এম. পি. প্রোডাকসন – ইতিহাস ও অবদান

বাংলা চলচ্চিত্র জগতে এম. পি. প্রোডাকসন ছিল এক প্রভাবশালী প্রযোজনা সংস্থা, যা একাধারে শিল্পমান বজায় রেখেছিল এবং বাণিজ্যিক সাফল্যও অর্জন করেছিল। ১৯৪০-এর দশকের শুরুর অস্থির রাজনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই প্রতিষ্ঠানের জন্ম, এবং কয়েক দশক ধরে তারা বাংলা সিনেমাকে সমৃদ্ধ করেছে।

এম. পি. প্রোডাকসন – ইতিহাস ও অবদান

 

প্রতিষ্ঠা সূচনা

মুরলীধর চট্টোপাধ্যায় ছিলেন এম. পি. প্রোডাকসনের প্রধান উদ্যোক্তা। তাঁর উদ্যোগে এবং দীপচান কঙ্কারিয়াসহ কিছু ব্যক্তির আর্থিক সহায়তায় ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সংস্থাটি। এম. পি. প্রোডাকসনের প্রযোজনায় প্রথম চলচ্চিত্র ছিল মায়ের প্রাণ (১৯৪১), পরিচালনায় ছিলেন কিংবদন্তি প্রমথেশ বড়ুয়া। এই ছবির মাধ্যমে সংস্থাটি চলচ্চিত্র শিল্পে পা রাখে এবং দ্রুতই একটি শক্তিশালী ব্যানার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

 

প্রমথেশ বড়ুয়া প্রাথমিক সাফল্য

প্রমথেশ বড়ুয়া এম. পি.-এর হয়ে আরও দুটি ছবি পরিচালনা করেছিলেন, যা সংস্থার মর্যাদা বাড়িয়ে তোলে। বড়ুয়ার মতো একজন খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকারকে প্রযোজনা ব্যানারে যুক্ত করতে পারা এম. পি. প্রোডাকসনের জন্য বড় কৃতিত্ব ছিল।

 

বৈচিত্র্যময় পরিচালকেরা

প্রমথেশ বড়ুয়া ছাড়াও বাংলা চলচ্চিত্রের বহু উল্লেখযোগ্য পরিচালক এম. পি.-এর হয়ে কাজ করেছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—

  • অগ্রদূত
  • সুকুমার দাশগুপ্ত
  • নির্মল দে
  • কালীপ্রসাদ ঘোষ
  • প্রেমেন্দ্র মিত্র
  • সুশীল মজুমদার

এই বৈচিত্র্যময় পরিচালকেরা তাদের নিজস্ব শৈলী ও দর্শন দিয়ে এম. পি.-এর প্রযোজনা সমৃদ্ধ করেছেন।

 

উত্তমসুচিত্রা যুগের সূচনা

এম. পি. প্রোডাকসনের সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক অবদান হলো বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি জুটি উত্তমকুমার সুচিত্রা সেন-কে দর্শকের সামনে নিয়ে আসা। তাদের প্রথম যুগল ছবি সাড়ে চুয়াত্তর (১৯৫৩) এম. পি.-এর প্রযোজনায় তৈরি হয় এবং এটি ছিল অভূতপূর্ব সাফল্য। এর পরবর্তী দুটি ছবি অগ্নিপরীক্ষা (১৯৫৪) এবং সবার উপরে (১৯৫৫) বাণিজ্যিক দিক থেকে সুপারহিট হয় এবং এই জুটি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কালজয়ী হয়ে ওঠে।

 

সমাজ সচেতনতা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

এম. পি. প্রোডাকসনের ব্যানারে সমাজকেন্দ্রিক ছবিও নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কার পাপে (১৯৫২), যা কালীপ্রসাদ ঘোষ পরিচালিত এবং সামাজিক বার্তার কারণে সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

অন্যদিকে, অগ্রদূত পরিচালিত বাবলা (১৯৫১), যা সৌরীন্দ্র মোহন মুখোপাধ্যায়ের কাহিনির উপর ভিত্তি করে নির্মিত, কার্লো ভি ভ্যারি চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক স্তরে এই স্বীকৃতি এম. পি.-কে বাংলা চলচ্চিত্রের মানচিত্রে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়।

 

প্রযোজিত চলচ্চিত্রসমূহ (নির্বাচিত)

  • ১৯৪১ – মায়ের প্রাণ, উত্তরায়ণ
  • ১৯৪২ – শেষ উত্তর
  • ১৯৪৩ – যোগাযোগ
  • ১৯৪৪ – বিদেশিনী
  • ১৯৪৬ – সাত নম্বর বাড়ী
  • ১৯৪৭ – স্বপ্ন ও সাধনা
  • ১৯৪৮ – অনির্বাণ
  • ১৯৪৯ – বিদুষী-ভার্যা, সঙ্কল্প, আভিজাত্য
  • ১৯৫০ – বানপ্রস্থ, কানতলা লাইট রেলওয়ে, বিদ্যাসাগর, ইন্দ্রনাথ
  • ১৯৫১ – নষ্টনীড়, প্রত্যাবর্তন, বাবলা, সহযাত্রী
  • ১৯৫২ – সঞ্জীবনী, কার পাপে, বসু পরিবার, আঁধি
  • ১৯৫৩ – সাড়ে চুয়াত্তর
  • ১৯৫৪ – অগ্নিপরীক্ষা
  • ১৯৫৫ – অনুপমা, সবার উপরে
  • ১৯৫৭ – যাত্রা হলো শুরু
  • ১৯৬০ – কুহক

 

মূল্যায়ন

এম. পি. প্রোডাকসন বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায়। তারা কেবল বাণিজ্যিক হিট ছবিই দেয়নি, বরং সমাজ সচেতন ও শিল্পমানসম্পন্ন ছবিও নির্মাণ করেছে। উত্তম-সুচিত্রা জুটির সূত্রপাত থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে স্বীকৃতি—সবক্ষেত্রেই এই প্রতিষ্ঠান তাদের স্বাক্ষর রেখেছে।

Leave a Comment