সত্তরের দশক: নাট্য আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্ব ও গতিধারা

সত্তরের দশক: নাট্য আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্ব ও গতিধারা। সত্তর দশক ছিলো বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের প্রথম পর্ব। আশির দশকের পূর্ব পর্যন্ত সময়কালটা ছিলো আন্দোলন গড়ে উঠবার একটা প্রক্রিয়া মাত্র। সে বিচারে বাহাত্তর থেকে আশি সাল পর্যন্ত সময়কালকে আমরা ধরে নিতে পারি নাট্য আন্দোলনের প্রাক পর্ব বা প্রস্তুতি পর্ব হিসাবে। গবেষণার এই অধ্যায়ে আমরা বাংলাদেশের সত্তর দশকের নাট্যচর্চা বা নাট্য আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি ও চরিত্রটি বুঝতে চেষ্টা করবো বিশেষ একটি কারণে। বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত এই সময়কালে যাঁরা নাটকের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ছিলেন, পরবর্তীকালে এঁদেরই একটি অংশ নাট্য আন্দোলনের নেতৃত্বে চলে আসেন।

 

সত্তরের দশক: নাট্য আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্ব ও গতিধারা [ পর্ব ১ ]

সত্তরের দশক: নাট্য আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্ব ও গতিধারা [ পর্ব ১ ]

 

নাট্যদল হিসাবে সে সময়ের দলগুলিরই কয়েকটি পরবর্তীতে প্রধান সারির দলে পরিণত হয়। শুধু তাই নয়, সেই দলগুলিই দীর্ঘ সময় পর্যন্ত নাট্য আন্দোলনে ব্যাপক প্রভাবও বিস্তার করে। যদিও প্রথম দিকের বহু ব্যক্তি পরবর্তী সময় নাটকের সাথে আর জড়িত থাকেননি, কিংবা প্রথম দিকের বেশ কয়েকটি দলও আর শেষ পর্যন্ত টিকে ছিলো না-তারপরও এটা সত্য যে, পরবর্তী নাট্য আন্দোলনে যেসব দলগুলো সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে, যাদের প্রযোজনা সবচেয়ে বেশি প্রশংসা পেয়েছে, সেইসব নাট্যদলগুলো হচ্ছে তিয়াত্তর সালের আগে যেগুলোর জন্ম।

নাট্য আন্দোলনের প্রধান ব্যক্তিত্বরাও ঐসব দল থেকেই আগত, যাঁরা প্রথম থেকেই নাট্যকর্মের সাথে জড়িত ছিলেন। সেইজন্য এইসব দলের কিংবা দলের ব্যক্তিবর্গের প্রথম দিকের দৃষ্টিভঙ্গিটি কী ছিলো সেটা জানা খুবই প্রয়োজন নাট্য আন্দোলনের স্বরূপটি প্রথম থেকেই বুঝে নেয়ার জন্য। নাট্য আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য।

কারণ নাট্য আন্দোলনের মূল চরিত্রটি বুঝতে হলে কোন লক্ষ্য নিয়ে এই আন্দোলন শুরু হয়েছিলো সে বিষয়টি পরিষ্কার থাকা দরকার। সেজন্য রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার প্রেক্ষাপট থেকে আমরা প্রধানত বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করবো, শুরুর এই নাট্য প্রচেষ্টাটি কতোটা রাজনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক চিন্তা বহির্ভূত ছিলো। কিংবা কতোটা সমাজের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলো।

প্রস্তুতি পর্ব সম্পর্কে আমাদের যা বলবার আছে তাহলো, স্বাধীনতা পূর্বের প্রযোজনারীতি এ পর্বে খোলনলচে সহ পাল্টে গিয়েছিলো, যদিও এ নাট্য আন্দোলন কোনো পরিকল্পিত উদ্যোগ হিসাবে আমাদের সামনে আসেনি। বৃহত্তর কোনো নাট্য আন্দোলন গড়ে তুলবার চিন্তাও এর পেছনে ছিলো না। নিছকই কিছু তরুণের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগ ছিলো তা। বিভিন্ন লেখালেখিতেও আমরা এ ব্যাপারটি দেখতে পাই। সত্তর দশকে আমরা দেখতে পাই, নাটক রাজধানীতে নতুন প্রাণের স্ফুরণ ঘটায়, পুরানো নাট্যচিন্তার জায়গায় নতুন এক নাট্যচিন্তাকে দর্শকদের সামনে হাজির করে। সাধারণভাবে বলা যায়, স্বাধীনতা পরবর্তী নতুন ভঙ্গির প্রযোজনাগুলো নাট্য প্রয়োগের মধ্যে একটা গতি এনে দিয়েছিলো।

স্বাধীনতা পরবর্তী নাটকে বারবার যবনিকা ফেলবার রেওয়াজ উঠে গিয়েছিলো। নাটকের দৃশ্য পরিবর্তনের জন্য দর্শকদের আগের মতো ক্লান্তিকরভাবে বসে থাকতে হতো না। নাট্য প্রযোজনার এই গতিময়তা স্বাধীনতা পরবর্তী সফলতার একটি প্রধান দিক। বিশেষ করে আলোর প্রক্ষেপণ, মঞ্চসজ্জা ও আবহ সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই নতুন নাট্যধারা বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত করেছিলো পূর্বের নাট্যরীতির তুলনায়। যা নাট্য প্রযোজনাকে বহু ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায় এবং দর্শক চিত্তকে জয় করে।

থিয়েটারের ইতিহাসই হলো থিয়েটার প্রযোজনার ইতিহাস। বিষয়বস্তুর পাশাপাশি থিয়েটারি সত্যটাই সেখানে প্রধান। থিয়েটারকে সবসময় সেই ভঙ্গি আয়ত্ত করতে হয়েছে যা হবে সময়োপযোগী। থিয়েটারকে সেজন্য বারবার পুরানো ভঙ্গি ছেড়ে নতুন ভঙ্গির আশ্রয় নিতে হয়েছে। থিয়েটারের ইতিহাসে প্রতি যুগে সেজন্য থিয়েটারের ভঙ্গি পাল্টেছে।’

পশ্চিমবঙ্গের নবান্ন হঠাৎ বিশাল দর্শকের মন জয় করেছিলো বিষয়বস্তুর জন্য ততোটা নয়, যতোটা নতুন প্রযোজনা ভঙ্গির জন্য। পুরানো নাট্যভঙ্গি যখন ক্লিশে হয়ে আসছিলো নবান্ন প্রযোজনার মধ্য দিয়ে নতুন নাট্যরীতির সাথে পরিচিত হলো দর্শক। নতুন দর্শকের নতুন নতুন চাহিদাই থিয়েটারের অগ্রগতির মূল কথা। ব্রেস্ট তাঁর নাটকে শুধু নতুন বিষয়বস্তু নয়, নতুন নাট্যভঙ্গিও নিয়ে এসেছিলেন এবং সে জন্যই তিনি দর্শক চিত্ত জয় করতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী নাট্যচর্চায় তাই ঘটেছিলো, নাট্য প্রযোজনার নতুন এক ভঙ্গির সাথে মানুষ পরিচিত হলো। আর এই নতুন ভঙ্গিই দর্শকদের মধ্যে সাড়া ফেললো।

সত্তরের দশক: নাট্য আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্ব ও গতিধারা [ পর্ব ১ ]

 

স্বাধীনতা পূর্বের নাট্যচর্চার তুলনায় চুয়াত্তর সালে ঢাকার নাট্যচর্চা প্রবল গতি লাভ করেছিলো। প্রথম দিকে বিনোদনের একটা নতুন মাধ্যম হিসাবে নাটককে শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা সাদরেই গ্রহণ করেছিলো। নাটক দেখাটা তাদের একটা নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো। এমন দিনও গেছে যে, রবিবার সকালে ঢাকাতে তিন জায়গায় নাটক হয়েছে এবং খবরের কাগজে পাশাপাশি তিনটি নাটকের বিজ্ঞাপন ছিলো। বাংলাদেশ মহিলা সমিতির মিলনায়তনকে কেন্দ্র করেই মূলত এই নিয়মিত নাট্যচর্চা দানা বেঁধে উঠেছিলো। নাটক নিয়ে যেমন ব্যাপক হৈ চৈ, তেমনি নানা বিরূপ বা সমালোচনামূলক মন্তব্যও লক্ষ্য করা গেছে।

রামেন্দু মজুমদার এ সময়ের নাটক সম্পর্কে লিখছেন ‘নাটক নিয়ে সম্প্রতি এতো হৈ-চৈ কেন হলো? তার আসল কারণ আমাদের দেশে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক তৎপরতা দৃষ্টিগোচর হয় না। এমন একটা পরিবেশে নিয়মিত নাটক, সুপরিবেশিত ও সমাজ সচেতন নাটক সহজেই দর্শক চিত্তকে নাড়া দিতে পেরেছিল।

স্বাধীনতার পরপর ঢাকা ও চট্টগ্রামে আমরা দেখতে পাই, হঠাৎ প্রচুর নাটক লেখা হয়। যেমন নাটকে আগ্রহী নতুনরা নাটক লিখতে আরম্ভ করেন, তেমনি পুরানো অনেক লেখক-সাহিত্যিকরাও হঠাৎ নাটক লেখার ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। হঠাৎ করে এতোবেশি নাটক লেখা হতে আরম্ভ করে এবং এতোবেশি নাট্যকারের দেখা মিলতে শুরু করে যে, এই প্রাচুর্য দেখে নাট্যকার নুরুল করিম নাসিম লিখেছিলেন, ‘আমাদের এখানে এক সময় সাহিত্য জগতে কবিতার চেয়ে কবির সংখ্যা দ্রুত বেড়ে গিয়েছিল। তখন অকবিদের ভিড়ে আসল কবিকে চিনে নিতে কষ্ট হতো। এখন যেন সেই রকম একটা সময় এসে গেছে। অনাট্যকারদের ভীড়ে আসল নাট্যকার চিনে নিতে ভুল হয়।”

সাতাত্তর সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী আয়োজিত জাতীয় নাট্যোৎসবের নাটকগুলো দেখে জনৈক লেখেন যে, বাংলাদেশে নাটকের নামে কতরকম পাগলামি চলছে তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া গেছে। এ্যাবস্ট্রাক্ট, এ্যাবসার্ড, সামাজিক, নৈতিক, ঐতিহাসিক এবং জগাখিচুড়ি-এমনি নানা ধরনের নাটক দেখে একটা ধারণা করা গেছে-বাংলাদেশের নাটক মোটামুটি হাঁটতে শিখেছে, কিন্তু চোখ ফোটেনি। অন্ধের মতো চলছে, সেক্কর খাচ্ছে, মাথা ফাটাচ্ছে। তিনি আরো লিখছেন, রেভ্যুলিউশন ও খৃষ্টাব্দ সন্ধান এবং এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা নিয়ে বাহাত্তরে এক ধরনের নাটক ‘বদর বদর’ বলে দাঁড় ফেললো ঠিকই তবে সে সময় নাট্যচক্রের উদ্ধত তরুণেরা জানতো না, কোথায় তারা যেতে চায়। বর্তমানের পরস্পর অলিখিত প্রতিযোগী নাটুকে দলগুলোও জানে না কোথায় তারা যাবে।

তবু যে যতো জোরে পারছে হাঁক মারছে, ‘বদর বদর’। বাহাত্তর থেকে এ পর্যন্ত অনেক নাটুকে দল দেখা গেছে, ‘আন্দোলন’ ‘আন্দোলন’ বলে নানারকম কসরতে বাজার গরম করার আপ্রাণ চেষ্টাও লক্ষ্য করা গেছে। নাট্যচর্চার তাতে উন্নতি না হলেও মহিলা সমিতির মিলনায়তনের ফটকে ‘মিলনায়তনপূর্ণ ফলকের গৌরবে ‘ল্যাজ’ ফুলেছে সবার। জনৈকের মন্তব্য থেকে এটা উপলব্ধি করা যায়, মধ্যবিত্তের জায়গা থেকে এ সবই হলো মধ্যবিত্তের সফলতার আনন্দ প্রকাশ। মধ্যবিত্তের কর্মকাণ্ডকে বড় করে দেখা। বিশাল জনগোষ্ঠীর সাথে যার কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়নি।

মধ্যবিত্ত নাট্যকর্মীরা তবুও নিজের কর্মে নিজেই সন্তুষ্ট ছিলো। শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের যে অঙ্গীকার সেদিনের জনগণের মধ্যে ছিলো তা থেকে কোনোভাবেই মুক্ত ছিলেন না নাট্যকর্মীরা। পাশাপাশি এ কথাও সত্য, সত্যিকার অর্থে শোষণমুক্তির রাজনীতি কী সে সম্পর্কেও সচেতন ছিলেন না তাঁরা। বিভিন্ন নাটকের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণের পর আমরা বলতে পারি, নাট্য আরম্ভের শুরুতে রাষ্ট্র ও সমাজ বিরোধিতা থাকলেও সেটা কোনোভাবেই রাজনৈতিক নাট্যচিন্তা হয়ে উঠতে পারেনি।

বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর নাট্য আন্দোলনের এই প্রারম্ভটা যথেষ্ট উচ্চগ্রামে শুরু হলেও, যথেষ্ট সাড়া ফেললেও এর ব্যাপকতা ঢাকার বাইরে তেমন ছিলো না। সে সময়কার একজন নাট্যকার নিরঞ্জন অধিকারী লিখছেন, সম্প্রতি ঢাকা কেন্দ্রিক কিছু নাট্য প্রতিষ্ঠান বেশ আলোড়ন তুলেছে। নাট্যান্দোলন গড়ে তোলার শ্লোগান দিচ্ছে। কিন্তু এই আলোড়ন কি • ঢাকার বাইরে তেমন সাড়া জাগিয়েছে? শুধু ঢাকা নিয়ে বাংলাদেশ নয়। তার বাইরেও রয়েছে প্রচুর কলাকুশলী, অভিনেতা ও দর্শক। তিনি আরো লিখছেন, গণ-নাটক গণ- জীবনে কোনো আবেদন, কোনো আগ্রহের সৃষ্টি করেনি এখনও।”

স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের মঞ্চ নাটকের বা নাট্য আন্দোলনের চরিত্র বোঝার জন্য স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশের নাটক আসলে কোন্ পথ ধরে আগাচ্ছিলো সেটাই এখানে প্রথম পর্যালোচিত হওয়া দরকার। স্বাধীনতার পর নানারকম রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘাত-প্রতিঘাতের কারণে বাংলাদেশের নতুন নাট্যধারায় নতুন এক মতবাদের আবির্ভাব আসন্ন হয়ে ওঠে।

এই মতবাদের প্রবক্তরা ছিলেন রাজনৈতিক দল বহির্ভূত, সমাজ বিশৃঙ্খলায় বিক্ষুব্ধ, নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করবার তাড়নায় উদগ্রীব একদল তরুণ। যাঁরা মঞ্চের পূর্বেকার সমস্ত রীতিনীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন, নতুন নাট্যধারা নির্মাণের কথা বলেন, নতুন বিষয়বস্তুকে ঘিরে নাটককে জনতার বিষয় করে তুলতে চান। যাঁদের লক্ষ্য ছিলো নতুনভাবে কিছু করা। পুরাতন নাটক নয়, পুরনো ঐতিহ্য খোঁজার চেষ্টা নয়। নিজেরাই তাঁরা নাটক লিখেছেন, নিজেরাই তা মঞ্চস্থ করেছেন কিন্তু নিজেদের মতবাদ বা চিন্তা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা ছাড়াই। সেই পথ ধরেই জন্ম নিয়েছিলো গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন।

স্বাধীনতার পরপরই গণমানুষের পক্ষে কথা বলার প্রবণতা গ্রুপ থিয়েটারগুলোর মাঝে দেখা গিয়েছিলো তবে সামাজিক বিশ্লেষণ বাদ দিয়ে। রাজনৈতিক চিন্তাকে বাদ দিয়ে, রাজনীতি থেকে যোজন যোজন দূরে দাঁড়িয়ে থেকে নাটককে জনতার বিষয় করে তুলতে চাওয়া হয়েছিলো। নতুন এই নাট্যধারার প্রবক্তারা সকলেই ছিলেন মধ্যবিত্তশ্রেণী থেকে আগত। মার্কসবাদীদের মতে মধ্যবিত্ত মানেই পাতিবুর্জোয়ার অংশ। পাতিবুর্জোয়া চিন্তার মধ্যে থাকে ভাববাদী ঝোঁক, যার ফলে নানা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। পাতিবুর্জোয়ার মানসিকতায় ভাববাদী চিন্তার প্রভাব যে কতোরকম নতুন নতুন চেহারা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে স্বাধীনতা পরবর্তী নাট্যচর্চার মধ্যে, মধ্যবিত্তের দোদুল্যমানতা নানাভাবে ধরা দেয়।

সামাজিক অঙ্গীকারের প্রশ্নে লক্ষ্যহীনভাবেই আসলে বাংলাদেশের নাট্যচর্চা শুরু হয়েছিলো। সামাজিক অঙ্গীকার একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাপার। এর সঙ্গে শুধু নাটক জড়িত নয়, নাট্যকর্মী, নাট্যসংগঠন, তার দিকনির্দেশনা সবই এর সঙ্গে সম্পর্কিত। সামাজিক অঙ্গীকারবদ্ধ নাটক মানে হচ্ছে এমন নাটক যা সামাজিক দ্বন্দ্বগুলোকে তুলে আনে এবং জনগণকে স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে ভাবতে শেখায়। বাংলাদেশের নাট্যকর্মীদের মধ্যে শুরুতে এধরনের কোনো অঙ্গীকার ছিলো না।

পশ্চিমবঙ্গের নাট্য আন্দোলনের সাফল্যই তাঁদেরকে এ পথে নিয়ে আসে যা আমরা পূর্ব অধ্যায়ে দেখেছি। পঁচাত্তর সালের পূর্বে যাঁরা বাংলাদেশের নাট্যচর্চা শুরু করেছিলেন তাঁদের সম্পর্কে শাহরিয়ার কবির লিখেছেন, ‘শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমে চমক সৃষ্টি করার অবকাশ তখন খুব কমই ছিল। কারণ বিভিন্ন মাধ্যমে আগে থেকে অনেকে এমন জাঁকিয়ে বসেছিলেন যে সদ্য অভিজ্ঞ এই তরুণরা সেখানে কিছু করার সুযোগ পাননি। তাই তাঁরা নাটক নিয়ে মেতে উঠলেন। সেখানে সামাজিক প্রশ্ন যে একেবারে আসেনি তা নয়। প্রবলভাবেই অনেক সময় নাটকে সামাজিক প্রশ্ন ধরা পড়েছে তবে তার পেছনে কোনো সমাজবিজ্ঞানের চেতনা ছিলো না। একটি রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলন গড়ে তুলবে তেমনি চিন্তাও নাট্যকর্মীদের মধ্যে দেখা যায়নি।

সত্তর দশকের নাটকে শ্রেণীর প্রশ্নটি তো ছিলোই না, দলগুলোর রাজনীতি প্রচারেও ছিলো আপত্তি। থিয়েটার পত্রিকায় চুয়াত্তর সালে নাটক সম্পর্কে পাঁচটি দলের মতামত গ্রহণ করা হয়েছিলো। সেখানে ‘কোন ধরনের নাটক প্রযোজনায় তাদের আগ্রহ বেশি এবং কেন?’-এই প্রশ্নের জবাবে ঢাকার নাগরিক, থিয়েটার, ঢাকা থিয়েটার, বহুবচন এবং চট্টগ্রামের থিয়েটার’৭৩ যে বক্তব্য দিয়েছিলো সেগুলো আমরা এখানে বিচার বিশ্লেষণ করে দেখবো। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের বক্তব্য ছিলো, ‘নাটক প্রযোজনায় আমরা বিচিত্রতায় বিশ্বাসী। যে কোন ভাষাতে অথবা যে কোন নাট্যকারের রচনা হোক না কেন-ভাল নাটক দেশ-কালের ঊর্ধ্বে নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখায় আবদ্ধ নয়।

বিশেষ কোন মতবাদ বা দর্শনে আমরা বিশ্বাসী নই বলে বিশেষ-ধরনের নাটকে আমাদের আগ্রহ শূন্য। আমাদের লক্ষ্য-দেশি বা বিদেশি ভালো নাটক।’১০ নাগরিক আরো বলছে, নাটক মঞ্চায়নে তারা লক্ষ্য রাখে দর্শকরা যেন কেবল আনন্দই লাভ না করেন, নাটক যেন তাঁদের চিন্তার খোরাক জোগায় এবং সংস্কারবদ্ধ ও সীমিত রুচির উন্নতি ঘটায়। সেই সাথে নাগরিক দাবি করছে, ‘আমরা সচেষ্ট থাকি-যেন আমাদের নাটক হয় জীবন থেকে অবিচ্ছিন্ন, অবশ্য সে জীবনের স্বরূপ ও ব্যাখ্যা আমাদের নিজেদের, অন্যের ধারণা বা ব্যাখ্যার সঙ্গে তা নাও মিলতে পারে।’

নাগরিকের বক্তব্যে নাটক মঞ্চায়নে কোনো দায়-দায়িত্বের কথা তারা স্বীকার করছে না। রাজনৈতিক নাট্যদলগুলোর মতো বিশেষ কোনো শ্রেণী বা শ্রমিকশ্রেণীর জন্যও তারা নাটক করে না। নাগরিকের নাটক মঞ্চায়ন শ্রেণীনিরপেক্ষ। নাগরিক বলছে জীবন সম্পর্কে তাদের ধারণা অন্যের সঙ্গে নাও মিলতে পারে, তবে সে বিষয়ে তারা আর কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি।

নাগরিক খুব স্বচ্ছ ভাষায় নিজেদের শ্রেণীস্বার্থের কথা ঘোষণা করেছে কারো প্রতি দায়-দায়িত্বকে অস্বীকার করে।” নাগরিক আর এক প্রশ্নের জবাবে বলছে, তাদের নাটকের দর্শক প্রধানত মধ্যবিত্ত ও কিছু সংখ্যক উচ্চবিত্ত। রাজনৈতিক নাট্যকার ব্রেন্টের নাটক ঢাকায় প্রথম মঞ্চস্থ করার কৃতিত্ব নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের। ব্রেস্টের গুড উওম্যান অব সেৎজুয়ান ও হের পুন্টিলা এণ্ড হিজ ম্যান মাট্টি নাটক দুটির রূপান্তর সৎ মানুষের গোঁজে ও দেওয়ান গাজীর কিসসা নাগরিক সত্তর দশকেই মঞ্চস্থ করে। মঞ্চায়িত তাদের নাটক দুটির প্রযোজনা সম্পর্কে সমালোচনা

ছিলো, ব্রেশটের নাটকের রাজনীতি বাদ দিয়ে শুধু গল্পের কাঠামো ও হাসি তামাশাগুলোই দর্শকদের মনোরঞ্জনে তারা ব্যবহার করেছিলো। রাজনৈতিক নাট্যচিন্তায় যেমন তাদের বিশ্বাস ছিলো না, তেমনি কোন্ ধরনের নাট্য আদর্শে তাদের বিশ্বাস সেটা বোঝা তাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
ঢাকা থিয়েটার-এর বক্তব্য ছিলো, ‘ঢাকা থিয়েটার প্রযোজিত নাটকগুলিই এর ধরন বলে দেবে। আমরা জীবন ঘনিষ্ঠ হবার জন্যে নাটক করি, আমরা নিজস্ব সৃজনশীলতাকে সর্বাগ্রাধিকার দেই। কারণ শুধু নাটক নয়, আমরা যে উদ্দেশ্যে নাটক করছি সে উদ্দেশ্য মাত্র আমাদের লেখকরাই অনুধাবন করতে পারে।’

ঢাকা থিয়েটার আরো বলছে, ঢাকা থিয়েটার নিজস্ব লেখকদের তুঙ্গতম সৃজনশীলতাকে সার্বিক সমর্থন যোগায় এবং পরিচালক, অভিনেতাদের বোধ এবং বুদ্ধিকে নাটকের পর্যায়ে উন্নীত করণের চেষ্টা চালায়। ঢাকা থিয়েটারের বক্তব্য স্ববিরোধী। ঢাকা থিয়েটার একবার বলছে তারা জীবন ঘনিষ্ঠ হবার জন্য নাটক করছে, আবার বলছে তাদের উদ্দেশ্য শুধু লেখকরাই অনুধাবন করতে পারবে। ঢাকা থিয়েটার কার জন্য নাটক করছে নিজেদের কাছেই যেন স্পষ্ট নয়। ঢাকা থিয়েটারের বক্তব্য পড়লে মনে হবে, তাদের লেখকদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্যই যেন তারা নাটক করছে। ঢাকা থিয়েটার সে সময় পর্যন্ত যে চারটি নাটক মঞ্চস্থ করেছিলো, তার ভেতর তিনটিই ছিলো প্রতীকধর্মী।” বিদায় মোনালিসা তো ছিলো খুবই দুর্বোধ্য।

পাশাপাশি ঢাকা থিয়েটারের সংবাদ কার্টুন ছিলো। একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রযোজনা। কিন্তু দুটো-একটা রাজনৈতিক প্রযোজনা দিয়ে কোনো দলের চরিত্র নির্ধারণ করা যায় না। ঢাকা থিয়েটারের লক্ষ্য উদ্দেশ্য থেকে এটা বোঝা যায়, দলটি শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষে বা কোনো রাজনীতি প্রচারের জন্য মূলত নাটক করে না। সে ধরনের নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য নিয়ে তারা মাঠে নামেনি।

যদিও ঢাকা থিয়েটারের প্রধান নাসির উদ্দীন ইউসুফ আবার পরবর্তীকালে নাটককে সমাজ পরিবর্তনের পক্ষে ব্যবহার করার কথা বলেছেন। সমাজ পাল্টাবার জন্য নাটককে গ্রামের মানুষের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের কাছ থেকে নাটককে নব্বইভাগ মানুষের কাছে নিয়ে যাবার জন্য ঢাকা থিয়েটার আশির দশকে গ্রাম থিয়েটার আন্দোলন শুরু করে। ঢাকা থিয়েটারের আশির দশকের গ্রাম থিয়েটার আন্দোলন সত্তরের দশকের বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীত, যা প্রমাণ করে কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে তারা যাত্রা শুরু করেনি।

বহুবচনের বক্তব্য ছিলো, মঞ্চের প্রচলিত ধারণার পরিবর্তন ঘটিয়ে, সেই সাথে আধুনিক বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সাম্প্রতিক নাট্য আন্দোলনের ধারাকে দেশীয় রীতির মিশ্রণে নতুন কোনো রূপ দেয়া যায় কি না সে ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোতেই তাদের উৎসাহ। বহুবচন শুধুমাত্র অভিনয়ের জন্য বা দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য একান্ত অনুগত নাটক করায় বিশ্বাসী নয়। বহুবচন নাট্য আন্দোলনের জন্য মূলত নাটক করছে এবং অভ্যস্ত চৈতন্যের দর্শককে নতুনভাবে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে ভাবনা করার ইন্ধন যোগাতে চায়। বহুবচনের বক্তব্যে নিরীক্ষার ব্যাপারটা খুব জোর পেয়েছে। নতুন জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তারা দর্শককে কী ধারণা দিতে চায় সেটা তাদের বক্তব্যের কোথাও প্রতিফলিত হয়নি।

পাশাপাশি আন্তর্জাতিক নাট্যধারা বলতে দলটি কী বোঝাতে চেয়েছে সেটাও পরিষ্কার নয়। বহুবচন কী ধরনের নাটক পছন্দ করে সেটা বোঝা যাবে ভিন্ন একটি প্রশ্নে বহুবচনের জবাব থেকে। সেখানে দলটি বলছে, বহুবচন নিরীক্ষামূলক নাটক নিয়ে যখন উপস্থিত হয় তখন নাট্যামোদীদের মধ্যে কিছুটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিলো। বিতর্ক উঠেছিলো এধরনের নাটক দর্শক গ্রহণ করতে পারবে না। বহুবচন এ বিতর্কের পক্ষে যেতে পারেনি। কারণ বহুবচন বিশ্বাস করে পরিবেশ গড়ে তুলতে হয়, আপনা আপনি গজিয়ে ওঠে না।” বোঝাই যাচ্ছে তাদের চিন্তা আঙ্গিক সর্বস্ব। বহুবচনের বক্তব্যে এরা বিষয়বস্তুর গুরুত্ব ততোটা দিতে চায় না। বিমূর্ত রীতির প্রতিই তাদের মোহ।

চট্টগ্রামের থিয়েটার’৭৩-এর বক্তব্য ছিলো বহুবচনের বক্তব্যের কাছাকাছি। আধুনিক কলাকৌশল ও আঙ্গিক ছিলো তাদের কাছে প্রধান। পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্বলিত নাটক করতেই তারা বেশি উৎসাহী ছিলো। পরীক্ষা-নিরীক্ষা বলতে তারা কী বোঝায় সে ব্যাপারে কোনো নির্দিষ্ট বক্তব্য ছিলো না। দর্শকদের প্রশ্নে তাদের বক্তব্যটি ছিলো বিভ্রান্তিকর। দর্শক প্রসঙ্গে তারা বলেছিলো, ‘দর্শনীর বিনিময়ে দর্শক সৃষ্টি করার উদ্যোগ নিয়েছি, অসংখ্য দর্শকদের ভীড়ে হাজির হতে এখনো প্রস্তুত নই।

আমরা কখনও অগণন দর্শক চাইনি। সর্বসাধারণকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বার্ষিক নাটক অনুষ্ঠান আমাদের উদ্দেশ্য নয়।” থিয়েটার’৭৩ নাটক যেন নিজেদের জন্যই করছে, দর্শকদের জন্য নয়। দর্শক সম্পর্কে তাঁদের বক্তব্যে এ ধরনের উন্নাসিকতা লক্ষ্য করা যায়। পূর্ব অধ্যায়ে আমরা দেখেছি বাংলাদেশের মঞ্চ নাটক ব্যাপক দর্শকের কাছে পৌছুতে পারেনি। থিয়েটার’৭৩-এর চিন্তায় দেখা যায় ব্যাপক দর্শকের কাছে তারা পৌছাতেও চায়নি।

থিয়েটার-এর বক্তব্য ছিলো, ‘যে ধরনের নাটকে সমসাময়িক জীবন আছে, জীবনের আধুনিক বিশ্লেষণ আছে কিন্তু মধ্যযুগীয় দার্শনিক তত্ত্বের উৎপাত নেই, আমরা সে ধরনের নাটক প্রযোজনায় আগ্রহী। কেননা আমরা বিশ্বাস করি আমাদের চারপাশের আবহ সব সময়ই নাটকীয় উপাদানে সমৃদ্ধ এবং এদের বাদ দিয়ে যত্রতত্র নাটকের অনুসন্ধান করা অযথা সময় ও শক্তির অপচয়।”

থিয়েটারের বক্তব্য বেশ জোরালো যদিও মধ্যযুগীয় দার্শনিক তত্ত্বের উৎপাত বা জীবনের আধুনিক বিশ্লেষণ বলতে দলটি কী বোঝাতে চেয়েছে সেটা বোঝা দুরূহ। কোন্টাকে আমরা জীবনের আধুনিক বিশ্লেষণ বলবো, কোন দর্শন দ্বারা সেটা বিশ্লেষিত হবে সে ব্যাপারে থিয়েটার কোনো বক্তব্য দেয়নি। থিয়েটার শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষে নাটক করার কথাও বলেনি, শুধু সমাজ ও জীবনের বিশ্লেষণের কথা বলেছে। সমাজসচেতন নাটক করার কথা বললেও শ্রেণীসচেতন নাটক করার কথা তারা বলেনি। কারণ তারা কার জন্য বা কোন্ শ্রেণীর পক্ষে নাটক করবে সে ব্যাপারে ছিলো নীরব। থিয়েটারের প্রযোজনার একটি বিশেষ দিক ছিলো এই যে, তারা কোনো দুর্বোধ্য নাটক করেনি। থিয়েটার তার নাটকের বক্তব্য সবসময়ই দর্শকের কাছে ভালোভাবে পৌছে দিতে পেরেছে।

বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, দলগুলোর কারো বক্তব্যের মধ্যেই শ্রেণীসংগ্রাম কিংবা সমাজ পরিবর্তনের ব্যাপারাটা আসেনি বা কার জন্য তারা নাটক করছে সে কথাও বলা হয়নি। রাজনৈতিক নাট্যচিন্তা থেকে তারা অনেক দূরে ছিলো। সমাজের প্রতি নাট্য দলগুলোর যে কোনো ভূমিকা থাকতে পারে সে ব্যাপারে তাদের কোনো জোরালো বক্তব্য ছিলো না। কেউ কেউ সচেতনতার পরিচয় দিলেও মোটেই সেটা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়। থিয়েটার-এর সে সংখ্যায় দলগুলোকে আরো যেসব প্রশ্ন করা হয়েছিলো, সেসব প্রশ্নের উত্তর পাঠ করবার পর কোনো একটি দলও যে তাদের মধ্যে নাটককে রাজনৈতিক হাতিয়ার বলে মনে করতো তেমন মনে হয় না।

নাগরিকের মূল শ্লোগান ছিলো, দর্শনীর বিনিময়ে নাটক দেখার অভ্যাস করুন। আওয়াজ তুলুন সাধারণ রঙ্গমঞ্চের। ঢাকা থিয়েটার শ্লোগান তুলেছিলো, নাটকের মাধ্যমে আমরা সৎ সমাজের বক্তব্য রাখবো, বাংলাদেশের লেখা নাটক করবো। থিয়েটারের শ্লোগান ছিলো, ভালো নাটক প্রযোজনা করা, নাট্যপত্রিকা প্রকাশ করা, নিয়মিত নাটক করা।

থিয়েটার’৭৩-এর শ্লোগান ছিলো, সমঝদার দর্শক গড়ে তুলবো উপযুক্ত দর্শনীর মাধ্যমে। বহুবচনের শ্লোগান ছিলো, আমাদের নাটক মানে নাটকীয়তা নয়, নাটকের চিরাচরিত আঙ্গিকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। উল্লিখিত নাট্যদলগুলোর বাইরেও নাট্যচক্রের শ্লোগান ছিলো, নাটকের মাধ্যমে নতুন প্রতিভার বিকাশের পথ করে দিতে হবে। চট্টগ্রামের অরিন্দমের বক্তব্য ছিলো, নাটক আমাদের শিল্প, শিল্পই আমাদের ঈশ্বর।

যাদের নিয়ে আমরা আলোচনা করলাম সেসব নাট্যদল আজও টিকে আছে এবং তাদের মধ্যে বহুবচন ছাড়া বাকি দলগুলো ঢাকা ও চট্টগ্রামের প্রথম সারির নাট্য দলগুলোর মধ্যেই রয়েছে। সেক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন জাগে নাট্যচর্চা শুরুর পেছনে তাহলে তাদের মূল সামাজিক অঙ্গীকারটি কী ছিলো? নাটক তারা কার জন্য, কেন মঞ্চস্থ করতে চেয়েছিলো? মতাদর্শগত কোনো সংগ্রামের প্রশ্ন সেখানে ছিলো কি না? দলগুলোর বক্তব্য ও নাট্য প্রযোজনা প্রমাণ করে এই নাট্য আন্দোলন ছিলো একটি তাৎক্ষণিক উত্তেজনা, কোনো সুসংগঠিত আন্দোলন নয়। পঁচাত্তর সালের একটি সেমিনারে পঠিত আলী যাকের-এর প্রবন্ধে এর সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়।

তিনি বাংলাদেশের বা ঢাকার নাট্য আন্দোলনকে একটি আকস্মিক ঘটনা বলে মনে করেন। তিনি আরো বলেন যে, কোনোরকম অনুশীলন ছাড়াই প্রায় প্রস্তুতিহীন, নবিশ কুশীলবরাই প্রধানত ঢাকার নাট্য আন্দোলনের কর্মী।” মন্তব্যগুলো যথার্থই ছিলো। নাটক দিয়ে সমাজ পরিবর্তন করা কিংবা জনগণের রাজনৈতিক প্রয়োজনে নাটককে ব্যবহার করা, কারো চিন্তার মধ্যেই তখন ছিলো না। দু-চারটি নাটকের কথা বাদ দিলে পঁচাত্তর সাল পর্যন্ত নাটক ছিলো বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে মূলত বিভ্রান্তিকর ও বৃত্তাবদ্ধ।

নাট্যদল এবং নাট্য ব্যক্তিত্বদের কথাবার্তার মধ্যে নানাসময় নানারকম অসামঞ্জস্য লক্ষ্য করা গেছে। দলগুলো নাটক মঞ্চায়নের লক্ষ্য সম্পর্কে যা বলেছে, দেখা গেছে দলের প্রধানরা বিভিন্ন লেখনীতে ঠিক তার ভিন্ন বক্তব্য রাখছে। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় নাটককে রাজনীতির পক্ষে ব্যবহার করার কথা কখনও বলেনি কিন্তু দলের প্রধান ব্যক্তিরা বিভিন্ন সভায় নাটককে রাজনীতির পক্ষে বা সমাজ পরিবর্তনের পক্ষে ব্যবহারের কথাও বলেছেন এবং উদ্দেশ্যহীন নাটক প্রযোজনা করাকে মনে করেছেন অসঙ্গত।

নাগরিকের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান এবং গুরুত্বপূর্ণ সদস্য আলী যাকের বিভিন্ন লেখালেখিতে রাজনৈতিক নাটকের প্রয়োজনীতার কথা বারবার স্বীকার করেছেন। যেমন আতাউর রহমান থিয়েটার পত্রিকায় এক প্রবন্ধে লিখছেন, রাজনৈতিক চেতনা ছাড়া প্রকৃত সমাজ চেতনা তৈরি হতে পারে না।২২ তিনি আরো লিখছেন, কোনো শিল্পকর্মই মূলগতভাবে জীবনবিচ্ছিন্ন তথা জীবনের রাজনীতি- নিরপেক্ষ হতে পারে না। তদর্থে মঞ্চ নাটকের তো প্রশ্নই উঠে না। শিল্পের জন্য শিল্প এ এক অপপ্রচার। সাধারণ মানুষ যখন নাটকের পাত্রপাত্রী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলো নাটক তখন সত্যিকার অর্থে হয়ে উঠলো রাজনৈতিক। ২৩ পাশাপাশি তিনি উল্লেখ করছেন, উইলিয়াম শেক্সপিয়ার শুধু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকারই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বিশ্বের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক নাট্যকার।

 

রাজনৈতিক নাট্যচিন্তা ও স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের মঞ্চনাটক | সূচিপত্র

 

যাকের তার দু-দুটো প্রবন্ধে নাটককে বিভিন্ন দেশে রাজনীতির পক্ষে ব্যবহার করার উদাহরণ দিয়েছেন এবং তার পক্ষে ওকালতি করেছেন। সেখানে তাঁরা নিজেদেরকে রাজনৈতিক নাটকের লোক হিসাবে প্রমাণ করতে চেয়েছেন। নিজেদের দলের ব্যাপারেই শুধু নাটকে রাজনীতি প্রচারে তাঁদের আপত্তি ছিলো। রাজনৈতিক নাটকের পক্ষে-বিপক্ষে তাই এমনভাবে তাঁরা বক্তব্য রেখেছেন যা শুধু বিভ্রান্তিই সৃষ্টি করে। ঢাকা থিয়েটারের নাসির উদ্দীন ইউসুফ যেখানে রাজনীতির প্রশ্নে, সমাজ পরিবর্তনের প্রশ্নে গ্রামের নব্বইভাগ মানুষের কাছে নাটককে নিয়ে যাবার কথা ভাবছেন, নিজের দলের নাট্যভাবনায় তিনি সে কথা বলছেন না।

২৬ ঢাকা থিয়েটার নাটকে রাজনীতি প্রচার করবে কি না সে প্রশ্ন উহ্য রেখে তারা জাতীয় নাট্য ঐতিহ্য নির্মাণের কথা বলছে। থিয়েটারের সভাপতি কবীর চৌধুরী নাটকে রাজনীতি প্রচারের পক্ষে নানান বক্তব্য রেখেছেন অথচ থিয়েটার নাট্যদলও কখনও সুনির্দিষ্ট করে বলেনি নাটকে তারা রাজনীতি প্রচার করতে চায় কি না।

নাট্যদলের বক্তব্যে বা দলের প্রধান প্রধান ব্যক্তিদের বক্তব্যে এধরনের বৈপরীত্য প্রায় সময়ই খুঁজে পাওয়া যাবে। স্থান-কালের সুবিধা অনুযায়ী তাঁরা নানা বিবৃতি দিয়েছেন, কোনো নির্দিষ্ট আদর্শের জন্য লড়াই করেননি। নিজেদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাঁরা ভালো জানতেন না বলেই আমরা ধরে নিতে পারি। নাটকের মধ্য দিয়ে সত্যিকার অর্থে তাঁরা কী করতে চান, নিজেরাই তা সুনির্দিষ্ট করে জানতেন না বলেই নাট্যচর্চার শুরুতে শোষিতশ্রেণীর তাঁরা সাময়িক

মিত্র হিসাবেই দেখা দিয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে তাঁরা বুর্জোয়াদের সাথেই আপোষ করে বসেছিলেন যা পরের অধ্যায়গুলোতে দেখা যাবে। গ্রুপ থিয়েটার বা নবনাট্য আন্দোলনের এই পরস্পর বিরোধী চরিত্রটি আমরা পূর্বেই দেখেছি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমবঙ্গের নাট্য আন্দোলনে।স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের নাট্যকার ও নাট্যকর্মীদের দৃষ্টিভঙ্গি মধ্যবিত্ত মানসিকতা দ্বারাই আচ্ছন্ন ছিলো। বিভিন্ন দলগুলোর কোনো সুনির্দিষ্ট আদর্শ ছিলো না বলেই কোনো বিশেষ আদর্শকে ঘিরে দলগুলোর মধ্যে কোনো ঐক্য গড়ে উঠবার কারণও তৈরি হয়নি। দীর্ঘদিন পর্যন্ত এটা কোনো প্রকৃত নাট্য আন্দোলন হয়েও দেখা দেয়নি। সেজন্যই আনু মুহাম্মদ ছিয়াত্তর সালে লিখছেন, ‘যে ধারার নাটক স্বাধীনতার পর থেকে দেখতে পাচ্ছি সে নাটক মূলত বেশ কটি সৌখিন আগ্রহী নাট্য পাগল তরুণ গোষ্ঠীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফসল। এবং এদের ভিন্ন চরিত্রের নাট্যধারাই নাট্য আন্দোলন বলে অনেকের কাছে স্বীকৃত।’২”

সেখানে নাট্য আন্দোলনের বীজ সুপ্ত থাকলেও তা নাট্য আন্দোলন হয়ে দেখা দিতে পারেনি। শিল্পের জন্য শিল্প নয়, শিল্প হোক জনগণের জন্য কিংবা নাটক হোক সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার কিংবা শ্রেণীসংগ্রামের হাতিয়ার-সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো নাটকের শুরুতে ছিলো না। মঞ্চায়িত নাটকগুলোর সাথে সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাবলীর সম্পর্ক ছিলো খুবই ক্ষীণ। স্বাধীনতার পরপর বাংলাদেশে যে নাটকগুলো মঞ্চস্থ হয় তাতে সামাজিক নানা চিত্র ধরা পড়লেও তৎকালীন রাষ্ট্রের নানা উত্থান-পতনের ঘটনা বা রাজনৈতিক ঘটনাবলীর চিত্র নেই। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নানা চিন্তার যে প্রকাশ ঘটেছিলো, নাটক তার থেকে বহু দূরে ছিলো। সরকার বদলের ঘটনাগুলোও নাটকে স্থান পায়নি।

স্বাধীনতার পর দেশের রাজনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাবো স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ স্বাধীন দেশের ক্ষমতায় আরোহণ করে দেশ চালাতে থাকে। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে এসে বাহাত্তর সালের বারোই জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর শাসনে খুব শীঘ্রই দেশ নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা ও দুর্নীতির আখড়ায় নিপতিত হয় যা পূর্বের অধ্যায়ে আমরা দেখেছি। শেখ মুজিবের এই শাসনকালকে বাহাত্তর সালেই দৈনিক গণকণ্ঠের এক সম্পাদকীয়তে ‘ফ্যাসিবাদের উদ্ভব’ শিরোনামে চিহ্নিত করা হয়।* তিয়াত্তর সালে রেসকোর্সে ন্যাপের জনসভায় মতিয়া চৌধুরী সে সময় শেখ মুজিবের শাসনকাল সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেন, বর্তমান সরকার দেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।

শেখ মুজিব সরকার তখন বিরোধী দলগুলোকে বেশ ধমক- ধামক দিচ্ছিলো। বিরোধী দলগুলোর ওপর চলছিলো নানারকম নিপীড়ন। সেই নিপীড়ন সন্ত্রাস বেড়েই চলছিলো দিনকে দিন। দেশজুড়ে তখন একটা অরাজক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিলো। শেখ মুজিব সদিচ্ছা সত্ত্বেও তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। সরকারের এই ব্যর্থতায় বিরোধীদলগুলো ও সাধারণ জনতা সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপে ওঠে। সরকারও বিরোধীদের প্রতি মারমুখী আচরণ করে।

বিরোধীদলগুলোর সরকারের প্রতি ক্রুদ্ধ হবার নানা কারণ ছিলো। মুক্তিযুদ্ধে তারাও অংশ নিয়েছিলো, স্বাধীনতার জন্য তারাও লড়াই করেছিলো অথচ স্বাধীন দেশের সরকার গঠিত হয়েছিলো শুধুমাত্র আওয়ামী লীগকে নিয়ে। দেশ গঠনে বিরোধীদলের তাই ভূমিকা রাখবার সুযোগ ছিলো না। মতাদর্শগত কারণে আবার আওয়ামী লীগের পক্ষেও সকলকে সরকারে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। বিরোধীদের সাথে সরকারের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়া তাই স্বাভাবিক ছিলো।

সেই দ্বন্দ্ব ক্রমে মহীরুহ হয়। সরকার বিরোধীদলগুলোর সাথে ব্যাপকভাবে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি দলের ভিতরেই স্বার্থ ও মতাদর্শগত কোন্দলের কারণে বিভিন্ন কর্মসূচী সার্থক করে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছিলো। সরকার যতোই ব্যর্থ হচ্ছিলো বিরোধী পক্ষের সমালোচনা ততোই তীব্র হচ্ছিলো। সরকার বিরোধীদলের এই সমালোচনাকে গঠনমূলকভাবে নিতে পারলো না। নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে গিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে বিরোধীদের ওপর। সরকারের সেই চেহারাই ধীরে ধীরে ফ্যাসিস্ট আকার ধারণ করে।

সারাদেশের বিশৃঙ্খল এই অবস্থার মধ্যে ক্ষমতাসীন সরকার এই সময় বারবার দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিতে থাকে। সে সময়কার দৈনিক পত্রিকাগুলোর পাতায় চোখ বুলালেই এই বক্তব্যের স্বীকৃতি মিলবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব সহ বিভিন্ন মন্ত্রীদের বক্তৃতায় সমাজতন্ত্রের পক্ষে যে যুক্তি দেয়া হয়, পত্রিকাগুলোতে নিয়মিত সে সংবাদ বিবৃত হয়েছে।

শেখ মুজিব ঘোষণা দেন, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ার কর্মসূচী নিয়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়েছে আর সাম্রাজ্যবাদী চক্র ও তাদের দালালরা দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করে সমাজতন্ত্রকে বানচাল করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, সকল যড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবেই। সরকারের মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত বলেন, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া শুধু বেতন বৃদ্ধি করে দুঃখ ঘুচবে না। যশোরে রাষ্ট্রপ্রধানের ভাষণে বলা হয়, সমাজতন্ত্র ছাড়া দেশের দারিদ্র্য দূর করা যাবে না। শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী বলেন, একমাত্র সমাজতন্ত্রই দেশের সমৃদ্ধি বিধান করতে পারে।

তিয়াত্তর সালের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘এই বাজেট সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পথে একটি পদক্ষেপ’।সেই সময়কার আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থনৈতিক মূল কর্মসূচীর ঘোষণায় ছিলো সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। শক্তিশালী বিরোধী দল জাসদও এই সময় ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’- এর প্রবর্তক হয়ে ওঠে। জাসদ ছিলো কিছু দিন পূর্বেও সরকারি দল আওয়ামী লীগেরই অংশ, বিশেষ করে ছাত্রলীগের। ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ অথবা ‘সমাজতন্ত্র’-এই মতাদর্শগত প্রশ্নে এবং সরকারের ত্রাস, দমননীতি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ছাত্রলীগের প্রধান এবং বৃহৎ অংশটিই সরকারি দল ছেড়ে জাসদ গঠন করে। সরকারি দল যখন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উচ্চকিত সেই সময় জাসদের শাহজাহান সিরাজ মন্তব্য করেন, মুজিববাদের প্রবক্তাগণ সমাজতন্ত্রের অর্থ বোঝেন না।

শেখ মুজিবের সমাজতন্ত্রের ধারণা তখন ‘মুজিববাদ’ নামে চিহ্নিত। সরকারি দল সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সে সময় ভীষণভাবে দ্বিধাবিভক্ত। সমাজতন্ত্র বলতে মার্কসবাদকেই বোঝায়-এটা ছিলো তাজউদ্দিন আহমদের বক্তব্য। আর শেখ মুজিব বলেন, এদেশে সমাজতন্ত্র কায়েম হবে তবে এ সমাজতন্ত্র গণতন্ত্রের মাধ্যমেই আসবে। গণতন্ত্র থাকবে, সমাজতন্ত্রও থাকবে। শেখ মুজিবের এই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে ছাত্রলীগ বলে, সমাজতন্ত্রের জন্য চাই সামাজিক বিপ্লব।

গণতন্ত্র দিয়ে সমাজতন্ত্র হয় না। একই বক্তব্য রাখেন তাজউদ্দিন আহমেদ শহীদুল্লাহ হল ছাত্র সংসদের অভিষেক অনুষ্ঠানে। তিনি বলেন, সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে পৌছুতে হলে গণতন্ত্রের প্রচলিত ধারণাকে বাদ দিতে হবে। সমাজতন্ত্রের জন্য দরকার বিপ্লবী মানসিকতা।

সরকারি দল সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিলেও মতাদর্শ ও সদিচ্ছার ক্ষেত্রে তাদের বিভ্রান্তি ধরা পড়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। বাহাত্তর সালের এক সংবাদ শিরোনামে দেখা যায়, ভূমিহীন কৃষকরা জমির মালিক হচ্ছে না, আমলাতন্ত্র জোতদার ও ধনী কৃষকরা অদৃশ্য যুক্তফ্রন্ট গড়ে তুলেছে।৩৮ ভিন্ন একটি সংবাদে দেখা যায়, দিনাজপুরের জোতদাররা বর্গাচাষীদের জমি কেড়ে নিচ্ছে। সরকারি দলের ছত্রছায়ায় এসব ঘটছিলো যা ছিলো সমাজতন্ত্রের পরিপন্থী। পরবর্তীকালে বাকশাল নেতা আবদুর রাজ্জাক দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় এক সাক্ষাতকারে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সমাজতন্ত্রে পৌঁছা সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ আওয়ামী লীগে জোতদার ও মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের প্রাধান্য বাড়ছিল। জোতদারদের জন্য ভূমি সংস্কার নীতি সঠিকভাবে এগিয়ে নেয়া যাচ্ছিল না।… তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জোতদার বলে ভূমি সংস্কার বিলে স্বাক্ষর দিচ্ছিলেন না। আওয়ামী লীগের কিছু জোতদার সংসদ সদস্যও এর বিরোধিতা করেছিলেন। ‘

স্বাধীনতার পর বহুজাতিক পুঁজি ছাড়া প্রায় সকল বৃহৎ ও মাঝারি শিল্প, ব্যাংক, বীমা এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়েছিলো। রাষ্ট্রায়ত্ত না করে যদি ব্যক্তিগত খাতে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হতো তবে এগুলি কেনার মতো বিত্তবান এদেশে পাওয়া যেতো না। এই রাষ্ট্রায়ত্ত খাতই এই বিত্তবান তৈরির অন্যতম ক্ষেত্রে পরিণত হলো। দ্রুত সম্পদ অর্জনের পথ ছিলো তখন রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প-কারখানা, ব্যাংক- বীমা থেকে লুটপাট, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যের পারমিট লাইসেন্স জোগাড়, এবং অবৈধ বাণিজ্য-চোরাচালান, কালোবাজারির সাথে সম্পৃক্ত হওয়া। মধ্যবিত্তেরই সুবিধাপ্রাপ্ত একটি অংশের হাতে এভাবে যে পুঁজি জমা হয় তা শিল্পে বিনিয়োগের কোনো পথ পায়নি।

নতুন এই শ্রেণী পুঁজি বিনিয়োগ করার চেয়ে, শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার চেয়ে, ফটকাবাজিতে নিজেদের নিয়োগ করে। মুৎসুদ্দি, আমলাতান্ত্রিক এবং লুম্পেন চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিলো যাদের মধ্যে বর্তমান। ভিন্ন দিকে সরকারের পক্ষ থেকে আইনগতভাবে কলকারখানা রাষ্ট্রীয়করণ করা, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা, কোনো সুস্থ। বুর্জোয়াশ্রেণী গড়ে উঠতে সাহায্য করে না। ভূমি সংস্কার ছাড়া সরকারের সমাজতন্ত্রের ঘোষণা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সহায়ক না হয়ে বিভ্রান্তির জন্ম দেয়।

চিন্তার ক্ষেত্রে এই যে বিভ্রান্তি, বিশৃঙ্খলা তাই রাষ্ট্রীয় জীবনে আরো ব্যাপক ধরনের বিশৃঙ্খলা বয়ে আনে। পাতিবুর্জোয়াশ্রেণী যখন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার কথা বলে তখন তা হয়ে ওঠে ফ্যাসিবাদ। স্বাধীনতা-উত্তরকালে তাই না ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা, না সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা-কোনোটাই গড়ে ওঠার পরিবেশ ছিলো না। সেই মিশ্র অবস্থায় সুযোগ সন্ধানীরাই সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে যায়।মুজিব সরকার রাহাত্তর সালেই রাষ্ট্রের সংবিধান রচনা করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকার ছিলো রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার। বাহাত্তর সালে রচিত সংবিধানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার চালু করা হয়।

সংবিধান অনুসারে সংসদ ছিলো সার্বভৌম, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের নেতা এবং রাষ্ট্রপতি কাজ করতেন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুসারে। সে সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসাবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো। যদিও সে সংবিধান রচনায় বিরোধী দলের মতামত নেয়া হয়নি এবং সংবিধান কার্যকর করার ব্যাপারে সংসদে খুব বেশি আলোচনা করার সুযোগও ছিলো না। গণভোট ছাড়াই পাকিস্তানি আমলে নির্বাচিত সাংসদদের ভোটে সংবিধান বৈধ করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে মাওলানা ভাসানী বলেছিলেন, পাকিস্তানি আমলে নির্বাচিত সাংসদদের বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র রচনার অধিকার নেই।

সরকারের পক্ষ থেকে জনমতের তোয়াক্কা না করে সংবিধানটিকে তড়িঘড়ি ছাড়পত্র দেয়া হলে মাওলানা ভাসানী সাংবাদিক সম্মেলনে নয়া সংবিধানকে আওয়ামী লীগের দলীয় ইস্তেহার বলে মন্তব্য করেন। ৪৩ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আলীম আল রাজী মত প্রকাশ করেন যে, সমাজতন্ত্রের মূলনীতির সাথে খসড়া সংবিধানের কোনো সঙ্গতি নেই।

সাংবিধানিকভাবে তো বটেই, সার্বিকভাবেই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সরকারি শ্লোগান একটি প্রহসনে পরিণত হতে থাকলে চুয়াত্তর সালে তাজউদ্দিন আহমদ সরকারের সমাজতন্ত্রের শ্লোগানকে সমালোচনা করে বলেন, ‘সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের সংমিশ্রণে ঘোড়া, গাধা, খচ্চর কিছুই হয়নি। না হয়েছে সমাজতন্ত্র, না হয়েছে গণতন্ত্র। এক কথায় এটা গোঁজামিল হয়েছে।’ শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী একই রকম বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, গোঁজামিল দিয়ে প্রশাসন চালানো বা কোনো তন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। সমাজতন্ত্র প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সমাজতান্ত্রিক কর্মীবাহিনী যেমন দরকার তেমনি মনে প্রাণেও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী হতে হবে। বুর্জোয়া হঠকারী মনোভাব নিয়ে সমাজতন্ত্র হয় না।

সরকার যতোই মুখে সমাজতন্ত্রের বুলি আওড়াক না কেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কিংবা দেশের পররাষ্ট্রনীতি কী হবে এ ব্যাপারে কোনো স্থির সিদ্ধান্ত ছিলো না। সরকার ছিলো দোদুল্যমান। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময় বা যুদ্ধের অব্যবহিত পরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সোভিয়েত ঘেঁষা হলেও খুব শীঘ্র ভিন্ন ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। বাহাত্তর সালের অক্টোবর মাসে জগন্নাথ কলেজ সম্মেলনে জাসদ নেতা আ. স. ম. রব বলেন, দেশকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের খপ্পরে ঠেলে দেয়ার চক্রান্ত চলছে।”” রবের এই বক্তব্য যে মিথ্যা ছিলো না খুব শীঘ্রই তার প্রমাণ মিললো। স্বাধীনতা যুদ্ধে মার্কিনীদের স্বাধীনতা বিরোধী ভূমিকার জন্য দীর্ঘদিন বাংলাদেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক খারাপ ছিলো।

ফিনান্সিয়াল টাইমসের এক নিবন্ধে তখন বলা হয়, স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশ ছিলো দুনিয়ার সর্বাপেক্ষা গরীব তিনটি দেশের একটি। এখন বাংলাদেশ আরও গরীব। বাংলাদেশ সম্পর্কে তখন পশ্চিমা দেশগুলো ছিলো খুবই উন্নাসিক। চুয়াত্তর সালের এপ্রিল মাসে শেখ মুজিবের সাথে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের প্রথম সাক্ষাৎকারের পর থেকেই মার্কিনীদের সাথে শেখ মুজিবের সম্পর্ক ভালো হতে থাকে। শেখ মুজিব ধীরে ধীরে মার্কিন ঘেঁষা হয়ে পড়েন এবং সমাজতন্ত্রের চিন্তা থেকে দূরে সরে আসেন। মার্কিনীদের সাথে শেখ মুজিবের এই সম্পর্ক কতো দ্রুত ঘটে এবং তার ফলাফল কী দাঁড়ায় নীচের কয়েকটি সংবাদ শিরোনাম বা সংবাদ থেকেই তা ধরা পড়বে।

শেখ মুজিবের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফোর্ডের আলোচনা শুরু হয় উনিশশো চুয়াত্তর সালের দোসরা অক্টোবর। ফোর্ড বাংলাদেশকে সম্ভাব্য সকল প্রকার সাহায্য দানের আশ্বাস দেন এবং শেখ মুজিবও প্রেসিডেন্ট ফোর্ডের সাথে আলোচনায় সন্তুষ্ট হয়েছেন বলে মত প্রকাশ করেন। সেই আলোচনার পরপরই বাংলাদেশের জন্য নতুন করে দেড় লক্ষ টন মার্কিন চাউল ও গম বরাদ্দের ঘোষণা দেয়া হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যখন শেখ মুজিব সরকারের এই সুসম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে তখনি সরকারি দলের সমাজতন্ত্রের মূল ধারক ও বাহক অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ শেখ মুজিবের নির্দেশে মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

ঘটনাগুলো সব চুয়াত্তরের অক্টোবর মাসেই ঘটে। ফোর্ডের সাথে শেখ মুজিব আলোচনায় বসেন দোসরা অক্টোবর এবং তাজউদ্দিনকে পদত্যাগ করতে হয় ছাব্বিশে অক্টোবর। তাজউদ্দিন ছিলেন মনেপ্রাণে সমাজতন্ত্রী এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদ বিরোধী। তিনিই ছিলেন শেখ মুজিবের অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের মূল সংগঠক। যুদ্ধকালীন সময়ই মার্কিনপন্থী খোন্দকার মোশতাকের সাথে তাঁর ব্যাপক বিরোধ ঘটে।

মার্কিন বিরুদ্ধবাদী তাজউদ্দিনকে মন্ত্রী পরিষদ থেকে বাদ দেয়ার পর বাংলাদেশ- মার্কিন সম্পর্ক দিনকে দিন ঘনিষ্ঠতর হতে শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার বেড়াজালে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ আরও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে যেতে থাকে। বিদেশি সাহায্য বাড়তে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এই সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি সমাজতন্ত্রের দীর্ঘদিনের ঘোষণা ভিন্নখাতে বইতে শুরু করে। চুয়াত্তর সালের নভেম্বর মাসের একটি সংবাদ শিরোনাম ছিলো, ‘কোন তন্ত্র-মন্ত্র নহে অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয় ও কর্মসংস্থানই মুক্তি’।” কিছুদিন পরের কতোগুলো সংবাদে দেখা যায়, বাংলাদেশ ইউনিসেফের জরুরি সাহায্য পাচ্ছে এবং যে-কোনো সাহায্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।৫২ বাংলাদেশের খাদ্য সমস্যা সমাধানে ফাও সহযোগিতা করবে সেরকম আশ্বাসও দেয়া হয়।

পরের বছর জুন মাসে প্যারিসের কনসোর্টিয়াম বৈঠকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের প্রশংসা করা হয়। বিশ্বব্যাংক এসময় একশো নব্বই কোটি টাকা ঋণ প্রদান করার কথা বলে এবং যুক্তরাষ্ট্র চল্লিশ হাজার টন চাউল দানের প্রতিশ্রুতি দেয়। এই ঘোষণার পরেই বাংলাদেশ একশো বিশ কোটি ডলার সাহায্য মঞ্জুরের জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে আবেদন করে।  বাংলাদেশে হেনরী কিসিঞ্জারের সফর ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধির কারণে আন্তর্জাতিক পুঁজি পেট্রোডলারের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতির যোগাযোগ অনেক বেড়ে যায়। এই বেড়ে যাওয়ার জন্য অভ্যন্তরীণ উঠতি কোটিপতিদের তাগিদ ছিলো প্রচুর।

মুজিব সরকার তখন নানাভাবে অভিযুক্ত হচ্ছিলো। চুয়াত্তর সালের জানুয়ারি মাসে এক সাংবাদিক সম্মেলনে জাসদ নেতৃবৃন্দ উল্লেখ করেন, ছাব্বিশ মাসের শাসনে আওয়ামী লীগ ষাট হাজার লোককে হত্যা করেছে। তার মধ্যে দশ হাজার মুক্তিযোদ্ধা ও আট হাজার জাসদ কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। সরকার সে সাথে ছিয়াশি হাজার লোককে গ্রেফতার করেছে। চুয়াত্তরের জানুয়ারি মাসের এক সাংবাদিক সম্মেলনে বাণিজ্য মন্ত্রী স্বীকার করেন জনগণের ভোগান্তির জন্য সরকারই দায়ী। শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলীও সরকারের ব্যর্থতাকে স্বীকার করে নিয়ে বলেন, ‘ক্ষমতাসীন হয়ে গত ছাব্বিশ মাসে দেশের সরকার সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট কমাতে পারেনি। মানুষের মধ্যে নতুন নতুন অসন্তোষের সৃষ্টি হচ্ছে।

স্বাধীনতার স্বাদ কতিপয় সুবিধাবাদী লোক ভোগ করবে, আর দুঃখের বোঝা বইবে দেশের কোটি কোটি মানুষ-এটা বেশি দিন চলতে পারে না। সবাই যদি সুখ দুঃখকে সমভাবে ভাগ করে নিতে পারতো তবে এই অসন্তোষের সৃষ্টি হতো না।’ তিনি আরো বলেন, দেশের সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে গদি আটকিয়ে রাখার কোনো অধিকার সরকারের নেই।

মুজিব নিজে এসময় জোরালোভাবে ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরতে চান। তিনি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন। পঁচাত্তর সালের জানুয়ারির বাইশ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাকের সংবাদে দেখা যায়, দেশের সকল গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানে শেখ মুজিবের হাতে দেশের সর্বময় ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। জানুয়ারি মাসের পঁচিশ তারিখে শেখ মুজিব রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন এবং রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার কায়েম করেন। তিনি ঘোষণা দেন যে, দেশে একটি মাত্র রাজনৈতিক দল থাকবে আর এটাই শেখ মুজিবের দ্বিতীয় বিপ্লব। পঁচাত্তর সালের ফেব্রুয়ারি মাসের পঁচিশ তারিখের সংবাদে দেখা যায়, শেখ মুজিব সমস্ত দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বাকশাল গঠন করেন।

তিনি যেমন এই দলের প্রধান হন, তেমনি রাষ্ট্রপতি হিসাবে দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন। মূলত দেশ আইনগতভাবেই ব্যক্তির দ্বারা পরিচালিত হতে শুরু করলো। চারটি দৈনিক পত্রিকা ছাড়া বাকি সব দৈনিক নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। শেখ মুজিবের এই শাসনকাল খুব বেশিদিন স্থায়ী হলো না। উনিশশো পঁচাত্তরের পনের আগস্ট রাতে তিনি সপরিবারে নিহত হলেন এবং সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আরোহণ করলেন তাঁরই ঘনিষ্ঠ সহযোগী, বাকশাল মন্ত্রীসভার মন্ত্রী, মার্কিনপন্থী হিসাবে চিহ্নিত খোন্দকার মোশতাক আহমদ।

বাংলাদেশের সত্তর দশকের মঞ্চায়িত নাটকে উপরের এই রাজনৈতিক ঘটনাবলী বা রাষ্ট্র ও সরকারের ভিতরকার নানা দ্বন্দ্বগুলোকে কোনোরকম স্থান দেয়া হয়নি বা বাংলাদেশের থিয়েটার আন্দোলনের নাটকগুলোতে এই ইতিহাসের কোনো চিত্র ধরা পড়ে না বললেই চলে। জার্মানীতে যেমন পিসকাটর, ব্রেস্ট বা ভারতে উৎপল দত্ত সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনাবলী নিয়ে, সেই ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সহ নাটক রচনা করেন, বাংলাদেশে তেমন কিছুই ঘটে না দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া।

বিষয়গুলোর সাথে নাট্যকারদের সক্রিয় যোগযোগহীনতা যার প্রধান একটি কারণ। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাবের কারণেই নাটক লিখতে গিয়ে কেউ এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেননি বলে আমরা ধরে নিতে পারি। সরাসরি তো নয়ই, এমনকি ইঙ্গিতেও নয়। বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের শুরুতে যেমন তেমনি পরেও এ ধরনের নাটকের অভাব পরিলক্ষিত হয়। সমাজ সম্পর্কে জ্ঞানের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করার জন্য রাজনৈতিক নাটকের থাকে বিরাট ভূমিকা। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া পঁচাত্তর পর্যন্ত সে ভূমিকা বাংলাদেশের নাটক একেবারেই পালন করতে পারেনি। সমাজের কোনো স্তরেই নয়।

তৎকালীন নাটকগুলো দেখে বা পাঠ করে তাই শেখ মুজিবের শাসনকালের দুর্বিসহ অবস্থা, নৈরাজ্য, নানা অস্থিরতা বোঝা গেলেও রাষ্ট্র ও সরকারের অভ্যন্তীরণ বিরোধগুলো তাতে ধরা পড়ে না। চিহ্নিত হয় না রাষ্ট্রের শত্রু-মিত্ররা। নাটক যেমন একদিকে সমকালীন রাজনীতিকে ধারণ করতে পারেনি, তেমনি অন্যদিকে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের শ্রেণীচরিত্র বিশ্লেষণ করতে পারেনি। পারেনি ঘটমান ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ প্রদান করতে। মতাদর্শগত কোনো সংগ্রামও চালায়নি। সেক্ষেত্রে সেলিম আল দীনের সর্প বিষয়ক গল্প ও সঙবাদ কার্টুন খুব গুরুত্ব বহন করে। এই নাটকগুলোতে সমকালীন রাজনীতির চমৎকার চিত্র ফুটে ওঠে।

সেলিম আল দীনের সর্প বিষয়ক গল্প নাটকটি মঞ্চস্থ হয় বাহাত্তর সালে। শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয় পঁচাত্তর সালে। সেলিম আল দীনের এই নাটকটির সাথে শেখ মুজিবের হত্যার ঘটনার রয়েছে একটি চমৎকার মিল। বাহাত্তর সালে লিখিত রূপক এই নাটকটির মধ্য দিয়ে যেন নাট্যকার স্বৈরাচারী শেখ মুজিব সরকারের ভবিষ্যৎ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। নাটকটি পাঠ করলে এই সত্যটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

সর্প বিষয়ক গল্প’র আখ্যানটি রচিত হয়েছিলো খুবই জাদরেল একজন স্বৈরশাসকের পতনকে কেন্দ্র করে। স্বৈরশাসকের পতন ও মৃত্যু ঘটেছে সামরিক বাহিনীর দ্বারা। শাসকের হঠাৎ এই পতন ও মৃত্যুতে পুরো শহরে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। কোনো পূর্ব সংকেত ছাড়াই ঘটেছে ঘটনাটা। সবাই বিস্মিত, যে শাসক এতো ক্ষমতার অধিকারী ও এতো জনপ্রিয় কীভাবে তার এতো দ্রুত পতন ঘটলো।

শুধু পতনই নয়, তার জানাযা পড়বার মতো লোক পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। লোকটা যখন মিছিলে যেতো পেছনে হাজার হাজার লোক থাকতো অথচ জানাযা পড়তে গিয়েছিলো মাত্র ছয়জন। কেউ শোকসভা পর্যন্ত করেনি। জীবিত অবস্থায় লোকটাকে অনেকেই সমীহ করতো, তার সভা-সমিতি মিছিলেও প্রচুর লোক হতো। প্রথম দিকে অনেকেই খুশি মনে ঘরে নেতার ছবিও টাঙিয়েছিলো। লোকটা তখন কিছু কিছু সত্য কথাও বলতো। তবে তার শাসনের শেষদিকের লুটপাট অনেকেরই ভালো লাগতো না।

নাটকে দেখা যায়, স্বৈরশাসকের মৃত্যুর পর শহরে আর কোনো মিছিল মিটিং নেই। নেতা মারা গেছেন অতএব মিছিলও বন্ধ। সন্ধ্যার পর লুটতরাজের ভয়ও কমে গেছে। লোকটাকে যে মিছামিছি খুন করা হয়েছে তাও নয়। শেষদিকে শহরের লোকজন ক্ষেপে উঠেছিলো। লোকটাকে ঘুমের মধ্যে মেরে ফেলাতে অনেকের খারাপও লেগেছিলো। লোকটার যতোই দোষ থাক, হাজার হাজার লোক যার পেছনে ঘুরে বেড়ায় সেইতো নেতা। লোকটা যখন সত্যি কথা বলতো তখন সেগুলো আবার ব্যবসায়ীদের পক্ষে যেতো না। লোকটা বিদেশি মাল আমদানি বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলো। অথচ দেশি কারখানা চালু হবার আগেই বিদেশি মালের চালান তো বন্ধ করা যায় না।

বিদেশি মাল বিদেয় করতে গিয়ে শেষে নিজেই বিদায় হলেন। নেতা মারা যাবার পর ঘোষণা দেয়া হয়েছে, এবার থেকে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখুন। সারা শহরে কারফিউ এবং আর্মি টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। ব্রেনগান ফিট করে আর্মির ভ্যানগুলো রাস্তায় চক্কর দিচ্ছে। মিছিস ফিছিল ঠাণ্ডা। মিছিল মিটিংয়ের কোনো গন্ধ নেই। ব্যবসা- বাণিজ্য করার রাস্তা পরিষ্কার। অনেকের ধারণা নেতা বেঁচে থাকলে রাস্তায় মিলিটারী নামতে পারতো না। আবার কেউ কেউ বলেন, বুলেটের কাছে বক্তৃতা মিছিল কিস্সু খাটে না। ফলে এটা চুটিয়ে ব্যবসা করার সময়। কিন্তু শহরের মধ্যে এখানে ওখানে প্রায় একটা সাপ দেখা যাচ্ছে।

সর্প বিষয়ক গল্প শেখ মুজিবের মৃত্যুর বহু আগে লেখা হলেও শেখ মুজিবের পতনের সাথে ঘটনাগুলো আশ্চর্যভাবে মিলে যায়। মুজিব সামরিক বাহিনীর হাতেই নিহত হন এবং সত্যিকার অর্থে তাঁর জানাযা দেয়ার অবস্থা ছিলো না। যিনি ছিলেন বাঙালীর অবিংসবাদী নেতা তাঁর মৃত্যুটা হলো এমন ভাবে যে, কোনো লোক শোক জানাতেও আসেনি। এবং শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর দেশ দীর্ঘদিনের জন্য সামরিক বাহিনীর অধীনে চলে যায়। ব্যাপারটি কাকতালীয়। তবুও এ নাটকের মধ্য দিয়ে সেলিম আল দীনের রাজনৈতিক চিন্তা ধরা পড়ে।

একজন স্বৈরাচারী নেতার পতন, এবং সে পতন যে সামরিক বাহিনীর হাতেই ঘটতে পারে সেলিমের সেই রাজনৈতিক সচেতনতা যেমন এ নাটকে ধরা পড়ে, তেমনি ব্যবসায়ীদের শ্রেণীচরিত্র ফুটে ওঠে। নেতার প্রতি যার বিদ্বেষ এবং যার ভালবাসা রয়েছে, দুজনের কাছে প্রথম কথা হলো বাণিজ্যিক সুবিধা লাভ। নেতার ভালো-মন্দ দুটো দিক, সাধারণ মানুষদের চরিত্রের দোদুল্যমানতা, ব্যবসায়ীদের শ্রেণীচরিত্র সবকিছুই খুব সংযত ও সহজভাবে ফুটে উঠেছে নাটকটিতে। সর্পের বিষয়টি প্রতীকী। সাপ এখানে বিপদের প্রতীক।

সর্পের ব্যাপারটাতে নাটকের ঘটনাবলী জটিলভাবে আগালেও নাট্যকারের মেধা ও রাজনৈতিক চিন্তার ছাপ সেখানে সুস্পষ্ট। নাট্যকারের অপর একটি নাটক সঙবাদ কার্টুন-এ আমরা সে সময়কার সমাজ- রাজনীতিকে প্রত্যক্ষ করি। সেখানে ঘটনার বর্ণনা আছে, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নেই। রাজনৈতিক দিক নির্দেশনা নেই। নাটকটি মঞ্চস্থ হয় তিয়াত্তর সালে। নাটকটি সমসাময়িক রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত কিছু সামাজিক চিত্র তুলে ধরে যথেষ্ট সাহসের সঙ্গে। সঙবাদ কার্টুন, নাটকটি সরাসরি সরকারের সমালোচনা করে এবং নাটকে সরকার ও প্রশাসনের দুর্নীতিকে চিত্রিত করা হয়। স্পষ্টবাদিতার কারণে নাটকটির সাথে রাজনৈতিক এ্যাজিটপ্রপের তুলনা করা চলে। নাটকের কিছু সংলাপ এই রকম, ‘ঢাকা শহর।

জ্বী হাঁ, কালোবাজারী চোরাকারবারীর শহর, মুনাফাখোর, মজুতদারের শহর, হাইজ্যাকার, ব্যাঙ্ক লুটেরা নকলবাজের শহর।… দৈনিক তিনটি খুন, চারটি ধর্ষণ।’ স্বাধীনতা পরবর্তী সেই সময়কার বিশৃঙ্খল অবস্থাকে তুলে ধরার জন্য নাটকের একটি সংলাপ ছিলো, ‘চুকলো হাইজ্যাকারদের কথা। আসুন এবার গুপ্ত হত্যায়। রাজনৈতিক গুপ্ত হত্যা। এই গুপ্ত হত্যার জন্য দায়ী কারা?’ নাটকের আরো কিছু সংলাপ সরাসরি সরকারের বিরুদ্ধে উচ্চারিত হয়, ‘আমরা এই অযোগ্য সরকারের পতন চাই। অদূরদর্শী সরকার পরোক্ষভাবে কালোবাজারীদের হাতই শক্ত করছে। প্রায় চব্বিশ কোটি টাকার করের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।… যাবতীয় অপ্রয়োজনীয় কর থেকে জনতাকে রেহাই দাও, দেশদ্রোহী বলে প্রকৃত দেশপ্রেমিকদের হত্যা করা চলবে না, বন্যা সমস্যার স্থায়ী সমাধান কর, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য কমাও, সীমান্তে আরও কড়া প্রহরা মোতায়েন কর। ‘

বাহাত্তর-তিয়াত্তর সালে পথে ঘাটে হত্যা এবং গুপ্ত হত্যার সংখ্যা সত্যিই বেড়ে গিয়েছিলো। ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছিলো সন্ত্রাস, রাহাজানি, কালোবাজারি ও দুর্নীতি। সেলিম আল দীন কোনোরকম দুর্বোধ্যতার মধ্যে না গিয়ে সেগুলো সরল সোজাভাবে নাটকে তুলে আনেন, যা এ্যাজিটপ্রপ ধারারই বৈশিষ্ট্য। দুটি নাটকেই সচেতনভাবে তিনি কোনোরকম হতাশাকে প্রশ্রয় না দিয়ে যেভাবে রাজনীতিকে টেনে আনার চেষ্টা করেছেন তা খুবই সাহসী প্রচেষ্টা, যার মধ্যে রাজনৈতিক নাট্যধারা নির্মাণের একটি সম্ভাবনা ধরা পড়ে। সেই সময়কার রাজনৈতিক অস্থিরতাকে অনেকেই তাঁদের নাটকে স্থান দিয়েছেন তবে সেটা সমাজ বিজ্ঞানের দৃষ্টি থেকে রাজনৈতিক ঘটনাবলীকে বিশ্লেষণ করার জন্য নয়।

শুধুমাত্র অস্থির সময়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করার জন্য। বাংলাদেশের শুরুর নাট্যচিন্তায় রাজনৈতিক ঘটনাবলী নয়, সেই সময়কার অস্থির সময়ই বেশি প্রাধান্য লাভ করে। সকলেই যেন রাজনৈতিক ঘটনাবলীকে এড়িয়ে গিয়ে, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বাদ দিয়ে, রাজনৈতিক চিন্তা বাদ দিয়ে অস্থির সময়টাকেই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। মমতাজউদ্‌দীন আহমদের তেমন দুটি নাটক হরিণ চিতা চিল ও ফলাফল নিম্নচাপ।

হরিণ চিতা চিল ব্যঙ্গধর্মী ও রূপক নাটক। নাটকের গল্পে হাজেরা, হাকিম ও ভুইঞা হচ্ছে যথাক্রমে হরিণ চিতা চিল। নাটকের এই তিন চরিত্র মিলে একটি সভার আয়োজন করে এবং সভাপতি হিসেবে ধরে আনে ধনী হাক্কানীকে। হাক্কানী এই তিন জনকে নিজের বুড়ো গাভীটি দান করেন এই শর্তে যে, তিনজন সেই গরুর দুধ থেকে মিষ্টি বানিয়ে এবং তা বাজারে বিক্রি করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রমাণ করবে বাঙালী একটি উন্নত জাতি। হাজেরা-হাকিম-ভুইঞা সেই গরুর দুধ থেকে মিষ্টি বানিয়ে রাস্তার পাশে চেয়ার টেবিল নিয়ে বিক্রি করতে বসে। কেউ সে মিষ্টি কিনতে চায় না। লোকে বিশ্বাস করতে পারে না চারদিকের ভেজালের বাজারে তাঁদের এই মিষ্টিগুলো আসল।

বৃদ্ধ এক স্কুল-শিক্ষক সেখানে আসে তার ছোট্ট ছেলে সবুক্তিগীনকে নিয়ে লঙ্গরখানার খোঁজে। চুয়াত্তর সালের দুর্ভিক্ষে সরকার দেশের নানাস্থানে লঙ্গরখানা খুলেছিলো। চুয়াত্তরের সেই দুর্ভিক্ষে বহুদিন না খাওয়া শিশুটি লোভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকায় মিষ্টিগুলোর দিকে। ভুইঞার ইচ্ছা থাকলেও হাজেরার ধমকের ভয়ে সে সুবক্তিগীনকে মিষ্টি দিতে পারে না।

হাজেরা কিছুক্ষণ পর ভুইঞা আর হাকিমকে মিষ্টি বিক্রির দায়িত্বে রেখে নিজ চলে যায় গরুর জন্য ভুষি কিনতে। সবুক্তিগীনের বাবা আবার ফিরে আসে রক্তাক্ত অবস্থায়। তখন সবুক্তিগীনকে সে হারিয়ে ফেলেছে। রেলষ্টেশনে রিলিফের রুটি বিলি হচ্ছে শুনে ক্ষুধার্ত সবুক্তিগীন দৌড়াতে শুরু করলে বৃদ্ধ আর পাল্লা দিয়ে তাকে ধরতে পারে না। সবুক্তিগীনের বাবা ভুইঞা ও হাকিমের কাছে খাবার চাইলে হাকিম তাকে তাড়িয়ে দেয়। হাকিম আর ভুইঞা এই সময় নিজেরাই মিষ্টি খেতে শুরু করে দেয়। রসগোল্লার ব্যবসা শেষ পর্যন্ত রসাতলেই যায়। ক্ষুধার্ত একটি ছেলে এসে তখন আবার দাঁড়ায় তাদের সামনে। ভুইঞার মধ্যে কিছুটা মানবিকতা বেঁচে আছে।

ভুইঞা বাকি অর্ধেক মিষ্টি গরীব ছেলেটাকে দিয়ে দেয়। হাজেরা ফিরে এসে সব শুনে ব্যাপারটা পছন্দ করে না। সে ওদের দুজনকে ছেড়ে চলে যায় ধনী হাক্কানীর কাছে। কারণ হাজেরার মধ্যে রয়েছে সিঁড়ি টপকে অনেক উপরে উঠবার আকাঙ্ক্ষা। স্বাধীনতার পর মধ্যবিত্তরা যেভাবে একে অপরকে ডিঙিয়ে শুধু উপরে উঠবার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিলো তারই প্রতীক হিসাবে নাটকে এসেছে হাজেরার চরিত্র।

ফলাফল নিম্নচাপ নাটকের প্রধান চরিত্র রাজু। সে মুক্তিযোদ্ধা এবং এম এ পাশ। যুদ্ধের পর সে চাকরি না পেয়ে অপরাধীচক্রের সাথে জড়িয়ে পড়ে। রাজুর বাবা কলেজের প্রফেসর, নীতিবান মানুষ। রাজুর বোন তিশনা যুদ্ধের সময় ধর্ষিতা হবার পর থেকে আর কথা বলছে না। নাটকের শুরুতেই রাজুদের বাসার কাছে রাজুর চেলা পাটোয়ারী নীরিহ এক যুবককে খুন করে।

রাজুরও তাতে কিছুটা ইন্ধন ছিলো। স্বাধীনতার পর মৃত্যু তখন ছেলেখেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এবং তারপর বাবার সাথে রাজুর কিছু কথাবার্তার পরিপ্রেক্ষিতে রাজু আকস্মিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয় সে আর অপরাধচক্রে থাকবে না। চক্রের প্রধান তাতে ক্রুদ্ধ হয় এবং তার নির্দেশে রাজুর বোনকে অপহরণ করা হয়। রাজু নিজের বোনকে উদ্ধার করতে অপরাধীচক্রের আস্তানায় যায়। প্রধান রাজুকে জানায় তার বোনকে ছেড়ে দেয়া হবে যদি সে দলে ফিরে আসে। রাজু জোর করে বোনকে উদ্ধার করতে চাইলে নেপথ্য থেকে পাটোয়ারীর ওপর প্রধানের নির্দেশ আসে রাজুর বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করার।

পাটোয়ারি রাজুর সাথে লড়তে গেলে রাজুর গুলিতে মারা পড়ে। রাজু পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। জেলে রাজুর বিচার চলতে থাকে। এদিকে অজ্ঞান অবস্থায় রাজুর বোনকে পাওয়া যায়। চিকিৎসার পর সে আরোগ্য লাভ করে। অন্যদিকে বিচারে রাজুর ফাঁসির হুকুম হয়। বাবা আর তিশনা জেলখানায় রাজুর সাথে দেখা করতে গেলে রাজুর সাথে সাক্ষাতের পর ফাঁসির দড়ি দেখে তিশনা ‘না’ ‘না’ বলে চীৎকার করে ওঠে। তিশনা আবার তার ভাষা ফিরে পায়।

হরিণ চিতা চিল ও ফলাফল নিম্নচাপ দুটো নাটকের মধ্যেই তৎকালীন বাংলাদেশে রাষ্ট্র সম্পর্কে নানা সমালোচনা রয়েছে। হরিণ চিতা চিল নাটকের একটি সংলাপ, ‘আমি শুধু একটা কথা বলতে চাই এর জন্য দায়ী কে? আমাদের পরনে কাপড় নাই, উদরে ভাত নাই, দিকে দিকে মাবোনের হাহাকার।’ অপর একটি সংলাপ, ‘বাংলাদেশের বাতাসে এখন অক্সিজেনের অভাব… শ্বাস প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ঘরে ঘরে মৃত্যুর অশুভ পদধ্বনি। ‘

৬৬ চুয়াত্তর সালে লেখা এ নাটকের আরো একটি সংলাপ, ‘লঙ্গরখানাটা কোথায়?…না জানলে চলবে কেন বাবা। আপনাদের দেশে ছয় সাত কোটি মানুষ লঙ্গরখানা খুঁজে বেড়াচ্ছে, আর আপনি বলছেন জানেন না। তাহলে তো আপনারা এদেশের মানচিত্রটা ভালো করে দেখেননি। ‘৬৭ সেই সময় বারবার পাটের গুদামে আগুন লাগার খবর পত্রিকায় আসতো। শোনা যেতো গুদামের পাট দেশের বাইরে পাচার করে দিয়ে গুদামে আগুন লাগানো হতো। চাউল পাচার হয়ে সীমান্তে চলে যাচ্ছে সে খবরও পত্রিকায় থাকতো।

সেজন্যই উল্লিখিত নাটকের একটি সংলাপ, ‘তোমাদের পাটের গুদামে পাট আছে অথচ নাই। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেল। জমিতে ধান আছে অথচ থাকবে না। সব ফুটো দিয়ে পার হয়ে যাবে।’ নাটকের আর একটি সংলাপ, ‘হাজেরা হাক্কানীর গাড়ীতে ঘুরছে, উড়োজাহাজের প্রপেলার গোঁ গোঁ করছে, আর ঢাকায় সবুক্তিগীনের বাপ মরে পড়ে আছে।’ ফলাফল নিম্নচাপ নাটকেও এধরনের সংলাপ পাওয়া যাবে।

স্বাধীন বাংলাদেশের দুঃসময়ের প্রেক্ষিতে পুলিশ ইন্সপেক্টরকে একজন সাধারণ পুলিশ বলছে, ‘সাবধানে যাবেন স্যার, জায়গাটা খুব অন্ধকার’। ইন্সপেক্টর তার উত্তরে বলছে, ‘অন্ধকার। আর সময়টা ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ।’ এরপরই আবার সাধারণ পুলিশের সংলাপ, ‘আমরা বাঁচবো তো। এমন বেশুমার অন্ধকার আমার বাইশ বছর চাকুরি জীবনে দেখিনি কখনো।’ নাট্যকার তাঁর নাটকে স্পষ্ট বোঝাতে চেয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশের চেয়ে আগের বাইশ বছরের পাকিস্তানের শাসন ভালো ছিলো। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে নাটকে ক্ষোভ প্রকাশিত হয়েছিলো।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়কে নিয়ে নিরঞ্জন অধিকারীর কালো অশোক লাল ফুল, মমতাজউদ্‌দীনের আহমেদের ফলাফল নিম্নচাপ এর মতোই মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী হতাশাকে চিহ্নিত করে। কালো অশোক লাল ফুল নাটকে বিমূর্ত রীতির প্রভাব থাকলেও সমকালীন সমাজের চিত্রও দেয়া হয়েছে। যেমন নাটকের সংলাপের মধ্যে আছে, ‘কি হবে মিটিং করে? দেখতেই তো পাচ্ছিস সব। একদিকে চোরাচালানী, মজুতদারী, কালোবাজারী, টাউটগিরি-অন্যদিকে সমালোচনা আর রাজনীতির ফাঁকা বুলি।… শালার জনগণ হয়েছে দাবার গুটি।’৭° নাটকের আর একটি সংলাপ, ‘সারা দেশ আজ এক চরম সংকটের সম্মুখীন।… তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের স্মৃতি বিজড়িত এই স্বাধীন বাংলাদেশে সাত কোটি বাঙালীর আশা-আকাঙ্খা আজ হতাশার অনিশ্চয়তায় মাথা কুটে মরছে। দুর্নীতি, চোরাকারবার, চোরাচালান-মুনাফাবাজী, লুটতরাজ রাহাজানিতে মেতে
উঠেছে সমাজ বিরোধী দুর্বৃত্তের দল।

সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাবলী নাটকে স্থান না পেলেও সমকালীন সামাজিক সমস্যাগুলো সে সময়ের নাটকে বেশ গুরুত্ব পেয়েছিলো। বিশেষ করে নাগরিক জীবনের সমস্যা নাটকগুলিতে প্রকট হয়ে উঠেছিলো। সেলিম আল দীনের এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা নাটকটি গড়ে উঠেছে বাহাত্তরের কালোবাজারি আর ভেজালকে ব্যঙ্গ করে। সেদিক থেকে নাটকটিকে প্রহসন বলা যায়। কয়েকজন পুরুষ মিলে দীর্ঘদিনের পরিকল্পনায় বিশাল একটি বিস্ফোরণ ঘটাতে চায় ক্ষমতাধরের প্রতীক এক মহিলাকে ধ্বংস করার জন্য। তাদের সমস্ত ত্যাগ তিতিক্ষা পরিশ্রম বিস্ফোরণ ঘটবার আগ মুহূর্তে পণ্ডশ্রমে পরিণত হয় যখন দেখা গেল এক্সপ্লোসিভগুলো খাঁটি নয়। দোকানদার বা কালোবাজারি এক্সপ্লোসিভের পরিবর্তে কতোগুলো মিল্ক পাউডার দিয়েছিলো। বাহাত্তরে এভাবেই বাজারে সবাই ঠকছিলো, আর কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গিয়েছিলো। নাটকে তারই চিত্র দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

বাংলাদেশের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের ওপর তিয়াত্তরে-এ তেল সংকটজনিত আন্তর্জাতিক মন্দার বিরূপ প্রভাব পড়েছিলো।”  যার ফলাফল সাধারণ মানুষের জীবনে হয়েছিলো মারাত্মক। সেই প্রেক্ষিতে রশীদ হায়দারের তৈল সংকট ছিলো সময় উপযোগী নাটক। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে যে ভয়াবহ সংকট চলছিলো ও মানুষ যেভাবে স্বার্থান্ধতায় ভুগছিলো, তৈল সংকট তার বাস্তব চিত্র।”

বাংলাদেশের দ্রব্য সংকটকে কেন্দ্র করে মানবতার সংকট এ নাটকের প্রধান উপজীব্য। মানুষ আর মানুষকে বিশ্বাস করতে পারছে না। পকেটমার, চোর ডাকাত বা যে-কোনো ছোট-খাট অপরাধে মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা তখন একটি স্বাভাবিক ঘটনা বাংলাদেশে। এর জন্যে অনেক নিরপরাধও হাটুরে মারের পাল্লায় পড়ে বেঘোরে প্রাণ দিচ্ছে। নাটকের ঘটনায় দেখা যায় রেশনের ডিলারের বাড়িতে ভাড়া থাকে একজন চাকরিজীবী। সে সময় কেরোসিন তেলের সংকট চলছিলো।

কোনোভাবে তারা তিন টিন কেরোসিন জোগাড় করে এবং অসময়ের জন্য জমিয়ে রাখে। সেই ডিলারের বাড়ির ঠিক নীচেই ডিলারের দোকানের সামনে কেরোসিন তেলের জন্য লোকজন রাত থেকে দাঁড়িয়ে আছে লাইনে। ডিলার কিছু কিছু গ্রাহককে তেল দেয়ার পর জানিয়ে দেয় তেল আর নেই। জনতা এ ঘটনায় ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। ডিলার ভয়ে পালিয়ে যায়। তেলের ডিলারকে মারতে গিয়ে জনতা ডিলারের ভাড়াটের বাসায় তার অসময়ের জন্য জমিয়ে রাখা তেলের দু তিনটি টিন দেখে ভাড়াটেকেই পিটিয়ে মেরে ফেলে।

কেউ জানতেও চাইলো না কোথা থেকে তেল পেয়েছিলো তারা, কী তাদের পরিচয়। আগে পিটিয়ে মেরে ফেলা হোক। সেই অবস্থার চিত্রটি এঁকেছেন রশীদ হায়দার তাঁর নাটকে। মারা যাচ্ছে শুধু সাধারণ অসহায় নাগরিক। রাঘব বোয়াল যারা, যারা বাংলাদেশের এই পরিণতির জন্য দায়ী, সেই শাসক ও ব্যবসায়ীশ্রেণী ঠিকই দূরত্বে থেকে যাচ্ছে। সহজবোধ্য এই নাটকে সমকালীন বহু চিত্র ফুটে উঠেছে, সেই সঙ্গে শাসকশ্রেণীর সমালোচনাও করা হয়েছে।”

শেখ আকরাম আলীর লাশ’৭৪ নাটকের বিষয়বস্তু বহু কিছুই ছুঁয়ে গেছে। সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে যে বিষয়টি তাহলো, স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির পুনরুত্থান। নাটকের শুরু হয় চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের বেওয়ারিশ কিছু লাশ দাফনের মধ্য দিয়ে, সেসব লাশকে বেওয়ারিশ বলা হলেও একদিন তাদেরও পরিচয় ছিলো। সেখান থেকে শুরু হয় নাটকের ফ্লাশব্যাক। স্বাধীনতার দিন থেকে আরম্ভ করে নাটক ফিরে আসে আবার আগের জায়গায়। সেই ফ্লাশব্যাকে দেখা যায় স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যারা বিরোধিতা করেছে ক্ষমতায় আবার তারাই অধিষ্ঠিত। মাঝখানে সামান্য কিছু দিনের জন্য তাদের হাত থেকে ক্ষমতা চলে গিয়েছিলো। স্বাধীনতা বিরোধী একজনের সংলাপ, ‘চিনে রাখো, আমি হাজী মুকসেদ।

আগে হুজুর ছিলাম, বর্তমানেও হুজুর আছি, ভবিষ্যতেও হুজুর থাকবো। আমি মরে গেলেও আমার মতো হাজী মুকসেদরা হুজুরই থাকবে।হাজী মুকসেদ ছাড়াও সে দলে আছে হাসমত। তার বক্তব্য, ‘যে তন্ত্রই আসুক এদেশে, জমি আমাদের দখলে থাকবে। অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে।’ হাসমত গরীব মানুষের ত্রাণ-সামগ্রী নিজের ভোগ দখলে লাগাবার জন্য চেয়ারম্যানকে ঘুষের লোভ দেখায়, ‘পাঁচশো মন গমের যে এলটমেন্টটা এসেছে তার থেকে তিনশো মন গম আমার চাই। এক হাজার টাকা সঙ্গে এনেছি।’

জামসেদ চেয়ারম্যান সৎলোক, সে হাসমতকে ফিরিয়ে দেয়। হাসমত আর মুকসেদ মিলে তখন পুরো গ্রাম নিয়ন্ত্রণ করছে। জামশেদ আর মুকসেদ আপন দুই ভাই। জামশেদ স্বাধীনতার পর দালাল মুকসেদের জীবন রক্ষা করেছিলো। মুকসেদ হাসমতের সাথে মিলে সেই আদর্শবান ছোট ভাইকে হত্যা করে এবং পরে ভাইয়ের স্ত্রী শহীদন ও কন্যাকে জমি ও ভিটা থেকে উচ্ছেদ করে। অসহায় মা-মেয়ে কাজের সন্ধানে শহরে গেলে এক টাউটের পাল্লায় পড়ে। টাউট মেয়েটাকে পেতে চায়। সে মা ও মেয়ের সমস্যাটা জেনে নিয়ে মেয়েটাকে কোনো ধনী ঘরের পোষ্য হিসাবে দেয়ার কথা বলে। মেয়েটা খেয়ে পরে ভাল থাকবে ভেবে মা লোকটার কথা বিশ্বাস করে মেয়েটাকে দিয়ে দেয়। টাউট যাবার আগে মার জন্য খাবার রেখে যায়।

বহুদিন না খেতে পাওয়া শহিদন গোগ্রাসে সেটা খেতে গিয়ে ভাত গলায় আটকে মারা যায়। শহিদনের লাশ তাই বেওয়ারিশ নয়, কারণ একদিন তার স্বামী সংসার সবই ছিলো। এই হচ্ছে নাটকের গল্প। এই গল্পের মধ্য দিয়ে নাট্যকার সমকালীন আরো বহু সমস্যা তুলে ধরেছেন। বাহাত্তর-তিয়াত্তর সালে পরীক্ষায় নকলের হিড়িক পড়ে গিয়েছিলো। সেজন্য এ নাটকের ছোট্ট মেয়ে ফাতেমার সংলাপ, ‘জানো চাচু পাশের বাড়ির সামাদ ভাই বেলী আপা সবাই পরীক্ষায় নকল করেছে।

কি মজা, পড়া না করেই পাশ।’ স্বাধীনতার পর মানুষের মূল্যবোধের অবক্ষয় নিয়ে সংলাপ আছে, ‘মানুষগুলো রাতারাতি সব বদলে গেছে। সকলে শুধু টাকা টাকা করে অস্থির।’ কিংবা ‘বাঙ্গালী ব্যবসা শিখে ফেলেছে, টাকা বানাতে হবে। ‘অনেক টাকা। অনেক টাকা আর অনেক লাশ।’চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের ওপর কিছু সংলাপ, ‘লঙ্গরখানা খোলা হয়েছে। কিন্তু একা সরকার কি করবে? একদিকে লোক না খেয়ে মরছে অথচ কিছু লোকের হাতে এত পয়সা যে তারা খরচ করার পথ পাচ্ছেনা।’

বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক দেউলিয়াপনার ওপর নাটকের সংলাপ, ‘কিন্তু ফুটো একটা নয়। সারাটা দেশ ফুটোয় ভর্তি হয়ে গেছে। যেখানে হাত দাও সেখানেই পচা। এভাবেই লাশ’৭৪ নাটকে বাংলাদেশের তৎকালীন সামাজিক চিত্র ফুটে উঠেছে। সমাজের কিছু কিছু ত্রুটির দিকে নাট্যকার ইঙ্গিত করলেও তিনি কোনো সমাজ বিশ্লেষণে যাননি। বিশেষ করে নাটকটি খুবই আবেগআশ্রিত লেখা।

বাংলাদেশের আনাচে কানাচে সত্তর দশকে আবদুল্লাহ আল-মামুনের সুবচন নির্বাসনে মঞ্চস্থ হয়েছে বহুবার। চুয়াত্তরে যখন নাটকটি মঞ্চস্থ হয় তখন চারদিকে বিরাজ করছিলো যুদ্ধোত্তর হতাশা, মূল্যবোধের অবক্ষয়। মূল্যবোধের সেই অবক্ষয় নাটকের বিষয়বস্তু।৮৩ নাট্যকারের মতে নির্বাসিত সুবচনগুলো হলো, ‘সততাই মহৎ গুণ’ ‘লেখাপড়া করে যে গাড়ী ঘোড়া চড়ে সে’ এবং ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’। স্বাধীনতার পরপরই এই বচনগুলো তাদের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে বলে নাট্যকার হাহাকার আর আর্তি প্রকাশ করেন। আমরা লক্ষ্য করবো যে, তিনি যেগুলোকে সুবচন বলে অভিহিত করেছেন সেগুলো সত্যি সুবচন কি না।

লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে’ অংশে তিনি দেখিয়েছেন যে পুত্র লেখাপড়া না করে সন্ত্রাস করছে সেই পুত্রই গাড়ি চড়ছে, আর যে পুত্র লেখাপড়া করেছিলো তার কপালে একটি চাকরিও জোটেনি। যদিও ঘটনাচক্রে দুই পুত্রই জেলে যায়। যে ছেলে লেখাপড়া শিখেছিলো সততাই ছিলো তার মহৎ গুণ তবুও মিথ্যা অভিযোগে তাকে জেল খাটতে হলো। সততার কোনো মূল্যই সে পেল না। মামুন যা বলতে চান তাহলো লেখাপড়া ও সততার মূল্য হঠাৎ হারিয়ে গেছে। মানুষের ইতিহাস যদিও তা বলে না। ইতিহাসে আমরা দীর্ঘকাল ধরেই দেখতে পাই, নানারকম অন্যায় প্রভুত্ব করে এসেছে। ক্ষমতাবান মানুষদেরই জয় হয়েছে বারবার। সৎ মানুষরা সেখানে সর্বদাই অসহায়।

আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাটকে তাই আদর্শবাদী মানুষের পক্ষে হাহাকার ঘোষিত হলেও তাঁর বক্তব্য ইতিহাসসম্মত নয়। সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে-সেখানে একজন নারীকে নিজের ব্যক্তিত্ব বাদ দিয়ে স্বামীর সেবা ও স্বামীর পরিবারের প্রতি গুরুত্ব দেয়ার কথা বলা হয়। নাট্যকারের নিজেরই চিন্তার প্রতিধ্বনি সেটা।

নাটকের চরিত্র মেয়ে তা করা সত্ত্বেও শেষ রক্ষা হয় না। স্বামী সেবায় সে নিজেকে উৎসর্গ করলেও স্বামী বৈষয়িক লাভের জন্য তাকে নিজের উপরওয়ালার কাছে পাঠায়। সতীত্ব রক্ষার প্রশ্নেই তখন মেয়েটি স্বামীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিদ্রোহ করে, তার আগে নয়। সামন্তযুগের কুসংস্কার রক্ষা করতে এ নাটকে নাট্যকারের আর্তি প্রকাশ পেয়েছে যদিও স্বাধীনতা পরবর্তী মূল্যবোধের অবক্ষয় নাটকের কেন্দ্রবিন্দু।

সন্দেহ নেই, পঁচাত্তর সাল পর্যন্ত রচিত নাটকগুলির মধ্যে স্বাধীনতা পরবর্তীকালের বহু সামাজিক-ঘটনাই স্থান করে নিয়েছে। যেমন দুর্নীতি, রাহাজানি, ধর্ষণ, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, পরীক্ষায় নকলের প্রবণতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়। স্বাধীনতার পর যে মানুষের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছিলো, দেশের ভিতর বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিলো, মানুষের ওপর নানা নিপীড়ন চলছিলো, বিভিন্ন নাটকগুলোতে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মনে রাখতে হবে এগুলো রাজনৈতিক প্রসঙ্গ নয়। শাসন ব্যবস্থার ও সমাজ নৈরাজ্যের এগুলো কিছু খণ্ডিত ঘটনামাত্র। রাজনীতি থাকে এর পেছনে, শাসকদের শ্রেণীচরিত্রের সাথে থাকে তার সম্পর্ক।

রাজনৈতিক নাটকে তাই ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দেয়ার পাশাপাশি শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম চালানো একটি প্রধান কাজ। মতাদর্শগত সংগ্রাম চালাতে হয় মানুষের চিন্তার জগত থেকে পুরানো বহু বিশ্বাসকে ঝেড়ে ফেলে ইতিহাসের গতিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। রাজনৈতিক নাটক তাই সমাজ সমস্যার নাটক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। পূর্ব অধ্যায়গুলোতে আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক নাট্যকার কখনও খণ্ডিত বিষয় বা ব্যক্তিগত দুঃখকষ্টকে প্রাধান্য দেবেন না, ব্যক্তি বা ঘটনা আসবে শ্রেণীদ্বন্দ্বের প্রতিভূ হিসাবে। তাঁর কাছে প্রাধান্য পাবে শ্রেণী বা সামাজিক দ্বন্দ্বগুলো।

রাজনৈতিক নাটকের মূল দায়িত্ব হচ্ছে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমাজকে ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডকে ব্যাখ্যা করা যা স্বাধীনতা পরবর্তীকালের নাটকে ছিলো না বললেই চলে। সেজন্য সরকারি দলের একদিকে সমাজতন্ত্রের ঘোষণা আবার অন্যদিকে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে বিশ্বাস, বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুই পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা, পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, সমাজতন্ত্রের চিন্তা সরকারিভাবে বাদ পড়া-এ সকল বিষয়গুলি তৎকালীন নাটকে সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত থেকে যায়।

দেশের সরকার কেন জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে ব্যর্থ হলো তার ব্যাখ্যা নাটক দিতে পারলো না। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের চার বছরের শাসন এবং দেশের মানুষের আশা-ভরসা সর্বতোভাবে নির্মূল করে দেয়ার পিছনের কারণগুলোর কোনো বিশ্লেষণ নাট্যকাররা দাঁড় করাতে পারলেন না। অথচ রাজনৈতিক নাটকের একটি প্রধান দায়িত্বই হলো চলমান এসব ঘটনাবলীর একটি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দাঁড় করানো। রাজনৈতিক ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দর্শকদের কাছে তুলে ধরা যাতে শুধু ঘটনার বাইরের সত্যটা নয়, একই সাথে ভিতরের সত্যটাকেও দর্শক জানতে পারে। সেই জানা এবং বোঝার মধ্য দিয়েই সে যাতে বিপ্লবের কাজকে এগিয়ে নেবার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে পারে। বাংলাদেশের নাট্যকার ও নাট্যকর্মীদের কাছ থেকে তেমন কিছু ঘটলো না।

সে সময়কার মুজিববাদীদের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের ঘোষিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র নিয়ে যে দীর্ঘ দ্বন্দ্ব, যার প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের মধ্যকার বিভক্তি, আওয়ামী লীগের সাথে ছাত্রলীগের সম্পর্কে যে ভাঙন দেখা দেয়, সরকারের সাথে ছাত্রলীগের যে সকল খণ্ডখণ্ড যুদ্ধ চলে, সেগুলো ছিলো তৎকালীন রাজনীতির প্রধান প্রধান ঘটনা। সেখানে এই বিভক্তির কার্যকারণগুলো ব্যাখ্যা করা ছিলো রাজনৈতিক নাটকের কাজ। বাংলাদেশের নাটকে এর ব্যাখ্যা তো দূরের কথা, কোনো চিত্রও ধরা পড়ে না।

রাজনৈতিক নাটকের প্রশ্নে প্রধান কথা হলো সাধারণ মানুষ যা দেখতে পায় না নাট্যকারকে তাই দেখতে হবে, সেজন্যই তিনি জনগণের শিক্ষক। সেজন্যই তিনি মানুষকে সচেতন করার দায়িত্ব নিয়েছেন। নাট্যকারের চিন্তা ভাবনা যদি সাধারণ মানুষের মতোই হয়, তাঁর চিন্তা ভাবনা যদি সাধারণ মানুষের চোখকেই অনুসরণ করে, যদি তিনি একটি ঘটনাকে সাধারণ মানুষের মতোই আবেগ দিয়ে ক্রোধ দিয়ে ব্যাখ্যা করেন-তাহলে সে নাটক রচনায় কোনো ফল লাভ হবে না বলেই পিসকাটর, ব্রেস্ট বা উৎপল দত্ত মনে করেন।

রাজনৈতিক নাট্যকারের অবশ্যই শ্রেণী বিশ্লেষণের ক্ষমতা, ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার মতো দূরদৃষ্টি থাকতে হবে। বাংলাদেশের পঁচাত্তর পূর্ববর্তী নাটক তা পারেনি বলেই সেখানে হতাশা আর নৈরাজ্যর প্রকাশ দেখা যায়। সেজন্য পঁচাত্তর সালে এসে শাহরিয়ার কবির লিখছেন, বাংলাদেশে গত তিন বছরে যে কয়টি নাটক হয়েছে, তার প্রায় সবগুলোতেই একটা বিভ্রান্তি প্রচণ্ডভাবে উপস্থিত।

সেই বিভ্রান্তি এসেছে মূল্যবোধের সংকট থেকে, যার সূচনা হয়েছে একাত্তরের যুদ্ধের পর।” সেই মূল্যবোধের সংকট কেন? স্বাধীনতার পর ক্ষমতার হাত বদলের মধ্যে গুণগত কিছু পরিবর্তন এসেছিলো মানুষের চিন্তায়। স্বাধীনতা পূর্বের সময়কালকে যদি আমরা বলি প্রথম যুগ, তাহলে এটা হবে দ্বিতীয় যুগ। বাংলাদেশের সত্তর দশকের নাট্যধারাকে বুঝতে হলে এটা বোঝা দরকার।

 

রাজনৈতিক নাট্যচিন্তা ও স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের মঞ্চনাটক | সূচিপত্র

 

স্বাধীনতার পূর্ব থেকে স্বাধীনতার সময়কাল পর্যন্ত এখানকার মানুষের মনে জাতীয়তাবোধের চেতনা বিশেষভাবে কাজ করছিলো। বাংলাদেশ বা পূর্ব পাকিস্তান তখন ছিলো পাকিস্তানের একটি প্রদেশ। সে পর্বের রাজনীতিটিও ছিলো অপেক্ষাকৃত সহজ সরল। মূল শত্রু তখন পশ্চিম পাকিস্তানিরা। সেজন্য তখনকার মানুষদের মধ্যে গড়ে উঠেছিলো এক অলিখিত ঐক্যবোধ যে, পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিতে হবে। সেজন্য স্বাধীনতা যুদ্ধ যখন শুরু হলো জনগণের বিরাট অংশের কাছে স্বাধীনতা লাভটাই ছিলো মূখ্য। স্বাধীনতা লাভের পরে কী ঘটবে সে ব্যাপারে বেশির ভাগ মানুষেরই কোনো পূর্ব ধারণা ছিলো না।

স্বাধীনতা লাভের পর তারা আশা করলো এবার তাদের ভাগ্য পাল্টাবে। কোনরকম নির্যাতনের শিকার তারা হবে না। স্বাধীনতার সময় যেটা ছিলো দেশের জন্য আত্মত্যাগ, স্বাধীনতা-উত্তর কালে সেটাই হয়ে দাঁড়ালো নিজেদের আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই। দেশের প্রতি রাজনৈতিক দায়িত্ববোধ শেষ পর্যন্ত জীবনের প্রতি দায়িত্ববোধে রূপান্তরিত হলো।

স্বাধীনতা লাভের ব্যাপারটাই তো ছিলো সে-রকম। সেখানে তো বলাই হয়েছিলো পশ্চিমাদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেলেই দেশের আপামর জনতার ভাগ্য পাল্টাবে। ফলে স্বাধীনতার আগে সবাই যেমন এক সাথে কোনো একটি বিশেষ লক্ষ্যের পিছনে ছিলো, সেই লক্ষ্য সাধন হওয়ার পরবর্তী পদক্ষেপ হিসাবে ব্যক্তিগত লক্ষ্য সাধনে সবাই আলাদা আলাদা হয়ে গেল। দেশীয় শাসকরা ক্ষমতায় যাবার পর দেশের দীর্ঘ মানসিক ঐক্যের জগতটাকে ভেঙে দিয়ে বহুধারায় জনগণের চিন্তাকে বিভক্ত করে ফেললো। একই গোত্রের লোকরা বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়লো। যারা কিছুদিন আগ পর্যন্ত ছিলো একই দলভুক্ত তারা তখন ক্ষমতার লড়াইয়ে পরস্পরের চরম শত্রু হয়ে দেখা দিলো।

স্বাধীনতা যেমন একটি একক ভূখণ্ড উপহার দিলো, তেমনি দীর্ঘদিনের জাতীয় বন্ধনকে ভেঙে টুকরো করে দিলো। কেন এই ভাঙন? স্বাধীন দেশে দেশীয়দের মধ্যে থেকেই একদল ক্ষমতায় চলে গেল অথচ শোষণের যাঁতাকল টিকে রইলো। যাদের সাথে দু-একদিন আগেও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাজপথে সংগ্রাম করেছে, যখন তাদেরকে দেখা গেল শাসক-শোষকের ভূমিকায়, ঘটনার এই আকস্মিকতা মানুষকে বিভ্রান্ত করে ফেললো। ক্ষমতায় যাবার মোহ, আত্মপ্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা বেশ ভালভাবেই তখন সংক্রামিত হতে থাকলো। পূর্বের আদর্শবোধ ব্যক্তিগত স্বার্থরক্ষার চিন্তায় রূপ নিলো। মানুষের ক্ষুধা, আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই স্বাধীন দেশে হঠাৎ যেন সর্বগ্রাসী হয়ে উঠলো।

মূল্যবোধের সংকটও শুরু হলো সেখান থেকে। অথচ এসব ঘটনার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নাট্যকারদের জানা ছিলো না। মূল্যবোধের এই সংকটে জর্জরিত শিল্পকর্মীরা ইতিহাসের • উত্থান-পতন, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, উৎপাদন ব্যবস্থা ও সামাজিক সম্পর্ক নির্ণয়ে অক্ষম ছিলেন বলেই দেখা দেয় তাঁদের মধ্যে নানা বিভ্রান্তি।

বহুজনই বলেছেন সে বিভ্রান্তিই তাঁদের সৃজনশীল কর্ম থেকে বিরত রেখেছে। আনু মুহাম্মদ লিখছেন, ‘বর্তমানে যেসব নাটক হচ্ছে এই সীমিত পরিসরে সেগুলোর চরিত্র প্রশ্নাতীত নয় তবে সামাজিক দ্বন্দ্বের প্রকাশ সেগুলোতে আমরা দেখতে পাই। সামাজিক শ্রেণীগত দিক থেকে বিচ্ছিন্ন এবং সীমাবদ্ধতার কারণে সেসব নাটক কোন কোন ক্ষেত্রে সমাপ্ত, কোন কোন ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত।'”* সেই বিভ্রান্তি এসেছে চিন্তার বিভ্রান্তি বা দীনতা থেকে, সে বিভ্রান্তি এড়ানো গেছে খুব কম নাটকেই। দু-একটি নাটকই বিভ্রান্তি এড়িয়ে সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে পেরেছিলো। সেক্ষেত্রে প্রণব চক্রবর্তীর ওদের ডাক দাও নাটকটি যেমন ব্যতিক্রম তেমনি স্মরণযোগ্য।

বাংলাদেশের মঞ্চে সমকালীন রজনীতি নিয়ে এতো বিশ্লেষণমূলক নাটক আর কখনও মঞ্চস্থ হতে দেখা যায়নি। নাটকটি যেমন বাস্তববাদী ধারার তেমনি মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের চমৎকার ব্যাখ্যা রয়েছে এ নাটকে।” পঁচাত্তর সাল পর্যন্ত নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে নানারকম ব্যর্থতা সত্ত্বেও ঢাকার বাইরে নরসিংদিতে অভিনীত এই নাটকের বিষয়বস্তুর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

নাট্যকার সমকালীন সময়কে গুরুত্বের সাথে বোঝার চেষ্টা করেছেন নাটকটিতে। নাটকের চরিত্র খালেক, দেলোয়ার, মাসুদ, লীনা, রানা, শ্যামল, আনোয়ার ও আসাদ। দেলোয়ার সাহেব একজন মধ্যবিত্ত পিতা। মাসুদ, খালেক ও লীনা তার সন্তান। বড় ছেলে মাসুদ স্বাধীনতার পর লুটপাট করে, পারমিট বেচে হঠাৎ অনেক টাকা বানিয়ে ফেলেছে। বাবার এসব নিয়ে কোনো আপত্তি নেই। ছোট ছেলে মুক্তিযোদ্ধা খালেক, বড় ভাইয়ের এসব লুটপাট পছন্দ করে না। ছোট বোন লীনাও খালেকের দলে তবে সে তেমন প্রতিবাদী নয়। নাটকের আর একটি চরিত্র মুক্তিযোদ্ধা রানা। রানা খালেকের বন্ধু, লীনার প্রেমিক।

 

google news , গুগল নিউজ
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

 

যুদ্ধের পর রানা যখন দেখলো স্বাধীনতা তাদের প্রত্যাশিত আকাঙ্ক্ষা পূরণ করছে না সেও তখন হতাশ হয়ে লুটপাটে যোগ দেয়। ব্যাপারটা খালেক ও লীনাকে সমানভাবে আহত করে। খালেক ও রানার বয়োকনিষ্ঠ শ্যামল কলেজের ছাত্র। রানা ও খালেকের আহ্বানেই সে প্রগতিশীলদের দলে যোগ দিয়েছিলো। দেশের জন্য সে ভালো কিছু করতে চায়। রানার বর্তমান স্খলনে সে আহত এবং তাকে সুপথে ফিরিয়ে আনতে চায়।

মুক্তিযোদ্ধা খালেকের সাথে বড় ভাই মাসুদের দ্বন্দ্ব শুরু হয় মাসুদের ছেলের জন্মদিন পালন করা নিয়ে। খালেক মনে করে, মাসুদ যে টাকা দিয়ে বিরাট আকারে ছেলের জন্মদিন পালন করতে চায়, সে টাকাটাই অর্জন করা হয়েছে অনেক মানুষকে বঞ্চিত করে। খালেক তাই এই জন্মদিনের বিরুদ্ধে। মাসুদ খালেককে বোঝায় যে, সমাজটা এমনই, প্রতিযোগিতা করেই এখানে বেঁচে থাকতে হবে। না হলে সেও অন্যদের মতো তলিয়ে যাবে। খালেক জানে, এ প্রতিযোগিতায় দ্রব্যের মূল্য বাড়বে এবং অনেকগুলো মানুষের ক্রয় ক্ষমতা শূন্যের কোঠায় চলে যাবে। যা ডেকে আনবে দেশজোড়া দুর্ভিক্ষ, হতাশা ও বিশৃঙ্খলা।

খালেক এটাও বুঝতে পারে, তার ভাই ও তাদের মতো লোকদের অন্যায় দুর্নীতিতে গৌরবের মুক্তিযুদ্ধ অগৌরবের মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হবে। খালেক কলেজে যায়, সারা কলেজ ঘুরে কোথাও জীবনের ছোঁয়া পায় না। সে বুঝতে পারে না, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তাদের মধ্যে যেভাবে আগুন জ্বলে উঠেছিলো তা হঠাৎ এতো শীতল হয়ে তাদের কাফনের মতো জড়িয়ে ধরছে কেন? বড় ভাই মাসুদের বিরাট ব্যাংক ব্যালেন্সের দিকে তাকালে খালেকের মনে হয় সেটা স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যর্থতারই প্রতিচ্ছবি। সে বুঝতে পারে না, তার বাবা কী করে তার ভাইয়ের সব অন্যায়কে মেনে নিচ্ছে। নিজের কাছেই তার প্রশ্ন, সন্তানের কাছে বাবা- মা’র প্রত্যাশা কি শুধু টাকা, জমি আর গাড়ি-বাড়ি, মনুষ্যত্ব নয়?

রানা তার বন্ধু ছিলো, এক সময় সবাই রানাকে নিয়ে অহংকার করতো। যে রানা মৃত্যুকে বাজি রেখে যুদ্ধ করলো, সে এখন নীতিবোধ বিসর্জন দিয়ে টাকার পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছে। রানা আসে খালেকের কাছে, সে এখনো খালেককে বন্ধু মনে করে। খালেক রানাকে বোঝায় সে যা করছে ঠিক করছে না। রানা উত্তর দেয়, সে একসময় গরীব ছিলো বলে খালেকের ভাই মাসুদ তাকে ঘরে ঢুকতে দিতো না। সেই মাসুদও আজ তাকে সম্মান করে। যারা তাকে একসময় অবজ্ঞা করতো তারা আজ তার কৃপাপ্রার্থী। নিজের বাবাও আর আজ তাকে হতচ্ছাড়া বাউণ্ডেলে বলে গাল দেয় না। প্রচুর টাকা আয় করছে বলে তার ক্ষমাহীন অপরাধও আজ তারা হাসি মুখে মেনে নেয়। খালেক তাকে স্বাধীনতার আদর্শের কথা মনে করিয়ে দিতে চায়। রানা তখন বলে, সাধের স্বাধীনতাকে লোকে এখন অভিশাপ দিচ্ছে।

রানা জানতে চায়, যে স্বাধীনতার জন্য সে – প্রাণ দিতে চেয়েছিলো সে স্বাধীন দেশের চেহারা এমন হলো কেন? খালেক উত্তর দেয়, ‘স্বাধীনতা তো মানুষের মুক্তির পূর্ণ শর্ত ছিলো না।’ শ্যামল বলে, স্বাধীনতা ছিলো মুক্তির পূর্ব শর্ত। সেটা ছিলো মানুষের মুক্তির প্রথম ধাপ। রানারা প্রথম ধাপ শেষ করেই থেমে গিয়েছিলো। স্বাধীন দেশের কাছ থেকে বহু কিছু আশা করেছিলো। সেটাই ছিলো ভুল। মানুষের মুক্তির জন্য পরবর্তী ধাপগুলো এখন পার করা দরকার। খালেক ও শ্যামল সে কাজে রানাকে ফিরে আসার আহ্বান জানায়।

নাটকের অপর চরিত্র অধ্যাপক আনোয়ার হতাশ। তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের বলেছিলেন, দেশ স্বাধীন হলে মানুষের মুক্তি আসবে। স্বাধীনতা লাভের পরেও কেন সে মুক্তি এলো না তিনি সে হিসাব মেলাতে পারেন না। ছাত্র আসাদ তার ভুল কোথায় ছিলো ধরিয়ে দেয়। আসাদের বক্তব্য, সমাজের চরিত্র বিশ্লেষণ না করে শুধু আবেগের বশে এক লাফে সূর্যটাকে ধরতে চাওয়াটাই ছিলো ভুল।

সেই ভুলের কারণেই, সমাজ বিকাশের নিয়ম না জানার কারণেই রানার মতো ছেলেরা আজ উদভ্রান্ত। স্যার তার • শিক্ষার অসম্পূর্ণতার জন্যই ছাত্রদের মধ্যে শুধু ইচ্ছাপূরণের স্বপ্নটাই জাগিয়ে তুলেছিলেন। সঠিক পথের কথা বলতে পারেননি। শিখিয়ে দেননি স্বপ্ন পূরণ করতে গেলে, সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে কোন্‌ স্তর থেকে আঘাত আসবে এবং কীভাবে সে আঘাত প্রতিহত করতে হবে। স্যার নিজেই সমাজবিজ্ঞান সচেতন ছিলেন না বলে ছাত্রদেরও সেই জ্ঞান দিতে পারেননি। নীতি আর আদর্শের বুলি কপচিয়েছেন শুধু। তাই মুক্তিযুদ্ধের পর স্বপ্ন পূরণ না হতে দেখে যুবকরা হতাশাগ্রস্ত।

নীলা স্যারকে বলে, তার নীতিবোধ দিয়ে সকলকে সুপথে ফিরিয়ে আনতে। আসাদ জানায়, নীতিবোধ দিয়ে মানুষকে সুপথে ফিরিয়ে আনা যায় না। নীতিবোধের ভাবমূর্তি মানুষের মনকে কিছুক্ষণের জন্য মোহাবিষ্ট করে রাখতে পারে, স্থায়ীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। স্যারের ক্ষমতা নেই বাস্তব সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে শুধু নীতিবোধ দিয়ে তাদের ফিরিয়ে আনার। কারণ যে-সমাজ কাঠামোর মধ্যে তাদের জীবন আবদ্ধ, সে সমাজ কাঠামো তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আসাদ আরো ব্যাখ্যা করে, কেন সমস্তরকম সততা সত্ত্বেও স্যার আগে ভুল করেছিলেন। ব্যক্তি স্বার্থের চাবিকাঠিটা যারা জোর করে চেপে ধরে আছে, যারা মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, যারা জ্ঞানকে অর্থের দাস করে রাখতে চায়, তারাই সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করছে।

স্যারও তাদের চিন্তা দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। অধ্যাপক আনোয়ার নিজের চিন্তার ত্রুটি ধরতে পারেন। নীলা লড়াইয়ের নতুন ধাপ শুরু করার জন্য রানাকে ফিরিয়ে আনতে যায়। আসাদ রানাকে বলে বাস্তবকে বিশ্লেষণ করে লড়াইয়ের নতুন কাঠামো তৈরি করতে হবে, নতুন আদর্শের কথা বলতে হবে। সমাজকে সচেতন না করে হঠাৎ পরিবর্তন চাওয়াটা হবে অর্থহীন। সমাজসচেতন না করে যুবকদের পরিবর্তনের পথে পাঠালে তারা শত্রুদের সামাজিক হাতিয়ারে পরিণত হবে। সমাজটা অনেক পুরানো, অনেক বিভ্রান্তি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। হঠাৎ করে একদিনে এরকম একটা সমাজ পাল্টে দেয়া যাবে না। সমাজটাকে তাই ভালো করে বুঝতে হবে। পূর্বে সমাজ সচেতন না হওয়ার কারণেই শত্রু-মিত্র নির্ধারণ করা যায়নি। সঠিক পথটি এবার সকলকে দেখাতে হবে।

 

সত্তরের দশক: নাট্য আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্ব ও গতিধারা [ পর্ব ২ ]

সত্তরের দশক: নাট্য আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্ব ও গতিধারা [ পর্ব ২ ]

 

মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এ নাটকের মধ্যে হতাশা নেই, আছে বিশ্লেষণ, আছে উদ্যম, আছে আশার বাণী। স্বাধীনতার পরবর্তী ব্যর্থতার আছে একটি চমৎকার চিত্র। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়কে নিয়ে এরকম বিশ্লেষণাত্মক নাটক আমরা আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাই না। প্রণব চক্রবর্তীর এ নাটকটি সত্যিই একটি ব্যতিক্রম। সত্তর দশকে মঞ্চায়িত অন্য নাটকগুলোতে আমরা প্রণব চক্রবর্তীর রচনার বৈশিষ্ট্য একেবারেই দেখতে পাই না। সত্তর দশকের বেশিরভাগ নাটক খেয়াল করলে দেখা যাবে, যে বিষয়গুলো নাটকের ঘটনায় স্থান পেয়েছিলো-রাহাজানি, হত্যা, ধর্ষণ, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি-এগুলো মধ্যবিত্তদের ব্যক্তিগত বা দৈনন্দিন জীবনে বাধার সৃষ্টি করেছিলো, তাদের ব্যক্তিগত পারিবারিক জীবনকে ব্যাহত করেছিলো, তাদের নিরাপত্তা ক্ষুন্ন করছিলো। তাই মধ্যবিত্ত নাট্যকাররা ব্যক্তিগত ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে এসব ঘটনাকে নাটকে স্থান দিয়েছিলেন, এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন।

আসলে তাঁরা ব্যক্তিস্বার্থের উর্দ্ধে উঠতে পারেননি। যেখানে তাঁরা নিজেরা বিপদগ্রস্ত সেটুকুই তাঁদের প্রতিবাদের ব্যাপার ছিলো। তাঁদের ক্ষোভটা ছিলো একান্ত ব্যক্তিগত। এই প্রতিবাদ অবশ্যই বৃহত্তর সমাজের পক্ষে গিয়েছিলো কিন্তু বৃহত্তর সমাজের স্বার্থ নিয়ে, নিজ শ্রেণীর বাইরের স্বার্থ নিয়ে তাঁরা ভাবেননি। জোতদারদের সাথে ভূমিহীন বা বর্গাচাষীদের যে লড়াই, শ্রমিকদেরকে কলকারখানা থেকে ছাঁটাই, কল-কারখানাগুলো ‘লে অফ’ করার মতো যে ঘটনা সে সময় ঘটেছিলো নাট্যকার ও নাট্যকর্মীরা তার বিরুদ্ধে কোনোরকম প্রতিবাদ জানানোর চেষ্টা করেননি। কারণ তা সরাসরি তাঁদের স্বার্থে আঘাত হানেনি। রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থ সম্পর্কে নাট্যকাররা ছিলেন সম্পূর্ণ উদাসীন তা তাঁদের নাটকের বিষয়বস্তুর ওপর চোখ বুলালেই বারবার প্রতীয়মান হয়।বাংলাদেশে বাহাত্তর সালে শাসকচক্র দ্বারা যে সংবিধান রচিত হয়েছিলো সেই সংবিধানকে জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক বলা হলেও মোটেই তা ছিলো না।

শাসকচক্র প্রয়োজন মতো সংবিধান দ্বারা গণতন্ত্রের পতন ঘটায়, এক ব্যাক্তির শাসন প্রতিষ্ঠা করে, মূল নীতিগুলোকে স্থগিত বা বাতিল ঘোষণা করে-শাসকচক্র নিজ খেয়াল খুশি মতো সংবিধানকে এভাবেই জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলো। রাজনৈতিক কিছু কিছু দল এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেও বাংলাদেশের সে সময়কার কোনো নাটকেই এ প্রসঙ্গের কোনো অবতারণা নেই। রাষ্ট্র যেখানে জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করছে নাটক সেখানে সম্পূর্ণ নিশ্চুপ। অথচ যে-কোনো রাজনৈতিক নাট্যচর্চায় ব্রেশটের শিক্ষা অনুযায়ী মূল কর্তব্য হচ্ছে সমাজে এই মুহূর্তে যা কিছু গোপন, তা প্রকাশ করে জনতার সামনে তুলে ধরা, যা রয়েছে বীজের মতো, তাকে বিরাট মহীরুহ করে জনতার সামনে হাজির করা। যাতে রাজনৈতিকভাবে অসচেতন জনতা নাটকের মধ্য দিয়ে সমাজবিজ্ঞানের চেতনা লাভ করতে পারে।

স্বাধীনতার পরপর সমাজতন্ত্র নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে, রাষ্ট্রের বাইরে সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে যে-ধরনের চিন্তাভাবনা চলছিলো, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সাধারণ জনগণ, বুদ্ধিজীবী ও শ্রমিকদের মধ্যেও যে একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিলো-কোনো নাটকেই এসবের কোনো চিত্র পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সরকারি ও সরকার বিরোধী দুদিক থেকেই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটি * জোর পেয়েছিলো এবং সংবিধানেও ব্যাপারটি মূলনীতি হিসাবে উল্লিখিত ছিলো। তা সত্ত্বেও নাট্যকার ও ন’ট্যকর্মীরা এই বিষয়টি নিয়ে তখন আদৌ চিন্তাভাবনা করেননি। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কোনো দাবিও নাট্যকার ও নাট্যকর্মীদের দিক থেকে ছিলো না।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পেছনে মুক্তিযুদ্ধের যে অন্যতম প্রধান চেতনাটি কাজ করেছিলো তা হলো সমাজতন্ত্র। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী নাটক মুক্তিযুদ্ধের এ চেতনাকে ধারণ করতে পারলো না। বাংলাদেশের সত্তর দশকের নাট্য আন্দোলনে এ বিষয়টি বিরাট প্রশ্নের উদ্রেক করে, কেন নাট্যকারদের চিন্তায় রাষ্ট্রীয় জীবনে সমাজতন্ত্রের দাবির কোনো প্রতিফলন ঘটলো না। যদি আমরা পশ্চিমবঙ্গের নাট্য আন্দোলনের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো ভারতের স্বাধীনতার পরে পশ্চিমবঙ্গের নাট্য আন্দোলনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামটাই প্রধান হয়ে দেখা দিয়েছিলো।

বাংলাদেশে তখন নানা ধরনের শ্রমিক আন্দোলন চলছিলো, বিভিন্ন পেশার মানুষের নানা ধরনের বিক্ষোভ চলছিলো। পাশাপাশি চলছিলো সরকারি দমন- নিপীড়ন। পুরো সময়কালটাই ছিলো আন্দোলন আর দমনের ঘটনায় পূর্ণ। জনসাধারণের ওপর চলছিলো সরকারের বিশেষ বাহিনী ‘রক্ষী বাহিনী’র অত্যাচারসহ মারধর, গ্রেফতার, বিনা বিচারে হত্যা। সেসব ঘটনাও নাটকের বিষয়ম্ভর বাইরেই ছিলো। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের পাশাপাশি তখন সর্বহারা দলের রাজনৈতিক কর্মসূচী ব্যাপকভাবে সরকার বিরোধী ভূমিকা রাখছিলো। সর্বহারা দলের গুপ্ত কার্যক্রম সরকার তথা পুলিশ বাহিনীকে তটস্থ করে তুলেছিলো। শ্রেণীশত্রু খতমের লাইনও তারা নিয়েছিলো।

সর্বহারা দলের প্রধান সিরাজ সিকদার তখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং আলোচিত ব্যক্তি ছিলেন। চুয়াত্তর সালের জুলাই মাসে সিরাজ সিকদার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলে বিনাবিচারে তাঁকে হত্যা করা হয়। সিরাজ সিকদারের হত্যাকাণ্ডও ছিলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি আলোচিত ঘটনা, যা সে সময়কার নাটকের বিষয়বস্তুর মধ্যে জায়গা পেল না। অথচ চারু মজুমদারের নকশাল আন্দোলনকে নিয়ে উৎপল দত্ত রচনা করেছিলেন তীর নাটকটি, ভারতের রাজনীতিতে যা তখন উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করেছিলো।

দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনে আমরা সেরকম কোনো নাট্যকারের দেখা পাই না যিনি রাষ্ট্রের সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাবলীকে বিষয়বস্তু করে নাটক লিখছেন। রাজনৈতিক ঘটনা নিয়ে নাটক লেখার ব্যাপারটাই ছিলো সুদূর পরাহত। নাট্যকাররা যে রাজনৈতিক ঘটনাবলীর সাথে নিজেদের সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত রাখছিলেন না কিংবা সমাজ পরিবর্তনে রাজনৈতিক দলগুলো বা রাজনীতির ভূমিকা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না, এসব ঘটনায় তা প্রমাণিত। স্বাধীনতা-উত্তর রাজনৈতিক টানাপোড়েন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব, দলগুলোর নিজস্ব চিন্তাধারা, রাষ্ট্র গঠনে তার ভূমিকা বা ভুল ভ্রান্তি কিছুই সে সময়ের নাটকে ধরা পড়েনি।

অথচ স্বাধীনতা পরবর্তী এই ঘটনাবহুল রাজনৈতিক দ্বন্দ্বগুলো নাটকের জন্য চমৎকার বিষয়বস্তু হতে পারতো। বিশ্বের রাজনৈতিক থিয়েটারের প্রাণপুরুষ এরভিন পিসকাটরের সামনে অক্টোবর বিপ্লবের ঘটনা যেমন বিশাল কর্মক্ষেত্রের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়, যেমন ব্রেশটের সামনে প্রথম মহাযুদ্ধ ও তৎপরবর্তী ঘটনাগুলো পুঁজিবাদ সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিকে প্রসারিত করে, নাটক লিখবার বিভিন্ন তথ্য ও উপাদান যোগায়, ফলে গড়ে ওঠে মহৎ সব নাট্যসম্ভার-বাংলাদেশে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে তা ঘটে না।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও পরবর্তী রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাত ও ঘটনাগুলির প্রেক্ষিতে এখানকার নাট্যকার ও নাট্যকর্মীরা তেমনি কোনো মহৎ কিছু সৃষ্টি করতে পারলেন না। সেইজন্য তাঁদের নাটকে হত্যা, সন্ত্রাস, রাহাজানি, মূল্যবাধের অবক্ষয় এসব ধরা পড়লেও তার পেছনের রাজনীতিটা ধরা পড়েনি। রাজনীতির কোনো বিশ্লেষণ নেই, নেই শোষিতশ্রেণীর মুক্তির প্রশ্ন। রাজনৈতিক দায়িত্বকে তাঁরা এ ভাবেই এড়িয়ে গেছেন। এর থেকে বোঝা যায়, স্বাধীনতা পরবর্তী নাট্য আন্দোলনের পেছনে মূলত কোনো সুদূর প্রসারী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিলো না।

 

সত্তরের দশক: নাট্য আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্ব ও গতিধারা [ পর্ব ২ ]

 

বিলেতে গৃহযুদ্ধের পর বুর্জোয়ারা যখন ক্ষমতায় এলো তাদের প্রথম লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো থিয়েটার। কোনো ধরনের কার্পণ্য না করে মাধ্যমটিকে তারা ইচ্ছে মতো ব্যবহার করতে থাকে। কাজও হলো তাই যথেচ্ছভাবে। নাট্যকারদের বড় একটি অংশই জনগণের মুখপাত্র হবার চেষ্টা না করে শাসকশ্রেণীর স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে গেলেন। কিছু নাট্যকার জনগণের স্বার্থ রক্ষার নামে নিজেদের খেয়াল বা স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিফলন ঘটালেন। স্বভাবতই তারা জনগণের মুখপাত্র হয়ে উঠতে পারলেন না।

ফলে বুর্জোয়া যুগের উন্মেষকালে বিপুল সংখ্যক যে নাট্যকারের আবির্ভাব ঘটেছিলো তার মধ্যে মার্লো-শেক্সপিয়ারদের মতো জনগণের মুখপাত্র জনাকয়েক নাট্যকার ছাড়া বাকিরা ইতিহাস থেকে হারিয়ে গেল। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশেও তাই ঘটলো। থিয়েটারকে শোষণের বিরুদ্ধে তৎকলীন নানা অত্যাচারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হলো যথেচ্ছভাবে। বহু নাট্যকারের আবির্ভাব তখন ঘটলেও শীঘ্রই ইতিহাস থেকে ব্যাপক অংশের নাম মুছে গেল। থিয়েটার যে কী, কী ভাবে তা সমাজের ওপর প্রভাব বিস্তার করে, কিংবা থিয়েটার যে সমাজের জন্য ক্ষতিকারকও হতে পারে-সে সম্পর্কে তাদের কোনোরকম অভিজ্ঞতা বা পড়াশুনা ছিলো না। ছিলো নাটক ও নাট্য বিষয়ক জ্ঞানের ঘাটতি।

নাট্যচর্চায় তাঁদের প্রাথমিক পুঁজি ছিলো পশ্চিমবঙ্গের অন্ধ অনুকরণ। সে অনুকরণও যতোটা না বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে তার চেয়ে বহুগুণ আঙ্গিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে। পশ্চিমবঙ্গের মার্কসবাদী শ্রেণীসংগ্রামের বিষয়বস্তু তাঁরা গ্রহণ করেননি, সেইরকম কোনো আদর্শও তখন পর্যন্ত তাঁদের মধ্যে কাজ করছিলো না। পশ্চিমবঙ্গের নাট্য আন্দোলনের সাফল্য ও চাকচিক্যই বাংলাদেশের নাট্যকর্মীদের দৃষ্টিকে ঘোলা করে রেখেছিলো। মতাদর্শগত দিক থেকে কোনোরকম পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই তাঁরা নেমে পড়লেন মাঠে। নাট্যচর্চার প্রচলিত পদ্ধতিগুলোর সুবিধা অসুবিধা যাচাই না করেই সেগুলো বাতিল করতে শুরু করলেন। রাশিয়ায় বিপ্লবের পর যা দেখেছি বাংলাদেশেও তাই ঘটতে শুরু করলো।

নাট্য বিষয়ে নিজেদের পর্যাপ্ত বা প্রয়োজনীয় জ্ঞানটুকুও না থাকায় রূপক, অভিব্যক্তিবাদ বা জনবিচ্ছিন্ন বিমূর্ত বা অ্যাবসার্ড ভঙ্গির মোহে পড়ে গেলেন সে সময়ের এখানকার নাট্যকর্মের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা। নাট্যচর্চার শুরুর দিকে চোখ ফেরালেই সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। সে দিকেই এখন আমরা ধীরে ধীরে দৃষ্টিপাত করবো। প্রসঙ্গ নাট্য গ্রন্থে শম্ভু মিত্র লিখছেন, ‘যখন অল্পবয়সে শিল্পকর্মে জড়িত হয়ে পড়ি তখন অনেকটা যেন জৈব তাড়নাতেই শিল্পক্ষেত্রে আসি। নিজের আকাঙ্ক্ষার রূপটা তখনও ঠিক জানি না, তার উদ্দেশ্যও জানি না শুধু অন্ধকার গুহার দেওয়ালে দেওয়ালে হাতড়ে মরি একটা ফাঁটল খুঁজে পাওয়ার আশায়।”** তিনি আরো লিখছেন, ‘সেই সময়ে চারপাশের কতো মত যে আমাদের কতো পথে নিয়ে যায়।…

কতোরকম ধার-করা মতবাদের ছাঁচ যে আমাদের মনের ওপর চাপাতে চাই!’তিনি এর কারণ সম্পর্কে বলছেন, শৈশব থেকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষার মধ্যে থাকে না বলেই এসব ঘটে। স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে কোনো লক্ষ্যেই কেউ স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারে না।  স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় আমরা সেই প্রবণতাই লক্ষ্য করি। পঁচাত্তর সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের নাট্যচর্চার প্রথম পর্ব ছিলো পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জর্জর, চিন্তার ক্ষেত্রে অস্থির কম্পমান, প্রচারে উচ্চকিত। স্বাধীনতা পরবর্তী নাট্যচর্চার শুরুতে দেখা যায় পাশ্চাত্যের উদ্ভট বা বিমূর্ত রীতির প্রকোপ কিংবা রূপকধর্মী নাট্যচর্চা।

যাঁরা সে সময় নাটক লিখছিলেন, প্রায় সবাই স্বাধীনতা পূর্ববর্তী নাট্যরীতিকে বর্জন করতে গিয়ে কিংবা ভাঙতে গিয়ে সাংকেতিক, অভিব্যক্তিবাদী বা বিমূর্ত ধারার সাহায্য নিতে কিংবা সে ধারার কাছে হাত পাততে বাধ্য হয়েছিলেন। কারণ তাদের ছিলো না নিজস্ব কোনো বিজ্ঞানসম্মত চিন্তার জগত। বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের শুরুতে সেজন্য বিমূর্ত বা অ্যাবসার্ড ধারার প্রভাব ছিলো মারাত্মক। হাসান ফেরদৌস লিখছেন, বিশ শতকের যান্ত্রিকতার চরম প্রজ্ঞার ও ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অসম্ভব বিকাশের কালে অতি রোমান্টিক আধুনিকরা নাটকে অসম্ভব নামক যে বিষয়টির প্রবর্তন করেন, বাংলাদেশেও অনুরূপ প্রচেষ্টার আভাস দেখা যাচ্ছে। বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত এ ধারা খুব জোরেসোরে চলতে থাকে। তিন তিনটা বছর বেশিরভাগ তরুণ নাট্যকারদের দৃষ্টিকে বিমূর্ত নাট্যধারা সম্মোহিত করে রাখে।
বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত মূলধারার নাট্যচর্চায় পঞ্চাশটির উর্ধ্বে নাটক মঞ্চস্থ হতে দেখা যায়।

সেই মঞ্চায়িত নাটকগুলির বেশিরভাগ যে বিমূর্ত ভঙ্গিতে রচিত সেটা বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়। যদিও সে সময়কার অর্ধেকের বেশি নাটকই প্রকাশিত নয় এবং লিখিত পাণ্ডুলিপিও পাওয়া যাচ্ছে না। যেসব নাটক পাওয়া গেছে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করার পর এবং নাটক সম্পর্কে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার লেখালেখি ও মন্তব্য থেকে যথেষ্টভাবেই এটা প্রতীয়মান হয় যে, কিছুটা স্বেচ্ছাকৃত দুর্বোধ্যতা এবং বিমূর্ত নাট্যরীতিই স্বাধীনতা পরবর্তী নাট্যকার ও নাট্যকর্মীরা পছন্দ করেছিলেন।

সেই অ্যাবসার্ড ধারা বাংলায় কিম্ভুত, বেখাপ্পা বা অসম্ভব নাট্যধারা হিসাবেও পরিচিত। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতি, অর্থনীতি সম্পর্কে যুব মানসে যে হতাশার জন্ম দেয়, নাট্যকার ও নাট্যকর্মীদের ক্ষেত্রে তাই বিমূর্ত নাট্যভঙ্গি গ্রহণের কারণ। বিমূর্ত বা অ্যাবসার্ড রীতিটির জন্মই মূলত হতাশা থেকে।

যদিও বিমূর্ত ধারা খুব স্বল্প সময়ের জন্যই বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় প্রভাব বিস্তার করেছিলো। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলনের প্রশ্নে, রাজনৈতিক নাটকের গতিধারা বোঝার জন্যই বিমূর্তরীতির এই নাটকগুলোর প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলনের চিন্তার সাথে এই বিমূর্ত বা উদ্ভট ধারার রয়েছে একটি বিরাট যোগসূত্র। সেজন্য বিমূর্তরীতির এই নাট্যধারা খুব জোরালোভাবেই এ অধ্যায়ের আলোচনায় স্থান পাবে নাট্য আন্দোলনের শুরুর দিকের চেহারাটা বোঝার জন্য, যাতে আন্দোলনের শুরুটা দিকচিহ্নহীন না হয়ে পড়ে। শুরুর এই সময়টাকে ঠিক মতো মূল্যায়ন করতে না পারলে পুরো আন্দোলনের চেহারাটাই বুঝতে অসুবিধা হবে।

মূল প্রসঙ্গে যাবার আগে বলে নেয়া দরকার, রূপক, সাংকেতিক, অভিব্যক্তিবাদী বা পাশ্চাত্য নাট্যকলার আলোকে স্বাধীনতা পরবর্তী নাট্যধারায় বিমূর্তরীতির ছোঁয়া লাগে। তবে বাংলাদেশের বিমূর্ত নাট্যধারা সম্পূর্ণভাবে পাশ্চাত্যের নাট্যধারাকে অনুকরণ করেনি, সাংকেতিক বা রূপক নাট্যভঙ্গির সাথে তা মিলেমিশে ছিলো। পঁচাত্তর সাল পর্যন্ত বিমূর্ত, রূপক বা সাংকেতিক ভঙ্গির যে নাটকগুলো মঞ্চস্থ হয়েছে তার মধ্যে কয়েকটির বিষয়বস্তু নিয়ে আমরা এখানে আলোচনা করবো এটা দেখানোর জন্য যে সেগুলো বক্তব্যর দিক থেকে কীভাবে রাজনৈতিক থিয়েটারের বিরোধী ছিলো।

সালেহ আকরামের নিরঞ্জন ফিরে এসো নাটকে নিরঞ্জন কোনো চরিত্র নয়, নিরঞ্জন হচ্ছে মূল্যবোধ। যার শব্দগত অর্থ কালিমাহীনতা। তিনি মনে করছেন পৃথিবী একদা কালিমাহীন ছিলো। কোনো কারণে তা আর বর্তমান নেই। সেজন্য তিনি কালিমাহীনতাকে পুনরায় ফিরে আসবার আহ্বান জানান। নাটকের মূল চরিত্র ফারুক যাতনাপিষ্ট ও মদ্যাসক্ত। বিকারের ঘোরে সে হোমারের হেলেন থেকে ইতিহাসের মেহেরুন্নিসা অবধি একে একে সবাইকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেন। ফারুকের বিশ্বাস তাদের কৃতকর্মেই পৃথিবী থেকে কালিমাহীনতা চলে গেছে। নাট্যকারের মতবাদ নিয়ে এই প্রশ্ন তোলা খুবই স্বাভাবিক যে, ইতিহাসের ছাত্র হয়েও ফারুক কী করে এটা জানে না যে হেলেন, প্যারিস, হেক্টর, ইডিপাস কেউই এরা ইতিহাসের কোনো চরিত্র নয়, পৌরাণিক কাহিনীর চরিত্র। নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র এখানে ভালো কিছু আশা করে বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নয়, সে আশ্রয় খোঁজে মিথের কাছে।

নাট্যকারের চিন্তায় নিরঞ্জনের ফিরে আসাটা যেন আবেদন নিবেদনের ওপর নির্ভরশীল। ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়ায় ধর্মীয় প্রার্থনার মতো; যেন প্রার্থনা করে নিরঞ্জন বা ভালো অবস্থাকে ফিরিয়ে আনা যায়। বাস্তবে সেটা কখনো সম্ভব নয়। পৃথিবীতে কোনোদিনই কোনো সমাজ আবেদন নিবেদনে পরিবর্তিত হয়নি, পৃথিবীর প্রতিটি বিকাশ ও পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে দুই শ্রেণীর মধ্যকার পারস্পরিক ঘৃণা, রক্তপাত ও যুদ্ধ। সালেহ আকরামের চিন্তা ধর্মীয় পুরোহিতের চিন্তা, যিনি সংগ্রাম করার চেয়ে কোনো অলৌকিক শক্তির কাছে প্রার্থনা করতেই পছন্দ করেন, যা ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বতত্ত্বের সম্পূর্ণ বিরোধী।

সেই সময় নাটকে প্রতীক ব্যবহার করার প্রবণতাও খুব লক্ষ্য করা যায়। মমতাজউদ্‌দীন আহমদের স্পার্টাকাস বিষয়ক জটিলতা নাটকের বিষয়বস্তুত প্রায় একই রকম। নাটকের পাত্র পাত্রীরা শুধু মানুষ নয়, বিভিন্ন দেশও। ক্ষমতাবান সূর্যকুণ্ডু নিজের জীবনী লিখতে লেখককে ধরে আনে অথচ লেখকের কাছে নিজের মূল পরিচয়টি দেয় না, সব সময় সে আড়াল থেকে কথা বলে। লেখক তাকে দেখতেও পায় না। লেখক ক্লান্তি নিয়ে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লে লেখকের সামনে স্বপ্নে একে একে উপস্থিত হয় নানা চরিত্র-যার মধ্যে রয়েছে প্যালেস্টাইন, ল্যাটিন আমেরিকা, ভিয়েতনাম, বিদ্রোহী ক্রীতদাস স্পার্টাকাস, কৃষ্ণমানুষদের নেতা প্যাট্রিস লুমুম্বা-যারা নানারকম প্রশ্নের মাধ্যমে লেখককে নিজ নিজ বক্তব্য বলে যায়।

স্বপ্নের পর লেখকের ঘুম ভাঙে, সূর্যকুন্ডুর জীবনী লিখতে সে অস্বীকার করে। ফলে সূর্যকুন্ডুর নির্দেশে প্রভু পিছন থেকে আঘাত করে লেখককে হত্যা করে। কিন্তু কে এই সূর্যকুণ্ডু? নাট্যকারের ভাষায় তার পরিচয় ফুটে ওঠে লেখককে বলা তার সংলাপে, ‘আমি প্রকাণ্ড সূর্য, তুমি সামান্য পৃথিবী’।১০০ লেখক যদি পৃথিবী হয় সূর্যের সাথে কি তার কোনো বিরোধিতা চলে কিংবা পৃথিবীর পক্ষে কি সূর্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা সম্ভব?

নাট্যকারের উপমাগুলো সেক্ষেত্রে বিজ্ঞান সম্মত নয়। বিজ্ঞান সম্মত নয় নাটকের বিষয়বস্তু। বিষয়বস্তু প্রথমত দুর্বোধ্য, দ্বিতীয়ত ভ্রান্তজাত। মানুষ সবধরনের জ্ঞান লাভ করে বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে; স্বপ্নের ভিতর দিয়ে নয়। মমতাজউদ্‌দীনের এই নাটকে লেখক জ্ঞান লাভ করে স্বপ্নে এবং তারপর বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, মানুষের বাস্তবের সংগ্রামের সাথে যার কোনোই মিল নেই। বুর্জোয়া সমাজের মূল দ্বন্দ্ব শোষিত শ্রমিক আর পুঁজিপতির মধ্যে। সূর্যকণ্ডু এবং লেখক কে কোন্ চরিত্রের প্রতিনিধি বিষয়বস্তুর জটিলতার কারণে সেটা যেমন বোধগম্য নয়, তেমনি দুটো চরিত্রের দ্বন্দ্বের কারণটাও বিজ্ঞান সম্মত নয়-সম্পূর্ণ নাট্যকারের মস্তিষ্কজাত। নাট্যকার নিজের কল্পনাকেই মনে করেন বাস্তব।

বাস্তব থেকে উপাদান না নিয়ে মনগড়া বিশ্লেষণ কোনোভাবেই রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার আওতাভুক্ত হতে পারে না। প্রতীক ব্যবহারেও অতিকথন দোষ ঘটতে পারে, মমতাজউদ্দীন আহমদের স্পার্টাকাস বিষয়ক জটিলতায় সে প্রবণতা দেখা গেছে। নাট্যকার তার রাজনৈতিক বক্তব্য প্রকাশের ব্যগ্রতায় প্রতীক সমূহকে সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়গন্ধী করে তুলেছেন।

চুয়াত্তর সালে আরণ্যক প্রযোজনা করে গন্ধর্ব নগরী। এক অলীক নগরীর কল্পনা করা হয়েছে এ নাটকে, যেখানে কোনো এক কারণে সমগ্র প্রাণীকূল ধ্বংস হয়ে গেছে শুধু বেঁচে আছে কয়েকজন অসাধু ব্যক্তি। জীবিতদের মধ্যে আছে একজন আইনজীবী, একজন কেরানি, একজন ছাত্র, একজন শিক্ষিকা। সারা নগরীতে মানুষ নেই, যানবাহন পড়ে আছে, তা চালাবার লোক নেই। মহাবিপর্যয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। রাত্রি নেমে আসে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এর মধ্যে দেখা যায়, একজন বৃদ্ধ কৃষক আসছেন শহরে তার নাতিকে খুঁজতে। ওরা সবাই তার কাছে আত্মসমর্পণ করে। মামুনুর রশীদ এ নাটকে বাস্তব থেকে দূরে সরে গিয়ে সমস্যার সমাধান খোঁজেন।

 

সত্তরের দশক: নাট্য আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্ব ও গতিধারা [ পর্ব ২ ]

 

মানুষের সংগ্রামের মধ্যে নয়, তিনি সমাধান খোঁজেন কোনো এক কাল্পনিক চরিত্রের কাছে। বাস্তবে কখনই সংকটের সমাধান সেভাবে আসে না। নাট্যকার যেভাবে কোনো অলীক নগরীর গল্প সাজান সেটাও সমাজবিজ্ঞানের দ্বান্দ্বিকতার বাইরে, বস্তুবাদীরা বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়েই নাটকের পটভূমি তৈরি করেন।

সেলিম আল দীনের নাটক করিম বাওয়ালীর শত্রু অথবা মূল মুখ দেখা নাটকের * নামটাই দুর্বোধ্য। নাটকের প্রচারপত্রে সেলিম লিখেছিলেন যে, জীবনব্যাপী সংগ্রাম শেষে শত্রু জীবনকে তাড়িয়ে মানুষ কী পায় এই অনুসন্ধানের প্রেক্ষিতে লেখা এ নাটক।১০০ নাটকটি শুরু হয় বাস্তববাদী পটভূমিতে আর শেষ হয় বিমূর্তরীতিতে। সুন্দরবন এলাকার একটি বাওয়ালী পরিবারের এক দম্পতি, সে এলাকার সামাজিক কুসংস্কার, বেঁচে থাকার সংগ্রাম, শেষে দম্পতিদ্বয়ের মৃত্যু খুব দ্রুত ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা নিয়েই নাটক।

তবে মৃত্যুর আগে করিম বাওয়ালীর হঠাৎ ক্ষেপাটে হয়ে ওঠা, ক্ষুধার জ্বালা নিয়ে বিকারগ্রস্তের মতো নিজের মৃত স্ত্রীর ছায়ামূর্তি সহ বিভিন্ন ছায়ামূর্তিকে লক্ষ্য করে হম্বিতম্বি করা, দীর্ঘক্ষণ একটানা অসংলগ্ন সংলাপ বলে যাওয়া,বর্শা নিক্ষেপে ছায়ামূর্তির পালিয়ে যাওয়া, বাওয়ালীর চারপাশে প্রদীপ হাতে চার ছায়ামূর্তির ঘুরে বেড়ানো দর্শকদের কী বোঝাতে চায় তা দুর্বোধ্যই হয়ে রয়।

সমালোচক আলী আনোয়ার মনে করেন, এটা ঘটেছে আঙ্গিকগত প্রয়োজন থেকে যার পেছনে কোনো দাশর্নিক প্রস্তাবনা নেই। সেলিম রাজনীতি সচেতন, সমাজবিজ্ঞান সচেতন কোনো শিল্পীর মতো নয়, খেয়ালী চিত্রীর মতোই ছবিগুলো এঁকেছেন। নাটকে খণ্ডিত একটি রাজনৈতিক বক্তব্য এসেছে কোনো পরিণতি ছাড়াই। একটা পর্যায় পর্যন্ত করিম বাওয়ালীর সামাজিক শত্রুদের সনাক্ত করতে বেগ পেতে হয় না, নাটক একটি লক্ষ্যের দিকে অনিবার্যভাবে ধাবিত হতে থাকে, তার পরই মৃত্যুর আগের ঘটনাবলী ও শেষ পরিণতিকে নাট্যকার ধোঁয়াটে করে ফেলেন। মূল বক্তব্য তাঁর আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। সর্প বিষয়ক গল্প ও আতর আলীদের নীলাভ পাট-এ একই ধারার পুনরাবৃত্তি দেখি।

বাস্তববাদ দিয়ে শুরু হয়ে বিমূর্তভাবে বক্তব্যের অন্তর্ধান ঘটে। সেলিম আল দীনের নাটকের সামাজিক প্রেক্ষাপটটি চিনে নিতে কোনো কষ্ট হয় না। নাটকের একটি পর্যায় পর্যন্ত তিনি সামাজিক প্রেক্ষাপটটি বেশ দক্ষতার সঙ্গে তুলেও ধরতে পারেন। তারপরই তার কেন্দ্রবিন্দুটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে সংস্থিত থাকে না, ছড়িয়ে যায়। করিম বাওয়ালী ও আতর আলীদের নীলাভ পাট নাটকের সামাজিক বক্তব্য ও দার্শনিক বক্তব্য দুই প্রবণতার মধ্যে দোদুল্যমান। নাট্যকার নিজেও যেন নিশ্চিত নন কোন বক্তব্যটিতে তিনি জোর দিতে চান। তার চরিত্রগুলি কি তাদের নিয়তির শিকার অথবা তারা নিজেরাই তাদের নিয়তির স্রষ্টা তা আর স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে না।

আর তাতে বক্তব্যের অস্পষ্টতা নাটকের পরিণতিকে আচ্ছন্ন করে। কিন্তু রাজনৈতিক নাট্যকারের চাই সম্পূর্ণ সমাজ বিজ্ঞান সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি, কোনোরকম দোদুল্যমানতা নয়। যে নাটকের বক্তব্য দর্শকদের চিন্তাকে স্বচ্ছ না করে বিভ্রান্তির মধ্যে রেখে দেয়, সে নাটকও রাজনৈতিক নাট্যচর্চার বিপরীত। সে কারণেই সেলিম আল দীনের এই নাটকটিকে সমাজ বিজ্ঞান সচেতন বলে চিহ্নিত করতে পারি না।

মোহাম্মদ এহসানুল্লাহর কিংশুক যে মরুতে নাটকে পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা নোমানের সারারাতের বিতৃষ্ণা, বিক্ষোভ ও যন্ত্রণা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা রয়েছে। স্বাধীনতার জন্য নোমান যুদ্ধ করে দু পা হারিয়ে ভাবছে তার আর কিছুই করার নেই। তাই মৃত্যু কামনা করছে। নাট্যকার মুক্তিযোদ্ধার অন্তর্নিহিত আবেগকে জোরালোভাবে তুলে ধরেছেন তবে সে আবেগের পেছনের যুক্তিটি কী সেটাই প্রশ্ন?

যুদ্ধে যে যাবে সে তো পূর্বে থেকেই জানে যুদ্ধে সে মারা পড়তে পারে, আহত কিংবা পঙ্গু হতে পারে। যেহেতু জোর করে কেউ তাকে মুক্তিযুদ্ধে নিয়ে যায়নি, তাহলে পা হারাবার জন্য কার বিরুদ্ধে তার অভিযোগ সেটা নাটকে বোধগম্য নয়। যখন নোমান দেখতে পায় তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে কিছু লোক তা নিয়ে কেনাবেচা করছে, নিশ্চয় তখন সে হতাশ হবে। রাজনৈতিক নাট্যচিন্তায় সমাজ সচেতন একজন নাট্যকারের দায়িত্ব হবে তার সে হতাশার্কে কাটিয়ে’ তোলা, ইতিহাসের চেতনা দিয়ে যুব সমাজকে দেশের শোষিত জনগণকে নতুন এক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে তোলা। স্বাধীনতার ফল কীভাবে কিছু লোকের পকেটস্থ হয়ে যায় সেটার পিছনের কারণগুলো বুঝতে সাহায্য করা। নাট্যকার তার পরিবর্তে নাটকটাকে নানা রকম জটিলতার মধ্যে আটকে ফেলেন।

নাটকটির কোনো আখ্যান নেই এবং ঘুরে ফিরে বারবার একই সংলাপ। সংলাপ অতিমাত্রায় সাংকেতিক। বাস্তবের ঘটনাবলীর চেয়ে নোমানের মনোজগত ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা প্রধান্য পেয়েছে, সেজন্যই বিভিন্ন চরিত্রের আগমন। বারবার যে চরিত্ররা নোমানের সামনে এসে কথা বলে যায় তারা কি বাস্তবেই তার সামনে আসে, নাকি নোমানের কল্পনা সেটা বোঝার উপায় নেই। চরিত্র ও সংলাপগুলো আরোপিত ও শ্লোগানধর্মী। রাজনৈতিক নাটকের কাজ মানুষের চেতনাকে জাগরিত করা, সমাজ বিকাশের নতুন নতুন চিন্তার সাথে দর্শকদের পরিচিত করে তোলা, সেখানে নাটককে দুর্বোধ্যতার বেড়াজালে আটকে রেখে নাট্যকার কোনো মতাদর্শই প্রচার করতে পারেন না। সারা নাটক জুড়ে নোমানের মনোবেদনা ছাড়া কিছুই নেই।

নোমানের চিন্তাগুলোই নানা চরিত্রের রূপ ধরে আসে বিমূর্তরীতিতে। নোমানের চিন্তা, দুঃখবোধ, হতাশা সারা নাটক জুড়ে একটি বৃত্তের মধ্যে ঘুরপাক খায়। মনে হয় একজন মুক্তিযোদ্ধার গৌরবের যুদ্ধের চেয়ে, পরবর্তীকালের অগৌরবের হতাশা তরুণ নাট্যকারদের বেশি আলোড়িত করেছে। মনস্তাত্বিক বাদ-বিসম্বাদ এসব দ্বারা নাট্যকার যে কী বলতে চান সেটা এক গোলক ধাঁধাঁ হয়ে পড়ে। দর্শকদের চিন্তাকে যা বিভ্রান্ত করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বিধ্বস্ত সময়কে নিয়ে মোহাম্মদ এহসানুল্লাহর মতো আরো কয়েকজন নাট্যকার নাটক লিখতে গিয়ে একই ধরনের গোলক ধাঁধাঁর সৃষ্টি করেছেন। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশের রূপ ফুটে উঠেছে সেখানে তবে চিন্তার ক্ষেত্রে বিষয়বস্তুর মধ্যে সৃষ্টি করেছেন নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা। আক্তার কমলের রংহীন সিগন্যাল একই রকম দুর্বোধ্য, প্রলাপে ভরা। যার শেষ-শুরু নেই। নাট্যকার কী বলতে চান সেটাও বোঝা যায় না। শুধু কিছু চরিত্র আছে তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে।

সে কথাগুলো শেষ পর্যন্ত কোনো ধারণার জন্ম দিচ্ছে না।বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার মধ্য দিয়ে শুধু হতাশাই প্রচার করা হয়েছে। হাবীব আহসান রচিত তরুণ এবং বহমান ক্ষত নাটকে রয়েছে স্বাধীনতা পরবর্তী বিধ্বস্ত তারুণ্যের হতাশার মর্মন্তুদ আর্তচিৎকার। জীবনের বহমান স্রোতে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা কিছুতেই নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারছে না তারা, ক্ষয়ে ক্ষয়ে টুকরো টুকরো হয়ে তলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার প্রদেশে।

এই তরুণদের বাঁচাবার কোনো পথ দেখতে পারছে না কেউ।  নাট্যকার নিজেও দিশেহারা, সেজন্য পথের সন্ধান দেয়া তার পক্ষেও সম্ভব হয়ে ওঠে না। সংকট থেকে মুক্তিলাভের কোনো পথ বাতলাতে পারেন না। নতুন নাট্যধারা এভাবেই দূর্শকদের জন্য কোনো নতুন আলোকবর্তিকা হয়ে উঠতে পারে না।

নতুন নাট্যপদ্ধতি আবিষ্কার করার প্রয়োজন হয় কেবলমাত্র উগ্র দেশাত্মবোধ প্রকাশ করার জন্য নয়; সেটা দরকার অন্তরের গভীরকে শিল্পের মাধ্যমে উন্মোচিত করার জন্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী নাটক রচয়িতারা সমাজের বাইরের খোলসটাকে যতো গুরুত্ব দিয়েছেন, সমাজের ভিতরটাকে সেভাবে ধরতে পারেননি। প্রধানত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির অস্বচ্ছতার জন্যই ঘটনাগুলির অভ্যন্তরীণ সত্যগুলোকে দেখতে পাননি তাঁরা, শুধু বাইরের বাহ্যিক চেহারাটাই দেখতে পেয়েছিলেন। আল মনসুরের বিদায় মোনালিসা, আক্তার কমলের রংহীন সিগন্যাল, সাযযাদ কাদিরের সাড়ে সাতশো সিংহ, শাহনূর খানের পেন্ডুলামে খুন, ফরহাদ মজহারের প্রজাপতির লীলালাস্য, আবু বাকারের বিপন্ন ধারাপাত, সালাউদ্দিন জাকির অস্থির সুস্থিতি নাটকগুলোতে বিমূর্ত বা উদ্ভট রীতির ছাপ সুস্পষ্ট। বিষয়বস্তু যেমন দুর্বোধ্য, দুর্বোধ্য তেমনি সংলাপ।

শিল্পকর্ম হিসাবে বিমূর্ত এসব নাটক দর্শকদের কাছে কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ পৌছে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। পুনঃপুন একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি দর্শক-সমালোচকদের বিরক্তিও উৎপাদন করেছে। কেউ কেউ একথাও বলেছেন এও একরকম অসুস্থতা, সৎ কিছু করার নামে অসুস্থতা।

ঢাকা থিয়েটার প্রযোজিত আল মনসুরের বিদায় মোনালিসা সবচেয়ে দুর্বোধ্য নাটকগুলির একটি। নাটকের চরিত্রগুলির মধ্যে রয়েছে সুমন, শিল্পী, পথচারী, প্রেমিক, সূর্য, ক্যানভাস, মেয়ে। শিল্পী ও সুমন দুজনেই ছবি আঁকে। সুমন চায় ভালোবাসার ছবি আঁকতে। সূর্য তার ভালোবাসা। সূর্যের ছবি সে আঁকতে চায়। সে নিয়ে নানা সংলাপ বা বলা যায় প্রলাপ চলে সুমন, শিল্পী, পথচারী, প্রেমিক, সূর্য, ক্যানভাস ও মেয়েটির মধ্যে।

ক্যানভাস তাকে বলে জীবনের ছবি আঁকতে। ক্যানভাসের সংলাপ, ‘চে গুয়েভারার নাম জানো? রাজদণ্ডের ক্যানভাসে ভালোবাসা আঁকবে বলে বলিভিয়ার জঙ্গলে বুলেট বুকে নিয়ে শুয়ে আছে। মার্টিন লুথার কিং… কালো বুকে এঁকেছে মৃত্যু।’ . সাম্রাজ্যবাদের প্রশ্নও চলে আসে নাটকে। ‘পিরামিড থেকে ভিয়েতনাম। ভালবাসা মৃত্যুর পথে হেঁটে চলে। এ্যামেরিকার ভালবাসা ল্যাটিন আমেরিকায়।

ইউরোপের ভালবাসা তোমার পদে পদে শেকল পরিয়েছে।’ ক্যানভাস সুমনকে পরামর্শ দেয়, ‘প্রথমে চাই যুদ্ধ…তারপর শিল্প। প্রথমে লাঙ্গল…তারপর সবুজ জমি। প্রথম ছুরি তারপর তুলি।’ সুমন তখন বলে, ‘তাহলে দাও যুদ্ধ। ধ্বংস হোক পৃথিবী ধ্বংস হোক সুমনের আজীবন আকাঙ্ক্ষা তারপর আঁকবো পৃথিবীর মানুষের সাথে ফুটপাতে হাঁটবো নিঃসঙ্গ একাকী। তারপর সূর্য। তোমাকে ভালোবেসে আঁকবো ছবি। ‘

নাট্যকার যুদ্ধ চান কিন্তু কার বিরুদ্ধে কার জন্য সেটা বলেন না। নাট্যকার যেন উদ্দেশ্যহীনভাবেই পথ চলছেন তাঁর নাটকের একটি সংলাপের মতো, ‘করবার কিছু নেই, অতএব ফুটপাথে হাঁটি নিঃসঙ্গ একাকী। কখন মিছিলে যাই, কখনও মিটিং-এ। ঢিলছুঁড়ি দৌড় লাগাই অনেকের সাথে… আদর্শকে ভেবে নয়। করবার কিছু নেই বলে।’বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের শুরুটা ঠিক আল মনসুরের নাটকের সংলাপের মতোই, বহুকিছু তাঁরা করছেন তবে কোনো আদর্শকে সামনে রেখে নয়। নাট্যকার ও নাট্যকর্মীরা কী চান নিজেরাই যেন জানেন না। জানেন না বলেই চারদিক থেকে শুধু হতাশা তাঁদের গ্রাস করে রেখেছিলো।

স্বাধীনতার পরের নাটকগুলোতে যুব সমাজের যে হতাশার চিহ্ন আঁকা হয়েছে সেটা সমকালীন সমাজের একটি খণ্ডিত চিত্র মাত্র। হতাশা যে ছিলো না তা নয়, পাশাপাশি যুব-ছাত্র সমাজের একটা বড় অংশ তখন রাজনীতির মাঠে নেমে পড়েছে নতুন রাজনৈতিক দাবি দাওয়া নিয়ে, নতুন কর্মসূচী ঘোষণা করে। যুব সমাজের হতাশার চেয়ে সেটা ছিলো আরো ব্যাপক। সে সময়কার দৈনিক পত্রিকাগুলোর পাতায় পাতায় সে সোচ্চার প্রতিবাদের সংবাদ লিপিবদ্ধ আছে। বিশেষ করে সে সময়কার সর্ববৃহৎ ছাত্র-সংগঠন জাসদ-ছাত্রলীগ সংকট উত্তরণের জন্য জোরেসোরে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলো। সমাজের সেইসব বাস্তবতা নাট্যকারদের দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিলো।

স্বাধীনতা পরবর্তী যুব সমাজের হতাশার চিত্র অঙ্কনের নামে তাঁরা শুধু কল্পনার রাজ্যেই ঘুরপাক খেয়েছেন, বাস্তব থেকে উপাদান সংগ্রহের ক্ষেত্রে তাঁদের দৃষ্টি ছিলো সীমাবদ্ধ। সে কারণে স্বাধীনতার পর রূপকধর্মী অভিব্যক্তিবাদী বা বিমূর্ত ও বেখাপ্পা নাটকের মঞ্চায়নের সাড়া পড়ে যায় রাজনৈতিক আবেগের হাত ধরে। সেটা কোনো রাজনৈতিক নাট্যচিন্তা ছিলো না।

সমালোচকমাত্রই বিব্রত হয়ে লক্ষ্য করেছিলেন যে, সেই সময়কার নাটকের অনেকগুলিতেই নাট্যকার যেন দ্বিধাবিভক্ত মানসিকতা দ্বারা আক্রান্ত। ‘নাট্যকারদের অনেকের মধ্যেই অ্যাবসার্ড নাটকের যে ছায়াপাত ঘটেছে সেজন্য অসীম সাহা মন্তব্য করছেন, ‘বাংলাদেশের সাম্প্রতিক তরুণ নাট্যকারদের রচনা একটি সমাজ বিচ্ছিন্ন জীবন চেতনার আরোপিত আন্তর্জাতিক হতাশার প্রতিফলন প্রচেষ্টা মাত্র। যা যথাযথভাবে আমাদের মৃত্তিকা সংযুক্ত অনুভব উন্নতি নয়, ভাব আরোপিত কাল্পনিক প্রতিবেশ নির্মিত। যা অনিবার্য বুর্জোয়া মানস বিলাস প্রবণতা অঙ্গীত। ‘

সমকালীন সমাজ থেকে নাট্যকাররা খুব দূরে না থাকলেও বৃহত্তর জনগণের দুঃখকষ্টের সাথে তাঁরা সেভাবে সম্পৃক্ত হতে পারেননি। বিভিন্নভাবে তার প্রমাণ মেলে। বিশেষ করে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের দিকে তাকালে দেখতে পাই এতো ধ্বংস, মৃত্যু, ক্ষুধা নাট্যকারদের লেখনীতে তার চিত্র নেই। শেখ আকরাম আলীর লাশ’৭৪ নাটকে সেই দুর্ভিক্ষের ছায়া ফুটে উঠলেও অন্য কারো নাটকে সে ঘটনা তেমন ভাবে স্থান পায়নি।

দু-একটি নাটকে সামান্যতম উঁকি দিয়েছে মাত্র মন্বন্তরের ঘটনা। পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চাশের মন্বন্তর নিয়ে বিজন ভট্টাচার্য নবান্ন নাটক লিখে বাংলা নাটকের জগতে একটি বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। মন্বন্তরকে নিয়ে সে সময় আরো বহু বাংলা নাটক লেখা হয়েছিলো। অথচ এখানকার নাট্যকারদের কাছে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ কোনো গুরুত্ব পেল না। অথচ সংবাদপত্রে আমরা দেখতে পাই, সে-ঘটনায় লক্ষাধিক লোক মারা পড়েছিলো।  শেখ মুজিবের শাসনামলের সেটাই ছিলো অন্যতম প্রধান দুঃখজনক ঘটনা। ঘরে ঘরে এই দুর্ভিক্ষের ছায়া পড়েছিলো। শেখ আকরাম আলীর লাশ’৭৪-এ দুর্ভিক্ষের ইঙ্গিত থাকলেও নাটকের পূর্ণাঙ্গ বিষয়বস্তু হয়ে তা দেখা দেয়নি। সেইদিনগুলোতে, নাট্যচর্চার সেই বিশাল কর্মযজ্ঞে রাজনৈতিক অঙ্গনের বড় বড় ঘটনাগুলোর মতো দুর্ভিক্ষের ঘটনা নাট্যকারদের দৃষ্টিকে এড়িয়ে গিয়েছিলো।

স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় তাই একটি তীব্রতম প্রবাহ লক্ষ্য করা গেলেও তা আপাত চমকে যতখানি আলোড়িত, নাট্যিক গুণাগুণের যথাযথ প্রতিফলনে ততখানি, নয়। ১১৬ দুর্বোধ্যতার বেড়াজালে আটকে রেখে চমক সৃষ্টি করতে যেয়ে সমাজকে বিশ্লেষণের চেয়ে, ইতিহাসের শিক্ষার চেয়ে নাট্যকারদের নিজেদের খেয়ালই এক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব পায়। মাহবুব জামিল লিখছেন, ঢাকার কতিপয় আনকোরা স্বল্প- অভিজ্ঞ যুবক-ছাত্র নাট্যকারদের ইদানিং গতানুগতিক সংলাপের ধারা, গতানুগতিক অভিনয় রীতি ইত্যাদি ভেঙে সাংকেতিক সংলাপ, পরীক্ষা নিরীক্ষার বিরাট এক ধারা নির্মাণের চেষ্টা চালাতে দেখা গেল।

কিছুদিনের মধ্যে সমাজচিত্র প্রকাশ তথা প্রতিফলিত করতে গিয়ে তরুণ নাট্যকাররা অতিমাত্রায় চমক সৃষ্টি এবং নিরীক্ষার নামে সর্বৈব দুর্বোধ্য করে তুললেন মঞ্চ নাটককে।  নাট্য আন্দোলনের শুরুর পর্বে তাহলে আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? নুরুল করিম নাসিম লিখছেন, ‘দর্শক এবং নাট্যকার, মাঝখানে শূন্য একটা ফাঁক। দুজন পরস্পরের মুখোমুখি, কিন্তু কেউ কারও ভাষা বুঝতে পারছে না। নাট্যকারের বক্তব্য: দর্শকের দিকে তাকিয়ে ভাল নাটক লেখা সম্ভব নয়। দর্শক বলছে: আজকের নাট্যকার যে দুর্বোধ্য নাটক লিখছে তা বুঝতে পারছি না।’

সমাজ বিজ্ঞান চেতনাহীন এসব শিল্পী সাহিত্যিকদের সম্পর্কে ফরাসী লেখক হলের মন্তব্য ছিলো যে, এই সব শিল্পীদের সাথে পরিচয় ঘটলে দেখা যাবে সাধারণভাবে তারা নিতান্ত অজ্ঞ, সংঘাতমূলক। আদর্শ ও প্রকৃত নাটকীয় পরিস্থিতির মুখে অসহায় বা উদাসীন। সামাজিক আন্দোলনের স্পর্শ বাঁচিয়ে বহুদূর থেকে তারা কাজ করেন এবং বিষয়বস্তু বাদ দিয়ে আঙ্গিকের প্রশ্ন নিয়েই তাঁদের যতো মাথাব্যথা। বুদ্ধিগ্রাহ্য প্রভাবের কথা ভাবার চাইতে তাঁরা শিল্পের বহিরঙ্গ নিয়ে মশগুল থাকেন।

দৃশ্যত নাটক মঞ্চায়নের জন্যই রচিত হয়ে থাকে এবং দর্শকবিহীন অবস্থায় নাটক মঞ্চায়নের কথা আমরা চিন্তা করতে পারি না। সেজন্য নাট্যকারকে দর্শকদের কথা ভাবতেই হবে। তিনি যদি দর্শকদের কথা না ভেবে নিজের খেয়ালকে অধিক গুরুত্ব দেন, সেক্ষেত্রে কি আমরা ধরে নিতে পারি নাট্যকার একটি সুচিন্তিত ও আন্তরিক ষড়যন্ত্র পোষণ করেন যে, তাঁর নাটক দ্বারা তিনি দর্শকদের নিপীড়ন করবেন? বশীর আলহেলাল লিখছেন, যাঁরা পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন তাঁরা আসলে জনজীবন থেকে দূরে সরে রয়েছেন। এ আর কিছুই নয় ধনতন্ত্রের বা বুর্জোয়া ব্যবস্থার নব আকস্মিক ধূম্রজালে দৃষ্টি হারিয়ে যাওয়া। এ ধূম্রজাল যে সযত্নে পেতে রাখা হয়েছে সে কথা বলাই বাহুল্য। না হলে অ্যাবসাডিটি নিয়েও কেউ বাহাদুরী করতে পারে।  কিন্তু বিমূর্ত নাট্যধারা নিয়ে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে বাহাদুরী করা হয়েছিলো।

বিমূর্ত বা অ্যাবসার্ড নাট্যভঙ্গি নিয়ে নানারকম বিরূপ মন্তব্য হতে দেখা যায় প্রথম থেকেই। বিমূর্ত বা অসম্ভব নাটকের চর্চা বা বাড়াবাড়ি তৎকালীন নাট্য সমালোচকরা সুনজরে দেখেননি। হাসান ফেরদৌসের একটি রচনায় এ সত্য ধরা পড়ে। তিনি লিখেছেন, সাম্প্রতিক কালে পাশ্চাত্য নাট্য আন্দোলনের অনুকরণে ঢাকায় যে নব্য নাট্যধারা তাঁরা আমদানি করেছেন, ইতিমধ্যেই তা প্রচুর নরম গরম বাদ-বিবাদের সূত্রপাত করেছে। সে সময়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ লেখা হয় অ্যাবসার্ড ভঙ্গিকে সমালোচনা করে। নাট্যচর্চায় বেখাপ্পা রীতির এই ব্যাপকতা লক্ষ্য করে জনৈক সমালোচক লিখছেন, ‘ইতিমধ্যে কেউ কেউ নাটকের অঙ্গনে শব্দের মারপ্যাচে অযথা দর্শনের উৎপত্তি ঘটিয়ে, মুখের জোরে বাজীমাৎ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। নিরীক্ষা নামক একটি অসহায় শব্দ আবার তাদের সমর্থন যুগিয়ে চলেছে। সমালোচকদের কাছে নাটকগুলোর ত্রুটিই বেশি ধরা পড়েছিলো।

হাসান ফেরদৌস মন্তব্য করছেন, ‘ইতিমধ্যেই আমরা কয়েকজন সাধারণ শ্রেণীর নাট্যকারের কাছ থেকে কতিপয় নাটক পেয়েছি যেগুলি অবয়বে অভিনব হলেও প্রকাশের ক্রুডিটি, স্থুলতা ও সংলাপের প্রকাশ্য বর্বরতার জন্য আমাদের আকর্ষণের চাইতে বিকর্ষণই করেছে অধিক। ১২৩ নাট্য পরিচালক, অভিনেতা আতাউর রহমান লিখছেন, বিশ্ব-নাট্যসাহিত্যের ক্রমবিকাশের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ও যোগসূত্র রাখতে হবে। তবে আমাদের নাট্যান্দোলনকে অ্যাবসার্ড থিয়েটার নির্ভরশীল করতে গেলে ঠকতে হবে। জীবনের প্রয়োজনে শিল্প এবং নাটক হলো মানুষের সবচাইতে ঘনিষ্ঠ শিল্প যা অতি সহজে মানুষের চিন্তা ও বুদ্ধির সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করতে পারে। সেখানে এক লাফে বিমূর্ত নাটক ও অ্যাবসার্ড থিয়েটারের পর্যায়ে চলে গেলে, বদহজম হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

বিমূর্তবাদীদের বক্তব্যে খুব জোরালোভাবেই বলা হয়েছে, বিমূর্ত বা অসম্ভব নাটক সংযোগহীনতার নাটক। স্বভাবতই এ নাটক দর্শকদের সাথে সংযোগ সৃষ্টিতে ব্যর্থ হবে। বিমূর্ত নাটক প্রচলিত অর্থে নাটকীয় নয়। নাটকের বিষয়বস্তু অদ্ভুত ও অসঙ্গত। সাধারণ একটি সুলিখিত নাটকের চরিত্রগুলো থাকে খুব চেনা এবং তাদের একটি উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য থাকে। কিন্তু বিমূর্ত নাটকের বিষয় বা চরিত্ররা নাট্যকারের পরিচিত সামাজিক পরিমণ্ডলের বাইরে থেকে আসে। নাটকের চরিত্রগুলো যেমন চিরচেনা নয় তেমনি তাদের উদ্দেশ্যহীন ক্রিয়াকলাপও সাধারণ মানুষের মতো নয়। চরিত্রগুলো যেন নিয়তির দাস, কোনোরকম গঠনমূলক উদ্যম তাদের নেই।

সাধারণত একটা নাটকে যুক্তিপূর্ণ বা মজার মজার সংলাপ থাকে যা ঘটনাকে এগিয়ে নেয়, বিমূর্ত নাটক তা নয়। বিমূর্ত নাটকের কোনো কোনোটিতে সংলাপের কোনো মাথামুণ্ডু নেই। সেগুলোকে অর্থহীন বকবকানি বলে মনে হয়। ভালো নাটকের একটা সুন্দর সূচনা, একটা মধ্যাংশ এবং সুন্দর একটা সমাপ্তি আছে। অ্যাবসার্ড নাটক শুরুই হয় খামখেয়ালীপূর্ণ ভাবে এবং শেষটাও মনে হয় যেন শেষ হলো না। ধাপে ধাপে নাটকের ঘটনা এগিয়ে যাবার মতো কোনো ব্যাপার এখানে থাকে না। কিম্ভুতকিমাকারভাবে বহু কিছু ঘটে যায়। নাটকে অকস্মাৎ তিনবক্ষা রমনীর আবির্ভাব ঘটে, মানুষেরা ক্রমশ যন্ত্রতে পরিণত হয়, মৃতদেহরা ক্রমশ স্ফীত হতে থাকে। এ ধরনের অসংখ্য অসম্ভব দৃশ্যের সংযোজন এসব নাটকে প্রায়শই একটি শর্ত হিসাবে কাজ করে।

দর্শকদের রাজনৈতিক শিক্ষাদান কিংবা দর্শককে কোনো ধরনের সচেতনতা দেয়া এঁদের চিন্তায় থাকে না। অ্যাবসার্ড নাটকে দর্শক এমন সব ঘটনা প্রবাহের সম্মুখীন হয় যেগুলো উদ্দেশ্যবিহীন, চরিত্রগুলো অবিরত একই প্রবাহে আবর্তিত এবং যা ঘটেছে, যা হচ্ছে, সব যেন বিচার বুদ্ধি সম্পন্ন অভিজ্ঞতার বহির্ভূত। স্বপ্নের যেমন কোনো সঙ্গতিপূর্ণ বিকাশ ও পরিণাম থাকে না, সেইরকম বিমূর্তধারার নাটকগুলি। তার মানুষ, ঘটনাস্থল, সংলাপ, ভাবনা, সমস্যা, জটিলতা, সমাপ্তি-সবই সঙ্গতিহীন, অস্পষ্ট ছায়াময়। বিচ্ছিন্ন-খাপছাড়া দৃশ্যের সারি সারি মিছিল চলে, হঠাৎ কোনো উদ্ভট জায়গা থেকে এই নাটকগুলো শুরু হলো এবং শেষ হলো হয়তবা আরো উদ্ভটভাবে। ১২৭ নাটকের বিষয়বস্তুর প্রধান কথা হলো হতাশা।

নাটকের পূর্ণায়তন জুড়ে নাট্যকাররা এমন একটি গর্ত তৈরি করতে থাকেন যা তাঁরা পূর্ণ করেন টনটন হতাশ্বাস দিয়ে। সেখানে আশা তিরোহিত, আসল অর্থ যেখানে নঞর্থক ধোঁয়াশায় মিশে যায়, খালি কচকচানি এবং অন্ধকারের মধ্যে বাঁশী শোনা যায়। ১২৮ কিছু কিছু হতাশাগ্রস্ত যুবক এসব নাটকের ভক্ত হলেও বেশিরভাগ দর্শকদের কাছে তা অর্থহীন হয়ে ওঠে। নাটকগুলো কোনো বাস্তব সমস্যা দর্শকদের সামনে তেমন তুলে ধরে না, তেমনি তার কোনো সমাধান দেয়ার দায়ও এসব নাটকের থাকে না। স্বভাবতই রাজনৈতিক নাটকের সাথে বিমূর্তরীতির নাটকের কোনো মিল নেই, রয়েছে বিরোধ।

মার্কসবাদীরা মনে করে, বিমূর্তধারার নাটক ধনবাদকেই টিকে থাকতে সাহায্য করছে এবং তাদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে উঠছে। সেই বিমূর্তরীতির নাটকই ছিলো বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের সামনে উদাহরণ, সেই বিমূর্তধর্মী নাটককে ঘিরেই বাংলাদেশের প্রতিবাদী নাটকের যাত্রা, যা নাট্যকার ও নাট্যকর্মীদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির অস্বচ্ছতাই প্রমাণ করে; সমাজ বিজ্ঞান চেতনার অভাব থেকেই যা উৎসারিত। নাট্য আন্দোলনের শুরুতে তাই চরম এক বিভ্রান্তি নাট্যকর্মীদের কাজে, নাট্য রচনায় ধরা পড়তে থাকে, রাশিয়ার বিপ্লবের পর যা আমরা সেখানে ঘটতে দেখি। সরকার, সমাজ ব্যবস্থার প্রতি বাংলাদেশের নাটকর্মীদের ক্ষোভ তাঁদেরকে বিভ্রান্তির পথেই ঠেলে দেয়, সুস্থ সুপরিকল্পিত কোনো রাজনৈতিক পথে আগাতে সাহায্য করে না।

যে-প্রজ্ঞা, যে-চেতনা দরকার ছিলো রাজনৈতিক একটি নাট্য আন্দোলন নির্মাণে তা ছিলো নাট্যকর্মীদের চিন্তা ও কাজে অনুপস্থিত। বরং যে পথ ধরে তারা নাট্য আন্দোলন শুরু করেছিলেন সেটা পুঁজিবাদী চক্রের নাট্য আন্দোলন ধ্বংস করার যে প্রচেষ্টা, সে পথ। নাটকগুলোতে তাই ঘটমান বিভিন্ন বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থার বিরুদ্ধে শুধু তাঁদের ক্ষোভ বা প্রতিবাদ ঘোষিত হয়েছে, সমাজকে পাল্টানোর বা বিপ্লবকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে কোনোরকম সচেতনতা সৃষ্টিতে তাঁদের কোনো অবদান ছিলো না। বিশেষ করে পঁচাত্তর সালে শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে তার আগ পর্যন্ত নাট্যপ্রবাহ ছিলো মূলত ক্ষোভ প্রকাশ বা হতাশার মধ্যেই নিমজ্জিত।

স্বাধীন দেশে যা কিছু আশা করা হয়েছিলো ঘটেছিলো ঠিক তার উল্টো। সবকিছু যে ভেঙেচুরে যাচ্ছিলো-সেই সংকটটা কিসের, সেটা যখন অনেকে বুঝতে পারলো না-সে সময় কী করণীয় সে সম্পর্কে যখন স্পষ্ট ধারণা পাওয়া গেল না, সবাই নিজের মতো করে এর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করতে লাগলো। ঘটনাগুলোর সঠিক কারণ জানা না থাকলে মানুষ বিভ্রান্ত হতে বাধ্য। রাজনৈতিকভাবে অসচেতন যুব সমাজের কাছে স্বভাবতই ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ জানা ছিলো না। নিজেদের হতাশাই তাই নাটকে প্রাধান্য পেল। প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ঠিক এমনি প্রেক্ষাপট থেকেই বিমূর্ত ধারার জন্ম। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটলো। যদিও বাংলাদেশের বিমূর্ত নাট্য রীতির সাথে পাশ্চাত্যের বিমূর্ত রীতির একটা ফারাক ছিলো। যার প্রধান কারণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ।

দুটো মহাযুদ্ধ ছিলো সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ, বাজারের জন্য লড়াই। আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিলো জনগণের মুক্তির আন্দোলন। যে মানুষগুলো দীর্ঘ সংগ্রামের ঐতিহ্যের ভিতর দিয়ে বড় হয়েছিলেন তাঁদের নাটকে সেই সংগ্রামের ছায়া কোনো-না-কোনো ভাবে প্রকাশ পেতেই হবে। বাংলাদেশের বিমূর্ত রীতির নাট্যধারায় সেটাই দেখতে পাই।

বিমূর্ত রীতির নাট্যকাররা সংগ্রামের সেই ঐতিহ্যকে কখনই সম্পূর্ণভাবে তাদের নাটক থেকে মুছে ফেলতে পারেননি যা পাশ্চাত্যের নাট্যধারায় দেখা যায়। পাশ্চাত্যের বিমূর্ত ধারার যতোই এখানে অনুকরণ করার চেষ্টা হোক, চমক সৃষ্টির জন্য কিংবা দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য সেটা সর্বক্ষেত্রে • পাশ্চাত্যের বিমূর্ত রীতির হুবহু অনুসরণ ছিলো না। তাই বাংলাদেশের বিমূর্তধারার নাট্যরীতি পাশ্চাত্যের অনুকরণ হলেও তার নিজস্ব একটি বৈশিষ্ট্যও তৈরি হয়ে গিয়েছিলো।

পাশ্চাত্যের যাঁরা বিমূর্ত নাট্যধারার নাট্যকার বা পরিচালক তাঁদের বক্তব্য ছিলো নাটক হবে অর্থহীন। নাটকে কোনো বক্তব্য থাকবে না সে কথা বলা বা নাটকে বক্তব্য না থাকার মানেই থিয়েটার হয়ে পড়বে দুর্বোধ্যতার আখড়া। শাসক শ্রেণীর গায়ে নখের আঁচড়টিও কাটবে না। বাংলাদেশে যাঁরা বিমূর্ত রীতির নাটক মঞ্চায়ন শুরু করেছিলেন তাঁরা পুঁজিবাদকে রক্ষার জন্য বা শাসকদের দালালি করার জন্য তা করেননি। সেটা ঘটেছিলো রাজনৈতিক চেতনার অভাব থেকে যেমন, তেমনি নাট্যচর্চার অনভিজ্ঞতা থেকে।

নাট্যচর্চা শুরু করবার আগে তাঁদের সামনে রাজনৈতিক বা সমাজসচেতন নাটকের কোনো দীর্ঘ উদাহরণ ছিলো না বলেই তাঁরা জটিল পথে পা দিয়েছিলেন। নাটক সম্পর্কে পূর্ব অভিজ্ঞতার অভাব অথচ নাটক নিয়ে দেশ ও সমাজ সম্পর্কে কিছু করার আগ্রহ দুয়ের মধ্যে যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব বা বিরোধ-নতুন নাট্যকারদের নাটকে বিমূর্ত রীতি বা চড়াসুরের প্রাদুর্ভাব ঘটার কারণ ছিলো তাই। সত্য চিত্রনের দায় গ্রহণ করেছিলেন নাট্যকাররা। সেইজন্যই স্বাধীনতার পরবর্তী নাটকে এতো বিদ্রোহ এতো ব্যাপকতা। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় একদিকে যেমন তাঁরা পশুশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন তেমনি ভবিষ্যৎ প্রত্যাশায়ও উচ্চকিত ছিলেন। অথচ স্বাধীনতার পর তাঁদের সঞ্চয় হতাশ্বাস ও ক্ষুব্ধ মানসিকতা।

যে-কোনো বিধ্বস্ত সমাজ প্রথমে মানুষকে হতাশাগ্রস্তই করে, সেই সাথে করে তোলে বিদ্রোহী। বাংলাদেশের প্রথম দিকের বেশিরভাগ নাট্যকাররা নিজেরাও ছিলেন হতাশাগ্রস্ত সেজন্য তাঁদের নাটকগুলোতে বিদ্রোহ আছে, নেই নতুন সমাজের কথা। পাশাপাশি নৈরাজ্যরোগে তা আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলো। যদি নাট্যকাররা সাধারণ মানুষদের চেয়ে অগ্রচেতনার লোক হতেন তাহলে এই সময়টাকে তাঁরা নতুন বিশ্বাসে তাঁদের নাটকে ধরতে পারতেন।

বিমূর্ত ধারার বাইরেও তখন নাটক হয়েছে, তবে সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষার কিংবা সমাজ বিজ্ঞান সচেতন রাজনৈতিক নাটক সেগুলো ছিলো না। ইতিপূর্বেই সে ধরনের কিছু কিছু নাটকের বিষয়বস্তুর কথা বলা হয়েছে। সে সময়ে মঞ্চায়িত নাটকগুলোর মধ্যে এখন দুঃসময়, তৈল সংকট, লাশ’৭৪, এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্য কোনোভাবেই বিমূর্ত নাটক নয়। হরিণ চিতা চিল, ফলাফল নিম্নচাপ, সর্প বিষয়ক গল্প নাটকে বিমূর্ত রীতির ছোঁয়া থাকলেও সেগুলোকে বিমূর্ত ধারার নাটক বলা যাবে না। সে সময়ে মঞ্চস্থ হাবিবুল হাসানের সম্রাট ও প্রতিদ্বন্দ্বীগণ, বা মমতাজউদ্‌দীন আহমদের হরিণ চিতা চিল ইত্যাদি নাটক পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সেখানে রূপকধর্মীতার আড়ালে এসেছে রাজনীতি।

তবে বিমূর্ত রীতির দিকেই ছিলো নাটকের প্রধান ঝোঁক। সেই সময়ে কিছু কিছু নাটক মঞ্চস্থ হয় যেগুলোর মধ্যে বিমূর্ত রীতির প্রভাব থাকলেও সেসব নাটকে একটা বক্তব্য দেয়ারও চেষ্টা আছে। সেগুলোর কোনো কোনোটিকে আমরা সাংকেতিক নাটক হিসাবেও চিহ্নিত করতে পারি। যেমন বিজন বাড়ি নেই, বিপন্ন ধারাপাত, কালো অশোক লাল ফুল, জণ্ডিজ ও বিবিধ বেলুন ইত্যাদি। এই প্রতিটি নাটকে বিমূর্তরীতির ঝোঁক থাকলেও, রয়েছে সমাজ সম্পর্কিত প্রশ্ন। বিপন্ন ধারাপাতে শোষক, শোষিত ও সুবিধাবাদী-সমাজের এই তিন শ্রেণীর মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে তিনটি চরিত্র। ইতিহাসের অমোঘ ধারায় শেষ পর্যন্ত শোষকের পতন হয়। শোষিতদের বিজয় ঘটলে সুবিধাবাদীও যোগ দেয় শোষিতদের দলে। ঘটনাগুলো ঘটে রূপকের মাধ্যমে।

নাটকের দ্বন্দ্ব আদর্শগত আর চরিত্ররা প্রতীকধর্মী। সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাবলীকে নাটকে গুরুত্ব না দেয়া হলেও সমকালীন কিছু কিছু ঘটনা বা সামাজিক দিকগুলোর প্রতি যে নাট্যকাররা আলোকপাত করেছেন সেটা বিমূর্তরীতির নাটকেও আমরা দেখতে পাই। কোথাও বিমূর্ততার আড়ালে এসেছে জোরালো রাজনীতি। যেমন জণ্ডিজ ও বিবিধ বেলুন।সেলিম আল দীনের জণ্ডিজ ও বিবিধ বেলুন নাটকটি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার লাভ করে।

নাটকটি চরমভাবে দুর্বোধ্য হলেও নাটকে রয়েছে একটি রাজনৈতিক বক্তব্য। নাটকের বক্তব্য হচ্ছে, শহরে জণ্ডিজ রোগ ছড়িয়ে পড়ছে ফলে একদল যুবক চাচ্ছে দেশে ওষুধের কারখানা। অথচ তা না করে তৈরি করা হয়েছে চার-চারটা বেলুনের কারখানা, আর বিনা-পয়সায় লোককে বেলুন বিতরণ করা হচ্ছে। বেলুন বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে কথার ফানুস। চারটি কারখানা বলতে বোঝানো হয়েছে রাষ্ট্রের তৎকালীন চার মূলনীতি। কথার ফানুস দিয়ে, আর নানা রঙচঙ দেখিয়ে মানুয়ের দৃষ্টিকে ঘোলাটে করে রাখারই একটি প্রতীক ছিলো এই নাটক।

মাহবুব জামিল তাই লিখছেন, ‘স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের নাটক জীবনবিমুখ নয়, সমাজচ্যুত নয়। বরং জীবনের, সমাজের রূপই প্রতিবিম্বিত এসব নাটকে। কিন্তু তবুও আমরা যারা সাধারণ দর্শক, পরিতৃপ্ত হতে পারি না। মনের গভীরে দাগ কাটে না এসব নাটক। বিষয়বস্তু সহজ করে বোঝার ব্যাপারে, নিজেকে নাট্যবিষয়ের সাথে একাত্ম করে নিতে, জীবনের ছবি দেখতে সহায়তা করে না এসব নাট্যপ্রয়াস। থেকে যায় আমাদের বোধের বাইরে। কারণ সমাজচিত্র প্রকাশ তথা প্রতিফলিত করতে গিয়ে তরুণ নাট্যকাররা অতিমাত্রায় চমক নির্ভর হয়ে পড়ছেন। ‘

বিজন বাড়ী নেই নাটকটি বাস্তববাদী আর বিমূর্তধারার সংমিশ্রণ। যুদ্ধ পরবর্তী সমাজচিত্র ফুটে উঠেছে সংলাপের মধ্য দিয়ে। যেমন শহীদ চরিত্রটি বলছে, ‘বিশ্বেস কর তুই, ওকে আমি মারতে চাইনি। দুটো রিভলবার আমি এনে ওর কাছে রাখতে দিয়েছি। দুটোই মেরে দেবে?…হাইজ্যাক করে গাড়ী আনলাম, সেটাও বিক্রি করে দিল। ১৩১ বিজনের সংলাপ, ‘দেশ আমাদের কি দিয়েছে? কেন আমরা এমন হয়ে গেলাম’।১৩২ যুদ্ধ পরবর্তী সময় বিজনকে অস্থির করে তোলে। সে কিছু একটা করবার জন্য ঘর ছেড়ে চলে যায়। যাবার আগে মার জন্য যে চিঠিটি রেখে যায়, তাতে লেখা, ‘পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট। তাই ফিরে যেতে হলো। যা চেয়েছিলাম তা দেশের কাছে পাইনি। আমাদের অনেক ক্ষোভ। পৃথিবীর অবয়ব আমরা বদলে দিতে চাই।

বিজনের লড়াই করতে চাওয়ার মধ্য দিয়ে নাটকটিতে একটি আশাবাদ ব্যক্ত হচ্ছে। যদিও তার রাজনৈতিক কমিটমেন্ট কী-কোন্ ধরনের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে সে পৃথিবীকে পাল্টাতে চায় তার কোনো ইঙ্গিত নেই।সত্তর দশকের শুরুতে যেমন বিমূর্ত ধারার নাটকের দিকেই সকলের ঝোঁক ছিলো বেশি, তেমনি বাস্তববাদী ধারার নাটকও কমবেশি হয়েছে। বাস্তববাদী ধারার মধ্যে সবচেয়ে সহজ-সরল নাটক শেখ আকরাম আলীর লাশ’৭৪ ও আবদুল্লাহ আল-মামুনের সুবচন নির্বাসনে, এখন দুঃসময়, রশীদ হায়দারের তৈল সংকট ও প্রণব চক্রবর্তীর ওদের ডাক দাও। মামুনের নাটক দুটি সে সময় খুবই আলোড়ন তুলেছিলো। নাট্যকার হিসাবে তিনি বিমূর্তধারার নাটক কিংবা দুর্বোধ্য নাটক, রচনার চেষ্টা করেননি, তেমনি নাটকে বক্তব্য দেয়ারও চেষ্টা করেছেন।

শেখ আকরাম আলীর ক্ষেত্রেও একই বক্তব্য খাটে। নাট্যকার আবদুল্লাহ আল-মামুনের এখন দুঃসময় নাটকটি চুয়াত্তরের বন্যার প্রেক্ষাপটে রচিত। নাটকটি চুয়াত্তরের বন্যার পটভূমিতে রচিত হলেও মূল বিষয় আর বন্যার মধ্যে থাকে না। নাটকের শুরুতে নাট্যকার বাংলাদেশের তৎকালীন নানা সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করেছেন নাটকের বিভিন্ন সংলাপের মধ্য দিয়ে। পরবর্তীতে নাটকটি দুজন মানুষের মধ্যকার দ্বন্দ্বে গিয়ে স্থির হয়।

নাটকের প্রধান চরিত্ররা হচ্ছে বেপারী, সোনা, মুন্সি ও জরিনা। বেপারী অর্থাৎ মহাজন বন্যাটাকে কাজে লাগিয়ে ধনসম্পদ বাড়াবার মোক্ষম সুযোগ পেয়েছে, সোনা তার সম্পদের রক্ষক বা পাহারাদার। সোনার ভালোবাসার মানুষ ছিলো জরিনা কিন্তু জরিনার বাবা সোনার কাছে জরিনাকে বিয়ে দেয়নি সোনা গরীব বলে। জরিনার বাপ মারা গেলে জরিনার সৎ মা জরিনাকে বিয়ে দেয় সতীনের ঘরে। বিয়ের কিছুদিন পর স্বামী এক বাচ্চাসহ জরিনাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। জরিনা বাচ্চা নিয়ে অকূলে ভাসে। বানের পানিতে ডুবে জরিনার ছেলেও মারা যায়। সেই বানের সময় জরিনার অসহায়তার সুযোগে মুন্সি জরিনাকে নিয়ে আসে বেপারীর কাছে। চারদিকে পানি তার মধ্যে ছোট একটা টিলায় বেপারীর আস্তানা।

বেপারী জরিনাকে নিজের যৌন লালসার সঙ্গী করে রাখতে চায়। পাহারাদার সোনা জরিনাকে চিনতে পারে। বেপারীর খপ্পর থেকে জরিনাকে বাচাতে শেষ পর্যন্ত সে বেপারীকে হত্যা করে নিজেও বেপারীর হাতে প্রাণ দেয়। নাটকে বেপারীর ধনসম্পদ, নারীর প্রতি লালসা, মুন্সীর কূটচরিত্র এবং এর – পাশাপাশি জরিনার জন্য সোনার অন্তরের প্রেমই বড় হয়ে ওঠে। ১৩৪ নাট্যকারের বক্তব্যের মধ্যে কোনো দুর্বোধ্যতা নেই। নাটকের বক্তব্যে দুর্বোধ্যতা না থাকলেও নানাধরনের অসঙ্গতি রয়েছে। সোনা নাটকে বেপারীকে হত্যা করে তার শোষক চরিত্রের জন্য নয়, জরিনার প্রতি তার লালসার জন্য। নাটকটিতে একজন ব্যক্তির দ্বারা শোষককে উৎখাতের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তা অনৈতিহাসিক, কারণ শোষিতশ্রেণীর মিলিত আন্দোলনের মধ্য দিয়েই শুধু শোষকশ্রেণীকে উৎখাত করা সম্ভব।

শিল্পকলা ও সাহিত্য হচ্ছে জনগণের নৈতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির বাহন। স্বাধীনতার পর এই ব্যাপারটিকে সচেতনভাবে বাংলাদেশের নাট্যকার ও নাট্যদলগুলো গ্রহণ করেনি। কিন্তু দেখা যায়, বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের শতাধিক বছর পূর্বেই অবিভক্ত বাংলায় নাটক রাজনীতির বাহন হয়ে উঠেছিলো। উনিশ শতকে ঈশ্বরচন্দ্র শুধু বাংলা সাহিত্যকে জনমানসে সুপ্রতিষ্ঠিত করেই ক্ষান্ত ছিলেন না, সমাজের দুষিত ব্যাধিগুলোকেও সযত্নে বিতাড়িত করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্রের চেষ্টাতেই বহু বিবাহের বিরুদ্ধে জনমত জাগ্রত হলো, বিধবা বিবাহের আইন পাশ হলো ও তা কার্যকর হতে থাকলো। সমাজ-সংস্কারকগণের তখন প্রধান লক্ষ্যই ছিলো নারীমুক্তি।

সেকালে বাংলার নারীদের অবস্থা ছিলো অত্যন্ত শোচনীয়। নানা ধর্মীয় আচারের নামে তাঁদের ওপর চলতো অমানুষিক অত্যাচার। বঙ্গীয় সংস্কারকগণ প্রথমেই তাই দাবি জানিয়েছিলেন সতীদাহ নিবারণের। সতীদাহ নিষিদ্ধ হওয়ার পর সংস্কারকগণ চেষ্টা করেন বিধবাদের, বিশেষত বালবিধবাদের, ব্রহ্মাচর্যের নিষ্করুণ অত্যাচার থেকে বাঁচাতে।

কুলীনকন্যাদের দুর্গতি মোচনের জন্য তাঁরা বহুবিবাহ- বিরোধী আন্দোলন আরম্ভ করেন। সামাজিক এই জাগরণের ঘটনা যেমন তৎকালীন নাটকের বিষয়বস্তুর মধ্যে স্থান পেয়েছে, তেমনি ঐ সময়ের বিভিন্ন নাটক সমাজ সংস্কার আন্দোলনকে বেগবান করেছে। নিঃসন্দেহে সেসব নাটক ছিলো সাধারণ মানুষের কাছে একধরনের আলোকবর্তিকার মতো। বিশেষ করে নারী মুক্তির প্রশ্নে নাটকগুলো বিরাট প্রভাব ফেলেছিলো বাংলার সমাজ জীবনে। সামন্তপ্রথার নিগড়ে বাঁধা বাংলার সে নাট্যচর্চাও ছিলো এক ধরনের নাট্য আন্দোলন। বিপ্লবের কোনো আকাঙ্ক্ষা তার মধ্যে ছিলো না, ছিলো সমাজ সংস্কারের মূল্যবোধ। সচেতন সুবিধাভোগীদের একাংশের দ্বারা নিজশ্রেণীর বিরুদ্ধেই শুরু হয়েছিলো সে আন্দোলন।

ব্রাহ্মণ রামনারায়ণ তর্করত্ন কুলীনকুলসর্ব্বস্ব নাটক লিখে আপন কুলের ওপর আঘাত হানতে চেয়েছিলেন। রামনারায়ণের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে সংস্কার আন্দোলনের সমর্থনে বহু নাট্যকার এগিয়ে আসেন। সমাজ সংস্কারমূলক বহু নাটক লেখা হয় এ সময়। সমাজসংস্কারক ও নাট্যকারদের মিলিত আন্দোলন শত বছর পূর্বে এভাবেই দানা বাঁধে। মধুসূদন সে সময় একেই কী বলে সভ্যতা এবং বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রোঁ প্রহসন দুখানি লিখে একাধারে নবীন ও প্রাচীন উভয় সমাজেরই বিরাগভাজন হয়েছিলেন। প্রহসন দুখানির একটি শহরকেন্দ্রিক এবং অপরটি ছিলো গ্রামভিত্তিক প্রেক্ষাপটে রচিত।

একটিতে বর্ষিত হয়েছিলো তথাকথিত ইয়ংবেঙ্গলদের মানসিক বিকারের প্রতি সুতীব্র ব্যঙ্গ, আর অন্যটিতে ফুটে উঠেছিলো প্রাচীন সমাজের বাহ্যিক ধর্মীয় গোঁড়ামির অন্তরালে সামন্তসমাজের অবৈধ কামনার ছবি। ফলে তৎকালীন প্রাচীন ও নবীনপন্থী উভয়েই মধুসূদনের প্রতি খড়গহস্ত হলে তাঁকে নাট্যশালা থেকে বিদায় নিতে হয়েছিলো। সমাজসংস্কার বিষয়ক সচেতনতা ও মনোভাব সেকালের সাহিত্যের সকল বিভাগেই কমবেশি ছড়িয়ে থাকলেও, নাটকেই সবচেয়ে বেশি ও সরাসরিভাবে তা ব্যক্ত হয়। নাটকগুলো প্রধানত রচিত হয়েছিলো সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্য নিয়েই।
সাম্রাজ্যশক্তির বিরুদ্ধেও নাটকে বিদ্রোহ ঘোষিত হলো। দীনবন্ধু মিত্র বর্তমান কাল থেকে শত বছর পূর্বেই সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে কলম ধরলেন নীলদর্পণ নাটকে।

নাট্যকার তৎকালীন কৃষিপ্রধান বাংলার কৃষকদের ওপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরেছিলেন এ নাটকে। নীলদর্পণ নাটক রচনার নানা ত্রুটি সত্ত্বেও শাসকদের বিরুদ্ধে সমস্ত দেশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলো এ নাটক দেখে। নাটকটি অনুবাদ করে মধুসূদন দত্ত সুপ্রিমকোর্টের চাকরিটি হারিয়েছিলেন।

জনগণের ওপর এ নাটকের প্রভাব দেখে বিদেশি শাসকগোষ্ঠী এতোই শঙ্কিত হয়েছিলেন যে, নাটকের অভিনয় বন্ধ করতে নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা হলো। বাংলা নাটকের আদি পর্বের সমাজ সংস্কার চেতনা এভাবেই দ্বিতীয় পর্বে জাতীয়তাবাদী চেতনায় রপান্তরিত হলো। নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মধ্যেই বিভিন্ন নাট্যকাররা জাতীয়বোধ জাগিয়ে তুলতে থাকলেন মানুষের মনে-যার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই গিরিশ চন্দ্র ঘোষ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও ক্ষীরোদপ্রসাদের নাটকে। দর্শকদের সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে তাঁদের নাটকগুলো বিরাট ভূমিকা রেখেছিলো।

শত বছর পূর্বে বাংলা নাটকের যে প্রগতিশীল ভূমিকাটি দেখতে পাই, তার মধ্যে যে সাহস, জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার যে প্রয়াস দেখা যায়, স্বাধীনতা পরবর্তী সত্তর দশকের নাট্য আন্দোলনের মধ্যে সে প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করি না। শত বছর পূর্বেও বাংলা নাটক লক্ষ্যহীনভাবে কাজ করেনি। কিন্তু বাংলাদেশে নাট্য আন্দোলনের শুরুতে তার কোনো উদ্দেশ্যই ছিলো না। সেজন্য শতাধিক বছর আগে বাংলা নাটক জনগণের মধ্যে যে জাগরণ সৃষ্টি করতে পেরেছিলো, স্বাধীনতা পরবর্তী সত্তর দশকের নাটক তা পারেনি।

সে সময়কার নাট্যকর্মীরা প্রধানত ভেবেছিলেন প্রযোজনার মান ও প্রয়োগ নিয়ে। তার বাইরে যা প্রাধান্য পেয়েছিলো তাহলো, নিয়মিত নাটক করা, নিয়মিত নাটকের জন্য দর্শক সৃষ্টি করা। কিছু ভালো নাটক লেখা। সেই ভালোটা যে কী সে সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট ধারণা কারো কাছ থেকেই পাওয়া যায়নি। পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে সেটা আমরা খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করবো।

নিজেদের আত্মপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারটি নাট্যকর্মীদের কাছে অধিক গুরুত্ব পাওয়ায় দর্শকের চেয়ে তাঁরা বেশি নির্ভর করেছেন পত্র-পত্রিকা বা প্রচার মাধ্যমগুলোর ওপর। নাটক কাদের জন্য করবেন এ ব্যাপারটি তাই তাঁদের কাছে প্রধান ছিলো না। কোন ধরনের নাটক করে মানুষকে চমক দেয়া যাবে বা প্রচার মাধ্যমগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করা সহজ হবে, সেটাই ছিলো তাদের মূল বিবেচ্য। পঁচাত্তর পর্যন্ত নাটককে তাহলে আমরা কীভাবে মূল্যায়ন করবো?

শাসকদের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিবাদ বা সমালোচনা সব নাটকে না করা হলেও পরোক্ষভাবে শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক মনোভাবের জন্য এক অর্থে এঁরা সকলেই প্রগতিবাদী, জনতার পক্ষের লোক, আবার বিপরীত দিকে শাসকশ্রেণীর বুর্জোয়াশ্রেণীর সংস্কৃতিকে, বুর্জোয়াশ্রেণীর চিন্তাকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করার জন্য, ভাববাদকে প্রশ্রয় দেয়ার জন্য তাঁদের ভূমিকার মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীলতাও রয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তরকালের নাট্যকাররা তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মধ্যবিত্ত দোদুল্যমানতার কারণে একই সাথে প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো-এটাই হলো ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক চরিত্র।

নতুন নাট্যধারা সৃষ্টি সম্পর্কে মনে রাখতে হবে, এসবের পিছনে ছিলো কিছু সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতি, তাগিদ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বাধীনতা পূর্বের নাটকীয় বন্ধ্যাত্ব থেকেই মূলত এর জন্ম। কিন্তু সব সত্ত্বেও জোয়ার দীর্ঘস্থায়ী হলো না। বাহাত্তর থেকে চুয়াত্তর পর্যন্ত এর রেশ চললো। কিন্তু চুয়াত্তরের শেষে এসে মুখ থুবরে পড়লো নতুন নাট্যচর্চা।

বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত অনেক নাটকের দল দেখা গেছে, বারবার নাট্য আন্দোলনের কথাও ঘোষিত হয়েছে কিন্তু নাটকের বিষয়বস্তুর সঙ্গে রাজনীতির কোনো যোগসূত্র তৈরি হয়নি। রাজনৈতিক এই যোগসূত্রটি না হবার কারণ কী। প্রধানত বিজ্ঞান মনস্ক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব এবং সে-সাথে নাট্যচর্চায় রাজনৈতিক নাট্য ঐতিহ্যের সামান্যতম পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা। পিসকাটর যুদ্ধবিধ্বস্ত জার্মানীতে যে রাজনৈতিক নাট্যধারার প্রবর্তন করতে পেরেছিলেন তার কারণ, তিনি রাজনৈতিক নাট্যধারার  ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত ছিলেন। সরাসরি মার্কসবাদী থিয়েটারের সাথে তার পরিচয় থাকার প্রশ্নই ছিলো না কিন্তু বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে ইউরোপের নাটকে যে রাজনীতি প্রতিধ্বনিত হতো, সেই ঐতিহ্য থেকে পিসকাটর বিচ্ছিন্ন ছিলেন না।

পিসকাটর লিখেছেন ‘আমার চিন্তাভাবনায় রাজনৈতিক থিয়েটার যেভাবে গড়ে উঠেছিলো তা কিন্তু কোনও ব্যক্তিগত আবিষ্কার অথবা উনিশশো আঠার সালের সামাজিক পুনঃসমাবেশ নয়। এর শেকড় নিহিত রয়েছে গত শতকে। ১৩৬ পিসকাটর এক যুদ্ধ বিধ্বস্ত পরিবেশে জার্মানীতে রাজনৈতিক নাট্যধারার বিকাশ ঘটান কিন্তু যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের নাট্যকাররা তা পারলেন না। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের সাথে প্রথম মহাযুদ্ধ পরবর্তী জার্মানীর এবং জার্মানীর যুব সমাজের কমবেশি মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। পিসকাটর লিখছেন, ‘ইউরোপ যেমন তার হারানো ঐশ্বর্য এবং মৃত সন্তানদের জন্য অশ্রুসন্তপ্ত, আমার অবস্থাও ছিল ঠিক সেইরকমই।…

রাস্তা ঘাটে সেনাবাহিনীর রেখে যাওয়া অসংখ্য চিহ্ন, ব্যবসার অবস্থাও খুবই খারাপ। বাবার ব্যবসারও তথৈবচ অবস্থা। তার মূলধনের কিছু অংশ যা ওয়ার লোন হিসোবে দিয়ে দিতে হয়েছিল, তা তো যুদ্ধে নিঃশেষিত। কাইজার ভিলহেলমের শাসনে এবং কার্ল হেরষ্কেরিখের সর্বনাশা অর্থনৈতিক নীতিই সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে সর্বস্বান্ত করে ছেড়েছিলো।’মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে একই পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিলো।

বাংলাদেশে যুদ্ধের পূর্বে যারা হত্যা দেখেছে, পাশবিকতা দেখেছে, ধ্বংস দেখেছে এবং পরবর্তীতে দেশের যুদ্ধ বিধ্বস্ত পরিবেশ অবলোকন করেছে তাদের চিন্তায় একটি পরিবর্তন আসতে বাধ্য। বিশেষ করে যারা সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো, শত্রুর প্রাণ হরণ করেছিলো, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলো; তাদের পুরানো চিন্তা এবং স্বভাবে পরিবর্তন স্বাভাবিকভাবেই আসার কথা। যুদ্ধ প্রত্যাগত পিসকাটরের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিলো। নিজ গ্রামে ফিরে আসা সম্পর্কে তিনি লিখছেন, ‘যখন আমি মারবুর্গে ফিরে এলাম তখন আমার লাইব্রেরি, আমার খাতা-পত্র, আমার ঘরের আসবাব সব আগের মতোই ঠিকঠাক জায়গায় রয়েছে। কিন্তু যে বুর্জোয়া মানসিকতার প্রহরায় এগুলি বাঁধা ছিল সেই বাঁধনের ভিত খসে পড়েছে।’

পিসকাটর স্বীকার করছেন তিনি সেই আগের মানুষটি নেই। বুর্জোয়া ব্যবস্থার প্রতি তাঁর ক্রোধ জন্ম নিয়েছিলো। প্রথমে ক্রুদ্ধ এবং পরে ভীত ও হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় বুঝতে পারছিলেন না কী করবেন। তিনি লিখছেন, ‘যুব সমাজের সামনে মানবিক চেতনাসম্পন্ন এমন কোনও নেতা ছিলেন না, যাঁর প্রতি আমরা আস্থা রাখতে পারি, যাঁকে আদর্শ করতে পারি। আমি এবং আমার মতো অনেকেই তখন গভীর হতাশায় আচ্ছন্ন। আমাদের কোনও অভিজ্ঞতা নেই, আছে অন্তহীন হতাশা। পিসকাটর একা নয়, বহু মানুষ বিশেষ করে যুবকদের বিরাট অংশই হতাশায় নিমজ্জিত ছিলো। কিন্তু ঘটনাচক্রে পিসকাটর সে হতাশা থেকে বের হয়ে এসে সত্যকে অনুধাবন করতে পারলেন যখন তিনি মার্কসবাদী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হলেন।

তিনি সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি বুঝতে চেষ্টা করলেন। সে সময়ের নিজের উপলব্ধি সম্পর্কে পরে তিনি লিখেছেন, ‘বুঝতে পারলাম ভাগ্য আসলে কী, কোথায় তার উৎপত্তি। উপলদ্ধি করলাম নিয়তি কোনও অদৃশ্য শক্তি নয়। সেই সঙ্গে বুঝতে পারলাম এতদিন ধরে এক পাপ, এক অন্যায় সংঘটিত হয়েছে। এবং উপলব্ধি দ্বারাই বুঝতে পারলাম কীভাবে অদৃশ্য সেইসব শক্তির ক্রীড়নক হয়ে থেকেছি আমরা।’পিসকাটর প্রথম হাতাশাগ্রস্তদের মতোই ডাডাপন্থীদের উগ্র এবং বিমূর্ত শিল্পচর্চায় জড়িয়ে পড়েন।

কিন্তু রাজনীতির সাথে তাঁর সম্পৃক্ততা ও সমাজবিজ্ঞানের চেতনা তাঁকে এই পথ থেকে ফিরিয়ে আনে। তিনি সে সম্পর্কে বলছেন, ভাবাবেগ কেটে গিয়ে রাজনৈতিক দাবি যখন স্পষ্ট আকার পেল, ডাডাপন্থীদের শিল্পভাবনা তখন স্তিমিত হয়ে এলো। রাজনৈতিক ঘটনাবলী পিসকাটরের উপর ভীষণভাবে প্রভাব ফেলেছিলো। তিনি পরবর্তী সময় যখন শিল্প বা নাটক নিয়ে ভাবতে শুরু করেন তার মধ্যে গুরুত্ব পায় রাজনীতি। পিসকাটর খুব স্পষ্ট করেই তার বর্ণনা দিচ্ছেন, ‘আমাদের মধ্যে শিল্প নিয়ে আলোচনা হতো এবং অবশ্যই তার সঙ্গে যুক্ত থাকতো রাজনীতি। আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌছেছিলাম যে শ্রেণী সংগ্রামের হাতিয়ার হয়ে উঠতে না পারলে শিল্প বিষয়টাই হয়ে পড়ে অর্থহীন।…

জীবনের প্রতি যখন বীতশ্রদ্ধ আমরা, বিশ্বের মুক্তির বার্তা পেলাম। দেখলাম কীভাবে কোন পথে আগে মুক্তি-সর্বহারার সঙ্ঘবদ্ধ লড়াই, ক্ষমতা দখল।…এই বোধ যখন গভীর থেকে গভীরতর হলো আমরা তখন আমাদের শিল্পের ব্যানারে খোদাই করে নিলাম একটাই কথা সংগ্রাম।’ পিসকাটর তাঁর রাজনৈতিক নাটক গ্রন্থে বলছেন, রাজনীতির দিক থেকে আমি ছিলাম অঙ্গীকারবদ্ধ। যুদ্ধ ও তার পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনাবলী পিসকাটরকে যেভাবে রাজনীতির প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ করে তুলেছিলো, বাংলাদেশের নাট্যকর্মীদের মধ্যে সেই রাজনৈতিক অঙ্গীকারটাই দেখা যায় না।

নাটক মঞ্চায়নে রাজনীতি এবং শিল্প দুটোর ওপরই পিসকাটর প্রবল গুরুত্ব দেন। তিনি দৃঢ়ভাবে জানাচ্ছেন, ‘শিল্পের আশু এবং একমাত্র অর্থ কী? শিল্পের উদ্দেশ্য কী? এ ব্যাপারে আমার এখন পরিষ্কার মতামত গড়ে উঠেছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন। শিল্প হবে প্রচারমূলক এবং অবশ্যই শিক্ষামূলক।’রাজনীতির সাথে অঙ্গীকারবদ্ধ থেকেও তিনি হতে পেরেছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নাট্য পরিচালকদের একজন।

কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম দশকের নাট্যচর্চায় কাউকেই আমরা রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হতে দেখি না। রাজনৈতিক ভাবনা চিন্তা থেকে দূরে সরে থেকেই তাঁরা নাটক রচনা ও মঞ্চায়ন করেছিলেন। বাংলাদেশের নাট্য সংগঠকরা খুব দ্রুত উচ্চবিত্ত শ্রেণীতে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন, যাঁদের পিসকাটর উপহাস করে বলতেন ‘রুটি-মাখন’ শ্রেণী; যাঁরা শ্রেণীসংগ্রামের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে লড়াই চালাবার দায়িত্ব সম্পর্কে ছিলেন অচেতন। সমাজতন্ত্রেই মানুষের মুক্তি-পিসকাটর-ব্রেশটের মতো এমন প্রত্যয় পৃথিবীর সকল নাট্যকারের নাও থাকতে পারে। না থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সমাজতন্ত্রের প্রশ্ন বাদ দিয়েও মানুষের মুক্তির প্রশ্নে যিনিই শিল্পমানসম্মত নাটক লিখবেন; তিনিও মহৎ নাট্যকার। বাংলাদেশের নাট্য রচনায় তাও ঘটলো।

সত্তর দশকের প্রথম পর্বে প্রধানত তাঁরাই নাটক লিখতে এলেন, যাঁদের কাছে সমাজের ইতিহাস বা সামাজিক বিবর্তনের নিয়ম আদৌ কোনো চিন্তনীয় বিষয় নয়। ফলে, এমন একটা ব্যাপার দাঁড়িয়ে গেল যে মঞ্চের জন্য যা-কিছু লেখা হচ্ছে সবই যেন নাটক। বহু বছর পূর্বেই ব্রেস্ট লিখেছিলেন, যা কিছুই লেখা যাক না কেন, তাকেই তথাকথিত অর্থে নাটক ভেবে লাভ নেই। শ্লোগান মাখানো নাটকের বাইরের দিকটা যতো বড়, ভিতরটা ততো নয়। ১৪৩ কিন্তু সত্তর দশকের উল্লিখিত সময়ে আমরা শ্লোগান মাখানো নাটকই পেয়েছি বেশি। কালজয়ী নাটক তো বহু দূরের কথা; যুক্তিবাদী, বুদ্ধিদীপ্ত নাটকের সন্ধানও মেলে না।

জনপ্রিয় হবার জন্য, নিজেকে জগত-সভায় অন্যরকম প্রমাণ করার জন্য স্বাধীনতা পরবর্তীকালে যে নাট্যভঙ্গির আমদানি করা হলো, সেটা আর যাই হোক নাটক হয়ে উঠতে পারেনি। ব্রেন্ট এই ধরনের প্রচেষ্টাকে ব্যঙ্গ করে লিখেছিলেন, ‘জনপ্রিয় আবহাওয়া ফিরিয়ে আনার খিদমতগারি চলছে। এটাই মুশকিল। না বুঝে আমদানি।

নেহাতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠার তাগিদ।’তিনি লিখছেন, ‘জনপ্রিয় শব্দটার প্রকৃত অর্থ বোধহয় ততটা জনপ্রিয় নয়। কারণ, অবিশ্বাস্য কিছু ভাঙিয়ে বেশিদিন জনপ্রিয়তা টিকিয়ে রাখা যায় না।  সুখস্বপ্নের ফানুস উড়িয়ে যদি জনপ্রিয়তা হয় তবে সেই জনপ্রিয়তা কখনই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। নাটকে প্রকৃত জীবনের উত্থান-পতন ও সংগ্রামের বিশ্বাস্যতা দরকার। যা অধিকাংশ মানুষের ছবি-তাকেই বাস্তবতার প্রতিনিধি বলা চলে। সেই বাস্তবতার সঙ্গে আসলে জনপ্রিয়তার কোনও বিরোধ নেই। কারণ যা অধিকাংশ জনগণের কথা, তা-ই চিরস্থায়ী জনপ্রিয়। জনপ্রিয় বলতে আমরা বুঝব, বৃহত্তর মানব সমাজের বুদ্ধিগ্রাহ্য বিকাশ তথা প্রগতিশীল ধ্যান-ধারণার উদ্দীপনকে। যা তাদের জীবন পরিচালনার নিশ্চিত নির্দেশক। যা নেতৃত্বের শক্তি জোগাবে।

সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রকৃত আত্মীয়তা গড়ে তুলবে। জীবনের একটি প্রবৃত্তি থেকে অন্য প্রবৃত্তিগুলির সঙ্গে সহজ ও সুস্থ বোঝাপড়া সৃষ্টি করবে। ১৪৬ প্রসঙ্গত এখানে বলে রাখা দরকার, বাংলাভাষায় নাট্যচর্চা, তা সে সখের থিয়েটার, পেশাদার থিয়েটার বা বাণিজ্যিক থিয়েটার যাই হোক না কেন, কার্যত শুরু হয়েছিলো মধ্যবিত্ত বাবুশ্রেণীর হাতে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর বাঙালী সমাজে যে সামাজিক স্তর বিন্যাস ঘটলো, তাতে ঔপনিবেশিক প্রভুদের খুব কাছে এসে নিজেদের খুব আলোকপ্রাপ্ত বলে মনে করতে লাগলেন এই বাবুশ্রেণী।

বাবুশ্রেণীর লোকরা ভদ্রলোকশ্রেণীতে রূপান্তরিত হলেন এবং নাটক বা থিয়েটার তখন এক নবীন আমোদ বিষয়ক বাবুয়ানী প্রতিষ্ঠান হিসাবেই বিবেচিত হলো। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তপ্রসূত মধ্যবিত্তশ্রেণীর মধ্যে যাঁরা থিয়েটারকে আশ্রয় দিলেন এবং যাঁদের প্রশ্রয়ে বাংলা থিয়েটার গড়ে উঠলো, যেমন রামজয় বসাক, আশুতোষ দেব, কালীপ্রসন্ন সিংহ, নবীনচন্দ্র বসু, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, শরৎকুমার ঘোষ এবং পাথুরিয়াঘাটা, বেলগাছিয়া, জোড়াসাঁকো, শোভাবাজার প্রভৃতি থিয়েটারপ্রেমী বাবুরা কেউই সেই অর্থে বর্ণশ্রেষ্ঠ কুলীন ব্রাহ্মণ ছিলেন না। শুধুমাত্র সম্পত্তি, অর্থ এবং সামন্ততান্ত্রিক-ধনতান্ত্রিক ভাবাদর্শের অনুপ্রেরণায় থিয়েটার চর্চার সূত্রে তাঁরা সমাজে আপনশ্রেণীর নেতৃত্ব জারি করতে চাইলেন, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমাজসংস্কারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন।

অর্থ ও সম্পত্তির ওপর ভর করেই এবং বুর্জোয়া সংস্কৃতির ওপর সম্পূর্ণতই নির্ভরশীল হয়ে যে থিয়েটারের জন্ম, গোড়াতেই তার মধ্যে এমন এক আপাত বিরোধিতা দেখা দিলো যে জন্মমুহূর্ত থেকেই সে প্রতিবন্ধীরূপে আত্মপ্রকাশ করলো।  বাংলাদেশের থিয়েটারের ক্ষেত্রেও এ কথা সমানভাবে প্রযোজ্য। নাটক এখানে সবসময়ই পরস্পরবিরোধী চিন্তা দ্বারা পরিচালিত হচ্ছিলো। মধ্যবিত্ত মানসিকতার দ্বারা এর জন্ম হয়েছিলো বলেই ব্যাপারটা এমন ঘটেছিলো। বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে যে মধ্যবিত্তদের দ্বারা সে মধ্যবিত্তরা আসলে কারা? কী তাদের শ্রেণীচরিত্র সেটাও এ অধ্যায়ে আমরা বিচার করে দেখবো।

ইংল্যাণ্ডে পুঁজিবাদী বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে বুর্জোয়ারাই ছিলো মধ্যবিত্ত। তখন পুঁজিবাদী সঞ্চয় ও শোষণ থেকেই তারা সম্পদের মালিক হয়। ভূমি নির্ভর বা ভূ- স্বামীদের নিয়ন্ত্রণে না থেকে বুর্জোয়ারা নতুন একটি শ্রেণী, স্বাধীন মধ্যবিত্তশ্রেণী হিসাবে আবির্ভূত হয়। মূলত ইংল্যাণ্ডে শিল্প-বাণিজ্যের প্রসার ও সামাজিক তথা শ্রমসম্পর্কিত পৃথক ব্যবস্থার উদ্ভব হওয়ার ফলেই সেখানে মধ্যবিত্ত এই শ্রেণীর উদ্ভব আমরা লক্ষ্য করি। কালক্রমে অর্থ, শিক্ষা ও শক্তিতে বলীয়ান হয়ে এই নতুন সমাজশ্রেণী রাষ্ট্রনীতি ক্ষেত্রে বিপ্লব নিয়ে আসে এবং বিপ্লবের ফলে মধ্যবিত্তশ্রেণী রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে।

ইউরোপে এই মধ্যবিত্তরা উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অনুসারী ছিলো এবং আদর্শ হিসাবে এ শ্রেণী মুক্তবুদ্ধি ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের ধারক বাহক ছিলো। সেদিক থেকে এরা ছিলো এক নতুন যুগের স্রষ্টা। মানুষের চিন্তার স্বাধীনতার এরাই ছিলো প্রবর্তক। পরবর্তী সময় বুর্জোয়াদের আর মধ্যবিত্তশ্রেণীর মধ্যে ফেলা হতো না। বুর্জোয়া হলো সমাজের উচ্চবিত্তরা। ইংল্যাণ্ডে বা অন্যান্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রে এবং পৃথিবীর প্রধান প্রধান দেশগুলোতে বুর্জোয়ারাই সর্বোচ্চ মর্যাদা ভোগকারী ও প্রভাবশালীশ্রেণী এবং সেইসব দেশে মধ্যবিত্তশ্রেণী বলতে বোঝায় বুর্জোয়াদের থেকে ভিন্ন এক শ্রেণীকে।

বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যে-কোনো রাষ্ট্রে বিত্তবান ও বিত্তহীন এ দুটি প্রধান শ্রেণীর মধ্যবর্তী স্তরে অস্তিত্বশীল অভিন্ন স্বার্থের জনসম্প্রদায়কেই সাধারণত মধ্যবিত্ত বলা হয়। যারা প্রতিটি শ্রেণীবিভক্ত সমাজে বিত্তবান ও বিত্তহীন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংযোগ সেতু হিসাবে কাজ করে। সেই বিচারে কায়িকশ্রম পরিহারকারী ও অপরের শ্রম আমানতকারী অথবা কায়িক শ্রমজীবীদের শ্রমের ওপর প্রধানত নির্ভরশীল এবং প্রচুর বিত্ত বা বৃহদায়তন উৎপাদন উপকরণের মালিকহীন ব্যক্তিকেই আমরা মধ্যবিত্তশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করতে পারি। শিল্প-বাণিজ্য প্রভৃতিতে প্রত্যক্ষ কায়িকশ্রমে নিয়োজিত লোকদের পরিশ্রম-জাত সম্পদের একটি অংশ এই শ্রেণী ভোগ করে অথচ এরা নিজেরা সাধারণত কোনো কায়িকশ্রমের কাজ করে না।

বুদ্ধি অথবা বিদ্যা এদের প্রধান অবলম্বন। মধ্যবিত্তশ্রেণীকে কাজের বিচারে আবার চারটি উপভাগে ভাগ করা যায়। বাণিজ্যিক মধ্যবিত্ত, শিল্পাশ্রয়ী মধ্যবিত্ত, ভূমি নির্ভর মধ্যবিত্ত ও পেশাজীবী মধ্যবিত্ত। মধ্যবিত্তকে আর্থিক অবস্থানের বিচারেও আবার তিন ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। উচ্চ-মধ্যবিত্ত, মধ্য-মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীকেও এসব উপবিভাগে বিন্যস্ত করা চলে।

বর্তমান যুগে সামাজিক বিবর্তনের চরম ফলশ্রুতি হচ্ছে মধ্যবিত্তশ্রেণীর বিকাশ। বস্তুত এ যুগের সমাজ ব্যবস্থায় মধ্যবিত্তশ্রেণীই রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় প্রাধান্য বিস্তারকারী গোষ্ঠী। ভারতে মধ্যবিত্তশ্রেণীর সৃষ্টি হয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য শক্তির স্বার্থে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা ভূমির সঙ্গে সম্পর্ক রহিত একদল লোককে ভূমির মালিক বানিয়ে ইংরেজরা নিজেদের রাজ্য শাসনের ইমারত গড়ে তোলে। তাদের ওপর ভর করে ইংরেজদের ভারত শাসন হয়েছিলো নিরাপদ, নির্ভয় ও অত্যাচারে নিঃশঙ্ক।

চিরস্থায়ী জমিদারী ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর ভারতীয় বণিকরা বাণিজ্য সূত্রে সংগৃহীত পুঁজি শিল্প-কারখানা গড়ে তোলায় ব্যবহার না করে জমিদারী ক্রয় করে। স্থানীয় ব্যবসায়ী, ব্যাংকাররা শিল্প-পুঁজি বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করে এবং জমিদারি ক্রয়ের মধ্য দিয়ে সম্মান লাভের কথা ভাবে। ইংরেজ শাসনে পূর্বের জমিদাররা তাদের জমিদারি হারায় এবং উঠতি পুঁজিপতিরা জমিদারে রূপান্তরিত হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে এভাবেই ব্রিটিশ শাসন এদেশে সামন্তবাদকে নবজীবন দান করে।

ইংরেজ শাসন একদিকে যেমন দেশীয় পুঁজির বিকাশকে রোধ করে তেমনি নিজেদের শাসনের পক্ষে একটি শক্তিশালী দেশীয় শ্রেণী সৃষ্টি করে, যারা ব্রিটিশদের বাণিজ্যিক স্বার্থের রক্ষক হয়ে দাঁড়ায়। এরাই ভারতের প্রথম মধ্যবিত্তশ্রেণী। ইংরেজদের সামাজিক স্বার্থে যে মধ্যবিত্তশ্রেণীর আবির্ভাব হলো তারা ব্রিটিশ শাসনকে গ্রহণ করলো বিধাতার আশীর্বাদ হিসাবে। এই মধ্যবিত্তরা ইংল্যাণ্ডের প্রথম যুগের মধ্যবিত্তদের মতো স্বাধীন চিন্তার আধিকারী ছিলো না। সামন্ততন্ত্র পতনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনভাবে তাদের বিকাশ ঘটেনি, নিছক স্বার্থ প্রণোদিত হয়ে ব্রিটিশ জাতি ভারতে তাদের নিয়ন্ত্রিত অনুগ্রহ ভিখারি মধ্যবিত্তশ্রেণীর সৃষ্টি করেছিলো।

 

google news , গুগল নিউজ
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

পাশ্চাত্যের শিক্ষা ভারতবাসীকে যা কিছু দিয়েছিলো তা কেবল ব্রিটিশ বেনিয়াদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাহিদা মেটাবার উদ্দেশ্যে। ব্রিটিশ শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য ছিলো জনশিক্ষার প্রসার কিংবা দেশের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন নয়, রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্মচারীর চাহিদাপূরণ। শাসকদের বৈষয়িক স্বার্থ রক্ষাকল্পে শাসক ও শাসিতের মধ্যে দোভাষীর প্রয়োজন মেটানোর তাগিদে এদেশীয়দের মধ্যে ইংরেজি ভাষার আধুনিক শিক্ষাদান শুরু হয়। ইংরেজি শিক্ষানীতির অন্যতম প্রবক্তা মেকলে আশা করেন যে এ শিক্ষা ব্যবস্থায় ভারতে এমন একটি শ্রেণীর সৃষ্টির হবে যারা রক্তে ও গায়ের রঙে ভারতীয় হলেও রুচি, মূল্যবোধ ও বুদ্ধিবৃত্তির দিক দিয়ে ইংরেজদের অনুসারী হবে। যারা হবে নিজ স্বার্থেই ইংরেজদের স্বার্থ রক্ষাকারী। ভারতের পেশাজীবী মধ্যবিত্ত বলতে আমরা ব্রিটিশ শাসকদের প্রবর্তিত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং তাদেরই সৃষ্টি এবং স্বীকৃত পেশা সমূহে নিয়োজিত গোষ্ঠীটিকেই বুঝে থাকি।

ইংল্যাণ্ডে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনই আধুনিক মধ্যবিত্তের উদ্ভব ও বিকাশের মূল ভিত্তি ছিলো। বাংলাদেশে বা ভারতে অর্থনৈতিক বা প্রযুক্তিগত পরিবর্তন অপেক্ষা উপনিবেশবাদী ইংরেজ শাসকদের প্রবর্তিত আইন, প্রশাসন ও শিক্ষা ব্যবস্থাই মধ্যবিত্তদের উদ্ভব ও বিকাশে প্রধান ভূমিকা পালন করে। ইংল্যাণ্ডের বা ইউরোপের অনুরূপ মধ্যবিত্তশ্রেণী ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে বা পরে এ উপমহাদেশে পাওয়া যায় না। মধ্যবিত্তরা ইউরোপের মতো স্বাধীন ভূমিকা পালন করতেও সমর্থ হয় না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে শাসন ক্ষমতা লাভ করার পর থেকে শাসকদের অনুগ্রহপুষ্ট যে মধ্যবিত্তশ্রেণীর উদ্ভব ও বিকাশের প্রক্রিয়া এখানে শুরু হয়, পাকিস্তান আমল পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। ভারতে বাঙালীদের মধ্যে থেকেই এই শ্রেণীটির প্রথম বিকাশ আরম্ভ হয়।

প্রাথমিক যুগে এই মধ্যবিত্তরা ইংরেজ বণিকের এজেন্ট, গোমস্তা, মুৎসুদ্দি বা দেওয়ান রূপে ইংরেজ রাজশক্তির একান্ত বশংবদ সার্থক ভৃত্যে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো। তাদের জীবিকা তথা বৈষয়িক জীবনের উন্নতি ছিলো সর্বতোভাবে ব্রিটিশ বণিকদের করুণানির্ভর। দেশীয় জনসাধারণ ও সমাজ জীবনের সঙ্গে তারা আত্মিক মিল অনুভব করেনি, দেশের হয়েও এরা কাজ করেনি। বলাবাহুল্য এই শ্রেণীটিই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে মূল স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।

ব্রিটিশ শাসনকালে বর্তমান বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা আধুনিক শহর হিসাবে গড়ে ওঠার সুযোগ পায়নি। এর ফলে এই শহর আধুনিক মধ্যবিত্তশ্রেণীর বিকাশে তখন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। কলকাতা কেন্দ্রিক গড়ে ওঠা মধ্যবিত্তরা প্রধানত ছিলো হিন্দু সম্প্রদায়। মুসলমান বাঙালীরা তখন অনেক পিছিয়ে। মুসলিম শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের উদ্ভব হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের চেয়ে একশত বছরেরও অনেক পর।

মুসলিম মধ্যবিত্তরা হিন্দুদের মতোই শিল্প বা ব্যবসা বাণিজ্যের চেয়ে সরকারি চাকরিকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে বিশ শতকের প্রথম দিকে অন্যান্য অনেক বিষয়ের মতো ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারে কিছুটা সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা লাভের পর এই সুযোগ সুবিধা অনেকটা সম্প্রসারিত হলেও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের অনুসৃত অসম অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নীতি এবং অবাঙালী- মুসলমানদের আধিপত্যের কারণে স্থানীয় মুসলমানরা খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি।

পাকিস্তান জন্ম লাভের পর আবাঙালী ব্যবসায়ী এবং আমলাশ্রেণী এদেশের মূল নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা পায়। নতুন রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পৃষ্ঠপোষকতা তারা লাভ করে। সাতচল্লিশ সালে দেশ বিভাগের পর প্রাদেশিক রাজধানী হিসাবে স্বীকৃত হলেই কেবল ঢাকা একটা মফস্বল শহর থেকে আধুনিক নগরে রূপান্তরিত হতে থাকে। সে সময় সামান্য কজন বাঙালী মুসলমান শিল্প উদ্যোক্তা পশ্চিমবঙ্গ আসাম প্রভৃতি স্থান থেকে বাংলাদেশে এসেও সেভাবে প্রভাবশালী হতে পারেনি।

বাঙালী মুসলিম মধ্যবিত্তদের ব্যবসা-বাণিজ্যের পূর্ব ঐতিহ্য না থাকায় তাদের হাতে পুঁজি তেমন সঞ্চিত হয়নি। প্রযুক্তিগত শিক্ষাদীক্ষা ও অভিজ্ঞতাও তাদের ছিলো না বললেই চলে। সহজে পুঁজি সঞ্চয়ের আকাঙ্ক্ষাতেই মধ্যবিত্তদের একটি অংশ এসময় ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক হয়ে ওঠে, কেউ কেউ বিরোধী শিবিরেও চলে যায় একই উদ্দেশ্য নিয়ে। ষাটের দশকে মাত্র কিছু সংখ্যক প্রাক্তন সরকারি আমলা ও কতিপয় ব্যবসায়ী ইন্ডেন্টিং, কমিশন এজেন্সি, ঠিকাদারী প্রভৃতি মূলধনহীন ব্যবসায়ে লিপ্ত হবার সুযোগ পায়।

কেন্দ্রীয় সরকারের বশংবদ একটি বাণিজ্যিক বাঙালী মধ্যবিত্তশ্রেণী গড়ে তোলার লক্ষ্যেই এটা করা হয়। একদিকে পুঁজি ও অভিজ্ঞতার অভাব অন্যদিকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কাঁচা পয়সা উপার্জনের সুবিধা থাকায় বাঙালী মুসলমানরা পাকিস্তান আমলে খুব বেশি শিল্প- কারখানার ঝুঁকি নিতে যায়নি বলে বাংলাদেশে সে সময় বেশি সংখ্যক শিল্পাশ্রয়ী মধ্যবিত্তের উদ্ভব ঘটতে পারেনি।

উনিশশো একাত্তর সালে স্বাধীনতা লাভের পর অবাঙালী বহিরাগত ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা তাদের নেতৃত্ব হারায়। এই বিশেষ পরিস্থিতিতে বাঙালী মুসলিম মধ্যবিত্তের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। কারণ বাংলাদেশের মধ্যবিত্তশ্রেণীতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রশ্নাতীত বিষয়। এদের বেশিরভাগ কৃষকদের মধ্য থেকে উদ্ভূত হলেও পরবর্তীতে ব্যবসা-বাণিজ্যে সম্পৃক্ত হয়ে পরে। সেক্ষেত্রে কেউ বৃহদায়তন উৎপাদনের উপকরণের মালিক অথবা প্রচুর বিত্তের অধিকারী হলে তাকে আর মধ্যবিত্ত বলা যায় না। মধ্যবিত্তদের প্রধান অংশ সেক্ষেত্রে পেশাজীবীদের অন্তর্ভুক্ত। এই মধ্যবিত্তদের প্রধান লক্ষ্য আত্মপ্রতিষ্ঠা এবং বিত্তের সন্ধানে নিজেদের ব্যস্ত রাখা।

সেই একই লক্ষ্যে ব্রিটিশ আমল থেকেই মধ্যবিত্তরা শাসকশ্রেণীর সেবাদাস এবং অনুরক্ত। শাসকশ্রেণীর পক্ষে থাকাটাই মূলত তাদের বিত্ত বাড়াবার প্রধান অবলম্বন। ব্রিটিশরা যেমন মধ্যবিত্তশ্রেণীকে গড়েই তুলেছিলো শাসকশ্রেণীর স্বার্থকে সেবা করার জন্য, মধ্যবিত্তরা তেমনি তারপর থেকে সব শাসনামলেই নিজেদের ভাগ্য গড়ে তুলবার জন্য শাসকশ্রেণীর সেবা করে গেছে। যদিও তারা কখনও কখনও শাসক পরিবর্তনের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তবে সে আন্দোলন কখনও শ্রেণীগতভাবে শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে ছিলো না। মধ্যবিত্তরা সেক্ষেত্রে শুধু নিজেদের স্বার্থেই এক শাসকের জায়গায় অন্য শাসককে ক্ষমতায় বসাতে চেয়েছে। নিজেদের শ্রেণীস্বার্থেই।

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন বা পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মধ্যবিত্তদের সৃষ্ট আন্দোলন ছিলো মধ্যবিত্তশ্রেণীর আরো সুযোগ সুবিধা লাভেরই আন্দোলন। সেই কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর মধ্যবিত্তরা মূলত নিজেদের আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামেই বেশি ব্যস্ত ছিলো সকল মধ্যবিত্তদের মতোই। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষকতা-সাংবাদিকতা, সরকারি চাকরি সর্বক্ষেত্রেই তাই ঘটেছে। মধ্যবিত্তশ্রেণীর লোকরাই এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সামাজিক নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত। তাদের মধ্যে দু একজন মানবীয় গুণাবলীতে সমাজের শীর্ষ স্থানীয় এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় মধ্যবিত্তশ্রেণী থেকেই সাধারণত বরেণ্য-নেতা, সমাজ সেবক ও সংস্কৃতি কর্মীর জন্ম হয়েছে সবদেশে এবং এদেশেও। বিশেষ করে বাংলাদেশ এমন এক অদ্ভুত দেশ সর্বস্তরেই যেখানে প্রাধান্যে রয়েছে মধ্যবিত্তশ্রেণী।

কেননা দীর্ঘদিন পরশাসনে থাকায় নিজস্ব অভিজাতশ্রেণী যেমন গড়ে ওঠেনি, তেমনি গড়ে ওঠেনি বুর্জোয়াশ্রেণী। তাই তার ললাটে মধ্যশ্রেণীর প্রাধান্য। বর্তমানে রাষ্ট্র প্রধান থেকে শুরু করে সচিব, ব্যবস্থাপক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক প্রভৃতি মধ্যবিত্তশ্রেণীর অংশ • হিসাবেই যেমন দেশের অগ্রবর্তী নাগরিক তেমনি সর্বোচ্চ সামাজিক মর্যাদার অধিকারী। এদের মূল প্রবণতাই হচ্ছে আত্মপ্রতিষ্ঠা। তাদের ত্যাগের পেছনেও বেশির ভাগ সময়ই কাজ করে সেই প্রবণতা।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ মধ্যবিত্তের ক্ষেত্রেই ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবোধ, ভাবপ্রবণতা ও সংকীর্ণ স্বার্থপরতা সাধারণ লক্ষণ। ধর্ম-রাজনীতি-সমাজ-সংস্কৃতি প্রতি ক্ষেত্রেই মধ্যবিত্ত মনোবৃত্তি ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও আত্মসর্বস্ব। সকল বিপদ-আপদ থেকে নিজেদের বাঁচাবার জন্য যেমন এরা ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ স্বার্থের গণ্ডিতে বাধা তেমনি সেজন্য তারা যে- কোনো ধরনের পথ বেছে নিতেও দ্বিধা করে না। এদের চরিত্রে যেমন রয়েছে একদিকে নিম্নশ্রেণীর মানুষের প্রতি অশ্রদ্ধা ও অবজ্ঞা, শ্রম-নির্ভর মানুষদের থেকে নিজেদের আলাদা করে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা, তেমনি বিত্তবানদের শ্রেণীতে যে-কোনো উপায়ে অনুপ্রবেশের আকুলতা। স্বার্থপরতা, পরমত অসহিষ্ণুতা, মিথ্যাচার, শঠতা ও প্রবঞ্চনার আশ্রয় গ্রহণ তাদের সহজাত প্রবণতার মধ্যেই পড়ে। সেইজন্য কাজের সঙ্গে কথার অসঙ্গতি এদের মজ্জাগত।

মধ্যবিত্ত মানসিকতার কারণেই তাদের একাংশ সমাজ সংস্কারমূলক সৃজনধর্মী কর্মকাণ্ডে অগ্রসর হলেও যথার্থ প্রগতিশীল ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের ক্ষেত্রেও সেই সত্য প্রতিষ্ঠিত। মধ্য মানসিকতা বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের শুরু থেকেই কাজ করছিলো। নাট্যকর্মী ও দর্শক উভয়ই মধ্যবিত্তশ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিলো।

সাধারণভাবেই মধ্যবিত্তশ্রেণী বিত্তবানদের সংস্কৃতির অনুসারী। নিজেও বিত্তবান হবার প্রচেষ্টায় লিপ্ত, কেউ কেউ ক্ষিপ্ত। তাই সত্তর দশকে গ্রুপ থিয়েটার কর্মীরা সৃজনধর্মী কর্মকাণ্ডে অগ্রসর হলেও শ্রেণীচরিত্রের কারণেই নাট্য আন্দোলনে যথাযথ প্রগতিশীল ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীচরিত্র থেকে উদ্ভূত সুবিধাবাদ নাট্য আন্দোলনকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। দর্শকদের কোনো দিক নির্দেশনা দিতে পারেনি। এমনকি দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবোধের চেতনাও গড়ে তুলতে পারেনি। নাট্য আন্দোলনের সংকটের কারণও এর মধ্যেই নিহিত। নাট্যকর্মী ও নাট্য- চিন্তাবিদদের বিভিন্ন লেখনীতেও এই সত্য বের হয়ে এসেছে যে, দর্শকদের সচেতন করার জন্য নাটক কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না।

 

রাজনৈতিক নাট্যচিন্তা ও স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের মঞ্চনাটক | সূচিপত্র

 

পরাধীন ভারতে বাংলার মধ্যবিত্ত বাবুরা নাটককে আমোদ-প্রমোদের বিষয় করে তুলতে চাইলেও, কিছুকাল পেশাদার থিয়েটারে দর্শক রঙ্গমঞ্চ থেকে আনন্দ পেয়েছে, শিক্ষা পেয়েছে, জাতীয়তার প্রেরণা পেয়েছে। বিশেষ করে ভারতের স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গের মধ্যবিত্তরা নাটকে কিছুটা হলেও প্রগতিশীল ভূমিকা রেখেছিলো কিন্তু বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত নাট্যকর্মীরা সেটুকু ভূমিকা রাখতেও ব্যর্থ হয়।

বাংলাদেশের মধ্যবিত্তদের নাট্য আন্দোলনের শুরুতে প্রগতিশীল ভূমিকা না রাখতে পারার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। এখানে স্মরণ রাখতে হবে, ভারতে গণনাট্য সংঘ কিংবা রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলন জন্ম নেয়ার পেছনে ভূমিকা ছিলো ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির। বাংলাদেশে যে নাট্যচর্চা শুরু হয় তার পেছনে মার্কসবাদী কোনো দল কিংবা কোনো ধরনের কোনো রাজনৈতিক দলের ভূমিকা ছিলো না। স্বাধীনতা পরবর্তী নাট্যচর্চার ধারা গড়ে উঠেছিলো সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে। সারা বিশ্বেই মার্কসবাদী চিন্তা ও মার্কসবাদী দলগুলোর প্রভাবে সেখানকার রাজনৈতিক নাট্যধারা বা এ্যাজিটপ্রপগুলো জন্ম নেয়। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পূর্বে ও পরে মার্কসবাদী নানা দল থাকলেও তাদের অধীনে যেমন কোনো নাট্যচর্চা বা নাট্য আন্দোলন গড়ে ওঠেনি, স্বাধীনতার পরে গড়ে ওঠা নাট্যচর্চায়ও তাদের তেমন কোনো ভূমিকা বা প্রভাব ছিলো না।

বিভিন্ন দেশে যেমন দেখা যায়, শিল্পী সাহিত্যিকরা মার্কসবাদী দলগুলোর প্রেরণাতেই শিল্প-সাহিত্যকে রাজনীতির প্রয়োজনে ব্যবহার করতে শেখে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঘটেছে ঠিক তার উল্টো, মার্কসবাদী দলগুলোই এখানে নাট্যকর্মীদের কাজ দেখে প্রথম উপলব্ধি করে শিল্প-সাহিত্যকে রাজনীতির প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায়। মার্কসবাদী দলগুলো এ ব্যাপারে কোনো অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারেনি, নিজেদেরকে এ আন্দোলনের সাথে জড়াতে পারেনি। বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলন কোনো মার্কসবাদী দলের অধীন না থাকায় যেমন এঁরা মার্কসবাদকে এঁদের আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেননি, তেমনি নাট্যচর্চা কোনো মার্কসবাদী রাজনৈতিক দল দ্বারা পরিচালিত ছিলো না বলেই এঁদের চিন্তা চেতনার মধ্যে সমাজবিজ্ঞান বোধ এবং রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে ওঠেনি। পঁচাত্তর পর্যন্ত মঞ্চায়িত তাঁদের নাটকের বিষয়বস্তুই সে কথা প্রমাণ করে।

উনিশশো পঁচাত্তর পরবর্তী নাটকে আমরা লক্ষ্য করি ভিন্ন একটি অধ্যায়। রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার সূত্রপাত তখনও আরম্ভ না হলেও পঁচাত্তর সালের পর নাটক আর আগের ধারায় আগালো না। স্বাধীনতার পরপরই মঞ্চায়িত নাটকগুলো প্রথম চমক সৃষ্টি করলেও, নাটকের প্রতি মানুষের আগ্রহ জন্মালেও, খুব শীঘ্র এ নাটকের দোষ ত্রুটিও ধরা পড়তে লাগলো। নাট্যচর্চার প্রথম যে দুর্বলতা চোখে পড়ে তা হলো নাট্যরচনা। দেখা যায় বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর সাল পর্যন্ত নাটক লেখা হয়েছে ন্যূনতম একশো চুয়াত্তরটি। এসব নাটকের বড় একটা অংশই মঞ্চায়িত হয়নি। যেগুলো মঞ্চায়িত হয়েছে, নাটকের বক্তব্য মনে হতে থাকলো অর্থহীন ভাষার কচকচি। রূপকধর্মীতা একে আরো জটিল ও দুর্বোধ্য করে তুললো।

খুব শীঘ্রই এই রূপকভঙ্গি বা উদ্ভট নাটকের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখা দিলো। নাটকের সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দিয়েছিলো সে আর নতুন কিছু বলতে পারছিলো না। পুরনো কথারই পুনরাবৃত্তি হচ্ছিলো। স্বাভাবিকভাবেই তখন দর্শক সে নাটক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো, কারণ নাটক হয়ে পড়েছিলো নিষ্প্রভ ও প্রাণহীন। নাট্য আন্দোলন শব্দটা তখন খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু সেই ধরনের কোনো আন্দোলনের জোয়ার দেখা যায় না।

 

সত্তরের দশক: নাট্য আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্ব ও গতিধারা [ পর্ব ৩ ]

সত্তরের দশক: নাট্য আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্ব ও গতিধারা [ পর্ব ৩ ]

 

স্বাধীনতা লাভের পরপর কী ঘটেছিলো আসলে? জাতীয় আন্দোলনের তরঙ্গে আন্দোলিত সবাই এবং সে অবস্থায় অসংখ্য ছোটখাটো বিক্ষোভ, বিদ্রোহ নাটকে রূপান্তরিত হতে চাইলো। দেশের আর্থিক অবস্থার ক্রম অবনতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অবশ্যম্ভাবী ফলরূপে দেখা দিলো গণরোষ। দেশব্যাপী নৈরাশ্য ও ক্রোধের প্রতিক্রিয়া হলো প্রবল। নাটকগুলোতে তার সামান্য প্রতিফলনেই যুবসমাজ, নাগরিক দর্শক চমকিত হলো-নিজেদের মধ্যকার ক্রোধের কারণে তারা নাটকগুলোর পক্ষ নিয়েছিলো, সমর্থন যুগিয়েছিলো; কিন্তু মাথা ঠাণ্ডা করে বুঝে উঠতে পারেনি, সেগুলো সত্যিই নাটক হয়ে উঠেছিলো কি না।

কিন্তু একইরকম নাটক যখন বারবার হতে থাকলো, তখন দর্শকদের হুশ হলো-কী হচ্ছে এসব। দর্শক তখন ঐসব নাটক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। রাজনৈতিক বা সামাজিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্রোধ কখনই বৈপ্লবিক উত্তরণে পৌছায় না। ক্রোধের প্রকাশ দর্শককে অল্পক্ষণের জন্য উদ্দীপ্ত করতে পারে; কিন্তু সমাজ বিশ্লেষণের নাটক তাকে ভাবতে শেখায়। ক্রুদ্ধ নাটকের ফল তাৎক্ষণিক, বিশ্লেষণাত্মক নাটকের ফল সুদূরপ্রসারী।

স্বাধীনতার পর নাটকের জগতে অপসংস্কৃতি দূর করার শ্লোগান শোনা গিয়েছিলো। যাঁরা অপসংস্কৃতি দূর করার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাঁরা নিজেরাও ভালো জানতেন না কোন নাট্য-সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে হবে। শহরের উন্নাসিক পাতি-বুর্জোয়া মানসিকতার দর্শককে আকৃষ্ট করার জন্য ভাববাদী দর্শনের দারস্থ হতে হয়েছিলো নাট্যদলগুলিকে; ফলে রাজনীতি থেকে দূরে সরে থাকলো। বহু জনই মনে করে থাকেন দর্শক নাটকে রাজনীতির কচকচানি পছন্দ করে না। কিন্তু ব্যাপারটি একেবারেই সত্যি নয়। পিসকাটর প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে, বৈপ্লবিক নাটক বক্স-অফিসে রেকর্ড সৃষ্টি করতে পারে।

পিসকাটরের সাফল্যে বুর্জোয়া সংবাদপত্র ফাপড়ে পড়ে যায়, কারণ শিল্পমান নিয়ে পিসকাটরের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ তুলতে পারছিলো না। কারণ রাজনীতি, শিল্প এবং বিনোদন তিনটিরই সমন্বয় ঘটাতে পেরেছিলেন পিসকাটর। কিন্তু সত্তর • দশকের প্রথম পর্বের নাট্য রচনায় এবং দলগুলোর প্রযোজনায় এর কোনোটিরই দেখা মেলে না। যাঁরা স্বাধীনতা পূর্ববর্তী নাটকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঘোষণা করেছিলেন, দেখা গেল হঠাৎ তাঁদের অনেকেই নাট্যচর্চা থেকে সরে দাঁড়ালেন।

যেন একটি যুদ্ধ শেষ করে তাঁরা রণক্লান্ত। পঁচাত্তর পরবর্তীতে নাট্যকারদের মধ্যে যাঁরা সক্রিয় ছিলেন তাঁরা ভিন্ন পথ ধরে আগতে শুরু করলেন পুরানো হতাশার ভঙ্গি বাদ দিয়ে। শেখ মুজিবের মৃত্যুর পরের আরো কতোগুলো ঘটনা, মানুষকে রুদ্ধশ্বাস অবস্থার মধ্যে যেমন নিয়ে গেল, তেমনি দেশ-জাতি সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শেখালো। স্বাধীনতা যুদ্ধের হতাশা কেটে গিয়ে তাই পরবর্তী নাটকে কিছুটা হলেও প্রাধান্য পেল শোষক-শোষিতের দ্বন্দ্ব। সামাজিক বক্তব্যমুখ্য নাট্যধারাই পরবর্তী কিছুকালের জন্য হয়ে উঠলো বাংলাদেশের নাট্য সাহিত্যের প্রধান প্রবণতা। রাজনৈতিক ঘটনাবলীর প্রভাবেই পঁচাত্তর পরবর্তী নাটকে আমরা লক্ষ্য করি ভিন্ন একটি অধ্যায়।

সত্তরের দশক: নাট্য আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্ব ও গতিধারা [ পর্ব ৩ ]

পঁচাত্তর সালের পনেরই আগস্ট সামরিক বাহিনীর কিয়দংশের এক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব সরকারের পতন ঘটে। মুজিব সপরিবারে নিহত হন। ক্ষমতায় আসে সামরিক বাহিনী। রাজনৈতিকভাবে সেটা ঠিক কিংবা ভুল যাই হোক না কেন, শেখ মুজিবকে হত্যা করাটা ন্যায় কি অন্যায় সে বিচারে না গিয়েও বলা যায়-শেখ মুজিবের হত্যার পর আরো কয়েকটি রাজনৈতিক ও সামরিক উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান সরকার যখন তার ক্ষমতাকে সুদৃঢ় করে, তারপর রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে এক ধরনের শৃঙ্খলা ফিরে আসে। জিয়া ক্ষমতা গ্রহণ করার পর সন্ত্রাসী কার্যকলাপ হ্রাস পেয়েছিলো, দ্রব্যমূল্য কিছুটা কমেছিলো, সমাজে কিছুটা স্থিতিশীলতা যেন ফিরে এসেছিলো।

মূল ব্যাপার হলো সামরিক শাসনের চাপে রাজনৈতিক দল ও উগ্র-কর্মীদের দৌরাত্ম্য কমে যায় এবং সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বভাবতই পূর্বের ব্যাপক নৈরাজ্য থেকে দেশ কিছুটা নিষ্কৃতি লাভ করে। এ ছাড়াও বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর সাল পর্যন্ত কালো টাকার যে সমাবেশ হয়েছিলো জিয়া আমলে তাকে বৈধ করার মধ্য দিয়ে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। বিরাষ্ট্রীয়করণ নীতি গ্রহণ করায় ব্যবসায়ীদেরকে শিল্প-কারখানা স্থাপনের জন্য সহজ শর্তে ব্যাংকের দ্বার খুলে দেয়া হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প হিন্দু সম্পত্তি বা পরিত্যক্ত ঘরবাড়ি দখলের মতো নামমাত্র দামে বা বিনা দামে দখল করার ব্যবস্থা হলো। যা পঁচাত্তর সাল পর্যন্ত ছিলো ব্যাপক লুটপাট তা জিয়ার সময় প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মধ্য দিয়ে সংহত রূপ লাভ করে।

জিয়ার শাসনামলে নৈরাজ্য, সন্ত্রাস, রাহাজানি, লুটতরাজ হ্রাস পেলে নাটককে নতুন বিষয়বস্তুর সন্ধানে পথ খুঁজে নিতে হয়। রাজনৈতিক সচেতনতার অভাবের কারণেই স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তী অবক্ষয়ের কারণগুলো যেমন নাট্যকাররা বিশ্লেষণ করতে ব্যর্থ হলেন, তেমনি শেখ মুজিবের পতন বা সামরিক বাহিনীর উত্থানের কারণ বিশ্লেষণ করতেও পরবর্তী নাটকগুলো ব্যর্থ হলো। শেখ মুজিবের পতন ছিলো রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক বিরাট আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। যখন সাংবিধানিকভাবে শেখ মুজিব সকল ক্ষমতা ও আইনের উৎস, সেই সময় পচাত্তরের পনেরই আগস্ট সেনাবাহিনীর একটি বিদ্রোহী গ্রুপ শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের অন্য কয়েকজন সদস্যকে হত্যা করার ঘটনাটি ছিলো আকস্মিক ও বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। ঘাতকদের হাতে নিহত হন তাঁর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেছা, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা আহমেদ ও রোজী, ভ্রাতা শেখ নাসের।

 

সত্তরের দশক: নাট্য আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্ব ও গতিধারা [ পর্ব ৩ ]

 

সেই একই ঘটনায় আরো নিহত হন শেখ মুজিবের সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার জামিল, বাকশালের অন্যতম সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মনি ও তাঁর স্ত্রী, মুজিবের নিকট আত্মীয় ও মন্ত্রী সভার সদস্য আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও পরিবারের অপর দুই সদস্য। শেখ মুজিবের এই হত্যাকাণ্ডের পর বিদ্রোহীদের সমর্থনে রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহচর ও বাকশাল মন্ত্রীসভার সদস্য খোন্দকার মোশতাক আহমেদ। খোন্দকার মোশতাকের মন্ত্রীসভায় পূর্বেকার মন্ত্রীসভার দুই তৃতীয়াংশ সদস্যই মন্ত্রী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। যাঁরা কিছুদিন আগ পর্যন্ত ছিলেন মুজিব ভক্ত তাঁরা এই হত্যাকাণ্ডের পর শেখ মুজিবকে স্বৈরশাসক হিসাবে আখ্যায়িত করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশের আওয়ামী সরকার সবসময়ই দ্বিধাবিভক্ত ছিলো। বিভক্ত দলের একদিকে ছিলেন খোন্দকার মোশতাক অপর পক্ষে তাজউদ্দিন আহমদ। মোশতাক ছিলেন মার্কিন ঘেঁষা আর তাজউদ্দিন ছিলেন সমাজতন্ত্রী। শেখ মুজিব উনিশশো চুয়াত্তর সালে তাজউদ্দিনকে মন্ত্রী সভা থেকে অপসারণ করে খোন্দকার মোশতাককে ক্ষমতায় ধরে রাখেন। সেই মোশতাকই শেখ মুজিবকে হত্যার বড় সমর্থক হয়ে ওঠে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান ও তাজউদ্দিন আহমদ প্রমুখ খোন্দকার মোশতাককে সমর্থন না দেয়ায় তাঁদের বন্দী করে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে জেলখানার মধ্যে এই চারজনকে হত্যা করা হয়। মোশতাকের শাসনকাল ছিলো খুবই স্বল্প সময়ের, মাত্র একাশি দিনের।

খোন্দকার মোশতাক ক্ষমতায় আরোহণ করেই জিয়াউর রহমানকে সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসাবে দায়িত্বভার দেন এবং শেখ মুজিবের হত্যাকরীদের রক্ষা কবচ হিসাবে এক অধ্যাদেশ জারি করেন। তিনি এই অধ্যাদেশ বলে তার ক্ষমতায় আরোহণকে বৈধতা দেন, সামরিক অভ্যুত্থানকে বৈধ ঘোষণা করেন এবং অভ্যুত্থানের ঘটনায় শেখ মুজিব সহ বিভিন্ন ব্যক্তির হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবির পথ রুদ্ধ করে রাখেন। খোন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করলেও মূল রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা থাকে অভ্যুত্থানকারীদের হাতে। বঙ্গভবনে বসে তাঁরা নিজেদের মতো করে দেশ পরিচালনা করতে থাকেন এবং বেশ কিছু ট্যাংক ও দুইশত সৈন্য নিয়ে তাঁরা বঙ্গভবন ঘিরে রাখেন। ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্তারা এতে রুষ্ট হন। সামরিক বাহিনীর শৃঙ্খলা ভেঙে পড়াতে তাঁরা সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে দায়িত্ব দেন অভ্যুত্থানকারীদের সামরিক শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনতে। জিয়া ব্যর্থ হন।

ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে তখন ঘটে দ্বিতীয় অভ্যুত্থানের ঘটনা। পঁচাত্তর সালের নভেম্বর মাসের তিন তারিখে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে খোন্দকার মোশতাক সরকার ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়, সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দী করা হয়, শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতরা দেশ ত্যাগে বাধ্য হন। এই অভ্যুত্থানটি ঘটেছিলো অনেকটা শান্তিপূর্ণভাবে, আপোষরফার মধ্য দিয়ে। খালেদ মোশাররফের এই অভ্যুত্থান ছিলো রক্তপাতহীন।

খালেদ মোশাররফ প্রথম তার ঊর্ধ্বতন, সামরিক বাহিনীর প্রধান জিয়াকে গৃহবন্দী করেন, পরে বঙ্গভবনে এসে খোন্দকার মোশতাককে বাধ্য করেন তাঁকে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসাবে নিয়োগ দেয়ার জন্য। পূর্বের অভ্যুত্থানকারী মেজর ডালিম ও মেজর নূর এ সময় তাঁর পক্ষাবলম্বন করেন। দেখা গেল আগস্টের অভ্যুত্থানকারীদের মধ্যে যাঁরা বঙ্গভবনে অবস্থান করছিলেন তাঁরা যখন বুঝতে পারলেন তাঁদের পক্ষে এই পাল্টা অভ্যুত্থানকে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয় তখন তাঁরা সপরিবারে দেশত্যাগের সুযোগ চাইলেন। খালেদ মোশাররফ রক্তপাত এড়াতে এ প্রস্তাবে রাজি হন। পঁচাত্তরের আগস্টের নায়করা একটা ভাড়া করা বিমানে সপরিবারে দেশ ত্যাগ করলেন।

দেশ ত্যাগের প্রাক্কালে খোন্দকার মোশতাকের নির্দেশে তাঁরা পূর্বোক্ত চারজন নেতাকে জেলখানার মধ্যে নিয়ম বহির্ভূতভাবে হত্যা করে রেখে গেলেন। খালেদ মোশাররফ মাত্র তিনদিন ক্ষমতা ভোগ করেন। খালেদ মোশাররফের এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মোশতাক সরকারের পরিবর্তে বিচারপতি আবু সাদত মোঃ সায়েম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ঢাকা সেনানিবাসে তখন চলছিলো ভিন্ন এক নাটকের অভিনয়।

সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান নভেম্বরের তিন তারিখে বন্দী অবস্থায় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল তাহেরের কাছে ফোনে সাহায্যের দাবি জানান। কর্নেল আবু তাহের ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ও একটি সেক্টরের প্রধান। তিনি স্বাধীন দেশের উপযোগী সেনাবাহিনী গড়ার জন্য রাষ্ট্র প্রধান শেখ মুজিবের নিকট এক পরিকল্পনা পাঠালে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নেন। জিয়াউর রহমানের সাহায্যের আবেদনে আবু তাহেরের নেতৃত্বে সাতই মার্চ সাধারণ সৈন্যদের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে খালেদ মোশাররফ ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত হন। ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হন জিয়াউর রহমান। বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতির পদে বহাল থাকলেও মূল ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে জিয়াউর রহমানের হাতে। শেখ মুজিবকে হত্যা করার পর এভাবেই বাংলাদেশের রাজনীতির একটি অধ্যায় শেষ হয়।

বাংলাদেশের নাট্যকাররা রাষ্ট্রীয় এসব হত্যা, ক্ষমতাদখল, শাসকদের দ্রুত পালাবদলের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব। বাংলাদেশের কোনো নাটকে উল্লিখিত এসব ঘটনার ছায়ামাত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না। রাজনৈতিক ঘটনাবলীকে এড়িয়ে গিয়ে ভিন্ন সব প্রসঙ্গ নিয়ে তাদের নাটকগুলো এ সময় মঞ্চস্থ হতে থাকলো। পঁচাত্তরের পরের কিছু নাটক পর্যালোচনা করলে বা বিভিন্ন সমালোচনা পাঠ করলেই তার প্রমাণ পাওয়া যাবে।

পঁচাত্তর থেকে উনআশি সাল পর্যন্ত ঢাকায় যে নাটকগুলো নতুন করে মঞ্চস্থ করা হয় তার মোটামুটি একটা তালিকা তৈরি করা যেতে পারে। থিয়েটার মঞ্চস্থ করে চারদিকে যুদ্ধ, চোর চোর, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, দুই বোন, সেনাপতি। ঢাকা থিয়েটার মঞ্চস্থ করে মুনতাসীর ফ্যান্টাসী, শকুন্তলা, কসাই। আরণ্যক মঞ্চস্থ করে, ওরা কদম আলী, ওরা আছে বলেই। নাগরিক মঞ্চস্থ করে সৎ মানুষের খোঁজে, দেওয়ান গাজীর কিসসা, মাইলপোষ্ট, সাজাহান। পদাতিক মঞ্চস্থ করে সোজন বাদিয়ার ঘাট,তিন রোস্তমের গপো। বহুবচন মঞ্চস্থ করে ঘাতক দেশকাল, নন্দিত নরকে, ইডিপাস। সমষ্টি মঞ্চস্থ করে হুজুর কখন মরবে, মাননীয় মন্ত্রীর একান্ত সচিব। নাট্যচক্র মঞ্চস্থ করে স্পার্টাকাস, লেট দেয়ার বি লাইট, কাফন, প্রত্যাবর্তনের দেশে।

ব্যতিক্রম মঞ্চস্থ করে বিনি পয়সার ভোজ, চিড়িয়াখানা, সত্য অবাস্তব, ঈশ্বর এবং আমি। নান্দনিক’মঞ্চস্থ করে আমার সোনার হরিণ চাই, শান্তি। সারথী নাট্য গোষ্ঠী মঞ্চস্থ করে বাবু খেলা দেখে যান, আমি গাধা বলছি, একেই কি বলে সভ্যতা। ড্রামা সার্কল মঞ্চস্থ করে নব সংস্করণ ও কবয়। প্রতিদ্বন্দ্বি মঞ্চস্থ করে স্ফিংস, সিনথিসিস, যদি আমি কিন্তু আমি, সারি সারি মৃতদেহ। কথক মঞ্চস্থ করে প্রাগৈতিহাসিক।

সপ্তরূপা মঞ্চস্থ করে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে। উন্মোচন মঞ্চস্থ করে নির্ভরযোগ্য গুজবে প্রকাশ। দ্রাবিড় মঞ্চস্থ করে অগ্রাহ্য দণ্ডোৎসব। বিসর্গ নাট্যালোক মঞ্চস্থ করে অবক্ষয়। কালান্তর মঞ্চস্থ করে কবর, শিকল পরিয়ে দাও। নাট্যম মঞ্চায়ন করে বিপন্ন বসতি। ইত্যাদি আরো অনেক নাটক তখন মঞ্চস্থ হয়।

চট্টগ্রাম মহানগরীর নাট্যদলগুলো এ সময় যেসব নাটক মঞ্চস্থ করে তারও একটা তালিকা দেয়া যেতে পারে। তির্যক মঞ্চস্থ করে রবিউল আলমের এক যে ছিলো দুই হুজুর, সমাপ্তি অন্যরকম, জননীর মৃত্যু চাই, কাজী জাকির হাসানের শরবিদ্ধ যন্ত্রণা। থিয়েটার ‘৭৩ মঞ্চায়ন করে জিয়া হায়দারের এলেবেলে, জহুরুল হকের স্বর্গ উপসর্গ, অগ্নিমিত্রের আদম শুমারী। অরিন্দম মঞ্চায়ন করে আবদুল্লাহ আল-মামুনের উজান পবন, সেলিম আল দীনের আতর আলীদের নীলাভ পাট, অসিত বরণ সরকারের শেষ অংকের আগে, মমতাজউদদীন আহমদের যামিনীর শেষ সংলাপ ও খসরুল কবিরের ভোলা ময়নার বায়স্কোপ, হাসানাত আবদুল হাই রচিত সামনে যাই থাক ট্রেন চলবেই ও বের্টোল্ট ব্রেন্টের রাইফেল।

অঙ্গন থিয়েটার ইউনিট মঞ্চস্থ করে শান্তনু বিশ্বাসের দপ্তরী রাজ দপ্তরে, সনজীব বড়ুয়ার বাজলো রাজার বারোটা, মিলন চৌধুরীর যায় যায় ফাগুনো দিন। চট্টগ্রামের গণায়ন মঞ্চস্থ করে চিররঞ্জন দাসের গফুর আমিনা সংবাদ ও মিলন চৌধুরীর চর্যাপদের হরিণী ইত্যাদি।

উল্লিখিত নাটকগুলোতে বিভিন্ন ধরনের বিষয়বস্তুর দেখা মিললেও সে সময়কার রাজনৈতিক ঘটনাবলীর কোনো চিহ্নমাত্র ছিলো না। নাটকগুলোতে শোষক শোষিতের প্রশ্ন থাকলেও কিংবা জীবনের আরো বৃহত্তর প্রেক্ষাপট ফুটে উঠলেও পঁচাত্তর পরবর্তী সমকালীন রাজনীতির কোনো চেহারাই কোনো নাটকে ফুটে ওঠেনি। নাটক রচনার সংখ্যা এ সময় কমে এলো। কমে এলো নাট্যকারদের সংখ্যা।

পঁচাত্তর পূর্ববর্তী রাজনৈতিক ত্রাস, নৈরাজ্য, দলীয়করণ, দুর্নীতি, হত্যা, ধর্ষণ কমে আসার ফলে বেশিরভাগ নাট্যকার সম্ভবত লেখার কোনো বিষয়বস্তু খুঁজে পেলেন না, বা তাঁদের প্রাথমিক উৎসাহ কমে এলো কিংবা সমসাময়িক সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ব্যক্তিগত ক্ষোভ প্রকাশের জন্য নাটককে এক সময় হাতিয়ার হিসাবে মনে করলেও পরবর্তীতে তাঁদের ক্ষোভ হ্রাস পাওয়ায় তাঁরা হয়তো নাটক লেখার ভিন্ন কোনো কারণ খুঁজে পেলেন না। কিংবা নাটক লেখা তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনের জন্য লাভজনক নয় মনে -করেই, কিংবা পূর্বে নাটক লিখে দর্শকদের কাছ থেকে স্বীকৃতি বা সাড়া না পাওয়ার কারণেই তাঁরা খুব শীঘ্র নাটকের জগৎ থেকে নীরবে বিদায় নেন। জীবন গড়ে তুলবার অন্য ব্যস্ততাও হতে পারে সেটা কিংবা ভিন্ন কোনো হাতছানি।

যাঁরা তখনও লিখছিলেন, তাঁদের রচনায় নানা প্রসঙ্গ এলেও সমকালীন রাজনীতির কোনো চিত্র বা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। সে সময়কার কিছু কিছু আলোচিত নাটকের বিষয়বস্তুর ওপর দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাবো, তখন মূলত কী ধরনের বক্তব্য গুরুত্ব পেয়েছিলো। চোর চোর নাটকের প্রধান চরিত্ররা রহমত, সগীর আলী, রাহাত জিয়া আনসারীর ও রীনা। রহমত একজন পেশাদার চোর, সগীর আলী থানার ওসি।

রহমত থানার হাজত থেকে পালিয়েছে সগীর আলী তাকে ধরার জন্য পিছনে ছুটছে। রহমত পালাতে গিয়ে ঢুকে পড়ে এক বাড়ির মধ্যে, সগীর আলীও পিছন পিছন সেখানে এসে উপস্থিত হয়। সেখানে আসার পর তারা মুখোমুখি হয় আর একটি ঘটনার। সে ঘটনার প্রধান চরিত্র রীনা ও রাহাত। অবিবাহিত রীনা সাতদিন হয় একটি বাচ্চার জন্ম দিয়েছে। বাচ্চার অবৈধ পিতা রাহাত চাচ্ছে বাচ্চাটাকে মেরে ফেলতে। এই নিয়ে রীনার সাথে প্রেমিক রাহাতের দ্বন্দ্ব চলে। রীনার অনুপস্থিতিতে রহমত ও সগীর আলীর সামনে থেকে পিতার পরিচয় দিয়ে বাচ্চাটিকে সরিয়ে ফেলে রাহাত। রাহাতের আচরণে সন্দেহ প্রকাশ করে চোর রহমত।

রীনা এসে বাচ্চাকে দেখতে পায় না, উপরন্তু চোর ও ওসিকে দেখে অবাক হয়। এদিকে রাহাত বাচ্চাটিকে ঝোপঝাড়ওয়ালা এক পার্কে ফেলে রেখে আবার রীনার কাছে ফিরে আসে এবং সে বাচ্চাটাকে নিয়ে যাবার কথা রীনার কাছে একেবারেই অস্বীকার করে। কিন্তু রহমত ও সগীর আলীর কারণে রাহাত রীনার কাছে ধরা পড়ে যায়। রাহাত ধনীর ছেলে, তবুও তাকে গ্রেফতার করে সগীর।

শেষ পর্যন্ত চারজন পার্কে আসে বাচ্চার খোঁজে। বাচ্চাটিকে ঠিকই খুঁজে পাওয়া যায়। বাচ্চাটিকে পেয়ে চোর তার কোলে তুলে নেয়। রাহাত রীনাকে এখনো পেতে চায়, অন্ততঃ দৈহিকভাবে এবং বাচ্চাটিকে বাদ দিয়ে। সগীর আলী ও রহমতকে ঘুষ দিয়ে তাদের সামনেই বাচ্চাটিকে মেরে ফেলতে চায়। ঘটনার এক পর্যায়ে রীনা সগীর আলীর রিভলবার দিয়ে রাহাতকে হত্যা করে। সব ঘটনা জানার পর রহমত ও সগীর আলী দুজনেই রীনা ও তার বাচ্চার প্রতি মমতা অনুভব করে। রহমত বাচ্চাটিকে তার স্ত্রী ও পরিবারের মাধ্যমে লালন পালনের দায়িত্ব নেয়। পুলিশ রীনাকে ধরে নিয়ে যায়। ১৬৪ জিয়া আনসারীর এই নাটকটি সম্পর্কে বলা যায়, সমকালীন সমাজের কোনো গভীর সংকট এ নাটকের বিষয়বস্তু নয়।

নাটকটিতে চিন্তার কোনোই খোরাক নেই। নাট্যকার যেসব স্থূল প্রসঙ্গের অবতারণা করেন তা কোনো গভীর জীবনবোধের প্রকাশ নয়। নাটকের শেষ দৃশ্যের সবটাই বাড়াবাড়ি রকমের অবাস্তব। সমাজ পরিবর্তনের জন্য নাটক-এই বক্তব্য চোর চোর-এর বেলায় একেবারেই খাটে না। কারণ এটি স্রেফ নাটকের জন্যই নাটক। নাটকটির মূল উদ্দেশ্য ছিলো বিনোদন দান।

আবদুল্লাহ আল-মামুনের এবার ধরা দাও নাটকের প্রধান চরিত্ররা পলাতক, তরুণ, মহিলা, বাবা, বোন, রাজু ও পথচারী। তরুণ এম. এ. পাশ করে চাকরি পাচ্ছে না। তরুণের বাবা তরুণকে লেখাপড়া শিখিয়েছে টাকা পয়সা খরচ করে। এখন সে চায় ছেলে টাকা আয় করে তাকে টাকা ফেরত দিক। টাকা টাকা করে সে ছেলের মাথা খারাপ করে তোলে। তরুণ একটা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায়। পলাতক চরিত্রটি তরুণকে বলে পথচারীদের মধ্যে যে-কোনো একজনের কাছে তার আকাঙ্ক্ষিত চাকরি আছে। সে একে একে পথচারীদের কাছে চাকরি চাইতে থাকে। শেষ পর্যন্ত পূর্বে উল্লেখিত মহিলা চরিত্রটি তাকে চাকরি দিতে রাজি হয়। চাকরির শর্ত হলো, মহিলার অনেক টাকা পয়সা আছে-সে টাকাগুলো যুবককে খরচ করতে হবে, উড়িয়ে দিতে হবে।

যেনতেন প্রকারে খরচ করলে হবে না, এমনভাবে খরচ করতে হবে যেন মহিলা সেই খরচে ভীষণ কষ্ট পায়। মহিলা তাকে প্রতিশ্রুতি দেয় যদি সে টাকাগুলো খরচ করার মধ্য দিয়ে মহিলাকে কষ্ট দিতে পারে তাহলে সে যুবককে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে যাবে। যুবক চিন্তিত হয়ে পড়ে কীভাবে সে টাকাটা খরচ করবে। পলাতক তখন তরুণকে বলে, সে জানে কীভাবে টাকাটা খরচ করলে মহিলা কষ্ট পাবে।

অতএব তরুণ যদি টাকাটা পলাতককে দেয়, সে মহিলাকে কষ্ট দেয়ার মতো করে টাকাটা খরচ করে দেবে। তরুণ পলাতকের কথা মতো টাকাগুলো তাকে দিয়ে দেয়। এদিকে যুবক যে চাকরি পেয়েছে এই খবর বাবা পেয়ে যায় পলাতক চরিত্রের কাছ থেকে। বাবা এখন ছেলের কাছে টাকা চায়।

বাড়ি-ভাড়া দিতে হবে, আরো অনেক খরচ আছে। যুবক বাবাকে বলে, চাকরির বেতন পাওয়া যাবে মাস গেলে পর। বাবা তা শুনতে চায় না, ছেলেকে অগ্রিম চাইতে বলে চাকরিদাতার কাছে। ছেলে রাজি হয় না। তরুণের এক বোন আছে। বাবা টাকার জন্য তরুণের সেই বোন অর্থাৎ নিজের মেয়েকে দিয়ে দেহ ব্যবসা করাতে চায়। তরুণ বাধা দিতে চাইলে বাবা বলে, তরুণ তাকে টাকা দিলে সে মেয়েকে দিয়ে দেহ ব্যবসা করাবে না। সে অবস্থায় তরুণ মহিলার কাছে অগ্রিম টাকা চাইবার কথা ভাবে।

 

রাজনৈতিক নাট্যচিন্তা ও স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের মঞ্চনাটক | সূচিপত্র

 

নাটকে দেখা যায়, এদিকে মহিলার ভাই রাজু মহিলার সাথে দেখা করতে আসে। মহিলা রাজুকে আদর্শবান করে মানুষ করার জন্য হোস্টেলে রেখে পড়াতো। খুব কম টাকা পয়সা দিতো যাতে সে নষ্ট না হয়ে যায়। সেই ভাই মহিলাকে এসে জানায় সে লেখাপড়া ছেড়ে এখন ব্যবসা করছে। একজন লোক তাকে ব্যবসা করার জন্য টাকা দিয়েছে, সে এখন বিয়ে করতে চায়। সে এমন মেয়েকে বিয়ে করবে, যে মেয়ে অন্য মেয়েদের সাথে তার মেলামেশাকে মেনে নেবে।

ভাইয়ের চরিত্রের এই অধঃপতনে মহিলা খুবই কষ্ট পায়। এই ঘটনার পরই তরুণ মহিলার কাছে এসে তার সমস্যার কথা বলে। মহিলার কাছে সামান্য কিছু টাকা চায় ধার হিসাবে বোনকে রক্ষার করার জন্য। মহিলা তখন তরুণকে বলে সে তার আপন ভাইয়ের আচরণে এতো কষ্ট পেয়েছে যে টাকা খরচ করে তাকে আর কষ্ট দেয়ার দরকার নেই। অতএব সেই পুরো টাকাটাই সে তরুণকে দিয়ে দিচ্ছে। মহিলা তখন তরুণকে আরো জানায়, এই টাকার প্রতি লোভ তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। সে এই টাকার প্রতি লোভ-করে তার ভালোমানুষ প্রফেন্সর স্বামীকে হারিয়েছে। সে এখন আর টাকা চায় না। স্বামীকে ফিরে পেতে চায়। অতএব টাকাটা যেন তরুণ নিয়ে নেয়।

তরুণ তখন ছুটে যায় পলাতকের কাছে টাকাটা উদ্ধারের জন্য। পলাতক জানায়, টাকাটা সে মহিলার ভাইকে দিয়ে দিয়েছে ব্যবসা করার জন্য এবং সে নিজেই হচ্ছে মহিলার স্বামী। তরুণ পলাতককে জানায় তার স্ত্রী তার জন্য এখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। শুনে পলাতক খুশি হয় এবং মহিলার কাছে ছুটে যায়। তরুণের টাকা লাভের সকল আশা ভরসা চূর্ণ হয়ে যায়।

সেই সময় দ্বিতীয় পথিক যুবকের জন্য টাকা নিয়ে এগিয়ে আসে। যদি নিজের বোনকে পথচারীর যৌনসঙ্গী হতে দেয় তাহলেই তরুণ সে টাকাটা পেতে পারে। তরুণ তখন দর্শকদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাদের কাছে পরামর্শ চায় সে কী করবে। তার জন্য দুটি পথ খোলা আছে নিশ্চিত প্রতিষ্ঠা কিংবা নিশ্চিত ধ্বংস। তরুণ জানতে চায় দর্শকরা কি তাকে ধ্বংসের পথে যেতে দেবে, না ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করবে।

চারদিকে যুদ্ধ নাটকে শহর থেকে দূরবর্তী পলাশবাড়ির কিছু মানুষের জীবনসংগ্রাম প্রাধান্য পেয়েছে। বেকার সানু নাটকের প্রধান চরিত্র। সে সৎ, সদ্য পাশ করে জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে সে বিপর্যস্ত। আদর্শবাদী পিতা অবসরপ্রাপ্ত হেডক্লার্ক। সানুর দুই ভাই পানু আর কানু-কালোবাজারি আর ছিনতাই ওদের দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ। সানু সে পথে আগায় না। সানুর এককালের বন্ধু রাজাও নিজের ভাগ্য উন্নয়নে সবরকম নীতি বিসর্জন দেয়। পলাশবাড়ির মেয়ে নীলা প্রতিদিন ট্রেনে করে শহরে যায়, বিত্তবান ও উঁচু স্তরের মানুষের মনোরঞ্জনের ভিতর দিয়ে সে তার পিতা-মাতার সংসারটাকে বাঁচিয়ে রাখছে। নাটকের অপর চরিত্র মল্লিক সাহেব বিত্তবান মানুষ। সানুকে সে চাকরি দেয়ার কথা বলে ঘুরাচ্ছিলো।

নীলা মল্লিকের মনোরঞ্জনকারীদের একজন। নীলার কথায় শেষ পর্যন্ত চাকরি হয় সানুর। চাকরির প্রথম দিনেই সে দেখতে পায় তার বন্ধু রাজা নিজের উন্নতির স্বার্থে বোন লিলিকে বাধ্য করতে চায় মল্লিকের মনোরঞ্জনে। মল্লিকের হাত থেকে লিলির সম্মান বাঁচানোর জন্য সানু মল্লিককে চাকু মেরে কারাগারে যায়। নাটকে এভাবেই নারীর সম্মান বাঁচাতে সানুর প্রতিবাদ ঘোষিত হয়। আবদুল্লাহ আল- মামুনের উল্লিখিত দুটি নাটকের বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে মধ্যবিত্ত জীবনের অতলগামী ক্ষয়িষ্ণুতা, যুগগত মূল্যবোধগুলোর বিনষ্টি ও ভবিষৎ সম্পর্কে উদ্বেগ-অনিশ্চয়তা।

সাধারণ মানুষের জীবনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সকল বিরম্বনার চিত্র নাট্যকারের মনোভূমি স্পর্শ করেছে কিন্তু তিনি নিরাসক্ত মন নিয়ে ঘটনার কারণগুলো চিহ্নিত করতে পারেননি। সেজন্য সবকিছুকে অতিনাটকীয় করে তুলেছেন। লম্পট চরিত্রের খলনায়ক এবং বেকার-অসহায় নায়ক-নাটক দুটির দুদিকে অবস্থান করে। নিম্ন মধ্যবিত্ত যুবকের জীবনে চাকরির যে বড়ো প্রয়োজন এই সত্যটাই মামুনের নাটক দুটিতে বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে; এমনকি তার সেনাপতি নাটকেও তাই দেখা যায়।

আবদুল্লাহ আল-মামুনের সেনাপতি নাটকের প্রধান চরিত্র আব্বাস আলী তালুকদার। আব্বাস আলী তালুকদারের স্ত্রী মেরী বেকার তালুকদারকে ভালোবেসে বিয়ে করে। বিয়ের পরও তালুকদার বহুদিন পর্যন্ত চাকরি জোগাড় করতে পারে না। ঘটনাচক্রে অবশেষে একজন শিল্পপতির তালুকদারকে খুব পছন্দ হয়ে যায়। শিল্পপতির মনে হয় তালুকদার খুব সুন্দর করে কথা বলে। তালুকদারের প্রতি শিল্পপতির এই দুর্বলতার সুযোগে সে একের পর এক শিল্পপতির সংসারে ও বাণিজ্যে অঘটন ঘটিয়ে চলে। শিল্পপতি খুবই ভালো মানুষ। শ্রমিকদের যে-কোনো দাবি সে যখন তখন মেনে নেয়। তালুকদার আসার পর শিল্পপতিকে সে শ্রমিকদের দাবিগুলো মেনে নিতে দেয় না।

শিল্পপতিকে আড়াল করে তালুকদার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। শিল্পপতির স্নেহ ও প্রশ্রয় পেয়ে আব্বাস আলী তালুকদার প্রচুর টাকাও আয় করতে থাকে। টাকা আয় করার পর সে তার স্ত্রীর সাথেও খারাপ আচরণ করে। স্ত্রী যে শিল্পপতির কারখানাতেই শ্রমিক কল্যাণ কর্মকর্তার চাকরি করে সেটা আব্বাস আলী জানে না। আব্বাস আলীর ক্ষমতার দম্ভ এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছায় সে তখন কিছুই পরোয়া করে না, শুধু শিল্পপতির কাছেই সে একান্ত বাধ্যগত। কৌশল করে সে শিল্পপতির একমাত্র মেয়ে ও মেয়ের জামাইকেও বাড়ি থেকে বের করে দেয়। কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। কারখানায় মারামারি এমনকি হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ঘটায়। কেন সে এগুলো করে তার কোনো কারণ নাটকে বলা নেই।

শেষ পর্যন্ত তালুকদার ঘটনাকে সামাল দিতে পারে না। নিজ স্ত্রী মেরীই তার মুখোশ শ্রমিকদের কাছে তুলে ধরে। মেরীর কাছ থেকে তালুকদার সম্পর্কে সবকিছু জানার পর শ্রমিকরা আবার ঐক্যবদ্ধ হয় এবং আব্বাস আলীকে আক্রমণ করে এবং হত্যা করে। নাটকটি প্রমাণ করে কারখানার মালিক খারাপ নয়, খারাপ আব্বাস আলীর মতো লোকরা যারা সেনাপতির দায়িত্ব পালন করে।

রামেন্দু মজুমদার লিখছেন, সুবিধাবাদীশ্রেণীর প্রতিভূ আব্বাস আলী তালুকদারের স্বরূপ উদ্‌ঘাটনই এ নাটকের মূল উদ্দেশ্য। নাটকটি নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। কেউ বলেছেন নাটকের বক্তব্য প্রগতিবিরোধী। কেন এটাকে প্রগতিবিরোধী মনে করা হয়েছে? তার কারণ নাটকে কারখানার মালিক শিল্পপতিকে দেখানো হয়েছে ভালো মানুষ; যেন সে কোনো শ্রম শোষণ করে না। নাটকের বক্তব্য সম্পূর্ণভাবে ইতিহাসের চেতনা বিরোধী। উৎপাদন যন্ত্রের উপর ব্যক্তিমালিকানা থাকা অবস্থায় মালিকের সাথে শ্রমিকের সম্পর্ক সবসময়ই শোষণের বঞ্চনার অমানবিকতার। ১৬৮ মালিকই তার স্বার্থে সুবিধাবাদীদের ব্যবহার করে। মার্কসবাদী ধারণায় আব্বাস আলী তালুকদার পুঁজিবাদী ব্যবস্থারই সৃষ্টি, নাট্যকার যা সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে চেয়েছেন।

মামুনুর রশীদের ওরা কদম আলী নাটকের ঘটনা স্থাপিত হয়েছে একটি জাহাজ ঘাটের পটভূমিতে। নাট্যকারের মতে যেখানে নগরায়ন এবং প্রকৃতি এক জায়গায় মিলেছে। এই জাহাজ ঘাটে জড়ো হয়েছে বিভিন্ন বৃত্তি ও পেশার মানুষ, যেমন সর্বহারা রাবেয়া, বোবা কদম আলী, কুলি সর্দার, বই বিক্রেতা, সারেং নানা চরিত্র। ছিন্নমূল বোবা কদম আলী এ নাটকের প্রধান চরিত্র এবং মানব দরদী।

নাটকের খলচরিত্র নায়েব আলী একাধারে বেপারী, ঘাটের ইজারাদার, জাহাজের মালিক, হোটেল মালিক ইত্যাদি। তার অনেক অপকর্মের মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে এ রকম, সে ঘাটের ডাক নিয়ে সরকারি নির্দেশ না মেনে লোকের কাছ থেকে বেশি পয়সা আদায় করে, হোটেল শ্রমিককে মারধর করে, সারেংকে বেতন না দিয়ে উল্টো তাড়িয়ে দেয়। কদম আলীর কাছে অভিভাবকহীন এক বালক থাকে, তাকেও জোর করে নিয়ে যেতে চায় নায়েব আলী। রাবেয়ার ওপর প্রভাব খাটাতে চায়। এসবকে ঘিরে শোষিতরা জোট বাঁধে। ছিন্নমূল মানুষের প্রতিরোধের কাছে নাস্তানাবুদ হয় নায়েব আলী। রাবেয়ার দায়ের কোপে ব্যাপারীর কান কাটা গেলে পুলিশ কদম আলীকে খুঁজতে আসে।

পুলিশ যখন চায়ের দোকানে এসে জানতে চায় কে কদম আলী, সবাই এক যোগে বলে ‘আমরা কদম আলী’। দরিদ্র মানুষের একতাবদ্ধ হবার প্রতীক হিসাবে এসেছে নাটকের শেষ দৃশ্যটি। নাট্যকার বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার উৎপীড়ন, শোষণ ও অত্যাচারের রূপগুলি নাটকে তুলে ধরেছেন কিন্তু নাট্য রচনার নান্দনিক দিকটি এই নাটকে উপেক্ষিত হয়েছে। সমাজ সম্পর্কিত বোধগুলোও স্বচ্ছতা লাভ করেনি। শত অত্যাচারেও ছিন্নমূল মানুষগুলোর বিপ্লব ঘটাবার ক্ষমতা না থাকলেও, তারা যে ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে শাসকশ্রেণীকে আক্রমণ করতে পারে-এই বাস্তবতাটি নাটকে রয়েছে। কিন্তু নাটকের প্রথম দৃশ্যের সাথে শেষ দৃশ্যের পরম্পরা রক্ষিত হয়নি। নাট্যকার শেষ দৃশ্য তৈরি করবার জন্য অস্থির হয়েছেন; নাটকের ধারাবাহিকতাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারেননি।

বিদ্রোহের পথে যে বাধা ও সমস্যা আছে সেগুলো তলিয়ে দেখেননি। ভৈয়দ শামসুল হকের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় একটি কাব্য নাটক। মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শেষের দিকের কাহিনী এ নাটকের বিষয়বস্তু। নাটকে মুক্তিবাহিনীর আগমন আশঙ্কায় ভীত গ্রামের মানুষ মাতব্বরের বাড়িতে ভীড় করেছে। মাতবর এতোদিন পাকবাহিনীর হাত থেকে গ্রামের মানুষদের রক্ষা করেছে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করে। সেজন্যই লোকজনের মাতব্বরের বাড়িতে আসা, পাকবাহিনী শেষ পর্যন্ত তাদের রক্ষা করতে পারবে কি না সেটা জানার জন্য। মাতব্বর তাদের রক্ষা করার আশ্বাস দেয়। হঠাৎ মাতব্বরের মেয়ে ভিতর থেকে বের হয়ে এসে জানায়, পাকবাহিনী গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। সে গ্রামবাসীকে আরো জানায়, যাবার আগে পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেন সারারাত তার ওপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়ে গেছে এবং তার বাবার অনুমতি নিয়েই।

মাতব্বর জানায় তার কোনো উপায় ছিলো না ক্যাপ্টেনের দাবি মেনে নেয়া ছাড়া। লাঞ্ছিত মেয়ে গ্রামবাসীকে সব জানিয়ে নিজে বিষপানে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। গ্রামবাসী তখন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। কাব্যে রচিত নাটকটির মধ্যে খণ্ডিতভাবে জীবনবোধের নানা চিত্র ধরা পড়লেও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে গভীর অনুভবের দেখা মেলেনি। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় নাটকে রয়েছে এক নারীর বিদ্রোহ ও আত্মাহুতি দান। কিন্তু নাটকের মূল পটভূমিটিই প্রশ্নের সৃষ্টি করে।

পুরো একটি গ্রামের লোক মুক্তিবাহিনীর ভয়ে মাতব্বরের বাড়িতে আশ্রয় নেয় এটা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের কোনো বাস্তবতার চিত্র নয়। বাংলাদেশের কোথাও, কখনও গ্রামের লোকজন মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে কোনো গ্রামের মানুষ ভীতও ছিলো না। নাট্যকারের এ ধরনের বক্তব্য নির্জলা মিথ্যা, যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণেরই নামান্তর। ফলে যে নাট্যদল নাটকটি মঞ্চায়ন করেছে সে দলের সদস্যদের ইতিহাস জ্ঞান ও সমাজভাবনা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

সাঈদ আহমদের প্রতিদিন একদিন নাটকটি মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরবর্তী ঘটনাবলীর ওপর নিরীক্ষা ধর্মী একটি নাটক। নাটকটিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং মধ্যবিত্ত ঘরের মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রেণীচরিত্র চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। নাটকের শুরুতেই এক সাথে যুদ্ধের মাঠে ছিলো এরকম কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এক অনুষ্ঠানে – মিলিত হয়, যাদের মধ্যে প্রায় সকলেই আবার বহু টাকা পায়সার মালিক। দামী মদ এবং নানাধরনের খাবার নিয়ে তারা অনুষ্ঠানে যুদ্ধের ময়দানের স্মৃতিচারণ করে। স্মৃতিচারণ করে যুদ্ধে যাবার আগে তারা কীভাবে তাদের বাবাদের সাথে বিরোধে লিপ্ত হয়েছিলো। বাবারা চাইতেন তাঁদের ছেলেরা সমাজে প্রতিষ্ঠা পাবে কিন্তু তারা বিপ্লব করার জন্য রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলো।

শেষ পর্যন্ত তাদের বিপ্লবের পরিণতি কী হয়েছে, কেন হয়েছে সে সম্পর্কে সাঈদ আহমদ সামগ্রিকভাবে না হলেও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু প্রশ্ন তুলে ধরেছেন। নাটকটির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রশ্ন ও চিন্তা আছে। তবে সে চিন্তা সুসংগঠিত নয়; সংশ্লেষিত নয়। ১৭১ হাবিবুল হাসানের লেখা কসাই নাটকের বিষয়বস্তু কিছুটা জটিল। আব্বাস আলী কসাই। জবাই করা শুধু তার পেশা নয়, নেশা। তার ভালোবাসা। আব্বাস আলীর স্ত্রী ময়না রক্তের তাণ্ডবে ভালোবাসার স্বাদ পায় না। সেখানে আসে দুলাল, মূর্তি গড়ার কারিগর প্রাণবন্ত তরুণ। সে মূর্তি গড়তে গিয়ে গড়ে ময়নার মুখ। জবাই করতে গিয়ে একদিন আব্বাস আলী কেটে ফেলে তার ডান হাত। পঙ্গু আব্বাস আলী আর জবাই করতে পারে না। তার ভালোবাসা জীবন থেকে হারিয়ে যায়। সেই ক্ষোভে আব্বাস আলী নিজেকে হত্যা করে।

উল্লাসে উঠোনে দাঁড়ায় ইদ্রিস আলী, কসাইয়ের বাচ্চা কসাই। এই হচ্ছে কসাই নাটকের কাহিনী। নাটক হিসাবে কসাই অস্বচ্ছ অপরিণত। ঘটনার মধ্য দিয়ে কোনো সমস্যাকে প্রবলভাবে উপস্থাপিত করে না, কোনো সমাধানের জোরালো ইঙ্গিতও দেয় না। কসাই কোনো সমাজের সমস্যার কথা বলে না, বলে কোনো এক ব্যক্তির মনের গভীরে ফেনিয়ে ওঠা এক ক্রুদ্ধ ভালোলাগার কথা। ব্যক্তির মানসিক এই বিকৃতির ভিতর দিয়ে কোনো সমাজ সত্য ফুটে ওঠে না। কসাই নাটকটির পুরো কাঠামোটাই অবাস্তব। নাট্যকারের ব্যক্তিগত খেয়ালই কেবল চরিতার্থ হয় এ নাটকে। নাট্যকারের কল্পনা শক্তি এবং উদ্ভাবনী শক্তিও এক্ষেত্রে দুর্বল।

সেলিম আল দীনের শকুন্তলা নাটকটি পৌরাণিক ঘটনা অবলম্বনে রচিত। দেবরাজ ইন্দ্র বিশ্বামিত্রের ধ্যানে ঈর্ষান্বিত হয়ে অন্দরা মেনকাকে পাঠিয়ে কীভাবে তার ধ্যান ভঙ্গ করে সেই পটভূমিতেই এই নাটকটি রচিত। বিশ্বামিত্রের ধ্যান ভাঙাতে না পারলে সে হয়ে উঠতো বিশাল ক্ষমতার অধিকারী, তাই ইন্দ্র এই ষড়যন্ত্র করে। মেনকার রূপে মুগ্ধ হয়ে বিশ্বামিত্র ইন্দ্রের ফাঁদে পা দেয়। মেনকা আর বিশ্বামিত্রের মিলনে জন্ম নেয় শকুন্তলা। পুরাণের প্রতি সেলিম আল দীন সম্পূর্ণ বিশ্বস্ত ছিলেন না নাটক নির্মাণে, তেমনি কোনো রাজনীতিকেও ধারণ করতে পারেননি। সমকাল নয়, শকুন্তলার ব্যক্তিগত দুঃখ বেদনাই যেন বড় হয়ে ওঠে।

সেলিম আল দীনের মুনতাসীর ফ্যান্টাসী নাটকের মুনতাসীর একটি প্রতীকী চরিত্র। মুনতাসীরের, খাই খাই রোগ। সে পেস্ট্রি, কলা থেকে শুরু করে শাড়ি, ফাইল, শাসনতন্ত্র, তৈলচিত্র সব কিছুই খেয়ে ফেলে। ১৭৪ বুর্জোয়া রাজ্যের খিদে তো মুনাফার খিদে যা কখনো মেটে না। নাট্যকার এ নাটকের মধ্য দিয়ে সেটাই বোঝাতে চেয়েছেন কি না, নাটকে সেটা পুরোপুরি বর্ণিত না হলেও, মানুষের লোভ, অফুরন্ত চাহিদার ছবিটা নাটকের মধ্য দিয়ে ঠিকই ধরা পড়ে।

ফরহাদ মজহারের ঘাতক দেশকাল নাটকের মূল চরিত্র কবি। সে দ্রষ্টার মতো উচ্চারণ করে আমি জানি আমাদের যার যা ভূমিকা তা নিজস্ব নিয়মেই পালিত হবে। কিন্তু অধ্যাপকের অজ্ঞানতার শাস্তি সইতে হবে কবিকে। বিপ্লবীর ভুল ইতিহাস চৈতন্যের যে স্থূলতা তার ভারও বইতে হবে কবিকে। টেবিলের চারপাশে বসা মানুষের অজ্ঞতা এবং সেই অন্ধকারের জ্বালা সইতে হবে কবিকে।

যারা কেবল দর্শক, হা করে তাকিয়ে থাকে মঞ্চের দিকে, যারা ভূমিকাহীন, সমকালীন ঘটনার সঙ্গে যাদের বিশাল বিচ্যুতি, সেই বিচ্যুতির যন্ত্রণাও সইতে হবে কবিকে। সেজন্যই কবিকে মাতাল হতে হবে, সেইজন্যই মাতাল হওয়া কবিদের জন্মগত অধিকার। দুঃস্বপ্নগ্রস্ত, ইতিহাস তাড়িত প্রত্যেকের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে তাকেই। কারণ ইতিহাস ও চৈতন্যের বাহক হিসেবে সকল দায় দুর্ভাগা কবির।

নাট্য সমালোচক ফারুখ ফয়সল এ নাটক সম্পর্কে লিখছেন, শূন্যগর্ভ কলসের উঁচুতালের আওয়াজের মতোই কথাগুলো বেশ শ্রুতিমধুর সন্দেহ নেই। সস্তা জনপ্রিয় বিপ্লবী বুলি যুক্ত করে নাটকটিকে রাজনৈতিক চরিত্র দেবার নাট্যকারের সচেতন প্রচেষ্টা স্পষ্ট, যদিও মাও সেতুঙ রাজনীতিশূন্য সাহিত্য সমর্থন করেননি, আবার পোস্টারকেও সাহিত্যের মর্যাদা দেবার পক্ষপাতি ছিলেন না। ঘাতক দেশকাল নাটকে বড় বড় কথার কপচানি আছে, স্থূল রাজনৈতিক কথাবার্তা আছে, তবে তা শিল্পগুণে মণ্ডিত হয়ে সার্থক নাটক হয়ে উঠতে পারেনি।

নাটকটির সাথে সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাবলীরও কোনো সম্পর্ক নেই। গণায়নের চর্যাপদের হরিণী সম্পূর্ণ প্রতীকীধর্মী নাটক। নাটকটি বেশ জটিল ও দুর্বোধ্য। খসরুল কবিরের ভোলা ময়নার বায়োস্কোপ নাটকটিতে বাংলাদেশের ‘ রাজনৈতিক দলের কার্যকলাপে মধ্যবিত্ত চরিত্রের একটি দিক, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, জনসাধারণকে ধোঁকা দেয়ার কাহিনী রূপায়িত হয়েছে।

স্বাধীনতা-উত্তরকালে কালো টাকার ভূমিকা, বিদেশে প্রতিনিধি পাঠাবার হিড়িকের মধ্যে যে মানসিকতা ফুটে উঠেছে তাকেও বিদ্রূপ করা হয়েছে। ১৭৮ মানুষের দুঃখময় জীবনের কথা হলো আদম শুমারী। পৃথিবীতে বাস্তব চিরকালই নির্মম যন্ত্রণাময় তাই মানুষ কল্পনায় সুখী হতে চায়, ভালোবাসে বাস্তবকে ভুলে কল্পনার আশ্রয় নিতে। বস্তুত জীবনে মানুষ যা হতে চায় যা হতে পারতো সেটাই আনন্দদায়ক। মানুষ যেরকম থাকে সেটাই গভীর বেদনায় সিক্ত।

বাংলাদেশে এই সময়কালে বেশ কিছু বিদেশি নাটকের অনুবাদ বা রূপান্তর মঞ্চস্থ হয়েছে। মঞ্চস্থ হয়েছে দেশি গল্পের নাট্যরূপ। মৃত্যু সংবাদ বিদেশি নাট্যকার সিঙ্গের নাটকের রূপান্তর, রূপান্তর করেছেন ভারতের মোহিত চট্টোপাধ্যায়। নাটকটি বিমূর্ত ধারার। নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে আছে হতাশাগ্রস্ত আত্মজিজ্ঞাসায় উন্মুখ এক বিক্ষুব্ধ যুবক। অহেতুক জন্ম দেয়ার অপরাধে সে তার জনককে হত্যা করে এর প্রতিশোধ নেয়। সন্ত্রস্ত, ক্ষুর্ধাত এই যুবক এক বাড়িতে আশ্রয় নিলে সে বাড়ির মানুষ তাকে যথোপযুক্ত সম্মানে গ্রহণ করে এবং তাকে স্বাভাবিক করার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়।

সেখানেই পরিচয় ঘটে বুলুর সঙ্গে এবং এই পরিচয় প্রেমে পরিণত হয়। সে তার বাবাকে হত্যা করেছিলো বলে দাবি করলেও, আসলে তার জনকের মৃত্যু হয় না। তার স্নেহশীল বাবা তার সন্ধানে এলে নায়ক তার অস্তিত্ব স্বীকার করতে চায় না এবং আবার খুন করতে উদ্যত হয়। তার জনকের ভাষায়, এর কারণ তার সন্তানের কাছে ভাবনাটাই প্রধান, ঘটনা নয়। বাবার সাথে নায়ক শেষ পর্যন্ত নিজ বাসভূমে ফিরে যায় অপূর্ণ স্বপ্নকে পূর্ণ করতে।

বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর বের্টোল্ট ব্রেষ্টের বেশ কিছু নাটক মঞ্চস্থ হয়। নাটকগুলো খুব জনপ্রিয়তাও লাভ করে। ব্রেক্টেরই নাটকের রূপান্তর দেওয়ান গাজীর কিসসা। ব্রেন্ট একজন সমাজ সচেতন নাট্যকার, বক্তব্যহীন নাটক তিনি লেখেননি। নাগরিক প্রযোজিত দেওয়ান গাজীর কিসসা নাটকে সে রাজনৈতিক বক্তব্যটি নেই। নাটকে দেওয়ান গাজীই প্রধান চরিত্র। অন্যান্য চরিত্ররা এসেছে দেওয়ান গাজীকে স্পষ্ট করে তোলার জন্য। দেওয়ান গাজীর সাথে এখানে কোনো চরিত্রের শ্রেণী-বিরোধ দেখা দেয় না। মূল নাটকের শ্রেণী-দ্বন্দ্ব এ নাটকে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। দেওয়ান গাজীর কিসসা নাটকে মূল নাটকের এটুকুই রাখা হয়েছে, গ্রামের বিত্তশালী দেওয়ান গাজী মদ খেলে ভাল মানুষ হয়ে ওঠে আবার নেশা ছুটে গেলেই বদরাগী চেহারাটা দেখা যায়।

নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের প্রযোজনা সাঈদ আহমেদের মাইল পোষ্ট নাটকটি যেমন বিমূর্ত ধারার, তেমনি সমকালের রাজনীতির সাথে সম্পর্কহীন। মফিদুল হক লিখছেন, যে চিন্তা থেকেই নাগরিক মাইল পোষ্ট বেছে থাকুক না কেন দর্শকবৃন্দ মাইল পোষ্ট প্রত্যাখ্যান করেছিলো। তা সত্ত্বেও প্রায় শূন্য মিলনায়তনে নাগরিক মাইল পোষ্টের দশটি মঞ্চয়ন করেছে। ১৮২ নাগরিকের আর একটি প্রযোজনা ডি এল রায়ের সাজাহান, সম্রাট শাজাহানের পুত্রদের মধ্যে বিরোধ এবং ঔরঙ্গজেবের ক্ষমতায় আরোহণ নিয়ে।

এ নাটক বাংলাদেশে এর আগেও বহুবার অভিনীত হয়েছে। সমকালীন রাজনীতির সাথে এ নাটকের কোনো সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি নাগরিক বা চিরকালীন রাজনীতির কোনো বিশ্লেষণও এর মধ্যে ধরা পড়ে না। কোনো ধরনের শ্রেণী বিশ্লেষণও বেরিয়ে আসে না। ১৮৩ রাজতন্ত্র ও একনায়কত্বের অবশ্যম্ভাবী ফল হচ্ছে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। রাজতন্ত্র যতই বলদর্পী হোক এ ষড়যন্ত্র থেকে নিস্তার নেই, সেটুকু সত্য অবশ্যই এ নাটকে আছে।

সমাজের নীচুতলায় বাস করে যে মানুষগুলো তাদের জীবনের সুখ দুঃখ প্রেম- ভালবাসা বাঁচার জন্য সংগ্রাম স্বপ্ন নিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা গল্প প্রাগৈতিহাসিক। সে গল্পেরই নাটরূপ মঞ্চস্থ করে কথক নাট্যগোষ্ঠী। ১৮৪ নাটকটির মধ্যে ফুটে উঠেছে মানবজীবনের করুণ পরিণতি এবং মানুষের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম। মানুষ কোথাও থেমে থাকে না, বাঁচার লড়াই চালিয়ে যায় এটাই এ নাটকের মূল কথা। নাটকটির সাথে সমসাময়িক রাজনীতির সম্পর্ক না থাকলেও আছে গভীর জীবনবোধ। গফুর আমিনা সংবাদ নাটকটি শরৎচন্দ্রের মহেশ গল্পের ছায়া অবলম্বনে রচিত। মেয়ে আমিনার হাত ধরে দরিদ্র গফুর ফুলবাড়িয়ার চটকলের দিকে পা বাড়ায়।

সামন্ত সমাজে কৃষকের গোলাভরা ধান ও গোয়াল ভরা গরু গালপল্প ছাড়া আর কিছুই নয়। সেজন্যই সামন্ত সমাজের কৃষক গফুর বাঁচার তাগিদে চটকলে শ্রমিকের জীবন বেছে নেয়। সেখানেও শ্রমিক গফুরের জীবনের দারিদ্র্য ফুটে ওঠে। সুখে-দুঃখে অন্য শ্রমিকরা পাশে এসে দাঁড়ায়। শ্রমিক আন্দোলনের একটি ক্ষীণ চেহারাও তার মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে।

সোজন বাদিয়ার ঘাট নাটকটি কবি জসীমউদ্দিনের কাব্য গ্রন্থের নাট্যরূপ। হিন্দু ও মুসলিম পরিবারের দুটি বালক-বালিকার প্রেমকে ঘিরে দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ ও তার করুণ পরিণতিই এই নাটকের বিষয়বস্তু। সোজন-দুলির প্রেম, পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দুটো ঘটনাই নাটকে সমান গুরুত্ব পায়।

শান্তি নাটকটি রবীন্দ্রনাথের গল্পের নাট্যরূপ। একান্নবর্তী পরিবারের মধ্যে হত্যা ও অন্যান্য আবেগ, ভাইয়ের জন্য ভাইয়ের টান এসব ঘিরেই এ নাটক। আলোচিত উপরের এ নাটকগুলোতে বৃহত্তর জীবনবোধের অন্যান্য বিষয় স্থান পেলেও সমকালীন রাজনীতির সাথে, সেই সময়কার রাজনৈতিক ঘটনাবলীর সাথে তার কোনোই সম্পর্ক ছিলো না।

ঢাকা ড্রামার আমি গাধা বলছি কৃষণ চন্দরের গল্প অবলম্বনে রচিত। গাধার মুখ থেকে অনেক সমাজ সত্য যেমন বের হয়ে আসে তেমনি গাধার ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে পুঁজিবাদী সমাজের মানুষের স্বার্থ সচেতনতা, টাকার প্রতি মোহ এগুলো ধরা পড়ে। সাত্যিকারভাবে দেশের কোনো রাজনীতিকে বিশ্লেষণ করবার চেষ্টা এ নাটকে নেই। নাটকের আখ্যান গড়ে উঠছে এক শিক্ষিত গাধাকে নিয়ে। ছোট বেলায় খবরের কাগজ পড়তে গিয়েই তার যতো দুর্গতি। সে ছিলো প্রথমে ধোপার গাধা। পরে ভাগ্যান্বেষণে বের হলে কসাই, স্মাগলার, পশু চিকিৎসক, জুয়াড়ী, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির টাউট সবার সাথে তাকে থাকতে হয় এবং এর মধ্যে নানা অভিজ্ঞতা অর্জন করে।

লটারীতে টাকা পাওয়ার পর তার সম্মান অনেক বেড়ে গিয়েছিলো কিন্তু প্রতারকদের পাল্লায় পড়ে চলচ্চিত্রে পুঁজি বিনিয়োগ করতে গিয়ে সে সর্বস্বান্ত হয়। পরে ভাগ্যহীন এক কিষাণ-কিষাণীর হাত ধরে সে এগিয়ে যায় সাধারণ মানুষের কাছে। ১৮৭ নাটকটি একটি প্রহসনধর্মী রচনা, নানা ঘটনার ভিতর দিয়ে সমাজের বিভিন্ন দিককে ব্যঙ্গ করা হয়েছে।

পঁচাত্তর পরবর্তী সময় আমরা দেখতে পেলাম নাটক ভিন্ন পথ ধরে আগাতে শুরু করে। পঁচাত্তর পরবর্তী নাটকের ধারায় যেটা সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় তাহলো পঁচাত্তর পূর্ববর্তী অ্যাবসার্ড ধর্মী নাটকের জায়গায় স্বভাববাদ ও বাস্তববাদ নাট্যধারা ক্রমশই জায়গা করে নিতে থাকে। উল্লিখিত সময়ে মঞ্চায়িত প্রায় নাটকগুলোই ছিলো খুবই সহজ সরল এবং বিষয়বস্তুও দর্শকের বোধগম্য। নাটকগুলো সাধারণ মানুষের দুঃখকষ্ট নিয়ে রচিত। কিন্তু গভীর জীবনবোধের দেখা এসব নাটকে পাওয়া যেতো না। নাটকগুলো ছিলো স্বভাববাদী ধারার কিন্তু স্বভাববাদের যে স্বাভাবিকতা তা এসব নাটকে ছিলো না। নাটকগুলো ছিলো উচ্চকিত-অতিনাটকীয় আবেগেপূর্ণ।

ঠিক আবার বাস্তববাদী ধারার মনন বা যুক্তি ও বিজ্ঞানমনস্কতাও এই নাটকগুলোতে ছিলো না। শম্ভু মিত্র লিখেছিলেন, ‘আমাদের দেশে নাট্যকলা বাস্তববাদী হয়েছিলো য়ুরোপকে দেখে। দেশে বিজ্ঞানের প্রভাবে এই রূপ গড়ে ওঠেনি। তাই পাশ্চাত্যের নাট্যকাররা বিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে যেমন করে সমাজকে বিশ্লেষণ করেছেন, মানুষকে বিশ্লেষণ করেছেন, সেই বিজ্ঞানী দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের নাটকে ছিলো না। এবং বিজ্ঞানীর তীক্ষ্নচক্ষু অনুসন্ধিৎসা যদি না-থাকে, তাহলে তার স্থান অধিকার করে আবেগ। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে- আবেগ পর্যবসিত হয়েছে শুধুমাত্র সেন্টিমেন্টাল উচ্ছ্বাসে।

শম্ভু মিত্রের এই বক্তব্য বাংলাদেশের নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সত্য প্রমাণিত হয়েছিলো। বাস্তববাদ বা স্বভাববাদ নাটকের যে যাত্রা আরম্ভ হলো পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে তার জন্যই সামাজিক শোষণ-বঞ্চনার ঘটনা নাটকে প্রাধান্য পেলো। মুক্তিযুদ্ধোত্তর হতাশা কিংবা যুদ্ধোত্তর বিশৃঙ্খল অবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ এ সময়ের নাটকে বন্ধ হয়ে গেল। নাটকে প্রধান বিষয় হয়ে উঠলো শোষক বা ধনিকদের প্রতি ঘৃণার প্রকাশ। কিছু কিছু নাটকে যেমন সার্বজনীন শোষক-শোষিতের চেহারা ধরা পড়লো কিছু কিছু নাটকে তেমনি বিভিন্ন মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলো। মধ্যবিত্ত মানুষের রাগ দুঃখ ক্ষোভ সবকিছুই নাটকে স্থান পেল। কিন্তু নাটকগুলো দর্শকের ভিতরটাকে নাড়া দিতে পারলো না।

শহু মিত্র লিখছেন, দর্শকের ভিতরটাকে নাড়া দিতে গেলে যেই মানুষগুলোকে নাটকের চরিত্র করে আনা হচ্ছে, সেই মানুষগুলোর ঐতিহ্য ও বর্তমান, তাদের আশা কল্পনা, ভালবাসা এবং ভয় সবেরই অংশভাগী হতে হবে গভীরভাবে। মানুষগুলোকে জানতে হয়। এবং যে ইতিহাসের মধ্যে মানুষগুলো জন্মালো তাও অনুভব করতে হয়।’

শম্ভু মিত্র নাটক সম্পর্কে, নাটকের চরিত্র সৃষ্টি সম্পর্কে একটি বিরাট প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। কথাটা তো সত্যি, নিপীড়িতদের এবং উৎপীড়নকারীদের চেহারা সবসময় একরকম নয়। সুতরাং নাট্য রচনায় তাঁদের বিশ্লেষণও ঘটবে বহুভাবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টাবে তাদের চরিত্র ও চেহারা। সময়ের সাথে সাথে রকমফের ঘটবেই; সেই পরিবর্তিত চেহারা ও চরিত্র ধরতে হবে নাট্য রচনায়। মানুষের তথা শোষক-শোষিতের মিছিল যুগে যুগে রূপান্তরিত হবে। সবকিছুর রূপ পাল্টাচ্ছে, পাল্টাচ্ছে মানুষ এবং তার অনুভূতি। পাল্টে যাচ্ছে সময়ের প্রতিনিধিত্ব। ‘পুরানো’ সময়ের মধ্য থেকে ‘নতুন’ সময় জন্ম নিচ্ছে। ইতিহাসের জ্ঞান ছাড়া ঘটনার এই প্রতিটি পরিবর্তনকে বোঝা সম্ভব নয়। শম্ভু মিত্র চরিত্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে তাই ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে জানার যে-কথা বলেছেন, রাজনৈতিক নাটকের ক্ষেত্রেও তা সমানভাবে সত্যি।

রাজনৈতিক নাটক কোনো ধর্ম নয়, পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে রাজনৈতিক নাটকের পদ্ধতিও পাল্টায়; সেখানে নাটকের নামে একক বিধিবদ্ধ চিন্তাধারা নেই। কোনোদিন ছিলো না। কিন্তু লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট জনগণের মুক্তি। রাজনৈতিক নাটকে মানুষের মুক্তির লক্ষ্যকে সামনে রেখে দুজন নাট্যকারের নাট্য রচনায় ফারাক হতেই পারে কিন্তু তাকে প্রশ্নাতীতভাবেই নান্দনিক বোধসম্পন্ন শিল্প হয়ে উঠতে হবে। নাটক প্রধানত একটি শিল্প মাধ্যম এবং জনতার সেবক।

জনতার সেবাই যে-কোনো শিল্পের ধর্ম। শিল্প- সাহিত্য সম্পর্কে লেনিন বলেছিলেন, কৃষক-শ্রমিক-সাধারণ মানুষ বোঝে এমন ভাষায় তা লিখতে হবে বা বলতে হবে; কিন্তু বলতে হবে তাদের জানা বিষয়গুলো নয়, বলতে হবে গভীর জীবনবোধের কথা। কাল্পনিক রাষ্ট্র বা আইন নয়, বাস্তবে যা বিরাজিত তাকেই প্রকাশ করতে হবে। নান্দনিক বোধ না থাকলে জীবনের গভীর দিকগুলো তুলে ধরা যায় না এবং রাজনীতি-অর্থনীতি না বুঝলে রাষ্ট্র-আইন ইত্যাদি সম্পর্কে কিছুই ব্যাখ্যা করা যায় না।

মানুষের কোনো চিন্তাই শূন্যতা থেকে আসে না। চিন্তা বস্তুজগতের প্রতিফলন মাত্র। বস্তু জগতকে, বিশ্বের বস্তুবাদী দ্বান্দ্বিক অবস্থানকে যে নাট্যকার যতো ভালো বুঝবেন, তাঁর রচনা সেই পরিমানে ধারালো হবে। সেক্ষেত্রে মানুষের মানবিকতা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামও ঢের বৃহত্তর। কারণ, ধর্মীয় শোষণ, বিদেশিদের শোষণ, জমিদার ও ধনিকদের শোষণ, সুবিধাভোগীদের শোষণ ও অত্যাচারে দরিদ্র মানুষেরা ভুলে গেছে যে তারা মানুষ। বহু যুগ ধরে দরিদ্র মানুষকে অস্পৃশ্য ও হেয় করে দেখায় এমনটি ঘটেছে। সেজন্য সুষ্ঠুভাবে কোনো কিছু চিন্তা করবার ক্ষমতাই তাদের নেই। সেইসব মানুষদের কাছে চিন্তা পৌচ্ছ দিতে হবে।

তাদের চারপাশের দুনিয়ায় যা ঘটছে সে সম্পর্কে তাদের চক্ষু উন্মীলিত করে দিতে হবে। চিন্তার সংস্পর্শে আসা-এই টুকুই তাদের প্রথম প্রয়োজন বিপ্লবের প্রস্তুতির জন্য; নিজেদের ভাগ্য পাল্টাবার জন্য। বই পড়ে তাদের পক্ষে সেটা অর্জন করা সম্ভব নয় বলেই, নাটক সে-দায়িত্ব পালন করতে পারে। দর্শনের, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কঠিন কথাগুলো সহজ করে যিনি জনতার সামনে উপস্থিত করতে পারবেন, তিনিই হচ্ছেন এ-সময়ের মহৎ নাট্যকার। স্বামী বিবেকানন্দ বারবার দরিদ্র মানুষের কাছে চিন্তাসম্ভার বয়ে নিয়ে যাওয়ার দাবি তুলেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, কৃষক-মুচী-মেথর ঢের বেশি পরিশ্রমের ক্ষমতা রাখে।

যুগ যুগ ধরে তারা নীরবে কাজ করেছে এবং দেশের ঐশ্বর্য্য সৃষ্টি করেছে বিনা প্রতিবাদে। এখন তাদের প্রতিবাদ করার সময়। প্রতিবাদের শক্তি যোগাবার জন্য এই মানুষগুলোকেই শিক্ষিত করে তুলতে হবে। সেজন্য গভীর জ্ঞান তাদের কাছে পৌছে দিতে হবে। পিসকাটর ও ব্রেন্টের রাজনৈতিক নাটক সেই কাজটিই করতে চেয়েছিলো।

নাটক হচ্ছে বহু চরিত্রের পারস্পরিক সম্পর্কের একটি জটিল নকশা। কিন্তু সেই সম্পর্কগুলো তৈরি হয় সমাজের বা রাষ্ট্রের রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে। কার্যকারণ ছাড়া কোনো একজনকে শুধু খলনায়ক বানালেই হয় না। বর্তমান সমাজে মানুষ নিজেই বিনিময়ের পণ্য। কোনো মানুষই এ সমাজে স্বাধীন নয়। শাসকও বাধা পড়ে আছে সমাজের অর্থনৈতিক বন্ধনের কাছে-এই সত্যি উপলব্ধি না করলে নাটক লেখা যায় না; প্রকৃত শাসকের বা শোষকের কিংবা খলনায়কের চরিত্র অঙ্কণ করা যায় না। নাট্যকারকে আগে বুঝতে হয় কোন্ সমাজে তিনি বিরাজ করছেন এবং সেই সমাজের নাট্য দর্শক কারা, কোন্ কোন্ শ্রেণী বা পেশার লোক।

চলমান সময়কে বিশ্লেষণ করলে আমরা কী দেখতে পাই? শ্রমিকদের বা শ্রমজীবীদের কাজের অমানুষিকতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে এই সভ্যতা। মানুষকে এই সভ্যতা একটি ছাঁচে ফেলে দিয়েছে। বিকশিত পুঁজিবাদী সমাজের চরিত্রই এই; মানুষকে সে এক ধাঁচে ফেলে দেয়, ব্যক্তিত্বের ভিন্নতা রাখে না। মার্কস লিখছেন, ‘মানুষের যে-সব বৃত্তিকে লোকে এতদিন সম্মান করে এসেছে, সশ্রদ্ধ বিস্ময়ের চোখে দেখেছে, বুর্জোয়াশ্রেণী তাদের মাহাত্ম্য ঘুচিয়ে দিয়েছে। চিকিৎসাবিদ, আইনবিশারদ, কবি, বিজ্ঞানী-সকলকে এরা পরিণত করেছে তাদের মজুরি-ভোগী শ্রমজীবীরূপে।

কিংবা এরা নিজেরাই হয়ে ওঠে এক একজন ব্যবসায়ী। সবাই এখানে মুনাফালোভী হয়ে ওঠে কিংবা মুনাফার ভাগ পেতে চায়; কিংবা খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্য তাকে নামমাত্র মজুরিতে উদয়াস্ত কাজ করতে হয়। কলকারখানার শ্রমিকই হোক বা কোনো অফিসের পিয়নই হোক, দিনের পর দিন এই সমাজে সে একঘেয়েভাবে একই কাজ করে চলেছে। সারাদিন ধরে একঘেয়েভাবে একই কাজ করে যাওয়ার ফলে তারা বোকা হয়ে যায়। নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তি থেকে বিয়োজিত হয়ে পড়ে। মানুষের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে তার বহুমুখী প্রতিভা, কিন্তু মুদ্রাশাসিত সভ্যতা মানুষকে ক্ষুদ্র এক কর্মের গণ্ডির মধ্যে আটকে ফেলে তার মানবিক বৈশিষ্ট্যই হরণ করে। বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গিও তখন তার ক্ষুদ্র হয়ে পড়ে। কথাটা শুধু শ্রমিকদের বেলায়ই সত্য নয়। ইংরেজি শিক্ষায় গর্বিত কেরানি, নির্বাহী পদাধিকারী, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী সকল পেশাজীবীর ক্ষেত্রেই তা সত্য।

সারাজীবন ধরে একঘেয়ে কাজের পেছনে একইভাবে ছুটতে ছুটতে মানুষ নির্বোধ হয়ে যায়। কাজের চাপ ও একঘেয়েমি তাকে দেয় না দর্শন-ইতিহাস-মহৎ সাহিত্য পড়বার সময়, তাই সে জীবনের গভীরতা ও বৈচিত্র্য হারিয়ে ফেলে। বড়জোর সে কর্মক্লান্তি ঝেড়ে ফেলার জন্য দূরদর্শনের একঘেয়ে অনুষ্ঠান দেখে কিংবা ধনী হলে ক্লাবে যায়। কিন্তু সেখানেও সেই একই পরিবেশ যা তার ব্যক্তিত্বকে বিকশিত হতে দেয় না।

সর্বত্রই মূল আলোচ্য টাকা; কীভাবে রোজগারটা আর একটু বাড়ানো যায়। – এইরকম সমাজে মানুষ টাকার পেছনে ছুটতে ছুটতে নিজেই যন্ত্রে পরিণত হয়-গভীর কোনো জ্ঞানের অনুসন্ধান তখন আর তার কাছে আকর্ষণীয় মনে হয় না। কিছুটা মানসিক প্রশান্তির জন্য সে খোঁজে সস্তা বিনোদন কিংবা যৌন উত্তেজনা। কিন্তু সমাজ সচেতন একজন নাট্যকারের কাজ নয় তাকে সস্তা বিনোদন বা যৌন উত্তেজনা সরবরাহ করা।

বরং তার মানসিক জগতে ঘা দেয়াই নাট্যকারের কাজ। নাট্যকারের দায় তার মৃতপ্রায় ব্যক্তিত্বকে জাগিয়ে তোলা; যা সে হারিয়েছে যন্ত্রসভ্যতায় তাকে খুঁজে পেতে সাহায্য করা। তাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে দেয়া নিজের মূল পরিচয় হারিয়ে সমাজ- সভ্যতার কোথায় সে এখন দাঁড়িয়ে আছে, মানুষ হিসাবে আসলে তার কোথায় থাকবার কথা ছিলো। মানুষের বহুমুখী প্রতিভার সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়াটাই তাই আজকের বিপ্লবী নাটকের কাজ। সেখানে সস্তা প্রেমের গল্প থাকবে না, ক্ষুদ্র ছোটো- খাটো লড়াই নিয়ে চিৎকার চ্যাঁচামেচি করা হবে না। ইতিহাসের বৃহৎ বৃহৎ ঘটনা সেখানে স্থান পাবে।

নাটকে প্রতিদিনের দেখা ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখে মানুষের চিন্তার জগতে তেমন কোনো পরিবর্তন আসে না। দরকার উত্তেজনাপূর্ণ সব ঘটনা, যা তার চিন্তার জগতকে বারবার নাড়া দেবে। সেজন্যই সাধারণ মধ্যবিত্তের ঘরের দ্বন্দ্ব ও মনোমালিন্য অবলম্বনে তথাকথিত বাস্তববাদী নাটক, যেখানে পিতা-পুত্র, পিতা-কন্যা বা স্বামী-স্ত্রীর কলহকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সাজানো হয়; দৈনন্দিন ঘটনার পুনরাবৃত্তি করা হয়-তা বিপ্লবের কোনো কাজে আসতে পারে না। এবং এসব নাটক মানুষের চিন্তায় যুগান্তকারী কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী নাট্যচর্চা কোনো যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারলো না শুধুমাত্র বিষয়বস্তুর দুর্বলতার জন্যই। মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্তদের দৈনন্দিন জীবনই হয়ে উঠেছিলো নাটকের বিষয়। দেখতে দেখতে সত্তর দশকেই কয়েক কুড়ি নাটক রচিত হলো কিংবা মঞ্চস্থ হলো যেখানে রয়েছে নিম্নমধ্যবিত্তের চাকরির সমস্যা, পরিবারের নানা মনোমালিন্য, আর্থিক কারণে নারীর দেহ বিক্রি।

নাটকে ক্লান্তিকর সব দুঃখ-যন্ত্রণা ও আবেগের আমদানি করা হলো। নাট্যকাররা এমন সমাজ থেকে নায়ক বেছে আনছিলেন, যে-সমাজে কোনোরকম আলোড়ন ঘটে না। নিম্নমধ্যবিত্তের দৈনন্দিন জীবনে সামান্য মান-অভিমান, ছোটোখাটো মনোমালিন্য ছাড়া এমন বৃহৎ কী ঘটে যা নাটকে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে, বিরাট ইতিহাসের চিত্র যেখানে ফুটে ওঠে? মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্তের দৈনন্দিন জীবন নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করতে গিয়ে সত্তর দশকের পরবর্তী পর্বের নাটকও ক্রমশ বর্ণহীন, জোলো, আকর্ষণহীন হয়ে উঠলো এবং দর্শক কমতে থাকলো।

যখন শেক্সপিয়ার নাটক রচনা করেন, নাটকের মূল ঘটনায় জড়িত থাকে রাষ্ট্রের উত্থান-পতন, ব্যক্তির বিরাট সব কর্মকাণ্ড। মার্লোর নাটকে রাজারাজড়াদের বাইরে গিয়ে প্রথম যখন উঠতি মধ্যবিত্ত ডক্টর ফস্টাসকে নায়ক করা হলো তখন সে কিন্তু আর ঘটনায়ও মধ্যবিত্তের দৈনন্দিন জীবন ছিলো না। ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গ। মধ্যবিত্ত জগতকে আশ্রয় করে, তাদের দৈনন্দিন জীবনকে লিপিবদ্ধ করে নাটককে আকর্ষণীয় করে তোলা কঠিন, যদি না রাষ্ট্রের সাথে সংঘাতে মধ্যবিত্ত বিরাট শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়।

মধ্যবিত্তকে নাটকে আনতে হলে তাকে অবশ্যই আসতে হবে রাষ্ট্রের সাথে সংঘাতের মধ্য দিয়ে কিংবা সাহসী বুদ্ধিদীপ্ত হিসাবে; মধ্যবিত্তকে সেখানে আসতে হবে নতুন চিন্তার, নতুন দর্শনের স্রষ্টা হিসাবে।

মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত প্রতিদিন কী করে, কীভাবে জীবন কাটায় সেটা উপন্যাসের বিষয় হতে পারে, নাটকের নয়। কিন্তু মধ্যবিত্ত ঘরের কোনো সন্তান যখন হঠাৎ ফুসে ওঠে রাষ্ট্রের প্রচলিত নিয়ম-কানুনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, ভয়ানক কিছু একটা ঘটাতে চায়, ঠিক তখনি সে নাটকের নায়ক হবার যোগ্যতা অর্জন করে। গ্যালিলিও চার্চের দীর্ঘদিনের বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলো এবং সে ব্যাপারে দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিলো বলেই সে বহুকাল ধরে ইতিহাসের নায়ক হয়ে থাকবে।

যে খায় আর ঘুমায় সে নায়ক হতে পারে না, যে কিছু একটা অঘটন ঘটায় সেই নায়ক হয়। দর্শক নায়ক। হিসাবে তাকেই দেখতে চায় যে বিরাট বিরাট সব কাণ্ড ঘটায়। যদি ঘটনাটা ইতিহাস আশ্রিত হয়, দর্শক তাতে বেশি আকর্ষণ অনুভব করে। মধ্যবিত্ত নায়ক যখন নায়িকার জন্য চাকরি ত্যাগ করে কিংবা নায়িকার ব্যাগটা এগিয়ে দেয়-নাটকের এসব ঘটনা তাৎক্ষণিকভাবে দর্শকের ভালো লাগতে পারে, কিন্তু দর্শকের চেতনাকে পাল্টাতে সাহায্য করে না।

প্রাচীন ও মধ্যযুগের মহৎ নাট্যকাররা বড় বড় ট্র্যাজেডি লিখেছেন, কারণ তা দর্শকের চেতনাকে নাড়া দেয়। গ্রীক ট্র্যাজেডি ইডিপাস দৈনন্দিন জীবনের কোনো গল্প নয়। ঐ নাটকে রয়েছে মানুষ সম্পর্কে নতুন সব প্রশ্ন, তাই ঐ নাটকের আবেদন এখনো রয়ে গেছে। বিশ্বে চিরায়ত ট্র্যাজেডি ও চিরায়ত কমিডিগুলো আজও মঞ্চস্থ হয়ে চলেছে তার একটি আবেদন আছে বলেই। কিন্তু সারা বিশ্বজুড়ে মধ্যবিত্তদের দৈনন্দিন জীবন প্রবাহকে ঘিরে যে-অসংখ্য নাটক রচিত হয়েছে, সেগুলো নিজ দেশ-কালের সীমা অতিক্রম করতে পারেনি। বাস্তবকে হুবহু অনুকরণ করতে গেলে নাটক হয় না, কিন্তু যেখানে ঘটনাবহুল কিছু ঘটে সেখানেই নাটক জন্ম নেয়।

সেখান থেকেই নাটকের গল্পকে ছেঁকে বার করতে হয়। যুদ্ধ নিয়ে পৃথিবীতে তৈরি হয়েছে বহু শিল্প-সাহিত্য, কারণ যুদ্ধ কোনো দৈনন্দিন ঘটনা নয়। যুদ্ধে, বিপ্লবে যে রক্তপাত ও নিষ্ঠুরতা এবং এর বিরুদ্ধে মানুষের সাহসী প্রতিবাদ, মৃত্যুর মুখোমুখি দাড়ানো-এগুলো দৈনন্দিন জীবন নয়। যুদ্ধ একটি ঘটনাবহুল সময়-দৈনন্দিন জীবন যুদ্ধে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। ফলে সেখানে নাটকীয় উপাদান জন্ম নেয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, যুদ্ধ সমাজ-অর্থনীতি- শাসকসম্প্রদায় সবকিছুকে ওলট-পালট করে দেয়। নতুন নতুন দেশ জন্ম নেয়। পৃথিবীর ভূখণ্ডটাকেই পাল্টে ফেলে।

পৃথিবীর কোনো মহৎ নাটকই দৈনন্দিন জীবনের কাহিনী নয়। দৈনন্দিন জীবন তো মানুষের জানা বিষয়, নতুন কী ঘটলো মানুষ তাই জানতে চায়। সব সময় দেখা যায়, রাজনৈতিক উত্থান-পতনের ঘটনা জানার জন্য মানুষ উদগ্রীব হয়ে ওঠে। যখন রাষ্ট্রে রাজনৈতিক টানাপোড়েন চলে মানুষ তার সংবাদ জানার জন্য সংবাদপত্র খোঁজে, বেতার শোনে, দূরদর্শনের সামনে বসে থাকে, রাস্তায় গিয়ে ভীড় জমায়। যদি একটা দশতলা ভবন ধ্বসে পড়ে সেটা মানুষের কাছে উত্তেজনাকর খবর-তার দৈনন্দিন জীবনের চেয়ে।

বন্ধুর মেয়ের বিয়ের খবরের চেয়ে দশতলা কোনো ভবনে আগুন লাগাটা তার দৃষ্টিকে বেশি আকৃষ্ট করে। যে-কোনো নাট্যকারকে দর্শকের এই মনস্তত্ত্ব বুঝতে হবে। দৈনন্দিনের দিকে তাকিয়ে নাটক লিখলে তা নাটক হবে না, যদি না সেখানে নাটকীয়তা তৈরি হয়। নাটকে তাই উত্তেজনা থাকতে হবে। কিন্তু বিকৃত কোনো উত্তেজনা নয়, তা হতে হবে ইতিহাস আশ্রিত, বাস্তবসম্মত। নায়ক বা খলনায়ক বহুগুণ আকর্ষণীয় হবে যদি সে বিশ্ব ইতিহাসের কোনো এক পক্ষের প্রতিনিধি হয়। যেমন সক্রেটিস, ব্রুটাস, হিটলার, রাসপুটিন।

নাট্য রচনার একটি বড় দায় হচ্ছে চরিত্র সৃষ্টি। বৃহৎমাপের চরিত্র সৃষ্টির মধ্য দিয়েই নাটক আসলে দর্শক হৃদয় জয় করে। সেজন্য সকল মহৎ নাট্যকারের রচনায় দেখা যায়, ঘটনার পাশাপাশি রয়েছে বৃহৎ-সব চরিত্র। প্রাচীন গ্রীসের নাটকে প্রমিথিউস, ইডিপাস, আন্তিগোনে, হেলেন, লিসিস্ট্রা; মার্লোর নাটকে তৈমুর লং, ডক্টর ফস্টাস, শেক্সপিয়ারের নাটকে কিং লিয়ার, হ্যামলেট, ম্যাকবেথ, শাইলক; ইবসেনের নাটকে নোরা, হেড্ডা গাবলার, বার্নার্ড শর নাটকে সীজার, ক্লিওপেট্রা, ব্রেন্টের নাটকে মা, ম্যাকি, গ্যালিলিও; উৎপল দত্তের নাটকে বাহাদুর শাহ, তিতুমীর, ভগবৎ সিং ইত্যাদি। তালিকা দীর্ঘতর করা যায়।

মহৎ নাটকে চরিত্ররা বিষয়বস্তুর মধ্যে ঢুকে পড়ে গোটা সমাজের মূল দ্বন্দ্বগুলোকে তুলে ধরে, একটি যুগের সমগ্র মানবগোষ্ঠীর কোনো একটি অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। হ্যামলেট কোনো ভাগ্যের হাতে মার খাওয়া রাজপুত্র নয়; যুগ যুগের সব কিছু বুঝতে পারা, কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ মধ্যবিত্ত দোদুল্যমানতার প্রতীক হয়ে দাঁড়ালো। নিজের চারিত্রিক দুর্বলতা এবং চারপাশের ঘটনাবলী হ্যামলেটের পতনের কারণ। সত্তর দশকে বাংলাদেশের নাটকে স্মরণ করার মতো এইরকম কোনো বৃহৎ মাপের চরিত্র দেখা যায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চরিত্রগুলো সমাজের কোনো অংশের প্রতিনিধিত্বও করে না। কিন্তু শেখ মুজিব, তাজুদ্দীন আহমদ, জিয়াউর রহমান, কর্নেল তাহেবের মতো ব্যক্তিদের নিয়ে রচিত হতে পারতো কালজয়ী চরিত্র এবং ঘটনাবহুল ইতিহাস আশ্রিত নাটক।

বাস্তবে তা ঘটলো না। শেখ মুজিবকে হত্যা করার পর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে পালাবদল ঘটে স্বভাববাদ নাটকের উদ্ভব ছিলো সেই প্রতিক্রিয়ারই অংশ। তবে সে বিষয়বস্তুতে কখনই সমকালীন রাজনীতির প্রতিফলন ঘটেনি, সমকালীন রাজনীতির চিত্র ফুটে ওঠেনি। সবগুলো নাটকের বিষয়বস্তুই ছিলো সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাবলী থেকে যোজন যোজন দূরে। পঁচাত্তর সালের পর বিশেষ করে পঁচাত্তর থেকে সাতাত্তর পর্যন্ত রাজনীতিতে দ্রুত নানারকম পালাবদল ঘটে, নাটকীয় উত্থান-পতনে ছিলো রাজনৈতিক অঙ্গন উচ্চকিত। নাট্যরচনায় তার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাবে না। নাট্যদলগুলো রাজনৈতিক ঘটনাবলী থেকে দৃষ্টিকে ফিরিয়ে রেখে সস্তা ও আবেগধর্মী মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জীবনকেই প্রধানত নাটকের বিষয়বস্তু করে তুললো। ছিয়াত্তর থেকে উনআশি সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরে মূলত কী ধরনের নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে সেটা বোঝার জন্য আমরা শিল্পকলা একাডেমী আয়োজিত তিনটি নাট্যোৎসবে প্রদর্শিত নাটকগুলো পর্যালোচনা করবো।

সাতাত্তর সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী এক নাট্যোৎসবের আয়োজন করে যেখানে দেশের বিভিন্ন জেলার মোট উনত্রিশটি দলের নাটক মঞ্চস্থ হয়। শিল্পকলা একাডেমী আয়োজিত জাতীয় নাট্যোৎসব ১৯৭৬-৭৭-এ ঢাকার বাইরের প্রায় সবগুলো জেলা থেকেই নাট্যদল প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। সেইসব দল ও তাদের নাটকগুলো হচ্ছে দিনাজপুরের নবরূপীর শাহ্জাহান শাহ রচিত ইত্যাদি ধরনের প্রভৃতি। রংপুরের শিখা সংসদ মঞ্চস্থ করে রতন কুমার ঘোষের ভূমিকম্পের আগে। কুমিল্লার যাত্রিক নাট্যগোষ্ঠী মঞ্চস্থ করে রতন কুমার ঘোষের ভূমিকম্পের পরে। যশোরের ঝিনেদা কলা পরিষদ মঞ্চস্থ করে ফররুখ শিয়রের সামনের পৃথিবী।

রাজশাহী সাংস্কৃতিক সংঘ মঞ্চস্থ করে শংকর ভাদুরীর ইন্টারভিউ। পটুয়াখালীর শহীদ স্মৃতি পাঠাগার মঞ্চস্থ করে নির্মল কুমার দাশগুপ্তের নন্দিত আলোকে এসো; পটুয়াখালী ড্রামাটিক ক্লাব মঞ্চস্থ করে মহেন্দ্র গুপ্তের টিপু সুলতান। খুলনা নাট্য নিকেতন মঞ্চস্থ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শাস্তি। বরিশালের খেয়ালী মঞ্চস্থ করে অগ্নিমিত্রের কিন্তু নাটক নয়। সিলেটের বৈশাখী নাট্য গোষ্ঠী মঞ্চস্থ করে হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের জনতার আদালত ও একুশের নাম বাংলাদেশ। খুলনার সাতক্ষীরা প্রগতি সংঘ মঞ্চস্থ করে খায়রুল বাসারের শান্ত এখন কাঁদে। টাঙ্গাইলের করোনেশন ড্রামাটিক ক্লাব মঞ্চস্থ করে রতন কুমার ঘেষের ভোরের মিছিল। বগুড়া নাট্যগোষ্ঠী মঞ্চস্থ করে মুনীর চৌধুরীর দণ্ডকারণ্য।

পাবনার মঞ্চ পরাগ মঞ্চস্থ করে শওকত ওসমানের ক্রীতদাসের হাসি; নাট্যরূপ দিয়েছেন রামেন্দু মজুমদার। নোয়াখালীর ফ্রেন্ডস ক্লাব মঞ্চস্থ করে মমতাজউদদীন আহমদের ফলাফল নিম্নচাপ। মুন্সীগঞ্জের প্রবাহ নাট্যগোষ্ঠী মঞ্চস্থ করে প্রবীর দত্তের ক্ষিৎস। দিনাজপুর নাট্য সমিতি মঞ্চস্থ করে মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের ক্যাপ্টেন হুররা। পাবনার বনমালী ইন্সটিটিউট মঞ্চস্থ করে ডি. এল রায়ের শাজাহান।

সমগ্র বাংলাদেশের ষোলটি জেলার উনত্রিশটি দল উল্লিখিত উৎসবে অংশ নেয়। ঢাকার বাইরে থেকে আসে বাইশটি দল। এই উৎসবে যে নাটকগুলো মঞ্চস্থ করা হয়, বিশেষ করে ঢাকার বাইরের বেশির ভাগ নাটকগুলো সম্পর্কে জনৈক সমালোচক মন্তব্য করেন, মঞ্চস্থ নাটকগুলোর মধ্যে আলোচনাযোগ্য নাটক সামান্যই। এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যায় মফস্বলের নাটকের বিষয়বস্তু ও প্রযোজনার মান দুটোই ছিলো দুর্বল। ঢাকা চট্টগ্রামে যেমন বাংলাদেশের অন্যান্য জেলাতেও তেমনি নাটক মঞ্চায়নে সমকালীন উত্থান-পতনের ঘটনা স্থান পায়নি। নাট্যান্দোলন সব সময় রাজনৈতিক ঘটনাবলী থেকে বহুদূর পিছিয়ে ছিলো।

যদিও সাতাত্তরের উৎসবে অনেকগুলো পঁচাত্তরের পূর্বে লেখা নাটক মঞ্চায়ন করা হয়েছে তবে পঁচাত্তর পরবর্তীকালের লেখা নাটকগুলিও তেমন স্মরণযোগ্য কিছু ছিলো না। সেক্ষেত্রে ধরে নেয়া যেতে পারে পঁচাত্তরের পরবর্তী উত্থান পতনের ঘটনা মাত্র স্বল্প সময় পরেই নাটকের বিষয়বস্তুর মধ্যে চলে আসা সম্ভব ছিলো না। প্রস্তুতির জন্য ঘটনাকে বুঝে নেয়ার জন্য নাট্যকারদের কিছু সময় দরকার ছিলো। কিন্তু উনিশশো সাতাত্তর ও আটাত্তর সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নাট্যোৎসবের নাটকগুলো পর্যালোচনা করলে আমাদের একইভাবে হতাশ হতে হয়। সেই উৎসবে ঢাকার বাইরে থেকে সতেরটি দল অংশ নেয়। চট্টগ্রামের দুটি দল এবং রংপুর, রাজশাহী, চাঁদপুর, মুন্সিগঞ্জ, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, সিলেট, কুষ্টিয়া, বগুড়া, খুলনা, যশোর, দিনাজপুর ও টাঙ্গাইল থেকে একটি করে দল তাদের নাটক মঞ্চস্থ করে।

যশোরের তরঙ্গ নাট্য গোষ্টী মঞ্চস্থ করে জিয়া হায়দারের শুভ্রা সুন্দর কল্যাণী আনন্দ, কুষ্টিয়ার আমরা ক’জন সাহিত্য সংসদ মঞ্চস্থ করে স. ম. ওহিদুল কাওসারের লেখা সমুদ্রে সাইরেন। সিলেটের প্রান্তিক মঞ্চস্থ করে বিড়ম্বিত আর্তনাদ; নাট্যকার বিদ্যুৎ কর। রাজশাহী সংস্কৃতি সংঘ মঞ্চস্থ করে রবিউল আলমের সমাপ্তি অন্যরকম।

ফরিদপুর টাউন থিয়েটার মঞ্চস্থ করে এম এস হুদা রচিত তালেব মাস্টারের হালখাতা। চাঁদপুরের অনন্যা নাট্যগোষ্ঠী মঞ্চস্থ করে আবদুল্লাহ আল-মামুনের সুবচন নির্বাসনে। মুন্সিগঞ্জের প্রবাহ নাট্যগোষ্ঠী মঞ্চস্থ করে সফোক্লিসের ইডিপাস। পাবনার নবীন নাট্য সংসদ মঞ্চস্থ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিসর্জন। গাইবান্ধার কালচারাল এ্যান্ড ড্রামাটিক ক্লাব মঞ্চস্থ করে তুলসী লাহিড়ীর ছেঁড়া তার। বগুড়া নাট্যগোষ্ঠী মঞ্চস্থ করে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর তরঙ্গ ভঙ্গ। খুলনা নাট্যনিকেতন মঞ্চস্থ করে গঙ্গাপদ বসুর সত্য মারা গেছে, দিনাজপুরের বৈকালী নাট্যগোষ্ঠী মঞ্চস্থ করে আনোয়ার তালুকদারের উৎস থেকে সমুদ্দুর ও মোহাম্মদ এহসানুল্লাহর কিংশুক যে মরুতে।

নোয়াখালী ফ্রেন্ডস ক্লাব মঞ্চস্থ করে মুনীর চৌধুরীর কবর ও মামতাজউদ্দীন আহমদের হরিণ চিতা চিল। ময়মনসিংহের বহুরূপী মঞ্চস্থ করে শেখ আকরাম আলীর বিক্ষুদ্ধ অতীত এবং নজরুল। টাঙ্গাইলের নাট্যবিতান মঞ্চস্থ করে গোলাম আম্বিয়া নূরীর কুমার খালীর চর। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরের দলগুলো যে নাটকগুলো মঞ্চস্থ করেছে তার বিষয়বস্তু ও প্রযোজনা নিয়ে সমালোচকরা খুব খুশি ছিলেন না।

বেশিরভাগ দলের নাটকের মান যে আশানুরূপ নয় সমালোচকরা সে কথা খুব জোরের সাথেই বলে ছিলেন।বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী উনআশি-আশি সালে জেলাভিত্তিক একটি নাট্যোৎসবের আয়োজন করে। সে উৎসবকে কেন্দ্র করে বিশটি জেলার মোট একশো চৌষট্টিটি দল সর্বমোট একশো তেয়াত্তরটি নাটক মঞ্চস্থ করে।

সেই নাট্যোৎসবে সবচেয়ে বেশি মঞ্চস্থ হয়েছে আবদুল্লাহ আল মামুনের নাটক। আবদুল্লাহ আল-মামুনের পাঁচটি নাটক চোদ্দটি গোষ্ঠী অভিনয় করেছে। নাটকগুলো হচ্ছে এবার ধরা দাও, সুবচন নির্বাসনে, এখন দুঃসময়, উজান পবন, জীবন বারে বারে। জিয়া আনসারীর চোর চোর নাটকটি মঞ্চস্থ করেছে এগারটি দল। মামুনুর রশীদের ওরা কদম আলী করেছে ছয়টি দল। মমতাজউদ্‌দীন আহমদের পাঁচটি নাটক করেছে ছয়টি দল। নাটকগুলো হচ্ছে ফলাফল নিম্নচাপ, যামিনীর শেষ সংলাপ, হরিণ চিতা চিল, এই রোদ এই বৃষ্টি, স্পার্টাকাস বিষয়ক জটিলতা। রাধারমন ঘোষের সাতটি নাটক মঞ্চায়ন করেছে নয়টি দল। নাটকগুলো হচ্ছে শতাব্দীর পদাবলী, অমৃতস্য পুত্রা, ইতিহাস কাঁদে, হইতে সাবধান, বিবর্ণ বিস্ময়, অথঃস্বর্গ বিচিত্রা, যদিও সন্ধ্যা।

 

রাজনৈতিক নাট্যচিন্তা ও স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের মঞ্চনাটক | সূচিপত্র

 

শেখ আকরাম আলী, কাজী জাকির হাসান, রবিউল আলম, এম, এস হুদা, কল্যাণ মিত্র, অগ্নিদূত, রতন কুমার ঘোষ, শৈলেশ গুহ নিয়োগী, শচীন ভট্টাচার্য ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একাধিক নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। সে উৎসবে আরো মঞ্চস্থ হয় মাস্তান সুন্দরী ও জোস্না, শরীফুদ্দিনের শ্মশান সৈকতে, আনোয়ারুল ইসলামের তেঁতুল তলার খেয়া, ফুলজান সমাচার, বিমল মজুমদারের চৌকিদার।

জেলা শহরগুলো বা মফস্বলে মঞ্চায়িত নাটকগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে সেখানে যেমন ছিয়াত্তরের পরও স্বাধীনতা পরবর্তী কিছু কিছু বিমূর্তধারার নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছিলো, তেমনি মঞ্চস্থ হচ্ছিলো স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বহু নাটক। বিমূর্ত ধারার নাটকগুলোর মধ্যে আমরা দেখতে পাই কিংশুক যে মরুতে, উৎস থেকে সমুদ্দুর, শুভ্রা সুন্দর কল্যাণী আনন্দ, চর্যাপদের হরিণী, ইত্যাদি। আবার টিপু সুলতান, শাজাহান, সিরাজদৌলা, মীরকাসিম এ ধরনের বহু পুরোনো নাটকও মঞ্চস্থ হতে দেখি। বিদেশি নাটকের অনুবাদও মঞ্চস্থ হয় যেমন ইডিপাস, রাইফেল। নাটক মঞ্চায়নের মূল যে ধারাটা দেখতে পাই সেটা অনেকটা পুরানো সামাজিক নাটকের ঢংয়ে লেখা শোষক- শোষিত কিংবা ধনী দরিদ্রের মধ্যকার বিরোধ নিয়ে।

সেখানে সমাজের সত্যিকার বিশ্লেষণ তুলে ধরার চেয়ে ব্যক্তি মানুষের ভালাবাসা-রাগ-ক্ষোভ-ঘৃণাই বিপুল আবেগভারে জর্জরিত হয়ে মঞ্চায়িত হয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী যে বিমূর্ত ধারা বা যেসব বেখাপ্পা বা উদ্ভট নাটকের দেখা আমরা পাই, তা জেলা শহরগুলোতে তেমন কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। জেলা শহরের নাটকগুলোতে বক্ত্যবের চেয়ে বিনোদন দেয়ার প্রচেষ্টা প্রথম দিকের নাটকগুলোতে বেশি লক্ষ্য করা যায়। সেগুলোর মধ্যে যেটুকু বক্তব্য ছিলো তার সাথে তৎকালীন রাজনীতির যে-কোনো সম্পর্ক ছিলো না সেটা আমরা দুই উৎসবের বিভিন্ন নাটকের বিষয়বস্তুর মাধ্যমে এখানে তুলে ধরতে চেষ্টা করবো।মনী। তা ইত্যাদি ধরনের প্রভৃতি নাটকের মূল চরিত্র গ্রামের সহজ সরল মানুষ আক্কেল আলী। সে শহরে আসে তার স্ত্রী নূরীর খোঁজে।

নূরী শহরে চৌধুরী সাহেবের বাসায় কাছ করার জন্য এসেছে। আক্কেল আলী চৌধুরী সাহেবের বাসার ঠিকানা জানে না, জানে লাল রংয়ের একটি বাড়িতে থাকে সে। বিরাট শহরে এসে আক্কেল আলী আর সে বাসা খুঁজে পায় না। সেই খোঁজাখুঁজির ফাঁকে তার সাথে দেখা সিনেমা পরিচালক, প্রযোজক, কবি, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, পীর, প্রফেসর ইত্যাদি বিভিন্ন পেশার লোকদের সাথে। তারা সকলেই অসৎ ও দুর্নীতিপরায়ণ। সিনেমা পরিচালক সরল সহজ গ্রামের আক্কেল আলীকে ভিজিটিং কার্ড দিয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত সেই ঠিকানায় গিয়ে পরিচালকের সিনেমার সুটিংয়ে হাজির হয় আক্কেল আলী। সেখানে গিয়ে দেখে ছবির নায়িকাই হচ্ছে তার স্ত্রী নূরী। নূরীকে দেখে আক্কেল আলী খুশি হয়।

কিন্তু নূরী তাকে চিনতে চায় না। নূরী শেষ পর্যন্ত স্বীকার করে সে আক্কেল আলীকে চেনে। তবে সে জানায়, আক্কেল আলী ছিলো তার গ্রামের বাড়ির চাকর। নূরীর কথা মতো আক্কেল আলীকে পিটিয়ে সেখান থেকে বের করে দেয়া হয়। এই হচ্ছে ইত্যাদি ধরনের প্রভৃতি নাটকের গল্প। বিভিন্ন চরিত্রগুলোকে মঞ্চে এনে এবং তাদের অসততা ও মিথ্যাচার দেখিয়ে নাট্যকার বোঝাতে চেয়েছেন সমাজে কীভাবে মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়েছে। মূল্যবোধের অবক্ষয় তুলে ধরাই ছিলো এ নাট্যকারের প্রধান উদ্দেশ্য।

সামনের পৃথিবী নাটকের বিষয়বস্তু হচ্ছে রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়ার পর গ্রাম্য ছাত্রের কী পরিণতি ঘটে। গ্রাম থেকে শহরে আসা ছাত্র রাজনৈতিক আন্দোলনে নেমে মিছিলে আহত নিহতদের রক্ত দর্শনে স্মৃতি হারিয়ে ফেলে। গ্রামের অত্যাচারী ভূস্বামীকে হত্যা করার পর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে এবং তার আগে নতুন পৃথিবী গড়ার ইঙ্গিত রেখে যায় সকলের জন্য। ইন্টারভিউ নাটকে মূলত যুব সমাজের বেকারত্বই প্রাধান্য পেয়েছে।

সমাজে বেকার বাহিনীই জন্ম দিয়েছে রাজনৈতিক উগ্রপন্থার ও অর্থহীন হত্যার। অবস্থার চাপে নিম্নবিত্ত যুবকরাই হত্যার শিকার কিংবা হত্যাকারীর ভূমিকায় নামে, নাটকে তারও প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত রয়েছে। তা সত্ত্বেও দেখা যায়, বেকারত্বের বাজারে এক যুবক ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি পেলেও অসহায় এক রমণীর জন্য তার চাকরি পরিত্যাগ করে। যুবকের আত্মত্যাগই নাটকে প্রধান হয়ে উঠেছে। ১৯৪ কিন্তু নাটক নয় নাটকে কিছু মাতাল ইত্যাদি চরিত্র দর্শকদের ভিতর থেকে মঞ্চে উঠে নাট্যকারের কাছে নিজের দুঃখের কাহিনী ব্যক্ত করে। কিছু অসহায় মানুষের চরিত্র ফুটে ওঠে তার মধ্য দিয়ে। যামিনার শেষ সংলাপ হচ্ছে একজন প্রখ্যাত অভিনেতার শেষ জীবনের করুণ পরিণতির গল্প। শান্ত এখন কাঁদে নাটকটি হচ্ছে আত্মহত্যা প্রবণ জনৈক তরুণের সকরুণ গাঁথা।

নন্দিত আলোকে এসোর বিষয়বস্তুর মধ্যে দেখতে পাই আদর্শবাদী শিক্ষক পিতার আর্দশবাদী কন্যা ও বসে খাওয়া পুত্রের দ্বন্দ্ব এবং কন্যার নতুন সমাজের পথে এগিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত। শিক্ষাব্রতী পিতার সাধনা জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে নতুন মানুষ সৃষ্টি করা। নাটকে আদর্শ মানুষ গঠন আর উত্তম পুরুষ সন্ধানের আকুতি প্রধান হয়ে উঠেছে। বহু সন্তানের পিতার অসহায় অবস্থা দেখানোর পাশাপাশি সাংসারিক অশান্তির মূলে যে ছোট পরিবারের অনুপস্থিতি সেটাও এ নাটকের বক্তব্যে ঘুরে ফিরে এসেছে।

মধ্যবিত্ত সমাজের বিবিধ সমস্যা নিয়ে লেখা নাটক বিড়ম্বিত আর্তনাদ। সচেতন এক তরুণ যুবক আদর্শকে আঁকড়ে ধরে শত চেষ্টা করেও পারেনি বোনের কাঁধ থেকে সংসারের জোয়ালটা নামিয়ে নিজের কাঁধে তুলে নিতে। বোনও পারছিলো না জোয়ালটা নিজের কাঁধ থেকে নামাতে। দুঃসহ জোয়াল টানতে গিয়ে বোন লালসার শিকার হয়েছিলো বিত্তবানের। দারিদ্র্যের কাষাঘাতে জর্জরিত বাবা-মা ভুলেছিলেন মমত্ববোধ, কর্তব্যবোধ।

তরুণ যুবক পারেনি তার স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে। আদর্শের সাথে সংগ্রাম করে পায়নি কোনো সমাধান কিন্তু রেখে যায় জিজ্ঞাসা। তালেব মাস্টারের হালখাতা একজন দরিদ্র স্কুল শিক্ষকের অভাবের কঠিনতম পরিণতি। তালেব মাস্টার নাটকের প্রধান চরিত্র। স্কুল শিক্ষক তালেব দুটি কন্যা আর ছটি পুত্রের জনক। নিম্নবিত্ত পরিবারের যা স্বাভাবিক সঙ্গী তীব্র অভাব-অনটন তার জীবনকে বিপর্যস্ত করে দিয়ে যায়।

স্ত্রী খুবই অসুস্থ, ছোট ছেলে খোকা মৃত্যু শয্যায় শায়িত। এদের চিকিৎসা তার সামর্থ্যে কুলায় না। মেয়ে ফাতিমা উচ্চ শিক্ষিত হয়েও বেকার। শিক্ষক তার নীতি আর আদর্শে অটল। অর্থ উপার্জনের বঙ্কিম পথ হাতছানি দিলেও নিজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কাছে সে এতোটুকু পরাজিত হয় না। সেজন্য মৃত্যুপথযাত্রী স্ত্রী গঞ্জনা দিয়ে যায়। তবুও সে অটলই থাকে। জীবনের হিসাব মিলাতে না পেরে শেষে স্মৃতিভ্রষ্ট ঘটে।

বিক্ষুব্ধ অতীত এবং নজরুল নাটকে নজরুলকে নিয়ে ব্যবসা করতে নেমেছেন একদল রাজনীতিবিদ ও সংস্কৃতিসেবী। নজরুলকে সম্মান প্রদর্শনের নামে জড়ো হয়েছেন বিশিষ্ট ও খ্যাতনামা পুস্তক ব্যবসায়ী, বৃদ্ধ ধার্মিক, পুলিশ অফিসার আর সমাজসেবক রাজনীতিবিদ যাদের মূল লক্ষ্য ব্যবসা করা। নজরুলকে নিয়ে যে হৃদয় বিদারক ব্যবসা হয়েছে তার চিত্রই ফুটে উঠেছে নাটকে।

পাশাপাশি বিদ্রোহী কবির জীবনের নাটকীয় আকাঙ্ক্ষা বেদনার উজ্জ্বল চিত্রণও আছে। কুমারখালির চর নাটকটি মিলেমিশে থাকা দুই ভাই এর বিরোধ, গ্রামের মোড়লদের প্ররোচনায় অবশেষে সম্পত্তি ভাগ এই আখ্যানের ওপর দাঁড়ানো। পারিবারিক এই দ্বন্দ্বের পটভূমিকায় রাখা হয়েছে একটি আঞ্চলিক অথচ সামগ্রিক সমস্যা চরদখল।

চর অঞ্চলের এক বৃদ্ধের পরিবারের দুই সন্তান ময়জুদ্দি ও ফয়জুদ্দি। দুই ভাইয়ের স্ত্রী ফেরোজার মা আর আশাফনের মধ্যকার বচসা ও ঝগড়াকে কেন্দ্র করে গ্রাম্য মাতব্বরের প্ররোচণায় দু ভাইয়ের মধ্যে সম্পত্তি ভাগ হয়ে যায়। মাতব্বররা ছোট ভাইকে চাষের কাজে লাগায়। ধান যখন মাঠে হিল্লোলিত হয় তখন মাতব্বর নিজ স্বার্থ উদ্ধারের লোভে ধানে অগ্নিসংযোগ করে এবং ফয়জুদ্দির সুন্দরী বউ আসাফনকে ভোগ করতে উদ্যত হয়। তখন বড় বউ ফেরোজার মা তা প্রতিরোধ করে। গ্রামের ব্যাপক জীবন সংগ্রাম এই নাটকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।  সমূদ্রে সাইরেন নাটকের ঘটনা একটি জাহাজকে নিয়ে।

দেখা যায় একমাত্র একজন যাত্রী ব্যতীত ক্যাপ্টেনসহ সব যাত্রীই চোরাকারবার, নারী ব্যবসার সাথে জড়িত এবং একটি নক্শাকে পাবার জন্য পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে ঘিরেই ষড়যন্ত্র আর চক্রান্ত দানা বাঁধে নাটকে। পরিশেষে এক প্রাক্তন জাহাজ সেন্ট্রির কাছে সকলের পরাজয় ঘটে। শেষ পর্যন্ত জাহাজ ডুবির ভিতর দিয়ে নাটকের সমাপ্তি হয়। নাটকের বৃদ্ধ চরিত্রটি লাইফবোট নিয়ে প্রাণ রক্ষা করে এবং নতুন জাহাজ গড়ার ঘোষণা দেয়, সে জাহাজে কোনো অন্যায় অবিচার থাকবে না।

সমাপ্তি অন্যরকম নাটকে আদর্শবাদী এক গ্রাম্য শিক্ষক আবেদীন গ্রাম্য অনাচার এবং অসাধু এক সমাজপতির চোরা কারবারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীকে সে এ ব্যাপারে খবর দেয়।

ছাত্রদের মুক্তবুদ্ধি ও আদর্শবাদের শিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রচেষ্টা নেয়। শেষ পর্যন্ত টাকাওয়ালাদের কাছে সে হেরে যায়, গ্রাম্য সমাজপতিদের চক্রান্তে সে নিজেই কারারুদ্ধ হয়। তার সুন্দরী স্ত্রীকে সমাজপতি মাওলা সাহেব জটিল ফাঁদে আটকে বিয়ে করে। নাটক এখাইে শেষ হয় না। দর্শকদের মধ্যে থেকে উঠে আসে একটি চরিত্র। সে দাবি করে নাটকের সমাপ্তি এভাবে হতে পারে না। দুনিয়া পাল্টে গেছে। শোষণ-বঞ্চনা এবং অবিচারের দিন শেষ হয়ে গেছে।

মাস্তান সুন্দরী ও জোস্না নাটকে একটি রেলওয়ে স্টেশনের দৈনন্দিন জীবন সংগ্রামে পরাজিত কিছু ছিন্নমূল চরিত্রের রূপরেখা ফুটে উঠেছে। সেখানে শোষকরূপে একজন মাস্তানের আবির্ভাব ঘটে। ছিন্নমূল এক সহজ সরল নারী স্বামীকে হারিয়ে দুশ্চরিত্র মাস্তান ও তার চেলা পিচ্চির খপ্পরে পড়ে। তাকে মাস্তান অসামাজিক উপার্জনের বস্তু হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। ইত্যাদির বেষ্টনে নিজেকে ক্ষত-বিক্ষত করে জোস্না। স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলাদেশের তৎকালীন শাসকবর্গের দুর্বলতার সুযোগে স্বাধীনতা বিরোধীদের কুক্রিয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের দুরবস্থা ও হতাশার চিত্র শশ্মশান সৈকতে ফুটে ওঠে। তেঁতুল তলার খেয়া নাটকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যই প্রাধান্য পায়।

ক্ষুধার জ্বালায় মানুষের পাপবোধের অপমৃত্যু, ফুলী বাতাসীর অনাকাঙ্ক্ষিত যৌনাচার, মধ্যবিত্ত সমাজের হতাশ যুবকদের উচ্ছৃঙ্খলতা প্রভৃতির মাধ্যমে নাট্যকার সমাজের একটি চিত্র দিতে চেয়েছেন। ২০৩ বিমল মজুমদারের চৌকিদার একজন সৎ ও দায়িত্ববান চৌকিদারের কাহিনী। দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজে চৌকিদার শত প্রলোভনের মধ্যেও সৎ থাকার চেষ্টা করেছে, সঠিকভাবে তার ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করেছে। পাহারা দিতে গিয়ে সে নিজের ছেলেকে চুরি করতে দেখে। ব্যাপারটা সে গোপন রাখতে পারতো, কিন্তু নীতিবান সেই চৌকিদারের কাছে নিজের সন্তানও ক্ষমা পায় না।

সামন্ত প্রভুর হাতে নিচুশ্রেণীর, গণজীবনের লোকগুলো মার খায় এবং অবশেষে রুখে দাঁড়ায় তারই নাট্যরূপ দেয়া হয়েছে ফুলজান সমাচার নাটকে। ফুলজানের জীবনের ত্রিশঙ্কু অবস্থার প্রেক্ষিতে গড়ে উঠেছে নাটকের কাহিনী। একদিকে মাতাল স্বামীর খপ্পরে পড়ে ভ্রষ্ট জীবনে যেতে বাধ্য হয় অন্যদিকে সামন্ত বাড়িওয়ালা কৌশলে ফুলজানকে তার কামনার শিকার করে, যার পেছনে ফুলজানের স্বামীর সমর্থন থাকে পয়সার বিনিময়ে।

আর একটি দিক আছে ফুলজানের জীবনে তা হচ্ছে সে একজন রিক্সাচালকের সাথে ভাববিনিময় করে অন্যত্র সংসার পেতে এই জীবন থেকে মুক্তি পেতে চায়। সামন্ত শোষকরা তা হতে দেয় না। ফুলজানসহ নিচুতলার আরো তিনজনকে সামন্তপ্রভু গুণ্ডা লেলিয়ে হত্যা করে। রেল লাইনের ওপর ফেলে রাখে যেন লোকে মনে করে আত্মহত্যা। ওদিকে ফুলজানদের পক্ষের লোকজনরাও ক্ষেপে যায় এবং সামন্ত প্রভু ও তার সঙ্গীদের আক্রমণ করে। এই হচ্ছে ফুলজান সমাচার নাটকের বিষয়বস্তু।

ঢাকার বাইরে মঞ্চস্থ নাটকগুলোর বিষয়বস্তুর গভীরতা এবং নাট্যগুণ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে গেলে হতাশই হতে হবে। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে বাংলা নাটক সম্পর্কে শহু মিত্র লিখেছিলেন, ‘সর্বগুণ সমন্বিত ও সর্বজনপ্রিয় নাটক আমাদের দেশে এক্ষুণি হঠাৎ হতে পারে না।’২০৫ ষাট দশক পেরিয়ে সত্তর দশকেও সর্বগুণ সমন্বিত নাটকের দেখা বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনে পাওয়া যায়নি। হঠাৎ অত্যন্ত ভালো জিনিস একটা সৃষ্টি হতে পারে না, যদি না তার জন্যে একটা আবহাওয়া সৃষ্টি হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও নাট্য আন্দোলনের সাথে সম্পর্কিত প্রায় সকলেরই ধারণা, স্বাধীনতা পরবর্তী নাট্যকর্ম নাকি খুবই গৌরবদীপ্ত। বহুজনই মোটাদাগের নাটক লিখেছেন এবং তা মঞ্চস্থ করেছেন এবং তারজন্য গৌরবও বোধ করছেন।

গণনাট্য সংঘের নেতৃত্ব প্রথম থেকেই তাদের প্রযোজিত নাটকের ত্রুটি ধরতে পেরেছিলেন এবং তা স্বীকার করতেও দ্বিধা করেননি। গণনাট্য কর্মীদের নিজেদের দোষাগুলো শুধরে নেবার জন্য সবসময় আত্মসমালোচনা করতেও দেখা গেছে। কিন্তু বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় নিজেদের এই সমালোচনার ব্যাপারটি বলতে গেলে দেখাই যায় না।

যাই হোক, সত্তর দশকের দ্বিতীয় পর্বে রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার বাইরে মঞ্চস্থ নাটকগুলোতে দেখা যায়, নানা ধরনের বিষয়বস্তু সেখানে ভীড় করেছে। বিশেষ করে মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণাই প্রাধান্য পেয়েছে। ছিন্নমূল সমাজের বৃহত্তর অর্থনৈতিক সমস্যা, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের জরাজীর্ণ অবস্থা, আশাহীনতা, অবসাদ, দুঃসহ ব্যর্থতার করুণ চিত্রই ফুটে ওঠে নাটকগুলোতে। কিন্তু সমকালীন রাজনীতির উত্থান-পতন তাতে ধরা পড়ে না।

ঘটনাবহুল সময়কে কোনো নাটক চিত্রিত করেনি। অথচ বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই সময়কাল ছিলো খুবই ঘটনাবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ। জিয়ার আমলের শেষ দিকে সমাজ জীবনে ব্যাপক অস্থিরতা ও নিরাপত্তার অভাববোধ, মুদ্রাস্ফীতি, পণ্য সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি, রাজনৈতিক অঙ্গনে মিছিল, বিক্ষোভ, হরতাল নিত্য নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।

ব্যাপক দুর্নীতি, অক্ষমতা ও অবক্ষয় সরকারি প্রশাসনকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করেছিলো যে, দেশের অর্থনীতি চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এসে দাঁড়ায় সর্বনিম্ন পর্যায়ে। জিয়ার শাসনামলের অর্ধেকেরও বেশি সময় দেশ ছিলো সামরিক ও জরুরি আইনের অধীন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এবং সর্বময় ক্ষমতা নিজ হাতের মুঠোয় রাখার মানসে জিয়া সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেছিলেন। জিয়া রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেই দেশের সংবিধানে হাত দিয়েছিলেন। তিনি সংবিধানের পূর্বেকার মূলনীতি পাল্টে ইসলামীকরণ করেন। বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম কথাটা যুক্ত-করা হলো, ধর্ম নিরপেক্ষতার জায়গায় এলো ‘আল্লাহর উপর অবিচল আস্থা’।

জিয়ার পাঁচ বছরের শাসনকাল ছিলো সামরিক ও বেসামরিক ক্ষেত্রে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ, গুম, নির্যাতন তথা রক্তপাতময় একটি সময়। তার শাসনামলে জরুরি আইনের অধীনে বিশেষ আদালতের রায়ে কিংবা বিনাবিচারে প্রচুর রাজনৈতিক নেতাকে জেল বা মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। সাতাত্তর সালে বাজিতপুরের পাঁচজন রাজনৈতিক কর্মীকে মিথ্যা খুনের মামলায় জড়িয়ে সামরিক আদালতের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, এদের কোনোরকম আপীল গ্রহণ করা হয়নি। দেখা গেছে ছিয়াত্তর থেকে আশি সাল পর্যন্ত দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হয়েছেন দু হাজার একশো ষোল ব্যক্তি, এর মধ্যে একশ বিশ জন রাজনৈতিক কর্মী। বেসরকারি মতে হত্যার সংখ্যা আরো ব্যাপক।

পঁচাত্তরের আগস্ট থেকে আটাত্তর সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদের বাহাত্তর জন চেয়ারম্যান ও সদস্য খুন হন। বিভিন্ন অঞ্চলে জাসদ কর্মীদের ওপর জিয়া সরকারের নির্যাতন চলে। বিচার নামের প্রহসনের মধ্য দিয়ে কর্নেল তাহেরের মতো দেশপ্রেমিককে হত্যা করা হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠন এই হত্যাকাণ্ডে প্রতিবাদ জানালেও সভা সমাবেশ করলেও কোনো নাটকেই ব্যাপারগুলোকে উপস্থাপন করা হয়নি। ঘটনাগুলো নাট্যকারদের দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়েছিলো।

রাজনৈতিক নাটকের দায়িত্ব ছিলো এরকম ঘটনার পেছনে শাসকশ্রেণীর স্বার্থ কীভাবে কাজ করে, ঘটনাগুলো কীভাবে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র থেকে ব্যাপক ও ভয়াল রূপ নেয়, শেষ পর্যন্ত গিয়ে এর ফলাফল কী দাঁড়ায় তার সম্পূর্ণ চেহারা অঙ্কন করা এবং ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সহ জনগণের প্রতিক্রিয়া এ সব ক্ষেত্রে কী হতে পারে সেটাও বলার চেষ্টা করা। কিন্তু তা ঘটলো না। নির্বচিত বিষয়বস্তু বা নাট্য রচনার ধারা স্বাধীনতা পূর্বের অবস্থাতেই রয়ে গেল।

কিংবা বলা যায়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বাধীনতা পূর্বের চেয়ে ভালো করলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে নাট্যচর্চা তার চেয়েও দুর্বল অবস্থায় গিয়ে দাঁড়ালো। থিয়েটারে বৈপ্লবিক কিছু করার জন্য বিপ্লবী শিল্পী দরকার। যে শিল্পী গুণগত পরিবর্তন কী সেটা বোঝেন এবং তাকে রূপায়িত করতে পারেন, শুধু তাঁরাই পারেন থিয়েটারে বিপ্লব আনতে।” কীসের থেকে গুণগত পরিবর্তন? প্রচলিত যে নাট্যধারা চলছে তার থেকে। সেটা কী, কোন্ থিয়েটার তাতো বুঝতে হবে এবং সেই থিয়েটারের লক্ষ্য কী হবে সেটাও নির্ধারণ করতে হবে।

পিসকাটর সেটা পেরেছিলেন বলেই বিপ্লবী, বাংলাদেশের নবাগত নাট্যকার ও নাট্যকর্মীরা না বুঝে তার নকল করতে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়েছেন; নাটককে আর নাটকের জায়গাতেই রাখতে পারেননি। স্বাধীনতা লাভের পরপর বাংলাদেশে যা ঘটেছে যেহেতু প্রচলিত আঙ্গিক থেকে তা ছিলো অন্যরকম সে কারণে তা নতুন লাগে। কিন্তু সেটা নাট্যশিল্প বা জনগণের শিল্প হয়ে উঠতে পারেনি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা যেটুকু এগিয়ে নিয়ে গেছে তা সংস্কারপন্থীর কাজ, বিপ্লবীর নয়। কারণ বিপ্লব করবার কোনো চিন্তাই তাঁদের ছিলো না।

যখন দেশের তরুণ নাট্যগোষ্ঠীগুলো নাট্য আন্দোলনের কর্মসূচী নিয়েছিলো সে সময়েই প্রশ্ন উঠেছিলো, এসব কর্মসূচীর লক্ষ্য কতদূর? সে সময় পর্যন্ত নাটক মঞ্চায়ন সম্পর্কে দলগুলোর বক্তব্য ছিলো অস্পষ্ট। শিল্পকলা একাডেমী আয়োজিত প্রথম জাতীয় নাট্যোৎসব ১৯৭৬-৭৭-এ ঢাকার বাইরে থেকে অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে ‘সাধারণত কী ধরনের নাটক মঞ্চস্থ করতে আপনারা পছন্দ করেন? এবং ‘একটি নাটক মঞ্চস্থ করার জন্যে নাটকটির কী কী বৈশিষ্ট্য আপনারা অনুসন্ধান করেন?’-এই দুটো প্রশ্ন করা হয়। সেই প্রশ্নের উত্তরে বিভিন্ন দলগুলো যে উত্তর দেয় তার একটি সারমর্ম তুলে ধরছি যা থেকে তাদের বা সারাদেশের নাটক মঞ্চায়নের মূল উদ্দেশ্যটি বোঝা যাবে।

দিনাজপুরের নররূপীর উত্তর ছিলো, নির্দিষ্ট কোনো বাঁধাধরা ছকে বা বিশেষ ধরনের নাটক মঞ্চায়নে তারা উৎসাহী নয়। বিশ্বসাহিত্যের প্রায় সব মহৎ নাটক থেকে শুরু করে বর্তমানের ভিন্নমুখী বিচিত্র বিষয়-আশ্রয়ী নিরীক্ষামূলক নাটক করতেও তারা আগ্রহী। নাটক নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রধানত অনুসন্ধান করে যে ভাবনায় তারা ভাবিত সেই ভাবনার বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার অবকাশ আছে কি না। কুমিল্লার যাত্রিক নাট্যগোষ্ঠীর উত্তর ছিলো, বলিষ্ঠ বক্তব্য সম্বলিত রুচিশীল নাটক মঞ্চস্থ করতে তারা সচেষ্ট। যশোরের ঝিনেদা শিল্পকলা পরিষদ বলেছিলো, সব ধরনের নাটকেই তাদের আগ্রহ রয়েছে যদি তার মধ্যে মানুষের কথা থাকে। মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বিষাদ, জ্বালা-যন্ত্রণা, অনুরাগ-বিরাগ, ঈর্ষা-দ্বেষ অর্থাৎ মানবীয় পরিচয় সঞ্জাত নাটক যদি হয় এবং বিশেষ করে তার মধ্যে যদি সমাজ জীবনের স্পন্দন অনুভূত হয়।

রাজশাহী সাংস্কৃতিক সংঘের উত্তর ছিলো, সাধারণত যুগোপযোগী সমকালীন নাটক তাদের দলের পছন্দ, নাটক মঞ্চায়নে সাধারণত জনশিক্ষামূলক কিংবা আদর্শমূলক বিষয়বস্তুর তারা প্রাধান্য দিয়ে থাকে। পটুয়াখালী শহীদ স্মৃতি পাঠাগারের উত্তর ছিলো, সাধারণত বাস্তবধর্মী ও সামাজিক নাটক মঞ্চায়নে তারা আগ্রহী যাতে থাকবে জাতীয় ভিত্তিক ও সামাজিক সমস্যা এবং সমস্যার সমাধানের ইঙ্গিতবাহী বৈশিষ্ট্য। খুলনা নাট্য নিকেতন জবাবে বলে, জ্ঞানমুখী ও কাহিনী ভিত্তিক নাটক যা সমসাময়িক সমস্যা, বিশিষ্টতা ও অনাচারকে গুরুত্ব দেয় সে ধরনের নাটক মঞ্চায়নেই তারা আগ্রহী। বরিশালের খেয়ালীর ভাষ্য অনুযায়ী যে নাটক জীবনবোধে সমৃদ্ধ ও বাস্তবমুখী সেই ধরনের নাট্য মঞ্চায়নেই তারা বেশি জোর দিয়ে থাকে। সিলেটের বৈশাখীর বক্তব্য ছিলো, শিল্পসম্মত বক্তব্যধর্মী নাটক মঞ্চায়নই তাদের লক্ষ্য।

সাতক্ষীরা প্রগতি সংঘের বক্তব্য ছিলো, মৌলিক অথচ মানুষের শ্রম বন্টনের সূক্ষ্ম হিসাবের দায়িত্ব যে নাট্যকার নিয়েছেন তার নাটক কিংবা তেমন নাটক মঞ্চায়নের কথাই তারা ভেবে থাকে। নাটক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখে নাটকটি শ্রমজীবী মানুষের বাঁচবার কথা এবং প্রক্রিয়া প্রদর্শনে সক্ষম কি না।

চট্টগ্রামের গণায়নের উত্তর ছিলো, সাধারণত সমকালীন প্রেক্ষাপটে জীবনভিত্তিক নাটক মঞ্চায়ন করাই তাদের পছন্দ। তবে দেশ-কাল উত্তীর্ণ যে-কোনো মহৎ নাটক মঞ্চায়নেও তাদের আগ্রহ রয়েছে। বগুড়া নাট্যগোষ্ঠীর বক্তব্য ছিলো, মানুষের চিরকালীন সংগ্রামী চেতনাকে ব্যাহত করে এমন কোনো নাটক মঞ্চায়নে তাদের বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই। সুস্থ জীবনবোধ সম্পন্ন শিল্পসম্মত নাটককেই তারা প্রাধান্য দেয়। নাটকটিকে অবশ্যই কাব্যিক সৌন্দর্য্যে শিল্পিত হতে হবে এবং সংলাপ হবে প্রতীকধর্মী। পাবনার মঞ্চ পরাগ কী ধরনের নাটক মঞ্চস্থ করতে চায় সে ব্যাপারে তাদের বক্তব্য ছিলো, যে নাটক হবে বাস্তবভিত্তিক এবং কিছু যা-হোক একটা বক্তব্য থাকবে এবং কর্মক্লান্ত দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্যেও কিছু থাকবে।

নাটক মঞ্চায়ন সম্পর্কে ময়মনসিংহের বহুরূপীর বক্তব্য ছিলো, যা দর্শক সাদরে গ্রহণ করবে এবং যা দর্শককে তৃপ্তি দেবে। পটুয়াখালী ড্রামাটিক ক্লাবের বক্তব্য ছিলো, প্রায় সবধরনের নাটক মঞ্চস্থ করা তাদের উদ্দেশ্য, বিশেষ করে স্থানীয় দর্শকের মনোরঞ্জনের উপযোগী এবং শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ। মুন্সীগঞ্জের প্রবাহের বক্তব্য ছিলো, ভালো বক্তব্য, ঘটনার সুন্দর বিন্যাস, ভালো সংলাপ সমৃদ্ধ সামাজিক নাটক মঞ্চায়নে তারা আগ্রহী। চৌমুহনী ফ্রেন্ডস ক্লাব-এর উত্তর ছিলো, প্রতীকধর্মী, বক্তব্য প্রধান এবং সমাজসচেতন নাটককে তারা অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। রংপুরের শিখা সংসদের বক্তব্য ছিলো, শিল্পসমৃদ্ধ এবং পরীক্ষামূলক নাটক বিশেষ করে বক্তব্যধর্মী সর্বোপরি গণমুখী চেতনায় উদ্বুদ্ধ নাটক তারা মঞ্চায়ন করতে চায়।

নাট্যদলগুলোর বক্তব্য থেকে আমরা দেখতে পাই সাতক্ষীরা প্রগতি সংঘের বক্তব্য কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। যাদের বক্তব্যের মধ্যে শ্রমজীবী মানুষ বা শ্রমিকশ্রেণীর প্রশ্নটি সামান্য হলেও ধরা পড়েছে। বাকিদের বক্তব্যে শ্রমিকশ্রেণীর প্রশ্নটি একেবারেই নেই। যারা নাটক মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয় বক্তব্য প্রধান ও নিরীক্ষাধর্মী নাটক। বক্তব্য প্রধান বলতে কোন বক্তব্য, কাদের পক্ষে বক্তব্য সেটা যেমন তাদের ঘোষণায় প্রতিফলিত হয় না, তেমনি তাদের নাটক দেখেও বোঝা যায় না।

 

google news , গুগল নিউজ
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

তেমনি সাতক্ষীরা প্রগতি সংঘের মঞ্চায়িত নাটক থেকেও তারা শ্রমিকশ্রেণীর বক্তব্যকে যে গুরুত্ব দেয় সেটা বোঝার উপায় নেই। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী ১৯৭৯-৮০ সালে জেলা ভিত্তিক যে নাট্য উৎসবের আয়োজন করে, সেখানে বিভিন্ন দলগুলো তাদের উদ্দেশ্যের কথা ঘোষণা করে। সেইসব ঘোষণার কোথাও শ্রমিকশ্রেণীর জন্য নাটক করার প্রশ্নটি আসেনি। সেখানে বিভিন্ন দলের ঘোষণা থেকে যে উদ্দেশ্য বেরিয়ে এসেছে তা হলো-মানুষের বিবেক জাগ্রত করা, নিয়মিত নাটক করা, নাটকের মান উন্নয়ন করা, দর্শকের মনোরঞ্জন করা, ইত্যাদি।

যখন রাষ্ট্র সামরিক বেসামরিক সরকার, ক্ষমতাবান আমলা, মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিদের দ্বারা নিগৃহীত হচ্ছিলো সে সময়ে শোষক-শোষিতের নাটকে মূল প্রতিবাদ ঘোষিত হয়েছে গ্রাম্য মাতব্বর, স্থানীয় টাউট বাটপাড়দের বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক নাট্যচিন্তকদের মতে, রাজনৈতিক নাটকে জনগণকে শিক্ষিত করে তোলার জন্য সেসব প্রসঙ্গ অবশ্যই আসবে, তবে যারা রাষ্ট্রের মূল কর্ণধার তারা কীভাবে সেই শক্তির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা

সেটাও দেখাতে হবে। শাসকবর্গকে সম্পূর্ণ দূরে সরিয়ে রেখে চুনোপুটি গ্রাম্য মাতব্বরকেই শুধু খলনায়ক করে আনলে রাজনৈতিক নাটকের আসল লক্ষ্য সিদ্ধ হতে পারে না। রাজনৈতিক নাটকে অবশ্যই প্রধান শ্রেণীশত্রু কে, চূড়ান্তভাবে কাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে, দেশের সরকার, দেশের অর্থনীতি কীভাবে কাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, সেখানে কে কোথায় কার কাছে বাঁধা পড়ে আছে-সে কথাও বলতে হবে।

সত্তর দশকে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের নাটক তা পারেনি শুধুমাত্র সঠিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে, যদিও শোষকশ্রেণীর প্রতি ঘৃণার প্রকাশ নানাভাবে ঘটেছিলো। শেখ মুজিবের শাসনকালের মতো জিয়ার শাসনকাল তাই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের বাইরেই পড়ে থাকে। নাট্যকার ও নাট্যকর্মীদের এই ব্যর্থতার কারণ সম্পর্কে শাহরিয়ার কবির লিখছেন, বিভিন্ন দলের নাট্য কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে আমার কাছে যেটাকে সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে মনে হয়েছে সেটা হল নাট্যকর্মীদের রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব এবং রাজনৈতিক এবং সামাজিক নিরাপত্তার অভাব। দ্বিতীয় কারণটির চেয়ে প্রথম কারণটি বেশি জোরালো। রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব থাকলে সেক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থে সমাজ সচেতনতাও অনুপস্থিত থাকে, যা আমরা পরের অধ্যায়ে আলোচনা করবো। সেখানে নাট্যকারদের ব্যক্তিগত স্বার্থ চিন্তা দ্বারা নাটকের গতিপ্রকৃতি কী ভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিলো সেটাও দেখাতে পাবো।

 

আরও পড়ুন:

Leave a Comment