শাবনাজ সাদিয়া ইমি, ডাকনাম ‘ইমি’, বাংলাদেশের ফ্যাশন মডেলিং ও অভিনয় জগতের এক সুপরিচিত ও সম্মানিত নাম। তাঁর প্রতিভা, কঠোর পরিশ্রম এবং অনন্য ব্যক্তিত্বের কারণে তিনি নিজেকে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় মডেল ও অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। র্যাম্প শো থেকে শুরু করে চলচ্চিত্রের পর্দা—সবক্ষেত্রেই তিনি নিজের উপস্থিতি ও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
জন্ম ও প্রাথমিক জীবন
ইমি ২৬ ডিসেম্বর ঢাকার কানপুর এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা, এ কে এম জসীমউদ্দিন, ছিলেন একজন মঞ্চ নাটকের অভিনেতা, যা শৈশব থেকেই তাঁর শিল্পকলার প্রতি ভালোবাসা ও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে দাঁড়ায়। পিতার সৃজনশীল পরিবেশ ও শিল্প-সংস্কৃতিময় পারিবারিক আবহে বেড়ে ওঠা ইমির জীবনের প্রথম থেকেই নান্দনিকতা ও শিল্পের প্রতি আগ্রহ তৈরি করে।
তিনি আলাতুন্নেসা স্কুল, বাড্ডা, ঢাকা থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন এবং ভিকারুন্নেসা নূন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। পরবর্তীতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষাজীবনে তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
মডেলিংয়ে যাত্রা ও উত্থান
ইমির মডেলিং ক্যারিয়ারের সূচনা ২০০১ সালে, যখন বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল-এর অনুপ্রেরণায় তিনি ‘ডিএইচএল ফ্যাশন’ শোতে অংশগ্রহণ করেন। এটাই ছিল তাঁর প্রথম র্যাম্প অভিষেক, যা তাকে ফ্যাশন দুনিয়ায় প্রবেশের দরজা খুলে দেয়।
২০০২ সালে তিনি জনপ্রিয় মডেলিং প্রতিযোগিতা ‘ইউ গট দ্য লুক’-এ অংশগ্রহণ করেন এবং এখান থেকেই তিনি দেশীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। এরপর তিনি দেশ-বিদেশের অসংখ্য র্যাম্প শো, ফ্যাশন উইক, ওয়েডিং শো এবং কর্পোরেট ইভেন্টে অংশগ্রহণ করেন।
তিনি শুধু র্যাম্প মডেল হিসেবে নন, বরং টেলিভিশন বিজ্ঞাপনচিত্র, বিলবোর্ড মডেলিং এবং বিভিন্ন বিনোদন পত্রিকার কাভার মডেল হিসেবেও পরিচিতি পান। ২০১১ সালে তিনি ‘বেস্ট মডেল অব ডিএফডব্লিউ’ পুরস্কার লাভ করেন, যা তার পেশাগত জীবনে একটি বড় অর্জন হিসেবে বিবেচিত।

উপস্থাপনা ও বিচারক হিসেবে অবদান
মডেলিংয়ের পাশাপাশি ইমি উপস্থাপক হিসেবেও নিজের দক্ষতার পরিচয় দেন। তাঁর সাবলীল কথাবার্তা, আত্মবিশ্বাসী উপস্থাপনা এবং দর্শক-সংযোগের ক্ষমতা তাকে টেলিভিশন শো-এর জনপ্রিয় মুখে পরিণত করে।
এছাড়াও, তিনি বিভিন্ন সুন্দরী প্রতিযোগিতা ও মডেলিং কনটেস্টে বিচারক হিসেবে কাজ করেছেন। বিচারকের আসনে বসে নতুন প্রতিভা খুঁজে বের করার পাশাপাশি তাদের পেশাগত উন্নতির জন্য পরামর্শ প্রদান করেন, যা তার অভিজ্ঞতা ও পেশাগত মর্যাদার প্রতিফলন।
অভিনয় জগতে পদার্পণ ও সাফল্য
মডেলিং ও উপস্থাপনার পাশাপাশি ইমি অভিনয় জগতেও নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তার অভিনয় জীবন শুরুর বড় পদক্ষেপ ছিল শবনম ফেরদৌসী পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘আজব কারখানা’, যেখানে তাঁর সহ-অভিনেতা ছিলেন কলকাতার জনপ্রিয় নায়ক পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়।
চলচ্চিত্রটি ২০২৪ সালের ১২ জুলাই দেশের পাঁচটি মাল্টিপ্লেক্সে একযোগে মুক্তি পায়। মুক্তির পর এটি প্রশংসা কুড়ায় এবং বিশ্বের ১৫টি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। এর মধ্যে দুটি উৎসবে চলচ্চিত্রটি পুরস্কার জিতেছে, যা ইমির অভিনয় জীবনে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দেয়।
ব্যক্তিগত জীবন
২০১৭ সালের ১ ডিসেম্বর ইমি মডেল রিফাত আবদুল্লাহ আজমি-কে বিয়ে করেন। ঢাকার বেইলি রোডের একটি অভিজাত রেস্তোরাঁয় অনুষ্ঠিত এ অনুষ্ঠানে পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব উপস্থিত ছিলেন।
পিতার মৃত্যু
২০২১ সালের ৮ আগস্ট, ইমির পিতা এ কে এম জসীমউদ্দিন বার্ধক্যজনিত কারণে পটুয়াখালীতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পিতার মৃত্যুতে তিনি সামাজিক মাধ্যমে গভীর শোক প্রকাশ করেন এবং সবার কাছে তার বাবার আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা চান।
বিতর্ক ও সমালোচনা
যদিও তার ক্যারিয়ার উজ্জ্বল ও সফল, তবুও ইমি কিছু বিতর্কের মুখোমুখি হয়েছেন। তার কিছু উচ্ছৃঙ্খল আচরণ ও ব্যক্তিগত জীবনের কিছু ঘটনা সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এসব সমালোচনা কিছুটা হলেও তার পেশাগত জীবনে প্রভাব ফেলেছে, তবে তিনি দৃঢ়ভাবে এগিয়ে চলেছেন এবং নিজেকে উন্নত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
শাবনাজ সাদিয়া ইমি শুধুমাত্র একজন মডেল বা অভিনেত্রী নন, তিনি বাংলাদেশের বিনোদন জগতের এক অনুপ্রেরণামূলক ব্যক্তিত্ব। র্যাম্প, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে তার যাত্রা প্রমাণ করে যে, প্রতিভা, অধ্যবসায় ও আত্মবিশ্বাস থাকলে আন্তর্জাতিক মানের স্বীকৃতি অর্জন সম্ভব। তিনি নতুন প্রজন্মের জন্য এক অনুকরণীয় উদাহরণ।
আরও দেখুনঃ
এলবাম: