দীনেন গুপ্ত

দীনেন গুপ্ত বাংলা চলচ্চিত্র জগতের এক প্রভাবশালী ও বহুমুখী প্রতিভা, যিনি দক্ষ চিত্রগ্রাহক হিসেবেই চলচ্চিত্র জীবন শুরু করে পরবর্তীতে পরিচালক, প্রযোজক ও কাহিনিকার হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাঁর চলচ্চিত্রভিত্তিক যাত্রা ছিল দৃঢ়, চিন্তাশীল ও বহুমাত্রিক, যা বাংলা সিনেমার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত।

 

দীনেন গুপ্ত । বাংলা চলচ্চিত্রের অভিধান

দীনেন গুপ্ত

জন্ম ও প্রাথমিক জীবন:

দীনেন গুপ্তের জন্ম কলকাতায়। তাঁর পিতা হেম গুপ্ত পেশাগতভাবে চলচ্চিত্র ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই চলচ্চিত্র পরিবেশে বেড়ে ওঠা দীনেন শৈল্পিক চেতনার অনুরণনে বড় হন এবং অচিরেই সিনেমার কারিগরি দিকের প্রতি গভীর আগ্রহ গড়ে তোলেন।

 

চিত্রগ্রহণ জীবন:

দীনেন গুপ্ত প্রথমে চিত্রগ্রাহক পঞ্চ চৌধুরীর সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর কিংবদন্তি চিত্রগ্রাহক রামানন্দ সেনগুপ্তের সহকারী হিসেবে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তাঁর চিত্রগ্রাহক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে রাজেন তরফদার পরিচালিত অন্তরীক্ষ’ (১৯৫৭) চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। এর আগে তিনি নরমেধ যজ্ঞ’ (১৯৫৪) ছবিতে রামানন্দ সেনগুপ্তর সহকারী হিসেবে কাজ করেন।

উল্লেখযোগ্য চিত্রগ্রহণকৃত চলচ্চিত্রসমূহ:

  • অযান্ত্রিক (১৯৫৮) – ঋত্বিক ঘটকের মাস্টারপিস
  • বাড়ি থেকে পালিয়ে (১৯৫৯)
  • মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০) – ঋত্বিক ঘটকের কালজয়ী সৃষ্টি
  • হাটে বাজারে (১৯৬৭) – তপন সিংহর সমালোচনাধর্মী সামাজিক চিত্র
  • বৈশাখী মেঘ (১৯৮১) – উৎপল দত্তের রচনাশ্রিত চলচ্চিত্র
  • ঝড় (১৯৮২)
  • পরমা (১৯৮৫) – অপর্ণা সেন পরিচালিত নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির একটি চমৎকার রচনা

চিত্রগ্রাহক হিসেবে দীনেন গুপ্তের কাজ ছিল সূক্ষ্ম, নান্দনিক এবং আবেগঘন মুহূর্তের কৌশলী নির্মাণে দক্ষ।

 

পরিচালক হিসেবে যাত্রা:

দীনেন গুপ্ত পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন বনজ্যোৎস্না’ (১৯৬৯) ছবির মাধ্যমে। তাঁর পরিচালিত ছবিগুলির মধ্যে অনেকগুলোই সাহিত্যনির্ভর, সামাজিক বাস্তবতাভিত্তিক এবং পারিবারিক দ্বন্দ্ব-সংকটকেন্দ্রিক।

উল্লেখযোগ্য পরিচালিত চলচ্চিত্র:

  • নতুন পাতা (১৯৬৯)
  • প্রথম প্রতিশ্রুতি (১৯৭১) – আশাপূর্ণা দেবীর উপন্যাস অবলম্বনে
  • বসন্ত বিলাপ (১৯৭৩) – হাস্যরসাত্মক ও জনপ্রিয় চলচ্চিত্র, নিজেই প্রযোজনা করেন
  • কত ভালোবাসা (১৯৯২) – যার কাহিনিও তিনি নিজে রচনা করেন
  • ঋণমুক্তি (২০০০) – তাঁর শেষ পরিচালিত চলচ্চিত্র

পরিচালনার পাশাপাশি দীনেন গুপ্ত নিজেই অনেক ছবির চিত্রনাট্য কাহিনী রচনা করেন। তিনি মোট ২৮টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন, যার মধ্যে ৭টি ছবির চিত্রনাট্য এবং বেশ কয়েকটির মূল কাহিনী তাঁর নিজের লেখা।

 

চিত্রনাট্য ও কাহিনী রচয়িতা হিসেবে অবদান:

দীনেন গুপ্ত শুধুমাত্র পরিচালক বা চিত্রগ্রাহকই নন, ছিলেন একজন দক্ষ গল্পকার ও চিত্রনাট্যকারও। তাঁর লেখা কাহিনী ও চিত্রনাট্যের ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • প্রক্সি (১৯৭৭)
  • সানাই (১৯৭৭)
  • রজনী (১৯৭৮)
  • প্রিয়জন (১৯৯৯)
  • কত ভালোবাসা (১৯৯২) – চিত্রনাট্য ও কাহিনি উভয়ই তাঁর রচনা

 

পারিবারিক জীবন ও সহযোগিতা:

দীনেন গুপ্তের চলচ্চিত্রজীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী ছিলেন তাঁর স্ত্রী, খ্যাতনামা অভিনেত্রী কাজল গুপ্ত। তাঁর বহু পরিচালিত ও প্রযোজিত চলচ্চিত্রে কাজল গুপ্ত অভিনয় করেছেন, যা তাঁদের শিল্প-জীবনের একটি চমৎকার যুগল নিদর্শন হয়ে আছে।

তিনি নিজ পরিচালিত বেশিরভাগ চলচ্চিত্রে চিত্রগ্রহণের কাজও নিজেই সম্পাদন করতেন—যা তাঁর কারিগরি দক্ষতার পরিচায়ক।

 

নির্বাচিত চলচ্চিত্রপঞ্জি:

নিচে দীনেন গুপ্তর ক্যারিয়ারের বর্ণাঢ্য চলচ্চিত্রপঞ্জি উল্লেখ করা হলো (চিত্রগ্রাহক ও পরিচালক উভয় ভূমিকায়):

১৯৫০-এর দশক:

  • নরমেধ যজ্ঞ (১৯৫৪)
  • অন্তরীক্ষ (১৯৫৭)
  • অযান্ত্রিক, ডাক্তারবাবু, যৌতুক (১৯৫৮)
  • বাড়ি থেকে পালিয়ে, গলি থেকে রাজপথ (১৯৫৯)

১৯৬০-এর দশক:

  • মেঘে ঢাকা তারা, গঙ্গা, উত্তরমেঘ (১৯৬০)
  • সন্ধ্যারাগ, কানামাছি, বিষকন্যা (১৯৬১)
  • শিউলিবাড়ি, অভিসারিকা, বেনারসী (১৯৬২)
  • সপ্তর্ষি, অগ্নিবন্যা, সুভা (১৯৬৪)
  • শেষ তিন দিন, শঙ্খবেলা (১৯৬৬)
  • হাটে বাজারে, আকাশ ছোঁয়া (১৯৬৭)
  • নতুন পাতা, বনজ্যোৎস্না (১৯৬৯) *

১৯৭০-এর দশক:

  • প্রথম প্রতিশ্রুতি (১৯৭১) *
  • বসন্ত বিলাপ, মর্জিনা আবদাল্লা (১৯৭৩) *
  • রাগ অনুরাগ, নিশিমৃগয়া (১৯৭৫) *
  • প্রক্সি, সানাই (১৯৭৭) *
  • রজনী, তিলোত্তমা (১৯৭৮) *

১৯৮০–২০০০:

  • বৈশাখী মেঘ, কলঙ্কিনী (১৯৮১)
  • ঝড় (১৯৮২)
  • পরমা (১৯৮৫)
  • মহামিলন, সরগম, অন্তরঙ্গ (১৯৮৭–৮৮) *
  • কত ভালবাসা (১৯৯২) *
  • প্রিয়জন (১৯৯৯) *
  • ঋণমুক্তি (২০০০) *

*চিহ্নিত ছবিগুলোর পরিচালনাও দীনেন গুপ্ত করেছেন।

 

Google News দীনেন গুপ্ত
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

 

উত্তরাধিকার ও প্রভাব:

দীনেন গুপ্ত ছিলেন নিঃশব্দ অথচ শক্তিশালী এক চলচ্চিত্র নির্মাতা, যিনি কেবল তাঁর কাজের মাধ্যমেই কথা বলতেন। বাংলা চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য, চিত্রগ্রহণ ও নির্মাণশৈলীতে তিনি এক অনন্য ধারা সৃষ্টি করেন। তাঁর চিত্রগ্রহণের দৃষ্টিভঙ্গি, সংবেদনশীলতা ও চরিত্রনির্মাণের গভীরতা আজও চলচ্চিত্র শিক্ষার্থীদের জন্য একটি পাঠ্য বিষয়।

Leave a Comment