অর্জুন রায় ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের প্রাথমিক যুগের এক প্রতিভাবান শিল্প নির্দেশক (Art Director), যিনি চলচ্চিত্রের দৃশ্যমানতাকে বাস্তবসম্মত ও নান্দনিক করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর কাজ বাংলা চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছে দিতে সহায়ক হয়েছিল।
অর্জুন রায়
জন্ম ও শিক্ষা
অর্জুন রায় ১৯০৫ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর ঝোঁক ছিল শিল্পকলার দিকে। উচ্চশিক্ষায় তিনি স্থাপত্যবিদ্যা (Architecture)-য় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। দৃশ্যশিল্পে তাঁর আগ্রহ তাঁকে চলচ্চিত্রের কারিগরি শিক্ষার দিকে নিয়ে যায়।
তখনকার দিনে ইউরোপ, বিশেষত জার্মানি, চলচ্চিত্র শিল্প ও কারিগরি শিক্ষার অন্যতম কেন্দ্র ছিল। তাই তিনি জার্মানিতে গিয়ে হাতে–কলমে সিনেমার কারিগরি বিদ্যা শেখেন। সেখানেই তিনি আলো, সেট ডিজাইন, দৃশ্য নির্মাণ এবং চলচ্চিত্রের ভিজ্যুয়াল গঠন সম্পর্কে গভীর অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
চলচ্চিত্রজগতে প্রবেশ
জার্মানি থেকে ফিরে তিনি যোগ দেন নিউ থিয়েটার্স-এ, যা তৎকালীন সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। প্রথমে তিনি সহকারী শিল্প নির্দেশক হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
স্বাধীন শিল্প নির্দেশক হিসেবে কাজ
স্বাধীনভাবে তাঁর প্রথম কাজ ছিল নীতিন বসু পরিচালিত “দেশের মাটি” (১৯৩৮)। এই চলচ্চিত্রেই তিনি তাঁর শিল্পনৈপুণ্যের স্বাক্ষর রাখেন। এর পর ধারাবাহিকভাবে একাধিক প্রখ্যাত পরিচালকের ছবিতে কাজ করেন, যেমন—
- প্রমথেশ চন্দ্র বড়ুয়া – অধিকার (১৯৩৯), শাপমুক্তি (১৯৪০)
- হেমচন্দ্র চন্দ্র – পরাজয় (১৯৪০)
- সুশীল মজুমদার – তটিনীর বিচার (১৯৪০)
- প্রফুল্ল রায় – পাপের পথে (১৯৪৩)
- ছক্কা পাঞ্জা (১৯৬৩) – পরবর্তী জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য কাজ
বৈশিষ্ট্য ও অবদান
- অর্জুন রায়ের শিল্প নির্দেশনায় ইউরোপীয় শৈলী ও ভারতীয় বাস্তবতার এক অনন্য মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়।
- তিনি স্থাপত্যবিদ্যার জ্ঞান ব্যবহার করে চলচ্চিত্রে সেট ডিজাইন ও দৃশ্যমান বাস্তবতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিলেন।
- তাঁর তৈরি সেটগুলো কেবল গল্পের আবহ সৃষ্টি করত না, বরং চরিত্রের মানসিক অবস্থাকেও দর্শকের সামনে ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করত।
- নিউ থিয়েটার্স যুগে শিল্প নির্দেশনার যে উচ্চমান তৈরি হয়েছিল, তার অন্যতম রূপকার ছিলেন অর্জুন রায়।
চলচ্চিত্রপঞ্জি
- ১৯৩৮ – দেশের মাটি
- ১৯৩৯ – অধিকার
- ১৯৪০ – পরাজয়, তটিনীর বিচার, শাপমুক্তি
- ১৯৪৩ – পাপের পথে
- ১৯৬৩ – ছক্কা পাঞ্জা
মূল্যায়ন
অর্জুন রায় ছিলেন সেইসব শিল্প নির্দেশকদের একজন, যাঁরা বাংলা চলচ্চিত্রের প্রাথমিক যুগে ভিজ্যুয়াল ভাষার ভিত গড়ে তুলেছিলেন। স্থাপত্যবিদ্যা ও জার্মান প্রশিক্ষণের মেলবন্ধনে তিনি চলচ্চিত্রের দৃশ্যমানতাকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, যা আজও স্মরণীয়। তাঁর অবদান বাংলা সিনেমার ইতিহাসে প্রাথমিক স্তম্ভের মতো দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত।