একটি জীবন চলচ্চিত্র

বাংলা চলচ্চিত্রে মাঝে মাঝে এমন কিছু সৃষ্টি হয়, যা নিছক বিনোদনের গণ্ডি ছাড়িয়ে এক অন্তর্জগৎ অন্বেষণের যাত্রায় রূপ নেয়। “একটি জীবন” (১৯৮৭) ঠিক তেমনই একটি চলচ্চিত্র। এটি কেবল একটি জীবনীভিত্তিক সিনেমা নয়, এটি এক নিরহঙ্কার, পরিশ্রমী ভাষাপ্রেমিকের একক সংগ্রামের দলিল।

চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন রাজা মিত্র। তাঁর প্রথম পরিচালিত এই ছবি ভারতের ‘ইন্ডিয়ান প্যানোরামা’-তে নির্বাচিত হয় এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারেও সম্মানিত হয়। প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, মাধবী মুখোপাধ্যায়, এবং আভেরী দত্ত।

 

একটি জীবন চলচ্চিত্র
একটি জীবন চলচ্চিত্র

 

কাহিনির মূল সুর:

সিনেমাটির মূল চরিত্র গুরুদাস ভট্টাচার্য (অভিনয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়), একজন প্রান্তিক গ্রামের সংস্কৃত শিক্ষক, যিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেন বাংলা ভাষার একটি পূর্ণাঙ্গ অভিধান রচনার কাজে। তাঁর সংগ্রাম নিছক কোনও ভাষাবিদ্যার চর্চা নয়, বরং তা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি এক অকপট ভালোবাসার প্রকাশ।

এই কাহিনি হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনের ছায়া অবলম্বনে রচিত—তিনি ছিলেন বঙ্গীয় শব্দকোষের প্রণেতা এবং বাংলা ভাষার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম। সিনেমার চিত্রনাট্য তৈরি হয়েছে বিখ্যাত সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুর লেখা থেকে, আর ছবির চিত্রগ্রহণে ছিলেন কমল নায়েক।

‍‍‍ পারিবারিক জীবনের করুণ বাস্তবতা:

গুরুদাসের পরিবারে আছেন তাঁর স্ত্রী (মাধবী মুখোপাধ্যায়), ছেলে নব্যেন্দু এবং কন্যা শিবানী। সীমিত আয়ের সংসারে স্বস্তি থাকলেও সচ্ছলতা ছিল না। তিনি কেবলমাত্র ভাষার সেবা করতে চেয়েছেন, কিন্তু তাতে পরিবারের প্রাত্যহিক সংকট আরো বাড়ে। তবুও মেয়েটি শিবানী বাবার কাজের প্রতি আন্তরিকভাবে সাহায্য করত।

তবে জীবন সবসময় অনুকূল নয়। হঠাৎ করেই শিবানীর মৃত্যু ঘটে—এই ঘটনা গুরুদাসকে ভেঙে দেয়, কিন্তু থামায় না। ছেলে নব্যেন্দুও পড়াশোনা ছেড়ে চাকরিতে ঢুকে সংসারের ভার তুলে নেয়।

একটি জীবন চলচ্চিত্র
একটি জীবন চলচ্চিত্র

অভিধান রচনার প্রচেষ্টা:

গুরুদাস কেবল পাণ্ডিত্যপূর্ণ শব্দ নয়, বরং গ্রামবাংলার কথ্য ভাষা, লোকজ শব্দ, আঞ্চলিক টান—সবই অন্তর্ভুক্ত করতে চান তাঁর অভিধানে। কলকাতার প্রাতিষ্ঠানিক সমাজের কাছে তাঁর এই প্রচেষ্টা গুরুত্ব পায় না। তিনি প্রত্যাখ্যাত হন বহু জায়গায়, কিন্তু একজন তরুণ লেখক তাঁকে সাহায্য করেন নিজের সংগ্রহের বই দিয়ে।

যখন আশেপাশের মানুষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনায় ব্যস্ত, তখন গুরুদাস জ্ঞানভাণ্ডারের জন্য নিঃশব্দে সংগ্রাম করে চলেন। অবশেষে, একজন প্রকাশক তাঁর কাজে আগ্রহী হন এবং গুরুদাসের বহু বছরের নিষ্ঠা ও একাগ্রতা পাঠকমনে প্রশংসা অর্জন করে।

সিনেমার স্বীকৃতি ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব:

“একটি জীবন” কেবল একটি মানুষের জীবনের চিত্রায়ন নয়; এটি ভাষা, সংস্কৃতি ও অধ্যবসায়ের প্রতি এক শ্রদ্ধাঞ্জলি। সিনেমাটি ১৯৮৭ সালে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা প্রথম পরিচালকের জন্যস্বর্ণকমল’ পুরস্কার পায়। সেই সময়ে, বহু চলচ্চিত্র সমালোচক ও বুদ্ধিজীবী ছবিটির প্রশংসা করেন এর গভীরতা ও নির্মোহ চিত্রভাষার জন্য।

নির্মাণের কুশলী দল:

  • প্রযোজনা: চালচিত্র

  • কাহিনি: বুদ্ধদেব বসু

  • পরিচালনা, চিত্রনাট্য, সংগীত: রাজা মিত্র

  • চিত্রগ্রহণ: কমল নায়েক

  • সম্পাদনা: বুলু ঘোষ

  • শিল্প নির্দেশনা: শতদল মিত্র

  • অভিনয়: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, মাধবী মুখোপাধ্যায়, আভেরী দত্ত, মুন্না চক্রবর্তী, শুভেন্দু চাকী

 

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়: যাঁর জীবন অনুপ্রেরণা

এই ছবির প্রেরণা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা ভাষার ইতিহাসে এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ নাম। তিনি বাংলা ভাষার জন্য একটি বিশদ অভিধান রচনা করেন—”বঙ্গীয় শব্দকোষ“—যা আজও ভাষাবিদ, গবেষক, সাহিত্যিকদের জন্য এক মূল্যবান রেফারেন্স। তাঁর জীবনে ছিল ত্যাগ, নিঃসঙ্গতা ও অসীম অধ্যবসায়।

 

Google News একটি জীবন চলচ্চিত্র
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

“একটি জীবন” এমন একটি চলচ্চিত্র যা দর্শককে বিনোদনের বাইরেও চিন্তা করতে শেখায়—ভাষা কেবল কথোপকথনের উপকরণ নয়, এটি সভ্যতার ভিত্তি। যারা সেই ভাষার জন্য নিজেদের নিঃশেষ করে দেন, তাঁদের কাহিনি জানা এবং স্মরণে রাখা আমাদের কর্তব্য। গুরুদাস ভট্টাচার্যর মতো মানুষেরা ভাষাকে শুধু বাঁচিয়ে রাখেন না—তাঁরা সেটিকে সম্মানিতও করেন।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment