অশোক বিশ্বনাথন

অশোক বিশ্বনাথন ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রের এক বহুমুখী ব্যক্তিত্ব – তিনি চলচ্চিত্র পরিচালক, নাট্যব্যক্তিত্ব, শিক্ষক, লেখক এবং মাঝে মাঝে অভিনেতা হিসেবেও পরিচিত। সাহিত্য, সমাজ ও দর্শনের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ চলচ্চিত্রের ভিজ্যুয়াল ভাষায় প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর কাজের ভেতর দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন যে চলচ্চিত্র কেবল বিনোদন নয়, এটি একাধারে শিল্প, চিন্তাভাবনা এবং সামাজিক প্রতিফলনের মাধ্যম। বর্তমানে তিনি কলকাতার সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট (SRFTI)-এ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন প্রযোজনা বিভাগের অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত।

 

অশোক বিশ্বনাথন

 

জন্ম শিক্ষা

অশোক বিশ্বনাথনের জন্ম কলকাতায়। তাঁর পিতা ছিলেন প্রখ্যাত অভিনেতা এন. বিশ্বনাথন, যিনি মঞ্চ, চলচ্চিত্র ও সাহিত্যের জগতে সমানভাবে পরিচিত ছিলেন। পারিবারিক সংস্কৃতি ও শিল্পচর্চার আবহে বেড়ে ওঠায় শৈশব থেকেই অশোক শিল্প, নাটক ও চলচ্চিত্রের প্রতি আকৃষ্ট হন।

তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, কলকাতা থেকে গণিতে স্নাতক (অনার্স) সম্পন্ন করেন। তবে গণিতের সুশৃঙ্খল যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনার পাশাপাশি তাঁর প্রবল আকর্ষণ ছিল ভিজ্যুয়াল আর্ট ও সিনেমার প্রতি। এরই টানে তিনি ভর্তি হন পুনের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া (FTII)-তে চলচ্চিত্র পরিচালনা বিষয়ে। ১৯৮৫ সালে পরিচালনা বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন এবং ১৯৮৬ সালে টেলিভিশন প্রোডাকশনেও ডিপ্লোমা অর্জন করেন।

 

চলচ্চিত্রজীবনের সূচনা সাফল্য

অশোক বিশ্বনাথনের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র শূন্য থেকে শুরু (১৯৯৪)। ছবিটি একই বছর ইন্ডিয়ান প্যানোরামা-য় নির্বাচিত হয় এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি হিসেবে। এই ছবির মাধ্যমে তিনি চলচ্চিত্র অঙ্গনে সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়ে নেন এবং একজন পরীক্ষামূলক চলচ্চিত্রকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান।

এরপরের উল্লেখযোগ্য কাজ কিছু সংলাপ কিছু প্রলাপ (১৯৯৯), যা তাঁকে পুনরায় জাতীয় পুরস্কার এনে দেয়। চলচ্চিত্রটি তাঁর ভাবনাচিন্তার দিক থেকে আধুনিক ও শিল্পদর্শনের দিক থেকে ব্যতিক্রমী হিসেবে পরিচিত।

 

কাহিনি, শৈলী বৈশিষ্ট্য

  • অশোক বিশ্বনাথনের চলচ্চিত্রে প্রায়ই দেখা যায় সাহিত্য দর্শনের মেলবন্ধন
  • সমাজ, সময় ও মানুষের ভেতরের সংকট তাঁর সিনেমার মূল উপজীব্য।
  • তিনি চলচ্চিত্রে কবিতার ভঙ্গি ব্যবহার করেন – দৃশ্য, সংলাপ ও শব্দের মধ্যে রূপক ও প্রতীকের ব্যবহারে পারদর্শী।
  • সমান্তরাল সিনেমার ধারা বজায় রেখেও তিনি চলচ্চিত্রকে দর্শকবান্ধব করে তুলতে সচেষ্ট।

 

শিক্ষকতা অন্যান্য অবদান

চলচ্চিত্র নির্মাণের পাশাপাশি অশোক বিশ্বনাথন একজন স্বনামধন্য শিক্ষক। তিনি বর্তমানে সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট, কলকাতা-য় অধ্যাপনা করছেন। এছাড়া তিনি দেশের বাইরেও একাধিক চলচ্চিত্র শিক্ষাকেন্দ্রে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন।

তিনি প্রায় একশোরও বেশি তথ্যচিত্র স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন – কাহিনিচিত্র ছাড়াও তথ্যচিত্রে তাঁর সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে।

অভিনেতা হিসেবেও তিনি মাঝে মাঝে কাজ করেছেন, তবে মূলত পরিচালক ও শিক্ষক হিসেবে তাঁর পরিচয়ই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।

 

চলচ্চিত্রপঞ্জি (নির্বাচিত)

  • ১৯৯৪ – শূন্য থেকে শুরু
  • ১৯৯৯ – কিছু সংলাপ কিছু প্রলাপ, স্বপ্নের সন্ধানে
  • ২০০৩ – ব্যতিক্রমী
  • ২০০৬ – অন্ধকারের শব্দ
  • ২০০৯ – শেষ সংঘাত
  • ২০১২ – শান্তিনিকেতন

 

স্বীকৃতি পুরস্কার

  • জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারশ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি (শূন্য থেকে শুরু, ১৯৯৪)
  • জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারকিছু সংলাপ কিছু প্রলাপ (১৯৯৯)
  • দেশ-বিদেশের একাধিক চলচ্চিত্র উৎসবে সম্মানিত।

 

মূল্যায়ন

অশোক বিশ্বনাথন কেবলমাত্র একজন চলচ্চিত্র পরিচালক নন, তিনি সমান্তরাল ধারার ভারতীয় সিনেমার এক বুদ্ধিদীপ্ত নির্মাতা। তাঁর চলচ্চিত্রে কাহিনি, দর্শন ও ভিজ্যুয়াল নন্দনতত্ত্ব একীভূত হয়ে এক বিশেষ সৃজনশীল রূপ ধারণ করে। পাশাপাশি শিক্ষক হিসেবে নতুন প্রজন্মের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের গড়ে তুলতে তাঁর অবদান অসামান্য।

তাঁকে আজকের দিনে বাংলা সমান্তরাল চলচ্চিত্রের ধারার এক অগ্রগণ্য প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করা হয়।

Leave a Comment