আলাল দুলালের পালা নাট্যকার এস এম সোলায়মানের একটি বিখ্যাত নাটক। এই নাটকটির প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিলো ২ জানুয়ারি ২০০১। শেখ মোহাম্মদ সোলায়মান বা এস এম সোলায়মান একজন বাংলাদেশী অভিনেতা। তিনি ১৯৫৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মঞ্চ নাটক পরিচালনা করতেন এবং তাতে সঙ্গীত পরিচালনাও করতেন। তাকে বাংলাদেশের থিয়েটারের জগতে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৪ সালে একুশে পদক লাভ করেন তিনি।
আলাল দুলালের পালা ১ম পর্ব
প্রদর্শনীর স্থান : মহিলা সমিতি মিলনায়তন, ঢাকা
কুশীলব
সোনাফর দেওয়ান : মানিকচন্দ্র শীল
মা : সাবরিনা লিজা
আলাল (ছোট) : হৃদয় চৌধুরী
দুলাল (ছোট) : আরজুমান ইসলাম নান্টু
কথক : মঞ্জুরুল ইসলাম নান্টু
কইতর : আহসান হাবীব পলাশ/তুষার
কইতরী : সাবরিনা লিজা
উজির : বিজনকান্তি ধর
সতাই : রোখশানা পারভীন মনি
জল্লাদ : ফিরোজ হোসাইন
সেকেন্দার দেওয়ান : সামসুদ্দিন সবুজ
নতুন দেওয়ান : সঞ্জিত রায় শম্ভু
আলাল (বড়) : সাব্বির হোসেন মার্শাল
দুলাল (বড়) : সাবের আহমেদ শুভ
মদিনা সুন্দরী : বিলকিস নাহার স্মৃতি
আমেনা : সাবরিনা লিজা
মোমেনা : আরজুমান আরা পুষ্প
সুরুজ জামাল : হৃদয় চৌধুরী
যন্ত্রসঙ্গীত : হারমোনিয়াম – রাশেদুল হাসান বাবু
তবলা – প্রবীর পাল
বিশেষ যন্ত্রী : জাহিদ হাসান
কোরাস : মানিক, নান্টু, মার্শাল, স্মৃতি, লিজা, পুষ্প, পলাশ, তুষার, বিজন, মনি, ফিরোজ, সবুজ, সঞ্চিত, তুহিন, মোতালেব, শুভ, টিটো, বাবুল, প্রবীর, ফনিভূষণ, সুজন, পলাশ, টুটুল, শামিম, মাসুদ, ম্যামল, জাহাঙ্গীর, সরোবর, শিশির বাবু।
কলাকুশলী
নির্দেশনা : এস এম সোলায়মান
মঞ্চ, আলো ও কারিগরী নির্দেশনা : আমিনুর রহমান আজম
পোষাক পরিকল্পনা : অশোক কর্মকার
সহযোগী : হাবিবুর রহমান
মুখোশ ও বিশেষ পোষাক : কিরিটী রঞ্জন বিশ্বাস
মঞ্চ অধিকর্তা : কাজী সাব্বির হোসেন মার্শাল
প্রধান সমন্বয়কারী : গাজী জাকির হোসেন
প্রযোজনা অধিকর্তা : গোলাম কুদ্দুছ

আলাল দুলালের পালা ১ম পর্ব
(মঞ্চে উপবিষ্ট কোৱাস দল, শয্যাশায়িত দেওয়ানের স্ত্রী, দেওয়ান, আলাল এবং দুলাল।)
গান
সত্য করো প্রাণপতি, সত্য করো রইয়া,
আমি নারী মইরা গেলে না করবা আর বিয়া।
আমি অভাগীরে পিয়া, কই তোমার কাছে,
শিয়রে খাড়াইয়া যম, বাকি কয়দিন আছে ।
শরীল অইল মাটি মাটি, মুখে কালা ধরে,
দুই দিন পরে শইবাম কুয়ার করবরে।
ঘরে রইল আলাল দুলাল, তারা দুইটি ভাই,
অভাগী মায়ের আর কোনি লক্ষ্য নাই ।
শোন শোন ওহে দেওয়ান, কইয়া বুঝাই আমি,
দুধের বাচ্চা দুই না পুতে সপলাম অভাগিনী।
সাক্ষি থাইকো চান্দ সুরুজ, দুই নয়নের আঁখি,
তাহার হাতে সপ্যা গেলাম আমার পোষা পাখি।
কান্দিতে কান্দিতে মায়ের চক্ষে পড়ে কালি,
টান দিয়া বুকে লইল পুত্র পুত্র পুত্র বলি ।
মায়ের গান
সোনার কলি আলাল দুলাল, তারার দিক চাইয়া,
কথা দাও তুমি আর করবা না বিয়া।
সতিন বালাই কিয়া কই তোমার কাছে
এতিম ধনেরা মোর দুঃখ পাইব পাছে।
সতিনেরও ছাওয়াল কাঁটা সতাই মায়ে লাগে
সেই না কাঁটা তুলে সতাই সগলের আগে ।
শুন শুন পরান পতি মোর কথা রইয়া,
সতাইয়ের কিচ্ছা এক শোন মন দিয়া ।
কথক
হ্যাঁ শোনেন সবাই এক সতাইয়ের কিচ্ছা। কমল দিঘীর দক্ষিণ পাড়ে আছে এক দাড়াগ গাছ। তার ডালে বাসা বাইন্দা সুখে ঘর সংসার করতাইচুন এক কইতর আর কইতরি। চিত্ত সুখে নিত্যি তারা প্রেম আলাপনে সুখে দিন যায়। তারার দুঃখ নাই যে জানে। তো এইভাবে কিছু দিন যাওয়ার পর দুইখান ডিম রাইখ্যা কইতররে শোক সাগরে ভাসাইয়া কইতরি গেল মইরা। এখন কইতর পড়ছে মহা ফাপরে। উম না দিলে তো বাচ্চা ফুটব না।
কইতরের বাইরে যাওয়া বন্ধ। অনেক কষ্টে, অনেক যত্নে উম দিয়া কইতর বেটাই দুইখান বাচ্চা ফুটাইল। এখন তো আরেক বিপদ, বাচ্চার তো আদার লাগে। কইতরের নিজেরও খাওন লাগে ৷ কিন্তু ছোট দুইটা বাচ্চা বাসায় রাইখা কইতর বাইরে যায় কেমন কইরা সাত পাঁচ ভাইবা, কইতর বেটা শেষশেষ একখান বিয়াই কইরা ফালাইল। নতুন বউ কইতরিরে ডাইকা কইতর কয়
কইতর
আহা রে আমার সোনার বৌ টুনটুনি । ও কইতরি, যত দিন জীবন আছে আমারে সুখ দিবাম, শান্তি দিবাম, মন উজাড় কইরা ভালবাসা দিবাম।
কইতরি
আপনারে আমার খুব মনে ধরছে।
কইতর
আমারে তোমার মনে ধরছে, আমার বাচ্চাগুলোরে তোমার মনে ধরে নাই ?
কইতরি
হ্যাঁ তা ধরছে। তয় ।
কইতর
কইতরিরে, এরা আমার বড় দুঃখের বাচ্চা। ডিম রাইখা যখন কইতরি মইরা গেল, বহু কষ্টে তাগোরে আমি ফুটাইছি। এমনভাবে তুমি তাগোরে মানুষ করবা, যাতে তারা কোনদিন মনে কষ্ট না পায়। নিজের সন্তানের মত বুকে আগলাইয়া রাখবা চারা গাছ পানি দিয়া আগে বড় কইরে বড় হইলে মিঠা ফল সুখে খাইবা পরে ।
কথক
এই কথা বুঝাইয়া কইতর আদার আনতে গেল যে চলিয়া। কইতরি ভাবে মনে বাসাতে বসিয়া। বালাই সতীন গেছে রাইখা দুই কাটা। বড় হইলে আমার নছিবে মিলবে ‘ঝাটা। সতিনের বাচ্চা কবে বুঝছে সতায়ের সুখ। আখেরে আমার কপালে আছে বড় দুখ। সত্যই কইতরি বাচ্চাগুলার দিকে তাকায় আর ভাবে, ভাবে আর তাকায়।
মনে মনে কয় বাচ্চা আমারও অইব। তখন এই সতিনের বাচ্চারা অইব আমার বাচ্চার দুশমন। দুধ দিয়া কেউ কি কাল সাপ পালে? দুঃখ ডাকিয়া আমি না আনিরাম ঘরে, বালাই দূর করবাম আমি মারিয়া এবারে। কইতরা গেছে এখন আদারের লাগিয়া, আদার আনিলে খাইবাম দুইজনে মিলিয়া ।

গান
এই বলিয়া কইতরি কোন কাম করে,
গলাতে ধরিয়া ঠোঁটে আছড়াইয়া মারে।
দুই বাচ্চা মাইরা পরে জঙ্গলে ফালায়,
আদার লইয়া কইতরা বাসার পানে যায়।
কথক
তো সুধীজনেরা, বেচারা কইতরারে দেইখা কইতরি জুড়িল কান্দন । অবাক হইয়া কইতরিরে জিগায়, আরে বিবি কাল তুমি কিসের কারণ? তখন কইতরি কয়
কইতরি
প্রাণনাথ, তুমি তো আমারে বাচ্চার ভার দিয়া আদার আনতে গেলা। আমি বাচ্চা দুইভাবে বুকের মধ্যে লইয়া খালি আদর করতাছি তো আদর করতাছি। হঠাৎ চোখের সামনে দেখি এক গিরধিনী। তার হাতে ধরলাম, পায়ে ধরলাম, আমার কোন কইতর অনুরোধই সে রাখলো না। জোর কইরা দুই নয়নের মনিরে আমার সামনে আছড়াইয়া আছড়াইয়া মারিল । তারপর তাগো মৃত শরিল নিয়া উড়াল দিল আকাশে।
কইতর
কইতরি একি কথা শুনাইলা, তুমি আমারে? আমারে থুইয়া আমার ছেউরা বাচ্চারা কোন দেশে উড়াল দিল। কত কষ্ট পাইলাম হায়রে তারারো লাগিয়া, কোন পথে গেল তারা বুকে শেল দিয়া আগুন জ্বলিল হায়রে আমার অন্তরে, হায়রে দারুন ব্যথা চিত্তে নাই সে ধরে।
গান
এই না কথা বলিয়া পরে সেই তো না নারী,
মায়ের সংসার ছাইড়া তবে, গেল নিজ বাড়ি,
মন রে দিল ভব সাগর পাড়ি।
আওরাতেরও লাইগা কান্দে দেওয়ান সোনাফর,
আলাল দুলাল কাইন্দা কাইন্দা অইল জর জর ।
কান্দিয়া কান্দিয়া তারা ভূমিতে লুটায়,
দানা পানি ছাইড়া কেবল করে হায় হায় ।
মায়ে জানে পুতের বেদন অন্যে জানবো কি,
মায়েরও বুকের লৌ, পুত্র আর ঝি
দুই না ছেউরা ছাওয়াল বুকেতে করিয়া,
সোনাফর মিঞা কান্দে মাথা থাপাইয়া ।
মা মা বইলা যখন আলাল দুলাল কান্দে,
বুকেতে তাহার হায় রে শেল যেন বিন্দে।
আলাল দুলালের গান
মা আমার সাধ না মিটিল
আশা না পুরিল, সকলি ফুরায়ে যায় মা,
জনমের শোধ ডাকিগো মা তোরে,
কোলে তুলে নিতে আয় মা
সকলি ফুরায়ে যায় মা।
পৃথিবীর কেউ ভাল তো বাসে না,
এ পৃথিবী ভালবাসিতে জানে না,
যেথা আছে শুধু ভালবাসাবাসি,
সেথা যেতে প্রাণ চায় মা
সকলি ফুরায়ে যায় মা।
বড় দাগা পেয়ে বাসনা তেজেছি
বড় জ্বালা সয়ে কামনা ভুলেছি,
অনেক কেঁদেছি কাঁদিতে পারি না।
বুক ফেটে ভেঙে যায় মা,
সকলি ফুরায়ে যায় মা।
দেওয়ান
কি দিয়া বুঝাইয়া রাখি ছেউড়া পুত্ররে, কেবা খাওন দেয় তাগো পড়িলাম ফেরে। মইরা তো যাও নাই আওরাত গিয়াছ মারিয়া, তিনলা পরবনি মাইরা গেছ পালাইয়া। কি দুশমনি করিয়াছিলাম আর জনমে আমি, তার পতিশোধ লইলা এই না জনমে তুমি কিসের অভাব আছিল আমার আমি বেনাচঙ্গের দেওয়ান, অধুইনা ধন দৌলত গোলাভরা ধান। সব থাইক্যাও আমার কিছুই নাই। পন্থের ফকিরও তো আমারথন বেশি সুখি।
দুনিয়াতে নাই আর আমার মতন দুঃখী। কি করিব ধন দৌলত আর কি ছার দেওয়ানি। দিলের দুঃখেতে যদি চোক্ষেতে ঝরে পানি। কেবা খাইব আমার এই ধন দৌলত, শূন্য অইল ঘর মোর মরিয়া আওরাত। বুকে শেল দিয়া গেলা তুমি মোর কোন পরানে, দুনিয়াতে দেখি মোর আন্দার দুই নয়নে। তোমারে ছাড়িয়া আমি বাঁচি কোন পরানে। তেজিতাম পরানে আমি তোমার কারণে।
কথক
হায় এই না কান্দে দেওয়ান বুক না কুটিয়া, পাড়া পড়শি পরাবক পাইল তারে না বুঝাইয়া। ঘর খালি অইল আর গুজরান না চলে, সোনার সংসার ব্যর্থ হায়রে যায় যে বিফলে। কান্দন আহারে কান্দন । কি করব এহন সোনাফর দেওয়ান। দুই ছেউড়া বাচ্চা যহন মা মা কইরা কান্দে, দেওয়ানের বুকের গহিনে হাহাকার উঠে। ধিক্ ধিক্ এই জনমে। কিন্তু একটা উপায় তো দরকার। কি সে উপায়? দেওয়ান খালি ভাবে আর ভাবে। খাওয়া পরনের ঠিক নাই, দুই চোক্ষের ঘুম নাই, ভাবনার গহিন সাইগরে ডুব মারে দেওয়ান।

গান
দিবানিশি চিন্তে মিঞার দুঃখ অইল দিলে,
দরবার বিচার আচার কিছু নাহি চলে,
দেওয়ান হায় হায় রে ।
কিসের সংসার কিসের বাস, কেমনে সুখ মিলে,
মনসুরও বয়াতী সুখ না থাকলে দিলে,
দেওয়ান হায় হায় রে ।
উজির নাজির সবে আর এই না দেখিয়া,
মিঞারও নিকট কয় দর্শনও দিয়া,
দেওয়ান হায় হায় রে ।
উজির
শুনছাইন দেওয়ান সাব, মনোযোগ দিয়া আমার কথাটা একবার শুনছাইন। হায়াত মউত সব তো আল্লার হাতে। বিবিজানের হায়াত ছিল না, তাই তিনি মৱচুন। তাই বইলা এত সুন্দর সোনার সংসার নষ্ট করচুন কেন? আরেক সংসার কইরা রাখাইন দেওয়ানি বজায়। একজনের লাইগা কেন সকল জনে যায়।
দেওয়ান
আরে উজির পুতরে, কেমনে বুঝাই দুধের বাচ্চা আলাল দুলাল আছে মোর ঘরে। তারার দুঃখ দেইখা আমার ফাইটা যায় বুক। সাদি করিলে অইব দুঃখের উপর দুঃখ। সতাই না বুঝে সতিন পুতের বেদন, সতিন পুতে দেখে সতাই কাটার সমান। সেই কাটা তুইলা সতাই দূরেতে ফালায়। এই দেইখা মন আমার সাদি করতে না চায়।
কলিজার নৌ মোর আলাল দুলাল, দুঃখের উপর দুঃখ দিয়া না বাড়াই জন্মাল, আলাল দুলালেরে বিবি আমায় সন্ধ্যা দিয়া, সাদি না করতে গেল মানা যে কইরা। বিয়া নাই করবাম আমি সংসারের লাইগা, কিয়ের সংসার আলাল দুলালেরে মারিয়া। তারার মুখ দেইখা আমি বাঁচিয়া পরানে, রাক্ষসের হাতে নাই যে দিবাম আমি জীব মানে।
কথক
সুধীজনেরা আসলে কি তাই? বিয়া দেওয়ান সাব করবাইন না। মরা বৌয়ের জন্যে এত দরদ? ব্যাপার জানি কেমন কেমন লাগে। ঘটনা আবার এই না তো, যে আবার সাধিলে খাইব। তো যাই হোক দেওয়ানের কথা শুইনা উজির কর মিঞার কাছে—
উজির
আরে কান্দিয়া কাটিয়া সাহেব ফায়দা নাই যে আছে। সতাই সগল সাহেব আরে না হয় সমান। সতিন পুতের লাইগা কেউ কেউ দেয় জান পরান। আলাল দুলালে যতন করবাম সকলে, দুঃখ নাই সে পাইব কিছু সভাই বাদী অইলে। দিলের দুঃখ দূর করিয়া করবাইন একখান বিয়া, সোনার সংসার পালবাইন যতনও কইরা।
কথক
এই কথা শুইনা মিঞা চিন্তে মনে মনে, কিছু ফায়দা নাই মোর সংসার ছাড়নে। সোনার কলি আলাল দুলাল রইলে বাঁচিয়া সংসার না থাকলে তারা খাইব করিয়া 1 সংসার নষ্ট হইলে পরে অইব তারার দুখ, চিরদিন দুঃখে হায় ফাটিবে যে বুক। আমার বুকের ধন রাগবাম যতনও করিয়া, কি সাধ্য সভাই নেয় তারার কাড়িয়া।
এই মতে দেওয়ান আরে চিন্তে মনে মনে, উজির নাজির লাগে পাছে বিয়ারও কারণে। মনস্থির করিয়া দেওয়ান অইল সম্মত, সাদি করতে গেল পরে যেমনও বিহিত। (মঞ্চে উচ্চগ্রামে মিউজিক বাজছে। দেওয়ান বিয়ের আসরে উৎফুর।)
কথক
কি ভাইজানেরা, তখনই কইছিলাম না, আরেক বার সাধিলে খাইব। তো আমাগো দেওয়ানরে আরেক বার সাধা লাগে নাই। বিবিজানের চোখের এক ইশারাতেই দেওয়ান কাইত। আজিপ এই দুনিয়ার হাল হকিকত। একই ছাদের তলে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর সংসার করছেন মিয়া বিবি।
কত ভালবাসা, কত স্মৃতি, কত আবেগঘন মুহূর্ত। সেই বিবি মরছে সাতদিন অয় নাই এর মধ্যে মিঞায় আরেকখান বিয়া কইরা নতুন বিবির লগে আদর সোহাগে খুটমুট করতাছে। সেই যাই হোক, আমাগো দেওয়ান তো বিবির এক চোখের ইশারাতেই কাইত । দেখা যাক বিবির দুই চোখের ইশারায় না দেওয়ান উল্টাইয়া পড়ে ।
গান
সাদি না কইরা সাহেব নিজ পুত্র ধনে,
নিজের নিকটে রাখে পরমও যতনে ।
সতাইয়ের কাছে তারারে না দেয় যাইতে,
আলগা রাখিয়া পুত্রে পালে সুবিহিতে।
আলালে দুলালে লইয়া করে যে সোহাগ,
এরে দেখা সতাইয়ের মনে অইল রাগ ।
সতিন পুত্রেরারে করে কত না আদর,
ফিরিয়া না চায় মোর পানে এক নজর
কথক
এইবার জইমা গেছে নাটক। সতিন আর সতাই পুতের যুদ্ধ, মাঝখানে ফাঁটা বাঁশে আটকাইয়া গেছে সোনাফর দেওয়ান। বিবির মাথায় কত চিন্তা আসে। বিবি খালি ভাবে আমার যদি ছাওয়াল হয় থাকব অনাদরে। বুকের লৌ দেখব কেবল সতী পুতেরারে। এরে দেইখ্যা আর মোর সহা না যায়, মনে মনে চিন্তি কেবল কি করি উপায় ।
সতিনের পুত্র মোর অইল গলার কাঁটা, খাওন না সুজে মোর অইল বিষম লেটা। যত দিন না পারি এই কাঁটা দূর করিতে, তত দিন সুখ নাই মোর নসিবেতে। দেওয়ানেরে জানাই যদি দিলের দুঃখ মোর, ঝাটা না মারি মোরে কইরা দিব দূর। এক হেতু আছে আরে ছলনা না কইরা, যদি দিতাম পারি দিবাম দূর না কইরা ।
গান
চিন্তা করিয়া বিবি বুদ্ধির বহর দিয়া,
অন্দরেতে দেওয়ানেরে ডাকিল পাঠাইয়া,
ডাকিল পাঠাইয়া বিবি বুদ্ধির বহর দিয়া।
দেওয়ান আসিলে বিবি কান্দে জারে জার
দেওয়ান জিগায় কান্দ কেন কিবা সমাচার।
কান্দিয়া কান্দিয়া বিবি কয় দেওয়ানেরে,
কোন দোষে দুষী অইলাম তোমারও গোচরে।
বিবি
আলাল দুলাল মোর সতিন পুত বলিয়া আমার নজর ছাড়া রাখ্যাইছি করিয়া 1 আলাল দুলাল কি কেবল তোমার বুকের ধন। কেন আমি অইলাম বৌরি তারার কি কারণ। সতাই বলিয়া মোরে বিশ্বাস না করো সকল সতায়ের তুমি এক মত ধর। অঙ্গ জ্বলিয়া যায় এই না কারণে বদনাম রটাইব আমার পাড়া পড়শি জনে । সতাই যন্ত্রণা দেয় বলিব সকলে আমার কাছেতে আলাল দুলাল না আসিলে । আমার তো কোন সন্তান নাই। তুমি বিচার কর সতী পুতের সুখ দেখাইয়া আমার দুঃখ দূর কর ।

কথক
আহারে দয়ার সাগর একেবারে উলাইয়া উঠছে। আল্লাহ নাই করে, আরেক কইতরির কিচ্ছা আমাদের দেখতে হয় ।
ফোড়ন
মিয়া ভাই দেওয়ান কি বেকুব নাকি?
কথক
বেকুব না তো কি ইয়াকুব? আরে ভাই শাস্ত্রে এই কয়, নারীর এক ফোঁটা চোখের পানি মারাত্মক অস্ত্রের চাইতে ভয়ঙ্কর। সে চোখের পানির তরে কত উজির নাজির রাজা বাদশা ভাইসা গেছে।
ফোড়ন
আপনি খালি মাইয়া মানুষরে দোষ দেন। ছলাকলায় পুরুষ কিসে কম? দেইখা তো মনে অয় আপনার মনেতে কোন রহম নাই ।
কথক
থাকব কেমনে? এখন তো আমার কোন মনই নাই। আসল মনখান মায়ের কাছে দুইয়া গ্রাস পিয়ারটা নিয়া পালা গানের আসরে আসছি। লাগলে কন. বিনা দামেই দিয়া দিমু। তো যাউক, সুধীজনেরা, দেওয়ানের সামনে নিবিজ্ঞানে কাদে আর কান্দে। কাইন্দা কাইন্দা বিবিজানে কয়, কলিজার নৌ মোর আলাল দুলাল কি খায় কি না খায় কি বা করয়ে কুয়াল।
কত বন্ধু আনো যারে আন্দরও মহালে, মনের দুঃখেতে সেই সব পেটে নাহি চলে। তারায় আশায় রাখি হিকাতে তুলিয়া, পচাইয়া গেলে নিরাশ অইয়া দেই ফালাইয়া বুকের দুঃখ দূর অইব তারারে দেখিলে। আন্দরে আনিয়া দাও আইজই বিকালে। যদি মোর বাকা তুমি কর লঙ্ঘন, তাহলে জাইনা রাইখা আমার নিরচয়ে মরণ। এই কথা না কইয়া বিবি লাগিল কান্দিতে, দয়াতে ভরিল দেওয়ান সাবের চিত্তে।
দেওয়ান
তোমার কথায় বিবি দিলে পাইলাম সুখ, বিনা কারণে তুমি চিত্তে পাও দুখ। আগের বিবি মোর হস্তেতে ধরিয়া আলাল দুলালে আমার দিয়াছে সপিয়া। রাখতাম তারারে ধইরা আমার বুকেতে, কিছুর লাইগ্যা যেন কষ্ট না পায় মনেতে। সেই না কথা মনে জাগে তারার মুখ দেখিলে, এক দণ্ড না থাকতাম পারি কাছ ছাড়া অইলে। সেই না কারণে রাখি সদা সাথে সাথে, একলা না দেই আমি বাইর অইতে পথে। তা ছাড়া তোমার জঞ্জাল বাড়ে এই না ভাবিয়া, তোমার কাছে আমি দেই না পাঠাইয়া ।
কথক
এই কথা শুইনা বিবি দেওয়ান অগচরে মিডা (ছন্দে ছন্দে) ভুলে, ভুলে মিডা, চিনি মিডা, গুড় মিডা, কুশাইল মিডা, আম মিডা, কাডল মিডা, আর কি মিডা? বুলি মিডা, প্রেম মিডা, সোহাগ মিডা, বিবি মিডা, বুলি মিডা, মিডা বুলি কয় বিবি অতি ধীরে ধীরে।
বিবি
আমার গর্বের পুত্র অইলে আলাল দুলাল তারে যতন করলি কি অইত জঞ্জাল? ছাওয়ালে যতন করে মায়ে সব কাম থুইয়া, কাম নাই সেই বুজে ছাওয়ালের বেদনা দেখিয়া সংসারের কামের লাইগা না অইব তিরুভী, ইতে আন না অইব ধরি পাও দুইটি ।
গান
পায়েতে ধরিয়া বিবি জুড়িল কান্দন,
পাথরও গলিয়া যায় শুনিয়া বেদন
হায়রে শুনিয়া বেদন।
চোখের পানি মুছি দেওয়ান পরতিজ্ঞা করিল,
দুই ছাওয়াল আনা দিবাম কালকা সকাল ।
মিঠা বুলি রস দেওয়ান বিবিরে বুঝাইয়া
পানি খাইয়া গেল দেওয়ান আন্দরও ছাড়িয়া
কথক
বেকুব আর কারে কয়। হালা এই তো দেখি এক মাজা ভাঙ্গা কইতর। তো যাই হোক হাসিতে হাসিতে বিবি ধীরে ধীরে মিঠা বুলিতে কাম নিবাস অছিল করে। সতিনের কাঁটা আমি নিশ্চয় ভাঙবাম ছল কিংবা জোরে পারি আর না ছাড়বাম। বইল্যা গেছে দেওয়ানেরে কালুকা সকালে পাঠাইবাম আলাল দুলাল আন্দরও মহালে ।
বিবি
(ছন্দে ছন্দে নানান মতে সাজাই আমি আন্দরও মহল,
তাই পরকাশ করব আমার আদরও কেবল।
এমন করিবাম যাইতে সর্বলোকে বলে,
মনে দিয়া ভালবাসি সতিন পুত সকলে ।
নিজের হাতে ছিড়ি মুন্নু যদি আগচরে,
তেউ যেন মোর কথা কেউ বিশ্বাস না করে।
কথক
এ্যাতেক কইয়া বিবি আন্দর সাজায় যত মতে পারে নাই সে তিরুরি তাহায়। কত কত মিডাই বিবি জোগাড় করিয়া ঘরে ঘরে রাখে বিবি আন্দরে সাজাইয়া। আর যত খাদ্য জিনিস নিজ হাতে রান্দিল রাত্র থাকিতে রান্দন শেষ যে করিল 1 এই মতে নানা ইতি দ্রব্য সাজাইয়া সতিন পুতেরার লাইগা রইল বসিয়া।
বগা যেমন চোখ বুইজা পাগারের ধারে সাধু হইয়া বইস্যা থাইক্যা পুডি মাছ ধরে। মনসুর বয়াতী কয় সেই মতে রইয়া, বিবি রইল যেমন খাপ ধরিয়া। তারার বার চাইয়া বিবি থাকিতে থাকিতে ধরিয়া আইসা খবর দিল দেওয়ান আইসে পথে (মঞ্চে উচ্চগ্রামে মিউজিক বাজছে। সারা মঞ্চ জুড়ে তুমুল উত্তেজনা। কোরাসের মুভমেন্ট।)

গান
আগে চলে দেওয়ান মিঞা আলাল দুলাল,
তার পাছে পাইক পরী তামেশগীর সকল ।
নানা ইতি সাজে দেখ দেওয়ান পুত্রগণ,
সাজন দেখিয়া কিবা জুড়ায় নয়ন ।
রূপ দেইখ্যা পরীগণ চোখ ফিরাইয়া চায়,
এমন সুন্দর নাগর পাইলে পায়েতে লুডায়।
দেখিতে দেখিতে তারা আন্দরে আসিল,
দুই হাতে বিবি দুই কুমারে ধরিল ।
দুই পুতে সতায়ের জানাই ছালাম,
বুকুতে ধরিয়া সতায় করিল চুম্বন।
আয়োজন করিয়া যত রাখছিল সাজাইয়া,
সকলিই সামনে দিল হাজিরও করিয়া
কথক
আহা রে, এরেই কয় কপাল। রাক্ষসী কইতরির খপ্পরে পড়ছে আলাল দুলাল। বেকুব রে সবদার দেওয়ান, রাক্ষসীর চোখের পানির কাছে, নাকানি চুবানি খাইয়া দুই পুতেরে তুলিয়া দেয় বাজপাখির হাতে। দেওয়ান ভুইলা গেছে। মরণের সময় বিবিজানের কাছে কি পরতিজ্ঞা করছিল, সব ভুইলা গেছে। পরতিজ্ঞা ভাঙ্গা সহজ, রাখা বড় কঠিন। এটাই জগতের চিরন্তন নিয়ম। যাক, এ দিকে আলাল দুলালের কি অবস্থা?
খাইয়া আলাল দুলাল খুশি হইল মনে সতায়ে আদর করে পরমও যতনে। আলুফা জিনিস যত বাছিয়া বাছিয়া সদাই রাখিয়া দেয় তারার লাগিয়া। নিজ হাতে বিবি খাওয়ায় সামনে খাড়া হইয়া, এক দর তারার না থাকে পাঙ্গুরিয়া। সভাই আদরে তারা আন্দর না ছাড়ে, বাপের আঙুল ধইরা আর নাই সে ফেরে। সভায়ের যতনে তোলে মায়ের যে মুখ, আন্দরে থাকিয়া পায় যত রকম সুখ।
এই মতে সুখেতে আরে তারার দিন যায়, কিন্তু গোপনে থাকিয়া বিবি চিন্তয়ে উপায় দুশমন সতিন পুতে খেলাই কেমনে দিবা নিশি তার কেবল এই চিন্তা মনে। মনের তমর ভাব কেউরে না কয়, মিডা কথা দিয়া সকল করিয়াছে জয়। বলা বলি করে লোকে এই কি অচরিত, সতাইর না দেখছি আর অত করতে ইত। সভায়ে পরানে দেখি গাল টিপ্যা মারে, সতিন পুতের লাইগ্যা কেবা অত যতন করে। মুখের গরাস দেয় যতনে তুলিয়া, আলুফা জিনিস খাওয়ায় নিজে না খাইয়া ।
ও দিকে বেহুদা দেওয়ানের কি অবস্থা?বিবির যতনে দেওয়ান মহিত অইল, আলাল দুলালে রাখে আন্দর ও মহল। বিবির হাতেতে সপ্যা আলাল ও দুলালে, দেওয়ানগিরি করে দেওয়ান খুশি হইয়া দিলে। এই না মতে দিন যায় আর বিবি ভাবে বইয়া কেমনে সতিন কাঁটা দিবাম সাঙ্গ দিয়া সাউনিয়া বর্ষার পানি টলমল করে এরে দেইখ্যা বিবি কিনা ফন্দি এক করে। নয়া পানিতে আরে দৌড়ের নাও সাজাইয়া আড়ং জমির কত দেশ ভাসাইয়া ।
বিবি
এই না আড়ংয়ের কথা বুঝাইলে দুশমনে। যাইতে চাইব কত আনন্দিত মনে । এই না আড়ং এ দেই তারার না পাঠাইয়া মারিবাম জলেতে দিয়া চর পাঠাইয়া ।
গান
এই মতে মনে মনে কইরা বিবেচনা,
জল্লাদে ডাকিয়া বিবি করে এ মন্ত্রণা।
নিরালা ডাকিয়া কয় জল্লাদের ঠাই ।
জল্লাদ ও ভাই জল্লাদ তুমি আমার মায়ের পেটের ভাই ।
বিবি
জন্মাদ, ও ভাই জল্লাদ, এক রকম হিসাব করতে গেলে তো তুমি আমার মায়ের পেটের ভাই ।
তোমার মত মুরিদ আমার দুনিয়াতে নাই ।
এক কাম মোর যদি কর তুমি ভালা,
বিশ পুরা জমি বাড়ি দিবাম কইরা কাউলা ।
সত্য করো জন্মাদরে রাখবা আমার কথা,
গোপন মত করবা কাম না করবা অন্যথা ।
জল্লাদ
এমন কি কথা কইবাম বিবি এ অধমের কাছে। জলদি কওয়াইন মোরে কিবা কাম আছে? বিশ পুরা জমি দিলে জানবাইম মনে মনে না পারিমুই এমন কাম নাই ত্রিভুবনে । (মিউজিক বাজছে। খুশি মনে জন্মাদ এবং বিবিজান কানে কানে কথা বলছে। এখানে বিবিজানের চারিত্রিক স্খলনের ব্যাপারটাও আনা যেতে পারে।)
কথক
ষড়যন্ত্র রে ভাই ষড়যন্ত্র । ক্ষমতার লোভ, হালুয়া রুটির ভাগ বাটোয়ারা। যুগে যুগে এই নিয়া কত দেশে, কত রাজ্যে কত যুদ্ধ। কোটি কোটি মানুষ এই যুদ্ধের শিকার। হয় বিশ্বযুদ্ধ হিরোসিমা নাগাসাকি কত নিরপরাধ মানুষের নিষ্ঠুর মরণ। কত লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই বোমার আঘাতে জীবিত কিন্তু ক্ষত বিক্ষত। আমরার দেশের কথাই ধরি, ১৯৭১ সাল ৯ মাসের সেই যুদ্ধে কত মা বোন স্বজন হারাইয়া নিজের জীবন বিনাশ করছে।
লক্ষ লক্ষ মানুষের খুন করছে, করছে বর্বর পাকিস্তানিরা। সবই ষড়যন্ত্রের ফসল। ষড়যন্ত্র মিয়া কইলুন অর্থইনও চলচুন । এই পালাতেই দেখচুন সেই সর্বনাশ ষড়যন্ত্র তো যাইক, সুতার ডাকিয়া বিবি ফরমাইসে করিল, ময়ূর পংখী নাইয়ের এক করহ শিজিল। আলাল দুলাল সেই নায়ে আড়ং-এ যাইব, কিম্বত লাগিবে যাহা বিবি তাই দিব।
গান
ময়ূর পংখী নাও পরে ঘাটেতে আসিল,
নানা রূপ আভরণে কুমারে সাজাইল ।
খাদ্য বস্তু যত সবকিছু নায়ে সাজাইয়া,
তুল্যা দিল পীরার বান্দী কথা বুঝাইয়া ।
সাজাইয়া কুমারারে নায়ে দিল তুলি,
জল্লাদ অইল সেই নায়ের কড়ালী।
গান
কল কল ছল ছল নদী করে টলমল,
ঢেউ ভাঙ্গে ঝড় তুফানেতে নাও বাইওনা
মাঝি বিষম দইরাতে ।
ঐ গগনে গগনে হুং করিয়া ছুটে মেঘ।
শন শনে বায়ু বহে ঐদিকে
মাঝি নিমিষে জোটাইও পাল,
সামিলে ধরিয়ে হাল ধীরে ধীরে দিও পাড়ি বৈঠাতে।
ঐ বদর বদর বলি কিনারে বিলায়ে চলি
ভাটিয়ালী ভাটি গাঙ্গে বাইও…
থাকিলে জোয়ারে দেরি, লগি মাইরো তাড়াতাড়ি
বেলা বেলি ঘাঠে ফিরা আইও।
মোর কুলে রাইখা বারে বার, না যাইও গাঙ্গেতে আর
সাথে সাথে নিও তুলে নৌকাতে ।
কথক
তো দুষ্ট বিবি আবুদ্যা ছেলে দুইটারে জন্মাদের হাতে তুইল্যা দিয়া মনের সুখে হাসতাছে। সতায়ের পুত পথের কাঁটা শেষ। এইবার বিবিজান রে আর পায় কে? দেওয়ান তার রাজ্য তার সহায় সম্পত্তি তার বিবিজান—এই সব কথা ভাবতেছে আর মনে মনে খুট খুট খুট খুট করে হাসতাছে। এমন সময় দেওয়ান মিলা আইসা জিগায়
দেওয়ান
বিবিজান আলাল দুলাল কই গেছে?
বিবি
ও মা আপনি বুঝি জানেন না। তারা খুব হাউশ করছিল, আড়ং দেখব। তাই আমি ময়ূর পংখী নাও সাজাইয়া তাগোরে পাডাইয়া দিছি।
দেওয়ান
বিবিজান তোমার কাছে আমার হাজার বছরের ঋণ। আলাল দুলালরে নিয়া আমার বড়ই চিন্তা আছিল। পৃথিবীতে কোন নারী সভায়ের পুতের লাইগা এত কিছু করে? আলাল দুলালরে তোমার হাতে সপ্যা দিয়া আইল আমি নিশ্চিন্ত। বিবিজান তুমি আমার সতী নারী।
বিবি
আমি যদি সতী নারী অই, তয় আপনি অইলেন সতী নারীর পতি ।
কথক
ঢং দেইখা বাঁচি না। আহাম্মকের নাতী হইছে সতী, সতী নারীর পতি। কেমন সতী গো সুধীজনেরা দুধের বাচ্চারে যে জন্মাদের হাতে তুইল্যা দেয় সে কোন ধরনের সতী? ষড়যন্ত্র কইরা দেওয়ানেরে আহাম্মকের সরদার বানাইয়া যে রাজ্য বিষয় সম্পত্তি গ্রাস করতে চায় তারেই কি বলে সতী। বেকুবের সতী আবার বড়াই কইরা কয়, আমি সতী নারীর পতি। গ্রামে গঞ্জে, এই সতী নারীর গুণকীর্তন কইরা তারে নিয়ে গান বানছে।
গান
(কথকের গান) ও মোর নাতনি জামাই গো
তোর কপালে বৌ নাই আমার
আমার নাতিন আইনা দে।
নাতনি আমার মইরা গেছে ছিল বড় সতী,
খাতা খুইলা চাইয়া দেখি বাহাত্তুর জন পতি।
নাতিন আমার মইরা গেছে ফিক্কা মার তারে গাঙ্গে
কপাল থাপ্পাইয়া কান্দে ১৪ হাজার নাঙ্গে ।
তো যাউক সুধীজনেরা, এদিকে কি অইল
শোনেন বাইতে বাইতে নাও পড়ল।
দরিয়ার গিরাম নগর কিছু নাই দেখা যায়
পরেতে জল্লাদ কুমার দুয়ের কয়—
জল্লাদ
ইয়াদ কর আল্লার নামে মরণ কালের আগে। তোমার যম আমি দুয়ারেতে খাড়া, আমার হাতেতে দুইজন যাইবাম যে মারা। তখনই মারিবাম পড়ে ডুবাইয়া দরিয়াতে বদ নছীব সতায়ের বজ্জাতি কিছু না পারলাম বুঝিতে। বিবি যায় বানীর হুকুম জাইনো মনে সার, বিশ পুরা জমি পাইবাম নাই তোমরার উদ্দার। (মঞ্চে তুমুল ক্লাইমেক্স তৈরি হয়)।
কথক
আছানক এই কথা শুইনা মাঝির যে মুখে আলাল দুলাল কান্দে ফাপাইয়া বুকে।
আলাল
সতায়ের ছল কত হায়রে আগে জানি নাই, বেনালে পড়িয়া হায়রে পরানও হারাই। আগে যদি জানতাম সতাই এই তোমার মনে, পলাইয়া দুই ভাই থাকতাম বনে বনে । কোথায় রইলা মা জননী কোথায় বাপজান, বেনালে পড়িয়া আমরা হারাই পরান । জল্লাদ রে তুমি তো মাইনার চাকর তোমার দোষ নাই, যে কামেতে স্বার্থ অইব তোমরা করবা তাই। জন্ম হইতে আরে জল্লাদ কত পাইলাম দুখ, এক কাম কর যদি চাইয়া আমরার মুখ। বাপের ভিটা বাটি দিতে আমরা দুই ভাই, দুঃখের দোষ বাপের আর তো কেহ নাই।
দুলাল
ভাইরে যদি মায়ের বোইন আরে মাসি অইত পরান দিয়া সেইন পুতে পাইলা রাখিত । সুতি বাপের বোন আরে ফুপু অইত, টান দিয়া ছেউড়া ভাইপুত কোলে তুলে লইত। যদি মায়ের জন আরে চাচি অইত আদর করিয়া ঘরের বাহির না করত।
আলাল
জল্লাদ, জন্মাদ তোমার দুইখান পায়ে ধরি আমারে মারিয়া দেও দুলালেরই ছাড়ি ।
দুলাল
না, না জল্লাদ, কছম লাগে রাখ মোর কথা, ভায়েরে রাখ্যা আমারে মার দিয়া ব্যথা।
জল্লাদ
আহ্ মোর জ্বালা, এ কি যন্ত্রণা, দুই জনেরই সারবাম।
গান
দুই ভাইয়ে না জন্মাদের ধরা দুইটা পায়,
পাথর গলায়ে এমন কান্দিয়া ভাসায়।
কান্দন না শুহিন্যা জল্লাদ ভাবে মনে মনে,
এই খানতে রাখ্যা গেলে বাজিব পরানে।
বাপেরও রাজ্যেতে নাই সে পারিব যাইতে,
বিনা দোষে মাইরা কেন যাই পাব করিতে
কথক
সুধীজনেরা তাহলে জল্লাদেরও মায়া মমতা আছে। হোক জন্মাদ সেও তো কারো না কারো ভাই, কারো স্বামী, কারো সন্তান। তো ঐ দিকে অইল কি ১২ ডিঙ্গা সাজাইয়া সাধু সওদাগর উজান বাইয়া যায় ধান কিনিবার। জল্লাদে ডাকি তার কাছে কয় গোপনে কুমাররে লয়ে সাধু তুলিল যতনে। আলালে দুলালে সাধু তুইল্যা ভাসায় নাও, জল্লাদে ফিরিয়া পরে দেশ চইল্যা যায়। ধনুয়া নদীর পাড়ে কোজল কাণ্ডা বাড়ি, তাইতে না বসতি করে ইরা ধর ব্যাপারী।
গিরস্তি করিয়া বেচে ১০০ পুরা ধান এমন গিরস্ত নাই তাহার সমান। ইরা ধরের বাড়ি, সাধু ধান না কিনিয়া, আলাল দুলালে কিম্বত দিল দাম ধরিয়া। আলাল দুলাল থাকে সেই না বাড়িতে দেওয়ান পুত্ৰ অইয়া কত কষ্ট কপালেতে। সারা দিন গরু রাখে দুই বেলা খাইয়া মনের দুঃখে আলাল হায় রে গেল পালাইয়া। তো এই দিকে দিন যায় মাস যায় বছর যায়, দুলাল আলালের থুইয্যা না পায়। সাত গাঁয়ের লোকে চিনে মদিনা সুন্দরী—
সুধীজনেরা, এ যেন আরেক রাধা কৃষ্ণের পালা। দুলাল তো চাষীর বাড়িতে কাম করে। মদিনা সুন্দরী যেন তার দিকে কেমন কেমন কইরা চায় ।
গান
(মদিনার গান) নির্জন ও যমুনার কুলে,
বসিয়া কদম্ব তলে বাজায় বাঁশি বন্ধু শামরায়—
কথক
শ্যামে বাজাইছে বাঁশি রাধার পরান কি আর ঘরে থাকে? তো আলাল দুলাল আর মদিনা সুন্দরীর অবস্থা হইছে তাই। মদিনা সুন্দরীর চোখের এক ইশারায় দুলাল মিঞা চাট্টি বাটি এক দশ গোল। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সুযোগ পাইলেই মদিনার ঘরের চার পাশ ঘুর ঘুর ঘুর করে। ইশারা দেয়, শিষ বাজায় –
গান
রসিক আমার মন ভাঙ্গিয়া পিঞ্জর বানাইছে-

আজকে আমরা আলাল দুলালের পালা নাটক : ২য় পর্ব
প্রযোজক দল : ঢাকা পদাতিক
প্রদর্শনীর স্থান : মহিলা সমিতি মিলনায়তন, ঢাকা
কুশীলব
সোনাফর দেওয়ান : মানিকচন্দ্র শীল
মা : সাবরিনা লিজা
আলাল (ছোট) : হৃদয় চৌধুরী
দুলাল (ছোট) : আরজুমান ইসলাম নান্টু
কথক : মঞ্জুরুল ইসলাম নান্টু
কইতর : আহসান হাবীব পলাশ/তুষার
কইতরী : সাবরিনা লিজা
উজির : বিজনকান্তি ধর
সতাই : রোখশানা পারভীন মনি
জল্লাদ : ফিরোজ হোসাইন
সেকেন্দার দেওয়ান : সামসুদ্দিন সবুজ
নতুন দেওয়ান : সঞ্জিত রায় শম্ভু
আলাল (বড়) : সাব্বির হোসেন মার্শাল
দুলাল (বড়) : সাবের আহমেদ শুভ
মদিনা সুন্দরী : বিলকিস নাহার স্মৃতি
আমেনা : সাবরিনা লিজা
মোমেনা : আরজুমান আরা পুষ্প
সুরুজ জামাল : হৃদয় চৌধুরী
যন্ত্রসঙ্গীত : হারমোনিয়াম – রাশেদুল হাসান বাবু
তবলা – প্রবীর পাল
বিশেষ যন্ত্রী : জাহিদ হাসান
কোরাস : মানিক, নান্টু, মার্শাল, স্মৃতি, লিজা, পুষ্প, পলাশ, তুষার, বিজন, মনি, ফিরোজ, সবুজ, সঞ্চিত, তুহিন, মোতালেব, শুভ, টিটো, বাবুল, প্রবীর, ফনিভূষণ, সুজন, পলাশ, টুটুল, শামিম, মাসুদ, ম্যামল, জাহাঙ্গীর, সরোবর, শিশির বাবু।
কলাকুশলী
নির্দেশনা : এস এম সোলায়মান
মঞ্চ, আলো ও কারিগরী নির্দেশনা : আমিনুর রহমান আজম
পোষাক পরিকল্পনা : অশোক কর্মকার
সহযোগী : হাবিবুর রহমান
মুখোশ ও বিশেষ পোষাক : কিরিটী রঞ্জন বিশ্বাস
মঞ্চ অধিকর্তা : কাজী সাব্বির হোসেন মার্শাল
প্রধান সমন্বয়কারী : গাজী জাকির হোসেন
প্রযোজনা অধিকর্তা : গোলাম কুদ্দুছ

আলাল দুলালের পালা ২য় পর্ব
[মদিনার প্রবেশ]
দুলাল
মদিনা সুন্দরী, আজগর বেলডা বড় সুন্দর তাই না? কুনদিন ভাবিনি তুমি এভাবে ছুইডা আইবা ।
মদিনা
নিশির ডাক শুইনা কি ঘর থাকবার পারি? আপনি এমন বান্ধনে আমায় বান্ধিলেন কেন? যদি কোন দিন এর তাল কাইট্যা যায়? কাল জ্যাটারে খালি কইরা যদি সুরের ভারটার ছিড়া মাটিত লুটাইয়া পড়ে?
দুলাল
মদিনা। তোমার সাথে আমার সম্পর্ক জন্ম জন্মান্তরের। কাশ ফুলের পরাগের শিকল দিয়া বানছি তোমার মন। এ বন্ধন তো শেষ হইবার নয়।
মদিনা
কিন্তু ভয় যে করে? নারীর মন সে তো কাদামাটির মতন। যদি কোন দিন সে মাটি গইলা যায়, আচুমকা যদি কোন তশকর তার দখলের থাবা বিস্তার করে শীররের সর্বস্থানে । পারবা তখন আমারে ছাইড়া থাকতে?
দুলাল
না কইন্যা পারুম না। এই মন প্রাণ সব তোমার হাতে সপ্যা দিছি। যদি কোন দিন ছাইড়া যাইবার চাও, আমারে মনটারে সাথে লইয়া যাইও ।
মদিনা
তুমি মানুষটা ছাড়া তোমার মনটারে নিয়ে আমি কি করবাম? তেলে ভাইজা খাইতাম?
দুলাল
তোমার যা মন চায় তাই কইরো। যদি কোন দিন বন্ধন আলগা হয়। কিংবা মরণ আইসা যদি কোন দিন দুইজনের পার্থক্যের সীমারেখা নির্ধারণ কইরা দেয় তাইলে মাঝ রাতে উইঠা, আসমানের ভিটায় ঐ কালপুরুষটার দিকে চোখ রাইখ। দেখবা…
মদিনা
না… না…। মরণের কথা কইও না। মরণেরে আমার বড় ডর করে।
দুলাল
তাইলে কথা দাও ।
মদিনা
কি কথা দিবাম?
গান
(দুলালের গান) কাশ ফুলের মালা পরাব তোমায় সখি
দেলুম তোমারে আমি সাদা পরির রঙ্গে।
কথা দাও সখি আমায় যাইবা না ছাড়িয়া-
কথক
প্রেম খেলাতে মইজা গেছে মদিনা সুন্দরী আর দুলাল মিঞা। ভালবাসার যুগল বন্ধনে দুইজনে চরকির মত পাক খাইতেছে। ভালবাসার মহে দুইজনে এতই অন্ধ যে, ঘোলা পানিতে দেখে টলমলা সন্দর নীল মিঠা পানি। আর নীল মিঠা। পানিতে দুইজনে মিইল্যা কেবলি সাঁতার কাটতাছে। অবস্থা বেগতিক দেইখা ময়মুরুব্বিরা কি বইয়া থাকতে পারে? সুন্দর একখান দিন ক্ষণ দেইখা তারা দুলাল মিঞা আর মদিনা সুন্দরীর বিয়ার আয়োজন করল।
বিয়ের গান
আইছে দামান সাহেব হইয়া
বইছে মুখে রুমাল দিয়া
ঘোমটা খোলার আগে
তোমায় করি গো সাবধান
চান্দের আলো দেইখা তুমি হইও না অজ্ঞান।
দামান মিঞা কিপটার বেটা
সোনু আনছে আঠা আঠা
আলতা আনছে গঙ্গার পানি
পায়ে লাগে না।
এত সস্তায় মদিনারে পাওয়া যাইব না।
কথক
অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগিল। চলেন খুইজা দেখি ঐ দিকে আলাল মিঞার কি অবস্থা।
কথক
১২ জঙ্গল ১৩ ভূই ধুনুক দইরার পাড়,
তাহাতে বসতি করে দেওয়ান সেকেন্দর।
সেকেন্দর দেওয়ানের বড় শিকারের আউশ,
পংখি শিকার করবার যায় হইয়া বেউশ।
বনে বনে ঘুইরা মিঞা কত পংখি মারে ।
একদিন এক বৃক্ষের নিচেতে দেখে এক ছেলেয়ারে ।
সুন্দর ছেলিয়া দেখ্যা সংগেত লইল,
নিজের বাড়িতে মিঞা ফিরিয়া যে গেল।
এই ভাবে আবার বছর যায় মাস যায়, দুনিয়ার বয়স বাড়ার সাথে সাথে ছেলিয়ার বয়সও বাড়ে। এখন সে টগবগে দুঃসাহসী যুবক। বাপ সোনাফর দেওয়ানের কথা তার মনে পড়ে। মনে পড়ে সতায়ের ষড়যন্ত্রের কথা। না জানি কেমন আছে কোথায় ছোট ভাই দুলাল মিঞা। পরতিজ্ঞায় বুক বান্ধে আলাল, এর শোধ সে একদিন নিবে।
কত কাম করে ছেইলা মাইনা নাই সে নেয়। দেওয়ান ভাবে এই ছেইলা নিশ্চয় কোন ভাল বাপের বেটা, চিনা নাই সে, দেয় এই হইল বড় লেঠা। মাইনার কথা কয় ছেলিয়ারে, ছেলিয়া কয় নিবাম মাইনা আমি ঠকবরে। একদিন চাইবাম মাইনা রাখবাইম মনেতে সেই দিন পাই যেন আমার হাতে । জান দিয়া করে আলাল দেওয়ানের কাম, তাহার কারণে অইল চৌদিকে খুসনাম। দেওয়ানে বাসয়ে ভালা পুত্রের সামান খেশাড়া করিতে তার মনে অইল টান।

গান
দুই কইনা আছে তার রূপে গুণে দড়,
মমিনা আমিনা নাম আছে বুদ্ধি বড়।
দেওয়ান ভাবয়ে এক কইনা দিলাম তারে,
না জানিয়া বাপ-মায় পড়িল যে ফেরে ।
আলালে জিগায় যদি মুখ পুছা রয়,
গিরস্থের পুত্র আলাল নিজের মুখে কয়।
এমন বেটা অইল কোন গিরস্থের ঘরে,
বিশ্বাস না করে দেওয়ান ফের চিন্তা করে।
কথক
হায় হায়রে এইখানেও একই কেস। কারে পছন্দ করব আলাল, মমিনা নাকি আমিনা? মমিনা বড়, আমিনা ছোট। তয় হিসাবে কয় মমিনার লগেই মনে অয় কেসটা ভাজ খাইব। দুয়েক বছর আরো এই মতে যায়, মায়নার লাগ্যা আলাল দেওয়ানেরে চায়।
সেকেন্দর
আরে আলাল মিঞা কিবা মায়না নিবা। দিবাম তোমারে তুমি যেমন চাইবা।
আলাল
শোনেন সাহেব আরে, শুনখ্যাইন দিয়া মন শহর যে আছে এক তার নাম বান্যাচঙ্গ। সেই না শহরের লাগা সুন্দর কানজল বাড়ি বান্ধিতে আমার জন্য হইছে পাঁচশ মানুষ দিগাইন কাম করিবার আর দিগাইন কেজি দুইশ লগে করি তার। সেই না ঘরের মালিক সোনাফর দেওয়ান, জঙ্গে লড়্যা যেখানে বাড়ি করি সে নির্মাণ।
কথক
এত দিনের বিশ্বস্ত কর্মচারী আলাল তার উপর মনে মনে সিদ্ধান্ত নিছে বড় মাইয়া মোমিনার লগে আলালের বিয়া দিব। তার আবদার কি দেওয়ান ফেলিতে পারে? অতএব ইহাতে দেওয়ান সাহেব অইয়া সম্মত আলালের মনের বানছা করিল পূর্ণিত । এইবার সুধীজনেরা বান্যাচঙ্গ শহরের কিছু শুনখাইন বিবরণ, পুত্র শোকে সোনাফর করিল কান্দন।
পরানের পুত্রেরা মোর অকালে মরিল, মেহরার কিছু হায়রে চিহ্ন তো না রইল। এক পুত্র অইলে পড়ে সেই না বিবির তারে রাখ্যা সোনাফর গেল নিজের গীরে। তার পরে অইল দেওয়ান সেই না ছেলিয়া চারা ভাঙ্গা অইল সংসার দেখ শুনের লাগিয়া। নয়া উজির, নয়া নাজির পুরান যত থুইয়া, বিবির মনের মতন লইল বহালও করিয়া।
নয়া যত উজির নাজির মুচ তাওইয়া ফেরে সেই না বাচ্চা মাইরা নেয় কাম রনা যে করে। সেই না সময় আলাল বান্যাচঙ্গে আইল, পাঁচশত মানুষেরে কামে লাগাই দিল, দুইশত ফৌজে রাখে কানলও ঘেরিয়া নিরাবিলি হয় কাম বাঁধা না পাইয়া। এই না খবর গেল যখন বান্যাচঙ্গ শহর, নতুন দেওয়ান তখন রাগিল বিস্তর।
নতুন দেওয়ান
কি এত বড় সাহস, খিরা না খিরাজ আমার বাপের রাজ্যে আমার অনুমতি না নিয়া বাড়ি বানায়। অর ঘাড়ে মাথা কয়টারে চর তুম এখুনি ঐ লোকের কাছে যাও। তারে কইবা আমার অনুমতি নিয়া যথাযথ খিরাজ পরিশোধ কইরা বাড়ি বানাইতে পারবা। অন্যথায় এক ঘন্টার মধ্যে তারে এই রাজ্য ছাইড়া তোলপিতলপা গুটাইয়া অন্য রাজ্যে চইলা যাওন লাগব।
কথক
স ভাই নতুন দেওয়ান চর পাঠাইল পরে, খিরাজ চাইয়া। শোনেন সুধীগণে আলাল করিল বিদায় কি কথা বলিয়া।
আলাল
আরে বেটা, বেকুবের সরদার আবুদা তুই কি আমার লগে মশকরা করস? খিরাজ দিমু আমি? তোর সাহস তো কম না। তোর দেওয়ানেরে গিয়া কবি বাপের যায়গাতে আমি আরে বাড়ি করি খিরাজের আমি কিবা ধার তো ধারি ।
কথক
বান্যাচঙ্গের ফৌজ যত এই কথা শুনিয়া আলালেরে বান্দা নিতে আইল ধাইয়া দুই দলে অইল পরে জঙ্গ একখান ডারি, বান্যাচঙ্গ শহর হইল ছারখারি (মঞ্চে তুমুল যুদ্ধের দৃশ্য, উচ্চ গ্রাম মিউজিক বাজে। এক পর্যায়ে বানিয়াচঙ্গ শহরের সৈন্যরা পরাজিত হয়ে পলায়ন করে।)
গান
দখল করিয়া পরে, সেই না শহর,
আলাল অইল দেওয়ান, বাড়িতে বাপর ।
সেকেন্দর সাহেবের যত লোক লশকর,
ইনাম বকশিস লইয়া গেল নিজ নিজ ঘর ।
কথক
তো আলাল তো দেওয়ানি পাইয়া গেছে। এদিকে সেকেন্দর সাহেব এই কথা শুনিয়া বড় কন্যারে তার কাছে দিতে চায় বিয়া। তারপরে সেকেন্দর মিয়া গেল। বান্যাচঙ্গ শহরে সাদির কথা সব কহিল বিস্তারে বিয়ার কথা শুইন্যা আলাল কয় দেওয়ানের কাছে—
আলাল
দেওয়ান সাব, আমার আরেক ভাই দুনিয়াতে আছে। তার লাগে দিলে আমি বড় দুঃখ পাই, বিয়া করবাম কইন্যা তারে যদি পাই। দুই ভাইয়ের সাদি করবাম দুই কইন্যা তোমার, দেখশুন রাইখ্যান যাই খুঁইজে তাহার।
গান
একলা আলাল পরে ভাইয়ের তালাশে,
দরিদ্রের বেশে মিঞা চড়িল বৈদেশে।
নদী নালা কত বন জঙ্গল দিয়া পাড়ি,
ভাইয়ের না পাইয়া মিঞা অত দুঃখ করি।
কথক
তো আলাল তো ছুটছে দুলালের সন্ধানে। মদিনারে নিয়া সুখেই আছে দুলাল। এরই মধ্যে তাগো একটা ছেলে জন্ম নিছে। মদিনা এবং দুলাল সখ কইরা নাম রাখছে তার সুরুজ জামাল। দুলাল মিয়া চাষ-বাস করে আর খায়, বৌয়ের আদর যত্নে অষ্ট প্রহর তার মনে সুখের বাজনা বাজে। বড় ভালবাসে দুলাল মদিনা সুন্দরীরে। তবুও কোথাও যেন একটা কাঁটা তার মনেতে খচখচ করে ।
যত কিছুই হোক সেতো ভুলতে পারে না সে সোনাফর দেওয়ানের ছেলে। কিনা আছিল তার, হাতি ঘোড়া, বিষয় সম্পত্তি, চোখ ধাঁধানো রাজবাড়ি, শত শত দাসী-বান্দী কিন্তু এখন তারেও কামলার মতন কাজ করতে হইতেছে জমিনে 1 তাও নিজের জমিন হইলে কথা ছিল। চাষী মরবার আগে মদিনা সুন্দরীর নামে কিছু জায়গা-জমি দিয়া যায়। সোনাফর দেওয়ানের বেটা দুলাল মিয়া সে জমিতে চাষ কইরা খায়। দুলাল মিয়া কিছুতেই সে খচখচ করা কাঁটার যন্ত্রণা ভুলতে পারে না।
দুলাল (গান)
পরের জায়গা পরের জমি ঘর বানাইয়া আমি রই,
আমি তো সেই ঘরের মালিক নই।
এই ঘরখানা যার জমিদারি, আমি পাইনা তার হুকুম জারি
আমি পাইনা জমিদারের দেখা, মনের দুঃখ কারে কই ।
জমিদারের ইচ্ছা মত দেইনা জমি চাষ,
তাই তো ফসল ফলে নারে দুঃখ বারো মাস।
আমি খাজনা পাতি সবই দিলাম,
তবুও আমি আমার হয় যে নিলাম।
আমি চলি তাহার মন যোগাইয়া, দাখিলা মিলে না সই। এ

মদিনা
এই একখান ব্যাপার নিয়া তোমার মনে এত কষ্ট কেন? আমার যা কিছু আছে সবই তো তোমার। এক আত্মার বন্ধনে আবদ্ধ আমরা। তাই যদি হয় তো এই জায়গাখান পিরথক কর কেন?
দুলাল
সবই তো বুঝি মদিনা, তবুও কোথায় জানি আটকা পইড়া যায়। সোনাফর দেওয়ানের ছাওয়াল আমি কি না আছিল আমার। আর এখন তোমার বাপের জমিতে ।
মদিনা
অইছে অইছে, আর কহন লাগব না। সব কিছুই আছিল তোমার কিন্তু একটা জিনিস তো আছিল না।
দুলাল
না… না… তুমি বিশ্বাস কর মদিনা, আমার কোন অভাব ছিল না। সব কিছ আছিল আমার।
মদিনা
কইলাম তো বিশ্বাস করি সব কিছুই আছিল তোমার, খালি একখান জিনিস আছিল না তোমার। সেইডা কি কও তো?
দুলাল
কি?
মদিনা
আর কি এই মদিনা সুন্দরী”
দুলাল
হাছাই কইছ মদিনা, যখনই তোমার দিগে চাই, জগতের দুঃখ সব আমি ভুইলা যাই। শৈশবের কথা যখন মনে পড়ে। মনে পড়ে বাপ-মায়ের কথা, সুখ বিত্ত বৈভবের কথা। তখন মনেরে এই বইলা সান্ত্বনা দেই, হয়তো আমার কিছুই নাই কিন্তু আমার মদিনা সুন্দরী আছে। বিষয় সম্পত্তি সুখ সব এক পাল্লায় জড়ো করলে তারপরও তোমার পাল্লাডা অইব ভারী 1
মদিনা
আল্লার কাছে আমার একটাই প্রার্থনা, তোমার কোলে মাথা থুইয়া আমি যেন মরবার পারি ।
দুলাল
কে কার আগে মরব এইডাই অইতেছে কথা। মদিনা, হাছাই আমরা একদিন মইরা যামু, তাই না?
মদিনা
সুখের উল্টা পিঠে দুঃখ, আর ভালবাসার উল্টা পিঠে বিচ্ছেদ। )
দুলাল (গান)
হলদিয়া পাখি সোনারই বরণ পাখিটি ছাড়িল কে
মদিনা
একটা কথা কই । তুমি হঠাৎ এই গান করলা কেন?
দুলাল
জানিনা মদিনা সুন্দরী। কোথায় যেন একটা অমঙ্গলের ছায়া দেখতে পাই। সর্বক্ষণ আমার সাথে সাথে ঘোরে। হাতটা বাড়াইয়া কি যেন আমার কাছে চায়।
মদিনা
কি সব অলুইক্ষনা কথা কইল্যা আমার সাথে। বুজছি মনডা আইজ তোমার তাল নাই। আইস আমার সাথে, আমি তোমার মনডা ভাল কইরা দেই।
গান
তারপরেতে কি অইল শুনেন সমাচার,
বারো ভূঁই তালাশে আলাল হদিস পাইল তার।
গিরস্তের বাড়িতে আলাল দুলালে দেখিল,
সামনা সামনি পাইয়া তারা পরিচয় অইল।
দুলাল
আপনি কে, কারে চান?
আলাল
আমি একজনের লগে দেখা করতে আইছি। \
দুলাল
কার লগে দেখা করতে চান আপনি?
আলাল
আচ্ছা, এইডা কি হরিধর ব্যাপারী নামের এক চাষীর বাড়ি?
দুলাল
জে. এইডা ত্যানারই বাড়ি ।
আলাল
আমি ত্যানার লগে একটু সাক্ষাৎ করতে চাই ।
দুলাল
তিনি তো বহু আগেই ইন্তেকাল কইরাছেন ।
আলাল
ও…। আচ্ছা আপনি কি আমায় একটা সংবাদ দিতে পারেন?

দুলাল
কি সংবাদ?
আলাল
এই বাড়িতে একটা ছোট ছেলে কাম করত। সে আজ বহু বহু বছর আগের কথা। তার নামটা ছিল দুলাল। তার কোন সন্ধান আমায় দিতে পারেন আপনি?
দুলাল
কি নাম কইলেন, আবার কন তো?
আলাল
তার নাম দুলাল ।
দুলাল
দুলাল? দুলাল তো আমার নাম। আপনার নাম কি?
আলাল
ভাই রে আমায় চিনতে পারছ না? আমার নাম আলাল, আমি তোমার বড় ভাই ।
দুলাল
রাখুন, রাখুন। অত সহজে খাতির জমাইতে আইসেন না। বিষয় বিত্তান্ত আগে খোলাসা করেন । আলালের পরিচয় দিয়া কোন মতলবে এখানে আইচুন, কইচুন দেখি?
আলাল
ভাইরে কোন মতলবে আমি আসি নাই, আমি তোমারে নিবার আইছি।
দুলাল
নিবার আইছন? কোথায় নিবার আইছন? আপনার বাড়ি কই?
আলাল
সব ভুইলা গেছ ভাই? আমার বাড়ি বাইন্যাচঙ্গ শহর। আমাদের দুইজনের বাপের নাম দেওয়ান সোনাফর। আইস ভাই আমার বুকে আইস, আমার বুকে আইস। তোমারে বুকে নিয়া এই কলিজাডা ঠাণ্ডা করি । আপনে আলাল?
দুলাল
কিন্তু আলাল তো সেই কবে হারাইয়া গেছে।
আলাল
হাৱাই নাই রে ভাই, পালাইয়া গিয়েছিলাম। কি বিশ্বাস হয় না? আরো পিরমান চাও? তোমার মনে পড়ে দুলাল, আমার গলার এইখানে একটা কাটা দাগ আছিল। আর তোমার পিঠে আছে জরুল। কি বিশ্বাস হয় ভাই? এইবার বিশ্বাস হয়? (আলাল দুলাল একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে)
দুলাল
তারপর কও ভাই, তোমার খবর কও।
আলাল
আমার খবর তো মেলা কিচ্ছা। খালি এইটুকু শুইন্যা রাখ যে, সৎ মা ষড়যন্ত্র কইরা আমাগোরে বাইন্যাচঙ্গ শহর থেকে মাইরা ফেলতে পাঠাইছিল। সেই বাইন্যাচঙ্গ শহরের দেওয়ান এখন আমরা দুই ভাই। দুলাল, আমার পরানের ভাই, দেওয়ানগিরি করবাম দুইজন চল বাড়ি যাই। তা ছাড়া সেকেন্দার দেওয়ানের দুই পরমা সুন্দরী কইন্যা মমেনা এবং আমেনার সাথে বিয়ার সম্বন্ধ ঠিক অইছে । চলো ভাই আর দেরী কইর না। বেল থাকতে বাড়ির পন্থে রওয়ানা দিয়া দেই ।
দুলাল
কিন্তু ভাই আমি যে গিরস্তের কন্যারে করিয়াছি বিয়া। কইন্যার ঘরেতে আছে দুধের ছাওয়াল নাম রাইখ্যাছি তার সুরুজ জামাল (আলাল হতবাক হয়ে যায়)
দুলাল
মদিনা সুন্দরী, আরে ও মদিনা সুন্দরী দেখ কে আইছে। (মদিনা ঢোকে) এই অইছে আমার হারায়ে যাওয়া ভাই আলাল। ছালাম করো তাড়াতাড়ি ছালাম, করো। (মদিনা সালাম করতে যায়। কিন্তু আলাল পিছিয়ে যায়।)

আলাল
আপনি একটু ভিতরে যান। দুলালের সঙ্গে আমার কিছু কতা আছে। (মদিনা যায় না, দাঁড়িয়ে থাকে।) বিয়া করছ। একে তো গিরস্তের কইন্যা তার ওপর আবার কালাও নাকি? (মদিনাকে) আপনি আমার কথা শুনেন নাই? আমি আপনারে কই আপনি বাড়ির ভিতরে যান। দুলালের সঙ্গে আমার কথা আছে। (মদিনা ভিতরে চলে যায়)। দুলাল তোমার শরীলে কিসের রক্ত? আমার শরীলে কিসের রক্ত? রাজপরিবারের রক্ত।
জলের সঙ্গে যেমন তেলের মিল হয় না, তেমনি রাজার সঙ্গে। প্রজার পার্থক্য দূর করা যায় না। আমরা রাজা, তুমি কেমনে পারলা এক চাষা গিরস্তর মাইয়ারে বিয়া করতে? যখন বিয়া করতেছিলা, তখন কি তোমার একবারও মনে হয় নাই তুমি সোনাফর দেওয়ানের ছাওয়াল। যাক, যা করার করছ। এখন তুমি আমার সঙ্গে চল। দুই রাজকন্যার সঙ্গে আমাগো বিয়ার ব্যবস্থা ঠিক অইয়াছে। দুই ভাই মিইল্যা চল আবার রাজত্ব শুরু করি।
দুলাল
কিন্তু ভাই, জানি রাজরক্ত আমাগো শরীলে তারপরেও কেমনে ছাড়িয়া যাইব মদিনা সুন্দরীরে । মদিনা আমার পরানের স্ত্রী। তাহারে ছাড়িয়া কেমনে যাইবাম আমি অধর্ম করি।
আলাল
শোন দুলাল মিয়া আবারো কই। রাজরক্ত আমরার শরীলে । আর যদি অধর্মের কথাই কও, তাহলে কই তোমারে ভাই, তালাকনামা লেইখ্যা গেলে অধর্ম কিছু নাই । জাতি নাই সে থাকে আর এখানে থাকিলে, কিসের সংসার কও জাতি না রহিলে?
গান
কথা শুইন্যা আরে দুলাল চিন্তা করিয়া,
মদিনার ভাইরে আমি ডাক দিয়া।
তার নিকট মিঞা সকল কহিল,
তালাকনামা একখানা লিখিয়া যে দিল।
মদিনার সাথে আর দেখা না করিয়া,
আলালের সঙ্গ নিয়া গেল যে চলিয়া।
অবসিত অইয়া দুই ভাই পন্থেতে চলিল,
বাইন্যাচঙ্গ শহরে তারা দাখিল অইল।
মদিনা (গান)
বন্ধু রঙ্গিলা রঙ্গিলা রঙ্গিলারে,
আমারে ছাড়িয়া তুমি কই চলিলা রে-
কথক
তালাকনামা পাইয়া মদিনার দুঃখ হয়। কিন্তু বিশ্বাস হয় না। তালাকনামা যখন পাইল মদিনা সুন্দরী, হাসিয়া উড়াল কথা বিশ্বাস না করি। আমার পাষণ না ছাড়িব পরান থাকিতে, চালাকি করিলে মোরে পরখ করিতে । দুলালে তালাক দিব নাই সে লয় মনে, মদিনারে ভালবাসে যে বা জান-পরানে। তারে ছাড়িয়া দুলাল রইতে না পারিব, কয়েকদিন পরে খসম নিশ্চয় আসিব।
তো সুধীজনেরা এদিকে আলাল দুলালের কি অবস্থা? দুই ভাই সহি সালামতে বাইন্যাচঙ্গ শহরে গিয়া পৌঁছাইল। সেকেন্দর দেওয়ান পরে এই কথা শুনিয়া, বাইন্যাচঙ্গ শহরে আইল সাদির দিন দেখিয়া আলাল দুলালেরে সাজায় নানান আবরণে, মিছিল কইরা চলে আরে যত লোকজনে। হাত্তি চলে, ঘোড়া চলে, চলে উড আর তীরন্দাজ, বরকন্দাজ লাঠ্যা চলে পাছে তার। মোমেনারে আলাল, আর দুলাল আমিনারে, শরামতে বিয়া কইরা আইল নিজ ঘরে। দেওয়ানগিরি কইরা তারা সুখে দিন যায়, দিন ফিরিয়াছে আল্লা কইরাছে উপায়। (উচ্চগ্রামে মিউজিক বাজছে, মঞ্চে আমিনা এবং দুলাল মিয়া।)
আমিনা
আপনি আমার খসম। আপনার পায়ের নিচে আমার বেহেশত। দুই হাত তুইল্যা আল্লার কাছে আরজ করি শেষ নিশ্বাস থাকা পর্যন্ত আপনারে যেন সুখি করতে পারি।
দুলাল
আমিনা এই জীবনে যত দুঃখ ছিল তোমার একটা স্পর্শে সবকিছু মাটি অইয়া গেল । আমারও একই আরজ আল্লার কাছে, চির জীবন যেন পারি তোমারে সুখি করিতে । তুমি ভিন্ন পিয়া আমার আর কেহ নাই, চিরদিন তোমার অন্তরে পাই যেন ঠাঁই।
আমিনা
পরানের ধন পতি বলি যে তোমারে, বিশ্বাস রাইখ্য তুমি আমার উপরে। যে মতে চাও তুমি মোরে সেই মতেই পাইবা, কথা দাও কোন দিন এই মোরে দুঃখ না দিবা।
দুলাল
তোমারে দুঃখ দিবার আগে যেন মরণ হয় মোর, বিশ্বাস রাইখ্য কইন্যা আমার ওপর। সাত পাকে বাঁধা আছে আমরা দুইজন, থাকিব এক সাথে চখাচখির মতন। বড় ভালবাসি পিয়া বড় যত্ন করি, আইজ থেকে দুইজনে অইলাম প্রেমর কইতুরী।
কথক
এইখানে তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল। আমিনার প্রেমে প্রথম বরিষর উজান ভাঙ্গা কৈ-এর মত অবস্থা দুলালের। একই প্রেমতো তার মদিনা সুন্দরীর সঙ্গেও আছিল। সুধীজনেরা, কেমন আছে মদিনা সুন্দরী? আইজ আইসে কাল আইসে এই না ভাবিয়া মদিনা সুন্দরী দিল কত রাইত পোয়াইয়া।
আজ বানায় তালের পিডা, কাইল বানাই খই, ছিকাতে তুলিয়া রাখে গামছা বান্ধা নই। সাইল ধানের চিড়া কত যতনও করিয়া, হাড়িতে ভরিয়া রাখে ছিকাতে তুলিয়া। এই মতন খাদ্য কত মদিনা বানায়, হায়রে পরানের খসম ফিরা নাই চায়। ভালা ভালা মাছ আর মরণের ছালুন, আইজ আইব বইল্যা রাখেন খসমের কারণ। তেউত না পরানের খসম দেশেতে ফিরিল, কোন দোষে প্রাণনাথ আমারে ভুলিল।
মদিনা (গান)
আমার সোনার ময়না পাখি কোন দোষেতে গেলা উইড়া
দিয়া মোরে ফাঁকি।
দেহ দিছি প্রাণওৱে দিছি আর নাই কিছু বাকি
শত ফুলের মাজন দিয়ারে অঙ্গে দিছি মাখিরে ।
যাইবা যদি নিঠুর পাখি ভাসাইয়া মোর আঁখি
এ জীবনও যাইবার কালেরে ও পাখিরে
একবার যেন দেখিরে।
কথক
মদিনার আহাজারিতে আল্লার আরশ কাঁইপ্যা উঠে। কিন্তু বিচুলিত হয় না দুলালের পরান। মদিনা বিশ্বাস করে না দুলাল তারে ভুইলা থাকবার পারে। আবার দেখা অইবে, আবার জাইগা উঠবে ভালবাসার প্রবল স্রোত। অবশেষে মদিনা সুন্দরী সিদ্ধান্তে আইসে—
মদিনা
শিশু পুত্র সুরুজ জামাল বাপের পরানি, তারে পাইবাম যথাই করায়ে দেওয়ানি । সুখে থাউক সুখে থাউক, মোরে না ভুলিব, সমায় পাইলে মোরে নিরচয় কাছে নিব। ভাই, ভাই ও ভাই, কাছে আস ভাই। তোমার কাছে মোর কিছুই গোপন নাই। যাও তুমি পরানের পুত্র সুরুজের লইয়া খসমের খবর এক আনিয় জানিয়া। আমার সকল কথা তাহারে বলিবা, তার মনের কথা যত সকল শুনিবা।
গান
এই না বলিয়া বিবি পাঠাইয়া তাহারে,
যাইতে যাইতে গেল তারা বাইন্যাচঙ্গের সরে।
বাইন্যাচঙ্গের সরে পরে দুলালের সাথে,
দেখা না অইল তারার বারবাঙ্গলার পথে।
দুলাল দেখিয়া পরে তারারে চিনিল,
কানে কানে এই কথা তারারে বলিল ।
সুরুজ
বাপজান আমারে চিনতে পারলে না? আমি সুরুজ জামাল। অমনভাবে চাইয়া দেহেন কি? বাজান আমি সুরুজ জামাল।
দুলাল
চুপ, চুপ, আর একবারও আমারে বাপ বইলা ডাকবি না। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যায়। কি ভুল কইরাছি বিয়া কইরা গিরস্তের কইন্যা, নাই থাক এইখান চইলে যাও ফিরিয়া। অসম্মানী হইবাম আমি তোমরারে লইয়া। ক্ষেত খোলা আছে তোমরার সেই সকল কর, আর না আসিও ফিইরা বাইন্যাচঙ্গের শহরো। সেইখানে থাকলে তোমরার সুখে যাইব দিন, এইখান আইস্যা আমারে না করিও হীন। জলদি চলিয়া যাও মোর পানে চাইয়া, শরম পাইবাম লোকে ফালাইলে জানিয়া।
গান
দুলালের মুখে এই কথা না শুনিয়া,
দুঃখিত অইয়া তারা গেল যে চলিয়া ।
তারপর দুইজনে পন্থে মেলা নিল,
কান্দিতে কান্দিতে সুরুজ বাড়িতে ফিরিল ।
মদিনা
হায়রে আল্লা একি লিখছিলা আমার কপালে। বনের পংখি অইয়া যেমন উইড়া গেলে চইলে। পরানের পংখি আমার পরান লইয়া গেলা, পাষাণে বান্ধিয়া দিল রইল্যা একেলা । একদিনও তো না দেইখ্যা থাকিতে পারিত, কোন পরানে করলা ইতে বিপরীত । লক্ষী মা আগন মাসে বাওয়ার দাওয়া মারি, খসম মোর আনে ধান আমি ধান লারি।
দুই জনে বইস্যা পরে ধান দেই উনা, টাহল ভরা ধান খাই করি বেচা কিনা। হায়রে পরানের খসম এমনও করিয়া, কোন পরানে রইলা আমাকে ছাড়িয়া। হায়রে পরানের বন্ধু রইলা কোন দেশে, আভাগী কান্দিয়া মরে তোমারও উদ্দেশে। হায়রে দারুণ আল্লা যদি এই আছিল মনে, কেনে বা নিদয় অইলে দেখাইয়া সপনে। সেই না সুখের কথা যখন হয় মনে, আমার চোখে বয় পানি অভ্ররও নয়নে।
কথক
সুধীজনেরা, হাজার হোক মানুষের মন তো। কি অবস্থা এখন দুলালের? বিদায় দিয়া পরানের পুত্রে চিন্তে দুলাল, কলিজার লৌ আমার সুরুজ জামাল। নিদয় অইয়া তারে কেমনে দেই ছাড়ি, কেমনে ছাড়িবাম আমি মদিনা সুন্দরী? কি কইব মদিনা সুন্দরী শুনিয়া মোর কথা, দুঃখ যে পাইল তার দিলে কত ব্যথা।
যে নাকি পরান দিয়া কিইন্যা ছিল মোরে ফাঁকি দিয়া কোন পরানে আইলাম ছাইড়ে তারে। দুঃখের দুসর বিবি আমার যে জান, তারে ছাইড়াছি আমার কেমন পরান। সেইনা মদিনার মনে দিলাম বড় দাগা, মরিলে দুযখে হায়রে অইম আমার জাগা । এই না ভাবিয়া দুলাল কোন কাম করে, না জানায় আলাল ভাইরে না জানায় স্ত্রীরে। ঘর তনে বাইরি অইয়া পন্থে দিল মেলা, লোক লসকর নাই সে চলিল একেলা ।
আরও দেখুনঃ