আমিনা সুন্দরী নাটক – এস এম সোলায়মান

আমিনা সুন্দরী নাটকটি এস এম সোলায়মান এর একটি বিখ্যাত নাটাক। এই নাটকটির প্রথম প্রদর্শনী হয়েছে ২৯ ডিসেম্বর ১৯৯০ তারিখে। শেখ মোহাম্মদ সোলায়মান বা এস এম সোলায়মান একজন বাংলাদেশী অভিনেতা। তিনি ১৯৫৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মঞ্চ নাটক পরিচালনা করতেন এবং তাতে সঙ্গীত পরিচালনাও করতেন। তাকে বাংলাদেশের থিয়েটারের জগতে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৪ সালে একুশে পদক লাভ করেন তিনি।

(চট্টগ্রামের অমর লোককাহিনী নছর মালুম ও ভেলুয়া সুন্দরী অবলম্বনে)

 

আমিনা সুন্দরী নাটক : ১ম পর্ব

 

আমিনা সুন্দরী নাটক - এস এম সোলায়মান

 

প্রযোজক দল : ঢাকা পদাতিক

প্রদর্শনীর স্থান : মহিলা সমিতি মিলনায়তন, ঢাকা

কুশীলব

আমিনা সুন্দরী : রীমা রফিক

বাবা : মনসুর আহমদ

মা : তনু সাহা

এছাক সদাগর : এস এম সোলায়মান / পার্থসারথী রুদ্র

নছর মালুম : মাসুম আজিজ

এখিন : প্রতিভা

মাফো : স্বপন সৈয়দ/লিংকন 

মোহান চান : জহির আহমদ।

ভোলা : শেখ শানে মওলা

হাবা :  দেবাশীষ ঘোষ

মনাফ কাজী : খন্দকার তাজমিনুর 

কোরাস : বিজনকান্তি ধর, লিটন, পানু, জোয়ারদার, সোহেল আহমদ, মোহাম্ম গিয়াসউদ্দিন

কলাকুশলী

মঞ্চ ব্যবস্থাপনা : এনায়েত দাউদী

মঞ্চ ও আলোকসজ্জা : আমিনুর রহমান আজম

পোশাক : রোকেয়া রফিক বেবী, ফেরদৌসি হাবিব চিঠি, হাবিবুর রহমান

শব্দ : জাহেদ হোসেন

সমন্বয়কারী : গোলাম কুদ্দুছ

 

আমিনা সুন্দরী ১ম পর্ব
আমিনা সুন্দরী ১ম পর্ব

 

আমিনা সুন্দরী ১ম পর্ব

(আলো জ্বলতেই চড়া সুরে ঢোলের শব্দ। ঢোলের পরে পাত্র-পাত্রীরা সবাই বন্দনা গাইছে)

সভাজনে পেন্নাম করি ঠাইয়াজির মোকাম, ছোডরে মান্যতা করি বড়রে ছালাম। তোমারা সকলের কাছে মাগি অপরাধ, শুদ্ধ কি অশুদ্ধ হইল না কইবা সভাত তোমরা সবে গুণবন্ত আমি অধমজন, বুড়াবুড়ির কাছে আমি ছাওয়ালের মতন। ভালোমন্দ দুই আছে দুনিয়ার মাঝারে, ভাঙ্গাচোরা কথা আইলে ক্ষেমিবা আমারে । আমি হীন মূর্খ মতি নাই কুলমান, বিসমিল্লাহ বলিয়া এখন শুরু করি গান।

[আমিনা সুন্দরী ১ম পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

গান

পরথমে বন্দনা করি শ্রীগুরুর চরণ 

কৃপা করি দিলা শুরু মন্ত্ৰ মহাধন। 

এই দেহ ছিল আমার পাষাণ সমান 

মন্ত্র দিয়া কৈল্লা শুরু ফুলের বাগান। 

পশ্চিমেতে মানি আমি মক্কা মূলস্থান 

তার উদ্দেশে জানাই ছালাম হিন্দু মুসলমান 

পুবেতে বন্দনা করি পুবের ভানুশ্বর 

একদিকে উঠিলোরে ভানু চৌদিকে পহর । 

তার গুণে বন্দনা করি মসজিদের চর 

চাঁদ সুরুজ দুই ভাই সেই চরকের পর। 

রাউন্যা গিরামে মানম মাতা ইছামতি 

নোয়াপাড়ায় মানি আমি বড়পীর সাবের নাতি। 

এই মানি আমি মন কৈরাম স্থির 

মাথার উপরে মানম আশি হাজার পীর ।

আশি হাজার পীর মানম নয় লাখ পয়গাম্বর 

শিরের উপর মানম চাঁড়িগার বদর। 

তারপরে মানি আমি ফকির শেখ ফরিদ 

নেজাম আউলিয়া মানম তাহার সাহারিদ। 

চাষখোলা গিরামে মানম মা বুড়া ছিমাই 

হাওলায় কালাচাদ শীলক ঠাকুর ভাই।

হিন্দু আর মুসলমান একই পিণ্ডর দড়ি 

কেহ বলে আল্লা রসুল কেহ বলে হরি। 

বিছমিল্লা আর ছিরি বিষ্ণু একই ধেয়ান

দো ফাঁক করি দিয়ে পরভু রাম রহমান। 

(বন্দনা শেষে পাত্র-পাত্রীরা চলে যায়)

গায়েন

এইক্ষণে বন্দনা আমার কৈন্যাম সমর্পণ, আমিনা সুন্দরীর কথা করিব বর্ণন।

আমিনা

আমার গলার হার খুলে নেরে ওগো ললিতে

এখন হার পড়ে আর কি লাভ হবে সইগো

প্রাণ বন্ধু নাই ঘরেতে ওগো ললিতে

গলায় হারের কি আর শোভা আছে 

যার শোভা তার সঙ্গে গেছে গো

এখন কৃষ্ণ নামে মালা গেছে সইগো

দে না আমার গলেতে ওগো ললিতে 

আমার গলার হার খুলে নেরে ওগো ললিতে।।

গায়েন

স্বামী তাহার নছর মালুম আষ্ট বছর আগে

লক্ষরের কাম নিয়া গিয়াছে জাহাজে। 

ছয় মাসের লাগি গেল আষ্ট বছর যায়।

বনের বাঘে ন খায় তারে মনের বাঘে খায়। 

নারীর যৌবন সে তো জোয়ারের পানি

কুলে কুলে ভরা আবার ভাটায় টানাটানি ।

দা কিনিয়া না ধারাইলে মইরচা ধরি যায় 

খাইল্যা ভিডাত দুনিয়ার যত আগাছা জন্মায়।

(বৃষ্টির শব্দ । আকাশে মেঘের হুঙ্কার। হৈচৈ করে কিছু লোক ঢোকে। সবাই কই মাছ ধরছে।)

[আমিনা সুন্দরী ১ম পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

 

১ম জন

ঐ ধর ধর । কান্‌ডা চাইপ্যা ধর।

২য় জন

(ব্যথা পেয়ে) উহ্ ।

১ম জন

কি অইল?

২য় জন

কই মাছ কাটা মারি দিছে।

৩য় জন

রক্ত বন্ধ অইছে? (হাত টেনে নিয়ে মালিশ করবে)

 

আমিনা সুন্দরী ১ম পর্ব
আমিনা সুন্দরী ১ম পর্ব

 

২য় জন

না।

৪থ জন

ছেব দে, রক্ত বন্ধ অইয়া যাইবো।

৩য় জন

কয়ডা ধরছস?

১ম জন

চৌদ্দডা।

৩য় জন

মাশাল্লাহ।

১ম জন

চল চল। দক্ষিণের বিলে যাই।

(বৃষ্টিতে ভিজে আমিনা ঢোকে। চোখে মুখে এক ধরনের উন্মাদনা)

আমিনা

(গান) ঝড় পড়েরে লোছা লোছা উজান ভাঙে কই

এমন বরিষার কালে থাইকুম কারে লই । 

আউল হৈয়ে যতরে মাছ মেঘের পানি খাই 

খাইল্যা ঘরত কেমনে আমি মনরে বুঝাই । 

বাড়ির পিছে ঝিঙা ক্ষেত টুনি পঙ্খির বাসা 

দিনে খাইরে চড়ি বড়ি রাইতে ঘরে আসা। 

পাতিলের ভাত ঠাণ্ডা হইলে খাইতে মজা নাই 

ভাঙি পড়লে সোনার যৌবন কি করিব আঁই

(আমিনা বিশেষ মুদ্রায় স্থির। কিছু লোক ঢুকে আমিনাকে উদ্দেশ্য করে কথা বলে)।

১ম জন

এ্যা। কি আমার সতী নারীরে। দেমাগে ঠেং মাটিতে পড়ে না। ঐ দিন মশকরা করি একডা কথা কইছি। ওরে বাপরে কি গোস্বা! য্যান এই আষ্ট বছরে তারে কেউ ছুইয়াও দেখে নাই ।

২য় জন

ঠিকই কইছস। ঐ দিন তো আমি নিজ চক্ষেই দেখছি। বাইন্না পাড়ার হাসেম আলীর লগে কি হাসাহাসি। রস যেন ট্যাবাই ট্যাবাই পড়ে। 

৩য় জন

এতই যখন কুরকুরি, তয় একডারে বাছি লইলেই তো হয়। মানুষ কি আমরা খারাপ? 

৪র্থ জন

অঁ আমিনা। রাজি অইয়্যা যা। আগুন পাটের শাড়ি দিমু। জীবন রাখলাম বাজি। নাকেতে বেশর দিমু। অঁ আমিনা তুই কি রাজি? 

(আমিনা মুখ ঝামটা দেয়। ওরা পালিয়ে যায়)

১ম জন 

কি জারগুয়া মাইয়ারে বাজি। 

আমিনা

ও বন্ধুরে তোমার লাগিয়ারে বন্ধু

তোমার লাগিয়া

বন্ধুরে – আমি মরলে এই করিও

না পুড়িয়ো না গাড়িয়ো

সাইগরেতে দিওরে ভাসাইয়া

আমার চোখে চোখ লাগাইয়া

একবার তোরা দেখনারে চাইয়া

কেমন রঙিলারে বন্ধু পাগল করল হিয়া।

গায়েন

আমিনা সুন্দরী কন্যা বাপের এক ঝি

আষ্ট বছর খসম ছাড়া উপায় হইব কি । 

মেওয়া বিবি মা তার মাঝির গাও বাড়ি 

অতি কষ্টে দিন কাটে করে দিন মজুরি। 

কন্যারে দিছিল বিয়া ভালা ঘর চাই

আষ্ট বছর হইল গত খসমের খোজ নাই।

বাবা

তুই যে কিয়ের আশায় বুক বান্দি আছস বুঝি না। আমি তো খবর পাইছি। হারামজাদা নছর মালুম বার্মার অঙি শহরে সুখে শান্তিতে আছে। গিয়া দেখ, আমিনা নামের কাউরে হে বিয়া করছে। আর আট বছর ধইরা মাইয়াটা যে তার পন্থের আশায় চাইয়া রইছে হেইডা হে ভুইলা গেছে।

[আমিনা সুন্দরী ১ম পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

 

আমিনা

আমার বিশ্বাস হয় না বাজান। নছর মালুম আমারে তুইরা যাইতে পারে না। নিশ্চই মানুষটার কোথাও কোনো বিপদ হইছে। 

বাবা

না রে মা। এরই নাম হইতেছে গিয়া বার্মা। সাধে কি আর মাইনসে কর? বার্মায় যে যায় ফিরনের পথ নাই। নানান কিসিমের যাদু-টোনায় সেখানে পুরুষ মানুষ বশ হইয়া যায়।

 

আমিনা সুন্দরী ১ম পর্ব
আমিনা সুন্দরী ১ম পর্ব

 

মা

আমিনা তুই আমার বুদ্ধিটা ধর। নছরের আশা ছাড়ান দে। আরেকটা বিয়া কর। 

আমিনা

না মা, জীবন তো মানুষের একটাই। দুঃখ, কষ্ট, জ্বালা, সুখ সবটাইতো এই জীবনের মধ্যেই। জীবন শেষ ও বেবাক শেষ। তয় অত ডর কিসের? আট বছর যদি পার করতে পারি আশি বছর পারুম না? না মা আমারে আর বিয়ার কথা কইয়ো না।

বাবা

এইভাবে তো জীবন যাবে না আমিনা। তোর দুঃখে পশুপাখির চোখ গলে কিন্তু নছর মালুমের মনতো গলে না। আমার কথাটা ধর । তুই একটা বিয়া কর । বয়সটা একটু বেশি । ও কিছু না । চারদিকে রমরমা গিরস্তি। গোলাভরা ধান। পুকুর ভরা-

আমিনা

কার কথা কও বাজান?

মা

এছাক সওদাগর।

আমিনা

এটা কি কও মা? হেতো দোজবর।

মা

পুরুষ মানুষের আবার দোজবর কি? পুরুষতো পুরুষই।

আমিনা

হা পুরুষতো পুরুষই। সাত খুন মাপ। অনাচার যতই করুক হয় না তার পাপ। এই না হইলে পুরুষ। সাপের লাহান ফনা ধরি ছোবল মাইরা যায়। ফুরফুইর্যা বাতাস মাইখা ঘুইরা বেড়ায়। সেই নীলের দংশনে কত বাইরা যায় প্রাণ । এই না হইলে বাড়ে পুরুষের মান। নারী? সে তো ঘরের শোভা– কব্বরের ঘর। রাখ, বাড়, বাইচ্যা বিয়াও বছরে বছর। যত ইচ্ছা কর বিয়া কোনো দোষ নাই। খালি মাইয়া মাইনষের ঘরের বাইরে চোখ ফুটতে নাই। আটটা বছর পার করলাম না নিলো খবর। মাজান তুমি আবার কও এছাক সওদাগর। হাহ্! পুরুষ। 

গায়েন

গেরামের মাঝখানে এছাকের ঘর

নামে ডাঙর মানুষ তারা মস্ত তোয়াওর । 

ফুলেতে থাকিলে মধু জানে সে খবর 

মধু খাইতে চাহি বধু করে ধড়ফড় । 

এছাক মিয়া আসে সদাই আমিনার বাড়ি 

আমিনার প্রেম সাগরে দিতে চায় পাড়ি। 

বাপে গেইয়ে কাজে কামে মায়ে রান্ধে বাড়া 

এই সময়ে এছাক সদর দুয়ারেতে খাড়া 

পানের বিড়া আনছে ভাল নারিকেলের তেল

আমিনারে ডাক কয় ঘরের দুয়ার মেল।

(দরজায় টোকা)

(আমিনা ঘরের দরজা খুলে এছাককে দেখে)

আমিনা

আপনে।

এছাক

হ, আমি।

আমিনা

বাজান ত বাড়িত নাই।

এছাক

অসুবিধা কি। তুমি তো আছ। এই যে নাও। 

আমিনা

কি?

এছাক

তোমার মায়ের জন্য আনছি পানের বিড়া। এই রইল নারিকেলের তেল, চুনা থোরা। হাটে হাটে সদাই কইরা মনের সাথে জুড়ি। তোমার জন্য আনছি কইন্যা আগুন পাটের শাড়ি।

আমিনা

এই গুলান আপনে নিয়া যান, মায়ে বাপে দেখলে রাগ করবো। 

এছাক

আরে আমি কি এতই বোকা? তোমার বাপেও জানে মায়েও জানে। এই গুলান তুমি ঘরে নিয়া যাও। আর হুন। একটু পান তামুক তো খাওয়াও।

গায়েন

হুক্কাতে তামুক আর পানের খিলি দিয়া 

আমিনা বাহিরে আসে কথা না বলিয়া ।

জাইল্যা যেমন ঘোলায় পানি জাল ফেলিয়া দূরে 

হেই না মতে মনচোরা ঘুর ঘুর করে।

এছাক

এত সুন্দর রূপ তোমার আমিনা সুন্দরী, আর ক’দিন একলা থাকবা, এবার কর বিয়া

 

আমিনা সুন্দরী ১ম পর্ব
আমিনা সুন্দরী ১ম পর্ব

 

আমিনা

ঘরেতে রাখিয়া খসম কে করছে কবে বিয়া?

এছাক

ঘরেতে খসম? তুমি যে কি কও না কও আমিনা? নছর মালুম? এই জীবনে তার সাথে তোমার দেখা হবে না। বার্মা শহর- সে কত আচানক দেশ। নছরের আশা তুমি ছাইড়া দাও। আমিনা সুন্দরী একবার আমার দিকে চাও। 

[আমিনা সুন্দরী ১ম পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

 

আমিনা

ঘরে আমার মেলা কাজ কাম । আপনি এইবার বাড়ি যান। 

এছাক

যাইবার জন্য তো আমি আসি নাই সুন্দরী পণ কইরাছি তোমার সঙ্গে দিব শঙ্খ নদী পাড়ি।

এছাক

(গান) বিয়া যদি কর মোরে

তোমারে পালিবাম আমি সারা জীবন ধরে।

আষ্ট কানি জায়গা দিব শঙ্খ নদীর কূলে। 

ভরি ভরি সোনা দিব হাতে কানে চুলে।

(আমিনার মা ঢোকে)

বাবা

সালামালাইকুম। সওদাগর সাব। গরিবের বাড়িতে আপনি?

এছাক

ঘুরতে ঘুরতে আইসলাম এমনি।

মা

অ আমিনা। সওদাগর সাবেরে একটু পান তামুক দিছস তো।

এছাক

দিছে। তয় খুশি মনে দেয় নাই। বেজার হইয়া দিছে।

বাবা

ওমা এইসব কি কথা? কত বড় মানুষ তারা কত বড় ঘর। আপন মানুষেরে কেমনে করছ পর?

এছাক

হুন মেওয়া বিবি। আমি এক কথার মানুষ। জবান যখন দিছি। জবান রাইখতেও রাজি । রাজি যদি হয় আমার আমিনা সুন্দরী, বিয়া কইরা নিয়া যামু আমার খালি বাড়ি। আষ্ট কানি জায়গা দিমু শঙ্খ নদীর কুলে। ভরি ভরি সোনা দিমু হাতে কানে চুলে।

মা

আমারে দিবেন একখান দুই ভরি হাঁসুলি।

আমিনা

হাঁসুলি নি কইরবা কি ভুঁই চামড়া গ্যাছে ঝুলি। 

এছাক

এইবার বল তোমরা রাজি কি বেরাজি। 

বাবা

আষ্ট কানি জায়গা?

এছাক

বাবা

লগে একখান টিনের ঘর?

এছাক

তাও দিমু।

বাবা

তার মানে আপনি আমারে দিবেন একখান টিনের ঘর আর আষ্টকানি জমি । 

আমিনা

তুমি মরলে সেই জমিতে কাউয়ায় করবো বমি।

মা

চুপ, খালি মুখে মুখে কথা। এছাকরে না করলে বিয়া ভাঙি দিয়ম মাথা । সওদাগর সাব। আমি রাজি।

এছাক

রাজি? আমিনা সুন্দরী। তাইলে এবার ডাইক্যা আনি কাজী?

আমিনা

আমি তো না ঐ বুড়ি অইছে রাজি। বুড়িৱে করেন বিয়া, ডাইক্যা আনেন কাজী চুপ, পাজির গোষ্ঠি পাজি। সওদাগর সাব। হুনেন (কানে কানে বলে) য্যামনে পারেন রাজি করান। গেলাম আমি ঘরে। মিঠা কথার বুলি ছাড়েন মিশাইয়া অন্ত রে। মাইয়া মাইনষের যৌবন এমন পরাণ আনছান। স্রোতের টানে কতক্ষণ আর থাকে বালুর বান। (মা বাবা চলে যায়)

এছাক

বিয়া যদি না কর মোরে আমিনা সুন্দরী, মান্দার গাছে গিয়া দিমু নিজের মাথায় বাড়ি। রাজি যদি হওরে কইন্যা হইয়াম জিলাপি। প্যাঁচে প্যাঁচে প্যাচ করিয়াম লাগাইয়া পীরিতি।

কন্যাগো…

গো তোল গা তোল কন্যা ওঠ একবার 

চারি চক্ষের মিলনেতে চল যাই এইবার ।

উঠরে উঠরে কইন্যা পুণ্যিমাসির চান

আদর কইরা খাওয়াই দিবা মহেশখালির পান।

হুক্কাতে সাজাইয়া তামুক তুমি দিবা আনি

গরম কালে খাওয়াই দিবা লবণ জলের পানি 

গা তোল গা তোল কইন্যা অঙ্গ জ্বইলা যায় 1

ঘনশ্বাস ফেলি মোরে ধরনা বেড়াই,

(আমিনা অনেক আগেই চলে গেছে। মা এসে এছাকের দুঃখে ঘন ঘন চোখ মুছে শেষ মুহূর্তে এছাক আমিনার মাকে জড়িয়ে ধরে ।)

[আমিনা সুন্দরী ১ম পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

 

মা

তওবা তওবা। এইডা কেমন জামাই বউ আর শ্বাশুড়ির মাঝে বুঝি কোনো ভেদাভেদ নাই।

এছাক

মা জননী আমিনা সুন্দরী নাই,

 মা

হারামজাদি তাইলে রাজি হয় নাই। এখন কি উপায়?

এছাক

উপায় একটাই। চল। বুধা গুণীনের কাছে যাই। তার আগে একডা কাম কইরা যাও। পট্টি মাইরা আমার হাতে একড়া চুল তুইল্যা দাও।

 

আমিনা সুন্দরী ১ম পর্ব
আমিনা সুন্দরী ১ম পর্ব

 

(মা নিজের একটা পাকা চুল তুলে দেয়)

ধুর। পাকনা চুল দিয়া আমি কইরুম কি? এই বয়সে তোমারে নি কইরতাম আমি শাদি । ঝটপট চলে যাও ঘরের ভিতর ডাকি আনি আমিনার চুলের গোছা ধর। একখান কালো চুল তুলে লও হাতে, চুপি চুপি আনি ঢুকাও আমার পকেটে। 

(বাদন বাজে। মা আমিনাকে চুলের ঝুঁটি ধরে বাইরে আনে। একটা কালো চুল তুলে নিয়ে এছাকের পকেটে ঢুকিয়ে দেয়।)

গায়েন

সেই তো গ্রামের গুণীন বুধা তার নাম 

ঝাড় ফুক সবই জানে বিতিকিচ্ছা কাম।

(মঞ্চে বুধা ঢোকে)

গর্ভিতা খালাস হয় পানি পড়া খাই 

বুধা গুণীর দোয়া তাবিজ আচানক দাবাই।

পুরুষ দিওয়ানা হয় নারী ছাড়ে ঘর

পরকে আপন করে আপনেরে পর 

যুবতি নারীর লাগে খোপার আগার চুল

আর লাগে সন্ধ্যা বেলার বাসী জবা ফুল ।

আঙ্গুলের নখ আর অঞ্চলের সোনা 

এই সব জিনিস দিয়া করে যাদু টোনা।

(গানের সময়ে তাবিজ তৈরি করে এছাকের হাতে তুলে দিল।)

বুধা

শোনো মিয়া। দুইখান চুল দিছ আমারে ।

এছাক

দুইখান চুল দিছি আপনারে ?

বুধা

হ। একখান কালা। আর একখান সাদা মাইয়া ক্যান মাইয়ার মাও পাগল হইয়া বাহির হইয়া আইবো । 

এছাক

ধুর। মা দিয়া করুম কি? মাইয়ার তাবিজ কোনডা চিহ্ন দিয়া দেন।

বুধা

এইডা মার। আর এইডা মাইয়ার।

(এছাক তেল নিয়ে বুধার কাছে আসে। বুধা মন্ত্র পড়ে তেলে ফুঁ দেয়।) 

এছাক

শোন মিয়া দিলাম তেল পড়া। আগামীকাল সকালবেলায় এই তেল মুখে দিয়া আমিনার বাড়ি যাইবা। তেলের সুগন্ধে দেখবা আমিনা সুন্দরীর মন কচু পাতার পানির লাহান টলমল টলমল করতাছে। পাড়া দিবা, আবার দিবা না। দিবা, আবার দিবা না। দেখবা, সুন্দরী তোমার হইয়া গ্যাছে দিওয়ানা। এরপরও যদি না হয়। কাম, আবার আসিও ফিরে আমার মোকাম।

গায়েন

এরপরে একটা দিন গুজারিয়া গেল এ

ছাক সদর আমিনার মায়েরে বুঝাইল। 

তোমার বাড়িত যাইয়ম আমি আমাবশ্যার রাতে 

তোমরা কেহ না থাকিও ঐদিন ঘরেতে। 

বুধা গুণীন তাবিজেতে দিছে এমন বান 

তেল পড়া মুখ দেখি তাহার মন হইব আনছান। 

(মঞ্চে এছাক সাজ পোশাক পরছে) 

পরনেতে তহমান কালা কোর্তা গায় 

মাথার উপর টুপি দিয়া আয়না ধরি চায়। 

মুখেতে মাখিয়া দিল বুধার তেল পড়া 

সাজিয়া গুজি  এছাক বাহির হইল ত্বরা । 

ধীরে ধীরে আসে এছাক চায় ফিরি ফিরি 

একইবারে চলি আইল আমিনার বাড়ি।

(এছাক এসে আমিনার ঘরের সামনে দাঁড়ায়)

এছাক

(গান) পাড়া ডুশী ঘুমায় এখন ডাকে সব নাক 

ঘরের বাহির হওরে কন্যা দুয়ার করি ফাঁক । 

পাও চালাইয়া চল কন্যা আমার পিছে পিছে 

উতলা হইয়াছি আমি পীরিতের বিয়ে। 

বুধা গুণীর তেল পড়ার এমনি এক গুণ 

পাগল হইয়া বাইরঅ কন্যা চোখেতে নাই ঘুম

(এছাক দরজা খুলে দেখে ঘরে কেউ নাই)

গায়েন

দুয়ার খোলা রইল রে তার ঘরেতে নাই বাতি 

আমিনা সুন্দরী কন্ডে গেল এই রাতি। 

আসল কথা সকলের চক্রান্ত বুঝিয়া 

সেই রাতেই আমিনা গেল পালাইয়া । 

সারা রাইত মশার কামড় সহিয়া সহিয়া 

ফজরে আপনার বাড়ি গেল এছাক মিয়া। 

শোনেন যত সুধীজনে, শোনেন দিয়া মন 

এইক্ষণে নছরের কথা করিব বর্ণন।

চাড়িগাঁ বন্দরের হুলুপ নাম তার রুম

মহর আলী সেই জাহাজে স্যারি মালুম।

নহর পরথমে ছিল জাহাজের লক্ষর

ভাল মত হেজ করি পড়িল চাত্তর।

লক্ষর হইতে নছর হইল মালুম

টাকা পয়সা জমাইয়া হাতে করলো কুম।

টাকা পয়সা হাতে নিয়া ভাবিয়া ভাবিয়া

বার্মা দেশের অভি শহর আসিল পৌঁছিয়া ।

(ঢোলের শব্দে মঞ্চে বার্মা মুলুকের আবহ।)

আছানক দেশ এক শোন কহি যাই

বেপরদা মাইয়া মাইনষের লাজ শরম নাই।

মরদেরা রান্ধে ভাত, নারী হাটে যায়

ভালা মাছ রাখি তারা নাপপি পঁচা খায়।

মাইয়া মাইনষের জেয়র জাতি বহুৎ বহুৎ দামী 

এক প্যাঁচে কাপড় পিন্দে আড়াই হাতের থামী। 

মাথার চুল বাবরি কাটা এঙ্গি থাকে বুকে 

খোপার ভিতর পানের খিলি ইশারাতে ডাকে। 

কানের দুল বাতাসে দোলে রাস্তা দিয়া যায় 

মুচকি মুচকি হাসি তারা পুরুষ ভোলায় । 

মাফো নামের রেয়াজা এক অভি শহর বাড়ি 

এখিন তাহার কন্যা পরমা সুন্দরী। 

বিশ বছর বয়স তার চাম্পা ফুলের রং 

ঠককে ঠমকে চলে জানে কতো ঢং। 

শুকনা মাছ বেঁচে থাফো বড় সদাইগর 

তার বাড়িতে একদিন আসিল নছর।

মাফো

বুঝছি। তুমি চাড়িগার মানুষ। চাড়িগার মানুষ বার্মা মুলুকে ছাইয়া গ্যাছে। কি করবা। দ্যাশোতে অভাব। এইখানে থাকতে চাইলে বদলাও স্বভাব। শুকনা মাছের কারবার আমার মেলা মাইনষের দরকার। কি করবা চাকরি এইখানে আমার?

[আমিনা সুন্দরী ১ম পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

 

নছর

চাকরি আমি করবো না। বহু দিন পানিতে ভাইস্যা ভাইস্যা চাকরির উপর থাইকা মন উইঠ্যা গেছে। আপনার কাছে আইছি। মেহেরবানী কইরা যদি দেন বুদ্ধি ভরসা, তবেই শুরু করতাম স্বাধীন ব্যবসা। 

মাফো

ওরে বাবা ব্যবসা করতে চাও তাইলে তো মেলা টাকার দরকার। কই পাইবা এত টাকা? কে আছে তোমার-

নছর

জ্বে, বহুদিন জাহাজে মালুমের চাকরি করছি। ট্যাহা পয়সা মোটামুটি আছে। 

 

আমিনা সুন্দরী ১ম পর্ব
আমিনা সুন্দরী ১ম পর্ব

 

মাফো

এখিন, ও এখিন, আয়তো মা। 

এখিন

কি অইছে বাজান?

মাফো

ঘরেতে মেহমান সুন্দর কইরা বানাতো মা এক খিলি পান। (নছরকে) তাইলে তোমার কাছে ট্যাহা পয়সা কিছু আছে? 

নছর

যে আছে।

মাফো

তাইলে আমার বুদ্ধি ধর। ব্যবসা যদি করতেই চাও তো আমার সাথে কর।

নছর

তাইলেতো ভালোই অয়। 

মাফো

এই শহরে থাকবা কই। জানাশুনা কেউ আছে?

নছর

কেউ নাই সওদাগর সাব। আগে আল্লা, আপনি আছেন পিছে।

মাফো

তোমার কথাবার্তা খুবই সুন্দর। নিশ্চয়ই তুমি ভালো মাইনষের পোলা। কেউ যখন নাই কি আর করবা। তুমি আমার বাড়িতে থাক। মা এখিন। ঐ দক্ষিণের ঘরটায় নছররে থাকতে দিতে চাই।

এখিন

থাকুক, নাই যখন উপায়।

মাফো

আমি দোকানে যাই। তুমি বিশ্রাম করো। কাল সকালে আমার লগে দোকানে যাইবা। চিন্তা কইরো না। আমার লগে থাকলে তোমার আয় উন্নতি বাড়বোই । তুমি থাক, তাইলে আমি যাই। (মাফো চলে যায় )

এখিন

একডা কথা জিগাই?

নছর

হ, জিগাও।

এখিন

না, থাক ।

নছর

আহা থাকব ক্যান, কও ।

এখিন

না। থাক। আমার শরম লাগে ।

নছর

শরমের কথাডাই আগে কও এখিন সুন্দরী। আইচ্ছা আমার কাছে তোমার কিসের ডর শরম । ডরাইওনা। আমি ভালা মাইনষের পোলা। হাসি খেলি ঘুরি ফিরি মনের জানালা খোলা। কও ।

এখিন

দেশে তোমার কে কে আছে?

নছর

ও। এই কথা। দেশে আমার কেউ নাই সুন্দরী। স্রোতের শেওলা হইয়া দেশে। বিদেশে ঘুরি।

এখিন

দেশের বাড়িতে কোনো মনের মানুষ নাই? 

নছর

পানির মাঝে বসত করি কই মনের মানুষ পাই?

এখিন

যাও, সব মিছা কথা।

নছর

মিছা না মিছা না কইন্যা, এই মনে বড় ব্যথা। গাঙ যদি হইতা তুমি আমি হইতাম ঢেউ। বুকের ভিতর লুকাই রাখতাম না জানিত কেউ।

গায়েন

কেউ নাই ঘরে আর এখিন একলা। 

মস্করা করিয়া দিল পানের বডু মেলা।

সেই দেশের সরামতে তাদের বিয়া দিলো ।

এই সব দেখি মাফো কি কাম করিল। 

(বাদ্য তুঙ্গে ওঠে। নছর এবং এখিনের সেই দেশের নিয়ম মতে বিয়ে হচ্ছে

গায়েন

মুড়ার কুইল্যা গরু আর গাঙর কুইল্যা বাড়ি 

মুসলমানের বিবি আর হিন্দুর গালের দাড়ি। 

এই সকলের কোন দিন নাহি থাকে ঠিকানা 

বিশ্বাস না করিও কেহ আমি করি মানা। 

ফুলের মধু খায়রে নছর মুখেতে টাগা মারে

ভুলি গেইয়ে জানের জান সেই আমিনা সুন্দরীরে। 

এইখানে নছরের কথা করিলাম সমাপন 

আমিনা সুন্দরীর কথা শোনেন দিয়া মন । 

(আমিনা সুন্দরী ঠিকানাবিহীন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে)

আমিনা

দুশমনের লাগি আমি ছাইড়লাম বাপের বাড়ি 

নছিবের দোষে আমার খসম থাইকতে রাঢ়ি । 

ছোডকালে পালি মা-বাপ দিয়ে বড় দাগা 

কি করিব শঙ্খ কুলে আষ্ট কানি জাগা। 

কি করিব সোনার যৈবন বুকে বড় ঘাও 

মনের দুঃখ না বুঝিলা আমার বাপ-মাও। 

যৈবন তো নয় খাওনের জিনিস কাটিয়া খাওয়াইব 

বেচিবার মাল নহে বাজারে বেচিব 

বাটিবার ধন নহে দিব ঘরে ঘরে 

না বুঝিলা মাও-বাপ না বুঝিলা মোরে ।

গায়েন

কত গেরাম ছাড়ি আইল কত নদী নালা 

কত গণ্ডা লুইচ্যা ছান্ডা দিয়ে কত জ্বালা । 

খোদায় দিছে ছুরত তার ছুরত হইল বৈরী 

সন্তিপনা বজায় রাখে আমিনা সুন্দরী। 

ইছাখালির কুলে আছে মোহন চান্দের বাড়ি 

তার ঘরে আশ্রয় পাইল আমিনা সুন্দরী। 

ষাটের উপর বয়স তার বুড়া খেতিয়াল 

সন্ধ্যা বেলায় ঘরত আসে কাঁধে নিয়া হাল। 

অকুলে বসিয়া কইন্যা পাইল সুখের লাগ 

আঁধার ঘরে রশনা করি জ্বালিল চেরাগ। 

রান্ধি বাড়ি ভালা মতে তারারে খাবায় 

বুড়া বলে পাইলাম কইন্যা ভগবান কৃপায় । 

দুই ওয়াক্ত নাস্তা বানায় সকালে বিকালে 

ছেঁচা পান খাইয়া কইন্যার চুম্বা দিল গালে। 

(আমিনা মোহনের চুল বেছে দিচ্ছে)

আমিনা

বাজান ঐ যে কথায় কয়না ঠগ বাছতে গা উজাড়। তোমার অবস্থাও অইছে 

মোহন

তাই কেন রে মা, কি হইছে?

আমিনা

কি অইছে? যেইভাবে তোমার চুলে পাক ধরছে, বাছতে গেলে তো মাথায় আর চুলই থাকব না।

মোহন

পাকবে না । বয়স কত অইল হেই খেয়াল আছে? সামনের আশ্বিন মাসে তিন কুড়ি চাইর বছরে পড়ুম 

আমিনা

(হাসি)

মোহন

এই তুই হাসলি কেন?

আমিনা

হাসুম না বাজান? এইডা একটা বয়স অইল নাকি? 

মোহন

না তো কি? আমার বয়সে কত মানুষ দুইন্যা ছাইড়া পরকালের পথ ধরছে।

 

google news logo

 

(আমিনার হাসি)

মোহন

যমে যখন আইয়া আমারে ধরব তখন বুঝবি

আমিনা

(রাগ করে) দেখ বাজান। এইসব মরণ-ফরণের কথা কয়ো নাতো। আমার ভালো লাগে না।

মোহন

ভালো না লাগলে উপায় কিরে মা। ভগবানের ঘর পুনে যেই দিন আইছি হেই দিন যাওনের দিন তারিখ ঐ যম বেটা ঠিকঠাক কইরা রাখছে। তয় আমার দোষটা কি? 

[আমিনা সুন্দরী ১ম পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

 

আমিনা

হুন বাজান। আমি তোমার পাশে থাকলে আজরাইল তো দূরের কথা, হের জাতি অষ্টিও তোমারে ছুইতে পারবো না।

মোহন

তুই কি করবি?

আমিনা

কি করুম? হুন বাজান। আমি চিল্লান দিয়া কমু, ঐ যমের বেটা, বাজান এখন খুবই ব্যস্ত। নিশ্বাস ফেলনের যো নাই। সাতটা না পাঁচটা না একটা মাত্র মাইয়া তার। হেরে ফেইলা হে অখন কোনখানে যায়তে পারবো না। অই যাও যাও । 

[হাত নাড়তে গিয়ে আমিনার হাতের চুড়ি ভেঙ্গে পড়ে। অমঙ্গল আশঙ্কায় মোহন এবং আমিনা বিমর্ষ। বিলম্বিত লয়ে “আমার গলার হার” গানের হামিং]

আমিনা

বাজান। আমার তো তিন কুলে কেউ নাই। যারা আছে হেরা থাইক্যাও নাই। আল্লার তো দয়ার শরীর। আমার একটা ছোট্ট আবদার হে রাখবো না? তুমি মরলে যে শকুনের দল আবার এই শরীরটা নিয়া টানা হেঁচড়া শুরু করবো।

মোহন

মারে। এই জীবনে সন্তান সুখ যে কি সুখ, সেইডা তোরে না পাইলে তো বুঝতাম না। বাপই যদি আমারে ডাকবি, তয় বাপের কামখান আমারে করতে দে। আমি দেইখ্যা শুইন্যা ভালো মতো একখান পাত্তর দেখি। তোর বিয়াখান দিয়া আমি সুখে চোখ বুজি।

আমিনা 

সুখ’ বিয়া! বাজান তুমি আমার বিয়ার কথা কও? তয় তোমার একটা কথা জিগাই? তুমি বিয়া করলা না ক্যান? 

মোহন

ওঃ আমি? আমি তো (চিন্তা) আজ কি বাররে মা?

আমিনা 

আজ কি বার? কোথায় পালাইবা বাজান? কোনহানে? একজন মানুষ কতদূর পর্যন্তপালাইতে পারে? কিন্তু নিজের থ্যাকা পালানো কি সম্ভব?

ৰাজান বিয়াতো জীবনে একবার কইরাই দেখলাম, আরেক বিয়ার ডরে বাপ মারে ছাইড়া আইলাম। ওসব বাদ দাওতো বাজান, আমাগো বাপ বেটির জীবনও একভাবে না একভাবে কাইটাই যাইবো। 

মোহন

এইটা কি সম্ভব? আমি মরলে তোর কেউ আর রইলো না। হুন মা, ভালো একটা ছেইলে আছে দক্ষিণের চরে। বিদ্যা বুদ্ধি গেরস্তি। মন করছি স্থির, বিয়া দিয়াম তোরে। দক্ষিণের চরে গিয়া আনম তারে ধরি। ঘরে আছে কইন্যা আমার আমিনা সুন্দরী।

আমিনার

(গান) শোন গো ধর্মের বাপ শোন আমার বাণী

পিয়াস নাই বুকে আর না পিয়ম পানি। 

মা বাপরে ছাড়ি আইলাম ছাড়লাম বাড়ি ঘর 

শাদী দিতে ছাইল বইলা মা বাপ হইল পর 

শোন গো ধর্মের বাপ ধরি তোমার পাও 

অভাগিনীর ভাঙা বুকে আর না দিও ঘাও।

গায়েন

পরিদিয়ার লাউখ্যা শুটকি বড় নাম ডাক

মাফো ভাবে কেমন কইরা পাইব তার লাগ। 

নছরেরে ডাকি মাফো কহিল জামাই

কেমন কইরা পরিদিয়ার ভাল লাউখ্যা পাই। 

মাফো

শোন জামাই। অবস্থা যা, লাউখ্যা শুটকির বাজার এখন রমরমা। পরিদিয়া দ্বীপের শুটকি বাজারের সেরা কিন্তু সমস্যা একটা অনেক দূরে সেই দ্বীপ। একবার যদি যাওন যাইত—।

নছর 

অসুবিধা কি? আমিতো পরিদিয়ার দ্বীপ চিনি। যাতায়াতে ধরেন সময় লাগবো একমাস। দুই এক মাসেই সম্ভব।

মাফো 

তাইলে তুমি এখনি রওনা হও। তার আগে এখিনের কাছে গিয়া বিদায় লও ।

গায়েন

এখিনের কাছে গিয়া কহিল নছর 

এক মাসের লাগি যাইয়ুম পরিদিয়ার চর। 

কোন দুঃখ না করিও আসিব ফিরিয়া

কান্দিয়া কহিল এখিন ন করিও বিয়া।

আমারে ছাড়িয়া নছর ন যাইও তুমি 

হাতের বাজু বেচিয়ারে খাবাইয়াম আমি। 

বৈদেশে বিপাকে যাইতে আমি করি মানা

বেছিয়া খাওয়ামু আমি গলার সোনা দানা । 

ন যাইও ন যাইও নছর আমার প্রাণের ধন

তোমার জন্য বেচিবরে সোনার কাঁকন। 

দরকার হইলে ভিক্ষা মাগি খাওয়ামু তোমারে

ন যাইও ন যাইও তুমি বৈদেশে বন্দরে।

গায়েন

তিন দিনের পন্থে আসি করিল নোঙর 

মাঝির গাওয়ের মাঝে গেল তারপর। 

একেবারে ছলি আইল আমিনার বাড়ি 

শ্বশুর মরিয়া গেছে আছে যে শ্বাশুড়ি। 

পাড়ায় পাড়ায় বুড়ি ভিক্ষা মাগি খায় 

বেগর খাওনে হইলে কেহ না জিগায়। 

ছানি নাই বেড়া নাই ভাঙা সেই ঘর

আমিনা কস্তে গেছে ভাবিল নছর। 

বার মাইস্যা বাইয়ুন গাছে ফুইটে বাইয়ুন ফুল

ভাঙা ঘরত বসি নছর ভাবিয়া আকুল 

অবশেষে সাত পাঁচ ভাবিয়া ভাবিয়া 

বাড়ির পাশে হাটের মাঝে আসিল পৌঁছিয়া ।

দোকানদার

কার কথা কও?

নছর

আমিনা সুন্দরী।

দোকানদার 

কোন সুন্দরী?

নছর

আমিনা সুন্দরী।

দোকানদার 

এ্যা’ আমিনা সুন্দরী ! (হেসে উঠে)

নছর 

হাসেন ক্যান? কথা কন। কন্ডে গেলে পাইয়ুম খবর আমিনা সুন্দরীর।

 

আমিনা সুন্দরী ১ম পর্ব
আমিনা সুন্দরী ১ম পর্ব

 

দোকানদার

কন্ডে? (একেবারে উপরে আঙুল তুলে)

নছর

কি? আল্লার কাছে? আল্লার মাল আল্লা লই গেছে?

দোকানদার 

না না, আছে।

নছর

আছে? কন্ডে আছে? কোন দেশে? (দোকানদার উত্তরে নির্দেশ করে) উত্তরে কার বাড়িতে আছে? (এবার দক্ষিণে।) দক্ষিণে? এক্ষণি চলিলাম আমি তাহার তল্লাশে। 

দোকানদার

(হেসে) পয়সা-কড়ি কিছু আছে?

নছর 

মাইনে?

দোকানদার

বোজে না। রূপের হাটে সদায় করে আমিনা সুন্দরী। ট্যাহা পয়সায় ভারি হইছে শাড়ীর গিট্যা ভরি। এই অঞ্চলের সেরা বেইশ্যা আমিনা সুন্দরী। 

(এই কথা শুনে নছর কানে আঙুল দিয়ে ছুটে যায়)

গায়েন

বাড়িল বাতাসের জোর ফাল্গুন মাইস্যা দিন 

জাহাজে ছড়িয়া নছর করিল একিন 

বাহির দরিয়ায় যখন আসিল সলুপ 

ঝাপটাইন্যা বাতাসে পড়ি হৈল ডুপ ডুপ। 

আছমানে ডাকিল দেয়া চমকে বিজলি

আইয়ের কালা কালা মেঘ দৈত্যের মত ছলি 

শোর চিৎকার মারি কেহ করে ধড়ফড় 

না দেখিলাম মাও বাপ ভাই বেরাদর । 

ছিড়িল পালের রশি ভাঙ্গিল মাল

জাহাজের মাঝে এখন পড়ে হলুস্থুল। 

চুডিল জাহাজ বাতাসের জোরে

একইবারে চলি আইলো গোবদ্দার চরে।

নছর

হায়রে নছিব। শরীলে শক্তি নাই, মনেতেও জোর নাই। এইডা কোন জায়গা? 

১ম মাঝি

আস্তে কথা কন সওদাগর সাব ।

নছর

ক্যান?

১ম মাঝি 

এইডা কোন জায়গা চিনেন নাই?

নছর

মাথাও ঠিক নাই। চিনা চিনাও লাগে।

১ম মাঝি 

আস্তে কথা কন, এইডা গোবদ্দার চর। 

(এই কথা শুনে মাঝি মাল্লা সবাই চিৎকার করে উঠে) 

নছর

আল্লারে। আর রক্ষা নাই। হার্মাদ্যা ডাকাতের হাতে এইবার বুঝি জান যায়। হুঁশিয়ার। খুব হুঁশিয়ার।

গায়েন

দূরে থাকি ডাকুর দল দুরমি ধরি চায় 

দেখিয়া নছর মালুম করে হায় হায় । 

আইল আইল ডাকু কালা জংগি পরি 

কারো গায়ে লাল কোর্তা মাথাতে পাগড়ি । 

ছলুপে উঠিয়া ডাকু দেখ কিনা কাম করে 

নছর মালুমরে প্রথম গলা চাবি ধরে। 

গলা চাবি ধরি পরে মারিল চোয়াড় 

খোলের মুখে পড়ি নছর করে হাহাকার। 

নছরের সাঙ্গ পাঙ্গ আরও যত মাল ছিল 

সবারে বান্ধিয়া ডাকু মোকামে চলিল। 

(ডাকাতেরা সবাইকে বেধে দিয়ে যাচ্ছে)

 

 

আমিনা সুন্দরী নাটক : ২য় পর্ব

আমিনা সুন্দরী নাটক - এস এম সোলায়মান

 

প্রযোজক দল : ঢাকা পদাতিক

প্রদর্শনীর স্থান : মহিলা সমিতি মিলনায়তন, ঢাকা

কুশীলব

আমিনা সুন্দরী : রীমা রফিক

বাবা : মনসুর আহমদ

মা : তনু সাহা

এছাক সদাগর : এস এম সোলায়মান / পার্থসারথী রুদ্র

নছর মালুম : মাসুম আজিজ

এখিন : প্রতিভা

মাফো : স্বপন সৈয়দ/লিংকন 

মোহান চান : জহির আহমদ।

ভোলা : শেখ শানে মওলা

হাবা :  দেবাশীষ ঘোষ

মনাফ কাজী : খন্দকার তাজমিনুর 

কোরাস : বিজনকান্তি ধর, লিটন, পানু, জোয়ারদার, সোহেল আহমদ, মোহাম্ম গিয়াসউদ্দিন

কলাকুশলী

মঞ্চ ব্যবস্থাপনা : এনায়েত দাউদী

মঞ্চ ও আলোকসজ্জা : আমিনুর রহমান আজম

পোশাক : রোকেয়া রফিক বেবী, ফেরদৌসি হাবিব চিঠি, হাবিবুর রহমান

শব্দ : জাহেদ হোসেন

সমন্বয়কারী : গোলাম কুদ্দুছ

 

আমিনা সুন্দরী ২য় পর্ব
আমিনা সুন্দরী ২য় পর্ব

 

আমিনা সুন্দরী ২য় পর্ব

গায়েন

শুন এইবার অন্যদিকে কি কাম হইল 

আমিনার ধর্ম পিতা মোহন মারা গেল। 

হায় হায় করে কইন্যা বুকে চাপড় মারি 

কন্ডে গেলগই ধর্মের বাপ আমায় একলা ছাড়ি

[আমিনা সুন্দরী ২য় পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

আমিনা

আমি দিন দুঃখিনী অভাগিনী 

কেউ না লইল খবর, 

পন্থের আশায় চাইয়া রইলাম 

সারা জীবনভর। 

দেখতে দেখতে গেলরে কার্ডি 

দশটা বছর, 

মাও বাপে থাকতে বাঁচি 

না লইল খবর। 

ওরে মারি গেলওই ধর্মের বাপ 

তবু না আইল মোর যম, 

একবারও না লইল খবর

প্রাণের খসম ।

গায়েন

মাঝির গাও হইতে খবর পাইয়া এছাক 

আমিনার মার লগে করে ফুসফাস। 

বুদ্ধি ছল্লা করি বুড়ি কি কাম করিল 

সোজা ইছাখালির কুলে আসিয়া পড়িল। 

কান্দি কান্দি কয়রে বুড়ি কন্ডে মা আমিনা 

তোর এত দুঃখ কষ্ট পরাণে সয়না। 

আমার বুকে আয় দেখি মা কইলজা পুড়ি যায় 

যত দুঃখ অন্তরে তোর দিয়াম আঁই নিবাই।

আমিনা

মারে, এই বুকের জ্বালা কেমনে নিবাই। আইজ কতদিন পরে? কত মাস? কত বছর? আমারে ভুলি ছিলি মা কেমন করি? দশ মাস দশ দিন আমি কি ছিলাম না তোর গর্ভ ভরি? মনে আছে মা? জীবন। হায়রে সাধের মানব জীবন। কত কথা। কত স্মৃতি। শৈশবের কত ঘটনা । মনে কি কিছুই পড়ে না? রান্দিয়া বাড়িয়া ভাত সাজাইয়া থালে, গেরাসে গেরাসে দিতি আমার গালে তুলে। খুশি হইতাম খাইয়া মারে খুশি হইতাম। খাইয়া । ক্যামনে ভুলি । আইজো ভাবি, আমি তো সেই বাপের বাড়িরই মাইয়া। 

মা

মাফ কর মা আমিনা। আমারে মাফ কর। তোর দুঃখ দিয়া—এই বুকে হাত দিয়া দেখ মা, সাইগরের উথাল-পাতাল ঝড়। দুই হাত তুলিয়া ভিক্ষা মাগি আল্লার কাছে এই অন্তরের দোয়া গিয়া পৌঁছুক যাদু নছরের কাছে।

 

আমিনা সুন্দরী ২য় পর্ব
আমিনা সুন্দরী ২য় পর্ব

 

গায়েন

বুড়ি রইল কন্যার ঘরে মন করি স্থির 

মাঝির গাঁও হইতে একদিন আইল মুসাফির। 

হায়রে দুনিয়াদারি কন্ডে পাইবা সুখ 

পাথরের মত দড় হইয়ে মায়ের বুক। 

জোরাজুরি করি তারে ডিঙাতে তুলিল

ঢেউয়ের তালেতে ডিঙা নাচিতে লাগিল । 

(ঢেউয়ের তালে নৌকা দুলছে। একই তালে আমিনার গান, বুড়ির হাসি)

আমিনা

আর আমারে মারিসনে মা

পরে মারে পরের ছেলে কেঁদে গিয়ে মাকে বলে 

সেই মা জননী নিষ্ঠুর হলে কে বুঝে শিশুর বেদনা

আর আমারে মারিসনে মা- 

গায়েন

না মানিল পোষ কইন্যা না মানিল পোষ

জাউরা সাপের মতো করে ফোঁস ফোঁস 

দেখিয়া শুনিয়া এছাক এক কাম করে

বুধা গুণীনেরে ডাকে আমিনার ঘরে। 

দোয়া তাবিজ করল কতো করল যাদু টোনা 

আগুনে পুড়িলে ভাইরে চিনা যায়রে সোনা।

(বুধা গুণীন এসে ঘরে ঢুকে। প্রথমে কাঠি দিয়ে আমিনার চার পাশে দাগ দেয়। মন্ত্র পড়ে গান গায়। সরিষার তেলে কলাগাছের ডগা ডুবিয়ে আমিনাকে পেটাতে থাকে) 

বুধা

বুঝছি। তারে জ্বিনে ধরছে। বহুত খতরনাক জ্বিন। ঐ ভুঁড়ি ক তোর নাম কি? ক। আরে কথা কয় না। নাম কি? নাম কি? তোর নামডা কি। নাম না কইলে মন্ত্ৰ পড়ি দিমু বোতলে ঢুকাই। এতবড় সাহস তোর? এছাকের মাল নিবি তোর দেশে ভাগাই । ক, কি নাম তোর? আলুম হালুম।

[আমিনা সুন্দরী ২য় পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

আমিনা

আমার জ্বিনের নাম নছর মালুম। (বুধা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে চোখে তেল দিচ্ছে)

বুধা

গোস্যা হইছি দ্বিগুন করিয়া। একই চোয়াড়ে দিয়ম দুনিয়া ছাড়াইয়া। আমার লগে ছল্লিবল্লি? আমি বুধা গুণীন । আমার মন্ত্রের জোরে কন্যাতো বটে, কন্যার মাও করে একিন ।

আমিনা

তাইলে তো ভালই । মায়ের উপরে দেন মন্ত্র চালাইয়া । সাজিয়া গুজিয়া বুড়ি করুক এছাকেরে বিয়া।

বুধা

চুপ। একদম চুপ। বুঝছি। তোমার গুমর হইছে ভারি। এত সাহস? তুমি বুধা গুণীনের লগে করমশকারি নাম কি? নাম কি তোর? কোন দেশের জ্বিন তুই? কোন দেশে ঘর? বুধারে অমাইন্য করি কর লড়ছড়। সরস্বতী মা বন্দি জুড়ি দুই হাত। কামরুক কামাইখ্যার গুণে আইলাম সভাত। এমন বেতাইল্যা জ্বিন করে উল্টা গান। কৃপা করি মান রক্ষা কর রহমান। এই শেষ বারের মতন দিলাম হুঁশিয়ারি। ক, নাম কি তোর। সত্য না কইলে দিয়াম বোতলে ভরি। 

আমিনা

এক সইত্য লড়েচড়ে, দুই সত্য হুম। তিন সত্য নাম বলে নছর মালুম। (বুধা সম্মোহিত করার চেষ্টা করছে)। 

 

বুধা

পায়ের রক্ত মাথায় উঠি লড়চড় করে। শেষ মন্ত্র চালাই দিলাম জানিয়া অন্তরে। কামরুক কামাখ্যার গুণে যদি থাকে কেরামতি। বাপের বেটা বুধা আমি বাইন্যা গুণীর নাতি । এই মন্ত্র যারে ইচ্ছা তারে চাপি ধর । যার মনে যারে লাগে করো তার  কইরা। ছদর বদর কবি ছদর বদর। বড়র বড়র করি বড়র বড়র। শেষ মন্ত্র দিলাম ছাড়ি যাবে ইচ্ছা ধর।

(বুধা গুণী দ্রুত মন্ত্র পড়ছে। সম্মোহিত হয়ে এছাক এবং মা বারবার পরস্পর পরস্পরের দিকে ছুটে যাচ্ছে। এই ফাঁকে আমিনা পালিয়ে যায়)

গায়েন

না মানিল পোষ কন্যা না মানিল পোষ

জাউরা সাপের মতন করে ফোঁস ফোঁস ।

বুধা ওঝার গুণগান ঝুটা হইয়া গেল 

বরবাদ হইল কত মন্ত্র পড়া তেল। 

তার পরেতে কি হইল শুন বিবরণ 

গাঙের পারে আইল কইন্যা না রাইখবে জীবন। 

ঘাটেতে আসিয়া কইন্যা কান্দিয়া উঠিল 

আমারে ছাড়িয়া নছর কোন পন্থে গেল। 

সাত পাঁচ ভাবি কইন্যা কি কাম করিল 

ধীরে ধীরে গাঙের জলে নামিতে লাগিল। 

এমন সময় আসে এক সদাগরের ডিঙা 

ডিঙা তো নয় যেন বনের দস্যু ফিঙা। 

সেই ডিঙায় সদাই করে ভোলা সদায়গর 

আমিনা সুন্দরীর উপর পড়িল নজর । 

কন্যারে দেখিয়া ভোলা পাগল হইল 

মাঝি মাল্লা ডাকিয়ারে ছল্লা যে করিল ।

আমিনা

(গান) হায়রে এ কোন জ্বালা সইতে নারি মানব জীবনে 

আমার মনের মানুষ রইল কোথায় মানে না যৌবনে

গায়েন

নসিবের দুঃখ হায়রে খণ্ডন কে করে 

আমিনারে লুডি লইল ভোলা সদাইগরে। 

চঞ্চল চপলা ডিঙা হুংকারিয়া যায় 

ডিঙায় পড়িয়া কন্যা করে হায় হায় । 

এইখানে শুন সবে শুন বিবরণ 

নছর মালুমের কথা করিব বর্ণন। 

সেই না ছলুপ আর ছিল যত মাল 

বেচিয়া পাইল ডাকু টাকা টালে টাল। 

সাহা নামে ছিল এক নামী সদাই গর 

তাহার বাড়িতে নছর হইল নফর । 

হার্ট করে বাজার করে বোঝা লইয়া আনে 

ছোড নৌকা লইয়া নছর যায় নানা স্থানে। 

সুবুদ্ধি আসিল তার কুবুদ্ধি হইল 

সেই নৌকা লইয়া নছর সাগরে ভাসিল।

নছর

(গান) আর কতকাল ভাসব আমি দুখের সারি গাইয়া

জনম গেল ঘাটে ঘাটে আমার ভাঙ্গা তরী- 

বাইয়ারে আমার ভাঙ্গা তরী বাইয়া,

পরের বোঝা বইয়া বইয়া নৌকা গুলই গেছে খ‍ইয়া রে

গায়েন

এইভাবে চারিদিন পার হইয়া গেল

ঢেউ এর বাড়ি খাইয়া ডিঙা চলিতে লাগিল। 

পেডত নাই দানা পানি আছে অনাহারে

অবশেষে পৌঁছিল আসি অভি শহরে

(নছর এসে এখিনের বাড়িতে ঢোকে)

নছর

এখিন, কইলো কইন্যা এখিন সুন্দরী, দরজাড়া খোল। আমি নছর মালুম। বেবাক সাইগর পাড়ি দিয়া আইলাম তোমার কাছে। চাইর চাইরডা দিন পেডত দানা পানি পড়ে নাই। কই গো, দরজাড়া খোল। এখিন ও এখিন (গলায় দড়ি বাঁধা একজন হাবা দরজা খোলে )

 

 

আমিনা সুন্দরী ২য় পর্ব
আমিনা সুন্দরী ২য় পর্ব

 

নছর

তুমি কেডা ভাই?

হাবা

আমি? আমি না এই বাড়ির জামাই।

নছর

কি? তুমি এ বাড়ির জামাই। তোমার মাথা ঠিকঠাক আছে তো। তুমি কেমনে অইলা এ বাড়ির জামাই কওছাই মোরে?

[আমিনা সুন্দরী ২য় পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

হাবা

যাহ! আমার শরম করে।

নছর

শরম। কিসের শরম?

হাবা

যাহ্। আবার বলে কিসের শরম। আমি না খসম ? 

নছর

বুঝছি তোমার নাট বল্টু সব ঢিলা। তোমার এ অবস্থা ক্যান। গলায় বুঝলে রশি। ফাঁসি খাইবা নি ফাঁসি? 

হাবা

ও তুমি বুঝি আমার গলার রশির কথা কও কিল্লাই খাইতাম ফাঁসি? গলার রশির মানে, আমার বউয়ে কয় ভালোবাসাবাসি।

নছর

বুঝছি।

হাবা

বুঝছ’ কি বুঝছ? কিছু বোঝ নাই। এই দিকে আইও। কানে কানে একটা কথা কই। আমি না আমার বউয়ের ছয় নম্বর খসম গত দুই বছরে হে পাঁচখান বিয়া করছে। মগর আমি ছাড়া হের একটা খসমও টিকে নাই। দুই এক মাস ঘর করি ইরা বেবাকে গেছে চাড়িগা পালাই। হেই ডরে বউয়ে আমার গলায় দিছে দড়ি। যাতে আমি হেরার মতন চাড়িগা পলাই যাইতে না পারি, আমার কোনো দুঃখ নাই। খাই দাই হাসি খেলি বেশ আছি।

নছর 

তুমি কি মিঞা? মানুষ না খবি?

হাবা

ডামিস।

নছর

কি?

হাবা

বেবাকে আমারে ডাকে বার্মার ডামিস। 

মোথায় ভূড়ি নিয়ে এদের প্রবেশ) 

এখিন

ওরে বাপরে কি রইল । ঘামে গোসলের কাম সারা। আমার বার্মার ডামিস ই ঘরে আছে তো? আহারে যাদু আমার কি? ক্ষিদা লাগছে? পাড়ার আগে হাত মুখ ধুই আসি। হেরপর গলার রশি খুইলা দিমু। ওমা। এত শরমার ক্যা। এত শরম দিল কেডা? 

হাবা

এ্যা। শরম পামু না। ঘরের সামনে একডা আলগা বেড়া।

এখিন

কেডা?

(নছর এবং এখিন পরস্পর নীরবে তাকিয়ে আছে) 

নছর

এখিন, অমন কইরা চাইয়া দ্যাখ কি? আমারে চিনতে পারলা না? আমি নছর মালুম। 

এখিন

হ! তুমি নছর মালুম। আমার জীবনের পরথম খসম তোমারে চিনুম না? তা আমার এইখানে কি চাই? 

নছর

কি চাই মানে? এখিন আমি নছর মালুম।

এখিন

হ হ। তুমি নছর মালুম। আমার সাধের খসম । কই আছিলা গত দুই বছরে? নতুন ফুলের খোঁজে? নাকি আগের বউয়ের কাছে? নিশ্চই তার কাছে করছ পত্যয়- তুমি ছাড়া এ জীবনে আর কেহ নয় ।

নছর

আমারে ভুল বুইঝনা কইন্যা। গত দুইডা বছর এ জীবনে যে কত ঝড় ঝাপটা গেছে সেইডা শুনলে-

এখিন

শোনাইতে চাও? শোনাও গিয়া নিজের মাইনসের কাছে। 

নছর

আমার নিজের মানুষতো তুমি ।

এখিন

ও। আমি তোমার নিজের মানুষ? আর আমিনা সুন্দরী?

নছর

আমিনা সুন্দরী, কার কাছে শুইনলা এই নাম?

এখিন

তা জাইন্যা তোমার কি কাম। তোমরাতো পুরুষ তাই না? বড় আরামের জীবন। চরিবড়ি খাইবা । ঘাটে ঘাটে বিয়া কইরবা। তোমাগো বেলায় কৃষ্ণ লীলা। যত দোষ শুধু মাইয়া মাইনষের বেলা। যাও নিজ ঘরে যাও। আমিনা সুন্দরীর মনে আর না বাড়াইও ঘাও ।

নছর

আমিনা সুন্দরী। অই অসতী মাইয়া মানুষের নাম আর মুখেও নিমু না। 

 

আমিনা সুন্দরী ২য় পর্ব
আমিনা সুন্দরী ২য় পর্ব

 

এখিন

অসতী না? আর তুমি? তুমি কিয়ের সতীসাধ্যি পুরুষ ছনি? মাইয়া মানুষরে একলা থুইয়া নানান ফুলের মধু খাইবা । খাইলো কি খাইলো না তার খোজ খবরও নিবা না। তার কাছে আবার সস্তিপনার আবদার। এই রকম আবদারের মুখে ঝাড়ার বাড়ি। দাগাবাজ জাতি তো তোমরা মাইয়া মানুষের দুঃখ বুঝবা কেমনে?

নানান জায়গায় ছড়িবড়ি এখন আবার আমার কাছে আইছ। কি আমার সতীসান্ধি পুরুষ রে। তোমার পরে আরো চারজন দাগা দিয়া ভাগছে। এখন এই আমার সব। মাইনষে কয় বার্মার ডামিস। বুদ্ধিসুদ্ধি নাই। তাই খাইখাই ভাবও নাই। গলায় রশি বাইন্ধা কাজে কাম যাই। পুরুষতো তাই বিশ্বাস নাই। যদি হেও ভাগি যায়? হইছে। যাও, যদি ভাল চাও তো নিজের মাইনষের কাছে যাও।

[আমিনা সুন্দরী ২য় পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

নছর

ভিংজা জাতি হইলা তোমরা গলাত দিব ছুরি।

অভি শহর থাইকা এখন পালাই তাড়াতাড়ি।

এখিন কন্যা তোমার না চাইব মুখ 

অসম লইছ শুনি আমার ভাঙি গেলওই বুক। 

আৰু নাই ইজ্জত নাই দিলেতে দরদ 

ভিন্ন নাহি ভাব তোমরা বেগানা মরদ।

গায়েন

এইখানে বার্মার কথা হইল সমাপন 

আমিনা সুন্দরীর কথা বলিব এখন । 

লুটিয়া নিয়াছে তারে ভোলা সদাই গরে 

নানান রঙের কথা বলি ভুলাইতে চায় তারে।

ভোলা

শোনরে সুন্দরী কন্যা শোনরে খবর 

তোমারে নিয়া যাইয়ুম মুরালী নগর।

আমিনা

কোথায় গেল নছর মালুম আমার প্রাণের ধন 

কেন না হইল হায়রে আমার মরণ 

তোমার বিহনে বন্ধু না ধরিবে ফল

এক নারীর জীবনে হয় কত হাতবদল? 

ভোলা

আমিনা সুন্দরী । তুমি বুঝি নছর মালুমের কথা কও। নছর মালুম হেরে তো আমি চিনি । 

আমিনা

আপনি তারে চেনেন? সত্য কন? কোথায় আছে কেমন আছে পরাণের অসম

ভোলা

আহারে নছর মালুম, বড় ভালা মানুষ আছিল। এরেই কয় কপালের ফের। ভালা মানুষ বেশি দিন দুইন্যায় থাকে না।

আমিনা 

কি কন এই সব? কি অইছে আমার নছরের?

ভোলা

সে দুঃখের কথা বলি লাভ কি? আইজ খুনে দুই বছর আগে হাছিলি বন্দরে হে কলেরায় মারা গেছে। মারা যাওনের আগে আমার দুই হাত ধরি বহু অনুরোধ করছে, যাতে তোমার খোঁজ খবর নিয়া একটা ব্যবস্থা করি। সেই থেইক্যা পন্থে পন্থে তোমারে কত তালাশ করছি। যাইক, আল্লার বহুত মেহেরবানি। শ্যাষ ম্যাশ তোমারে পাইলাম। কোনো চিন্তা করিও না। আমার ঘরে তোমার কোনো অযত্ন হইবো না।

 

আমিনা সুন্দরী ২য় পর্ব
আমিনা সুন্দরী ২য় পর্ব

 

আমিনা

অসম্ভব। আমি বিশ্বাস করি না।

ভোলা

কি বিশ্বাস কর না?

আমিনা

আমার নছর মরে নাই। মরতে পারে না। 

ভোলা

আমি নিজের হাতে তারে মাডি দিয়া আইছি। আর তুমি কও হে মরে নাই

আমিনা

কোন অমঙ্গল যদি হইত পতির মোর

মলিন হইত মোর মাথার সিঁদুর। 

বুকের মাঝে ধুপ ধুপ কৈত্তরে পরাণ 

অমঙ্গল হইলে মোর কাঁপিত নয়ান।

ভোলা

অয় মেলা অই গেছে। এখন তুমি ঘুমাও। বিয়ানে উঠি আমি তোমারে বুঝামুনে আমার কথা বিশ্বাসই যখন করলা না, তখন আর কি করা। ঠিক আছে। রাইত মনে নছর মালুম মরছে নাকি মরে নাই। যাও। ঘুমাও।

[আমিনা সুন্দরী ২য় পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

গায়েন

ডিঙা খানি বাঁধা ছিল চরের কিনারে

মাঝিমাল্লা ঘুমাইতেছে নাক ডাকে আর ছাড়ে। 

ধীরে ধীরে আসে ভোলা ধীরে বাড়ায় পা 

চমকি চমকি হায়রে গরম হই যায় গা। 

আকাশ-পাতাল ভাবে কইন্যা চোখে নাইরে ঘুম 

ভোলার বজ্জাতি তার হইল মালুম। 

এমনিকালে ভোলারে দেখি বড় ডর পাইল 

বাঘের কামড়ে যেন হরিণী পড়িল ।

আমিনা

পর পুরুষ এখন তুমি ন ছুঁইও মোরে 

যাহা চাও তাহা দিব নিকা অইলে পরে।

ভোলা

বল বল বিবিজান মোর বাইর হই যায় জান

হাতের লাগাত পাইয়ম কখন আসমানের চান।

আমিনা 

আমার কথা রাইখবা বলি করহ কসম

তারপরে তোমার কাছে খুলি দিয়ম মন।

ভোলা 

তাই হইবে আমি তোমার হইলাম গোলাম

তুমি যাহা বল আমি মানিব এখন ।

আমিনা

শোন তবে মন দিয়া ভোলা সদাইগর 

আমার কাছে না আসিবা তুমি বার মাসের ভিতর। 

ইহার অন্যথা হইলে করি বিষ পান 

করাল করিলাম আমি না রাখিব জান।

শোন শোন সদাইগর তোমার কাছে কই । 

ইদ্দত পালিব ক মাস আমি খোদার নাম লই।

গায়েন

এমনি কালে শোন খবর কি কাম হইল 

চাড়িগার পথে নছর পায়ে হাঁটা দিল। 

অরাকান পার হইয়া নাফ নদীর পরে 

একদিন আসিয়া পৌঁছে মাঝির গাওয়ের পরে। 

কিসের ধন কিসের দৌলত কিসের সদাই গরি 

কন্ডে গেলগই আমার সাধের আমিনা সুন্দরী। 

সব কিছু ছাড়ি নছর পথের ফকির হইল 

তার লাগি আমিনা কত কষ্ট পাইল

নছর

(গান) কান্দো কেনে মন কান্দিয়া কান্দিয়া যাইব 

তোমারও জীবন রে কান্দো কেনে মন পাগলারে। 

প্রাণও কান্দে মন ও কান্দে বন্ধুরও লাগিয়া 

দ্যাশের বন্ধু বৈদেশ গেল আমারে ছাড়িয়া রে।

গায়েন

দেখতে দেখতে বারো মাস দেখ পার হইয়া গেল 

আমিনা সুন্দরীর এবার মাথাতে বাড়ি পড়ল 

হেনকালে দুষ্টু ভোলা আমিনার ঘর গেল। 

তাই দেখি আমিনার মরার জো হইল। 

মুখেতে সুগন্ধি পান দাড়িতে লাগায় আতর

ধীরে ধীরে আসি ভোলা পশিল ঘরের ভিতর।

ভোলা

আহ্হারে। আইজ বারডা মাস পরে তোমার আমার দেখা। কেমন ছিলাগো কইন্যা আমিনা সুন্দরী। পশ্চিম দিকে চাহিয়া দেখ, আহা কি সুন্দর বিকাল। একটু পরেই সূর্যটা কুটুস কইরা ডুব মাইরবো। লগে লগে বার মাস কাবার। আমি হইয়াম তোমার আর তুমি হইবা আমার।

আমিনা

সদাইগর। তোমার কাছে আমি মাপ চাই। বারডা মাস নিজের লগে নিজে অনেক যুদ্ধ করছি। মনের কাছে জিগাইছি মনের খবর। সেইখানে তোমার জায়গা নাইরে সদাইগর। মনবিহীন এ শরীল । শরীল দিয়া কি করবা তুমি? আমারে মাফ কর। আমি তোমারত লগে বিয়া বইতে পারুম না।

 

আমিনা সুন্দরী ২য় পর্ব
আমিনা সুন্দরী ২য় পর্ব

 

ভোলা

এইসব তুমি কি কথা কও? জবান দিছ জবান রাখবা। বারডা মাস তোমার অপেক্ষায় থাকি থাকি শরীর জ্বালাই ফেলছি, আর তুমি কও উল্টাপাল্টা কথা।

আমিনা

তুমি আমারে আরো ছয়টা মাস সময় দাও ।

ভোলা

আর একটা মিনিটও আমি তোমারে সময় দিতে পারুম না। কাল সকাল বেলায় আইবো কাজী। সরামতে বিয়ার কাম সারি তারপর-

আমিনা

আমারে আর তিনটা মাস সময় দাও সদাইগর। জোর করি বিয়া করি লাভটা কি। মাটি ছাড়া শিকড় আর শিকড় ছাড়া গাছ। খুসবো ছাড়া ফুল যেমন পানি ছাড়া মাছ । এমন মাইয়া মানুষেরে বিয়া কইরা তোমার কি লাভ?

[আমিনা সুন্দরী ২য় পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

ভোলা

চুপ। আর একটা কথাও কবি না। অনেক সহ্য করছি। আর না। তেড়িবেড়ি কইরলে এইবার মাথাত দিয়াম বাড়ি। বারমাসের করাল করি এখন মস্কারি? আমি এক কথার মানুষ। একবার যখন মন খুইলা কইছি, তখন তাই সই। কাইলকা সকালে তোমারে করিয়াম শাদি। অন্যথা তোমার বাড়িবে দুর্গতি।

গায়েন

এমনি কালে এক ফকির ছেঁড়া তেনা পিন্দা 

কান্দিয়া কান্দিয়া আসিল বাজাইলো সারিন্দা

ভাল করি চাহি কন্যা চিনিতে পারিল 

দোন চোখের পানি তার টলমল হইল।

আমিনার অনুরোধে ভোলা সদাইগর 

ফকিরারে থাকিবারে দিল এক ঘর।

ভাত পানি খাই নছরে করিল শয়ন 

চোখে নাই ঘুম তার মন উচাটন। 

রাত্রি নিশাকালে আমিনা কি কাম করিল। 

ফকিরার দুয়ারেতে গিয়া হাজির হইল। 

কেবারেতে টুকা দিল সাড়াশব্দ নাই। 

সাত রাজ্যের কথা ভাবি পড়িছে ঘুমাই। 

দুয়ার খুলি দাওনা বলি আবার দিল নাড়া 

ধীরে ধীরে নছর মালুম দুয়ার খুলি খাড়া

(দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে)

নছর

তুমি? তুমি এইখানে? এইডা কি করি সম্ভব আমিনা সুন্দরী? আমিতো ভাবছিলাম এ জীবনে আর তোমার আমার দেখা সাক্ষাৎ হইবো না। 

আমিনা

দশ দশটা বছর আমি তোমার আশায় আশায় দিন কাটাইতেছি। কেমন মানুষ তুমি? একবারও কি মনে পড়লো না আমার কথা। পারবা? পারবা ফিরায়া দিতে আমার জীবনের দশটা বছর? 

নছর

আমারে মাফ কর কইন্যা। না বুঝিয়া তোমায় অনেক দুঃখ কষ্ট দিছি, গত ছয় মাস ধইরা সে ভুলের মাসুল গুনতেছি। কিন্তু তুমি এই জায়গায় কেমন কইরা?

আমিনা

বার মাস কাটাইয়াছি দুষ্ট ভোলার ঘরে

নানান ছলনায় বুঝাইয়াছি তারে, 

তোমারে বলিতে আমার বুক ফাড়ি যায়

নিকার দিন ঠিক করছে কাইল শুক্রবারে।

নছর

এইডা কি মগের মুল্লুক নি? এত বড় সাহস? এক জনের বিয়া করা বউরে জোর কইরা বিয়া করবো? আমার লগে চল, দেহি সে কত বড় বাপের বেটা।

আমিনা

আস্তে কথা কও। আমারে চব্বিশ ঘণ্টা পাহারায় রাখছে যাতে পলাইয়া যাইতে না পারি। হুন। এই ভোলা সদাইগর বহুৎ ক্ষমতাশালী। লাঠালাঠি কইরা তার লগে কুলাইতে পারবা না। তার চাইতে এক কাম কর। এই দেশে কাজী আছে। চাইর দিকে তার সুনাম। ঈমানদার মানুষ। তার কাছে নাকি যে গেছে হেই সুবিচার পাইছে। মুনাপ কাজী নামে তারে এক ডাকে সবাই চেনে। সকাল অইলেই তুমি তার কাছে গিয়া বিচার দাও। কাউয়া ডাকে, কেউ জাননের আগেই আমি ঘরে যাই।

নছর

তোমারে একটা কথা জিগাই কইন্যা। দশডা বছর তো আর কম সময় না। তোমার সস্তিপনা বজায় আছে তো?

(আমিনা তীব্র ঘৃণা নিয়ে নছরকে দেখে)

আমিনা

যদি বলি না। তাইলে? আমার দশটা বছরের কাছে তোমার শুধু এইটাই প্রশ্ন। আর কিছু না? ও তুমিতো পুরুষ। হাহ্। পুরুষ। (চলে যায়) 

[আমিনা সুন্দরী ২য় পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

গায়েন

এই না বলিয়া কইন্যা ঘরে চলি গেল

নছর উঠি মুনাপ কাজীর বাড়ি চলি গেল ।

মুনাপ কাজী নাম ডাক করে সুবিচার

এই বছর নব্বই বছর বয়েস হইল তার। 

এক ঠেং দুনিয়াতে এক ঠেং কারে 

মনে বড় দুঃখ তার বিবি নাইরে ঘরে। 

বরিষার পানি যখন চালের উপর পড়ে 

গা গরম হই মুনাপ কাজী খাম্বা বেড়াই ধরে। 

(বৃষ্টি হচ্ছে, চঞ্চল চিত্তে মুনাপ কাজীর গান) 

মুনাপ

ঝড় পড়েরে লোছা লোছা উজান ভাঙে কই 

এমন বরিষার কালে থাইকুম কারে লই 

আউল হইয়ে যতনে মাছ মেঘের পানি খাই 

খাইল্যা ঘরে কেমনে আমি মনেরে বুঝাই । 

বৃক্ষ যদি হইলো কন্যা তুমি হইও লতা 

চুপি চুপি নিরালে বই কইবো মনের কথা । 

(তবলা ও হারমোনিয়ামের যুগলবন্দি )

গায়েন

এই না দেশে বিচার করে বুড়া মুনাপ কাজী 

সকালে নছর মালুম দিল তারে আর্জি। 

আর্জি পাইয়া মুনাপ কাজীর রাগ হইল ভারি 

ভোলারে ধরিয়া আনতে পরনা করল জারি 

পাইক পেয়াদা ধরি আইনল ভোলা সদাই গরে 

মুখের ধোয়া ছাড়ি কাজী তাহারে পুছারে।

মুনাপ

ভোলা সদাইগর। তোমার বিরুদ্ধে এই ফকিরা আমার কাছে আর্জি দিছে।

ভোলা

হুজুর। আমার বিরুদ্ধে আর্জি? আমি তো কিছুই বুঝতেছি না ।

 

আমিনা সুন্দরী ২য় পর্ব
আমিনা সুন্দরী ২য় পর্ব

 

মুনাপ

তা বুঝবা ক্যামনে? পিডের উপর যহন বাড়িড়া পড়বো তখন তুমি ক্যান তোমার চৌদ্দ গোষ্টিসহ বুঝবো ।

ভোলা

ফকিরা আমার নামে আপনার কাছে কি আর্জি দিছে হুজুর? 

মুনাপ

তুমি নাকি তার বউরে আনিছ লুডিয়া। এখন আবার জুলুম করি কইরবা তারে বিয়া । 

ভোলা

মিছা কথা। খাস মিছা কথা হুজুর। এই ফকিরা নিশ্চয় পাগল। তার বউরে আমি ক্যামনে পাইলাম নাগল। ঘরে ঘরে যাই বেডা সারিন্দা বাজায় সুন্দর বউ দেখলে তারে ফুসলাই লই যায়।

মুনাপ

কি মিয়া। ভোলা সদাইগর তো অস্বীকার করে।

নছর

হুজুর। আমার বউ এখনো তার ঘরে আটক আছে। আপনি তারে এই দরবারে আনি জিগাই দ্যাখেন, কে হের সোয়ামী। তাইলে তো পেরমান হাতে হাতে পাইবেন ।

মুনাপ

শোন শোন শোন ওরে ভোলা সদাই গর 

বিবিজানরে লইয়া আস আমার গোচর। 

তোমার বধু হইলে তুমি পাইবা হদে হদে

ফকিরারে দিয়ম আমি সাত বছর কয়ে

(ভোলা চলে যায়)

মুনাপ

তা বিবিজানের নামডা কি?

নছর

আমিনা সুন্দরী।

মুনাপ

আমিনা সুন্দরী। কেমন সুন্দরী কও চাই।

নছর

জি হুজুর?

মুনাপ

আরে বেটা এই যে কইলি সুন্দরী। সে কি নামে? নাকি কামে। বুঝস নাই? বিবিজানের বয়স কত?

নছর

বাইশ বছর।

মুনাপ

বাইশ বছর? তার মানে এখনও কচি ডাব কি কও। ফর্সা?

নছর

জি হুজুর।

মুনাপ

বাহ্ । বাহ্। চেহারা সুরত নিশ্চই টসটসা?

নছর

জি

মুনাপ

টোকা দিলেই রস একদম টেবাই টেবাই পড়ে। ঠিক কইছি না? উহুহুরে

গায়েন

পালকির মাঝে করি তবে ভোলা সদাইগর

আমিনারে লইয়া আইল মুনাপ কাজীর ঘর। 

পালকি হতে বাহির হইল বিজলীর কণা

আমিনারে দেখিয়া কাজীর পরাণ তো মানে না।

মুনাপ

তোমার নাম তাইলে আমিনা সুন্দরী। শোন, আমার বিচারে আছে বিশেষ নিশানা। বিশেষ করি সে যদি হয় জেনানা। মাথার ঘোমটাড়া খোল দেখি মা। বাহ্। শুধু নামে না। তুমি কামেও সুন্দরী। দেখি মা তোমার চুলের গোছা মারহাবা মারহাবা। এইবার চোখ তুইল্লা তুমি আমার দিকে দৃষ্টি দিয়া দেখ। মুখডা তোল। এ্যা এ্যা। (গুণ গুণ করে গান গায়) এইবার বলতো দেখি মা ছাড়িয়া শরম, এই দু’জনার মধ্যে কে তোমার খসম ।

[আমিনা সুন্দরী ২য় পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

আমিনা

হুজুর । এই মানুষটাই আমার খসম আজ দশটা বছর কত ঝড় ঝাপটা সহ্য কইরা এই মানুষটার জন্য নিজেরে বাঁচাইয়া রাখছি। আজ থেইকা বার মাস আগে দুষ্ট ভোলা আমারে জোর কইরা নদীর ঘাটথুনে লুট কইরা আনছে

মুনাপ

হারামজাদা। তোর এতবড় সাহস। বেগানা মাইয়া মানুষের গায়ে হাত। 

 

google news logo

 

আমিনা

আপনে আমার ধর্মের বাপ, করেন বিচার। হুজুর, মায়ের চক্রান্তে বাড়িঘর ছাড়ি জায়গায় জায়গায় পলাইয়া রইছি। মাঝখানে এছাক নামের এক তস্করের হাতে কত গগুণা পাইছি। এই জীবনে যত দুঃখ পাইছি হুজুর পুরা একদিন বইল্যাও তা শেষ করা যাইব না।

মুনাপ

চিন্তা কইরো না কইন্যা। তুমি আর দুঃখ পাইবা না। সারা জীবন আমি তোমারে দিয়াম সান্ত্বনা। খাড়াও বিচারের রায় খান দিয়া দি পরনারী অপহরণের অপরাধে ভোলা সদাইগরের সাত বছর কয়েন। (আমিনাকে ধরে) চল।

আমিনা

কই যামু হুজুর? 

মুনাপ

আমার লগে।

নছর

আপনার সুনামের কথা বহু শুনছি। আইজ নিজের চোখে দেখলাম। আল্লাহ আপনারে আরো হায়াত দরাজ করুক। এইবার আমি বউ নিয়া বাড়িত যাই। মাঝির গাঁও। সে হুজুর মেলা দূরের পথ। 

মুনাপ

কই যাইবা? বিবিজানরে নিয়া বাড়ি যাইবা? 

তোমার যোগ্য নয় এই বিবি তোমার যোগ্য নয়, 

কুত্তার পেড়ে ঘিয়ের ভাত বদহজম হয় শো

নরে শোনরে ফকিরা শোন মোর কথা 

তোমরা খায় ফুলের মধু পোকে খায় পাতা। 

তোমার যোগ্য নয় কইন্যা কহিলাম সার

আর একজনে লুডি নিলে আসিবা আবার। 

তোমার লাগি বারে বারে কে করে হাংগাম 

পইত্যেক দিন এজলাসে আছে আমার কাম। 

আমার ঘরে থাকুক বিবি সুখে খাই ভাত 

সোনার পালঙ্ক মাঝে শুইব দিন রাত।

গায়েন

কাঁদিতে কাঁদিতে নছর বুকে মারে কিল 

পাথরের মত দড় মুনাপ কাজীর দিল 

পাইক পেয়াদা মুনাপ কাজীর ইশারা পাইয়া 

ধাবাই দিল ফকিরারে ধাক্কাইয়া ধাক্কাইয়া। 

নছিবের দুঃখ হায়রে কে খণ্ডাইতে পারে। 

আমিনা সুন্দরী কান্দে মুনাপ কাজীর ঘরে । 

দানা পানি না খাইল লইল বিছানা 

অসুখে পড়িয়া কইন্যা হইল তেনা তেনা ।

আমিনা

হায়রে নছিব। ললাটের লিখন না যায় খণ্ডন। আল্লার দুনিয়ায় কোন দোষ করছিলাম আল্লাই জানে। জীবন তো মানুষের একটাই । আজ আছে কাল নাই। তয় এত ডর লাগে ক্যান? দশ বছর পরে খসমের লাগে পরথম দেখা। আর কিছু না, প্রশ্ন একটাই। এই শরীলের সস্তিপনা বজায় ছিল তো? হায়রে শরীল, আর তোর সস্তিপনা। এর প্রতি মাইনষের এত লোভ? আইচ্ছা মরণের পরে কই যায় মানুষ? কেমন লাগে ঐ কব্বরে। একটা মানুষরে গোরে থুইয়া বেবাকে বাড়ির পন্থে পা বাড়ায়। কব্বর। ঘুটঘইটা আন্ধার কব্বর একা একদম একা একজন মানুষ।

তারপরে এক-দুই-তিন। বাড়তে থাকে দিন। শরীলটা আস্তে আস্তে ফুইলা ফাইটা মাংসগুলান ঝইরা ঝইরা পড়ে। হায়রে সাধের শরীল কিল-বিল করে পোকা। কি যে দুর্গন্ধ। মাটির নিচে বিভৎস মাংসের দলা। এখানে-ওখানে টুকরা টুকরা। হাওয়া বাতাস নাই। সাদা কাফন হাতছানি দিয়ে ডাকে আয় ফিরে আয় শেষ জীবনের যাত্রায়। হায়রে সাধের মানব জীবন।

গায়েন

আমিনা সুন্দরী কাজির ঘরে বিমারে পড়িল 

সোনার অঙ্গ মলিন হইয়া হাড়েতে মিলাইল। 

মনের আগুনে জ্বলি খানাপানি ছাড়ি

কখন হাসে কখন কান্দে মাথাত থাবা মারি।

কখন বকে কখন আবার বিলাপের গীত গায়

পাগল হইল হায়রে নানান চিন্তায়।

আমিনা

পারে লয়ে যাও আমায়। আমি অপার হয়ে বসে আছি ওহে দয়াময়। আইচ্ছা। ঐ যে শুকতারাটা। দূরে। কত দূরে? কত রাইত ঐ শুকতারার দিকে চাইয়া চাইয়া ভাবছি জীবনের কথা। এ কেমন জীবন? সোয়ামীর সস্তিপনার আবদার রাখতে গিয়া নিজের তো বার দশা করছি। আর হে? ঠিকই দশটা বছর গায়ে নানান কিছিমের বাতাস লাগইয়া ঘুরছে। আর আমি? আইজ বাদে কাল যখন মরুমই কয়দিন থাকবো শোকের আয়ু? কয়দিন? বড় জোর তিন মাস? হের পরে নওশা সাইজা আর এক সুন্দরীর সন্ধানে যাত্রা।

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment