ভারতের সংগীত ইতিহাসে দক্ষিণামোহন ঠাকুরের অবদান অপরিসীম। তিনি শুধু একজন সংগীতশিল্পী ও সংগীত পরিচালক হিসেবেই পরিচিত নন, বরং সংগীতের নানা শাখা এবং যন্ত্রে তার বিস্তৃত দক্ষতার জন্যও তিনি স্মরণীয়। কলকাতার একটি সংগীতবদ্ধ পরিবারে জন্মগ্রহণ করা দক্ষিণামোহন ঠাকুরের সংগীত জীবনের শুরুটা হয়েছিল ছোটবেলায়, তার মায়ের কাছ থেকে গানের তালিম নিয়ে। তার সঙ্গীতের প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং একাগ্রতার ফলস্বরূপ তিনি শুধুমাত্র একজন সংগীতজ্ঞ হিসেবে নয়, বরং একজন সংগীত পরিচালক হিসেবেও বাংলা চলচ্চিত্রে নিজের একটি শক্তিশালী অবস্থান প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

দক্ষিণামোহন ঠাকুরের শৈশব এবং শিক্ষা
দক্ষিণামোহন ঠাকুরের জন্ম কলকাতায়। তিনি ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, যা সংগীতের এক ঐতিহ্যবাহী পরিবার হিসেবে পরিচিত। ছোটবেলা থেকেই সংগীতের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে, কারণ তার মা ছিলেন একজন সংগীতজ্ঞ। মায়ের কাছেই তিনি গানের প্রথম পাঠ নেন। তাঁর দাদু ও কাকা ছিলেন সেতার ও এসরাজ বাজানোর দক্ষ শিল্পী, আর তাদের কাছ থেকে তিনি এই দুই যন্ত্রে সংগীত শেখেন।
শৈশবে সংগীতের প্রতি গভীর আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও দক্ষিণামোহন ঠাকুরের সংগীতের প্রতিভা ত্বরান্বিত হয় যখন তিনি মাত্র ১৬ বছর বয়সে রেডিওর অর্কেস্ট্রা দলের সদস্য হিসেবে যোগ দেন। এটাই তার সংগীত জগতে প্রবেশের প্রথম দিকের ধাপ।
শান্তিনিকেতনে সংগীত শিক্ষার দীক্ষা
দক্ষিণামোহন ঠাকুর শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ সময় যন্ত্রসংগীতের পরীক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। এই অভিজ্ঞতা তাকে সংগীতের নানা শাখায় দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করে। শান্তিনিকেতনে তার অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তিনি সংগীতের গভীরতা এবং বৈচিত্র্য সম্পর্কে আরও জানেন এবং সেই অনুযায়ী তার সংগীতশৈলীকে আরও উন্নত করেন।
সংগীত যন্ত্রে দক্ষতা
দক্ষিণামোহন ঠাকুর শুধু একজন সংগীত পরিচালক ছিলেন না, তিনি বিভিন্ন ধরনের সংগীত যন্ত্রের সঙ্গেও পরিচিত ছিলেন এবং সেগুলো বাজাতে পারতেন। তার যন্ত্রসংগীতের মধ্যে বিশেষ দক্ষতা ছিল দিলরুবা, তারসানাই, ধীগা, মন্দারবাহার ইত্যাদি যন্ত্রে। এসব যন্ত্রে তাঁর পারদর্শিতা তাকে এক অনন্য অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিল। একাধিক সংগীত যন্ত্রে তার দক্ষতা এবং বিভিন্ন শাখার সংগীতের প্রতি তার গভীর ভালোবাসা তাকে এক ধরনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেছে।
চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা
দক্ষিণামোহন ঠাকুর শুধুমাত্র কনসার্টে এবং রেডিওতে সংগীত পরিচালনা করেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, তিনি চলচ্চিত্রেও সংগীত পরিচালনার কাজ করেছেন। ১৯৪০ সালে ‘স্বামী স্ত্রী’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তার সংগীত পরিচালনার যাত্রা শুরু হয়। এই ছবির পরিচালনা করেন সতু সেন। এরপর তিনি ১৯৪০ থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত ১৮টি চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন, যার মধ্যে ‘শেষরক্ষা’, ‘নিবেদিতা’, ‘পথের দাবী’, ‘কালো ঘোড়া’, ‘মর্যাদা’, ‘পলাতকা’, ‘প্রহ্লাদ’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
চলচ্চিত্র পঞ্জি
দক্ষিণামোহন ঠাকুরের সংগীত পরিচালনার কিছু গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রের তালিকা নীচে দেওয়া হলো:
বছর | চলচ্চিত্রের নাম |
---|---|
১৯৪০ | স্বামী স্ত্রী |
১৯৪৪ | শেষরক্ষা |
১৯৪৬ | নিবেদিতা |
১৯৪৭ | পথের দাবী |
১৯৪৮ | কালো ঘোড়া |
১৯৪৯ | কার্টুন, রবীন মাস্টার |
১৯৫০ | মর্যাদা |
১৯৫১ | পলাতকা, কুহেলিকা, রাণী ভবানী, আবু হোসেন, কা তব কাস্তা, মহিষাসুর বধ |
১৯৫২ | প্রহ্লাদ, কুহেলিকা, রাণী ভবানী, আবু হোসেন, কা তব কাস্তা, মহিষাসুর বধ |
১৯৫৩ | পথিক, সবুজ পাহাড় |
১৯৫৪ | অমর প্রেম |
সংগীত জীবনে অর্জন এবং সম্মান
দক্ষিণামোহন ঠাকুরের সংগীত পরিচালনায় তার নানা ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র এবং সুরের মাধ্যমে তিনি নিজেকে একটি অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার সংগীতের প্রতি গভীর ভালোবাসা, যন্ত্রের প্রতি তার দক্ষতা, এবং চলচ্চিত্রে তার অসাধারণ সংগীত পরিচালনা তাকে ভারতীয় সংগীতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
দক্ষিণামোহন ঠাকুরের জীবন এবং কাজ কেবল একজন সংগীতজ্ঞ হিসেবে তার অবদানকেই প্রকাশ করে না, বরং সংগীতের প্রতি তার গভীর ভালোবাসা এবং আত্মনিয়োগকে তুলে ধরে। তাঁর সংগীত পরিচালনার শৈলী, যন্ত্রের প্রতি তাঁর দক্ষতা এবং চলচ্চিত্রে সংগীতের প্রয়োগ তাকে এক অনন্য দৃষ্টান্তেরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আজকের দিনে, যেখানে সংগীত শুধুমাত্র শ্রবণযোগ্য বিনোদন হিসেবে পরিচিত, সেখানে দক্ষিণামোহন ঠাকুরের কাজ আমাদের মনে করিয়ে দেয় সংগীতের প্রকৃত উৎকর্ষ এবং তার শক্তি।
আরও দেখুনঃ