বিশ শতকের রাজনৈতিক নাট্যধারায় মার্কসীয় প্রভাব : রাজনৈতিক নাট্যচিন্তা বা রাজনৈতিক নাটক বলতে আমরা কি বুঝবো এর একটি সংজ্ঞা দেয়া প্রাসঙ্গিক। রাজনৈতিক থিয়েটারের সংজ্ঞা সংক্ষেপে বলতে গেলে, সেই থিয়েটার যা রাজনীতি প্রচার করবে। সেজন্য রাজনৈতিক থিয়েটারের প্রকৃতি বিশ্লেষণে আগে রাজনীতি বলতে আমরা কী বুঝতে চাইছি সে বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া দরকার। চেম্বারস অভিধানে সরকার, রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ অথবা মতামত পরিচালনার কলাকৌশলকে রাজনীতি বলা হয়েছে। ভিন্ন কিছু অভিধানে রাজনীতি বলতে সরকার বা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পদ্ধতি বা আন্দোলনকে যেমন রাজনীতি বোঝানো হয়েছে, তেমনি সরকারে জড়িতরা রাষ্ট্র বা সরকার পরিচালনায় যে-সকল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কিংবা সরকারের বাইরে থেকে রাজনৈতিক দলের পক্ষাবলম্বনে কিংবা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণের জন্য সরকারের প্রতি যে চাপ প্রয়োগ করে তাকেও রাজনীতি হিসাবে চিহ্নিত করেছে।
বিশ শতকের রাজনৈতিক নাট্যধারায় মার্কসীয় প্রভাব [ পর্ব ১ ]
রাজনীতি বহু সময়ই দেশে সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত করতে চায়, রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের চেষ্টা চালায়, নিজ দল বা মতাদর্শের পক্ষে জনমত সৃষ্টির চেষ্টা করে। রাজনীতি হলো একটা লড়াই, প্রতিকূল একটা শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাকে পরাভূত করাই হলো লক্ষ্য। রাজনীতি হলো ক্রমান্বয়িক গতিশীলতা, প্রতিকূলকে পরাজিত করেও তাকে এগিয়ে যেতে হয়। রাজনীতি হলো একটা বিজ্ঞান, যার একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে, পদ্ধতি আছে।’
মার্কসবাদী ব্যাখ্যায় রাজনীতি বলতে মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক, শ্রেণীগত, ব্যক্তিগত সব কর্মকাণ্ডকে বোঝায়। রাজনীতির প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য হলো কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা। রাজনৈতিক দল হলো সেই লক্ষ্যের বা অভিযানের সামগ্রিক বাহিনী। সেই লক্ষ্য অর্জনে সব থেকে বেশি যেটা প্রয়োজন সেটা হলো নিজ মতাদর্শের প্রতি মানুষের দৃষ্টিকে আকৃষ্ট করা। রাজনীতির এই যে ব্যাপকতা, এখান থেকেই রাজনৈতিক থিয়েটারের সংজ্ঞা অনুসন্ধান করা যেতে পারে। সমস্ত থিয়েটার কি রাজনৈতিক-এই প্রশ্নেরও বিচার বিশ্লেষণ শুরু করা যায়। কোনো থিয়েটারকে তখনই রাজনৈতিক বলা যায়, যখন সেই থিয়েটার রাষ্ট্র এবং সরকার ও রাজনীতি নিয়ে কথা বলে।
ইচ্ছাকৃতভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে, কোনো-না-কোনো রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের সাথে যুক্ত হয়। রাজনীতি প্রচার না করে রাজনৈতিক থিয়েটার হতে পারে না। এই প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক থিয়েটার কোনো একটি ভাবনা বা মতাদর্শকে একটি বিশেষ রাজনৈতিক অবস্থান থেকে হয় সমর্থন, নয় আক্রমণ করে। এই ধরনের রাজনৈতিক থিয়েটারের ক্ষেত্রে নাটক, তার প্রযোজনাগত সকল উপাদান যেমন আলো, সঙ্গীত, পোষাক, মঞ্চ প্রভৃতি সবকিছুই কোনো একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যকে প্রকাশ করতে চায়।
থিয়েটারের মধ্যে রাজনীতি সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় যেভাবেই অভিব্যক্ত হোক না কেন, থিয়েটারটি পাঠ বা প্রদর্শন দর্শকের কাছে একটি বিশেষ অর্থ বহন করে। থিয়েটার একটি বিশিষ্ট বাণী দর্শকের কাছে পৌঁছে দেয়, রাজনৈতিক সংযোগ ও অংশগ্রহণের প্রক্রিয়াকে সচল করে তোলে। রাজনৈতিক শিক্ষাদানের প্রক্রিয়া এইভাবে থিয়েটারে প্রতিভাত হয়। দর্শকদের মনের বিশ্বাস ও মতামতের পরিবর্তন ঘটানো এই থিয়েটারের মূল লক্ষ্য থাকে। কখনও প্রকাশ্যে, কখনও পরোক্ষভাবে, কখনও রূপকের সাহায্যে থিয়েটার এই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চায়। কখনও এই সকল প্রদর্শিত থিয়েটারে সমাজ, রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভুল-ত্রুটি নির্ণয় করে তা পরিবর্তনের জন্য তাগিদ দেয়। দর্শকদেরকেও ঐ বিশ্বাসের পথে নিয়ে আসতে চায়।
সব রাজনৈতিক থিয়েটারই যে দর্শকদের বিশ্বাস ও মতামতকে পরিবর্তিত করতে চায় এমন নয়। কোনো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করে, সমস্যাটি বিশ্লেষণ করে, কিছু প্রশ্ন তুলে থিয়েটার নিজেকে রাজনীতিবদ্ধ করে তুলতে পারে। থিয়েটার যদি নির্দিষ্ট এক জনমণ্ডলীর কাছে কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক বা অর্থনৈতিক কোনো নির্দেশ বা ধারণা বহণ করে নিয়ে যায় তবে নিঃসন্দেহে তাকে রাজনৈতিক আখ্যা দেয়া যায়।’ এই সূত্রে থিয়েটার রাজনৈতিক সংযোগ সমন্বয়কারী ও রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের মাধ্যম হিসাবে পরিচিত।
রাজনীতির যেমন নানা ধারা আছে, রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার তেমনি নানা পথ ও মত রয়েছে। রাজনৈতিক থিয়েটার বলতে যা বোঝানো হয় তাহলো একান্তই মার্কসীয় রাজনৈতিক থিয়েটার। প্রাচীনকাল থেকে থিয়েটারে যে রাজনীতি চলে এসেছে তারই ধারাবাহিকতায় এই থিয়েটারের জন্ম। রাজনৈতিক নাটকের স্বরূপ নিয়ে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মত থাকতে পারে কিন্তু বর্তমান গবেষণায় আমরা রাজনৈতিক নাটককে দেখতে চাই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে। রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার উৎসমূল ও তার লক্ষণগুলো আমরা বিশ্লেষণ করতে চাই ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরায় এবং সে আলোকেই আমরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চ-নাটকগুলোকে উপস্থাপনের চেষ্টা করবো।
যারা থিয়েটার থেকে রাজনীতি দূর করতে চায়, থিয়েটারকে রাজনীতি মুক্ত করতে চায় রাজনৈতিক থিয়েটারের তারা বিপরীত ধারা। তবে তারাও রাজনীতিমুক্ত নয়, যদিও তাদের নাটককে আমরা রাজনৈতিক নাটক বলছি না। কেন বলছি না, তার বিশদ ব্যাখ্যা এই অধ্যায়ের শেষে থাকবে। মার্কসবাদী রাজনৈতিক থিয়েটার হচ্ছে পূর্বের গ্রীক ধ্রুপদী থিয়েটার, আধুনিক যুগের রোমান্টিক থিয়েটার ও বাস্তববাদী থিয়েটারের উচ্চতর ধাপ।
প্রাচীন থিয়েটারের রাজনীতির সাথে, রেনেসা ও বুর্জোয়া পর্বের থিয়েটারের রাজনীতির সাথে মার্কসীয় রাজনৈতিক থিয়েটারে প্রধান পার্থক্য হলো-সে সকল থিয়েটার ছিলো সমাজ সচেতন, এই নতুন থিয়েটার হয়ে উঠলো সমাজ সচেতনতার পাশাপাশি শ্রেণীসচেতন, সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতন।
রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার জন্ম বিশ শতকে এবং মার্কসবাদকে ঘিরে। মার্কসবাদের প্রভাবে বিশ শতকেই রাজনৈতিক লড়াইয়ে নাটককে সরাসরি ব্যবহার করা শুরু হয়। বিশ শতকের আগে নাটকে রাজনীতি থাকলেও বা রাজনৈতিক প্রসঙ্গের অবতারণা করা হলেও সরাসরি কোনো দলের পক্ষে বা ক্ষমতা দখলের স্বার্থে তাকে ব্যবহার করা হয়নি। বিশ শতকের আগে ক্ষমতা দখলের স্বার্থে নাটককে ব্যবহার করা হয়নি বলেই তা রাজনৈতিক নাটক নয়। রাজনৈতিক নাটকের জন্ম বুর্জোয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে, যখন বুর্জোয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ডালপালা মেলে সারা পৃথিবীতে তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। সেই সময় বুর্জোয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার প্রশ্নে এই নাট্যধারার আবির্ভাব ঘটে।
সে কারণে রাজনৈতিক নাটক ততোটা বিনোদনের নয় যতোটা মতাদর্শ বা শ্রেণীসংগ্রামের। এর লক্ষ্য বুর্জোয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নতুন এক ব্যবস্থা স্থাপন, শ্রমিকশ্রেণীর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, বুর্জোয়া গণতন্ত্রের স্থলে শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা। রাজনৈতিক নাটকের সেই দর্শনটি মূলত গড়ে উঠেছে মার্কসীয় চিন্তা থেকে। সেজন্য রাজনৈতিক নাটকের আলোচনা যেমন মার্কসীয় চিন্তাকে বাদ দিয়ে হতে পারে না, তেমনি যে প্রেক্ষাপটে এর জন্ম সে প্রেক্ষাপটকেও বাদ দেয়া যায় না। এই কারণে রাজনৈতিক নাটকের এ আলোচনায় মার্কস-এঙ্গেলসের দর্শন প্রত্যক্ষভাবে প্রাসঙ্গিক।
মার্কস-এঙ্গেলসের দর্শনই মার্কসীয় দর্শন বা মার্কসবাদ হিসাবে সর্বজন স্বীকৃত। মার্কস-এঙ্গেলস এর সময়কাল ছিলো ইতিহাসের এক যুগ সন্ধিক্ষণ। বুর্জোয়ারা তখন সামন্ততন্ত্র ভেঙে ফেলে তার ধ্বংসের ওপর দাঁড় করিয়েছে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা। ফ্রান্সে ফরাসী বিপ্লবের পরে বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক ক্ষমতাও জয় করে নিলো। মার্কস- এঙ্গেলসের সমস্ত চিন্তা-ভাবনার বিষয় ছিলো এই পুঁজিবাদকে বিশ্লেষণ করা এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ আহ্বান করা। মার্কস-এঙ্গেলস একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসাবেই দেখেছিলেন পুঁজিবাদের উত্থানকে। সামন্ততন্ত্রের জায়গায় পুঁজিবাদের আগমন মার্কস- এঙ্গেলসের চোখে অবশ্যই একটি উত্তরণ। সে উত্তরণের সার্বিক চেহারাটাও ছিলো তাঁদের কাছে পরিষ্কার।
পুঁজিবাদের আগমনের ফলে সামন্ততন্ত্রের ভূমিদাসদের জায়গায় এলো শ্রমিকশ্রেণী। মার্কস-এঙ্গেলস এটাকে দেখেছেন শোষণের রূপ বদল বা উৎপাদন প্রক্রিয়ার রূপান্তর হিসাবে। সামন্ততন্ত্র থেকে ধনতন্ত্রে উত্তরণের পর কি ঘটলো? ধনতন্ত্র বা পুঁজিবাদ বিকাশের সাথে সাথে কল-কারখানা, জমি-জমা, খনির মালিকানা মুষ্টিমেয় লোকের হাতে কেন্দ্রিভূত হতে থাকলো। মাঝারি ও ছোট কারখানাগুলি অপেক্ষাকৃত বড় পুঁজিপতিরা গ্রাস করলো। দেশের সম্পদের এক বিরাট অংশ কয়েকজন লোকের হাতের মুঠোর মধ্যে চলে এলো। চরকা, হস্তচালিত তাঁত ও কামারের হাতুড়ির জায়গায় এলো সুতা-কল, শক্তিচালিত তাঁত ও বাষ্পচালিত হ্যামার। ব্যক্তিগত কর্মশালার জায়গায় এলো ফ্যাক্টরি যাতে শত শত হাজার হাজার মজুরের সহযোগ প্রয়োজন। পুঁজির দাপটে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মালিকরা। এমনিভাবে পূর্বের গোটা উৎপাদন ব্যবস্থায় এলো পরিবর্তন।
বিরাট বিরাট কল-কারখানার বিপুল উৎপাদনের কাছে হেরে গেলো ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র উৎপাদন ব্যবস্থা।
ফ্যাক্টরি থেকে এবার যে সূতা, যে কাপড়, যে ধাতু দ্রব্যাদি বেরিয়ে আসতে লাগলো তা হলো বহু শ্রমিকের মিলিত উৎপাদন, যা পরপর বহু শ্রমিকের হাত ঘুরে এসে তবে তৈরি হয়েছে। পূর্বে উৎপাদন ছিলো ব্যক্তিগত কর্মের ফল। মালিক নিজেই সেটা উৎপাদন করতো। নিজেরই কাঁচামাল-সাধারণত নিজের ঘরে তৈরি, নিজের হাতিয়ার দিয়ে নিজের বা পরিবারের যৌথ মেহনতে সেটা উৎপন্ন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদন সামাজিক রূপ নিলো। এখন উৎপাদন কোনো একক ব্যক্তির হাতে নয়, সমষ্টির হাতে। কিন্তু সামাজিকভাবে উৎপন্ন দ্রব্যের দখল উৎপাদনকারীর হাতে রইলো না, দখল চলে গেল পুঁজিপতির কাছে। দখলের অধীন হলো উৎপাদন পদ্ধতি।বিরাট বিরাট এইসব কারখানার মালিক বুর্জোয়ারা শুধু নিজেরাই জন্ম নিলো না, নিজের বিপরীতে একটি শ্রেণীর জন্ম দিলো। সে শ্রেণীটিই হলো শ্রমিকশ্রেণী।
মার্কস ও এঙ্গেলসের সারা চিন্তার রাজ্য জুড়ে আছে এই শ্রমিকশ্রেণী। কোনো মনীষীর চিন্তায় এই প্রথম শোষিতরা ব্যক্তিত্ব ও শক্তির প্রতীক হিসাবে দেখা দিলো। চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে এসে দাঁড়ালো। মনীষীদের দয়া পরবশ হয়ে নয়, নিজেদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের জন্যই। যে পুঁজিবাদ শ্রমিকশ্রেণীর শ্রম শোষণ করে, মার্কস ও এঙ্গেলস চেয়েছিলেন তার স্বরূপ উদ্ঘাটন করে শ্রমিকদের সাথে তার সম্যক পরিচয় পটিয়ে দিতে, যাতে শ্রমিকশ্রেণী সে ব্যবস্থা ধ্বংস করার জন্য সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারে।
মার্কস-এঙ্গেলস চেয়েছিলেন শ্রমিকশ্রেণীর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে। বিশ শতকে রাজনৈতিক নাটকের মূল বিষয় ছিলো এই পুঁজিবাদ ও তার ধ্বংস সাধন করার জন্য প্রচার চালানো। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক নাটক এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গেছে। মার্কসের চিন্তার সূত্র ধরে পুঁজিবাদের চরিত্র উদঘাটনের চেষ্টা করেছে শ্রমিকশ্রেণীকে নিজ লড়াইয়ে সচেতন করে তোলার জন্য।
রাজনৈতিক নাটকের সুদৃঢ় লক্ষ্যটি ছিলো মার্কস এবং এঙ্গেলসের মতোই শ্রমিকশ্রেণীর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে একটি শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থায় পৌঁছানো। মার্কস-এঙ্গলসের মতোই বিশ শতকের রাজনৈতিক নাটকের চিন্তার জগত জুড়েও আছে এই শ্রমিকশ্রেণী। রাজনৈতিক নাটক সেদিনই জন্ম নিলো যেদিন তার বিষয়বস্তুর প্রথম অবলম্বন হলো শ্রমিকশ্রেণীর মুক্তির প্রশ্নটি। আগের নাটকে রাজনীতি থাকলেও তাকে আমরা রাজনৈতিক নাটক বলবো না। কারণ রাজনীতি বলতে আমরা বুঝি ক্ষমতা দখলের প্রশ্ন। মার্কসবাদী রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার আগে ক্ষমতা দখলের কথা নাট্যদল বা নাট্যকাররা ভাবেনি বা তার জন্য লড়াইও করেনি।
মার্কসবাদী রাজনৈতিক নাট্যচিন্তা ক্ষমতা দখলের প্রশ্নটিকেই অগ্রাধিকার দিলো। শ্রমিকশ্রেণীর ভাগ্য পাল্টাবার জন্য রাজনৈতিক নাটক মাঠে নেমেছিলো। কেন এই শ্রমিকশ্রেণী বিশাল এক শক্তির প্রতীক হয়ে দেখা দিয়েছিলো মার্কসের চোখে? কোন্ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে মার্কস-এঙ্গেলস এ সত্য আবিষ্কার করলেন যে, ‘প্রলেতারিয়েত আজকের সমাজের নিম্নতম স্তর; তাকে নড়তে হলে, দাঁড়াতে হলে, উপরে চাপানো সরকারি সমাজের গোটা স্তরটিকে শূন্যে উৎক্ষিপ্ত না করে উপায় নেই’।”
মার্কস-এঙ্গেলসের চিন্তার পেছনে ছিলো একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি যা বুঝে নেয়া কঠিন কিছু নয়। পুঁজিবাদী সমাজ শুধু নিজের বিপরীতে শ্রমিক সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হলো না, শেষ পরিণতিতে দেখা গেলো যারা ছিলো এতোদিন ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক তারাও বাধ্য হলো পুঁজিবাদী কলকারখানার অধীনে চাকরি নিতে। যেহেতু পুঁজিবাদীদের সাথে প্রতিযোগিতায় তারা পেরে উঠলো না তাই তাদের ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব আর থাকলো না। সেজন্য উৎপাদনের উপায় নিজেদের হাতে না থাকার দরুন তারা বেঁচে থাকার জন্য স্বীয় শ্রমশক্তি বেচতে বাধ্য হলো। সামন্ততন্ত্রের ভাঙনের পর উৎপাদন পদ্ধতির এবার দ্বৈত চেহারা দেখা দিলো। প্রতিটি উৎপাদনের পেছনে সেখানে রয়েছে মালিক আর শ্রমিক পক্ষ।
মালিক আর শ্রমিকের পারস্পরিক সম্পর্ক সেখানে শোষক আর শোষিতের। বিশ শতকের রাজনৈতিক নাটকের মূল প্রতিপাদ্য এই শোষকের প্রতি ঘৃণার প্রকাশ এবং শোষিতের পক্ষ অবলম্বন। শোষিতের প্রতি শ্রেণীঘৃণা প্রকাশের ভিতর দিয়েই রাজনৈতিক নাটক হয়ে উঠেছে মার্কসীয় চিন্তার উত্তরাধিকারী। ‘শোষণ’ শব্দটি রাজনৈতিক নাটকের সাথে খুবই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেই শোষণ বলতে আমরা কী বুঝবো আসলে? শোষণ এখানে কোনো ব্যক্তিগত শোষণ নয়। রাজনৈতিক নাটকের শোষণের রূপটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। শোষণ বলতে এখানে প্রাধান্য পায় শ্রেণীশোষণ। সেই শ্রেণীশোষণের রূপটিই বা কী?
যন্ত্রশিল্প ও বিশ্ববাজার প্রতিষ্ঠার পর বুর্জোয়াশ্রেণী রাষ্ট্রের মধ্যে নিজেদের পরিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলো। ভিন্ন দিকে শ্রমিক বা মজুররা কেবলমাত্র বুর্জোয়া যন্ত্রের দাসে পরিণত হলো। কীভাবে সে যন্ত্রের দাসে পরিণত হলো? মার্কস দেখাচ্ছেন, মেহনতিদের এ শ্রেণীটি বাঁচতে পারে যতক্ষণ কাজ জোটে, আর কাজ জোটে শুধু ততক্ষণ, যতক্ষণ তাদের পরিশ্রমে পুঁজি বাড়তে থাকে।’ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এই হচ্ছে শ্রমিকের অবস্থা। শ্রমদিনের এক অংশ সে খাটে তার স্বপরিবারের ভরণপোষণের খরচ তোলার জন্য, বাকি অংশ সে খাটে বিনা মজুরিতে-যা পুঁজিপতিদের জন্য উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি করে। এখান থেকেই আসে পুঁজিপতির মুনাফা।’
মার্কস দেখান মালিক উদ্বৃত্ত শ্রম শোষণ করে নিজের মুনাফা গড়ে তোলে। শ্রমিকের শ্রম শোষণই হচ্ছে বুর্জোয়ার মূল শোষণ। মার্কসের চোখে এটাই বুর্জোয়া ব্যবস্থায় শ্রেণীশোষণ। মার্কস বলছেন, শ্রমিকদের উদ্বৃত্ত শ্রমের প্রতি লোভের সীমা পরিসীমা নেই পুঁজিপতিদের। যে-কোনো উপায়ে শ্রমিকদের শ্রম শোষণ করার জন্য মার্কসের চোখে পুঁজিবাদী হলো লুন্ঠনকারী।
মার্কসের বহুপূর্বে নাট্যকার শেক্সপিয়ারও এই বুর্জোয়াদের দেখেছেন লুণ্ঠনকারী হিসাবে। সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্ক ভেঙে মুদ্রা অর্থনীতির পত্তন কীভাবে বিষিয়ে তুলছে সমাজকে-তার অকরুণ বিবরণ শেক্সপিয়ারই দেন তাঁর নাটকগুলোতে। মুনাফার সম্ভাবনা থাকলে এমন কোনো অপরাধ নেই যা পুঁজিপতি সংঘটিত করতে পিছপা হবে। শেক্সপিয়ার, ইবসেন, জর্জ বার্নার্ড শ, হাউপ্টমান, ব্রেস্ট প্রত্যেকের নাটকেই বারবার লুণ্ঠনকারী হিসাবে ফুটে উঠেছে এদের চেহারা। উৎপল দত্তের ভাষায় শ্রেণীগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে বুর্জোয়া শুধু লুটেরা নয়, ফিউদালদের চেয়ে ঢের বেশি দস্যুপরায়ণ।
মার্কস বাড়তি মূল্যের তত্ত্ব আবিষ্কার করে দেখালেন কীভাবে পুঁজিপতিরা কৌশলে লক্ষলক্ষ সর্বহারা মজুরকে খাটিয়ে বেগার শ্রমের মারফত মুনাফার পাহাড় গড়ে চলেছে, কীভাবে মেহনতি মানুষের শ্রম শুষে পুঁজি বেড়ে উঠেছে এবং সেই শ্রমিকের উপর শোষণ তীব্রতর হচ্ছে। মার্কস-এঙ্গেলস শ্রেণীশোষণকে দেখেছেন পুঁজিপতির শ্রম শোষণের প্রেক্ষিতেই। মার্কস এঙ্গেলসের চোখে শ্রমিক কিন্তু যন্ত্রশিল্পের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে উপরে উঠে না, নিজেদের শ্রেণীর যে অবস্থা, তারও নিচে ক্রমশই বেশি করে তাদের নেমে যেতে হয়। মজুর হয়ে পড়ে নিঃস্ব। নিঃস্ব অবস্থা বেড়ে চলে জনসংখ্যা ও সম্পদ বৃদ্ধির চেয়ে দ্রুততর তালে। মার্কস-এঙ্গেলসের দৃষ্টি শুধু শোষণের মধ্যেই আটকা পড়ে থাকেনি।
নিঃশেষিত শ্রমিকই শুধু তাঁরা দেখেননি। সেই শ্রমিকের সম্ভাবনা ও তার শক্তিকেও দেখেছেন। ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় যন্ত্রের অবিরাম উন্নতি যতো দ্রুত তালে বাড়তে থাকে, মজুরদের জীবিকা হয়ে পড়ে আরো বিপন্ন। শ্রমিকশ্রেণীর দারিদ্র্য বাড়তে থাকে। ঘটনা এখানেই থেমে থাকে না। এরই সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকশ্রেণীর বিদ্রোহ বাড়তে থাকে, তীক্ষ্ণ ও তীব্র হয়ে ওঠে ততো সামাজিক বিরোধ। শ্রমিকশ্রেণীকে বাদ দিয়ে যেমন পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ দাঁড়াতে পারে না, মার্কস-এঙ্গেলস দেখিয়েছেন তেমনি শ্রমিকদের দ্বারাই পুঁজিবাদী সমাজের ধ্বংস সাধিত হবে। পুঁজিবাদের অভ্যন্তরেই তার নিজ মৃত্যুবাণ নির্দিষ্ট হয়ে আছে।
মার্কসবাদের এই চিন্তা মনগড়া নয়। পুঁজিতন্ত্র বিকাশের কিয়ৎকাল পরে একটি স্তরে গিয়ে দেখা গেলো ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বিবর্তনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে শ্রমিকশ্রেণী ইতিহাসের এই পর্বে একটি রাজনৈতিক শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করে। সেই রাজনৈতিক শক্তির প্রথম প্রকাশ ঘটে মেশিন ভাঙার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। হস্তচালিত যন্ত্রের সঙ্গে মেশিনের অসম দ্বন্দ্বে কুটির শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকরা ক্রমশ অনিশ্চয়তা, ছাঁটাই, দারিদ্র্য ও বেকারত্বের মুখোমুখি এসে দাঁড়াতে বাধ্য হলো ও তারই পরিণতিতে শ্রমিকদের সমস্ত আক্রোশ কেন্দ্রীভূত হলো মেশিনের ওপর। মেশিন প্রবর্তনই ছিলো শ্রমিকদের জীবনের অভিশাপ ও অশান্তির মূল কারণ-এই ধারণা থেকেই জন্ম নিয়েছিলো মেশিন ভাঙার আন্দোলন। সেই সময়ে কারখানা ও মালের গুদামগুলিতে অগ্নিসংযোগ, যন্ত্রপাতি লুণ্ঠন ও ধ্বংস প্রভৃতি ঘটনার মধ্য দিয়ে এই আন্দোলন এসে তীব্র আকার ধারণ করে।
মেশিনভাঙার আন্দোলন মেশিনের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিলো ঠিকই; কিন্তু এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সেদিনের শ্রমিকরা মেশিনকে স্বাভাবিক কারণেই ধনতান্ত্রিক শোষণের হাতিয়ার রূপে মনে করেছিলো ও ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মেশিনভাঙার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছিলো। শ্রমিকরা এই আন্দোলনের মাধ্যমে যন্ত্রসভ্যতা বা প্রগতির বিরোধিতা করেনি; এই বিরোধিতা ছিলো ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের একটি অপরিণত, অস্পষ্ট রূপ। ইতিহাসের তথ্যগুলোকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, শ্রমিকরা সেই ধরনের কারখানা ও শিল্প সংস্থাকেই আক্রমণ। করেছিলো যেগুলো কুটিরশিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকের দারিদ্র্য, অনিশ্চয়তা ও বেকারত্বের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।
শিল্পবিপ্লবের দ্বারা প্রভাবিত হয়নি এমন সব পেশায় নিযুক্ত শ্রমজীবী মানুষও সেদিন মেশিনভাঙার আন্দোলনে সামিল হয়েছিলো। মেশিন ভাঙা আন্দোলনকে এঙ্গেলস ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে শ্রেণীসংগ্রামের প্রথম পদক্ষেপ বলে বর্ণনা করেছেন। মেশিনভাঙার আন্দোলন সবচেয়ে হিংসাত্মক রূপ নিয়েছিলো ব্রিটেনে। মেশিনভাঙা আন্দোলনের পাশাপাশি শ্রমিকরা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাদের অর্থনৈতিক চাহিদাগুলিকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদ জ্ঞাপনের দ্বিতীয় একটি পন্থা অবলম্বন করেছিলো; সেটি ছিলো ধর্মঘটের পথ। ধর্মঘটের জোয়ারে ব্রিটেনের পাশাপাশি ইউরোপের অনেকগুলো দেশ তখন উত্তাল হয়ে ওঠে। প্রথমদিকে ধর্মঘটের এই ঘটনাগুলো ঘটেছিলো বিচ্ছিন্নভাবে।
পরবর্তীতে শ্রমিকরা সংগঠিত হতে থাকে, দৃঢ়ভাবে সংগঠিত রূপে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হয়, গড়ে তোলে। তাদের নিজস্ব সংগঠন। বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর এই ধরনের বিদ্রোহগুলোই পরে শ্রেণীদ্বন্দ্বে রূপ নেয়, যার পরিণতিতে দুয়ের মধ্যে শুরু হয় দাঙ্গা। মার্কস লিখছেন, শিল্প এবং অন্যদিকে বুর্জোয়ার নবার্জিত রাজনৈতিক প্রাধান্যের বিকাশের সমানুপাতে প্রলেতারিয়েত-বুর্জোয়া শ্রেণীসংগ্রাম পুরোভাগে আসতে থাকে ইউরোপের অতি অগ্রসর। দেশগুলোতে।স্তালিন লিখেছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠের উপর সংখ্যালঘিষ্ঠের অত্যাচার অবসানের জন্য বহু ঝড়-ঝঞ্ঝা, বহু রক্তস্রোত পশ্চিম ইউরোপের ওপর দিয়ে বয়ে গেল।১২ ধর্মঘটের জোয়ারে তখন ইউরোপের বহু দেশ উত্তাল হয়ে উঠেছিলো।
আঠারশো বারো সালে স্কটল্যান্ডে তাঁতীদের ও আঠারশো আট সালে ল্যাংকাশায়ারের। সুতো শ্রমিকদের ধর্মঘট শুরু হয়। আঠারশো একত্রিশ সালে প্রথম শ্রমিক অভ্যুত্থান ঘটে লিয়োতে। আঠারশো ত্রিশ থেকে আঠারশো সাতচল্লিশ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সে তিনশো বিরাশিটি ধর্মঘটের হিসাব পাওয়া যায়। ফ্রান্সের তুলনায় জার্মানী ও ইতালীতে ধর্মঘট হয়েছিলো অপেক্ষাকৃত কম। রাশিয়াতে সেই তুলনায় ধর্মঘট হয়েছিলো বেশি। আঠারশো চুয়াল্লিশ সালে সেন্ট পিটার্সবুর্গ মস্কো রেলপথ নির্মাত্রে সময় রেল-শ্রমিকরা অন্তত চারবার ধর্মঘট করেছিলো। আঠারশো থেকে আঠারশো বিয়াল্লিশ সালের মধ্যে প্রথম জাতীয় শ্রমিক আন্দোলন ইংরেজ চার্টিস্টদের আন্দোলন শীর্ষে আরোহণ করে।
বুর্জোয়া ও শ্রমিকদের এই দ্বন্দ্বের মাঝখানে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন সময় কাল্পনিক সমাজতন্ত্রীরা এগিয়ে এলেন, যাঁরা মনে করতেন এই শোষণ বঞ্চনার অবসান হওয়া দরকার। শক্তিমানদের দয়া ও মানবতার দ্বারাই তাঁরা সমাজটাকে পরিশুদ্ধ করার কথা ভাবলেন। যেমন সমাজে শ্রেণীসংঘাতের অস্তিত্বের কথা স্বীকার করলেন প্রুধো। স্বীকার করলেন ধনীদের সম্পত্তি সঞ্চয়ে এক ধরনের চৌর্যবৃত্তি রয়েছে এবং ধনীদের সম্পত্তি সঞ্চয়ের সঙ্গে সঙ্গে শোষিতশ্রেণী নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে দিনেদিনে। সেই সঙ্গে ধনী-গরীবের শ্রেণীগত বিরোধের শান্তিপূর্ণ অবসানের কথাও বললেন। প্রুধো ভাবছিলেন, ন্যায়পরায়ণতা আর সুবুদ্ধি যখন জাগবে ধনীদের মনে, তখন তারা নিজেদের ভুল বুঝে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠবে বিশ্বপ্রেম, ভ্রাতৃত্ব আর মানবতার আদর্শে। সব শোষণও বন্ধ হয়ে যাবে তখন সমাজে। শ্রেণীসংগ্রামের অবসান ঘটবে এক সার্থক সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে। রবার্ট ওয়েন, চার্লস ফুরিয়ের ও সেন্ট সাইমনের চিন্তা ছিলো একই ধরনের।
ধনবাদের শোষণ তাঁরা স্বীকার করে নিলেন, আর সমাধান খুঁজলেন শান্তিপূর্ণ উপায়ে। কাল্পনিক সমাজতন্ত্রীরা বুর্জোয়া সমাজ না ভেঙে, না পাল্টে জোড়াতালি দিয়ে শ্রেণী সমন্বয়ের দ্বারা আদর্শ সমাজ গড়ে তুলতে চাইলেন।পুঁজিবাদের এই পর্বেই মার্কসের আগমন রাজনীতিতে। শীঘ্রই সহযোদ্ধা হিসাবে পেলেন ফ্রেডারিক এঙ্গেলসকে। এই দুজনের কেউই কাল্পনিক সমাজতন্ত্রীদের সাথে একমত হতে পারলেন না।
ইউরোপে ঘটছে তখন একের পর এক বিদ্রোহ। মূলত ব্রিটেন ও ফ্রান্স ছিলো শ্রমিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। মার্কস খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করলেন শ্রমিকদের জয়ী হওয়ার জন্য যে-ধরনের সংগঠন ও পাশাপাশি যে-ধরনের বিপ্লবী চিন্তা দরকার, তা শ্রমিকদের নেই। শ্রমিকদের আন্দোলনের পেছনে প্রধান লক্ষ্য ছিলো অর্থনৈতিক দাবি দাওয়া আদায়। পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিক প্রতিরোধের মূল কথাটি ছিলো শ্রমিকদের রাজনৈতিক অধিকার ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা, এক কথায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। মার্কসের মনে সেখানে নতুন চিন্তা দেখা দিলো। বিশেষ করে আঠারশো একত্রিশ সালে লিয়োতে শ্রমিকদের যে অভ্যুত্থান ঘটে, লিয়োর সে অভ্যুত্থানের ব্যর্থতা মার্কসের চিন্তার জগতে নতুন খোরাক জোগায়।
লিয়োতে রেশম শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকদের ধর্মঘটে জ্যাকোবিনদের বিপ্লবী আদর্শ গভীর প্রভাব ফেলেছিলো। লিয়োর এই ঐতিহাসিক ঘটনা ফরাসী শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিক চেতনাকে নতুন স্তরে পৌঁছে দিয়েছিলো। যার কারণে আঠারশো চল্লিশে প্যারিসে সাধারণ ধর্মঘটের দিন শ্রমিকরা পুলিশের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে উপনীত হয়-যা আঠারশো আটচল্লিশে আরো পরিণতি পায়।
ফরাসী বিপ্লবের পর আঠারশো আটচল্লিশের ফেব্রুয়ারী বিপ্লব ফ্রান্সকে এনে দেয় প্রজাতন্ত্র। জুনের পর সে বিপ্লবের অর্থ দাঁড়ায় বুর্জোয়া সমাজকে উচ্ছেদ। বিশেষ করে বাইশে জুন শ্রমিকদের সশস্ত্র অভ্যুত্থান ছিলো বুর্জোয়াদের সাথে শ্রমিকশ্রেণীর প্রথম বৃহৎ লড়াই। শ্রমিকরা তাদের আন্দোলনের পক্ষে পাঁচদিন প্যারিস শহরকে অবরোধ করে রাখে। পাঁচদিন পর্যন্ত সরকারি সৈন্যবাহিনী ও সচল রক্ষীবাহিনী তাদের প্রতিরোধ চূর্ণ করতে ব্যর্থ হয়। মার্কসের চোখে এসব ঘটনায় শ্রমিকদের শক্তির অভ্যন্তরীণ দিকটি ধরা পড়ে এবং তিনি ব্যর্থতার প্রাথমিক কারণগুলো অনুধাবন করতে সমর্থ হন।
মার্কস দেখলেন, ফরাসী দেশে গণতন্ত্রের চরম বিকাশ না ঘটার জন্য সামাজিক শ্রেণীসংগ্রাম সফল হয়ে উঠতে পারেনি। মার্কস-এঙ্গেলস বিপ্লবের ব্যর্থতার কারণ সম্পর্কে এক বিবৃতিতে লেখেন, যে-কোনো বুর্জোয়া উৎপাদন ব্যবস্থায় যতোরকম উন্নতি ও সমৃদ্ধি সম্ভব তা যতোদিন না পূর্ণ পরিণতি লাভ করবে ততোদিন কোনো প্রকৃত সর্বহারার বিপ্লব সম্ভব নয়। মার্কস বুঝলেন শ্রমিকদের বিজয়ী হতে হলে দরকার নতুন চিন্তা, নতুন পরিবেশ ও ভিন্নতর সংগঠন। মার্কস দেখালেন শ্রমিকশ্রেণী দীর্ঘদিন বুর্জোয়াদের স্বার্থ আদায় করে দিয়েছে গণতন্ত্রের জন্য লড়তে গিয়ে। গণতন্ত্রীদের সাথে হাত মিলিয়ে তাদের নিজস্ব কোনো লাভ হয়নি, শুধুমাত্র ইতিহাসে একটি স্বাধীন শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করা ছাড়া। সেখান থেকেই শ্রমিকদের ভাগ্য পরিবর্তনে মার্কসের নতুন চিন্তার সূত্রপাত। রাজনৈতিক নাট্যকাররা মার্কসের সেই চিন্তাগুলোকেই ধারণ করে পরবর্তী কালে ঘটনা পরম্পরায়। সে আলোচনায় আমরা ধীরে ধীরে পৌছুবো।
মার্কস বুঝতে পারলেন বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাফল্য লাভ করতে গেলে চাই শ্রমিকশ্রেণীর নিজস্ব দর্শন। শুধুমাত্র সমাজ পরিবর্তনের চেতনা সমাজ পাল্টাতে সাহায্য করবে না যতক্ষণ না সমাজবিজ্ঞানকে বোঝা যাবে, যতক্ষণ না সমাজ পরিবর্তনের চেতনার পাশাপাশি সমাজের গতিপ্রকৃতির নিয়ম আবিষ্কার করা যাবে। মানুষের ইতিহাসকে যতক্ষণ না বিশ্লেষণ করা যাবে। শুধু ক্ষোভ নিয়ে সমাজ পরিবর্তন বা বিপ্লবে পরিপূর্ণ সাফল্য লাভ সম্ভব নয়, যতক্ষণ না পরিবর্তনের জন্য কোথায় আঘাত করতে হবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়। মার্কস-এঙ্গেলস দেখান যে, পূর্বে যেসব শ্রমিক আন্দোলন হয়েছে সেগুলো ছিলো স্বতঃস্ফূর্ত কিংবা বুর্জোয়া নেতৃত্ব দ্বারা পরিচালিত। হয় শ্রমিকরা স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগে বিশৃঙ্খলভাবে এ আন্দোলন চালিয়েছে কিংবা বুর্জোয়াদের স্বার্থে লড়াই করে গেছে। মার্কস-এঙ্গেলস শ্রমিক আন্দোলনকে একটি সুশৃঙ্খল পথে চালিত করতে চেয়েছিলেন।
মার্কস-এঙ্গেলস চেয়েছিলেন শ্রমিকদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে সচেতন আন্দোলনে রূপান্তরিত করতে। শ্রমিকদের মধ্যে ইতিহাসের চেতনাকে পৌছে দিতে। শ্রমিকরা অন্ধভাবে ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি না বুঝে লড়াই চালিয়ে সফলতা লাভ করবে, মার্কস-এঙ্গেলস তা মনে করতেন না। মার্কস-এঙ্গেলসের লক্ষ্য ছিলো, স্বতঃস্ফূর্ততার জায়গায় চেতনাকে স্থান দেয়া এবং সে চেতনা সমাজ বিজ্ঞানের চেতনা। মার্কস-এঙ্গেলসের কাছে চেতনার ব্যাপারটা কোনো ধোঁয়াশে বিষয় ছিলো না। দুজনেই চেতনা বলতে সমাজবিজ্ঞান চেতনাকেই বুঝিয়েছেন।
সমাজ বিজ্ঞানের চেতনা আসলে কী রাজনৈতিক নাটক বুঝতে হলে এ প্রশ্নটি খুবই মৌলিক প্রশ্ন।
নাটকে সমাজ চেতনার ব্যাপারটি পূর্বেও লক্ষ্য করা গেছে কিন্তু রাজনৈতিক নাটক শুধুমাত্র সমাজ চেতনার ব্যাপার নয়। রাজনৈতিক নাটক সমাজবিজ্ঞানের চেতনা পৌছে দিতে চেয়েছে শ্রমিকশ্রেণীর কাছে, সাধারণ জনতার কাছে। সেখানে শ্রেণীর প্রশ্নটি প্রধান প্রশ্ন। শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবে সাফল্য লাভ করতে হলে শ্রমিক যে নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ বিপ্লবী শক্তি এই সত্যটি প্রথম মার্কস আবিষ্কার করেন এবং দেখান যে, শ্রমিকশ্রেণীই আজকের মূল নিয়ামক শক্তি। মার্কস-এঙ্গেলস তাই ঘোষণা করলেন, যারা সর্বহারা তাদের একমাত্র শৃঙ্খল ছাড়া হারাবার আর কিছুই নেই, জয় করবার জন্য আছে সারা বিশ্ব। রাজনৈতিক নাটক সদম্ভে মার্কস- এঙ্গেলসের সেই ধারণাগুলোকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করেছে এবং শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে প্রচার করে চলেছে।
মার্কস-এঙ্গেলসের মূল সংগ্রাম ছিলো শ্রমিকশ্রেণীর মুক্তির প্রশ্নে পুঁজিবাদকে ধ্বংস করা। মার্কস-এঙ্গেলস তাই পুঁজিবাদের আসন্ন মৃত্যু ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দর্শন প্রচার করেন। মার্কস দেখান যে, সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ভেঙে পুঁজিবাদের যেমন উত্থান ঘটেছে, ইতিহাসের অনিবার্য ধারাবাহিকতায় সেই পুঁজিবাদেরও মৃত্যু ঘটবে। সেখানে নতুন সমাজ ব্যবস্থা জন্ম নেবে। মার্কস-এঙ্গেলসের রচনার মূল লক্ষ্য ছিলো কীভাবে, ইতিহাসের কোন কোন্ অনিবার্যতার কারণে পুঁজিবাদের মৃত্যু ঘটবে তাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিধিবদ্ধ করা, সে সাথে কী জন্য পুঁজিবাদের মৃত্যু ঘটা দরকার তাকেও জোরালোভাবে ব্যাখ্যা করা। মার্কসের এই নতুন দর্শন হলো দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শন।
দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ নিছক দর্শন নয়, বিজ্ঞানের সমগোত্রীয়-যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে ইতিহাসের গতিধারাকে বিশ্লেষণ করা, স্বরূপ উন্মোচন করা। মার্কসীয় দ্বন্দ্ববাদ বলে এ জগতে কিছুই শাশ্বত নয়, এই জগতে প্রতিটি বস্তু অস্থায়ী ও পরিবর্তনশীল। বিকাশের ক্ষেত্রে মূল নিয়ামক হলো আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। বস্তু ও মানবজগত দুই ক্ষেত্রেই তা সত্য, তবে বাইরের দ্বন্দ্বও সেখানে বর্তমান ও গুরুত্বপূর্ণ। মার্কসীয় দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতির উদ্ভব হেগেল থেকে আর তার বস্তুবাদী তত্ত্ব হলো ফয়েরবাখের তত্ত্বের আরো বিকাশ। দ্বন্দ্ব যে-কোনো পরিবর্তনের চালিকা শক্তি। সেজন্য কোনো বস্তু বা ঘটনা প্রবাহ কীভাবে পরিবর্তিত হয় সেটা বুঝতে কিংবা পরিবর্তনকে নিয়ন্ত্রণ করতে দ্বন্দ্ব সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন।
মার্কসীয় দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ কোনো যুক্তিতর্কহীন বদ্ধমূল ধারণা নয়, বরং প্রতিটি প্রশ্নকে বিচার করা, অনুধাবন করা ও ব্যাখ্যা করার একটি উপায়। মার্কস-এঙ্গেলস ইতিহাসের নতুন ব্যাখ্যা দিলেন। দুজনেই বললেন সমাজ বিভক্ত হয়ে আছে নানা রকম অর্থনৈতিক শ্রেণীতে। যা-কিছু চিন্তা, সামাজিক কাজকর্ম, রাজনৈতিক কার্যকলাপ, ধর্মীয়-যুক্তি ইত্যাদির পেছনে কোনো-না-কোনো শ্রেণীর স্বার্থ কাজ করে এসেছে এবং তা না জানার জন্য অনেক দুঃখ, রক্ত ও অশ্রুর মূল্য দিতে হয়েছে মানুষের সমাজকে। মার্কস ইতিহাসকে দেখেছেন মানুষের শ্রমের ফসল হিসাবে। মানুষের সামাজিক কর্মের ভিত্তি হলো শ্রম।
শ্রমের সাহায্যেই মানুষ প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করে নিজের প্রয়োজনীয় রসদ যুগিয়েছে, নিজের ভাগ্যকে পাল্টেছে। মার্কস-এঙ্গেলস দেখিয়েছেন মানুষের আসল পরিচয় মেলে তার উৎপাদনী কর্মে। সভ্যতা সংস্কৃতির বিরাট ইমারত মানুষ তৈরি করেছে। শিল্প-সাহিত্য চিন্তার রাজ্য সবই মানুষের কর্মফল। চিন্তা ও ভাষার উৎস মূলেও রয়েছে মানুষের শ্রম। তবে সবকিছুর মূলে রয়েছে তার অন্নবস্ত্র বাসস্থানের ভাবনা। মানুষকে জানতে হলে তার ইতিহাসকে জানতে হলে সর্বপ্রথম জানতে হবে তার বৈষয়িক কর্মগুলোকে, যার মধ্য দিয়ে সে সংগ্রহ করে জীবন ধারণের উপকরণসমূহ। অর্থাৎ মানুষের উৎপাদন ব্যবস্থাকে ভালো মতো বুঝতে হবে। সেক্ষেত্রে মূল প্রশ্নটি হচ্ছে মানুষের শ্রম।
মার্কস-এঙ্গেলসের আলোচনার যাত্রা বিন্দু হলো ব্যক্তির শ্রম, যে শ্রমের অধিকারী ব্যক্তি স্বয়ং। সামাজিক উৎপাদনের স্বার্থে একসময় শ্রম বিভাজন দেখা দেয় কিন্তু ঘটনা পরম্পরায় কিছু লোকের নিয়ন্ত্রণ তৈরি হলো শ্রম বিভাজন প্রক্রিয়ার ওপর। শ্রম বিভাজন জন্ম দিলো অসাম্যের। শ্রম বিভাজনের সূত্র ধরেই জন্ম হলো সম্পত্তির ওপর ব্যক্তিগত মালিকানার। মার্কসের মতে তাই শ্রমের ইতিহাস বা উৎপাদন কর্মের ইতিহাস আড়াল করে রেখে মানুষ ও তার কর্ম সম্পর্কে কোনো ভাসাভাসা অস্পষ্ট ধারণা করা যেতে পারে, তাতে মানব সভ্যতার পূর্ণাঙ্গ রূপ পাওয়া যাবে না। মানুষের ইতিহাস কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, উৎপাদন ব্যবস্থার সাথেই এর সম্পর্ক।
শোষণের মূল কারণগুলোও নিহিত রয়েছে উৎপাদনের ইতিহাসের মধ্যে। সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন মানেই উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তন। মার্কসের নতুন দর্শনের মূল কথা ছিলো তাই শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষে পুঁজিবাদের কাছ থেকে কীভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা যায়, সে রাজনৈতিক নির্দেশনা আবিষ্কার করা। দর্শনের জন্য দর্শন চর্চা মার্কসবাদ নয়। শ্রমিকশ্রেণীর বিজয়কে ত্বরান্বিত করার জন্য মার্কস-এঙ্গেলসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ হলো এমন এক তাত্ত্বিক হাতিয়ার, জগৎ পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে যাকে কাজে লাগানো যায়।
মার্কস-এঙ্গেলস চেয়েছিলেন পুরানো অবৈজ্ঞানিক ধ্যান ধারণা ও কুসংস্কারকে সমূলে উৎপাটিত করে গোটা সমাজ ব্যবস্থার একটি বিজ্ঞানসম্মত দর্শন দাঁড় করাতে, যা ইতিহাসের গতি প্রকৃতি বুঝতে, তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দাঁড় করাতে সাহায্য করবে। যা বিজ্ঞানসম্মতভাবে সমাজতন্ত্রে পৌছুবার পথ দেখাবে। মার্কস-এঙ্গেলস ইতিহাসের নতুন ব্যাখ্যা দিলেন। মার্কস-এঙ্গেলসের কাছে পৃথিবীর ইতিহাস হলো শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস। মানব সমাজের ইতিহাস শোষণ এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে শোষিত মানুষের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের ইতিহাস।
শ্রেণীসংগ্রামের পথ ধরেই ইতিহাসের বিকাশ ও নতুন নতুন সমাজ ব্যবস্থার উদ্ভব। ইতিহাসের অগণিত দাস-বিদ্রোহ, কৃষক-বিদ্রোহ, সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলন সবকিছুকেই মার্কস-এঙ্গেলস দেখেছেন শ্রেণীসংগ্রাম হিসাবে। মার্কস-এঙ্গেলস দেখালেন সমাজ বিভক্ত হয়ে আছে নানা রকম অর্থনৈতিক শ্রেণীতে। কোনো-না-কোনো শ্রেণীর স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে সমাজ ব্যবস্থা। নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ধর্ম ও সংস্কৃতি। সেই নিয়ন্ত্রণ চিরস্থায়ী কোনো পাকাপাকি ব্যবস্থা নয়।
শ্রেণীসংগ্রামের মধ্য দিয়েই ঘটে তার রূপান্তর ও অবসান। সেজন্য মার্কস-এঙ্গেলসের মতবাদ শ্রেণীসংগ্রামের মতবাদ হিসাবেও খ্যাত। মার্কসের পূর্বে যে-সকল ইতিহাসবিদরা সমাজ বিবর্তনের বিভিন্ন পর্বকে সংঘাতপূর্ণ শ্রেণীদ্বন্দ্বের অভিব্যক্তি রূপে বর্ণনা করেছিলেন তাঁরা কেউই শ্রেণীচরিত্র বিশ্লেষণ বা ইতিহাসে শ্রেণী উদ্ভবের কারণ ব্যাখা করতে পারেননি। মার্কস-এঙ্গেলস ইতিহাসের বস্তুবাদী বিশ্লেষণ করে দেখিয়ে দিলেন কীভাবে সমাজ বিকাশের একটা স্তরে পুঁজিবাদের আবির্ভাব হয়েছে, কীভাবে পুঁজিবাদ নিজের গর্ভেই আপন মৃত্যুবীজের জন্ম দিয়েছে, কেন পূর্ববর্তী দাস সমাজ ও সামন্ত সমাজের মতোই বিকাশের একটি পর্যায়ে গিয়ে ধ্বংস হয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। মার্কস এটা প্রমাণ করলেন যে, শ্রমিকশ্রেণীর জয় আর পুঁজিবাদের পতন একইভাবে অবশ্যম্ভাবী।
কিন্তু যতোই অবশ্যম্ভাবী হোক, সমাজ বিপ্লব কোনো অবস্থাতেই আকস্মিকভাবে সংঘটিত হয় না। যা কোনো ব্যক্তি বিশেষের ওপরেও নির্ভর করে না। সার্বিক বাস্তব পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেই একমাত্র সমাজব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন সম্ভব। এর জন্য দরকার শ্রেণীসংগ্রাম। চাই লক্ষলক্ষ নর-নারীর সমবেত আন্দোলন ও সচেতন শ্রমিকশ্রেণীর সেই সংগ্রাম যার নেতৃত্বে থাকবে এমন একটি দল এবং এমন সব নেতা যাদের নেতৃত্বের ভিত্তি হবে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান।” বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে শুধুমাত্র ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়া যায় না। দীর্ঘদিনে বুর্জোয়ারাও তাদের ঘাঁটি শক্ত করে নিয়েছে ইতিহাসের অনিবার্য ধারায়। দুর্ভেদ্য প্রাকারে বাস করছে তারা। কী করে সেই দুর্ভেদ্য প্রাকার ছিন্নভিন্ন করা যায় তারই কলাকৌশল আবিষ্কার করেছেন মার্কস-এঙ্গেলস শ্রেণীসংগ্রামের তত্ত্ব হাজির করে।
মার্কস-এঙ্গেলস সুনির্দিষ্টভাবেই শ্রমিকদের মুক্তির প্রশ্নে শ্রেণীসংগ্রামের ভিতর দিয়েই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পৌছাতে চেয়েছিলেন। শ্রমিকদের মুক্তির প্রশ্নে সমাজতন্ত্র ছিলো মার্কস-এঙ্গেলসের চোখে প্রথম ধাপ। মার্কস-এঙ্গেলস সমাজতন্ত্র বলতে বুঝিয়েছেন ব্যক্তিগত সম্পত্তির উচ্ছেদ। জমির মালিকানার অবসান, সবরকম উত্তরাধিকারের বিলোপ। মার্কস-এঙ্গেলস উভয়ই দেখিয়ে দিয়েছিলেন ব্যক্তি মালিকানা কিভাবে ক্ষতি করছে প্রোলেতারিয়েত শক্তিকে। মার্কস-এঙ্গেলস লিখেছিলেন, বুর্জোয়া ব্যক্তিত্ব, বুর্জোয়া স্বাধীনতার উচ্ছেদই আমাদের লক্ষ্য তাতে সন্দেহ নেই। শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লব হলো চিরাচরিত সম্পত্তি-সম্পর্কের সঙ্গে একেবারে আমূল বিচ্ছেদ।
সেই উচ্ছেদ ও বিচ্ছেদের জন্য সর্বহারার বিপ্লবই হচ্ছে একমাত্র পথ। সে বিপ্লব অবশ্যই আসবে শ্রেণীসংগ্রামের পথে; রক্তপাত এবং সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। তবে মার্কস-এঙ্গেলস দেখান যে, শ্রেণীসংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে সেই সমাজবাদই শেষ কথা নয়। সেই সমাজতন্ত্রে থাকবে সর্বহারা শ্রেণীর বিশিষ্ট ভূমিকা। আর তা পূর্ণতা পাবে সাম্যবাদের মধ্যে। সাম্যবাদে পৌছুবার আগে সমাজতন্ত্রের একটি ধাপ পার হয়ে যেতে হবে।
বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে মার্কস-এঙ্গেলসের যে শ্রেণীসংগ্রাম তার প্রথম ধাপ হলো তাই সমাজতন্ত্র। শ্রমিকশ্রেণী কর্তৃক রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের মধ্য দিয়েই এই বিপ্লব সম্পন্ন হবে। সমাজতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি হলো উৎপাদন উপকরণের সামাজিক মালিকানা। শ্রমজীবী জনগণই হবে তার মালিক। শ্রমিকরাই হবে রাষ্ট্রের শাসক। মার্কস দেখান যে, শ্রমিকশ্রেণী কর্তৃক পুঁজিপতিশ্রেণীকে দমনের মাধ্যমেই পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব। কেবলমাত্র শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামের ভিতর দিয়েই এই সমাজতন্ত্র অর্জিত হবে। সেক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বের সঙ্গে শ্রমিকশ্রেণীর গণ- আন্দোলনের সেতুবন্ধন পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের অন্যতম শর্ত। বিজ্ঞানসম্মত সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বের নেতৃত্বকারী ও সংগঠনী শক্তি ছাড়া শ্রমিকশ্রেণী পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিজয় অর্জন করতে পারে না। বিনা রক্তপাতে এবং বিনা আত্মত্যাগেও এ সংগ্রাম সফলতা লাভ করে না। মার্কস-এঙ্গেলস তাদের আলোচনায় শ্রমিকশ্রেণীর গুরুত্বটি ভালভাবে বুঝিয়ে দিলেন।
মার্কস-এঙ্গেলস বললেন, এর আগে ইতিহাসে যতো বিপ্লব ঘটেছে তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো শাসন ক্ষমতার পরিবর্তন। সমাজ বিপ্লব অনুষ্ঠিত হয়েছে এক শোষকশ্রেণীর উচ্ছেদ ও অপর এক শোষকশ্রেণীর উত্থানের মাধ্যমে। প্রচলিত রাষ্ট্রযন্ত্রকে বজায় রেখে শাসন ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিলো তারা। প্রোলেতারীয় বিপ্লবের লক্ষ্য হবে বাষ্ট্রযন্ত্রকে সম্পূর্ণরূপে ভেঙে ফেলে নতুন শ্রেণীহীন সমাজ গড়ে তোলা। যা ইতিহাসের সব শোষণের নিষ্পত্তি ঘটাবে চিরকালের মতো। প্রলেতারিয়েত বিপ্লবের সঙ্গে পুরানো সমাজ ব্যবস্থার গোটা ইমারতটাই ভেঙে পড়বে। মার্কসের নতুন দর্শনে মূল প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয় শ্রমিকশ্রেণী। বুর্জোয়া রাষ্ট্রের উৎখাত ও সমাজতন্ত্র বিনির্মাণে মার্কস বলেছেন, সেখানে শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।
জনগণেরই রাষ্ট্র হবে সেটা, তার মূল কথাটা হবে প্রলেতারীয় একনায়কত্ব।মার্কস-এঙ্গেলস দেখান যে, প্রতিটি রাষ্ট্রই হলো শ্রেণী-শত্রুকে দমন করার জন্য শাসকশ্রেণীর হাতের যন্ত্র বিশেষ। বুর্জোয়া রাষ্ট্রে এই দমন চলে প্রধানত শ্রমিকশ্রেণীর ওপর। ঠিক একইভাবে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্ব হলো বুর্জোয়াদের ওপর শ্রমিকশ্রেণীর শাসন, কিন্তু ব্যক্তি সম্পত্তি উচ্ছেদের ভিতর দিয়েই তা ঘটবে।
শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্বের আমলে গণতন্ত্র হলো শ্রমিকশ্রেণীর গণতন্ত্র, অধিকাংশ শোষিত জনসাধারণের গণতন্ত্র। লেনিনও শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্বের ব্যাপারটাকেই সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি লিখছেন, ‘যে শুধু শ্রেণী-সংগ্রাম স্বীকার করে, সে তখনো মার্কসবাদী নয়,….সে-ই মার্কসবাদী যে শ্রেণী-সংগ্রামের স্বীকৃতিকে প্রসারিত করে প্রলেতারীয় একনায়কত্বের স্বীকৃতিতে।মার্কসবাদী সম্পর্কে লেনিনের একেবারে সংজ্ঞার্থের মধ্যেই এসে যাচ্ছে সর্বহারা একনায়কত্বের ধারণা। শ্রমিকশ্রেণীকেই মার্কস সবার সামনে টেনে আনেন। শ্রমিকশ্রেণীকেই তিনি মনে করেন নতুন পৃথিবীর নিয়ন্তা, বিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি।
সেই শ্রমিক বিশ শতকের নাটকেরও মূল প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয় মার্কসবাদের প্রভাবের ফলে। শ্রমিকশ্রেণীর মুক্তি প্রশ্নেই প্রধান প্রধান নাট্যকাররা তাদের কলম ধরেন, দলগুলোর নাট্যকর্মীরা নাটক মঞ্চায়ন করেন। বিশ শতকের শুরু থেকেই এ নাট্যধারার আরম্ভ।
মার্কসবাদী দর্শন আবিষ্কারের পর বিশ্ব দ্রুত প্রধান দুটো শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায়। যার একদিকে আছে সাম্যবাদী তথা সমাজতন্ত্রীরা, ভিন্ন দিকে পুঁজিবাদী গোষ্ঠী। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা, শিল্প-সাহিত্য সবক্ষেত্রেই এই দুই পক্ষ জন্ম নেয়। শিল্প-সাহিত্যের দিক থেকে নাটক ভীষণভাবে এই মার্কসীয় দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়।
মার্কস-এঙ্গেলসের দর্শন কী করে বিশ শতকের নাটকের ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছে সেটা বুঝতে গেলে বিশ শতকের রাজনীতির প্রধান ঘটনাবলী, বিশ শতকের অর্থনীতি, সমাজ ব্যবস্থা সবকিছুই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বুঝতে হবে। বিশ শতকের মূল দর্শনই হচ্ছে মার্কসবাদ। মূলত এটা সমাজতান্ত্রিক শিবিরের দর্শন। পুঁজিবাদীরা এ দর্শনের • বিরোধিতা করলেও এর বিরুদ্ধে নিজস্ব কোনো দর্শন দাঁড় করাতে পারেনি, মার্কসবাদের বিরোধিতার মধ্যেই তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ থেকেছে। ইতিহাস- রাজনীতি-অর্থনীতি সবক্ষেত্রেই বিশ শতকে মার্কসবাদ বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছিলো। যে-কাউকে হয় এর পক্ষে, নতুবা এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়েছে। মার্কসবাদের মতো এক কথায় প্রকাশ করার মতো আর ভিন্ন কোনো দর্শন বিশ শতকে জন্ম নেয়নি। বিশ শতকের রাজনৈতিক নাটক বা তার গতিধারা বুঝতে হলে এই নাট্য আন্দোলনের সাথে মার্কসবাদের সম্পর্ক বা বিরোধ কোথায় তারও মূল্যায়ন দরকার।
বিশ্লেষণ করা দরকার শ্রমিকশ্রেণী কেন বিশ শতকের নাটকে এতো গুরুত্ব পেল। মার্কসবাদের প্রভাবই বা কেমন করে পড়লো এই নাট্যধারার ওপর। মার্কসের দ্বান্দ্বিক চিন্তাধারা উনিশ শতকেই নাট্যকারদের মানসিকতায় নানাভাবে প্রভাব ফেলছিলো। বিশ শতকের প্রারম্ভের দুটো ঘটনা নাট্যচিন্তার সেই ধারাকে সম্পূর্ণ ভিন্নখাতে বইয়ে দেয়। তার মধ্যে একটি হচ্ছে প্রথম মহাযুদ্ধ আর দ্বিতীয়টি সোভিয়েত দেশে সমাজতন্ত্রের আবির্ভাব। দুটো ঘটনা পাশাপাশিই ঘটে যায় এবং নাট্যকার ও নাট্যকর্মীদের চিন্তায় তার ছাপ রেখে যায়, যার ভিতর দিয়েই রাজনৈতিক নাটকের জন্ম। বিশ্বে মার্কসবাদ স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে সোভিয়েত দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে।
বিশ্ব ইতিহাসে এ ছিলো এক নতুন ঘটনা। বিশ্বে মার্কসবাদ প্রতিষ্ঠা লাভের পরপরই মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে নাটকের নতুন সংজ্ঞা তৈরি হচ্ছিলো। ঘোষণা করা হলো, মানব সমাজ নিরন্তর শ্রেণী সংগ্রামে ব্যস্ত। সেখানে পুঁজিবাদী শোষণ চলছে শ্রমিকদের ওপর। সচেতন বিবেকবান নাট্যকর্মী এ সংগ্রামে শোষিতশ্রেণীর সামিল হতে বাধ্য। বিশ শতকে নাটক তাই এক নতুন সংগ্রামী চেহারা নিয়ে দেখা দিলো। নাটকের মাধ্যমে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করা হলো। নাটক আর কোনো নিরপেক্ষ মাধ্যম হয়ে রইলো না। পুঁজিবাদী দুনিয়ায় সে নিলো শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষ।
এভাবেই বিশ শতকে নাটকের একটি ধারা সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক চরিত্র লাভ করলো। নাটক রচনা, মঞ্চায়ন, অভিনয় সর্বক্ষেত্রেই প্রাধান্য পেল এই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। রাজনৈতিক নাট্যধারা একদিনে তার সার্বিক অবস্থানে এসে দাঁড়ায়নি, বিভিন্ন ঘটনার প্রভাবে তার জন্ম হয়েছে। বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিতর দিয়ে সে পথ চলেছে। নাটকের এই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী তৈরির জন্য তৎকালীন বাস্তব অবস্থাই দায়ী ছিলো।
সোভিয়েত দেশে সমাজতন্ত্র আগমনের পাশাপাশি নাটকের ক্ষেত্রে মার্কসীয় চিন্তার বিকাশ ঘটাতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছিলো প্রথম মহাযুদ্ধের ঘটনাবলী ও যুদ্ধোত্তর মানুষের বিক্ষোভ। মহাযুদ্ধের পর গোটা বিশ শতক জুড়ে রাজনৈতিক নাট্যধারা নানাভাবে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে এসেছে মানুষের চিন্তার জগতে। যদিও এ ধারার শুরু হয়েছিলো ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে। পরবর্তীতে তা বিশ্ব জুড়েই ছড়িয়ে পড়ে। গোটা বিশ্বকে গ্রাস করে নেয় রাজনৈতিক নাট্যচিন্তা।
রাজনৈতিক নাটকের আরম্ভটা ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রে হলো কেন? ভিন্ন দেশগুলোতে কেন নয়? বিশ শতকের বাস্তব অবস্থাই ছিলো এর কারণ। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপেই পুঁজিবাদ তখন পূর্ণভাবে বিকাশ লাভ করেছিলো। পূর্বেই আমরা দেখেছি, শ্রমিকশ্রেণীর সাথেই রাজনৈতিক নাটকের সম্পর্ক মার্কসীয় চিন্তাধারার সূত্র ধরে, আর পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ছাড়া শ্রমিকশ্রেণী জন্ম নিতে পারে না।
যেহেতু পৃথিবীর অন্যান্য দেশে তখনো শ্রমিকশ্রেণী সেভাবে বিকশিত ছিলো না, সেজন্য শ্রমিকশ্রেণীর নাটক সেখানে জন্ম নেয়ার কথাও নয়। রাজনৈতিক নাটক তো প্রাথমিক ভাবে শ্রমিকশ্রেণীর মুক্তিরই নাটক। রাজনৈতিক নাটক ইউরোপে ও যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হওয়ার ভিন্ন একটি প্রেক্ষাপটও আছে, সেটা হলো পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সংকট। বিশ শতকের প্রারম্ভ থেকেই ইউরোপ ও আমেরিকায় পুঁজিবাদ মারাত্মক সংকট আকারে দেখা দেয়। মার্কসীয় চিন্তাধারা ঠিক
এই সময়ই তার প্রাধান্য বিস্তার আরম্ভ করে।
বিশ শতকের প্রথম দিকে ইউরোপ ও আমেরিকার রাজনীতি ও অর্থনীতিতে আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইংল্যাণ্ড, জার্মানী ছিলো সে সময় বিশ্বরাষ্ট্রসমূহের প্রথম সারিতে। আর ইউরোপের প্রধান প্রধান রাষ্ট্রের সবগুলোর অবস্থা ভালো ছিলো না। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দরুন নানারকম সমস্যা তৈরি হচ্ছিলো। বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে এদের প্রত্যেকটি কোনো-না-কোনো দুরবস্থার সম্মুখীন ছিলো। দ্রুত কারিগরি উন্নতি হচ্ছিলো, শাসক-কর্তৃপক্ষ ধন সম্পদে ফুলে ফেঁপে উঠছিলো, অন্য দিকে জনসাধারণের বঞ্চনা ও হতাশাই বৃদ্ধি পেয়ে চলছিলো।
সর্বাপেক্ষা সভ্য দেশেও দারিদ্র্য, বেকারত্ব, রোগব্যাধি, মানুষের প্রতি মানুষের অশ্রদ্ধা, সামরিক শাসন, অসাম্য এবং অত্যাচার সমস্যার আকার ধারণ করেছিলো। সারা ইউরোপ জুড়েই তখন বণিকশ্রেণী মুনাফার জন্য এমন কোনো অপরাধ নেই যা সংঘটিত করছিলো না। শ্রমিক ছাঁটাই, শ্রমিকদের মজুরি কমিয়ে দেয়া, যার জন্য ইউরোপের দেশে দেশে বেকারত্ব বেড়েই চলেছিলো; সেই সাথে বাড়ছিলো দারিদ্র্য।
অন্যদিকে এইসব লোকের কর্মসংস্থানের ব্যাপারে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ছিলো সীমাবদ্ধ। দ্রব্যমূল্য আকাশে তুলে দিয়ে মুনাফা লুণ্ঠন, শ্রমিকের মজুরি প্রায় অর্ধেক করে দিয়ে মুনাফা লুণ্ঠন, মুদ্রাস্ফীতিকে লাগামহীন করে মুনাফা লুণ্ঠন! পুঁজিবাদের ভয়ংকর রূপ এভাবে বের হয়ে পড়লো।
ইউরোপের দেশে দেশে ধনের অসম বন্টন ও বুর্জোয়া উৎপাদন ব্যবস্থা যেভাবে – মানুষের দারিদ্র্য বাড়িয়ে তুলছিলো রাষ্ট্রের হাতে আসলে এর কোনো সমাধানই ছিলো না। ফরাসী সিন্ডিকেটর জর্জ সোরেল ছিলেন বুর্জোয়া ব্যবস্থার তীব্র সমালোচক। সোরেল শুধু বুর্জোয়াদেরই দোষারোপ করতেন না। সমসাময়িক জীবন, চিন্তাধারা, গণতন্ত্র সবকিছুই তিনি সমালোচনা করতেন।
তিনি পুঁজিবাদী দেশগুলোতে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান কল্পে বলেছিলেন যে, দুটো ঘটনাই এই অধঃপতনের গতিকে রোধ করতে পারে। প্রথমত কোনো মহাযুদ্ধ যার মাধ্যমে মানুষ তার হারানো শক্তিকে ফিরে পাবে। দ্বিতীয়ত দুনিয়া জোড়া সর্বহারাদের এক মহাযুদ্ধ। ২২ বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে দুটো ঘটনাই ঘটেছিলো। সেটা সোরেলের বক্তব্যের হুবহু অনুরূপ ছিলো না। যদিও দুটো ঘটনাই তাৎপর্যপূর্ণভাবে ঘটেছিলো। বিশ শতকের চৌদ্দ সাল থেকে উনিশ সাল পর্যন্ত চলে মহাযুদ্ধ এবং সতের নভেম্বর রাশিয়ায় ঘটে সর্বহারার মহাবিপ্লব। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রীদের ক্ষমতা দখল এবং প্রথম মহাযুদ্ধ ও তৎপরবর্তী ঘটনাগুলো কীভাবে বিশ্বে মাকর্সবাদী চিন্তার প্রসার ও সেই সাথে রাজনৈতিক নাট্যধারার উদ্ভব ঘটাতে সাহায্য করেছিলো সেই আলোচনার ভিতরেই আমরা এখন চলে এসেছি।
পুঁজিবাদী দুনিয়ায় যে বিপর্যয় দেখা দিলো তার পরিণামে বেধে গেল সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ। মার্কস-এঙ্গেলস লিখেছিলেন, ‘বুর্জোয়া-সমাজ যে সম্পদ উৎপন্ন করে তাকে ধারণ করার পক্ষে বুর্জোয়া-সমাজের অবস্থা বড়ই সংকীর্ণ। এই সংকট থেকে বুর্জোয়াশ্রেণী আবার কোন উপায়ে নিস্তার পায়? নিস্তার পায়-একদিকে উৎপাদন-শক্তির বিপুল অংশ বাধ্য হয়ে নষ্ট করে ফেলে, অপরদিকে নতুন বাজার দখল করে এবং পুরনো বাজারের পূর্ণতর শোষণে। ‘২৩ ধনতন্ত্রী দেশগুলোর বাজার আর কাঁচামালের প্রয়োজন দিনদিন বেড়ে যাচ্ছিলো, অতএব তারা সাম্রাজ্যের সন্ধানে পৃথিবীময় ছুটে বেড়াতে লাগলো।
মার্কস-এঙ্গেলস লিখেছেন, ‘নিজেদের প্রস্তুত মালের জন্য অবিরত বর্ধমান এক বাজারের তাগিদ বুর্জোয়াশ্রেণীকে সারা পৃথিবীময় দৌড় করিয়ে বেড়ায়। সর্বদা তাদের ঢুকতে হয়, সর্বত্র গেড়ে বসতে হয়, যোগসূত্র স্থাপন করতে হয় সর্বত্র। ‘২৪ বিশ শতকের গোড়ার বছরগুলিতে ইউরোপীয় সম্প্রসারণবাদের ধারা চরমে উঠেছিলো। বিভিন্ন জাতির মধ্যে চলছিলো বাজার দখলের লড়াই। জাতিতে জাতিতে এই রেষারেষি, এটা আসলে ছিলো ধনিকতন্ত্রী শিল্প-বাণিজ্যের অবশ্যম্ভাবী ফল। ধনিকতন্ত্রের সাধারণ পদ্ধতি ছিলো পরস্পরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর গলা কাটাকাটি করা। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রভুত্বের প্রশ্নটি সর্বাপেক্ষা বড় হয়ে দেখা দিলো, যেটা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ছিলো স্বাভাবিক।
দেশে দেশে সম্পদ বৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি অর্জনের বাধ্যতামূলক প্রতিযোগিতা অত্যন্ত নগ্নভাবেই প্রকট হয়ে উঠলো। ইউরোপে এশিয়ায় আফ্রিকাতে সর্বদাই এদের মধ্যে ঠোকাঠুকি বাধতে লাগলো। বেড়ে উঠলো মানোমালিন্য। যুদ্ধ তখন শুধু বাধবার অপেক্ষা। সেই সময়ে বৃহৎ শক্তিগুলি নিজ নিজ সাধ্য মতো অস্ত্র সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছিলো। যুদ্ধের আতঙ্ক ক্রমে ইউরোপময় ছড়িয়ে পড়লো। সবাই তখন যুদ্ধের সম্ভাবনার কথাই বলতো এবং সেই অনুসারে সাধ্যমতো নিজেদের প্রস্তুতও রাখতো।
রণসজ্জার কারখানাগুলো ছিলো অত্যন্ত ধনশালী এবং শক্তিশালী। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানী, ইতালী এবং অন্যান্য দেশের বহু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং মন্ত্রীদেরও এতে অংশীদারিত্ব ছিলো। নিজের নিজের স্বার্থেই ঐ সকল দেশের মন্ত্রী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও যুদ্ধের পক্ষে জোরালো প্রচার চালাচ্ছিলেন। যুদ্ধ বাধলেই তাদের লাভ। যুদ্ধ যে অতো তাড়াতাড়ি বেধে উঠলো তার মধ্যে অনেকখানি হাত ছিলো এদের। মহাযুদ্ধ যে ছিলো পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অনিবার্যতা, সমাজতন্ত্রী ও পুঁজিবাদী দুপক্ষের রাষ্ট্র চিন্তাবিদরাই এ সত্য স্বীকার করেন। পুঁজিবাদের সৃষ্ট এই যুদ্ধ এবং তৎপরবর্তী ঘটনা কী করে নাটকের ইতিহাসকে নতুন দিক নির্দেশনা দেয় সেটাই এখানে আমাদের আলোচনার মূল একটি বিষয়। মহাযুদ্ধ ও তৎপরবর্তী ঘটনা প্রবাহের মধ্যেই নিহিত ছিলো এই নতুন নাট্যধারার বীজ।
যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির এক হিসেবে প্রথম মহাযুদ্ধে মোট হতাহতের সংখ্যা ছিলো চার কোটি ষাট লক্ষ। সামরিক ও অসামরিক মৃতের সংখ্যা ছিলো তার মধ্যে তিন কোটি ষাট লক্ষ। পঙ্গু ও আহতের সংখ্যা দুই কোটি। সর্বস্বান্ত ও আশ্রয়হীন এক কোটি। যুদ্ধে পিতৃ-মাতৃহীন শিশুর সংখ্যা ছিলো নব্বই লক্ষ ও বিধবার সংখ্যা দাঁড়িয়েছিলো পঞ্চাশ লক্ষ। ২৬ জাতিগত প্রশ্ন তুলে যুদ্ধ শুরু করা হয়েছিলো। যুদ্ধের শুরুতে প্রচারের কারণে সকল দেশের নাগরিকরাই যুদ্ধের ব্যাপারে উৎসাহ দেখালেও খুব শীঘ্রই তাদের ভুল ভাঙলো। যুদ্ধের মধ্যেই রক্তপাত-মৃত্যু এবং পাশাপাশি চরম অর্থনৈতিক দৈন্যদশা দেখা দিলো। যুদ্ধের ভিতরেই ব্যবসায়ী-পুঁজিপতিরা মুনাফা লুটতে লাগলো।
খাদ্য ও অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বেড়ে চললো অথচ শ্রমিকের মজুরি বাড়লো না। না খেতে পেয়ে, জামা-কাপড়ের অভাবে কষ্ট পেয়ে শ্রমিকদের মধ্যে বিক্ষোভ চরমে উঠলো। যুদ্ধের ধ্বংসলীলা তৃতীয় বছর পেরিয়ে চতুর্থ বছরে পড়লে বিষয়টা সবার নিকটে অসহ্য হয়ে উঠলো। সে বছরেই যুদ্ধের মধ্যে ঘটে যায় বিপ্লব। মহাযুদ্ধ পুঁজিবাদী দুনিয়ার সর্বগ্রাসী রূপকে যেমন নগ্ন করে তুললো, তেমনি এই সংকটের মধ্য থেকেই জন্ম নিলো শ্রমিকশ্রেণীর নিজস্ব রাষ্ট্র ব্যবস্থা। জনন্ম নেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মার্কস এঙ্গেলসের তত্ত্বকে বাস্তবায়িত করলেন ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন এবং অন্যান্যরা। বিপ্লব বিশ শতকের অন্যতম মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনায় রূপ পরিগ্রহ করলো। নতুন দুনিয়ার জয়যাত্রা শুরু হলো।
পৃথিবীর এক ষষ্ঠমাংশ জুড়ে অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক মহাবিপ্লবের সাফল্য ইউরোপের ঘটনাবলীকে নতুন খাতে প্রবাহিত করলো। বিপ্লব যুদ্ধের গতিতে একটা প্রকাণ্ড পরিবর্তন নিয়ে এলো। যুদ্ধের ঘটনাবলী, মানুষের মৃত্যু সাধারণ মানুষের মধ্যে ধনবাদের প্রতি এতো বিতৃষ্ণা জাগিয়ে তুলেছিলো যে সোভিয়েত দেশকে তারা অনুসরণ করতে চাইলো। সমাজতন্ত্রকে অনেকেই তাদের মুক্তির দিশারী বলে মনে করলো। যুদ্ধের পর তাই মার্কসবাদ বা সমাজতন্ত্রের পক্ষে বিভিন্ন ঘটনাবলী লক্ষ্য করা যায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশে দেশে। উনিশশো উনিশ সালে গ্লাসগোর পৌর পতাকাদণ্ডে লাল- নিশান উড়েছিলো। অনেকে আশা করেছিলো লাল-নিশান বাকিংহাম প্রাসাদের চূড়ায়ও উড়বে। জার্মানী-ইটালিতে বিপ্লব সংঘটিত হবে বলেই মনে হচ্ছিলো।
ফ্রান্সে যুদ্ধ শেষে ফরাসী শ্রমিকরা শ্রেণীসংগ্রাম শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। যে যুক্তরাষ্ট্র মিত্রশক্তিবর্গকে পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা করেছিলো এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পরিপূর্ণ শক্তি সহকারে অবতীর্ণ হয়েছিলো, তারাও এই ঝঞ্ঝার কবল থেকে রেহাই পেল না। উনিশশো উনিশ সালে সেখানকার চল্লিশ লক্ষ শ্রমিক ধর্মঘট করে বসলো। শিকাগো শহরে একটা নয় দু-দুটো কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হলো। ক্ষুব্ধ হয়ে এটর্নী জেনারেল এ মিচেল আদালতে লাল-আন্দোলনের বিরুদ্ধে এক মামলাই দায়ের করে বসলেন। দেখা যাচ্ছে যে, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সারা ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে মার্কসবাদী চিন্তাধারা উঁকিঝুঁকি মারছিলো। প্রথম মহাযুদ্ধের পর এভাবেই মার্কসবাদের ভিত্তি দৃঢ় হচ্ছিলো পৃথিবীর দেশে দেশে। মাকর্সবাদের ভিত্তি দৃঢ় না হলে রাজনৈতিক নাটকের জন্মও সম্ভব ছিলো কি না বলা যায় না।
বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের প্রধান সমস্যা ছিলো যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে শান্তিপূর্ণ অর্থনীতির পুনপ্রবর্তন। সেটা ছিলো অসম্ভব ব্যাপার। ইউরোপ তখন সর্বনাশী যুদ্ধে সর্বস্ব খুইয়ে বসেছিলো। যারা জয়ী হয়েছিলো তাদের বিজয়টাও ছিলো শূন্যগর্ভ। দেখা গেল যুদ্ধে মিত্রপক্ষের মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছিলো প্রায় চার হাজার একশো কোটি পাউণ্ড, জার্মানীর ব্যয় ছিলো পনেরশো কোটি পাউণ্ডেরও বেশি। ফলে নতুন ব্যয়ের ধাক্কাটা সামলে ওঠা সহজ ছিলো না। যুদ্ধ শেষে দেখা গেল, সব সরকারই দেনার দায়ে ডুবে গেছে। বিজয়ী দেশগুলোকেও টিকে থাকার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করতে হলো। সেই সাথে ছিলো দেশের অভ্যন্তরে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে গৃহীত ঋণ। দুই ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে কেউ সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারছিলো না।
যুদ্ধরত অবস্থায় ইংল্যাণ্ডের অবস্থা প্রায় দুর্ভিক্ষের কাছাকাছি পৌঁছেছিলো। যুদ্ধ শেষে দেশটি তীব্র আর্থিক দারিদ্র্যে নিপতিত হলো। ফল দাঁড়ালো পণ্যের মূল্যের সার্বিক ও বিপর্যয়কর পতন। বিশেষ করে মধ্য ইউরোপের ছোট ছোট দেশগুলোর দশা সংকটাপন্ন হয়ে উঠলো। মুদ্রা ব্যবস্থা ভেঙে পড়লো ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতির কারণে। মধ্যবিত্ত – শ্রেণীগুলো সর্বস্বান্ত হলো। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রতি মানুষের মোহ ভেঙে গেল।
সেই পটভূমিতে কমিউনিস্টরা নিজেদের আওয়াজ জোরদার করে বললো-গোটা সভ্যতা এখন ধ্বংসের মুখে, মানবতা বানচাল হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মাত্র একটা শক্তি এখন একে রক্ষা করতে পারে-আর তা হলো সর্বহারাদের শক্তি। যুদ্ধোত্তর কালে পুঁজিবাদ যখন সারা ইউরোপে ধ্বংস বয়ে আনে বিপর্যয়ের প্রত্যক্ষ আঘাত থেকে রক্ষা পেল সোভিয়েত রাশিয়া। সবাই যখন বিধ্বংস, সবাই যখন হতাশার মধ্যে নিমজ্জিত সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন নতুন উদ্যমে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো। বেকারত্ব ছিলো না, মুদ্রাস্ফীতি ছিলো না। রবীন্দ্রনাথ রাশিয়ার চিঠিতে লিখেছিলেন, সোভিয়েত দেশের মজুরদের সাথে ইংল্যাণ্ডের মজুরদের তুলনা করলে আকাশ পাতাল তফাৎ দেখা যায়। ধনী দরিদ্রের ভেদাভেদ মোটামুটি ঘুচে গেছে।
জনসাধারণের আত্মমর্যাদা বেড়েছে।৩৩ সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের নিরবচ্ছিন্ন অগ্রগতি, সোভিয়েতবাসীর জীবনমানের ক্রমান্বয়ে উন্নতি, সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্বেরই ইঙ্গিত বহন করে। সারা ইউরোপের বিপন্ন মানুষের কাছে তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন সত্যিকার অর্থেই আশার আলো বয়ে এনেছিলো। বুদ্ধিজীবীদের মাঝেও তা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিলো। তাই মার্কসবাদ কী সে সম্পর্কে জানার জন্য মানুষের মনে নতুন উদ্দীপনা জন্ম নেয়। ইউরোপের রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে মার্কসবাদ বিস্তার লাভ করতে থাকে। রাজনৈতিক অঙ্গনে মার্কসবাদ বিস্তৃত হওয়ার পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তার প্রভাব বিস্তার শুরু হয়। বিশেষ করে জার্মানী ও রাশিয়ার নাট্য ভাবনায় মার্কসবাদী চিন্তার উন্মেষ ঘটে। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকশ্রেণীর নাট্যচর্চায় তা ছড়িয়ে পড়ে।
রাশিয়ায় বিপ্লব সম্পন্ন হবার পর তা নিরঙ্কুশ ছিলো না। রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় পুঁজিবাদী দেশগুলো ভীত হয়ে পড়ে। বুঝতে পারে যে-কোনো সময় তাদের দেশের ক্ষমতাও শ্রমিকদের হাতে চলে যেতে পারে। শ্রমিকদের হাতে ক্ষমতা চলে যাওয়ার ব্যাপারটা বুর্জোয়ারা কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ফ্রান্স, জার্মানী, ইংল্যান্ড, পোল্যান্ড, রুমানিয়া প্রভৃতি চোদ্দটি দেশ একযোগে রাশিয়ার শ্রমিকশ্রেণীকে ধ্বংস করার জন্য প্রায় তিন লক্ষ সৈন্য পাঠায়। উনিশশো সতের থেকে বিশ সাল পর্যন্ত চলে তাদের আক্রমণ। বাইরের শত্রুর তীব্র আক্রমণের মুখে সোভিয়েত ইউনিয়নের শ্রমিকশ্রেণী এবং লালফৌজ শক্ত প্রতিরোধ তৈরি করে। শেষ পর্যন্ত বিপ্লবীদের লালফৌজের সামনে শত্রু সৈন্যরা কেউ টিকতে পারে না।
যেসব দেশ সৈন্য পাঠিয়েছিলো তাদের শ্রমিকরাও সরকারের কাছে দাবি জানাতে থাকে রুশ দেশ থেকে সৈন্যদের প্রত্যাহার করার জন্য। মহাযুদ্ধের পর সেসব দেশের সৈন্যরাও ছিলো ক্লান্ত, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপ্লবের বিরুদ্ধে লড়বার ক্ষমতা বা ইচ্ছা কোনোটাই তাদের ছিলো না। এসব কারণে পুঁজিবাদী দেশগুলো পিছু হটতে বাধ্য হয়। ভিন্নভাবে তারা শ্রমিকশ্রেণীকে জব্দ করার জন্য রাশিয়ার সঙ্গে মালপত্র কেনাবেচা, ধার দেওয়া সহ সকল ধরনের সম্পর্ক বন্ধ রাখে। এই ঘটনায় সমাজতান্ত্রিক দেশ রাশিয়াকে ভীষণ সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়নের তখন বাইরের আক্রমণের ভয় তো ছিলোই, ছিলো ভিতর থেকেও অভ্যুত্থানের ভয়। লেনিন তাই বলেছিলেন, ‘বিপ্লব এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। জারতন্ত্র যেমন বিপ্লবকে পরাজিত করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী আর নয় তেমনি বিপ্লবও এখন পর্যন্ত জারতন্ত্রকে পরাজিত করার মতো যথেষ্ট শক্তি অর্জন করে নি’।৩৫ বিপ্লবের পয় সোভিয়েত ইউনিয়নে খাদ্য, জ্বালানী ও অন্যান্য দ্রব্যের খুবই অভাব ও নানারকম অসুবিধা দেখা দিয়েছিলো। বিপ্লবী পার্টি সে সবের সমাধান করা নিয়ে ছিলো বেশি ব্যস্ত। তা সত্ত্বেও বিপ্লবের পরপরই সোভিয়েত দেশে থিয়েটার বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিলো। বিপ্লবী শিল্প-সাহিত্য কী রকম হবে তা নিয়ে দীর্ঘ বিতর্কের ঝড় ওঠে এই সময়।
বিভিন্ন শ্রেণীর লোক থিয়েটারকে বিপ্লবের পক্ষে কাজে লাগাবার জন্য এগিয়ে আসে। শিল্প-সাহিত্য প্রসঙ্গে লেনিনের বক্তব্য ছিলো, বুর্জোয়া ধ্যান ধারণার বৈপরীত্যে, বুর্জোয়া ব্যবসায়ী চিন্তার বৈপরীত্যে, বুর্জোয়া পেশাদারি মনোভাবের বৈপরীত্যে এবং ‘ব্যক্তি কেন্দ্রিক উচ্ছৃঙ্খলতার’ বিরুদ্ধে সর্বহারাকে দলীয় সাহিত্যের নীতি অনুসরণ করতে হবে; সমাজতান্ত্রিক আদর্শ প্রচারই হবে যার মূল লক্ষ্য। সর্বহারার স্বার্থ ছাড়া আর কোনো স্বার্থ সেখানে বিচার্য নয়। বিপ্লবের পর লেনিন মনে করতেন, শিল্প-সাহিত্য প্রলেতারিয়েত স্বার্থকে বাদ দিয়ে একটি ব্যক্তিগত উদ্যোগ হতে পারে না।
বিপ্লবের পর সোভিয়েত দেশে শুধু সমাজতন্ত্রের পক্ষে নাটক মঞ্চায়নই বড় কথা ছিলো না, নাটক যে রাজনীতি প্রচারের বিরাট হাতিয়ার হিসাবে গড়ে উঠতে পারে সেই বিশ্বাসও দৃঢ় হয়। লেনিন এবং স্তালিন দুজনেই নাটকের প্রচারের ক্ষমতাকে স্বীকার করে নেন এবং নিজেদের রাজনীতির পক্ষে তাকে ব্যবহার করার কথা ভাবেন। লেনিন একবার লুনাচারস্কিকে বলেছিলেন, ‘শিল্প ইতিহাস কী অপূর্ব ক্ষেত্র। মার্কসবাদীদের পক্ষে এখানে করবার কতো কী-ই না রয়েছে’।৩৭ তিনি আরো বলেছিলেন যে, শিল্পকে প্রচারের মাধ্যম হিসাবে এগিয়ে দিতে হবে। লেনিনের আগ্রহ ছিলো সেই সংস্কৃতি নিয়ে যা সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি লাভের জন্য, রাজনৈতিক বিজয়ের সংহতির জন্য এবং সোভিয়েত দেশের সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির সফল নির্মাণের জন্য অপরিহার্য পূর্বশর্ত হিসাবে কাজ করবে।
সোভিয়েত সরকার সচেতন উদ্যোগ নিলো নাটককে রাজনীতির পক্ষে ব্যবহারের জন্য। রাষ্ট্র ও সমাজের সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠনের চিন্তায় নতুন থিয়েটার সৃষ্টির উদ্যোগে সোভিয়েত সরকার উনিশশো সতের সালেই এক শিক্ষামূলক সরকারি পরিষদ গঠন করে তার ওপর সমস্ত থিয়েটারের দায়িত্বভার ন্যস্ত করেছিলো। থিয়েটারের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য আইন মাফিক থিয়েটারের প্রেক্ষাগৃহ, পোষাক, দৃশ্যসজ্জার উপকরণ সবকিছু জাতীয় সম্পত্তি হিসাবে ঘোষণা করা হয়।
উনিশশো উনিশ সালে সে আইনে স্বাক্ষর করেন স্বয়ং লেনিন, যার লক্ষ্য ছিলো জনগণের কাছে রাজনৈতিক আদর্শ পৌঁছে দেয়া।।সেই সময়ের সোভিয়েত থিয়েটার জগতের একটি উল্লেখযোগ্য পর্ব বলা যায় সারা দেশে ব্যাপকভাবে পিপলস্ থিয়েটার বা গণনাট্যের জাগরণকে। যার লক্ষ্য ছিলো জনগণের ব্যাপকতম অংশের কাছে সংস্কৃতি বা শিল্পকে পৌছে দেয়া। থিয়েটার যে চেতনা বিকাশে সাহায্য করে সেই বিশ্বাস থেকেই এটা করা হয়েছিলো। সোভিয়েত দেশে গড়ে ওঠা এইসব গণনাট্য, যাকে ‘এ্যাজিটপ্রপ’ বলা হতো তার মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার উন্মেষ ঘটে।
এ্যাজিটপ্রপ এই নাট্যধারার মধ্যেই রাজনৈতিক থিয়েটারের বীজ লুকিয়ে ছিলো। এ্যাজিটেশন ও প্রোপাগান্ডা এই দুই শব্দের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে এই নাট্যধারা। পূর্বেই আমরা দেখেছি, অক্টোবর বিপ্লবের ঠিক পরপরই নবীন সোভিয়েত সমাজতন্ত্রকে বিপ্লবের সাফল্যগুলো রক্ষার কাজে ভিতরের ও বাইরের শত্রুদের মোকাবেলা করার লড়াইয়ে আত্মনিয়োগ করতে হয়েছিলো। গৃহযুদ্ধের সম্মুখ সমরে হাজার হাজার শ্রমিক-কৃষককে ছুটে যেতে হয়েছিলো। এই পরিস্থিতিতেই এ্যাজিটপ্রপ নাট্যধারার জন্ম। নাটকগুলো ছিলো মূলত প্রচারণামূলক ও মানুষকে উদ্দীপ্ত করার জন্য। নাটকগুলি সাধারণত সমসাময়িক ঘটনাবলী বা সমস্যা নিয়ে লেখা হতো, কীভাবে সে সমস্যাগুলিকে মোকাবেলা করতে হবে নাটকে তারও নির্দেশ থাকতো।
সোভিয়েত সরকার যেসব আইনকানুন প্রচলিত করেছিলেন তার ব্যাখ্যাও দেয়া হতো নাটকগুলোতে। নাটকগুলি সহজবোধ্য ছিলো এবং যে-কোনো অবস্থায় যে-কোনো দল কর্তৃক অভিনীত হতে পারে সেভাবেই লেখা হতো। দাবানলের মতো এই নাটকগুলো ছড়িয়ে পড়ছিলো। লাল উড়ালের জন্য সংগ্রাম, লাল পতাকার নীচে, মুক্ত শ্রমিক গাথা, বিপ্লবের জয়গান নাটকগুলো প্রচণ্ড জনসমর্থন লাভ করেছিলো। বিশেষ করে যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকদের মধ্যে এ্যাজিটপ্রপ নাটকগুলির রাজনৈতিক গুরুত্ব এবং তার প্রভাব ছিলো অপরিসীম। বিপ্লবের সাফল্যকে রক্ষা এবং গৃহযুদ্ধে জয়ী হতে এই নাটকগুলো অপ্রতিরোধ্য হাতিয়ারের কাজ করেছিলো।
রাজনৈতিক এ্যাজিটেশন কোর্ট নামক আর এক ধরনের ভ্রাম্যমান থিয়েটার ব্যাপক প্রচারের উৎস হয়ে উঠলো। কোনো কোনো ঘটনার অথবা বাস্তব বা কাল্পনিক বিশিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের বিচার অবলম্বনে নাটক মঞ্চস্থ হতো, দর্শকদের সুযোগ দেওয়া হতো তর্ক-বিতর্কের, অভিনয়ে অংশগ্রহণকারী চরিত্রগুলিকে সমর্থন বা ধিক্কার জানাতে। এই এ্যাজিট কোর্টগুলি রাজনৈতিক শত্রুদের মুখোশ খুলে ধরতো, মাস্তান বা দলত্যাগীদের শাস্তি দিতো। তবে এ্যাজিটপ্রপগুলো কোনো পূর্ণাঙ্গ নাট্যধারা ছিলো না। এইগুলো সাধারণত মুক্তাঙ্গনের নাটক ও ক্ষুদ্রাকৃতির, যার মূল উদ্দেশ্য হলো রাজনীতি প্রচার। সেই প্রচারণা ছিলো শত্রুর বিরুদ্ধে, সেখান কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ছিলো না। সরাসরি সেগুলো সমাজতন্ত্রের পক্ষে জনগণকে উত্তেজিত করতো।
লেনিন মনে করতেন, শুধু উত্তেজনা সৃষ্টি করা রাজনৈতিক নাটকের কাজ নয়, রাজনৈতিক নাটকের কাজ হবে শ্রমিক-কৃষককে সমাজ- বাস্তবতা সম্পর্কে জানতে দেয়া। শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে লেনিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উক্তি ছিলো, ‘শিল্প সম্বন্ধে আমরা কী ভাবছি, সেটা বড়ো জিনিস নয়। কোটিকোটি জনগণের মধ্যে কয়েক’শ অথবা এমনকি কয়েক হাজার মানুষ শিল্প থেকে কি পেল সেটাও জরুরি নয়। শিল্প জনগণের সম্পদ। ব্যাপকতম মেহনতি জনের ঠিক গভীরেই তার শেকড় যাওয়া দরকার। ‘৪০ শিল্প-সাহিত্য জনগণের সম্পত্তি-লেনিনের এই উক্তি শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে শুধু সোভিয়েত দেশেই নয়, বিশ্বের সমস্ত কমিউনিস্ট পার্টির মূলমন্ত্র হয়ে উঠলো।
শিল্প-সাহিত্য জনগণের সম্পত্তি, সেই শিল্প-সাহিত্যের যে অমূল্য সম্পদ শোষকশ্রেণীর কুক্ষিগত ছিলো তাকে শ্রমিকশ্রেণীর কাছে পৌছে দিতে হবে-লেনিনের এই উক্তির প্রেক্ষিতেই সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন সংস্থায় কর্মরত শ্রমিকদের বিনামূল্যে থিয়েটারে প্রবেশের অধিকার দেয়া হয়। সরকার থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদেরকে লালফৌজের জন্য গৃহীত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাটক করার নির্দেশ প্রদান করে।
নতুন লক্ষ্য পূরণের দাবি পড়ে থিয়েটারের ওপর-জনসাধারণের জন্য থিয়েটারের দ্বার খুলে দিতে হবে। যে কোটিকোটি মানুষ এতোকাল সাংস্কৃতিক কর্মের আনন্দ থেকে বঞ্চিত ছিলো তাদের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে নাট্য-মঞ্চ। এইভাবে বিপ্লব-উত্তর যুগে সোভিয়েত দেশের থিয়েটারে নতুন দর্শকের সমাগম শুরু হয়, যা বিপ্লবের পূর্বে ছিলো কল্পনাতীত। শ্রমিকশ্রেণীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এবং গ্রামাঞ্চলে নাটককে ছড়িয়ে দেয়া হয়। রাশিয়ার চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘থিয়েটার ভালো ভালো অপেরা ও বড়ো নাটকের অভিনয়ে বিষম ভিড়, কিন্তু যারা দেখছে তারা কৃষি ও কর্মীদের দলের’।
সোভিয়েত রাশিয়ার যেসব অঞ্চলে থিয়েটার কী বস্তু লোকে জানতো না বিপ্লবের পরে সেইসব অঞ্চলেও নাট্যকলা বা থিয়েটার বিস্তার লাভ করে। বিপ্লবের পূর্বে রাশিয়ায় সব জাতির থিয়েটার ছিলো না। বিপ্লবের পরে সোভিয়েত থিয়েটার এক ব্যাপক জাতীয় রূপ নেয় আর তার চরিত্র বদলে যায়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায়, মধ্য এশিয়ার উজবেক, কাজাখ, কিরগিজ, তাজিক, তুর্কমেনিয়া প্রভৃতি স্থানে পূর্বে থিয়েটারের নিদর্শনই ছিলো না।
কাজাখ প্রজাতন্ত্রের আয়তন ইউরোপের এক তৃতীয়াংশ। বলশোভিক বিপ্লবের আগে যেখানে কোনো নাট্যশালার অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া যায় না, বিপ্লবের পর সেখানেও থিয়েটার পৌছে দেয়া হয়। এ সকল কিছুর পেছনে মূল লক্ষ্য ছিলো নাটককে রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করে তোলা, রাজনীতির পক্ষে প্রচার চালানো। লেনিন দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা চালিত হয়ে এবং সর্বহারা একনায়কত্বের যুগে তাদের জীবনের অবস্থা ও সংগ্রামের প্রতি দৃষ্টি রেখে সংস্কৃতি উন্নত করতে হবে।
এভাবেই থিয়েটার রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হতে থাকে সোভিয়েত দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর। সেখানে গোড়াতেই যে সমস্যাটা দেখা দেয় তাহলো রাজনৈতিক থিয়েটার বা মার্কসবাদী থিয়েটার ব্যাপারটা আসলে কী সেটা বেশির ভাগ মানুষের কাছেই স্পষ্ট ছিলো না।মার্কসবাদী থিয়েটারের কী রূপ, কী তার মূল লক্ষ্য সব ব্যাপারেই দেখা দেয় অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তি। শিল্প-সাহিত্য প্রসঙ্গে লেনিন মতামত রাখলেও তার স্বরূপটি কী হবে সে ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলার সুযোগ ছিলো না।।
যেটুকু নির্দেশনা তিনি রেখেছিলেন একটি বিপ্লবী নাট্যধারা গড়ে উঠবার জন্য তা ছিলো সামান্য। সেজন্য সোভিয়েত থিয়েটারে বিপ্লবের পর অনেক কালাপাহাড়ি কাণ্ডও ঘটে। লুনাচারস্কি প্রতিষ্ঠিত লীগ ফর প্রলেতারিয়ান কালচার বা ‘প্রোলেটকুল্ট’ যা উনিশ শতকের শেষ দশক থেকেই কমিউনিস্ট আন্দোলনের অংশীদার ছিলো, বিপ্লবের পর স্বভাবতই এই গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নেতৃত্ব লাভের দাবি জানাতে থাকে। ট্রটস্কির প্রস্তাব অনুসারে প্রোলেটকুল্ট গোষ্ঠীকে শিক্ষা-দপ্তরের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়। লীগ ফর প্রলেতারিয়ান কালচার-এর নাট্য পরিচালক ও নাট্যকারদের মধ্যে প্রথম সারিতে ছিলেন বোগদানভ, মায়ারহোল্ড, ফরেগার, ব্রিউসভ প্রমুখ।
ট্রটস্কির সুপারিশে সোভিয়েত সরকার মায়ারহোল্ডকে ‘জনতার শিল্পী’ উপাধিতে ভূষিত করলো। মায়ারহোল্ড কমিউনিজমের আদর্শে কাজ করার অভিলাষ ব্যক্ত করেন। সোভিয়েত সরকার তাকে গণশিক্ষা দপ্তরের থিয়েটার বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব দেন এবং তিনি থিয়েটারকে বিপ্লবী আদর্শে ঢেলে সাজাবার জন্য পরিকল্পনা নেন, যার মূল লক্ষ্য ছিলো পুরানো সকল থিয়েটারকে বর্জন করা। সরকারি অনুমোদন লাভের পর প্রোলেটকুল্ট প্রথমেই ‘সর্ববিধ ঐতিহ্য’ ধ্বংস করার শপথ গ্রহণ করে। মাকর্সবাদের শ্লোগান ছাড়া তারা কোনো নাটক বা সাহিত্যকে বিপ্লবের অস্ত্র বলে স্বীকার করতে চাইছিলো না।
মায়ারহোল্ড ও ফরেগার এক সার্কুলার জারি করেন যার দু নম্বর অনুচ্ছেদে লেখা ছিলো ‘সর্বপ্রকার পুরাতন নাটকের উচ্ছেদ চাই’। নতুন নাট্য সৈনিকরা পুরাতনকে উপড়ে ফেলার জন্য ‘অক্টোবর থিয়েটার ফ্রন্ট’ নামে এক যুদ্ধংদেহী সংগঠন গড়ে তুলে বহু চমকপ্রদ পরীক্ষা চালাতে লাগলেন। বিপ্লব-পূর্বে, বিশেষ করে উনিশশো সতের- আঠার সালের মঞ্চায়িত নাট্য তালিকায় ছিলো অর্ধেক রুশ বা বিদেশি ধ্রুপদী নাটক এবং বাকি অর্ধেক প্রাকবিপ্লব যুগের নাট্যকার যেমন নেভেজিন, স্পাঝিনসকি, রিশরুভ ও অন্যান্যদের নাটকাবলী। সোভিয়েত সরকারের সাংস্কৃতিক দপ্তর এই নাট্যতালিকা আপাদমস্তক পরিবর্তনের নির্দেশ জারি করে।
প্রোলেটকুল্টরা অন্যসব গোষ্ঠীকে প্রতিক্রিয়াশীল, প্রতিবিপ্লবী, সোভিয়েত-বিরোধী প্রভৃতি হিসাবে চিহ্নিত করে প্রভৃত গালাগাল করতে লাগলো এবং নিজেদেরকেই একমাত্র বৈপ্লবিক বলে প্রচার করতে লাগলো। বিপ্লবের পূর্বেই লেনিন তার ‘পার্টি সংগঠন ও পার্টি সাহিত্য’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘সাহিত্যিক অতিমানবরা উচ্ছন্নে যাক। সাহিত্যকে অবশ্যই প্রলেতারিয়েতের সাধারণ স্বার্থের অংশ হতে হবে; সাহিত্যকে সমগ্র শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিকভাবে সচেতন সমগ্র অগ্রগামী বাহিনীর দ্বারা চালু একটি একক মহান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক প্রক্রিয়ার ক্রু ও খাঁজ হতে হবে।
সাহিত্যকে অবশ্যই সংগঠিত, পরিকল্পিত ও সুসংহত সোশ্যাল- ডেমোক্র্যাটিক পার্টির কাজের অন্যতম অংশ হতে হবে। ‘যদিও মার্কস শিল্প সাহিত্যের ক্ষেত্রে সর্বপ্রকার বিধি নিষেধের দ্ব্যর্থহীন বিরোধিতা করে গিয়েছিলেন। কিন্তু লেনিন প্রত্যক্ষ লড়াইয়ের ময়দানে দাঁড়িয়ে শিল্প-সাহিত্যকে শত্রুর বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন শিল্প-সাহিত্যের যখন বিরাট ভূমিকা রয়েছে, শত্রুর বিরুদ্ধে তাকে ব্যবহার করতেই হবে। সে নির্দেশ ছিলো শুধু পার্টির লেখক- শিল্পীদের বেলায়। পার্টির অন্তর্ভুক্ত শিল্পী-সাহিত্যিকরা পার্টির সিদ্ধান্ত মতো শ্রমিকদের স্বার্থেই শিল্প-সাহিত্য রচনা করবে।
কিন্তু যারা পার্টির বাইরের লেখক শিল্পী, তাদের সম্পর্কে লেনিনের বক্তব্য ছিলো-সকলের স্বাধীনতা থাকবে যা খুশি লেখার এবং বলার, পাশাপাশি পার্টির অধিকার থাকবে কঠোর সমালোচনার। তবে বাধা প্রদান নয়। শিল্প-সাহিত্যকে শ্রমিকশ্রেণীর আদর্শের অংশ হতে হবে, বৈপ্লবিক যন্ত্রের নাটবল্টু হতে হবে- লেনিনের এই ‘নাটবল্টু’ কথাটার তাই একটি বিশেষ অর্থ ছিলো যা তাঁর পুরো প্রবন্ধ পড়লেই বোঝা যায়। প্রোলেটকুল্টরা লেনিনের মূল প্রবন্ধ অগ্রাহ্য করে ‘নাটবল্টু’ শব্দটা নিয়ে মেতে উঠলেন। প্রোলেন্টকুল্টবাদীরা অতীতের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করার প্রসঙ্গে কেবলমাত্র বুর্জোয়া বাস্তববাদ বা রূপকধর্মী শিল্প সৃষ্টিই নয়, তারা বুর্জোয়া অভিনেতাদেরও বাতিল করার প্রস্তাব দেয়।
কেরঝেন্সেভ উনিশশো উনিশ সালে ‘সৃষ্টিশীল থিয়েটার’ পত্রিকায় মন্তব্য করেন, বুর্জোয়া প্রতিভাধর অভিনেতাদের সাহায্যে সমাজতান্ত্রিক থিয়েটার গঠনের কোনো প্রচেষ্টা, বুর্জোয়া সাংবাদিকদের সাহায্যে সমাজতান্ত্রিক পত্রিকা প্রকাশের মতোই হাস্যকর।পূর্বের সবকিছুই বর্জন করার ঝোঁক, নতুন সব উদ্ভট চিন্তার প্রতি সমর্থন, প্রলেতারীয় সংস্কৃতি সৃষ্টির এক উন্মাদনা শুরু হলো প্রলেটকুন্টদের মধ্যে। এঁরা বুর্জোয়া শিল্প-সাহিত্যের বিরোধিতা করতে গিয়ে শিল্প-সাহিত্যের শেকড় থেকে সরে গিয়ে বিকৃত এক শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি করলো।
থিয়েটারে মায়ারহোল্ড ‘বায়োমেকানিকস’ তত্ত্ব খাড়া করলেন যেখানে অভিনেতার দেহ সঞ্চালন ও মঞ্চসজ্জা প্রাধান্য পেল। থিয়েটারের দৃশ্যপট বলতে সেখানে থাকবে যন্ত্রপাতি, মেশিন, মোটর, কামান; মায়ারহোল্ড-এর মতে যা নাটককে গতিময় করবে। রুক্ষ সার্কাস ভঙ্গির থিয়েটার তারা গ্রহণ করলো। যেখানে বিষয়বস্তুর চেয়ে প্রাধান্য পেল আঙ্গিক। মায়ারহোল্ডের বায়োমেকানিক্স পদ্ধতিতে অভিনেতা নিজেকে কোনো যন্ত্রের স্ক্রু বা কজা হিসাবে গণ্য করবে।বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার প্রথম দশকে এইসব বেপরোয়া পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকে। চিন্তা, মানুষের আবেগ ও ব্যক্তিসত্তার যেখানে কোনো মূল্য নেই।
বিপ্লবের পূর্বে স্তানিস্লাভস্কি ছিলেন রুশ নাট্য জগতের সবচেয়ে সম্মানিত নাট্য পরিচালক, যিনি ছিলেন মানবতাবাদী এবং কোনো ধরনের রাজনীতির সাথে যাঁর কোনো সম্পর্ক ছিলো না। ধ্রুপদী নাটক মঞ্চায়নে ছিলো তাঁর আগ্রহ। মায়ারহোল্ড ছিলেন তাঁর ছাত্র। বিপ্লবের পর সেই মায়ারহোল্ডই স্তানিস্লাভস্কির থিয়েটারের বিরুদ্ধে কঠোর আক্রমণ চালান এবং নিজের বায়োমেকানিক্স পদ্ধতিকেই সঠিক বলে প্রচার করতে থাকেন।
মায়ারহোল্ডের একটি প্রযোজনা ‘পৃথিবী উঠে দাঁড়াচ্ছে’। নাটকটা শুরু হয় থিয়েটারের লবি থেকে। সেখানে দর্শকদের সামরিক কুচকাওয়াজ করানো হচ্ছে। চারজন করে সার বেঁধে কদম মিলিয়ে লবিটা প্রদক্ষিণ করতে থাকে। তারপর বিউগল-এ সংকেত ধ্বনি হলে দর্শকবৃন্দ মার্চ করে যার যার আসনে গিয়ে বসে। মঞ্চে পর্দা নেই, দেখা যাচ্ছে তিনটি বড় প্লাটফরম, কয়েকটি কামান এবং দুটি এরোপ্লেন। আবার বিউগল বাজতে আধ ডজন মোটর গাড়ি ভীমরবে প্রেক্ষাগৃহের মধ্য দিয়ে ছুটে গিয়ে সেতু বেয়ে মঞ্চে উঠলো। তাদের পেছনে সাইকেল বাহিনীর আরোহীরা সামরিক উর্দিপরা ও সশস্ত্র। মঞ্চে শুরু হলো প্রথম মহাযুদ্ধের দৃশ্য। সংলাপ সামান্য ও তীক্ষ্ণ, বেশির ভাগই কণ্ঠনিঃসৃত নানা গর্জন, আর্তনাদ ও গোঙানি। রুশ জেনারেলকে মঞ্চে আনা হলো রক্তে চুবিয়ে, শ্রমিকদের রক্তে তিনি আক্ষরিক অর্থে লাল।

জার্মান অফিসাররা ঢুকলেন হিংস্র কুকুরের ডাক ডাকতে ডাকতে। যুদ্ধ শুরু হলো-গুলি চলছে, কামান গর্জাচ্ছে, মেশিনগান মঞ্চে এনে গুলিবর্ষণ করা হচ্ছে। বিমান উড়ছে, আর প্রেক্ষাগৃহ দিয়ে অনবরত যাতায়াত করছে মোটর গাড়ি আর সাইকেল। মুহূর্তে কি এক কাণ্ড ঘটতে শুরু করে-গুলিবর্ষণ বন্ধ, সৈন্যরা জড়ো হয় প্লাটফরমের চারদিকে। সৈন্যরা বক্তৃতা শুরু করলো লাল ঝাণ্ডা তুলে দিয়ে। কেরেনেস্কি মঞ্চে এলো গড়াতে গড়াতে। সৈন্যরা তাকে উপহাস করতে শুরু করলো ডিগবাজি খেয়ে। তারপর মোটর-কামান- এরোপ্লেন দিয়ে ব্যারিকেড গড়ে মঞ্চে অক্টোবর বিপ্লবের এক সশব্দ আশ্চর্য চিত্ররূপ সৃষ্টি করে নাটক শেষ।
মায়ারহোল্ডের বায়োমেকানিক্স পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের চেয়ে বর্ণনা প্রাধান্য পায় এবং যা হয়ে দাঁড়ায় ভীষণ ব্যয়বহুল। প্রোলেটকুল্টরা এ সময় কিউবিস্ট ও অ্যাবস্ট্রাকট ভঙ্গিকেও প্রাধান্য দিতে শুরু করে, যা বুর্জোয়া সমাজের অবক্ষয় থেকেই উদ্ভূত। শিল্প-সাহিত্য নিয়ে দীর্ঘ ও তিক্ত বিতর্কের ঝড় ওঠে এ সময়। পার্টি ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে সম্পর্ক কী হবে, শ্রমিকশ্রেণীর সংস্কৃতি কাকে বলে, বুর্জোয়া সংস্কৃতির প্রভাব কতোটা থাকে, কী করে দু ধারার সংঘর্ষকে এক ধারায় মেলানো যায়-এ রকম বহু জটিল প্রশ্নের আলোচনায় তীব্র মতবিরোধ দেখা দেয়।
একদল নাট্যকার ও নাট্য পরিচালক জোর দিয়ে বলেন যে, বিপ্লবের পুনর্গঠনকালে ব্যক্তিকে নিয়ে থিয়েটারের মাথা ঘামাবার প্রয়োজন নেই, তার একমাত্র ভাবনার বিষয় জনতার সমষ্টিগত জীবন। অন্য গোষ্ঠীর মত হলো যে, সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তব অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লব মানুষের আত্মাকে পরিবর্তন করছে। সুতরাং নাট্য ও সাহিত্যে ব্যক্তিজীবন অবশ্য আসা দরকার। তবু বুখারিনের নেতৃত্বে ঘোষণা দেয়া হলো, ব্যক্তিত্বের দিন শেষ হয়ে গেছে, চাই সমাজবদ্ধ মানুষ। বুখারিনের ঘোষণায় মনে হতে থাকে, লক্ষলক্ষ শ্রমিক যেন অবয়বহীন নাট-বল্টু মাত্র। যেন ব্যক্তিসত্তাই এক পাপ, যেন ব্যক্তিত্বই হচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল।
কিন্তু এই চিন্তার মধ্যে যে মারাত্মক ত্রুটি ছিলো, সে কথাও উল্লেখ করেন অনেকেই। কলম ধরেন বহু বিদগ্ধজন। মার্কসবাদের গোড়ার কথা ছিলো, শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্বে বুর্জোয়া ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অবসান ঘটাতে হবে, কারণ বুর্জোয়া ব্যবস্থায় ‘ব্যক্তি বলতে বুর্জোয়ারা ছাড়া, শুধু মধ্য-শ্রেণীভুক্ত সম্পত্তির মালিক ছাড়া’ অন্য লোক বোঝায় না।ব্যক্তি সম্পত্তির উচ্ছেদের মধ্য দিয়েই সেই ব্যক্তিত্বকে উচ্ছেদ করা হয় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। নতুন সমাজবদ্ধ সমাজে তাই শ্রমিকের ও অন্যান্য মেহনতী মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটাতে হবে। মার্কস-এঙ্গেলস লিখেছেন, শ্রেণী-বিরোধ সম্বলিত পুরানো বুর্জোয়া সমাজের স্থান নেবে এমন এক গোষ্ঠী, যার মধ্যে প্রত্যেকটা লোকেরই স্বাধীন বিকাশ ঘটবে সকলের স্বাধীন বিকাশের শর্তে।
বুখারিন-মায়ারহোল্ডরা রাজনৈতিক চিন্তার অস্পষ্টতার জন্য কী করেছেন? মানুষের চিন্তা-মানস-ব্যক্তিত্ব-আবেগ সব অস্বীকার করেছেন। বুখারিন তাই লিখছেন, ‘বলশেভিক বিপ্লব যে গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষকে সৃষ্টি করেছে তার আত্মায় আমরা বিশ্বাস করি না’।১ সমষ্টিবদ্ধ জীবনে ব্যক্তিত্বের কোনো স্থান নেই, এই বলে বুখারিনরা শ্রমিকদের বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দিলেন। বলশেভিক বিপ্লবের পর সংস্কৃতিবিদদের কাজ ছিলো শ্রমিকদের সাধারণ মানকে উর্দ্ধে তোলা। ঘটলো তার উল্টো। প্রোলেটকুল্টরা বিষম আত্মঘাতী পথে পা দিলো। যাঁদের বিপ্লবের সাথে পূর্বে কোনো সম্পর্ক ছিলো না, বা যাঁরা ছিলো বিপ্লব বিরোধী এঁরাই এ সময় বেশি বিপ্লবী হয়ে ওঠেন। বোগদানভ ছিলেন এদের অন্যতম। বোগদানভ মার্কসবাদী চিন্তার ক্ষেত্রে এক সময় কমরেড লেনিনের প্রতিপক্ষ ছিলেন। বিপ্লবের পর তিনিই ঘোষণা করেন, অতীতকে সম্পূর্ণ বাতিল করে বিজয়ী সর্বহারাশ্রেণীর নতুন সোভিয়েত সংস্কৃতি সৃষ্টি করবেন।
শিল্প-সাহিত্য সম্পর্ক লেনিনের চিন্তা, মোটেই প্রোলেটকুল্টদের মতো ছিলো না। লেনিন লিখেছিলেন, ‘সরকারের যাকে বাধা দেবার শক্তি নেই, তাকে “নিষিদ্ধ” করার জন্য মূর্খের মতো প্রচেষ্টা সরকারের নিজের কলঙ্ক ডেকে আনা ছাড়া এবং সরকারের উপর আরও নৈতিক আঘাত হানা ছাড়া আর কিছুই আনতে পারে না।” তিনি আরো লিখছেন, ‘সামন্ততান্ত্রিক সেন্সর ব্যবস্থার বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়ে বুর্জোয়া দোকানদারির সাহিত্যগত সম্পর্কে বন্দী হবার বাসনা আমাদের নেই, তা হবও না’।” তা সত্ত্বেও বোগদানভ-মায়ারহোল্ডদের প্রভাবে লেভ তলস্তয়, আলেকজাণ্ডার পুশকিন, নিকোলাই গোগল ও দস্তয়ভস্কিকে বাতিল করার উদ্যোগ নেয়া হলো।
ধ্রুপদী নাটককে তারা শ্রমিকশ্রেণীর নাটক না ভেবে প্রতিক্রিয়াশীল আখ্যা দিলেন এবং সব ধরনের ধ্রুপদী নাটকের বিরুদ্ধে নিজেদের বক্তব্য জোরালো করে তুললেন। প্রোলেটকুল্টদের চিন্তা সম্পর্কে লেনিনের বিরোধিতা এবং পার্টির পত্রপত্রিকায় তীব্র আক্রমণাত্মক সমালোচনা সত্ত্বেও সে সময়ে পার্টির মধ্যে মায়ারহোল্ড ও তাঁর সমর্থকদের অবস্থিতি খুবই শক্তিশালী ছিলো।
প্রোলেটকুল্টরা সর্বদা নিজেদের অতিবিপ্লবী হিসেবে এবং সোভিয়েত সমাজের মানসিকতার যথার্থ শিল্পসম্মত প্রতিনিধি বলে ঘোষণা দেয়। প্রোলেটকুল্টদের শিল্প- সংস্কৃতি চিন্তার মধ্যে অতীতের সবকিছুকে বর্জন করার ঝোঁক তীব্র ছিলো। নাট্যচিন্তায় প্রোলেটকুল্টদের সমর্থক বোগদানভের চোখে স্তানিস্লাভস্কিসহ সবাই প্রতিক্রিয়াশীল, সনাতনপন্থী। এ সব অতি বিপ্লবীরা শেক্সপিয়ার, ইবসেন, হাউপ্টমান, গ্যাটে, শিলার সবাইকে বাতিলের খাতায় ফেললেন। গ্যাটে, শিলার আর শেক্সপিয়ার তিনজনেই • ছিলেন মার্কস-এর প্রিয় নাট্যকার। যদিও এই তিনজন নাট্যকারের নাটকের কোথাও শ্রমিক-কৃষকের বিপ্লবের কথা উল্লেখ নেই।
পল লাফার্গে তাঁর ‘মার্কস-স্মৃতি’তে জানিয়েছেন যে, মার্কস হাইনে ও গ্যাটেকে মন-প্রাণ দিয়ে আস্বাদ করেছিলেন, মূল গ্রীক-ভাষায় ইস্কাইলাস পাঠ ছিলো তাঁর সাংবাৎসরিক কৃত্য আর শেক্সপিয়ারের প্রতি তাঁর অকপট সুগভীর শ্রদ্ধাবোধ তিনি সঞ্চারিত করেছিলেন তাঁর সমগ্র পরিবারে। রুশ লেখক পুশকিন, গোগোল, তুর্গেনেভ, লেরমানতোভ তাঁর মনে দাগ কেটেছিলেন।” কিন্তু প্রোলেটকুল্টরা সকল ধ্রুপদী সাহিত্য ও শিল্পকলার বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হলেন। শিল্পকলা কিংবা নাটক থেকে সকল প্রকার মানবিক ভাবনা-চিন্তা বা ধ্যান-ধারণাকে বিসর্জন দেয়ার চেষ্টা চলতে থাকলো।
রাশিয়াতে আসলে বিপ্লবের পূর্বে এবং পরবর্তী সময় এতো ধরনের রাজনৈতিক বিভক্তি ছিলো, বিভিন্ন ধরনের ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে জনগণ ছিলো বিভ্রান্ত, তাদের পক্ষে আসলে বোঝা সম্ভব ছিলো না কে যে তাদের শত্রু আর কে তাদের প্রকৃত বন্ধু। বিপ্লবী পার্টির মধ্যেই তীব্র মতপার্থক্য ছিলো, সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও সে মতপার্থক্য তৈরি হয়। বিপ্লবী আবেগের আতিশয্য স্তিমিত হবার পরই বিপ্লবী সংস্কৃতি গড়ে তোলার চেষ্টা নেয়া হলো।
শিল্প-সাহিত্যের জগৎটাকে যে শ্রমিকশ্রেণীর নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে সেটা অনেকেই বুঝেছিলেন। কীভাবে আনবেন সেটাই বুঝতে পারছিলেন না। শিল্প-সাহিত্য প্রসঙ্গে মার্কস-এঙ্গেলসের কোনো লেখা ছিলো না। মার্কস-এঙ্গেলস এ ব্যাপারে তেমন কোনো নির্দেশই দিয়ে যেতে পারেননি। সেজন্য বিপ্লব পরবর্তী শিল্প-সাহিত্য বা প্রলেতারীয় শিল্প-সাহিত্য কী হবে সে সম্পর্কে প্রায় কারোরই কোনো ধারণা ছিলো না। শিল্প-সাহিত্য প্রশ্নে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা সত্যিই নতুন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়ালো।
সামন্ততন্ত্র থেকে বুর্জোয়া বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার পর বুর্জোয়ারা এ ধরনের কোনো সমস্যায় পড়েনি। বুর্জোয়াদের নিজস্ব এবং খুবই উচ্চমান সম্পন্ন শিল্প-সাহিত্য ছিলো। বুর্জোয়া বিপ্লবের আগেই তারা নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতির জন্ম দেয়, বিপ্লবের পর তারা নিজস্ব শিল্প সাহিত্য নিয়ে আবির্ভূত হয়। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হবার পর শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে শ্রমিকশ্রেণী ছিলো রিক্ত ও নিঃস্ব, সেজন্যই যতো সমস্যার উদ্ভব। শ্রমিকশ্রেণীর চাহিদা মেটাবার জন্য শিল্পের চরিত্র, শিল্পের কর্মধারা কী হবে সে নিয়ে অনেকেই বিভ্রান্তিতে পড়েন। শ্রমিকশ্রেণীর জন্য শিল্প সাহিত্য সৃষ্টি করতে গিয়েই তাই দেখা দেয় যতো বিপত্তি।
শ্রমিকশ্রেণীর শিল্প-সাহিত্য কীভাবে তৈরি করা যাবে বুঝতে না পেরে নানা জন নানা পথ ধরে আগাতে থাকে। কেউ কেউ অতিবিপ্লবী প্রথ অবলম্বন করে যার সাথে সত্যিকারভাবে শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবের কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া না। প্রোলেটকুল্টদের পক্ষ থেকে শিল্প-সংস্কৃতিকে সামরিক কায়দায় সুসংবদ্ধ করতে এক পরিকল্পনা করা হলো, যার পেছনে কোনো অভিজ্ঞতা, কোনো তত্ত্ব বা পূর্বের শেকড় ছিলো না।
লেনিন বুঝতে পেরেছিলেন, প্রোলেতারীয় সংস্কৃতিকে কেউ শূন্য থেকে খামচে বার করতে পারবে না, যারা নিজেদের প্রোলেতারীয় সংস্কৃতির বিশেষজ্ঞ বলছে তারা নিজেদের মস্তিষ্ক থেকে অকস্মাৎ সে-সংস্কৃতি আবিষ্কার করতে পারবে না। প্রোলেটকুল্টরা যেভাবে নতুন থিয়েটারের নামে পুরাতন থিয়েটারকে আক্রমণ করা শুরু করলো, সর্বহারা শ্রেণীর সংস্কৃতি বলতে ভাবতে শুরু করলো গাদাগাদা প্রচার এবং শ্লোগান-সে সময় প্রকৃত বিপ্লবীদের অনেকেই এদের সামাল দিতে এগিয়ে আসেন। লুনাচারস্কি প্রথম ছিলেন প্রোলেটকুল্টদের পূর্ণ সমর্থক, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে ভেবেছিলেন নতুন কিছু সৃষ্টির সম্ভাবনা। তিনিও শীঘ্রই নিজের ভুল বুঝতে পারলেন।
দেখলেন প্রোলেটকুন্টরা সস্তায় বাজিমাত করা ছাড়া আর কিছুই চায় না। স্বয়ং লেনিনের কাছে যখন এদের কাজগুলো কৃত্রিম মনে হয়েছিলো লুনাচারস্কিও মত পাল্টালেন। তিনি তাই লিখছেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমি ছিলাম প্রলেতকুল্পের ঘনিষ্ঠ, কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীলদের ঘাঁটি নিশ্চিহ্ন করার ব্যাপারে তাদের জেদাজেদিতে আমি খানিকটা বিব্রতবোধ করি’।
পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ভরভস্কি তার প্রতিবেদনে লিখলেন, যা চলছে তা শ্রমিক সাহিত্য নয়, বুর্জোয়া বিমূর্ত শিল্পের উপাসনা। লেনিন নিজেও মুখ খুলতে বাধ্য হলেন। প্রলেতারীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে তিনি লিখলেন, মার্কসবাদের একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব এই যে, বুর্জোয়া যুগের মূল্যবান সাফল্যগুলিকে বাতিল করে দেবার পরিবর্তে দুই হাজার বছরের উপর থেকে মানুষের চিন্তা ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে যা কিছু মূল্যবান মার্কসবাদ তাকেই ঢেলে সাজিয়েছে, গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। দুই হাজার বছরের মূল্যবান ঐতিহ্যকে ঢেলে সাজাবার মধ্য দিয়েই প্রলেতারীয় সংস্কৃতির ভীত রচিত হবে, সেজন্য নতুন একটা প্রলেতারীয় সংস্কৃতি উদ্ভাবনের কোনো দরকার নেই।
মার্কসবাদের ভিত্তিতে এবং প্রলেতারীয় একনায়কত্বের সংগ্রামের দৃষ্টিকোণ থেকে শুধু সেগুলোর বিকাশ ঘটাতে হবে। নাদেঝদা ক্রুপস্কায়া শিল্পের ক্ষেত্রে প্রোলেটকুল্টদের আধুনিকতা ও বিকৃতির বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনামূলক পত্র মারফত এক প্রশ্ন উত্থাপন করেন যে, মায়ারহোল্ড প্রমুখের এই কিউবিস্ট ও অ্যাবস্ট্রাকট ভঙ্গি আদৌ প্রোলেতারীয় কি না। পার্টিই শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত দেয় যে প্রোলেটকুল্টদের মতামত মূলত বুর্জোয়াপন্থী।
সার্কাস ভঙ্গির থিয়েটার বা অন্যান্য ভঙ্গিগুলোর কোনোটাই সর্বহারার থিয়েটার হতে পারে না। সর্বহারার থিয়েটারের কাজ হবে জনগণকে শিক্ষিত করে তোলা, শিল্পের সেই শিক্ষা মোটেই শ্লোগানধর্মী হবে না। মানুষের ব্যক্তিত্বকেই তা গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। নতুন থিয়েটার মানুষকে গড়ে তুলবার কাজে দিক নির্দশনা দেবে। শিক্ষা-সম্মেলনে লেনিন বললেন, শিল্প-সাহিত্য এবং পার্টির পুরো প্রচারকার্য এমনভাবে করতে হবে যেন শ্রমিক কৃষকরা তা বুঝতে পারে। মায়ারহোল্ডের দুর্বোধ্য থিয়েটার তা পারছিলো না। দেখা গেলো দর্শকরা খুব শীঘ্রই এইসব সার্কাস ভঙ্গির থিয়েটারে যাওয়া বন্ধ করে দেয়।
শ্রমিকরা প্রোলেটকুল্টদের দুর্বোধ্য মহাবিপ্লবী নাটকগুলিকে বর্জন করলো আর কাতারে কাতারে এসে লাইন দিলো স্তানিস্লাভস্কির আর্ট থিয়েটারের দোরগোড়ায়। শ্রমিক-কৃষক দর্শকের ভীড়ে পূর্ণ হলো ‘মস্কো আর্ট থিয়েটার’। প্রেক্ষাগৃহে স্থান সংকুলান হয় না বলে মাঝে মাঝে বিশাল সোলোদোভনিকভ থিয়েটারে আর্ট থিয়েটারের অভিনয়ের ব্যবস্থা হলো। শ্রমিকদের সঙ্গে আর্ট থিয়েটারের সংযোগ ঘটিয়ে দিয়ে সোভিয়েত সরকার ও কমিউনিস্ট পার্টি স্তানিস্লাভস্কিকে নিজের পথ ধরে বিপ্লবী চেতনার দিকে এগুতে দিলেন।
প্রোলেটকুল্টরা যে বিপ্লবের সুবিধা নেবার জন্যই বেশি বেশি বিপ্লবী সাজছিলো লুনাচারস্কিও অবশেষে তা বুঝতে পারলেন।
বিরক্ত হয়েই তাই তিনি একবার লেনিনকে বলেছিলেন, ‘দেখতে হবে যাতে যারা এখন প্রচুর সংখ্যায় আমাদের জাহাজে উঠে পড়ার চেষ্টা করছে সেই ছিটগ্রস্ত ও হাতুড়েরা ক্ষতিকর একটা ভূমিকা না নিয়ে বসে। লেনিন নিজে সমস্তরকম ব্যস্ততার মধ্যেও ছিটগ্রস্ত ও হাতুড়েদের ব্যাপারে ছিলেন সচেতন। তিনি এটাও উপলদ্ধি করেন, বিজয়ী শ্রেণী অর্থাৎ বিপ্লবীদের নিজস্ব বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। দৃঢ় চিত্তের লোকের অভাব খুব অনুভব করেন লেনিন এবং সেজন্য ভয় পান বিপ্লবীরাই আবার প্রোলেটকুল্টদের উন্মাদনার শিকার না হয়ে পড়ে। তিনি তাই ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘সাবেকী শিল্পের ন্যূনধিক ভালো জিনিসগুলো সবই রক্ষা করতে হবে। কারণ হিসাবে দেখিয়েছেন, প্রত্যেক জাতির সংস্কৃতির মধ্যেই গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির বীজ নিহিত আছে, কারণ প্রত্যেক জাতির মধ্যেই শোষিত ও অত্যাচারিত মানুষ রয়েছে।
স্তালিনও পরবর্তীকালে একই কথা বলেছিলেন, সর্বহারার সংস্কৃতি জাতীয় সংস্কৃতিকে বাতিল করে না বরং তাকে পূর্ণতা দেয়। স্তালিন বলেছেন, মানুষের যা মহৎ সৃষ্টি যা নিজ যুগকে প্রতিফলিত করে তা সর্বকালের হয়, তা উৎপাদন সম্পর্ককে অতিক্রম করে। সেইসব শিল্প জনতার হৃদয়ে স্থান করে নেয়। মহৎ শিল্পীরা সবাই মার্কসবাদী কি না সেটা বিচার্য নয়, বিচার্য নিজ কালের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা কী দিয়ে গেলেন। লাল বই পড়ে সবাই শিল্পী হবে না। সমাজের ভিৎ পাল্টালেই হোমার, শেক্সপিয়ার, গ্যাটে পরিত্যক্ত হন না, বরং আরো ব্যাপক অর্থে সত্য হয়ে ওঠেন। কারণ আগে যেখানে তাঁরা তিন কি চার জনের দখলে ছিলেন এখন শতকরা নিরানব্বই জনের নাগালের মধ্যে তাঁদের এনে ফেলা হবে।
জগতের যা কিছু সুন্দর তা আগের সমাজে ভোগ করতো শুধু শোষক। সমাজতন্ত্রে তা হবে সকলের, শ্রমিকশ্রেণীও হবে তার উত্তরাধিকারী। আগেকার সমাজে শ্রমিক-কৃষকদের নিরক্ষর করে রাখা হয়েছিলো, সান্ধ্য ভদকার সংগে পায়ের ওপর পা তুলে তলস্তয় পড়ার অবসর, সুযোগ ও সম্ভাবনা শ্রমিক-কৃষকের ছিলো না। জনতাকে দেয়া হয়নি তার দেশের শ্রেষ্ঠ কাব্যে অধিকার। ফিউদাল ও বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় শ্রমিক থাকে শোষণে এমন পিষ্ট যে সংস্কৃতির নাগাল সে কখনও পায় না। ৩০ শ্রমশক্তি বেচে যাকে খেতে হয়েছে, সে পায়নি অবসর, পায়নি শিক্ষা, পায়নি তার দেশের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পড়ার সুযোগ। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে রাশিয়ার শ্রমিকদের জন্য সে সুযোগ এসে গেল।
বিশ শতকের রাজনৈতিক নাট্যধারায় মার্কসীয় প্রভাব [ পর্ব ২ ]
বিপ্লবের পূর্বে রুশ সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ করতো জার ও বুর্জোয়ারা, সেই শ্রেণীর ভাবাদর্শই প্রতিফলিত হতো। বিপ্লবের পর রাতারাতি সেই চিন্তার পরিবর্তন ঘটা সম্ভব ছিলো না। যাঁরা এক রাতের মধ্যেই সংস্কৃতির এই অবস্থাকে পাল্টাতে চেয়েছিলেন তাঁরা ছিলেন উগ্র মতবাদের ধারক, বাস্তবচিন্তা বর্জিত। যাঁরা ভেবেছিলেন বুঝিবা যেন এক পিস্তল থেকে এক মুহূর্তেই প্রলেতারীয় সংস্কৃতি ফুটিয়ে তোলা যায়। লেনিন মনে করতেন, কোনো সংস্কৃতি হঠাৎ করে গজিয়ে উঠতে পারে না, সবকিছুর থাকে একটা ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা। ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে সমাজতন্ত্রের শিকড় গড়ে উঠেছে দুনিয়া জুড়ে তারই মধ্য দিয়ে গড়ে উঠবে মার্কসীয় শিল্প ভাবনার সূত্রগুলি, মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের চেতনা।
মার্কসীয় শিল্প সম্পর্কে লেনিন বলেছিলেন, এটা ভুঁইফোড় নয়, কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মস্তিষ্কপ্রসূত উদ্ভাবনও নয়। মানব জাতির বিকাশের ধারা বেয়ে যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, মানব সমাজ যে জ্ঞানভাণ্ডার সঞ্চিত করেছে, প্রলেতারীয় সংস্কৃতি হবে তারই স্বাভাবিক বিকাশের পরিণতি, তাকেই আমাদের পুনরায় প্রয়োগ করতে শিখতে হবে। যারা বুর্জোয়া সভ্যতার সমস্ত সাহিত্য সম্ভারগুলিকে উৎপাটিত করতে চেয়েছিলেন নতুন সৃষ্টির তাগিদে, লেনিন তাদেরকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন এই বলে যে, কোনরকম কূপমণ্ডুকতা সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির ভিত্তি হতে পারে না। প্রলেতারীয় সংস্কৃতি গড়ে উঠবে মার্কসীয় চিন্তায়, কোনো গোঁড়ামি বা পেটিবুর্জোয়া সুলভ একগুঁয়েমি দিয়ে নয়। সর্বহারার সংগ্রাম হবে এর নৈতিকতার উৎস।
সংস্কৃতির সংগ্রাম ও রাজনৈতিক সংগ্রাম বিচ্ছিন্ন নয়। দুই সংগ্রামের লক্ষ্য সমাজটাকে পাল্টানো, যে সমাজ সৃষ্টি করবে নতুন মানুষ, নতুন মানবিকতা।থিয়েটার সাহিত্য সঙ্গীতকে অবশ্যই চাপ দিতে হবে বিপ্লবের নতুন চাহিদা মেটানোর জন্য কিন্তু তা মূলভাবে নয়। লেনিন বিশ্বাস করতেন, বুর্জোয়া জ্ঞান ভাণ্ডার ও. তার প্রযুক্তি থেকে তেমন সবকিছুই নিষ্কাশন করে নিতে হবে, যা বুর্জোয়ার উচ্ছেদের এবং বিপ্লবীদের নিজস্ব জগৎ সৃষ্টির ব্যাপারে কাজ দেবে। মূলত সোভিয়েতের বিপ্লবী সরকার গৃহযুদ্ধ, বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও রাষ্ট্রীয়শক্তি সংহত করার কাজে অগ্রাধিকার দিতে বাধ্য হন। বিপ্লবের পরপর সত্যিকার মার্কসবাদী শিল্প-সাহিত্য বা নাটক কী হবে সে সম্পর্কে চূড়ান্ত ও সামগ্রিক মতামত রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে সেটার দিকে বিশেষ নজর দেয়ার মতো পরিবেশও পাওয়া যায়নি।
সর্বহারার সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয় ক্ষমতা দখলের কাজে, সেই ক্ষমতাকে সংগঠিত করতে। সেখানে শিল্প-সাহিত্য নিয়ে সঠিক চিন্তা করবার উপায়ও ছিলো না। ট্রটস্কি লিখেছিলেন, সর্বহারার একনায়কত্ব কেবলমাত্র ধ্বংসাত্মক কাজের চাপে মানুষের মূল কতগুলি চাহিদা-চাল, ডাল, নুন, তেল, লাকড়ির সমস্যা নিয়েই জর্জরিত, সেখানে সংস্কৃতির চিন্তায় নতুন বিষয়বস্তুর আবির্ভাব অসম্ভব। ট্রটস্কি আরো লিখলেন, বিপ্লব নতুন সমাজের ভিত্তিপ্রস্তর। তবে সেটা করা হয় পুরানো সমাজের পরিবর্তন প্রক্রিয়ার দ্বারা, শ্রেণীসংঘর্ষ, হিংসা, ভাঙন আর ধ্বংসের দ্বারা। প্রলেতারীয় বিপ্লব যদি না ঘটতো, মানব জাতি নিজের দ্বন্দ্বে নিজেই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা পড়তো। বিপ্লব সমাজ ও সংস্কৃতিকে এই আত্মহত্যার হাত থেকে বাঁচালো ঠিকই কিন্তু নিষ্ঠুর ব্যবচ্ছেদের সাহায্যে। সর্বহারার একনায়কত্ব আসলে নতুন সমাজব্যবস্থার সংস্কৃতি-চিন্তার সংগঠন নয়, ঐ সংস্কৃতি পাবার এক বিপ্লবী ও সামরিক শাসন।
ট্রটস্কির মতে বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে প্রলেতারীয় সংস্কৃতি গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। তিনি বলছেন, যেহেতু বিপ্লবটা শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লব, সেহেতু বিপ্লব ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে নজর দেবার মতো কর্মোদ্যম সর্বহারার কমই অবশিষ্ট থাকে। তিনি ইতিহাস থেকে উদাহরণ টেনে দেখালেন যে ফরাসী বিপ্লবের সময় যে সমস্ত মহান শিল্প সৃষ্টিতে এই বিপ্লবের চেহারা প্রতিফলিত হয়েছিলো তা সৃষ্টি হয়েছিলো ফরাসী শিল্পীদের দ্বারা নয়, তা করেছিলো জার্মান, ইংরেজ ও অন্যান্যরা। ফরাসী বিপ্লবে বুর্জোয়ারা প্রত্যক্ষভাবে এর নেতৃত্বে থাকার জন্য অন্য কোনো ক্ষেত্রে সেই বিপ্লবের চেহারার ছাপ রেখে যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ বা উদ্যম কোনোটাই দেখাতে সক্ষম হয়নি, সর্বহারার ক্ষেত্রে এ কথা আরো বেশি প্রযোজ্য।
কারণ সর্বহারারা সংস্কৃতির ব্যাপারে পূর্ব থেকেই অনেক বেশি রিক্ততায় ভুগতে থাকে। ট্রটস্কির বিপরীতে লেনিন মনে করতেন, সর্বহারার একনায়কত্বের সময়কাল অন্যপক্ষে আবার সাংস্কৃতিক বিপ্লবেরও কাল। রাশিয়ার ব্যাপারে অবশ্য লেনিনের চেয়ে ট্রটস্কির চিন্তাই অনেক বেশি সত্য হয়েছিলো। ট্রটস্কি যেমন বলেছিলেন পার্টির পক্ষে রাজনীতির বাইরে সময় দেয়া সম্ভব নয়, রাশিয়াতে তাই ঘটেছিলো। লেনিন নতুন সংস্কৃতির প্রেক্ষাপট তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন সত্যি তবে তার ওপর নজরদারি করার সময় তাঁর ছিলো না। ট্রটস্কির আর একটি কথাও সত্য প্রমাণিত হয়, ফরাসী বিপ্লবের মতোই রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর শিল্প- সংস্কৃতি সম্পর্কে সেখানে সমাজতান্ত্রিক ধারা গড়ে না উঠলেও, সেই ধারা গড়ে উঠেছিলো জার্মানীতে, পিসকাটর ও ব্রেশটের মাধ্যমে। সে প্রসঙ্গেই আমরা এখন আসবো।
মহাযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো জার্মানী। যুদ্ধে জার্মানরা পরাজিত হয়। ফলে যুদ্ধের নানা দায়-দায়িত্ব জার্মানীকে বহন করতে হয়, বিশেষ করে ক্ষতিপূরণ সমস্যা। ক্ষতিপূরণ সমস্যা কীভাবে জার্মানীর গলায় ফাঁসের মতো আটকে গিয়েছিলো সেটা বোঝা যায় সেখানকার অর্থনীতির দিকে তাকালে। যুদ্ধের পরপরই জার্মানীর জনজীবনে নেমে এসেছিলো তীব্র সংকট। ক্ষতিপূরণ সব সময়ই বিজয়ী রাষ্ট্র পরাজিত রাষ্ট্রের ওপর আরোপ করে থাকে।
তবে জার্মানীর ওপর কী পরিমাণ ক্ষতিপূরণ আরোপ করা হবে সে নিয়ে নানারকম মতভেদ দেখা দিয়েছিলো। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় উনিশশো একুশ সালের মে মাসে জার্মানীর জন্য মোট দেয় ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয় ছয়শো যাট কোটি পাউণ্ড। ফ্রান্সের প্রস্তাব ছিলো জার্মানী বিয়াল্লিশটি বাৎসরিক কিস্তিতে এক হাজার একশো বিশ কোটি পাউণ্ড ক্ষতিপূরণ দেবে। ফ্রান্সের এই বিরাট অংকের ক্ষতিপূরণ দাবি করার পেছনে মূল উদ্দেশ্যটি ছিলো জার্মানীকে একেবারে পঙ্গু করে রাখা। জার্মানী তার প্রথম কিস্তি পাঁচ কোটি পাউন্ড শোধ করলো। তিন বছরের শর্তে এটাই ছিলো তার নগদ অর্থে দেয় পরিশোধ। জার্মানীর পক্ষে পরবর্তী ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো।
জার্মানী মিত্র শক্তিকে দেয় ক্ষতিপূরণের টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে ফ্রান্স জার্মানীর ধাতু শিল্পের কেন্দ্রস্থল এবং কয়লা, অশোধিত লোহা ও ইস্পাত উৎপাদনের শতকরা আশিভাগ যেখানে পাওয়া যেতো, সেই রূঢ় অঞ্চল দখল করে। রূঢ় অঞ্চল দখলের পর জার্মানীর সার্বিক অর্থনৈতিক জীবন থমকে দাঁড়ালো। এর পরিণতিতে জার্মানীতে চরম মুদ্রা সংকট দেখা দেয়। জার্মান সরকারের নিজের দেশের অভ্যন্তরেও ঋণ ছিলো। বলা হয়ে থাকে যে, টাকা সহজে শোধ করার জন্যই সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে মুদ্রাস্ফীতি ঘটিয়েছিলো। বিশ সালের মাঝামাঝি মার্কের মূল্যমান তার স্বাভাবিক হার এক ডলারের বিনিময়ে বিশ মার্ক থেকে নেমে দাঁড়ালো পাউণ্ড প্রতি দুশো পঞ্চাশ মার্ক।
একুশ সালের মাঝামাঝি তা বেড়ে দাঁড়ালো এক পাউণ্ড সমান একহাজার মার্ক। তেইশ সালে পাউণ্ড প্রতি পঁয়ত্রিশ হাজার মার্ক পাওয়া যেতো। সে সময় মাত্র কয়েক পেন্সের বিনিময়ে জার্মানীতে রাজার হালে জীবন যাপন করা যেতো বা যে কোনো বিদেশি মাত্র কয়েক শিলিংয়ের বিনিময়ে জার্মানীর সর্বত্র পরিভ্রমণ করতে পারতো। তেইশ সাল শেষ হবার আগেই মার্ক-এর মূল্যমান আরো নেমে গিয়ে এক ডলার সমান দাঁড়ালো বিরাশি কোটি মার্ক। সে সময় এক জোড়া জুতার জন্য পঞ্চাশ লাখ মার্ক দিতে হতো, ছাপাখানায় মুদ্রিত একটি সংবাদ পত্রের জন্য দিতে হতো বিশ লাখ মার্ক। সুটের একটি কাপড় সংগ্রহের জন্য বিশ সপ্তাহ কাজ করতে হতো।
জার্মানীর অবস্থা এমন দেউলিয়ার পর্যায়ে গিয়েছিলো যে জার্মানীর রাইখস ব্যাংককে নোটের সরবরাহের জন্য তিনশো কাগজের মিল এবং বিশ হাজার ছাপাখানা বসাতে হয়েছিলো, যেখানে চব্বিশ ঘন্টা কাজ চলতো। বোঝাই যাচ্ছে যুদ্ধের পর জার্মানীর অর্থনৈতিক অবস্থা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছিলো। এমন অবস্থায় বুর্জোয়া ব্যবস্থার প্রতি স্বভাবতই মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে। শ্রমিকশ্রেণী আন্দোলনের জন্য তৈরি হতে থাকে।
শুধু জার্মানীতে নয়, সারা বিশ্বে এক অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছিলো এসময়। বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপের আর্থিক পুনর্গঠন কোনভাবেই সম্ভব হচ্ছিলো না। কেন্দ্রীয় ইউরোপে আর্থিক সংকটের দরুন উৎপাদন হ্রাস পেল। রাশিয়া সাময়িকভাবে হলেও ছিলো এসব সমস্যার বাইরে। মানুষের দৃষ্টি স্বাভাবিকভাবেই রাশিয়ার ওপর নিবদ্ধ হলো এবং সাধারণ মানুষ ও শ্রমিকদের মধ্যে মার্কসবাদ সম্পর্কে জানার আগ্রহ জন্মালো। সমাজতন্ত্রীরা খুব শীঘ্রই ক্ষমতায় আরোহণ করবে এ সময় এমন কথাও * শোনা যেতে থাকে। জার্মানীর একদল এ সময় ধনীদের পক্ষে অপর একদল শ্রমিকদের পক্ষে যোগ দিতে লাগলো-শ্রেণীসংগ্রাম তীব্রতর হলো। সর্বত্র এক নতুন বিপ্লবী চেতনার ঢেউ পরিলক্ষিত হতে থাকলো। বুদ্ধিজীবীরাও চুপ করে বসে রইলেন না।
বিশ দশকের শেষার্ধ থেকে ত্রিশ দশকের প্রারম্ভ পর্যন্ত জার্মান সাংস্কৃতিক জগতে বুদ্ধিজীবীরা নতুন ভাবে চিন্তা-ভাবনা শুরু করলেন। রাজনৈতিক জীবনে যেহেতু সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদী চিন্তা ব্যাপকতা লাভ করে, নাট্যচিন্তায়ও তা প্রভাব ফেলতে থাকে। বিশেষ করে থিয়েটারের ক্ষেত্রে শ্রেণীসংগ্রামের ধারণা ব্যাপকতা পায়। থিয়েটারের অভ্যন্তরে কিংবা নাট্যকারদের নাট্যচিন্তায় এই প্রশ্ন সকলের নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটাতে শুরু করেছিলো যে, শিল্পকে বাঁচতে গেলে তাকে শ্রেণীসংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবেই গড়ে উঠতে হবে কি না?”” নাট্যকারদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ অংশটি বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণীর রাজনীতি-চিন্তার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান খুঁজতে চেষ্টা করলেন। জার্মানীতে এই সময় দুইজন অসাধারণ নাট্যকার ও পরিচালকের দেখা পাওয়া যায়। যাঁরা হলেন সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক নাট্যধারার পথিকৃত, যাঁদের নাট্যচিন্তার মূল ভিত্তি ছিলো মার্কসবাদ। তাঁদেরই একজন হলেন এরভিন পিসকাটর এবং অপরজন বের্টোল্ট ব্রেন্ট।
নাটকের ইতিহাসে ‘পলিটিক্যাল থিয়েটার’ শব্দটি জার্মান পরিচালক পিসকাটর উদ্ভাবন করেছিলেন বিশ শতকের বিশের দশকে। তিনি মার্কসবাদী ও সমাজতন্ত্রী ছিলেন। নাটকে তিনিই সচেতনভাবে রাজনীতি টেনে আনেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আমরা আমাদের কর্মসূচী থেকে শিল্প কথাটি নিষিদ্ধ করলাম; আমাদের নাটকগুলি হোলো ফতোয়া-যার মাধ্যমে আমরা সমসাময়িক ঘটনায় ‘রাজনৈতিক’ দিক থেকে অংশগ্রহণ করতে চাই। আমাদের সমস্ত শিল্প-সৃষ্টি বিপ্লবী লক্ষ্যের অধীন; শ্রেণী সংগ্রামের প্রচারই আমাদের শিল্প সৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্য।’ পিসকাটরের পূর্বে সচেতনভাবে রাজনীতিকে নাটকে ব্যবহার করার উদাহরণ দেখা যায় না।
বিশেষ করে নাটকে মার্কসবাদের প্রয়োগ তিনিই শুরু করেন। যুদ্ধোত্তর জার্মানীর নাট্যজগতে তাঁর . আবির্ভাব। পূর্বেই নাট্যশিল্পে তাঁর অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ ঘটে যুদ্ধপূর্ব মিউনিখের কোর্ট থিয়েটারের অভিনেতারূপে, পরে সৈন্য বিভাগে থাকাকালীন সৈনিক নাট্যদলে অভিনয় করে। মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময়ই তিনি দর্শন, শিল্প এবং থিয়েটারের ইতিহাস পাঠ করেন। ঘটনাচক্রে তাকে বাধ্যতামূলকভাবে প্রথম মহাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হয়। সেখানে দুবছরের মতো যুদ্ধের ফ্রন্ট লাইনে থাকতে হয়। যুদ্ধকালে এক পর্যায়ে তার ঊর্ধ্বতন সামরিক অফিসার তাঁর পেশা জানতে চাইলে তিনি – নিজেকে অভিনেতা বলে দাবি করেন।
ঐ সময় সামরিক বাহিনীর জন্য যে নাট্যদল তৈরি করা হয় সেখানে পিসকাটরের অন্তর্ভুক্তি ঘটে। তিনি সামরিক থিয়েটার ইউনিটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন প্রযোজনার দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি যুদ্ধ সম্পর্কে তাঁর চিন্তা-চেতনা ভিন্ন খাতে বইতে শুরু করে। যুদ্ধের অভিজ্ঞতাই তাঁকে রাজনীতিক করে তোলে। সৈনিকদের মধ্যে যে যুদ্ধ বিরোধী বৈপ্লবিক প্রচার চলছিলো পিসকাটরকে তা নাড়া দিয়েছিলো বিশেষভাবে। জাতিগুলো কেন যুদ্ধে মেতেছে, একতরফের প্রবল লোভের জন্য ঝাঁকে ঝাঁকে সাধারণ মানুষকে যুদ্ধে কেন প্রাণ দিতে হচ্ছে, এসব কার্যকারণ তাঁকে সচেতন করে দিয়েছিলো। যুদ্ধের পর তিনি এ ব্যাপারে আরো ব্যাপক ভাবনা-চিন্তা শুরু করেন।
স্পার্টাকুস বিপ্লব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে যখন লিয়বনেখট এবং রোজা লুক্সেমবুর্গকে হত্যা করা হয় তখন আবেগে বিচলিত হয়ে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেন। জার্মানীর কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর নাট্যশালার যোগ ছিলো দীর্ঘ, গভীর ও ফলপ্রসূ। নাটককেও তিনি সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবহার করার কথা ভাবেন।
বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, রুশ বিপ্লব সম্পর্কে সচেতনতা এবং মার্কসবাদের প্রতি মনস্কতা তাঁকে নতুন উপলব্ধি ও বিশ্বাসে পৌছে দিয়েছিলো। তিনি শ্রমিকশ্রেণীর সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ বেছে নিলেন তাঁর নাটক মঞ্চায়নের জন্য। যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে তাই তিনি উনিশশো উনিশ সালে বার্লিনে প্রলতারিয়েত থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন হেরমান ভ্যলারের সহযোগিতায়। নামের ভিতর দিয়েই এ থিয়েটারের উদ্দেশ্য অনেকটা ধরা পড়ে।
তিনি নাটকের জন্য যে সূত্র খাড়া করলেন তার মূল কথাই হচ্ছে থিয়েটার হবে জনগণের জন্য, যার বিচার্য হবে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়। নিজের নাট্যকর্ম সম্পর্কে পিসকাটর লিখেছেন, ‘আমি শিল্প সৃষ্টি করতে আসিনি, ব্যবসা করতেও নয়।…যে থিয়েটারের দায়িত্ব আমি গ্রহণ করবো, সে থিয়েটার হবে বৈপ্লবিক অথবা কিছুই নয়’। তিনি শুরু থেকেই থিয়েটারকে রাজনৈতিক সংগ্রামের হাতিয়ার রূপে চিন্তা করেছিলেন ও সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তার সমস্ত নাট্যকর্ম পরিচালিত করেছিলেন।
নাটকের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের কথা তিনি ঘোষণা করেছিলেন। ব্রেন্ট লিখেছিলেন, উনিশশো আঠারো সালের বিপ্লবই পিসকাটরকে রাজনীতিজ্ঞ করে তোলে। পিসকাটরের নিজের লেখাতেও সে কথার প্রমাণ পাওয়া যায়। থিয়েটারের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির বক্তব্য প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে পিসকাটর প্রচলিত রীতি ও পদ্ধতি থেকে ভিন্ন পথের সন্ধান করেছিলেন। দীর্ঘ দিন ধরে নাটকের নায়ক ছিলো ব্যক্তি, তিনি বিশেষ একক ব্যক্তির জায়গায় জনগণকেই নাটকের নায়ক করেন। তিনি চলতি ঘটনা ও সাম্প্রতিক ইতিহাসকে সোজাসুজি প্রকাশ করার চেষ্টায় ব্রতী হন। রাজনীতিকরা যেভাবে রাজনৈতিক অথবা অর্থনৈতিক কিংবা অন্য যে কোনো সামাজিক সমস্যার মোকাবেলা করবে, প্রলেতারিয়েত থিয়েটারের কর্মীরা ও দর্শকরাও সে ভাবে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করবে ও সমাধানে উদ্যোগী হবে বলে তিনি দাবি করেছেন।
মার্কসের মতো তাঁরও লক্ষ্য ছিলো পুঁজিবাদের ধ্বংস সাধন করা, তিনি তাঁর নাটকগুলোতে তাই পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। সবকিছুর উর্দ্ধে দেখতে গেলে থিয়েটার হচ্ছে তাঁর কাছে রাজনৈতিক হাতিয়ার। তিনি মনে করতেন, থিয়েটার হচ্ছে একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার যা প্রকৃত এবং সত্য ঘটনা প্রবাহ নিয়েই কাজ চরবে। থিয়েটারের কর্তব্য হলো জনসাধারণকে রাজনৈতিকভাবে উদ্বোধিত করা। তিনি বললেন এমন নাটকের কথা যা দর্শককে রাজনীতিতে শিক্ষিত ও উদ্বুদ্ধ করে তুলবে। এ কারণেই তাঁকে রাজনৈতিক থিয়েটারের পথিকৃতরূপে নাট্যবিদগণ চিহ্নিত ও সম্মানিত করেছেন।
নাট্যচর্চায় শ্রমিকশ্রেণীর মার্কসীয় দর্শনকে বিশ্বের দরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রাম শুরু করেছিলেন পিসকাটর এবং ব্রেস্ট। রাজনৈতিক নাট্যকার হিসাবে সারা বিশ্বে ব্রেস্ট স্বীকৃত। শত্রুরাও ব্রেস্টকে এড়িয়ে সুবিধা করে উঠতে পারছে না বলে তাঁর নাটকের বৈপ্লবিক সারপদার্থটা বাদ দিয়ে নাটকটাকে বিকৃত করে উপস্থাপন করছে শাসকদের মনঃপূতভাবে। কিন্তু শত্রুরা হার মানে পিসকাটরের দোরগোড়ায় এসে।
পিসকাটর নাটক লেখেননি, প্রযোজনা করেছেন মাত্র। দেশকাল অতিক্রম করে পিসকাটর সারা বিশ্বের রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। উৎপল দত্ত মনে করেন, ‘রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলনে এমন কোনো বৃহৎ প্রশ্নের উদয় হয়নি যার উত্তর পিসকাটর আগেই দিয়ে যান নি।’৭১ পিসকাটর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গণমঞ্চ নয়, সর্বহারার মঞ্চ। পিসকাটর লিখেছেন, ‘আমি পরিচালনার একটা বিশেষ পদ্ধতি বিকশিত করতে সমর্থ হলাম যাকে পরে অন্যেরা এপিক থিয়েটার নাম দিয়েছেন। বস্তুটা কী? সংক্ষেপে বলতে গেলে, নাট্যক্রিয়ার সম্প্রসারণ এবং পটভূমিকার বিশ্লেষণ; অর্থাৎ নাটকটি নাট্যকাঠামোর বাইরে বিস্তৃত হবে।
পতাকার অভিনয় থেকে এপিক থিয়েটারের শুরু। নাটকটির বিষয় ছিলো শিকাগোর শ্রমিকদের ভুবন বিখ্যাত আটঘণ্টার দিনের জন্য সংগ্রাম এবং তৎসংক্রান্ত নিষ্পেষণ, মিথ্যা মামলা ও মৃত্যুদণ্ড। কুড়িটি পরপর আপাত যোগাযোগবর্জিত দৃশ্যের সমাবেশে এপিক পদ্ধতিতে শিকাগোর ঐতিহাসিক ঘটনাটিকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। পিসকাটর পরিচালিত রেড রেভ্যু-র বিষয় ছিলো জার্মানীতে শ্রেণীসংগ্রাম ও শোষণের চেহারা। রেড রেভ্যু অভিনীত হতে থাকলো শ্রমিক অঞ্চলগুলিতে, লক্ষলক্ষ শ্রমিক সে নাটক দেখলেন। পিসকাটর নাট্যচর্চা থেকে নাট্য আন্দোলনে পা রাখলেন।
সর্বহারা বা প্রলেতারিয়েত থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে শুরু করে একত্রিশ সালে হিটলারের আক্রমণে দেশ ত্যাগ করার পূর্ব পর্যন্ত তিনি সত্যিকার অর্থেই শ্রমজীবীদের সাথে থেকে শ্রমিকদের জন্য কাজ করেছেন। ক্রমাগত অর্থনৈতিক সংকটে থেকেও তিনি কখনও দর্শককে স্থির থাকতে দেননি, তাদের চারপাশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সমস্যাসমূহকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। সেসব মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত করে তুলেছেন এবং একের পর এক রাজনৈতিক নাট্য প্রযোজনার মধ্য দিয়ে জার্মান নাট্য ইতিহাসে, এমনকি বিশ্বের নাট্য ইতিহাসের জন্য নতুন ধারার জন্ম দিয়ে গেছেন। সোভিয়েত দেশে প্রথম সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলেও যা তারা পারেনি, সে কাজটিই সম্পন্ন করেছেন জার্মানীতে পিসকাটর।
ব্রেস্ট নিজেই স্টকহোমের এক সেমিনারে যুক্তিসঙ্গতভাবেই একথা বলেন যে, বর্তমানকালের প্রায় সকল নাট্যকার, অভিনেতা এবং পরিকল্পনাবিদদের মধ্যে সকল প্রচলিত ধারা ভেঙে পিসকাটরের ধারাই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে। তিনি জার্মানীর ‘এ্যাজিটপ্রপ’ আন্দোলনের পথিকৃৎ, তিনি রাশিয়ার ‘এ্যাজিটপ্রপ’ নাটককে নতুন পথ দেখান। পিসকাটরের চিন্তাই পরবর্তীকালে সমস্ত ‘অ্যাজিটপ্রপ’ নাট্য প্রযোজনার রীতি নির্ধারিত করেছে।ফ্রীডরিশ ভোলফ স্বীকার করেন যে, পেশাদার মঞ্চের সমস্ত বামপন্থী নাটক তা সে ভাগেন হাইমের মাউসেফেলেই হোক কিংবা ব্রেস্টের এপিক বা তার নিজের কোনো নাটকই হোক- পিসকাটর-এর চিন্তা বা এ্যাজিটপ্রপ স্কোয়াডগুলির কাজ ছাড়া এসব নাটকের চিন্তাই সম্ভব ছিলো না।
রাজনৈতিক বিষয়বস্তুই পিসকাটরের পক্ষে যথেষ্ট ছিলো না। তিনি আধুনিক পরিস্থিতিকে প্রকাশের জন্য নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। তিনি তাঁর নাট্য আঙ্গিকের নামকরণ করেছিলেন এপিক বা মহাকাব্যিক। ব্রেন্টও পরে তাঁর নাট্য আঙ্গিকের একই নামকরণ করেছিলেন। পিসকাটর থিয়েটার থেকে শিল্প শব্দটি বর্জন করার ঘোষণা দিলেও মূলত তিনি তা করেননি। তিনি শিল্প বর্জনের কথাটি বলেছিলেন আসলে যারা ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ চর্চার শ্লোগান তুলেছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধাচারণ করবার জন্য। তিনি তাঁর নাটকে যতোই রাজনৈতিক প্রচার চালান না কেন, শিল্পসম্মতভাবেই তা ঘটতো।
তাঁর নাট্য প্রযোজনাগুলো সচেতনভাবে এমন উদাহরণ রাখতে চেয়েছিলো যা এক নতুন ধরনের নাট্যশালার বাস্তবভিত্তি স্থাপন করবে। তিনিই প্রথম নাট্য পরিচালক যিনি থিয়েটারে ফিল্মের ব্যবহার আনেন এবং দৃশ্যপটটিকেও পর্যন্ত অভিনেতায় পরিণত করেন। উৎপল দত্ত তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেন, পিসকাটর মঞ্চের সর্ববিধ যন্ত্রকে রাজনৈতিক নাটকের কাজে নিয়োজিত করে শতাব্দীর সবচেয়ে বিশাল প্রযোজনাগুলোর সৃষ্টি করেছিলেন। নাট্যবিদরা যে ঘন ঘন ‘টোটাল থিয়েটারের’ কথা বলেন তাও পিসকাটরের সৃষ্টি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এক সময়ে সারা ইউরোপের নাট্যশালাকে একা পিসকাটর নতুন আঙ্গিকে গড়ে তুলেছিলেন।
উৎপল দত্ত লিখছেন, ‘পিসকাটরের পদ্ধতি হচ্ছে ভবিষ্যতের নাট্যরীতির এক অপূর্ব ফর্মুলা। ভুল করবেন না, পিসকাটরের পদ্ধতি কমিউনিস্ট পার্টির নিজস্ব কোনো ব্যাপার নয়। যে কোনো পার্টিই তাঁর উদ্দীপনাকে মঞ্চে রূপ দিতে পারে যদি সে পিসকাটরের পদ্ধতি অনুসরণ করে।” সেজন্য ইউরোপের কট্টর বাণিজ্যিক নাট্যশালাও পিসকাটরের নাট্য পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটিয়েছে।
পিসকাটর নাট্য পরিচালনায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবার জন্য নলেনডর্ফপ্লাটস-এ একটি রঙ্গমঞ্চ ভাড়া নিয়ে নিজের দল পিসকাটর-ব্যুহনে প্রতিষ্ঠিত করলেন। নলেনডর্ফপ্লাটস-এর রঙ্গমঞ্চটিকে ভেঙেচুরে যথাসম্ভব যন্ত্রপাতি স্থাপন করলেন পিসকাটর এবং সেখানেই প্রথমবারের মতো বিশ্ব রাজনৈতিক নাট্যশালার শ্রেষ্ঠ নিদর্শনগুলি একের পর এক জনসমক্ষে আবির্ভূত হলো। প্রথম নাটক এর্নস্ট টলারের হোপলা, ভিরলেবেন বা বাংলায় ‘কী মজা, আমরা বেঁচে আছি’। মঞ্চজুড়ে তিনতলা দৃশ্য রচনা এবং অসংখ্য কক্ষ যুগপৎ দর্শক চক্ষুর সামনে উদঘাটিত।
পরবর্তী প্রযোজনা রুশ নাটক আলেকসেই তলস্তয়ের রাসপুটিন। মঞ্চজুড়ে এক বিশাল গ্লোব, সেটা ঘুরে যাচ্ছে আর তার একেকটি দেয়াল খুলে গিয়ে ভিতরে দৃশ্যমান হচ্ছে নানা মঞ্চ স্থাপত্যর যারের প্রাসাদের নানা কক্ষ, লেনিনের সদর দপ্তর, সম্রাজ্ঞীর শয়নকক্ষ, কাইজারের কার্যালয়। গ্লোবটি যখন স্থির, তখন অভিনয় হচ্ছে তার চূড়ায়। জার দাঁড়িয়ে আছেন বেন পৃথিবীকে পায়ের তলায় চেপে, কিন্তু তিনি জানেন না তাঁর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে বহুগুণ বৃহৎ রাসপুটিনের ছায়া। পিসকাটর নানান আঙ্গিকগত কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছিলো রীতিমত ব্যয় সাপেক্ষ।
তাঁর এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার পেছনে মূল কারণ ছিলো শ্রমিকদের কাছে নাটককে গ্রহণযোগ্য করে তোলা। শ্রমিকরা যেখানে মানসিক পক্ষাঘাতে পঙ্গু সেখানে শ্রমিকের নাট্যশালাকে শক্ত বিষয়বস্তুর পাশাপাশি চমকের উপরেও নির্ভর করতে হয়। নাহলে শ্রমিকের বিয়োজিত বিচ্ছিন্ন ক্লান্ত দেহমন তা গ্রহণ করতে সক্ষম হবে না। তিনি শুধু থিয়েটার করা নয়, সে থিয়েটারকে দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেয়ার কথাও ভেবেছিলেন। সেজন্য গবেষণা চালিয়েছিলেন। যিনি বিশ শতকের উপযোগী নতুন নাটক ও নাট্যশালা সৃষ্টিতে উদ্যত, তিনি পুরাতন অভ্যস্ত চিন্তার দাসত্ব করতে পারেন না। নতুন চিন্তা তাঁকে আমদানি করতেই হয়। তাঁকে বিদ্রোহ করতেই হয় দর্শক ও অভিনেতার অভ্যাসগুলির বিরুদ্ধে।
তিনি একদিকে যেমন যান্ত্রিক সব উপকরণের সাহায্য নিয়েছিলেন অন্যদিকে আবার বিষয়বস্তুর জন্য সাহায্য নিয়েছেন সমাজ বিজ্ঞান, রাষ্ট্র বিজ্ঞান, ইতিহাস, মনোবিজ্ঞান, পরিসংখ্যান বিজ্ঞানের। পিসকাটর লিখেছেন, আমার কাছে কেউ কেউ দাবি করেন, সরল নাটক ও সরল দৃশ্যসজ্জা। এক কথায় পুরানো ঢংয়ের থিয়েটার। না, প্রলেতারীয় নাটককে স্বাভাবিকতাবাদী ঢংয়ে উপস্থিত করা আমাদের কাজ নয়। মঞ্চের বিকাশকে পঞ্চাশ বছর আগের যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাবো না। রাজনৈতিক নাটকের লক্ষ্য হচ্ছে বুর্জোয়া থিয়েটারকে অতিক্রম করে যেতে হবে দর্শনে, নাট্যতত্ত্বে, মঞ্চকৌশলে, মঞ্চায়নে। তিনি বলেন, রাজনীতিতেই মানুষ সবচেয়ে পরিস্ফুট, রাজনীতির মধ্যেই মানুষ যথার্থ মানুষ।
রাজনৈতিক নাটক সম্পর্কে খুব স্পষ্টভাবে পিসকাটর বলছেন, নাটকে দৈনন্দিন জীবনের প্রতিবেদন প্রকাশ করলেই হবে না, চাই সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা। তিনি চাইছেন অখণ্ড-আস্ত বিশ্বচিত্র, মূল থেকে বিস্তার পর্যন্ত। তিনি তথ্য চাইছেন না, চাইছেন সত্য। সেই সত্যকে তিনি আখ্যা দেন বৈপ্লবিক, যে-সত্য নিরপেক্ষ নয়, উগ্ররূপে পক্ষপাতি; যে-সত্য শ্রেণীর ঊর্ধ্বে নয়, শ্রেণীসংগ্রামের অংশীদার। পিসকাটর লিখছেন, ‘সত্য ও পক্ষপাতিত্বের সম্পর্ক কী। এ দুটির মধ্যে কি কোনো বিরোধ আছে? একেবারেই নয়। যে যুগে সত্য হচ্ছে বৈপ্লবিক সে যুগে এ দুটির অঙ্গাঙ্গি মিল। যার অর্থ পক্ষপাতিত্ব ব্যতীত, সংগ্রামী শ্রেণীগুলির পক্ষ অবলম্বন না করা পর্যন্ত সত্যে উপনীতই হওয়া যাবে না।
কেউ যদি এই সর্বাত্মক শ্রেণীসংগ্রামের কালে বসে ভাবেন তিনি এমন সত্যের কারবার করবেন যা এই সংঘর্ষের ঊর্ধ্বে, বা যা দুই যুদ্ধমান শ্রেণীর কাছেই সত্য হবে, তবে তিনি নির্লজ্জ, অশ্লীল মিথ্যায় গিয়ে উপনীত হবেন। সকলের জন্য, সকলের পছন্দের সত্য বলে কিছু নেই। ব্রেস্ট বলেন, শ্রমিকশ্রেণী ব্যতীত এখন পর্যন্ত কোনো শ্রেণী নেই যার সত্যের প্রয়োজন আছে। বাকিরা আকণ্ঠ মিথ্যায় ডুবে আছে, নানা মিথ্যা কথা বলে’ শ্রমিকশ্রেণীর চূড়ান্ত বিজয়ের সত্যটাকে আড়াল করছে। শাসকশ্রেণীর সত্য হলো মিথ্যা-বিশ্বটাকে গ্রাস করার জন্য নানা মিথ্যাকে তারা সত্যি বলে চালাচ্ছে। সুতরাং শ্রমিকশ্রেণীর সত্যই এখন একমাত্র সত্য এবং সে সত্য বৈপ্লবিক।
পিসকাটর পরিচালিত প্রত্যক্ষ সংগ্রামের নাটকের মধ্যে সব চাইতে স্মরণযোগ্য হলো গাসবারা রচিত উটৎসআলডেম। কমিউনিস্ট পার্টির প্রত্যক্ষ প্রযোজনায় এই নাটক পরিচালনা করলেন, নাটকটির প্রতিটি ঘটনা ছিলো ঐতিহাসিক দলিল নির্ভর। বিষয়বস্তু আঠারশো আঠারো সালের বিপ্লব। দর্শক হিসাবে যেখানে উপস্থিত ছিলো শ্রমিকশ্রেণী। সেই প্রযোজনাতেই রাজনৈতিক থিয়েটারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষদের বিক্ষুদ্ধ ও উত্তেজিত করবার বিশেষ ক্ষমতা প্রমাণিত হয়েছিলো। তাঁর আর একটি উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা শোয়াইক।
যুদ্ধের পরবর্তী প্রভাব কী ভয়ংকর হতে পারে এ অবিস্মরণীয় যুদ্ধবিরোধী নাটকে তাই দেখানো হয়েছে। যুদ্ধের মিথ্যা প্রচার, গুপ্তচর বৃত্তি, সৈন্য সমাবেশ, সৈন্যদের শাস্তি, অন্যত্র চালান দেওয়া, বোমা ফেলা-যুদ্ধের আনুষঙ্গিক সমস্ত কিছু এতে দেখান হয় একটি কেন্দ্রীয় চরিত্রের সঙ্গে। যুদ্ধটা পরিপ্রেক্ষিত মাত্র। ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে যুদ্ধের ভিতরকার দ্বন্দ্বটাকে ধরা হয়েছে, নগ্ন সত্যটাকে প্রকাশ করা হয়েছে। তাঁর উল্লিখিত নাটক দুটিতে বিপ্লব ও যুদ্ধের জীবন্ত দলিল তুলে ধরা হয়েছিলো।
রাসপুটিন নাটকটিও ছিলো প্রামাণ্য দলিলের মতো, রাসপুটিনকে তিনি দেখেছেন ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে। তিনি দেখিয়েছেন যে, রাসপুটিন যে-সমস্ত ছোটখাট রাজনৈতিক নীতি গ্রহণ করেছিলো তার কোনোটাকেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে না দার্দালেনেসে প্রযুক্ত ইংরেজ কূটনীতির প্রেক্ষাপট বা পশ্চিম সীমান্তে সামরিক অভিযানের ঘটনাকে উল্লেখ না করে। পিসকাটরের বিরুদ্ধে প্রাক্তন কাইজার একটি আইনি অভিযোগ এনেছিলেন, যে অভিযোগে বলা হয়-পিসকাটর মঞ্চে কাইজারের মুখ দিয়ে যেসব সংলাপ বলিয়েছেন তার সবই বাস্তব জীবনে কাইজার উচ্চারণ করেছেন। বেশ হাঙ্গামা বেধেছিলো রাসপুটিন নাটকের অভিনয় নিয়ে।
সাম্রাজ্যবাদী দস্যুদের যুদ্ধ বাধাবার দৃশ্যে জার্মান কাইজারের যতো সংলাপ ছিলো, আদালত তা এক আদেশ জারি করে নাটক থেকে বাদ দিতে বলে। পিসকাটর নাটক বন্ধ করলেন না। নাটক ঠিকই চললো শুধু কাইজারের দৃশ্য এলেই পিসকাটরের সহকারী লিও লানিয়া মঞ্চে প্রবেশ করে কাইজারের সংলাপের পরিবর্তে আদালতের আদেশটা গুরুগম্ভীর কণ্ঠে পাঠ করে শোনাতেন। দর্শক হেসে খুন হতো। সরকারি আদেশকে বানচাল করে দিয়ে দর্শকের সাথে এভাবেই সংযোগ সৃষ্টি করবার ক্ষমতা রাখতেন পিসকাটর।
রাজনীতি পৌঁছে দিতে হবে জনগণের কাছে, শ্রমিকশ্রেণীর কাছে সেটাই ছিলো তাঁর থিয়েটারের প্রধান উদ্দেশ্য। রাজনীতির গর্ভে পিসকাটরের যাবতীয় নাট্যচিন্তা তাঁরত। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই তিনি তাঁর সমকালীন নাটক তো বটেই ধ্রুপদী নাটকও নিরিবর্তন করে নিতেন। তাঁর এপিক পদ্ধতি অকারণে ভাবাবেগ সৃষ্টির বিরোধী। সেজন্য তিনি নাটকে প্রামাণ্য কায়দায় ঘটনার পর ঘটনা সাজিয়ে, ভাবাবেগের পরিবর্তে দর্শককে যুক্তির মুখোমুখি দাঁড় করান।
মার্কসবাদই যে দুনিয়াকে বুঝবার একমাত্র পথ এটাকে মঞ্চে প্রকাশ করাই ছিলো পিসকাটরের একমাত্র লক্ষ্য। কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন, পিসকাটর সব নাটকেই জোর করে একটা শ্রেণীসংগ্রাম ঢোকাবার চেষ্টা করতেন। তার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই নাটক বাস্তবতা হারিয়ে নির্জলা রাজনৈতিক খুবই সত্য যে, পিসকাটর যে-কোনো নাটককেই দ্বান্দ্বিক বা প্রচারে পরিণত হতো। শ্রেণীসংগ্রামের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতেন। তবে তার প্রকাশ ঘটতো শিল্পসম্মতভাবেই। পিসকাটর মনে করতেন, শিল্প ছাড়া নাটক হতে পারে না এবং নাটক কিছু প্রচার না করেও পারে না। নাট্যকলা শ্রেণীসংগ্রামের ঊর্ধ্বে নয়, বাইরেও নয়।
পিসকাটরের কাছে নান্দনিকতা বিষয়টিও ছিলো রাজনৈতিক বিবেচনার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু নান্দনিকতাহীন কোনো নাটক তিনি করেননি। বরং বলা যায় রাজনৈতিক নাটক নান্দনিকতার বিরোধী তো নয়ই, নতুন নান্দনিকতার জন্মদাতা। পিসকাটরের পদ্ধতি সম্পর্কে মতবিরোধ থাকলেও এটা অত্যন্ত সত্য যে, জনগণকে জাগিয়ে তুলতে বা উত্তেজিত করতে তাঁর পদ্ধতিই সর্বশ্রেষ্ঠ পদ্ধতি। সেইজন্যই তাঁর বিরুদ্ধে দক্ষিণপন্থীদের পক্ষ থেকে যে অভিযোগ তোলা হয়েছিলো তাহলো, থিয়েটারকে অতিমাত্রায় রাজনৈতিক করে তোলা। তিনি এ অভিযোগ খণ্ডন করতেন না, বরং তিনি মনে করতেন সত্যিকার অর্থে যে-কোনো মার্কসবাদীর সেটাই উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে হিটলারবাদকে উচ্ছেদ করার পর পিসকাটর যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাসিত জীবন থেকে ফিরে আসেন তাঁর প্রিয় বার্লিন শহরে। বার্লিনে ফিরে এসে তিনি চুপ করে ছিলেন না, পুনরায় নাট্য পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
বিশ শতকে আমরা যে রাজনৈতিক নাটকের পথযাত্রা দেখতে পাই মূলত এরভিন পিসকাটরই হচ্ছেন তার স্রষ্টা। যদিও তাঁর সমকালীন ব্রেখটের নাট্যখ্যাতি পিসকাটরকে ছাপিয়ে উঠেছে তবুও পিসকাটরের নাট্যকীর্তির ছাঁচে এবং আদর্শেই পরবর্তীকালে গঠিত হয়েছে প্রচার নাটক। ব্রেস্ট তাকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান এবং আরো বেশি পরিচিত করে তোলেন। পিসকাটর দার্শনিক তর্কে যাননি কোনোদিন, রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলনের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছেন মাত্র। ব্রেস্ট নাট্যকার হিসাবে পিসকাটরকে উচ্চমূল্য দিলেও তিনি মূলত ছিলেন পরিচালক। ব্রেস্ট ছিলেন নাট্যকার, নাট্যপরিচালক ও নাট্য-তাত্ত্বিক। ব্রেন্টই মূলত রাজনৈতিক নাটক তথা এপিক থিয়েটার তথা মার্কসবাদী থিয়েটার সম্পর্কে চমৎকার চমৎকার সব তত্ত্ব লিখে রেখে গেছেন, সে বিচারে তিনি পিসকাটরের যোগ্য উত্তরসূরী।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক নাট্যজগতে ব্রেশ্টই সর্বাপেক্ষা প্রভাব সৃষ্টিকারী নাট্যকার ও তাত্ত্বিক রূপে পরিগণিত হয়েছেন। তিনি ছিলেন পিসকাটরের ছাত্র ও সহকর্মী। তাঁর নাট্যচিন্তা সে কারণে পিসকাটরের প্রভাবে পরিপুষ্ট। থিয়েটার নিয়ে তত্ত্বগত ও প্রয়োগগত পদ্ধতিতে পিসকাটর ও ব্রেস্টের মধ্যে চিন্তার ফারাক থাকলেও মূল জায়গায় উভয়েই ছিলেন এক। ব্রেস্টের রাজনীতিতে হাতে খড়ি পিসকাটরের কাছে। শিক্ষানবিশ হিসাবে প্রথম দিকে তাঁর কাজ ছিলো পিসকাটরের নাটকগুলির পাণ্ডুলিপি সংশোধন করে দেয়া। বিনিময়ে পিসকাটর ব্রেন্টের ভরণপোষণ জোগাতেন। পিসকাটরের আরো দুজন ছাত্র হলেন ফ্রিডরীশ ভোলফ ও ভানগেন হাইম।
ব্রেস্ট, ভোলফ এবং ভানগেন হাইম ত্রিশ দশকের এই তিনজন বিপ্লবী নাট্যকারের মধ্যে শিল্পগত কিছু পার্থক্য থাকলেও নীতিগতভাবে তাঁরা ছিলেন একই পথের পথিক-মার্কসবাদী রাজনৈতিক নাট্যকার। পিসকাটরের মতো এঁরাও শ্রমিকশ্রেণীর জন্য নাটক করার কথা ভাবেন। শ্রমজীবী মানুষের কাছে পৌঁছাবার জন্য তাঁরা সমস্ত রাজনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে থিয়েটারের নতুন দিক উন্মোচন করলেন। ব্রেস্ট ছিলেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রণী এবং সফল নাট্যকার ও পরিচালক। ব্রেস্টের নাটকগুলোতেই শ্রেণীসংগ্রাম চরম শৈল্পিক উৎকর্ষ নিয়ে হাজির হয়েছিলো। তাঁর প্রথম নাটক বা-আল, দ্বিতীয় নাটক ড্রাম ইন দ্য নাইট।
জার্মানীর যুদ্ধ, বিপ্লব ও অর্থনৈতিক পতনের চিত্রই বা-আল নাটকে ফুটে ওঠে। বে-আইনী কার্যকলাপ, খুন, ধর্ষণ, মাতলামি, বেশ্যাবৃত্তি, চরম হিংসাত্মক কার্যকলাপ সবই নাটকের বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত। ব্রেস্ট সমাজের মানুষের নীচতা, ক্রুরতা ও স্বার্থপরতাকে প্রবল শক্তিতে এ নাটকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। রাত্রিতে ঢোলের আওয়াজ নাটকের এন্ড্রিয়াস ক্র্যাগলার প্রথম মহাযুদ্ধের পর এক বন্দী শিবির থেকে বার্লিনে ফিরে এসে দেখে যে, তার বাগদত্তা আনা মুনাফাখোর ব্যবসায়ী মার্কের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে যাচ্ছে। রাতের অন্ধকারে ক্র্যাগলার ঝড়ের মতো বেরিয়ে যায়, পাগলের মতো মদ্যপান করে।
সে সময় স্পার্টাকুস কমিউনিস্ট বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেছে, ক্র্যাগলারও সে অভ্যুত্থানে যোগ দিয়ে ফেলে। আর সকাল বেলা যখন আনা ওর কাছে ফিরে আসে, ক্র্যাগলার বিপ্লবকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে বুর্জোয়া নিরাপত্তার প্রলোভনে আনাকেই বেছে নেয়। এই নাটকে তিনি সচেতন ভাবে মধ্যবিত্তের বুর্জোয়া নিরাপত্তাভিলাষকে আক্রমণ করেছেন। বা-আল ও রাত্রিতে ঢোলের আওয়াজ দুটি নাটকেই তিনি পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে নগ্ন সত্য তুলে ধরেন। পরবর্তী মান ইস্ট মান নাটকেও তিনি সরাসরি পুঁজিবাদকে আক্রমণ করেন। দর্শকের সামনে নাটকের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদের বিরোধিতা ও তার স্বরূপকে তুলে ধরাই ছিলো তাঁর প্রথম কাজ। তাঁর পুঁজিবাদকে আক্রমণের পেছনে মূল কারণ কী ছিলো? পিসকাটরের মতো ব্রেস্টকেও প্রথম মহাযুদ্ধে অংশ নিতে হয়, সে সময় তিনি ছিলেন চিকিৎসা শাস্ত্রের ছাত্র। পিসকাটরের মতো তাঁর মধ্যেও যুদ্ধ নেতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলে।
তিনি মনে করতেন, পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার মধ্যেই রয়েছে যুদ্ধের বীজ। সেজন্যই তিনি প্রথম থেকেই পুঁজিবাদী সমাজের বিরুদ্ধে কলম ধরেন এবং পুঁজিবাদের ধ্বংসাত্মক, হিংসাত্মক দিকটাকেই তার নাটকে ফুটিয়ে তোলেন। বিশ শতকের চব্বিশ, পঁচিশ ও ছাব্বিশ সালে ব্রেষ্ট আর পিসকাটরের নাটক চলাকালীন থিয়েটারে যে কতো দাঙ্গা লেগেছিলো তার হিসাব নেই। সরকারি মহলের তথাকথিত দেশরক্ষা আর দেশপ্রেমিক যুদ্ধের শ্রাদ্ধ করেছিলেন ব্রেশট। তাঁর প্রথম তিনটি নাটকে তো বটেই পরেরও বেশ কয়েকটি নাটকের পটভূমি বা বিষয়বস্তুও ছিলো
যুদ্ধ।
সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের তিনি কেবল নিন্দা করেই ক্ষান্ত হননি, যুদ্ধের মূল কারণ যে কী সে ব্যাপারেও আলোক সম্পাতের চেষ্টা করেছেন। তিনি বলতেন যুদ্ধটা একটা আকস্মিক দুর্ঘটনা নয়, পুঁজিতন্ত্রের স্বাভাবিক বিষক্রিয়া। মার্কসের চিন্তার প্রতিধ্বনি শোনা যায় তাঁর এই বক্তব্যের মধ্যে। তিনি তখন মার্কসবাদী ছিলেন না। পরবর্তীকালে একজন মার্কসবাদী হয়ে উঠেছিলেন; যদিও প্রথম থেকেই তিনি নাটক লিখতে শুরু করেছিলেন পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে রচিত এসব নাটকে তাঁর ক্রোধ প্রকাশ পেলেও মার্কসবাদ অধ্যয়নের আগ পর্যন্ত তিনি বুঝে উঠতে পারেননি পুঁজিবাদের শেষ কোথায়। মান ইস্ট মান নাটক লেখার পর থেকেই তাঁর চিন্তার জগতে নানা পরিবর্তন আরম্ভ হয়। নাটক রচনা ও প্রযোজনা সম্পর্কে তার মনে নতুন সব প্রশ্ন দেখা দেয়। জগত ও মানুষ সম্পর্কে ভালোভাবে জানার জন্য তিনি মার্কসবাদে দীক্ষা নেন।
মার্কস-এঙ্গেলস ও লেনিনের রচনাবলী তিনি গভীর নিষ্ঠার সাথে অধ্যায়ন করেছিলেন। মার্কসবাদ পড়েছেন। কী কী বই পড়ে ফেলা দরকার তার তালিকা তৈরি করেছেন।৮২ উনিশশো সাতাশ সালের জুলাই মাসে হেলেন ভাইগেলকে চিঠি লিখে তিনি আনিয়ে নিয়েছেন মার্কসের যাবতীয় রচনাবলী এবং সদ্য প্রাকাশিত বিপ্লবের কালানুক্রমিক ইতিহাস। এর পরপরই তিনি গভীরভাবে মার্কসবাদ অধ্যয়ন আরম্ভ করেন। পরবর্তীকালে তিনি শ্রমিকদের স্কুলে হেরমান ডুংকের পরিচালিত মার্কসবাদের ক্লাশগুলিতেও অংশ নেন। মার্কসবাদ তাঁর নৈরাজ্যমূলক প্রবণতাগুলিকে খানিকটা শোধরায়। চারপাশের পৃথিবী সম্পর্কে তাঁর বিরক্তি খানিকটা দূর করে তাঁর মধ্যে একটা মানসিক নিয়মানুবর্তিতা তৈরি করে।
মার্কসবাদ অধ্যয়নের পরই তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের দিকে ফিরলেন। উনিশশো আটাশ সালের পরে আমরা তাঁকে পাই এক কমিউনিস্ট শিক্ষক হিসাবে, যিনি শিক্ষামূলক নাটক লিখছেন এবং নাটককে তুলে ধরলেন এক নতুন দর্শককুলের কাছে। সেই দর্শক হলো সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণী। মার্কসবাদ থেকে লব্ধ জ্ঞানই তার চিন্তার জগতকে পূর্বের তুলনায় আরো ধারালো করে তোলে। সে সম্পর্কে জ্ঞান লাভের পরই তিনি রচনা করেন থ্রি পেনি অপেরা। থ্রি পেনি অপেরা নাটকটি মূলত তাঁর কোনো মৌলিক রচনা নয়, বেগারস অপেরা অবলম্বনে তিনি থ্রি পেনি অপেরা রচনা করেন।
সেখানে প্রথমবার তিনি মার্কসবাদের প্রয়োগ ঘটান, যা পুঁজিবাদী সভ্যতার ভয়ংকর দিকগুলি তুলে ধরে। নাটকটিতে কোনো ভাবাবেগ সৃষ্টির প্রয়াস নেই। তথাকথিত আইন শৃঙ্খলার রক্ষকদের সঙ্গে দুষ্কর্মকারীদের যোগাযোগই হচ্ছে নাটকের মূল সুর। বেশ কিছু দুশ্চরিত্র লোক এবং তাদের কার্যকলাপ পরপর দেখানো হয় এ নাটকে। নাটকের দস্যু সর্দার শেষ পর্যন্ত ডাকাতি ছেড়ে দিয়ে একটি ব্যাংক বানাবার সিদ্ধান্ত নেয়।
কারণ সেটা হবে আইনসঙ্গত ডাকাতি। পুলিশ তাহলে আর তার পিছু নিতে পারবে না। থ্রি পেনি অপেরাতে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ব্যাংক সম্পর্কে এই হচ্ছে তাঁর মনোভাব। নাটকটি পৃথিবী জুড়ে সমাদৃত হতে থাকে। থ্রি পেনি অপেরা বার্লিনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিলো। প্রথমবার একাদিক্রমে চারশো রাত্রি এই নাটকের অভিনয় হয়। জার্মানী ও ইউরোপের অন্যান্য অংশে অসংখ্য মঞ্চে অসংখ্য রাত্রি ধরে এর অভিনয় চলে। নাটকটি ব্রেন্টকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছিলো। নাটকটি লক্ষলক্ষ টাকার ব্যবসায়িক সাফল্যও লাভ করেছিলো।
মার্কসবাদের সাথে পরিচয় ব্রেন্টকে নতুন পথের সন্ধান দেয়। মার্কসবাদ থেকে তিনি পেয়েছিলেন এক বিচারশীল দৃষ্টিভঙ্গি। মার্কসবাদ থেকে জ্ঞানলাভের পর ব্রেস্ট নিজেই লিখেছেন, মার্কসবাদ নিয়ে গভীর অধ্যয়ন ছাড়া আধুনিককালে নাটক লিখতে যাওয়াই বিড়ম্বনা। নাট্যকার হিসাবে ইতিহাস সম্বন্ধে মার্কসের ধ্যান-ধারণা না পড়ে উপায় নেই। মার্কসবাদ পাঠ করবার আগ পর্যন্ত তিনি শুধু পুঁজিবাদের বিরোধিতাই করেছেন। মার্কসবাদ অধ্যয়নের পর তাঁর মধ্যে এলো বিকল্প সমাজ ব্যবস্থার চিন্তা। তিনি সমাজতন্ত্রী হয়ে উঠলেন মনেপ্রাণে। মার্কসবাদ অধ্যয়নের পরই সমাজ বদল তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়। ব্রেস্ট-এর উদ্দেশ্য তাই সমকালীন অন্যান্য মার্কসবাদী নাট্যকারের চেয়ে অনেক ব্যাপক।
মার্কসবাদ অধ্যয়নের পর তিনি বিরামহীনভাবে মার্কসবাদের শিক্ষাকে কাজে লাগান এবং শ্রমিকশ্রেণীর সঙ্গে নাটকের সংযোগ গড়ে তোলার ব্যাপারে জোর দেন। তিনি মনে করতেন নাটকের কাজ হচ্ছে সোজাসুজি রাজনীতি প্রচার করা। শিল্পকে যদি সাধারণের রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়, সে শিল্প শাসকশ্রেণীর হাতিয়ারে পরিণত হয়। সেইজন্য নাটককে হতে হবে বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শ্রমিকশ্রেণীর সঙ্গী। প্যারি কমিউন থেকে শুরু করে উনিশশো পাঁচ সালের রুশ বিপ্লব, স্পেনের গৃহযুদ্ধ, হিটলারের অভ্যুত্থান, চীনের বিপ্লব, ফ্রান্সের নাৎসী বিরোধী পার্টিজান যুদ্ধ, স্তালিনের বিপুল কর্মযজ্ঞ একের পর এক সব এসেছে তাঁর নাটকের পটভূমিকা হিসাবে। ছুরির ফলার মতন তার বিশ্লেষণী দৃষ্টি চলে গেছে সমাজবদলের প্রয়োজনে পুঁজিবাদের ব্যবচ্ছেদ করতে।
ধনতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে, মানুষের মনুষ্যত্ব অপহরণের বিরুদ্ধে, মনুষ্যত্বের বিনাশের বিরুদ্ধে তিনি সর্বদাই ছিলেন খড়গহস্ত। থিয়েটারকে তিনি সেভাবেই দেখেছেন, থিয়েটারকে হতে হবে দুনিয়া বদলের মাধ্যম। থিয়েটারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি আরো বলেছেন, থিয়েটার মার্কসবাদের অনুসরণে সমাজ পরিবর্তনের মাধ্যমরূপে কাজ করবে। থিয়েটার তখনই শুধু স্বাধীন ও মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করবে যখন যারা সমাজের বিরাট পরিবর্তন ঘটানোর জন্য সবচেয়ে অধীর তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করবে। তিনি নিজ যুগে বসে দেখে গেছেন যুদ্ধ, হিংসা, মানুষের অশেষ দুঃখ, বুভুক্ষা, বেকারত্ব, সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ, বিপ্লব।
দেখেছেন দুর্নীতি, ফ্যাসিবাদের নগ্নরূপ, আবার যুদ্ধ ও যুদ্ধান্তে ঠাণ্ডা লড়াই। এর মধ্যেই তিনি দেখেছিলেন এক পরিবর্তনশীল জগৎ আর মানুষের সীমাহীন সম্ভাবনা। তিনি হতাশ না হয়ে তাই জগতটাকে পাল্টাবার জন্য, নতুন এক সমাজের জন্য শ্রেণীসংগ্রামের কথা বলে গেছেন, দুনিয়াকে ব্যাখ্যা করেই তিনি শুধু ক্ষান্ত ছিলেন না। নাটকের পর নাটকে তিনি সশস্ত্র বিদ্রোহের সরব প্রচারক, অস্ত্রের উপাসক।
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদীদের মতোই ব্রেশটের বিশ্বাস ছিলো যে মানব সমাজ নিরন্তর পরিবর্তনশীল এবং প্রতিনিয়ত উন্নত পর্যায়ে ধাবমান। তিনি বিশ্বাস করতেন সবকিছুরই পরিবর্তন সম্ভব, দর্শককে সেই পরিবর্তনের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে হবে, যার মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর চিন্তা শাণিত হবে।
ব্রেস্ট থিয়েটারকে সমাজ বিপ্লব আন্দোলনের একটি রণাঙ্গন করে তুলতে চেয়েছিলেন যেখানে এসে দর্শক বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ধারণা পাবে।যেহেতু তিনি ছিলেন বিপ্লবী চিন্তাবিদ, থিয়েটারকে তিনি করে তুলেছিলেন তার সমাজদর্শন প্রকাশের ও প্রচারের মাধ্যম যার ভিতর দিয়ে থিয়েটারকে মার্কসবাদী এক চিন্তার রাজ্যে পরিণত করে তোলাই ছিলো তাঁর মূল লক্ষ্য। সমাজ বদলানোর স্বার্থেই তাঁর সব নাটকের মূল প্রতিপাদ্য ছিলো মানুষ ও তার চুলচেরা বিশ্লেষণ, সমাজ বদলের স্বার্থেই তিনি তার বক্তব্য দাঁড় করিয়েছিলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তির ওপরে আর নাটককে তিনি ব্যবহার করেছেন সমাজ পরিবর্তনের রাজনীতির পক্ষে।
তিনি এই সত্য অনুধাবন করলেন যে, চলমান থিয়েটারও শাসকশ্রেণীর হাতে উৎপাদনের শক্তি সমূহের মতো তার শাসন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার এক যন্ত্র। যে নাট্যকার সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন চান তিনি সে থিয়েটার সম্পর্কে নীরব থাকতে পারেন না। শাসকশ্রেণীর স্বার্থ কায়েমী করে রাখে এমন কোনো কিছুর পক্ষেই তিনি রায় দিতে পারেন না। তিনি হবেন অবশ্যই নতুন পথের সন্ধানী, বিষয়বস্তু ও আঙ্গিক দুই ক্ষেত্রেই। সেই দিনগুলোতে পুরানো জার্মান থিয়েটারে ব্রেস্ট দেখেছিলেন আবেগের ব্যবসা। বুর্জোয়াদের সেই আবেগ জাগানো নাট্যকৌশল নাৎসীদের হাতে একটা বীভৎস হাতিয়ার হয়ে দেখা দিয়েছিলো বিশের দশকের শেষ দিকে।
তিনি সেই বুর্জোয়া থিয়েটারের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজস্ব ধারা ও তত্ত্ব নির্মাণের মধ্য দিয়ে এমন এক থিয়েটার সৃষ্টি করতে তৎপর হলেন, যে থিয়েটার যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে এবং জনগণকে শ্রেণীসংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করবে। ব্রেস্ট বুঝেছিলেন প্রথাগত থিয়েটার-এর খোলনলচে না পাল্টালে কিছু করা যাবে না। বিশ শতকের শেষার্ধ থেকেই তাই ব্রেস্ট বুর্জোয়া থিয়েটারকে নতুন আঙ্গিক ও বুর্জোয়া মতাদর্শের বৈপরীত্যে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারায় ঢেলে সাজালেন। নিজেই তাঁর নামকরণ করলেন ‘এপিক থিয়েটার’। যদিও এই ‘এপিক থিয়েটার’ ধারণাটি ব্রেস্টের একার নয়।
পিসকাটরের স্ত্রী মারিয়া লে পিসকাটর দাবি করেন, এপিক থিয়েটারের জন্ম বিশের দশকের বিক্ষুব্ধ বার্লিনের কঠোর বাস্তবভূমিতে।
সক্রেটিস, দিদেরো কিংবা শিলার তো নয়ই, মার্কসকেও এপিক থিয়েটারের সৃষ্টিকর্তা বলা চলে না। মারিয়া লে পিসকাটর বোঝাতে চান, এপিক থিয়েটার কারো একার সৃষ্টি নয়। এপিক থিয়েটারের স্রষ্টা গোটা একটি প্রজন্ম। মহাযুদ্ধের পরবর্তী বিশের দশকের ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে . এপিক থিয়েটারে জন্ম। একক কোনো প্রচেষ্টায় নয়, যৌথ উদ্যোগে গড়ে উঠেছিলো এপিক থিয়েটার।
সামিল হয়েছিলেন নাট্য পরিচালক পিসকাটর, কবি ব্রেস্ট, বার্লিনের নাট্য ব্যক্তিত্ব গেওর্গ গ্রোসৎঞ্জ, ভাল্টার মেহরিং, নাট্যকার এর্নস্ট টলার এবং মঞ্চ নির্মাতা ভাল্টার গ্রোপিউস। যুদ্ধের আঘাতে যেমন এঁরা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন, তেমনিই এই যুদ্ধই আবার এঁদের শিল্প সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছিলো। শুধু রাজনীতিগত দিক থেকেই নয়, নৈতিক, সামাজিক এবং সৌন্দর্য্যচেতনায়ও বিদ্রোহ সঞ্চারিত হয়েছিলো। কিন্তু এঁরা শুধু বিদ্রোহী ছিলেন না, বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন। সন্দেহ নেই, সেক্ষেত্রে ব্রেস্ট ছিলেন অগ্রগণ্য এবং তাঁর প্রতিভা সকলকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলো।
ব্রেস্ট কেন তাঁর থিয়েটারের এপিক নামকরণ করলেন? এপিক বা মহাকাব্য বহু ঘটনাকে এক সঙ্গে সমান্তরাল রেখায় উপস্থিত করে ঘটনাকে ইতিহাসের ব্যাপ্তি আর দর্শনশাস্ত্রের গভীরতা দিতে পারে। দীর্ঘদিন পর্যন্ত নাটক ছিলো সমাজের দর্পণ। ব্রেন্টের এপিক থিয়েটারের দাবি নাটককে শুধু সমাজের দর্পণ হয়ে থাকলে চলবে না, সমাজের বিশাল ভাঙাগড়ার ব্যাখ্যাকারও হতে হবে। শ্রেণীসংগ্রামের জটিল বিষয়গুলিকে রূপ দিতে হবে, সবরকম দ্বন্দ্বের স্বরূপ খুলে ধরতে হবে দর্শকদের সামনে। দর্শককে তার নিজের জগৎ সম্পর্কে সচেতন করে তোলাই হবে এপিক থিয়েটারের মূল কাজ, যাতে জগৎকে পরিবর্তন করার কাজে সে হাত লাগায়।
তিনি বাস্তববাদী নাট্যধারার বিপরীতে তাঁর মহাকাব্যিক নাট্যভাবনাকে দাঁড় করান। তাঁর মতে বাস্তববাদী নাটক সমাজের সমস্যাগুলোকে চিত্রায়িত করলেও পরিবর্তনশীল দুনিয়া ও তার দ্বন্দ্বগুলিকে ধরতে পারে না, কারণ সে নাটক মার্কসীয় দ্বান্দ্বিকতার ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। এপিক থিয়েটার প্রচলিত নাট্যরীতির বিপরীতে একটি স্বতন্ত্র ধারা, সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার আরেকটি শক্তিশালী পদ্ধতি।
থিয়েটারের ইতিহাসে এপিক থিয়েটার হলো বুদ্ধিনির্ভর বিশ্লেষণী ভঙ্গির থিয়েটার, যেখানে মার্কসবাদের দ্বান্দ্বিকতার প্রয়োগই হবে প্রধান বিষয়। যুক্তির শান্ত পরিবেশনে যেমন মার্কসবাদী তাঁর বিপ্লবের তত্ত্ব পৌঁছে দেন শ্রমিকশ্রেণীর কাছে, নাট্যকারও তেমনি বিশ্লেষণী কৌশলে দর্শককে বোঝাবেন সমাজ বিবর্তনের ধারা, সমাজ পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা। দর্শনের জায়গা দখল করবে নাটক ঠিক হেগেল যেভাবে বলেছিলেন, এপিক পদ্ধতিতে শিল্প উন্নততর হতে হতে দর্শনে রূপান্তরিত হবে। চিন্তার রাজ্যে উন্নীত হয়ে যাবে। মার্কস যদিও বিষয়টাকে দেখেছেন… ঠিক উল্টো দিক থেকে। মার্কসের মতে দর্শনই যাবে লুপ্ত হয়ে। শিল্পই থাকবে, দর্শন নয়।
ব্রেস্ট একজন বিপ্লবী নাট্যকার। তিনি নিরপেক্ষ নন, প্রতি মুহূর্তে তিনি শ্রেণীসংগ্রামের বিশ্লেষক ও প্রচারক। নিজস্ব মতামত বা উদ্দেশ্য ব্যতীত যেহেতু কিছুরই শিল্পরূপ দেয়া যায় না, সেজন্য কোনো নাট্যকারই নিরপেক্ষ নন, কোনো না কোনো পক্ষে তিনি থেকেই যান। যুদ্ধমান দুই শ্রেণীর বাইরে তাঁরা কেউ যেতে পারেন না, কোনো না কোনো পক্ষের হয়ে তাঁরা মতামত দিয়ে ফেলেন। যাঁরা বিপ্লবী তাঁরা নিজের পক্ষে সচেতনভাবে এবং সাহসের সঙ্গেই দাঁড়িয়ে যান, দোদুল্যমানতায় ভোগেন না। সে বিচারে ব্রেস্ট বিপ্লবী নাট্যকার তো বটেই একই সাথে মার্কসবাদী নাট্যকার। তিনি তাঁর সব নাটকেই নানাদিক থেকে বুর্জোয়া সমাজকে আঘাত করেছেন, সমাজতন্ত্রের পক্ষেই তাঁর শ্লোগান।
তাঁর বক্তব্য ছিলো, ‘আপনি যদি নিরপেক্ষ হন, শ্রেণীসংগ্রামে যদি আপনার আগ্রহ না থাকে, তবে আমার নাটক স্পর্শ করবেন না।’ মার্কসীয় দর্শনের সাথে সম্পৃক্ত থেকে তিনি সব সময় শ্রেণীসংগ্রামের নাটক লিখে গেছেন। তাঁর নাটক প্রচারধর্মী হলেও তা সস্তা কচকচানি নয়। পৃথিবীর যে-কোনো বড় নাট্যকারের মতোই তার নাটকের রস, চরিত্র সৃষ্টি বহুগুণে সমৃদ্ধ। তিনি বলেছিলেন যে, সমালোচকরা যদি আমার থিয়োরি না দেখে থিয়েটারটা দেখে আসত, তাহলে দেখতে পেত যে এটা একটা থিয়েটার, যে থিয়েটারে কল্পনা আছে, রসকিতা আছে, এবং যার একটা অর্থ আছে।
বিশেষ করে চরিত্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে তিনি এক নতুন দিগন্ত উম্মোচন করেছেন। মান ইস্ট মান নাটক লেখার সময়ই তিনি যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন তাহলো মানুষকে আমরা কীভাবে দেখবো। তাঁর চোখে সম্পূর্ণ ভালো, সম্পূর্ণ খারাপ মানুষ বলে কিছু নেই। সব মানুষই দোষ এবং গুণ দুয়েরই অধিকারী। সব নাটকেই তাঁর এ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে। দ্বান্দ্বিকতার ভিতর দিয়ে প্রতিটি মানুষের চরিত্রের বৈপরীত্যকে তিনি হাজির করেন তাঁর নাটকগুলোতে। তাঁর নাটকের চরিত্ররা তাই নির্মমভাবে বাস্তব ও দ্বন্দ্বজর্জর। সেখানে প্রতি মুহূর্তে মানুষের নানা বৃত্তিকে পরীক্ষা করা হচ্ছে শ্রেণীর ভিত্তিতে। বিশুদ্ধ কোনো মানুষের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না তাঁর নাটকে। বিশুদ্ধ প্রেমও নয়।
নারী-পুরুষ সম্পর্ক চিত্রায়নে বিশুদ্ধ প্রেম, নিষ্পাপ আবেগ আর নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ প্রভৃতি মিথ্যাকে কোনো আমল দিতেই রাজি হননি তিনি। তাঁর মতে বুর্জোয়া সমাজে প্রেম হলো লেনদেনের একটা হিসাবি সম্পর্ক। এ সমাজে মানুষ তার সুকুমার বৃত্তি থেকে বিয়োজিত। তার ভালবাসা, স্নেহ-মমতা, শ্রদ্ধা টাকার ক্লেদাক্ত স্পর্শে কলুষিত। সেজন্য ব্রেস্টের নাটকে আছে অবহেলিত মানুষের ছবি। নানা লোকঠকানো বৃত্তির মানুষ এবং নানা প্রকার উচ্ছৃবৃত্তির মানুষ। নিজস্ব বৈপরীত্য নিয়ে এসব চরিত্র হাজির হয়েছে। বুর্জোয়া থিয়েটারের মতো এরা কেউ ছাঁচে ঢালা নয়।
বুর্জোয়া থিয়েটারে সমষ্টিকে বাদ দিয়ে ব্যক্তিই বড় হয়ে দেখা দেয়। সেখানে নাটকের চরিত্রগুলোকে দেখানো হয় এমন অনড় যেন বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তারা রূপান্তরহীন, পরিস্থিতিবিহীনভাবেও যেন বা তারা অস্তিত্বময়।
বুর্জোয়া থিয়েটারে উপস্থাপনা ব্যাপারটা হামেশাই দ্বন্দ্ব বিরোধগুলোকে মুছে ফেলে, শ্বাসরুদ্ধ করে দেয়, ঘটনাবলীকে হাজির করে এমনভাবে যেন সে-সব কেবল ওভাবেই ঘটতে পারে, আর কোনভাবে নয়। বুর্জোয়ারা সেই ব্যক্তি মানুষটাকে যেভাবে দেখাচ্ছে, সত্যিকার অর্থে তার আসল রূপটা কী, সেটাকেই ব্রেস্ট দেখাতে চেয়েছেন তাঁর সব নাটকে।
তাঁর চরিত্ররা বিপ্লবী কি অবিপ্লবী সেটা বড় কথা নয়-কিন্তু প্রায় সকলেই কেন নানারকম আপোস, চুরি, জালিয়াতি, অসাধু কার্যকলাপে জীবন কাটায়-এ নিয়ে সমালোচক মহলে বহু বাদানুবাদের ঝড় উঠেছে। বলা বাহুল্য এ ক্ষেত্রেও তিনি মার্কসবাদী হিসেবে বুর্জোয়া নাট্যধারার মহানায়কদের আস্ফালন অগ্রাহ্য করে মূর্তিমান অনিয়মের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন, প্রত্যেক মানুষ যদি মানব সমাজের ইতিহাস হয় তাহলে মানুষের বিশ্লেষণে ইতিহাসের প্রভাব, নানা চিন্তা ও ঐতিহ্যের প্রভাব অস্বীকার করলে মানুষের বিশ্লেষণ অসম্পূর্ণ ও ভ্রান্ত হতে বাধ্য। ব্যক্তিগতকে তাই তিনি ঐতিহাসিকে পর্যবসিত করেন, যেখানে ব্যক্তির ইতিহাসের মধ্যে সমাজের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ধরা পড়বে। ব্রেস্টের কাছে শিল্পোন্নত সমাজে ব্যক্তি হলো এক ক্ষুদ্র অণুর মতো বা বিরাট মেশিনের নাট-বল্টুর মতো।
তিনি মনে করতেন, বুর্জোয়া নাটকের প্রবক্তারা ইতিহাস ও সমাজকে বাদ দিয়ে ব্যক্তি মানুষকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে, বিশ্লেষণ করতে গিয়ে একটি খণ্ডিত মানুষেরই ছবি আঁকছেন মাত্র। তিনি বলছেন, খণ্ডিত জীবনের চিত্র এঁকে মোহ সৃষ্টি করা থিয়েটারের উদ্দেশ্য নয়, দর্শকদের মোহমুক্তি ঘটিয়ে সত্যের দিকে নিয়ে যাওয়াই থিয়েটারের লক্ষ্য। পূর্ণ মানুষের ছবি চাই সেখানে। মানুষের শ্রেণীচরিত্র, ব্যক্তিগত গুণাগুণ, মহত্ব ও নীচতা সব মিলিয়ে তার আস্ত একটি ছবি আঁকতে চেয়েছেন তিনি। মাদার কারেজ নাটকে তাই স্নেহশীল মাতার পাশাপাশি বিরাজ করে মুনাফালোভী, অর্থগৃধনু মা, যিনি মুনাফার স্বার্থে নিজের ছেলেকে চিনতে অস্বীকার করেন।
গ্যালিলিওর মতো মহান বিজ্ঞানীও ভালো খাবার এবং পানীয়র প্রতি বিশেষভাবে লালায়িত। তিনি তাঁর গবেষণা বাধাগ্রস্ত হবে বলে প্লেগের মতো মহামারীকে অগ্রাহ্য করেন আবার চার্চের ভয়ে কাপুরুষের মতো আচরণ করেন। তিনি ভিন্ন বৈজ্ঞানিকের আবিষ্কার নিজের নামে চালাতেও দ্বিধা করেন না, আবার বিজ্ঞানের স্বার্থেই নিজেকে উৎসর্গ করেন। সমাজের ঘটনাবলীর সাথেই তার চরিত্র বাঁধা পড়ে থাকে।
সেজন্য হিটলারের ছবি আঁকতে গিয়ে ব্রেস্ট শুধু হিটলারের ঘাড়েই সব দোষ চাপান না, ফ্যাসীবাদের সব দায়িত্ব বিশেষ ব্যক্তির গলায় ঝোলান না। তিনি দেখিয়ে দেন কেন, কাদের উদ্দেশ্যে, কীভাবে ফ্যাসীবাদ জাতি বৈষম্যের ঘৃণ্য কদর্যতা কার্যকরী করে। ব্যক্তি সেখানে উপলক্ষ মাত্র। তিনি মনে করতেন, বর্বরতা বর্বরতার জন্ম দেয় না, বরং তা আসে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড থেকে, বর্বরতা ছাড়া ব্যবসায়িক পেশা টিকতেই পারে না। পুঁজিবাদী ব্যক্তিস্বার্থপরতাই ফ্যাসীবাদের জন্ম দেয়। ব্যক্তি সেখানে নিজস্ব ভূমিকা রাখলেও বিরাট ইতিহাসের সে ক্রীড়নক মাত্র। ব্যক্তির বিচার হবে তাই ইতিহাসের আলোকেই। ব্রেশন্টের নাটকের কোনো চরিত্র তাই সমাজ বিচ্ছিন্ন, রাজনীতি বিচ্ছিন্ন মানুষ নয়।
ব্রেশটের এপিক থিয়েটারের আলোচনায় এ্যারিস্টটল প্রসঙ্গ অপরিহার্য। ব্রেশটের থিয়েটারের প্রধান পরিচয় সে এ্যারিস্টটল এর নিয়ম বিধির বিরোধী। রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের মতে, সে সচেতনভাবে অ-আরিস্তোতলীয়।” এ্যারিস্টটল নাট্যশালার নিয়মবিধি লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে শাসকশ্রেণীর মতামতই গ্রহণ করেছিলেন। নাট্যশাস্ত্রের আলোচনায় তিনি বলেছিলেন ট্র্যাজেডির নায়কের চিন্তা হবে উচ্চ আদর্শে অনুপ্রাণিত, স্বভাবতই ব্রেশট যার বিরোধী। এ্যারিস্টটল বলছেন নায়ক হবে নীতিবান, যার থাকবে ন্যায়বোধ, জ্ঞান, সাহস, সংযম ইত্যাদি। অথচ মার্কসবাদের বিচারে সর্বাঙ্গ সুন্দর কোনো মানুষ নেই, মার্কসবাদ তাই এ্যারিস্টটলের এই চিন্তারও বিরুদ্ধে।
এ্যারিস্টটল এক আদর্শবান চরিত্রের কথা বলছেন অথচ মার্কসবাদে কোনো অনড় আদর্শ বলে কিছু নেই, সব আদর্শই যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়। এ্যারিস্টটল যে শুধু উচ্চ আদর্শের কথা বলেছেন তাই নয়, তিনি বলেছেন নায়কের থাকবে চরিত্রের একটিমাত্র দোষ, সেই দোষেই ট্র্যাজেডির নাটকে ঘটবে তার সর্বনাশ। সেই দোষগুণ মাপবার মাপকাঠি হবে ‘সংবিধান’ ‘রাষ্ট্রের আইন’ এগুলি। যেহেতু নায়কের দোষগুণ বিচার হবে রাষ্ট্রীয় রাজনীতির নিরিখে, সেহেতু দর্শকদের রাজনৈতিক অপরাধ প্রবণতাকেই তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি শুধু অভিজাতদেরকে নায়ক হিসাবে দেখতে চেয়েছেন এবং নায়ক সম্পর্কে বদ্ধমূল একটি ধারণায় এসেছিলেন। যদিও তিনি নায়ক কথাটি ব্যবহার করেননি।
বোঝাই যাচ্ছে সামাজিক আচরণ বিধি লঙ্ঘন করতে পারে এমন সব প্রবণতা দর্শকদের মন থেকে দূর করাই ছিলো এ্যারিস্টটলের লক্ষ্য। নাট্যশালা ছিলো সেখানে নীতিকথা প্রচারের পাশাপাশি ভীতি প্রদর্শনের, দমননীতির সহায়ক, বলপ্রয়োগের বিকল্প। দেখাই যাচ্ছে, এ্যারিস্টটলের নাট্যরীতির মূল প্রেরণা হচ্ছে দর্শকদের শিক্ষাদান যেখানে নাটক হবে বক্তব্য প্রধান। ব্রেশটের সাথে এখানে তাঁর মিল থাকলেও রয়েছে চরম অমিল।
শিক্ষা বলতে ব্রেষ্ট নীতি শিক্ষা বা ধর্ম শিক্ষার মতো কোনো শিক্ষা বোঝাননি। তিনি শিক্ষা বলতে বোঝাতে চান ভাবতে শেখা, জানতে শেখা, বিচার করতে শেখা। দর্শককে সমস্যার মুখোমুখি, বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করানো। ব্রেস্ট দেখান সমস্যাকে, সমাধানের ভার দেন দর্শকদের ওপর। এ্যারিস্টটল চেয়েছেন দর্শকরা নাটকের নায়কের সাথে একাত্ম হবে, নায়কের পক্ষ নেবে, নায়কের প্রতি তার সহমর্মিতা সৃষ্টি হবে, নায়কের উচ্চ আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হবে, আবার নায়ক যখন নিজের দোষত্রুটি বুঝে নিয়ে পরিশুদ্ধ হবে, দর্শকও তার সাথে সাথে পরিশুদ্ধ হবে।
কিন্তু ব্রেস্ট মনে করতেন যে, দর্শককে একাত্ম বা সহমর্মী করে তোলার চেয়ে তাদের ক্রিয়াশীল করে তুলতে হবে, চরিত্র ও ঘটনাকে বিশ্লেষণের সুযোগ দিতে হবে এবং তাদেরকে একটি সিদ্ধান্তে আসার জায়গায় নিয়ে আসতে হবে। দর্শক কিন্তু সিদ্ধান্ত নেবে স্বাধীনভাবে, নাটকে বর্ণিত ঘটনা বা তথ্যের ভিত্তিতে।
নিজের নাট্যরূপ দেয়া দি মাদার সম্পর্কে ব্রেস্ট লিখেছিলেন, নাটকটি শিক্ষামূলক লেখার ধরনে লেখা, নাটকটি ভাববাদ বিরোধী, বস্তুবাদী, অ-আরিস্তোতলীয় নাটক। এ নাটক কখনই এ্যারিস্টটলীয় নাটকের মতো দর্শকের নিষ্ক্রিয় একাত্মতার সাহায্য নেয় না। ভাগ্যকে অপ্রতিরোধ্য মনে করে এ নাটক যেমন তার নায়ককে পৃথিবীর কাছে সঁপে দেয় না, তেমনি দর্শককে নাটকীয় অভিজ্ঞতার কাছে সম্পূর্ণ সঁপে দেবার কথাও ভাবতে পারে না।
পৃথিবীকে বদলানোর উদ্দেশ্যে যে বিশেষ বাস্তবমুখী দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন দর্শককে তাই শেখানোর জন্য এ নাটকের প্রচেষ্টা। ব্রেস্ট বলেন যে, এ্যারিস্টটলের নাট্যশাস্ত্রে ভয় ও করুণা উদ্রেক করার মতো ঘটনা মানেই হলো দর্শকদের মনের মধ্যে কতক আবেগের সঞ্চার করা, তিনি যেন কোনো বিচার বিবেচনা না করতে পারেন তারই ব্যবস্থা পাকা করা। সেজন্য এ্যারিস্টটলের চিন্তার বিরুদ্ধে একটি পুরাতন প্রশ্নের অবতারণা করা হয়েছে ব্রেশটের এপিক তত্ত্বে। আর তাহলো বিপ্লবী নাট্যকার দর্শকের আবেগে ঘা দেবেন, না বুদ্ধির, কাছে আবেদন রাখবেন।
সবচেয়ে জটিল পরিস্থিতি সবচেয়ে রক্তাক্ত বিরোধকেও বুঝতে বা সামাল দিতে পারে মানুষের যুক্তি কিংবা বুদ্ধি। যুক্তির কাছে আবেদন রাখাটাই তাই ব্রেশটের কাছে প্রধান ব্যাপার। নাটক ধাক্কা মারবে দর্শকদের বিচার বুদ্ধির দরজায়। সেজন্য তাঁর নাটকে আবেগের রাশ টেনে রাখা হয়। সব মিলিয়ে আবেগও হয়ে ওঠে যুক্তির মতোই। দর্শকদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে দেয়ার জন্যই তা করা হয়ে থাকে।
দর্শকদের কাছে তিনি যা চেয়েছিলেন তারা হবে সাংসদের মতো, নাটক দেখতে দেখতেই বিষয়বস্তুর ঠিক ভুল বিচার করবে। এ্যারিস্টটল যেখানে একাত্ম হবার কথা বলেছেন, ব্রেস্ট সেখানে বলেছেন বিচ্ছিন্নতার কথা। নাটকের ঘটনাকে দর্শক দেখবে বিচারকের ভঙ্গিতে, কোনো পক্ষের সাথেই একাত্ম হয়ে নয়। নাটক দেখতে দেখতে দর্শক ঠিক ভুল নির্বাচন করবে। সেটাই ব্রেশটের বিখ্যাত বিয়োজন বা এলিয়েনেশন তত্ত্ব।
তাঁর বিয়োজন তত্ত্বের মূল লক্ষ্য ছিলো দর্শক নাটক দেখতে এসে যেন নিষ্ক্রিয় না হয়ে পড়ে এবং সে যেন সচেতন থাকে যে সে নাটকই দেখছে, কোনো সত্য ঘটনা নয়। সমালোচকের মতো তার বিচার বুদ্ধিকে যেন সেক্ষেত্রে সে কাজে লাগাতে পারে। দর্শক যাতে কোনো ভাবেই একাত্ম না হতে পারে সেজন্য চমক সৃষ্টি করতেন তিনি নাটকে, যাতে দর্শক একাত্মতা ভেঙে বের হয়ে আসতে পারে। দূরত্ব স্থাপন ও চমক-এসবই রাজনৈতিক প্রয়োজনে সৃষ্ট। চমক, দূরত্ব স্থাপন বা বিয়োজন-সবকিছুরই পেছনের উদ্দেশ্যটা দর্শককে বিচার বিশ্লেষণ করতে শেখানো। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে সাহায্য করা।
বড় কথা হলো, অন্য অনেক ব্যপারে এ্যারিস্টটল-এর বিরোধী হলেও অন্তত একটি ব্যাপারে ব্রেশট তাঁর সঙ্গে একমত। চরিত্র নয়, আখ্যানই নাটকের প্রাণ। নাটকের মূল কথাটি গেঁথে দিতে হবে দর্শকের মনে। ব্রেশট সবসময় চেষ্টা করেছেন দর্শক প্রতিক্রিয়া যেন তাঁর উদ্দেশ্যের সঙ্গে মেলে। দশজন দর্শক দশ রকম বুঝবে এমন সম্ভাবনা তিনি রাখতে চাননি। নাট্যকারের চাওয়াটাই ব্রেশন্টের কাছে সবচেয়ে বড় কথা।
তার মানে এ নয় যে, ব্রেস্ট তাঁর চিন্তাকে চাপিয়ে দিতে চাইছেন দর্শকদের ওপর। ব্রেস্ট যা করতে চাইছেন, দর্শক যেন তা উপলব্ধি করতে পারে সেটাতেই তিনি জোর দিয়েছিলেন। বক্তব্য পরিষ্কার না বুঝতে পারলে দর্শক তাকে গ্রহণ বা বর্জন করবে কিসের ভিত্তিতে। নাট্যকারের বক্তব্যই যদি দর্শক সঠিকভাবে বুঝতে না পারে সমাজের সাথে তাকে মিলিয়ে দেখবে কীভাবে। ব্রেস্ট তাই কোনো দুর্বোধ্যতার পথ ধরেননি। সর্বদাই সহজ সরল পথ ধরে এগিয়েছেন। দুর্বোধ্যতার বিরুদ্ধেও ছিলো তাঁর লড়াই।
রাজনৈতিক নাট্যকারদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে সফল ব্যক্তি। তিনি সফল ছিলেন দুভাবে। প্রথমত তিনি মার্কসবাদকে যথাযথভাবে নাটকে প্রয়োগ করেন যা এর আগে আর কেউ পারেননি। ব্রেস্টের দ্বিতীয় সাফল্য ছিলো, বুর্জোয়া নাটক যখন দর্শক হারিয়ে ফেলছিলো তাঁর নাটক আবার শূন্য মিলনায়তন দর্শক সমাগমে পূর্ণ করলো।
মার্কসবাদের প্রতি আস্থাশীল ব্রেশটের থিয়েটার চেয়েছিলো পুঁজিবাদী সমাজের নগ্ন স্বরূপ তুলে ধরতে, সে সাথে নাট্যজগতের আর একটি প্রশ্নকে তিনি সমান গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সে প্রশ্নটি হচ্ছে থিয়েটারের দর্শকের প্রশ্ন। মার্কসবাদী রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি যার আনুগত্য সদম্ভে ঘোষিত হয়েছিলো, থিয়েটার চর্চার ক্ষেত্রে তার বিবেচনায় প্রধান স্থান পেয়েছিলো দর্শকরা।
তিনি নাট্য রচনা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে সকল কিছুর আগে মাথায় রাখতেন দর্শকদের। তাঁর চিন্তায় কোনো ভঙ্গিই সার্থক নয় যদি না তা দর্শককে আকৃষ্ট করে, উদ্বুদ্ধ করে। তিনি বিশ্বাস করতেন, দর্শককে বাদ দিয়ে থিয়েটারে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে পারে না। সর্বাগ্রে দর্শককে মিলনায়তনে নিয়ে আসতে হবে। তাঁর নাট্য চিন্তার এটাই আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর নাটকের দর্শকরা যেন সুখী বা তৃপ্ত হয়ে প্রেক্ষাগৃহ থেকে বের হয়ে যায়।
নাট্যকার হিসাবে তিনি জানতেন, দর্শকরা বিনোদন লাভের জন্য থিয়েটারে আসে। তিনি তাঁদের খাটো করে দেখতেন না। তাঁর নাট্যচিন্তা নিয়ে যে সব দীর্ঘ আলোচনা রয়েছে, ‘ফর্মের খোঁজে ব্রেফ্ট পিকিং অপেরার কাছে গেছেন, কাবুকি বুঝতে চেয়েছেন, প্রাচীন সংস্কৃত নাটক পড়েছেন, মার্কস অধ্যয়ন করেছেন’-এর মূল উদ্দেশ্যই ছিলো দর্শক চিত্তকে জয় করা। তিনি এটা বিশ্বাস করতেন না যে, শুধুমাত্র হৃদয় বৃত্তির জন্যই দর্শক নাটক দেখতে চায়। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, শিক্ষাদান ও আনন্দ দান দুটোই থিয়েটারের কর্তব্য এবং দর্শকদের সম্মান করতে গেলে তাঁরা যে নাটক বুঝবার মতো উচ্চ বুদ্ধি রাখে, একথা মনে রাখা ভালো। দর্শকদের চিত্তকে জয় করবার জন্য তিনি ‘নাটকে বিনোদন বা-আমোদের ওপর গুরুত্ব দিতেন।
তিনি দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছেন যে, যদি আনন্দ দানের আয়োজন না থাকে তাহলে থিয়েটার সামগ্রিকভাবে ‘শিক্ষা’ দানে সফল হবে না। তাঁর কাছে যে প্রশ্নটি প্রাধান্য পেয়েছিলো তা হলো শিল্প-সংস্কৃতি কার জন্য? কয়েকজন রুচিবান দর্শকদের জন্য, না ব্যাপক জনগণের জন্য? তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন থিয়েটারের লক্ষ্য হবে মুষ্টিমেয় দর্শক নয়, পুরো সমাজ। জার্মান থিয়েটারের তখন করুণ চিত্রই দেখতে পাওয়া যাচ্ছিলো। সেখানে থিয়েটার থাকলেও থিয়েটারের দর্শক ছিলো না। জার্মান পেশাদার থিয়েটারগুলো তখন রাজনীতি থেকে পালিয়ে ভঙ্গিসর্বস্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। দু-চারজন যাঁরা ফ্যাসিবাদ বিরোধী বক্তব্য রাখতে চেষ্টা করছিলেন, সেগুলোও ছিলো বিভ্রান্তিকর।
থিয়েটার সম্পর্কে সঠিক চিন্তাই যেন কারো মধ্যে ছিলো না। নাট্যের নানা উপাদান মঞ্চ নাটকে ব্যবহার করা বা বিষয়বস্তু উপস্থাপনার সত্যিকারের পদ্ধতি খুব অল্পই এইসব প্রযোজনায় দেখা যেতো। দর্শকদের সঙ্গে সঙ্গে এ সময় ব্রেস্ট নিজেও পেশাদার থিয়েটারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু তিনি থিয়েটারের ক্ষমতা সম্পর্কে আস্থা হারাননি। তিনি বুঝতে চাইছিলেন কী করে থিয়েটারকে পুঁজিবাদ তথা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায়, কীভাবে ফ্যাসিবাদ বিরোধী বক্তব্য দর্শকদের মধ্যে পৌঁছে দেয়া যায়। দর্শকরা যখন থিয়েটার ছেড়ে চলে গেলো, তিনি মনে করেননি যে, দর্শকরা থিয়েটার বোঝে না। তিনি উপলব্ধি করলেন সে ব্যর্থতা নাট্যকার ও পরিচালকদের। তাঁরা নাটক দর্শকদের ভালো লাগাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
তিনি মনে করতেন, যে থিয়েটারের সাথে জনগণের সম্পর্ক নেই সে থিয়েটার অর্থহীন। সে থিয়েটার জানেই না জনগণ তার কাছ থেকে কী চায়। তাঁর নাট্য সাধনার তাই আর এক মূল লক্ষ্য ছিলো জনগণ থিয়েটারের কাছে কী চায়, কী আশা করে সেটা গভীরভাবে অনুধাবন করা। দর্শকের অন্তরকে বোঝা, তার চিন্তার জগতের সাথে পরিচিত হওয়া। সেজন্য প্রাচীন কাল থেকে দেশে-বিদেশে যে থিয়েটার জনগণের-মন জয় করে এসেছে, সে থিয়েটারকে তিনি প্রত্যক্ষভাবে অবলোকন করতে চেয়েছেন, সে সম্পর্কে অধ্যয়ন করেছেন। কোনো শিল্প সম্পর্কে তাঁর শুচিবাই ছিলো না। তিনি চ্যাপমানের ব্যালাড থেকে চীনের থিয়েটার, সর্বক্ষেত্র থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতেন।
কিন্তু প্রয়োগের ব্যাপারে তিনি সবসময় মগজে রাখতেন যে বিষয়গতভাবে দর্শক যেন কোনো বিভ্রান্তির সম্মুখীন না হয়। থিয়েটারের ইতিহাসে চোখ বুলিয়ে তিনি আবিষ্কার করলেন যে, চলতি থিয়েটারে ‘আমোদ’ জিনিসটির খুব অভাব। তিনি তৎকালীন থিয়েটার সম্পর্কে লিখেছিলেন, থিয়েটারের দর্শকদের জন্য সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপারটি হলো যে সেখানে আনন্দ জিনিসটাই নেই। তিনি বলতেন, থিয়েটারের এক বিশেষ কর্তব্য রয়েছে দর্শকদের প্রতি এবং সেটা হলো আনন্দ দান।
পিপলস থিয়েটার বা গণনাট্য সম্পর্কে রম্যা রলাঁ ঠিক একথাই বলেছিলেন। পিপলস থিয়েটারে সবার আগে অবশ্যই যা প্রয়োজন, যা প্রাথমিক শর্ত তা হলো, এই থিয়েটারকে অবশ্যই বিনোদন দিতে হবে। বিনোদন বা আমোদ বলতে ব্রেস্ট কখনই সস্তা জনপ্রিয়তার কথা বোঝাননি। তিনি মনে করতেন কেবলমাত্র যুক্তিগ্রাহ্য এবং চিস্তাদীপ্ত মানসিকতার দ্বারাই সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নতুন প্রাণবস্তু আমোদের সৃষ্টি করা সম্ভব। চিন্তার কেন্দ্র ‘গুরু মস্তিস্ক’কে যা নাড়া দিতে পারে, তাই হলো সফল বিনোদন।
তাঁর ধারণায় থিয়েটারে আমোদ জিনিসটি যুক্ত করতে উপরি পরিশ্রমের প্রয়োজন নেই, দৈনন্দিন জীবনের ঘটনায় যে বৈজ্ঞানিক কার্যকারণ সেটাই হবে আমাদের থিয়েটারের আমোদের উৎস। মানুষকে যে কখনই পুরোপুরি চেনা যায় না, চূড়ান্তভাবে চেনা যায় না, সে যে এতো সহজে নিঃশেষ হওয়ার নয়, তার মধ্যে যে এতো বিচিত্র সম্ভাবনার বৈভব লুকিয়ে আছে, এটা জানা পরম আনন্দের ব্যাপার। পরিবেশ মানুষকে বদলাতে পারে, মানুষ নিজেও পারে পরিবেশকে বদলাতে, এই বোধ বড় আনন্দের।১৭ সেজন্য মানুষের মনের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দরকার। সেই বিশ্লেষণে নাট্যকার যদি দক্ষ হয়ে উঠতে পারেন, থিয়েটার তার মধ্য দিয়েই হয়ে উঠতে পারে হৃদয়গ্রাহী। সেজন্য কিছু শেখাও ব্রেশটের কাছে একটা বড় বিনোদন।
ঠিক এই ব্যাপারটাতেই মিউনিখের নাট্য জগতের দিকপাল ডেভিডকিন ব্রেশটের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। তিনি দেখলেন ডেভিডকিনের থিয়েটারে দর্শকের অভাব নেই। তিনি ভালো করে খেয়াল করলেন যে, ডেভিডকিন দর্শকদের ভুলতে দিতেন না তারা থিয়েটারে বসে আছে। দর্শকদের তিনি গুরুত্ব দিতেন এবং দর্শকদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তিনি সজাগ থাকতেন।
ডেভিডকিনের নাটকের সবচেয়ে নতুনত্ব ছিলো তাঁর ভঙ্গিতে নয় বরং নাটকের সহজ সরল সংলাপে এবং ঘটনায় এবং নীচুতলার মানুষদের জীবনযাত্রার তীব্র দ্বন্দ্বের মধ্যে। ব্রেস্ট বুঝলেন, আনন্দ দানের জন্য বিষয়বস্তুই হবে প্রধান, ভঙ্গি শুধু তার পিছু নেবে বিষয়বস্তুকে সহজ সরলভাবে উপস্থাপন করার জন্য। তিনি এটাও উপলব্ধি করলেন, দর্শকদের ভালো লাগার মতো শ্রেণী-সচেতন নাটক লিখতে হলে আগে ইতিহাসকে ভালো করে বুঝতে হবে এবং যে অর্থনৈতিক বন্ধনের মধ্যে মানুষ বাঁধা পড়ে থাকে সেটা বুঝতে না পারলে মানুষের আসল সত্তাই আবিষ্কার করা সম্ভব নয়।
সেজন্য বৈপ্লবিক নাটকের কাজ হবে মানুষকে তার আসল পরিচয়ের মুখোমুখি দাঁড় করানো। মার্কসবাদ অধ্যয়নের মধ্য দিয়েই ব্রেস্ট বুঝেছিলেন, মানুষ নিজেকে জানতে চায়, সে অন্য মানুষকেও বুঝতে চায়। মানুষে মানুষে পারস্পরিক সম্পর্ক কী এবং সমাজের সাথে তার বন্ধন কোথায়, কীভাবে-তা আবিষ্কার করতে পারার মধ্যেও আছে এক ধরনের আনন্দ। ব্রেস্ট আনন্দকে এভাবেই দেখেছিলেন। তাঁর মতে জটিল সময়কে সহজভাবে উপস্থাপন করাই নাট্যকারের সবচেয়ে বড় দক্ষতা। দর্শককে আমোদ দানের জন্যই থিয়েটারের গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো বলতে হবে এমনভাবে যেন তা হয় অতি সহজ সরল। থিয়েটারকে শুধু গালভরা বুলি দিয়ে ভরিয়ে তুললে হবে না।
বারনার্ড গুলেমিনকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘কিছু লেখক আছেন যাঁরা আসলে ঘটনার ছবি আঁকেন। আমি তাঁদের মধ্যে একজন। তত্ত্ব উপস্থিত করে আমি কাউকে কিছু বোঝানো পছন্দ করি না। বরং একটা ঘটনা দিয়ে অনেক কিছু ভাববার অবকাশ করে দেওয়া যায়’।
– নাট্য রচনায় তিনি জটিলতা ও তত্ত্বের কচকচানিকে একেবারে জায়গা দিতেন না, যদিও আবেগ, যুক্তিবোধ ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের এক চমৎকার সমন্বয় সাধন করেছিলেন।
দর্শক থিয়েটারের কাছে কী চায় আর তিনি থিয়েটারের দর্শককে কী দিতে চান, এ ব্যাপারে তাঁর চিন্তা ছিলো পরিষ্কার। তিনি তাঁর দর্শককে দিতে চাইতেন মার্কসবাদের ধারণা, আর দর্শক থিয়েটারের কাছে চাইতো তার চিন্তা ও আবেগের তৃপ্তি। সাধারণত দেখা গেছে, রাজনৈতিক থিয়েটারের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় শিক্ষাগত দিকটির প্রতি জোর দিতে গিয়ে আমোদের দিকটি হারিয়ে যায়, থিয়েটার আর থিয়েটার থাকে না, হয়ে ওঠে পাঠশালা। ঠিক বিপরীত দিকে, কোনো কোনো থিয়েটারে দর্শককে আবেগ প্রবণতার খোরাক যোগাতে গিয়ে শিক্ষণীয় আর কিছুই থাকে না। তিনি চমৎকার ভাবেই এ দুয়ের মেলবন্ধন ঘটাতে পেরেছিলেন।
যতক্ষণ তাঁর দর্শকরা প্রেক্ষাগৃহে থাকতো তারা পেতো আনন্দ আর যখন বের হয়ে যেতো তখন সঙ্গে নিয়ে যেতো নতুন চিন্তা। নাট্য পরিচালক আউগুস্তো বোয়াল মনে করতেন, ব্রেন্ট সারাজীবন যা করে গেছেন তাহলো বিষয়বস্তু বিশ্লেষণে, আঙ্গিকে, অভিনয় ধারায় এবং দর্শকদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে মার্কসবাদের প্রয়োগ। কিন্তু কোনো একটি বিশেষ প্রযোজনা দেখেই সব দর্শক যে তৎক্ষণাৎ শিক্ষিত হয়ে পড়বেন ব্যাপারটাকে নাট্যপরিচালক আউগুস্তো বোয়াল সেভাবে দেখেননি। ব্যাপারটাকে তিনি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া হিসাবেই দেখেছিলেন।** ব্রেস্টীয় প্রযোজনা দেখতে দেখতেই দর্শকরা আস্তে আস্তে তাঁর পথে আসবেন কিংবা সমাজ বিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতন হবেন।
জার্মানীতে পিসকাটরই প্রথম রাজনৈতিক থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন এবং ব্রেশট মার্কসবাদী রাজনৈতিক থিয়েটার সম্পর্কে প্রথম একটি পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব দাঁড় করান। বিশের দশকের শেষে এসে জার্মানীতে এই রাজনৈতিক থিয়েটার চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। পিসকাটর ও ব্রেস্ট দুজনেই রাজনৈতিক থিয়েটার প্রতিষ্ঠায় বিপুল সাফল্য পেলেও ফ্যাসিবাদের উত্থান ও হিটলারের ক্ষমতা আরোহণের পর দুজনকেই জার্মান ছাড়তে হয়। পিসকাটর জার্মান ছেড়ে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। ব্রেস্ট প্রথম কোপেনহেগেন পরে নিউইয়র্কে গিয়ে নাট্য রচনা পরিচালনায় যুক্ত হয়ে পড়েন, যতদিন না যুদ্ধ শেষ হয়। পরে তিনি বার্লিন ফিরে আসেন।
রাজনৈতিক নাট্যকার ফ্রীডরিশ ভোলফ ব্রেশটের বহু পূর্বেই জার্মানী ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে থিয়েটার ইউনিয়নের সাথে কাজে লেগে পড়েন। পিসকাটর, ব্রেস্ট, ফ্রীডরিশ ভোলফ ও অন্যান্য রাজনৈতিক নাট্যকাররা মিলে থিয়েটারের জগতে যে নতুন ভাবধারণা সৃষ্টি করেন তার প্রভাব পড়ে পৃথিবীর সর্বত্র তবে তার তাৎক্ষণিক প্রভাব লক্ষ্য করা যায় যুক্তরাষ্ট্রে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপকে প্রায় নিঃশেষ করে দিয়েছিলো। যুক্তরাষ্ট্র সেসব সমস্যা থেকে দূরে ছিলো। কিন্তু উনিশশো উনত্রিশ সালের অক্টোবর মাসে সেখানকার সমস্যা খেয়েরে ধ্বস নামলো। নিউইয়র্কের শেয়ার বাজারে এর কারণে যে চরম অর্থ শেয়ার বিপর্যয় দেখা দেয় তা এ তাবৎকালের ধনতন্ত্রের সবচেয়ে চরম ও স্থায়ী সংকট হিসাবে বিশ্বষ বাণিজ্য মন্দায় অন্যান্য দেশগুলির যে দুর্গতি চলছিলো যুক্তরাষ্ট্রও এবার সে দলে ডিগুলো। যে মন্দা চলছিলো ইউরোপে, যুক্তরাষ্ট্রও তার শিকার হওয়ায় সেটা এবার দলে বিল মহাসংকটে। দেখতে দেখতে পৃথিবীময় মহাসংকট ছড়িয়ে পড়লো।
ব্যবসা- বাণিজ্য ক্রমেই নিম্নের দিকে ধাবিত হলো। সে সময়কার এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় সারা পৃথিবীতে উনত্রিশ সালের প্রথম তিন মাসের আমদানি-রপ্তানির মোট পরিমাণ ছিলো দশলক্ষ সোনার ডলারের হিসাবে পনের হাজার দুইশো উননব্বই। অথচ তেত্রিশ সালের প্রথম তিন মাসে তা নেমে দাঁড়ালো দশলক্ষ সোনার ডলারের হিসাবে পাঁচশত তিনশো একান্ন। ব্যাংক আর কারবারে টাকা রেখে লাভ নেই মনে করে লোকে টাকা তুলে এনে ঘরে জমাতে লাগলো। এই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের হাজার হাজার ব্যাংক বসে গেল। ব্রিটেনের মহাজনদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং যোগ্যতম ব্যাক্তিদের একজন মন্টেগু নরম্যান, ব্যাংক অব ইংল্যাণ্ডের গভর্নর।
বিশ্বব্যাপী মহাসংকট সম্পর্কে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি প্রকাশ্য জনসভায় বললেন যে, ‘অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে সমস্যা দেখা দিয়েছে তার বিশ্লেষণ করা আমার শক্তির বাইরে। যেসব বিঘ্নবিপত্তির সৃষ্টি হয়েছে তার পরিমাণ এত বিপুল, এমন অভিনব এবং এমন অভূতপূর্ব যে, এর আলোচনা আমাকে করতে হবে সম্পূর্ণ অজ্ঞতা এবং অক্ষমতা স্বীকার করে নিয়ে। ‘
সংকটের কারণ ছিলো পণ্যের অভাব নয়, পণ্যের বাহুল্য। প্রসিদ্ধ অর্থনীতিবীদ হেন্দ্রী স্ট্রাকোশ-এর মতে বাণিজ্য সংকটের দ্বিতীয় বছরেও পৃথিবীর বাজারে এতো মালপত্র মজুত ছিলো যে তার দ্বারা পৃথিবী শুদ্ধ মানুষকে তিনমাস কাল খাইয়ে পরিয়ে রাখা যেতো। অথচ চরম অর্থনৈতিক সংকটে মানুষ এতোবেশি দরিদ্র হয়ে পড়েছিলো যে, তারা নিজেরাই যা উৎপাদন করেছিলো তাও কেনার সামর্থ তাদের ছিলো না।
বিশ্বের এই অর্থনৈতিক সংকটে দেখা গেল ক্ষুধায় মানুষ না খেয়ে মরছে। বেকারত্বের সংখ্যা দিনকে দিন বেড়েই যাচ্ছে।১০১ হঠাৎ দেখা গেল যুক্তরাষ্ট্রে অসংখ্য মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। ইউরোপ আর আমেরিকা মিলে বেকার শ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিলো তিন কোটি। এর মধ্যে বৃটেনে বিশ লক্ষ, আর যুক্তরাষ্ট্রে এক কোটি ত্রিশ লক্ষ। বিশ্বব্যাপী এই মহাসংকট, বিশ্বযুদ্ধের মতোই এর ভয়াবহতা। খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই না খেয়ে মানুষ মারা গেল এই ঘটনায়।
উল্লিখিত মহামন্দার করাল গ্রাস যখন সারা পৃথিবী জুড়ে ধনতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছিলো, সেই ভাবনায় মার্কসবাদীরা নতুন করে দিক নির্দেশনা দিতে এগিয়ে এলো। যুক্তরাষ্ট্রও এর বাইরে থাকলো না। মার্কসবাদ সেখানকার মানুষের চিন্তাকেও নতুনভাবে নাড়া দিলো। প্রথম মহাযুদ্ধের পরিণতিতে তারা বুঝতে পারলো, পুঁজিবাদী সমাজকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যুদ্ধ হয়, লক্ষলক্ষ মানুষকে মরতে হয়, তেমনি তা দেশের জন্য বয়ে আনতে পারে অর্থনৈতিক দুরবস্থা, খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ। সে সময়কার সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শিক্ষিত সচেতন মানুষ জগৎ-জীবন নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে শুরু করে।
নতুন চিন্তা-ভাবনায় তারা উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। সেই প্রেক্ষাপটেই মার্কসবাদের আলোকে শুরু হলো ধনতন্ত্রবাদের চুলচেরা বিশ্লেষণ। জনগণতন্ত্রের মূল্যায়নে আর সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রয়োগে ঘনীভূত হলো মতাদর্শগত বিরোধ। মানুষ তখন সংকট থেকে মুক্তি খুঁজছে। অর্থনৈতিক মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকার তরুণদের মধ্যে কেউ কেউ চেয়েছিলেন এ রহস্যের উৎসে পৌছুতে। সেজন্য তাঁদের কাজকর্ম চিন্তায় বামপন্থী ঝোঁক লক্ষ্য করা গিয়েছিলো। পাশাপাশি সেই একই অভিঘাতে জেগে উঠলো শ্রমিকশ্রেণী। কমিউনিস্ট পার্টিও সক্রিয় হয়ে উঠলো। সেই সময়কার নাটকেও এইসব ঘটনার ছায়া পড়তে শুরু করে।
যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজার মুখ থুবড়ে পড়ার পর রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে ওঠে নাট্যকর্মীরা, এবং পুরানো নাট্যধারাকে অস্বীকার করতে থাকে। পুরানো নাট্যধারাকে তারা বর্জনীয় বলেও ঘোষণা দেয়। যুগদ্বন্দ্বের এই সন্ধিক্ষণে আমেরিকায় নতুন নতুন থিয়েটার আন্দোলন দানা বাঁধে। বিশৃঙ্খল এই বাস্তব অবস্থার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বহু নাট্যদল যেমন পলায়নপর মনোবৃত্তি গ্রহণ করেছিলো, ধনতান্ত্রিক যুগের সমস্যাবলী থেকে মুখ ফিরিয়ে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে ছিলো আত্মমগ্ন, তেমনি আবার নাটককে ব্যবহার করা হলো ধনতান্ত্রিক সংকটের বিরুদ্ধে এবং সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পক্ষে প্রচারে। সংগঠিত হলো শ্রমিক নাট্যদল।
দেখা গেল নিউইয়র্কেই কারখানা শ্রমিকদের অনেক দল নাটক করে চলেছে। বিশের দশকের শেষভাগে যুক্তরাষ্ট্রের এই বামপন্থী থিয়েটার আন্দোলনের জন্মই হয়েছিলো শ্রমিকদের দ্বারা শ্রমিকদের কথা বলার জন্য শ্রমিকদেরই একটা প্রচেষ্টা হিসাবে, যা ছিলো শ্রেণীসংগ্রামের থিয়েটার। তারা নাটক করতো কোনো সভা সমাবেশে, যারা আন্দোলনে সংগ্রামে জড়িত তাদের জন্য। বিশের দশকের শেষে পার্টি ট্রেড ইউনিয়নের কর্মকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর এরকম প্রলেতারিয়েত নাট্য সংস্থার আবির্ভাব ঘটেছিলো। নাটকে পূর্ব-অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লোকজন ছাড়াই তারা নাটক করতো। প্রলেতারিয়েত নাট্যকর্মীরা সাম্যবাদের পক্ষে লেখা জোগাড় করাটা নিজেদের দায়িত্ব হিসাবে নিয়েছিলো।
যার লক্ষ্য ছিলো সেইসব লোকদের নিয়ে সেই ধরনের নাটকই মঞ্চায়ন করা যা ধর্মঘটী শ্রমিকদের উৎসাহিত করবে, বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দিয়ে শ্রমিকদের মুক্তির স্বপ্ন দেখাবে। শ্রমিক অভিনেতারা ছিলো খণ্ডকালীন নাট্যকর্মী। নিজেদের অবসর সময়টাকে তারা বিসর্জন দিয়েছিলো নাটকের মধ্য দিয়ে সহকর্মীদের শ্রেণী সচেতন করে তোলার জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল থিয়েটার, লিভিং নিউজ পেপার থিয়েটার, ওয়ার্কার্স ড্রামা লীগ, নিউ প্লেরাইটস থিয়েটার, এ্যাজিটপ্রপ ট্রুপ, ব্লু
ব্লাউজ ট্রুপ, লীগ অব ওয়ার্কার্স থিয়েটার, গ্রুপ থিয়েটার, থিয়েটার ইউনিয়ন, থিয়েটার গিল্ড, লেবার স্টেজ-প্রভৃতি বামপন্থী থিয়েটারগুলি এপিক থিয়েটার বা জার্মান এ্যাজিটপ্রপগুলোর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবে সৃষ্ট হয়েছে। বামপন্থী এই থিয়েটারগুলি যেসব নাটক মঞ্চস্থ করতো তাকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যায়। ইউরোপীয় নাট্যকারদের নাটক, যার অধিকাংশই এক্সপ্রেশনিস্ট, অ্যাকটিভিস্ট ও লিভিং নিউজপেপার। এ্যাজিটেশন-প্রোপাগাণ্ডার নাটক, এতে ইউরোপীয় এবং রাশিয়ান দু ধারারই প্রভাব ছিলো। আর ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের নাট্যকারদের লেখা নাটক, যেখানে সামাজিক সমস্যাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হতো। এর অধিকাংশই ছিলো ফ্যাসি-বিরোধী নাটক। রেইন ফ্রম হেভেন, দ্য অ্যাডিং মেশিন, উই দ্য পিপল ছিলো ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দুর্বার প্রতিবাদ।
উনিশশো উনত্রিশ সালে ওয়ার্কার্স ল্যাবরেটরি থিয়েটারের উদ্যোগে শ্রমিকদের প্রায় বারোটি দল ওয়ার্কার্স ড্রামাটিক কাউন্সিলে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলো। ড্রামাটিক কাউন্সিল-এর সচিবের মতে দলগুলো পুরোদমে নাটক মঞ্চায়ন করছিলো। নিজস্ব মঞ্চ না থাকায় তারা নাটক করতো বিভিন্ন সমাবেশে, বাইরের দর্শকরা যার খবরাখবর পেতো না। নাট্যদলগুলোর বৃহত্তর উদ্দেশ্য ছিলো সাম্যবাদী দলের তৃতীয় স্তরের বৈপ্লবিক নীতিকে এগিয়ে নেওয়া। উনিশশো উনত্রিশ সালে কমিনটার্ন বা কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল ঘোষণা করেছিলো যে, উনিশশো সাতাশ সালে পুঁজিবাদী অর্থনীতি তৃতীয় স্তরে পৌঁছেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিলো সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার পর অবক্ষয়ের বছর।
সাম্যবাদী দলের কর্মনীতি অনুসারে তৃতীয় স্তর ছিলো আসন্ন বিপ্লবের প্রস্তুতির কাল। যুক্তরাষ্ট্রে ও অন্যান্য দেশে মহামন্দার ক্ষতিকর প্রভাব পুঁজিবাদ বিরোধী বক্তব্য সমূহকে যথার্থতা দান করেছিলো। তৃতীয় স্তরে পার্টির সকল কাজকর্মের মূলে ছিলো ট্রেড ইউনিয়ন লীগের ‘শ্রেণীর বিরুদ্ধে শ্রেণী’ মতবাদটি। স্তালিনবাদে বিশ্বাসের দৃঢ়তা থেকে শ্রেণীসংগ্রামকে এরা খুব কট্টরভাবেই গ্রহণ করেছিলো।
পূর্বে উল্লেখিত ওয়ার্কার্স ল্যাবরেটরি থিয়েটার ছিলো এই নতুন নাট্যান্দোলনের সর্বজন স্বীকৃত পুরোধা। দলের প্রতিষ্ঠাদের মধ্যে আলবার্ট প্রেন্টিস, লুই ডিস্যানেন্টস এবং ফ্লোরেন্স রাউ সহ বেশ কয়েকজন উনিশশো ছাব্বিশ সালে পুরানো ‘ওয়ার্কার্স থিয়েটারে’ কাজ করেছিলেন এবং তা বন্ধ হওয়ার পর পুনরায় সংঘবদ্ধ হয়েছিলেন ওয়ার্কার্স ল্যাবরেটরি থিয়েটারে। গোল্ডের স্ট্রাইক নাটকটি ছিলো স্বল্পায়ূ ওয়ার্কার্স থিয়েটার কর্তৃক প্রথম এ্যাজিটপ্রপ নাটক সম্ভবত যা যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম লিখিত ও মঞ্চায়িত। নাটকটির বিষয়বস্তু ছিলো প্রাধান্যের জন্য শাসক ও শাসিতশ্রেণীর মধ্যকার চিরন্তন সংগ্রাম। গোল্ডের লেখা ছিলো সবসময় প্রকাশ্যভাবে সাম্যবাদী দলের পক্ষে।
ওয়ার্কার্স ল্যাবরেটরি থিয়েটার-এর পুরোধারা ছিলেন প্রথম থেকেই বিপ্লবী চিন্তার অধিকারী যাদের উদ্যোগে শ্রমিকশ্রেণীর নাট্যদলগুলো সারা নিউইয়র্ক ও নিউইয়র্কের বাইরে গঠিত হতে থাকে। প্রথম দিকে এই নাট্যদলগুলোর লক্ষ্য ছিলো মালিকদের বিরুদ্ধে শ্রমিকদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলা। নাটকগুলো তাই বেশিরভাগ সময় হয়ে পড়তো শ্লোগানধর্মী। শ্রমিকদেরকে শ্রেণীসচেতন করে তোলার পাশাপাশি এদের নাটকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে ভূয়সী প্রশংসা থাকতো। আমেরিকার এই বামপন্থী থিয়েটারগুলোর নামডাকের বহরই ছিলো আলাদা। ১০৬ পিটারসন লিখেছিলেন যে, শ্রমিক দর্শককুল আর সবার চেয়ে এমন এক নাটকের উত্তেজনা দেখতে চাইতো যে পথ হবে পরিষ্কার, তীক্ষ্ণ আর স্পষ্টভাষী এবং যে পথে স্বচ্ছতা থাকবে।
ভাসার এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটারের প্রধান হ্যালি ফ্ল্যানাগান ‘থিয়েটার আর্টস মান্থলি’তে শ্রমিকদের একটি প্রযোজনা সম্পর্কে আলোচনায় কিছু ত্রুটির কথা উল্লেখ করায় ল্যাবরেটরি থিয়েটারের প্রেন্টিস ক্ষুদ্ধ হয়ে লিখেছিলেন, ‘আমাদের নাটকে নাকি পুনরুক্তি আছে-অবশ্যই, যদিও তা বুর্জোয়া থিয়েটারের বেডরুমের দৃশ্যগুলোর মতো ন্যাক্কারজনক নয়। আমরা অবশ্যই পুনরুক্তি করবো শ্রমিকদের হৃদয়ে আমাদের ঐক্যের কথা পৌছে দেয়ার জন্য।
‘শ্রমিকদের হৃদয়ে আমাদের ঐক্যের কথা পৌঁছে দেয়া’ প্রেন্টিসের এই শব্দগুচ্ছই ছিলো থার্ড পিরিয়ডের মর্মবাণী। তবে খুব শীঘ্রই তারা নিজেদের কট্টর মনোভাব ত্যাগ করলো। পার্টির নির্দেশেই তিন বছরের মধ্যে শ্রমিকদের নাট্যদলগুলো সংকীর্ণতা থেকে নিজেদের মুক্ত করলো। সে সংকীর্ণতা মুক্ত বলতে যা বোঝায় তা হলো প্রথমে তারা শ্রমিকশ্রেণী ছাড়া অন্যদেরকে নিজেদের দলভুক্ত বা সংগ্রামের সাথী মনে করতো না। পরবর্তী পর্যায়ে তাদের পক্ষে এটা অনুধাবন করা সম্ভব হলো যে, কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সম্পর্কহীন কোনো কোনো দলও রাজনৈতিক সামাজিক নাটকে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। ব্রডওয়ের একজন প্রযোজকও কখনও কখনও এমন নাটক উপহার দিতে পারেন যা বামপন্থীদের মনোযোগ লাভের যোগ্য। পার্টির এই সহনশীল মনোভাব বিশ্বব্যাপী ফ্যাসিবাদ বিরোধী দলগুলোর একটি ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠনের লক্ষ্যে কমিন্টার্নের ক্রমপরিবর্তিত নীতির সাথে। সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিলো।
সাম্যবাদী দলের নেতৃত্বের প্রেরণাতেই অনেকে বুঝতে পেরেছিলেন যে, নিম্ন স্বরেও জনতার হৃদয়ে পৌছানো যায় এবং বিপ্লবের জন্য হৈ চৈ বিহীন শিক্ষামূলক নাটকও যথেষ্ট কাজ দেয়। বেশির ভাগ এ্যাজিটপ্রপের নাটকগুলোই ছিলো শ্লোগান সর্বস্ব, অবশ্য ধীরে ধীরে দলগুলো উপযুক্ত নাট্যপদ্ধতি খুঁজে পেয়েছিলো। ফ্রীডরিশ ভোলফ ইন্টারন্যাশনাল লিটারেচার-এ লিখেছিলেন যে, নিউইয়র্কের থিয়েটার হলো সমস্ত পুঁজিবাদী দেশগুলির বামপন্থী থিয়েটারের মধ্যে যথেষ্ট শক্ত এক ঘাঁটি।
যুক্তরাষ্ট্রের থিয়েটার ইউনিয়ন ছিলো ওয়ার্কার্স ল্যবরেটরি থিয়েটারের মতোই আর একটি নাট্যদল। উনিশশো তেত্রিশ সালে থিয়েটার ইউনিয়নের জন্ম শ্রমিকদের নিয়ে মার্কসবাদী সংগ্রামী নাটক করার জন্য। লীগের সহযোগিতা ও সাম্যবাদী দলের সাথে সংশ্রব ছাড়াই থিয়েটার ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। বিনা বেতনের স্বেচ্ছাব্রত সদস্যদের নিয়ে এই থিয়েটার ইউনিয়ন গঠিত ছিলো।
থিয়েটার ইউনিয়ন হলো নিউইয়র্ক সিটির প্রথম পেশাদার থিয়েটার। এই দলের মূলমন্ত্র ছিলো সেই মার্কসীয় শ্লোগান, ‘থিয়েটার হচ্ছে হাতিয়ার’। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো শ্রমিকদের নাটক মঞ্চস্থ করা, যে নাটক লেখা হয়েছে শ্রমিকদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। উনিশশো চৌত্রিশ সালে এই দলটি মঞ্চস্থ করে মল্টৎঞ্জ ক্লা-র যুদ্ধ-বিরোধী নাটক পিস অফ আর্থ। থিয়েটার ইউনিয়নের প্রথম সফল প্রযোজনা ছিলো সেলস অফ কট্টরো। অ্যাড্রিয়াটিক সমুদ্রের কট্টরো উপসাগরে অস্ট্রিয় নৌ-বাহিনীর বিদ্রোহের বাস্তব ঘটনাই ছিলো ওই নাটকের উপাদান।
নাটকটি যেমন নাট্যগুণ সমৃদ্ধ ছিলো, তেমন এখানে কখনই শ্লোগানধর্মিতা বড় হয়ে ওঠেনি। বিদ্রোহের ব্যর্থতার তুলনায় বিদ্রোহের সাহসিকতার দিকটিকেই এ নাটকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছিলো এবং নাটকটির অভাবনীয় সাফল্যের পিছনেও মূল কারণ ছিলো এগুলিই। উনিশশো পঁয়ত্রিশ সালে থিয়েটার ইউনিয়ন প্রযোজনা করে ব্রেস্টের মাদার। থিয়েটার ইউনিয়নের শেষ দুটি প্রযোজনা ছিলো ভিক্টর উলফসমের বিটার স্ট্রীম এবং জন হাওয়ার্ড লসনের মার্চিং সঙ।
উনিশশো পঁয়ত্রিশ সালে থিয়েটার ইউনিয়ন এটা বড় গলায় বলতে পারতো যে ইউনিয়নের আগের চারটি প্রযোজনা পাঁচ লাখ লোক দেখেছে। তার মধ্যে পঁচাত্তর ভাগ মানুষই ছিলো শ্রমিক, যাদের বেশির ভাগ আবার এর আগে কোনো নাটক দেখেনি। থিয়েটার ইউনিয়ন ছিলো সম্পূর্ণ স্বাধীন এক সংগঠন। স্বল্প মূল্যের টিকেটে দর্শকদের নাটক দেখানো ছিলো এই দলের লক্ষ্য। মূল লক্ষ্য ছিলো শ্রমিক দর্শকদের প্রেক্ষাগৃহে নিয়ে আসা।

পেশাদার মঞ্চে বামপন্থী নাটক মঞ্চায়ন করার জন্য দুটো দলের নাম সবার আগে উল্লেখযোগ্য। প্রথমটি থিয়েটার ইউনিয়ন ও দ্বিতীয়টি গ্রুপ থিয়েটার। থিয়েটার ইউনিয়নের আগেই গ্রুপ থিয়েটার-এর জন্ম। থিয়েটার ইউনিয়ন যেমন মার্কসবাদী নাটক মঞ্চায়ন করবার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেছিলো গ্রুপ থিয়েটার- এর লক্ষ্য তা ছিলো না। গ্রুপ থিয়েটারের জন্মের প্রেক্ষাপটটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিলো। এই ‘গ্রুপ থিয়েটার’ নাট্যদলের নাম থেকেই পরে ভারত ও বাংলাদেশে গ্রুপ থিয়েটার নাট্য আন্দোলনের জন্ম। সে বিষয় আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে বিশদ আলোচনা করবো।
উনিশশো ত্রিশ সালে তৈরি হয় প্রলেতারিয়েত মঞ্চ। রক্ষণশীল সমালোচকদের চোখে এরা ছিলো বিপ্লবী এবং খুবই ক্ষমতাশালী। জার্মানী এবং রাশিয়া থেকে এরা এ্যাজিটপ্রপ ভাবনা আহরণ করেছিলো। প্রায় প্রস্তুতিহীন নাটকগুলিতে দর্শকরা কখনই শিল্প খুঁজে পেতো না, পেতো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং সামাজিক-ন্যায়বিচারের সোচ্চার দাবি। কখনও কখনও রাজনীতিও দূরে সরে যেতো। তবে নাটকগুলো সর্বদাই অফুরন্ত ভাবাবেগে বোঝাই হয়ে থাকতো। সুরুচিসম্পন্ন চানিন থিয়েটারে যে কেউ দেখতে পেতো মুষ্টিবদ্ধ উত্তেজিত হাত, ধনাঢ্য হেকশচার থিয়েটারে শোনা যেতো মানবপ্রেম-বিরোধী আন্দোলনের ঝড়, সমৃদ্ধশালী সাটোন থিয়েটারে বেসরকারি মালিকানার বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনার ঝড় উঠতো এবং নিউ স্কুল ফর সোস্যাল রিসার্চে প্রগতিশীল বিবাদ-বিতর্কের তুফান ছুটতো।
চার বছর ধরে প্রলেতারিয়েত মঞ্চে সৌখিন অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে এমন সব নাটক অভিনয় করা হয় যার বিষয়বস্তু ছিলো মহামন্দা বা নিউইয়র্কের তখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। চড়া গলায় চটকদার ভঙ্গীতে লড়াইয়ের উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে শুরু হয়েছিলো এই জঙ্গী থিয়েটার। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক থিয়েটার তো নয়ই, তৎকালীন সামাজিক থিয়েটার গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথাও সেখানে উহ্য থেকেছে।
উনিশশো তেত্রিশ সালে পার্টি থেকে সরাসরি পরামর্শ দেয়া হলো যে, থিয়েটারের সদস্যগণকে ব্যক্তি এবং বিভিন্ন শ্রমিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর যথাযথ উপস্থাপনার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বিপ্লবী থিয়েটারকে অবশ্যই নরমান থমাস, সোশালিস্ট পার্টি বা আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার-এর লোকদের নিয়ে স্থল ক্যারিকেচার ও নিছক গালাগালি করে নাটক করা বন্ধ করতে হবে। বিপ্লবী থিয়েটারের প্রভাব বৃদ্ধির জন্য এটা অতি আবশ্যক। দৃষ্টিভঙ্গি এভাবে প্রসারিত হওয়ার ফলে পেশাদার অনেক নাট্যকর্মীকে আন্দোলনের সাথে যুক্ত করা সম্ভব হলো। সোভিয়েতপন্থী শ্লোগানগুলো বাদ দিয়ে প্রোলেতারীয় নাট্যচিন্তায় পরবর্তী সময় যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পেল তা হলো যুদ্ধ, ফ্যাসিবাদ, নিষেধাজ্ঞা ও সাধারণ মানুষের বাঁচার দাবি।
বিশেষ করে আমেরিকান নাট্যকারদের লেখা নতুন নাটকগুলো ছিলো ভিন্ন প্রকৃতির, সেখানে সামাজিক সমস্যাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হতো। মানুষের বাঁচার দাবিটাই নাটকের সামনে এসে গেল। নাট্যদলগুলো এই দাবির প্রেক্ষিতে পার্টির . পরিচালনায় লীগ অব ওয়ার্কার্স থিয়েটার-এর অধীনে একত্রিত হয়েছিলো। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আরো ব্যাপক দলকে এর সাথে যুক্ত করার জন্য উনিশশো পঁয়ত্রিশ সালে লীগ তার নাম থেকে ওয়ার্কার্স শব্দটি বাদ দেয়।
উনিশশো পঁয়ত্রিশ সাল থেকে লীগের অধীনস্থ দলগুলো যখন কট্টর বাম চরিত্র সম্পূর্ণ পরিহার করলো, নাটকের বিষয়বস্তুও বদলানো শুরু হলো। পার্টির নেতৃবৃন্দ সহনশীলতা দেখানোর সাথে সাথে উদারনৈতিক বুর্জোয়া লেখকগণ তাদের নাট্যান্দোলনে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এলেন। সমাজের দারিদ্র্য, অস্থিতিশীলতা ও দুঃখ-দুর্দশায় আলোড়িত নাট্যকারগণ এ্যাজিটপ্রপের প্রতি যথেষ্ট আকর্ষণ বোধ করতে শুরু করলেন। নিজেরা যেমন এতে করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য একটি নতুন নাট্য আঙ্গিক পেলেন, শ্রমিকদের দলগুলোকেও তাদের সাথে পেয়ে উৎসাহিত হলেন। নাটকে তখনো শ্লোগানধর্মিতা বিদ্যমান ছিলো, তবুও এ্যাজিটপ্রপের ক্ষেত্র প্রসারিত হয়ে সুসংগঠিত চরিত্র ও সুসংহত সংলাপের আবির্ভাব ঘটলো।
প্রোলেতারীয়, মধ্যবিত্ত, পেশাদার ও সখের নাট্যদলগুলোর মধ্যে এই পারস্পরিক বোঝাপড়ায় নাটক পূর্ব গণ্ডি ছাড়িয়ে ব্রডওয়ের বিশাল প্রাঙ্গনে ছড়িয়ে পড়লো। ব্রডওয়ের পেশাদার মঞ্চেও শ্রেণীসংগ্রামের নাটক বা এ্যাজিটপ্রপ মঞ্চস্থ হতে শুরু করলো। শ্রেণীসংগ্রামের শ্লোগানসর্বস্বতাও এর কারণে অনেকটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হলো। রাজনীতি পূর্বের চেয়ে গভীরতা লাভ করলো।
বিশ শতকের রাজনৈতিক নাট্যধারায় মার্কসীয় প্রভাব [ পর্ব ৩ ]
মারিয়া লে-পিসকাটর লিখেছিলেন, জার্মানীর মুদ্রাস্ফীতির সময়কার বিদ্রোহী থিয়েটারের সঙ্গে এই সময়কার যুক্তরাষ্ট্রের থিয়েটারের তুলনা করলে বলতে হয়, যুক্তরাষ্ট্রের থিয়েটার যুদ্ধের আহবান জানালেও যুক্তরাষ্ট্রের জঙ্গী থিয়েটার আদৌ জঙ্গী ছিলো না। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে তা ছিলো মধ্যবিত্তের থিয়েটার। রাজনীতি নিয়ে কিংবা সমাজ পরিবর্তনের প্রশ্নে তাদের নাটকে কোনো স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিলো না। অধিকাংশ বামপন্থী নাটকই রাজনৈতিক নাটক তো নয়ই, আদৌ ভালো নাটকই হয়ে উঠতে পারেনি। নাট্যকারদের বিপুল উদ্দীপনা ও প্রাণশক্তি থাকলেও বড় মাপের প্রতিভা ছিলো না। তারা সচেতন সাহিত্যিকও ছিলো না।
তিনি আরো লিখছেন, কী করছে কেন করছে সেসব না বুঝেই থিয়েটার গিল্ড এবং এই রকম আরো কয়েকটি দক্ষিণপন্থী থিয়েটার সাফল্যের সঙ্গেই বেশ কিছু বামপন্থী থিয়েটার মঞ্চস্থ করেছিলো। যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েতের মার্কসবাদী সাহিত্যিকদের রচিত বেশ কয়েকটি নাটকও তারা করে।
কিন্তু সমাজ বিজ্ঞানের চেতনা বা শ্রেণীচেতনা তাদের কাছে পরিষ্কার ছিলো না। যুক্তরাষ্ট্রের এই থিয়েটার মার্কসবাদী হয়ে উঠতে চাইলেও সত্যিকার অর্থে মার্কসবাদী ছিলো না। মার্কসবাদ আত্মস্থ করার জন্য যে ধরনের পড়াশুনা বা ধৈর্য বা রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দরকার ছিলো তার অভাব থেকেই এটা ঘটেছিলো। তা সত্ত্বেও মার্কসবাদ বা সমাজতন্ত্র বা শ্রমিকশ্রেণীর রাজনীতি যে তখন সারা পৃথিবীর মতো যুক্তরাষ্ট্রেও প্রভাব ফেলেছিলো তার প্রমাণ পাওয়া যায় শ্রমিকশ্রেণীর নাট্য আন্দোলনগুলোতে। স্মরণ রাখতে হবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম বছর পর্যন্তই যুক্তরাষ্ট্রে এই বামপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি থিয়েটারে বজায় ছিলো।
বামপন্থী দৃষ্টিভঙ্গির নাটক এরপর আমরা দেখতে পাই চীন ও ভারতে। চল্লিশের দশকে চীন দেশে ও ভারতে এ্যাজিটপ্রপ দলের পদ্ধতি অনুসৃত হচ্ছিলো মার্কসীয় রাজনীতি প্রচারের লক্ষ্যে। চীন ও ভারতে সে সময় তাই গড়ে উঠেছিলো পিপলস থিয়েটার বা গণনাট্য। চাইনিজ পিপলস থিয়েটার সোভিয়েত পিপলস থিয়েটারের মতোই লক্ষলক্ষ শ্রমিক ও কৃষকের কাছে হাজির হতে পেরেছিলো। চীন বিপ্লবের নেতা মাও সেতুঙ রাজনৈতিক থিয়েটার সম্পর্কে ছিলেন ভীষণভাবে সচেতন। শিল্প-সাহিত্যের গুরুত্বকে মাও সেতুঙ খুব বেশি বড় করে যেমন দেখতেন না, তেমনি এর গুরুত্বকে খাটো করেও দেখতেন না।
তিনি মনে করতেন শিল্প-সাহিত্য হচ্ছে রাজনীতির অধীন, কিন্তু সেগুলি আবার রাজনীতির উপরেও বিরাট প্রভাব বিস্তার করে থাকে। সাহিত্য ও শিল্পকলা সম্পর্কে ইয়েনানের প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেন, ‘কমরেডগণ! আজকের এ আলোচনা সভায় আপনাদের আমন্ত্রণ করার উদ্দেশ্য হল, শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কাজের সঙ্গে সাধারণভাবে বৈপ্লবিক কাজের সম্পর্ক কি সে বিষয় নিয়ে পরস্পরের মধ্যে মতামত বিনিময় করা এবং তার পর্যালোচনা করা।
এ আলোচনার উদ্দেশ্য হলো আমাদের বৈপ্লবিক শিল্প-সাহিত্য যাতে সঠিক পথে বিকাশ লাভ করে এবং যাতে বৈপ্লবিক শিল্প-সাহিত্য অন্যান্য বিপ্লবী কাজকেও আরও ভালোভাবে সাহায্য করতে পারে তা নিশ্চিত করা; এইভাবে আমরা আমাদের জাতীয় শত্রুদের উৎখাত করে জাতীয় মুক্তি অর্জন করার কর্তব্য সম্পন্ন করতে পারব।’
বিশ শতকের রাজনৈতিক নাট্যধারায় মার্কসীয় প্রভাব [ পর্ব ৩ ]
উল্লিখিত ভাষণে তিনি আরো বলেন, ‘শত্রুদের পরাজিত করার জন্য অবশ্যই আমাদের সর্বপ্রথমে বন্দুকধারী সৈন্যবাহিনীর উপর নির্ভর করতে হবে; কিন্তু কেবলমাত্র এই ধরনের বাহিনীই যথেষ্ট নয়, একটি সাংস্কৃতিক বাহিনীও আমাদের অবশ্যই থাকতে হবে, যে বাহিনী আমাদের নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করবার জন্য এবং শত্রুদের পরাজিত করবার জন্য একান্তভাবে অপরিহার্য’। মাও এ ভাষণে স্বীকার করেন যে, চীন দেশে এরূপ একটি সাংস্কৃতিক বাহিনী গড়ে উঠেছে এবং তা চীন বিপ্লবকে সাহায্য করে আসছে। মাও সেতুঙ সত্যি কথাই বলেছিলেন। চীনের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে সাম্যবাদী দলের নেতৃত্বে এক রাজনৈতিক থিয়েটার গড়ে ওঠে, যা কৃষক বাহিনীকে প্রোলেতারীয় বিপ্লবের কাজে রাজনৈতিক শিক্ষা প্রদানের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে।
চীনে প্রথম গণনাট্যের কাজ শুরু হয়েছিলো শহর থেকে বহু দূরে হুনান প্রদেশের অন্তর্বর্তী অঞ্চলে যেখানে বহুখ্যাত লংমার্চের রেড আর্মিরা থাকতো ও তাদের কাজকর্ম করতো। চীনের গণনাট্যের প্রথম পরিচালক মিস ওয়-কুঙ-চিহ ইউরোপ ও রাশিয়া থেকে গণনাট্যের শিক্ষা গ্রহণ করে এসেছিলেন। কিয়াংসির গোর্কি স্কুলে হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে এ বিষয়ে শিক্ষিত হয়ে ষোলটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গ্রামাঞ্চলে ও সীমান্ত এলাকায় অভিনয় করতে বেরিয়ে পড়েছিলো। পিপলস থিয়েটার চীনা জনগণের মধ্যে দারুণ সাড়া ফেলে দিয়েছিলো। স্বয়ং লিন পিয়াও বা মাও সেতুঙ এগুলি দেখতে আসতেন অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে। টিকেট ছিলো না, বসার কোনো ভেদাভেদ ছিলো না।
পুরানো ভগ্ন মন্দিরের চত্বরে, মুক্তমঞ্চে একটু উঁচু জায়গায় নাটক অভিনীত হতো। এগুলি এতো জনপ্রিয় ছিলো যে, বিরোধী কুও মিন-টাঙের সৈন্যরা পর্যন্ত গোপনে এগুলি তাদের দেখাবার জন্য বারবার অনুরোধ পাঠাতো এবং তাদের অবস্থিতির কাছাকাছি অঞ্চলে নাটক মঞ্চস্থ হলে তারা সাদা পোষাকে এসে অনুষ্ঠানগুলি উপভোগ করতো।
চীনের মুক্তিযুদ্ধে লালবাহিনীর গৌরবের পাশাপাশি গণনাট্য কর্মীদের সাংস্কৃতিক অবদান কোনো অংশেই তাই কম ছিলো না। চীনের লালবাহিনী যেখানে যেতো সঙ্গে যেতো গণনাট্যের দল। তারা সেই নতুন জায়গার অধিবাসীদের পরিস্থিতি ও প্রয়োজন বুঝিয়ে চলতো গণনাট্য মারফত।১১” একেকটা অঞ্চল মুক্ত হওয়ার পর, লালবাহিনীর পরে পরেই গণনাট্য দল সেখানে হাজির হয়ে ভীত সন্ত্রস্ত মানুষের মনে আশা জাগিয়ে তুলতো। নতুন চেতনার কথা বলে তাদের সাহস জোগাতো এবং এ-যুদ্ধ জয় যে চীনের মুক্তিরই জয়যাত্রা নাটকের মাধ্যমে জনগণকে তা বুঝিয়ে দিয়ে গ্রামাঞ্চলের মানুষদেরকেও নিজের ভাবনার সামিল করে নিতো। সৈন্যরা অঞ্চল দখল করতো আর থিয়েটার কর্মীরা সেই অঞ্চলের মানুষের মন জয় করে নিতো। মাও সেতুঙ বলেছিলেন, ‘জনগণেরও ত্রুটি রয়েছে।
সর্বহারাদের অনেকের মধ্যেই পাতি বুর্জোয়াশ্রেণীর চিন্তাধারা রয়ে গেছে; তাছাড়া কৃষকদের ও শহুরে পাতি বুর্জোয়াদের পশ্চাদমুখী চিন্তাধারা রয়েছে। তাঁদের সংগ্রামের পথে এগুলো তাঁদের বোঝাস্বরূপ। যাতে তাঁরা দ্রুত গতিতে এগিয়ে যেতে পারেন তার জন্য আমাদের উচিৎ ধৈর্য্য সহকারে দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের শিক্ষিত করে তোলা এবং এসব গুরুভার বোঝা থেকে মুক্ত হতে ও নিজেদের ভুল ত্রুটির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে তাঁদের সাহায্য করা। মাও সেতুঙ গণনাট্যকে ব্যবহার করেন সেইসব লোকদের রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত হয়ে ওঠার জন্য। থিয়েটারকে ব্যবহার করতে চান তাঁদের শ্রেণীচেতনা গড়ে দেয়ার জন্য। শ্রেণীসংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই ছিলো তাঁর মূল লক্ষ্য।
মাও সেতুঙ বলেন, যারা শ্রেণীর উর্দ্ধে শিল্প-সাহিত্যের কথা বলে থাকে বাস্তবে তারা বুর্জোয়াশ্রেণীর শিল্প-সাহিত্যের ধারা বহন করে। জনগণ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন। চীনের জনগণ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, মোট জনসংখ্যার বৃহত্তম অংশ শতকরা নব্বই ভাগেরও বেশি হচ্ছে শ্রমিক, কৃষক, সৈনিক ও শহুরে পাতি বুর্জোয়ারা।
সুতরাং শিল্প- সাহিত্য হচ্ছে প্রথমত, শ্রমিকদের জন্য যাঁরা বিপ্লবকে পরিচালনা করছেন; দ্বিতীয়ত, তা কৃষকদের জন্য, বিপ্লবে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সংখ্যায় যাঁরা সর্বাধিক এবং যাঁরা বিপ্লবে সবচাইতে দৃঢ় মিত্রবাহিনী; তৃতীয়ত, তা সশস্ত্র শ্রমিক-কৃষকদের জন্য, অর্থাৎ অষ্টম রুট বাহিনী ও নতুন চতুর্থ বাহিনী এবং জনগণের অন্যান্য সশস্ত্র দলের জন্য, যাঁরা যুদ্ধের প্রধান শক্তি; এবং চতুর্থত, তা শহুরে পাতি বুর্জোয়াশ্রেণীর শ্রমজীবী- সাধারণ ও পাতি বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের জন্য, তাঁরাও বিপ্লবের মিত্র এবং তাঁরা দীর্ঘদিন সহযোগিতা করতে সক্ষম। এই চার ধরনের লোকই হচ্ছেন চীনা জাতির বৃহত্তম অংশ এবং তাঁরাই হচ্ছেন ব্যাপক জনসাধারণ।
মাও সেতুঙ ব্যাপক জনগণের জন্যই বিপ্লবী শিল্প-সাহিত্যের কথা বলেছিলেন। ব্যাপক জনগণকে শিক্ষিত করে তোলার জন্য সচেতন করে তোলার জন্য। সেজন্য সে শিল্প-সাহিত্যে যেমন থাকবে রাজনীতি বা শ্রেণীসংগ্রামের কথা তেমনি তা বোধগম্য ও সহজ সরল হবে। জনগণই যদি ব্যাপারটা ধরতে না পারলো তাহলে সে শিল্প সাহিত্য তো ব্যর্থ।
মাও একথাও বলেছিলেন যে, জনগণের মধ্যে যারা অগ্রণী অংশ তাদের জন্য চাই ভিন্ন শিল্প-সাহিত্য, সে শিল্প-সাহিত্য হবে সাধারণের চেয়ে উচ্চ ধরনের। কেডাররা হচ্ছেন জনসাধারণের অগ্রগামী অংশ। সাধারণত তারা জনসাধারণের চাইতে বেশি শিক্ষা পেয়েছেন, তাই অপেক্ষাকৃত উচ্চ মানের সাহিত্য ও শিল্পকলা তাঁদের পক্ষে একান্ত প্রয়োজন। এটা অবহেলা করলে ভুল করা হবে। সেগুলো সর্বসাধারণের বোধগম্য না হলেও চলবে। সেগুলো আবার মার্কসীয় চিন্তার বাইরে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি বাদ দিয়ে কোনো ধোঁয়াশে শিল্প-সাহিত্যেও হবে না। দর্শকের প্রতিক্রিয়া যেন লেখক বা স্রষ্টার উদ্দেশ্যের সঙ্গে মেলে। দশজন দশরকম বুঝবে এ রকম দুর্বোধ্য শিল্প-সাহিত্য মার্কসবাদী শিল্প সাহিত্য নয়।
দশজন দশরকম বুঝবে এর অর্থ দাঁড়ায় স্রষ্টা নিজে কোনো কিছু বোঝাতে অক্ষম। মাও সেতুঙয়ের ইয়েনানের এই ভাষণ মার্কসবাদী শিল্প-সাহিত্যের তত্ত্ব নির্মাণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। চীনের এই থিয়েটার ছিলো প্রধানত রাশিয়ার এ্যাজিটপ্রপের মতো প্রচারধর্মী, বিশ্লেষণধর্মী নয়। যুদ্ধের সময় শত্রুর বিরুদ্ধে জনগণের ক্রোধ জাগিয়ে তোলাই ছিলো যার মূল লক্ষ্য।
বিশের দশকে যে রাজনৈতিক নাট্যধারা জন্ম নিতে দেখি জার্মানী ও যুক্তরাষ্ট্রে এবং ত্রিশের দশকে চীনে, সেই একই রাজনৈতিক নাট্যধারা চল্লিশের দশকে জন্ম নেয় ভারতে। ভারতে এই নাট্যধারা পরিচিত ছিলো গণনাট্য হিসাবে। গণনাট্য প্রথম থেকেই মনে করতো থিয়েটারের কাজটা আপাদমস্তক মতাদর্শগত। গণনাট্য সংঘের প্রতিষ্ঠা, বিকাশ ও ব্যাপ্তি এই মতাদর্শগত চিন্তারই প্রতীক। গণনাট্য সংঘ ভারতে জন্ম লাভ করেছিলো উনিশশো তেতাল্লিশ সালে। যদিও তার আবির্ভাবের আয়োজন চলছিলো অনেক আগে থেকেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের মধ্যে। রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত প্রতিষ্ঠাই এর প্রেরণা ছিলো।
বলশেভিকদের জয় সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের সঙ্গে ভারতবাসীকেও অনুপ্রাণিত করেছিলো। সে সাথে বিশ্বযুদ্ধের প্রতিক্রিয়া ও ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের নগ্নরূপ সাম্যবাদী চিন্তাকে সংগঠিত হতে সাহায্য করেছিলো। উনিশশো বিশ সালের অক্টোবর মাসে তাসখন্দে কয়েকজন ভারতীয় মিলে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির পত্তন করে। ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের মধ্যে ভারতে এই পার্টি বিস্তার লাভ করতে থাকে। জাতীয়তাবাদী ও সন্ত্রাসবাদী যেসব বাঙালী ব্রিটিশের কারাগারে দণ্ডিত ছিলেন, তাদের অনেকেই, বিশেষ করে তরুণদের অনেকেই, মার্কসবাদী চিন্তাভাবনায় ভাবিত হচ্ছিলেন। মার্কস- এঙ্গেলসের বই তাঁরা পড়ছিলেন। সোভিয়েত রাশিয়ার শ্রমিকদের অভ্যুত্থানের ইতিহাস জানছিলেন।
মার্কসবাদ বিকাশে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছিলো ভারতের শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনগুলো। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের পর সারা ভারতে যে সর্বাত্মক হরতাল হয় তা থেকেই জন্ম নেয় অসহযোগ আন্দোলন। এই ঘটনা ভারতের নারী সমাজেও এক বিপ্লব এনে দেয়। সাধারণ ঘরের নারীরাও গৃহকোণ ছেড়ে এসে যোগ দেয় রাজনৈতিক আন্দোলনে। পারিবারিক কর্তব্যের বাইরেও যে সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্তব্য পালনের দায়িত্ব রয়েছে নারী সমাজের, এই নতুন উপলব্ধি আসে তাদের মধ্যে।
ভারতের শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যেও ব্যাপক সাড়া জাগে এর পরপরই। জগদ্দল চটকল শ্রমিকদের ব্যাপক ধর্মঘট, বোম্বাই, আহমেদাবাদ ও কানপুরের সুতাকল ও কাপড়ের কলগুলোতে শ্রমিক ধর্মঘট, দক্ষিণপূর্ব রেলওয়েকে ঘিরে শ্রমিক ধর্মঘট, টাটা ইস্পাত কারখানায় শ্রমিক ধর্মঘট, কলকাতায় গাড়োয়ান ধর্মঘট, আসামের চা বাগানে কুলি ধর্মঘট প্রভৃতি ইতিহাসের প্রসিদ্ধ ঘটনা। কৃষকশ্রেণীর মধ্যেও এ সময় একটা নতুন চেতনা আসে। জোতদার ও মহাজনের শোষণ থেকে মুক্তি পাবার জন্য তারাও সংঘবদ্ধ হতে থাকে। জাতীয় কংগ্রেসও নীতিগতভাবে স্বীকার করতে বাধ্য হয়,লাঙ্গল যার জমি তার। যদিও শ্লোগানটি ছিলো সাম্যবাদীদের।
ইতিহাসের এমনি এক সন্ধিক্ষণেই ভারতীয় গণনাট্য সংঘ জন্ম নেয়। তখন স্বাধীনতা আন্দোলন দুর্বার হয়ে উঠেছে, আন্দোলনের নেতৃত্বে প্রধান শক্তি ছিলো কংগ্রেস দল। কংগ্রেসের আপোষমুখী দোদুল্যমান নীতি জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষাকে মূর্ত করবে, জনগণের সংস্কৃতিকে বিকশিত করবে-সাধারণ মানুষ এ বিশ্বাস রাখতে পারছিলো না। স্বভাবতই, এ অবস্থায় শ্রমিকশ্রেণীর যুক্তিবাদী বৈজ্ঞানিক মতাদর্শ শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, সাংস্কৃতিক জগতেরও বিপুল সংখ্যক মানুষকে আকৃষ্ট করলো। অধিকন্তু তারা যখন জানতে পারলো, এই মতাদর্শের প্রভাবে রাশিয়ায় বিপ্লবের পর সমাজতান্ত্রিক সমাজ জীবনের বিরাট কর্মকাণ্ড সফল হচ্ছে; তখন বহু শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শকে জীবনের আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করলেন। যদিও একটি সংগঠনে ঐক্যবদ্ধ হবার প্রক্রিয়া শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে ফ্যাসিবিরোধী সংগ্রামের আন্তর্জাতিক চেতনায় এবং মন্বন্তর-মহামারীর যুগযন্ত্রণায়।
গণনাট্য সৃষ্টির পেছনে প্রত্যক্ষ কারণ ছিলো প্রগতি লেখক সংঘ বা ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক সংঘের কার্যক্রম। প্রথম মহাযুদ্ধের পর সারা ইউরোপ জুড়ে ফ্যাসিবাদের উত্থানপর্বে ভারতের বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিক নেতারা ফ্যাসিজমের উদ্ভব ও তার ভয়াবহ প্রকৃতি কিংবা তার বিপজ্জনক তাৎপর্যটা উপলদ্ধি করতে পারেননি। উনিশশো চব্বিশ সালে রম্যা রলাঁর সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাক্ষাৎকার ঘটে। বস্তুত মুসোলিনী ও ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে রোলাঁই সেদিন রবীন্দ্রনাথের চোখ খুলে দিয়েছিলেন। রম্যা রলাঁর সাথে এই সাক্ষাৎকারের পর যুদ্ধ ও ফ্যাসীবাদ বিরোধী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ জোরালো সমর্থন দেন। ১২ ভারতের তরুণ সমাজকে তা বিশেষ উদ্বুদ্ধ করে।
বিলাতের সমাজতান্ত্রিক চিন্তায় উদ্বুদ্ধ ও প্রগতিশীল তরুণ লেখকরা তখন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে নিজেদের আন্দোলন গড়ে তোলে। এ ঘটনাও অনেক ভারতীয় ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের অনুপ্রাণিত করেছিলো। ভারতের প্রগতিশীল লেখকগণ তখন নিজেদের সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। উনিশশো ছত্রিশ সালে লখনউ শহরে সর্বভারতীয় লেখকদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন মুন্সি প্রেমচাঁদ। জন্ম নেয় প্রগতি লেখক সংঘ। উনিশশো আটত্রিশ সালে কলকাতায় সংঘের সর্বভারতীয় দ্বিতীয় সম্মেলন হয়।
যুদ্ধের প্রথম অবস্থায় সংঘের রাজনৈতিক সংকল্প ছিলো সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে কোনো পক্ষকেই সমর্থন না করা। কিন্তু হিটলারের নাৎসী বাহিনী সোভিয়েত দেশ আক্রমণ করার অব্যবহিত পরেই জাপান বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেওয়ায় সংঘের প্রভাবশালী অংশ একটি নির্দিষ্ট নীতির পথ বেছে নেয়। সংঘের কোনো উদ্যমী কার্যক্রম না থাকায় সংঘের সদস্যরা কিছুদিনের জন্য স্তিমিত হয়ে পড়ে, সে সময় ঘটে একটি দুঃখজনক ঘটনা। উনিশশো বিয়াল্লিশের আটই মার্চ তরুণ লেখক, ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী সোমেন চন্দ ঢাকায় পঞ্চম বাহিনীর হাতে ছুরিকাঘাতে নিহত হন। এই হত্যাকাণ্ড বাংলার শিল্প ও সাহিত্য জগতকে ভীষণভাবে নাড়া দিলো এবং অনেকে উপলব্ধি করলো যে, এমন একটি অবস্থা দাঁড়িয়েছে যখন শিল্প ও ব্যক্তিগত সততাকে রক্ষা করতে হবে।
প্রগতি লেখক সংঘ এ সময় ফ্যাসিবাদ বিরোধী শিল্পী সংঘ নাম নিয়ে পঞ্চম বাহিনী ও তাদের ফ্যাসিস্ট প্রভুদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সিদ্ধান্ত নিলো। ফ্যাসিস্তদের যুদ্ধের বিরুদ্ধে নিজেদের বক্তব্য প্রচার করাই তখন সংঘের মূল নীতি হয়ে দাঁড়ালো। পাশাপাশি সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রতিও আস্থা স্থাপন করা হলো। সংঘের আদর্শ ও লক্ষ্য ক্রমশ স্বচ্ছ হয়ে উঠতে লাগলো।
সাহিত্যিক ও লেখকরা ফ্যাসিবাদ বিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করলেও পেশাদার নাট্যদলগুলোর ভূমিকা ছিলো আগের মতোই গতানুগতিক। স্পেনের গৃহযুদ্ধ, মুসোলিনীর ফ্যাসিস্ত সৈন্যদল কর্তৃক আবিসিনিয়া আক্রমণ, জাপানের চীন আক্রমণ এবং অবশেষে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ায় আন্তর্জাতিক অবস্থার যে একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটে তার প্রতিক্রিয়া ভারতবর্ষেও দেখা দেয়।
ভারতের গণমানসে একটা নতুন চেতনা আসে, শ্রেণীশোষণের বিরুদ্ধেও বিক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে। পেশাদার মঞ্চের নাটকে এর কোনোই ছায়া পড়ে না। শ্রেণীশোষণকে ভিত্তি করেই যে পুঁজিবাদ দাঁড়িয়ে আছে এবং সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ যে তারই নগ্ন রূপ, এসব বিষয়ে পেশাদার মঞ্চের কর্তৃপক্ষগণ ও তাঁদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নাট্যকারগণ একেবারে উদাসীন ও অচেতন ছিলেন বললেই চলে। পেশাদার নাট্যশালা সর্বসাধারণের মনোরঞ্জন করতে গিয়ে নাটকের বিষয়বস্তুকে ক্ষণস্থায়ী উপভোগ্য করে তুলেছিলো। পেশাদার মঞ্চের গতানুগতিক ধারা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, যেভাবে সাধারণ রঙ্গালয় চলছে তা মোটেই আশাপ্রদ নয়।
চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে তাই ফ্যাসিবিরোধী লেখক শিল্পী সংঘের গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছিলো ভারতীয় গণনাট্য সংঘ। সমাজ পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও আন্তর্জাতিক আদর্শের প্রতি গভীর আস্থা ও আনুগত্য রেখে ঘোষিত হয়েছিলো গণনাট্য সংঘের কর্মসূচী। গণনাট্য সংঘের প্রথম সর্বভারতীয় সম্মেলনে জনগণের স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক ন্যায় বিচার ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য সংগ্রামকে গণনাট্য আন্দোলনের কর্তব্য ও দায়িত্ব বলে ঘোষণা করা হলো। গণউন্নয়ন ও গণমুক্তির চেতনাকে নাটকের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলাই ছিলো এর মুখ্য উদ্দেশ্য। গণনাট্যের ঘোষণাপত্রে বিষয়বস্তু নির্ধারণের প্রশ্নে বলা হয়েছিলো, সমাজের যে শ্রেণীদ্বন্দ্বগুলি প্রধান সে শ্রেণীগুলিকে সঠিকভাবে দর্শকদের সামনে তুলে ধরাটাই হবে গণনাট্যের কাজ।
নাট্যকারদের দায়িত্ব প্রসঙ্গে বলা হয়েছিলো-শ্রমিক-কৃষক এই দুই প্রধান শ্রেণীর আন্দোলনের পটভূমিকায় শ্রমিক-মালিকের দ্বন্দ্ব ও কৃষক-জোতদার-জমিদারের দ্বন্দ্বগুলিই স্বাভাবিকভাবে প্রাধান্য পাবে। যেহেতু এই মূল দ্বন্দ্ব ছাড়াও শ্রেণীবিভক্ত সমাজে নানা ধরনের দ্বন্দ্বের অস্তিত্ব বর্তমান, যেহেতু শ্রমিক ও কৃষক এই দুই প্রধান শক্তি ছাড়াও অসংখ্য মেহনতী মানুষ প্রতিনিয়ত একচেটিয়া পুঁজিবাদ, সামন্ততন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সামিল হচ্ছে, তাদের জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত এবং সংগ্রামের কাহিনীও নাটকের উপাদান হিসাবে ব্যবহৃত হওয়া দরকার। ঘোষণাপত্রে আরো বলা হয়, শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শ্রেণী ভেদাভেদের উর্দ্ধে কোনো শিল্পের অস্তিত্ব নেই, সমস্ত শিল্পকর্মই শ্রেণীভিত্তিক। সার্থক শিল্প সৃষ্টির জন্য শিল্পকর্ম তাই জনগণের জীবন ও সংগ্রাম অর্থাৎ শ্রেণীসংগ্রামকেই উপস্থিত করবে এবং শ্রেণীহীন শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক, কৃষক ও অন্যান্য সকল স্তরের মেহনতী মানুষের সংগ্রামী মোর্চার সাংস্কৃতিক বাহিনী রূপে কাজ করবে।
গণনাট্য সংঘের প্রচারিত উদ্দেশ্য থেকে এটা পরিষ্কার হলো যে, গণনাট্য আন্দোলন গড়ে উঠবে বিভিন্ন গণ আন্দোলনের মাধ্যমে এবং শ্রমিক-কৃষক ও অন্যান্য সংগ্রামী শ্রমজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের যে সাম্রাজ্যবাদী লড়াই, এক কথায় সাম্যবাদের লড়াই তার সঙ্গে যুক্ত থেকে। গণনাট্যের সত্যিকার কর্মীদের মধ্যে এ নিয়ে কোনো সংশয় ছিলো না যে, সমস্ত শিথিলতা ও পিছুটান সরিয়ে ফেলে সংগ্রামী শ্রমিক-কৃষক ও মধ্যবিত্তের লড়াইয়ের মধ্যে তাদের ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। শ্রেণী চেতনায় তারা কোন্ পক্ষে, এবং উদ্দেশ্যই বা কী-এ ব্যাপারে তারা নিজেদের পরিষ্কার করে নিয়েই নাট্য আন্দোলনে নামলো।
মার্কসবাদী রাজনীতির সংস্পর্শেই গণনাট্য সংঘ জন্ম নিয়েছিলো যদিও শুরুতে তা অতোটা উচ্চকিত ছিলো না। যদিও একেবারে প্রথম থেকেই গণনাট্য আন্দোলনের অধিকাংশ কর্মী মার্কসবাদী রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী ছিলো, তবুও প্রগতিশীল ব্যক্তিরাও যাতে গণনাট্যের সাথে যুক্ত হতে পারে সেজন্য খোলাখুলিভাবে তার প্রচার ছিলো না।
গণনাট্য সংঘ যখন জন্ম নেয় সে সময়টা ছিলো ভারতের রাজনীতির এক বিশেষ পর্ব। বিশেষ করে বাংলার জন্য বিশ শতকের চল্লিশের দশক সত্যিই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দশক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ একেবারে ঢুকে পড়লো ভারতের ঘরের ভিতর। যুদ্ধে মদমত্ত সৈনিকদের সবুট পদের আস্ফালনে ভারতের ভূমি কম্পমান। যুদ্ধের রসদ যোগাতে গিয়ে ব্রিটিশ ভারতের শস্যভাণ্ডার শেষ। বিবেকশূন্য মুনাফাখোর, মজুতদার, চোরাকারবারিরা ব্রিটিশ সরকারের বাহিনীকে খাদ্য জোগাতে সাহায্য করে টাকার পাহাড় বানালো আর সাধারণ মানুষের জন্য বয়ে আনলো দুর্ভিক্ষ-অভাব-অনটন। মানুষের সৃষ্ট সেই দুর্ভিক্ষ যা পঞ্চাশের মন্বন্তর বলে চিহ্নিত, সেই মন্বন্তরে বাংলাদেশের পনের লক্ষ দরিদ্র নর-নারী সর্বনাশের সম্মুখীন হয়েছিলো। ১৩০ বাংলার পেশাদার নাট্যমঞ্চে এর কোনো চিত্রই ধরা পড়েনি। বাংলার পঞ্চাশ হাজার মানুষ মারা পড়ছে মন্বন্তরে।
সে ব্যাপারে পেশাদার নাট্যশালা ছিলো সম্পূর্ণ নীরব। পেশাদার নাট্যশালায় তার কোনো প্রতিধ্বনি নেই। পেশাদার থিয়েটার তখনও গণ্ডিবদ্ধ হয়ে পুরানো চক্রের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, কিছুতেই সে চক্র ভেঙে বের হয়ে আসতে পারছে না। মিলনায়তনের বাইরের জগতটাকে যেন সে দেখতেই চাইছে না, পুরানো চিন্তার মধ্যেই বুঁদ হয়ে আছে।
ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে কলকাতার পেশাদার নাট্যশালার সঙ্গে জীবন ও সমাজের বাস্তব কোনো সম্পর্ক ছিলো না। রোমান্টিক নাটক কিংবা ধর্মাশ্রিত নাটক রচনা ও মঞ্চায়নে তখনও তারা ব্যস্ত। সারা দেশের সংগ্রামের ঘটনা মঞ্চে আনার আগ্রহ কারোরই ছিলো না। শ্রেণীসংগ্রাম বা সমাজতন্ত্র কিংবা ফ্যাসিবাদ এসব প্রসঙ্গ বাদ দিলেও, জনগণের স্বাধীনতার স্পৃহা, স্বাধীনতার জন্য জনগণের লড়াই-এসব ঘটনা থেকেও নাটক তখন মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলো।
পেশাদার থিয়েটারে দর্শক তখন কমে গেছে, দর্শকদের টেনে আনবার জন্য দলগুলো কোনো চিন্তা উদ্ভাবন করতে পারছে না। যেন নতুন এক থিয়েটারকে জায়গা করে দেবার জন্য ইতিহাস এ অনিবার্যতাকে সৃষ্টি করেছে। ফলে চুয়াল্লিশ সালে বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের জড়তা, পৌনঃপুনিকতা আর স্থূলতাকে ভাঙার জন্য গণনাট্যের জন্ম। গতানুগতিক পেশাদার মঞ্চের আওতার মধ্যে থেকেই তার সংস্কারের প্রচেষ্টায় গণনাট্যের উদ্ভব নয়, তার উদ্ভব হয়েছে সমাজ মানুষের এক রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক কার্যকারণে।
ভারতীয় গণনাট্য সংঘকে কোনো একটি বিশেষ গোষ্ঠী ভাবলে ভুল করা হবে। চল্লিশের দশকে এটা গড়ে ওঠে এক সর্বভারতীয় নয়া সাংস্কৃতিক আন্দোলন রূপে। আসমুদ্র হিমাচল এতে আলোড়িত হয়। এর ব্যাপ্তি ছিলো কাশ্মীর থেকে কন্যা কুমারিকা, গুজরাট থেকে মনিপুর পর্যন্ত। যদিও বাংলা তথা পশ্চিমবঙ্গেই সবচেয়ে ব্যাপকতা লাভ করেছিলো এ আন্দোলন। চল্লিশোত্তর গণনাট্য আন্দোলন গড়ে উঠবার কালে বলা হয়েছিলো বাঙলা তথা ভারতীয় থিয়েটারকে চার দেয়ালে আবদ্ধ রাখা হবে না। গণমানুষের কাছে নিয়ে যেতে হবে নাট্যশিল্প কিংবা সকল ধরনের শিল্পচর্চাকে। নাটকের বিষয়বস্তুর মধ্যেও স্থান পেল কৃষক-শ্রমিক কিংবা মেহনতী মানুষের জীবন ও সংগ্রাম।
গণনাট্যের বিষয়বস্তু সংক্রান্ত নির্দেশগুলি থেকে একথা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো গণনাট্যের মূল দর্শক হবে শ্রমিক-কৃষক ও অন্যান্য মেহনতী শ্রেণীগুলি। লক্ষ-কোটি মেহনতী মানুষের উন্মুক্ত অঙ্গনে নাট্যকর্ম ছড়িয়ে দেওয়াই হবে এর আদর্শ। স্বাধীনতা-পূর্ব এবং পরবর্তী যুগে গণনাট্যই হলো সেই ধারা, যা কলকাতা শহরে আটকে থাকতে চায়নি। গণনাট্যকে ঘিরে বাংলা থিয়েটারে আবার হলো পালাবদল। মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তের গণ্ডি ভেঙে গণনাট্য আন্দোলনের দর্শক হলেন লক্ষলক্ষ
শ্রমিক-কৃষক-শ্রমজীবী। চল্লিশের দশকের গোড়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দেশব্যাপী ফ্যাসিবাদ বিরোধী, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণ-আন্দোলন চলছিলো। সেই সময় দেশ রক্ষা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছিলো গণনাট্য আন্দোলন। গণনাট্য মানেই প্রগতিশীল নাটক। বিষয়বস্তুর মধ্যে শ্রমিক-ধর্মঘট, কৃষকের ভূমি ও ফসলের লড়াই, পঞ্চায়েত নির্বাচন, গণ সাক্ষরতা, নারীর অধিকারের সংগ্রাম, শ্রমিক কর্মচারীদের সংগ্রাম এ সবই ছিলো। মতাদর্শগত সংঘাত সংগ্রামের কথাও থাকতো, পশ্চাদপদতার বিরুদ্ধে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিরও দেখা মিলতো। গ্রাম নগরের নয় কোটি দর্শকদের হৃদয় জয় করতেই গণনাট্য আন্দোলন।
শুধু হৃদয় জয় করাটাই মুখ্য নয়, গণনাট্য আন্দোলনে পূর্ববর্তী যুগের সামন্তসমাজের বিরোধিতা, ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার সমালোচনা, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা প্রভৃতি প্রগতিশীল সারবস্তু আরো তীক্ষ্ণ আরো তাৎপর্যময় হয়ে দেখা দিলো। গণনাট্য সংঘ ফ্যাসিবাদ, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, স্বদেশি প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ও মন্বন্তর বিরোধী নাট্য অভিযান শুরু করে। যেমন, ব্যক্তিগত মানুষের স্থানে শ্রেণীগত মানুষের অবতারণা, বঞ্চিত, বুভুক্ষু, শ্রীহীন মানুষকে নিয়েই নাটক রচনা, সংঘবদ্ধ মানুষের প্রতিরোধ, সংগ্রামী মানুষের অন্তিম জয়, যেগুলির মধ্যে প্রগতিবাদী, মানবমুক্তিকামী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় আছে।
গণনাট্য সংঘ কখনই সমকালীন সমস্যাগুলোকে পাশ কাটিয়ে যেতে চেষ্টা করেনি। গণনাট্য সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমস্যাবলী জনগণের সামনে উপস্থাপন করে দেশবাসীর ব্রিটিশ বিরোধী, ফ্যাসিবিরোধী মানসিকতাকে জাগরূক করে দিতে বদ্ধপরিকর হলো। শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, অত্যাচারীর মুখোশ খুলে ধরা, মুনাফাখোর, মজুতদারের বদমায়েসি প্রকাশ করা, অর্থনৈতিক শোষণ এবং সামাজিক অবক্ষয়ের পরিণাম এবং এর সঙ্গে মুক্তিকামী মানুষের জীবন সংগ্রাম, প্রতিরোধ ও বাঁচার লড়াইকে সামনে এনে মানুষের মুক্তি ও শ্রেণীহীন সমাজ গঠনের উপস্থিত সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করে তোলা-এই ছিলো ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সকল সাংস্কৃতিক কাজের অনুপ্রেরণা। কৃষক জীবন, শ্রমিক জীবন, অবহেলিত শোষিত সাধারণ মানবজীবন ও মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজ-এগুলিই তার সব বঞ্চনা ও শোষণ নিয়ে মঞ্চে হাজির হলো। চল্লিশ দশকে এবং তারপরেও যেখানেই সাধারণ মানুষ অত্যাচার আর অন্যায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে, সেখানেই গণনাট্য জনগণের সংগ্রামের পাশে থেকেছে।
গণনাট্যের মাধ্যমেই মার্কসবাদের প্রসার ও প্রচার শুরু হলো গ্রামে গঞ্জে খেটে খাওয়া মানুষদের মধ্যে। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের আবির্ভাব শ্রমজীবী মানুষের মুক্তিকে লক্ষ্যে রেখেই সংগঠিত হয়েছিলো, যা রাজনৈতিক নাটকের গণমুখীনতার দিকটিকে বাস্তবায়িত করলো নানা ধরনের নাটক মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে। ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা যেমন শুরু হলো নাট্যরচনা ও প্রযোজনায়, তেমনি দেশের সামন্ততান্ত্রিক পশ্চাদপদতা, সাম্প্রদায়িকতা, প্রাদেশিকতা ও উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের, শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্তের সংগ্রামী জীবন চেতনাকে উন্নীত করে তোলা হলো। শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য সংহতি তার শ্রেণীশত্রুকে চিহ্নিত করতে শুরু করলো।
গণনাট্যের আলোচিত এই নাট্য আন্দোলন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয়ে ওঠে শ্লোগানধর্মী। সেখানে রাজনীতি থাকলেও নাটকীয় উপাদানের অভাব ছিলো। গণনাট্যের এ নাটকগুলো মানুষের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করলেও তার মধ্যে সমাজ বিশ্লেষণ ছিলো খুবই কম। গণনাট্য আন্দোলনের প্রচুর দুর্বলতা ছিলো। গণনাট্য সংঘে সৃজনশীল প্রতিভার যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হয়েছিলো। ক্রমে গণনাট্য সংঘের অধিকাংশ অনুষ্ঠান রূপরীতিহীন বিষয়বস্তুতে পরিণত হতে থাকে। গণনাট্য আন্দোলনের গোড়ার দিকের নাটকে প্রগতিশীল কথাবার্তা থাকলেও বৈপ্লবিক দিক থেকে নাটকগুলি ছিলো নিম্নমানের।
গণনাট্যের নাটক সম্পর্কে তাই অনিল দে বিতর্ক তুলেছেন, ‘এ নিয়ে কখনও আমরা প্রশ্ন তুলি নি যে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের কৌশল বা দলিলের আংশিক প্রকাশ থাকলেই সেটিকে প্রগতিশীল নাটক বলা যাবে কি না। ১৩ তিনি বলেন, আর এই দ্বিধাই আমাদের থিয়েটারে রাজনৈতিক নাটকের সংজ্ঞা সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা দিতে অক্ষম হয়েছে। তিনি আরো লিখছেন, ‘গণনাট্য সংঘ যাটের দশকে কিংবা পরবর্তীকালে এমন কোনো প্রযোজনা দর্শকের সামনে উপস্থিত করতে পারে নি-যা প্রগতিশীল হলেও দর্শকের বিপুল অনুমোদন লাভ করেনি। তিনি বলছেন, এর কারণ সম্ভবত ‘রাজনৈতিক নাটক’ নামে যে নাটকগুলিকে চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো যথার্থ অর্থে রাজনৈতিক নাটক ছিলো না, সেগুলো ছিলো প্রচারমূলক এক ধরনের সংকীর্ণ নাট্যভঙ্গি।
সন্দেহ নেই গণনাট্য সংঘের নাটক একসময় পশ্চিমবাংলার গ্রাম-গঞ্জ মাতিয়ে তুলেছিলো। বিরাট সাড়া ফেলে দিয়েছিলো। কিন্তু তলিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে সংঘের নাটকে কিছুটা বৈচিত্র্যের অভাব ছিলোই। মানুষের প্রাণের কথা বলা হয়েছে ঠিকই কিন্তু মানুষের ‘প্রাণের কথা’র জগৎটা অনেক বড়, তার সবটা সংঘের রাজনৈতিক নাট্যে প্রতিফলিত হয়নি। যেটুকু প্রতিফলিত হয়েছে সেটুকুও নিতান্ত প্রয়োজনীয় একটি অংশ মাত্র। গণনাট্যের নাটকে সবসময়ই ঐশ্বর্যের অভাব ছিলো। প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে, প্রাত্যহিক প্রয়োজনের স্থূলতার মধ্যে যে বোধবুদ্ধি সীমাবদ্ধ তার ভূমিকা সংকীর্ণ। এই বৈচিত্র্যহীন সংকীর্ণতা গণনাট্যের রাজনৈতিক নাটকে সর্বদাই ছিলো, বিচার করে দেখলে সে সত্য সকলের চোখেই ধরা পড়বে।
প্রত্যক্ষ রাজনীতির সংগ্রামটা যে-সকল মানুষের জীবনের এক অপরিহার্য অংশ, সেই সকল মানুষরা বৈচিত্র্যমণ্ডিত হয়ে সামগ্রিকভাবে গণনাট্যের রাজনৈতিক মঞ্চে প্রতিফলিত হয়নি। গণনাট্যের নাটকের বৈচিত্র্যহীনতার প্রশ্নে হীরেন ভট্টাচার্য চমৎকার একটি প্রশ্ন তুলেছেন যে, ‘খেটে খাওয়া মানুষের বাস্তব লড়াইয়ের পাশে নাটককে নিয়ে যাওয়ার জন্য যখন বহু নাট্যকার কলম ধরেছেন এবং সংগ্রামী ঘটনা-ভিত্তিক প্রচুর নাটক যথাসাধ্য লিখে গেছেন, তখন তাঁদের নাটকের বৈচিত্র্যহীনতার জন্য আক্ষেপ করা যেতে পারে কিন্তু ঐ অবস্থায় নাটক না লিখে এবং সর্বহারার সংগ্রামে অংশগ্রহণ না করাটা কি সঠিক হতো?
ইতিহাসে ভুরি ভুরি চিরায়ত নাটক লেখা কখনই কোনো সমাজে সম্ভব হয়নি এবং গণনাট্যের নাট্যকারের মেধা না থাকলে কী করা যাবে! কিন্তু জনগণের-সর্বহারা মানুষের সংগ্রাম থেকে তাঁরা তো দূরে সরে থাকেননি। গণনাট্যের বাইরে বহু প্রতিভাবান নাট্যকারই তা করেছেন, নিজেদের আত্মপ্রতিষ্ঠার স্বার্থে সর্বহারার সংগ্রাম থেকে দূরে সরে ছিলেন। গণনাট্যের শত ত্রুটি সত্ত্বেও বলতে হয়, প্রকৃত গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক শিল্প বা নাট্যধারা তৈরি করাও একটা বিরাট রাজনৈতিক সংগ্রাম; সে
বিচারে গণনাট্য সংঘের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যাবে না। গণনাট্য আন্দোলন ছিলো বাংলার রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলনের ভিত্তি স্বরূপ। গণনাট্যের রাজনৈতিক নাটকগুলি তার শত ত্রুটি সত্ত্বেও, শোষিত মানুষের আকাঙ্ক্ষিত প্রাণের কথাটি মঞ্চে তুলে ধরতে পেরেছে। কাজেই রাজনৈতিক নাটকগুলি বহুদিন ধরে একই কথা বলে গেলেও সে নাটক দেখার জন্য মানুষের ভীড় কখনও কমেনি। ‘মানুষের প্রাণের কথা’ ব্যাপারটা এমন যে তা কখনও বৈচিত্র্য হারায় না। প্রাণের কথা, তা সে ব্যক্তিগত বা সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক যাই হোক না কেন বৈচিত্র্যহীন হয়েও তা গ্রহণযোগ্য হয়। কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের ক্ষেত্রে তা খুব কার্যকরী নয়।
মার্কসবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে গণনাট্যের নাটক রীতিমত চর্বিতচর্বণ হয়ে উঠেছিলো। বারবার একই ধরনের ঘটনা, গল্প, সংলাপ ও একইরকম বক্তব্য ঘুরেফিরে আসছিলো এবং প্রচারটা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো শ্লোগনধর্মী। রাজনৈতিক নাটকের মূল লক্ষ্য মার্কসবাদ প্রচার তা নিয়ে কোনোই সন্দেহ নেই। সে প্রচারের অর্থ এ নয় নাটকে কতোগুলো শ্লোগান জুড়ে দেয়া, কিংবা মার্কসের তত্ত্বগুলো সব নাটকে আওড়ে যাওয়া। রাজনৈতিক ঘটনাবলী সর্বক্ষেত্রেই ক্ষমতা দখল কিংবা দখলের পর তা অধিকারে রাখার প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা দেয়। এই ঘটনাবলীকে নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ না করলে নাট্যকার তার সিদ্ধান্তে একপেশে হয়ে পড়েন, যার ফলশ্রুতিতে সত্যের বিকৃতি ঘটে।
বিকৃত সত্য কখনই সমাজের তথা মানুষের কোনো উপকারে আসে না। নাট্যকারকে নিরাসক্তভাবেই সমাজকে বিশ্লেষণ করতে হয়, তা না হলে প্রায়শই ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হবার, অন্ধকারে হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। মার্কসবাদের মূল কথা হলো শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রমিকশ্রেণীকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে হবে। শ্রমিকশ্রেণীর ক্ষমতা দখলকে পশ্চিমবঙ্গের গণনাট্য যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। গণনাট্য খুব গুরুত্বের সাথেই জনগণকে বোঝাচ্ছিলো প্রচলিত সমাজ কেন ক্ষতিকর, কেন তার বিরুদ্ধে লড়াই করা দরকার। কিন্তু শোষণ ব্যবস্থার সামগ্রিক চেহারাটা সব নাটকে ঠিকভাবে আসছিলো না।
বেশির ভাগ নাটকেই শোষণের বাইরের রূপটা দেখা যাচ্ছিলো বটে, তার ভেতরের দ্বান্দ্বিক রূপটা ধরা পড়ছিলো না। চীনের গণনাট্যে সম্পর্কে মাও সেতুঙ একই মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেন, চীনের নাট্য রচনায় আমি দেখছি রাজনৈতিক দিকটিই এখন অধিকতর সমস্যা। শ্রেণী সম্পর্কগুলো সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয় না। কিছু কমরেডের প্রাথমিক রাজনৈতিক জ্ঞানেরই অভাব রয়েছে এবং এর ফলেই নাট্যরচনায় নানারকমের ভ্রান্ত ধারণা দেখা দিচ্ছে।
মাও সেতুঙের মতে ‘শিল্প-সমালোচনা একটি জটিল প্রশ্ন, তার জন্য বিশেষ ধরনের প্রচুর অধ্যয়নের প্রয়োজন’। তিনি লিখছেন, ‘শিল্প-সমালোচনার ক্ষেত্রে বিচারের দুটি মানদণ্ড রয়েছে-একটি রাজনৈতিক মানদণ্ড, অন্যটি হচ্ছে শিল্পগত মানদণ্ড’। মাও বলেন, বিমূর্ত ও একান্ত অপরিবর্তনীয় একটি মানদণ্ড আছে বলে আমি মনে করি না। রাজনৈতিক মানদণ্ড ও শিল্পগত মানদণ্ড; এ দুয়ের মধ্যে সম্পর্কটা কি? মাও এ সম্পর্কে বলেন, সবসময় রাজনীতি ও শিল্পের মধ্যে একটি ঐক্য তরি করা দরকার। বিষয়বস্তু এবং সর্ব্বোচ্চ সম্ভব নিখুঁত শিল্পগত আঙ্গিকের মধ্যকার ঐক্য। যেসব শিল্পগত রচনায় শিল্পগুণের অভাব রয়েছে তা রাজনৈতিকভাবে যতো প্রগতিশীলই হোক না কেন তা হয়ে পড়ে শক্তিহীন।
সুতরাং ভুল রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন শিল্প সৃষ্টির প্রবণতার আমরা যেমন বিরোধিতা করি, তেমনি পোস্টার ও শ্লোগানের কায়দায় শিল্পসৃষ্টির প্রবণতা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে সঠিক হওয়া সত্ত্বেও তাতে শিল্পগত শক্তির অভাব থাকলে আমরা তার বিরোধিতা করি। গণনাট্যের নাটকের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছিলো, তাহলো নাটকগুলো বৈচিত্র্যহীন, একঘেয়ে ও শুদ্ধ।
গণনাট্যের নাটকগুলো যে বৈচিত্র্যহীন ছিলো সে অভিযোগ মিথ্যা নয়। রাজনৈতিক সংগ্রামটা মানুষের জীবনের যে বিপুল বিস্তার নিয়ে বৈচিত্র্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে, গণনাট্যের নাটকে তা প্রতিফলিত হতে দেখা যায় না। হীরেন ভট্টাচার্য দেখান যে, নাট্যকাররা মার্কসবাদ প্রচার করেছে বলেই নাটকগুলো একঘেয়ে হয়নি। বরং নাট্যকাররা যথেষ্ট মার্কসবাদী ছিলেন না বলেই তাঁদের নাটকে সুবিপুল জীবন তার সমগ্র বৈচিত্র্য নিয়ে প্রতিফলিত হতে পারেনি। মার্কসবাদী নাট্যকার হতে গেলে মার্কস-লেনিনের তত্ত্ব যেমন পড়া থাকা চাই, তেমনি নাটকে স্বকীয় বাস্তব অবস্থার সৃজনশীল প্রয়োগ ঘটানোর ক্ষমতাও থাকা চাই। মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনাকে দেখতে শিখলে মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক সকল সমস্যার উপরই নাট্যকার আলোকপাত করতে পারবেন। নাটক তখন বৈচিত্র্যহীন হবে না। গণনাট্যের নাটকের বিরুদ্ধে প্রধান যে অভিযোগ ছিলো তা হলো চরিত্র সৃষ্টির ত্রুটি। চরিত্রগুলি ছিলো নিষ্প্রাণ এবং ভালো-মন্দ দুভাগে বিভক্ত।
জমিদার-জোতদার যেহেতু শোষক তাই তাদের সবকিছুই খারাপ, শ্রমিক যেহেতু বিপ্লবী তাই তার সবকিছু ভালো-মার্কসবাদ এটা স্বীকার করে না। মার্কসবাদ মনে করে, শ্রমিকরাই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মূল শক্তি কিন্তু তার স্বভাবে রয়েছে নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি। যদি সেগুলো তাকে না জানানো হয়, যদি সেগুলো সম্পর্কে সে সচেতন না হয়ে বুর্জোয়া রাষ্ট্র কাঠামো দখল করে, তার ফলাফল ভালো হবে না; তার হাত দিয়ে তৈরি হবে নৈরাজ্য।
মার্কসবাদের প্রশ্ন শুধু ক্ষমতা দখলের প্রশ্ন নয়, শুধু লড়াই নয়-সেই ক্ষমতায় টিকে থাকা, ক্ষমতায় গিয়ে সমস্ত শ্রেণীশোষণের অবসান ঘটানো। প্যারি কমিউন গঠনের পর শ্রমিকদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা চলে গেলেও ক্ষমতায় তারা টিকে থাকতে পারেনি। মার্কস তার কারণ দেখিয়েছিলেন সমাজ বিজ্ঞান সম্পর্কে তাদের চেতনার অভাব, চিন্তার দৈন্যতা। রাজনৈতিক নাটকের লক্ষ্য শুধু শোষকদের বিরুদ্ধে শোষিতদের উত্তেজিত করাই নয়, শুধু শ্রেণীঘৃণার প্রকাশ নয়, শোষিতদের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষিত করে তোলা-যার অর্থ তাদেরকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিদান। চিন্তার জগৎটাকে যুক্তির দ্বারস্থ করা। সেখানেই গণনাট্যের ব্যর্থতা খুব প্রকট হয়ে উঠো উঠেছিলো।
শোষিতদেরকে তারা একপেশে বক্তব্য দিয়ে যতোটা উত্তেজিত করছে সে পরিমাণে যুক্তিবাদী মনোজগৎ গড়ে দিতে পারেনি। নাটকগুলো যতোটা উত্তেজনার খোরাক যুগিয়েছে, সে পরিমাণে চিন্তা করার সুযোগ রাখেনি; যদিও নাটকগুলো মঞ্চস্থ হয়েছে শ্রমিক-কৃষকদের মধ্যে। গণনাট্যের নাটক সম্পর্কে তাই হেমাঙ্গ বিশ্বাস লিখছেন, সোভিয়েত দেশের গোর্কি বর্ণিত সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার ধ্বনি সবে তখন ভারতে এসে পৌছেছে এবং গণনাট্যের সাহিত্য ও শিল্পে শ্রেণীসংগ্রামের কথা বলা শুরু হয়েছে; যদিও তার প্রয়োগ ও বিশ্লেষণে ছিলো নানা বিভ্রান্তি। ১৪৪
গণনাট্য সংঘ পরবর্তীকালে তার চিন্তা চেতনার জগতে নতুন নতুন অনেক প্রশ্নকে তুলে আনতে বাধ্য হয়।
সেখানে নাটক রচনা সম্পর্কে বলা হয়, নাটকের কাহিনী সৃষ্টিতে, চরিত্র গঠনে, সামাজিক ঘটনা ও ঘটনার উত্থান-পতন সংক্রান্ত বিষয়ের উপস্থাপনায় সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে যেন কোনোক্রমেই এগুলি মূল আদর্শ বা তত্ত্ব থেকে বিচ্যুত না হয়। নাট্যকারদের কর্তব্য সম্পর্কে সেখানে বলা হয়, শ্রেণীসংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে নতুন জীবনবোধ ও সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টি হচ্ছে তাকে প্রাধান্য দিতে হবে। শাসকশ্রেণীর চরিত্র বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানের সঠিক মূল্যায়নের ভিত্তিতেই শুধু শ্রেণীশত্রুর মুখোশ প্রকাশিত হবে। আর সামাজিক নানা কার্যকারণে নিয়ত দোদুল্যমান মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তের ও শোষিতদের চরিত্রাঙ্কন করে, এবং অকস্মাৎ তাকে সংগ্রামী নায়ক করে তোলার প্রবণতা ত্যাগ করে, মানুষের দোদুল্যমানতার সঠিক বস্তুবাদী ব্যাখ্যা তুলে ধরতে হবে। যা হবে একদিকে বিপ্লবী মতাদর্শ সম্পর্কে যত্নবান এবং অন্যদিকে শিল্প হিসাবে সকলের কাছে আদৃত।
‘ঘোষণা সত্ত্বেও গণনাট্যের রচনায় রাজনৈতিক বক্তব্য উপস্থাপনে এবং তার মঞ্চায়নে বহুবিধ ত্রুটি লেগেই ছিলো। তথাপি গণনাট্য আন্দোলনের রাজনৈতিক চরিত্রটি ছিলো স্পষ্ট। রচনা ও মঞ্চায়নের সকল ত্রুটি সত্ত্বেও, সেটা কোনো সৌখিনতার ব্যাপার ছিলো না। সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যেই তাঁদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছিলো। সেখানে নাট্যকর্মীর ত্যাগ-তিতিক্ষার ব্যাপারটি প্রাধান্য পেয়েছিলো।
বাংলা রঙ্গমঞ্চের প্রবাদ পুরুষ উৎপল দত্তের রাজনৈতিক নাট্য প্রযোজনায় হাতে খড়ি হয়েছিলো এই গণনাট্য সংঘের প্রভাবে এবং গণনাট্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে। সারা বিশ্বের রাজনৈতিক নাট্যাঙ্গনের আর এক দিকপাল হচ্ছেন উৎপল দত্ত। চল্লিশ বছর যিনি একটানা রাজনৈতিক নাটক করে গেছেন। উৎপল দত্তের নাট্যকর্ম আরম্ভ হয়েছিলো বিদেশি নাটক প্রযোজনা, পরিচালনা ও অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। তিনি খাঁটি ইউরোপীয় বৈজ্ঞানিক থিয়েটারের ধারায় দীক্ষিত ছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা- উত্তরকালে উৎপল দত্ত প্রথম রাজনৈতিক নাট্যাঙ্গনে পা রাখেন গণনাট্য সংঘের মাধ্যমে। যিনি জীবনের শুরুতে ছিলেন শেক্সপিয়ারের ইংরেজি নাটকের সাথে যুক্ত এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত যিনি ইংরেজি নাটক ভিন্ন অন্য কোনো নাটক করেননি, সেই উৎপল দত্তই খুব শীঘ্রই পশ্চিমবঙ্গ তথা সারা ভারতের প্রধান রাজনৈতিক নাট্য ব্যক্তিত্ব হিসাবে আবির্ভূত হলেন।
যিনি স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের ঘটনাবলীর কারণে খুব শীঘ্রই বুঝতে পারলেন নাটক মঞ্চায়নের কোনো একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকা দরকার। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় লালফৌজের প্রতিরোধ ও প্রত্যাক্রমণের কাহিনী পড়ে তিনি চমকিত হতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত লালফৌজের অগ্রগতির সংবাদ তাঁকে রীতিমতো উত্তেজিত করতো হিটলারের বিরুদ্ধ পক্ষ অবলম্বন করতে। সে-সময় স্কুলে থাকতেই তিনি স্ত ালিনের রচনা পাঠে মনোযোগ দেন। স্কুল শেষ হতে না হতেই লেনিন-মার্কস-এঙ্গেলস- কান্ট-হেগেল-ফয়েরবাখ পড়তে শুরু করেন।
থিয়েটারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে তখনো তাঁর কোনো পরিষ্কার ধারণা ছিলো না। তিনি ছিলেন মাত্র একজন সৌখিন নাট্যশিল্পী।
পূর্বে উল্লিখিত ইংরেজি নাটকের সাথেই ছিলো তাঁর সম্পর্ক। সেখানে নাটক পরিচালনা করেছেন, নাটকে অভিনয় করছেন। পরবর্তীকালে কিছুদিন ‘শেক্সপিয়ারিয়ানা ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার কোম্পানি’তে জেফ্রি কেন্ডালের অধীনে পেশাদার নাট্যাভিনেতা হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন। সেটাই ছিলো তাঁর জন্য নাটক সম্পর্কে জানা ও বোঝার শিক্ষানবিশী কাল। সেখানেই তিনি থিয়েটারের কঠোর বাস্তব সত্যগুলির সম্মুখীন হন। এই পেশাদার দল থেকে নাটক পরিচালনা, অভিনয় ও নাট্য সংগঠন চালাবার দক্ষতা অর্জন করলেও জনগণের সাথে কিংবা রাজনীতির সাথে নাটকের যে সম্পর্ক সে ব্যাপারে তাঁর তেমন কোনো অভিজ্ঞতা ছিলো না। গণনাট্য সংঘই তাঁকে জনতার মুখরিত সখ্যে নিয়ে যায়। ১৪৬ গণনাট্য সংঘে এসেই তিনি নাটক সম্পর্কে নতুন দিক নির্দেশনা লাভ করেন এবং জনগণের থিয়েটার যে কী তা বুঝতে পারেন।
তিনি উনিশশো পঞ্চাশ সালের শেষদিকে গণনাট্য সংঘের সাথে যুক্ত হন এবং উনিশশো একান্ন সালে গণনাট্যের বেশ কয়টি নাটক পরিচালনা করেন। যখন গণনাট্য সংঘে যোগ দেন তখন সংঘের একেবারে দিশেহারা অবস্থা। গণনাট্য সংঘে এসেই তিনি মূলত বাংলা ভাষার নাটকের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন বাংলা নাটক পরিচালনা ও অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। তিনি গণনাট্যকে আবার চাঙ্গা করে তোলেন তার পেশাদারি দক্ষতা দিয়ে। বিশেষ করে এ সময় রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন নাটকের পরিচালনা ছিলো তাঁর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। গণনাট্যের সাথে তিনি খুব সামান্য দিনই কাজ করার সুযোগ পান। রাজনৈতিক ভুল বোঝাবুঝি ও দলীয় কোন্দলের কারণে তিনি আবার নিজ দল লিটল থিয়েটার গ্রুপ-এ ফিরে আসেন।
লিটল থিয়েটার গ্রুপ ইংরেজি নাটক মঞ্চস্থ করতো। গণনাট্যে কাজ করার মধ্য দিয়ে গণনাট্যের প্রেরণায় উৎপল দত্ত বুঝতে পারছিলেন নাটক করতে হবে বাংলা ভাষায় এবং ব্যাপকতম দর্শকদের জন্য। সে নাটকের বিষয়বস্তু হবে জনতার সর্বস্তরের সংগ্রাম, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। নিজের পূর্বকৃত থিয়েটার সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি জন্মালো, যে থিয়েটার কেবল বিনোদন বিতরণ করে এবং রাজনৈতিক সামাজিক প্রশ্ন এড়িয়ে যায় সে থিয়েটার থিয়েটার নামের অযোগ্য। ১৪৭ নিজ দলে ফিরে তাই তিনি বাংলা থিয়েটারের সবচেয়ে অলোচিত ও ঘটনাবহুল রাজনৈতিক নাটকগুলোর নির্দেশনা দেন।
নাট্য নির্দেশনার ক্ষেত্রেই শুধু নয়, নাটক রচনায় তিনি বাংলা থিয়েটারে নতুন ধারার সৃষ্টি করলেন। গণনাট্য সংঘে থাকাকালীন রাজনীতির সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ তাঁর সামনে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে লেনিনবাদী কর্তব্যের নিশানা ঠিক করে দেয়। যিনি কিছুদিন আগেও জানতেন না থিয়েটারের লক্ষ্য কী, পঞ্চাশের দশকে তিনিই হয়ে উঠলেন প্রধান রাজনেতিক নাট্যব্যক্তিত্ব। নাটক রচনা ও অভিনয় প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক নাট্যশালায় খুব শীঘ্রই তিনি হয়ে উঠলেন ব্রেষ্টের মতো এক নাট্যতাত্ত্বিক, মার্কসবাদী মতাদর্শের নাট্যকার এবং পিসকাটরের মতো দুর্ধর্ষ ধরনের নাট্য পরিচালক ও প্রযোজক। তিনি প্রবল প্রতাপে শাসন করেছেন, নিয়ন্ত্রণ করেছেন এবং লালন করেছেন তাঁর যুগের থিয়েটারকে। নাটকীয় গঠনে, ইতিহাস বোধে, রাজনৈতিক স্পষ্টতায়, কৌতুকে, ব্যঙ্গে, দুর্দান্ত অভিনয়ে তাঁর নাটকগুলি অন্য মাত্রা পেয়েছিলো। পার্টি সদস্য না হয়েও তিনি নাট্য আন্দোলনের মঞ্চে মার্কসবাদী রাজনীতিই প্রচার করে গেছেন।
পঞ্চাশ দশক থেকে অশির দশক পর্যন্ত পশ্চিমবাংলার রাজনীতি ও রাজনৈতিক নাট্যকর্ম বাদ দিয়ে উৎপল দত্তের কর্মজীবন আলোচনা করা যায় না। পশ্চিমবঙ্গে তাই রাজনীতি, রাজনৈতিক নাট্যশালা এবং উৎপল দত্ত সমার্থক শব্দ। উৎপল দত্ত শুধু আর নাট্য ব্যক্তিত্বই থাকলেন না, সাম্যবাদী আন্দোলনের সংগ্রামী সহচর হয়ে উঠলেন। হয়ে উঠলেন রাজনৈতিক নাট্যজগতের কীর্তিমান যোদ্ধা। কেন, কিসের জন্য উৎপল দত্তের মধ্যে এই পরিবর্তন?
ইংরেজি স্কুলে পড়া, ইংরেজি কেতাদুরস্ত উৎপলের কেন রাজনৈতিক নাট্যশালায় আগমন, কোন প্রয়োজনে? সেখানেও সেই একই কারণ, শাসক-মহল তার মনকে বিষিয়ে তুলেছিলো। পিসকাটর ও ব্রেন্টের মতো তিনিও শাসকদের ভূমিকায়, জনগণের প্রতি তাদের আচরণে বিরক্ত এবং ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত তাঁর ধারণা ছিলো, ব্রিটিশ দেশ ছেড়ে চলে গেলেই শাসন-শোষণের অবসান ঘটবে। স্বাধীনতার পর তিনি দেখতে পেলেন সেটা সত্য নয়। স্বাধীনতার পর যখন কংগ্রেস ক্ষমতায় আরোহণ করে, শুরু হয় তাদের শাসনের বর্বরোচিত আর এক অধ্যায়। তার মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদের নগ্নরূপ তিনি প্রত্যক্ষ করেন।
স্বাধীনতার পরপরই পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টিকে বে-আইনী ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কমিউনিস্টদের পরিচালিত ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকার অফিস, সমস্ত পার্টি দপ্তর সরকারের দখলে চলে যায়, প্রেস ও সমস্ত অর্থ বাজেয়াপ্ত হয়। সেই অবস্থায় সুন্দরবনে কৃষক আন্দোলনে শহীদ হলেন অহল্যা, সরোজিনী, যশোদা। রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবিতে প্রাণ দিলেন হুগলি জেলার পুষ্পবালা মাঝি, পাঁচবালা ভৌমিক, দাসী বাসা মাল, কালীবালা পাখীরা, মুক্তকেশী মাঝি। পরের বছর কলকাতা শহরে মিছিল চললো এসব ঘটনার প্রতিবাদে। সে মিছিলে গুলি করা হলে নিহত হলেন-লতিকা সেন, গীতা দে, অমিয় সরকার, প্রতিভা গঙ্গোপাধ্যায়, নবীন যুবক বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রাণ বিসর্জন দিলেন আরো শত শত নারী-পুরুষ।
সরকারি পরিসংখ্যানেই ছিলো স্বাধীনতার প্রথম তিন বছরে পঞ্চাশ হাজার মানুষ কারাবরণ করেছেন, নিহত ও আহত হয়েছেন তেরো হাজার। ডিব্রুগড়ে গণনাট্যের অনুষ্ঠানে গুলিবর্ষণ, হাজরা পার্কে জনসমাবেশে বেপরোয়া গুলি চালনা, বউ বাজারে নারী মিছিলের ওপর গুলি-পুঁজিবাদের এই আগ্রাসী মনোভাব উৎপল দত্তকে নিশ্চুপ থাকতে দেয়নি। এসব ঘটনাই তাঁকে ইংরেজি নাটক ছেড়ে জনগণের জন্য নাটক করতে উত্তেজিত করে। সেক্ষেত্রে মার্কসবাদ ও গণনাট্য সংঘ হয় তাঁর সহায়ক। সুতরাং কমিউনিজমের মতাদর্শ প্রচারের স্বার্থেই তাঁর লিটল থিয়েটার গ্রুপকে সংগঠিত করে নিয়ে গেলেন সাম্যবাদীদলের ঘনিষ্ঠ সংশ্রবে।
নিজের বিশ্বাসের জগতে এক দুর্ভেদ্য মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-স্তালিনীয় দুর্গ তৈরি করে তবে তিনি তাঁর থিয়েটারের বৈপ্লবিক প্রয়াসে অগ্রসর হন। শোষিত সর্বহারার পক্ষে ধনতান্ত্রিক শাসক-শোষকের বিরুদ্ধে সামন্ততান্ত্রিক চিন্তাধারা আর প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের হাতিয়ার হয়ে উঠলো তাঁর রাজনৈতিক নাট্যশালা। লিটল থিয়েটার গ্রুপ গণনাট্য আন্দোলনের সহযোদ্ধা হয়ে দাঁড়ালো। নিজ দলের নাটককে তিনি রাজনৈতিক লক্ষ্যে সঠিকভাবে ব্যবহারের জন্য পিসকাটর ও ব্রেস্টের চিন্তাগুলো পাঠ করলেন মনোযোগ দিয়ে। পিসকাটর ও ব্রেস্টের চিন্তা ও দৃষ্টান্তের দ্বারা অনুপ্রাণিত উৎপল দত্ত স্বয়ংসম্পূর্ণ রাজনৈতিক থিয়েটারের এক শক্তিশালী ও জনপ্রিয় ঐতিহ্য গড়ে তুললেন।
এই কাজে তাঁর দুটি প্রবণতাই তাঁকে অসম্ভব সাহায্য করেছিলো। এক, তাঁর বিদ্যা-বুদ্ধি পাণ্ডিত্যের সুমহান উচ্চতা যার দ্বারা তিনি একাধারে মার্কস-এঙ্গেলস- লেনিন-স্তালিন-মাওয়ের রচনাবলী থেকে আহরণ করেছিলেন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ এবং শ্রেণীসংগ্রামের তাত্ত্বিক দিক। দ্বিতীয়শ্রাট্য তত্ত্বের সবকিছু ছিলো তাঁর দখলে। এ্যারিস্টটল থেকে পিসকাটর, ব্রেস্ট, আউগুস্তো বোয়াল পর্যন্ত আড়াই হাজার বছরের নন্দনতত্ত্বের প্রতিটি দিক ছিলো তাঁর জানা ও চেনা, সম্পূর্ণ নখদর্পণে। ১৫২ পনের বছর বয়স থেকে তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে নাট্যচর্চা আরম্ভ করেছিলেন, সে অভিজ্ঞতাও . তার সাথে যুক্ত হয়েছিলো।
ফলে তিনি নাটকের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলা তথা ভারতীয় নাটকের হয়ে উঠলেন প্রধান পুরুষ। যা প্রমাণ করলো রাজনৈতিক নাটক শিল্পের শত্রু নয়। কারণ উৎপল দত্তের রাজনৈতিক নাট্য প্রযোজনাগুলো পেশাদারি দক্ষতায় কারো চেয়ে পিছিয়ে ছিলো না। তাঁর প্রায় প্রতিটি প্রযোজনা প্রাণবন্ত অভিনয় ও মঞ্চায়নের প্রয়োগ বৈচিত্র্যে, নন্দনতত্ত্বে পেশাদারি ও সৌখিন নাট্যচর্চার সমস্ত স্তরকে অতিক্রম করে গিয়েছিলো।
মার্কসবাদী শিল্পচিন্তার প্রাথমিক শর্ত অনুসরণ করেই গড়ে উঠেছিলো উৎপল দত্তের থিয়েটার। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ও শিক্ষায় তিনি তাঁর থিয়েটার নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিলেন শ্রমিক-কৃষক ও মধ্যবিত্তের মধ্যে। একদিকে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন, অন্যদিকে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের শিক্ষায় তিনি সংস্কৃতিকে শাণিত অস্ত্রের মত ব্যবহার করার যে শিক্ষা আয়ত্ত করেন তাহলো মানুষের মনকে মুক্ত করা, সমাজের পশ্চাদপদ শাসনের হাত থেকে মানুষকে উদ্ধার করা, তার শিক্ষা-স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা। মার্কসবাদী চিন্তানায়কদের শিক্ষায় শিক্ষিত উৎপল দত্ত শ্রেণীবিভক্ত সমাজে নাট্যকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্বন্ধে ছিলেন সবিশেষ সচেতন। তিনি জানতেন ধনতান্ত্রিক শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষে নিপীড়িত সর্বহারার পক্ষে তাঁর সংগ্রাম। তিনি তাঁর থিয়েটারকে বিপ্লবের হাতিয়ার হিসাবেই ব্যবহার করেছেন। বিপ্লবী থিয়েটারের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, বিপ্লবী থিয়েটারকে অবশ্যই বিপ্লব প্রচার করতে হবে।
মার্কসবাদ অনুশীলন এবং চর্চায় তাঁর ছিলো নিজস্ব বিচারধারা এবং উপলব্ধি। তিনি যে মার্কসবাদী একথা ঘোষণা করতে তাঁর কুন্ঠা বা সংকোচ ছিলো না। তিনি নিজেকে বলতেন একজন প্রোপাগান্ডিস্ট একজন এ্যাজিটেটর। ১৫০ মাকর্সবাদের প্রচারই ছিলো তাঁর লক্ষ্য। সরাসরি তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন না, তবে রাজনৈতিক বিশ্বাসে ছিলেন মার্কসবাদী।
মার্কসবাদ প্রচারের কারণেই কংগ্রেস সরকার কখনও তাঁকে ঝামেলামুক্তভাবে নাটক মঞ্চায়ন করতে দেয়নি। কংগ্রেস সরকারের আমলে হামলা ছাড়া, হামলার মুখোমুখি হওয়া ছাড়া তাঁর একটি নাটক মঞ্চায়নেরও বোধ করি কোনো ইতিহাস নেই। হামলা আক্রমণ ছিলো তাঁর নিত্য সঙ্গী। সশস্ত্র হামলা, রাজনৈতিক হামলা, বৃহৎ সংবাদপত্রগুলির ব্যঙ্গ বিদ্রুপের হামলা। সেই সাথে কারাগারের জীবনও ভোগ করতে হয়েছিলো। সবই ঘটেছিলো তাঁর নাটক মঞ্চায়নকে ঘিরে। কিন্তু শত অত্যাচারেও তাঁকে মার্কসবাদের প্রচার ও প্রসার থেকে সরিয়ে নেয়া যায়নি। মার্কসবাদের প্রতি শেষদিন পর্যন্ত তাঁর আস্থা বা বিশ্বাস ছিলো অটুট। সে বিশ্বাস অন্ধ নয়, যুক্তি ও বুদ্ধিতে শাণিত।
মার্কসবাদী চিন্তার প্রতি তিনি এতোবেশি একনিষ্ঠ ছিলেন যে, তিনি বলে গেছেন, মার্কসবাদের দ্বান্দ্বিকতা ছাড়া এ যুগের কোনো থিয়েটারই জনগণের থিয়েটার হতে পারে না এবং এই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের আলোকেই সমস্ত ধ্রুপদী নাটক ও থিয়েটারকে দেখতে হবে। ব্রেশটের মতো নাটকের বিষয়বস্তুই ছিলো তাঁর কাছে প্রধান। বিষয়বস্তু বা নাট্য রচনার প্রশ্নে তিনি মনে করতেন, নাট্য আন্দোলনের কর্মীদের প্রাথমিক কর্তব্য হলো জনতার কাছে রাজনীতি পৌছে দেওয়া। যেমন বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্তের সংগ্রামের সকল খবর কৃষকশ্রেণীর কাছে পৌঁছে দিতে হবে, তেমনি শ্রমিকশ্রেণীর লড়াইয়ের খবরও কৃষককে জানতে দিতে হবে।
পাশাপাশি আবার কৃষকশ্রেণীর যাবতীয় সমস্যা ও সংগ্রামের কাহিনী শ্রমিকশ্রেণী ও বুদ্ধিজীবীদের কাছে পৌছে দেওয়াটাও জরুরি। সেটা পৌছাতে হবে বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে। প্রতিটি সংগ্রামের বীরত্ব, ভুল-ত্রুটি, সফলতা-বিফলতা সহ। উৎপল দত্ত নিজের জীবনেও তার প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন। তিনি যেমন বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত্বের প্রগতিশীল সংগ্রামের কাহিনী বিবৃত করেছেন তাঁর নাটকে, তেমনি শ্রমিক-কৃষকের সংগ্রামও এসেছে বারবার বহু নাটকে। বিশেষ করে দেশের কৃষকশ্রেণীর সমস্যাসংকুল জীবন, স্বাধীনতা সংগ্রামে কৃষকশ্রেণীর বীরত্বব্যঞ্জক ভূমিকা এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী তাদের ওপর শাসকশ্রেণীর ও সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার নিরবচ্ছিন্ন অত্যাচার ও শোষণ তাঁর নাটক ও নাট্য প্রযোজনায় এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।
উৎপল দত্তের নিজস্ব দল ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’ ও পরবর্তীতে ‘পিপলস লিটল থিয়েটার’-এ মার্কসবাদী বস্তুবাদের প্রয়োগের দিকটি সচেতনভাবে রক্ষিত হয়েছিলো। মার্কসবাদের তাত্ত্বিক ও প্রয়োগিক মতাদর্শে বিশ্বাসী এই মানুষটি তাঁর নাট্য প্রযোজনার ক্ষেত্রটিকে রবীন্দ্র-নাটকের ব্যাপ্তি থেকে বিচ্ছিন্ন রাখেননি। নিজ দল লিটল থিয়েটার গ্রুপে উৎপল দত্ত পরিচালিত রবীন্দ্র নাটকের সংখ্যা কম নয়।
বরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালের যাত্রা, অচলায়তন, তপতী, শোধবোধ ইত্যাদি নাটকগুলো মঞ্চস্থ হয়েছিলো উৎপল দত্তের পরিচালনায়। উৎপল দত্তের রবীন্দ্র নাট্য প্রযোজনা সমস্ত স্তরের বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষকে নাড়া দিয়েছিলো। কেউ কেউ বা আঁতকে উঠেছেন। রবীন্দ্রনাথের নাট্য বক্তব্য উপস্থাপনে তিনি যেভাবে সমসাময়িককালের ইঙ্গিত দিয়েছেন তাতে বহুসময় বুদ্ধিজীবীরা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। কিন্তু যতক্ষণ মিলনায়তনে বসে নাটক দেখেছেন ততক্ষণ বিষয়বস্তুতো বটেই, প্রযোজনা কৌশলে কেউ চোখ ফেরাতে পারেননি। রবীন্দ্র নাট্য প্রযোজনা ও পরিচালনায় উৎপল দত্তের দক্ষতা ছিলো অনন্য। নাটকের বক্তব্য বা বিষযবস্তুকে তিনি সহজ ও আকর্ষণীয় করে দর্শকদের সামনে তুলে ধরতেন। সেজন্য নাটক শেষ হলে মিলনায়তন থেকে বের হয়ে যাবার পরেও দর্শকের মাথার ভিতরে যেন নাটক শেষ হয়ে যায় না।
জালিয়ানওয়ালাবাগের রক্তাক্ত অধ্যায়, আফগানিস্তানের আত্মনিয়ন্ত্রণের জাতীয়তাবাদী যুদ্ধ, আজাদ হিন্দ ফৌজের দুঃসাহসিক কার্যক্রম, স্বাধীনতার জন্য সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, ভারতের নৌ বিদ্রোহ, গান্ধীর জাতীয়তাবাদী রাজনীতি যেমন তাঁর নাটকের বিরাট অংশ দখল করে আছে, তেমনি বাঁশেরকেল্লার তিতুমীরের লড়াই, আঠারশো সাতান্ন সালের কৃষক-সিপাহীদের বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, নকশাল বাড়ির কৃষক বিদ্রোহ-সবকিছুই ব্যপকতা লাভ করেছে তাঁর নাটক রচনায়। তিনি যেমন বিশ্বাস করতেন প্রতিটি সচেতন নাট্যকর্মীর কর্তব্য হলো দেশপ্রেমিক সংগ্রামের প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি শ্রমিক সংগ্রামের উত্থান-পতনের ঘটনা দেশের প্রতিটি কোণায় থিয়েটারের মাধ্যমে পৌঁছে দেয়া দরকার, তেমনি নিজেই তিনি সে দায়িত্ব কাঁধেও তুলে নিয়েছিলেন। তাঁর প্রযোজিত নাট্য তালিকার দিকে তাকালেই নাটকের বিষয়বস্তু নির্বাচনে তাঁর চিন্তাধারার পরিচয় পাওয়া যায়।
শুধু জাতীয় বিপ্লব- বিদ্রোহের ঘটনাই নয়, আন্তর্জাতিক গণ-বিপ্লবের কাহিনীও তাঁর নাটকের বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিলো। বিদেশের প্রায় সমস্ত গণ-অভ্যুত্থানের মঞ্চরূপ দিয়েছিলেন তিনি। গোটা বিশ্বের সংগ্রামী মানুষের মরণপণ সংগ্রামের ঘটনাগুলি তাঁর নাটকে ধরা পড়েছে গভীর ইতিহাস বীক্ষার আলোকে। রাশিয়া-আমেরিকা-ফ্রান্স-ভিয়েতনাম-জার্মানী-কিউবা পর্যন্ত যেখানে লড়াই ও প্রতিবাদ সেখানেই চলে গেছে বিপ্লবী নাট্যকর্মী উৎপলের চিন্তা ও কল্পনা।
পৃথিবীর প্রথম শ্রমিকশ্রেণীর রাষ্ট্রগঠনের যে ঘটনা আজও সর্বহারাশ্রেণীর চোখের মণি সেই প্যারি কমিউন, অক্টোবর বিপ্লবের পূর্ব ও উত্তরকাল, ফ্যাসিবিরোধী সংগ্রাম, চীনের বিপ্লব, ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ, কিউবার প্রতিরোধ আন্দোলন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, এমনকি নব্বইয়ের দশকে পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় ও প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের কলঙ্কজনক ভূমিকা সবই তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন নাটকের বিষয়বস্তুতে। সময়কালের প্রতিটি বাঁক বা মোড়ের সামনে দাঁড়িয়ে, একান্তভাবে নিজের মতো করেই নাটকের শরীরে নির্ণয় করেছেন ইতিহাস ও রাজনৈতিক চেতনার দলিল।
ইতিবাচক শক্তির ওপর দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়ে তাকে একই সঙ্গে বৈপ্লবিক, জনপ্রিয় ও দর্শকের জন্য উদ্দীপক শিল্পরূপে পরিণত করে গেছেন। উৎপল দত্তের নাটক সম্পর্কে তাই ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন, ‘রাজনৈতিক থিয়েটারের বাইরে পা রেখে নানান তকমা আর প্রলেপ লাগানো নাট্যক্রিয়া সম্পর্কে তাঁর ছিলো নিদারুণ সন্দেহ, অতৃপ্তি, আর ক্ষোভ। নাটকের সামাজিক ভূমিকাটি তিনি চিহ্নিত করেছেন শ্রেণীসম্পর্ক আর শ্রেণীসংগ্রামের প্রেক্ষাপটে। সমসাময়িক ঘটনাবলীকে তাৎক্ষণিক উত্তেজনায় নাটকে পরিবেশনের পরিবর্তে তিনি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন মার্কসীয় ধ্রুপদী তত্ত্ব পাঠ ও আয়ত্তের মাধ্যমে সমকালকে বিচার বিশ্লেষণ করার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির দিকে।
উৎপল দত্ত তাঁর রচিত নাটক ও প্রতিটি প্রবন্ধে সমসাময়িক এবং ভাবীকালের নাট্যকর্মীদের কাছে ঋজু বক্তব্যে এ কথাই বারবার ঘোষণা করেছেন-নাটক শুধু আলগা, ভাসাভাসা সমাজ সমালোচনার বিষয় নয়, কেবলমাত্র আবেগনির্ভর দৃশ্যকাব্যও নয়; যার মূল নিশানা সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা।
নাট্যকার হিসাবে যেমন তিনি ছিলেন মাকর্সবাদী তেমনি আধুনিক। নাট্যকার হিসাবে তিনি সবচেয়ে আধুনিক এই অর্থে যে তাঁর নাটকে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে অগ্রণী চিন্তা ধরা পড়েছে। পাশাপাশি তিনি এই অর্থেও আধুনিক যে নাট্য প্রযোজনার ক্ষেত্রে তিনি কোনো বাছবিচারে না গিয়ে প্রয়োজন মতো যে-কোনো ফর্ম বা আঙ্গিক গ্রহণ করেছেন।
বিষয়বস্তু নির্বাচনের মধ্যেই তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি সক্রিয় থাকতো যে, কীভাবে উপযুক্ত আঙ্গিকের আধারে দ্বান্দ্বিকতা প্রয়োগ করে নাট্যদ্বন্দ্বকে বিশ্বাসযোগ্য বাস্তবতায় নিয়ে যাওয়া যায় এবং থিয়েটারকে দর্শকের উপভোগ্য করে তোলা যায়। বিশেষ কোনো সূত্রের ছকে কখনই বেঁধে ফেলেননি তাঁর থিয়েটারকে। তিনি বলে গেছেন, সূত্র হচ্ছে অজ্ঞতার আশ্রয়, আলস্যের ছদ্মবেশ, ফাঁকির অবলম্বন। সূত্রের প্রশ্নে চরম বা পরম বলে কিছু নেই। যে-কোনো সূত্র হচ্ছে নাটকের অশনি সংকেত। আসল কথা হলো বৈপ্লবিক বিষয়বস্তু। বিপ্লবের চেতনা ছড়িয়ে দিতে হবে মানুষের মধ্যে। গণতান্ত্রিক বিপ্লবের যুগে মানুষকে কীভাবে উপস্থাপন করতে হবে তা বুঝতে উৎপল দত্ত হেগেল থেকে গ্রামশি পর্যন্ত প্রতিটি দার্শনিকের ‘মানুষ’ সম্বন্ধে বক্তব্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে ডুব দেন।
মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আয়ত্ত করায় কী নাটক, কী নাটকের বিষয়বস্তু, কী প্রয়োগ পদ্ধতি-সব বিচারে তিনি প্রচলিত বাংলা থিয়েটারের ঐতিহ্য ভেঙেছেন এবং বিশ্বের রাজনৈতিক থিয়েটারের মূল স্রোতের সঙ্গে তাকে যুক্ত করেছেন। সেসব কাজ করতে গিয়ে তিনি কখনই দর্শকদের কথা বিস্মৃত হননি। পিসকাটর ও ব্রেশটের নাট্যতত্ত্ব ও গণনাট্যের শিক্ষা তাঁকে এই সত্য বুঝতে সাহায্য করেছে ‘থিয়েটার নিভৃত সাধনা নয়, প্রতিমুহূর্তে তাকে দর্শকের সামনে হাজির হয়ে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে’।
নাটক সম্পর্কে তাঁর আর একটি প্রশ্ন ছিলো যা রাজনৈতিক নাটকের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা রাজনৈতিক নাটক কার সামনে অভিনীত হবে? নিজেই আবার তার জবাব দিয়েছেন, রাজনৈতিক নাটক তৈরি করে তারপর আকাদেমি নামক ক্ষুদ্র প্রেক্ষাগৃহে কয়েক কুড়ি সূক্ষ্ম বিচারবুদ্ধি-সম্পন্ন ভদ্রলোকের সামনে অভিনয় করতে থাকলে, সেটা আর রাজনৈতিক নাটক থাকে না।
সহজ ভায়ায় তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন নাটককে নিয়ে যেতে হবে শ্রমিক-কৃষকের কাছে, ভদ্রলোকদের প্রেক্ষাগৃহে তাকে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। বাংলার মাটিতে তথা সারা ভারতবর্ষে বামপন্থীদের প্রতিষ্ঠিত করার দুর্জয় সংকল্প নিয়েই তিনি কাজ করেছেন। সাফল্যও লাভ করেছেন। ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন, ‘পাঁচের দশকের সেই ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ পশ্চিমবাংলা, যার নাড়িতে নাড়িতে দেশভাগের যন্ত্রণা, ছিন্নমূল মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই, কৃষকের অঞ্জলিতে ধরা রক্তসমুদ্র; এবং শাসকের শত অত্যাচার আর ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে বাংলার মাটিতে বামপন্থাকে প্রতিষ্ঠা করার দুর্জয় সংকল্প-সেই ‘প্রবাহের’ একনিষ্ঠ সঙ্গী ছিলেন উৎপল দত্ত।
প্রচারক কিংবা পার্টিজান হয়ে কমিউনিজম তথা মার্কসবাদ প্রচার করাটাই ছিলো যাঁর কাছে মুখ্য জীবনাদর্শ, তিনি দেখা করেছেন পাহাড়ে জঙ্গলে সংগ্রামরত কৃষকদের সঙ্গে। কথা বলেছেন, বুঝতে চেষ্টা করেছেন তাঁদের সমস্যাকে। ছাত্র-যুবাদের নিয়ে আলোচনার আসর বসিয়েছেন তাঁর বাড়িতে, থিয়েটারে। দিনের আলোচনা শেষ করে ছুটে গেছেন কোনো উদ্বাস্তু কলোনিতে সারারাতের বিতর্ক সভায়। এসবই করেছেন মানুষকে বোঝা এবং জানার জন্য। সম্যক রাজনীতির সাথে পরিচিত হবার জন্য। জনগণের কাছ থেকে শেখার আগ্রহ নিয়ে।
তিনি বিশ্বাস করতেন জনগণকে সাত্যিকারভাবে কিছু শেখাতে গেলে আগে তাদের কাছ থেকে শিখতে হবে। সমাজের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বৈপরীত্যের দ্বন্দ্বের ওপর সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে থিয়েটার গড়তে গেলে দর্শক সমাজের শিক্ষা, রুচি ও পরিধিও বিবেচনা করতে হবে। সেজন্যই মার্কসবাদের শিক্ষা ও লেনিনের রণকৌশলকে তিনি খুব গুরুত্ব দিতেন। তিনি বলতেন, থিয়েটার করতে গেলে প্রধান যে তত্ত্বটা আমাদের আয়ত্ত করতে হবে সেটা থিয়েটারের তত্ত্বের চেয়েও বড়, আর তা হচ্ছে মার্কসবাদ লেনিনবাদ। যে-কোনো নাট্যকর্মীর জন্য নাটকের সকল তত্ত্বের চেয়ে ঢের বেশি প্রয়োজনীয় মার্কসবাদ। প্রতিমুহূর্তে শ্রেণীসংগ্রামের সাথে নিজেকে যুক্ত করা, শ্রেণীসংগ্রামের গতি প্রকৃতি লক্ষ্য করা, শ্রেণীসংগ্রামের প্রকৃতি বোঝা। মার্কসবাদ শিখবে এই জন্য নয় যে, সব নাটকে মার্কসবাদের তত্ত্ব ঢুকিয়ে দিয়ে সে নিজের পাণ্ডিত্য জাহির করবে, মার্কসবাদ শিখবে সে জগতকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার জন্য।
তাঁর নিজস্ব সৃষ্টি সাধনার অন্তরবিন্দুতে ছিলো মার্কসবাদী চিন্তাধারার ক্ষুরধার উপাদান। নিজ দেশের ঐতিহ্যকে তিনি বিচার বিশ্লেষণ করেছেন মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে। তিনি জানতেন নিপীড়িত মানুষকে ভালোবেসে তার চিরমুক্তির সোপান তৈরিতে একজন স্রষ্টার অবশ্যই ইতিহাস, দর্শন ও নাট্যতত্ত্ব সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান এবং মার্কসবাদের শিক্ষা থাকা দরকার। তিনি মনে করতেন, খানিকটা লাল ঝাণ্ডা নাড়ালেই নাটক বিপ্লবী হয় না। বিপ্লবী নাটক মানুষের চিন্তার জগতকে নাড়া দেবে, জগৎকে পাল্টাতে সাহায্য করবে এবং সব সময় সর্বহারাশ্রেণীর পাশে দৃঢ়ভাবে জায়গা করে নেবে।
রাজনৈতিক নাটক সম্পর্কে তাহলে আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? এটা একটা উদ্যোগ, স্বতঃস্ফূর্ত কোনো ব্যাপার নয়। রাজনৈতিক থিয়েটারের সংজ্ঞা সংক্ষেপে বলতে গেলে, সেই থিয়েটার যা রাজনীতি প্রচার করবে। মার্কসবাদী ব্যাখ্যায় রাজনীতি বলতে মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক, শ্রেণীগত, ব্যক্তিগত সব কর্মকাণ্ডকে বোঝায়। বিপ্লবী বা প্রতিবিপ্লবী যাই হোক না কেন, রাজনীতি হচ্ছে শ্রেণীর বিরুদ্ধে শ্রেণীর সংগ্রাম, তা মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যক্তির কার্যকলাপ নয়। মতাদর্শ ও শিল্পগত ক্ষেত্রের সংগ্রামকে রাজনৈতিক সংগ্রামের অধীন থাকতে হয় এইজন্য যে, একমাত্র রাজনীতির মধ্য দিয়েই শ্রেণী ও জনগণের প্রয়োজন কেন্দ্রীভূত আকারে প্রকাশ পায়।
রাজনৈতিক নাটকও তাই শ্রেণীর প্রশ্নটিকে কিছুতেই বাদ দিতে পারে না। রাজনৈতিক নাটকের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে প্রভাতকুমার গোস্বামী বলেছেন, সাধারণত সেই নাটককেই রাজনৈতিক নাটক বলবো, যা নাট্যকারের দিক থেকে দর্শকের মধ্যে সচেতন রাজনৈতিক বোধ জাগ্রত করা বা রাজনৈতিক শিক্ষাদানের জন্য রচিত। ‘
প্রভাতকুমার গোস্বামী সরলভাবে রাজনৈতিক নাটকের একটি সংজ্ঞা দিতে চেষ্টা করেছেন, যদিও রাজনৈতিক নাটকের বিষয়টি বহু গুণ বিস্তৃত। সামান্য কয়েক পংক্তির মধ্যে রাজনৈতিক নাটক কী তা বোঝানো সম্ভব নয়। যেহেতু রাজনীতি কথাটিই খুব ব্যাপক অর্থের, রাজনৈতিক নাট্যও তাই। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে যে-কোনো ধরনের বিতর্কের সূত্রপাত করতে হলে প্রাথমিকভাবে সুনির্দিষ্ট কিছু মতামত প্রদান এবং পূর্ণ আলোচনার একটি সংক্ষিপ্ত গণ্ডি টানা দরকার। সেজন্যই এ কথা বলা, রাজনৈতিক নাটকের প্রথম কাজ দর্শককে রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত করে তোলা। শিক্ষা বলতে এখানে সচেতনতা বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে।
কিন্তু মনে রাখতে হবে নাটক পাঠশালা নয়, নাটকের মাধ্যমে যে শিক্ষা দান করা হবে তা হতে হবে শৈল্পিকভাবে এবং বিনোদনের মধ্য দিয়ে। রাজনৈতিক নাটকে রাজনীতি শিক্ষার বিশেষ কতগুলো দিকই গুরুত্ব পায়। মূলগতভাবে সেগুলো হলো-একটি দেশের নিজস্ব রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সমস্যা এবং শাসক শ্রেণীর জনগণকে শোষণ করার প্রক্রিয়া, রাজনীতি-অর্থনীতির আন্তর্জাতিক সমস্যা ও সাম্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রণ, সভ্যতা ও শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস, শ্রেণী বিন্যাস ও উৎপাদন সম্পর্ক, সভ্যতার দ্বাধিক অগ্রগতি এবং রাজনৈতিক সংগ্রাম বা আন্দোলনের পদ্ধতি। রাজনৈতিক, সংগ্রাম বা আন্দোলনের পদ্ধতি এই বিষয়টিতে শুধু শিক্ষা নয়, দীক্ষা নেয়ার ব্যাপারও রয়েছে। দেখা যাক রাজনীতির সঙ্গে নাট্যক্রিয়ার কী ধরনের সাযুজ্য ঘটলে অথবা নাটকে রাজনীতির কী ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসৃত হলে যথার্থ রাজনৈতিক নাটকের জন্ম হতে পারে।
রাজনীতির লক্ষ্য সমাজে অনুসৃত অর্থনৈতিক প্রশাসনিক ধারাকে নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করে সমাজকে নতুনতর অবস্থায় নিয়ে যাওয়া। সমাজের বর্তমান কাঠামোকে উন্নততর অবস্থান দেওয়া। রাজনীতি আসলে মানুষের সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক নির্ণয়ের প্রক্রিয়া। প্রকৃতিগতভাবে যে বিবর্তন ঘটবে রাজনীতি এক অর্থে সেই বিবর্তনকে ত্বরান্বিত করে তোলে। সমাজের বিবর্তনে নতুনতর অবস্থা গড়ে তুলতে রাজনীতি অনিবার্য।
সেক্ষেত্রে পরস্পর বিপরীতধর্মী রাজনৈতিক ধারণার সংঘাতে অপেক্ষাকৃত শ্রেয় সমাজ ব্যবস্থা গড়ে ওঠার অবস্থা তৈরি হয়। আর তা করা হয়ে থাকে মানুষের জন্যই, ঠিক আবার মানুষই তাকে গ্রহণ কিংবা বর্জন করে। মানুষকে কেন্দ্র করেই রাজনীতির অনুবর্তন। নাট্য নামক শিল্পটিরও লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য সেই মানুষ। মানুষকে নিয়ে মানুষের জন্যে রাজনীতি; আবার মানুষের জন্যে, মানুষকে নিয়ে নাট্যকারের যতো মাথা ব্যথা। সেই অর্থে নাট্যকার সত্যের অনুসন্ধানে ক্রিয়াশীল। সুতরাং নাট্যকার, রাজনৈতিক ঘটনাবলীর নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে সত্যকে মানুষের সামনে তুলে ধরেন।
দেখা যাচ্ছে, নাট্যকার যখন কোনো রাজনৈতিক বিষয়কে তাঁর উপজীব্য করেন তখন তিনি আসলে রাজনৈতিক ঘটনাবলীর মূল্যায়ন করেন। আর এই মূল্যায়নে নাট্যকারকে সতত এক ধরনের নিরাসক্তি অবলম্বন করতে হয়। প্রচার যেখানে সাময়িক স্বার্থকে দেখে রাজনৈতিক নাটক সেখানে চিরকালীন সত্যকে উদ্ঘাটিত করে। রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী, রথের রশি কোনো দলীয় তাৎক্ষণিক দলিলের সমর্থন না করেও সমাজের অসাম্যকে তীব্রভাবে আক্রমণ করে এবং নতুন এক সমাজের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে।
রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলনের পূর্বেও নাটকে রাজনীতি ছিলো এবং সেটা রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলনের সহায়ক হলেও, রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলন তাকে বলা যাবে না। কারণ সচেতনভাবে সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে সেটা পরিচালিত হয়নি। নাট্যকার সমাজের প্রতি দায়দায়িত্ব থেকে নাটকে রাজনীতি এনেছিলেন, তিনি ছিলেন সমাজ সচেতন কিন্তু সমাজবিজ্ঞান সচেতন নন। শ্রেণীদ্বন্দ্বের প্রশ্নটি তাঁদের মাথায় ছিলো না।
সমাজসচেতন নাটক ও রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলনের মধ্যেও একটা সীমারেখা তাৎক্ষণিকভাবে টানা যেতে পারে। যে নাট্যরচনায় সমাজব্যবস্থার ত্রুটি- বিচ্যুতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ঘোষিত হয়েছে, রাজনীতি প্রচার করা হয়েছে সেটাও একধরনের রাজনৈতিক নাটক। কিন্তু রাজনৈতিক নাট্যচিন্তা আমরা সেটাকে তখনই বলবো যখন সমাজ পাল্টাবার জন্য নাট্যকার বা নাট্যকর্মীরা সেখানে সক্রিয়, সমাজ পরিবর্তনের বৃহত্তর লক্ষ্যেই যখন তাঁরা নাটক রচনা কিংবা তা মঞ্চায়ন করেন। স্মরণ রাখতে হবে, রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলন শুধু নাটক মঞ্চায়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়,শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনেও তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
মাও সেতুঙ যে কথা বলেন, ‘পৃথিবীতে সকল সংস্কৃতি, সকল সাহিত্য ও সকল শিল্পই বিশেষ শ্রেণীর সম্পত্তি এবং বিশেষ রাজনৈতিক লাইন প্রচার করাই তার কাজ। শিল্পের জন্য শিল্প, শ্রেণী-স্বার্থের ঊর্ধ্বে অবস্থিত বা রাজনীতির সাথে সম্পর্কহীন ও স্বাধীন শিল্প বলে আসলে কিছু নেই।’ মাওয়ের মতে, প্রলেতারীয় শিল্প হচ্ছে সমগ্র প্রলেতারীয় বিপ্লবী লক্ষ্যের অধীন। রাজনৈতিক নাট্য তাই সুনির্দিষ্টভাবে প্রলেতারীয় শ্রেণীর পক্ষে দাঁড়াবে। মার্কসের জন্মের আগে যা চিন্তাই করা যেতো না।
রাজনৈতিক নাট্যচিন্তা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে একথাও স্মরণ রাখতে হবে, বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থা জন্ম নেয়ার পর শ্রমিক-মালিকের দ্বন্দ্ব যেমন মার্কস-এঙ্গেলসের দৃষ্টিকে খুলে দিয়েছিলো, তেমনি মার্কসবাদের সাথে পরিচিত না হয়েও পুঁজিবাদের সংকট ও দ্বন্দ্ব থেকেই জন্ম নেয় বহু বড় বড় নাট্যকার। যেমন মার্লো, শেক্সপিয়ার, শিলার, ইবসেন সহ আরো অনেকে যাঁদের নাটকে সমকালীন সমাজের দ্বন্দ্ব চমৎকারভাবে ধরা পড়েছিলো।
মার্কসবাদের সাথে পরিচিত হবার আগেই বা পরিচয় ব্যতিরেকেই বুর্জোয়া সমাজের বিরুদ্ধে তাঁদের লেখনী সরব হয়েছে। পূর্বে উল্লিখিত সেসব নাট্যকারদের নাটকেও পুঁজিবাদের চেহারা ফুটে উঠেছিলো, সমাজের চমৎকার বিশ্লেষণও ছিলো। তবে পুঁজিবাদী সমাজ থেকে উত্তরণের জন্য তাঁরা যেমন কোনো পথ বাতলাতে পারেননি, তেমনি শ্রেণীসংগ্রামের প্রশ্ন তোলেননি। সেজন্য তাঁদের নাটকে রাজনীতি থাকলেও, সমাজের নানা দ্বন্দ্ব থাকলেও সেই সংকটের উৎস কোথায় কিংবা উত্তরণ কীভাবে সম্ভব, তা তাঁরা বলে যাননি, আধুনিক রাজনীতির দিক থেকে যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মার্কসবাদী থিয়েটারের আগে কেউই সংকট থেকে উত্তরণের পথ বাতলাননি। বাতলানো সম্ভবও ছিলো না। সেখানে উত্তর না জেনেই প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে। শোষণের কথা জানানো হয়েছে, কীভাবে শোষণ হচ্ছে সেটা না বলেও।
বিশ শতকের রাজনৈতিক থিয়েটারের সাথে তাই তাদের মূল পার্থক্য হলো মার্কসবাদ বুর্জোয়া সমাজ থেকে উত্তরণের জন্য শ্রমিকশ্রেণীর যে একনায়কত্বের কথা বলেছিলো তা তাঁদের কারো নাটকে ধরা পড়েনি। বুর্জোয়া সমাজের প্রতি তাঁদের অনাস্থা তৈরি হলেও, বিপ্লবের প্রশ্ন না তুলে তাঁরা শুধু কিছু সংস্কারের দিকে দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন। যেখানে বিপ্লব সামান্য উঁকি দিয়েছিলো, সেখানেও শ্রেণীদ্বন্দ্ব ছিলো একেবারেই অনুপস্থিত।
তবুও সেসব নাটক মার্কস- এঙ্গেলসের দৃষ্টি কেড়েছিলো, তাঁদের প্রশংসা অর্জন করেছিলো। মানবতাবাদী শিল্প- সাহিত্য হিসাবেই তা পরিচিত। স্বভাবতই প্রশ্ন দাঁড়ায়, বিশ শতকে সে-সকল নাট্যকার ও তাঁদের নাটকগুলোকে আমরা কোন্ চোখে দেখবো। মার্কসবাদী চিন্তাবিদরা সেগুলিকে রাজনৈতিক নাটকের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন। মানবতাবাদী সকল নাটক তাই বিশ শতকে রাজনৈতিক নাট্যচিন্তারই অংশ।
মার্কসবাদী চিন্তানায়করা বুঝেছিলেন বিপ্লবের জন্য যেমন শিল্প-সাহিত্যে শ্রেণীসংগ্রাম দরকার, তেমনি পুরানো মহৎ শিল্পকেও দরকার মানুষের চিন্তার জগৎকে গড়ে তোলার জন্য। শেক্সপিয়ার, গ্যাটে, শিলার যদি – মার্কস এঙ্গেলসের চিন্তার জগৎকে গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারেন, তাহলে আজকের বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণীর চিন্তাকে গড়ে তুলতে সাহায্য না করবারও কিছু নেই। ফলে সেই সব চিন্তা, সেই সব মহান রচনাও রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত হবে শুধু একারণেই যে, যুগে যুগে তাঁরা মানুষের মুক্তির কথাই বলেছেন। সমাজও মানুষকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। সেজন্য রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার সাথে তার মূলগত কোনো বিরোধ নেই।
পিসকাটর যে কথা বলেন, যে-কোনো বুর্জোয়া নাটকও যদি বুর্জোয়া সমাজের অবক্ষয়কে চিত্রিত করে, অথবা যদি সেটা পুঁজিবাদী নীতিটাকে স্পষ্ট মেলে ধরে, তাহলে তা শ্রেণীসংগ্রামের ধারণাকেই শক্তিশালী করবে এবং সে সংগ্রামের ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে সাহায্য করবে। ১৬৫ শিল্পীকে বিপ্লবী মতাদর্শের শরিক হতেই হবে এমন ফরমান মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন দেননি। শিল্পীর মহত্ত্বের মাপকাঠি হলো তাঁকে অবশ্যই সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। জীবন সম্পর্কে নির্মোহ প্রকৃত তথ্য হাজির করতে হবে। লেনিন বলেছেন, যে-কোনো মহৎ শিল্পীর কাছে আমাদের দাবি জীবনের সত্যনিষ্ঠ প্রতিচ্ছবি।
ইস্কাইলাস, সফোক্লিস, ইউরিপিডিস, আরিস্তোফানিস, শেক্সপিয়ার, গ্যাটে, ইবসেন, শিলার, বার্নার্ড শ, গলসওয়ার্দি, প্রমুখ নাট্যকাররা তাঁর সময়কে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, দর্শককে চিন্তার খোরাক যুগিয়েছেন। শেক্সপিয়ার, ডিকেন্স, থ্যাকারে, গ্যাটে, পুশকিন, বালজাক প্রমুখ প্রসিদ্ধ রচয়িতাদের বিষয় উল্লেখ করে মার্কস ও এঙ্গেলস বলেছেন, সমাজ জীবনের বাস্তব প্রতিফলন তাঁদের লেখায় পাওয়া যায়। শুধু সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছবি নয়, জীবন ও সমাজের ভিতরকার মানসচিত্রের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে জটিল সমস্যার নানা অলিগলিতে অন্তদৃষ্টি ফেলে বিশ্লেষণমূলক নাটক-উপন্যাস সৃষ্টিই তাঁদের রচনার বৈশিষ্ট্য। একটা বিশেষ যুগের সমাজ-জীবনের বিভিন্ন সমস্যার এক একটি দিকের প্রতিফলন যেমন পাওয়া যায় তাঁদের রচনায়, তেমনি আবার বহুমুখী নানা চরিত্রের সৃষ্টি সে রচনাকে আরো উজ্জ্বল করে। গোটা সমাজের নানা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ছবি পাওয়া যায় এঁদের রচনায়। সেই রচনায় উপকৃত হয়েছেন বহু রাজনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী।
মার্কস-এঙ্গেলস মনে করতেন, সত্য কারো উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রকাশিত হবে না। তাকে নিজ গুণেই প্রকাশিত হতে হবে। এই কারণেই এঙ্গেলসের কাছে রাজতন্ত্রের সমর্থক বালজাক মহান কথাকার। কেন না বালজাক সেদিনের ফ্রান্সের জীবনকে সততার সঙ্গে এঁকেছিলেন, সে ছবি তাঁর শ্রেণীর বিপক্ষে গেলেও তিনি তা প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি। শেক্সপিয়ারের নাটকের আলোচনা করলে দেখা যায় তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো অভিজাত, উদার মানসিকতাসম্পন্ন এবং সামগ্রিকভাবে মানবতাবাদী। সে যুগের শ্রমজীবী সম্পর্কে তাঁর সহানুভূতি থাক বা নাই থাক, শেকসপিয়ারকে প্রতিক্রিয়াশীল হাতের ক্রীড়নক গণ্য করা হবে সরলীকরণ।
মার্কস-এঙ্গেলস বালজাক দরকার মানুষের চিন্তার জগৎকে গড়ে তোলার জন্য। শেক্সপিয়ার, গ্যাটে, শিলার যদি মার্কস এঙ্গেলসের চিন্তার জগৎকে গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারেন, তাহলে আজকের বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণীর চিন্তাকে গড়ে তুলতে সাহায্য না করবারও কিছু নেই। ফলে সেই সব চিন্তা, সেই সব মহান রচনাও রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত হবে শুধু একারণেই যে, যুগে যুগে তাঁরা মানুষের মুক্তির কথাই বলেছেন। সমাজও মানুষকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। সেজন্য রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার সাথে তার মূলগত কোনো বিরোধ নেই।
পিসকাটর যে কথা বলেন, যে-কোনো বুর্জোয়া নাটকও যদি বুর্জোয়া সমাজের অবক্ষয়কে চিত্রিত করে, অথবা যদি সেটা পুঁজিবাদী নীতিটাকে স্পষ্ট মেলে ধরে, তাহলে তা শ্রেণীসংগ্রামের ধারণাকেই শক্তিশালী করবে এবং সে সংগ্রামের ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে সাহায্য করবে। শিল্পীকে বিপ্লবী মতাদর্শের শরিক হতেই হবে এমন ফরমান মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন দেননি। শিল্পীর মহত্ত্বের মাপকাঠি হলো তাঁকে অবশ্যই সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। জীবন সম্পর্কে নির্মোহ প্রকৃত তথ্য হাজির করতে হবে। লেনিন বলেছেন, যে-কোনো মহৎ শিল্পীর কাছে আমাদের দাবি জীবনের সত্যনিষ্ঠ প্রতিচ্ছবি।
ইস্কাইলাস, সফোক্লিস, ইউরিপিডিস, আরিস্তোফানিস, শেক্সপিয়ার, গ্যাটে, ইবসেন, শিলার, বার্নার্ড শ, গলসওয়ার্দি, প্রমুখ নাট্যকাররা তাঁর সময়কে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, দর্শককে চিন্তার খোরাক যুগিয়েছেন। শেক্সপিয়ার, ডিকেন্স, থ্যাকারে, গ্যাটে, পুশকিন, বালজাক প্রমুখ প্রসিদ্ধ রচয়িতাদের বিষয় উল্লেখ করে মার্কস ও এঙ্গেলস বলেছেন, সমাজ জীবনের বাস্তব প্রতিফলন তাঁদের লেখায় পাওয়া যায়। শুধু সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছবি নয়, জীবন ও সমাজের ভিতরকার মানসচিত্রের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে জটিল সমস্যার নানা অলিগলিতে অন্তদৃষ্টি ফেলে বিশ্লেষণমূলক নাটক-উপন্যাস সৃষ্টিই তাঁদের রচনার বৈশিষ্ট্য। একটা বিশেষ যুগের সমাজ-জীবনের বিভিন্ন সমস্যার এক একটি দিকের প্রতিফলন যেমন পাওয়া যায় তাঁদের রচনায়, তেমনি আবার বহুমুখী নানা চরিত্রের সৃষ্টি সে রচনাকে আরো উজ্জ্বল করে। গোটা সমাজের নানা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ছবি পাওয়া যায় এঁদের রচনায়। সেই রচনায় উপকৃত হয়েছেন বহু রাজনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী।
মার্কস-এঙ্গেলস মনে করতেন, সত্য কারো উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রকাশিত হবে না। তাকে নিজ গুণেই প্রকাশিত হতে হবে। এই কারণেই এঙ্গেলসের কাছে রাজতন্ত্রের সমর্থক বালজাক মহান কথাকার। কেন না বালজাক সেদিনের ফ্রান্সের জীবনকে সততার সঙ্গে এঁকেছিলেন, সে ছবি তাঁর শ্রেণীর বিপক্ষে গেলেও তিনি তা প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি। শেক্সপিয়ারের নাটকের আলোচনা করলে দেখা যায় তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো অভিজাত, উদার মানসিকতাসম্পন্ন এবং সামগ্রিকভাবে মানবতাবাদী। সে যুগের শ্রমজীবী সম্পর্কে তাঁর সহানুভূতি থাক বা নাই থাক, শেকসপিয়ারকে প্রতিক্রিয়াশীল হাতের ক্রীড়নক গণ্য করা হবে সরলীকরণ।
মার্কস-এঙ্গেলস বালজাক ও শেক্সপিয়ারকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন, তাঁদের রক্ষণশীল মানসিকতা সত্ত্বেও তাঁরা দুজনেই নিজ নিজ সামাজিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে সমাজ সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করেন। শেক্সপিয়ারের নাটক দর্শকে শিক্ষাদান করে না, জীবনের সব সম্পদ ও বৈচিত্র্যসমেত তাকে উপস্থিত করে। পিসকাটরের নাটককে এপিক আখ্যা দেয়া হয় কারণ এর ফলে থিয়েটারের বাহ্যিক আকারের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। প্রচলিত ধারার ভাঙন ধরে। সুদূর প্রসারিত ভাবান্তরের সৃষ্টি হয়। এই ভাবান্তরের আরো সম্প্রসারণ ঘটায় ব্রেন্ট।
যাঁরা নাট্য রচনায় শ্রেণীসংগ্রামের সৎ বিবরণ দেন না, যাঁরা বিপ্লবের বা শ্রমিকদের দোষ-ত্রুটি দেখতে পান না, কল্পনার ফানুস উড়িয়ে বিপ্লবকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলেন, তাঁদের রচনা মার্কসবাদী রচনা নয়। শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবের প্রতিটি স্তর, নানা সংকট এবং অন্তর্দ্বন্দ্বগুলি না দেখানো হলে সেখানে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা অনুপস্থিত। ইতিহাসের তথ্য উপস্থাপনও শিল্পকীর্তি নয়, সেই তথ্যগুলি শ্রমিকশ্রেণীর প্রগতির নৈতিকতার নিরিখে বিচার করতে হবে। সমাজতান্ত্রিক বস্তুবাদ সমাজের অগ্রণী বাহিনীর সাথে জনগণের যোগসূত্র তৈরি করবে। লেনিন বলেছিলেন, সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাকে শাশ্বত বলে স্ট্যাম্প মেরে দেয়া যায় না, সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাকেও অভিজ্ঞতার মানদণ্ডে বারবার যাচাই করতে হবে। বারবার পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে।
আর এই নিরন্তর পরীক্ষার মধ্য দিয়েই সমাজতান্ত্রিক বস্তুবাদ ত্রুটিহীন দর্শনের পথে পা বাড়াবে। তখনই নির্দ্বিধায় ঘোষণা করা যাবে সমাজতান্ত্রিক বস্তুবাদ যুগের নানান অভিজ্ঞতাকে ব্যাখ্যা করতে পারে, গ্রহণীয়কে গ্রহণ করতে পারে। রাজনৈতিক নাটক কখনই তিন ঘন্টা ধরে ক্যাপিটাল গ্রন্থের আবৃত্তি হতে পারে না। নাটকের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রকাশ তখনই ঘটবে যখন নান্দনিকভাবে এবং শিল্পের নিজের ভঙ্গিতে রাজনীতির কঠিন সমস্যাগুলিকে দর্শকের সামনে সহজভাবে তুলে ধরা হবে। পিসকাটর যখন ঘোষণা দিয়েছিলেন, সর্বহারার নাট্যশালার নাটকগুলি কোনো শিল্প নয় প্রচার, জার্মান কমিউনিস্ট পার্টি পিসকাটরের এই বক্তব্যকে।
আক্ষরিকভাবে ধরে নিয়ে পার্টির মুখপাত্র ‘লাল নিশান’ পত্রিকায় প্রতিবাদ জানায়। পত্রিকাটি লিখলো, সর্বহারার নাট্যশালার ধারণাটি সম্পর্কে কোনো আপত্তি নেই; কিন্তু তাদের প্রচারপত্রে বলা আছে নাটকগুলো শিল্প নয় প্রচার-এর উত্তরে বলতে হয়, তাহলে থিয়েটার নাম নেয়া হয়েছে কেন? থিয়েটার নাম গ্রহণ করা মাত্রই সর্বহারার নাট্যশালার ওপরেও শৈল্পিক দায়িত্ব এসে পড়েছে। শিল্প এমনই এক বস্তু যে প্রচারের জগাখিচুড়িকে সে নামে অভিহিত করা যায় না।১৬ মার্কস-এঙ্গেলস দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে ধীরে ধীরে মার্কসীয় শিল্পতত্ত্বের বা দ্বান্দ্বিক নাট্যধারার বিকাশ। কিন্তু শুধু ফরমান জারি করে বা কোনো সূত্র দিয়ে গবেষণাগার থেকে মার্কসবাদী নাটক তৈরি করা যায় না। উৎপাদন আর সৃষ্টিশীলতার মধ্যে পার্থক্য আছে, মার্কসবাদীরা সবসময় তা স্বীকার করেন।
পিসকাটর লিখেছেন, চর্বিতচর্বণ ও প্লাকার্ডে লেখা কিছু শ্লোগান মারফত একটা জীবন দর্শন প্রচার তার উদ্দেশ্য ছিলো না। যুক্তিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার ছিলো তার লক্ষ্য এবং এটা করার পথ হচ্ছে মঞ্চের ঘটনার সঙ্গে ইতিহাসের শক্তিগুলির যোগসূত্রটা ধরা। রাজনৈতিক নাট্যচিন্তা বা রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলন তাই কোনো গণ্ডিবদ্ধ ব্যাপার নয়, কোনো সংকীর্ণ ব্যাপার নয়। সমাজ পরিবর্তনে নতুন জগৎ নির্মাণে যা কিছু মানুষের চিন্তাকে সাহায্য করবে তার সবই রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলনে স্থান পাবে। শুধুমাত্র খেয়াল রাখতে হবে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণে শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠায় তা চূড়ান্তভাবে সাহায্য করছে কি না।
বিশ শতকের যে রাজনৈতিক নাটক তার সাথে শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্বের প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটাই মূলকথা, প্রধান প্রশ্ন। যাঁর মধ্যে এ ব্যাপারে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আছে তিনি পরিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক থিয়েটারের লোক নন। রাজনৈতিক থিয়েটার কোনো সখ নয়, সমাজ পরিবর্তনের জন্য এক ধরনের দায়বদ্ধতা। সমাজ পরিবর্তন কথার অর্থও এই নয় যে, তাদের নিজেদের সুবিধা মতন সমাজ পরিবর্তন এবং সেই পরিবর্তনটুকু ঘটার সঙ্গে সঙ্গে থেমে পড়া। সমাজ পরিবর্তন ইতিহাসের একটি অনিবার্য ব্যাপার, সেই পরিবর্তনকে কখনই থামানোর চেষ্টা চলবে না। সমাজতন্ত্র এমনকি সাম্যবাদ আসার পরেও নয়। মার্কসবাদী চিন্তাই হচ্ছে পরিবর্তনকে চিরন্তন হিসাবে দেখতে পারা। ইতিহাসে পিছনে ফিরবার কোনো উপায় নেই। ইতিহাস অনিবার্যভাবে সামনের দিকে ঠেলছে মানুষকে।
প্রশ্ন আসতে পারে, মার্কসীয় চিন্তা অনুযায়ী যদি সমাজ পরিবর্তন ইতিহাসের অনিবার্য ব্যাপার হয় তাহলে রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলনের প্রয়োজনটা কোথায়? মার্কসীয় তত্ত্ব অনুযায়ী পরিবর্তন যেখানে অনিবার্য, সেখানে পরিবর্তন তো আসবেই। রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলন তাহলে সেখানে কোন দায়িত্বটি পালন করছে? দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ তত্ত্বের বিশেষত্ব এখানেই, মার্কস-এঙ্গেলস কোনো কিছুকেই স্বয়ম্মু মনে করছেন না। সেখানে সকলেই সকলের ওপর নির্ভরশীল, পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত। মার্কস- এঙ্গেলস তাই মনে করেন, ইতিহাস যেমন মানুষকে পরিচালিত করে, মানুষেরও চিন্তা ও কাজের প্রভাব পড়ে তেমনি ইতিহাসের ওপর। ইতিহাসের বাইরে যেতে পারে না মানুষ, আবার ভিন্নার্থে ইতিহাস মানুষকে ঠেলে দেয় ইতিহাসের বাইরে, সৃষ্টি হয় নতুন ইতিহাস। রাজনৈতিক নাটকের লক্ষ্য তাই পৃথিবীর পরিবর্তনের ইতিহাসের গতির ওপর প্রভাব ফেলা। যে পরিবর্তন অনিবার্য তাকে এগিয়ে আনা।
মার্কসের মতে সমাজ পরিবর্তন অনিবার্য তাই বুর্জোয়া ব্যবস্থা ভেঙ্গে একদিন শ্রমিকের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হবেই। মানুষ শোষণমুক্ত হবে তার মধ্য দিয়ে। সেটা কবে ঘটবে? কতো বছর কতো যুগ পর? যতোদিন সেটা না ঘটবে ততোদিন কি তাহলে মানুষ চোখ বুজে নির্যাতন সহ্য করে যাবে এই কথা ভেবে যে পরিবর্তন অনিবার্য? মার্কসবাদীরা মনে করেন ব্যাপারটা তা নয়। সেটা হবে ভাগ্যের হাতে নিজেকে ছেড়ে দেয়া।
রাশিয়ায় যখন বিপ্লব হলো রাশিয়া তখন অনেক পশ্চাদপদ দেশ। পুঁজিবাদ বিকশিত হলে সমাজতন্ত্র বিকশিত হবে এই ছিলো মার্কসের মতবাদ। লেনিন মানলেন না। লেনিন দেখলেন সেটা মানতে গেলে রাশিয়ার শ্রমিকশ্রেণীকে আরো বহু বহু বছর ধরে নির্যাতিত হতে হবে। সমাজ পরিবর্তনে মানুষের নিজেরও ভূমিকা আছে। সেই ভূমিকা সম্পর্কে মানুষকে যেমন সচেতন করবে রাজনীতি, দর্শন, রাজনৈতিক বক্তৃতা, লেখা-লেখনী, তেমনি রাজনৈতিক নাটকও সেই একই কাজ করবে।
প্রশ্ন আসতে পারে, বিপ্লবের প্রয়োজনে রাজনীতি প্রচারের কাজ করবে রাজনৈতিক দল বা দলের কর্মীরা, নাটক বা শিল্পের সেখানে প্রয়োজন কোথায়? বিপ্লবের সাথে বিপ্লবী রাজনৈতিক সংস্কৃতির সম্পর্ক বোঝার জন্য প্রথমেই এ বিষয়টি বোঝা দরকার যে, বিপ্লবী রাজনৈতিক সংগ্রাম ও বিপ্লবী সাংস্কৃতিক সংগ্রাম যদি সমান্তরালভাবে গঠিত না হয় ও চলমান না থাকে তাহলে কোনো সমাজেই বিপ্লব সংগঠিত হওয়া সম্ভব নয়।
সম্ভব যে নয় তার কারণ-বিপ্লবী রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রধান দিক হলো মূলত সাংগঠনিক দিক, বিপ্লবী সাংস্কৃতিক সংগ্রামের প্রধান দিক হলো তার মতাদর্শগত দিক। রাজনৈতিক কর্মীরা যখন দৈনন্দিন রাজনৈতিক সংগ্রামের জন্য প্রাণপাত করবে, মতাদর্শের কর্মীরা তখন তাদের সাহায্য করবেন জনতার দৃষ্টি ভবিষ্যতের বিশাল সংগ্রামের দিকে চালনা করতে; অর্থাৎ দৈনন্দিন সংগ্রামের চাপে যেন ভবিষ্যতের বৃহত্তর সংগ্রাম হারিয়ে না যায়। সংস্কৃতির সংগ্রাম ও রাজনৈতিক সংগ্রাম বিচ্ছিন্ন নয়, দুই সংগ্রামের লক্ষ্য এক-সমাজটাকে পাল্টানো।
শিল্প মানুষের আবেগকে সংগঠিত রূপ দান করে, মানুষের প্রকৃতিকে পরিবর্তনশীল বস্তুজগতের সঙ্গে অন্বিত করে এবং নতুন চিন্তার জন্ম দেয়। নতুন চিন্তার মধ্যেই থাকে যে-কোনো পরিবর্তন বা বিপ্লবের বীজ। সমাজ পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক নাটক প্রচার চালায়, তেমনি বুর্জোয়ারা এ ব্যবস্থাকে ধরে রাখার জন্য আরো জোরেসোরে প্রচার চালাচ্ছে।
বুর্জোয়া প্রচারের পক্ষে বহু নাট্যদল বা নাটক পাওয়া যাবে যারা বুর্জোয়া রাজনীতিই প্রচার করে চলেছে কিন্তু বুর্জোয়ারা সেটা স্বীকার করছে না। নিজেদের নাটকে রাজনীতি প্রচারের ব্যাপারটাকে তারা গোপন রাখতে চায়। সেজন্য তাদের রাজনীতি প্রচারের ধরনটাও আলাদা। বুর্জোয়ারা রাজনীতি প্রচার করে নীতিকথার মাধ্যমে। বুর্জোয়া থিয়েটার তাই নীতি কথার মাধ্যমে শেখায় প্রচলিত রীতিনীতিকে মেনে চলতে, আইনকে শ্রদ্ধা করতে ও শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে।
নিজেদের রাজনীতির পক্ষেই এই ধরনের প্রচার চালায় তারা নিজেদের তৈরি সমাজ ব্যবস্থাটাকে ধরে রাখবার জন্য। শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবকে ঠেকাবার জন্য। বুর্জোয়ারা চায় সুবোধ সুশীল ভদ্র বামন, যারা ধর্মগ্রন্থ পড়বে এবং ক্ষুদ্র অকিঞ্চিৎকর মধ্যবিত্ত জীবন যাপন করবে। পরকালের সুখের জন্য ইহলোককে তুচ্ছ জ্ঞান বা বিসর্জন দেওয়ার ধর্মীয় শিক্ষা ধর্মগ্রন্থের পাতায় পাতায় বর্ণিত। বুর্জোয়ারাও সেটাই প্রচার করতে চায় নিজ স্বার্থে।
মানুষের দৃষ্টিকে বর্তমান থেকে পরলোকের দিকে সরিয়ে দেয়ার জন্য। লক্ষ্য খুব স্পষ্ট। সমাজ পরিবর্তনের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা থেকে স্থিতাবস্থার অন্ধকারে আটকে রাখতে হবে সমাজের গতিকে। তবুও বুর্জোয়াদের জোর দাবি নাটকে রাজনীতির প্রচার তারা বিশ্বাস করে না, ‘শিল্পের জন্য শিল্পই’ তাদের লক্ষ্য। পাশাপাশি যারা বুর্জোয়াদের শ্রেণীস্বার্থের বিরুদ্ধে নাটক করছে তারা সজোরেই নিজেদের ‘রাজনৈতিক নাটকের লোক’ বলে চিহ্নিত করে নিয়েছে।
যেহেতু বুর্জোয়ারা নাটকে রাজনীতি প্রচারের বিরুদ্ধে বা সেই ধরনের শ্লোগানই দিয়ে থাকে, সেজন্য খোলাখুলিভাবে রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলন করার বাধা তাদের রয়েছে। খোলাখুলিভাবে ঘোষণা দিতে পারে না বলেই তারা নিজেদের নাটককে ‘রাজনৈতিক নাটক’ বলতে পারে না, নিজেদের নাটক সম্পর্কে মার্কসবাদীরা যা সহজেই বলতে পারে। মার্কসবাদীরা ঘোষণা দিয়েই নাটকে রাজনীতি প্রচার করছে, সেজন্য তারাই রাজনৈতিক থিয়েটারের লোক, সেজন্য তাদেরই থিয়েটার রাজনৈতিক থিয়েটার নামে চিহ্নিত হতে পারে।
মার্কসবাদী নাট্যচিন্তা বা রাজনৈতিক নাটক যে ধরনের সমাজ পরিবর্তনের কথা • বলছে সেটা যেমন একদিনে ঘটার ব্যাপার নয়, তেমনি সে পরিবর্তনের পথে রয়েছে নানা স্তর। মাঝখানের বিভিন্ন স্তরগুলোকে অতিক্রম করার পরেই যেহেতু সে স্তরে পৌঁছানো সম্ভব হবে তাই প্রতিটি স্তর অতিক্রম করার জন্য রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন লড়াই।
রাজনৈতিক নাট্যচিন্তাবিদ বা কর্মীদের সেইসব লড়াইয়ে সফলতা লাভের জন্য নানাধরনের কৌশলও গ্রহণ করতে হয়। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা শুধু কথার কথা নয়, তার জন্য দরকার দীর্ঘ সংগ্রাম, সংগ্রামের আগে দরকার দীর্ঘ প্রস্তুতি। শ্রমিকশ্রেণীকে বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে একথা যেমন সত্য, তেমনি এটাও মনে রাখতে হবে বুর্জোয়া শোষণের সঙ্গে মিশে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ, মাতব্বর-জোতদারদের শোষণ, সম্প্রদায়গত শোষণ, ধর্মীয় শোষণ, আমলার শোষণ, গ্রাম্য পীর-পুরোহিতদের প্রাতিষ্ঠানিক শোষণ সহ নানা ধরনের সামাজিক শোষণ। সেইসব শোষণের বিরুদ্ধেও রাজনৈতিক নাটকে কথা বলতে হবে, জনগণকে সজাগ করতে হবে, তবে তার মূল লক্ষ্য থাকবে শ্রমিকশ্রেণীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা। রাজনৈতিক নাটককে তাই একই সঙ্গে দ্বিমুখী-ত্রিমুখী লড়াই চালাতে হয়। বিভিন্ন প্রশ্নকে একই সঙ্গে সামনে নিয়ে আসতে হয়।
সমাজতন্ত্র একটি বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা, মানুষকে মানুষ হিসাবে আত্মপ্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দেয়ার লড়াই। দীর্ঘদিনের মানুষের চিন্তার যে ইতিহাস, সেখানে মার্কসের চিন্তা বহু বেশি অগ্রগামী, পুরানো চিন্তার নির্যাস থেকে যেহেতু তা উদ্ভুত। সেই চিন্তাকে মানুষের কাছে পৌঁছানো খুব সহজ কাজ নয়, সরাসরি সম্ভবও নয়। দীর্ঘ বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন ঐতিহ্যের ভিতর দিয়ে মানুষের চিন্তা নানা কুসংস্কারে বাঁধা পড়ে আছে, সেখানে নতুন চিন্তাকে জায়গা দিতে হলে সেই সব পুরানো চিন্তাকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে। শত শত বছরের চিন্তাকে মানুষের ভিতর থেকে উৎপাটিত করতে দরকার সময় ও ধৈর্য্যের, দরকার সে যে পরিমণ্ডলে বাস করছে সেই পরিমণ্ডলকে অল্প অল্প করে পাল্টানো।
মানুষ বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থায় প্রবেশ করলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এখনো তার মধ্যে সামন্ততান্ত্রিক চিন্তা বাসা বেঁধে আছে। বিশেষ করে এশিয়ার পশ্চাদপদ দেশগুলোতে। এইসব দেশে বুর্জোয়া ব্যবস্থার প্রলোভন, প্রতিযোগী মনোভাব আর মধ্যযুগীয় কুসংস্কার-এমন এক জগাখিচুড়ির মধ্যে মানুষ বিরাজমান।
মানব সমাজকে এক ধাক্কায় বহু শতাব্দী এগিয়ে দিয়েছে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। তার মানে এ কথা বোঝায় না যে, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিও বুর্জোয়া যুগে উৎপাদনী শক্তির সঙ্গে তাল রেখে এগিয়ে গেছে। বুর্জোয়ারা নিজ স্বার্থেই মানুষের সামন্তবাদী চিন্তাগুলোকে এখন আর দূর করতে চাইছে না। ধর্ম প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লড়াই করে যে বুর্জোয়াদের জন্ম, এখন তারাই প্রমাণ করতে চায় সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের পায়ে মানুষ সমর্পিত জীবমাত্র। সেটা এইজন্য যে, সর্বশক্তি ও সমস্ত গুণ যদি ঈশ্বরে আরোপ করা যায়, মানুষকে তাহলে নির্জীব,ক্ষমতাহীন হিসাবে দেখানো যায়। মার্কসবাদীরা মনে করে, বুর্জোয়ারা যদি মানুষের সামন্তবাদী চিন্তা বা কুসংস্কার দূর করার দায়িত্ব নিতো তাহলে মার্কসবাদীদের কাজ অনেকাংশে কমে যেতো।
বুর্জোয়ারা তা করছে না বলেই মার্কসবাদীদের এখন প্রথম কাজ হলো সামন্তবাদী চিন্তা থেকে মানুষের চিন্তার জগতকে বুর্জোয়া চিন্তার জগতে উত্তীর্ণ ঘটানো, বুর্জোয়া বিজ্ঞান প্রযুক্তির সাথে তার চিন্তার মেলবন্ধন ঘটানো। গণতান্ত্রিক চিন্তার সাথে মানুষকে প্রথম পরিচিত করে তোলা। বুর্জোয়া দর্শন যদিও ইতিবাচক ও নেতিবাচকের জগাখিচুড়ি, তবুও তারপরেও তার প্রগতিশীল দিকটাকে অস্বীকার করা যায় না। উদীয়মান যুগে বুর্জোয়ারাই বিপ্লবী ভূমিকা নিয়েছিলো ধর্মের ব্যাপারে, কারণ তাদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো অতিবৃদ্ধ সামন্ততন্ত্র। উৎপাদন ব্যবস্থাও ছিলো সেদিন সামন্ততন্ত্রের করায়ত্ত আর চার্চ ছিলো তাদের সহায়। যুক্তিবাদের প্রতি সমর্থন ও সামন্ততন্ত্রের বিরোধিতা ছিলো বুর্জোয়া চিন্তাবিদদের সেদিন মূল অস্ত্র।

সেই নতুন চিন্তার পেছনে বুর্জোয়ারা সেদিন শোষিত সমাজকে সমাবেশিত করেছিলো পরে যখন দেখা গেল সেই শোষিতদের মধ্যে বিপ্লবের এমন বেগ সঞ্চারিত হয়েছে যা বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধেও চলে যেতে বসেছে, তখনি বিপ্লবী যুক্তিবাদের পতাকা ফেলে দিয়ে বুর্জোয়ারা গ্রহণ করলো চার্চের মতবাদ। বুর্জোয়াশ্রেণী যখন ভীত হয়ে আপন শ্রেণীস্বার্থেই অর্ধপথে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও যুক্তিবাদের পতাকা ফেলে দিয়ে বিপ্লব অসমাপ্ত রেখেই সামন্ততন্ত্র ও পুরানো ধর্মব্যবস্থার সাথে সন্ধি করলো তখনো কিন্তু বুর্জোয়া বিপ্লবের বাস্তব অবস্থাটা ফুরিয়ে গেল না, রয়েই গেল।
যুক্তিবাদ হচ্ছে যে-কোনো আধুনিক সংগ্রামের পূর্বশর্ত যার প্রাথমিক প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো বুর্জোয়াদের হাতে। কাজেই পশ্চাদপদ সংস্কারপূর্ণ চিন্তার জগতে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব একটি প্রগতিশীল আন্দোলন। বুর্জোয়ারা এ আন্দোলন সম্পূর্ণভাবে সমাপ্ত করেনি বলেই মার্কসবাদীরা মনে করে তাদের দায় সে আন্দোলন সমাপ্ত করা।
সাম্যবাদ কিংবা সমাজতন্ত্র অথবা শ্রমিকশ্রেণীর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবার আগে সেটা একটা প্রধান জরুরি কর্তব্য। সেই কর্তব্য পালনই হচ্ছে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক স্তর। সমাজতন্ত্রে পৌঁছবার প্রস্তুতি পর্ব। সেটা প্রতিষ্ঠা করতে হবে বুর্জোয়া সুবিধাবাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নয়, মার্কসীয় বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। সেজন্য মার্কসবাদীরা মনে করে, রাজনৈতিক নাটক শুধুমাত্র সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথাই বলবে না, তার পূর্বের সবগুলো স্তরের ক্রমবিকাশের ধারা মেনে চলবে। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক নাট্যকারের দায়িত্ব দ্বিবিধ।
রাজনৈতিক থিয়েটার পশ্চাদপদ মানুষকে প্রথম বলবে যুক্তিবাদের কথা, মানবিকতার কথা এবং সেই একইসাথে সমাজতন্ত্র বা শ্রমিকশ্রেণীর রাষ্ট্রের ব্যাপারটিকেও লক্ষ্য হিসাবে দর্শকের সামনে তুলে ধরবে। সশস্ত্র বিপ্লবের কথা বলবার আগে তার প্রস্তুতির বিষয়টিতেই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি অতীতের সমস্ত সশস্ত্র বিপ্লবের ঘটনাগুলো দর্শকদের চোখের সামনে তুলে ধরে সশস্ত্র বিপ্লবের মাহাত্ম্য এবং এর বীরত্বের দিকগুলোর সাথে তাদের পরিচিত করে তুলতে হবে, যাতে প্রয়োজনের সময় সে এ পথ থেকে সরে না দাঁড়ায় বা শ্রমিকশ্রেণীর সশস্ত্র বিপ্লবকে সে ঘৃণার চোখে না দেখে।
সশস্ত্র বিপ্লবের নানা ভুলভ্রান্তির সাথে যাতে দর্শক পরিচিত হতে পারে। সশস্ত্র বিপ্লবকে কখনই যাতে তার কাছে সন্ত্রাস মনে না হয়। সশস্ত্র বিপ্লবের সংগ্রামের প্রতি তার বিশ্বাসটাকে গড়ে তুলতে হবে মানবতাবাদের জয়গানের মধ্য দিয়েই। রাজনৈতিক নাটকের প্রথম পর্ব তাই কুসংস্কার আচ্ছন্ন মানুষের কাছে যুক্তিবাদ ও মানবিকতার ছোঁয়া পৌঁছে দেয়া।
সবকালেই যে-কোনো ক্ষেত্রেই পরাধীন দেশগুলোকে স্বাধীনতার জন্য প্রথম লড়তে হয় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। সেজন্য সেসব ক্ষেত্রে মার্কসবাদী থিয়েটারেরও লক্ষ্য থাকে উদারনৈতিকদের, মধ্যবিত্তদের সাথে নিয়ে সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ সেখানে প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। সাম্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক সরকারের চরিত্র এবং তার মুৎসুদ্দিদের চেহারাটা পরিষ্কার করে তোলাই হয়ে দাঁড়ায় সেখানে প্রাথমিক কর্তব্য।
রাজনৈতিক থিয়েটার সেটা করে অবশ্যই সমাজ বিজ্ঞান চেতনার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। স্বাধীনতা লাভের পর যেমন তার প্রথম কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় বুর্জোয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শ্রেণীসংগ্রাম প্রচার, তেমনি বুর্জোয়া স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সকল উদারনৈতিকদের সাথে মিলে মিশে গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করা। পশ্চাদপদ বুর্জোয়া ব্যবস্থায় শুধু শ্রমিক শোষিত নয়, শোষিত কৃষক সম্প্রদায়, মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তরাও। স্বৈরশাসনের দাপটের স্বীকার হয় সেখানে উচ্চবিত্তরাও।
সেজন্য মার্কসবাদীরা জোট বাঁধে এদের সকলের সাথে। ফলে প্রাথমিক স্তরে মার্কসবাদী নাটকের লক্ষ্য থাকে শ্রেণীসংগ্রাম প্রচারের পাশাপাশি প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগ্রামের পক্ষে স্থান-কালের প্রেক্ষিতে বিজ্ঞানসম্মত চিন্তা প্রচার করা, বিজ্ঞানের চুলচেরা বিশ্লেষণ সকলের সামনে হাজির করা। রাজনৈতিক নাটকের বৈজ্ঞানিক চিন্তা থেকে তাই কখনই সরে দাঁড়াবার সুযোগ নেই। রাজনীতি ও শিল্প সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মার্কস ও এঙ্গেলস খুব স্পষ্টভাবেই বলেছেন, কোনো শিল্পীই তাঁর সময়কালের শ্রেণীসংগ্রাম উপেক্ষা করতে পারে না; সব শিল্পী সাহিত্যিক সচেতনভাবে হোক বা নিজের অজ্ঞাতসারেই হোক ঐ শ্রেণীসংগ্রামে বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করতে বাধ্য এবং নিজের শিল্প সৃষ্টিতে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে তা প্রকাশ করেন।
সাম্রাজ্যবাদের নিগড়ে বাঁধা স্বাধীন রাষ্ট্রের বুর্জোয়া সরকারগুলো সর্বদাই স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদে রূপ নেয়। মধ্যবিত্ত ভাববাদীরা সেই সরকারের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করলেও তার মূল স্বরূপটি তুলে ধরতে ব্যর্থ হয় নিজেদের মানসিকতার জন্যই। যাঁরা বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত, বহু সময় দেখা যায় বুর্জোয়াদের ভীষণ প্রভাব তাঁদের ওপর রয়ে গেছে, অথচ তাঁরা নিজেরাই বুঝতে পারেন না যে অবচেতনে তাঁরা বুর্জোয়া চিন্তাকেই প্রচার করে চলেছেন।
বুর্জোয়া বিশ্বাসগুলো তাঁদের ওপর এমনভাবেই চাপানো থাকে যে নিজের অজান্তেই তাঁরা সেগুলোকে গ্রহণ করেন। মানুষের চিন্তার জগতে শাসকশ্রেণীর প্রভাব এভাবেই কাজ করে। সেক্ষেত্রে তাঁদের দ্বারা যে কাজটি হয় তাহলো ক্ষোভ আর ঘৃণার প্রকাশ, সেজন্য তাঁদের শিল্প-সাহিত্য বিজ্ঞানসম্মত কোনো দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করতে পারে না। ফলে যে ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি বা যে ধরনের দর্শন তারা প্রচার করে থাকে তা মূলত বুর্জোয়াদের পক্ষেই চলে যায়। শ্রমিকশ্রেণী বা শোষিত জনগণ এর থেকে কোনো দিক নির্দেশনা লাভ করতে পারে না এবং সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়।
মার্কসবাদী রাজনৈতিক নাটকগুলোর এক্ষেত্রে কাজ হয়ে দাঁড়ায় সমস্ত ঘটমান রাজনৈতিক ঘটনাগুলোকে তুলে ধরে তার অভ্যন্তরীণ সত্যটি দর্শকদের দৃষ্টির সামনে নিয়ে আসা। বুর্জোয়া গণতন্ত্র, বুর্জোয়া দেশপ্রেম ও বুর্জোয়া উন্নয়নের মূল স্বরূপটি দেখিয়ে দেয়া। বুর্জোয়া গণতন্ত্র যে ভাগ বাটোয়ারার লড়াই, প্রতিটি রাজনৈতিক ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে তা প্রমাণ করা। সেজন্যই রাজনৈতিক নাটককে রাজনৈতিক উত্থান-পতনের ঘটনাকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে হয়। বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থার হতাশা প্রচার করা তার কাজ নয়।
রাজনৈতিক নাটককে রাজনৈতিক ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিতে হবে কেন, কোন্ কোন কারণে এই সমাজ ব্যবস্থা শ্রমিকশ্রেণীসহ অন্যান্য শোষিত শ্রেণীর ভাগ্য পাল্টাতে পারে না, কেমন করে বুর্জোয়া ব্যবস্থায় তাদের মধ্যকার গলা কাটাকাটি করার প্রতিযোগিতা সমগ্র রাষ্ট্রের জন্য বিপর্যয় বয়ে আনে। বুর্জোয়া ব্যবস্থার নেতিবাচক দিকটিকেই যেমন তুলে ধরতে হবে তেমনি সমকালীন রাষ্ট্র, সরকার ও রাজনৈতিক ঘটনাবলী থেকে মুখ লুকিয়ে থাকলেও সেটা রাজনৈতিক নাটক হবে না। রাজনীতি প্রচারই যেখানে মূল কথা, সেখানে রাজনীতি প্রচার সমকালীন বাস্তবতায় কার বিরুদ্ধে এবং জনগণের কোন অংশের পক্ষে সেটাও সরাসরি উপস্থাপন করতে হবে।
বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা প্রচারের স্বার্থে যাঁরা রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলন করবেন, সব কিছুর আগে তাঁদের জানতে হবে নাটকের দর্শক কারা; কাঁ তাদের শ্রেণী অবস্থান, কী রকম তাদের সবার মন-মানসিকতা। সেই প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেই নাটক রচনা ও মঞ্চায়ন করতে হবে। দর্শকদের মধ্যে বিভিন্ন মানসিকতার লোক থাকবে। সেজন্য বিভিন্ন ধরনের দর্শকদের মানসিকতা বুঝেই নাটকের বিষয়বস্তু নির্বাচন করতে হবে। শিক্ষিত-অগ্রণী দর্শক এবং একেবারেই অচেতন দর্শক-দুজনে সবসময়ই একই নাটক পছন্দ নাও করতে পারে; ভিন্ন ভিন্ন মানসিক অবস্থানের কারণে দুজনের কাছে একটি নাটক একইরকমভাবে বোধগম্য না হবার সম্ভাবনাই বেশি। রাজনৈতিকভাবে সচেতন দর্শক এবং যার কোনোরকম রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নেই, এই দু-ধরনের দর্শককে মাথায় রেখেই তাই বিপ্লবী নাটক রচনা করতে হবে।
রাজনৈতিক নাটকের নামে ব্যক্তিগত বিপর্যয় কিংবা জাতীয় ক্ষোভ হতাশাকে চিহ্নিত করলেই হবে না, দরকার সংকটের স্বরূপ উন্মাচন ও উত্তরণের পথ খোঁজা। দর্শকদের তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া। রাজনৈতিক নাটকে দু ভাবে চলবে লড়াই বা বক্তব্য প্রচার। এক সমকালীন রাজনীতি নিয়ে নাটক রচনা ও বিশ্লেষণ, যা ক্রমাগত চলতেই থাকবে, পাশাপাশি শ্রেণীদ্বন্দ্বের সামগ্রিক চেহারাটাও তুলে ধরতে হবে বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপটে।
যুগের চেহারাটা যেমন তুলে ধরতে হবে, তেমনি রাজনীতির চিরকালীন রূপটাও প্রকাশ পাবে। বিষয়টা যে খুব সহজ তা নয়। সেজন্য প্রায় একশো বছর ধরে রাজনৈতিক নাটকের পথযাত্রা শুরু হলেও, পৃথিবীর কোথাও সে আন্দোলন নিখুঁত ছিলো না। সর্বত্রই সে নাটক যেমন বিশাল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে তেমনি নানারকম বিভ্রান্তিরও জন্ম দিয়েছে। সেজন্যই মার্কসবাদ কোনো মনগড়া আদর্শ নয়। বাস্তবের কঠিন কষ্টিপাথরে যাচাই হতে হয় আগে। রাজনৈতিক নাটকও তেমনি।
আরও দেখুন: