গুরু বাগচী (গুরুদাস) – এক নিষ্ঠাবান চলচ্চিত্রকারের জীবন ও কর্ম

ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র জগতের ইতিহাসে গুরু বাগচী (গুরুদাস) এক উল্লেখযোগ্য নাম। মূলত পরিচালক হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি চিত্রনাট্য রচয়িতা হিসেবেও দক্ষতা প্রদর্শন করেছিলেন। পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি চলচ্চিত্র অঙ্গনে সক্রিয় ছিলেন এবং বাংলা সিনেমায় নিজের এক স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করেছিলেন।

 

জন্ম ও শিক্ষা

গুরু বাগচীর জন্ম কলকাতায়। ছোটবেলা থেকেই তিনি শিল্প-সংস্কৃতির পরিবেশে বেড়ে ওঠেন। সাধারণ প্রথাগত শিক্ষা শেষ করার পর তাঁর আগ্রহের কেন্দ্র হয়ে ওঠে নাটক ও চলচ্চিত্র। যুবক বয়সেই চলচ্চিত্র নির্মাণের নেপথ্য কাজকর্মের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন এবং ধীরে ধীরে সহকারী পরিচালক হিসেবে পা রাখেন চলচ্চিত্র জগতে।

 

প্রাথমিক কর্মজীবন

গুরু বাগচীর চলচ্চিত্র জীবন শুরু হয় ছবি বিশ্বাস পরিচালিত “যার যেথা মার” (১৯৪৯) চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক হিসেবে। এই অভিজ্ঞতা তাঁর জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণ শেখার প্রথম পাঠশালা হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তীকালে তিনি প্রায় এক দশক ধরে বিখ্যাত পরিচালক অর্ধেন্দু মুখার্জী-র সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এ সময়ে তিনি “দস্যু মোহন” (১৯৫৫), “গরীবের মেয়ে” (১৯৬০), “রায়বাহাদুর” (১৯৬১) সহ একাধিক চলচ্চিত্রে কাজ করে চলচ্চিত্র পরিচালনার খুঁটিনাটি গভীরভাবে আয়ত্ত করেন।

সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার সময় তিনি চলচ্চিত্রের প্রযুক্তিগত দিক, গল্প বলার ধরন, এবং অভিনেতা পরিচালনার দক্ষতা অর্জন করেন। এই অভিজ্ঞতাগুলোই তাঁকে পরবর্তীতে একজন স্বাধীন পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশের জন্য প্রস্তুত করে।

 

স্বাধীন পরিচালনা জীবন

১৯৬৩ সালে গুরু বাগচীর প্রথম স্বাধীন পরিচালিত ছবি ছিল “দ্বীপের নাম টিয়ারং” ছবিটির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন খ্যাতনামা চলচ্চিত্রকার ঋত্বিককুমার ঘটক। এই সহযোগিতা গুরু বাগচীর চলচ্চিত্র জীবনকে এক নতুন মাত্রা দেয়। তাঁর নির্মাণশৈলী ও গল্প বলার ভঙ্গি দর্শক এবং সমালোচকদের নজর কাড়ে।

পরবর্তী সময়ে তিনি একে একে ষোলোটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—

  • তাহলে (১৯৬৪) – নিজের চিত্রনাট্যে নির্মিত এই চলচ্চিত্র সামাজিক কাহিনিনির্ভর।
  • আলো ছায়া (১৯৭৪) – মানবজীবনের দ্বন্দ্ব, আশা-নিরাশা, এবং সামাজিক বাস্তবতার চিত্রায়ণ ছিল এই ছবির মূল উপজীব্য।
  • সৃষ্টিছাড়া (১৯৭৮) – সমাজচ্যুত মানুষদের জীবনের সংকট তুলে ধরেছিলেন।
  • টুসি (১৯৭৮) – এক নারীর সংগ্রাম ও আত্মপ্রতিষ্ঠার গল্প।
  • সমৰ্পিতা (১৯৮৪) – আবেগ ও মানবিক সম্পর্কের সূক্ষ্ম দিকগুলোকে ফুটিয়ে তুলেছিল।
  • মহাপীঠ তারাপীঠ (১৯৮৯) – ধর্মীয় আবহ, বিশ্বাস ও ভক্তির এক অনন্য চিত্রায়ণ।

তাঁর সর্বশেষ চলচ্চিত্র পেন্নাম কলকাতা” (১৯৯২) মুক্তি পায়, যা দিয়ে তিনি তাঁর দীর্ঘ পরিচালনা জীবনের সমাপ্তি টানেন।

 

চলচ্চিত্র তালিকা

১. ১৯৬০ – দ্বীপের নাম টিয়ারং
২. ১৯৬৪ – তাহলে
৩. ১৯৬৯ – তীরভূমি
৪. ১৯৭০ – সমান্তরাল
৫. ১৯৭৩ – বিন্দুর ছেলে
৬. ১৯৭৪ – আলো ও ছায়া
৭. ১৯৭৪ – ছন্দপতন
৮. ১৯৭৭ – রামের সুমতি
৯. ১৯৭৮ – সৃষ্টিছাড়া
১০. ১৯৭৮ – টুসি
১১. ১৯৭৯ – যত মত তত পথ
১২. ১৯৮১ – স্বামী স্ত্রী
১৩. ১৯৮৪ – সমৰ্পিতা
১৪. ১৯৮৯ – মহাপীঠ তারাপীঠ
১৫. ১৯৯০ – ভাঙাগড়া
১৬. ১৯৯২ – পেন্নাম কলকাতা

 

চলচ্চিত্রে অবদান ও বৈশিষ্ট্য

গুরু বাগচীর চলচ্চিত্রে সাধারণত দেখা যায়—

  • বাস্তবধর্মী গল্প বলার ধারা।
  • সামাজিক সমস্যা ও পারিবারিক টানাপোড়েনের প্রতিফলন।
  • চিত্রনাট্যের উপর জোর এবং চরিত্র বিকাশে মনোযোগ।
  • নাটকীয় দৃশ্যপটের সঙ্গে আবেগঘন সঙ্গীতের ব্যবহার।

তিনি সিনেমাকে শুধু বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে দেখেননি, বরং সমাজের আয়না হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলেন। এজন্য তাঁর অনেক চলচ্চিত্রে সামাজিক অবিচার, মানবিক সংকট ও ধর্মীয় আবহ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।

 

ব্যক্তিজীবন

গুরু বাগচী সাধারণত আলো-ঝলমলে জীবনের বাইরে ছিলেন। তিনি প্রচারবিমুখ, শান্ত স্বভাবের এবং কাজপাগল মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিজীবন নিয়ে খুব বেশি তথ্য জনসমক্ষে না এলেও জানা যায়, তিনি পরিবারকেন্দ্রিক জীবনযাপন করতেন এবং প্রজন্মের তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সহযোগিতা করতে আগ্রহী ছিলেন।

 

উত্তরাধিকার ও স্মরণ

বাংলা চলচ্চিত্র জগতে গুরু বাগচী এক মূল্যবান নাম। যদিও তিনি বাণিজ্যিক সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছাতে পারেননি, তবে তাঁর চলচ্চিত্রগুলোকে সমালোচকরা সবসময়ই গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর কাজ আজও চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস। বিশেষ করে “মহাপীঠ তারাপীঠ” ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক চলচ্চিত্রের ধারায় একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন।

১৯৯২ সালে তাঁর শেষ চলচ্চিত্র মুক্তির পর থেকে তিনি ধীরে ধীরে চলচ্চিত্র জগত থেকে সরে আসেন। তবুও বাংলা সিনেমার ইতিহাসে তাঁর অবদান অম্লান থেকে গেছে।

 

উপসংহার

গুরু বাগচী ছিলেন এক নিষ্ঠাবান, সৃজনশীল এবং বাস্তবমুখী চলচ্চিত্রকার। তিনি যেমন গল্প লিখেছেন, তেমনি পর্দায় সেই গল্পকে ফুটিয়ে তুলেছেন আবেগ ও বাস্তবতার মিশেলে। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাঁর নাম হয়তো বাণিজ্যিক দিক থেকে খুব উজ্জ্বল নয়, কিন্তু গুণগত দিক থেকে তিনি ছিলেন এক অগ্রগণ্য স্রষ্টা।

Leave a Comment