গীতা সেন (সোম) বাংলা চলচ্চিত্র ও নাট্যাঙ্গনের এক উজ্জ্বল নাম, যিনি একইসাথে অভিনেত্রী এবং সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবেও পরিচিত। তাঁর জন্ম হুগলী জেলার উত্তরপাড়ায়। ছোটবেলা থেকেই তিনি নাটকের প্রতি গভীর অনুরাগী ছিলেন এবং স্থানীয় নাট্যসংগঠন উত্তরপাড়ার ভদ্রকালী নাট্যচক্রে নিয়মিত অভিনয়ের মাধ্যমে শিল্পীজীবনের সূচনা করেন। প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি নাটকের মঞ্চই হয়ে ওঠে তাঁর অভিনয়শিক্ষার প্রাথমিক ক্ষেত্র।
চলচ্চিত্রে অভিষেক ও প্রাথমিক সাফল্য
গীতা সেনের প্রথম চলচ্চিত্র অনামী পরিচালিত দুধারা (১৯৫০)। এই ছবিতে তিনি নায়িকা মায়া চরিত্রে অভিনয় করেন। ছবিটির বিশেষত্ব হল এটি নির্মিত হয়েছিল কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনের কাহিনি অবলম্বনে। এই ছবিকেই কেন্দ্র করে গীতা সেন ও মৃণাল সেনের প্রথম পরিচয় হয়, যা পরে বিবাহবন্ধনে রূপ নেয়। ফলে বলা যায়, তাঁর ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনের মোড় ঘুরে যায় দুধারা ছবির মাধ্যমে।
বাংলা চলচ্চিত্রে অবদান
গীতা সেন মোট দশটি বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। সংখ্যায় কম হলেও তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলো ছিল বৈচিত্র্যময় ও স্মরণীয়। প্রথম দিকের উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হলো—
- জীবন সৈকতে (১৯৫০), যেখানে তিনি গীতা চরিত্রে অভিনয় করেন।
- জাগৃহি (১৯৫৪), এখানে তিনি ইন্দ্রা চরিত্রে অভিনয় করেন।
- কঙ্কাল (১৯৫০) ছবিতেও তাঁর অভিনয় বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছিল।
মৃণাল সেন পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলোতে তিনি মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। বিশেষ করে কলকাতা ৭১ (১৯৭২), কোরাস (১৯৭৪), নাগরিক (১৯৭৭), একদিন প্রতিদিন (১৯৭৯), চালচিত্র (১৯৮১), আকালের সন্ধানে (১৯৮২) এবং মহাপৃথিবী (১৯৯১) চলচ্চিত্রে তাঁর চরিত্রগুলো দর্শক ও সমালোচক উভয়ের কাছে সমানভাবে সমাদৃত হয়েছিল।
হিন্দি চলচ্চিত্রে কাজ
যদিও তাঁর মূল কাজ ছিল বাংলা চলচ্চিত্রে, তবুও তিনি কিছু হিন্দি ছবিতেও অভিনয় করেন। এসব ছবির অধিকাংশই ছিলেন মৃণাল সেন পরিচালিত। সেখানে গীতা সেন প্রায়শই পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করলেও তাঁর অভিনয় নৈপুণ্য আলাদাভাবে লক্ষ্য করা যেত।
নাট্যজীবন ও গণনাট্য সংঘে ভূমিকা
চলচ্চিত্রের পাশাপাশি গীতা সেন ছিলেন একজন সক্রিয় নাট্যকর্মী। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের (IPTA) সঙ্গে যুক্ত থেকে বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করেন। সেই সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক আবহে গণনাট্য ছিল একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন, যেখানে তিনি কণ্ঠ মেলান। পরে তিনি উৎপল দত্ত, সুধী প্রধান প্রমুখ নাট্যব্যক্তিত্বের নির্দেশনায় নাটকে অভিনয় করেন। এর মাধ্যমে তিনি নাট্যাঙ্গনের ভিন্নধর্মী ও প্রগতিশীল ধারার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
নেপথ্য সংগীতে অংশগ্রহণ
শুধু অভিনয়েই নয়, গীতা সেন সংগীতেও নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। তিনি অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায় পরিচালিত দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন (১৯৭০) ছবিতে নেপথ্য সংগীত পরিবেশন করেন। এর মাধ্যমে তাঁর বহুমুখী প্রতিভা প্রকাশ পায়।
অভিনয়ের বৈশিষ্ট্য
গীতা সেনের অভিনয় ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও বাস্তবঘনিষ্ঠ। তিনি সাধারণত গ্ল্যামারাস চরিত্রে অভিনয় করেননি, বরং মধ্যবিত্ত সমাজের নারী, মায়ের চরিত্র বা সংগ্রামী নারীর ভূমিকাই বেশি ফুটিয়ে তুলেছেন। মৃণাল সেনের ছবিতে তাঁর অভিনয় অনেক সময়ই চলচ্চিত্রের বাস্তবধর্মী ব্যঞ্জনাকে আরও শক্তিশালী করেছে।
চলচ্চিত্রপঞ্জি
- ১৯৫০: দুধারা, জীবন সৈকতে, কঙ্কাল
- ১৯৫৪: জাগৃহি
- ১৯৫৬: মামলার ফল
- ১৯৭০: দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন (নেপথ্য সংগীত)
- ১৯৭২: কলকাতা ৭১
- ১৯৭৪: কোরাস
- ১৯৭৭: নাগরিক
- ১৯৭৯: একদিন প্রতিদিন
- ১৯৮১: চালচিত্র
- ১৯৮২: আকালের সন্ধানে
- ১৯৯১: মহাপৃথিবী
ব্যক্তিগত জীবন
গীতা সেন ও মৃণাল সেন ছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের এক প্রভাবশালী দম্পতি। তাঁদের সম্পর্ক শুধু ব্যক্তিগত জীবনেই নয়, শিল্পচর্চার ক্ষেত্রেও পরস্পরকে সমর্থন ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
উত্তরাধিকার
গীতা সেনের অভিনয়জীবন সংখ্যায় সীমিত হলেও মান ও গভীরতায় সমৃদ্ধ। তিনি চলচ্চিত্র ও নাট্যদুনিয়ায় নারীর চরিত্রকে যে বাস্তবতার সাথে উপস্থাপন করেছেন তা আজও অনন্য। তাঁর কাজ মৃণাল সেনের রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি সমৃদ্ধ চলচ্চিত্রগুলিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে।