অসীম কুমার ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্র জগতের এক শক্তিমান অভিনেতা, যিনি প্রায় পাঁচ দশক ধরে সিনেমা ও রঙ্গমঞ্চে অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকদের মুগ্ধ করে গেছেন। তাঁর অভিনয় জীবনে বৈচিত্র্যময় চরিত্রের সমাহার যেমন দেখা যায়, তেমনি ভক্তিমূলক, পৌরাণিক, সামাজিক, সাহিত্যনির্ভর এবং সমকালীন কাহিনিভিত্তিক ছবিতে তাঁর পারদর্শিতা তাঁকে স্মরণীয় করে রেখেছে।
অসীম কুমার
জন্ম ও শিক্ষা
অসীম কুমারের জন্ম ১৯১৩ সালে ওড়িশার ঢেঙ্কানল জেলায়। শৈশব ও কৈশোর অতিবাহিত হয় শিক্ষার পরিবেশে। তিনি কলকাতার সাউথ সুবারবন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন এবং পরবর্তীতে আশুতোষ কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পড়াশোনা শেষ করে কিছুদিন চাকরিও করেছিলেন, কিন্তু শিল্প ও অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ তাঁকে টেনে নিয়ে যায় রূপালি পর্দার জগতে।
চলচ্চিত্রজীবনের সূচনা
অভিনয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটে নীরেন লাহিড়ী পরিচালিত “সিংহদ্বার” (১৯৪৯) চলচ্চিত্রে, যেখানে তিনি সুনন্দা দেবীর বিপরীতে শঙ্কর চরিত্রে অভিনয় করেন। প্রথম ছবিতেই তাঁর অভিনয় সমালোচক ও দর্শকমহলে প্রশংসিত হয়। এর পর থেকে তিনি একে একে বাংলা চলচ্চিত্রের নানা ধরণের চরিত্রে নিজেকে মেলে ধরেন।
উল্লেখযোগ্য চরিত্র ও অভিনয়শৈলী
অসীম কুমার প্রায় পঞ্চাশটিরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলি—
- চৈতন্যদেব – নীলাচলে মহাপ্রভু (১৯৫৭)
- বিদ্যাপতি – পুরীর মন্দির (১৯৫৮)
- কেতু – অলজঙ্গল (১৯৫৯)
- সুবিমল – কিছুক্ষণ (১৯৫৯)
- কমলেশ – রাতের অন্ধকারে (১৯৫৯)
- চৈতন্য – নদের নিমাই (১৯৬০)
- অরুণ – কাজল (১৯৬২)
- অসীম – এরা কারা (১৯৬৪)
- মহিম – অঙ্গীকার (১৯৬৬)
- মৈত্র – রামধাক্কা (১৯৬৬)
তিনি ভক্তিমূলক ও পৌরাণিক চরিত্রে যেমন স্বতঃস্ফূর্ত ছিলেন, তেমনি সামাজিক ও সমসাময়িক গল্পেও সমান দক্ষতায় অভিনয় করেছেন। বিশেষত ভক্তি ও আধ্যাত্মিক ভাবনায় ভরপুর চরিত্রগুলিতে তাঁর অভিনয় ছিল অতুলনীয়।
সহযোগিতা ও পরিচালকরা
তাঁর দীর্ঘ চলচ্চিত্রজীবনে অসীম কুমার কাজ করেছেন বাংলা চলচ্চিত্রের একাধিক প্রখ্যাত পরিচালকের সঙ্গে। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
- নীরেন লাহিড়ী
- কার্তিক চট্টোপাধ্যায়
- ফণী বর্মা
- অসিত সেন
- সুশীল মুখোপাধ্যায়
- অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়
- শ্যাম গুরু বাগচী
- পিনাকী মুখোপাধ্যায়
শুধু বাংলা নয়, তিনি হিন্দি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন। এছাড়াও তিনি পেশাদার রঙ্গমঞ্চে নিয়মিত অভিনয় করতেন, যা তাঁর অভিনয় দক্ষতাকে আরও পরিপক্ব করে তোলে।
চলচ্চিত্রপঞ্জি (নির্বাচিত)
- ১৯৪৯ – সিংহদ্বার
- ১৯৫২ – বাগদাদ
- ১৯৫৭ – নীলাচলে মহাপ্রভু, দাতা কর্ণ
- ১৯৫৮ – তানসেন, জোনাকির আলো, পুরীর মন্দির, মর্মবাণী
- ১৯৫৯ – জলজঙ্গল, কিছুক্ষণ, রাতের অন্ধকারে
- ১৯৬০ – নদের নিমাই
- ১৯৬১ – মধ্যরাতের তারা
- ১৯৬২ – কাজল
- ১৯৬৪ – এরা কারা, কাঁটাতার
- ১৯৬৬ – অঙ্গীকার, রামধাক্কা
- ১৯৬৭ – দুষ্টু প্রজাপতি, এন্টনী ফিরিঙ্গী
- ১৯৬৯ – পিতাপুত্র
- ১৯৭০ – নল দময়ন্তী, মহাকবি কৃত্তিবাস, নিশিপদ্ম
- ১৯৭১ – শচীমার সংসার
- ১৯৭৫ – অগ্নীশ্বর, বাঘবন্দী খেলা
- ১৯৭৬ – বহ্নিশিখা, যুগমানব কবীর
- ১৯৭৭ – শ্রীশ্রী মালক্ষ্মী
- ১৯৭৮ – জয় মা তারা, মা ছিন্নমস্তা, ইমন কল্যাণ
- ১৯৭৯ – যত মত তত পথ, হীরে মাণিক, পম্পা, নন্দন
- ১৯৮০ – মাতৃভক্ত রামপ্রসাদ, সীতা
- ১৯৮১ – মানিকচাদ
- ১৯৮২ – অনুসন্ধান
- ১৯৮৩ – সংসারের ইতিকথা, মাতা আগমেশ্বরী
- ১৯৮৬ – জীবনসাথী
- ১৯৮৭ – লালন ফকির, নদীয়া নাগর
- ১৯৯০ – সংক্রান্তি
- ১৯৯৩ – ফিরে পাওয়া
- ১৯৯৬ – মার্গ
- ১৯৯৭ – বৌঠান, মনসাকন্যা
মূল্যায়ন
অসীম কুমার ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্র জগতের এক বহুমুখী অভিনেতা, যিনি দীর্ঘ অভিনয়জীবনে পঞ্চাশটিরও বেশি চলচ্চিত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি ছিলেন সেই প্রজন্মের শিল্পী, যাঁরা পরিশ্রম, নিষ্ঠা ও প্রতিভার মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্রের ভিত্তি শক্ত করেছেন।
ধর্মীয়, পৌরাণিক ও ভক্তিমূলক ছবিতে তাঁর অভিনয় তাঁকে জনপ্রিয়তা এনে দেয়, তবে একই সঙ্গে তিনি সামাজিক-বাস্তবধর্মী চরিত্রেও সমান দক্ষ ছিলেন।
তাঁর নাম আজও স্মরণ করা হয় বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে।