কাবেরী বসু ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের এক প্রতিভাবান অভিনেত্রী, যিনি অল্প সময়ের মধ্যেই দর্শক ও সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তার অভিনয়জীবন দুই পর্বে বিভক্ত—একটি তরুণী নায়িকা হিসেবে ১৯৫০-এর দশকে এবং অপরটি ব্যক্তিগত দুর্ঘটনার পর দ্বিতীয়বার প্রত্যাবর্তন করে পরিণত চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে।
কাবেরী বসু – জীবন ও কর্ম
জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন
কাবেরী বসুর জন্ম কলকাতায়। তিনি বেলতলা গার্লস স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার আগেই তিনি অভিনয়ের জগতে প্রবেশ করেন। ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল এবং সেই আবেগই তাঁকে দ্রুত চলচ্চিত্রের পর্দায় নিয়ে আসে।
চলচ্চিত্রে সূচনা
১৯৫৫ সালে সুবোধ মিত্র পরিচালিত রাইকমল চলচ্চিত্রে নায়িকা কমল-এর ভূমিকায় অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তার চলচ্চিত্রজীবনের সূচনা ঘটে। এই ছবির সাফল্য তাকে রাতারাতি আলোচনায় নিয়ে আসে। পরবর্তী দুই বছরে (১৯৫৫–১৯৫৭) তিনি নায়িকা হিসেবে সাতটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।
এ সময়কার উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলি—
- দেবী মালিনী (দেবী মালিনী, ১৯৫৫)
- মালতী (দৃষ্টি, ১৯৫৫)
- সুপ্রিয়া (পরাধীন, ১৯৫৬)
- মীনা (শঙ্করনারায়ণ ব্যাঙ্ক, ১৯৫৬)
- শ্যামলী (শ্যামলী, ১৯৫৬)
- লতা (মধুমালতী, ১৯৫৭)
এই চলচ্চিত্রগুলির মাধ্যমে তিনি সুকুমার সৌন্দর্য ও অভিনয়ের দক্ষতা দিয়ে সমকালীন দর্শকদের মন জয় করেছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবন ও বিরতি
অভিনয়জীবনের উজ্জ্বল সূচনার পর কাবেরী বসু বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং সংসার জীবনে মনোনিবেশ করেন। কিন্তু একটি ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা তাঁর জীবনের গতিপথ বদলে দেয়। দুর্ঘটনায় তাঁর স্বামী ও মেয়ে মারা যান এবং কাবেরী নিজেও দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী অবস্থায় ছিলেন। এই কারণে তিনি অভিনয়জীবন থেকে দীর্ঘ বিরতিতে চলে যান।
দ্বিতীয় পর্ব – চলচ্চিত্রে প্রত্যাবর্তন
প্রায় এক যুগ পরে তিনি আবার চলচ্চিত্রে ফিরে আসেন। সত্যজিৎ রায়ের অরণ্যের দিনরাত্রি (১৯৭০)-এ জয়া-এর ভূমিকায় অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি পুনরায় আলোচনায় আসেন। এখানে তিনি তার সংযত ও পরিণত অভিনয় দিয়ে বিশেষ প্রশংসা অর্জন করেন।
পরবর্তী সময়ে তিনি সীমিত সংখ্যক চলচ্চিত্রে কাজ করলেও তার অভিনয় ছিল ব্যতিক্রমী ও স্মরণীয়। বিশেষত—
- চন্দ্রাণী (আমি সে ও সখা, ১৯৭৫)
- শ্রীলেখা (নগর দর্পণে, ১৯৭৫)
এই চরিত্রগুলি তাঁর বহুমাত্রিক অভিনয় প্রতিভাকে নতুনভাবে প্রকাশ করে।
চলচ্চিত্রপঞ্জি
- ১৯৫৫ – রাইকমল, দেবী মালিনী, দৃষ্টি
- ১৯৫৬ – পরাধীন, শঙ্করনারায়ণ ব্যাঙ্ক, শ্যামলী
- ১৯৫৭ – মধুমালতী
- ১৯৭০ – অরণ্যের দিনরাত্রি
- ১৯৭৪ – যে যেখানে দাঁড়িয়ে
- ১৯৭৫ – আমি সে ও সখা, নগর দর্পণে
মূল্যায়ন
কাবেরী বসুর চলচ্চিত্রজীবন দীর্ঘ না হলেও তার অভিনয় প্রমাণ করে যে তিনি ছিলেন মেধাবী ও প্রভাবশালী শিল্পী। জীবনের কঠিনতম দুর্ঘটনা তাকে কিছুদিনের জন্য আড়ালে সরিয়ে দিলেও, প্রত্যাবর্তনের পর তার অভিনয় আরও গভীর ও সংযমী হয়ে ওঠে। বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসে তিনি এক ব্যতিক্রমী অধ্যায়—অল্প সময়ে উজ্জ্বল সাফল্য, দীর্ঘ বিরতি এবং সীমিত অথচ গভীর অভিনয় উপস্থিতি।