অভিনয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোর মধ্যে একটি হলো মনোলগ বা স্বগতোক্তি। একটি মনোলগে অভিনেতা সম্পূর্ণভাবে একা মঞ্চে বা ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে চরিত্রের আবেগ, মানসিক অবস্থা ও চিন্তাকে প্রকাশ করেন। এটি একজন অভিনেতার কণ্ঠ, ভঙ্গি, আবেগ এবং চরিত্র বোঝার ক্ষমতার চূড়ান্ত পরীক্ষা। তাই বিশ্বজুড়ে থিয়েটার স্কুল, ড্রামা ওয়ার্কশপ বা চলচ্চিত্র শিক্ষায় মনোলগ অনুশীলনকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়।
এই নিবন্ধে আমরা আলোচনা করব মনোলগ অনুশীলনের জন্য ১০টি শক্তিশালী স্ক্রিপ্ট—যেগুলো বাংলা ও আন্তর্জাতিক নাটক, চলচ্চিত্র ও সাহিত্যের মধ্য থেকে বেছে নেওয়া। প্রতিটি মনোলগ আলাদা ধরনের চ্যালেঞ্জ দেয়, যা একজন অভিনেতাকে সমৃদ্ধ করে তোলে।

১. হ্যামলেট – উইলিয়াম শেকসপিয়র (“To be or not to be”)
ধরন: ক্লাসিক ট্র্যাজেডি
চ্যালেঞ্জ: গভীর মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ও দার্শনিক ভাবনা
শেকসপিয়রের হ্যামলেট–এর এই স্বগতোক্তি ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী মনোলগ। এখানে হ্যামলেট নিজের ভেতরে প্রশ্ন তোলে— “বেঁচে থাকা ভালো, না মৃত্যুকে বেছে নেওয়া ভালো?” এই দার্শনিক বিতর্কে মানুষের অস্তিত্বের অর্থ, যন্ত্রণার ভার, আর মৃত্যুর অজানা ভয় একসঙ্গে মিশে গেছে।
অভিনয়ের মূল দিক
- দার্শনিক গভীরতা ফুটিয়ে তোলা:
- উদাহরণ: যখন হ্যামলেট বলে “To die, to sleep—no more”, অভিনেতা একটু থেমে, শান্ত স্বরে যেন ঘুমের শান্তি অনুভব করছে। এতে দর্শক মৃত্যুকে এক ধরণের আরাম হিসেবে উপলব্ধি করে।
- অভ্যন্তরীণ বেদনা:
- উদাহরণ: “The slings and arrows of outrageous fortune” লাইনে অভিনেতা শরীর খানিকটা কুঁকড়ে, কণ্ঠে যন্ত্রণার সুর আনতে পারে। যেন জীবনের অবিচারের বোঝা কাঁধে বয়ে যাচ্ছে।
- দ্বিধা ও বিভ্রান্তি প্রকাশ:
- উদাহরণ: “To be, or not to be” উচ্চারণ করার সময় বারবার থেমে থেমে বলা যেতে পারে— যেন হ্যামলেট উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। দর্শক বুঝতে পারে, চরিত্রটি আসলে এক অনন্ত দোলাচলে আটকে গেছে।
- আবেগের পরিবর্তন:
- উদাহরণ: শুরুতে মনোলগটি ধীর ও শান্তভাবে বলা যেতে পারে, কিন্তু যখন আসে “Thus conscience does make cowards of us all”, তখন কণ্ঠে হতাশার ঝাঁঝ বাড়ানো যেতে পারে— যেন নিজের ভীরুতায় সে নিজেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে।

২. ওথেলো – উইলিয়াম শেকসপিয়র (“It is the cause, it is the cause…”)
ধরন: ট্র্যাজিক রোম্যান্স
চ্যালেঞ্জ: আবেগীয় অস্থিরতা ও ভালোবাসার সঙ্গে সন্দেহের সংঘাত
ওথেলো যখন ডেসডিমোনাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন তাঁর অন্তর্দ্বন্দ্ব মর্মান্তিকভাবে প্রকাশিত হয়। তিনি একদিকে ভালোবাসেন, অন্যদিকে বিশ্বাস করেন ডেসডিমোনা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ভালোবাসা, ঈর্ষা, সন্দেহ এবং নৈতিকতার টানাপোড়েন একত্রে মঞ্চে উপস্থাপন করতে হয়।
অভিনয়ের মূল দিক ও উদাহরণ
- দ্বন্দ্বের সূচনা (নৈতিকতার সাথে প্রেমের সংঘর্ষ):
- সংলাপ: “It is the cause, it is the cause, my soul.”
- উদাহরণ: অভিনেতা এই লাইন ধীরে, থেমে থেমে বলবে। যেন নিজের হৃদয়কে বোঝাচ্ছে— “আমি যা করতে যাচ্ছি, সেটা ব্যক্তিগত প্রতিশোধ নয়, একটি উচ্চতর কারণে।” চোখে অশ্রু ভেসে ওঠার ইঙ্গিত থাকতে পারে, যাতে বোঝা যায় সে এখনও ডেসডিমোনাকে ভালোবাসে।
- ভালোবাসার স্বীকারোক্তি (যতটা ভালোবাসে, ততটাই কষ্ট):
- সংলাপ: “Yet she must die, else she’ll betray more men.”
- উদাহরণ: এই লাইন বলার সময় ওথেলোর কণ্ঠ ভারী হবে। অভিনেতা যেন বুকের ভেতরে আগুন চেপে রেখেছে এমন অনুভূতি দেখাবে। হাত কাঁপতে পারে, যেন নিজের সিদ্ধান্তের ভারেই দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
- ডেসডিমোনার সৌন্দর্যের প্রতি মুগ্ধতা:
- সংলাপ: “Yet I’ll not shed her blood, nor scar that whiter skin of hers than snow…”
- উদাহরণ: অভিনেতা এখানে কণ্ঠে কোমলতা আনবে, চোখে বিস্ময় নিয়ে ডেসডিমোনার দিকে তাকাবে। যেন তার সৌন্দর্য ও নির্দোষতার প্রতি এক চূড়ান্ত টান এখনও তাকে থামিয়ে দিতে চাইছে।
- অন্তর্দ্বন্দ্বের চূড়া:
- সংলাপ: “When I have plucked thy rose, I cannot give it vital growth again, it needs must wither.”
- উদাহরণ: এখানে অভিনেতা কণ্ঠ নামিয়ে আনবে, যেন ফুল ছিঁড়ে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে তার হৃদয়ও ভেঙে যাচ্ছে। হাতে সত্যিই একটি কল্পিত গোলাপ ধরা থাকতে পারে, যেটি ছিঁড়ে ফেলার অভিনয় করতে গিয়ে মুহূর্তে নীরব হয়ে যাবে।
- চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত:
- সংলাপ: “Be thus when thou art dead, and I will kill thee, and love thee after.”
- উদাহরণ: অভিনেতা ধীরে ধীরে এই লাইন বলবে, যেন মৃত্যুর মধ্য দিয়েই ডেসডিমোনার প্রতি তার ভালোবাসা বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। চোখে জল, কণ্ঠে দৃঢ়তা এবং শরীরে কাঁপুনি—সব মিলিয়ে এক গভীর ট্র্যাজেডি তৈরি হয়।
এখানে অভিনেতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো—
- ওথেলোর ভেতরের ভালোবাসা ও হিংসার দ্বন্দ্ব দর্শকদের কাছে একসঙ্গে পৌঁছে দেওয়া।
- শুধু রাগ বা সন্দেহ নয়, বরং হত্যার মুহূর্তেও তার ভালোবাসার গভীরতা যেন স্পষ্ট হয়।
এ কারণে এই মনোলগকে অনেক থিয়েটার শিক্ষক অভিনয়ের জন্য “অ্যাবসোলিউট টেস্ট অব ইমোশনাল রেঞ্জ” বলে থাকেন।

৩. চারুলতা – সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র (রবীন্দ্রনাথের নষ্টনীড় অবলম্বনে)
ধরন: মানসিক একাকিত্ব
চ্যালেঞ্জ: সূক্ষ্ম আবেগের প্রকাশ
সত্যজিৎ রায়ের ক্যামেরায় চারুলতার চরিত্র হয়ে ওঠে এক নিঃশব্দ মনোলগ—যেখানে এক নারীর ভেতরে লুকিয়ে থাকা নিঃসঙ্গতা, দমবন্ধ পরিস্থিতি, ভালোবাসার তৃষ্ণা আর স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ফুটে ওঠে।
অভিনেত্রীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো সংলাপ ছাড়াই দর্শকের কাছে চরিত্রের গভীর অনুভূতি পৌঁছে দেওয়া। চোখ, ঠোঁটের সামান্য নড়াচড়া, জানালার দিকে তাকানো বা পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরের জগৎ দেখা—এসবই হয়ে ওঠে তাঁর “মনোলগ”।
অভিনয়ের মূল দিক ও উদাহরণ
- জানালার পাশে একাকিত্ব:
- দৃশ্য: চারুলতা দোলনায় বা জানালার ধারে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
- উদাহরণ: অভিনেত্রী ধীরে ধীরে মাথা ঘোরাবে, বাইরের গলির মানুষের চলাফেরা লক্ষ্য করবে। চোখে থাকবে হালকা বিষণ্ণতা, ঠোঁটে মৃদু নিঃশ্বাস। যেন চারপাশে অনেক মানুষ আছে, অথচ সে সম্পূর্ণ একা।
- অভ্যন্তরীণ বেদনার আভাস:
- দৃশ্য: জানালা দিয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে, বই হাতে রেখেও পড়ছে না।
- উদাহরণ: বইয়ের পাতায় চোখ রাখবে, কিন্তু চোখের দৃষ্টি বারবার সরে যাবে বাইরে। যেন তার মন অন্য কোথাও উড়ে যাচ্ছে। এখানে হালকা আঙুলের কম্পন বা বই বন্ধ করার ছোট্ট অঙ্গভঙ্গিই বেদনার সংকেত দেবে।
- অভিলাষ ও আকাঙ্ক্ষা:
- দৃশ্য: অমলের সঙ্গে আলাপ বা সাহিত্যচর্চার মুহূর্তে তাঁর চোখে নতুন দীপ্তি আসে।
- উদাহরণ: চোখে হঠাৎ ঝিলিক, কণ্ঠে বা ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটে উঠবে। তবে সেটি যেন সংযত—যেন অন্তরের গভীর আনন্দ অন্যদের চোখে ধরা না পড়ে।
- দমবন্ধ পরিবেশ থেকে মুক্তির তৃষ্ণা:
- দৃশ্য: বাইরের মানুষদের জীবন্ত চলাফেরা দেখা আর নিজের একঘেয়ে ঘরোয়া জীবনের তুলনা।
- উদাহরণ: জানালার গ্রিল বা পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকাবে। হাত দিয়ে হালকা করে গ্রিল ছোঁয়া বা পর্দা সরানোর ভঙ্গি যেন বোঝায়—সে মুক্তি চাইছে, কিন্তু শৃঙ্খল কাটাতে পারছে না।
- নীরবতার শক্তি:
- চারুলতার সবচেয়ে বড় মনোলগ আসলে তাঁর নীরবতা।
- উদাহরণ: চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলা, মুখে চাপা হাসি কিন্তু চোখে বিষণ্ণতা—এসবই দর্শকের কাছে হাজার সংলাপের চেয়েও গভীর হয়ে ওঠে।
একজন অভিনেত্রীর জন্য এই অংশের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো—
- কম দিয়ে বেশি বলা।
- সংলাপ ছাড়াই দেহভঙ্গি, চোখ, শ্বাস-প্রশ্বাস ও নীরবতার ভেতরে পুরো চরিত্রের জগত তুলে ধরা।
এ কারণেই চারুলতার চরিত্র বাংলা সিনেমার ইতিহাসে এক “silent monologue of emotions” হিসেবে বিবেচিত।

৪. নবান্ন – বিজন ভট্টাচার্য
ধরন: গণনাট্য / রাজনৈতিক থিয়েটার
চ্যালেঞ্জ: বাস্তবধর্মিতা ও সামাজিক প্রতিবাদ
১৯৪৪ সালের দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে নবান্ন নাটক রচিত। এখানে কেবল ব্যক্তিগত বেদনা নয়, সমগ্র সমাজের ক্ষুধা, বঞ্চনা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠে এসেছে। নাটকের সংলাপগুলোতে সাধারণ মানুষের ক্ষুধার্ত কণ্ঠস্বর প্রতিফলিত হয়। একজন অভিনেতার দায়িত্ব হলো সেই আর্তনাদকে নিজের শরীর, দৃষ্টি ও কণ্ঠ দিয়ে জীবন্ত করে তোলা।
অভিনয়ের মূল দিক ও উদাহরণ
- ক্ষুধার কষ্ট (শরীরী প্রকাশ):
- সংলাপ (উদাহরণ): “ভাত দে! ভাত দে!”
- অভিনয়: অভিনেতা শরীর কুঁজো করে, কণ্ঠ ভাঙা সুরে উচ্চারণ করবে। যেন ক্ষুধায় নিঃশেষ হয়ে পড়ছে। হাত বাড়ানো, শরীর কাঁপা, হাঁপ ধরা শ্বাস—এসব অঙ্গভঙ্গি ক্ষুধার তীব্রতা বোঝাবে।
- বঞ্চনার বেদনা:
- সংলাপ (উদাহরণ): “আমাদের ঘরে ভাত নেই, শিশুর মুখে দুধ নেই।”
- অভিনয়: চোখে অশ্রুর ছাপ, কণ্ঠে চাপা ক্রন্দন। সংলাপ বলতে বলতে মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে বসে পড়া—যেন সম্পূর্ণ অসহায়।
- সমষ্টিগত আর্তনাদ:
- দৃশ্য: একসঙ্গে কয়েকজন চরিত্র ক্ষুধার্ত মানুষের মিছিল বা প্রতিবাদ করছে।
- অভিনয়: অভিনেতা যেন নিজের সংলাপ শুধু ব্যক্তিগত নয়, সমষ্টিগত কণ্ঠস্বর মনে করে বলে। একসঙ্গে উচ্চারণের সময় কণ্ঠে ক্রোধ, শরীরে প্রতিবাদের ভঙ্গি (হাত উঁচু করা, মুষ্টিবদ্ধ করা) রাখতে হবে।
- প্রতিবাদের শক্তি:
- সংলাপ (উদাহরণ): “আর না! আমরা চুপ করে থাকব না।”
- অভিনয়: এখানে কণ্ঠ হঠাৎ তীক্ষ্ণ ও দৃঢ় হবে। চোখে আগুনের ঝলক থাকবে। শরীর সোজা হয়ে দাঁড়াবে, যেন ক্ষুধার্ত মানুষ প্রতিবাদে উঠে দাঁড়াচ্ছে।
- বাস্তবধর্মিতার আবশ্যকতা:
- নবান্ন–এর অভিনয় কৃত্রিম বা অতিরঞ্জিত হওয়া উচিত নয়। ক্ষুধার দৃশ্য ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে অভিনয়কে এতটাই বাস্তব করতে হবে যে দর্শক মনে করবে—এটি শুধু নাটক নয়, তাদের চোখের সামনে সত্যিই ঘটছে।
এই মনোলগ/সংলাপ অনুশীলনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো—
- অভিনেতা নিজের মধ্যে ক্ষুধা ও বঞ্চনার অনুভূতি বাস্তব অভিজ্ঞতার মতো গ্রহণ করবে,
- এবং তা নিজের কণ্ঠ, দেহভঙ্গি ও দৃষ্টির ভেতর দিয়ে প্রকাশ করবে।
এই কারণেই নবান্ন কেবল একটি নাটক নয়, বরং গণনাট্যের ইতিহাসে এক সামাজিক নথি (social document) হয়ে উঠেছে।

৫. অঙ্গার – উৎপল দত্ত
ধরন: রাজনৈতিক নাটক
চ্যালেঞ্জ: প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ও আবেগের বিস্ফোরণ
অঙ্গার নাটকের কেন্দ্রে রয়েছে শ্রমিক শ্রেণির দুর্দশা ও শোষণের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ। শ্রমিক চরিত্র যখন নিজের দুঃসহ জীবনের কথা বলে, তখন তা শুধু ব্যক্তিগত বেদনা নয়—পুরো সমাজের ক্ষোভ ও প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে ওঠে।
অভিনয়ের মূল দিক ও উদাহরণ
- প্রথম বিস্ফোরণ (ক্ষোভের উন্মুক্ত প্রকাশ):
- সংলাপ (উদাহরণ): “আমাদের রক্ত চুষে, ঘাম চুষে কারা দিন দিন মোটা হচ্ছে?”
- অভিনয়: অভিনেতা বুক চিতিয়ে দাঁড়াবে, কণ্ঠ গর্জন করবে। যেন প্রশ্ন নয়, অভিযোগ। চোখে জ্বলন্ত দৃষ্টি, হাতে মুষ্টিবদ্ধ ভঙ্গি থাকবে।
- শ্রমিক জীবনের দুঃসহতা:
- সংলাপ (উদাহরণ): “আমাদের ঘরে ভাত নেই, শিশুর মুখে দুধ নেই, অথচ মালিকের প্রাসাদে আলো ঝলমল।”
- অভিনয়: কণ্ঠে যন্ত্রণা ও ক্ষোভ একসঙ্গে। সংলাপের প্রথম অংশ (ক্ষুধা, বঞ্চনা) ধীরে, ভাঙা কণ্ঠে বলা যেতে পারে। তারপর হঠাৎ শক্তি বাড়িয়ে “মালিকের প্রাসাদে আলো ঝলমল”—এই অংশে বিদ্রোহী তেজ দেখাতে হবে।
- সমষ্টিগত শক্তির ইঙ্গিত:
- সংলাপ (উদাহরণ): “আমরা এক হলে, আমাদের গলা আর কেউ চেপে ধরতে পারবে না!”
- অভিনয়: অভিনেতা হাত উঁচু করে দর্শকদের দিকেই ইঙ্গিত করবে। যেন সমগ্র শ্রমিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানাচ্ছে। কণ্ঠে দৃঢ়তা, শরীরে উত্তেজনার কম্পন থাকবে।
- আবেগের বিস্ফোরণ:
- সংলাপ (উদাহরণ): “আমরা আর চুপ করে থাকব না! শোষণ ভেঙে ফেলব!”
- অভিনয়: শেষ লাইনগুলো প্রায় চিৎকার করে বলা উচিত। যেন ভেতরে জমে থাকা আগুন হঠাৎ বিস্ফোরিত হচ্ছে। শরীর সামনে ঝুঁকে আসবে, চোখ জ্বলবে, গলা যেন মঞ্চ কাঁপিয়ে তুলবে।
- ভয়েস প্রজেকশন ও শারীরিক ভাষা:
- অঙ্গার–এর মনোলগে কণ্ঠের জোর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অভিনেতাকে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে শক্তিশালী প্রজেকশন ব্যবহার করতে হবে।
- শরীরের ভাষা হবে তীক্ষ্ণ, দৃঢ় এবং প্রাণবন্ত। হাঁটা, দাঁড়ানো, হাত নড়াচড়া—সবকিছুতেই যেন বিদ্রোহের আগুন প্রতিফলিত হয়।
অভিনয়ের জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো—
- শ্রমিক চরিত্রকে বাস্তব করে তোলা,
- কণ্ঠে অভিযোগ থেকে প্রতিবাদ, আর প্রতিবাদ থেকে বিপ্লবী ডাক–এর ধারাবাহিক পরিবর্তন দেখানো।
এই কারণেই অঙ্গার–এর মনোলগকে অনেক নাট্যশিক্ষক বলেন “দ্য থিয়েটার অব রেজিস্ট্যান্স”–এর জীবন্ত অনুশীলন।

৬. এন্টিগোন – সফোক্লিস
ধরন: গ্রিক ট্র্যাজেডি
চ্যালেঞ্জ: নৈতিকতা বনাম রাষ্ট্রক্ষমতার দ্বন্দ্ব
সফোক্লিসের এন্টিগোন–এ মূল দ্বন্দ্ব হলো রাষ্ট্রীয় আইন বনাম ব্যক্তিগত নৈতিকতা। রাজা ক্রেয়ন ঘোষণা দেন যে, রাষ্ট্রদ্রোহী ভাই পলিনিসিসকে সমাধি দেওয়া যাবে না। কিন্তু এন্টিগোন নিজের নৈতিক বিশ্বাস ও পারিবারিক কর্তব্যের তাগিদে সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ভাইয়ের অন্ত্যেষ্টি সম্পন্ন করে। তাঁর বক্তব্যে প্রকাশ পায় সাহস, দৃঢ়তা ও একইসঙ্গে নিজের ট্র্যাজিক পরিণতির প্রতি মেনে নেওয়ার মনোভাব।
অভিনয়ের মূল দিক ও উদাহরণ
- নৈতিক দৃঢ়তার ঘোষণা:
- সংলাপ (উদাহরণ): “I will bury him; well for me to die in doing so.”
- অভিনয়: অভিনেত্রী কণ্ঠ দৃঢ় ও পরিষ্কারভাবে বলবে। শরীর সোজা, মাথা উঁচু—যেন অন্যায় রাষ্ট্রীয় আদেশকে সে ভয় পাচ্ছে না। চোখে সাহসী ঝলক থাকবে।
- রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতি প্রতিবাদ:
- সংলাপ (উদাহরণ): “I owe a longer allegiance to the dead than to the living.”
- অভিনয়: এখানে কণ্ঠে বিদ্রোহের সুর থাকবে। হাত সামান্য উপরে তুলে যেন অদৃশ্য ক্রেয়নকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। তবে প্রতিবাদে অহংকার নয়, বরং দৃঢ় নৈতিক আস্থা থাকবে।
- ভালোবাসা ও কর্তব্যের টান:
- সংলাপ (উদাহরণ): “He is my brother, and—deny it as thou wilt—thy brother too.”
- অভিনয়: কণ্ঠে আবেগ বাড়বে, চোখে অশ্রুর ঝিলিক থাকবে। অভিনেত্রী যেন দর্শকের হৃদয়ে পৌঁছে দিতে পারে—এটি কেবল একটি রাজনৈতিক কাজ নয়, বরং ভালোবাসা ও রক্তের টান থেকে আসা একটি কর্তব্য।
- ট্র্যাজিক পরিণতির গ্রহণযোগ্যতা:
- সংলাপ (উদাহরণ): “If I die before my time, I count that a gain.”
- অভিনয়: অভিনেত্রী কণ্ঠ নিচু করবে, শান্ত ও স্থির ভঙ্গিতে বলবে। যেন মৃত্যুকেও সে সাহসের সঙ্গে গ্রহণ করছে। মুখে প্রশান্তি, শরীর শিথিল, চোখে অবিচল শান্তি—এটি এক অদম্য চরিত্রের প্রতিচ্ছবি।
- অভ্যন্তরীণ শক্তির প্রকাশ:
- এন্টিগোনের মনোলগ শুধু শব্দ নয়, বরং শরীরী ভাষার মধ্যেও শক্তি চাই।
- অভিনেত্রীকে দৃশ্যত এমনভাবে দাঁড়াতে হবে যাতে দর্শক মনে করে—সে একা হলেও পুরো রাষ্ট্রক্ষমতার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
অভিনয়ের জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো—
- এন্টিগোন চরিত্রে শুধু প্রতিবাদ নয়, বরং নৈতিক দৃঢ়তা, পারিবারিক ভালোবাসা ও মৃত্যুকে বরণ করার প্রস্তুতি–এই তিনটি স্তর সমানভাবে ফুটিয়ে তুলতে হবে।
এই কারণেই এন্টিগোনের এই মনোলগকে বলা হয় “the eternal voice of conscience against tyranny”—যা আজও মঞ্চে দর্শককে নাড়া দেয়।

৭. মেথড অ্যাক্টিং অনুশীলন – কাল্পনিক চরিত্র (ব্যক্তিগত স্মৃতি)
ধরন: সেলফ-মেড স্ক্রিপ্ট
চ্যালেঞ্জ: ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও আবেগীয় পুনর্নির্মাণ
মেথড অ্যাক্টিং-এর অন্যতম কৌশল হলো নিজের জীবনের কোনো স্মৃতি বা অভিজ্ঞতাকে নাটকীয়ভাবে পুনর্নির্মাণ করা। এটি অভিনেতার জন্য এক ধরণের inner monologue অনুশীলন, যেখানে বাস্তব জীবনের আবেগকে মঞ্চের আবেগে রূপান্তর করা হয়। যেমন—প্রথম বড় হার, প্রিয়জনকে হারানো, স্কুলে ব্যর্থতা, কোনো অসম্পূর্ণ স্বপ্ন ইত্যাদি।
অভিনয়ের মূল দিক ও উদাহরণ
- স্মৃতি নির্বাচন:
- উদাহরণ: অভিনেতা তার জীবনের প্রথম বড় ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা বেছে নিল। যেমন—একটি প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়া।
- অভিনয়: সে মুহূর্তটিকে মনে করার সময় চোখ কিছুটা নিচু থাকবে, শরীর ভাঙা ভঙ্গিতে থাকবে, যেন পরাজয়ের ভার এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে।
- অভ্যন্তরীণ আবেগ খোঁজা:
- উদাহরণ: প্রিয়জনকে হারানোর স্মৃতি বেছে নিলে, অভিনেতা চোখ বন্ধ করে সেই মুহূর্তে ফিরে যাবে।
- অভিনয়: দীর্ঘশ্বাস ফেলবে, কণ্ঠ ভেঙে আসবে, হয়তো নিঃশব্দে চোখে জল চলে আসবে। দর্শক বুঝবে—এই অনুভূতি সত্যিকার।
- আবেগীয় পুনর্নির্মাণ:
- উদাহরণ: কোনো অসম্পূর্ণ স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে অভিনেতা কণ্ঠে হতাশা ও ক্ষোভ মিশিয়ে বলবে— “আমি এত চেষ্টা করেছিলাম, তবুও কেন পারলাম না?”
- অভিনয়: কণ্ঠ কখনো ধীর, কখনো হঠাৎ তীব্র হয়ে উঠবে। শরীরের ভঙ্গি বদলাবে, হাত কখনো মুখে যাবে, কখনো আকাশের দিকে উঠবে।
- ব্যক্তিগত থেকে সার্বজনীন রূপান্তর:
- অভিনয়ের বড় কাজ হলো ব্যক্তিগত স্মৃতিকে এমনভাবে বলা যাতে দর্শক নিজেদের অভিজ্ঞতা খুঁজে পায়।
- উদাহরণ: ব্যক্তিগত ব্যর্থতার গল্প বলতে গিয়ে অভিনেতা থেমে গিয়ে বলবে— “আমরা সবাই কি জীবনে এমন হার মানিনি কখনো?”
- এতে দর্শকের সঙ্গে সরাসরি এক আবেগীয় সংযোগ তৈরি হয়।
- নীরবতার ব্যবহার:
- মেথড অ্যাক্টিং–এ নীরবতাও এক ধরণের সংলাপ।
- উদাহরণ: প্রিয়জনকে হারানোর কথা বলতে বলতে অভিনেতা হঠাৎ থেমে যাবে, চোখে শূন্য দৃষ্টি রেখে এক মিনিট নীরব থাকবে। এই নীরবতা দর্শকের হৃদয়ে হাজারো কথা বলে যাবে।
এই অনুশীলনের মূল শিক্ষা হলো—
- নিজের ব্যক্তিগত আবেগকে ভয় না করে গ্রহণ করা,
- সেটিকে মঞ্চে এমনভাবে প্রকাশ করা যাতে তা বাস্তব ও সত্যিকারের মনে হয়।
এই কারণেই অনেক শিক্ষক বলেন, মেথড অ্যাক্টিং-এর এই ধরণের মনোলগ আসলে “truth in performance” এর অনুশীলন।

৮. গোধূলি আলাপ – মৃণাল সেনের নাট্যধারা থেকে
ধরন: বাস্তবধর্মী / সমকালীন
চ্যালেঞ্জ: সামাজিক সংকটের বাস্তব ভাষা
গোধূলি আলাপ–এর একটি অংশে এক সাধারণ মানুষ নিজের জীবনের কষ্ট, ভাঙা স্বপ্ন ও অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কথা বলে। এখানে নেই কোনো উচ্চকিত সংলাপ, নেই কাব্যিক শব্দ। বরং খুব সাধারণ দৈনন্দিন ভাষায় ফুটে ওঠে জীবনের তীব্র বেদনা।
অভিনয়ের মূল দিক ও উদাহরণ
- সরল ভাষার ব্যবহার:
- সংলাপ (উদাহরণ): “সকাল থেকে খেটে খেয়ে সন্ধ্যার পরও ভাত জোটে না। ছেলে স্কুলে যেতে পারে না, বই কেনার টাকা নেই।”
- অভিনয়: সংলাপগুলো যেন নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা মনে করে বলা হয়। কণ্ঠে যেন ক্লান্তি থাকে, গলার স্বর হালকা কর্কশ। শরীর নুয়ে থাকবে, যেন সত্যিই সারাদিন খেটে এসেছে।
- অস্থিরতা ও বেদনার প্রকাশ:
- সংলাপ (উদাহরণ): “ভাবতাম একদিন নিজের ঘর হবে, এখন মনে হয় স্বপ্নটা শুধু মিথ্যে।”
- অভিনয়: ধীরে বলা, চোখে শূন্য দৃষ্টি। মুখে হালকা তিক্ত হাসি, যা আসলে হতাশার প্রতীক। থেমে থেমে বললে বাস্তব অনুভূতি আরও তীব্র হবে।
- অর্থনৈতিক চাপের বাস্তবতা:
- সংলাপ (উদাহরণ): “দোকানে বাকি চাইতে চাইতে লজ্জায় মাথা তুলতে পারি না।”
- অভিনয়: হাত কাঁপতে কাঁপতে কণ্ঠ নিচু করে বলা। যেন সত্যিই কাউকে অনুরোধ করতে হচ্ছে। চোখে লজ্জার ছাপ রাখতে হবে।
- সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর:
- সংলাপ (উদাহরণ): “আমরা কি মানুষ নই? আমাদের কথা কেউ শুনবে না?”
- অভিনয়: প্রথম অংশ ধীরে বলা, তারপর হঠাৎ কণ্ঠে চাপা প্রতিবাদ। শরীর সামনের দিকে ঝুঁকবে, চোখে তীব্র প্রশ্নবোধক দৃষ্টি থাকবে।
- স্বাভাবিকতার আবশ্যকতা:
- এখানে অতিরঞ্জন করলে নাটকটি কৃত্রিম হয়ে যাবে।
- অভিনয়: সংলাপগুলো যেন রাস্তায় বা চায়ের দোকানে একজন সাধারণ মানুষ কথা বলছে—এমন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলা হয়। মাঝে মাঝে থেমে যাওয়া, নিঃশ্বাসের শব্দ ব্যবহার করাও বাস্তবতা বাড়ায়।
এই অনুশীলনের মূল শিক্ষা হলো—
- সংলাপ মুখস্থ করা নয়, বরং যেন নিজের জীবন থেকে আসছে এমন অনুভূতি নিয়ে বলা।
- কৃত্রিম আবেগ বা নাটকীয় ভঙ্গি এড়িয়ে গিয়ে স্বাভাবিকতার ভেতর দিয়ে গভীর সত্য প্রকাশ করা।
এই কারণেই গোধূলি আলাপ–এর মনোলগকে বলা হয় “the theatre of lived reality”—যেখানে দর্শক মনে করে, সে নাটক নয়, বরং নিজের প্রতিবেশীর গল্প শুনছে।

৯. এন্ডগেম – স্যামুয়েল বেকেট
ধরন: অ্যাবসার্ড থিয়েটার
চ্যালেঞ্জ: নিঃসঙ্গতা ও অস্তিত্ববাদ
বেকেটের Endgame–এ চরিত্রগুলো এমন এক জগতে বসবাস করে, যেখানে সময় থেমে আছে, সম্পর্কগুলো ফাঁপা, আর জীবনের অর্থ নিয়ে এক অন্তহীন প্রশ্ন জাগে। হ্যাম বা ক্লভ যখন দীর্ঘ মনোলগ বলে, সেটি প্রায় ভাঙা ভাঙা বাক্যে, পুনরাবৃত্তি আর অদ্ভুত বিরতিতে ভরা থাকে। দর্শকের কাছে এর ভেতরকার শূন্যতা সবচেয়ে বড় শক্তি।
অভিনয়ের মূল দিক ও উদাহরণ
- ভাঙা ভাঙা সংলাপ:
- সংলাপ (উদাহরণ): “Finished, it’s finished, nearly finished, it must be nearly finished.”
- অভিনয়: অভিনেতা একই শব্দ বারবার ভিন্নভাবে বলবে—একবার হতাশ ভঙ্গিতে, একবার রাগে, একবার সম্পূর্ণ নিস্তেজভাবে। যেন কথার পুনরাবৃত্তিই তার অন্তরের ভাঙন প্রকাশ করছে।
- শরীরী শূন্যতা:
- উদাহরণ: চরিত্র হ্যাম চেয়ারে বসা, নড়াচড়া করতে অক্ষম।
- অভিনয়: অভিনেতা শরীরকে ভারী, ক্লান্ত ভঙ্গিতে রাখবে। মাথা সামান্য ঝুঁকানো, হাত ঝুলে পড়া। সংলাপ বলার সময় শরীর প্রায় নিষ্ক্রিয় থাকবে—যেন প্রাণশক্তি নিঃশেষ।
- অস্তিত্ববাদী দ্বন্দ্ব:
- সংলাপ (উদাহরণ): “Nothing is funnier than unhappiness.”
- অভিনয়: অভিনেতা হালকা হাসবে, কিন্তু চোখ থাকবে শূন্য। হাসি ও শূন্যতার এই দ্বন্দ্ব দর্শকের মনে গাঢ় অস্বস্তি তৈরি করবে।
- নীরবতার ব্যবহার:
- বেকেটের নাটকে নীরবতা সংলাপের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।
- উদাহরণ: সংলাপের মাঝখানে হঠাৎ থেমে যাওয়া, শূন্য চোখে দূরে তাকানো, তারপর আবার শুরু করা। এই বিরতিগুলো যেন সময়ের অচলাবস্থাকে প্রকাশ করে।
- দৈনন্দিনতার অদ্ভুত রূপ:
- উদাহরণ: ক্লভ যখন বলে, “I’ll leave you.” অথচ যায় না।
- অভিনয়: অভিনেতা বারবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত থেমে যাবে। শরীরের এই ব্যর্থ প্রচেষ্টা চরিত্রের ভেতরের আটকে পড়া অস্তিত্বকে তুলে ধরে।
এই অভিনয়ের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো—
- শব্দ নয়, বরং নীরবতা, পুনরাবৃত্তি, ভাঙন আর শূন্যতা দিয়ে আবেগ প্রকাশ করা।
- দর্শক যেন মনে করে—সে এক শূন্য, অনন্ত অপেক্ষা আর অস্তিত্বের অনিশ্চয়তার জগতে ঢুকে পড়েছে।
এই কারণেই Endgame–এর মনোলগকে বলা হয় “the theatre of emptiness”—যেখানে অভিনয়ের শক্তি লুকিয়ে থাকে অসম্পূর্ণ সংলাপ ও গভীর নীরবতার ভেতর।

১০. সমকালীন বাংলা নাটক – “স্বপ্নসন্ধানী” নাট্যদলের প্রযোজনা
ধরন: আধুনিক ও পরীক্ষামূলক
চ্যালেঞ্জ: শরীরী ভাষা, প্রতীকী উপস্থাপনা
কৌশিক সেনের নির্দেশনায় স্বপ্নসন্ধানী–এর বেশ কিছু নাটকে মনোলগ হয়ে ওঠে শরীর ও শব্দের একসঙ্গে চলা কাব্য। এখানে সংলাপ কখনও ভাঙা ভাঙা, কখনও ছন্দোবদ্ধ; আবার শরীরের ভঙ্গিমা হয়ে ওঠে অর্থ বহনের প্রধান মাধ্যম। অভিনেতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো—শুধু মুখের ভাষা নয়, বরং পুরো শরীরকে ভাষায় রূপান্তরিত করা।
অভিনয়ের মূল দিক ও উদাহরণ
- শরীরী কাব্যিকতা:
- উদাহরণ: চরিত্র যখন নিজের নিঃসঙ্গতার কথা বলে, অভিনেতা মঞ্চের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ধীর গতিতে হাঁটবে। প্রতিটি পদক্ষেপ হবে ভারী, যেন মনের দুঃখ পায়ের ভেতর দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে।
- অভিনয়: সংলাপের সঙ্গে শরীরের ছন্দ মিলিয়ে দিতে হবে, যেন প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি কথার একটি প্রতীক।
- মুখের অভিব্যক্তি:
- উদাহরণ: যখন চরিত্র নিজের ভেতরের ভয় প্রকাশ করছে, তখন অভিনেতা মুখ বিকৃত করবে না, বরং চোখ বড় করে শূন্যে তাকাবে, ঠোঁট সামান্য কাঁপবে।
- অভিনয়: কণ্ঠ কম ব্যবহার করে শুধু চোখ ও ঠোঁটের কম্পন দিয়ে ভয় দেখাতে হবে।
- ভোকাল এক্সপ্রেশন:
- উদাহরণ: সংলাপ যদি হয়—“আমি কোথায় যাচ্ছি?”—তাহলে এটি একবার স্বাভাবিক স্বরে, একবার চিৎকার করে, একবার ফিসফিস করে বলা যেতে পারে।
- অভিনয়: ভোকালের টোন বদলে একই বাক্যকে বহুমাত্রিক অর্থ দেওয়া যায়।
- প্রতীকী উপস্থাপনা:
- উদাহরণ: চরিত্র যখন ভেতরের সংকট প্রকাশ করছে, তখন অভিনেতা হাত দুটো প্রসারিত করে বাতাসে যেন অদৃশ্য কিছু আঁকতে পারে। এতে মনে হবে—সে নিজের ভেতরের জটিল অনুভূতিগুলোকে দৃশ্যমান করার চেষ্টা করছে।
- অভিনয়: আলো-ছায়ার খেলাও ব্যবহার করা যেতে পারে। ম্লান আলোয় ফিসফিস করা সংলাপ, আবার তীব্র আলোয় হঠাৎ চিৎকার—এই বৈপরীত্য মনোলগকে গভীর প্রতীকী করে তোলে।
- শব্দ ও দেহের মিলন:
- এখানে কণ্ঠ ও দেহ যেন আলাদা নয়, একে অপরকে সম্পূর্ণ করে।
- উদাহরণ: সংলাপ বলতে বলতে অভিনেতা শরীর মুচড়ে ফেলছে, যেন শব্দ শরীর থেকে বেরিয়ে আসছে—এভাবে দর্শক অনুভব করে চরিত্রটি শুধু বলছে না, বরং বেঁচে আছে।
এই ধরণের মনোলগে অভিনেতার জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো—
- দেহকে কবিতার মতো ব্যবহার করা,
- শব্দ ও ভঙ্গিমার মিলনে চরিত্রের ভেতরের সংকট প্রকাশ করা।
এই কারণেই স্বপ্নসন্ধানী–এর মনোলগকে সমকালীন বাংলা থিয়েটারের এক বিশেষ ধারা বলা হয়—“the theatre of symbolic realism”—যেখানে দর্শক শুধু শুনে নয়, দেখে এবং অনুভব করেও চরিত্রের মনের ভেতর ঢুকে যায়।
মনোলগ অনুশীলনের গুরুত্ব
১. আত্মবিশ্বাস বাড়ায় – একা মঞ্চে দাঁড়িয়ে অভিনয় করার অভিজ্ঞতা অভিনেতাকে আত্মবিশ্বাসী করে।
২. আবেগ নিয়ন্ত্রণ শেখায় – ভিন্ন ভিন্ন মনোলগ ভিন্ন আবেগের অনুশীলন করায়।
৩. ভাষা ও উচ্চারণ উন্নত করে – মনোলগ বারবার বলার মাধ্যমে উচ্চারণে স্বচ্ছতা আসে।
৪. শরীরী ভাষার বিকাশ ঘটায় – সংলাপের পাশাপাশি শরীর ও দৃষ্টির ব্যবহার শিখতে সাহায্য করে।
৫. কাস্টিং অডিশনে সহায়ক – অধিকাংশ অডিশনেই অভিনেতাদের মনোলগ বলতে হয়।

মনোলগ হলো অভিনয়ের মেরুদণ্ড। একজন অভিনেতার দক্ষতা, সংবেদনশীলতা ও সৃজনশীলতা সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা হয় মনোলগে। উপরের ১০টি শক্তিশালী স্ক্রিপ্ট—হোক তা শেকসপিয়রের ক্লাসিক, উৎপল দত্তের রাজনৈতিক নাটক, রবীন্দ্রনাথ-সত্যজিৎ রায়ের সংবেদনশীলতা কিংবা সমকালীন পরীক্ষামূলক নাটক—সবই অভিনেতাদের প্রশিক্ষণ ও আত্মোন্নয়নের অসাধারণ উপকরণ।