রবীন্দ্রনাথ ও নাট্যচর্চা: তাঁর নাটকে অভিনয় নন্দনশাস্ত্র

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে এক অনন্য নাম। কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাসের মতো তাঁর নাটকও সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভাণ্ডারে এক অমূল্য সংযোজন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কেবল নাটক লিখেই থেমে থাকেননি, তিনি নাটকের অভিনয়-নন্দনতত্ত্ব মঞ্চ-সংস্কৃতির নতুন রূপরেখা গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর নাটকে অভিনয় নন্দনশাস্ত্র নিয়ে আলোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, নাটককে তিনি শুধু শব্দের শিল্প নয়, বরং দেহভাষা, সংগীত, নৃত্য ও আবহমান সংস্কৃতির এক সমন্বিত রূপ হিসেবে কল্পনা করেছিলেন।

 

রবীন্দ্রনাথ ও নাট্যচর্চা: তাঁর নাটকে অভিনয় নন্দনশাস্ত্র

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

১. রবীন্দ্রনাথের নাট্যদর্শন

রবীন্দ্রনাথের মতে নাটক হলো এক সামগ্রিক শিল্পকলা—যেখানে সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য, দৃশ্যকলা ও অভিনয় একসাথে মিলিত হয়।

  • নাটককে তিনি সমাজ ও মানবিকতার প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখেছিলেন।
  • তাঁর নাটকে মানুষের আবেগ, দ্বন্দ্ব ও চিরন্তন প্রশ্নগুলো উঠে আসে।
  • অভিনয়কে তিনি কেবল সংলাপ উচ্চারণ নয়, বরং দেহভাষা, স্বরসঙ্গতি ও আবেগপ্রকাশের সমবায় বলেই মনে করতেন।

 

২. নাট্যরূপের ধারা: কাব্যনাটক থেকে প্রতীকী নাটক

রবীন্দ্রনাথের নাটককে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়—
১. প্রথম যুগের নাটকপ্রাচীন কাহিনি অবলম্বনে কাব্যনাটক (যেমন: প্রথম কবিতা, সারদা)।
২. সামাজিক নাটক – সমাজের কুসংস্কার ও সংস্কারভেদ ফুটে উঠেছে (চিরকুমার সভা, মূল্যপ্রকাশ)।
৩. প্রতীকী দার্শনিক নাটক – মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্ব, জীবনদর্শন, বিশ্বসচেতনতা প্রকাশ পেয়েছে (ডাকঘর, রক্তকরবী, চণ্ডালিকা)।

এই ধারার নাটকগুলোতে অভিনয়শৈলীও ভিন্ন ভিন্ন: প্রথমদিকে গীতিনাট্যের আবহ, পরে বাস্তবতার সঙ্গে মিশে গেছে প্রতীক ও দর্শনের অভিনয়ভাষা।

 

৩. রবীন্দ্রনাথের অভিনয় নন্দনশাস্ত্র

শরীরী ভাষার ব্যবহার
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, সংলাপের মতো দেহভঙ্গিও সমানভাবে আবেগ প্রকাশ করে। তাঁর নাটকে চরিত্রের অন্তর্লীন অনুভূতি অঙ্গভঙ্গি ভঙ্গিমার সূক্ষ্ম ব্যবহারের মাধ্যমে ফুটে ওঠে।

কণ্ঠস্বর আবৃত্তি
সংলাপের উচ্চারণে রবীন্দ্রনাথ গুরুত্ব দিয়েছেন ছন্দ, স্বরসঙ্গতি আবেগের প্রবাহে। অতিনাটকীয়তা তিনি পছন্দ করতেন না। তাঁর মতে, সংলাপের ভেতরে যেন সংগীতের মাধুর্য থাকে।

সংগীত নৃত্যের সংমিশ্রণ
রবীন্দ্রনাথের নাটকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো গান নৃত্যের অন্তর্ভুক্তি

  • ডাকঘর-এ গান চরিত্রের অন্তর্লীন বেদনা প্রকাশ করে।
  • চণ্ডালিকা-তে নৃত্য চরিত্রের আবেগকে আরও প্রবল করে তোলে।
  • রক্তকরবী-তে সমবেত কণ্ঠ ও সুর নাটককে আধ্যাত্মিক আবহ দেয়।

প্রতীকী অভিনয়ভাষা
তাঁর নাটকে প্রায়ই ব্যবহৃত হয়েছে প্রতীক—যেমন রক্তকরবী-তে করবী ফুল স্বাধীনতার প্রতীক। অভিনয়ে এই প্রতীকগুলোকে দেহভঙ্গি, মঞ্চসজ্জা মঞ্চচালনা দিয়ে জাগিয়ে তোলা হয়।

সমবায় শিল্পচর্চা
রবীন্দ্রনাথ অভিনয়কে ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিল্প নয়, বরং সমবায় শিল্প হিসেবে দেখেছিলেন। তাঁর মতে, নাটক তখনই পরিপূর্ণ হয় যখন সব শিল্পী ও শিল্পশাখা একসাথে কাজ করে।

 

৪. রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতনের নাট্যমঞ্চ

শান্তিনিকেতনে তিনি নাটককে শিক্ষার অংশ হিসেবে রূপ দেন।

  • ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে নাটক অভিনয় করিয়ে অভিনয়কে শিক্ষামূলক অনুশীলন বানিয়েছিলেন।
  • খোলা আকাশের নিচে প্রাকৃতিক আবহে নাটক মঞ্চস্থ করতেন, যা ছিল এক অভিনব শিল্পনন্দন।
  • এভাবে তিনি “গ্রামোন্মুখ নাট্যচর্চা”-র পথিকৃত।

 

৫. রবীন্দ্রনাথের নাটকে অভিনয়ের তাৎপর্য

  • অভিনয় এখানে মনন আবেগের সমন্বয়
  • কণ্ঠ, দেহভঙ্গি, সংগীত ও নৃত্যের সমন্বয় অভিনয়কে করে তোলে বহুমাত্রিক।
  • দর্শককে কেবল বিনোদন দেওয়া নয়, বরং চিন্তা, আত্মবিশ্লেষণ ও মানসিক পরিবর্তনের সুযোগ করে দেওয়াই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য।

 

৬. প্রভাব ও উত্তরাধিকার

  • রবীন্দ্রনাথের নাট্যদর্শন বাংলা থিয়েটারে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল।
  • তাঁর নাটকে প্রতীক, সংগীত ও নৃত্যের ব্যবহার সমকালীন ও পরবর্তী নাট্যকারদের অনুপ্রাণিত করেছে।
  • শান্তিনিকেতনের নাট্যচর্চা আজও তাঁর নাট্যনন্দনশাস্ত্রের জীবন্ত ধারক।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাটককে শুধু সাহিত্যের একটি শাখা হিসেবে দেখেননি; তিনি অভিনয়কে করেছেন এক সমবায় শিল্পকলার মহোৎসব, যেখানে কণ্ঠস্বর, শরীরী ভাষা, সংগীত, নৃত্য ও প্রতীকের একত্র ব্যবহারে জন্ম নেয় পূর্ণাঙ্গ নাট্যরূপ। তাঁর নাটকে অভিনয়ের নন্দনতত্ত্ব কেবল বাংলা নাটককেই সমৃদ্ধ করেনি, বিশ্ব নাট্যচর্চাতেও এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।