বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এমন কিছু নাম আছে, যাদের উপস্থিতি শুধু সিনেমার পর্দায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং এক যুগের সংস্কৃতি, সামাজিক চেতনা ও আবেগের সঙ্গে মিশে গেছে। উত্তমকুমার সেই বিরল শ্রেণির একজন—যিনি শুধু একজন অভিনেতা বা তারকা নন, বরং এক বিশাল সাংস্কৃতিক ঘটনাপ্রবাহের প্রতীক। ১৯৮০ সালের জুলাই মাসে তাঁর অকালপ্রয়াণ বাংলা চলচ্চিত্রকে এক গভীর শূন্যতায় ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু মৃত্যুর চার দশক পরও তাঁর প্রভাব, জনপ্রিয়তা ও আলোচনার ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে, তাঁর স্টারডম ছিল ব্যতিক্রমী এবং ইতিহাসে বিরল।

ব্যক্তিজীবন ও মানবিক সত্তা
উত্তমকুমার, জন্ম আরম্ভিক মধ্যবিত্ত পরিবারে, ছিলেন এক মিশুক, আড্ডাবাজ, দানশীল ও পারিবারিক মানুষ। তিনি মাতৃভক্ত ছিলেন, বন্ধুদের কাছে ছিলেন ‘বড়দা’, ইন্ডাস্ট্রির নতুন শিল্পীদের জন্য ছিলেন অভিভাবক। কিন্তু ব্যক্তিত্বে ছিল এক ধরনের রক্ষণশীলতা ও ঝুঁকি নিতে অনীহা। এই স্বভাব তাঁকে জীবনের নানা ক্ষেত্রে সাফল্য এনে দিলেও চলচ্চিত্র-নির্বাচনের ক্ষেত্রে কখনও কখনও সীমাবদ্ধ করেছে।
তাঁর জীবনের এই মানবিক দিকগুলোকে বাঙালি দর্শক তাঁর জন্ম ও মৃত্যুদিনে বিশেষভাবে স্মরণ করে থাকে। তবে সমালোচকরা মনে করেন, ব্যক্তিজীবনকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে শিল্পীসত্তাকে মূল্যায়ন করলে তাঁর শিল্প-ঐতিহ্যের গভীরতাকে খাটো করা হয়।
অভিনেতা বনাম তারকা
উত্তমকুমার ছিলেন বিরল উদাহরণ, যেখানে ‘তারকা’ ও ‘অভিনেতা’ সত্তা একসঙ্গে এবং সমানভাবে উজ্জ্বল ছিল। ১৯৫৪ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ২০ বছর ধরে তিনি ধারাবাহিকভাবে বছরে অন্তত দুইটি অসাধারণ চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছেন—যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডেও অনন্য।
পৃথিবীর তাবড় অভিনেতারা—যেমন ক্যারি গ্রান্ট, হামফ্রে বোগার্ট, মার্লন ব্রান্ডো বা অ্যালেন দিলোঁ—যেখানে ১০-১৫টি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন, সেখানে উত্তমের সংখ্যাটি দাঁড়ায় অন্তত ৫০-এ, এবং সবগুলোতেই তিনি ছিলেন কেন্দ্রীয় চরিত্রে।

অভিনয়ের ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র্য
উত্তমের ক্যারিয়ারকে সময়ভিত্তিক ভাগ করলে দেখা যায়, তাঁর অভিনয় কখনও সরল রৈখিকভাবে এগোয়নি। রোমান্টিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক—প্রতিটি ধারায় তিনি সমান স্বচ্ছন্দ ছিলেন।
- ১৯৫৫ সালে ‘শাপমোচন’-এর মতো মেলোড্রামার পাশেই ছিল ‘উপহার’ বা ‘হ্রদ’-এর মতো ভিন্নধর্মী ছবি।
- ১৯৫৭ সালের ‘হারানো সুর’ ও ‘ইন্দ্রাণী’-র পাশাপাশি এসেছে ‘বড়দিদি’ ও ‘ডাক্তারবাবু’।
- ১৯৬৪-তে ‘লালপাথর’-এর তেজি নায়ক এবং ‘জতুগৃহ’-এর একাকী বুদ্ধিজীবী—দুটি একেবারে বিপরীত চরিত্রে সমান মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন।
এই বৈচিত্র্যই তাঁকে কেবল জনপ্রিয় নায়ক নয়, একজন সিরিয়াস অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
সত্যজিৎ রায়ের স্বীকৃতি ও ‘নায়ক’
সত্যজিৎ রায় প্রথম থেকেই উত্তমকুমারের তারকা সত্তার বাইরে গিয়ে তাঁর অভিনয়ক্ষমতাকে দেখতে চেয়েছিলেন। ‘নায়ক’ ছবিতে রায় তাঁকে এমন এক চরিত্রে কাস্ট করেছিলেন, যেখানে অভিনেতা হিসেবে তাঁর স্বচ্ছতা ও গভীরতা ফুটে ওঠে। ‘নায়ক’ নিয়ে বহু গল্প প্রচলিত, যার মধ্যে অন্যতম বংশী চন্দ্রগুপ্তের সাথে তাঁর আলাপ—যেখানে বংশী তাঁর অভিনয়কে তুলনা করেছিলেন নিজের নিখুঁত সেট ডিজাইনের রহস্যের সঙ্গে।

স্টারডমের আশীর্বাদ ও অভিশাপ
উত্তমকুমারের স্টারডম বাংলা চলচ্চিত্রে বিশাল জনপ্রিয়তা ও আর্থিক সাফল্য এনেছিল। কিন্তু এই সাফল্যের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল একটি বিপজ্জনক দিক—ইন্ডাস্ট্রির অতিরিক্ত নির্ভরতা। সত্তরের দশকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, হিন্দি ছবির প্রতিযোগিতা, আর্থিক সংকট—সব মিলিয়ে বাংলা চলচ্চিত্র যখন টালমাটাল, তখন প্রায় একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন উত্তম।
এই চাপ অনেক সময় তাঁকে দুর্বল চিত্রনাট্যেও অভিনয় করতে বাধ্য করেছে, যাতে ইন্ডাস্ট্রি টিকে থাকে। এর ফলে শেষ জীবনের অনেক ছবি মানের দিক থেকে নিম্নমানের হয়ে যায়।
সারপ্লাস ভ্যালু: জাতীয় সীমানা পেরোনো তারকা
বাংলা সিনেমার সীমার বাইরে উত্তমকুমারের জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছিল হিন্দি ভাষার দর্শকের কাছেও। এই অতিরিক্ত জনপ্রিয়তাকেই বলা যায় তাঁর সারপ্লাস ভ্যালু—যা বাংলা চলচ্চিত্রকে দেশীয় সীমানা ছাড়িয়ে জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। এই ভ্যালুই প্রমাণ করে, কেন তাঁর মৃত্যু বাংলা সিনেমাকে শুধু দরিদ্র করেনি, একপ্রকার নিঃস্ব করে দিয়েছে।

মৃত্যুর প্রভাব ও উত্তরাধিকার
১৯৮০ সালের জুলাই মাসে তাঁর হঠাৎ মৃত্যু বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য এক সাংস্কৃতিক শোকাবহ মুহূর্ত ছিল। ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই মনে করেন, উত্তম-পরবর্তী বাংলা সিনেমা ধীরে ধীরে গতি হারিয়েছে। তাঁর মৃত্যুর পর বাংলা চলচ্চিত্রের একটি যুগ শেষ হয়ে গিয়েছিল।
‘নায়ক’ বা ‘চিড়িয়াখানা’-এর মতো ছবিতে সত্যজিৎ রায় পোস্টারে চরিত্রের নামের চেয়ে অভিনেতার নামকে বড় করে রেখেছিলেন—যা তাঁর উত্তরাধিকারের প্রতীক। এই উত্তরাধিকার কেবল সিনেমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং বাঙালির সাংস্কৃতিক স্মৃতির গভীরে প্রোথিত।
চিরন্তন নায়ক
হয়তো একদিন তাঁর সব ছবিই প্রযুক্তিগত দিক থেকে পুরনো হয়ে যাবে, কিন্তু উত্তমকুমার নামটি থাকবে চিরজীবী। তাঁর স্টারডম একাধারে কালজয়ী, আবার এক শিল্প-যুগের সমাপ্তিরও প্রতীক—এক আশ্চর্য, মর্মান্তিক এবং অদ্বিতীয় স্টারডম।