিলো স্বচ্ছ, তা * ক্রমশ ঘোলাটে হতে লাগলো।
সাতচল্লিশের আগে মধ্যবিত্ত শিক্ষিতদের নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষকদের নিয়েই ছিলো গোটা জাতির রাজনীতি ও স্বাধীনতা অধিকারের সংগ্রাম। ক্ষমতা হস্তান্তরের পর বুর্জোয়া-জমিদারদের, অর্থাৎ শাসকশ্রেণীর প্রভাবে দ্বিধাগ্রস্ত ও দোলাচল মধ্যবিত্ত অংশের কাছে রাজনীতি থেকে দূরে সরে থাকাটাই প্রধান হয়ে গেলো। আর স্বাধীনতার ব্যাপারটা আখেরমুখী ব্যক্তিতান্ত্রিকতায় সীমাবদ্ধ ও সংকুচিত হয়ে পড়লো। স্বভাবতই মধ্যবিত্ত শিক্ষিতদের একটা বড় অংশ বুর্জোয়া-জমিদারদের স্বাধীন শাসনযন্ত্রের কৃপাধন্য থাকার জন্য এবং নিজেদের গোছানো ঘরগুলোয় ঝড়ের হাওয়া লাগার ভয়ে, রাজনীতির আঁচ থেকে দূরে থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করলেন।
যাঁরা ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক-শিল্পীদের আন্দোলনে, গণনাট্য আন্দোলনে জোয়ার সৃষ্টি করেছিলেন, তাঁদেরই একাংশ স্বাধীনতার পর ব্যক্তিগত সুখ ও প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পথকেই দেশ গড়ার ও সুসংস্কৃত হওয়ার পথ বলে আঁকড়ে ধরলেন। যাঁরা একদিন একমন, একপ্রাণ হয়ে মাঠে নেমেছিলেন, দেখা গেল তাঁরাই ভিন্ন ভিন্ন পথে পা বাড়িয়েছেন। মনোরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায়, মধ্যবিত্ত শিল্পী-কর্মীদের ঘর নেই, পরিবারগুলিও ছিন্নমূল এবং জীবিকাগত নিরাপত্তার অভাবে দিশাহারা। গণনাট্য সংঘের এইসব অধিকতর প্রতিভাবান শিল্পীরা বুর্জোয়া-শিল্পরীতির বাজারে ও ধনিকপুষ্ট শিল্পীদের সাথে বিষম প্রতিযোগিতায় মার খেতে রাজি নন। তাঁদেরও নতুন ঘর বাঁধতে হবে, বাঁচতে হবে। তাই তাঁদের মধ্যে একাংশ ‘অধিকতর শিল্প চাই’ অথবা ‘আঙ্গিকের উৎকর্ষতা বাড়াতে হবে’ বলে সরাসরি আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আখের গড়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়লেন।”
কাজেই চল্লিশের দশকে শ্রমিক-কৃষকদের বিপ্লবী সংগ্রামের শরিক হয়ে যে গণ- শিল্পীরা একদিন এগিয়ে এসেছিলেন, ক্রমে তাঁদের অনেকেই স্বদেশি শোষকশ্রেণীর কৃপা লাভের জন্য বুর্জোয়া শিল্প দর্শনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। যেভাবে ভারত দেশটা দুখণ্ড হয়ে গেল তেমনি দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেল ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের মানুষগুলো। সাতচল্লিশের স্বাধীন ভারতে মধ্যবিত্ত লেখক শিল্পীদের বড় একটা অংশ আত্মপ্রতিষ্ঠার দিকে চলে গেল গণনাট্যের আদর্শকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে। সমস্ত ব্যাপারটাই যেহেতু মধ্যবিত্ত উদ্যমে তাই সামাজিক ভাঙচুরের মধ্যে গিয়েও পুরোটা এগিয়ে যাওয়ার সাহস থাকে না মধ্যবিত্ত শিল্পীদের। গণনাট্য সংঘ শ্রমিক-কৃষকদের সংগ্রামী স্বার্থে নাটক মঞ্চস্থ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলেও মধ্যবিত্ত মানসিকতার দুর্বল বিপ্লবী চেতনা নিয়ে এর নেতৃত্ব ছিলো দোদুল্যমান।
বিপ্লবের প্রতি, সংগঠনের প্রতি তাদের আনুগত্য দৃঢ় বন্ধনে বাঁধা ছিলো না। সেজন্যই সত্যিকারের লড়াইয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শিল্পীদের সব ব্যক্তিগত শ্রেণী-বৈশিষ্ট্য, সংস্কার, পিছুটান, উচ্চবিত্ত জীবনের আকাঙ্ক্ষা ধীরে ধীরে মাথা চাড়া দিতে লাগলো। অর্থচ এঁরাই ছিলেন একদিন গণনাট্য সূচনার অগ্রণীবাহিনী, সেদিন সুবিধাভোগী এবং সুবিধাবাদী চরিত্রের এই মানুষগুলোই শ্রেণীবিভক্ত সমাজের আমূল পরিবর্তন ঘটাবার চিন্তার সাথে ঐক্যমত পোষণ করেছিলেন।
পার্টি ও গণনাট্য সংঘের রাজনৈতিক দুর্যোগে এঁরাই আবার প্রতিক্রিয়াশীলদের সঙ্গে হাত মেলালেন। অনেকে হয়ে পড়লেন নিষ্ক্রিয়, আবার অন্য দল গণনাট্য সংঘকে বিলুপ্তির পথে নিয়ে যাবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন। কমিউনিস্ট আক্রমণের মুখে গণনাট্য সংঘ আর দাঁড়াতে পারবে কি না সে প্রশ্ন নিশ্চয় তাঁদের কাছে প্রাধান্য পেয়েছিলো।
রাজনৈতিক সন্ত্রাস, দাঙ্গা, দেশবিভাগ ও স্বাধীনতা প্রায় পরপর এসে গেল। স্বাধীনতা পাওয়ার বছর ঘুরতে না ঘুরতেই গণনাট্য আন্দোলনেও চিড় ধরলো। গণনাট্য ভাঙলো এবং শুরু হলো ‘নবনাট্য’ নামে নতুন আন্দোলন। ক্ষোভ-অভিমান- আত্মপ্রতিষ্ঠার ব্যাপার তো ছিলোই, অনেকগুলি কারণের মধ্যে একটি হলো গণনাট্য কর্মীদের আর্থিক দুর্দশা। যাঁরা মাসোহারা পেতেন, গণনাট্য সংঘ কংগ্রেসী আক্রমণের মুখে পড়ে সেটাও বন্ধ হবার অবস্থা।
শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, মহম্মদ ইসরাইল, তৃপ্তি মিত্র প্রমুখ এই সময়ই গণনাট্য থেকে বেরিয়ে যেতে শুরু করেন। শম্ভু মিত্র গণনাট্য সংঘ ছাড়ার পর আরো অনেকের সাথে মিলে গণনাট্যের বাইরে প্রথম বাংলা অপেশাদার নিয়মিত নাট্যদল গঠন করেন ‘বহুরূপী’ নামে। বহুরূপী প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হলো ভালোভাবে ভালো নাটক করা। পরপর যে কয়টি নাটক তিনি করলেন সবগুলোই সাফল্য পেল প্রযোজনার গুণেই। গণনাট্য ছেড়ে নতুন যে নাট্যধারা তিনি চালু করলেন তার নামকরণ করা হলো ‘নবনাট্য’ বা ‘সৎনাট্য’। ‘গণ’ এর জায়গায় ‘নব’ বা ‘সৎ’ শব্দটি এলো। গণ হারিয়ে গেল নামকরণে এবং বিষয়বস্তু নির্বাচনে।
বহুরূপী তার নাটকগুলোকে রাজনৈতিক দলের উগ্র প্রচারকার্যে জড়াতে দিলো না। নাটক মঞ্চায়ন সম্পর্কে শম্ভু মিত্র যে বিশ্বাসের কথা প্রচার করলেন তাহলো, শ্রেণী বিশেষের বা দল বিশেষের জীবন নয়, সমগ্র জাতির কথা বলবে নাটক। সমগ্র শ্রেণীর সুখ-দুঃখ-আশা-আনন্দ নিয়ে যে মহৎ জীবন, সেই জীবনের স্রোতকে বইয়ে দিতে হবে মঞ্চের মাঝখান দিয়ে। সেই স্রোতে স্নান করতে দিতে হবে দর্শকদের।”
তিনি স্পষ্টই শ্রেণীসংগ্রাম বা শ্রমিকশ্রেণীর মতাদর্শকে বাদ দিলেন নাটক থেকে। বহুরূপী এসেই দর্শক হৃদয় জয় করলো। তাদের নাটকের বিষয়বস্তু সরকার কিংবা দলের ওপর আক্রমণ আসতে পারে এমন কারো বিরুদ্ধে যায়নি। বিষয়বস্তুর মধ্যে তারা কোনো শত্রু পক্ষ নির্ধারণ করেনি। গণনাট্যের ওপর তখনও সরকারি আক্রমণ চললেও ব্যবসায়িক সংবাদপত্র এবং সরকার দুহাত তুলে বহুরূপীকে আশির্বাদ করলো। কিছু কিছু সংবাদপত্র এদের নিয়ে এতো প্রচারে মেতে উঠলো যে পেশাদার থিয়েটারগুলো পর্যন্ত ভীত হয়ে পড়লো।
যেমন বিভাব মঞ্চায়ন সম্পর্কে লেখা হলো, মনে হয় সুযোগ পেলে এরা নাট্যজগতে বিপ্লব ঘটাবার শক্তির অধিকারী। আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা হলো, বহুরূপীর ছেঁড়া তার যিনি দেখবেন তিনিই বুঝতে পারবেন বাংলা নাটকের অভিনয়ের ক্ষেত্রে এরা অভিনবত্ব এনেছে। তাদের অভিনয় আদর্শের উপযোগী নাটক বাংলায় এখন পাওয়া কঠিন। খেয়াল করতে হবে যে, বিষয়বস্তু নয় অভিনয়ই প্রধান হয়ে উঠেছিলো নাটকে। পথিক নাটকের অভিনয় সম্পর্কে আনন্দবাজার পত্রিকার সমালোচনায় বলা হলো, শ্রীমতি তৃপ্তি মিত্র এবং এক উদ্ভট চরিত্র যুবকের ভূমিকায় শ্রী শম্ভু মিত্র প্রথম শ্রেণীর অভিনয় করেছেন। রসোত্তীর্ণ এই নাটকখানি অভিনয় নৈপুণ্যে সার্থক হয়ে ওঠে।
পত্রিকাগুলোর প্রশংসা যে মিথ্যা ছিলো তা নয়। শম্ভু মিত্র রাজনীতি থেকে সরে গেলেও, গণনাট্য ত্যাগ করলেও বাংলা নাটক মঞ্চায়নে নতুন আঙ্গিক সৃষ্টি করেছিলেন তিনি একক প্রতিভা ও পরিশ্রমে। তিনিও নিখুঁতভাবে শিল্পমানসম্পন্ন নাটক মঞ্চায়নের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। বাংলা নাটকে বিজ্ঞানমনস্ক বাচিক অভিনয়রীতি প্রবর্তনে এবং বাস্তববাদী নাট্য আঙ্গিক নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনি বিরাট ভূমিকা রাখেন। শম্ভু মিত্রের উদ্ভাবিত নাট্যকৌশল পরবর্তীকালে নবনাট্য ও গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের সাথে জড়িতদের নাটক মঞ্চায়নে প্রভৃত সাহায্য করেছিলো। বহুরূপীর রক্তকরবী দেখে উৎপল দত্ত লিখেছিলেন, ‘শল্প বাবুর সূক্ষ্ম রসবোধ এবং প্রয়োগ কৌশলের অভিনবত্ব এমন এক নাটক সৃষ্টি করেছে যা বাংলা রঙ্গমঞ্চের প্রকৃত ঐতিহ্যকে ধরে তাকে বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়েছে।
বিগত পঁচিশ বৎসরে বাংলা দেশে কোনো নাটক এ করতে পেরেছে বলে জানা নেই।’ তিনি বহুরূপীর নাটক সম্পর্কে আরো লিখছেন, ‘উলুখাগড়া, পথিক ও ছেঁড়া তার নাটক হিসাবে কোনোটাই আমার ভাল লাগেনি। কিন্তু প্রযোজনার দিক থেকে মনে হলো নতুন বাংলা নাট্যশালার জন্ম হচ্ছে।’
শম্ভু মিত্র, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, মহম্মদ ইসরাইল, গঙ্গাপদ বসু প্রমুখর দ্বারা বহুরূপী গঠন এবং সাফল্য লাভের পর, সেই পথ ধরে ব্যাপকভাবে গণনাট্য শিল্পীরা বের হয়ে আসেন এবং গড়ে তোলেন নতুন নতুন নাট্যদল। আটচল্লিশ সাল থেকেই গণনাট্য ছেড়ে চলে যাওয়ার যে প্রবণতা শুরু হয়েছিলো ষাটের দশক পর্যন্ত সেটা চলতেই থাকে। নানা ছলছুতো করে গণনাট্য থেকে অনেকে বেরিয়ে গিয়ে নতুন দল গড়তে থাকেন। মুখে আদর্শের বুলি রেখে পেশাদারি হওয়ার সুযোগও খোঁজেন। যাঁরা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে এগিয়ে থাকা কমরেডদের একদা গাল দিয়েছিলেন পরে নিজেরাও তাঁদের পথ ধরলেন। গণনাট্য সংঘে এটা একটা প্রথা হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো।
স্বাধীনতা লাভের অনেক আগেই, গণনাট্য আন্দোলনে এমন একটি প্রবণতা জন্ম লাভ করেছিলো যার প্রতিক্রিয়ায় সংগঠন বারবার সংকটাপন্ন হয়ে অবশেষে বাষট্টির রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতায় ভাঙনের প্রান্তদেশে এসে দাঁড়ায়। গণনাট্য থেকে বেরিয়ে আসা কর্মীদের দ্বারা গঠিত নতুন নতুন নাট্যদলের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকায় তারা নিজেদের এক বিশেষ গোষ্ঠী বা বিশেষ মতবাদে বিশ্বাসী এই ধরনের একটা নামে চিহ্নিত করতে চাইলো। তখন থেকেই নবনাট্য আন্দোলন কথাটার প্রচলন। নতুন নতুন আরো দল নবনাট্যের সাথে যুক্ত হলে নবনাট্যও ব্যাপকতা লাভ করে। নব নাট্যের পাশাপাশি সৎনাট্য কথাটারও প্রচলন ঘটে।
সাম্রাজ্যবাদ তথা ফ্যাসিবিরোধী যে কার্যক্রমের পতাকাতলে গণনাট্য সংঘ বিভিন্ন স্তরের শিল্পী এবং বুদ্ধিজীবীদের এক জায়গায় জড়ো করতে পেরেছিলো, গণনাট্য সংঘের নিজের কমজোরি হয়ে পড়া এবং স্বাধীনতার পরপরই সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটায় সে আর সেই আগের প্রভাব বিস্তার করতে পারছিলো না। সে সাথে চরমপন্থী রাজনৈতিক মতবাদ গ্রহণ করায় সকলকে একসূত্রে বেঁধে রাখা যাচ্ছিলো না।
পাশাপাশি গণনাট্য কর্মীদের ওপর সরকারি হামলা ও বিধি নিষেধে গণনাট্য আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসছিলো। গণনাট্য প্রযোজিত উনিশশো তিপ্পান্ন সাল পর্যন্ত উনষাটটি নাটক পুলিশ কমিশনার চেয়ে পাঠিয়ে পরীক্ষা করলেন এবং প্রায় সবকটির অভিনয় বন্ধ করে দিলেন। * গণনাট্যের এগিয়ে যাবার সমস্ত পথ এভাবে বন্ধ করে দেয়া হলো। গণনাট্য সংঘের সেই দুর্দিনে আরো অনেক শিল্পীই সেদিন শিবির পরিত্যাগ করেছিলেন। শুধু ব্যক্তিগত উচ্চাশা এবং অর্থনৈতিক কারণ নয়, রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াশীল আক্রমণের ভয়ও ছিলো অনেকের মধ্যে। গণনাট্য সংঘে এসেই তাঁরা পেয়েছিলেন আত্মপ্রতিষ্ঠার সুযোগ, সম্মান ও খ্যাতি। প্রতিষ্ঠানের দূরবস্থার দিনে সেসব ভুলে গেলেন। প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের চেয়ে, প্রতিষ্ঠানের আদর্শকে সমুন্নত রাখার চেয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ চিন্তাই তাঁদের কাছে প্রাধান্য পেয়েছিলো। সেজন্য গণনাট্য থেকে পাওয়া খ্যাতি ভাঙিয়ে ব্যক্তি প্রতিষ্ঠার ও অর্থনৈতিক সুবিধার জগতে চলে গেলেন।”
শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও শত্রুপক্ষের অন্যান্যরা ভালোই জানতো গণনাট্যের মাধ্যমে শ্রেণীসংগ্রাম কীভাবে সমাজের অন্তঃস্থলে অনুপ্রবেশ করেছে। গণনাট্য থেকে বেরিয়ে আসা দ্বিধাগ্রস্ত বিপথগামীদের চড়াদামে কিনে নিতে তারা যথেষ্ট তৎপর হলো। কায়েমী পুঁজিবাদী স্বার্থ এবং তার পরিবর্তন বিরোধী গোষ্ঠী সমস্ত পসরা নিয়ে তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে এলো। গণনাট্যের পরিবর্তে যাঁরা স্বাধীন থিয়েটারের, নবনাট্যের প্রবর্তক হয়ে উঠেছিলেন নানাভাবে তাঁদের কেনা-বেচা চলতে লাগলো। মধ্যবিত্তের পাওনা গণ্ডা বুঝে নিতে তাঁরাও সে পথে পা বাড়ালেন। যেমন বলেছিলেন যোসেফ স্তালিন, বুদ্ধিজীবী- কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকরা কিংবা তাঁদের অনেকেই অনেক অলীক আশা আর স্বপ্ন নিয়ে বিপ্লবের সমর্থনে ঝাঁপিয়ে পড়তে চান। পরবর্তী অধ্যায়ে পথের বন্ধুরতা দেখে শঙ্কিত হয়ে পড়েন।
আশাভঙ্গের হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে বিলাপ করতে থাকেন, কেউ বা আত্মবিনাশের পথও বেছে নেন। শিল্পী কিংবা রাজনীতিক যখন লক্ষ্যের প্রতি বিশ্বাস খুইয়ে নৈরাজ্যবাদী হয়ে পড়েন তখনই তিনি বা তাঁরা সন্ধান করেন তাঁদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার। যাঁরা নিজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আসেন তাঁরা তো সবকিছুকেই তাঁর প্রতিষ্ঠার সিঁড়ি হিসাবে ব্যবহার করেন যখন যেভাবে সুযোগ এসে যায়। সেই তাঁরাই গণনাট্য চর্চার নামে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ছত্রছায়ায় তার সাংগঠনিক সুবিধাদি গ্রহণ করে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার পর চরম সুবিধাবাদের পথ অবলম্বন করে সংগঠন ছেড়ে চলে গেলেন। শ্রেণীহীন সমাজ গঠনের আদর্শে উদ্বুদ্ধ মধ্যবিত্ত জীবন, বিপ্লবী চেতনা নিয়ে কতোটা তারা এগোতে পারে আর কতোটা পারে না, তারই এক দলিল হয়ে থাকলো বাংলার এই অপেশাদার থিয়েটার আন্দোলনের বিশিষ্ট অধ্যায়টি।
যাঁরা একদা প্রগতি লেখক সংঘের ঘোষণাপত্রে সংযোজিত ‘মানুষের জন্য শিল্প’ কথাটি মেনে নিয়েছিলেন পরবর্তীকালে তাঁদের অভিযোগ ছিলো শিল্প-সাহিত্য হয়ে উঠছে প্রচারধর্মী এবং সাম্যবাদ প্রাধান্য পাচ্ছে। শম্ভু মিত্র প্রমুখ মনে করতেন যে, গণনাট্য প্রকৃত পক্ষে শ্লোগান মঙ্গারিং করে যাচ্ছে। সেসব বাদ দিয়ে শিল্পের দিকে জোর দেয়া দরকার। তাই তারা রাজনীতিহীন শিল্প চর্চার দিকে ঝুঁকলেন। রাজনীতি বাদ দিয়ে শিল্প চর্চা সম্পর্কে লেনিন বলেছিলেন, শিল্পী সাহিত্যিকদের রাজনীতিহীনতার শ্লোগান ভণ্ডামি ও বেশ্যাবৃত্তি ছাড়া কিছু নয়। যারা গণনাট্যের নাট্যকর্মী ছিলেন, অথচ রাজনৈতিক চেতনায় ন্যূন ছিলেন পরবর্তীকালে তাদের বৃহৎ একটি অংশ ‘বিশুদ্ধ শিল্পের’ ‘সৎ নাটকের’ প্রচারক হয়ে উঠলেন এবং ধনিকশ্রেণীর স্বার্থরক্ষায় এবং মনোরঞ্জনে নিজেদের নিয়োগ করলেন।
যাঁরা ডিক্লাসড হতে চেয়েও সদা সচেষ্ট আপার ক্লাশে উঠতে, সেই মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের খ্যাত শিল্পীরা নবনাট্য নামক নতুন নাট্যচিন্তার প্রবর্তন করলেন। নামের মোহই যেখানে উকিঝুঁকি মারছিলো। গণনাট্য ছেড়ে যখন চলে গেলেন তাঁদের পক্ষ থেকে অবশ্য অজুহাত দেখান হলো পার্টির সংগঠকদের সাংগঠনিক অযথা হস্তক্ষেপের নামে।
হস্তক্ষেপের এই ব্যাপারটা ঠিক ছিলো কি না বা কতোটা সত্য ছিলো তা বিচার্য বিষয়। বিভাস চক্রবর্তী এ সম্পর্কে বলছেন, ‘গণনাট্য সংঘের ভাঙনের পেছনে পার্টির হস্তক্ষেপের প্রশ্ন ছিলো, কিন্তু সে প্রশ্নে কোনও কদর্যতা ছিলো না।’৩° পার্টি হস্তক্ষেপ সম্পর্কে কুমার রায় অভিযোগ তুলেছিলেন এই বলে যে, গণনাট্য সংঘ শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামই নাটকের একমাত্র বিষয়বস্তু বলে নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলো এবং হুঁশিয়ারি দিয়েছিলো যে ‘কেন্দ্রীয় মূলনীতি’ তাদের অধীনস্থ দলগুলি মানতে বাধ্য। রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থকরণকেই সাংস্কৃতিক অনুশীলনের প্রধান লক্ষ্য হিসাবে আত্মপ্রকাশ করিয়ে সংগ্রামী মজদুর, কৃষক ও অন্যান্য শ্রমজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের নবতর এক সাম্যবাদী গণতান্ত্রিক লড়াই-এ সামিল করতে সচেষ্ট হলেন গণনাট্য সংঘের নেতৃস্থানীয় শিল্পী কর্মী ও নাট্যকারগণ।
জনসাধারণের দৈনন্দিন দুঃখ দৈন্য আর জীবিকার সংগ্রামকে জীবনে যোগ করে সেগুলিকে উদ্দেশ্য সিদ্ধির পাথেয় হিসাবে ব্যবহার করা শুরু হলো নাট্য আন্দোলনে। মূল উদ্দেশ্য যাই থাক না কেন, সরকার বিরোধী পক্ষের নেতৃবৃন্দের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের গৌণ উদ্দেশ্যটিই নগ্ন রূপ ধারণ করলো। নাটকের সখে যাঁরা নাটক করতে চান তারা স্বভাবতই বিশেষ রাজনৈতিক ভাবাদর্শের আওতায় হাঁফিয়ে পড়লেন।
পূর্বেই আমরা দেখেছি, যে-কোনো শিল্প সৃষ্টিই উদ্দেশ্যমূলক। আর যা উদ্দেশ্যমূলক, তা প্রচারমূলক। বিশেষ করে উদ্দেশ্যকে প্রচার করাটাই যেখানে শিল্প সৃষ্টির মূল কাজ। খুব স্বাভাবিক যে গণনাট্য সংঘের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিলো। একটি রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা সামনে রেখেই তারা লক্ষ্য পথে আগাচ্ছিলো। সেখানে ক্ষমতা দখলের প্রশ্নও ছিলো। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে নিপীড়িতশ্রেণীর পক্ষে যে সংগ্রাম, সে সংগ্রামের লক্ষ্য নিপীড়িতশ্রেণীর স্বার্থেই রাষ্ট্রযন্ত্রে শ্রমিকশ্রেণীর শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন। লেনিন সবসময় বলতেন, ক্ষমতা সংক্রান্ত প্রশ্নটা হচ্ছে যে-কোনো বিপ্লবের মূল বিবেচ্য বিষয়।
সমাজ ব্যবস্থাকে পাল্টাতে গেলে অবশ্যই রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা দরকার। সেই চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌছানোর আগের স্তরগুলিতে রাজনৈতিক আন্দোলন অথবা অর্থনৈতিক আন্দোলনের চাহিদা থাকে দফাওয়ারি, লক্ষ্য থাকে সুনির্দিষ্ট ক্ষমতা অধিকার। সেই ক্ষমতা দখলের প্রশ্নে সুনির্দিষ্ট কোনো একটি পক্ষে তাকে থাকতেই হয়। নিরপেক্ষতা সেখানে একধরনের ভণ্ডামি কিংবা লুকোচুরি। সেজন্য দেশ-কাল নিরপেক্ষ শিল্প-সাহিত্যে গণনাট্যের আস্থা ছিলো না। গণনাট্য তথাকথিত নিরপেক্ষতা বর্জন করে এক পক্ষের সমর্থনে দাঁড়িয়ে অন্য পক্ষের বিরুদ্ধতা করেছিলো। যাঁরা গণনাট্যের সাথে কাজ করতেন ব্যাপারটা যে তাঁদের কাছে অজানা ছিলো তা নয়।
কৃষক, শ্রমিক ও নিম্নবিত্ত মানুষের চেতনাকে সমাজ পরিবর্তনের কাজে নিযুক্ত করার জন্য গণনাট্য মানুষের সৃষ্টিশীলতাকে উদ্বুদ্ধ করার কাজে নেমেছিলো। সেটা ছিলো ক্ষমতা দখলেরই প্রথম ধাপ, নিপীড়িত জনগণের পুঞ্জীভূত বিক্ষোভকে সংগঠিত করা। সেজন্যই গণনাট্য সংঘ নাটককে সর্বস্তরের জনগণের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো এবং মানুষকে রাজনৈতিক ভাবে শিক্ষিত করে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছিলো। রাজনীতিমুক্ত সাধারণ মানুষকেও বুঝিয়ে দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলো, রাজনীতি সকলকে জড়িয়ে ধরেছে। মানুষ চায় কিংবা না চায় রাজনীতির হাত থেকে তাদের নিষ্কৃতি নেই। কাজেই রাজনীতি আছে, থাকবে। রাজনৈতিক সেই ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে পড়ে হাবুডুবু খেলে হবে না। সকল সংকটের শেকড় কোথায়, সংকট থেকে উত্তরণের উপায় কী সেটা খুঁজে বের করতে হবে। সংকট উত্তরণের পথের সাথে গণনাট্য জনগণকে পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছিলো বিপ্লবের প্রথম স্তর হিসাবে।
গণনাট্য প্রসঙ্গে উৎপল দত্ত লেখেন, ‘সংঘের যে দিকটা আমাকে সবচেয়ে মুগ্ধ করেছিলো, উদ্বুদ্ধ করেছিলো-সেটি হোলো খোলা আকাশের নীচে, বিনা রঙ্গমঞ্চে, বিনা আড়ম্বরে রাস্তার পথচারীদের জড়ো করে তাদের সামনে অভিনয়। এর মধ্যে দেখলাম নাটকের প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধিত হবার সম্ভাবনা বিশেষ করে আমাদের মত দরিদ্র, অশিক্ষিত দেশে। ‘৩৪ গণনাট্যের এই লক্ষ্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন যাঁরা সেদিন দল ছেড়ে চলে যান, শিল্পমান নিয়ে ব্যক্তি স্বার্থের চিন্তায় ব্যস্ত ছিলেন তাঁরা। পার্টির হস্তক্ষেপ বলতে তাঁরা যেটা বোঝাতে চেয়েছিলেন সেটা আসলে তাঁদের ইচ্ছামাফিক চলবার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। পূর্বে উল্লিখিত চারুপ্রকাশ ঘোষের প্রতিবেদন থেকে সে কথার প্রমাণ মেলে।
ঘোষ লিখেছেন যে, কলকাতায় পরপর সাতদিন ‘নবান্ন’ নাটক মঞ্চায়ন হওয়ার পর মঞ্চ মালিকরা নবান্ন-কে ব্যবসায়িক থিয়েটারের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে গণ্য করে কোনো শর্তেই আর মঞ্চ ভাড়া দিতে রাজি ছিলো না। অন্য কোনো মঞ্চে নবান্ন’র প্রদর্শনী হতে পারতো। কিন্তু নাটকের গতি শ্লথ হয়ে যাবে এই আশঙ্কায় শম্ভু মিত্র ঘূর্ণায়মান মঞ্চের জন্যই জিদ ধরলেন। পরবর্তী সময় আবার যখন বাংলার বন্যা বিধ্বস্ত নরনারীর সাহায্যকল্পে পার্টি থেকে একটি চ্যারিটি শো করতে অনুরোধ করা হয়, তখন সেই সময়কার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অধিকাংশ সভ্য নবান্ন পুনরায় মঞ্চস্থ করতে চাইলে কেবলমাত্র শম্ভু মিত্র এর বিরোধিতা করেন। শম্ভু মিত্র নবান্ন বা জবানবন্দী বা অন্য কোনো নাটক মঞ্চায়ন করতে রাজি ছিলেন না এই যুক্তিতে যে, স্বল্প সময়ের প্রস্তুতিতে তা করতে গেলে নাটকের মান পড়ে যাবে।
শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য ও জ্যোতিরিন্দ্র প্রমুখ প্রযোজনার ক্ষেত্রে আঙ্গিকের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন এবং নাটকের উচ্চমান রক্ষার জন্য দরকার হলে নিষ্ক্রিয় বসে থাকতে রাজি ছিলেন। বিষয়টা আপাতদৃষ্টিতে শিল্প সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য থেকে উদ্ভূত হলেও প্রকৃত প্রস্তাবে তা ছিলো মতাদর্শগত বিরোধ।
নবান্নকে যাঁরা ঘূর্ণায়মান আধুনিক উন্নত মঞ্চের বাইরে মঞ্চস্থ করতে বেঁকে বসেছিলেন, কালক্রমে দেখা গেল তাঁরাই জনগণের সংগ্রাম থেকে শিল্পকে বিচ্ছিন্ন করার মধ্য দিয়ে সংস্কারবাদী ধ্যান-ধারণাকে প্রশ্রয় দিলেন এবং অবশেষে নবনাট্য, সৎনাট্যর শ্লোগান তুলে গণনাট্যের পতাকাকে ধুলায় টেনে নামাতে চাইলেন। চারুপ্রকাশ ঘোষের সেই প্রতিবেদন থেকেই জানা যায়, তাঁরা মনে করতেন প্রতিভা বিকাশে নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা দরকার। শিল্পকলার ব্যাপারে পার্টির কোনো নির্দেশ দেয়াটাকেও তারা সঠিক মনে করতেন না।
পার্টির হস্তক্ষেপের ব্যাপারটিকে কেন্দ্র করেই আর একটি বিষয় এখানে আলোচিত হওয়া দরকার। নবান্ন নাটক দিয়েই যদিও গণনাট্য সংঘ প্রথম সাফল্য লাভ করে, তা সত্ত্বেও নবান্ন যথাযথ গণনাট্য ছিলো কি না সে ব্যাপারেও তখন প্রশ্ন দেখা দেয়। নবান্ন কমিউনিস্টদের একাংশের কাছে বিপ্লবের সহায়ক বা যথার্থ গণনাট্য বলে মনে হয়নি। নবান্ন নাটকের মূল বিষয়বস্তু ছিলো পঞ্চাশের মন্বন্তর। সেই মন্বন্তর সৃষ্টির পেছনে মূলত দায়ী ছিলো ব্রিটিশ সরকার, কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে এটা ঘটেনি। নবান্ন নাটকে জনগণের সেই মূল শত্রু অনুপস্থিত এবং বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে ব্রিটিশ শাসকদের কোনো প্রতিনিধিই নাটকে নেই। নাটকে জনগণের সংগ্রামের চেয়ে হতাশাই বেশি পরিস্ফুটিত।
নবান্ন যখন প্রথম অভিনীত হয় তখনই এ প্রশ্ন উঠেছিলো, কয়েকজন কমিউনিস্ট নেতা এ নাটক বন্ধ করে দিতেও চেয়েছিলেন। পার্টির সাধারণ সম্পাদক যোশী ছিলেন এর বিরুদ্ধে। তিনি মত দিয়েছিলেন, গণনাট্যের আদর্শ যাঁরা মেনে নিয়েছেন তাঁদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। প্রথম ভুল-ত্রুটি হবে, কাজের মধ্য দিয়ে সেটা সংশোধনও হবে। কিছু চাপিয়ে দিতে গেলেই কর্মপ্রেরণা নষ্ট হবে।
দেখা যাচ্ছে যে, পার্টির হস্তক্ষেপ বা চাপিয়ে দেয়ার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ সত্য নয়। বরং বলা যায় পার্টির হস্তক্ষেপ সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের ওপর খুবই জরুরি। বুদ্ধিজীবীদের কাজের ওপর পার্টির নিয়ন্ত্রণ যদি না থাকে তবে সেগুলি ক্রমশই যে এক একটি গোষ্ঠীতন্ত্রে পরিণত হয়, পার্টির শৃঙ্খলা ও আদর্শের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়, পরবর্তী ইতিহাস সে কথাই প্রমাণ করেছে।
হস্তক্ষেপের ব্যাপাটা যে অজুহাত সেটা বোঝা যায় শত্রু বাবুর একটি চিঠির বক্তব্যে। সে চিঠিতে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক পুরন্দর চন্দ্র যোশীর নিকট প্রস্তাব রেখেছিলেন যে, পার্টি তাকে অর্থ দেবে নাটকের দল গড়ার জন্য এবং তিনি তাঁর বুদ্ধিমতো প্রগতিশীল নাটক করবেন। যেটা তাঁর বিবেচনায় প্রগতিশীল বলে মনে হবে।
অথচ গণনাট্য আন্দোলন কোনো ব্যক্তির নিজস্ব প্রতিভা ও ক্ষমতা দেখানোর জায়গা ছিলো না। গণনাট্য সংঘ কোনো ব্যক্তি বিশেষের দ্বারাও গঠিত হয়নি। এটা ছিলো যৌথ প্রয়াসের ফসল। এটা ছিলো জনগণ কর্তৃক, জনগণ সমন্বিত, জনগণের জন্য। সেখানে শম্ভু মিত্রের দাবিটি ছিলো সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। পার্টির হস্তক্ষেপ যদি শল্প মিত্রের পছন্দ না হয় তাহলে তিনি পার্টির সাধারণ সম্পাদকের কাছে এ ধরনের সুবিধা চাইবেন কেন? এই ঘটনা প্রমাণ করে শম্ভু মিত্র গণনাট্য সংঘে তাঁর একক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।
শম্ভু মিত্র যে সত্যিকার অর্থে রাজনীতি বহির্ভূত লোক ছিলেন তাও নয়। বাষট্টির নির্বাচনে তিনি কংগ্রেস প্রার্থী হুমায়ুন কবীরের নির্বাচনী প্রচারে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন। পঞ্চাশের দশকে হুমায়ুন কবীরের নির্বাচনে শম্ভু মিত্রের সমর্থনসূচক পক্ষপাত নিয়ে প্রভৃত বিতর্কও হয়েছিলো। যাঁরা সেদিন গণনাট্য ছেড়ে চলে যান এবং নবনাট্য বা সৎনাট্য আন্দোলন শুরু করেন তাঁরা পার্টির হস্তক্ষেপের দোহাই দিলেও তাঁদেরই একজন নেতৃস্থানীয় সহযাত্রী সুধী প্রধান, যিনি পরে গণনাট্য ছেড়ে চলে আসেন তাঁর বক্তব্য, গণনাট্যের সংঘের ভিতর যতোদিন ছিলাম এই কথা নিশ্চয় বলবো যে শিল্পগত ব্যাপারে জবরদস্তি বা সংখ্যাধিক্যের দ্বারা কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করানো হয়নি।
পার্টির হস্তক্ষেপ সম্পর্কে উৎপল দত্তের বক্তব্য ছিলো, ‘লিটল থিয়েটারের উত্থানের পেছনে মহত্তম ভূমিকা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির। কখনও কোনো হস্তক্ষেপ পার্টি করে নি, নিঃস্বার্থভাবে শুধু প্রচার করেছে, আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছে, সারা বাংলার মানুষের কাছে লিটল থিয়েটারকে নিয়ে পৌছে দিয়েছে। কোনোদিন মাস্টারি করে নি, কিন্তু শিখিয়েছে সর্ব সময়ে। কখনও কিছু চায় নি, শুধু দিয়েছে।'”° তিনি আরো লিখছেন, ‘কখনও পার্টি এসে বলেনি, পথনাটিকা করতে হবে। কিন্তু স্বেচ্ছায় যখন করেছি পার্টি দু’হাত বাড়িয়ে আমাদের বুকে নিয়ে গ্রামে গ্রামান্তরে হাঁটতে শিখিয়েছে।’
গণনাট্য সংঘ ভাঙনের পেছনে বহু কারণের পাশাপাশি অন্য একটি রাজনৈতিক ও আদর্শগত প্রশ্ন ছিলো, পার্টি থিয়েটারকে নিয়ন্ত্রণ করবে কি না। রাজনীতি প্রচারের চেয়ে শিল্পমান নিয়ে বিরোধটি চরম হয়ে দেখা দেয়। গণনাট্য আন্দোলন থেকে জন্মানো পেটি বুর্জোয়া ‘প্রতিভাবান’ লেখক শিল্পীরা যখন ‘নতুন রীতি’ বা ‘নবনাট্য’ নাম নিয়ে আমরা শ্রমিক আন্দোলন বা প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে নেই, কমিউনিস্ট পার্টির কাজকর্মে নেই-এইসব বলে বিষয়বস্তুর চেয়ে আঙ্গিককে আরোও সূক্ষ ও পরিমার্জিত করার দিকে ঝুঁকলেন, সহজেই বুর্জোয়া-জমিদারদের সমর্থন পেলেন। বাংলা নাটকে এভাবেই তাঁরা এক নতুন সৃষ্টিশীল ধারার প্রবর্তন করলেন।
যার মূল্য বাংলা থিয়েটার তো বটেই রাজনৈতিক থিয়েটারেও কম নয়। লেনিন বলেছিলেন, বুর্জোয়া সৃষ্টির এবং সভ্যতার সমস্ত ভালো দিকগুলো সর্বহারাশ্রেণীকে গ্রহণ করতে হবে। সেজন্য শম্ভু মিত্র গণনাট্য ত্যাগ করে যেমন রাজনৈতিক নাট্যাঙ্গনের প্রভৃত ক্ষতি সাধন করেছিলেন তেমনি নাট্য আঙ্গিক চিন্তায়, নতুন অভিনয়ের ধারা সৃষ্টি করে রাজনৈতিক নাটক তথা সারা বাংলা নাটকের উপকার সাধন করেছিলেন।
রাজনৈতিক নাট্যধারার সাথে শত্রুতা করেও তিনি মিত্র হবার মতো কিছু কাজ করে গেলেন। শম্ভু মিত্রের পথ ধরে সেদিন আর যাঁরা গণনাট্য থেকে বের হয়ে এসেছিলেন, তাঁরা বাংলা রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলনে ভাঙন সৃষ্টি করলেও, বাংলা নাটককে আধুনিক একটি রীতি দেয়ার ব্যাপারে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে অবদান রেখেছিলেন। বাণিজ্যিক থিয়েটারের থেকে ভিন্ন গোত্রের এক নাট্যজগৎ রচিত হলো এইভাবে। নবনাট্য ছিলো এমন এক নাট্য ভাবনা, পেশা হিসাবে যাকে গ্রহণ করা যায় না অথচ পেশাদারিত্বের চূড়ান্ত গুণগুলি সেখানে অর্জন করা বাধ্যতামূলক।
কেবল সখ, কেবল ভালোবাসা থেকে এ নাটক করা যায় না, দরকার নাটকের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর দক্ষতা। বিশেষ করে দরকার নাট্য আঙ্গিক ও নাট্যাভিনয়ের পারদর্শিতা। যাঁরা গণনাট্য ছেড়ে নবনাট্য বা সৎনাট্য করতে চলে যান তাঁদের কাছে যে আঙ্গিক অভিনয় প্রাধান্য পেয়েছিলো, সেটার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁদের প্রযোজনাগুলোতে যা পূর্বেই আমরা উল্লেখ করেছি। পরবর্তী দীর্ঘ সময় ধরে নবনাট্যের সাথে গণনাট্যের এই পার্থক্যটি নজরে আসবে। একদলের কাছে বিষয়বস্তু হয়ে উঠছে প্রধান, রাজনীতি প্রচারটাই সেখানে মুখ্য এবং লক্ষ্য গ্রাম-গঞ্জের দর্শক, অন্য দলের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছিলো আঙ্গিক এবং লক্ষ্য শহুরে দর্শক।
গণনাট্য ও নবনাট্যের এই পার্থক্য সর্বদাই লক্ষণীয়। গণনাট্য প্রধানত কৃষক, শ্রমিক জীবন থেকে তার চরিত্রগুলোকে আহরণ করতে চেয়েছে আর নবনাট্য চাইছিলো বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য। সত্তর দশকেও গণনাট্য শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে বহু নাটক মঞ্চস্থ করে। উনিশশো চুয়াত্তর সালে এক ব্যাপক রেল ধর্মঘট দেখা দেয়, রেল শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কংগ্রেস সরকার মাস্তান লেলিয়ে দেয়। তার বিরুদ্ধে শ্রমিক আন্দোলনের ভিত্তিতে রচিত নাটক রেল কি ভেলকি, এ প্রাণ রাতের গাড়ি, বেইমানের মা। বেইমানের মা নাটকে দেখা যায় শ্রমিকদের সাথে মাহিলারাও শাসকচক্রের গুণ্ডাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।
উনিশশো সত্তর থেকে ছিয়াত্তর পর্যন্ত শাসকশ্রেণী পশ্চিম বাংলায় এক সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। বিভিন্ন রাজনৈতিক কার্যকলাপের ওপর নেমে আসে নৃশংস আক্রমণ। এর বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণী যে প্রতিরোধ সংগঠিত করে তা নিয়েই রচিত হয়েছে শ্রীজীব গোস্বামীর রক্তগোলাপ নাটক। শ্রমিক। আন্দোলনের ধর্মঘট ও অন্যান্য বহুবিধ সমস্যার প্রতিচ্ছবি ধরা পড়েছে মৃত্যু নাই, সূর্যগ্রাস, মশাল, মোকাবিলা, নাগপাশ, দাবি ইত্যাদি নাটকে। গণনাট্য আন্দোলনের সবসময়ই একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিলো।
নবনাট্য আন্দোলন রাজনৈতিক লক্ষ্যবর্জিত গণনাট্যের একটা পাল্টা আন্দোলনরূপে গড়ে উঠলো। নবনাট্যের কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃস্থানীয় সংগঠন না থাকায় যে যার স্বাধীন বোধ বুদ্ধি এবং শিল্পকর্ম অনুযায়ী এক একটা লক্ষ্য ঘোষণা করতে লাগলো। বক্তব্যের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো গণ্ডির মধ্যে তারা আটকে থাকতে চাইছিলো না। গণনাট্যের যে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যটি ছিলো, নবনাট্য সেখান থেকে সরে দাঁড়ালো।
শ্রেণীদ্বন্দ্বের নিরন্তর সংগ্রামে যে শ্রেণীহীন সমাজের প্রতিষ্ঠায় গণনাট্যের আন্দোলন তার নাটক ও বিষয়বস্তুকে নিয়োজিত করেছিলো, নবনাট্য আন্দোলনে কর্মীরা তা থেকে সরে এসে অবক্ষয়ী সমাজের হতাশা, ব্যক্তিজীবনের ট্র্যাজেডি, রোমান্টিক মানবিকতা নাটকীয় কলাকৌশলের মাধ্যমে প্রচার করতে লাগলো। নবনাট্য আন্দোলন যে পরিমাণে নতুন আঙ্গিকের উন্নতি ঘটিয়ে ছিলো, অভিনয়ের ক্ষেত্রে উৎকর্ষ সাধন করেছিলো, সে পরিমাণে মৌলিক নাটক সৃষ্টির প্রমাণ রাখতে পারেনি। নাটক যে রচনা হয়নি তা নয়, কিন্তু সত্যিকারের মহৎ নাটক লেখা হয়েছে হাতে গোনা এবং তা লিখেছেন মাত্র কয়েকজন নাট্যকার। শম্ভু মিত্র তাই লিখছেন, ‘আমরা জানি যে আমাদের মঞ্চে প্রভুত ক্ষমতাসম্পন্ন অভিনেতা ও অভিনেত্রীর উদ্ভব হয়েছে। কিন্তু এও জানি যে ততোখানি গুণসম্পন্ন নাট্যকার আসেনি।তিনি আরো লিখছেন, বাংলা ভাষায় রচিত বেশিরভাগ নাটকই গভীর অন্বেষায় সাহায্য করে না।
যখন গণনাট্য সংঘ তথা গণনাট্য আন্দোলন সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ঐতিহ্য সৃষ্টি করছে তখন তার পাশাপাশি সংগঠনের মধ্যে ও বাইরের নাট্যজগতে নবনাট্যের প্রবক্তারা যেসব তত্ত্ব হাজির করলেন, তার দ্বারা আর যাই হোক জনগণকে তার অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের সমস্যাগুলির কারণ ও সমাধান সম্পর্কে সচেতন করা যায় না। ঋত্বিক ঘটক লিখছেন, ‘গণনাট্য আন্দোলন করতাম। ঠিক-ভুল যাই করি, নিজের হদিসটা ঠিক ছিল। সামাজিক, রাজনৈতিক দিকনির্দেশে সময় সময় ভুল হয়েছিল, কিন্তু কোন্ শক্তির শরীক আমরা, কার প্রতি আমাদের দায়িত্ব-সে বোধে কোনো ধোঁয়াটে ভাব ছিল না।
নবনাট্যে ব্যক্তিজীবনের প্রতিষ্ঠার লড়াইটা বড় হয়ে উঠলো। কেন তারা নাটক করছে সে ব্যাপারে নবনাট্যের বক্তব্য ছিলো, সত্যিকারের দেশ প্রেমের মহৎ নাটক করে দেশ গড়ার কাজে সাহায্য করা। কার জন্য বা কোন্ শ্রেণীর পক্ষে তারা নাটক করছে সে ব্যাপারে কোনো বক্তব্য ছিলো না। দেশপ্রেম বা দেশগড়া ব্যাপারটা খুবই আপেক্ষিক, কার স্বার্থে সেটাই বড় কথা। রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টির জন্য এই প্রশ্নটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মূলত নবনাট্যের পথিকৃতরা কী করলেন? শ্রেণীসংগ্রামের সমাজবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যাগ করে শ্রেণীসমঝোতার পথে পা বাড়ালেন। এইভাবেই কর্তৃপক্ষশ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার কথা ভাবা হয়েছিলো। ঋত্বিক ঘটকের ভাষায়, ‘সাহস, মেরুদণ্ড, আঘাত সহ্য করবার ক্ষমতা, অপ্রিয় সত্য-ভাষণের পরম প্রসাদ, এগুলো নেই। তাই নবনাট্য আন্দোলন’।
নবনাট্য, সৎনাট্য প্রভৃতি অভিধার মধ্যে যেমন নিহিত ছিলো মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হওয়ার বীজ তেমনি ‘আমরা ভালোভাবে ভালো নাটক করবো’ এ জাতীয় ঘোষণায় এক ধরনের অস্বচ্ছতা ও ধোঁয়াটে ধ্যান ধারণা প্রবেশ করলো নাট্য আন্দোলনে। গণনাট্য সংঘের বিরুদ্ধে অজস্র অভিযোগ এনে তার অসারতা প্রমাণ করতে যে নবনাট্য আন্দোলনের জন্ম হলো-সে আন্দোলন পরবর্তী সময়ে গণনাট্যকে ছাপিয়ে কোনো বলিষ্ঠ আদর্শ অথবা প্রত্যয় মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারলো না। কিছুদিনের মধ্যেই নবনাট্যধারা তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে সমাজ বিচ্ছিন্ন বিমূর্ত নাটকের গাড্ডায় গিয়ে পড়লো। ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার অবক্ষয়ী সংস্কৃতির চোয়ানো ঢেকুর উদ্গিরণ হতে থাকলো নবনাট্যের ধারায়।
নবনাট্যের পথিকৃতরা গণনাট্য সংঘ ছেড়ে আসার সময় পার্টির হস্তক্ষেপ-এর প্রশ্ন তুলেছিলেন। নবনাট্য আন্দোলনে কী ঘটলো? মূলত একজনকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠলো দলগুলো। কেননা ব্যক্তির শিল্পভাবনা, মনন ও মনস্বতাকে রূপ দেবার তাগিদেই নবনাট্যের সৃষ্টি। স্বভাবতই দলের সাংগঠনিক চরিত্র ধামাচাপা পড়ে সেখানে ব্যক্তিই প্রধান হয়ে ওঠেন, পূজনীয় হন। দলের নেতা যা বললেন সবাই তাতে হ্যাঁ মেলান-নেতা যেন কোনো মোহান্ত। বাকিরা কর্মী, পদ সেবক। কর্মীদের শ্রম-অর্থ-ত্যাগে গড়ে ওঠে কোনো-না-কোনো প্রযোজনা, সে প্রযোজনা সার্থক হলে দলপ্রধান নামী ব্যক্তির মর্যাদা পান। দলের কর্ণধার দুধের সরটি খান আর তাঁর নামের জ্যোতির ছত্রছায়ায় বাকিরা তাঁদের শ্রমদান করে সেই মহান ব্যক্তির কাছে কৃপা বা করুণা প্রার্থনা করেন।
কিন্তু নামী প্রতিভার পাশে থেকে দিনের পর দিন কি নিজেকে বিলিয়ে দেয়া যায়? সে কারণে যার কিছুটা প্রতিভা আছে তিনি আবার বের হয়ে এসে নিজে ভিন্ন দল গঠন করেন। নবনাট্যের শুরু থেকেই ব্যক্তি প্রতিভা মাথা চাড়া দিতে শুরু করেছিলো। নাট্য আন্দোলন তাঁদের কাছে প্রকারান্তরে খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার মঞ্চে পরিণত হলো। গণনাট্য সংঘে এই ব্যক্তি প্রতিষ্ঠার, ব্যক্তি অহমের কোনো সুযোগ ছিলো না।
শম্ভু মিত্র গণনাট্য ছেড়ে চলে এসেছিলেন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের প্রশ্ন তুলে, নাটক সেখানে শ্লোগান হয়ে যাচ্ছিলো বলে। শেষ পর্যন্ত তিনি বহুরূপীতেও থাকলেন না, নিজের তৈরি দল ছেড়ে চলে এলেন। নাটকের সাথেই আর নিজেকে জড়িত রাখলেন না। দীর্ঘ পঁচাশি বছরের জীবনে মাত্র ত্রিশ বছর তিনি সরাসরিভাবে নাটকের সাথে যুক্ত ছিলেন। শম্ভু মিত্র প্রথম গণনাট্য ছেড়েছিলেন, তারপর অভিমান করে নিজের প্রতিষ্ঠিত দল বহুরূপী ছেড়েও চলে গেলেন। নাট্য-ইতিহাসে তাঁর অবদান কম নয়। বহুরূপীর প্রযোজনায় বাংলা থিয়েটার আধুনিকতার পরশে সমৃদ্ধ হয়েছে, বহুরূপীসহ তিনি নিজে খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার শিখর ছুঁয়েছেন। তবুও তাঁর অভিমান ছিলো কার বিরুদ্ধে?
জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলেই মানুষ অনেক দায়-দায়িত্ব এড়াতে পারেন, জনগণের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত উৎপল দত্ত যা পারেননি। আমৃত্যু তিনি নাট্য দলের সাথে কাজ করে গেছেন। পঁয়ষট্টি বছরের জীবনে তিনি পঁয়তাল্লিশ বছর নাটকের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ছিলেন যুব মানুষের নেতা এবং পথিকৃৎ। আর শম্ভু মিত্রের ক্ষেত্রে কি ঘটলো? শম্ভু মিত্রের মতো প্রতিভাবান শিল্পী নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান এবং কিংবদন্তী হয়ে উঠলেন। নবনাট্য আন্দোলনের হোতা শম্ভু মিত্র স্বাভাবিকভাবেই কোনো আন্দোলনের নেতা হয়ে উঠতে পারলেন না, হয়ে উঠলেন কিংবদন্তীর নাট্যতারকা।
নবনাট্য আন্দোলনের মধ্যে ছিলো প্রচলিত নাট্যধারা সম্পর্কে প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ। সে বিদ্রোহ নাটকের মঞ্চজগত ও নাটকের রূপরীতি সম্পর্কে। গণনাট্য যখন রাজনৈতিক চেতনায় প্রভাবিত হয়ে বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে পৌনঃপুনিকতায় স্থবিরতা লাভ করতে শুরু করলো নবনাট্য তখন নতুন নতুন নাটক দেখিয়ে ভিন্ন রুচির স্বাদে দর্শকবৃন্দকে মোহিত করে তাদের নাট্যানুরাগকে সঞ্জীবিত করতে চাইলো। নবনাট্য কথাটির অর্থ ছিলো ছিলো বোধ হয় এক নাটকের বিষয়বস্তু আর এক নাটকের বিষয়বস্তু হয়ে উঠবে না কিংবা হলেও বিশ্লেষণ এবং বক্তব্যে সেটি হবে ভিন্নতর। নবনাট্য কি তা পেরেছিলো? গণনাট্য আর নবনাট্য কাল দুটো সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। যদিও গণনাট্যের পথ বেয়েই নবনাট্য এসেছে, তবুও চিন্তাভাবনা মানসিকতা সম্পূর্ণ আলাদা। পরবর্তীকালে নবনাট্য ধারায় যাঁরা খ্যতিমান হয়েছেন, তাঁদের প্রায় সবাই এককালে গণনাট্যের পাঠশালায় হাতে খড়ি নিয়েছিলেন।
রাজনৈতিক ভাবনার দোটানায় গণনাট্য ছেড়ে চলে গেলেও, হাতে খড়ির শিক্ষা তাঁদের পরবর্তী নাট্যভাবনায় কার্যকরী হয়েছে; সে নাটক লিখতে গিয়েই হোক, অভিনয় করতে গিয়েই হোক। গণনাট্য আন্দোলনের হাত ফেরতা হয়ে এঁরা এসেছিলেন বলে এবং মূলত নাট্যবোধ এঁদের প্রবল ছিলো বলে, এঁদের নাট্য প্রচেষ্টা তদানীন্তন গতানুগতিক পেশাদারি নাট্য প্রচেষ্টা থেকে সর্বদাই মুক্ত থাকার চেষ্টা করেছে, শুধু রাজনৈতিক ভাবনাটুকু ছাড়া।
বিষয়বস্তু সম্পর্কে যথেচ্ছাচারী হলেও এই সমস্ত নাট্য সংস্থার নাটকগুলিতে সুগভীর চিন্তা ও পরিশ্রমের ছাপ আছে। প্রাথমিক পর্বে এই নব প্রতিষ্ঠিত থিয়েটার দিয়েছে ভালো অভিনেতা, থিয়েটার, সংগীত, আলো। মঞ্চে এনেছে বহু পরিবর্তন। পঠন পাঠন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অনেকেই তৈরি করেছেন সুশৃঙ্খল এক একটি প্রতিষ্ঠান। শুধু থিয়েটার-এর কথা বলবার জন্য বের করেছেন পত্রিকা, তৈরি করেছিলেন রুচিশীল দর্শকমণ্ডলী। সেদিক থেকে নাট্যচর্চার নতুন ভিত রচিত হলো নবনাট্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। সে আন্দোলনের অসম্পূর্ণতা হলো-যতো দুশ্চিন্তা নাটক নিয়ে, নাটকের আঙ্গিক নিয়ে। বিষয়বস্তু বা জনগণ নিয়ে, বা সমকালীন সমাজ ব্যবস্থা বা তার দ্বন্দ্ব নিয়ে কোনোরকম মাথা ব্যাথা ছিলো না।
‘শিল্পের জন্য শিল্প’ এই শ্লোগান তারা না তুললেও শ্রমিকশ্রেণীর রাজনীতি সেখানে জায়গা পেল না। নাটককে সর্বহারার বা গণতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষে সচেতন অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করার কোনো দায়িত্ববোধ সেখানে লক্ষ্য করা গেল না। গণনাট্য সংঘে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই ছিলো নাটক মঞ্চায়নের উদ্দেশ্য, নবনাট্য সে বিশ্বাস থেকে সচেতনভাবেই নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখলো। নাটকের মধ্য দিয়ে নবনাট্য কর্মীরা। শুধুমাত্র সমাজের খণ্ডিত ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো প্রকাশ করতে চাইলেন। সমাজ পাল্টাবার জন্য জনগণকে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে সামিল করা বা মার্কসীয় দৃষ্টিতে সমাজ ব্যাখ্যা করার দিকে তাঁরা গেলেন না।
ইতিহাসের বাস্তবতায় অবশ্য নবনাট্য খুব বেশিদিন রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে পারেনি। ঘটনাচক্রই আবার তাকে রাজনীতির দিকে মুখ ফেরাতে বাধ্য করে। বিশেষ রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি না করলেও, তাকে সমাজ পরিবর্তনের পক্ষে শ্লোগান তুলতেই হলো। নবনাট্য আন্দোলনে যখনই আবার রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটলো তখনি তা নবনাট্য থেকে গ্রুপ থিয়েটার নামকরণ হয়ে গেল। সে প্রসঙ্গে আমরা পরে আসব। রাজনীতি অনুপ্রবেশের যে কার্যকারণ তৈরি হয়েছিলো সেগুলো আগে ব্যাখ্যা করা যাক।
গণনাট্য সংঘ থেকে যখন মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, গঙ্গাপদ বসু, কলিম শরাফি, মহম্মদ ইসরাইল প্রমুখ বের হয়ে আসেন সেটাই ছিলো গণনাট্য ভাঙনের প্রথম পর্ব। গণনাট্যের দুরবস্থার কালে নবনাট্য বা সৎনাট্য তার শক্তি বৃদ্ধি করে এবং শীঘ্রই একটি আন্দোলন হিসাবে স্বীকৃতি পায়। গণনাট্যের সেই দুর্দিনে, উনিশশো পঞ্চাশ সালে উৎপল দত্ত গণনাট্যে যোগ দেন এবং সেখানে বেশ কিছু সময় কাজ করেন যা পূর্ব অধ্যায়ে আমরা জেনেছি।
গণনাট্য সংঘে উৎপল দত্ত পরিচালিত কিংবা অভিনীত নাটকগুলো হচ্ছে পানু পালের ভাঙা বন্দর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিসর্জন, ঋত্বিক ঘটকের দলিল, পানু পালের ভোটের ভেট ও অভিসার ইত্যাদি। খুব শীঘ্রই পার্টি তাকে ভুল বোঝে এবং ট্রটস্কিপন্থী বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে। উৎপল দত্ত গণনাট্য ছেড়ে চলে আসেন। গণনাট্য সংঘে যোগ দেবার পূর্ব থেকেই যেহেতু উৎপল দত্ত নিজ দল লিটল থিয়েটার গ্রুপে নাটক করে আসছিলেন, পরে তিনি আবার সেখানেই ফিরে যান। ফিরে এসে তিনি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করতে শুরু করলেন। গণনাট্য সংঘে কাজ করার দিনগুলো ছিলো তাঁর জন্য রাজনৈতিক নাটক সম্পর্কে শিক্ষালাভের কাল।
পূর্বে লিটল থিয়েটার দু একটি ছাড়া বেশিরভাগ ইংরেজি ভাষায় নাটক করতো। গণনাট্য থেকে ফিরে এসে উৎপল দত্ত দলের সকলের সাথে বসে, পরামর্শ করে বাংলায় নাটক করার সিদ্ধান্ত নিলেন। বাংলায় নাটক মঞ্চায়ন করা নিয়ে তাঁর নিজের বক্তব্য ছিলো, ‘ইংরেজি নাটক করবো মুষ্টিমেয় বুদ্ধিবাজের স্বার্থে আর বৈপ্লবিক নানা তত্ত্ব কপচাবো-এ দুটো যে এক সংগে চলতে পারে না, এ বোধ আমাদের অবশেষে হোলো।””° নাটক হবে বাংলায়, নাটক হবে অসংখ্য সাধারণ মানুষের জন্য, নাটক কইবে সংগ্রামের কথা-সর্বস্তরের সংগ্রাম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ। মিটিং করা হলো লিটল থিয়েটার গ্রুপ সম্পূর্ণত বাংলা নাটকে মনোনিবেশ করবে।
লিটল থিয়েটার গ্রুপ থেকে এরপর উৎপল দত্ত পরপর অনেকগুলো নাটক মঞ্চায়ন করলেন যা পূর্ব অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে। উনিশশো উনষাট থেকে উনিশশো আটষট্টি সাল পর্যন্ত তাঁর প্রযোজিত অঙ্গার, ফেরারী ফৌজ, কল্লোল, অজেয়-ভিয়েতনাম, দিন বদলের পালা, মানুষের অধিকারে সবগুলোই ছিলো রাজনৈতিক নাটক। নাটকগুলোর বেশিরভাগ পেশাদার মঞ্চেই মঞ্চস্থ করা হয়েছিলো এবং নাটকগুলো ভারতবর্ষে ভীষণভাবে সাড়া জাগিয়েছিলো। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নাটক প্রযোজনা করেও যে উন্নতমানের শিল্প রচনা করা যায়, দর্শকদের মুগ্ধ করা যায় উৎপল দত্তের নাটকগুলো তারই উদাহরণ।
বিশেষ করে উৎপল দত্তের অঙ্গার ও কল্লোল-এর সাফল্য ছিলো আকাশচুম্বী। কয়লাখনির শ্রমিকদের জীবন নিয়ে অঙ্গার, উনিশশো ঊনষাট সালে মিনার্ভা মঞ্চে সে নাটক ইতিহাস সৃষ্টি করে।২ অঙ্গার নাটক নাট্য আন্দোলনকে, গণনাট্যকে নতুন পথের সন্ধান দেয়। এই অঙ্গার নাটক মঞ্চায়নের পরপরই রাজনৈতিক নাটকের দিকে সকলের দৃষ্টি নতুনভাবে প্রসারিত হয়। নবনাট্য ধারার সাথে উৎপল দত্তের নাট্য আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক ছিলো না। তিনি নতুন এক ধারার জন্ম দেন।
উৎপল দত্তের নাটক কল্লোল যা বামপন্থী নবজাগরণের সূচনা করে।
কল্লোল-এ উৎপল দত্ত রাজনৈতিক একটি দল হিসাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি কংগ্রেসের বিশ্বাসঘাতকতার এক জ্বলন্ত চিত্র আঁকেন। সে সময় গোটা বামপন্থী আন্দোলনেই যেন একটা ভাটার টান চলছিলো। কল্লোল তার বলিষ্ঠ বক্তব্যে, দুরন্ত পরিচালনার গুণে সারাদেশকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। এই নাটক শীঘ্রই কংগ্রেস সরকারের রোষানলে পড়লো। নাটকের বক্তব্য ও সংলাপ মোটেই তাদের জন্য সুখকর ছিলো না। নাট্যকার উৎপল দত্ত গ্রেফতার হলেন। চব্বিশে সেপ্টেম্বর সমস্ত সংবাদপত্রে ঘোষণা দেয়া হলো কল্লোলের বিজ্ঞাপন ছাপা হবে না। কল্লোল তাতে বন্ধ হলো না, আরো দ্রুত গতিতে চলতে থাকলো। পশ্চিম বাংলার শহর গ্রাম ভেঙে পড়লো কল্লোল দেখার জন্য।
কোনো বিজ্ঞাপন ছাড়াই নাটক চললো হৈ হৈ করে। কল্লোল ভারতের নাট্য ইতিহাসে বিশেষ করে রাজনৈতিক নাট্য ইতিহাসে বিশাল এক ঘটনা হয়ে রইলো। কল্লোল অভিনয়ের সময়েই উৎপল দত্ত, শেখর চট্টোপাধ্যায়, জোছন দস্তিদার, নির্মল ঘোষ, বিদ্যুৎ বসুর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হলো সংযুক্ত গণশিল্পী সংস্থা।
দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্টের সময় উৎপল দত্ত ঝুঁকে পড়লেন নকশালপন্থী আন্দোলনের দিকে। চারু মজুমদারের সাথে আলাপ করার পর নাটক লিখলেন তীর। উনিশশো উনসত্তর সালে তা মঞ্চস্থ হলো মিনার্ভাতে। নাট্যকারের তীব্র শ্রেণী-ঘৃণা ও ক্রোধ এ নাটকে সোচ্চারভাবে প্রকাশ পেয়েছে। নাটকের একটি দৃশ্যে ভারতের জনগণের, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের নকশালবাড়ি আন্দোলন সম্বন্ধে প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছে। নাট্য প্রযোজনার কৌশলে সেখানে একসঙ্গে হাজির হয় ধনী মহাজন, ব্যবসায়ী, সরকারের মন্ত্রী, বিদেশি পুঁজিপতি, উন্নাসিক শহুরে অভিজাত, সংবাদপত্রের মালিক এবং শাসকশ্রেণীর প্রতিনিধি।
নাট্যকারের চোখে সমাজের শ্রেণীগত পংক্তি-বিন্যাসের মূল যে নিয়ামক শ্রেণীস্বার্থ তা গোটা নাটকে ছড়িয়ে রয়েছে। নাটকটি ভীষণভাবে তখন কলকাতার মধ্যবিত্ত সাধারণ দর্শকদের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছিলো। দর্শকদের উদ্দেশ্যে তখন রাস্তায় রাস্তায় লেখা থাকতো তীর চিহ্নিত পথে এগিয়ে চলুন। সেই পথ ধরে এগুলেই মিনার্ভা থিয়েটারে পৌছে যেতো দর্শক, যেখানে মঞ্চস্থ হচ্ছিলো উৎপল দত্তের তীর নাটক। কলকাতা শহরের নানা প্রান্তে বাড়ির দেওয়ালে নিজ উদ্যোগেই এই পোস্টার সেঁটে দিয়েছিলেন দর্শকরা বা কলকাতার জনগণ। ৫৫ রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়েও যে জনপ্রিয় নাটক প্রযোজনা করা যায় এবং সে নাটকের দুর্দিনে জনগণই যে তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসে সেই সত্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন।
নকশালবাড়ির ঘটনার পর সারাদেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যুবমানসে যুগান্তকারী পরিবর্তনের দোলা লাগলো। মানুষ তখন রাষ্ট্রের, সরকারের অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করবার জন্য উদ্দীপ্ত। সেই রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তেরকালে উৎপল দত্ত-জোছন দস্তিদারের নেতৃত্বে গঠিত ‘সংযুক্ত গণশিল্পী সংস্থা’ রাজনৈতিক নাট্যচর্চার একটা ঝড়ো হাওয়া ওঠালো।
পশ্চিম বাংলার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে বিস্ফোরণ ঘটলো নকশালবাড়ির আন্দোলনের অভিঘাতে তা থিয়েটারেও ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেললো। সে প্রেক্ষাপটেই উৎপল দত্তের উল্লিখিত নাটকগুলো দেখে অনেকেই তখন নতুন করে রাজনৈতিক নাটক করবার প্রেরণা লাভ করেন। যেহেতু উৎপল দত্ত গণনাট্যের বাইরে থেকেই এই রাজনৈতিক নাট্যধারা তৈরি করেছিলেন-তাই গণনাট্যের বাইরের অনেক দলও তাঁর পথ অনুসরণ করেন। আবার নতুন নতুন দলও জন্ম নেয় নতুন সংকল্প নিয়ে। শহর কলকাতার থিয়েটারে তার প্রভাব যতোটা না পড়েছিলো তার শতগুণ প্রভাব পড়েছিলো মফস্বলের ছোট ছোট নাট্যদলে। উৎপল দত্তের রাজনৈতিক নাটকগুলোর সাফল্যের প্রেরণাতেই নবনাট্য নতুন করে দানা বাঁধে, সেখানে নতুন চিন্তার সূত্রপাত ঘটে। রাজনীতিহীনতার নামে সাধারণ মঞ্চে যা চলছিলো উৎপল দত্তের নাটক থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে একদল সেসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালো। আরো নতুন নতুনদের আগমন ঘটে নাট্যজগতে বিপ্লব ঘটাবার জন্য।
মূল প্রেরণা উৎপল দত্ত ও তাঁর নাটক। মিনার্ভা থিয়েটার হয়ে উঠলো বিদ্রোহী যুব-ছাত্রদের দুর্গ এবং কমিউন। মিনার্ভা থিয়েটারের দোতলায় প্রতিদিন বিকেলে ভিড় করতো অসংখ্য তরুণ নাট্যকর্মী ও সংস্কৃতিকর্মী। নতুন এক ঝাঁক নাট্যগোষ্ঠী, নাট্যকার অভিনেতা, কলাকুশলীর আবির্ভাব হলো। মিনার্ভার দোতলায় একাধিক নবীন নাট্যগোষ্ঠী মহড়া দিতো। রাজনীতি প্রচারে এদের কোনো আপত্তি ছিলো না, ভীতিও ছিলো না। ধীরে ধীরে উৎপল দত্ত নিজেই এক বিপ্লবী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হচ্ছিলেন। যেখানে উৎপল দত্ত, সেখানে হাজার হাজার মানুষ, নতুন দিনের স্বপ্ন, দুর্বার শপথ। যুব, ছাত্র, তরুণরাই ছিলো তাঁর প্রিয় আমজনতা। তিনিই ছিলেন তারুণ্য, স্পর্ধা, দুঃসাহস আর প্রদীপ্ত মেধার প্রতীক।
গণনাট্য পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক নাট্যধারার সূচনা করেছিলো সন্দেহ নেই। নানারকম ভাঙনের মধ্য দিয়ে গণনাট্য যখন দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছিলো সেই দুর্দিনে উৎপল দত্ত রাজনৈতিক নাটককে নতুন পথ দেখালেন। গণনাট্য তার নাটকে রাজনীতিকে বিষয়বস্তুর দিক থেকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলো, শিল্পগত দিক বা নাটকের আঙ্গিক সেখানে গুরুত্ব পায়নি। নবনাট্য আবার নাটকের শিল্পরীতি ও আঙ্গিককে যতোটা গুরুত্ব দিয়েছিলো সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিষয়বস্তুকে একেবারেই গুরুত্ব দেয়নি। উৎপল দত্তর নাটকে সবকিছুই সমান গুরুত্ব পেয়েছিলো। যেমন রাজনৈতিক বিষয়বস্তু, তেমনি আঙ্গিক, উন্নত অভিনয়, সাংগঠনিক শৃঙ্খলা-সব ব্যাপারেই তিনি সমান নজর রাখতে পেরেছিলেন। এই সময় আরো অনেকগুলো ঘটনা ঘটে। পশ্চিমবঙ্গের নাট্য জগতে তার প্রতিক্রিয়া হয় মারাত্মক এবং রাজনৈতিক নাটকের ক্ষেত্রে তা নতুন দিগন্তের সূচনা করে। বাষট্টি সালে চীন-ভারত যুদ্ধ ও পঁয়ষট্টি সালের পাক-ভারত যুদ্ধ ছিলো এর মূলে।
বাষট্টি সালে চীন-ভারত যুদ্ধকে কেন্দ্র করে গণতান্ত্রিক মানুষের ওপর প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সর্বব্যাপী আক্রমণ নেমে এলো। চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে তথাকথিত দেশপ্রেমের জোয়ার বইয়ে দিলো শাসকশ্রেণী। কমিউনিস্টদের একাংশকে ‘চীনের দালাল’ এবং দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করা হলো।” কমিউনিস্টরা চীনপন্থী অতএব দেশদ্রোহী, এই দাবিতে জাতীয় কংগ্রেসী সরকার সবরকম দমন পীড়ন পার্টির ওপর চালাতে থাকলো। এই বছরেই পশ্চিমবঙ্গ নাট্য নিয়ন্ত্রণ বিল’৬২ ঘোষিত হয়। সে বিল অনুযায়ী সরকারি অনুমোদন ছাড়া কারো নাটক করার অধিকার ছিলো না। নাট্যশালায় কোন নাটক প্রদর্শিত হবে তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন নাট্যশিল্পী, নাট্যকর্মী বা নাট্যনুরাগী নয়; নাটক বাছাই করবেন লালবাজারের পুলিশ অফিসার। সরকারি চাপের মুখে উৎপল দত্তকে অঙ্গার নাটক বন্ধ করে দিতে হলো।
গ্রগতিশীল নাট্য সংগঠনগুলো কোনোরকম মুখ খুলতে পারছিলো না। নবনাট্যও এসময় চাপের মুখে পড়ে। বাষট্টি থেকে চৌষট্টির এপ্রিল মাস পর্যন্ত নাট্য জগতে একটা দারুণ দুর্যোগের কালো ছায়া পড়েছিলো। জরুরি অবস্থাকালীন যে শ্বাসরোধকারী পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিলো ভাতে সর্বস্তরেই স্বাধীনভাবে মতামত ব্যক্ত করার সুযোগ সংকুচিত হয়ে এসেছিলো।
ষাট দশকের শেষভাগে শ্রেণীসংগ্রামের চরম মুহূর্তে যখন জমিদার আর মেহনতি মানুষ মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে তখন কংগ্রেসী শাসকদল পুরাতন সমাজ ব্যবস্থার বুনিয়াদ রক্ষার জন্য সংস্কৃতির ওপর আরো জোরালো আক্রমণ চালায়। সেই দুর্দিনের অভিজ্ঞতায় বহুজন বুঝতে পেরেছিলো সংস্কৃতি রাজনীতির বাইরে নয়, ব্যক্তি জীবনের অভিজ্ঞতায় তখন বহুজনই বুঝেছে সমাজ ব্যবস্থায় নিরপেক্ষতার স্থান নেই। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রগতিশীল নাটকের দলগুলো নতুন নতুন নাটক প্রযোজনায় হাত দেয়, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে জীবনকে বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করে। পঁয়ষট্টি সালে শুরু হয় পাক-ভারত যুদ্ধ। পাশাপাশি অর্ধাহার অনাহারজনিত মৃত্যু, ছাঁটাই, কলকারখানা বন্ধ হওয়া নিত্যকার ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়।
সারাদেশ জুড়ে ব্যাপক ও তীব্র চাকরি সংকট যুবসমাজকে এক ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন করে। ছেষট্টি সালে যা আরো দুর্বিসহ আকার নেয়। ছেষট্টির খাদ্য আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গকে আলোড়িত করে তুলেছিলো। সারা রাজ্য জুড়ে এতো ব্যাপক খাদ্য আন্দোলন আগে কখনও হয়নি। প্রচণ্ড মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, মুনাফাবাজি মানুষের ধৈর্য্যের সীমা বিপর্যস্ত করলো।
ছেষট্টির ব্যাপক প্রত্যক্ষ আন্দোলনের ভেতর দিয়ে দেশের সাধারণ মানুষ নতুন রাজনৈতিক বোধে উপনীত হলেন। এ আন্দোলনকে দমন করার জন্য সরকার তেড়ে সন্ত্রাস চালালো। বামপন্থী নেতারা যেমন বন্দী হলেন, বন্দী হলেন বেশ কিছু সাহিত্যিক ও নাট্যকর্মী। নিরাপত্তা আইন, নিবর্তনমূলক আটক আইন, প্রভৃতি দমনমূলক আইনগুলির দ্বারা খেয়ালখুশি মতো জনগণের অধিকার খর্ব করা হচ্ছিলো। জনগণের সামান্যতম প্রতিবাদের বিরুদ্ধে সরকারি নিপীড়ন শুরু হলো, নির্মম পাশবিক পদ্ধতিতে প্রতিবাদ দমন করে দেশে পুলিশী রাষ্ট্র ব্যবস্থা পত্তন করে তৎকালীন সরকার। শ্রমিক- কৃষক-মধ্যবিত্ত মানুষ এই অবস্থাকে নির্মূল করতে চাইলো।
শহরে গ্রামাঞ্চলে তারা প্রতিরোধ সংগ্রামে সামিল হলো। শিল্পী-সাহিত্যক-বুদ্ধিজীবীরাও হাজারে হাজারে প্রতিবাদে সংগঠিত হলেন। গণনাট্য সংঘের মধ্যে তখন ভাঙ্গাগড়ার চরম খেলা চলছে। এই অবস্থার মধ্যেও গণনাট্য সংঘের কর্মীরা গণনাট্যের পতাকাকে উর্দ্ধে তুলে ধরতে মরণপণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবিতে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে, অভূতপূর্ব খাদ্য সমস্যার প্রতিকারে এবং সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের মোকাবেলায় গণনাট্য সংঘ শ্রমিক-কৃষকদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। দেখা গেল এই সংগ্রামে গণনাট্য সংঘ একা নয়, সাথে যুক্ত হয়েছে আরো অনেক নাট্যদল এবং শিল্পী ও সাহিত্যিক। অগ্নিগর্ভ রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে সূচিত হলো প্রগতিশীল নাট্য আন্দোলনের আর এক নতুন অধ্যায়।
বিশুদ্ধ শিল্পচর্চার ঝোঁক কেটে গিয়ে আবার আত্মপ্রকাশ করলো সমাজ সচেতন, শ্রেণী-দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিচালিত রাজনৈতিক নাটক। তৎকালীন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডল ছিলো এর পশ্চাতে সক্রিয়। সন্দেহ নেই যে উৎপল দত্তই ছিলেন এর অন্যতম পথ প্রদর্শক। গণনাট্য থেকে সরে গিয়ে যাঁরা এতোদিন পলায়নপর মনোভাব নিয়েছিলেন তাঁদের অনেকেই নাটক নিয়ে এই সময় নতুন চিন্তার মুখোমুখি হন।
দেখা যায় রাজনৈতিক ভাবে পলায়নপর মনোবৃত্তি কেটে যাচ্ছে অনেকের। নতুন নাট্যচিন্তায় রাজনীতিও প্রাধান্য পায়। সরকারি শাসনযন্ত্রের চেহারা এমন নগ্নভাবে প্রকাশ হয়ে পড়েছিলো, নাট্যকর্মীরা বুঝতে পারলো রাজনীতি থেকে দূরে সরে গিয়ে নিজেদের গা বাঁচানো যাবে না। তাই সরকারি নির্যাতনের সামনে দাঁড়িয়ে ষাট দশকের মাঝ থেকে নবনাট্য আন্দোলন নতুন চরিত্র লাভ করলো। নবনাট্য আন্দোলন গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনে পরিণত হলো।
মন্মথ রায় উনিশশো পঁয়ষট্টি সালে লিখেছিলেন, নবনাট্য আন্দোলন বুড়ো হয়ে পড়েছে। সেজন্য নতুন এক নাট্য আন্দোলন অনিবার্যভাবে সমাসন্ন।
মানুষের দুঃসহ জীবন যন্ত্রণা অবসানের একমাত্র পথ সমাজতন্ত্র। সেই সমাজতন্ত্রের পথেই নতুন নাট্য আন্দোলনকে প্রবাহিত করা দরকার। মন্মথ রায়ের চিন্তার পথ ধরেই যেন আগাতে থাকে পশ্চিমবঙ্গের পরবর্তী দেড় দশকের অপেশাদার থিয়েটার। সেখানে সমাজতন্ত্রের চিন্তা আবার জায়গা করে নেয়। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার ব্যাপারটি আবার গুরুত্ব পেতে শুরু করে নাট্য প্রযোজনায়। এই পর্যায়ে এসেই গণনাট্য সংঘ বহির্ভূত নাট্য দলগুলি গ্রুপ থিয়েটার নামে পরিচিত হতে শুরু করে। সমাজের প্রতি দায় পালন করতে চায় বহু মানুষ অর্থাৎ গ্রুপ। গ্রুপ থিয়েটারের নাম ও চরিত্র সৃষ্টির ইতিহাস সম্ভবত এই।
পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে একটি বৈশিষ্ট্য সুপরিস্ফুট হয়ে ওঠে তা হলো, সমাজ ও জনগণের জন্য শিল্প নয়, ‘শিল্প শিল্পের জন্য’-এই কথা আর তেমন উচ্চারিত হচ্ছে না। এমন কি যারা প্রতিক্রিয়াশীল তারাও তা বলছে না। জনগণ ও সমাজের জন্য নাটক করবো, নিজেদের প্রগতিশীল পরিচয় অক্ষুন্ন রাখবো, অথচ গণনাট্য করবো না-এই জায়গায় দাঁড়িয়ে বিকল্প কিছুর পরিচয় সেদিন প্রয়োজন হয়ে পড়লো। গ্রুপ থিয়েটার নামে অভিহিত হবার মধ্য দিয়ে সম্ভবত এই সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো।২ গণনাট্য আন্দোলনের মূল প্রবাহের সাথে এই ধারা চলতে লাগলো এবং আংশিক মিশে গেল।

ব্যাপারটার এখানেই শেষ নয়, পশ্চিমবঙ্গের নাট্য আন্দালনের মূল স্রোতধারা হয়ে দাঁড়ায় এই গ্রুপ থিয়েটার। তিরানব্বই সাল পর্যন্ত এক হিসাবে দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গের সতেরটি জেলায় গণনাট্যের মোট তিনশো বারোটি শাখা রয়েছে, গড়ে প্রায় প্রতিটি জেলায় আঠারটি করে শাখা। গণনাট্যর এই শাখাগুলোর বাইরেও সারা পশ্চিমবঙ্গে নাটক মঞ্চায়ন করে চলেছে হাজারের অধিক গ্রুপ থিয়েটার বা বিভিন্ন নাট্যদল।
কিন্তু ‘থিয়েটার গ্রুপ’ নাম না নিয়ে ‘গ্রুপ থিয়েটার’ বলার দরকার কী ছিলো কিংবা এই নামটির উৎসই বা কী? পশ্চিমবঙ্গে ষাটের দশক থেকে যে গ্রুপ থিয়েটারগুলোর যাত্রা দেখতে পাই তার বৈশিষ্ট্য ও স্বরূপ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে এ অধ্যায়ে প্রথম ‘গ্রুপ থিয়েটার’ শব্দটির উৎপত্তি, গ্রুপ থিয়েটার কী এবং কেন, কোথায় কখন কীভাবে এর ব্যবহার আরম্ভ হয় তা নিয়ে অনুসন্ধান ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের চেষ্টা চালাবো। থিয়েটার গ্রুপ না বলে কেন গ্রুপ থিয়েটার বলা হচ্ছে ব্যাপারটা প্রশ্ন সৃষ্টি করে। থিয়েটার বিষয়টিই একাধিক ব্যক্তির সম্মিলিত কর্মফল, অর্থাৎ থিয়েটার-কর্ম মাত্রই একটি গ্রুপের কর্ম। এদিক থেকে গ্রুপ থিয়েটার অভিধাটির আলাদা কোনো অর্থ নেই।
সে বিচারে ‘গ্রুপ থিয়েটার’ শব্দের ব্যবহারের পেছনে যে একটা বিশেষ লক্ষ্য আছে তা খুব ভালোই বোঝা যায় এবং গ্রুপ থিয়েটার এই শব্দটি নাট্যজগতে বেশ আলোড়নও সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে বিশ শতকের তিনের দশক থেকে গ্রুপ থিয়েটার শব্দটি বিশেষ স্থান পেয়ে আসছে। সেজন্য গ্রুপ থিয়েটার সৃষ্টির প্রেক্ষাপটটাকেই প্রথমে নজরে আনা যাক। যদি গ্রুপ থিয়েটারের শুরুর ব্যাপারটা দেখতে যাই তাহলে বলতে হবে সে ব্যাপারে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তাতে দেখা যায়, গ্রুপ থিয়েটার শব্দের উৎপত্তি নিয়ে যে-সকল ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এসেছে তার সবই প্রায় একই রকম। দ্বিমত প্রকাশের অবকাশ সেখানে খুবই কম। ‘গ্রুপ থিয়েটার’ শব্দটির সাথে আমরা প্রথম পরিচিত হই প্রথম মহাযুদ্ধের পর, প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অন্তর্বর্তীকালে, বিশ শতকের বিশের দশকে। মঞ্চ প্রক্রিয়ার ইতিহাসে সর্বপ্রথম গ্রুপ থিয়েটার কথাটি ব্যবহৃত হয় যুক্তরাষ্ট্রে।
যুক্তরাষ্ট্রে যখন শ্রমিকশ্রেণীর এ্যাজিটপ্রপগুলো প্রচারণামূলক শ্লোগানসর্বস্ব নাটক মঞ্চায়ন করছিলো, সেই সময় পেশাদার মঞ্চে জন্ম নেয় নতুন এক নাট্যদল-এই নাট্যদলের নামই গ্রুপ থিয়েটার। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার যুগে আমেরিকার নিউইয়র্কে হ্যারল্ড ক্লারম্যান, লী স্ট্রাসবার্গ, চেরিল ক্রফোর্ড, ক্লিফোর্ড ওডেটস প্রমুখ কয়েকজন তরুণ নাট্যকর্মী মূলত আমেরিকার ব্রডওয়ে থিয়েটারের বিরোধিতায় গ্রুপ থিয়েটার নাম দিয়ে একটি নাট্যদল গঠন করেন। বিশ শতকের বিশের দশকে যারা থিয়েটার গিল্ডের প্রযোজনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাঁদের মধ্যেই কয়েকজন স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই গ্রুপ থিয়েটার দলের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
থিয়েটার গিল্ডের আওতার মধ্যে থেকেই তারা প্রথম উনিশশো উনত্রিশ সালে রেড রাস্ট নাটকটি অভিনয় করেন। রুশ বিপ্লবের গোড়ার দিকের বিষয় নিয়ে রচিত নাটক রেড রাস্ট। সেই সময় খুব সাড়া জাগিয়েছিলো নাটকটি। পরের বছর তারা মঞ্চস্থ করে রুশ নাট্যকার তেত্রিয়াকভের রোর চায়না। উনিশশো একত্রিশ সালে মঞ্চস্থ করে পল গ্রীনের লেখা হাউস অব কনেলি। পল গ্রীনের লেখা হাউস অব কনোলি নাটক অভিনয়ের মধ্য দিয়ে গ্রুপ থিয়েটার নিউইয়র্কের নাট্যজগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। গ্রুপ থিয়েটার দর্শকের সামনে হাজির হলো সম্পূর্ণ নতুন ধারার নাটক নিয়ে। সেখানে শিল্প ও সামাজিক দায়বদ্ধতার মেলবন্ধন ঘটাবার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।
গ্রুপ থিয়েটার একটা বিশেষ নাট্যদলের নাম ছিলো যুক্তরাষ্ট্রে। যারা উনিশশো পঁয়ত্রিশ সালের ক্লিফোর্ড এর লেখা ওয়েটিং ফর লেফটি নাটকটি মঞ্চস্থ করার পর বামপন্থী সংস্থা হিসাবে পরিচিত হলো। নাটকটি সে সময় খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। নাটকটি নিউইয়র্ক শহরের অবহেলিত ট্যাক্সি চালকদের অবস্থা নিয়ে রচিত। হ্যারল্ড ক্লারমানের ভাষায় নাটকটি ছিলো তিরিশের দশকের প্রসব বেদনা। যুব সমাজ এর মধ্যে নিজেদের খুঁজে পেয়েছিলো। বস্তুত এ-নাটকে অভিনেতা এবং দর্শক মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলো। উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় মুখর হয়েছিলেন – সমালোচকরা।
নিউইয়র্কের বাকভঙ্গি ওডেন্সের ভালোভাবে আয়ত্তে থাকায় ট্যাক্সি চালকদেরকে তিনি বাস্তবসম্মতভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন, পূর্বের কোনো এ্যাজিটপ্রপে যা দেখা যায়নি। ঘটনাস্থল শ্রমিক ইউনিয়নের একটি সভা, মালিক পক্ষের একটি লোক ইউনিয়নের মুখপাত্র হয়ে শ্রমিকদের ধর্মঘট না করার পরামর্শ দিচ্ছে। শ্রমিকরা তার যুক্তি মেনে নিতে পারছে না। মঞ্চে ঘটনাসমূহ বিচ্ছিন্নভাবে দেখানো হলেও সামগ্রিকভাবে তা এ্যাজিটপ্রপ-এর রীতি অনুযায়ী শোষক ও শোষিতশ্রেণীর মধ্যকার দ্বন্দেরই প্রকাশ। পরিশেষে শোষিতদের ঐক্য ও বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে নাটকটির যবনিকাপাত হয়। ওডেটস কিছুকাল পার্টির সদস্য ছিলেন সে কারণে পার্টির চিন্তার সাথে তার নাটকের যথেষ্ট সামঞ্জস্য ছিলো। লেফটি নাটকে ধর্মঘটকে সমর্থন করা হয়, পার্টির প্রশংসা করা হয়, তবে তাতে সোভিয়েতপন্থী শ্লোগান বা সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক ছিলো না।
উনিশশো পঁয়ত্রিশ সালের জুন মাসে ওয়েটিং ফর লেফটির পূর্বে দ্য লিগ অব ওয়ার্কার্স থিয়েটার এলিয়া কাজান ও আর্ট স্মিথ রচিত ডিমিত্রফ নাটকটি মঞ্চস্থ করে, যা ছিলো খুবই সাহসী প্রযোজনা। নাটকটির মূল বক্তব্য ছিলো হিটলারের ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে। ডিমিত্রফ লেখা হয়েছিলো উনিশশো তেত্রিশ সালে রাইখস্টাগে অগ্নিসংযোগে জড়িত বলে অভিযুক্ত জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান আর্নস্ট থেলমান ও আর্নস্ট টগলারের মুক্তির দাবিতে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির জন্য। পরবর্তী সময় প্রমাণিত হয়েছিলো কমিউনিস্টরা কেউ ঐ অগ্নিকাণ্ডে জড়িত ছিলেন না। হিটলারের লোকরাই সে অগ্নিসংযোগ করেছিলো। মাত্র বিশ মিনিটের এ নাটকটি দর্শকদের বেশ আলোড়িত করেছিলো।
শ্রেণীসংগ্রামের ব্যাপারটি এ নাটকে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিলো। নাটকটি ছিলো মূলত ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। নাটকে ডিমিত্রফের একটি সংলাপ ছিলো, বিপ্লবী জনতার দাবির কারণে আমরা মুক্তি পেয়েছি। কিন্তু টগলার এখনও কারাগারে এবং থেলমান শৃঙ্খলাবদ্ধ। আমাদের থামলে চলবে না। অনমনীয় শক্তি ও সাহসের সাথে আমাদের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। কমরেডদের মুক্ত করতেই হবে। নাটক হিসাবে ডিমিত্রফ যে খুব উন্নত মানের ছিলো তা নয় কিন্তু নাটকটির বক্তব্য ছিলো জোরালো। ডিমিত্রফ নাটকটিই ওয়েটিং ফর লেফটির জন্য রাস্তা তৈরি করে দেয়। ওয়েটিং ফর লেফটির ত্বরিৎ সাফল্যের প্রধান একটি কারণই হলো ওডেটস মধ্যবিত্তশ্রেণীর সমস্যার কথা মনে রেখে নাটকটি লিখেছিলেন। সুতরাং ব্রডওয়ের দর্শকগণ এমন চরিত্রদের মধ্যে বিদ্রোহ গড়ে উঠতে দেখলেন যাঁদের সঙ্গে তাঁরা নিজেদের মিল খুঁজে পেলেন। ডিমিত্রফের সমস্যাটি ছিলো বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে ও আন্তর্জাতিক।
পার্টির শ্রমিকদের কাছে এ নাটকের সামান্য মূল্য থাকলেও, পার্টি বহির্ভূত মধ্যবিত্তদের কাছে এর কোনো আবেদন ছিলো না। তার প্রধান কারণ ছিলো, মহামন্দার কালে আমেরিকানদের প্রধান সমস্যা ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য সমর্থন বা হিটলারের নিন্দাবাদ নয়, সে সময় জীবিকা অর্জনের কঠিন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হচ্ছিলো। সেজন্য ওয়েটিং ফর লেফটির আবেদন ছিলো অনেক বেশি। গ্রুপ থিয়েটার সেই সময়কার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এড়াতে না পেরে বামপন্থী নাটক করলেও দলটি ছিলো মধ্যবিত্তদেরই। শ্রমিকশ্রেণীর এ্যাজিটপ্রপগুলো তখন যে নাট্যধারার জন্ম দিয়েছিলো, বিদ্রোহী কোনো নাট্যদলের পক্ষেই তার বাইরে থাকা সম্ভব ছিলো না। গ্রুপ থিয়েটারকে তাই বামপন্থী নাটকের পথেই পা বাড়াতে হয়।
যদিও এই দলটি ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে নাটকে সোচ্চার বক্তব্য রাখে তবুও এই দল গঠনের পিছনে একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটও ছিলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে স্টার সিস্টেম চালু হয়েছিলো অর্থাৎ থিয়েটারের যেসব বড় বড় স্টার ছিলেন তাঁরা থিয়েটারের ওপর চেপে বসেছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে দ্য গ্রুপ থিয়েটার বিদ্রোহ করেছিলো।
পেশাদার মঞ্চে তখন তারকাদের দেখিয়েই অর্থোপার্জন করা, বাণিজ্য চালানো রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। প্রযোজনার মান সেখানে রক্ষা করার দিকে নজর ছিলো না। গ্রুপ থিয়েটারের স্রষ্টারা স্টার সিস্টেমের বিরুদ্ধে টিম ওয়ার্ক তৈরি করার জন্য দলের নাম গ্রুপ থিয়েটার দিয়েছিলেন। স্তানিশ্লাভস্কি নির্দেশিত গ্রুপ অ্যাকটিং বা দলীয় অভিনয় অনুসরণ করতেন বলেই এ দলের নাম হয়েছিলো গ্রুপ থিয়েটার।
যার অর্থ নাট্যশালায় বিশেষ কেউকেটাদের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না কিংবা দু-একজন বিশেষ অভিনেতা অভিনেত্রীর আস্ফালনের আখড়া হয়ে উঠবে না। ব্যক্তিপূজা তখন স্বৈরাচারের নামান্তর। ব্যক্তিপূজার বিরুদ্ধে মানুষ তখন সরব। নাটকে যখন ব্যক্তিপূজা প্রতিষ্ঠা পাচ্ছিলো এবং ব্যক্তিপূজার নামে নাটক আর নাটকই থাকছিলো না, ব্যক্তির দৌরাত্ম্যে পরিণত হয়েছিলো, সেই সময় গ্রুপ থিয়েটার প্রতিষ্ঠা ছিলো তার বিরুদ্ধে সচেতন প্রতিবাদ।
যুগের সন্ধিক্ষণেই সেদিন ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে সমষ্টির চিন্তা তখন সচেতন মানুষদের মধ্যে প্রসারিত হতে আরম্ভ করেছিলো। শুধুমাত্র গ্রুপ থিয়েটার নয়, সে সময়কার বিভিন্ন স্বাধীন থিয়েটারগুলোতেও আমরা এই সত্য লক্ষ্য করবো। শুধুমাত্র একজন ব্যক্তিকে জায়গা ছেড়ে দিতে থিয়েটার তখন রাজি নয়। সেজন্য গ্রুপ থিয়েটার- এর নাটকে সমষ্টিবদ্ধভাবে সাংগঠনিক পদ্ধতিতে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে কর্ম সম্পাদনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো। গ্রুপ থিয়েটার-এ কোনো ব্যক্তিবিশেষের মূল্য নেই, সবটাই সেখানে দলগত। ‘গ্রুপ থিয়েটার’ শব্দ প্রচলনের সার্থকতা এখানেই।
যুক্তরাষ্ট্রের গ্রুপ থিয়েটার নাট্য প্রযোজনায় যথেষ্ট বামপন্থী ভূমিকা রাখলেও সংগঠনটির প্রাথমিক লক্ষ্য ছিলো ভালো প্রযোজনা তৈরি করা এবং অন্যদিকে গোষ্ঠীবদ্ধ অভিনয়ের মাধ্যমে নাটকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো। দলটি ছিলো সম্পূর্ণ পেশাদার তবুও তাদের কতোগুলো বৈশিষ্ট্য ছিলো যা বাণিজ্যিক থিয়েটারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবেই ঘোষিত হয়েছিলো।
বাণিজ্যিক থিয়েটারে বাণিজ্য বা মুনাফা লাভই ছিলো বড় কথা। প্রযোজনার মান নিয়ে তারা ভাবতো না। তাদের লক্ষ্য ছিলো দর্শকদের মনোরঞ্জন করা এবং অর্থোপার্জন। বাণিজ্যিক থিয়েটারের নাট্যকাররা স্বাধীন ছিলেন না, মালিকের কিংবা নাট্যদলের চাহিদা মতো তাঁকে নাটক লিখতে হতো। নাট্যকার ছিলেন সেখানে পুঁজির দাস। গ্রুপ থিয়েটার-এর কোনো মালিকানা ছিলো না। কোনো পুঁজি বিনিয়োগকারী ছিলো না। বেশ কয়েকজনের যৌথ ব্যবস্থাপনায় গ্রুপ থিয়েটার পরিচালিত হতো। গ্রুপ থিয়েটারের ঘোষণাপত্রের মধ্যেই বলা ছিলো, বাণিজ্যিকভাবে তারা নাটক করবে না। সে দেশি বা বিদেশি নাটক যাই হোক না কেন। সেজন্য সেখানে নাট্যকারের স্বাধীন চিন্তা বা মতামতের মূল্য ছিলো। বাণিজ্যিক থিয়েটারের মতো নাটককে ব্যবসায়িক সাফল্য এনে দেয়ার দায়দায়িত্ব নাট্যকারের ছিলো না।
নাট্যকাররা নিজেদের স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গিকে সেখানে প্রকাশ করতে পারতেন বলেই ক্লিফোর্ড ওডেটসের মতো বামপন্থী চিন্তার নাট্যকার নাটক লিখে দ্রুত সাফল্য লাভ করেছিলেন। ক্লিফোর্ড ওডেটস-এর ওয়েটিং ফর লেফটি ও টিল দাডে আই ডাই মার্কিন নাটকের ইতিহাসে স্মরণীয় দুটি নাম। দুটি নাটকই লেখা হয়েছিলো ধনবাদের বিরুদ্ধে। মনে রাখার ব্যাপার হলো, গ্রুপ থিয়েটার-এর ঘোষণার কোথাও ধনবাদের বিরুদ্ধে নাটক মঞ্চায়ন করা বা কার বিরুদ্ধে কী ধরনের নাটক মঞ্চায়ন করবে তার কিছুই বলা ছিলো না। মূল লক্ষ্যটি ছিলো শুধুমাত্র দলগতভাবে নাটক মঞ্চায়ন করা। ঘটনাস্রোতই তাদেরকে ধনবাদের বিরুদ্ধে নাটক মঞ্চায়নে আগ্রহী করে। নাটক যেহেতু সমাজের দর্পণ, সেজন্য সমকালীন ঘটনাস্রোত থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখে সার্থক নাটক লেখা যায় না।
যে-কালে, যে-জনমণ্ডলীর মধ্যে মানুষ বাস করে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সংগ্রামকে ব্যক্ত না করলে নাটক বৃহত্তর জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। সেজন্যই গ্রুপ থিয়েটারের প্রথম নাটকগুলো দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি, যদিও প্রযোজনার গুণে তা খ্যাতি ও সম্মান লাভ করেছিলো বুদ্ধিজীবী মহলে। প্রথমদিকে নাটকগুলোর দর্শক সাফল্য না থাকার কারণে গ্রুপ থিয়েটার আর্থিকভাবে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই দিক থেকে বামচিন্তার নাটক ওয়েটিং ফর লেফটি তাকে যেমন সুনাম এনে দেয় তেমনি এনে দেয় আর্থিক সাফল্য। স্বভাবতই গ্রুপ থিয়েটার পরের প্রযোজনাগুলিতে আরো বেশি বামপন্থী চিন্তার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সরকারের রোষানলেও তাকে পড়তে হয়। ওয়েটিং ফর লেফটি ধনবাদী সমাজের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও তা ছিলো এক ধরনের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ। ধনবাদী ব্যবস্থার তারা শুধু সমালোচনা করেছে তবে সেই ব্যবস্থাকে উচ্ছেদের ব্যাপারে তাদের কোনো বক্তব্য ছিলো না।
ক্লিফোর্ড ওডেটস-এর ওয়েটিং ফর লেফটি যখন মঞ্চস্থ হয় ব্রেন্ট তখন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। তিনি এ নাটক দেখে লিখেছিলেন যে, ওয়েটিং ফর লেফটি নাটককে তিনি যথেষ্ট মূল্য দেন তবে কোথাও যেন একটা গোলমাল রয়েছে বলেও তিনি মনে করেন। তিনি এ নাটককে বামপন্থী খেয়ালিপনা হিসাবেই দেখেছিলেন এবং তিনি সমালোচক জেরোমকে সেই খেয়ালিপনা শুধরে দেয়ার জন্য নিয়মিত লিখতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। গ্রুপ থিয়েটার মার্কসবাদী ধারায় সমাজ পরিবর্তন চায়নি আবার সেদিনের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতে জনগণের আকাঙ্ক্ষাকেও অস্বীকার করতে পারেনি। পিসকাটরের স্ত্রী মারিয়া লে পিসকাটর গ্রুপ থিয়েটার সম্পর্কে নানা ধরনের প্রশংসা করলেও তিনি দলটিকে খুব বিপ্লবী বলে মনে করেননি। যুক্তরাষ্ট্রের এই গ্রুপ থিয়েটার খুবই সুনাম অর্জন করেছিলো এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিলো। সে খ্যাতি ছিলো প্রায় আকাশচুম্বি।
লগুনেও উনিশশো তেত্রিশ সাল থেকে ‘গ্রুপ থিয়েটার’ নাম নিয়ে আর একটি দল বেশ কিছুকাল নাটক করেছিলো। ৭° পশ্চিমবঙ্গে ঋত্বিক ঘটকও ‘গ্রুপ থিয়েটার’ নামে একটি নাট্যদল গঠনের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন।” চল্লিশের দশকে উত্তর ভারতে ‘গ্রুপ থিয়েটার’ নামে একটি আন্দোলন শুরু হয়েছিলো। নাট্য আন্দোলনে গ্রুপ থিয়েটার শব্দটি এখন বহুল ব্যবহৃত। তবে ‘গ্রুপ থিয়েটার’ নামের যে খ্যাতি বা গ্রহণযোগ্যতা তা এসেছিলো অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের নাট্য সংস্থাটি থেকেই। সে সাথে একথাও মনে রাখতে হবে, মার্কিন দেশজাত গ্রুপ থিয়েটার সেখানে যে ধরনের নাটক মঞ্চস্থ করেছে তার সাথে মার্কসীয় রাজনীতি কিংবা গণ আন্দোলনের কতোটা সম্পর্ক ছিলো তা যথেষ্ট প্রশ্নের সম্মুখীন।
পশ্চিমবঙ্গের বাংলা নাটকে গ্রুপ থিয়েটার শব্দ দুটি অবশ্যই তাদের মূলগত উত্তরাধিকার নিয়ে প্রযুক্ত হয়নি। গ্রুপ থিয়েটার শব্দটি প্রথম যে লক্ষ্যে ব্যবহৃত হয়েছিলো পরে আর সে লক্ষ্যে স্থির থাকেনি। সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে ‘গ্রুপ থিয়েটার’ শব্দের অর্থ ব্যাপকভাবে পাল্টে গেছে। বাংলার নাট্য আন্দোলনে গ্রুপ থিয়েটার সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারা।
যে স্টার সিস্টেম বা তারকা প্রথার বিরুদ্ধে গ্রুপ থিয়েটার-এর জন্ম, গ্রুপ থিয়েটারের অধিকাংশরাই পরবর্তীতে সেই ‘স্টার’ বা ‘তারকা’ হয়েই দেখা দেয়। আর প্রতিষ্ঠা লাভের পর এঁরা আর গ্রুপ থিয়েটার-এর সাথে সম্পর্কিত না থেকে ব্রডওয়ের অন্য থিয়েটার ও হলিউডের সাথে জড়িয়ে পড়েন। মার্লেন ব্রান্ডো পরবর্তীতে চলচ্চিত্রের ‘সুপার স্টার’ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। এলিয়া কাজানও ‘স্টার’ হিসাবে স্বীকৃতি পান।
তবে ক্লিফোর্ড ওডেটস-এর অভ্যুত্থানও যেমন আকস্মিক, পতনও তেমনি দ্রুত। সেই সময় বামপন্থী নাট্যকারদের মধ্যে ক্লিফোর্ড ওডেটস ছিলেন সবচেয়ে বেশি সফল ও সর্বজনস্বীকৃত। নাটক লেখা একরকম ছেড়ে দিয়ে পরবর্তী জীবনে তিনি হয়েছিলেন হলিউডের চিত্রনাট্য লেখক। শেষ দিকে এসে তিনি মার্কসবাদেও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন।
যুক্তরাষ্ট্রে ত্রিশের দশকে যেভাবে দুর্ভিক্ষ বা অর্থনৈতিক মন্দা ও ফ্যাসিবাদের উত্থানকে ঘিরে স্বাধীন থিয়েটারগুলি এবং গ্রুপ থিয়েটার জন্য নেয়, ভারতে তেমনি সেই একইভাবে চল্লিশের দশকে ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা ও দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে সৃষ্টি হয় গণনাট্য সংঘ। দুটো আন্দোলন গড়ে উঠবার প্রাথমিক কারণ বা প্রেক্ষাপট প্রায় একই ছিলো, তা সত্ত্বেও দুটোর মধ্যে কিছু বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্যও ছিলো।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীন থিয়েটারগুলো মূলত গড়ে উঠেছিলো সে সময়কার পেশাদার বাণিজ্যিক থিয়েটারের বিকল্প হিসাবে। বিশেষ করে গ্রুপ থিয়েটার গঠনে মূল লক্ষ্য ছিলো পেশাদার মঞ্চের স্টার সিস্টেমের বা তারকা প্রথার বিকল্প ধারা তৈরি করা। গ্রুপ থিয়েটার সহ স্বাধীন থিয়েটারগুলোও ছিলো পেশাদার দল।
শুধু পূর্বের পেশাদার দলগুলো থেকে তাদের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো উন্নত ও ভিন্ন। ভারতের গণনাট্য সংঘ কোনো পেশাদার নাট্যদল ছিলো না। ছিলো মার্কসবাদী দলের সাংস্কৃতিক সংগঠন। যুক্তরাষ্ট্রে বামপন্থী চিন্তাকে ঘিরে গ্রুপ থিয়েটার তথা স্বাধীন থিয়েটারগুলোতে মার্কসবাদী চিন্তা উকি দিয়েছিলো বটে, তবে স্বাধীন থিয়েটারগুলোর মধ্যে যে বামধারা জন্ম নিয়েছিলো, সেগুলোর রাজনৈতিক পটভূমি থাকলেও সেটা সত্যিকার অর্থে কোনো শ্রেণীসংগ্রামের পথ ধরে আসেনি। সে পথে যাবার একটা সম্ভাবনা থাকলেও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ এবং পরে বিজয় লাভের মধ্য দিয়ে সে সম্ভাবনাও শেষ হয়ে যায়।
মূলত ত্রিশ দশকের সেই অর্থনৈতিক মন্দা কেটে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের নাট্যদলগুলো মার্কসবাদ সম্পর্কে শীঘ্রই উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। তাৎক্ষণিক প্রয়োজন ও আবেগে যে নাট্যান্দোলন জন্ম নিয়েছিলো, সে আন্দোলনের প্রয়োজন তখন ফুরিয়ে গেছে। ভারতের গণনাট্য সংঘ সে ধরনের স্বস্তি ফেলবার সুযোগ পায়নি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পর ভারত ফ্যাসিবাদের ভয় কাটিয়ে উঠলেও, তখনো তা ছিলো ব্রিটিশ উপনিবেশ।
তখনও তাকে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছিলো। পক্ষান্তরে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই ছিলো সাম্রাজ্যবাদী দেশ। স্বভাবতই বিশ্বযুদ্ধ শেষে যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীন থিয়েটারগুলোর প্রয়োজন সেভাবে আর দেখা না গেলেও, ভারতে গণনাট্যের প্রয়োজন বা ভূমিকা তখনো শেষ হয়ে যায়নি। ভারতীয় গণনাট্য সংঘ যেহেতু মার্কসবাদী দলের সংগঠন, মার্কসবাদের লক্ষ্য যেহেতু সমাজ পরিবর্তন, সেহেতু সমাজ পরিবর্তন না ঘটা পর্যন্ত কিংবা সমাজ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সাম্যবাদে না পৌঁছানো পর্যন্ত গণনাট্য আন্দোলন থেমে যেতে পারে না।
শ্রেণী বিভক্ত সমাজে যুদ্ধ চলে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে! প্রতি ইঞ্চি মাটিতে। সে লড়াই যেমন থেমে থাকে না, গণনাট্যের কার্যক্রমও তেমনি থেমে থাকার নয়। বিষয়টাকে এভাবে বলা যায়, সমাজ পাল্টানোর যে সামগ্রিক লড়াই তারই একটি অংশ গণনাট্য আন্দোলন। মেহনতী মানুষের শ্রেণীসংগ্রামে সেও নিজের মতো করে অংশ নিতে চায়। নাটকে সেই শ্রেণীসংগ্রামের কথা গণনাট্য গোপনও করে না।
সমাজ কাঠামো বদলাবার জন্য যে আন্দোলন, গণনাট্য সেটা জনগণের মধ্যে প্রচারের দায়িত্ব বহন করছে শ্রমিকের দৃষ্টিকোণ থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের গ্রুপ থিয়েটার তথা স্বাধীন থিয়েটারগুলো বামপন্থী প্রগতিশীল ধারার অধিকারী হলেও সেটা ছিলো সংস্কার আন্দোলন। সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলন নয়। সত্যিকারভাবে বলতে গেলে সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য নিয়েই এই নাট্য আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয়নি। সমাজের অসন্তোষ ও নানা অভাব-অভিযোগ নিয়ে তাৎক্ষণিক ক্রোধ প্রকাশ করেছিলো এবং নাট্যচর্চার ফলাফল সেজন্য সুদূর প্রসারী হতে পারলো না।
যুক্তরাষ্ট্রের নাট্য আন্দোলনের সাথে ভারতের নাট্য আন্দোলনের এক বিরাট পার্থক্য ছিলো। ভারতীয় গণনাট্য আন্দোলন কোনোভাবেই কোনো সংস্কার আন্দোলন ছিলো না। সমাজকে খোলনলচে সহ পাল্টাবার আন্দোলন ছিলো সেটা। নিরপেক্ষ সংস্কৃতির পরিবর্তে গণনাট্য ছিলো সমাজতন্ত্রের, শ্রেণীসংগ্রামের প্রচারক। সেখানে সমাজচেতনার ব্যাপারটা কেবল উদারনৈতিক বুর্জোয়া দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হলো না, দেখা হতে শুরু করলো দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে। গণনাট্য সংঘের গর্ভ থেকে কী করে জন্ম নিলো পশ্চিমবঙ্গের গ্রুপ থিয়েটার আমরা দেখেছি। যুক্তরাষ্ট্রে এবং যুক্তরাজ্যে যেখানে দলের নাম ছিলো গ্রুপ থিয়েটার, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে ঐ দলগুলোর ভাবধারা বা আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নাট্য মঞ্চায়নই গ্রুপ থিয়েটার নামে বিশ শতকের শেষার্ধে পরিচিত হতে লাগলো। সেখানে রাজনীতির প্রশ্নটিও গুরুত্ব পেয়েছিলো, সর্বক্ষেত্রে তা মার্কসবাদী রাজনীতি না হলেও। বহু নাট্যবোদ্ধাই তাদের আলোচনার মধ্য দিয়ে গ্রুপ থিয়েটার কথাটিকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
বিশ শতকের পঞ্চাশ দশক থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মূল নাট্যধারাটি গ্রুপ থিয়েটার নামেই সর্বজন বিদিত। গ্রুপ থিয়েটার শব্দের শেষে ‘আন্দোলন’ বলে একটা কথাও প্রায় অপরিহার্য ভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে কোন্ প্রেক্ষাপটে এবং কী কারণে নাট্যদলগুলো তাদের কর্মধারাকে ‘গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন’ নামে পরিচিত করতে আগ্রহী সে উত্তর বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে দেন। যাঁর যাঁর মতো করে তাঁরা গ্রুপ থিয়েটারকে ব্যাখ্যা করেন। সেখানে কোনো সার্বজনীন বা এক উত্তর পাওয়া যাবে না। গণনাট্য সম্পর্কে এ ধরনের কোনো বিভ্রান্তি নেই। যে-কেউ গণনাট্য সম্পর্কে একথাই বলবে যে, এটি একটি মার্কসবাদী সংগঠন। শ্রমিকশ্রেণীর রাজনীতি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলার জন্যই তাদের নাটক।
পাশাপাশি গ্রুপ থিয়েটারের সংগে জড়িত নামী দামী মাথাওয়ালা থেকে কনিষ্ঠ ব্যক্তিটিকেও যদি জিজ্ঞেস করা যায় গ্রুপ থিয়েটার বলতে কী বোঝায়? তার জন্ম, উদ্দেশ্য, সাংগঠনিক বা শৈল্পিক চরিত্রটি ঠিক কী?-সে সব প্রশ্নের নানা ধরনের উত্তর আসবে। সে থেকে গ্রুপ থিয়েটার সম্পর্কে একটা ধারণাও জন্ম নেবে। তবে সেটাকে পরম বা চরম বলে মনে করা যাবে না। সজল রায় চৌধুরী লিখছেন, গ্রুপ থিয়েটারের কোনো সুনির্দিষ্ট আদর্শ আছে বলে জানি না। ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে তারা চলে। কেউ গণনাট্যের কাছাকাছি, কেউ বহুদূরে। এদের মধ্যে কোনো কোনো গোষ্ঠী আবার পেশাদার হতে প্রয়াসী।
গ্রুপ থিয়েটার আদতে কী, তার সংজ্ঞাটাই বা কী এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে। বহুজনের মতো গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন বস্তুটি কী বা গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন নামকরণের যৌক্তিকতা কী, সে প্রশ্ন তুলেছিলেন রাজনৈতিক থিয়েটারের উৎপল দত্ত। তিনি লিখেছিলেন, নাট্য আন্দোলন একটিই-তাহলো গণনাট্য আন্দোলন। গণনাট্য আন্দোলনের ভিতরে থাকুক কিংবা বাইরে থাকুক, প্রতিটি সমাজসচেতন নাট্যকর্মী গণনাট্য আন্দোলনে সমাবিষ্ট। শ্রেণীসচেতন নাট্যদলগুলোর গ্রুপ থিয়েটার হিসাবে নিজেদের চিহ্নিত করার কোনো অর্থ দাঁড়ায় না। তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, গ্রুপ থিয়েটার কি গণনাট্যের পাল্টা আরেকটি আন্দোলন?
নাকি গ্রুপ থিয়েটার নামক অলীক সংজ্ঞার আড়ালে আত্মগোপন করে সামাজিক-রাজনৈতিক কর্তব্য এড়িয়ে বুদ্ধিবাজ বুর্জোয়াদের দলে ভেড়ার চেষ্টা?” তিনি অন্যত্র লিখছেন, যাঁরা গণনাট্যের সাথে নিজেদের জড়াতে চান না তাঁরাই গ্রুপ থিয়েটার নামের আড়ালে থাকতে চাইছেন। একটু সংগ্রামী সংগ্রামী ভাবমূর্তি রইলো আবার ফ্যাসিস্ত আক্রমণের কালে পালাবার পথও খোলা রইলো।
খুব স্পষ্ট করেই উৎপল দত্ত বলতে চেয়েছিলেন, রাজনীতি বাদ দেয়ার জন্যই গণনাট্য নাম পাল্টে সৎনাট্য, গ্রুপ থিয়েটার বা এ নাট্য সে নাট্য হওয়ার চেষ্টা। কেননা যখন চাপ আসবে, যখন মার আসবে তখন যাতে বলা যায়, গণনাট্য তো করিনি, সৎনাট্য করেছি বা গ্রুপ থিয়েটার করেছি।” উৎপল দত্তের এ বক্তব্য যে মিথ্যা ছিলো না পরে আমরা তার প্রমাণ পাবো। যদি আমরা উৎপল দত্তের ভাবনার জায়গা বাদ দিয়ে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনকে বিচার করতে যাই তাহলে কী দেখতে পাই? নির্দিষ্ট আদর্শ বা লক্ষ্যে কোনো সঠিক সংকল্প না নিয়েও গ্রুপ থিয়েটার ধারার নামধারী দলের সংখ্যা বেশ কয়েক হাজারে এসে দাঁড়িয়েছিলো। সবরকম অপেশাদার নাট্যদলকেই তখন গ্রুপ থিয়েটার নামে অভিহিত করা হতো।
সেই প্রেক্ষিতে যারা থিয়েটারকে একটি গোষ্ঠীভিত্তিক আন্দোলনের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করতে চায় সেই সব ভারতীয় তথা বাংলা থিয়েটারকে গ্রুপ থিয়েটার বলা যায়। যারা গণনাট্যের মূল আদর্শ শ্রেণীসংগ্রাম বা শ্রেণীদর্শন গ্রহণ করতে পারেনি আবার প্রগতিশীল লড়াইয়ের আন্দোলন থেকেও সরে দাঁড়ায়নি। যারা সরাসরিভাবে গণনাট্য আন্দোলন নাম নিয়ে কিংবা গণনাট্য আন্দোলনের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে কাজ করে না, অথচ গণনাট্যের আদর্শকে কোনো না কোনোভাবে বহন করে চলেছে।
গণনাট্য সংঘ স্বভাবতই জনগণের প্রতি বিশ্বস্ত, আর গ্রুপ থিয়েটারগুলির মধ্যে দুইধারার সংমিশ্রণ দেখা যায়। রাজনৈতিক ঘটনাবলীর মূল্যায়নে, শ্রেণীচরিত্র বিশ্লেষণে, শ্রেণীশত্রুকে চিহ্নিত করার প্রশ্নে, এমনকি নাটক রচনা ও প্রযোজনার আঙ্গিকের ক্ষেত্রেও গ্রুপ থিয়েটার দলগুলির চিন্তাভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে গণনাট্য সংঘের চিন্তার মিল রয়েছে, তেমনি অনেক ব্যাপারে মতের ও চিন্তার অমিলও রয়েছে। গ্রুপ থিয়েটার দানা বেঁধেছিলো বামপন্থী বোধের দিকে পাল্লা ভারী করেই। তবে গণনাট্য যেমন সরাসরি রাজনীতি প্রচার করে, গ্রুপ থিয়েটারের মধ্যে আছে তেমন পাশ কাটাবার চেষ্টা।
শ্রেণীসংগ্রাম গ্রুপ থিয়েটারের আদর্শ নয়, আবার সুবিধা বা দরকার মতো তারা তা নাটকে ব্যবহারও করে। গ্রুপ থিয়েটারের কেউ কেউ বিপ্লবী চিন্তার ধারক বাহক হলেও বড় একটা অংশ সংকীর্ণতাবাদেরও পরিচয় দিয়ে থাকে। কিছু কিছু দলের মধ্যে আছে নৈরাজ্যবাদী ধারা, যারা সমাজ বিচ্ছিন্ন নাটক মঞ্চস্থ করে থাকে। গ্রুপ থিয়েটারের আর এক অংশ, সমাজচেতনার সঠিক বোধ না থাকায় নাটকে এরা ক্ষতিকারক মশলাও বিতরণ করেছে। মধ্যমানসিকতার চিন্তার মোড়কে প্রগতি নাট্য আন্দোলনের নামে, নাটককে জনগণমন হরণের দিকে নিয়ে গেছে। তবে এ কথা সত্যি, গ্রুপ থিয়েটারের বৃহৎ অংশটিই ছিলো রাজনীতি প্রচারের পক্ষে।
সত্তর দশকে গ্রুপ থিয়েটার মূলত তার প্রতিবাদী চরিত্র লক্ষণের কারণেই দর্শকদের নজর কেড়েছিলো।” তারা শ্রমিকশ্রেণীর রাজনীতি না করলেও শাসকশ্রেণীর শ্রেণীস্বার্থদুষ্ট শাসননীতির বিরুদ্ধে তাদের নাটকে সোচ্চার কিংবা শাসকশ্রেণীর গণতন্ত্র হত্যার বিরুদ্ধে তারা নিরন্তর আক্রমণরত ছিলো। তবে সেই প্রতিবাদ কিসের জন্য, কার বিরুদ্ধে সে ব্যাপারে সকলের দৃষ্টিভঙ্গি একরকম নয়।
গ্রুপ থিয়েটার কর্মীরা তাঁদের নাটক শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের মধ্যেই প্রদর্শন করতে আগ্রহী, শ্রমিক বা কৃষকদের কাছে নাটককে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো দায়-দায়িত্ব বোধ করেন না। গ্রুপ থিয়েটার সম্পর্কে সজল রায় চৌধুরী লিখেছেন, যে থিয়েটার কমিউনিস্ট আন্দোলনের মার্কায় চিহ্নিত হতে চায় না অথচ কমিউনিস্ট পার্টির বিরোধী নয়, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের দ্বারা অনুপ্রাণিত তাই প্রকৃত গ্রুপ থিয়েটার। তিনি এ কথাও স্বীকার করছেন, অপসংস্কৃতির প্রতিরোধে এবং জনগণের গণতান্ত্রিক চৈতন্য সংগঠনে গ্রুপ থিয়েটার কথিত নাট্য সংস্থাগুলির ভূমিকা অনস্বীকার্য।
গ্রুপ থিয়েটারগুলোর মধ্যে আবার নানা প্রকারভেদ রয়েছে। বিভিন্ন জনের চিন্তা ও বিশ্বাসের জায়গাগুলো আলাদা। গ্রুপ থিয়েটারের একটি বৃহৎ অংশ গণনাট্যের ঐতিহ্য সাঙ্গীভূত করে সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে বাস্তবায়িত করতে চায়। সেখানেও মুশকিল বেধেছে দুটি ক্ষেত্রে। গ্রুপ থিয়েটারের অনেকগুলোই মার্কসবাদী চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত হলেও ঠিক কোনো কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নয়।
দ্বিতীয়ত, দলগুলো সেখানে কয়েকজন ব্যক্তির চিন্তা-ভাবনার অধীন। যার জন্য শেষ পর্যন্ত যা দাঁড়ায় তাহলো-গোষ্ঠীতন্ত্র কী আদর্শে, কী প্রযোজনায়, কী সংগঠনে গোষ্ঠীবাদেরই জন্ম দেয়। ব্যক্তিবাদ সেখানে ধীরে ধীরে মুখব্যাদান করে। ব্যক্তির আত্মপ্রতিষ্ঠার চিন্তা থেকেই সেখানে আদর্শবোধে ঘটে বিচ্যুতি। গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের ক্ষেত্রে বারবার ব্যক্তিবাদ যেমন মাথা চাড়া দিয়েছে, তেমনি মূল আদর্শ থেকে বিচ্যুত হওয়ার ঘটনাও লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে আশির দশকের শেষদিক থেকে সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধান প্রবণতা। ষাটের দশকের শেষে গ্রুপ থিয়েটার যে লক্ষ্য নিয়ে কাজ আরম্ভ করেছিলো নব্বইয়ের দশকে এসে আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকেনি। আশির দশকের মাঝ থেকেই গ্রুপ থিয়েটারে আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই প্রাধান্য পেতে থাকে।
গ্রুপ থিয়েটারগুলো তার পূর্বের সংগ্রামী চেহারা হারিয়ে ফেলে। নব্বইয়ের দশকে গ্রুপ থিয়েটার সম্পূর্ণভাবে সংগ্রামের পথ ছেড়ে দিয়ে ব্যক্তির প্রতিষ্ঠা লাভের পথে হাঁটতে থাকে। পেশাদারিত্বের প্রশ্নটাই সেখানে গুরুত্ব পায়। ষাট ও সত্তর দশকের গ্রুপ থিয়েটারের সাথে নব্বইয়ের দশকের গ্রুপ থিয়েটারের অমিলই বেশি চোখে পড়ে। ষাটের দশকের পর থেকে আশির দশক পর্যন্ত গ্রুপ থিয়েটারের কর্মধারা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, গণনাট্যের পাশাপাশি রাজনৈতিক নাটকের ধারাও এরা রক্ষা করে চলেছিলো। গ্রুপ থিয়েটাগুলির সেই সময়কার প্রযোজনার ইতিহাস খুঁজলে লক্ষ্য করা যায় প্রায় নব্বই শতাংশ দল তাদের সৃষ্টি কর্মে সমাজকে স্বীকার করেছে, সমাজের মানুষের মর্যাদা দিয়েছে, সমকালের ঘটনাবলীকে তুলে ধরেছে, জীবনের আর্তিকে প্রকাশ করেছে, এগিয়ে চলার ধ্বনি তুলেছে।
এইসব গ্রুপ থিয়েটার, তাদের প্রযোজিত শিল্পকর্মের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়াশীল ফ্যাসিস্ত শাসকচক্রের মুখোশ খুলে দিয়েছে বারবার, বিভিন্ন নাট্যকর্মের মাধ্যমে জনগণের অধিকার রক্ষার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গেছে বৈজ্ঞানিক সমাজবাদের লক্ষ্যে অবিচল থেকে, থিয়েটার শিল্পের পাদপীঠ ছেড়ে নেমে এসেছে বাস্তবের কঠিন সংগ্রামের পথে।১ স্বৈরশাসনের সময়ে এইসব গ্রুপ থিয়েটারের একটা অংশ অসম সাহসে বুক টান করে দাঁড়িয়েছিলো। আঘাত তারা কম পায়নি, তবে কর্তব্যকর্ম বাদ দিয়ে চলতি ব্যবস্থার সঙ্গে আপোষ করতে তারা অনীহা দেখিয়েছে। সত্তরের দশক থেকে আধা-ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাস ও জরুরি অবস্থাকালীন অন্ধকার দিনগুলিতে কয়েকটি প্রথম সারির গ্রুপ থিয়েটারের ভূমিকা ছিলো যথেষ্ট বীরত্বপূর্ণ।
সত্তরের দশকে গ্রুপ থিয়েটারের নাটক মানেই গভীর সামাজিক সমস্যা-সংকটের বা রাজনৈতিক চরিত্রের হতে হবে এমন একটা ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছিলো। যে-নাট্য রাজনৈতিক বিতর্ক জাগাবে, আক্রমণাত্বক হবে, শাসকদলের বা শ্রেণীর কঠোর সমালোচনা করবে, নিষ্পেষিত বঞ্চিতের হয়ে, নিপীড়কের বিরুদ্ধে গর্জে উঠবে, সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হবে, সেগুলোই গ্রুপ থিয়েটার হিসাবে পরিচিতি লাভ করে।
সে অবস্থা নব্বইয়ের দশকে আর সেভাবে ছিলো না। নব্বইয়ের দশকে এসে গ্রুপ থিয়েটারগুলো পেশাদারি চিন্তার পথ ধরে আগাতে চায়, কেউ অন্য থিয়েটার নাম নিয়ে রাজনীতি বাদ দিয়ে দর্শদের শুধু বিনোদন বিতরণ করার চেষ্টা চালায়, অনেকে একক অভিনয়কে প্রাধান্য দিতে শুরু করে। কখন একটি দলে একক অভিনয় হয়? যখন দলগত অভিনয় করার সুযোগ ও আদর্শ কোনোটাই থাকে না এবং নাট্যদলটি ব্যক্তির বা একটি পরিবারের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের গ্রুপ থিয়েটারের ইতিহাসে আমর একই ব্যাপার দেখতে পাই। গ্রুপ থিয়েটার সেখানেও নিজেদের ঘোষিত আদর্শকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখেনি। দলগত অভিনয়ের লক্ষ্য পথে স্থির থাকেনি। না যুক্তরাষ্ট্রে, না ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। কারণ তা ছিলো মধ্যবিত্তের ক্ষোভ প্রকাশের থিয়েটার, শ্রমিক- কৃষকশ্রেণীর রাজনীতির সাথে তার কোনো সম্পৃক্ততা ঘটেনি।
যদিও গ্রুপ থিয়েটার গণনাট্য আন্দোলনের আদর্শকে কম-বেশি বহন করে চলেছে তবুও গোষ্ঠীস্বাতন্ত্র্য আর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের পাশাপাশি কয়েকটা উদ্ভট জটিল প্রশ্নের ঘূর্ণাবর্তে পাক খেতে খেতে তারাও শেষ পর্যন্ত এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়েছিলো যে, দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে যথার্থ নাট্য আন্দোলনে সামিল হতে পারছিলো না। মার্কসবাদী রাজনীতি সম্পর্কে দ্বিধাগ্রস্ত মনোভাবই সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিলো গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের পথে। মার্কসীয় রাজনীতিকে তারা যেমন বাতিল করেনি, তেমনি দৃঢ়ভাবে আঁকড়েও ধরেনি। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শোষক-শোষিতের নিপীড়নটা তারা সঠিক নির্দেশ করেছে, তবে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী অন্দোলনে নিজেদের তারা সক্রিয় রাখেনি। মার্কসীয় রাজনীতি গ্রহণ-বর্জনের প্রশ্নে তাদের কোনো জোরালো মতামত ছিলো না। সেই মনোভাবের কারণেই নব্বইয়ের দশকে রাজনীতি বাদ দিয়ে তা মৃতবৎ অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছিলো এবং এখন ‘অন্য থিয়েটার’ আন্দোলন নামে নতুন পথ খোঁজার চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনেও আমরা তাই দেখবো। পশ্চিমবঙ্গের নাট্যধারা এবং নাট্য ব্যক্তিত্বদের সাথে বাংলাদেশের নাট্যচর্চার বেশ মিল আছে। পশ্চিমবঙ্গের নবনাট্য বা গ্রুপ থিয়েটার ধারার আন্দোলন দলীয় অভিনয়ের কথা বললেও সেখানে তারকা খ্যাতিই প্রাধান্য পায়। বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনেও তাই ঘটে, যা আমরা পরে বিস্তারিত আলোচনা করবো। পশ্চিমবঙ্গের নাট্য আন্দোলন সম্পর্কে আমাদের দীর্ঘ আলোচনার আর একটি লক্ষ্য তাই বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের সাথে তার মিল-অমিলগুলো খুঁজে বের করা। শিল্প-সাহিত্যে রাজনীতির প্রশ্নে মধ্যবিত্তরা কী ভূমিকা নিয়ে থাকে তার একটি চিত্রও তুলে ধরা।
রাশিয়ায় বিপ্লবের পর মধ্যবিত্ত প্রোলেটকুল্টরা যে অতিবিপ্লবী ভূমিকা পালন করে, পুরানো সব কিছু বর্জন করতে গিয়ে বুর্জোয়া ক্ষয়িষ্ণু শিল্প-সাহিত্যের ধারা বেছে নেয়, যুক্তরাষ্ট্রে গ্রুপ থিয়েটার-এর মধ্যবিত্তরা যেভাবে তারকা প্রথার বিরোধিতা করতে গিয়ে আবার নিজেরাই তারকা খ্যাতির পেছনে ছুটে বেড়ায়, পশ্চিমবঙ্গে যেমন মধ্যবিত্তদের একদল আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য গণনাট্য ছেড়ে নবনাট্য বেছে নেয়-বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনে তার সবকিছুই লক্ষ্য করা যাবে।
গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের এই যে পূর্বের মতাদর্শ থেকে বের হয়ে এসে অন্য ধারার সন্ধান করা, সেটাই তার চরিত্রকে বুঝতে সাহায্য করে। সেক্ষেত্রে গ্রুপ থিয়েটার সম্পর্কে নৃপেন্দ্র সাহার বক্তব্যটি খুবই মূল্যবান। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘গ্রুপ থিয়েটার, যে থিয়েটার পিপলস্ থিয়েটারকে স্বাধীনভাবে লালন করার জন্য জন্ম নিয়েছিল পিপলস থিয়েটারেরই গর্ভ থেকে সেই গ্রুপ থিয়েটার… যার সংখ্যা খুব কম করে হলেও সহস্রাধিক-তারা কি পৃথক কোনো আন্দোলন করতে পারে? যাকে আমরা গণ আন্দোলন বলি, সেই গণ আন্দোলনের পর্যায়ের কোনো আন্দোলন?
তিনি নিজেই এর উত্তর দিচ্ছেন, ‘সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে যখন কোনো স্বতঃস্ফূর্ত গণবিক্ষোভকে গণ আন্দোলনের পর্যায়ে সংগঠিত করা হয় তখনই তা গণ-আন্দোলনের চরিত্র পায় নচেৎ স্বতঃস্ফূর্ততায় গণবিক্ষোভ কেবল ধূমায়িতই হয়; কার্য-কারণ সূত্রে কিছুতেই তা লক্ষ্যস্থলে উপনীত হতে পারে না-বিরুদ্ধ শক্তির দ্বারা স্বভাবতই তা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির কুক্ষিগত হয়ে যায়, অবদমিত হয়ে পড়ে…।
তিনি আরো লিখছেন, ‘ইতিহাস যখন এই কথাই বলে, তখন স্বাধীন স্বতঃস্ফূর্ততায় গড়ে ওঠা কিছু গ্রুপ থিয়েটার, নেতৃত্ব যেখানে সোচ্চার সঠিক কোনো দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করে না, এক দলের নেতৃত্বের সঙ্গে অপর দলের এক নেতৃত্বের মৈত্রির পরিবর্তে বিরোধই যেখানে বড়, সেখানে সংখ্যায় সহস্রাধিক হয়েও গ্রুপ থিয়েটার পৃথক কোনো আন্দোলন হতে পারে না, গ্রুপ থিয়েটার সেখানে সমাজ কাঠামোর এই উপরিতলে, গণ আন্দোলনের বাতাবরণ রচনা করতে পারে মাত্র, গণ আন্দোলনের সহায়ক শক্তি হতে পারে মাত্র, নিজেরা পৃথক কোনো গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন গড়তে পারে না। এটাই বাস্তব সত্য।
ইতিহাস প্রমাণ করেছে, পশ্চিমবঙ্গের গ্রুপ থিয়েটার তার মতাদর্শের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। সরকার বিরোধী চরিত্রটিও হারিয়ে ফেলেছে। রাজনীতি বাদ দিয়ে তারা এখন শেকড়ের সন্ধানে নতুন নাট্যধারা নির্মাণে ব্যস্ত। রাজনীতি বাদ দিয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে একক চরিত্রের নাটকের অভিনয়, যা দলগত অভিনয়ের জায়গায় ব্যক্তির আত্মপ্রতিষ্ঠার পথকেই সুগম করে দিচ্ছে। গ্রুপ থিয়েটারের অনেক মানুষ এবং অনেক বিষয় এখন ব্যবসায়িক নাটকের সামিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাণিজ্যিক মঞ্চের কুপ্রভাবে আচ্ছন্ন হচ্ছে গ্রুপ থিয়েটারের প্রযোজনা।
সত্তরের দশকে মুনাফার কথা চিন্তা না করে সমাজসচেতন নাটকের মাধ্যমে জনগণকে বিনোদন দেয়াটাই ছিলো গ্রুপ থিয়েটার নাট্যচর্চার প্রধান বিবেচ্য বিষয়। নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যটাই প্রধান হয়ে দাঁড়ালো। গ্রুপ থিয়েটারগুলো এখন টাকার বিনিময়ে কলশো করে বেড়ায়। টাকার পরিমাণ নিয়ে মফস্বলের মানুষের সাথে দরাদরি করে। মফস্বলের মানুষকে নাটক দেখানোর চেয়ে তাদের কাছ থেকে টাকা অর্জনটাকেই বড় করে দেখে।
বাংলাদেশের যে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন তার মূল উৎস পশ্চিমবঙ্গের গ্রুপ থিয়েটারগুলো। পশ্চিমবঙ্গের গ্রুপ থিয়েটার চর্চার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এখানে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন জন্ম নেয়। পশ্চিমবঙ্গের গ্রুপ থিয়েটারের প্রভাব ও প্রেরণাতেই স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বাংলাদেশে যেমন নিয়মিত নাট্যচর্চা শুরু হয়, তেমনি নাট্য মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে নতুন যে চিন্তা-ভাবনা দেখা দেয়, নাটকের যে জঙ্গী রূপটি দেখতে পাই সেক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গের প্রভাব অস্বীকার করা যাবে না। বিভিন্ন জনের লেখনীর মধ্যে এই বক্তব্য সুস্পষ্ট। স্বভাবতই প্রশ্ন দাঁড়াতে পারে পশ্চিমবঙ্গের গ্রুপ থিয়েটার কীভাবে এই প্রভাব বিস্তার করেছিলো, কোন্ ঘটনার প্রেক্ষাপটে এবং কাদের দ্বারা।
সে জঙ্গী রূপটির মাহাত্ম্যটি বা কী। সেসব প্রশ্নের উত্তরে আমরা পরে আসবো। তার আগে যে বিষয়টির ওপর আলোকপাত করা দরকার তা হলো স্বাধীনতা-উত্তর কালে এ ধারার বিকাশ ঘটলো কেন? স্বাধীনতার পূর্বে সে ধরনের কোনো উদ্যোগ দেখতে পাই না কেন? স্বাধীনতার পূর্বে কোনো নাট্য আন্দোলন দানা বাঁধলো না কেন বাংলাদেশে?
সন্দেহ নেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর নাট্যচর্চার ও নাট্যদলগুলির যে জঙ্গী রূপটি দেখি স্বাধীনতার আগের নাট্যচর্চায় কখনো সে জঙ্গী রূপটি ছিলো না। প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায়ের দীর্ঘ আলোচনায় দেখা গেছে, নাটকের জঙ্গী রূপটি খুব বেশিদিনের নয়; বিশ শতকের বিশের দশকে এর শুরু। সরাসরি ঘোষণা দিয়ে মার্কসীয় নাট্যচর্চার শুরুও ঐ সময় থেকে। মার্কসীয় রাজনৈতিক নাটকের সেখানে প্রধানত দুটি রূপ দেখা যায়; একটি তার বিশ্লেষণাত্মক রূপ এবং অপরটি জঙ্গী রূপ। জঙ্গী রূপটির মধ্যে নানা ক্ষোভ প্রকাশিত হয় এবং অনেক সময় তা সত্যিকারের রাজনৈতিক নাটক হয়ে উঠতে পারে না।
পাশাপাশি দেখেছি বিশ শতকের পূর্বে যখন নাট্যচর্চায় ঘোষণা দিয়ে রাজনীতি প্রচারের কথা বলা হয়নি, তখনো নাটকের মধ্য দিয়ে নানাভাবে রাজনৈতিক প্রসঙ্গ এসেছে কিন্তু উচ্চকিতভাবে নয়। বহুজনের নাটকের মধ্যে তখনও সমাজ বিশ্লেষণ ছিলো তবে তা মার্কসীয় প্রেক্ষাপট থেকে নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ব নাটক সম্পর্কে এখানে এ বিষয়টি আগেই বলে নেয়া ভালো যে, সে সময়ের নাট্যচর্চায় নাটকের বিশ্লেষণাত্মক বা জঙ্গী রূপ কোনোটারই দেখা মেলে না। সাতচল্লিশ সালের দেশ বিভাগের পর পশ্চিমবাংলায় যখন মার্কসীয় রাজনৈতিক নাটকের বিশ্লেষণাত্মক ও জঙ্গী রূপ দুটোই ব্যাপকতা লাভ করে, পূর্ব বাংলা বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সে ভঙ্গিটি সম্পূর্ণ অনুপস্থিত ছিলো।
পশ্চিমবঙ্গে যে রাজনৈতিক নাট্যধারার সাথে আমরা পরিচিত হই তার জন্ম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শাসনামলে। ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর তা ব্যাপকতা লাভ করে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হাত থেকে ভারতের স্বাধীনতা লাভ সাধারণ মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা তো পূরণ করতেই পারেনি বরং নতুন শাসকচক্র মানুষের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলো শোষণ, নির্যাতন ও দমননীতি। তার প্রতিবাদেই পশ্চিমবঙ্গে গণনাট্যের নাটকগুলি জন্ম নেয় এবং ঐক্যবদ্ধ হয় সরকারের দমননীতির বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে এবং কেউ কেউ সমাজতন্ত্রের পক্ষে নাট্যান্দোলন গড়ে তোলে। পরবর্তীতে সরকারের দমননীতির বিরুদ্ধেই গড়ে ওঠে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন।
স্মরণ রাখতে হবে, ভারত ও পাকিস্তান একই সাথে স্বাধীনতা লাভ করে। পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করার পর একইভাবে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর চলে শোষণ ও নির্যাতন। নতুন শাসকবর্গ চাপিয়ে দেয় নানারকম দমননীতি, যার প্রধান ফলশ্রুতি পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন। স্বভাবতই এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, পশ্চিমবঙ্গে শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে যে ধরনের নাট্য আন্দোলন গড়ে উঠেছিলো, পূর্ববঙ্গে তা গড়ে উঠলো না কেন?
সাতচল্লিশ সালে বাংলা ভাগের পর দুই বাংলাতেই নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। পশ্চিম বাংলায় বেশি, পূর্ব বাংলায় তুলনামূলক কম। ভাবতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর পশ্চিম বাংলায় গণনাট্যের আদর্শ দ্বিধাবিভক্ত হলেও, গণনাট্য থেকে বহু প্রতিভা চলে গেলেও গণনাট্যের কার্যক্রম বন্ধ হয়নি। পাশাপাশি নাট্য মঞ্চায়নের নতুন দিগন্ত তৈরি হয় গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু পূর্ব বাংলার নাট্যচর্চায় গণনাট্যের বিন্দু পরিমাণ ছায়া ছিলো না। রাজনৈতিক নাট্যধারা যেমন গড়ে উঠতে পারেনি, তেমনি দেখা যায় না নিয়মিত নাট্য প্রযোজনার কোনো আধুনিক মনস্ক ধারা।
স্বাধীনতা পূর্ববর্তী দুই যুগে পূর্ব বাংলায় যে নাটক মঞ্চায়ন কম হয়েছে তা নয় কিন্তু নাটককে কখনও সচেতনভাবে কিংবা সমন্বিতভাবে প্রতিবাদের ভাষা হিসাবে ব্যবহার করা হয়নি। নাটক যদি প্রতিবাদের ভাষা’ হয়, তাহলে সাতচল্লিশের দেশ বিভাগের পর পূর্ববঙ্গে সরকার বিরোধী কোনো নাট্য আন্দোলন গড়ে না উঠবার কারণটি কী ছিলো? দেশভাগের পর থেকেই একের পর এক সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দাবানল জ্বলে উঠেছে, নাট্য দলগুলো সেসব রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দেয়নি কেন?
পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করেছিলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যশক্তির হাত থেকে, বাংলাদেশও স্বাধীনতা লাভ করে পাকিস্তানের বন্ধন থেকে। দুই স্বাধীনতার মধ্যে পার্থক্য কোথায় যে এক স্বাধীনতার পর • নাট্য আন্দোলন জন্ম নিলেও, অন্য স্বাধীনতার পর নাট্য আন্দোলন জন্ম নিতে পারলো না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে নাট্য আন্দোলন গড়ে উঠবার বাধাটা কোথায় ছিলো, স্বাধীনতা পরবর্তী নাট্য আন্দোলনের উৎস খুঁজতে গেলে সেটাও বুঝে নিতে হবে।
বিষয়টি নিয়ে বেশ কিছু নাট্য ব্যক্তিত্ব ভাবনা চিন্তা করেছেন। দু-চারজন নিজের মতো করে এ ব্যাপারে মতামতও দিয়েছেন। সেগুলো আমরা এখানে বিচার বিশ্লেষণ করে দেখবো সে চিন্তার সাথে একমত হওয়া যায় কি না। যাঁরা এ ব্যাপারে মতামত দিয়েছেন তাঁরা সকলেই বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনের বিশেষ ব্যক্তিত্ব হিসাবে চিহ্নিত। বাংলাদেশের প্রথিতযশা নাট্যকার হিসাবে স্বীকৃত সৈয়দ শামসুল হক স্বাধীনতার পূর্বে কোনো বৃহত্তর নাট্যপ্রচেষ্টা গড়ে না উঠবার কারণ সম্পর্কে বলেন, ‘পরাধীন জাতির নাটক হয় না; স্বাধীনতা নাম মাত্র হলেও না; যে জাতি রক্তের ভেতরে স্বাধীনতা অনুভব করতে পারে না সে জাতি হয়তো সাহিত্যে, চিত্রকলায়, ভাস্কর্যে বা সঙ্গীতে বড় মাপের কিছু সৃষ্টি করতে পারে, নাটক তার কাছে অধরাই থেকে যায়।’
শামসুল হক মনে। করেন শিল্পীর মত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে তার পক্ষে মহৎ কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। স্বাধীনতার পূর্বে শিল্পীর কথা বলার স্বাধীনতা ছিলো না বলেই নাটক বেড়ে উঠতে পারেনি। নাট্যকার, নাট্য পরিচালক ও নাট্য-সংগঠক আবদুল্লাহ আল-মামুনও একই বক্তব্য রেখেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, ‘বাংলাদেশে গ্রুপ থিয়েটার চর্চার জন্য আমাদের উনিশশো একাত্তর সাল পর্যন্ত কালক্ষেপ করতে হয়েছে।
স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের ফলেই বহু বছর আগে দেখা নাট্য স্বপ্ন বাস্তবরূপ লাভ করেছে। এ থেকে তাৎক্ষণিক যে সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলো প্রকৃত নাট্যচর্চার প্রথম এবং প্রধান শর্ত হচ্ছে মুক্ত পরিবেশ এবং স্বাধীন মঞ্চ। শৃঙ্খলিত পরাধীন জাতির আত্মায়-শরীরে নাটক তার নীড় রচনা করতে পারে না। নাট্য পরিচালক, অভিনেতা ও নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সভাপতি আলী যাকেরও তদ্রুপ বক্তব্য রাখেন। তার ভাষায়, ‘আজকের নাট্য দর্শক এবং নাট্যকর্মী পরাধীন দেশে ছিলো নিজ বাসভূমে পরবাসী। প্রতি মুহূর্তেই তাকে বলা হত রাষ্ট্রদ্রোহী, বেঈমান,দুষ্কৃতিকারী। স্বাধীনতা তাকে দিয়েছে বৃহত্তর শিল্পবোধ যে বোধ-এর বাস্তবায়ন আমরা দেখি আজকের মঞ্চ প্রক্রিয়ায়।” যাকের শামসুল হক ও মামুনের মতোই বলতে চান, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বাধীনতা ছিলো না বলেই সেখানে নাটক গড়ে উঠতে পারেনি। একই বক্তব্য রাখেন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ।
তিনি বলেন, ‘রক্তঝরানো মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের সমাজে যে বিপ্লবী জাগরণ সংগঠিত হয় তারই সোনালী ফসল হচ্ছে এই নাটক আজকের নাট্যচর্চা। অর্থাৎ স্বাধীন জাতি হিসাবে বাংলাদেশের মানুষ যখন থেকে আত্মপ্রকাশ করলো ঠিক তখন থেকেই নাটকের যাত্রা শুরু। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, নাট্যকার ও নাট্য-নিদের্শক জিয়া হায়দারের বক্তব্যও তাই। তিনি বলছেন, ‘ঔপনিবশিকতায় আবদ্ধ কোনো জাতি যেমন স্বাধীনভাবে কোনো কিছু নির্বিঘ্নে করতে সক্ষম হয়না, এবং ফলে অ-সৃজনশীল হয়ে থাকে, তেমনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে ঘটেছিলো। স্বাধীনতা আমাদের নাট্যকারদের রচনায় যেমন উৎসাহ ও সুযোগ এনে দিয়েছে, তেমনি অবাধ মঞ্চ নিরীক্ষাতেও।’
নাট্য সমালোচক মফিদুল হকের বক্তব্য ঠিক একই রকম। তিনি বলেন, স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বাংলাদেশে পাকিস্তানি চেতনা ও ভাবাদর্শ দ্বারা যে শিল্পধারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সেটা নাটক। বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমলে পূর্ববঙ্গে যে নাট্যচর্চা ছিলো তা কোনোভাবে কলকাতা-কেন্দ্রিক থিয়েটারের সঙ্গে তুলনীয় না হলেও সেই ধারা নিজস্বভাবে যথেষ্ট বলবান ও সক্রিয় ছিল। তিনি আরো লিখছেন, নীলদর্পণের প্রথম অভিনয় ঘটে ঢাকা শহরে, কিংবা উনিশ শতকে বাংলা নাট্যপালার প্রকাশনায় ঢাকার ছিলো বিশিষ্ট ভূমিকা ইত্যাদি কেবল ইতিহাসের নীরস তথ্য নয়, সামাজিক নাট্য- সক্রিয়তারও ইঙ্গিতবহ।
তিনিও মনে করেন, পাকিস্তানি আমলে তা সম্ভব হয়নি কারণ, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের অভাবে নাটকের অনুকূল পরিবেশ এতটাই বৈরী ছিলো যে ভাষা আন্দোলনের পটভূমিকায় রচিত ও অভিনীত মুনীর চৌধুরীর কবর দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পর্যন্ত খুব বেশি অভিনীত হতে পারেনি। তিনি মন্তব্য করছেন, মুনীর চৌধুরী স্বয়ং নাটক-অন্তঃ প্রাণ হলেও অনুবাদেই খুঁজেছেন নিভৃতি, অথবা বড় জোর ঐতিহাসিক রূপক নাটক রচনায় গণ্ডিবদ্ধ থেকেছেন। কেন তা করেছেন? মফিদুল হকের ভাষায়, ‘সামরিক শাসনাধীন নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সমাজবাস্তবতার সরাসরি রূপায়ণ ছিল অসম্ভব। সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সঙ্গে আরেক ভিন্নমাত্রার বাস্তবতা পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছিল। দেশভাগের পর থেকে, সাম্প্রদায়িক পীড়নের কারণে কখনও ঢেউয়ের মতো, কখনও-বা অন্তঃসলিলাভাবে ক্রমাগত যে দেশত্যাগ ঘটেছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজনের তা নাট্যচর্চাকারীর সংখ্যাহাস ঘটিয়েছিল ব্যাপকভাবে।
সৈয়দ শামসুল হক, আলী যাকের, আবদুল্লাহ আল-মামুন, জিয়া হায়দার ও মফিদুল হক-যাঁরা ব্রিটিশের হাত থেকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভকে স্বাধীনতা মনে করছেন না এবং পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তানকে পরাধীন জাতি হিসাবেই দেখেছেন এবং সেই সাথে বিশ্বাস করছেন পরাধীন জাতির নাটক হয় না, তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মনে করছেন প্রকৃত স্বাধীনতা। যার অর্থ, তাঁদের ধারণায় পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার ছিলো না, বাংলাদেশে মানুষ সে অধিকার পেয়েছে।
উল্লিখিত ব্যক্তিদের এই বক্তব্যই বা কতটুকু সত্য? বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের কিছু দিন পরেই সরকার-বিরোধীদের ধরপাকড় করা বা তাদের ওপর অত্যাচার চালাবার জন্য রক্ষীবাহিনী নামে একটি বাহিনী গঠন করা হয়, দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়, তিন বছরের মাথায় শাসকদল একটিমাত্র রাজনৈতিক দল ছাড়া বাকি দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, চারটি দৈনিক ছাড়া দেশে আর সকল পত্রিকা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়-এই অবস্থাকে কি মুক্তচিন্তার অধিকার বা কথা বলার স্বাধীনতা হিসাবে ধরে নেয়া যায়?
সেই সময়কেই উল্লিখিত ব্যক্তিরা কেন কথা বলার মুক্ত পরিবেশ হিসাবে দেখেছেন সেটা বিতর্কিত থেকে যায়। কিছু পরেই আমরা এই বিতর্কের জবাব পেয়ে যাবো। সে প্রসঙ্গ এখন বাদ রেখে এই আলোচনার সুবিধার্থে মফিদুল হক বা অন্যান্যরা পাকিস্তানি আমলে নাটক না হবার যে যুক্তি দিয়েছেন সেটা কতোটা গ্রহণযোগ্য পর্যালোচনা করে দেখা যাক।
বাংলাদেশের প্রধান প্রধান নাট্যকার, নাট্য পরিচালক, নাট্য অভিনেতা ও নাট্য সংগঠকদের বক্তব্য হচ্ছে, স্বাধীনতার আগে নাটক হয়নি তার কারণ সরকারি বাধা ছিলো; শিল্প চর্চার কোনো পরিবেশ ছিলো না। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে সরকারিভাবে নাটককে বাধা দানের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য তথ্য আমাদের হাতে নেই। বিপরীতভাবে এটাও বলা যায়, কোনো নাট্য আন্দোলন গড়ে ওঠার পরেই তো সরকারি বাধা দানের প্রশ্ন আসে। স্বাধীনতার পূর্বে আমরা কোনো নাট্য আন্দোলনই গড়ে উঠতে দেখি না, বাধা দান তো পরের প্রশ্ন। সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতার পূর্বে শাসকচক্রের বাধার কারণে নাটক সঠিক পথে আগাতে পারেনি বক্তব্যটির পক্ষে আমরা কোনো যুক্তি খুঁজে পাই না।
উল্লিখিত নাট্য ব্যক্তিত্বদের দ্বিতীয় বক্তব্য হচ্ছে, পরাধীন দেশে স্বাধীন ভাবে চিন্তা করবার উপযুক্ত পরিবেশ ছিলো না, নাট্য আন্দোলন শুরুর জন্য দরকার মুক্ত কিংবা অনুকুল পরিবেশ। বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে বক্তব্যটি সত্যিই যুক্তিগ্রাহ্য কি না কিংবা উল্লিখিতদের বক্তব্যের মধ্যে কোনো সারবত্তা আছে কি না।
পৃথিবীর নাটকের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? পিসকাটর ও ব্রেন্টের রাজনৈতিক নাটকের পথযাত্রা যে সময়কালে কিংবা যুক্তরাষ্ট্র বা চীনে পিপলস থিয়েটারের উদ্ভব যে বৈরী পরিবেশে, ইত্যকার নাট্য ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে পরাধীন মানুষের নাটক হয় না এই বক্তব্য কি আদৌ মেনে নেয়া যায়? রাজনীতি, রাজনৈতিক প্রতিবাদ যেমন বৈরী পরিবেশে জন্ম নেয়, তেমনি নাট্য আন্দোলনের ইতিহাস। পরাধীন ভারতেই গণনাট্য সংঘের জন্ম।
গণনাট্যের রাজনীতি ছিলো তৎকালীন বৈরী পরিবেশের বিরুদ্ধেই। বঙ্গদেশে নীলদর্পণ নাটকের অভিনয় তার আরো একটি বড় উদাহরণ। পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ শাসনেই সে নাটক মুক্তি পেয়েছিলো। নীলদর্পণ নাটককে বলা হয় ভারতবর্ষের প্রথম রাজনৈতিক নাটক, গণনাট্যের পথিকৃত।জনতার নাটক ছিলো নীলদর্পণ। বিদেশিদের শোষণনীতির বিরুদ্ধে দেশীয় কৃষককূলের রক্তচক্ষু প্রতিবাদ ছিলো নীলদর্পণ। বিপ্লবের আগে ফরাসী দেশের বমার্শের মতো নাট্যকারকে দেখেছি, কীভাবে শাসকদের ক্রোধকে উপেক্ষা করে নাটক লিখেছেন এবং সরকারের কাছ নাটক মঞ্চায়নের অনুমতি আদায় করছেন। নাট্যকারের হাতকে কেউ বেঁধে রাখে না যে তিনি লিখতে চাইলে কেউ বাধা দেবেন।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিকূল পরিবেশেই নাটক জন্ম নিয়েছিলো, জার্মানীতেও তাই। ভারতবর্ষ তথা পশ্চিম বাংলার যে বাংলা রাজনৈতিক নাটক তা সম্পূর্ণ প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে জন্ম নেয় এবং সে রাজনৈতিক নাটক সবচেয়ে প্রভাব বিস্তার করেছিলো যখন সবচেয়ে বেশি সরকারি আগ্রাসী আক্রমণ চলেছিলো নাট্যদলগুলোর ওপর। পূর্বেই আমরা লক্ষ্য করেছি গণনাট্য সংঘ ভারতের স্বাধীনতার পূর্বে যেমন ব্রিটিশ ও কংগ্রেসীদের আক্রমণের শিকার হয়, তেমনি স্বাধীন ভারতেও গণনাট্যর ওপর সরকারের বিধিনিষেধের খড়গ নেমে এসেছিলো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে যেসব গণনাট্য কর্মী ও সদস্য সমাজবিরোধী গুণ্ডা কিংবা পুলিশের হাতে নিহত হয়েছেন তাঁরা হলেন দুলাল অধিকারী, সরল রায়, অনিলপাত্র, অধীর চক্রবর্তী, শংকর দত্ত, কল্যাণ ব্যানার্জী, অধ্যাপক সত্যেন্দ্র চক্রবর্তী, প্রবীর দত্ত প্রমুখ।
পশ্চিমবঙ্গে নাটকের ওপর এ ধরনের আক্রমণের বহু ঘটনা ঘটে। বাষট্টির নির্বাচনী নাটক ট্রেন মঞ্চায়নের কারণে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই সন্ধ্যার পর মিনার্ভা থিয়েটার আক্রান্ত হয়। বিজয় মিছিলের নাম করে একদল নেশাগ্রস্ত গুণ্ডা বোমা আর ইট ছুড়তে থাকে জীর্ণ প্রাচীরের গায়ে। ‘লিটল থিয়েটার ও আমি’ প্রবন্ধে উৎপল দত্ত ঐ বর্ণনা দিচ্ছেন। কী প্রতিকূল পরিবেশে নাটক করেছেন তারই প্রমাণ সেটা।
তিনি লিখেছেন, ‘সি-আই-টি পদ্মপুকুরে অভিনয় শুরু হওয়ার দশ মিনিটের মধ্যেই দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড। ইট ও বোমা ছুঁড়তে ছুঁড়তে একদল কুখ্যাত গুণ্ডা এগুতে লাগলো মঞ্চের দিকে। কমরেড মনিকুন্তলা সেন বসে ছিলেন মঞ্চের কাছে, ইটের ঘায়ে মাথা থেকে রক্ত ঝরতে লাগল।’সেই একই রচনায় ভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করেছেন উৎপল দত্ত, ‘পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ অপেক্ষা করছে পর্দা ওঠার। কাছেই বীডন স্কোয়ারে কংগ্রেসি জনসভায় নেপাল রায় সরাসরি ডাক দিলেন-এ পাড়ার লজ্জা যে অঙ্গার নাটক এখনো চলছে। সভা থেকে মিছিল বেরুলো মারণাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে এবং সোজা এসে ইটের ঘায়ে লবির সব কাচ ভেঙে ফেললো।
যখন উৎপল দত্ত কল্লোল নাটক মঞ্চস্থ করেন কী ধরনের বিরুদ্ধতার তাকে সম্মুখীন হতে হয়েছিলো পূর্ব অধ্যায়ে সে কথা উল্লিখিত হয়েছে। সবচেয়ে প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেই উৎপল দত্তের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নাটক সৃষ্টি হয়েছিলো। যে নাটকের বক্তব্য ছিলো সরাসরি সরকারি দল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার প্রশ্নে কংগ্রেস কী ধরনের আপোষের পথে এগিয়েছিলো তারই জ্বলন্ত চিত্র ছিলো সে নাটক। কোনো আক্রমণের ভয়ে উৎপল দত্ত পিছু হটেননি। গোপাল দাস লিখেছেন সে প্রসঙ্গে, ‘মনে আছে, ‘মিউটিনি অব বিডন স্ট্রীট’ করতে পার্টির ডাকে প্রতিদিন ছুটে গেছি মিনার্ভা রক্ষা করতে। পার্টির ডাক, কল্লোলকে চোখের মণির মতো বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
রোজ সন্ধ্যায় এক ভয় এক আশংকা, ‘ঐ আসছে চীৎপুর থেকে গুণ্ডারা’, ‘ঐ আসছে ট্রাক বোঝাই করে’। তার মধ্যেই এ নাটক মঞ্চায়িত হয়েছে এক নাগাড়ে মাসের পর মাস। জনতাই, শ্রমিকশ্রেণীর পার্টিই নাটককে বাঁচিয়েছে আক্রমণের হাত থেকে। বাইরে তখন হাজার হাজার জনতা কল্লোলের পাহারায়।
সংস্কৃতির ওপর ভয়ংকর আক্রমণ এলে, সরকারি প্রশাসনযন্ত্র মারমুখী হয়ে উঠলে সাময়িকভাবে পিছু হটতে পারে শিল্প-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, কিন্তু থেমে থাকে না। বিভিন্ন দেশের শিল্প সাহিত্যের ইতিহাস সে কথাই প্রমাণ করে। বৈরী পরিবেশের মধ্যেই সাহসের জন্ম, প্রতিবাদের জন্ম। গ্রীক নাট্যকার ইউরিপিডিসকে মিডিয়া নাটক লেখার জন্য দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো।
শেকস্পিয়ার, ইবসেন, মলিয়ের প্রত্যেককেই বিরুদ্ধ পরিবেশে দাঁড়িয়ে নাটক করতে হয়েছিলো। অনুকূল পরিবেশের জন্য তাঁরা বসে থাকেননি। যারা ভীতু, যারা সুবিধাবাদী কিংবা সুযোগ সন্ধানী, তারা সবকিছুর জন্যই অনুকূল পরিবেশ খোঁজে, মুক্ত পরিবেশ খোঁজে। সত্যিকারের যাঁরা দেশপ্রেমিক, প্রতিবাদী-বিরুদ্ধস্রোত তাঁদের কণ্ঠকে রোধ করতে পারে না।
যখনই অত্যাচার, সন্ত্রাস ও নিপীড়ন নেমে আসে, কিছু নাট্যকার তখনই বিপ্লবী নাটক লিখবার মতো উদ্দীপনা ও বিষয়বস্তু খুঁজে পান। ইতিহাসে দেখা যায়, বিরুদ্ধ পরিবেশে দাঁড়িয়েই বিখ্যাত সব সাহিত্য জন্ম নিয়েছে; বহু সময় বহু মহৎ শিল্পকলার সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি এ কথাও মিথ্যা নয় যে, সংকটকালে স্বভাবতই সন্ত্রস্ত কিছু শিল্পী প্রতিবাদী কিছু সৃষ্টির কথা বাদ দিয়ে দল ছেড়ে চলে যান কিংবা নিশ্চুপ হয়ে পড়েন; যা পশ্চিমবঙ্গের গণনাট্যের বেলায় দেখা গেছে।
সাহসী মানুষরা কিংবা দায়বদ্ধ শিল্পীরা সব দেশেই নিপীড়নের মধ্যেই তাঁদের শিল্পকর্ম বিকশিত করে তোলেন। ইংরেজ অধিকৃত আয়ারল্যান্ডেই বস্তুত সে দেশের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্য আন্দোলনের জন্ম। ইয়েটস, সিঙ্গ প্রমুখ নাট্যকাররা রূপক বা সাংকেতিক নাটকের মাধ্যমে পরাধীন আয়ারল্যাণ্ডের সামাজিক ও রাজনৈতিক অভিলাষকেই ব্যক্ত করেছেন।
কালো আফ্রিকার স্বাধীনতা প্রাপ্তি প্রধানত ষাটের-সত্তরের দশকের ঘটনা, আর পঞ্চাশের দশক থেকেই সেখানে নাট্য আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গরা নিজেদেরকে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এমনকি বৌদ্ধিক বা চেতনাগতভাবে পরাধীন ভেবে থাকে নিজ দেশেই। তাদের নাটকে যে বিদ্রোহ দেখা দেয় তার উদাহরণ বিশ্বসাহিত্যে কমই আছে। চীনে যখন জাপানী আক্রমণ শুরু হয় তখন দেশপ্রেমমূলক নাটক মঞ্চায়নের মাঝ দিয়েই গণপ্রতিরোধ গড়ে ওঠে। ভিয়েতনামে মুক্তিযুদ্ধের সময় তো আগ্নেয়াস্ত্র কাঁধে ঝুলিয়েই নাটক অভিনীত হয়েছে গ্রামে, গঞ্জে, জনপদে। নিরঙ্কুশ সুখের ভেতর থেকে কেউ কোনো মহৎ শিল্প কর্ম রচনা করেছেন এমনটি আজ অবধি শোনা যায়নি। সমাজে সাধারণ মানুষ যদি যন্ত্রণা ও নিপীড়নের মধ্যে থাকেন তাহলে শিল্পীদের আরো যন্ত্রণার মধ্যে থাকতে হয়।
প্রতিবাদের প্রশ্ন তো তখনই আসে যখন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়তে হবে। টয়েনবি লিখেছিলেন, সভ্যতার সৃষ্টি প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করতে গিয়ে। ব্রেশন্টের গ্যালিলিও নাটকের সংলাপ ছিলো, ‘দুর্ভাগা সেই দেশ যার বীর সন্তান দরকার’। যখন দেশ দুর্ভাগা, পরাধীন বিশৃঙ্খলার শিকার তখনই বীরকে আসতে হয়, সেই বিশৃঙ্খলতাকে কাটিয়ে তোলার জন্য। যাঁরা প্রতিবাদী নন, যাঁরা সৌখিনভাবে সবকিছু করতে চান তাঁরা মুক্ত পরিবেশ খোঁজেন।
প্রগতিশীল শিল্পকর্মীরা সব দেশে, সব সময়ে প্রতিকূল অবস্থার ভেতর দিয়েই কাজ করে গেছেন। সেটাই ইতিহাসের বাস্তবতা। যুদ্ধ ঘোষণা বা আন্দোলন বিরুদ্ধ পরিবেশেই ঘটে, মুক্ত পরিবেশে নয়। বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন তো একটি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিলো, যে আন্দোলন তৈরি হয়েছিলো জেল-জুলুম, পুলিশের লাঠি, টিয়ার গ্যাস ও বুলেটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। সর্বত্র একই ইতিহাস। মানুষের রাজনৈতিক চেতনা তৈরি হয় বিরুদ্ধ পরিবেশে দাঁড়িয়েই। পৃথিবীর ইতিহাস সে কথাই বলে। মার্কসের ভাষায়, বিরুদ্ধ মতবাদ না আসলে নতুন মতবাদ জন্ম নেয় না। বিরুদ্ধ পরিবেশ না থাকলে প্রতিবাদী চেতনাও জন্ম নেয় না। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের যে সংগ্রাম সে তো প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধেই। ঠিক একইভাবে প্রতিকূল পরিবেশকে অনুকূলে আনার জন্যেই শিল্পীদের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম করতে হয়।
রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লবের আগে থেকেই গোর্কি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে বিপ্লবের কাজ জড়িয়ে ফেলেছিলেন। সেই সময় গোর্কির নাটক থেকে উপার্জিত অর্থের সিংহভাগই যেতো বলশেভিক পার্টির ফাণ্ডে। সেজন্য গোর্কিকে একাধিকবার জারের কারাগারে নিক্ষিপ্ত হতে হয়েছে। জনগণের প্রচণ্ড বিক্ষোভের ফলে জার সরকার প্রতিবারই তাঁকে কারামুক্ত করেছে। যাঁরা ইতিহাস পড়েছেন এবং ইতিহাসের গতিধারাকে যাঁরা বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ করতে সক্ষম, তাঁরা কখনও নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে থাকতে পারেন না। একজনের নিষ্ক্রিয়তা যেমন একশজনের ভেতরে সংক্রামিত হতে পারে, তেমনি একেজনের সক্রিয় ভূমিকা একশজনকে সক্রিয় করে। প্রতিবাদী চেতনা প্রকৃত পক্ষে সমাজ চেতনারই সম্প্রসারিত রূপ।
নাটক হয় আসলে পরাধীন মানুষেরই। পরাধীন মানুষই তো নাটকের মধ্য দিয়ে তার স্বাধীনতার স্পৃহা ঘোষণা করবে। মানুষ যেখানে মুক্ত, নাট্যকার যে সমাজে সুখী সেখানে সত্যিকারের নাটক জন্ম নিতে পারে না। সুখী সমাজে নাট্যকার কেন নাটক লিখবেন, বিশেষ করে প্রতিবাদী নাটক? মানুষের প্রতিবাদ ঘোষিত হয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে, শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে। শোষণ-বঞ্চনা না থাকলে, মানুষের সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলে, তার প্রতিবাদ ঘোষিত হবে কেন, কিসের জন্য? প্রতিবাদী চেতনার সঙ্গে তাই সামাজিক বাস্তবতার বিষয়টি অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। শান্তিতে কখনও কোথাও ভালো শিল্পকর্ম সৃষ্টি হয়নি।
বিরুদ্ধ পরিবেশে দাঁড়িয়ে গ্যালিলিও পিছু হটেছিলেন কিন্তু তিনি তাঁর গবেষণা বা কাজ এবং তাঁর প্রচার শুরু করেছিলেন বিরুদ্ধ পরিবেশেই। বিরুদ্ধ পরিবেশের মধ্যে লড়াই আরম্ভ করে তিনি চার্চের আগ্রাসী নীতির মুখে দাঁড়িয়ে পিছু হটতে বাধ্য হলেন কিন্তু থেমে পড়েননি। বন্দী জীবনেই লিখেছিলেন ডিসকোর্স। যাঁরা মুক্ত পরিবেশের প্রশ্ন তুলছেন সেটা কেন তুলছেন, ঠিক সে ব্যাপারে শাহরিয়ার কবির লিখছেন, ‘আমাদের দেশের কিন্তু শিল্পকর্মী আছেন যাঁরা তাঁদের শিল্পের প্রয়োজনে, সমাজের প্রয়োজনে এবং জনগণের প্রয়োজনে সামান্যতম স্বার্থ ত্যাগ করতে পারেন না, তার ওপর নিজেদের অক্ষমতাকে চাপিয়ে দেন সমাজের ওপর।
তাঁরা মনে করেন একটি প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের সমালোচনা তখনই করা যায় যখন সেই সরকার তাঁদের নিরাপত্তার আশ্বাস দেবেন। নইলে তাঁরা চুপ করে থাকবেন। আসলে এটা হচ্ছে মধবিত্ত সুবিধাবাদী মানসিকতা। এই মধ্যবিত্ত মানসিকতার কারণেই স্বাধীনতা পূর্ব বাংলাদেশে আমরা সাহসী কোনো নাট্যকার বা নাট্যদলের দেখা পাই না। বাংলাদেশের নাটকের গতি-প্রকৃতি অনুধাবন করতে এই সত্যটিও আমাদের মনে রাখতে হবে।
মুনীর চৌধুরী সম্পর্কে মফিদুল হক যে কথা বলছেন, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের অভাবে তিনি সমাজবাস্তবতা তুলে ধরতে পারেননি কিংবা সামরিক শাসনাধীন নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে তিনি নাটকে সরাসরি কিছু বলতে পারেননি; মফিদুল হকের এই বক্তব্য আদৌ সত্য নয়। মুনীর চৌধুরী ছিলেন সুবিধাভোগী মধ্যবিত্ত, তিনি নিজেই সুযোগ-সুবিধা লাভের জন্য শাসকশ্রেণীর সাথে আপোষ করে বসেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম দিকে মুনীর চৌধুরী সাম্যবাদী রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন এবং তখন কিছু কিছু প্রগতিশীল ভূমিকা রেখেছেন। যুক্তিবাদী হিসাবে তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামিকেই আঘাত করতেন প্রধানত।
কমিউনিস্টদের বাস্তব রাজনীতির সঙ্গে মুনীর চৌধুরীর সম্পর্কের সূত্রটি স্থাপিত হয়েছিলো এই গোঁড়ামি-বিরোধীতার জন্যই। স্মরণ রাখতে হবে, পাকিস্তানের কারাগারের মধ্যেই মুনীর চৌধুরী কবর নাটক লিখেছিলেন এবং কারাগারের মধ্যেই তার প্রথম মঞ্চায়ন হয়েছিলো। বিরুদ্ধ পরিবেশে দাঁড়িয়েই তিনি সেদিন সেইটুকু প্রতিবাদী চেতনা লাভ করেছিলেন। তিপান্ন সালে মুনীর চৌধুরী জেলে ছিলেন। সে-বছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে একটি নাটক মঞ্চায়ন করার উদ্যোগ নেয় ঢাকা কারাগারের দু-নম্বর খাঁচায় আটক কমিউনিস্ট বন্দীরা। তাঁরা অনুরোধ জানিয়েছিলেন মুনীর চৌধুরীকে একটি নাটক লিখে দিতে। রণেশ দাশগুপ্তও তখন কারাগারে।
রণেশ দাশগুপ্তের সাথে মুনীর চৌধুরীর ব্যক্তিগত পরিচয় ছিলো বলে তিনিই মুনীর চৌধুরীকে ভাষা আন্দোলনের ওপর নাটক লিখে দেবার জন্য গোপনে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। মুনীর চৌধুরী কবর নাটকটি লিখে দিলেন, যা ছিলো মূলত আরউইন শ রচিত বেরি দ্য ডেড নাটকের অনুকরণ। রণেশ দাশগুপ্ত পরে মন্তব্য করেছিলেন, মুনীর চৌধুরী রাজনীতি সচেতন হলে নাটকটির শেষ অন্যরকম হতো। মুনীর চৌধুরী কখনই বিপ্লবী নাট্যকার ছিলেন না। নাট্য রচনায় কোনো প্রগতিশীল ঘরানার লোক তাঁকে বলা যাবে না। সংলাপ সাজাবার ক্ষমতা ছিলো মারাত্মক কিন্তু তিনি
লিখেছেন প্রধানত কৌতুকরসাত্মক্রান্ত এবং ব্যঙ্গধর্মী নাটক। প্রথম থেকেই লঘুতা, চাপল্য ও উদ্ভটের প্রতি ঝোঁক নির্ভুলভাবে লক্ষ্যণীয়। ১০২ রক্তাক্ত প্রান্তর বাদ দিলে বাকি নাটকগুলোর কোনোটাই খুব আলোচনার দাবি রাখে না। কবর নাটকটিও মান সম্পন্ন নাটক নয়; তবে নাটকটির গুরুত্ব এই যে, এর সাথে ভাষা আন্দোলনের আবেগ জড়িত।
নাটকটি তিনি লিখেছিলেন কারাগারে বসে এবং খুবই অল্প সময়ে, সে কারণে এটি একটি রাজনৈতিক ইতিহাসের অংশ। মুনীর চৌধুরীর সমসাময়িক আসকার ইবনে শাইখ ছিলেন বরং অনেকবেশি অগ্রণী নাট্যকার। শাইখ খুব স্থূলভাবে হলেও শাসক-শাসিতের সম্পর্ক, শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার বিষয়গুলিকে নাটক রচনায় যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলেন। মুনীর চৌধুরী নাট্য নির্দেশক ও অভিনেতা হিসাবে অনেক বেশি সফল ছিলেন, শিক্ষক হিসাবেও তিনি ছাত্রদের খুব প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। কিন্তু মধ্যবিত্ত সুবিধাভোগী হিসাবে তিনি ধীরে ধীরে শাসকশ্রেণীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
মুনীর চৌধুরী সম্পর্কে স্মৃতি কথায় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখছেন, ‘পরে আরো পরে মুনীর চৌধুরীকে দেখেছি বদলে যাচ্ছেন। জীবন্ত মানুষটি দেখেছি ক্রমশঃ জীবনের প্রতি আসক্ত মানুষে পরিণত হচ্ছেন।’১০৩ তিনি লিখছেন, ‘মুনীর চৌধুরীর পরিবর্তনটা ধীরে ধীরে হয়েছে’। ১০৪ রণেশ দাশগুপ্ত লিখছেন, ‘পরবর্তীকালে তিনি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন রাজনীতিবর্জিত ভাবে শিক্ষক জীবনকে চূড়ান্ত গুরুত্ব এবং পরিপূর্ণ অনুগত্য দিয়ে, তার জন্যে আংশিকভাবে দায়ী আমরা ও তাঁর সাথীরা যারা প্রধানত প্রত্যক্ষ রাজনীতির সাথে জড়িত থেকেছি। এ ব্যাপারটা ঘটবার আগে সমস্ত মিলিয়ে মুনীর চৌধুরী সাহিত্য আর রাজনীতির মধ্যে যে সম্মেলন সাধন করেছিলেন, তার মধ্যে থেকে গিয়েছিলো অনির্দেশ্যতা। তিনি নিজেও একটা পরিষ্কার ফয়সালা করে নেন নি। আমরা বিশেষ করে যারা তাঁর সাহিত্যিক সতীর্থ ছিলাম তারাও ফয়সালা করে দেই নি। ‘
রণেশ দাশগুপ্ত একটি ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন, একটা বিকালে আমরা তিন চার জন লাল ঝাণ্ডা নিয়ে ঢাকার একটি জনাকীর্ণ মহল্লার দিকে যাত্রা করলাম। মুনীর চৌধুরীও ছিলো। লাল ঝাণ্ডাটা মাঝে মধ্যে হাত বদল হচ্ছিলো। মাঝখানে এক সময় হঠাৎ সে আমার হাতে নিশানটা তুলে দিয়ে একটা রিক্সায় চেপে বসে বললো ‘একেবারে মনে ছিলো না, রেডিওতে আমার একটা প্রোগ্রাম আছে’।
মধ্যবিত্ত শিক্ষিতদের একটি বিশেষ আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে রেডিও বা অন্যান্য প্রচার মাধ্যমগুলোতে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা। সরকারি এসকল মাধ্যমে নিশ্চয় বিপ্লবী কোনো অনুষ্ঠান করার সুযোগ ছিলো না। তা সত্ত্বেও সে দিনগুলোতে মুনীর চৌধুরী তাতেই আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। রণেশ দাশগুপ্ত লিখছেন, ‘মুনীর চৌধুরীর কাছে থেকেও চেয়েছিলাম অন্য কিছু নয়, সাহিত্য নয়, অধ্যাপনা নয়, শুধু রাজনৈতিক সংগ্রাম। এখানেই আমাদের ভুল হয়েছিলো, তাঁরও ভুল হয়েছিলো। মুনীর চৌধুরী তখন কিছুটা অধ্যাপনার দিকে ঝুঁকে পড়েছেন, তাঁর কাছে সাহিত্য বোধহয় বৈপ্লবিক রাজনীতি থেকে একচুল আলগা হয়ে গিয়েছে। একচুল পার্থক্যই সে সময়ে পারস্পরিক চিন্তার ব্যবধানের বিস্ফোরণ ঘটাবার পক্ষে যথেষ্ট ছিলো।’
মুনীর চৌধুরী সম্পর্কে রণেশ দাশগুপ্তের চূড়ান্ত মন্তব্য বা উপসংহার হলো, ‘কমিউনিস্ট মুনীর চৌধুরী প্রত্যক্ষ রাজনীতি করার জন্য বেরিয়ে আসার ব্যাপারে অন্তর্দ্বন্দ্বের মীমাংশা করতে পারেন নি বলে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান শুধু বাগ্মী মুনীর চৌধুরী রূপেই খ্যাতি পেয়েছিলেন। আর কিছু নয়।
মুনীর চৌধুরী প্রথমদিকে সৌখিন কমিউনিস্ট হিসাবে আবির্ভূত হলেও খুব শীঘ্রই তিনি সুবিধাভোগীদের দলে যোগ দেন। মধ্যবিত্তদের বেলায় দেখা যায়, যতোক্ষণ পর্যন্ত আত্মপ্রতিষ্ঠার কিংবা উপরে উঠবার সিড়িটার সন্ধান পাওয়া যায় না, ততোক্ষণ বহুজনই শোষিতের পক্ষে গলাবাজি করেন, তারপর সুবিধা মতো নিজের খোলস পাল্টাতে থাকেন। মুনীর চৌধুরী তার একটি বড় উদাহরণ। মুনীর চৌধুরী প্রথম কিছুদিন কমিউনিস্ট ঘরানা সাথে যোগাযোগ রাখলেও, শীঘ্যই তিনি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হলেন। মুনীর চৌধুরীকে স্মরণ করতে গিয়ে তাই লায়লা সামাদ লিখছেন, ‘জনসাধারণের সাথে আন্দোলনে এগিয়ে যেতে যেতে পিছু হটে এসেছিলেন তিনি। সংগ্রামে পরাজিত সৈনিকের মত পলাতক হয়ে নিরূপদ্রব, নিশ্চিন্ত নিরিবিলি জীবনের ছত্রছায়ায় খুঁজেছিলেন আশ্রয়। জীবনের মোহ তাঁকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছির সংগ্রামী জীবন থেকে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দূরে বহুদূরে।
মুনীর চৌধুরী নিজেই পাক্ষিক বিচিত্রা-র প্রতিনিধির কাছে তাই অকপটে স্বীকার করেছিলেন জীবনের শেষ দুর্বলতা ও বিচ্যুতিকে। বলেছিলেন, ‘জীবনের মোহের কাছে হেরে গেছি আমি’।১১০ জীবনের মোহের কাছে যে মানুষ পরাজিত হয়েছিলেন, সরকারের তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনোই প্রয়োজন নেই। কারণ, জীবনের মোহে পরাজিত মানুষের কাছে বিপ্লবী নাটক কিংবা সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নাটক বা কোনো ধরনের রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন নাটক রচনার কোনো আশঙ্কা ছিলো না।
মুনীর চৌধুরীর আপোষকামীতার নগ্নরূপ ধরা পড়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়।
সেই উত্তাল সময়ে শেখ মুজিব জনগণকে বলেছিলেন, পাক-সরকারের সাথে সকল প্রকার অসহযোগিতা চালিয়ে যেতে, যার যা আছে তাই নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে। মুনীর চৌধুরী যুদ্ধে গেলেন না, পাক সরকারের সাথে কোনো অসহযোগিতাও করলেন না। সামরিক জান্তার অধীনে একাত্তর সালে যুদ্ধের সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে থেকে গেলেন। জনতার আকাঙ্ক্ষার সাথে রইলেন না বা শেখ মুজিবের নির্দেশ তিনি মানলেন না। পাকবাহিনীর সাথে সখ্যতার কারণে কর্তৃপক্ষের আদেশে তিনি মে আর জুন মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন; কলা বিভাগের ডীন হলেন জুলাই থেকে। তাঁর নিন্দা মুখরোচক হয়ে উঠলো; স্বাধীনবাংলা বেতার থেকেও তিনি নিন্দিত হলেন। মুনীর চৌধুরী বাংলাদেশে থেকে গেলেন কিন্তু পুত্র ভাষণ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেন।
বন্ধুরা তাঁকে ক্ষেপিয়েছিলো তাঁর বাবা দালাল বলে, সামরিক সরকারের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছিলো বলে।” পাক সরকারের পক্ষে থাকার ঘটনায় পিতার প্রতি মুক্তিযোদ্ধা পুত্রের যথেষ্ট ক্ষোভ ছিলো। মুনীর চৌধুরীর মায়ের এক লেখা থেকে জানা যায়, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তিনি প্রায় প্রতিদিন প্রচুর হাট বাজার করে নিয়ে আসতেন, ভালো খেতেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে, যুদ্ধের শেষ দিকে রমজান শেষে ঈদ এলো। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ থেকে সেবার ঈদের উৎসব বর্জন করা হয়েছিলো। ঈদ উৎসবকে বর্জন করে বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র থেকে একটি গান প্রচারিত হয়েছিলো। প্রচারিত সে গানের কলিটি ছিলো, ‘চাঁদ তুমি ফিরে যাও, ফিরে যাও’।
কিন্তু মুনীর চৌধুরীর মায়ের লেখায় বলা আছে, মুনীর চৌধুরী সেবার যুদ্ধের মধ্যেই ঈদ পালন করলেন বেশ ভালোভাবে। পাকবাহিনীর সাথে তাঁর আঁতাত খুব জোরলো ছিলো, কিন্তু এই আপোষকামিতা মুনীর চৌধুরীকে বাঁচাতে পারলো না। দুঃখজনকভাবে প্রাণ দিতে হলো তাঁকে। মুনীর চৌধুরী নিজেই যেন নাটকের এক চরিত্র। বলা যায়, বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত সমাজের কিংবা মধ্যবিত্ত মানসিকতার ইতিহাস অভিনীত হয়েছে মুনীর চৌধুরীর জীবনে।
মধ্যবিত্তের সুযোগ সন্ধানী চরিত্র মুনীর চৌধুরীকে নিয়ে মফিদুল হকের উচ্ছ্বাস বা উচ্চকিত বক্তব্যটি তাই মাঠে মারা যায়। তিনি অকারণেই মুনীর চৌধুরীর ব্যক্তিগত লোভ এবং আকাঙ্ক্ষার দায় সরকারের কাঁধে দোষ হিসাবে চাপাতে চান। মধ্যবিত্তরা সবসময় তাই করে থাকেন, নিজের ব্যর্থতা অন্যের ওপর বা সবেধন নীলমনি সরকারের ওপর চাপান। জুলিয়াস সীজার একবার তাই এঁদের নিয়ে উপহাস করে বলেছিলেন, আমি তো কারো কণ্ঠ চেপে ধরে নেই যে তাঁরা গণতন্ত্রের পক্ষে চিৎকার করতে পারবেন না।
মুনীর চৌধুরী একা নন, আরো বহু নাট্যকারের মধ্যবিত্ত চরিত্রের অন্ধকার দিক ধরা পড়ে। সুকুমার বিশ্বাস লিখছেন, উনিশশো বায়ান্ন থেকে সাতান্ন সাল পরিসরে মুনীর চৌধুরী, আসকার ইবনে শাইখ, নুরুল মোমেন প্রমুখ আধুনিক চিন্তা-চেতনায় পরিস্রত নাট্য-ব্যক্তিত্ব প্রতিবাদী এবং মৃত্তিকামূল সংলগ্ন নাটক রচনায় করেছিলেন পথিকৃতের ভূমিকা, ষাটের দশকে এসে জীবন-জীবিকার নিরাপত্তার প্রশ্নে তাঁরাই হয়ে গেলেন সংক্ষুব্ধ, সমকাল-বিচ্যুত, জীবন পালতক। পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গন যাঁদের পদচারণায় মুখর ছিল-তাঁরা প্রাথমিক প্রতিশ্রুতি বির্সজন দিয়ে ভিন্ন অভিরুচি ও চেতনা প্রকাশ করতে থাকলেন। মূলত ষাটের দশকেও তাঁরাই ছিলেন এ-দেশের নাট্যাঙ্গনের প্রধান ব্যক্তিত্ব। সর্বত্রই মধ্যবিত্তের একই চেহারা; এদের প্রধান একটা অংশ শাসকশ্রেণীর লেজুরবৃত্তি করে নিজ ভাগ্য উন্নয়নে। বিদ্রোহ দিয়ে শুরু এবং আত্মসমপর্ণ দিয়ে শেষ-এই হচ্ছে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের একাংশের প্রকৃত চরিত্র।
স্বাধীনতার পূর্বে নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে সরকারের বাধা দান নয়, বরং সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদানের নানা উদাহরণ আছে। সেদিকে এখন কিছুটা দৃষ্টি প্রদান করা হবে। উনিশশো পঞ্চান্ন সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-এর উদ্যেগে পরপর চার রাত মঞ্চস্থ হলো চারটি নাটক। কবর নাটকের মঞ্চসজ্জা ছাত্ররা নিজেরাই করলেন, অন্যান্য নাটকের মঞ্চসজ্জাও তাদের নির্দেশ মতো হলো। মঞ্চব্যবস্থাপনা, অলোক প্রক্ষেপণ ও দৃশ্যাবলী তৈরি, নাটকের গতি সৃষ্টি ইত্যাদি ক্ষেত্রে তারা এমন কিছু দেখাতে চাইলেন যা ছিলো একেবারেই নতুন। এটা ছিলো দিগন্ত উন্মোচনের একটি প্রাথমিক প্রচেষ্টা। সর্বমহলে এর এক বিপুল শুভ প্রতিক্রিয়া হলো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠনকারীদের কাছে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকার পশ্চিম পাকিস্তান সফরের জন্য একটি সাংস্কৃতিক মিশন গঠনের আমন্ত্রণ জানান। নাট্য কর্মের নব প্রয়াসের প্রতি নাট্যমনস্ক ব্যক্তিদের বিপুল সাড়া এবং এই আমন্ত্রণের পরিপ্রেক্ষিতে উনিশশো ছাপান্ন সালে জন্ম নেয় ড্রামা সার্কল। ড্রামা সার্কল পরের বছর জানুয়ারি মাসে করাচির কাটরাক হলে মঞ্চস্থ করে বার্নার্ড শ-র ইউ নেভার ক্যান টেল-এর বাংলা রূপান্তর মুনীর চৌধুরীর কেউ কিছু বলতে পারে না। ১১৩ মুনীর চৌধুরীর উপর কিংবা নাট্যচর্চার বিরুদ্ধে সরকারের নাখোশ থাকার তো কোনো লক্ষণই দেখা যায় না।
ঘটনার এখানেই শেষ নয়। উনিশশো সাতান্ন সালে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অনুরোধে ড্রামা সার্কল জাতীয় রঙ্গমঞ্চের জন্যে নকশা ও প্রাতিষ্ঠানিক গঠন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল-এর লাগোয়া রমনা উদ্যানে জাতীয় রঙ্গমঞ্চের স্থান নির্ধারণ করা হয়। উনিশশো আটান্ন সালের জানুয়ারি মাসে ড্রামা সার্কল জাতীয় রঙ্গমঞ্চ নির্মাণের প্রাথমিক পর্বের তত্ত্বাবধান করে। সে বছরের এপ্রিল মাসে সেই মঞ্চে ড্রামা সার্কল-এর নাটক মঞ্চায়িত হয়। কথা ছিলো, এর পরবর্তী পর্যায়ে রঙ্গমঞ্চ নির্মাণের পুরো কাজ শুরু হবে। কিন্তু তারপর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দরুণ সব উদ্যোগ ভেস্তে যায়।
বাষট্টি সালে মকসুদুস সালেহীন ও চৌষট্টি সালে বজলুল করিম যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেলে কাজটি আর আগায় না। নাট্যশিল্পীদের দাবির প্রেক্ষিতে উনিশশো সাতান্ন সালেই পাকিস্তান ইন্সটিটিউট আব ইঞ্জিনিয়ার্স ঢাকায় স্থায়ী রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেয়। সরকার এ কাজে পাঁচ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করে।
পূর্ব বাংলার নাট্যচর্চায় সরকারের অসযোগিতার কোনো নিদর্শনই তো দেখতে পাচ্ছি না। ব্যাপারটাকে ঠিক উল্টোভাবে আলোচনায় নিয়ে এসেছেন মফিদুল হক এবং অন্যান্যরা।স্বাধীনতা পূর্ববর্তীকালে তাই রাজনৈতিক বা প্রতিবাদী নাট্য আন্দোলন না হবার কারণ এ নয় যে, নাট্যচর্চা করবার মতো মুক্ত পরিবেশ ছিলো না। সত্য প্রকাশের দায় থেকেই এখানে বলে রাখা ভালো যে, নাটকের ওপর সরকারি বাধা দানের ঘটনা না থাকলেও বি. এন. আর. বা বোর্ড অব ন্যাশনাল রিকন্সট্রাকশন প্রধান মুসা আহমেদ নানাভাবে রবীন্দ্র-বিরোধী তৎপরতায় সক্রিয়ভাবে লিপ্ত হন। মুসা আহমেদের সহযোগী হিসাবে সে সময় বি. এন. আর.-এর উপপরিচালক ছিলেন কবীর চৌধুরী; মুনীর চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা।
পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসন ‘বি. এন. আর.’ এবং ‘পাকিস্তান লেখক সঙ্ঘ’ প্রতিষ্ঠা করে রবীন্দ্রজন্ম-শতবার্ষিকী পালনে বাধা সৃষ্টি করে। কিন্তু এই বিরুদ্ধ শক্তিকে ভয় না পেয়ে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উৎসব উদযাপন উপলক্ষে উনিশশো একষট্টি সালের মে মাসে ড্রামা সার্কল মঞ্চায়িত করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজা ও রাণী।
রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উপলক্ষেই পুনরায় ড্রামা সার্কল জুন মাসে মঞ্চরূপ দেয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তাসের দেশ এবং রক্তকরবী। স্বাধীনতার পূর্বে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চায়িত হবার আরো উদাহরণ আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ কর্তৃক উনিশশো পঞ্চাশ সালের এপ্রিল মাসে কার্জন হলে অভিনীত হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষরক্ষা। উনিশশো বায়ান্ন সালে সেন্ট গ্রেগরী কলেজ ছাত্র সংসদ সেপ্টেম্বর মাসে মঞ্চস্থ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডাকঘর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক মুসলিম হল ছাত্র সংসদ সেপ্টেম্বর মাসে কার্জন হলে মঞ্চায়িত করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিরকুমার সভা।
চুয়ান্ন সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী হল কর্মপরিষদের প্রযোজনায় নভেম্বর মাসে অভিনীত হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক রক্তকরবী। এই তালিকা দীর্ঘ করা যাবে। ফলে যাঁরা বলতে চান স্বাধীনতা পূর্বের নাট্যচর্চায় সরকারি বাধা ছিলো বলেই নাট্য আন্দোলন দানা বাঁধতে পারেনি, তাঁরা ভুল বলছেন এবং ভুল তথ্য পরিবেশন করছেন। সে-সময়ে মধুসূদন দত্ত, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তুলসী লাহিড়ী, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখর নাটকও মঞ্চস্থ হয়েছে। সরকারি বাধা থাকলে উল্লিখিতদের নাটক মঞ্চায়ন করা সম্ভব হতো না। যাঁরা সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে ভয় পান, তাঁরা সবসময়ই খোঁজেন অনুকূল পরিবেশ; বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের শেষ বিচারে সেই সত্যই প্রমাণিত হবে। সে প্রসঙ্গে আমরা পরে আসবো। যাঁরা মনে করেন স্বাধীনতা পরবর্তীকালে দেশে মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিলো এই অধ্যায়ে আমরা তাঁদের সেই চিন্তারও অসারতা তুলে ধরবো।
স্বাধীনতার পর জনগণ মুক্ত পরিবেশ পেয়েছিলো এ বক্তব্য কি আদৌ সত্যি? স্বাধীনতার পরের ঘটনাবলী তা প্রমাণ করে না। নাট্যচর্চার স্বাধীনতার কথাই ধরা যাক। তিয়াত্তর সালেই ঢাকা থিয়েটারের সংবাদ কার্টুন এবং সম্রাট ও প্রতিদ্বন্দ্বিগণ নাটক দুটি বন্ধ করে দিয়েছিলো তদানীন্তন সরকার।স্বাধীনতা লাভের পর মানুষ যে নিরঙ্কুশ বাক স্বাধীনতা পেয়েছিলো বা নাগরিক অধিকার সংরক্ষিত হচ্ছিলো এসব কথা সত্যি নয়।
সর্বৈবভাবে একথা স্বীকৃত যে, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের নাটক ছিলো প্রতিবাদী চরিত্রের। স্বাধীনতা যদি সত্যি মুক্ত পরিবেশ এনে দেয় তাহলে সেই প্রতিবাদ ঘোষিত হয়েছিলো কার বিরুদ্ধে? নাট্যকার সমাজবিচ্যুত কেউ নন। দৈনন্দিন জীবন প্রবাহের ধারায় তারও ব্যক্তিমানস গ্রথিত। স্বাভাবিকভাবেই তাই আশা করা যায় নাট্যকারের রচনাতে প্রতিফলিত হবে সমাজ, আর সে সমাজ সমকালীন। সমকালের সামাজিক রূপ ধরা দেবে তার রচনায়।বাংলাদেশের নাট্যকারদের রচনায় সেই সময়ের বিক্ষুব্ধ অবস্থাটাই তাই ধরা পড়েছিলো প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে।
স্বাধীনতার পূর্বে প্রতিবাদী নাটক না হওয়ার বা কোনো নাট্য আন্দোলন গড়ে না উঠবার কারণ এ নয় যে, শোষিত মানুষের নাটক হয় না বা নাটক করবার জন্য চাই হাঁফ ছেড়ে কথা বলবার পরিবেশ। পশ্চিমবঙ্গের গণনাট্য সংঘই হতে পারে তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। ষাট ও সত্তরের দশকে পুরোপুরি রাজনৈতিক গণসংগঠন গণনাট্য সংঘ সন্ত্রাসের মধ্যেও কাজ করে গেছে, পিছু হটেছে তথাপি কাজ বন্ধ করেনি। অথচ আশির দশকে এসে কী দেখতে পাচ্ছি? রাজ্যের অন্যতম বৃহৎ শাসকদলের গণসংগঠন হিসাবে গণনাট্য সংঘ বিপুল নিরাপত্তা, অবস্থানগত সুস্থিতি ও প্রাদেশিক সরকারের আনুকূল্য ও সহযোগিতা নিরন্তর পেয়ে চলেছে।
দীর্ঘদিন ধরে এইরকম চলার ফলে সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দের এবং সংঘের শিল্পীদেরও মানসিক পরিমণ্ডলে মেদভার সঞ্চিত হয়েছে। কর্মে অনীহা উদ্যোগহীনতা অবশ্যম্ভাবী অভিশাপের মতো গণনাট্য সংঘের মধ্যে ক্রিয়াশীল হয়ে পড়েছে। নাটক থেকে রাজনীতি, প্রতিবাদ হারিয়ে যাচ্ছে। নাট্য আন্দোলন বলে কিছু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বামফ্রন্ট সরকার যতোই রাইটার্সে তাদের আসন পাকা করেছে, ততোই পাল্লা দিয়ে কমে যাচ্ছে থিয়েটারের বিপ্লব। ক্লান্ত উৎপল দত্ত একা হাতে গুণ টেনে যাচ্ছিলেন, তাঁর মৃত্যুতে এখন প্রতক্ষ্যভাবে রাজনৈতিক নাটক অনুপস্থিত পশ্চিম বাংলার থিয়েটারে।
গণনাট্য পূর্বের তেজ ও প্রতিবাদী চরিত্রটি হারিয়ে ফেলেছে বৈরী পরিবেশে তাকে কাজ করতে হচ্ছে না বলে। বামফ্রন্ট সরকার তাদের নিজেদের সরকার। নাটকে রাজনীতির কথা বললে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে সেটা নিজেদের পক্ষের বামফ্রন্ট রাজ্য সরকারকে বিব্রত করতে পারে, সেই ভয় বা ভাবনাও থেকে যাচ্ছে। নিজেদের পক্ষের সরকার বলেই মন্ত্রীদেরকে খুশি রাখার তাগিদও কাজ করে। রাজনীতি বিমুখতা তাই দেখা দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা থিয়েটারে। ক্ষমতায় বিরুদ্ধ পক্ষ থাকলে এমনটি ঘটার সম্ভাবনা ছিলো না।
স্বাধীনতার আগে কেন রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলন গড়ে ওঠেনি বা নিয়মিত নাটক হয়নি তার বহু কারণ আছে।
স্বাধীনতার আগে কেন প্রতিবাদী নাটক হয়নি সে সম্পর্কে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলছেন, শিক্ষিতশ্রেণীর সৃষ্টিশীলতা, চিন্তা চেতনা আর দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা এবং চিন্তার দেউলিয়া অবস্থাই ছিলো এরজন্য দায়ী।” মনজুরুল ইসলাম প্রতিবাদী নাটক এবং শিক্ষিতশ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা বলতে কী বুঝিয়েছেন তা স্পষ্ট নয়। সন্দেহ নেই যে, স্বাধীনতার পূর্বে শিক্ষিতশ্রেণী, শিল্পী- সাহিত্যিক কেউই নাটককে ততোটা গুরুত্ব দেননি। তাঁরা ধারণা করতে পারেননি নাটক সংগ্রামের একটি অস্ত্র। নাটক যে একটি উন্নত ও মর্যাদা সম্পন্ন শিল্প মাধ্যম এটা বুঝবার ক্ষমতাই তাঁদের ছিলো না। সেই রকম পরিবেশে নাটক হতে পারে কিন্তু নাট্য আন্দোলন বেড়ে উঠবার কোনো সম্ভাবনা ছিলো না। স্বাধীনতার পূর্বে লেখক সাহিত্যিকদের কথা বলার স্বাধীনতা ছিলো না বলে নাটক সে সময় প্রাণ পায়নি এ প্রসঙ্গ উত্থাপন তাই বাতুলতা মাত্র।
ইতিহাসে দেখা গেছে বড় বড় যুদ্ধ, গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতা, দেশভাগ এই সকল বৃহৎ ঘটনাগুলিকে ঘিরেই সাধারণত নাট্য আন্দোলন গড়ে ওঠে। দেশভাগের পরপরই পূর্ববাংলায় নাট্য আন্দোলন গড়ে উঠবার সামান্য পরিবেশ থাকলেও মুসলমানদের নাট্যচর্চার দীর্ঘ ঐতিহ্য না থাকায় সেটা ঘটলো না। দ্বিতীয়ত পাকিস্তান লাভের পর সুবিধাভোগীরা এই রাষ্ট্রে সুখীই ছিলো; ফলে তাদের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে খুব একটা ক্ষোভ জাগেনি।
কিছু মানুষের মধ্যে রাষ্ট্র সম্পর্কে ক্ষোভ জাগলেও মুসলমান হিসাবে তারা পাকিস্তান মেনে নিয়েছিলো। দেশভাগের পর আসলে মানুষ দিশেহারাও ছিলো। স্বপ্নের পাকিস্তান লাভ করলো এবং সঙ্গে সঙ্গেই ভাষার প্রশ্নে রাষ্ট্রের সাথে বিরোধ শুরু হলো, এমনি অবস্থায় মানুষ ছিলো দ্বিধাবিভক্ত এবং বিভ্রান্ত। ঠিক এসময় নাট্যচর্চায় পিছিয়ে পড়া মুসলমানরা রাজনৈতিকভাবে নাটককে কাজে লাগাবার কথা প্রথমে ভাবতেই পারলো না পূর্ব অভিজ্ঞতার অভাবে। নাটক যে একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে, রাজনৈতিক দলের মতো সমন্বিতভাবে যে রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতে পারে এই অভিজ্ঞতাই তাদের মধ্যে ছিলো না।
পশ্চিমবঙ্গে দেশভাগের পর যে নাট্যধারা বা যেসব নাট্য আন্দোলন গড়ে ওঠে তার দুটি দিক আছে; একটি দিক রাজনৈতিক ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত এবং অপরটি ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠা লাভ বা আখের গোছাবার চেষ্টা। পূর্ববাংলার নবউত্থিত মুসলমান মধ্যবিত্ত শিক্ষিতরা তখনো সে পরিমান দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হয়ে ওঠেনি যে, নাটককে নিজের আত্মপ্রতিষ্ঠার সিঁড়ি হিসাবে ব্যবহার করতে চাইবে।
এই মধ্যবিত্তরা তখন জানতোই না যে নাট্য মাধ্যমটিকে কাজে লাগিয়ে সমাজে ব্যাপক মর্যাদা পাওয়া যায়, প্রতিষ্ঠা লাভ করা যায়। দেশ বিভাগের পর পূর্ব বাংলায় রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলন গড়ে ওঠেনি তার কারণ মাত্র একটি নয়, বহুবিধ কারণ আছে। শিক্ষিতশ্রেণী নাটককে প্রধানত বিনোদনের মাধ্যম হিসাবে দেখতেন বলেই রাজনৈতিক নাটক তৎকালে গড়ে ওঠার সুযোগ ছিলো না। উপরন্তু ভারতের মতো কোনো কমিউনিস্ট দল পূর্ববঙ্গে রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য কোনো ভূমিকা রাখেনি; নাটককে তাদের রাজনীতি প্রচারের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করার কথা ভাবেনি। রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দরকার ছিলো মার্কসবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্যোগ; মার্কসবাদী রাজনৈতিক দলগুলো সে-রকম কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি।
কী দেখতে পাচ্ছি তাহলে? রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলন গড়ে ওঠেনি তার কারণ সমাজতান্ত্রিক বাম দলগুলো এর জন্য কোনো উদ্যোগ নেয়নি; নাট্য আন্দোলন গড়ে তোলবার কোনো পরিকল্পনাই রাজনৈতিক দলগুলির ছিলো না। বিজ্ঞানমনস্ক নবনাট্য আন্দোলনের ধারাও পূর্ববাংলায় গড়ে উঠতে পারেনি তার প্রধান কারণ, মধ্যবিত্তরা এই মাধ্যমকে স্বাধীনতার পূর্বে তাদের আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই হিসাবে দেখতে পায়নি।
সেজন্য রাজনৈতিক চিন্তার বাইরে শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা নাট্যচর্চায় যে প্রগতিশীল ভূমিকা রাখতে পারতো, সেটাও ঘটেনি। স্বাধীনতার পূর্বে বাংলাদেশে নাটককে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার বা নিয়মিত নাটক করবার কোনো ধারা গড়ে ওঠেনি এ কথা খুবই সত্যি। কিন্তু বহুজন যেমন বলতে চান স্বাধীনতার পূর্বে এখানে তেমনভাবে নাট্যচর্চাই হয়নি, কথাটা ঠিক নয়। স্বাধীনতার পূর্বেও নাটক হয়েছে এখানে। কিন্তু কোনো নিয়মিত নাট্য মঞ্চায়ন তা ছিলো না এবং নাট্যদলগুলো সঙ্ঘবদ্ধভাবে কিংবা সচেতনভাবে নাটককে রাজনৈতিক প্রশ্নে ব্যবহার করতে চায়নি। তা সত্ত্বে কিছু কিছু নাটকে শোষক-শোষিতের দ্বন্দ্ব যথেষ্ট জোরালোভাবে জায়গা পেয়েছিলো।
রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ ঘোষিত হয়েছিলো। কিন্তু পূর্ব বাংলার নাট্যচর্চায় কখনও এ ঘোষণা দেয়া হয়নি; নাটক সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার কিংবা নাটক শ্রেণীসংগ্রামের পক্ষে কাজ করবে। পূর্ব বাংলায় নাট্য আন্দোলন গড়ে তুলবার চিন্তা বা চেষ্টা যে একেবারেই হয়নি তা নয়। দু-একজন কালে ভদ্রে নাট্য আন্দোলন গড়ে তুলবার কথা ভেবেছেন।
উনষাট সালে নাট্য আন্দোলন সম্পর্কে এফ করিম লিখছেন, ‘নাট্য আন্দোলনকে আজ অবহেলা করলে চলবে না। কেননা, দেশের জনসাধারণের মানসকে উন্নত, শাণিত এবং দীপ্তিমান করে তুলতে পারে নাটক এবং চলচ্চিত্র। নাটকের এই মহান দায়িত্ব ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা মনে রেখে সুষ্ঠু পরিকল্পনা আমাদের গ্রহণ করতে হবে। নইলে আমাদের জাতীয় চেতনাও স্বাতন্ত্র্যের অপমৃত্যু ঘটবে-এ কথা বলাই বাহুল্য।’
কিন্তু এসব মূলত দু-এক ব্যক্তির চিন্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। এর কোনো বাস্তব প্রয়োগ ছিলো না। ড্রামা সার্কলের মতো একটি আধুনিকমনস্ক দলও নাটক করেছে সৌখিনভাবে। কোনোধরনের রাজনৈতিক দায় এই দলটির চিন্তায় ছিলো না। প্রাক মুক্তিযুদ্ধ কালে রাজনৈতিক নাটক নিয়ে সামান্য চিন্তা করা হয়েছিলো। প্রাক মুক্তিযুদ্ধকালে প্রতিষ্ঠিত পারাপার গোষ্ঠীর সভাপতি কবীর আনোয়ার বলেন, দেশে গণনাট্য আন্দোলন গড়ে তোলাই তাঁদের নাট্যগোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য। তিনি বলেন, আমরা চাই আজকের এই অবক্ষয়ী সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন।
শুধু নাটক মঞ্চস্থই নয়, গণনাট্য সম্পর্কে বিভিন্ন আলোচনা সভা ও সেমিনার করে আমরা আমাদের লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করতে চাই। বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো যেভাবে জনতাকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে নাটককে গণমানুষের কাছাকাছি নিয়ে গেছে তেমনিভাবে আমাদের দেশেও আন্দোলনের মাধ্যমে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে জীবনঘনিষ্ঠ নাটক মঞ্চস্থ করতে হবে-এই আহ্বান জানান জনৈক নাট্য সমালোচক।
নাট্য আন্দোলন বা গণনাট্য সম্পর্কে চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান যে বক্তব্য রাখেন তা প্রণিধাণযোগ্য। তিনি বলেন, গণনাট্য আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে গ্রামে গঞ্জে ক্ষেতে-খামারে মুক্ত মঞ্চে গিয়ে গণমুখী নাটক মঞ্চস্থ করতে হবে। যাদের নিয়ে গণমুখি নাটক সৃষ্টি, তাদের কাছেই আগে এর বক্তব্য পৌঁছে দিতে হবে। তাহলেই গণনাট্য আন্দোলন সার্থক হয়ে উঠবে। তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা শোষণহীণ সমাজ আনার বিপ্লব হবে না।

বিপ্লব করে খেটে খাওয়া মেহনতী মানুষেরা; কৃষক, মজদুর যারা। আমরা যারা শহুরে আবহাওয়ায় বসে বিপ্লবের বড় বড় কথা বলি, অবক্ষয়ী সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের দাবি করি, তারা আসলে বিপ্লব চাই না, মেহনতী মানুষের মুক্তি চাই না। খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের মাঝে আমাদের গিয়ে দাঁড়াতে হবে, তাঁদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে, তাদের সুখ-দুঃখ, হাসিকান্নার মাঝে নিজেদের অংশীদার করতে হবে। তাদের মাঝে গিয়েই তাদের জন্য নাটক রচনা করতে হবে। তাহলে গণনাট্য আন্দোলনও সার্থক হয়ে উঠবে। এইসব বক্তব্যগুলো এসেছিলো উনিশশো একাত্তর সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, যখন রাজনৈতিক উত্তেজনা তুঙ্গে।
স্বাধীনতা লাভের পূর্বে বিভিন্ন সময় পূর্ববঙ্গে কী ধরনের নাটক হয়েছে তা আমরা ভূমিকায় দেখতে পেয়েছি। সামাজিক নানা প্রসঙ্গ যেমন সেখানে ছিলো, তেমনি রাজনৈতিক বিষয়বস্তুও ছিলো। কিন্তু স্বাধীনতা পূর্ববর্তী তেইশ বছরে নাট্য আন্দোলন কিংবা নাটক ও রাজনীতি নিয়ে কোনো ধুম্রজাল তৈরি করা হয়নি। নাটকে রাজনীতি থাক কিংবা না থাক এসব নিয়ে কোনো প্রকার কোনো ঘোষণা দেয়া হয়নি। কোনো ধরনের শ্লোগান তুলে নাট্যচর্চায় হৈ চৈ ফেলা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের আগে পূর্ব পাকিস্তানে যে-ধরনের নাটক মঞ্চস্থ হতো তার সাথে স্বাধীনতা পরবর্তী নাটকের চিন্তা চেতনার, প্রয়োগ রীতির বিরাট পার্থক্য দেখা দেয়। দর্শনীর বিনিময় নিয়মিতভাবে নাটক মঞ্চায়ন শুরু ঢাকা ও ঢাকার বাইরে। মর্যাদার দিক থেকেও মঞ্চনাটক এক বিশেষ স্থান অধিকার করে। স্বাধীনতা পরবর্তী নাট্যচর্চার এটা একটা বিশেষ দিক। ভিন্ন দিকটি হলো রাজনীতি নিয়ে হৈ চৈ।
নাটক হয়ে দাঁড়ালো রাজনীতি, সমাজ-চিন্তা প্রকাশের মাধ্যম। নাটক হয়ে দাঁড়ালো প্রতিবাদের ভাষা। নাট্যকর্মীরা নিয়মিত নাটক মঞ্চায়নে উদ্যোগী হলেন, নাটককে গ্রহণ করলেন সমাজ-বদলের হাতিয়ার হিসাবে। বিভিন্ন ধরনের আন্দোলন চালাবার জন্য নাট্যদলগুলো মিলিতভাবে গড়ে তুললো নিজেদের একটি সঙ্ঘ। যুগ চেতনা থেকে, একটি যুদ্ধের পরবর্তী ঘটনা থেকে এই নাট্য আন্দোলনের জন্ম। কিন্তু নাটকের দর্শক হবে কারা এ নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনা হলো না। নাটকের যারা দর্শক তাদের সামাজিক অবস্থান, মনোজগৎ বিবেচনা করলো না কেউ।
স্বাধীনতার পর সত্তরের দশকের গোড়ায় যে নতুন নাট্যচর্চা শুরু হয়, সেখানে কি কোনো ঘোষিত কর্মসূচী ছিলো, কোনো আদর্শ বা উদ্দেশ্য রূপায়ণের কোনো প্রতিশ্রুতি ছিলো, নাকি পুরোটাই ছিলো সাময়িক উত্তেজনা সে প্রশ্নের উত্তর পেতে হবে নাট্য আন্দোলনের চরিত্র বুঝতে গেলে। নাট্য আন্দোলন বা যে-কোনো আন্দোলন বলতে আমরা বুঝি-যেখানে একটা নির্দিষ্ট কর্মসূচী থাকে, কোনো একটা আদর্শ উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করার জন্য একটা সমবেত কর্মোদ্যোগ থাকে। বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের পেছনে তেমন কিছু কাজ করেনি। কোনো সুনির্দিষ্ট ইস্তেহার কখনও কোনো দল ঘোষণা করেনি।
নাট্যদলগুলো মিলিতভাবে শ্রেণীসংগ্রামের পক্ষে নাটককে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়নি, সকলে নিজের নিজের মতো করে শ্রেণীসংগ্রামে নাটককে হাতিয়ার করে তুলবার ঘোষণা দিয়েছিলো মাত্র। নাট্য আন্দোলন শব্দটা বহু ব্যবহৃত বাংলাদেশে এবং দুই বাংলায়। যদিও আন্দোলন কী, কেন, কীভাবে তা করা হবে এ-সব নিয়ে প্রশ্ন করে বাংলাদেশের নাট্যদল ও নাট্যকর্মী কিংবা নাট্যবোদ্ধাদের কাছ থেকে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায় না। নাট্য আন্দোলন নিয়ে কোনো লেখালেখিও নেই। যদিও নাটক ও সমাজ, নাটক ও রাজনীতি নিয়ে নানা ধূম্রজাল তৈরি হয়েছে স্বাধীনতা পরবর্তী কয়েক দশক ধরে।সন্দেহ নেই, পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতার নাট্যচর্চার প্রভাব পড়েছিলো এইসব ক্ষেত্রে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় বিভিন্ন শ্রেণীর, বিভিন্ন পেশার মানুষ পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও নাটকের সাথে কম-বেশি সম্পৃক্ত ব্যক্তিরাও ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা সরাসরি অংশ নেন তাঁদেরও একটা অংশের পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতার সাথে নানাভাবে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতার নাটকের সাথে বাংলাদেশের মানুষের পরিচয় ঘটে সেই সময়। নাটক সম্পর্কে নাট্য আন্দোলন সম্পর্কে তখন তাঁরা নতুন করে জানার সুযোগ পান।
একাত্তর সালে যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ চলছে সরকারের দমননীতির ফলে পশ্চিমবঙ্গে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের তখন কিছুটা পড়তি অবস্থা। তা সত্ত্বেও উৎপল দত্তের টিনের তলোয়ার, জোছন দস্তিদারের পদ্য গদ্য প্রবন্ধ-র মতো কিছু নাটক কলকাতায় খুবই সাড়া জাগায়। বাষট্টি সনে পশ্চিমবঙ্গের নাট্যচর্চার ওপর আনন্দবাজার পত্রিকার এক হিসাবে দেখা যায় সমগ্র রাজ্যে শুধুমাত্র অপেশাদার নাট্যাভিনয়ের সংখ্যা সাত হাজার তিনশত আটষট্টি। এর মধ্যে কলকাতা শহর ও শহরতলীতে বিভিন্ন রঙ্গমঞ্চে মঞ্চায়িত হয় তিন হাজার নয়শ পঁচাশিটি অভিনয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় একাত্তর সালে এ সংখ্যা কিছুদিনের জন্য কমে গেলেও পূর্বের নাট্য আন্দোলনের রেশ তখনো ছিলো। বিশেষত কলকাতা শহরে পেশাদারি থিয়েটার ও গ্রুপ থিয়েটার মিলিয়ে প্রতিদিন তখন নিয়মিত অনেক নাটক মঞ্চস্থ হতো। ঘটনাগুলো বাংলাদেশের শিক্ষিত মানুষের চিন্তায় খুবই প্রভাব ফেলেছিলো।
পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় তখন শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত ও অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বহুরূপী, পি. এল. টি. ও নান্দিকারের যুগ। এর বাইরে আরো অনেক দলই ছিলো, যারা কলকাতায় নিয়মিত অভিনয় করে চলেছিলো বিভিন্ন রঙ্গমঞ্চে। তাদের কারো কারো মুখে শোনা যায় তখন ভালো নাটক করার কথা, কেউবা শ্রেণীসচেতন জঙ্গী নাটক বেছে নিয়েছে। বিশেষ করে যে তিনজন নাট্যকারের কথা বলা হলো, তাঁদের ব্যক্তিত্বের আকর্ষণ তখন কলকাতার থিয়েটারে ব্যাপক।
তখন নাট্য-জগতের আরো অন্যান্য ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন বিভাস চক্রবর্তী, কেয়া চক্রবর্তী, তৃপ্তি মিত্র, মনোজ মিত্র প্রমুখ। বাংলাদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও তরুণরা দেখলেন, থিয়েটার ব্যক্তিত্ব উৎপল দত্ত, শম্ভু মিত্র, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভাস চক্রবর্তী, কেয়া চক্রবর্তী, তৃপ্তি মিত্র, মনোজ মিত্র, প্রমুখ নাট্য ব্যক্তিত্বরা তখন সর্বমহলে স্বীকৃত ও সম্মানিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, রাজনীতিক থেকে শুরু করে সর্ব সাধারণ তাঁদের নাটকের দর্শক। শুধু দর্শক নন টিকেট কেটে তাঁরা নাটক দেখেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নাটক আলাদা বিষয় হিসাবে পড়ানো হয়, রাজধানী দিল্লিতে রয়েছে জাতীয় নাট্য বিদ্যালয়।স্বভাবতই এসব দেখার পর পূর্ব বাংলার যে-সকল শিক্ষিতরা নাটক সম্পর্কে দীর্ঘদিন উন্নাসিকতা, অবহেলা দেখিয়েছেন, তাঁরা নিজেদের ভুলটা বুঝতে পারলেন।
বাংলাদেশের মঞ্চনাটক : উৎস ও কর্মধারার ব্যাপকতা [ পর্ব ৩ ]
আর যাঁরা শিক্ষিত-সমাজের ভ্রুকুটির মুখে এতদিন নাটক করে আসছিলেন, এসব দেখে তাঁদের হীনমন্যতাও তখন কেটে গেল। যেসব তরুণ-তরুণীরা পূর্বে কখনও নাটক নিয়ে মাথা ঘামাননি তাঁরাও বুঝতে পারলেন নাটক করেও সমাজে প্রতিষ্ঠা মেলে, সম্মান লাভ করা যায়। সেই সাথে যাঁরা এতোদিন নাটক করে আসছিলেন মান্ধাতার আমলের বৃত্তাবদ্ধ হয়ে, নাটককে যে কতোটা উন্নতির শিখরে নিয়ে যাওয়া যায় তাঁরা পেলেন সেই শিক্ষা। বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিত সম্প্রদায় বুঝতে পারলেন নাটক শুধু নাটক নয়, এটা শিক্ষারও বাহন হতে পারে। নাটক দিয়েও রাজনীতি প্রচার করা যায়। সমাজের ন্যয়- অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো যায়। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁরা সঞ্চয় করলেন কলকাতা থেকে।
আর তাই স্বাধীনতা-উত্তরকালে নাটক সম্পর্কে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। বিভিন্ন শ্রেণী এই সময় নাটককে তাঁদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির পাথেয় হিসাবে ব্যবহার করতে উদ্যোগী হলেন, বিশেষত মধ্যবিত্তশ্রেণী। মধ্যবিত্তশ্রেণী সর্বদাই উপরে উঠবার সিঁড়ি খোঁজে, নাট্যচর্চা তাঁদের কাছে সেই সিঁড়ি হিসাবে প্রতিভাত হলো। সেইজন্য মধ্যবিত্তের এক বিরাট অংশ কোনোরকম পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই স্বাধীনতার পরপর নাটক লিখতে বসে গেলেন এবং সুবিধা করতে না পেরে যথারীতি ছেড়েও দিলেন।
ফলে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের নাট্য আন্দোলনের প্রভাবে বাংলাদেশে নতুন নাট্যধারা জন্ম নেয়। মামুনুর রশীদ লিখছেন, ‘যুদ্ধকালীন অবস্থায় অনেক নাট্যকর্মীর সুযোগ ঘটে কলকাতার নাটক, নাট্য-সংগঠন, নাট্যকার, অভিনেতা-অভিনেত্রী ও কুশলীদের সাথে পরিচিত হবার। এ ঘটনাটি আমাদের নাট্য ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কলকাতার নাটক দেখার পর হাঁটতে হাঁটতে সবাই ভাবতে শুরু করে দেশে ফিরে গিয়ে কিছু একটা করতে হবে। ৭ কলকাতার নিয়মিত নাট্য প্রদর্শনী এবং নাটকের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ এদের প্রচণ্ড রকমের প্রভাবিত করেছিলো। কয়েকজন উৎসাহী তরুণ সেখানে বসেই নাটক লিখে বিভিন্ন জায়গায় অভিনয় করেছেন।
দেশে ফিরে এঁরা নতুন কিছু করার ইচ্ছা নিয়েই নাটকের প্রতি মনোযোগী হলেন। কলকাতার অভিজ্ঞতাই এদের নাটকের প্রতি বেশি আগ্রহী করেছে। স্বাধীনতা লাভের দু মাসের মধ্যেই আরণ্যক নাট্যদল গড়ে উঠলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত যেসব ছাত্ররা যুদ্ধে গিয়েছিলেন তাঁরাও ফিরে এসে দ্রুত সংগঠিত হলেন নাট্যচর্চাকে ঘিরে। বিশ্ববিদ্যালয় হলগুলোতে, ডাকসুতে, সর্বত্র একটা ব্যাপক সাড়া পড়ে গেল, যা আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি।
স্বাধীনতা যুদ্ধটার বিরাট মহিমা ছিলো বলেই বাহাত্তর পরবর্তী নাট্যচর্চাও বিরাট মহিমা পেয়েছিলো। স্বাধীনতা পরবর্তী নাটকের মূল্যায়ন করতে গিয়ে তাই ওয়াসিউদ্দিন আহমেদ লিখছেন, ‘আগে যারা নাট্যচিন্তা থেকে ইচ্ছের বশবর্তী হয়ে দূরে সরে ছিলেন, বিতর্কিত সময়ে তারা এখন সে ভাবনায় সক্রিয়’। ৯ স্বাধীনতার পর চুয়াত্তরে তাই এক সাক্ষাৎকারে রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘বেশ কিছু সংখ্যক দর্শক যাঁরা মঞ্চের নাটক প্রায় পছন্দই করতেন না, তাঁরা নাটকের প্রতি বেশ উৎসাহিত হয়ে উঠেছেন। অন্যকেও নাটক দেখার পরামর্শ দিচ্ছেন এবং দর্শনীর বিনিময়ে। ‘ ৩০ কলকাতার অভিজ্ঞতা লাভ করার পর তাঁরা যে আর নাটক সম্পর্কে উন্নাসিকতা দেখাবেন না বরং একটু বেশি উৎসাহ দেখাবেন সেটাই ছিলো স্বাভাবিক।
ছিয়াত্তর সালে দৈনিক বাংলার শেষের পাতায় লেখা হচ্ছে, ঢাকায় আজকাল সময় মতো টিকেট কাটতে না পারলে রোববার সকাল বা সন্ধ্যায় নাটক দেখা অনেকের কপালে হয়ে ওঠে না। নাটক দেখার জন্য ভিড় দিনদিন বাড়ছে। নতুন নতুন লোক উৎসাহী হয়ে উঠছেন নাটক সম্পর্কে। নাটক যতোই দেখার দর্শক বাড়ছে ততোই বাড়ছে নাটক করার দল। বছর তিনেক আগে হাতে গোনা দু তিনটে দল নিয়মিত নাটক করতো। এখন টিকেটের বিনিময়ে নাটক করার দল প্রায় এক ডজন। এখন ঢাকার সংস্কৃতি অঙ্গনে সবচেয়ে সক্রিয় শাখা হলো নাটক। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের যে নাট্য আন্দোলন তার উৎস তাই পশ্চিমবঙ্গের গ্রুপ থিয়েটার। বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলন তাই ‘গ্রুপ থিয়েটার’ নামে পরিচিতি লাভ করে। নাটক বাছাই ও নাট্য প্রযোজনায়ও তাই বেশ কিছুকাল কলকাতার ঝোঁক লক্ষ্য করা যায়।
সাতাত্তর সালে জাতীয় নাট্যোৎসবে অংশগ্রহণের জন্যে চূড়ান্ত বাছাইয়ের উদ্দেশ্যে উৎসবে অন্তর্ভুক্তির নীতি নির্ধারণী আবেদনপত্র দেশের যে আটান্নটি গোষ্ঠী বা দল পূরণ করে পাঠিয়েছিলো তাদের সর্বমোট প্রস্তাবিত নাটকের সংখ্যা ছিলো একশো চুরাশিটি। সর্বমোট একশত একান্ন জন নাট্যকারের নাটক প্রস্তাব করা হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশের নাট্যকার ছিলেন তিরাশি জন ও পশ্চিমবঙ্গের তিপ্পান্ন জন।
বাংলাদেশ থেকে যাঁরা তখন নাট্য বিষয়ে বাইরে শিক্ষা নিতে গিয়েছিলেন, প্রায় প্রত্যেকে তখন দিল্লির জাতীয় নাট্য বিদ্যালয়ে গিয়েছেন, পরে অনেকে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। বহুজন সেখানে শিক্ষা সমাপ্ত করে পশ্চিমবঙ্গের নাট্যদলগুলোর সাথে কাজ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ হচ্ছে সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড় নাট্য আন্দোলনের জায়গা। নাটক নিয়ে এতো হৈ চৈ এতো গবেষণা এতো চর্চা এতো ব্যাপকভাবে আর কোথাও হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের মূল পরিচয় যেন তখন নাটক। এমনি একটি রাজ্যের প্রভাব ঘটনাচক্রে পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশের ওপর পড়া কোনো অস্বাভাবিক বা কাকতালীয় ব্যাপার নয়। দু অঞ্চলের ভাষার মিলটা এ ক্ষেত্রে কাজটাকে ত্বরান্বিত করেছে।
সাধারণত বড়দের দ্বারা, বিখ্যাতদের দ্বারা সবাই প্রভাবিত হয়, বাংলাদেশের নাটকও তাই কলকাতার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলো। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কলকাতার গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ এ ক্ষেত্রে প্রেরণা সঞ্চার করেছে। জামিল আহমেদ তাই এক প্রবন্ধে লিখছেন, কলকাতা কেন্দ্রিক গ্রুপ থিয়েটার-এর প্রভাবে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের নাট্যদলগুলোর সৃষ্টি। পশ্চিমবঙ্গের নাট্য আন্দোলন পরবর্তীকালেও বাংলাদেশের নাটকের ওপর বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিলো তার আরো বহু প্রমাণ আমরা পাবো। বাংলা ভাষাভাষী হওয়ায় ও সংস্কৃতিতেও নানারকম মিল থাকায় এটা ঘটেছে এবং সে সাথে পশ্চিমবঙ্গ সবচেয়ে পার্শ্ববর্তী অঞ্চল হওয়াতে এটা হওয়ার সুযোগ ছিলো।
তবে স্বাভাবিক একটি প্রশ্ন, শুধুমাত্র কলকাতার নাট্য আন্দোলনের প্রভাবেই কি বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলন জন্ম নিয়েছিলো? নাকি ভিন্ন কোনো কারণও ছিলো? মধ্যবিত্তশ্রেণীর একটি অংশ যেমন নাটককে আত্মপ্রতিষ্ঠার সিঁড়ি মনে করেছিলো বলে বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর নাটকের যাত্রা আরম্ভ, তেমনি কোনো কিছু শুধু একটি কারণেই ঘটে না। সকল কারণের সাথে আরো আনুষঙ্গিক নানা কারণ থাকে। বাংলাদেশের নাটক জনমনে প্রতিষ্ঠা লাভ করার, প্রভাব বিস্তার করার একটি ভিন্ন কারণ আছে। স্বাধীনতা পরবর্তী নাট্যচর্চার ধারা বুঝতে গেলে সেই সত্যটাও জানা দরকার। সেই ক্ষেত্রে আমাদের স্বাধীনতার পরের দেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক চেহারাটা বুঝতে হবে। কোনো দেশের শিল্প- সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটক প্রভৃতির পর্যালোচনায় সে দেশের রাজনৈতিক চরিত্রের বিশ্লেষণ অপরিহার্য।
জীবন ধারণের বস্তুগত উপকরণের উৎপাদন পদ্ধতিই সাধারণভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন-প্রক্রিয়াকে নির্ধারণ করে; মানুষের চেতনার দ্বারা তার সত্তা নির্ধারিত হয় না, বরং বিপরীতভাবে তার সামাজিক সত্তাই মানুষের চৈতন্যের নির্ধারক। সামাজিক সত্তা স্বয়ম্মু নয়, সামাজিক সত্তা কতকগুলি সামাজিক সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল। সামাজিক সম্পর্ক বলতে একই সঙ্গে বস্তুগত ও ভাবগত এ দ্বিবিধ সম্পর্কই বুঝতে হবে। এই দ্বিবিধ সম্পর্ক যেমন পরস্পর সাপেক্ষ তেমনি একটি বিন্দুতেও স্থির নয়। নিসর্গ প্রকৃতি, উৎপাদন ব্যবস্থা ও মানুষ-এই তিন সম্পর্ক প্রাচীন কাল থেকে বারেবারেই বদল হয়েছে। নিত্য নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলেছে নিত্য নতুন সমাজ ব্যবস্থা।
আর সেই সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলেছে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি। শিল্পীর স্বভাবকে গড়ে তুলেছে প্রত্যক্ষ প্রভাবে বা পরোক্ষে। শিল্পী সচেতনভাবে সামাজিক ব্যবস্থার দ্বারা প্রভাবিত হতে না চাইলেও সমাজের বাইরে থাকা সম্ভব নয় তার পক্ষে। স্বাধীনতা- উত্তর বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের শুরু এবং তার গতিপ্রকৃতির ধারায় এই বক্তব্য ভীষণ সত্য বলে প্রতীয়মান হবে। বাংলাদেশের রাজনীতি, আইন, দর্শন ও ধর্ম দ্বারা কীভাবে এই নাট্য, আন্দোলন বিস্তার লাভ করে এবং কীভাবে ধীরে ধীরে তা অর্থনৈতিক বন্ধনে বাঁধা পড়ে যায়-নাট্যান্দোলনের সামগ্রিক চেহারাটা বিশ্লেষণ করলেই সেটা খুব পরিষ্কার ভাবে ধরা পড়বে।
নাট্য আন্দোলনের শুরুতে দেশের রাজনীতি ও সামাজিক অবস্থা কীভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিলো সেটাই এখানে দেখার চেষ্টা করবো। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দেশে দেখা গিয়েছিলো চরম অরাজকতা। মানুষের জীবনে নেমে এসেছিলো নানা দুর্ভোগ। বাহাত্তর-তিয়াত্তর সালের দৈনিক পত্রিকাগুলোর কিছু সংবাদের ওপর চোখ বুলালেই সে সময়কার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক চেহারাটা আমাদের কাছে পরিষ্কার হবে।
দৈনিক পত্রিকাগুলোর সে সময়কার নিত্যদিনের সংবাদ ছিলো, ঢাকায় দিনে দুপুরে সশস্ত্র রাহাজানি বেড়েই চলেছে। গ্রাম বাংলায় আগ্নেয়াস্ত্র সজ্জিত দুর্বৃত্তদের অমানুষিক অত্যাচারে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে এবং গ্রাম বাংলার বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের অমানুষিক কাণ্ডকীর্তন সাধারণ মানুষের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। সত্যিকার অর্থেই লুটতরাজ, গুপ্তহত্যা ও ধর্ষণ খুবই বেড়ে গিয়েছিলো। জনস্বাস্থ্যের প্রতি সরকারের ঔদাসীন্যে ওষুধ, খাদ্য ও পণ্য দ্রব্যে ভেজালের রাজত্ব চলছিলো। দেশে আইন শৃঙ্খলা আদৌ আছে কি না তাই নিয়ে জনমনে সন্দেহ দেখা দিয়েছিলো। গ্রামাঞ্চলে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অস্বাভাবিকতার দরুন ঢাকার লোক সংখ্যা তখন দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিলো।
আওয়ামী লীগ সরকারের কার্যকলাপে দেশবাসী তখন ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়ছিলো। মাঝে মধ্যেই তখন থানা বা বিভিন্ন পুলিশ ফাঁড়ি থেকে অস্ত্র লুট হতে থাকে। ভীষণরকম ডাকাতি বেড়ে যায়। একরাত্রে সত্তর বাড়িতে ডাকাতি হবার মতো ঘটনাও ঘটে। দেশের অর্থনীতির অবস্থাও খুব খারাপ হয়ে দাঁড়ায়। আশংকাজনক হারে চোরাচালান ও মূলধন পাচার দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের প্রধান কারণ বলে সে সময়কার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বিবৃতি দেন। ৩* দ্রব্যমূল্য ভীষণভাবে বেড়ে যেতে থাকে।
খাদ্যের অভাব দেখা দেয়। দুর্ভিক্ষে মানুষ না খেয়ে মরতে শুরু করে। সেই সময়কার জনপ্রিয় এক রাজনৈতিক দলের নেতা আ.স.ম. রব এক বক্তৃতায় বলেন, আওয়ামী লীগ ওয়াদা করেছিলো কাউকে না খেয়ে মরতে দেবে না অথচ মানুষ আজ না খেয়ে মরছে। কাপড়ের অভাবে উলঙ্গ।প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা মাওলানা ভাসানী সরকারের কাছে দাবি তোলেন, অন্ন-বস্তু দাও নইলে গদি ছাড়ো। সরকারকে গদি ছাড়ার হুমকি দেন আরো অনেকে।
উপরে উল্লিখিত সংবাদগুলো থেকে স্বাধীনতার পরের দু বছরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা কী ছিলো তার চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। সেই চিত্র কোনো স্বাভাবিক চিত্র ছিলো না। স্বাধীনতার পর মানুষ আশা করেছিলো, পূর্বের সমস্ত শোষণ- বঞ্চনা-নৈরাজ্য শেষ হয়ে নতুন রাষ্ট্র জন্ম নেবে, আর বাস্তবতা ছিলো স্বাধীনতা পূর্ব অবস্থার চেয়েও ভয়াবহ। দেশের সাধারণ মানুষ এমনি পরিস্থিতির জন্য একেবারেই তৈরি ছিলো না। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে সকলের চোখে-মুখে স্বপ্ন ছিলো-দেশ স্বাধীন হলে, পাকিস্তানিদের শাসন-শোষণ থেকে মুক্তি পেলে ‘সোনার বাংলা ভরে উঠবে সোনায়’। ৩৬ দেশের মানুষ বিশেষ করে যুব সমাজ সেই নতুন স্বপ্ন নিয়েই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়।
উনিশশো একাত্তর সালের ডিসেম্বর মাসে যখন পাকিস্তানি সামরিকজান্তা আত্মসমর্পণ করে এবং নতুন সরকার শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, দেশের সর্বস্তরের মানুষ আশা করেছিলো এর ফলে সুখী সমৃদ্ধ একটি দেশ গড়ে উঠবে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতরা খুব শীঘ্রই জনগণের সে আশা আকাঙ্ক্ষার মৃত্যু ঘটালো। জনসাধারণের প্রথমে অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হতে হয়, সেই সাথে মুখোমুখি হতে হয় নানা বিশৃঙ্খলার।
সারাদেশ জুড়ে তখন নৈরাজ্য চলছে, জনগণের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারের নীতি ও কার্যক্রম ব্যর্থ-দিনের পর দিন তখন মানুষের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠছিলো, জনসাধারণের স্বার্থ তখন সরকার রক্ষা করতে পারছিলো না, মুনাফাবাজরা নিজেদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি আরো দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করেছিলো। ০ সমাজতন্ত্র রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য হলেও হতাশা-হাইজ্যাক-ব্লাকমানি ইত্যাদি তখন শহরের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ শব্দ।
সেই প্রেক্ষিতেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা বোধ থেকে রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তির পারস্পরিক সম্পর্ক নবমূল্যায়নের স্পৃহা জাগে যুবমানসে। সে স্পৃহা যে তীব্রভাবে জেগেছিলো এটি ঐতিহাসিক সত্য। আর সে স্পৃহা জেগে উঠেছিলো বলেই নাটকে এক নতুন প্রাণস্পন্দন দেখা দিয়েছিলো। নতুন মাত্রা যোগ হয়েছিলো।
যখন দেশের সরকার সন্ত্রাস, লুটতরাজ ও দুর্নীতির মধ্য দিয়ে দেশকে এক অনিশ্চিত জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেয়, তখন নাটক তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে এগিয়ে আসে। যদিও সে প্রতিবাদ ছিলো মধ্যবিত্তের প্রতিবাদ। মুক্তিযুদ্ধের পর তখন নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে জাতির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এই ঘটনা মানুষের মনে যে হতাশা এবং ক্রোধের জন্ম দেয়, তা থেকেই শিল্প-চিন্তার নতুন উত্তরণ ঘটে। ইউরোপে যেমন বুর্জোয়া ব্যবস্থার ত্রুটিগুলোকে আঘাত করতে গিয়ে, কিংবা চীন-ভারতে চল্লিশের দশকে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে শিল্প উদ্দেশ্যমূলক হয়ে ওঠে, বাংলাদেশেও সেই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি ঘটে স্বাধীনতা-উত্তরকালে। সেই প্রতিবাদের উৎস প্রাথমিকভাবে কলকাতা হলেও পরবর্তী সময় আরো নানা দেশের নাট্য আন্দোলন, নাট্য ব্যক্তিত্বরা তাতে প্রণোদনা যোগালো। পরবর্তী বিভিন্ন অধ্যায়গুলোতে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে।
স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনৈতিক-সামাজিক ঘূর্ণাবর্তেরকালেই গ্রুপ থিয়েটার নাট্যচর্চার আরম্ভ। কিছু লোকের সখ থেকে সেটা শুরু হলেও, পরে তা আর সখের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো না। রাজনৈতিক ঘটনাবলীর নানা অস্থিরতার ভিতর নাটক একটি সামাজিক আন্দোলন হয়ে দেখা দিলো। স্বল্প সময়ের মধ্যে বহু নাটক মঞ্চস্থ হলো রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরীতে। অন্যান্য দু-একটি জেলাতেও।
ঠিক একই ধরনের রাজনৈতিক- সামাজিক ঘৃণাবর্তে আমরা যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পশ্চিমবঙ্গে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন জন্ম নিতে দেখি। বাংলাদেশেও ঠিক তেমনি স্বাধীনতার পরপরই হঠাৎ বহু দল ও বহু ব্যক্তি নাটক মঞ্চায়নে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার মধ্যে কিছু কিছু নাটক হলো, কিছু শুধু রাজনীতি হলো, কিছু হলো শ্লোগান, কিছু আবার কিছুই হলো না। সমকালীন সমস্যা সংঘাতের কিছু চিত্র তুলে ধরলেও পূর্ণতর অভিব্যক্তির দাবি সে পূরণ করতে পারলো না। রাজনৈতিক দিক নির্দেশনার অভাবে সমকালীন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক। অবক্ষয়ের এক ইতিহাস হয়ে রইলো তা।
সখ, আত্মপ্রতিষ্ঠার চিন্তা ও মধ্যবিত্ত-শোষিত জনগণের প্রতি একাত্মবোধ নিয়েই শুরু হয়েছিলো এই নাট্যধারা। নাট্যচর্চার পূর্ণ আয়তন জুড়ে ছিলো মধ্যবিত্তের আশা- আকাঙ্ক্ষা, তথাপি স্বাধীনতা-পূর্ব নাট্যচর্চার প্রেক্ষিতে বিচার করলে নাট্যধারায় এসেছিলো এক বৈপ্লবিক দ্যোতনা। যাঁরা নাটকের ক্ষেত্রে এই নবধারা আনয়নের চেষ্টা করেছেন তাদের মধ্যে প্রধানত একটা সমবোধই কাজ করেছে, আর তা হলো সরকারি প্রশাসনযন্ত্র ও সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো নতুন এক নাট্য পদ্ধতির মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কলকাতার গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ যেমন এক্ষেত্রে প্রেরণা সঞ্চার করেছে, ঠিক তেমনি অনুপ্রেরণা এসেছেন মুক্তিযুদ্ধের অম্লান সব সদর্থক চেতনা থেকে। বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনে পশ্চিমবঙ্গের গ্রুপ থিয়েটারের প্রভাব ছিলো বাইরের শক্তি, কিন্তু বাংলাদেশের মঞ্চ নাটকের রাজনৈতিক চরিত্রটি বুঝতে হলে বিশ্লেষণ করতে হবে অভ্যন্তরীণ এই পটভূমিকে।
বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের কাছে স্বাধীনতা লাভের অর্থ ছিলো, স্বাধীনতা-পূর্বের চেয়ে সচ্ছল জীবন এবং সুখ ও সমৃদ্ধি। স্বাধীন দেশে কোনোরকম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে – চায়নি তারা। সামাজিক রাজনৈতিক দিক থেকে বিশৃঙ্খলা, সরকারের স্বৈরাচারী মনোভাব, বুদ্ধিজীবী ও নেতৃত্বের দোদুল্যমান অবস্থা, চারদিকে নৈরাজ্য, খাদ্যাভাব, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, যুদ্ধোত্তর সময়ের স্বাভাবিক পরিণতি হলেও-যারা নয় মাস যুদ্ধে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখেছে কেন তারা তা মেনে নেবে? বিশেষ করে বাস্তবতা যখন পূর্বের চেয়েও খারাপ অবস্থা ধারণ করে এবং মধ্যবিত্তের দুর্দশা চরমে পৌছায় তখন তাদের কন্ঠ গর্জে উঠতে চায়। স্বাধীনতা-উত্তর কালের নাটক হয়ে ওঠে তাদের সেই কণ্ঠ।
ঢাকার আরণ্যক নাট্যদলের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে তাই মামুনুর রশীদ লিখছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বল্পকাল পরেই যুদ্ধ প্রত্যাগত একদল মধ্যবিত্ত তরুণ যুদ্ধের অভিঘাতজাত নতুন চেতনাকে ধারণ করে ‘আরণ্যক’ প্রতিষ্ঠা করে। দেশের কৃষক শ্রমিকের মত তাদেরও প্রত্যাশা ছিলো, এই মুক্তিযুদ্ধের পরিণতিতে ঘটবে সত্যিকার বিপ্লব; যার ফলে ভূমির পুনর্বণ্টন হবে, সামন্তবাদী কাঠামো পরিবর্তিত হবে এবং দেশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত করবে দেশেরই জনগণ। কিন্তু যখন তারা দেখলো তাদের প্রত্যাশা প্রত্যাশাতেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে, গ্রামীণ সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন হয়নি, দেশের অর্থনীতি বিদেশিদের নিয়ন্ত্রণে রয়ে গেছে এবং স্বাধীনতার সুযোগ গ্রহণ করে একচেটিয়া . মুনাফা লুটেছে সংখ্যালঘু মুৎসুদ্দীরা তখন তারা কিছু একটা করতে চাইলো।
তাদের এই রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মাধ্যম হিসাবে তারা বেছে নিলো নাটককে। ‘ দেখাই যাচ্ছে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অবস্থা যখন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে চরম হতাশা এবং অনৈতিকতার গহ্বরে নিমজ্জিত, মধ্যবিত্তের আশা-আকাঙ্ক্ষা যখন পদদলিত, নাটক তখন তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিলো।
যুদ্ধোত্তর কালে যখন নাগরিক জীবন বিধ্বস্ত, বিধ্বস্ত মূল্যবোধ, প্রতিটি মানুষই ভুগছে এক নৈতিক দ্বন্দ্বে, প্রায় অনিবার্যভাবেই নেমে পড়ছে অধঃপতনের খাদে, সরকার পক্ষ যখন সর্বশক্তি দিয়ে বিরুদ্ধ পক্ষকে খতম করতে উদ্যত, সাধারণ মানুষ যখন তার সামনে অসহায়, কোথাও ন্যায় বিচার নেই, নাটক তখন মধ্যবিত্তের সান্ত্বনা ও সাহস হিসাবে তার পাশে দাঁড়িয়েছিলো। শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে সে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলো। যুদ্ধ বিদাস্ত বা যুদ্ধ পরবর্তী অবক্ষয়-হত্যা-রাহাজানি-ধর্ষণ এসবের বিরুদ্ধে সরাসরি লড়বার শক্তি বা অবস্থা তখন ছিলো না, তাই তাদের প্রতিবাদ ঘোষিত হলো নাটকের মধ্য দিয়ে। যতোটা প্রতিবাদ তার চেয়ে বেশি ক্ষোভ প্রকাশ।
রামেন্দু মজুমদার তাই লেখেন, ‘আমাদের তারুণ্য তার ক্ষোভ, হতাশা, আশা-আকাঙ্খা নিয়ে পাদপ্রদীপের সামনে এসে দাঁড়াল অত্যন্ত দৃপ্ত পদভারে। নাটকের সংলাপ হয়ে উঠলো স্পষ্ট, তীক্ষ্ণ। ‘ ০০ প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের আদর্শ ও অনুপ্রেরণার উৎস ছিলো কলকাতার গ্রুপ থিয়েটাগুলো। এখানে যে ক্ষোভের কথা বলা হচ্ছে তা হলো, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জনমানসে যে স্বপ্ন ছিলো, সে স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার ক্ষোভ।
জাতি রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছিলো না বলেই মুক্তিযুদ্ধের সুফল চলে যায় শোষকশ্রেণীর হাতে। সেক্ষেত্রে গোড়াতেই যে ভুলটা হয়েছিলো তা হলো তখন কেউ খেয়াল করে দেখেনি যে, সমস্ত পাকিস্তানিরা পূর্ববাংলাকে শোষণ করে না, শোষণ করে পাকিস্তানের একটি গোষ্ঠীমাত্র। সে-রকম শোষক গোষ্ঠীর উপস্থিতি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানেও ছিলো। মুক্তিযুদ্ধ শুধু জনগণের সাথে পাকিস্তানি শোষকচক্রের লড়াই ছিলো না। এ লড়াই ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানি ধনিকদের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের ধনিকদের এবং সুবিধাভোগীদের। ব্যবসা বাণিজ্য, সরকারি উঁচুপদ সবই ছিলো পশ্চিমাদের দখলে। সেই দখলদারির বিরুদ্ধেই এখানকার তুলনামূলক কম সুবিধাভোগীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে।
সেই সুবিধাভোগীরা যখন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন, তখন তাঁদের সকলে জনগণের স্বার্থের কথা ভেবে তা করেননি। দেশকে স্বাধীন করার মধ্য দিয়ে তাঁদের অনেকেই নিজেদের ভাগ্য সুপ্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। সেজন্য দেখা যায় দেশ স্বাধীন হবার পরও বহুলোক না খেয়ে মরছিলো, নানারকম নিপীড়ন চলছিলো।
কিন্তু সেইসব সুবিধাভোগী লোক যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বা প্রথম সারিতে ছিলেন, যুদ্ধ শেষে তাঁরা কী করলেন? তাঁদের একদল ক্ষমতা দখল করলেন-মন্ত্রী-সাংসদ হলেন, অন্যদল বীর উত্তম, বীর বিক্রম প্রভৃতি বড় বড় খেতাব পাওয়ার পর নিজ নিজ পুরানো পেশায় ফিরে গেলেন। তাঁরা পূর্বের চেয়ে অধিক সুবিধাপ্রাপ্ত পদ ও ক্ষমতায় আসীন হলেন। দেশ স্বাধীন হয়েছে, তাঁদের ভাগ্য পাল্টেছে। যাদের ভাগ্য পাল্টায়নি তাদের কথা তাঁরা একবারও ভাবলেন না। যাঁরা সবাই একই লক্ষ্যে পরিচালিত একটি মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন, দেখা গেল নিজের নিজের সুবিধাটুকু নিয়ে অনেকেই সে মিছিল থেকে বের হয়ে গেলেন।
ইতিহাসে লড়াই কখনো থেমে থাকে না। কখনো বন্ধ হয় না। ইতিহাসের অগ্রগতির প্রয়োজনে এক লড়াইয়ের পর আর এক লড়াই অনিবার্য হয়ে ওঠে। যারা এক থাকে তারা ভেঙে দুই হয় এবং পুনরায় ইতি এবং নেতির দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ইতিহাসের প্রয়োজনেই এক ভেঙে দুই হতে বাধ্য। ফরাসী বিপ্লবেও তাই দেখি। যাঁরা ঐক্যবদ্ধভাবে ফরাসী বিপ্লবের প্রথম পর্বে অংশ নিয়েছিলেন, দ্বিতীয় পর্বে সেই বিপ্লবী শক্তি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে নতুন ইতি ও নেতির জন্ম দিলেন। জিরন্দিনরা ইতির প্রতিনিধি; তাঁরা বিপ্লবলব্ধ অধিকার যেমন আছে তেমন রাখার পক্ষপাতি। জ্যাকোবিনরা যতোটুকু পাওয়া গেছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে রাজি নন; বিপ্লবের কাজ আরো বহুদূর নিয়ে যেতে তাঁরা প্রস্তুত।
সব বিপ্লবকেই আসলে একদল লোক অর্ধ পথে থামিয়ে দিতে চায়। যারা সমাজ পরিবর্তনের জন্য ঐক্যবদ্ধ লড়াই আরম্ভ করে তাদের একটি অংশ নিজেদের সুবিধাটুকু পেয়েই আর আগাতে চায় না, অপর পক্ষের সাথে দ্বন্দ্ব তখন অনিবার্য হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও আমরা তাই দেখি।যাঁরা সুবিধা পেলেন না বা সুবিধা পেয়েও নিলেন না স্বভাবতই বাকিদের সাথেতাদের এক দীর্ঘ বিরোধ শুরু হলো। স্বাধীনতার পূর্বে যাঁরা ছিলেন পরস্পরের বন্ধু স্বাধীন দেশে তাঁরা পরস্পরের শত্রু হয়ে দাঁড়ালেন। নতুন ধরনের এক শ্রেণীঘৃণার জন্ম হলো, স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন নাট্যধারায় সেই ঘৃণারই প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়।
সময়টা তখন বিরূপ। অনেক রক্ত এবং অশ্রুর পর দর্শকদের মানসিকতা তখন ছিন্ন- ভিন্ন। রাজনৈতিক সামাজিক অবস্থার একটি ক্রান্তিকাল চলছিলো। মানুষ অস্থির, কোথায় স্থিরতা নেই, কোথাও নিশ্চয়তা নেই। সেই অস্থির সময়েই নাট্যচর্চার শুরু বা নাট্য আন্দোলনের জন্ম। সে আন্দোলন কোনো সমাজবিজ্ঞান চেতনা থেকে আরম্ভ হয়নি। এর পেছনে কোনো মার্কসীয় বা শ্রমিকশ্রেণীর রাজনীতি ছিলো না। ছিলো শুধু মধ্যবিত্তের হাহাকার আর হতাশা। শাহরিয়ার কবির লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের কাছে
যুদ্ধোত্তর হতাশা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে-এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই’। বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের নাট্য আন্দোলন তাই যুদ্ধ বিধ্বস্ত হতাশার ফসল। যুদ্ধ বিধ্বস্ত হতাশার মধ্যেই তার জন্ম। মোকাররম হোসেন চুয়াত্তর সালে এক প্রবন্ধে লেখেন, একটা অভিযোগ আমাদের সবকটি গোষ্ঠী সম্পর্কেই সোচ্চার যে এরা যুদ্ধোত্তর হতাশা, নৈরাজ্য নিয়েই ব্যস্ত থেকেছে। বেশির ভাগ গোষ্ঠী অবক্ষয়ের চিত্রই তুলে ধরেছে মাত্র।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত এই হতাশার মধ্যে পুরানো থিয়েটারের কাছে সঙ্গত দাবি এলো পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াবার। শহুরে তরুণদের সেই বাঁধভাঙা উন্মত্ততার সামনে প্রচলিত নাটকের টিকে থাকবার মতো কোনো শক্তি ছিলো না। স্বাধীনতার পর যে অবক্ষয় প্রকাশ পাচ্ছিলো মধ্যবিত্ত মানুষ ত্রাণ খুঁজছিলো তার থেকে। নাটক যেন সেই সময়ে তাদের প্রতিবাদের ভাষা হয়ে পাশে এসে দাঁড়ালো। কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে, কোনো সচেতন রাজনৈতিক প্রক্রিয়া হিসাবে যেমন এর জন্ম নয়, তেমনি কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচী এ নাট্যচিন্তায় ছিলো না।
দীর্ঘদিনের নাট্যমঞ্চের জড়তা, স্থূলতা, পৌনঃপুনকিতা এই নতুন নাট্য আন্দোলনের প্রভাবে ভেসে গেল। যাঁরা এই নাট্যচর্চার সাথে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন তাঁরা ছিলেন জাতির খুবই ক্ষুদ্র অংশ। নাট্য আন্দোলন বা নব নাট্যচর্চার সাথে সম্পৃক্ত হয়েছিলো রাজধানী ঢাকা ও বিভিন্ন শহরের একটি অংশের মানুষ। সারাদেশ বা সারাদেশের জনগণ এর সাথে ছিলো না।
যুব সমাজের এক অংশকে তা মাতিয়ে তুললো। দেশকে নৈরাজ্য থেকে বাঁচানোটাই হয়ে উঠেছিলো তাঁদের প্রাথমিক দায়িত্ব, আবার নৈরাজ্যের পথ ধরেই এগিয়েছিলেন তাঁদের অনেকে। কোনো সুস্থ চিন্তার লক্ষণ সেখানে আমরা কমই দেখতে পাই। নাটক একই সাথে হলো তাদের আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই, প্রতিবাদের ভাষা ও নিজেদের প্রচারের মাধ্যম এবং বিনোদন লাভ ও বিনোদন বিতরণেরও উপায়। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যেহেতু এটা ছিলো এক নতুন ও উদ্দীপ্ত করার মতো ঘটনা, তাই তা ব্যাপক প্রচার পেলো সংবাদ মাধ্যমগুলোর। শহুরে সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষ নাটক সম্পর্কে উৎসাহী হলো। নতুন নাট্যধারা তাদের সচকিত করলো। প্রচার ও নতুনত্বের গুণে দর্শকদের আশীর্বাদ পুষ্ট হলো তা।
দর্শকদের আশীর্বাদ লাভ করেছিলো, কারণ নাটকের সাথে একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন জড়িত ছিলো। সে রাজনীতি কোনো দলবাজি নয়, ঝাণ্ডা নিয়ে লড়াই নয়, মার্কসীয় চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত নয়। শ্রমিকশ্রেণীর বা নিম্নবর্গীয় মানুষের মুক্তির প্রশ্নও সেখানে ছিলো না। সেটা ছিলো মানুষের দৈনন্দিন সমস্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। মধ্যবিত্ত জনতার কাম্য বক্তব্য নিয়ে নাটক জনতার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো।
মধ্যবিত্তের চিত্তে তাই দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো এই নাট্যচর্চার আসন সেই নৈরাজ্যের দিনগুলোতে। তবে কোনোভাবেই আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, সেটা ছিলো শহুরে মধ্যবিত্তদের দাবি-দাওয়ার লড়াই। ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণ সেখানে ছিলো না। সত্যিকার কোনো সমাজ পরিবর্তনের রাজনৈতিক আন্দোলন সেটা ছিলো না। শ্রমিকশ্রেণী বা গণমানুষের মুক্তি নয়, মধ্যবিত্তের মুক্তির জন্য লড়ছিলো নাটকের দলগুলো। ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়াই প্রচারের জোরেই সেটা আন্দোলন হয়ে দাঁড়ালো। নাটকের আঙ্গিক ও গুণের বিচারে নিঃসন্দেহে সেটা আন্দোলন ছিলো। তবে নাটকের বক্তব্য ও ব্যাপক মানুষের অংশগ্রহণের প্রশ্নে তা খুবই ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো।
নাট্য আন্দোলন যখন শুরু হয় তখন সবাই সেটাকে ইতিবাচকভাবে দেখলেও প্রথম থেকেই নানারকম প্রশ্নও দেখা দিয়েছিলো। যেমন আনু মুহাম্মদ ছিয়াত্তর সালে লিখছেন, নাটকের অগ্রযাত্রাকে আন্দোলন বলে অভিহিত করবার আগেই ভাববার প্রয়োজন আছে যদি এ নাটক-স্রোত আন্দোলন হয় তবে নাট্যকর্মীরা এই আন্দোলন কী জন্যে, কাদের জন্যে করতে চাইছেন? কী তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য? তিনি লিখছেন, বর্তমানে দর্শক এবং পরিধি দুদিক থেকেই নাটক সীমিত পরিসরে আবদ্ধ। বর্তমানে যেসব নাটক পরিবেশিত হচ্ছে সীমিত পরিসরে সেগুলোর চরিত্র প্রশ্নাতীত নয় তবে সামাজিক দ্বন্দের প্রকাশ আমরা সেগুলোতে দেখতে পাই।
সামাজিক শ্রেণীগত দিক থেকে বিচ্ছিন্নতা এবং সীমাবদ্ধতার কারণে সেসব নাটক কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমাপ্ত, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত। তিনি দেখাচ্ছেন যে, আধা সামন্ত ও আধা পুঁজিবাদী সামাজিক কাঠামোতে দেশের মানুষ সর্বত্র প্রতারিত এবং কোটিকোটি মানুষ শোষিত ও বঞ্চিত; যারা নিজেরা মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে না এবং শাসকশ্রেণীর যাঁতাকলে যারা পিষ্ট।
নাটককে যদি সত্যিকার নাট্য আন্দোলন হয়ে উঠতে হয় তাহলে সেইসব শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই হবে। কিন্তু সমসাময়িক নাটক শোষিতদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না।তিনি সেই একই প্রবন্ধে আরো লিখছেন, ‘বর্তমান নাটকের ধারায় কিছু কিছু দিক আমার কাছে দুর্বলতা বলে মনে হয়েছে, যেমন-নাট্যঅঙ্গনে বেশ কিছু গোষ্ঠী নাটককে শুধুমাত্র বিনোদনের মাধ্যম হিসাবে ধরেছেন-তারা এটাকে আন্দোলন বলছেন না; বললেও তা অন্য অর্থে বলছেন। তিনি আরো লিখছেন, ‘সবচেয়ে গুরুতর দুর্বলতা যেটি আমি মনে করছি সেটা হচ্ছে কোনো কোনো গোষ্ঠী ও বহুসংখ্যক কর্মীর মধ্যে আদর্শ এবং লক্ষ্যের অভাব কিংবা আদর্শ ও লক্ষ্যের বিচ্যুতি।
বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলন যখন শুরু হয়, সত্যিই তখন তার কোনো সুনির্দিষ্ট চেহারা ছিলো না। সেই সময়ের নাট্যচর্চা সম্পর্কে তাই বশীর আল্হেলাল লিখছেন, স্বীকার করতেই হবে পরিস্থিতির বহুল পরিবর্তন হয়েছে। সেই সঙ্গে এ-কথাও স্বীকার করতে হবে নাটকের নব-সম্ভাবনার কোনো লক্ষণও লক্ষ্যগোচর নয়। তিনি সে সময় নাট্যচর্চা সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে আরো লিখছেন, ‘বাহাদুরী করা হয়। বলা হয়, “বাংলাদেশের নাটকের অঙ্গনে বিদ্রোহ এসেছে। তারুণ্যের দীপ্ত স্পর্শ লেগেছে। আধুনিক আঙ্গিকের নাটক মঞ্চায়ন করার একটা উল্লেখযোগ্য প্রয়াস আমাদের এখানে ক্রমবর্ধমান। সুবাতাস বইছে। নতুন চিন্তাভাবনা নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্ম হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যচক্র ঢাকার নাট্য জগতে রীতিমতো বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল।” ইত্যাদি। ঢাকার নাট্যজগতে নাটক কোথায় যে তার বিদ্রোহ ও বিস্ফোরণ ঘটল? নাটকের কোনো ঘুণ-ধরা প্রাচীন পতিত ইমারত কি এখানে আছে যে বিদ্রোহ ও বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তার পতন ঘটাতে হবে? আগে একটা মোটামুটি ইমারত গড়ে উঠুক, তারপর বিদ্রোহ ও বিস্ফোরণের চিন্তা। ‘
বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের প্রথম পর্বের নাটকের বিষয়বস্তু ও সামগ্রিক দিকটি নিয়ে অনেকেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। থিয়েটার পত্রিকায় তিয়াত্তর সালেই অসীম সাহা লিখছেন, ‘স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের নাট্যচর্চার একটি তীব্রতম প্রবাহ লক্ষ্য করা গেলেও, তা আপাত চমকে যতখানি আলোড়নে সমর্থ, নাট্যিক গুণাগুণের যথাযথ প্রতিফলনে ততখানি নয়। বিশেষত টেকনিক্যাল প্রয়োগনিপুণতার দিকে বর্তমান নাট্যকারদের আগ্রহ অত্যন্ত বেশি বলেই মনে হয়। ‘ নুরুল করিম নাসিম লিখছেন, ‘অনেকের ধারণা বিশ্ববিদ্যালয় যেমন স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার, তেমনি নাট্য আন্দোলনেরও সূচনা হবে সেখান থেকে।
রাজনৈতিক আন্দোলন এবং সাহিত্য বা শিল্প আন্দোলন দুটি বিপরীত ধর্মী বিষয়। একটি আবেগকে পুঁজি করে, বিশেষ একটি সময়কে ভিত্তি করে, কিছু ছলাকলা আশ্রয় করে, রাজনীতির আন্দোলন গড়ে তোলা যায়, কিন্তু সাহিত্য বা নাট্য আন্দোলন নয়। সাহিত্য বা নাট্য আন্দোলন নিছক আবেগ নয়, আন্তরিকতা, অভিজ্ঞতা এবং আরও কিছু অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ প্রয়োজন। শাহরিয়ার কবির সে সময়েই নাট্যকারদের শ্রেণীদৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি দেখান যে শ্রেণীবিভক্ত সমাজে কোনো ব্যক্তিই শ্রেণীস্বার্থের উর্দ্ধে নয়। তাই তাদের শিল্পকর্মও কোনোভাবেই শ্রেণীস্বার্থের উর্দ্ধে অবস্থান করতে পারে না। হয় তাকে বুর্জোয়াশ্রেণীর পক্ষে নতুবা প্রলেতারিয়েতশ্রেণীর পক্ষে দাঁড়াতে হবে। স্বাধীনতার পরপর বাংলাদেশের নাট্যকর্মীদের এ ব্যাপারে কোনো স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা সুনির্দিষ্ট চিন্তা ছিলো না। বরং নানা ধরনের বিভ্রান্তিই লক্ষ্য করা গেছে।
নাট্যকর্মীদের সম্পর্কে তাই শাহরিয়ার কবির লিখছেন, ‘বুর্জোয়া শিল্পকর্মী শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে অহরহ যে ধুম্রজাল সৃষ্টি করে চলেছেন আমাদের অধিকাংশ শিল্পীই সেই ধারণা থেকে মুক্ত নন। এঁরা কখনও বলেন, শিল্পের জন্য শিল্প, কখনও মানুষকে ভালোবাসার জন্য শিল্প রচনা করেন, কখনও রাজনীতি নিরপেক্ষ শিল্প সৃষ্টি করেন, কখনও বাস্তবতার হুবহু প্রতিফলনকে শিল্প বলেন, কখনও বা বলেন, বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যই হচ্ছে শিল্প বিচারের মাপকাঠি। আসলে এঁরা প্রত্যেকেই প্রতিক্রিয়াশীল শিল্পের কর্মী যারা প্রগতির বিপরীতে কাজ করে যাচ্ছেন। ‘ঢাকার বাইরেও বাংলাদেশের সর্বত্র একই ব্যাপার ঘটেছিলো। নাট্য আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত একজন নাট্যকার নুরুল করিম নাসিম তিয়াত্তর সালেই লিখছেন, ‘এটা আনন্দের এবং আশার বিষয় প্রচুর নাটক হচ্ছে কিন্তু সত্যিকার অর্থে আন্দোলন শুরু হয়নি, শুরু হয়েছে আলোড়ন।
এই আলোড়ন এবং আবেগ আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে আমরা জানি না।’ বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলন প্রশংসার পাশাপাশি এভাবেই সমালোচিত হয়ে আসছিলো নানা দিক থেকে। যেমন আটাত্তর সালে রামেন্দু মজুমদার লিখছেন, ‘স্বাধীনতা-উত্তরকালে নাট্য প্রযোজনার ক্ষেত্রে আশাতীত কর্মতৎপরতা পরিলক্ষিত হয়েছে, কিন্তু নাট্যরচনার ক্ষেত্রে আমাদের দারিদ্র্য তেমন একটা ঘোচেনি। সোজা ভাষায় যে হারে বা মানে আমাদের দেশে নাটক অভিনীত হচ্ছে তার সাথে তাল মিলিয়ে ভালো নাটক রচিত হচ্ছে না।
সমালোচনাগুলো অনেক সময় খুব কঠোর প্রকৃতির হলেও তার মধ্যে বহু সত্য ধরা পড়েছে। নাট্যচর্চার শুরুতে যেমন কোনো ধরনের কোনো দিক নির্দেশনা ছিলো না, ঠিক তেমনি তা মহিলা সমিতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। নাট্যকর্মীরা তখন সত্যিকার অর্থেই জানতেন না তাঁরা আসলে কী চান। নাটক করার পেছনের মূল লক্ষ্যটা তখনো তাঁরা নির্ধারণ করতে পারেননি। কাদের জন্য নাটক করবেন সে ব্যাপারেও তাঁদের কোনো স্বচ্ছ ধারণা ছিলো না। যে-কোনো আন্দোলন শুরু করার পূর্বে একটা সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা থাকা দরকার, একটা লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্থির করা দরকার। সে আন্দোলনকে এগিয়ে নেবার জন্য কাজের পদ্ধতি কী হবে সে ব্যাপারেও ভাবনা চিন্তা করা দরকার।
বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনে সেটা কখনও দেখা যায়নি। ইতিহাস স্বাক্ষী দেয়, বাহাত্তর সালের নাট্য আন্দোলনকারীরা নাট্য রচনার যে ধারা জন্ম নেয় তার পেছনে বিজ্ঞান চেতনা না থাকায় তা খুব দ্রুত হারিয়ে গেল। সামান্য হৈ চৈ ফেলে ইতিহাস থেকে বিদায় নিলো। নাটকগুলো পরবর্তীকালে আর মঞ্চায়ন হতে দেখা যায়নি। প্রকৃত ঘটনা হলো এই যে, মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধ পরবর্তীকালের নানা ঘটনাবলীকে ঘিরে ইতিহাসের একটা অনিবার্য পরিণতিতে ভিন্ন পথে চলতে শুরু করেছিলো পুরানো নাট্যধারা। কিন্তু তখনো তার মূল চরিত্রটি নির্ণিত হয়নি।
সত্তর দশক পর্যন্ত নাট্য দলগুলো কোনো সংঘের অধীন না থেকে যার যার মতো নাটক করে যাচ্ছিলো। নাটকের দলগুলোর এক লক্ষ্যে কাজ করার উদ্যোগটি প্রথম দেখা যায় আশির দশকে। সেসময়ই সারা বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটারগুলোকে নিয়ে গড়ে ওঠে ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান’। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের নাট্যচর্চার প্রায় দশ বছর পর গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের জন্ম হয়। নাটকের দলগুলো সেই সময় থেকে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে। ফেডারেশানের অধীনে তারা নানা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বা আন্দোলনে অংশ নেয়। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান গঠনের পেছনে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যটি কী ছিলো সেটা বোঝা যায় না।
গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের দলিলপত্র বা ঘোষণাপত্রে নাট্যদলগুলো কী ধরনের আন্দোলন বা কর্মসূচী নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলো, সে সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছুই বলা হয়নি। ঘোষণাপত্রের মূল যে বক্তব্য ছিলো তা হলো, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিপূরক হিসাবে জন্ম নিতে থাকে গ্রুপ থিয়েটার। সমসাময়িক ঘটনা প্রবাহকে উপজীব্য করে সামাজিক ক্রিয়ায় সে অংশগ্রহণ করতে থাকে।
ফলে নাটক ক্রমশ হয়ে ওঠে একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের চরম অনীহার ফলে নাটকের পরবর্তী বিকাশ রুদ্ধ হয়ে উঠেছে। সেইজন্যই প্রয়োজন আজ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। আর সে আন্দোলনের প্রয়োজনেই বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান। ফেডারেশান আরো ঘোষণা দেয়, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানকে হতে হবে গ্রুপ থিয়েটার ও নাট্যকর্মীদের এক শক্তিশালী সংগঠন যার মাধ্যমে তাদের অভিন্ন স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট আশা-আকাঙ্ক্ষার পূর্ণ প্রতিফলন সম্ভব হবে। নাটক মঞ্চায়নের কোনো লক্ষ্য বা আদর্শের কথা এখানে বলা হয়নি। গ্রুপ থিয়েটার কী ধরনের নাটক মঞ্চায়ন করবে সে ব্যাপারে ফেডারেশানের ঘোষণাপত্র নীরব।
যদি আমরা বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করি তাহলে তার সাথে রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার কোনোই মিল খুঁজে পাবো না। সংক্ষিপ্ত ঘোষণাপত্র ও উদ্দেশ্যাবলীর মধ্যে কোথাও ‘রাজনৈতিক’ শব্দটাও উচ্চারণ করা হয়নি। যদি গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের গঠনতন্ত্র পাঠ করা হয়, পাঠকদের বুঝতে অসুবিধা হবে না, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের মূল লক্ষ্য ছিলো নিয়মিত নাট্যচর্চা ও নাটককে ব্যাপক সামাজিক ক্রিয়ার সাথে যুক্ত রাখা।
সামাজিক ক্রিয়া কথাটিরও কোনো নির্দিষ্ট অর্থ দাঁড়ায় না। সবকিছুই সামাজিক ক্রিয়া। পশ্চিমবঙ্গে যাঁরা গণনাট্যের রাজনৈতিক আন্দোলন বা শ্রেণীসংগ্রাম থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন, তারাও নাটককে সামাজিক আন্দোলন বা সামাজিক ক্রিয়া হিসাবে দেখেছেন। সামাজিক আন্দোলন বললে রাজনীতি থেকে সরে থাকা যায় যা আমরা পশ্চিমবঙ্গে দেখেছি। সামাজিক আন্দোলনগুলো অনেক সময়ই শাসকদের বিরুদ্ধে যায় না কিংবা শ্রেণীসংগ্রামের প্রশ্নে তা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে।
রাজনৈতিক নাট্যচিন্তায় নাট্যদলগুলোর কোনো নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের সুযোগ নেই। নিঃসন্দেহে এ কথা সত্যি, গণতান্ত্রিক মূলাবোধের চর্চা এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের আন্দোলনে নাট্যকর্মীদের মাঠে নেমে পড়ার পেছনে মূল প্রেরণা ও শক্তি ছিলো বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন। তা সত্ত্বেও গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের ঘোষণা বা গঠনতন্ত্রের কোথাও সমাজ পরিবর্তন, শ্রেণীসংগ্রাম বা কোনো রাজনৈতিক সংগ্রামের কথা বলা নেই কেন, সেটাও একটা প্রশ্ন। রাজনৈতিক প্রশ্নটি তুললে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের চরিত্রটি বোঝা সহজ হতো যে, শ্রেণীসংগ্রাম বা শোষণ বঞ্চনা ও শাসকশ্রেণী সম্পর্কে তাদের মতামতটি কী কিংবা কোন শ্রেণীর পক্ষে তারা।
গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান আদৌ শ্রেণীসংগ্রামের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসাবেই নাটককে দেখেনি যদিও গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান জন্মের কিছু পূর্বে এবং পরবর্তীতে গ্রুপ থিয়েটারের সদস্যভুক্ত বহু দলই নাটককে শ্রেণীসংগ্রামের হাতিয়ার বলে ঘোষণা দেয়। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের লক্ষ্য ও কর্মসূচীতে এর কোনো প্রভাব পড়েনি।
বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের দীর্ঘদিনের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করার পর সংগঠনের দুর্বলতার বিশেষ যে দিকটি চোখে পড়ে তাহলো, গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন কী, বা গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন বলতে কী বোঝায় সে ব্যাপারে তাদের কোনো বক্তব্য ছিলো না। যদিও ফেডারেশানের উদ্দেশ্যের মধ্যে বলা হয়েছিলো, ‘গ্রুপ থিয়েটারের আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রামকে সংহত করা’। কিন্তু ফেডারেশানের লক্ষ্য বা গ্রুপ থিয়েটারের আদর্শ কী সে সম্পর্কে সেখানে কিছুই বলা হয়নি। ফেডারেশানের নেতৃত্ব যেমন এ ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো মতামত রাখতে পারেনি, তেমনি নাট্যদলগুলো। সে কারণেই ‘গ্রুপ থিয়েটার নাট্যচর্চা’ বা ‘গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন’ যে কী সেটা বুঝে ওঠা যেমন কষ্টসাধ্য তেমনি বিভ্রান্তিকর।
বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটারের প্রধান একটি উৎস পশ্চিমবঙ্গের গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন হলেও, বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন কখনো পশ্চিমবঙ্গের মতো ব্যাপক আকার নিতে পারেনি। জনগণের ব্যাপক অংশের সাথে তার কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়নি। মধ্যবিত্তের আশা-আকাঙ্খা ও মধ্যবিত্তের জগতের মধ্যেই তা শুধু ঘুরপাক খেয়েছে। কিছু কিছু দল রাজনীতির কথা শ্রেণীসংগ্রামের কথা বললেও এই নাট্যধারা আটকে ছিলো একটি গণ্ডির মধ্যে।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের যে নাট্যচর্চা সেটা পশ্চিমবঙ্গের অনুসারী হয়েছিলো মূলত ভঙ্গির ক্ষেত্রে, সামগ্রিক চিন্তার ক্ষেত্রে বা বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে ততোটা নয়। মনে রাখতে হবে, প্রযোজনা ভঙ্গি শুধু আপাত চমক সৃষ্টি করে। যদি উপযুক্ত বিষয়বস্তু সেই ভঙ্গির সাথে যুক্ত না হয় তাহলে সে প্রযোজনা ভঙ্গিসর্বস্ব হয়ে দাঁড়ায় এবং ভঙ্গিসর্বস্ব প্রযোজনা থেকে দর্শক খুব শীঘ্রই মুখ ফিরিয়ে নেয়। বাংলাদেশের নাট্যচর্চার ইতিহাসে এই সত্যটা আমরা বারবার লক্ষ্য করবো। পশ্চিমবঙ্গে নবান্ন প্রযোজনা যে নতুন ভঙ্গির প্রবর্তন করেছিলো সেই ভঙ্গির পাশাপাশি নতুন নতুন বিষয়বস্তুর আবির্ভাব পশ্চিমবঙ্গের নাট্যচর্চাকে দীর্ঘদিন সজীব রেখেছিলো। পশ্চিমবঙ্গের নাটকে বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য যেমন ভঙ্গিকে আরো উন্নত করেছিলো তেমনি আশির দশকের শুরু পর্যন্ত একটানা চল্লিশ বছর পশ্চিমবঙ্গের নতুন নাট্যধারা ক্রমশই নিজের শ্রীবৃদ্ধি করেছিলো।
পাশাপাশি দেখা যায়, বাংলাদেশের নাট্যচর্চা যতোই মাথা তুলে দাঁড়াতে চেষ্টা করুক না কেন কখনই তা সফলকাম হয়নি। প্রধান কারণ হচ্ছে বিষয়বস্তুর দুর্বলতা। বিষয়বস্তুর দুর্বলতাই নাটককে খুব বেশি দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে দেয়নি। বিশ্ব-রাজনীতিতে প্রতিবাদী নাটক বিরাট গুরুত্ব বহন করলেও বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় সবসময় তা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো চর্বিতচর্বণ। যে-কোনো প্রসঙ্গেই সেখানে প্রতিবাদটাই মুখ্য, সমাজ বিশ্লেষণ নয় কিংবা রাজনীতি বিশ্লেষণ নয়। বাংলাদেশে প্রতিবাদী নাটক তাই চর্বিতচর্বণ হয়ে দ্রুত দর্শক হারিয়ে ফেললো। প্রেক্ষাগৃহ ফাঁকা যেতে থাকলো। নাট্যকর্মীদের মনে হতাশা বাসা বাঁধতে লাগলো। সে-সময় জাতীয় নাট্য বিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে আসা তরুণরা কিছুদিন নাট্যাঙ্গনের বিভিন্ন গ্রুপের হাল ধরলেন।
বাংলাদেশের আশির দশকের নাট্যচর্চায় আমরা দেখবো ভারতের জাতীয় নাট্য বিদ্যালয় থেকে সনদপ্রাপ্ত বাংলাদেশের কিছু যুবক নাট্যাঙ্গনের কর্মকাণ্ডে ভীষণ প্রভাব ফেলেন। যাঁরা নাট্য-প্রযোজনায় মঞ্চসজ্জা ও আলোর প্রক্ষেপণকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলেন। তাঁদের নির্দেশিত নাট্যধারায় চিৎকার-চেঁচামেচি এবং কোরিওগ্রাফ-এর ব্যাপক ব্যবহার চললো। বিষয়বস্তুর দৈন্যদশা ও নাট্য প্রযোজনার দুর্বলতা ঢাকতে গিয়েই এ সময়ে মঞ্চসজ্জা ও আলোর বাড়াবাড়ি শুরু হয়, আর সেইজন্য ভারতের জাতীয় নাট্য বিদ্যালয়ের স্নাতকধারীরা খুব গুরুত্ব পান। প্রথম ঢাকায়, পরে ঢাকার বাইরের নাট্যচর্চায় ধীরে ধীরে এঁরা বিভিন্ন দলের নাট্য পরিচালনারও দায়িত্ব নেন। সবকিছুই এঁরা করেন পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের চরিত্র নষ্টে এঁদেরও একটি ভূমিকা আছে।
জাতীয় নাট্য বিদ্যালয় থেকে যাঁরা প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছিলেন তাঁরা কোনো আদর্শ নিয়ে নাট্য আন্দোলনে যোগ দেননি। নাট্য আন্দোলনকে তাঁরা তাঁদের প্রতিষ্ঠার সিঁড়ি হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন মাত্র। যাঁরা সাথে করে এনেছিলেন নাট্য বিদ্যালয় থেকে শেখা কিছু নিয়মকানুন। যাঁদের মূল লক্ষ্য ছিলো নাটক করতে পারা এবং সেটা বেঁচে থাকার জন্য। নাটক করাটাকে তাঁরা জীবিকা বা অর্থ লাভের উপায় হিসাবেই দেখেছেন।
দীর্ঘদিন পর্যন্ত নাট্যচর্চা ছিলো ‘নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’। নাটক করাটাকে সবাই সামাজিক দায়িত্ব হিসাবেই ভাবতে অভ্যস্ত ছিলেন-যাঁরা মনে করতেন সমাজ পরিবর্তনের জন্য কিংবা সামাজিক আন্দোলনের জন্য নাটক এবং সে আন্দোলনের সেও একজন সদস্য। কিন্তু জাতীয় নাট্য বিদ্যালয়ের শিক্ষিতরা বোঝাতে চাইলেন, নাটককে গ্রহণ করতে হবে পেশা হিসাবে। পশ্চিমবঙ্গের বা বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের মূল ভাবনার সাথে জাতীয় নাট্য বিদ্যালয়ের স্নাতকধারীদের বক্তব্য ছিলো বিপরীত।
দিল্লির নাট্য বিদ্যালয় থেকে প্রত্যাগতরা নাট্য আন্দোলনের সুরটাই কেটে দিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বহুজনের কাছে নাট্য আন্দোলন সখের ব্যাপার বা আত্মপ্রতিষ্ঠার সিড়ি হলেও, অনেকের কাছে এ নাট্য আন্দোলন ছিলো সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার। বিশেষ করে আশির দশক থেকে দেশ-জাতি-সমাজ-মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য নাট্য আন্দোলনের বহু কর্মী নিজেদের নিবেদিত করতে চেয়েছিলেন।
নাট্য আন্দোলন ছিলো তাঁদের কাছে রাজনৈতিক আন্দোলনের মতোই। রাজনৈতিক কর্মী বা রাজনৈতিক দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য যাঁরা মাঠে নামেন, আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন, তাঁরা যেমন এটা তাঁদের আত্মত্যাগ বা সামাজিক দায়িত্ব হিসাবে গ্রহণ করেন-নাট্য আন্দোলনের বহু কর্মী সেই পথেই আগাচ্ছিলেন, সে তাঁদের চিন্তায় কাজে যতোই ভুল থাক না কেন।
নাট্য আন্দোলনে তাঁরা নিজেদের যুক্ত করেছিলেন অর্থনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য নয়; সামাজিক আন্দোলনে নিজেদের সম্পৃক্ত করার জন্য। কোনো পেশা হিসেবে নয়, নিজের বিভিন্ন কাজের বাইরে, পেশার বাইরে দেশের জন্য কিছুটা নিঃস্বার্থ সময় দিতে চেয়েছিলেন নাট্য আন্দোলনের সাথে যুক্ত থেকে। বিশেষ করে বহু সাধারণ নাট্যকর্মী, নাটকটা ভালো না বুঝলেও কিছুটা ত্যাগ-তিতিক্ষা তাঁদের ছিলো। অথচ জাতীয় নাট্য বিদ্যালয় থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্তরা পেশাদারিত্বের প্রশ্ন তুলে সেই নিঃস্বার্থ আন্দোলনকে নাট্যকর্মীদের খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার পথে ধাবিত করার চেষ্টা করলেন।
দীর্ঘদিন ধরে যে নাট্য আন্দোলন সামাজিক আন্দোলন হিসাবে দেখা গিয়েছিলো, এখান থেকেই তার বিচ্যুতি শুরু হয়। জাতীয় নাট্য বিদ্যালয় থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্তরা তাদের মূল লক্ষ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণার অভাবে বিভিন্ন পেশার মতো এটাকেও একটি পেশা হিসাবে দেখতে চাইলেন, যা শুধু মানুষের খাওয়া-পরাই নিশ্চিত করে। নাট্য আন্দোলন বা যে-কোনো আন্দোলনই একটি দায়িত্ব, ব্যক্তিগত খাওয়া-পরার চেয়ে তা উচ্চতর ব্যাপার। মানুষ সেখানে একটি উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সমবেত হয়।
সেই উদ্দেশ্য সাধনটাই এখানে প্রধান, ফরাসী বিপ্লব যেমন। সেখানে যাঁরা আন্দোলনে নেমেছিলেন সেটা তাঁদের পেশা ছিলো না, উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই তাঁরা মিলিত হয়েছিলেন। যাঁরা বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান কিংবা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁরা যেমন সেটা পেশা হিসাবে নেননি, নাট্য আন্দোলনও ছিলো সে-রকম একটি আন্দোলন। যে-কোনো আন্দোলনে ত্যাগটাই বড়, যে-কোনো সামাজিক আন্দোলনই ত্যাগ-তিতিক্ষার ব্যাপার। নিজেদের ভাগ্য গড়ে নেয়ার ব্যাপার নয়।
বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের কর্মীরা চিন্তার মধ্যে নানা বিভ্রান্তি নিয়েই মাঠে নেমেছিলেন। সংখ্যায় খুব কম হলেও কিছু কিছু দলের নাট্যকর্মীরা সত্যিকারভাবে সমাজ পরিবর্তনের চিন্তা, শ্রেণীসংগ্রামের চিন্তা নিয়েই মাঠে-ঘাটে ছুটে বেড়াচ্ছিলেন। ঠিক-ভুল কর্মসূচী নিয়ে স্বপ্রণোদিতভাবেই মানুষের ভাগ্য পাল্টানোর কাজে নেমেছিলেন তাঁরা; কেউ তাঁদের এ পথে নামতে বাধ্য করেনি। সত্যিকার অর্থে তাঁদের কাছে বেতনভাতা লাভের কোনো চাকরিও সেটা ছিলো না। জাতীয় নাট্য বিদ্যালয়ের স্নাতকধারীরা সেই চিন্তার বিপরীতে নাট্যচর্চাকে সুযোগ-সুবিধা লাভের মঞ্চ হিসাবেই দেখালেন। নাট্য আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারে দিল্লির জাতীয় বিদ্যালয়ের স্নাতকধারীদের কোনো মাথা ব্যথা ছিলো না।
নাট্যদলের সাথে তাঁদের সম্পর্ক ছিলো কোনো আদর্শগত নয়, সম্পর্কটা ছিলো আর্থিক লেনদেনের। যে দলের কাছ থেকে টাকা পেয়েছেন তাঁদেরই কাজ করে দিয়েছেন। সেখানে ভিন্ন কোনো প্রশ্ন তাঁদের কাছে প্রাধান্য পায়নি। যাঁরা নাটক করছেন তাঁরা প্রতিক্রিয়াশীল কি না, নাটকের বিষয়বস্তু গ্রহণযোগ্য কি না-এসব প্রশ্ন নিয়ে তাঁরা ভাবেননি, অর্থ উর্পাজনটাই ছিলো প্রধান। নাট্য আন্দোলনের মূল লক্ষ্য থেকে এই কর্মকাণ্ড ছিলো বহুদূরে।
নাট্যকর্মীদের চিন্তায় বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব ও নানাধরনের বিভ্রান্তির কারণেই জাতীয় নাট্য বিদ্যালয়ের সনদধারীরা তাঁদের উপর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হলেন। জাতীয় নাট্য বিদ্যালয় সম্পর্কে উৎপল দত্তের দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিলো? তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলছেন, ‘আমাদের দেশে যে ড্রামা স্কুল আছে-সেই দিল্লীতে অসহ্য! অখাদ্য! ওফ! ওঁরা যা শেখান, সেগুলো আগে পরিচালককে অভিনেতার মন থেকে থেকে অপসৃত করতে হয়, এরা যা শিখেছেন, ভুল শিখেছেন, এটা ঠিক নয়। ‘
উৎপল দত্তের মতো নাট্যব্যক্তিত্ব মনে করেন, ভারতের জাতীয় নাট্য বিদ্যালয়ে নাটক সম্পর্কে ভুল শিক্ষা দেয়া হয়। সেই জাতীয় নাট্য বিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে আসা তরুণরা কিছুদিন বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনের বিভিন্ন গ্রুপের হাল ধরলেন যেখানে মঞ্চসজ্জা এবং আলোর প্রক্ষেপণই প্রাধান্য পেল। তাদের নির্দেশিত নাট্যধারায় চিৎকার-চ্যাঁচামেচি এবং কোরিওগ্রাফ-এর ব্যাপক ব্যবহার চললো। দৃশ্যসজ্জা ও আঙ্গিক নিয়ে অতিরিক্ত মাতামাতির কারণে মঞ্চায়ন ব্যয় বেড়ে গেল। কিন্তু এই ধারাও দর্শককে বেশি দিন ধরে রাখতে পারলো না।
সত্তর দশক পর্যন্ত নাট্যকর্মের নানা দুর্বলতা থাকলেও নাটক নিয়ে মানুষের মধ্যে উন্মাদনা দেখা দিলেও নাটকের মধ্যে বাণিজ্যিক চিন্তা তখনো প্রবশে করেনি। নাট্যকর্মীরা সে সময় পর্যন্ত নাটককে অর্থনৈতিকভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠার সোপান হিসাবে দেখেননি। গ্রুপ থিয়েটারগুলোর প্রধান আয়ের দিক বলতে ছিলো, টিকেট বিক্রয় এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত স্বল্প টাকার বিজ্ঞাপন।
বাকিটা সদস্যদের চাঁদা। গ্রুপ থিয়েটারের নাটক মঞ্চায়ন করার জন্য ভালো মিলনায়তনের অভাব ছিলো, ঢাকা শহরের মিলনায়তনের সংখ্যা কম ছিলো, তবুও দলগুলো নাটক করে গেছে বাণিজ্যিক চিন্তা না করে। অধিকাংশ নাট্যকর্মী দিনে রুটিরুজির লড়াই করে সন্ধ্যাবেলায় এসে নাট্যচর্চা করেছে। মহড়া কক্ষ ছিলো না, কোনোভাবে এখানে সেখানে তার ব্যবস্থা করা হয়েছে-এমনি লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই বেশির ভাগ দল নাটক করে গেছে। সত্তর দশকের পর নাটকের মধ্যে যেমন বাণিজ্যিক চিন্তা ঢুকে পড়ে তেমনি নাটককে বহুজনেই তাদের বৈষয়িক স্বার্থে কাজে লাগান। নব্বইয়ের দশকে যা মারাত্মক আকার ধারণ করে। নাট্যকর্মীদের কাছে নাট্যমঞ্চ আর সংগ্রামের মঞ্চ থাকে না, সেটা তখন হয়ে দাঁড়ায় একটা আয়ের উৎস। আর তাই তাঁরা নাটককে পেশাদার করার রব তোলেন।
যেমন আতাউর রহমান লিখছেন, ‘পেশাদারিত্ব ছাড়া থিয়েটারের সার্বিক উৎকর্ষ যেমন সম্ভব নয় তেমনি দীর্ঘস্থায়ী অস্তিত্বের প্রশ্নও হয়ে পড়বে নাজুক। জাতীয় নাট্য বিদ্যালয় থেকে স্নাতক প্রাপ্তরাই প্রথম নাটকের পেশাদারি দিকটিকে প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেন, নব্বইয়ের দশকে সেটাই সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। নাটককে পেশাদারি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে না দেখার কারণে নাট্যকর্মীদের কী ধরনের ক্ষতি হয়েছে সে সম্পর্কে মামুনুর রশীদ এক সাক্ষাৎকারে নাট্যকার ও নির্দেশক এস. এম. সোলায়মানকে বলছেন, ‘নাটক যদি শততম মঞ্চায়ন হয় তবুও তুমি অর্থনৈতিকভাবে শূন্য। সামাজিকভাবে শূন্য।
মামুনুর রশীদের এ বক্তব্য থেকে এটা প্রতিয়মান হয় যে, টাকা এবং সামাজিকভাবে . প্রতিষ্ঠা লাভই তাদের নাটক করার প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো। মামুনুর রশীদের পরের বক্তব্যে তা আরো স্পষ্ট হয়। মামুনুর রশীদ সেখানে বলছেন যে, নাটক থেকে টাকা পেলেই সে টাকা দিয়ে নাট্যকর্মীদের সংসার চললেই দর্শককের প্রতি তার দায়িত্ব বা • বাধ্যবাধকতা জন্ম নেবে। ৬৩ মামুনুর রশীদের এ বক্তব্য থেকে নাট্য আন্দোলনের চরিত্র বের হয়ে আসছে। মামুনুর রশীদের চোখে দর্শকদের বা জনগণকে সচেতন করার ব্যাপারটা তাহলে কোনো রাজনৈতিক বা আদর্শগত দায়িত্ব নয়। সেটা হচ্ছে অর্থনৈতিক লেনদেনের একটা সম্পর্ক। স্বতঃস্ফূর্তভাবে বা স্বেচ্ছায় নাট্যকর্মীরা জনগণকে সচেতন করার দায়িত্ব নেবেন না, অর্থ বা সম্মানী দিয়ে তাদের সে কাজে বাধ্য করতে হবে। শ্রেণীসংগ্রামের নাট্যকার হিসাবে বিবেচিত মামুনুর রশীদের এ বক্তব্য কতোটা যৌক্তিক সেটা আমরা বিচার করে দেখবো।
বিপ্লবের স্বার্থে লেনিনই প্রথম রাজনৈতিক দলের কর্মীদের সার্বক্ষণিক করে তোলার জন্য ভাতা দানের ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। সে ভাতা দানের লক্ষ্য ছিলো কর্মীদের ব্যাপকভাবে দলের কাজে ব্যবহার করা। ভাতার পরিমাণও ছিলো ন্যূনতম, দলের কর্মীদের বেঁচে থাকার মতো। পরে বহু দেশের সাম্যবাদী দলই যৌক্তিকভাবে সার্বক্ষণিক কর্মীদের জন্য সেইরকম ভাতা প্রদানের কর্মসূচী গ্রহণ করেছিলো, তবে সবার জন্য নয়।
যাদের পারিবারিক আয় থেকে টাকা আসবার উৎস ছিলো তাদের জন্য সেটা করা হয়নি। বরং যেসব সার্বক্ষণিক পাটি কর্মীদের পারিবারিক সূত্রে বড় অংকের টাকা লাভের সুযোগ ছিলো তাদেরকে ন্যূনতম টাকাটা নিজের জন্য রেখে বাকিটা পার্টিকে দিয়ে দিতে হতো। ব্যক্তিগতভাবে সেখানে কারো অধিক টাকা আয় করার কোনো সুযোগ ছিলো না। গাড়ি-বাড়ির বিলাসিতার সুযোগ ছিলো না। পুরো ব্যাপারটাই থাকে সেখানে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে।
সাম্যবাদী আদর্শের প্রতি, দলের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করার পরই একজনকে সার্বক্ষণিক দলীয়কর্মী হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়। দলকে সে অর্থ যোগায় শ্রমিকরা। কাদের জন্য সে অর্থ তারা জোগায়? যাঁরা স্পষ্টভাবে ঘোষণা দিয়ে শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্বের পক্ষে লড়াই করেন। সেখানে রাজনৈতিক কোনো অস্পষ্টতা নেই, কাজের মধ্যে কোনো অস্পষ্টতা নেই। যাঁরা সেখানে কাজ করতে আসেন টাকার জন্য আসেন না, আসেন একটা আদর্শের জন্য জীবন দিতে। সর্বস্ব ত্যাগ করে তাঁরা আসেন। সামাজিক মর্যাদা লাভের জন্য তাঁরা আসেন না, আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য তাঁরা আসেন না। প্রথমে তাঁরা কাজ করেন দলের জন্য নিজের পকেটের পয়সা দিয়ে, নিজেকেই নিজের বেঁচে থাকার অর্থ জোগাড় করতে হয়।
দল যখন কোনো সদস্যকে সার্বক্ষণিক কর্মী হিসাবে কাজে লাগাতে চায় তখনি তাঁকে শুধু ভাতা প্রদান করে। মামুনুর রশীদের বক্তব্য মতো নাট্যকর্মীদের জন্যও সে ধরনের সুযোগ লাভের পথ খোলা ছিলো, যদি তাঁরা কোনো সাম্যবাদী দলের আদর্শে বিশ্বাস করে তাদের দলের সার্বক্ষণিক নাট্যকর্মী হতেন। সেখানে আদর্শটাই হতে হবে বড়, লেনদেনের হিসাবটা নয়
মামুনুর রশীদ যে প্রশ্ন তুলেছেন তার সাথে সাম্যবাদী দলের চিন্তার মিল নেই। মামুনুর রশীদ তার বক্তব্য দেয়ার ক্ষেত্রে উদাহরণ দিচ্ছেন সাম্যবাদী দলের। তিনি দেখাচ্ছেন যে পৃথিবীর সব জায়গায় রাজনৈতিক দলগুলো চাঁদায় চলে। তিনি হিসাব করে দেখাচ্ছেন, কলকাতার কমিউনিস্টদের ট্রাম চালকরা চাঁদা দিচ্ছেন। সেই টাকায় দলের তহবিল তৈরি হচ্ছে। সে কারণে তিনি মনে করেন নাট্যকর্মীরা যদি শ্রমিকদের কাছ থেকে চাঁদা পান, নাট্যকর্মীদের পক্ষে সেখানে তাঁদের জন্য কাজ করা সম্ভব। মামুনুর রশীদের এই বক্তব্য সত্যি যে, শ্রমিকশ্রেণীর নাটকের দলকে শ্রমিকশ্রেণীর চাঁদায় বা শ্রমিকশ্রেণীর পৃষ্ঠপোষকতায় চলতে হবে।
কিন্তু তিনি সে উদাহরণটা দিচ্ছেন নিজের তৈরি স্টুডিও থিয়েটারকে কেন্দ্র করে, যে স্টুডিও থিয়েটারটা একটা ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত উদ্যোগ। বিষয়টাকে তিনি গুলিয়ে ফেলছেন কমিউনিস্ট পার্টির সাথে। কমিউনিস্ট পার্টি একটা আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে আর স্টুডিও থিয়েটার একটা বাণিজ্যিক উদ্যোগ। সেই বানিজ্যিক উদ্যোগটাকেই তিনি মহিমামণ্ডিত করতে চাইছেন একথা বলে যে, নাট্যকর্মীরা দর্শকদের কাছ থেকে টাকা গ্রহণ করলেই দর্শকদের প্রতি দায়িত্ব এসে যাবে।
তিনি তাঁর বক্তব্য দিয়ে যেটা বোঝাতে চেয়েছেন, তাহলো মানুষ যখন কোনো দায়িত্ব পালনের জন্য অর্থ পাবে, সংসার চালাবার অর্থ, জীবন জীবিকার অর্থ, সে দায়িত্ব পালনেও বাধ্য থাকবে। নাট্যকর্মীদের ক্ষেত্রেও তিনি তাই মনে করছেন। মামুনুর রশীদের এ বক্তব্যই বা কতোটা সঠিক? মামুনুর রশীদের এ কথা সত্যি হলে সরকারি প্রশাসন, পুলিশ এবং সকল সরকারি কর্মচারীরাই জনগণের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালন করতো।
জনগণের টাকায় প্রশাসন চলে, তারপরেও তারা তাহলে জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালন করছে না কেন? ব্যবসায়ীরা তো পুরো টাকাটাই পাচ্ছে ক্রেতাদের কাছে থেকে, সেখানে কি তারা তাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করছে, সৎ থাকছে? শাসকবর্গকে তো জনগণই সবসময় কর জুগিয়ে এসেছে, শাসকরা কি তাই বলে জনগণের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালন করে এসেছে? পৃথিবীর ইতিহাসে যাঁরা বড় বড় বিপ্লব ঘটিয়েছেন, জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালন করেছেন, জীবন দিয়েছেন তারা কেউই জনগণের বেতনভোগী কর্মচারী ছিলেন না। নিজের উদ্যোগে, নিজের অন্তরের তাড়নায় তাঁরা জনগণের জন্য কাজ করেছেন। কখনও সেটা লেনদেনের কোনো হিসাব ছিলো না। মার্কসও বিপ্লবীদের বেতনভোগী কর্মচারী মনে করেননি।
বিপ্লবের মূল শক্তি ছিলো তার চোখে শ্রমিকশ্রেণী-সাম্যবাদী দল শুধু তাকে সংগঠিত করতে, এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে। দলীয় সদ্যস্যদের সেটা করতে হবে আত্মত্যাগের মহিমা থেকেই, বেতনভোগী কর্মচারী হিসাবে নয়। লেনিন সাম্যবাদী দলে একটি নতুন ধারার প্রবর্তন করেছিলেন। সেটা মামুনর রশীদ যা বলেছেন তা নয়।
মামুনুর রশীদের বক্তব্যের মধ্যে আর একটি অস্পষ্টতা রয়েছে। মামুনুর রশীদ বা ঢাকার নাট্যদলগুলো দর্শকদের কাছ থেকে টিকিট বিক্রির মাধ্যমে টাকা নিচ্ছেন সে কথাটা এখানে উল্লেখ করেননি। গ্রুপ থিয়েটারের নাটক যে-সকল দর্শকরা দেখতে আসেন তাঁরা একটি প্রবেশ-মূল্য দিয়েই নাটক দেখেন। সেক্ষেত্রে বলাই যায় দর্শকের কাছ থেকে নাট্যকর্মীরা তো টাকা নিচ্ছেনই। স্টুডিও থিয়েটারও নিচ্ছে। সেক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন না করার তো কোনো কারণ গ্রুপ থিয়েটার বা স্টুডিও থিয়েটারের থাকে না। পেশাদার আর অপেশাদার দুটোর মধ্যে পার্থক্য করা হবে কিসের ভিত্তিতে? টাকা তো দুপক্ষই নিচ্ছে। মামুনুর রশীদ বলছেন স্টুডিও থিয়েটার অনেক বেশি বার মঞ্চস্থ হবে, অনেক বেশি দর্শক সেটা দেখবে।
মামুনুর রশীদের এই বক্তব্য সম্পর্কেও প্রশ্ন তোলা যায়। মামুনুর রশীদ নিজেই লিখছেন, ঢাকা শহরের অধিবাসীর সংখ্যা এখন প্রায় আশি লাখ। এই আশি লাখ লোকের মধ্যে নাটক দেখার ব্যবস্থা আছে সাতশো জনের মাত্র। মিলনায়তন উপচে ভেঙে পড়ার কথা অথচ তা হচ্ছে না। দর্শক ভীষণভাবে, মারাত্মকভাবে সংকুচিত। থিয়েটার সংস্কৃতিটার বৃত্ত যে কতোটা ক্ষুদ্র তা আর প্রমাণের আপেক্ষা রাখে না।
কি দাঁড়ালো তাহলে? দর্শকই তো নেই। নাটককে পেশাদারভাবে নেয়ার জন্য দর্শক হবে মূল পৃষ্ঠপোষক। দর্শক না থাকলে টিকেট কিনবে কে? মামুনুর রশীদ একা নন, নাট্য কর্মীদের বড় একটা অংশই পেশাদার থিয়েটারের কথা বলছেন। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সম্মেলনেও এ প্রশ্ন তোলা হয়েছে-কিন্তু পেশাদার থিয়েটারের দর্শক আসবে কোথেকে সে প্রশ্নের জবাব আমরা পাইনি কারো কাছ থেকেই।
পিসকাটর ছিলেন পেশাদার এবং রাজনৈতিক নাটকই প্রযোজনা করেছিলেন তাঁর মঞ্চে। কারণ তাঁর উদ্ভাবনী নাট্যকৌশল এবং জীবন্ত রাজনৈতিক বিষয়বস্তু দর্শক টানতে সক্ষম ছিলো। পিসকাটর অবশ্য স্বীকার করে নেন, বিপ্লবী পেশাদার নাট্যশালা তার বিরাট আকার ও জটিলতা হেতু এক জায়গায় স্থানু; প্রোলেতারিয়েত দলগুলি সারা জার্মানী ঘুরে শ্রমিক অঞ্চলে অভিনয় করতে সক্ষম, যা পেশাদার দলের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু রাজনৈতিক পেশাদার নাট্যশালা সমাজের সুবিধাভোগী এমন এক অংশকে কাছে টানতে পারছে, বিপ্লবের প্রতি আগ্রহী করতে পারছে যাদের আগে বিপ্লব সম্পর্কে কোনোরকম মাথা ব্যথা ছিলো না।
পিসকাটর লিখেছিলেন, মঞ্চের যন্ত্রপাতির ব্যাপকতর ব্যবহার, পেশাদার অভিনেতা নিয়োগ-এসব কারণেই থিয়েটারের রাজনৈতিক ও বৈপ্লবিক কার্যকারিতা লোপ পায়, এ মতটি ভুল। কিন্তু সতর্ক থাকতে হবে যাতে বাণিজ্যিক নাট্যশালার কাছে আত্মসমর্পণ করতে না হয়। দর্শক পেতে হলে সেই নাটক খুঁজে বার করতে হবে যা রাজনীতির দিক থেকে সুসামঞ্জস্য অথচ মঞ্চ সফল। ইউরোপের শ্রেষ্ঠ অভিনেতারা অবশ্যই পেশাদার। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে পাশাপাশি গড়ে উঠেছিলো অনেকগুলি অপেশাদার শ্রমিক নাট্যগোষ্ঠী। ৬৬ শ্রমিকদের প্রতি দায়বদ্ধ থেকেই তারা নাট্যচর্চা করতো। কিন্তু রাজনৈতিক নাটক যে পেশাদারভাবে করা যাবে না এমন কথা মার্কসবাদীরাও বলেননি।
পিসকাটর, ব্রেন্ট এবং উৎপল দত্ত পেশাদার মঞ্চে রাজনৈতিক নাটক মঞ্চস্থ করেছেন। নিজেদের মেধা ও যোগ্যতার কারণে রাজনৈতিক নাটক করেই তাঁরা দর্শক টানতে পেরেছিলেন। কোনো নাট্যদল যদি সমাজ সচেতন নাটক করে দর্শকের কাছে জনপ্রিয় হতে পারে, সে দলের তো পেশাদার হতে বাধা নেই। কেউ তো তাদের পেশাদার হতে নিষেধ করছে না। নাট্য দলগুলো পেশাদার হবে কি হবে না, সেটা কোনো বিতর্কের বিষয় নয়।
সেটা হচ্ছে নাট্য দলগুলোর নিজেদের সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপার। কারো পক্ষে পেশাদার হবার সুযোগ থাকলে সে নাট্যদল পেশাদার হবে; কিন্তু পেশাদার হোক কিংবা অপেশাদার হোক দলটির সামগ্রিক মূল্যায়ন হবে তার প্রযোজনার মান দেখে। কিন্তু বাংলাদেশের নাট্যকর্মীরা যখন একথা বলেন, নাট্যচর্চা পেশাদার না হওয়াতে তার উৎকর্ষতা বাড়েনি-এই বক্তব্য একেবারে গ্রহণযোগ্য নয়। নাটককে পেশাদার করার প্রশ্নে গোলাম সারোয়ার লিখছেন, বিগত দিনের নাট্যচর্চায় চর্বিত চর্বণ নতুন অঙ্গিকের নামে চমক সৃষ্টি, নতুন নাটকের নামে পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটাঘাঁটি, এসব কেবল নাটকের কমিটমেন্টের নামে মিথ্যাচার। নতুন নাটক কিংবা নতুন আঙ্গিক অন্বেষণের প্রচেষ্টায় কোনো দোষ নেই, তা হতেই হবে।
কিন্তু যারা নাটক করবেন, সেই নাট্যকর্মীদের কী হবে? কেবলমাত্র নাটক নিয়ে জীবীকা নির্বাহের পথ তাদের দেখাতেই হবে। সেই পথ হচ্ছে নাটকের পেশাগত চর্চা, জীবিকাশ্রয়ী নাটক। কেননা নাটককে জীবিকা আশ্রয়ী না করতে পারলে, নাটকের উৎকর্ষ সাধনও সম্ভব নয়। সারোয়ারের বক্তব্যটির মধ্যে কি সত্যিই কোনো সারবস্তু লুকিয়ে আছে? বাংলাদেশের নাটক জীবীকা আশ্রয়ী নয় বলে কি এখানে ভালো কোনো নাটক মঞ্চস্থ হয়নি? বাংলাদেশের যাত্রাশিল্প পেশাদার, নাটক পেশাদার নয়। তা সত্ত্বেও নাটকের মান কি যাত্রার চেয়ে উন্নত নয়?
জীবিকা আশ্রয়ী হলেই যে উৎকর্ষতা বাড়ে না তার প্রমাণ বাংলাদেশের মূলধারার চলচ্চিত্র। সেটা তো পেশাদার মাধ্যম। সেখানে তাহলে শিল্পচর্চার মান বাড়ছে না কেন? চলচ্চিত্র শিল্প সম্পর্কে তাহলে এতো অভিযোগ কেন? কোনো শিল্প মাধ্যম পেশাদার হলেই তার মান বাড়ে সে চিন্তাটা খুবই ভুল। পশ্চিমবঙ্গের পেশাদার নাট্যশালা যখন সবরকম উৎকর্ষতা হারিয়ে ফেলে পৌনঃপুনিকতার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছিলো, সে সময় গণনাট্য সংঘের নবান্ন নতুন যুগের সূচনা করে।
নবান্ন ভারতে আধুনিক নাট্যধারার জন্ম দিয়েছিলো যা পেশাদার দলগুলোর পক্ষে সম্ভব হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের নাট্য নির্দেশক, মঞ্চাভিনেতা ও নাট্য সমালোচক অশোক মুখোপাধ্যায় লিখছেন, ‘বাংলা থিয়েটারের যা কিছু গর্বের কাজ, ব্যক্তিত্বশালী নাট্যপ্রতিভাদের যত আবির্ভাব, সব ঘটেছে পেশাদার মঞ্চের বাইরে। ৬ বাংলাদেশের নবনাট্যধারার প্রবর্তন হয়েছিলো কোনো পেশাদার থিয়েটার দলের দ্বারা নয়। পশ্চিমবঙ্গে এখনো গ্রুপ থিয়েটারগুলো বিষয়বস্তু প্রযোজনা, অভিনয় সবক্ষেত্রেই পেশাদারি থিয়েটারের চেয়ে এগিয়ে আছে। পেশাদার থিয়েটারই পেশাগত কারণেই সংকুচিত হয়ে পড়তে বাধ্য হয়; পৃথিবীর নাট্যচর্চার ইতিহাস বারবার তা প্রমাণ করেছে। নাট্যচর্চায় পেশাদারিত্ব থাকলেই তার মান বাড়বে এ তত্ত্ব মেনে নেয়া যায় না।
মামুনুর রশীদ একদিকে বলছেন পেশাদার হবেন, আবার অন্যত্র বলছেন শ্রমিকরা কেন তাদের চাঁদা দিচ্ছে না। পেশাদার থিয়েটার তো কারো চাঁদায় চলে না। পেশাদার থিয়েটারকে চলতে হয় পুঁজি ও জনপ্রিয়তার জোরে। মামুনুর রশীদ এবং বাকিরা চিন্তার নানা বিভ্রান্তি নিয়ে এক এক সময় এক এক কথা বলছেন। বাংলাদেশের নাট্যবোদ্ধারা আসলে নাট্য আন্দোলনে এমন সব প্রসঙ্গের অবতারণা করেছিলেন যার সাথে নাট্য আন্দোলনের সাফল্যের কোনো সম্পর্ক ছিলো না। নাট্যবোদ্ধাদের চিন্তার বিভ্রান্তিই বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনকে কখনও সঠিক পথে এগিয়ে যেতে দেয়নি।
যদিও আমরা বলছি, বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের উৎস পশ্চিমবঙ্গের গ্রুপ থিয়েটার কিন্তু কর্মধারা ও ব্যাপকতার দিক থেকে তা মোটেও পশ্চিমবঙ্গের গ্রুপ থিয়েটারের সমতুল্য নয়। গণনাট্য ও নবনাট্য আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গে বহু পূর্বে শুরু হলেও গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন মূলত আরম্ভ হয় বিশ শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে। সে বিচারে পশ্চিমবঙ্গের গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের ইতিহাস বাংলাদেশের তুলনায় খুব দীর্ঘ নয়।
বাংলাদেশে এ আন্দোলন শুরু হয় সত্তরের দশকের শুরুতে। পশ্চিমবঙ্গে যত ব্যাপকভাব এ আন্দোলন বিস্তার লাভ করে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা কখনই ঘটেনি। পশ্চিমবঙ্গের গ্রুপ থিয়েটার রাজ্যের সর্বত্র সর্বশ্রেণীর মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিলো। ব্যাপক সাধারণ মানুষ এর সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলো। বিশেষ করে মফস্বলগুলোতে নাট্য আন্দোলনের ব্যাপক প্রভাব পড়েছিলো। সত্তরের গোড়া থেকে আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিভিন্ন জেলায় চলছিলো নাট্যচর্চার জোয়ার। নাট্য উৎসব, নাট্য প্রতিযোগিতার মুখরতা তখন মফস্বলের চারদিকে।
উনিশশো পঁচাত্তর সালে জরুরি অবস্থা জারির ফলে কলকাতার থিয়েটার সাময়িকভাবে থমকে দাঁড়ালেও মফস্বলের নাট্যকর্মীরা খুব দ্রুত নিজেদের বিমূঢ় অবস্থা কাটিয়ে উঠেছিলো। পুনরায় কাজ আরম্ভ করেছিলো। ৭° পশ্চিমবঙ্গের গ্রুপ থিয়েটার চর্চা শুধু রাজধানীতে আটকে ছিলো না।
বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন প্রধানত ঢাকা শহরের মধ্যে আটকে থাকে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে তা কিছুটা সাফল্য পেলেও, সারাদেশে এ আন্দোলন কখনই তেমনভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। ঢাকার বাইরে জেলা শহরগুলোর মধ্যবিত্তদের মধ্যে এ আন্দোলন কিছুটা প্রভাব ফেললেও তা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়।
অথচ পশ্চিমবঙ্গে মফস্বল শহর পর্যন্ত ব্যাপকভাবে এ আন্দোলন প্রসার লাভ করেছিলো। মফস্বল শহরে মঞ্চস্থ হতো সাধারণত রাজনৈতিক বক্তব্যধর্মী একাংক নাটক। সত্তর দশকে সারা পশ্চিমবঙ্গে এ ধরনের বহু নাট্যদলের সন্ধান পাওয়া যায়, যাদের শহর ও শহরতলীতে অভিনয় সংখ্যা উনত্রিশ হাজার, মফস্বলে ছত্রিশ হাজার এবং নাট্যকর্মের সঙ্গে জড়িত মানুষের সংখ্যা সেখানে চার লক্ষ চল্লিশ হাজার।” অথচ বাংলাদেশে আমরা চার লক্ষ দর্শকের দেখা পাচ্ছি না।
উপরের বিবরণ থেকে পশ্চিমবঙ্গের নাট্য আন্দালনের যে ব্যাপক চেহারা ধরা পড়ে, তা থেকে বোঝা যায় সত্তরের দশকে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন সেখানে কী ব্যাপক রূপ নিয়েছিলো। নাটকই যেন তখন পশ্চিমবঙ্গের মূল পরিচয় হয়ে – দাঁড়িয়েছিলো। বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনে কখনো এমনটি ঘটেনি। বাংলাদেশে কখনই নাট্য প্রদর্শনীর এই ব্যাপকতা লক্ষ্য করা যায় না। সত্তর দশকে নয়, আশির দশকে নয়, নব্বইয়ের দশকেও নয়।
বাংলাদেশে সারা বছরে গ্রুপ থিয়েটারগুলোর মোট প্রদর্শনীর সংখ্যা দুই হাজারের মতো। ৭ বারো কোটি মানুষের দেশে নাটকের দর্শক যে কতো সামান্য এর থেকেই উপলব্ধি করা যায়। সংখ্যাটি যে-কোনো নাট্য আন্দোলনের জন্যও খুবই নগণ্য। বাংলাদেশে যেখানে সারা বছরে নাটকের প্রদর্শনী হয় দুই হাজার, পশ্চিমবঙ্গে সেখানে গ্রুপ থিয়েটার দলের সংখ্যাই হাজারের অধিক। কারো কারো মতে তিন হাজার।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকার লেখালেখিতে নাট্যকর্মী ও সমালোচকদের মন্তব্য থেকে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাংলাদেশের সামগ্রিক নাট্য আন্দোলনে এই গ্রুপ থিয়েটারগুলোর ভূমিকা যেমন সামান্য, তেমনি তিন দশকের গ্রুপ থিয়েটার চর্চায় দর্শক আশানুরূপ বাড়েনি বরং কমেছে। বলতে দ্বিধা নেই সম্মিলিত চেষ্টার অভাব, নির্দেশনা অভিনয় ও কারিগরি দিকে অক্ষমতা, ভালো নাটক রচনার ব্যর্থতা, মঞ্চের অভাব, এবং দলগুলোর আর্থিক দৈন্যদশা এবং সর্বোপরি নাট্যকর্মীদের আন্তরিকতার অভাবের কারণেই নাট্য আন্দোলন কখনই আশানুরূপ গতি পায়নি। দর্শক সংখ্যা যেমন বাড়েনি, ত্রিশ বছরে তেমনি দলের সংখ্যাও বাড়েনি। নাট্যকর্মীর সংখ্যাও তেমনি হাতে গোনা।
বাংলাদেশের নাট্যদলগুলো বারবার পেশাদার হবার যে রব তুলছে সেটা নিজেদের অক্ষমতাকে ঢাকবার জন্য। কিন্তু এর থেকে তাদের যে মনোভাবটি ধরা পড়ে তাহলো নিজেদের জন্য বৈশয়িক সুবিধা লাভ। নাটককে যদি তারা জনগণের স্বার্থে ব্যবহার করতে চাইতেন বা করতে পারতেন তাহলে তাদের নাটকে দর্শকের অভাব ঘটতো না। পিসকাটরের মতো রজনৈতিক নাটক তো দূরের কথা, সস্তা হাসির নাটক করেও তারা দর্শক টানতে পারেনি। প্রশ্নটা হলো যোগ্যতার। যারা তিন দশক ধরে নানা পরীক্ষা- নিরীক্ষা চালিয়ে কোনোভাবেই দর্শকের মানসিকতা বুঝতে পারলো না, কোনো চিরায়ত • রাজনৈতিক কিংবা মানবিক নাটক সৃষ্টি করতে পারলো না; ফাঁকা কিংবা অর্ধফাঁকা মিলনায়তনে শুধু চিৎকার করে বেড়ালো-তাদের সব বক্তব্যই অসার, এক ধরনের আস্ফালন মাত্র।
পিসকাটর পেশাদার ছিলেন কি ছিলেন না, সেটা বড় কথা নয়। তিনি জানতেন, তিনি কাদের জন্য নাটক করছেন এবং নাটকে তিনি কী বলবেন। পিসকাটর তাঁর দর্শকদের চিনতেন। তিনি যে রাজনৈতিক নাটকই করবেন সে সিদ্ধান্ত সবার আগে নেন। তারপর পেশাদার মঞ্চে উপস্থিত হন। পিসকাটর-ব্রেস্ট-উৎপল প্রত্যেকেই দর্শককে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। নাট্য আন্দোলন আসলে কার জন্য? মঞ্চের দর্শকদের জন্য।
ফলে সেই দর্শকরা কারা, কী তাদের শ্রেণী অবস্থান, কীরকম তাদের মানসিক অবস্থা সবার আগে সেটাই জানতে হয় এবং সেই প্রেক্ষাপট থেকেই নাটক রচনা ও মঞ্চায়ন করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের সাথে জড়িতরা এসব অনুসন্ধানের প্রয়োজন বোধ করেননি। দর্শকের মানসিক জগৎ বুঝতে না পারলে কোনো নাট্য আন্দোলনই সফলতা লাভ করতে পারে না। বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলন তাই খুব বেশি দূর আগাতে পারলো না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী নাট্য আন্দোলন নিয়ে যতোটা হৈ চৈ হয়েছে, দেখা যাবে নাট্য আন্দোলনের ব্যাপকতা কখনও তেমনটি ছিলো না। নাট্য আন্দোলন ছিলো দেশের খুবই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ।
ঢাকা শহরের নাটকই মূলত বাংলাদেশের নাটক হিসাবে চিহ্নিত হচ্ছিলো, ঢাকার বাইরে যার কোনো ব্যাপকতাই ছিলো না। থিয়েটার পত্রিকায় আটাত্তর সাল থেকে ‘গ্রুপ থিয়েটার: জেলায় জেলায়’ শিরোনামে একটি নিয়মিত বিভাগ চালু করা হয়। সেখানে বিভিন্ন জেলার থিয়েটার দলগুলোর খবরাখবর ছাপা হতো। সেসব গবর বেশির ভাগ সময়েই হতো হতাশাব্যঞ্জক। যেমন থিয়েটার পত্রিকার আটাত্তর সালের সেপ্টেম্বর সংখ্যায় বাংলাদেশের ছয়টি জেলা থেকে নাটকের ওপর স্থানীয় প্রতিনিধিদের পাঠানো সংবাদ ছাপানো হয়।
চট্টগ্রাম সম্পর্কে সেখানে লেখা হচ্ছে, চট্টগ্রামের থিয়েটার দলগুলো দীর্ঘদিন ধরে নীরব। ঢাকায় একটি উৎসবে অংশগ্রহণ করার পর সাত মাস চট্টগ্রামে কোনো দল নতুন নাটক যেমন মঞ্চায়ন করেনি তেমনি পুরানো নাটক মঞ্চায়ন করতেও তারা সক্ষম হয়নি। পাবনার নাট্যচর্চা সম্পর্কে লেখা হচ্ছে, সাম্প্রতিক কালে পাবনা নাট্যাঙ্গনে বলতে গেলে দুঃসময়ই চলছে। সেখানে আরো বলা হচ্ছে, পাবনায় প্রতিমাসে গড়ে তিনটি নাটক মঞ্চায়ন হয় কি না সন্দেহ। রংপুর সম্পর্কে লেখা হচ্ছে, গত এপ্রিলে শিখা সংসদের নাট্য সপ্তাহ পালনের পর থেকে নাট্যাঙ্গন এক প্রকার নীরবতায় আচ্ছন্ন। বরিশাল জেলা সম্পর্কে লেখা হচ্ছে, বরিশালে এখনও গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতে পারেনি।
বর্তমান মুহূর্তের কথা বলতে গেলে এক সর্বগ্রাসী বন্ধ্যাত্ব জেলা শহরে বিরাজ করছে। নোয়াখালী জেলার নাট্য সংবাদে লেখা হচ্ছে, জন্মলগ্ন থেকেই নাটকের মানোন্নয়নে যথেষ্ট আন্তরিকতার সাথে কাজ করলেও তাদের কার্যক্রমও ইদানিং শ্লথ গতিতে এগুচ্ছে। কুমিল্লা জেলার নাট্যাঙ্গন সম্পর্কে হতাশাজনক সংবাদ ছাপা না হলেও তেমন ইতিবাচক কোনো খবরও ছিলো না। উনআশি সালের শীতকাল থেকে জেলাগুলোতে আবার কিছু কিছু নাটক মঞ্চায়নের খবর পাওয়া যায়। সেগুলোও কোথাও খুব নিয়মিতভাবে প্রদর্শিত হয়নি।
উনআশি সাল থেকে আশি-একাশি সাল পর্যন্ত জেলা শহরগুলোতে বেশকিছু নতুন ও পুরানো নাটকের প্রদর্শনী হয়। জেলা শহরের দলগুলোর তখন চাঙ্গা হবার পেছনে একটি কারণও ছিলো। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী উনআশি সালে বিভিন্ন জেলা শহরগুলোতে নাট্য উৎসবের আয়োজন করে। সে নাট্য উৎসব সম্পর্কে আমরা চতুর্থ অধ্যায়ে কিছুটা আলোকপাত করবো। সেই সব নাট্য উৎসবকে ঘিরেই জেলা শহরের নাট্য দলগুলো কিছুদিনের জন্য সরব হয়ে ওঠে। সেটাও তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু ছিলো না। যদিও সেটাই ছিলো বাংলাদেশের জেলা শহরগুলোর নাটক মঞ্চায়নের সবচেয়ে রমরমা সময়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার দশ বছর পর গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান যখন জন্ম নেয় তখন বাংলাদেশে বিভিন্ন জেলা থেকে ছেচল্লিশটি নাট্যদলের প্রতিনিধি ফেডারেশানের উদ্বোধনী অধিশেনে অংশ গ্রহণ করে। সে সময় সারা বাংলাদেশে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের সদস্যভুক্ত দলের সংখ্যা ছিলো সাতষট্টিটি। তার মধ্যে ঢাকা মহানগরের নাট্যদলের সংখ্যা ছিলো সতেরো।
উনিশশো বিরাশি সালের ডিসেম্বর মাসে সারাদেশে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় একাত্তরে। যে-কোনো নাট্য আন্দোলনের জন্য সংখ্যাটি খুব উল্লেখযোগ্য নয়। পঁচাশি সালে থিয়েটার পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরে গ্রুপ থিয়েটার চর্চা খুবই সীমাবদ্ধ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ঢাকার বাইরের নাট্যদলগুলো বছরে তিন চারটি প্রদর্শনী করে কোনোভাবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। ঢাকার বাইরের নাট্যানুষ্ঠান আয়োজনের মূল সমস্যা দর্শক পাওয়া যায় না। নাট্যদলগুলোও সুসংগঠিত নয়।
জেলা শহরের দলগুলো বেশির ভাগেরই নিজেদের কোনো মহিলা শিল্পী নেই। মহিলা শিল্পী না আসার প্রধান কারণ সামাজিক বাধা। যা প্রমাণ করে ঢাকার বাইরে নাট্য আন্দোলন তখনো সেভাবে দানা বাঁধতে পারেনি। নাট্য আন্দোলন দানা বাঁধলে, ব্যাপক মানুষের তাতে অংশগ্রহণ থাকলে সামাজিক বাধা আসতে পারতো না। নাট্য আন্দোলন যেহেতু নাটকের দলগুলোর দ্বারাই গড়ে উঠবার কথা, সে বিচারে যে-কোনো নাট্য আন্দোলনের পূর্ব শর্ত হচ্ছে বেশি বেশি নাটকের দল গড়ে তোলা।
আমরা, দেখতে পাচ্ছি, সামাজিক কারণে ঢাকার বাইরের মফস্বল শহরগুলোতে সত্যিকারের নাটকের দল গড়ে তোলাই ছিলো কঠিন। যাঁরা মনে করছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তচিন্তার সুযোগ এসেছে, তাঁদের বক্তব্য যে সঠিক ছিলো না তাও এ ঘটনায় প্রমাণিত হয়।
বাংলাদেশে আশির দশক থেকে প্রথম জেলা শহরগুলোতে নাটক মঞ্চায়ন কমে আসতে শুরু করে, পরবর্তীতে ঢাকা শহরেও। আশির দশকের শুরু থেকেই যে মফস্বলের দলগুলো নির্জীব হয়ে পড়ছিলো থিয়েটার পত্রিকার ‘গ্রুপ থিয়েটার: জেলায় জেলায়’ শিরোনামের সংবাদগুলো পাঠ করলেই তা দেখা যাবে। রামেন্দু মজুমদার পঁচাশি সালের মার্চ মাসে থিয়েটার পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লিখছেন যে, ‘রাজধানী’ ঢাকাতে আজ একাধিক মঞ্চে প্রতিদিন নাটক হয় এবং তা দর্শকদের আনুকূল্য লাভ করে। কিন্তু ঢাকা ও চট্টগ্রাম ছাড়া দেশের অন্যান্য শহরের এ চিত্র ভিন্ন। গ্রুপ থিয়েটার চর্চা সেখানে বড়ই সীমাবদ্ধ। চুয়াত্তরের দিকে সর্বত্র একটা জোয়ার পরিলক্ষিত হয়েছিলো।
কিন্তু আস্তে আস্তে তা স্তিমিত হয়ে গেছে।রামেন্দু মজুমদার ঢাকার নাট্যদলগুলো সম্পর্কে যে কথা বলেছেন, তা সত্য হলেও পূর্ণ সত্য ছিলো না। ঢাকার নাটকও তখন পুরানো গতিবেগ হারিয়ে ফেলে। আশি সাল শেষ হবার আগে যেমন মহিলা সমিতি প্রতিদিন ব্যস্ত থাকতো দর্শকদের ভিড়ে, নতুন নতুন দল নতুন নতুন নাটক নিয়ে উপস্থিতি হতো, পত্রিকা খুললেই রোজ সকালে কোনো না নাট্য দলের বিজ্ঞাপন নজরে পড়তো, সে অবস্থাটা আর রইলো না।চট্টগ্রামসহ সারা বাংলাদেশ জুড়ে সত্তর দশকের শুরুর দিকে নাট্যজগতে যে উদ্যম দেখা গিয়েছিলো, দশ বছরের মাথায় তা অনেকটাই বিবর্ণ হয়ে আসে।
উনিশশো উননব্বই সালে গ্রুপ থিয়েটারের এক বিশেষ বুলেটিন সংখ্যায় দেখা যায়, সারাদেশে গ্রুপ থিয়েটারের সদস্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছে একশো চৌত্রিশ। তার মধ্যে ঢাকা মহানগরীরই দলের সংখ্যা বত্রিশ। সেই বুলেটিনে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের দলগুলোর এক বছরের নাট্য প্রদর্শনীর একটি তালিকাও প্রদান করা হয়। সেখানে দেখা যায়, আটাশি সালের পহেলা এপ্রিল থেকে উননব্বই সালের একত্রিশে মার্চ পর্যন্ত ঢাকা মহানগরীর ষোলটি দলের নাটক মঞ্চায়নের সংখ্যা ছিলো তিনশো বাইশটি, আর ঢাকার বাইরের চল্লিশটি দলের মোট প্রদশনীর সংখ্যা ছিলো দুইশো সাতটি। বাকি অনেক দলের কাছ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।যেসব দল তথ্য পাঠায়নি ধরে নেয়া যেতে পারে তাদের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ড বা প্রদর্শনী ছিলো না।
একশো চৌত্রিশটি দলের মধ্যে মাত্র চল্লিশটি দলের প্রতিবেদন পাঠানো বাকি দলগুলোর নিষ্ক্রিয়তাই প্রমাণ করে। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের তালিকাভুক্ত দলগুলোর বড় একটি অংশ যে কোনোরকম কার্যক্রম ছাড়াই নামসর্বস্ব হয়ে টিকে আছে এর থেকে বোঝা যায়। বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের সত্যিকারের কর্মধারার ব্যাপকতাও এর মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়।
নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও দলগুলোর নাট্য মঞ্চায়নের কার্যক্রম বৃদ্ধি পায়নি। উনিশশো নিরান্নব্বই সালে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের পঞ্চদশ জাতীয় সম্মেলনে ফেডারেশানের সদস্যভুক্ত দলের সংখ্যা দেখা যায় একশো পঁচাত্তরটি। তার মধ্যে ঢাকা মহানগরের নাট্য দলের সংখ্যা দাঁড়ায় উনষাট। উননব্বই সাল থেকে নিরানব্বই সাল পর্যন্ত দশ বছরে ঢাকা মহানগরের বাইরে দলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে চোদ্দটি।
আর ঢাকা মহানগরে দলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে সাতাশটি। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানকে পাঠানো বিভিন্ন দলের প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি, সাতানব্বই সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে একত্রিশে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা মহানগরীর বাইরের ফেডারেশান ভুক্ত একচল্লিশটি দলের মোট প্রদর্শনী সংখ্যা চারশো আটত্রিশটি। আর ঢাকা মহানগরীর পনেরটি দলের মোট প্রদর্শনী সংখ্যা তিনশো আটাশটি। আটানব্বই সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে একত্রিশে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা মহানগরীর বাইরের ফেডারেশান ভুক্ত সাতচল্লিশটি দলের মোট প্রদর্শনী সংখ্যা চারশো তিপ্পান্নটি। আর ঢাকা মহানগরীর একুশটি দলের মোট প্রদর্শনী সংখ্যা তিনশো উনচল্লিশটি।
বাকি দলগুলোর কাছ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ঢাকার বাইরের নাট্য দলগুলোর পাঠানো তথ্য কতোটা সঠিক সেটাও প্রশ্নাতীত নয়। বিভিন্ন দলগুলো অনেক সময়েই নিজেদের কার্যক্রম ব্যাপকভাবে দেখাবার জন্য প্রদর্শনীর সংখ্যা বাড়িয়ে দেখায়।যদি আমরা বিভিন্ন দলের পাঠানো তথ্য সঠিক ধরে নেই তাহলেও দেখা যাবে জেলা শহরের নাট্য প্রদর্শনীর সংখ্যা তেমন উৎসাহ সৃষ্টি করে না।
বিশেষ করে নাট্য আন্দোলনের জায়গা থেকে দেখতে গেলে যা আমরা দেখতে পাবো তাহলো, ঢাকা মহানগরীর বাইরে বাংলাদেশের কোথাও নিয়মিত নাট্য প্রদর্শনীর ধারা গড়ে ওঠেনি। ঢাকার বাইরের কয়েকটি দলের মোট প্রদর্শনীর সংখ্যা উল্লেখ করলে সেটা বুঝে নেয়া সহজ হবে। বরিশালের ‘খেয়ালী গ্রুপ থিয়েটার’ খুবই পুরানো সংগঠন। উনিশশো উনসত্তর সালে এই সংগঠনটির জন্ম। স্বাধীনতার পর খেয়ালী তার নামের শেষে গ্রুপ থিয়েটার শব্দটি সংযুক্ত করে। মফস্বলের দলগুলোর মধ্যে খুবই কর্ম তৎপর এই দলটি। স্বাধীনতার পর তারা পঞ্চাশটির মতো নাটকের প্রযোজনা করে, যা বাংলাদেশের বা ঢাকা শহরের কোনো নাট্যদলই করতে পারেনি।
কিন্তু দেখা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে পঁচানব্বই সাল পর্যন্ত চব্বিশ বছরে তাদের পঞ্চাশটি নাটকের মোট প্রদর্শনী সংখ্যা দাঁড়ায় তিনশোর মতো। এই সবগুলো প্রদর্শনী মঞ্চের নয়, তিনশোর মধ্যে বহু পথ নাটকও রয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, দলটি সারা বছরে বারোটি প্রদর্শনী বা গড়ে প্রতি মাসে একটি করে প্রদর্শনী করতে পারেনি।
চুয়াডাঙ্গা জেলার ‘অরিন্দম’ উনিশশো ছিয়াশি সালের নভেম্বর থেকে সাতানব্বই সালের আগস্ট পর্যন্ত এগারো বছরে চোদ্দটি নাটকের মাত্র তেত্রিশটি প্রদর্শনী করেছে। যার অর্থ বছরে গড়ে তিনটি করে প্রদশনী। চুয়াডাঙ্গার ‘চুয়াডাঙ্গা থিয়েটার’-এর এক হিসাবে দেখা যায়, উনিশশো চুরানব্বই সালের জুন মাস থেকে আটানব্বই সালের মে মাস পর্যন্ত তারা মঞ্চে তাদের সাতটি নাটকের মাত্র ষোলটি প্রদর্শনী করে। বছরে দলটির গড় মঞ্চায়নের সংখ্যা দাঁড়ায় চারটি।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা শহরে মঞ্চায়িত নাটকগুলোর দর্শকের সংখ্যাও তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। আর টিকেট কেটে নাটক দেখার দর্শক সংখ্যা আরো কম। বেশির ভাগ নাটকগুলোরই এক রাতে মৃত্যু ঘটে, কম সংখ্যক নাটকই বারবার মঞ্চায়িত হয়। ঢাকা চট্টগ্রাম ছাড়া দেশের আর কোথাও দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত নাটক মঞ্চায়িত হয় না। বিভিন্ন স্থানে চেষ্টা করা হয়, কিন্তু অল্প কয়েকদিন পরই আবার তা বন্ধ হয়ে যায়। খুলনা, ঠাকুরগাঁও, বরিশাল, বাগেরহাট, যশোর, দর্শনা, বগুড়া, ইত্যাদি শহরের বিভিন্ন সংগঠন নিয়মিতভাবে নাটক মঞ্চায়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করলেও শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি।
বিপুল সমারোহে বা ক্ষুদ্র পরিমণ্ডলে যে-সকল নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছিলো রাজধানী কিংবা বিভিন্ন শহরে, তা মূলত ছিলো নিম্নমধ্যবিত্ত ও সুবিধাভোগীদের জন্যই। স্বাধীনতা-পূর্ব এবং স্বাধীনতার পর দু-ক্ষেত্রেই কথাটা সমানভাবে সত্য। বাংলাদেশের যে নাট্য আন্দোলন তা মূলত রাজধানী কেন্দ্রিক হলেও রাজধানীতেও নাট্য আন্দোলন তেমন কোনো ব্যাপক দর্শক তৈরি করতে পারেনি। জিয়া হায়দার লিখছেন, ‘মনে রাখতে হবে, রাজধানীর লোকসংখ্যা প্রায় পৌনে এক কোটি… মাত্র এক শতাংশ লোকই ঢাকার গ্রুপ থিয়েটারের দর্শক তা’ও যেসব নাটক সহজ-জনপ্রিয়তায় বিখ্যাত, সেগুলির’।
জিয়া হায়দারের বক্তব্য মতো ঢাকায় নাটকের দর্শক সংখ্যা দাঁড়ায় এক লক্ষ। সে সংখ্যাটাও যথেষ্ট বিতর্কিত। ঢাকার যে দুটি মঞ্চে সাধারণত নাটক হয় তাহলো মহিলা সমিতি ও গার্লস গাইড মিলনায়তন। সেখানে এক সাথে চারশো দর্শক নাটক দেখতে পারে। যদি বাড়তি আসন দেয়া যায় সাড়ে চারশো লোক বসতে পারে। যদি কোনো নাটকের মঞ্চায়ন পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে ন্যূনতম দুশো বিশটি হয় তাহলেই একলক্ষ দর্শক পাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশের মঞ্চে খুব কম নাটকই পঞ্চাশটির বেশি প্রদর্শনী করতে পেরেছে। দুশো প্রদর্শনী করেছে এমন নাটকের সংখ্যা ছয় সাতটির বেশি নয়। সব প্রদর্শনী আবার সব সময় পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে হয় না। বহু মঞ্চায়নেই মিলনায়তন ফাঁকা থাকে।
যে-কোনো দলের নাটকের দুশো প্রদর্শনী হতে কয়েক বছর লেগে যায়। ফলে ঢাকা শহরে নাটকের এক লক্ষ দর্শক আছে কি না সেটা ভেবে দেখবার বিষয়। মঞ্চনাটক দীর্ঘ সময়ের পথযাত্রায়ও ব্যাপক মানুষের কাছে পৌছুতে পারেনি। দেশের সামান্য কয়েকটি অঞ্চলে এর বিস্তার ঘটলেও সারা দেশে ব্যাপকভাবে তা কখনও ছড়িয়ে পড়েনি। ঢাকা বা বিভিন্ন অঞ্চলে আমরা নাটকের যে দর্শকদের দেখা পাই স্বভাবতই সেই দর্শক মধ্যবিত্ত দর্শক।
সেই মধ্যশ্রেণীই যেমন নাটক প্রযোজনা করছে, দর্শকও তেমনি মধ্যশ্রেণী। বাংলাদেশের নাটক শুরুই হয়েছিলো মধ্যবিত্তকে নিয়ে এবং শেষ পর্যন্ত নাটককে আমরা সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। যাঁরা সে সময়কার নাট্যচর্চাকে নাট্য আন্দোলন বলতে চাননি তাঁদের মূল যুক্তিটি ছিলো দর্শকের স্বল্পতা।
দর্শকদের সংখ্যার প্রশ্নেই অনেকে এই নাট্যচর্চাকে নাট্য আন্দোলন বলে স্বীকৃতি দেননি। আবার অনেকে একই সাথে নাটকের বক্তব্যের প্রশ্ন তুলেও এ ধারাকে নাট্য আন্দোলন হিসাবে মেনে নেননি। শাহরিয়ার কবির পঁচাত্তর সালে বাংলাদেশের মঞ্চের নাট্যচর্চা সম্পর্কে লিখছেন, ‘গত দুই দশকে যেখানে উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না সেখানে তিন বছরে এই অগ্রগতিকে আশাব্যঞ্জক বলা যাবে, যদি নাটকের এই ধারা একটি সুনির্দিষ্ট নাট্য আন্দোলনের জন্ম দিতে পারে। যাঁরা এখনই এটাকে নাট্য আন্দোলন বলছেন তাদের সঙ্গে আমি অবশ্য দ্বিমত পোষণ করি। কারণ একটি শিল্প আন্দোলনের যে বৈশিষ্ট্যগুলো থাকা দরকার বাংলাদেশের গত তিন বছরের নাটকে সেই বৈশিষ্ট্য গুলো অনিবার্যভাবে অনুপস্থিত ছিল।’ তিনি দেখাচ্ছেন যে, এটা নাট্য আন্দোলন নয় তার প্রধান কারণ এর দর্শক সংখ্যা খুবই সামান্য।
সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে ঢাকার যে-কোনো একটি ভালো নাটক দেখার দর্শক মাত্র তিন হাজার, যাদের সিংহভাগ আবার একটি বিশেষ শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে। অথচ ঢাকায় একটি ভালো বিদেশি ছবির দর্শক সংখ্যা কম করে হলেও পঁচিশ হাজার। দেশি ছবির দর্শক সংখ্যা ন্যূনতম দুই লক্ষ। তিনি উদাহরণ টেনে দেখান যে, সে সময় ঢাকায় একবার যাত্রা প্রদর্শনীর আয়োজন করা হলে সেখানে প্রতিরাতে চার হাজার দর্শকের উপস্থিতি ছিলো, চল্লিশ দিন পর্যন্ত পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে সে যাত্রা চলেছিলো। সেজন্য তিনি দর্শকের পটভূমিতে কোনোভাবেই নাটককে আন্দোলন হিসাবে স্বীকৃতি দিতে রাজি ছিলেন না।

বাংলাদেশের ত্রিশ বছরের নাট্য ইতিহাস প্রমাণ করে এ নাট্যধারা শুধু রাজধানী ঢাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ এবং যে মধ্যশ্রেণীকে নিয়ে মধ্যশ্রেণীর জন্য নাট্যচর্চা শুরু হয়েছিলো, সেই মধ্যশ্রেণীর গণ্ডি বাংলাদেশের নাটক কখনো ভাঙতে পারেনি। বাংলাদেশের নাট্যপ্রযোজনার ক্ষেত্রে যদিও তা ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছিলো তবে সে পরিবর্তন সবসময় আশানুরূপও ছিলো না। যেমন আটাত্তর সালে রামেন্দু মজুমদার লিখছেন, ‘বাংলাদেশে বিরাট একটা নাট্যান্দোলন সংঘটিত হয়ে গেছে বলে অনেকে চূড়ান্ত রায় দিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু যা কিছু হয়েছে তা নিয়ে সত্যিকারের সৎ নাট্যকর্মীদের আত্মতৃপ্তির অবকাশ আছে বলে আমি মনে করি না। এখনো আমরা আমাদের নাটক বৃহত্তর দর্শক সমাজের কাছে পৌছাতে পারি নি।’
নাসির উদ্দীন ইউসুফের ‘প্রসঙ্গ: গ্রাম থিয়েটার’ প্রবন্ধে একই বক্তব্যের প্রতিধ্বনি দেখতে পাই। আশির দশকে ঢাকা থিয়েটার গ্রাম থিয়েটার গড়ে তোলে ঢাকার নাট্য আন্দোলন রাজধানীর সীমিত দর্শকদের মধ্যে আটকে ছিলো বলে। আশির দশক পর্যন্ত নাটকের এই যে রাজধানীর মধ্যে আটকে থাকা সেটা সত্যিকার অর্থে কোনো নাট্য আন্দোলন ছিলো না বলে তিনি মনে করেন। তিনি লিখছেন, ‘উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষেরা ভোগ বিলাসী ও সুবিধাবাদী। শুধুমাত্র তাদের সামনে নাটক করে সমাজ পরিবর্তনের যে স্বপ্ন আমরা দেখছি তা কখনও সফল হতে পারে না।’
মধ্যবিত্ত মানসিকতার প্রভাব ও স্বচ্ছ চিন্তার অভাবের কারণেই প্রথম থেকেই আমরা দেখবো নাট্য আন্দোলন নানা বিভ্রান্তির মধ্য দিয়ে আগাতে থাকে। নাট্য আন্দোলনকে কখনো আমরা একটি স্থির লক্ষ্যে দাঁড়িয়ে থেকে কাজ করতে দেখিনি। কোনো ধরনের সঠিক চিন্তার প্রয়োগও আমরা লক্ষ্য করি না। বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলন ত্রিশ বছরেও যে কোনো উল্লেখযোগ্য অবস্থানে যেতে পারেনি তা নাট্য আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মীদের বক্তব্যের মধ্য দিয়েই বের হয়ে আসে। ঢাকা মহানগরীর বাইরে যেমন, ঢাকা শহরেও তেমন নাটক নানা সংকটের মধ্য দিয়ে আগাতে থাকে।
নিরানব্বই সালে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের মহাসচিবের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মঞ্চ-নাটক সম্পর্কে লেখা হয়, ‘বলতে দ্বিধা নেই সারা দেশের মঞ্চ নাটক এক গভীর সংকটে নিমজ্জিত’। তিনি আরো বলেন, ‘মঞ্চ-মিলনায়তনের অভাব তো আমাদের নাট্যচর্চার পুরাতন সমস্যা। তারই সাথে যুক্ত হয়েছে দর্শক সংকট। মানুষকে নাটকের প্রতি আকৃষ্ট করাটাও এক সমস্যা।’
আতাউর রহমান লিখছেন, ‘দেশের নাট্যস্রোত এখন ভীষণ শীর্ণ, কালে- ভদ্রে ভাল নাটক প্রযোজিত হয়, সত্তর-আশির দশকের নাট্যচর্চার সে রমরমা দিনগুলো আজ পলাতক। নাট্য প্রযোজনার মান বর্তমানে নিম্নগামী, সুরুচি, নান্দনিক বোধ ও সুষ্ঠু নাট্য বুদ্ধির দুর্ভিক্ষ দেশের নাট্যাঙ্গনকে গ্রাস করেছে।’ ৯ সমালোচক আতাউর রহমান কিছু মিথ্যা বলেননি। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে কিছু কিছু ভালো প্রযোজনা যেমন নাট্যাঙ্গনকে চকিত করে তুললো, বাকি ক্ষেত্রে ঘটলো ঠিক উল্টো। গণনাট্য, বহুরূপী, নান্দিকার এবং উৎপল দত্তের প্রচেষ্টায় বিজ্ঞানমনস্ক ভিন্ন ধরনের নাট্যচর্চার সূত্রপাত হয়েছিলো পশ্চিম বাংলায়, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে সেই ধারারই বিকাশ ঘটে নাট্য নির্দেশনায়, মঞ্চ নির্মাণে, শব্দ প্রক্ষেপণে ও আলোক বিন্যাসে।
নির্ধিদ্বায় বলা যায়, অভিনয় এবং প্রযোজনায় আঙ্গিককুশলতার মান স্বাধীনতার পর বিস্ময়কর উন্নতি লাভ করে অতি অল্প সময়ের মধ্যে। কিন্তু শুরুতে যে উদ্দীপনা দেখা গিয়েছিলো, তাতেও যেনো ভাটা পড়লো খুব দ্রুতই। পরবর্তীতে নাট্যচর্চার আঙ্গিক কুশলতা ও অভিনয়ের ব্যর্থতাও বেশি করে চোখে পড়তে লাগলো।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের অনুপ্রেরণায় এবং স্বাধীন দেশের ঘটমান বাস্তবতাকে ঘিরে যে গ্রুপ থিয়েটার নাট্যধারার জন্ম, সেই গ্রুপ থিয়েটারের চরিত্রটি কী রকম ছিলো, সেই নাট্যধারাকে এবং নাটকের প্রধান প্রধান বিষয়বস্তুগুলোকে একটু বিশ্লেষণ করা দরকার। সেজন্য গ্রুপ থিয়েটারগুলোকে প্রধানত আমরা তিন ধারায় ভাগ করতে পারি। প্রথম ধারায় ধরতে পারি যারা বিশেষ একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে অর্থাৎ শ্রেণীসংগ্রামের বা সমাজতন্ত্রের পক্ষে নাটক করবার ঘোষণা দিয়েছিলো। দ্বিতীয় ধারায় পড়ে যারা কোনোরকম রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ব্যক্ত না করে মানুষের কথা বলতে চেয়েছিলো এবং শেষ ধারায় পড়ে যারা নাট্য আন্দোলন বা নাট্যচর্চার নামে দর্শক মনোরঞ্জনের দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়েছিলো।
শেষ পর্যন্ত যদিও এই বিভাজন রক্ষিত হয়নি। নব্বইয়ের দশকে এসে গ্রুপ থিয়েটারগুলো সর্বত্র প্রায় একই লক্ষ্য পথে ধাবিত হচ্ছিলো। সেখানে গ্রুপ থিয়েটারগুলোর কার্যক্রমকে ভাগ করা যায় দুটি ভাগে। যারা বিষয়বস্তু ও প্রযোজনার ক্ষেত্রে কিছুটা মান বজায় রাখতে পেরেছে আর যারা তা একেবারেই পারেনি। দুপক্ষ সম্পর্কেই একথাও বলা যায়, সমাজচেতনার সঠিক বোধ না থাকায় বা সজাগ দৃষ্টির অভাবে দুপক্ষই বিষয়বস্তুর মধ্যে বহুক্ষেত্রেই ক্ষতিকারক মশলা বিতরণ করেছে।
নাটক পৃথিবীর প্রাচীনতম শিল্প মাধ্যমগুলোর অন্যতম। শিল্পকলার অন্য যে-কোনো মাধ্যমের চেয়ে নাটকের আবেদন সৃষ্টির ক্ষমতা অনেক বেশি। কারণ নাটক চোখ দিয়ে দেখার, কান দিয়ে শোনার, অনুভূতি দিয়ে উপলব্ধি করার শিল্প। কিন্তু নাট্যচর্চা যদি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কহীন হয়ে কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে তবে তা গণ-সংস্কৃতির সঙ্গেও সম্পর্কহীন হয়ে পড়তে বাধ্য।”? বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের ক্ষেত্রে কথাটি চরমভাবে সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। বিগত তিন দশক ধরে নাটক হয়েছে, নাটকের কোনো সত্যিকার আন্দোলন গড়ে ওঠেনি।
ঐক্যবদ্ধভাবে বাঁচার কোনো পরিকল্পনা নিতে পারেনি নাট্যদলগুলো। লক্ষ্যে কোনো স্পষ্টতা নেই, সাংগঠনিক-আর্থিক সংকটের মোকাবেলায় নতুন কোনো পথও খুঁজে বের করা যায়নি, দর্শক তৈরি হয়নি, সমালোচনার কোনো বলিষ্ঠ ঐতিহ্য গড়ে ওঠেনি। ভালো নাটকের যেমন অভাব, ঠিক তেমনি অভাব প্রতিশ্রুতিশীল ত্যাগী নাট্যকর্মীর। নাট্যচর্চায় নতুন কোনো প্রতিভাবান নির্দেশক ও কলাকুশলীর দেখাও মিলছে না। নাট্যচিস্তকরা শুধু প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি করছেন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে যেমন এ নাট্য আন্দোলন শুরু হয়েছিলো, তিনদশক ধরে তেমনি পথ চলছে তাৎক্ষণিক আবেগ ও ঘটনার দ্বারা। সেখানে নেতৃত্বের শ্রেণীস্বার্থ দ্বারাই নাট্য আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি নানাভাবে প্রভাবিত হয়েছে। বিভিন্ন সময় বা দশকে সেই গতি প্রকৃতি কীভাবে প্রভাবিত হয়েছিলো তাই আমরা পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে আলোচনা করবো।
আরও দেখুন: