অপুর সংসার চলচ্চিত্রটি নিয়ে আমাদের আজকের আলোচনা- অপুর সংসার (দ্য ওয়ার্ল্ড অফ অপু নামেও পরিচিত) একটি ১৯৫৯ সালের সত্যজিৎ রায় দ্বারা নির্মিত, রচিত এবং পরিচালিত ভারতীয় বাংলা ভাষার নাট্য চলচ্চিত্র। এটি বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের উপন্যাস অপরাজিতের দ্বিতীয়ার্ধের উপর ভিত্তি করে নির্মিত। পথের পাঁচালী (১৯৫৫) এবং অপরাজিত (১৯৫৬) এর পরে অপুর সংসার হল অপু ত্রয়ীর শেষ পর্ব।
গল্পটি বিংশ শতাব্দীর ভারতে অপু নামক এক তরুণ বাঙালির শৈশব এবং প্রাথমিক প্রাপ্তবয়স্কতা সম্পর্কে।অপু আইএ পাশ করেছে বটে, কিন্তু চাকরি এখনও জোটাতে পারেনি, চাকরির সন্ধানে কলকাতায় ভাড়াবাড়িতে থেকে টিউশন করে সে পেট চালায়।
বহু বছর বাদে কলেজের প্রাণের বন্ধু পুলুর সাথে দেখা হয় অপুর,পুলু অপুকে নিমন্ত্রণ কোরে তার মাসির মেয়ের বিয়েতে নিয়ে গেলে ঘটনাচক্রে অপর্ণাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয় অপু, অপর্ণাও শহুরে দরিদ্র জীবনে দরিদ্র স্বামীর ভাড়াবাড়ির সংসারে মানিয়ে নেয়। কাজলের জন্ম দিতে মৃত্যু হয় অপর্ণার।কাজলকে অপু পছন্দ করে না, কারণ কাজল আছে বলেই অপর্ণা নেই। অপুর সংসারের শেষ দৃশ্য – অপুর কাঁধে চেপে কাজল চলেছে কলকাতায়।
অপুর সংসার চলচ্চিত্র
- প্রযোজনা—সত্যজিৎ রায় প্রোডাকসন্স।
- কাহিনি—বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
- চিত্রনাট্য ও পরিচালনা—সত্যজিৎ রায়।
- চিত্রগ্রহণ—সুব্রত মিত্র।
- সংগীত —রবিশঙ্কর।
- শিল্প নির্দেশনা— বংশী চন্দ্রগুপ্ত।
- শব্দগ্রহণ—দুর্গাদাস মিত্র, সত্যেন চট্টোপাধ্যায়।
- সম্পাদনা—দুলাল দত্ত।
অপুর সংসার চলচ্চিত্রে যারা অভিনয় করেছেন —
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর, শ্রীমান অলোক চক্রবর্তী, স্বপন মুখোপাধ্যায়, শেফালিকা (পুতুল), বেলারানী, আশা, ধীরেশ মজুমদার, ধীরেশ ঘোষ, শান্তি ভট্টাচার্য, পঞ্চানন ভট্টাচার্য, বেচু সিংহ, অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায়, তুষার বন্দ্যোপাধ্যায়, যোগেশ চট্টোপাধ্যায়, গুপী বন্দ্যোপাধ্যায়।
অপুর সংসার চলচ্চিত্রের কাহিনি—
অপু ত্রয়ীর শেষ ছবি। অপু (সৌমিত্র) এখন কলকাতায় একটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে, খরচ চালানোর জন্য কয়েকটি টিউশনি করে এবং ভবিষ্যতে সাহিত্যিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখে। অপুর বন্ধু প্রণব (স্বপন) তার মামাতো বোন অপর্ণার (শর্মিলা) বিয়েতে যাওয়ার পথে অপুর সাথে দেখা করে এবং তাকে সাথে নিয়েই খুলনায় গঙ্গানন্দকাটি গ্রামে মামার বাড়ি উপস্থিত হয় ।
পরের দিন বিকেলে বর আসার পর জানা যায় যে ছেলেটি বদ্ধ উন্মাদ। প্রণবের মামিমা (শেফালিকা) মেয়ের সাথে পাগলের বিয়ে দিতে রাজি নন, তিনি অপর্ণাকে সঙ্গে নিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করেন । মামা শশীনারায়ণ (ধীরেশ) অনেক বুঝিয়েও স্ত্রীকে রাজি করাতে পারেন না । প্রণব গ্রামের কিছু মান্যগণ্য লোকের সাথে অপুকে অনুরোধ করে অপর্ণাকে বিয়ে করার জন্য । অপু প্রথমে আপত্তি জানালেও পরে রাজি হয় এবং বিয়ের পর অপর্ণাকে নিজের আর্থিক অবস্থার কথা জানায়।
অপু নববধূকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় আসে। আর্থিক অসুবিধা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অপু একটি কেরানির চাকরি নেয়, অভাব সত্ত্বেও তারা সুখী হয়। এক বছর পর সন্তানসম্ভবা অপর্ণা বাপের বাড়ি যায় এবং সেখানে সন্তানের জন্ম দিয়ে অপর্ণার মৃত্যু হয়।
শোকার্ত অপু তার সামান্য সঞ্চয় সম্বল করে বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ যাত্রায় বেরিয়ে পড়ে। পাঁচ বছর পরে প্রণব উচ্চশিক্ষান্তে বিলেত থেকে ফিরে দেশে গিয়ে অপুর কোনো খোঁজ না পেয়ে মামার বাড়ি যায় এবং জানতে পারে অপু এই পাঁচ বছরে নিজের সন্তানকে এক বার চোখের দেখাও দেখতে আসে নি।
নাগপুরের জঙ্গলে সে অপুর সাক্ষাৎ পায়, অপু জানায় সে অপর্ণার মৃত্যুর জন্য ছেলেকেই দায়ী করে। শুধু বন্ধুর অনুরোধ রাখার জন্য সে গঙ্গানন্দকাটি গ্রামে শ্বশুর বাড়িতে যায়, তার ইচ্ছা ছেলেকে নিশ্চিন্দিপুরে কারও বাড়িতে রেখে সে আবার নিরুদ্দেশ যাত্রায় বেরিয়ে পড়বে। কিন্তু কাজলকে দেখে সে তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে, নিষ্পাপ কাজল তার সমস্ত মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।

প্রকাশনা :
ছবিটির চিত্রনাট্য ১৯৯২ সালে এক্ষণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । পুরস্কার : বছরের সেরা ছবি হিসাবে রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক ১৯৫৯। ১৯৬০ সালে লন্ডন চলচ্চিত্র উৎসবে সাদারল্যান্ড ট্রফি। ১৯৬০ এডিনবার্গ চলচ্চিত্র উৎসবে ডিপ্লোমা অব মেরিট । ১৯৬০ সালে বিদেশি ভাষায় নির্মিত শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে ন্যাশনাল বোর্ড অব রিভিউ অব মোশন পিকচার্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুরস্কার। ছবিটির দৃশ্য ধরে ধরে অধ্যাপক মামুন হাসানের ‘মুভি মাস্টার ক্লাস’ নামে একটি অনুষ্ঠান বিবিসি টিভি সম্প্রচার করেছিল।
আরও দেখুনঃ