ইন্দর সেন ছিলেন ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রের একজন মেধাবী পরিচালক, প্রযোজক ও চিত্রনাট্যকার। তাঁর চলচ্চিত্রে সমাজবাস্তবতা, সাহিত্যিক গভীরতা এবং মানবিক সম্পর্কের সূক্ষ্মতা ধরা পড়ে। যদিও তাঁর পরিচালিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা খুব বেশি নয়, তিনি প্রতিটি কাজের মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্রে এক অনন্য স্বাক্ষর রেখেছেন।
ইন্দর সেন – জীবন ও কর্ম
প্রারম্ভিক জীবন ও কর্মজীবনের শুরু
চলচ্চিত্রে প্রবেশের আগে ইন্দর সেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক মৃণাল সেন-এর সহকারী হিসেবে কাজ করেছিলেন। এই সময়ে তিনি চলচ্চিত্র পরিচালনার কারিগরি দিক, কাহিনির ভেতরের স্তর আবিষ্কার এবং সিনেমার ভাষার ব্যবহার সম্পর্কে সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
স্বাধীন পরিচালক হিসেবে তাঁর অভিষেক ঘটে ১৯৭০ সালে, অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্তের রচিত গল্প অবলম্বনে নির্মিত প্রথম কদম ফুল চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। প্রথম ছবিতেই তিনি তাঁর কাহিনি বলার নিজস্ব ভঙ্গিমা প্রকাশ করেন।
চলচ্চিত্রজীবন ও অবদান
১৯৭০ থেকে ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত তিনি মোট দশটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন। অধিকাংশ ছবির কাহিনি ও চিত্রনাট্য তিনি নিজেই রচনা করতেন, যা তাঁর সৃজনশীলতার স্বাক্ষর বহন করে।
তাঁর উল্লেখযোগ্য ছবিগুলি—
- প্রথম কদম ফুল (১৯৭০) – সাহিত্যনির্ভর কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত তাঁর প্রথম ছবি।
- পিকনিক (১৯৭২) – তরুণ প্রজন্মের সম্পর্ক, জীবনবোধ ও মানসিক দ্বন্দ্বের কাহিনি নিয়ে নির্মিত।
- অসময় (১৯৭৬) – সমকালীন সমাজ ও পারিবারিক সংকটকে কেন্দ্র করে নির্মিত, সমালোচকদের প্রশংসিত।
- চামেলী মেমসাহেব (১৯৭৯) – সমরেশ বসুর জনপ্রিয় উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই ছবি ইন্দর সেনের ক্যারিয়ারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাফল্য। চলচ্চিত্রটি ১৯৭৮–৭৯ সালে ইন্ডিয়ান প্যানোরামা-য় নির্বাচিত হয়, যা ছিল একটি বড় সম্মান।
- পিপাসা (১৯৮২) – শক্তিপদ রাজগুরুর চিত্রনাট্য অবলম্বনে নির্মিত।
- মন মানে না (১৯৯৩) – তপেন্দু গঙ্গোপাধ্যায়ের চিত্রনাট্য অবলম্বনে পরিচালিত।
- তুমি যে আমার (১৯৯৪) – এই চলচ্চিত্রের জন্য তিনি ১৯৯৫ সালে বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতির (BFJA) সেরা ভারতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
চলচ্চিত্রপঞ্জি
- ১৯৭০ – প্রথম কদম ফুল
- ১৯৭২ – পিকনিক
- ১৯৭৬ – অসময়, অর্জুন
- ১৯৭৯ – চামেলী মেমসাহেব
- ১৯৮১ – বন্দী বলাকা
- ১৯৮২ – পিপাসা
- ১৯৯১ – ঠিকানা
- ১৯৯৩ – মন মানে না
- ১৯৯৪ – তুমি যে আমার
বৈশিষ্ট্য
- ইন্দর সেন তাঁর ছবিতে সাহিত্যনির্ভর কাহিনি, বাস্তব জীবন ও আবেগকে মেলবন্ধন ঘটাতেন।
- অধিকাংশ ছবির চিত্রনাট্য নিজেই লিখতেন, যা তাঁর চলচ্চিত্রকে মৌলিক ও ব্যক্তিত্বপূর্ণ করত।
- তিনি সমাজ ও সম্পর্কের গভীরতাকে ক্যামেরার ভাষায় উপস্থাপন করতে পারদর্শী ছিলেন।
- চলচ্চিত্রের বাণিজ্যিক সাফল্যের পাশাপাশি তিনি সমালোচকদের কাছ থেকেও স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।
মূল্যায়ন
ইন্দর সেন বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী পরিচালক হিসেবে স্মরণীয়। তাঁর ছবিগুলি হয়তো সংখ্যায় কম, কিন্তু মানের দিক থেকে উচ্চমানসম্পন্ন। বিশেষত চামেলী মেমসাহেব ও তুমি যে আমার তাঁকে বাংলা চলচ্চিত্রে এক স্থায়ী আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, সীমিত কাজের মাধ্যমেও একজন পরিচালক দর্শক-সমালোচক উভয়ের কাছেই সম্মান অর্জন করতে পারেন।