বাংলা নাটক ও চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নারী অভিনেত্রীদের অবদান অপরিসীম। তবে এই যাত্রা কখনোই সহজ ছিল না। উনিশ শতকের শেষভাগে যখন নাট্যমঞ্চে নারী-অভিনেত্রীর আবির্ভাব ঘটল, তখন সমাজের নানা বাধা, রক্ষণশীলতা ও অবজ্ঞাকে অতিক্রম করতে হয়েছিল তাঁদের। সেই প্রথম অগ্রদূতদের সাহসী পদক্ষেপ আজকের আধুনিক অভিনেত্রীদের জন্য পথ প্রশস্ত করেছে।
১. প্রারম্ভিক সময়: নারী মঞ্চে (উনিশ শতক)
বাংলা নাট্যজগতে উনিশ শতক ছিল এক অভূতপূর্ব পরিবর্তনের যুগ। প্রাথমিক পর্যায়ে সমাজে নারীর স্থান ছিল সীমাবদ্ধ; সেকালে নারীরা জনসমক্ষে অভিনয়কে অনৈতিক ও অসম্মানজনক কাজ হিসেবে ভাবা হতো। ফলে নাট্যমঞ্চে নারীচরিত্রও পুরুষ অভিনেতারাই ফুটিয়ে তুলতেন। একসময় নাটকের মূল আকর্ষণ হয়ে উঠেছিল এই পুরুষ অভিনেতাদের নারীর বেশধারণ ও অভিনয় দক্ষতা।
তবে ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রভাবে সাহসী কিছু নারী সমস্ত সামাজিক বাঁধা অগ্রাহ্য করে প্রথমবারের মতো মঞ্চে আসেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বীণা দাসী, গিরিবালা দেবী, ত্রিপুরাসুন্দরী প্রমুখ। তারা অসংখ্য গঞ্জনা, সামাজিক বর্জন ও পারিবারিক চাপে থেকেও নাট্যমঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রমাণ করেছিলেন যে নারীও অভিনয়ে সমানভাবে দক্ষ।
এই নারীদের পথপ্রদর্শক ছিলেন নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষসহ একদল উদারচেতা নাট্যব্যক্তিত্ব। তাঁরা বুঝেছিলেন—যদি নাটককে বাস্তবসম্মত ও প্রাণবন্ত করতে হয়, তবে নারীচরিত্রে প্রকৃত নারীর অভিনয় অপরিহার্য। গিরিশচন্দ্র ঘোষ নারীদের মঞ্চে আনতে নানা উদ্যোগ নেন এবং তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে আংশিকভাবে হলেও ভাঙতে সক্ষম হন।
নারীদের মঞ্চে আগমন কেবল নাটকের জগতে নতুন মাত্রা যোগ করেনি, এটি ছিল নারীমুক্তির আন্দোলনের এক প্রতীকী পদক্ষেপও। এই সূচনা থেকেই ধীরে ধীরে বাংলার নাট্যাঙ্গনে নারী-অভিনেত্রীদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়, যা পরবর্তী শতকে নাটক ও চলচ্চিত্রে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণের ভিত্তি গড়ে তোলে।

২. বিংশ শতকের প্রথমার্ধ: পেশাদার অভিনেত্রীদের উত্থান
বিংশ শতকের প্রথমার্ধ ছিল বাংলা নাটক ও চলচ্চিত্র ইতিহাসে নারীদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। উনিশ শতকের শেষভাগে যেখানে নারী অভিনেত্রীরা সমাজের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে মঞ্চে দাঁড়ানোর সাহস করেছিলেন, সেখানে বিশ শতকের শুরুতে তাঁরা ধীরে ধীরে নিজেদের পেশাদার অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে শুরু করেন। এবার তাঁরা কেবল মঞ্চেই সীমাবদ্ধ থাকলেন না, বরং নবীন মাধ্যম—চলচ্চিত্রেও পদার্পণ করলেন।
চলচ্চিত্রে নারীর আবির্ভাব
বাংলা চলচ্চিত্রের শুরুর সময়েও নারী চরিত্রে পুরুষরাই অভিনয় করতেন। তবে সাইলেন্ট সিনেমার যুগ শেষ হয়ে টকিজ সিনেমা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নারী অভিনেত্রীদের উপস্থিতি অপরিহার্য হয়ে ওঠে। কারণ, সংলাপভিত্তিক ছবিতে নারীর কণ্ঠ ও ভঙ্গি ছাড়া নারীচরিত্রকে পূর্ণতা দেওয়া সম্ভব ছিল না। এই বাস্তবতার মধ্য দিয়েই নারীরা চলচ্চিত্রে সক্রিয়ভাবে প্রবেশ করেন।
কানন দেবী: প্রথম সুপারস্টার অভিনেত্রী
এই সময়ে আবির্ভূত হন কানন দেবী, যিনি বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম প্রকৃত সুপারস্টার অভিনেত্রী হিসেবে স্বীকৃত। তাঁর কর্মজীবনের শুরু হয়েছিল শিশুশিল্পী হিসেবে, তবে ধীরে ধীরে তিনি নায়িকা হিসেবে জনপ্রিয়তা পান। ‘মুক্তি’ (১৯৩৭) চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয় তাঁকে অভূতপূর্ব উচ্চতায় নিয়ে যায়। কানন দেবীর সাফল্য দেখিয়ে দেয় যে, নারীরা কেবল গৌণ চরিত্রে নয়, বরং গল্পের কেন্দ্রে থেকেও দর্শকনন্দিত হতে পারেন। তাঁর অভিনয়, কণ্ঠস্বর ও ব্যক্তিত্ব তাঁকে সাধারণ দর্শকের কাছে এক অদ্বিতীয় আইকন বানিয়ে তোলে।
অন্যান্য প্রখ্যাত অভিনেত্রী
কানন দেবীর পাশাপাশি আরও অনেক অভিনেত্রী এই সময় জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
চন্দ্রাবতী দেবী: তাঁর সাবলীল অভিনয় ও শক্তিশালী সংলাপ উচ্চারণ তাঁকে দর্শকদের কাছে বিশেষ মর্যাদা দেয়।
রাণী মুখার্জী (প্রবীণ অভিনেত্রী): তিনি মঞ্চ ও প্রাথমিক চলচ্চিত্র উভয় ক্ষেত্রেই নিজের পরিচিতি গড়ে তোলেন।
প্রমীলা দেবী: তাঁর অভিনয় বাংলা চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করে তোলে এবং নারী চরিত্রকে নতুন মাত্রা দেয়।
সমাজে প্রভাব ও মর্যাদা
এই অভিনেত্রীদের আবির্ভাব শুধু শিল্পের ক্ষেত্রেই নয়, সমাজেও একটি নতুন ধারা সৃষ্টি করে। তাঁদের কারণে নারী চরিত্র আর শুধু নায়কের ছায়া বা পার্শ্বচরিত্র রইল না। বরং চলচ্চিত্র ও নাটকের কাহিনিতে নারীর অবস্থান হয়ে উঠল কেন্দ্রীয়। নারী চরিত্রগুলোতে আসল আবেগ, দ্বন্দ্ব ও স্বপ্নের প্রকাশ ঘটতে শুরু করে।
একইসাথে এই সময়কার নারী অভিনেত্রীরা প্রমাণ করেছিলেন যে অভিনয় একটি পেশা হতে পারে। এর ফলে ধীরে ধীরে সমাজে নারী অভিনয়শিল্পীদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে এবং নতুন প্রজন্মের নারীরা অভিনয় জগতে আসার সাহস পান।
বিংশ শতকের প্রথমার্ধে পেশাদার নারী অভিনেত্রীদের উত্থান বাংলা নাটক ও চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়। তাঁদের উপস্থিতি বাংলা চলচ্চিত্রকে শুধু শিল্পসম্মত উচ্চতাই দেয়নি, বরং নারী চরিত্রকে কেন্দ্রস্থলে এনে দিয়েছে। কানন দেবী, চন্দ্রবতী দেবী, রাণী মুখার্জী ও প্রমীলা দেবীরা তাঁদের প্রতিভা ও সাহসিকতার মাধ্যমে প্রমাণ করেছিলেন—অভিনয় জগতে নারীরা কেবল অংশগ্রহণকারী নন, তাঁরা কেন্দ্রীয় শক্তি।

৩. ১৯৫০–৬০-এর দশক: সোনালি যুগের নায়িকারা
বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসে ১৯৫০–৬০-এর দশককে যথার্থভাবেই “সোনালি যুগ” বলা হয়। এই সময়েই বাংলা সিনেমা আঞ্চলিক সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও স্বীকৃতি লাভ করে। এবং এই সাফল্যের কেন্দ্রে ছিলেন নারীরা। এ যুগে নারী অভিনেত্রীরা আর কেবল নায়কের প্রেমিকা বা গৌণ চরিত্রে সীমাবদ্ধ থাকেননি—তাঁরা হয়ে উঠেছিলেন গল্পের মূল চালিকাশক্তি। রোমান্টিক, ট্র্যাজেডি, সমাজসচেতন কিংবা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের নাটকে তাঁদের উপস্থিতি দর্শকের কাছে চলচ্চিত্রের আসল আকর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সুচিত্রা সেন: রোমান্টিক নায়িকার প্রতীক
বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালি যুগে সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র নিঃসন্দেহে সুচিত্রা সেন। তিনি কেবল বাংলা নয়, হিন্দি চলচ্চিত্রেও নিজের অমোঘ ছাপ রেখে গিয়েছেন।
হারানো সুর (১৯৫৭), অগ্নিপরীক্ষা (১৯৫৪), সপ্তপদী (১৯৬১) প্রভৃতি ছবিতে তিনি ছিলেন রোমান্টিক নায়িকার প্রতীক।
তাঁর অনন্য রসায়ন উত্তম কুমারের সঙ্গে বাংলা চলচ্চিত্রে নতুন এক যুগের সূচনা করে। “উত্তম–সুচিত্রা জুটি” আজও রোমান্সের প্রতীক হিসেবে কালজয়ী।
হিন্দি চলচ্চিত্রে Aandhi (১৯৭৫)-তে তাঁর অভিনয় তাঁকে জাতীয় স্তরে প্রতিষ্ঠিত করে।
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়: প্রাণবন্ত ও বাস্তবসম্মত অভিনয়
এই সময়ে আরেক উজ্জ্বল নাম সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়।
তিনি সামাজিক ও পারিবারিক নাটকে প্রাণবন্ত অভিনয়ের জন্য বিখ্যাত ছিলেন।
পথে হলো দেরি বা ঝিন্দের বন্দী ছবিতে তাঁর অভিনয় দর্শকদের কাছে গভীর প্রভাব ফেলে।
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী—তিনি রোমান্স, কমেডি থেকে শুরু করে ট্র্যাজেডি—সব ধরনের চরিত্রে সমান দক্ষ ছিলেন।
অরুন্ধতী দেবী: অভিনেত্রী থেকে পরিচালক
অরুন্ধতী দেবী ছিলেন সোনালি যুগের আরেক পথিকৃৎ শিল্পী।
তিনি শুধু সফল অভিনেত্রীই নন, পরিচালক হিসেবেও ছিলেন অগ্রণী।
তাঁর পরিচালিত চলচ্চিত্র ছোট্ট জিজ্ঞাসা (১৯৬৮) আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় এবং ভারতীয় সিনেমাকে বিশ্বমানচিত্রে তুলে ধরে।
তাঁর কাজ প্রমাণ করে নারীরা শুধু পর্দার সামনে নয়, পর্দার পেছনেও সমান দক্ষ।
বহুমুখী চরিত্র ও অভিনয়ের ক্ষেত্র
১৯৫০–৬০-এর দশকে নারী অভিনেত্রীরা কেবল রোমান্টিক চরিত্রেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। তাঁরা—
রোমান্সে: সুচিত্রা সেনের মতো অভিনেত্রী দর্শককে স্বপ্ন দেখিয়েছেন।
ট্র্যাজেডিতে: সামাজিক কষ্ট ও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ফুটিয়ে তুলেছেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়।
সমাজসচেতন চরিত্রে: অরুন্ধতী দেবী সমাজ-বাস্তবতার কথা বলেছিলেন সাহসী কণ্ঠে।
এই সময়ের নারী চরিত্রগুলো চলচ্চিত্রের কেন্দ্রস্থলে চলে আসে। গল্পের অগ্রগতি, আবেগের গভীরতা এবং দর্শকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে নারীর ভূমিকাই প্রধান হয়ে ওঠে।
সমাজে প্রভাব
এই সোনালি যুগ নারীর সামাজিক অবস্থানেও প্রতিফলিত হয়েছিল। সিনেমার মাধ্যমে দেখা যায়—নারী আর কেবল গৃহবন্দি নয়; তিনি প্রেমিকা, সংগ্রামী, বুদ্ধিমতী এবং স্বাধীনচেতা। এর ফলে সমাজে নারীর গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা বৃদ্ধিতেও সিনেমা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

৪. ১৯৭০–৮০-এর দশক: নতুন চেতনা ও বাস্তবধর্মিতা
১৯৭০–৮০-এর দশক ছিল বাংলা চলচ্চিত্রের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ষাটের দশকের সোনালি যুগ পার হয়ে এই সময়ে চলচ্চিত্রে এক নতুন ধারা গড়ে ওঠে—বাস্তবধর্মী চরিত্রায়ণ ও সামাজিক চেতনা। সমাজ তখন রাজনৈতিক অস্থিরতা, নকশাল আন্দোলন, অর্থনৈতিক সঙ্কট ও নারীমুক্তি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। এসব পরিবর্তনের প্রতিফলন দেখা যায় চলচ্চিত্র ও নাটকে, বিশেষত নারীর চরিত্রে।
সুচিত্রা সেনের উত্তরসূরি: সংবেদনশীলতার নতুন ধারা
ষাটের দশকের শেষভাগে সুচিত্রা সেন ধীরে ধীরে সিনেমা থেকে সরে গেলে তাঁর উত্তরসূরিদের দায়িত্ব হয় নারীর অভিনয়কে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাওয়া।
মাধবী মুখোপাধ্যায় সত্যজিৎ রায়ের চারুলতা (১৯৬৪)-তে এক গৃহবধূর নিঃসঙ্গতা ও আত্মজাগরণকে এমন বাস্তবভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন, যা আজও বিশ্ব চলচ্চিত্রের এক অনন্য উদাহরণ। সত্তরের দশকে তিনি আরও নানা চরিত্রে নিজের সংবেদনশীল অভিনয় চালিয়ে যান।
অপরাজিতা ঘোষ দাস-এর মতো অভিনেত্রীও এই সময়ে মঞ্চ ও চলচ্চিত্রে আবেগপ্রবণ অথচ সংযত চরিত্রাভিনয়ে খ্যাতি পান।
সমান্তরাল সিনেমার উত্থান
এই সময়েই বাংলা চলচ্চিত্রে আসে সমান্তরাল সিনেমার ধারা। বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের পাশাপাশি বিকল্প ধারার সিনেমা সমাজের বাস্তব সমস্যা ও সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে কাজ করতে থাকে।
মমতা শঙ্কর, যিনি সত্যজিৎ রায়ের অরণ্যের দিনরাত্রি ও গণশত্রু, গৌতম ঘোষের মহাপৃথিবী প্রভৃতি ছবিতে অভিনয় করে আলোচনায় আসেন। তাঁর অভিনয়ে ছিল স্বতঃস্ফূর্ততা ও গভীর মানবিক বোধ।
মহুয়া রায়চৌধুরী ছিলেন আশির দশকের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি বাণিজ্যিক ও সমান্তরাল উভয় ধারার ছবিতেই অভিনয় করেছেন। তাঁর অকালমৃত্যু (১৯৮৫) বাংলা চলচ্চিত্রে এক অপূরণীয় শূন্যতা তৈরি করে।
নারী চরিত্রের ভাঙন ও নতুন দিগন্ত
সত্তর–আশির দশকে নারী চরিত্র শুধু নায়িকার সীমাবদ্ধতায় আটকে থাকেনি। বরং তাঁরা সমাজের নানা বাস্তবতা তুলে ধরতে শুরু করেন।
গৃহবধূর সংগ্রাম, সমাজে নারীর অবস্থান, দাম্পত্য জীবনের দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন—সবই উঠে আসে সিনেমার পর্দায়।
নারী চরিত্র অনেক সময় কেন্দ্রীয় ভূমিকায় এসে দাঁড়ায়, যেখানে নায়ক নয়, বরং নারী-চরিত্রই গল্পকে এগিয়ে নেয়।
বাণিজ্যিক ছবিতেও নারীর ভূমিকা বদলাতে শুরু করে; তাঁরা কেবল রোমান্স বা গানের দৃশ্যের অংশ নন, বরং গল্পের আবেগ ও দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দু।
সমাজ ও সংস্কৃতিতে প্রভাব
এই সময়কার নারীরা দর্শকের মনে নতুন ভাবনার জন্ম দেন। সিনেমার মাধ্যমে দর্শকরা বুঝতে পারেন—নারী শুধু সংসারের অংশ নন, তিনি সমাজের পরিবর্তনেরও অংশ। বাস্তবধর্মী চরিত্রায়ণ সাধারণ নারীদের অভিজ্ঞতা ও সংগ্রামকে বৃহত্তর কণ্ঠস্বর দেয়।

৫. আধুনিক সময় (১৯৯০–বর্তমান)
বাংলা চলচ্চিত্রে ১৯৯০-এর দশক থেকে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। বাণিজ্যিক ছবির পাশাপাশি সমান্তরাল ধারা, পরবর্তীতে আর্ট-হাউজ এবং বর্তমানে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম—সব মিলিয়ে নারীর অভিনয় সুযোগ বহুমাত্রিক হয়ে ওঠে। আধুনিক বাংলা চলচ্চিত্রে নারীরা কেবল রোমান্টিক নায়িকার ভূমিকায় সীমাবদ্ধ নন, বরং সাহসী, পরীক্ষামূলক এবং সমাজ-বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করা চরিত্রে অভিনয় করছেন।
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত: দুই ধারাতেই সফলতার প্রতীক
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত আধুনিক বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম।
তিনি সমান দক্ষতায় বাণিজ্যিক ছবির নায়িকা ও সমান্তরাল ছবির সংবেদনশীল চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন।
দহন (১৯৯৭), পরমিতার একদিন (২০০০), চিরদিনই তুমি যে আমার (২০০৮) প্রভৃতি ছবিতে তাঁর বহুমুখিতা স্পষ্ট।
তিনি প্রমাণ করেছেন, জনপ্রিয়তা ধরে রেখেও একজন অভিনেত্রী শিল্পমানের ছবিতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারেন।
কোয়েল মল্লিক: মূলধারার জনপ্রিয় মুখ
২০০০-এর দশকে কোয়েল মল্লিক মূলধারার রোমান্টিক ও পারিবারিক ছবির মুখ হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
নাটের গুরু (২০০৩) থেকে শুরু করে হেমলক সোসাইটি (২০১২) পর্যন্ত নানা ধারার ছবিতে অভিনয় করে দর্শকের মন জয় করেছেন।
তিনি আধুনিক বাংলা বাণিজ্যিক ছবির ধারাবাহিকতা ধরে রাখেন এবং প্রমাণ করেন নারী-অভিনেত্রীও ইন্ডাস্ট্রির ভরসার স্তম্ভ হতে পারেন।
সমসাময়িক প্রজন্ম: সাহসী ও পরীক্ষামূলক চরিত্র
আধুনিক সময়ে নারী অভিনেত্রীরা কেবল গ্ল্যামার নয়, বরং কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং চরিত্রেও কাজ করেছেন।
স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়: মানসিক জটিলতা, সম্পর্কের দ্বন্দ্ব এবং সমাজে নারীর অবস্থানকে সাহসিকতার সাথে তুলে ধরেন। তাঁর মোন জাই না (২০০৮), তাহাদের কথা বা পারোমিতা একদিন–এ অভিনয় গভীর আলোচনার জন্ম দেয়।
পাওলি দাম: সাহসী চরিত্রে তিনি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও সমাদৃত হয়েছেন (চত্রক, ২০১১)।
নুসরাত জাহান ও মিমি চক্রবর্তী: মূলত বাণিজ্যিক ধারার হলেও সামাজিকভাবে প্রাসঙ্গিক ও পরীক্ষামূলক চরিত্রেও তাঁরা নিজেদের প্রমাণ করেছেন।
এই প্রজন্ম দেখিয়েছে—নারী চরিত্র শুধু দর্শক আকর্ষণের মাধ্যম নয়, গল্পের মেরুদণ্ডও হতে পারে।
ওটিটি যুগ: নতুন প্রজন্মের উত্থান
২০১৫-এর পর থেকে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বাংলা কনটেন্টে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
ইশা সাহা, সুরাঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়, অনিন্দিতা বোস, মধুমিতা সরকার প্রমুখ তরুণী অভিনেত্রীরা ওটিটির মাধ্যমে বহুমুখী চরিত্রে অভিনয় করছেন।
তাঁরা কখনো ক্রাইম-থ্রিলারের সাহসী পুলিশ অফিসার, কখনো সাইকোলজিক্যাল ড্রামার জটিল নারীর ভূমিকায় অভিনয় করে দর্শক মুগ্ধ করছেন।
ওটিটি নারীদের জন্য এমন চরিত্র তৈরি করেছে যা আগে মূলধারার সিনেমায় প্রায় অনুপস্থিত ছিল।
সমাজ ও সংস্কৃতিতে প্রভাব
আধুনিক বাংলা চলচ্চিত্রে নারী অভিনেত্রীদের এই বহুমাত্রিকতা সমাজে এক নতুন বার্তা দিয়েছে—নারীরা আর কেবল প্রেমের প্রতীক নন; তাঁরা স্বাধীনচেতা, দ্বন্দ্বময়, সমাজ-সচেতন, এমনকি বিদ্রোহী চরিত্রও ধারণ করতে সক্ষম। সিনেমা ও ওটিটির মাধ্যমে তাঁরা সমকালীন সমাজের নানা ট্যাবু ভাঙছেন, দর্শককে ভাবাচ্ছেন এবং নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করছেন।
৬. নাট্যমঞ্চে নারী অভিনেত্রীদের অগ্রগতি
বাংলা নাট্যমঞ্চের ইতিহাসে নারী অভিনেত্রীদের ভূমিকা চলচ্চিত্রের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। বরং বলা যায়, মঞ্চই ছিল নারীদের শিল্পীসত্তা প্রকাশের প্রথম এবং অন্যতম বড় ক্ষেত্র। উনিশ শতকের সমাজে যখন নারীরা জনসমক্ষে অভিনয় করতে সংকোচবোধ করতেন, তখন থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত নারীরা ধীরে ধীরে নাট্যমঞ্চে নিজেদের শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছেন।
প্রাথমিক সংগ্রাম থেকে প্রতিষ্ঠা
প্রথমদিকে নারী অভিনেত্রীরা মঞ্চে আসতে সামাজিক বাঁধার সম্মুখীন হন। অনেক সময় পরিবার ও সমাজের বিরোধিতা সত্ত্বেও তারা অভিনয় চালিয়ে গেছেন। এই প্রতিবন্ধকতাকে অগ্রাহ্য করে তাঁরা শুধু অভিনয়শিল্পী হিসেবেই নয়, বরং নারী মুক্তির প্রতীক হিসেবেও পরিচিত হন। মঞ্চে নারীর উপস্থিতি দর্শকদের কাছে ধীরে ধীরে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে এবং তাঁদের অভিনয় প্রতিভা শ্রদ্ধার আসন দখল করে।
গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব
কেতকী দত্ত: বাংলা থিয়েটারে নারীর অভিনয়ের মান উন্নত করতে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। তাঁর সংলাপপ্রবাহ ও আবেগময় অভিনয় নাটককে প্রাণবন্ত করেছে।
উষা গঙ্গোপাধ্যায়: তিনি শুধু অভিনেত্রীই নন, একজন শক্তিশালী পরিচালক ও নাট্যকার হিসেবেও পরিচিত। তাঁর রণধীর নাটক এবং সংসার সীমান্তের মতো প্রযোজনাগুলো সমাজ-বাস্তবতাকে নাট্যমঞ্চে হাজির করেছে।
অর্পিতা ঘোষ: সমসাময়িক মঞ্চে তিনি অভিনয়ের পাশাপাশি সংগঠক এবং পরিচালক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর নাটকগুলোতে নারীর সামাজিক অবস্থান, লিঙ্গ বৈষম্য ও রাজনৈতিক বাস্তবতা উঠে আসে।
আধুনিক থিয়েটারে নারীর বহুমুখী ভূমিকা
আজকের দিনে নারী শিল্পীরা শুধু অভিনয়শিল্পী হিসেবে সীমাবদ্ধ নন। তাঁরা—
পরিচালক: নাটক মঞ্চস্থ করার প্রতিটি ধাপ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
নাট্যকার: নতুন গল্প, সমকালীন অভিজ্ঞতা ও নারীর কণ্ঠস্বর নাট্যপাঠে যুক্ত করছেন।
সংগঠক: নাট্যদল পরিচালনা, উৎসব আয়োজন, আন্তর্জাতিক যোগাযোগে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন।
প্রভাব ও উত্তরাধিকার
নারী অভিনেত্রীদের এই অগ্রগতি শুধু শিল্পক্ষেত্রে নয়, সমাজেও এক নতুন বার্তা দিয়েছে। তাঁরা প্রমাণ করেছেন—মঞ্চ কেবল পুরুষ-অভিনেতাদের আধিপত্যের জায়গা নয়, বরং নারীর শিল্পীসত্তার বিকাশের অন্যতম ক্ষেত্র। তাঁদের অবদানে বাংলা থিয়েটার আরও বাস্তবসম্মত, বহুমাত্রিক ও সমকালীন হয়ে উঠেছে।

৭. চ্যালেঞ্জ ও সাফল্য
বাংলার নাট্য ও চলচ্চিত্র ইতিহাসের শুরুতে নারী শিল্পীদের জন্য পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত প্রতিকূল।
সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি: উনিশ শতকে মঞ্চে বা পর্দায় অভিনয় করাকে নারীর জন্য অসম্মানজনক মনে করা হতো। তাঁদের প্রায়ই অবমাননা, কটূক্তি ও সামাজিক বর্জনের শিকার হতে হয়েছে।
পারিবারিক বাধা: অনেক নারী পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের চাপ সত্ত্বেও অভিনয়ে যুক্ত হয়েছিলেন। তাদের জীবনে নিরাপত্তাহীনতা ও সামাজিক অবজ্ঞা ছিল নিত্যসঙ্গী।
অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা: নারীরা অভিনয়কে পেশা হিসেবে বেছে নিলেও যথাযথ পারিশ্রমিক ও পেশাদার মর্যাদা পেতেন না।
তবুও, সাহসী অভিনেত্রীরা প্রতিকূলতাকে অগ্রাহ্য করে সামনে এগিয়ে যান। বীণা দাসী, গিরিবালা দেবী কিংবা ত্রিপুরাসুন্দরীর মতো অগ্রদূতরা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন।
ক্রমশ পরিবর্তিত পরিস্থিতি
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নারীরা মঞ্চ ও চলচ্চিত্রে নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করতে শুরু করেন।
পেশাদারিত্ব: অভিনয়কে তাঁরা কেবল শখ নয়, পূর্ণাঙ্গ পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
অভিনয়ের বহুমাত্রিকতা: সুচিত্রা সেন, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় বা অরুন্ধতী দেবীর মতো শিল্পীরা নারী চরিত্রকে কেবল নায়ক-নির্ভর গল্পে সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং তাঁরা গল্পের কেন্দ্রীয় শক্তিতে পরিণত হন।
সম্মান আদায়: ধীরে ধীরে সমাজও বুঝতে শুরু করে, অভিনয় কেবল বিনোদনের বিষয় নয়—এটি শিল্প, যা সম্মান দাবি করে।
আধুনিক যুগের চ্যালেঞ্জ
আজকের দিনে নারী অভিনেত্রীদের চ্যালেঞ্জ ভিন্ন রকম।
বৈচিত্র্যের অভাব: বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে এখনও অনেক সময় নারীর ভূমিকা গ্ল্যামার, রোমান্স বা নায়কের পরিপূরক হিসেবে সীমিত থাকে।
পুরুষকেন্দ্রিক গল্প: মূলধারার ছবিতে কাহিনির কেন্দ্রে অধিকাংশ সময় পুরুষ চরিত্র থাকে, নারী চরিত্রগুলো প্রান্তিক হয়ে পড়ে।
স্টেরিওটাইপ: নারীকে প্রায়শই “আদর্শ মা”, “ত্যাগী স্ত্রী” বা “অতিমাত্রায় আধুনিক নারী” চরিত্রে সীমাবদ্ধ করে দেখানো হয়।
ক্যারিয়ারের সীমাবদ্ধতা: বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক অভিনেত্রীকে কম সুযোগ দেওয়া হয়, যেখানে পুরুষ অভিনেতারা দীর্ঘদিন নায়ক হিসেবে জায়গা পান।
সাফল্যের নতুন দিগন্ত
চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও আধুনিক অভিনেত্রীরা নতুন সাফল্যের দিগন্ত উন্মোচন করেছেন।
সমান্তরাল ও আর্ট হাউস সিনেমা: পাওলি দাম, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত প্রমুখ শিল্পীরা জটিল ও সাহসী চরিত্রে অভিনয় করে দর্শক ও সমালোচকের প্রশংসা পেয়েছেন।
ওটিটি প্ল্যাটফর্ম: ইশা সাহা, মধুমিতা সরকার, সুরাঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নতুন প্রজন্মের অভিনেত্রীরা বৈচিত্র্যময় চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পাচ্ছেন।
আন্তর্জাতিক মঞ্চ: আজকের নারীরা শুধু দেশীয় সিনেমায় নয়, আন্তর্জাতিক উৎসবেও নিজেদের প্রতিভা তুলে ধরছেন। কানের চলচ্চিত্র উৎসব বা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতায় তাঁদের উপস্থিতি বাংলা সিনেমাকে বিশ্বদরবারে পরিচিত করছে।

বাঙালি নারী অভিনেত্রীর পথচলা হলো সংগ্রাম থেকে সাফল্যের ইতিহাস। অগ্রদূতরা সমাজের বাঁধা ভেঙে যে আলো জ্বালিয়েছিলেন, তা আজ বহুমাত্রিক সৃজনশীলতায় প্রসারিত। সুচিত্রা সেন থেকে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, মমতা শঙ্কর থেকে স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়—এই দীর্ঘ ধারাবাহিকতায় নারী অভিনেত্রীদের অবদানই বাংলা নাটক ও চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করেছে।
নারী অভিনয় আজ কেবল সহ-অভিনেত্রীর সীমায় আটকে নেই, বরং সমাজ-সংস্কৃতি ও শিল্পচর্চার কেন্দ্রে এসে দাঁড়িয়েছে। ভবিষ্যতের বাংলা চলচ্চিত্র ও নাট্যমঞ্চ এই ধারা আরও প্রসারিত করবে, নতুন নতুন মুখ যুক্ত হবে, আর বাঙালি নারী অভিনেত্রীর পথ চলা আরও গৌরবময় হবে।