বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক অনন্য নাম — উমাশশী। নির্বাক যুগের শেষলগ্ন থেকে সবাক যুগের প্রথম দিকে তার অসাধারণ অভিনয় প্রতিভা ও মাধুর্য দিয়ে তিনি দর্শক-মন জয় করেছিলেন। বাংলার সাংস্কৃতিক ও চলচ্চিত্রিক রেনেসাঁর সময়ে জন্ম নেওয়া এই শিল্পী সীমিত সংখ্যক সিনেমায় অভিনয় করেও নিজের এক অমলিন ছাপ রেখে গেছেন। তার অভিনীত চরিত্রগুলোর মধ্যে যেমন ছিল গ্রামীণ সরলতা, তেমনি ছিল গভীর আবেগ ও জীবনঘনিষ্ঠতা, যা আজও ইতিহাসের পাতায় জীবন্ত।
শৈশব ও পরিবার
উমাশশী জন্মগ্রহণ করেন ১৯১৫ সালে, কলকাতার এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে। তার পিতা নীলমণি চট্টোপাধ্যায় ছিলেন পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশের) ঢাকা জেলার অধিবাসী। পারিবারিক আর্থিক সঙ্কটের কারণে নীলমণি কলকাতায় চলে আসেন, এবং এখানেই উমাশশীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা।
শৈশবেই উমাশশীর মধ্যে শিল্প-প্রতিভার ঝলক দেখা গিয়েছিল। পড়াশোনা শুরু হয় বাড়িতে, একজন গৃহশিক্ষকের অধীনে। তবে ঐতিহ্যগত শিক্ষার পাশাপাশি সংগীতের প্রতি ছিল তার সহজাত আকর্ষণ। ছোটবেলা থেকেই সংগীতের তালিম নেন সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। পরবর্তীকালে চলচ্চিত্রে কাজ করতে গিয়ে পঙ্কজকুমার মল্লিক এবং রাইচাঁদ বড়ালের মতো কিংবদন্তিদের কাছেও সংগীত শিক্ষার সুযোগ পান, যা তার অভিনয় জীবনে এক অতিরিক্ত মাত্রা যোগ করেছিল।
সংগীত জীবনের সূচনা
অভিনয়ে হাতেখড়ির আগেই সংগীত জগতে উমাশশীর পদচারণা শুরু হয়। তিনি ‘শ্রীমতি উমা দেবী’ নামে কলম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানির জন্য গান রেকর্ড করতেন। সেই সময়ে রেকর্ডিং শিল্প তখনও প্রাথমিক পর্যায়ে, আর উমাশশীর মধুর কণ্ঠ তাকে জনপ্রিয় করে তোলে। পরে তিনি হিন্দুস্থান মিউজিক্যাল প্রোডাক্টসের সাথেও যুক্ত হন।
তার কণ্ঠে ছিল সুরের আবেগময় প্রকাশ, যা পরবর্তীকালে তার অভিনয়শৈলীকেও সমৃদ্ধ করেছিল।
চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ: নির্বাক যুগ
উমাশশীর চলচ্চিত্রজীবনের সূচনা হয় ১৯২৯ সালে।
‘গ্রাফিক আর্টস’-এর প্রযোজিত এবং দ্বারিকা খোসলা পরিচালিত ‘বঙ্গবালা’ সিনেমার সুবর্ণা চরিত্রে তিনি প্রথমবারের মতো অভিনয় করেন। এটি ছিল একেবারেই ছোট ভূমিকা, কিন্তু তার সহজাত অভিনয়প্রতিভা প্রথম দর্শনেই চলচ্চিত্র জগতের মনোযোগ আকর্ষণ করে।
পরবর্তীকালে তিনি আরও কয়েকটি নির্বাক ছবিতে অভিনয় করেন:
‘বিগ্রহ’ (১৯৩০) : এখানে তিনি জমিদারের স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেন।
‘অভিষেক’ (১৯৩১) : সর্বেধারের স্ত্রীর চরিত্রে তার আবেগঘন অভিনয় দর্শক ও সমালোচক মহলে প্রশংসিত হয়।
এই সময়ে অভিনেত্রীর কাজ ছিল অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং, কারণ নির্বাক ছবিতে মুখের অভিব্যক্তি, শরীরী ভাষা এবং দৃষ্টিভঙ্গিই ছিল একমাত্র প্রকাশের মাধ্যম। উমাশশী এই চ্যালেঞ্জ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করেছিলেন। তার অভিনয় ছিল সংযত, সুশৃঙ্খল এবং অত্যন্ত প্রাণবন্ত — যা অনেক সময় শব্দের অভাবও পূরণ করত।
সবাক যুগের অগ্রদূত
১৯৩১ সালে বাংলা চলচ্চিত্র যখন সবাক যুগে প্রবেশ করে, উমাশশীও নিজেকে নতুন যুগের সাথে মানিয়ে নেন। তার প্রথম সবাক ছবি ‘দেনাপাওনা’ (১৯৩১), পরিচালনায় প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। এই ছবিতে তিনি অসাধারণ সাবলীলতায় সংলাপের মাধ্যমে আবেগ প্রকাশ করেন, যা নির্বাক যুগের অনেক অভিনেত্রীর পক্ষেই তখন সম্ভব ছিল না।
তারপর ১৯৩২ সালের ‘চণ্ডীদাস’ ছবিতে তিনি রামী চরিত্রে অভিনয় করে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এটি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়।
‘চণ্ডীদাস’ ছিল একটি সামাজিক সংকেতবাহী ছবি, যেখানে জাতিভেদের বিরুদ্ধে মানবতার বার্তা ছিল। রামী চরিত্রে উমাশশী অসাধারণ আবেগ প্রকাশ করেন — চোখের ভাষায়, কণ্ঠের নরম সুরে, আর সংলাপের আন্তরিকতায়। কেএল সায়গল ও পাহাড়ি সান্যালের মতো বিশিষ্ট সহশিল্পীদের সঙ্গে কাজ করে তিনি নিজেকে এক সুদক্ষ অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
উমাশশীর কিছু উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র
সাল | চলচ্চিত্র | চরিত্র |
---|---|---|
১৯২৯ | বঙ্গবালা | সুবর্ণা |
১৯৩০ | বিগ্রহ | জমিদারের স্ত্রী |
১৯৩১ | অভিষেক | সর্বেধারের স্ত্রী |
১৯৩১ | দেনাপাওনা | উল্লেখযোগ্য চরিত্র |
১৯৩২ | বিষ্ণুমায়া | মন্দাকিনী |
১৯৩২ | ভাগ্যলক্ষ্মী | লক্ষ্মী |
১৯৩২ | চণ্ডীদাস | রামী |
১৯৩৩ | কপালকুণ্ডলা | কপালকুণ্ডলা |
১৯৩৪ | রূপলেখা | সুলেখা |
উমাশশীর অভিনীত ‘কপালকুণ্ডলা’ (১৯৩৩) ছবিটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিদ্যাসাগরের কালজয়ী উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই ছবিতে তার অভিনয় সর্বজন প্রশংসিত হয়। কপালকুণ্ডলার ব্যক্তিত্ব, শক্তি ও আবেগ তিনি দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
‘রূপলেখা’ (১৯৩৪)-তে সুলেখার ভূমিকাতেও তার অভিনয় ছিল নজরকাড়া — গ্রামীণ জীবনের সরলতা ও গভীর প্রেমের আবেগ নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
রঙ্গমঞ্চের জীবন
চলচ্চিত্রের পাশাপাশি উমাশশী নিয়মিত রঙ্গমঞ্চেও অভিনয় করতেন। সেই সময়ে রঙ্গমঞ্চ ছিল বাংলার প্রধান বিনোদনের মাধ্যম এবং অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম। পেশাদার মঞ্চে তিনি যে দক্ষতায় অভিনয় করেছেন, তা তার চলচ্চিত্র জীবনের জন্যও ছিল এক প্রশিক্ষণের ক্ষেত্র। মঞ্চে তার সংলাপ উচ্চারণের স্পষ্টতা, শরীরী ভাষার দক্ষতা এবং আবেগ প্রকাশের সূক্ষ্মতা পরবর্তীতে সিনেমায় তার অভিনয়ে গভীরতা এনেছিল।
সহশিল্পী ও পরিচালকদের সঙ্গে সম্পর্ক
উমাশশী সৌভাগ্যবান ছিলেন যে, তিনি বাংলা সিনেমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন।
কেএল সায়গল, পাহাড়ি সান্যাল, পৃথ্বীরাজ কাপুরের সঙ্গে তার অন-স্ক্রিন কেমিস্ট্রি ছিল অনন্য।
পরিচালক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, দেবকী বসু, প্রমথেশ বড়ুয়া, চারু রায় প্রমুখের পরিচালনায় কাজ করার অভিজ্ঞতা তার শিল্পীজীবনকে সমৃদ্ধ করেছিল।
সহশিল্পী ও পরিচালকেরা তাকে নিয়ে উচ্চমত পোষণ করতেন। অনেকেই তার সংযত অভিনয় ও সততা সম্পর্কে আলাদাভাবে মন্তব্য করেছেন। উমাশশী ছিলেন অল্প কথার, কিন্তু পরিশ্রমী ও একাগ্রচিত্ত শিল্পী।
চলচ্চিত্র জীবন থেকে অবসর ও অন্তর্ধান
উমাশশী ১৯৫১ সালে চলচ্চিত্র জগত থেকে অবসর নেন। তারপর তিনি একেবারে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান। পরবর্তী জীবনের বিশদ বিবরণ এখনো অজানা রয়ে গেছে। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, তিনি ব্যক্তিগত শান্তি ও গোপনীয় জীবন বেছে নিয়েছিলেন। চলচ্চিত্রের প্রাথমিক যুগের অনেক শিল্পীর মতোই, তিনিও নিজের জীবনের শেষ অধ্যায় নিভৃতে অতিবাহিত করেছিলেন।
উমাশশীর উত্তরাধিকার
বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে উমাশশীর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি ছিলেন সেই বিরল শিল্পীদের একজন, যারা নির্বাক যুগের অভিব্যক্তিপূর্ণ অভিনয় ও সবাক যুগের সংলাপভিত্তিক অভিনয়ের মধ্যে সফলভাবে সেতুবন্ধন তৈরি করেছিলেন। তার অভিনীত রামী, কপালকুণ্ডলা, সুলেখার চরিত্রগুলি বাংলা সিনেমার স্মরণীয় নারী চরিত্রগুলির অন্যতম হয়ে আছে।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, যখন বাংলা ও ভারতীয় সিনেমা তার শতবর্ষ পার করছে, তখন এই অগ্রজ শিল্পীদের অবদান স্মরণ করা অত্যন্ত জরুরি। উমাশশী তার সংক্ষিপ্ত ক্যারিয়ারেই দেখিয়ে দিয়েছিলেন, প্রতিভা, নিষ্ঠা এবং শিল্পসাধনার মাধ্যমে ইতিহাসে চিরস্থায়ী হয়ে ওঠা সম্ভব।

উমাশশী শুধুমাত্র একজন অভিনেত্রী ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের একটি যুগের প্রতিনিধি। তার চোখের ভাষা, তার অনবদ্য সংলাপ প্রক্ষেপণ, তার আবেগময় অভিনয় আজও বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগের কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনি প্রমাণ করেছিলেন, অভিনয় মানে শুধুই জনপ্রিয়তা নয়; অভিনয় হলো আবেগ, সততা, শিল্পের প্রতি ভালোবাসা। উমাশশীর জীবন এবং কর্ম বাংলা সিনেমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য চিরকাল অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
আরও দেখুনঃ