বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে সালমান শাহ (আসল নাম: চৌধুরী মোহাম্মদ শাহীরিয়ার ইমন, জন্ম: ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১, সিলেট) ছিলেন নব্বই দশকের সর্বাধিক জনপ্রিয় নায়ক এবং বাংলা চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। মাত্র চার বছরের চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে তিনি অভিনয় করেছেন প্রায় ২৭টি চলচ্চিত্রে এবং অসংখ্য জনপ্রিয় গান ও সংলাপের মাধ্যমে দর্শকের হৃদয়ে স্থায়ী আসন গড়ে তুলেছেন। তাঁর ফ্যাশন, স্টাইল ও অভিনয় তাকে তৎকালীন তরুণদের কাছে এক অনন্য আইকনে পরিণত করেছিল।
সালমান শাহ এর মৃত্যু রহস্য
মৃত্যুর সময়ের ঘটনা
৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬, সকাল প্রায় ১১টার দিকে ঢাকার এসকাটন গার্ডেন রোডের নিজ বাসায় সালমান শাহকে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ওড়না দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। বাসায় তখন উপস্থিত ছিলেন স্ত্রী সামিরা হক, শ্বশুরবাড়ির কয়েকজন সদস্য ও গৃহকর্মী। খবর পেয়ে তাকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। প্রাথমিকভাবে ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে ধরে নেওয়া হলেও, পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় এটি ছিল পরিকল্পিত হত্যা। এরপর থেকেই শুরু হয় এক দীর্ঘ তদন্তযাত্রা, যা প্রায় আড়াই দশক ধরে নানা মোড় নিয়েছে এবং এখনো দর্শক ও ভক্তদের মনে রহস্যের জন্ম দিয়ে রেখেছে।
পর্ব–১: মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ ও প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া
১. আত্মহত্যা তত্ত্ব
মৃত্যুর পরপরই পুলিশ ও কিছু প্রাথমিক তদন্তকারী সংস্থা ধারণা দেয় যে এটি আত্মহত্যা। তারা যুক্তি হিসেবে উল্লেখ করে—
- ঝুলন্ত অবস্থায় মরদেহ উদ্ধার।
- কোনো বড় ধরনের বাহ্যিক আঘাতের চিহ্ন না থাকা।
- মানসিক অবসাদ ও ব্যক্তিগত জীবনের টানাপোড়েন (দাম্পত্য কলহ, ক্যারিয়ারের চাপ ইত্যাদি)।
তবে আত্মহত্যার এই তত্ত্বটি পরিবারের সদস্যরা প্রথম দিন থেকেই প্রত্যাখ্যান করেন।
২. হত্যা তত্ত্ব
পরিবার ও ভক্তদের দাবি, সালমান শাহ মানসিকভাবে শক্ত ছিলেন এবং আত্মহত্যা করার কোনো কারণ ছিল না। তারা বেশ কয়েকটি যুক্তি দেন—
- তাঁর ক্যারিয়ার তখন শীর্ষে, নতুন একাধিক ছবির শুটিং চলছিল।
- মৃত্যুর কিছুদিন আগে পর্যন্ত তিনি নতুন বাড়ি কেনা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করছিলেন।
- মরদেহে কিছু অস্বাভাবিক চিহ্ন, যা আত্মহত্যার পরিবর্তে হত্যার ইঙ্গিত দেয় বলে পরিবারের সন্দেহ।
৩. ষড়যন্ত্র তত্ত্ব
কিছু মহল থেকে দাবি ওঠে, তার জনপ্রিয়তা ও ক্যারিয়ার ঈর্ষণীয় হওয়ায় চলচ্চিত্র জগতের প্রতিদ্বন্দ্বীরা কিংবা ব্যক্তিগত সম্পর্কের জটিলতা থেকে পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হতে পারে।
এখানে স্ত্রী সামিরা, শ্বশুরবাড়ির সদস্য এবং কিছু ব্যবসায়িক ও পেশাগত বিরোধের দিকেও আঙুল তোলা হয়।
পর্ব–২: মৃত্যুর দিন ও মূল ঘটনা
৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬, শুক্রবার
- সকাল: সালমান শাহ নিজ বাসায় ছিলেন। জানা যায়, স্ত্রী সামিরা বাসার ভেতরে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত ছিলেন।
- প্রায় সকাল ১১টার দিকে গৃহকর্মী প্রথমে সালমান শাহকে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ওড়না দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পান।
- খবর ছড়িয়ে পড়লে বাসার অন্যরা এসে তাকে নিচে নামিয়ে দ্রুত হাসপাতালে নেন।
- ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এ কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
প্রথমিক পর্যায়ে পুলিশের কার্যক্রম:
- ঘটনাস্থল ঘিরে রাখা হয় এবং আলামত সংগ্রহ করা হয়।
- পুলিশ আত্মহত্যার নোট খুঁজে না পেলেও প্রাথমিকভাবে এটি আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করে।
- মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়।
পর্ব–৩: তদন্তের অগ্রগতি
প্রাথমিক তদন্ত (১৯৯৬–১৯৯৭)
- পুলিশ: আত্মহত্যার মতামত দিলেও পরিবারের অভিযোগে হত্যা মামলা রেকর্ড হয়।
- সিআইডি: ঘটনার তদন্ত শুরু করে, তবে সুনির্দিষ্ট হত্যার প্রমাণ খুঁজে পায়নি।
- জুডিশিয়াল ইনকোয়ারি: কিছু অসঙ্গতি তুলে ধরে, যা পরিবারের দাবি জোরদার করে।
একাধিক সংস্থার যুক্ত হওয়া
ঘটনার জটিলতার কারণে তদন্তের দায়িত্ব পরে পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) এর হাতে যায়।
- তারা পুরনো আলামত পুনঃপরীক্ষা করে, নতুন করে সাক্ষ্য নেয়।
- ২০১৯ সালে পিবিআই আনুষ্ঠানিকভাবে জানায় যে প্রমাণ অনুযায়ী ঘটনাটি আত্মহত্যা।
- তবে সালমান শাহের মা এই রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে উচ্চ আদালতে আপিল করেন।
পর্ব–৪: বর্তমান অবস্থা ও বিতর্ক
পারিবারিক অবস্থান
সালমান শাহের মা ও পরিবার আজও দাবি করেন যে তিনি খুন হয়েছেন এবং এর পেছনে শক্তিশালী একটি চক্র জড়িত।
জনমত
বেশিরভাগ ভক্ত ও সাধারণ মানুষ মনে করেন, সালমান শাহ আত্মহত্যা করতে পারেন না।
তারা মনে করেন, পুলিশি তদন্তে অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলেনি—
- কেন আত্মহত্যার নোট পাওয়া যায়নি?
- মরদেহে কিছু ক্ষতচিহ্ন কেন ছিল?
- মৃত্যুর আগে-পরে পরিবারের সদস্য ও স্ত্রীর আচরণে কেন অসঙ্গতি ছিল?
বিচার প্রক্রিয়া
মামলাটি এখনো চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হয়নি। যদিও পিবিআই ও কিছু তদন্ত সংস্থা আত্মহত্যার রিপোর্ট দিয়েছে, পরিবারের পক্ষ থেকে মামলাটি উচ্চ আদালতে ঝুলে আছে।
পর্ব–৫: প্রমাণ ও আলামত বিশ্লেষণ
ঘটনাস্থলের প্রমাণ
- মরদেহের অবস্থান – ফ্যানের সঙ্গে একটি ওড়না/দুপাট্টা দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়।
- আত্মহত্যার নোট – পাওয়া যায়নি।
- আঘাতের চিহ্ন – গলায় দাগ ছাড়াও কিছু ক্ষতচিহ্ন ছিল, যা পরিবারের মতে হত্যার ইঙ্গিত দেয়।
- ঘটনাস্থল – ঘরের ভেতরের কিছু আসবাবপত্রের অবস্থান ও অগোছালো পরিবেশ সন্দেহ তৈরি করে।
- ফরেনসিক রিপোর্ট – সরকারি রিপোর্টে বলা হয় গলায় ফাঁসের দাগ ছাড়া প্রাণঘাতী আঘাতের চিহ্ন নেই, তবে পরিবারের নিযুক্ত ডাক্তার রিপোর্টে অসঙ্গতি উল্লেখ করেন।
পর্ব–৬: সাক্ষ্য ও জবানবন্দি
পরিবারের পক্ষ থেকে সাক্ষ্য
- সালমান শাহের মা নীলা চৌধুরী একাধিকবার বলেন, “আমার ছেলে কখনো আত্মহত্যা করতে পারে না। তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।”
- পরিবার অভিযোগ করে, হত্যার সঙ্গে স্ত্রী সামিরা, শ্বশুরবাড়ির কয়েকজন সদস্য এবং কিছু চলচ্চিত্র জগতের ব্যক্তিত্ব জড়িত।
গৃহকর্মী ও প্রতিবেশীর সাক্ষ্য
- গৃহকর্মীর দাবি, ঘটনার আগে সালমান শাহকে মানসিকভাবে অস্বাভাবিক বা হতাশাগ্রস্ত দেখেননি।
- প্রতিবেশীরা জানান, ঘটনার দিন বাসা থেকে কোনো অস্বাভাবিক শব্দ বা চিৎকার শোনেননি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাক্ষ্য
- পুলিশের প্রাথমিক সাক্ষ্য ছিল—ঘটনাটি আত্মহত্যা।
- সিআইডি ও পিবিআই পরে একই রিপোর্ট দেয়, তবে কিছু আলামতের ব্যাখ্যা পরিষ্কার করতে ব্যর্থ হয়।
পর্ব–৭: বিতর্কিত সাক্ষাৎকার ও মিডিয়া প্রভাব
- স্ত্রী সামিরার সাক্ষাৎকার – একাধিক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, সালমান মানসিক চাপে ছিলেন এবং আত্মহত্যা করেছেন। তবে তার সাক্ষাৎকারের কিছু অসঙ্গতি জনমনে সন্দেহ তৈরি করে।
- সহশিল্পী ও বন্ধুর মন্তব্য – কিছু সহশিল্পী দাবি করেন, সালমানের ব্যক্তিগত জীবনে টানাপোড়েন ছিল, আবার কেউ কেউ সরাসরি হত্যা তত্ত্ব সমর্থন করেন।
- মিডিয়া কভারেজ – সালমান শাহের মৃত্যু তখনকার বাংলাদেশি মিডিয়ার অন্যতম বড় নিউজ ইভেন্টে পরিণত হয়, যা মাসের পর মাস সংবাদ শিরোনামে ছিল।
- সোশ্যাল মিডিয়া যুগে নতুন করে বিতর্ক – ইউটিউব, ফেসবুক ও অনলাইন মিডিয়ায় পুনরায় আলোচনায় আসায় পুরনো সাক্ষাৎকার ও সাক্ষ্য আবার ভাইরাল হয়।
পর্ব–৮: চলচ্চিত্র জগতে প্রভাব
শূন্যতা ও দর্শকের ধাক্কা
- সালমান শাহের মৃত্যুতে বাংলা চলচ্চিত্রের রোমান্টিক নায়কের যুগে এক বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি হয়।
- তাঁর মৃত্যুতে দর্শকরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন; দেশের বিভিন্ন স্থানে ভক্তরা শোক মিছিল করেন।
অপূর্ণ প্রকল্প
- একাধিক ছবির শুটিং অসম্পূর্ণ রয়ে যায়, যেমন অনন্যা, অন্তরে অন্তরে, সত্যের মৃত্যু নেই ইত্যাদি, যা পরে অন্য অভিনেতা দিয়ে শেষ করা হয়।
নতুন নায়ক তৈরির চাপ
- চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিচালকরা নতুন নায়ক খুঁজতে বাধ্য হন। এর ফলে ৯০-এর দশকের শেষভাগে নতুন প্রজন্মের অভিনেতারা সুযোগ পান, তবে কেউই সালমান শাহের জনপ্রিয়তার সমকক্ষ হতে পারেননি।
গান ও ফ্যাশনে প্রভাব
- সালমান শাহের অভিনীত গানের স্টাইল, পোশাক, চুলের ধরন তরুণ সমাজে দীর্ঘদিন ট্রেন্ড হিসেবে বজায় থাকে।
পর্ব–৯: মৃত্যুর পরবর্তী ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বিশ্লেষণ
সালমান শাহের মৃত্যুর পর থেকেই জনমনে প্রশ্ন জাগে—এটি কি সত্যিই আত্মহত্যা, নাকি পরিকল্পিত হত্যা? সময়ের সাথে সাথে একাধিক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সামনে আসে, যা মিডিয়া, পরিবার, সহকর্মী ও ভক্তদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী বিতর্কের জন্ম দেয়। নিচে প্রধান তত্ত্বগুলো এবং তাদের বিশ্লেষণ দেওয়া হলো—
১. পারিবারিক কলহ ও ব্যক্তিগত জীবনের চাপ
- তত্ত্ব: স্ত্রী সামিরা ও সালমানের মধ্যে দাম্পত্য কলহ ছিল, যা মানসিক চাপে রূপ নিয়েছিল।
- প্রমাণ: কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু দাবি করেন, পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে সালমান বিষণ্ণ ছিলেন।
- বিশ্লেষণ: যদিও ব্যক্তিগত কলহ স্বাভাবিক ঘটনা, তবে সালমানের ক্যারিয়ার তখন শীর্ষে ছিল—যা আত্মহত্যা তত্ত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
২. চলচ্চিত্র জগতের হিংসা ও প্রতিযোগিতা
- তত্ত্ব: সালমান শাহের জনপ্রিয়তা ও বাজার দখলের কারণে প্রতিদ্বন্দ্বী অভিনেতা বা প্রযোজনা গোষ্ঠী তাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল।
- প্রমাণ: তাঁর মৃত্যুর আগে কিছু চলচ্চিত্র থেকে তাকে বাদ দেওয়া বা চুক্তি বাতিলের গুজব ছড়ায়।
- বিশ্লেষণ: প্রতিযোগিতা থাকলেও সরাসরি হত্যার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে অনেকের মতে, ব্যবসায়িক স্বার্থ বড় কারণ হতে পারে।
৩. শ্বশুরবাড়ির সম্পৃক্ততা
- তত্ত্ব: শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে বিরোধের জেরে সালমানকে হত্যা করা হয়েছে।
- প্রমাণ: সালমানের মা একাধিকবার সরাসরি স্ত্রী সামিরা ও তার পরিবারের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছেন।
- বিশ্লেষণ: এ অভিযোগের পক্ষে সরাসরি ফরেনসিক প্রমাণ নেই, কিন্তু সাক্ষ্যের অসঙ্গতি সন্দেহ বাড়িয়েছে।
৪. আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্রের সম্পৃক্ততা
- তত্ত্ব: কিছু সূত্র দাবি করে, সালমান শাহ বিদেশি অপরাধ চক্রের ফাঁদে পড়েছিলেন—যেখানে ব্যবসায়িক বা আর্থিক স্বার্থ জড়িত ছিল।
- প্রমাণ: নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি, তবে মিডিয়ায় গোপন ফোনালাপ ও অজানা লেনদেনের কথিত রেকর্ড প্রচারিত হয়েছিল।
- বিশ্লেষণ: এ তত্ত্ব প্রমাণসাপেক্ষ নয়, তবে চাঞ্চল্যকর সংবাদ তৈরিতে বড় ভূমিকা রেখেছিল।
৫. পরিকল্পিত আত্মহত্যা
- তত্ত্ব: সালমান মানসিক চাপে ছিলেন এবং পূর্বপরিকল্পনা করে আত্মহত্যা করেন।
- প্রমাণ: ফরেনসিক রিপোর্টে গলায় ফাঁসের দাগ ছাড়া মারাত্মক আঘাতের চিহ্ন না পাওয়া।
- বিশ্লেষণ: আত্মহত্যার আগে কোনো চিঠি বা ভিডিও বার্তা না পাওয়া এই তত্ত্বের দুর্বল দিক।
৬. প্রমাণ নষ্ট ও তদন্তে গাফিলতি
- তত্ত্ব: ঘটনাস্থলে প্রমাণ নষ্ট করা হয়েছে এবং তদন্তে গাফিলতি ছিল।
- প্রমাণ: পরিবারের অভিযোগ—ঘটনার পর বাসা পরিষ্কার করা হয়েছিল, কিছু বস্তু সরিয়ে ফেলা হয়।
- বিশ্লেষণ: যদি সত্য হয়, তবে এটি হত্যার সম্ভাবনা বাড়ায় এবং তদন্তের স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ করে।
সালমান শাহের মৃত্যু নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলো একে অপরের সাথে মিলে যায়—যেখানে পারিবারিক দ্বন্দ্ব, পেশাগত প্রতিযোগিতা ও সম্ভাব্য অপরাধচক্র—সবকিছু এক অদৃশ্য জালের মতো যুক্ত। তবে এখনো পর্যন্ত কোনো তত্ত্বই শতভাগ প্রমাণিত নয়, এবং মৃত্যুর প্রকৃত কারণ রহস্যাবৃত রয়ে গেছে।
পর্ব–১০: আইনি প্রক্রিয়া ও ভবিষ্যতের সম্ভাব্য রায়
সালমান শাহের মৃত্যু শুধু চলচ্চিত্র জগত নয়, বাংলাদেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থাকেও দীর্ঘ এক প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে যায়। মৃত্যুর ঘটনার পরপরই মামলা, তদন্ত, পুনঃতদন্ত—সব মিলিয়ে এটি প্রায় তিন দশক ধরে আলোচনার বিষয় হয়ে আছে।
১. মামলার সূচনা
- প্রথম ধাপ: ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর, সালমান শাহের মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার মা নিলুফার মঞ্জুর কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থানায় একটি মামলা করেন।
- অভিযোগ: মামলায় প্রধান আসামি করা হয় সালমানের স্ত্রী সামিরা, শ্বশুর, শাশুড়ি, এবং আরও কয়েকজনকে। অভিযোগ ছিল—এটি আত্মহত্যা নয়, পরিকল্পিত হত্যা।
- আইনি ধারাসমূহ: মামলাটি দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা (হত্যা) এবং ৩৪ ধারা (যৌথ অপরাধ) অনুযায়ী দায়ের করা হয়।
২. প্রথম তদন্ত ও আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত
- পুলিশ তদন্ত: প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ এটিকে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করে।
- ফরেনসিক রিপোর্ট: গলায় ফাঁসের দাগ পাওয়া যায়, তবে শরীরে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
- প্রতিক্রিয়া: পরিবার এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে এবং পুনঃতদন্তের দাবি জানায়।
৩. পুনঃতদন্ত ও সিআইডি’র ভূমিকা
- সিআইডি তদন্ত: মামলাটি সিআইডির হাতে যায়। তারা দীর্ঘ সময় ধরে সাক্ষী, প্রমাণ ও মেডিকেল রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে।
- সিআইডির সিদ্ধান্ত: ২০১৪ সালে সিআইডি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়—এটি আত্মহত্যা।
- বিতর্ক: পরিবারের দাবি, সিআইডি প্রভাবিত হয়ে সত্য গোপন করেছে।
৪. আদালতের পুনঃতদন্ত নির্দেশ
- আদালতের পদক্ষেপ: পরিবারের আপিলের ভিত্তিতে আদালত একাধিকবার পুনঃতদন্তের নির্দেশ দেয়।
- এফবিআই সম্পৃক্ততার দাবি: এক সময় গুজব ছড়ায় যে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই তদন্ত করবে, কিন্তু তা আনুষ্ঠানিকভাবে হয়নি।
৫. সাক্ষ্যগ্রহণ ও বিতর্কিত সাক্ষী
- মামলায় একাধিক সাক্ষী পরিবর্তিত বক্তব্য দেন।
- কিছু সাক্ষাৎকার মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়, যা আদালতে জমা পড়ে।
- বিতর্কিত সাক্ষীদের কারণে মামলার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
৬. বর্তমান অবস্থা (২০২৫ সালের মাঝামাঝি)
- মামলাটি এখনো চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায়।
- আদালত বলেছে, নতুন প্রমাণ এলে মামলাটি পুনরায় খোলা হবে।
- পরিবার এখনো হত্যার দাবিতে অনড়, আর পুলিশের চূড়ান্ত অবস্থান—আত্মহত্যা।
৭. ভবিষ্যতের সম্ভাব্য রায়
- পরিকল্পিত হত্যা প্রমাণিত হলে: অভিযুক্তদের ফৌজদারি আইনে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে।
- আত্মহত্যা প্রমাণিত হলে: মামলাটি খারিজ হবে, তবে মানসিক স্বাস্থ্য ও ব্যক্তিগত জীবনের ওপর গবেষণা হতে পারে।
- মিশ্র ফলাফল: আদালত আংশিকভাবে উভয় দিক স্বীকার করতে পারে—অর্থাৎ আত্মহত্যার পেছনে অন্যদের প্ররোচনার প্রমাণ পাওয়া গেলে “আত্মহত্যায় প্ররোচনা” ধারা (৩০৬) প্রয়োগ হতে পারে।
সালমান শাহের মৃত্যু মামলাটি বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় একটি নজিরবিহীন দীর্ঘস্থায়ী মামলা। একদিকে প্রমাণের অভাব, অন্যদিকে সাক্ষ্যের অসঙ্গতি—সবকিছু মিলিয়ে সত্য উদঘাটন কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে জনগণের মনে এখনো আশা আছে যে একদিন প্রকৃত সত্য প্রকাশ পাবে।